গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
১৫.
মারুফ সাহেব বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরলেন।তিনি ব্যবসায়ীক কাজে প্রায়ই শহরের বাইরে থাকেন।আজ অবশ্য তিনি পুরোটা সময় অফিসেই ছিলেন।মিটিং ছিলো দুইটা।বাড়ি আসার পরেই তার প্রথম সাক্ষাৎ হলো তার মেঝ পুত্রের সাথে।
শোহরাব লিভিং রুমের বড়ো ঝাড়বাতির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল।তার দু’হাত বুকে ভাঁজ করা।চোখে তখন দাবানলের আগুন জ্বলছিলো।একটা দীর্ঘসময় সে বাবার বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করেছে।ভালোবাসা থেকে অপেক্ষা করে নি।তীব্র ঘৃণা নিয়ে অপেক্ষা করেছে।মারুফ সাহেব ঘরে পা রেখেই তাকে দেখলেন।তারপর সম্পূর্ণ রূপে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন।
শোহরাব মুখ শক্ত করে ডাকলো,’বাবা! দাঁড়াও।কথা আছে আমার।’
মারুফ সাহেব থামলেন।কঠিন মুখে বললেন,’মাত্র বাড়ি এসেছি।ফ্রেশ হতে দাও।’
‘না।অতো সময় আমার নেই।এখনই শুনবে তুমি।’
মারুফ সাহেবের কপালের রেখা স্পষ্ট হলো।যেই তেজ শোহরাবের কন্ঠে ছিলো,সেই একই তেজ তিনি নিজের কন্ঠেও অনুভব করলেন।রাগত স্বরে বললেন,’তোমার ঐ থার্ড ক্লাস বউ কে নিয়ে কোনো কথা শুনতে ইচ্ছুক নই আমি।’
‘শুনতে হবে বাবা।ইচ্ছুক নই বললেই ল্যাটা চুকে যাবে না।তোমাকে শুনতে হবে।’
মারুফ দাঁড়ালেন।বিরক্তির পারদ তখন আকাশ ছুঁয়েছে।শোহরাব পরোয়া করলো না।দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’তুমি রূপসাদের বাড়ি গিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘গিয়ে কি করেছো?’
‘কথা বলেছি।রূপসার বাবার সাথে।’
‘কথা বলেছো নাকি অপমান করেছো?’
মারুফ সাহেব একবার বড়ো করে শ্বাস ছাড়লেন।দায়সারা হয়ে বললেন,’ভালো কথাই বলেছি।সত্য কথা বলেছি।এখন সত্য কথা যদি অপমান হয় তাহলে তো কিছু করার নেই আমার।’
শোহরাব বাবার মুখের দিকে তাকালো।কতোটা নির্বিকার দেখাচ্ছে তাকে।অথচ তিনি অনায়াসে একটা জঘন্য কাজ করে এসেছেন।সে অনেক কষ্টে ক্রোধ নিয়ন্ত্রন করলো।দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ মুখ খিঁচে বলল,’তোমার কারণে রূপসার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেছেন।হি ইজ ডেড নাও।’
মারুফ সাহেব হয়তো ক্ষণিকের জন্য কিছুটা থমকালেন।তারপরই বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,’সো সেড।আমি তো এমন কিছু চাইনি।আমি কেবল তাকে কিছু তিতা সত্য বলেছি।সে যদি সত্য কথা নিতে না পারে,আমার কিছু করার নেই।’
‘সত্য কথা?মানুষ কে অপমান করে সত্যের গান গাইছো?’
মারুফ সাহেব হাসলেন।আচমকাই চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিঁষে বললেন,’জিনিয়ার বাবার কাছেও তোমার কারণে আমাকে অপমানিত হতে হয়েছিল।আমিও তো অপমান সহ্য করেছি শোহরাব।তাই বলে কি আমি মরে গেছি?তোমার শ্বশুড় মরলে কি সেটা আমার দোষ?’
শোহরাব কেন জানি কোনো উত্তর দিতে পারলো না।অতিরিক্ত রাগে মুখ দিয়ে কোনো শব্দই আসছিলো না।কেবল ঘৃণা হচ্ছিল।বাবার প্রতি সম্মান আর অনুভুতির শেষ বিন্দটুকুও গায়েব হয়ে গেল।বাবা এতো নির্বিকার?এতো স্বাভাবিক?সে কাঁপা স্বরে বলল,’একটা মানুষ মা’রা গেছে।হাউ ক্যান ইউ বি সো নরমাল?’
‘আমি নিশ্চয়ই তাকে গলা চে’পে মারি নি?তাহলে এদিকে আমার কি করার আছে?’
শোহরাব আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।যেখানে শব্দ বললে কেবল মুখেরই কষ্ট হয়,কাজের কাজ কিছু হয় না।সেখানে চুপ থাকাই শ্রেয়।সে তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি।বড়ো বড়ো দু’টো শ্বাস ছেড়ে সে পুনরায় রূপসাদের বাড়ি গিয়েছিলো।
.
.
.
.
রাজিব সাহেবের জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বাদ আসর।তার মৃ’তদেহ ফেলে রাখা হয়েছে বাড়ির সামনের উঠোনে,একটা খাটিয়ার উপর।রূপসা হাত পা ছেড়ে পাথর হয়ে সদর দরজায় বসেছিল।জেসমিন ছিলো তার পাশে।একটু পর পর তার মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো।
রূপসার স্থির,টলমলে নয়ন তখন উঠোনের সেই খাটিয়ার দিকে।গলার কাছটায় কাঁটা এসে বিঁধেছিলো।রূপসা শ্বাস নিতে পারছিলো না ঠিকঠাক।বাবা মৃ’ত্যুর আগে জানলো না যে রূপসা পালিয়ে যায়নি।কিছুতেই জানতে পারলো না যে এই বিয়ে রূপসার স্বেচ্ছায় হয়নি।অথচ বাবা জানলো,রূপসা নিজের বিয়ে ভেঙে আরেক ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে।এর চেয়ে জঘন্য আর কোনো অপবাদ হতে পারে?
জেসমিন একবার তার ফ্যাকাশে মুখখানা দেখলেন।কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।জেসমিনের খুব মায়া হলো সবটা জানার পর।রূপসা তার বাবার অত্যন্ত স্নেহের।অথচ মৃ’ত্যুর সময় তিনি মেয়ের প্রতি এক বুক অভিযোগ পোষণ করে গেলেন।
রূপসা আস্তে করে চৌকাঠে পিঠ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’মৃত মানুষ কি সব কথা শুনতে পারে মনি?আমি যদি বাবার কানের কাছে গিয়ে বলি আমি পালিয়ে যায়নি।বাবা কি তবে শুনবে?’
জেসমিন উত্তর দিলেন না।আগের মতো করেই একটা হাত রূপসার মাথায় রেখে তার চুল গুলো গুছিয়ে দিলেন।রূপসা কেবল তপ্তশ্বাস ছাড়লো।
রূপম বসেছিলো অনেকটা দূরে।রূপসা তার দিকে চোখ নিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,’কাছে আয় ছোট।এদিকে এসে বোস।’
রূপম বসলো তার পাশে।মাথা নুয়িয়ে বলল,’তুমি কিছু খাবে না দিদিয়া?সেই তখন থেকে না খেয়ে আছো।’
‘নাহ্।খিদে নেই আমার।’
রাজিব সাহেবের শেষ বিদায়ের সময় এসে গেছে।নিজের সাদামাটা বাড়ির চৌকাঠ ছেড়ে অদূর গন্তব্যে পাড়ি জমাতে হবে।লোকজন এসে তার খাটিয়া কাঁধে তুলে নিলো।সাথে যোগ দিলো রূপমও।বাবার সাথে তার তিক্ত সম্পর্কের অবসান ঘটেনি।পাঁচ বছরের মনমালিন্যের সমাপ্তি হয়েছে রাজিব সাহেবের নিঃশ্বাস বন্ধের মাধ্যমে।এখন আর দু’জনের কথা কাটাকাটি হবে না।রূপম আর বিরক্ত চোখে কারো দিকে তাকাবে না।
___
শোহরাবের আসতে একটু দেরি হলো।আসরের সময় হয়ে গেছে।তাই আর রূপসাদের বাড়ি যাওয়া হয়নি।সে বাড়ি গেলো জানাযার শেষে।
বাড়ি তখন সুনশান।আপন আত্মীয়রা স্বান্তনা দেওয়ার মতো ফরজ কাজটি শেষ করে যার যার বাড়ি চলে গেছে।বাড়িতে কেবল তিনটি প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো।রূপম জানাযা শেষে বাড়ি ফিরেই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসেছিলো।রূপসা আর দরজার কড়া নাড়েনি।নাড়তে ইচ্ছে হয়নি।
জেসমিন তখনও জায়নামাজে,নফল নামাজ পড়ছিলেন।সেখান থেকে একটু পর পর ডুকরে কান্না করার শব্দ ভেসে আসছিলো।সেই শব্দে রূপসার বুক ভারি হয়ে উঠছিলো বারবার।মনে হচ্ছিল ভেতরে কতো হাহাকার,কতো যন্ত্রনা! এতো যন্ত্রনা নিয়ে সে বাঁচবে কেমন করে?
শোহরাব তার ঘর চিনতো।সুতরাং খুঁজে পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না।ঘরে উঁকি দিতেই দেখলো,রূপসা দুই হাঁটু ভাঁজ করে খাটে বসে আছে।মাথা নামানো।
শোহরাব ভেতরে এলো।আনমনে গলা খাকারি দিলো।রূপসা মাথা তুলেও তাকে দেখলো না।উল্টা পিঠটা পেছনের দিকে ঠেস দিয়ে উপরে তাকালো।তার চোখ ঘোলা।শোহরাব সেই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না।কেমন একটা জঘন্য অপরাধ বোধ তার দমবন্ধ করে দিচ্ছিলো।
সে গিয়ে রূপসার পাশটায় বসলো।খুবই খচখচ করছিলো ভেতরটা।তবুও একবার ঢোক গিলে ডাকলো,’রূপসা! শুনছো?’
রূপসা নিরুত্তর।সেই আগের মতোই।কোনো বিকার নেই।কোনো চাঞ্চল্য নেই।কিচ্ছু নেই।দৃষ্টি স্থির।তবে সে কিছুই দেখছে না।আশ্চর্য বিষয়,শোহরাব কাছে এলো।অথচ সে কিছু বললো না।কোনো প্রতিবাদ করলো না।
শোহরাব আবার ডাকলো।
‘মিস! শুনছো?’
—
‘রূপসা?’
—
‘আই অ্যাম সরি রূপসা।আমি জানতাম না এমন কিছু হতে পারে।জানলে কখনো এই কাজ করতাম না।’
—
‘রূপসা?’
মেয়েটা পাথর হয়ে বসেছিল।শুধু পার্থক্য একটাই ছিলো।সে পলক ফেলছিলো।পাথর তো পলক ফেলে না।তার চোখ ভেজা ছিলো।কতো কতো যন্ত্রনা লুকানো ছিলো সেই চোখে!
শোহরাব আলতো করে তার হাত স্পর্শ করলো।খুব ভয়ে ভয়ে।রূপসার যন্ত্রনা বাড়ানো তার উদ্দেশ্য না।সে শুধু তার সাথে কথা বলতে চায়।
এই প্রথম তার স্পর্শে রূপসা তেঁতেঁ উঠল না।ছ্যাৎ করে তার হাত সরিয়ে দিলো না।কটমটে রাগী এক জোড়া চোখ আজ আর শোহরাবকে ভস্ম করলো না।রূপসা বসেছিল আগের মতো করেই।অযাচিত স্পর্শ আর তার চিত্ত ব্যাকুল করলো না।শোহরাব কেবল তার শ্বাস টানার শব্দ পেলো।
‘রূপসা! তুমি প্লিজ কিছু বলো।আমি সরি।জানি এই সরির কোনো মূল্য নেই।তবুও।প্লিজ।আমাকে বকো।আমাকে কথা শোনাও।বাট এট লিস্ট কিছু তো বলো।ভুল হয়েছে আমার।প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।কি করতে হবে বলো?’
রূপসার উত্তর পাওয়া গেলো না।শোহরাব দু’জনার দূরত্ব আরো কিছুটা কমালো।রূপসার ঘাড়ের কাছে পর পর দু’টো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,’তুমি কি চাও রূপসা?তুমি যা চাও,আমি তোমায় তা ই দিবো।’
রূপসার নড়বড়ে শরীরটা টলমল করে উঠলো।কিছুক্ষণ দুলতে দুলতে শেষে সমস্ত ভর ছেড়ে তোষকের উপর গিয়ে পড়লো।শোহরাবের হাতে থাকা তার হাতটা আচমকাই খসে পড়লো নিচে।
শোহরাব বোকা বোকা চোখে তার দিকে তাকালো।তার কৌতূহলী চোখ,প্রশ্নাত্মক চাহনি।রূপসার রক্তশূণ্য মুখটা দেখামাত্র আরো একবার একটা ঢোক তার কন্ঠনালি বেয়ে নেমে এলো।
বসন্তের শুরু হয়েছে মাত্র।ঝরা পাতার মর মর শব্দে প্রকৃতি তখন সতেজতার খোঁজে ব্যস্ত।সুবাস মিত্র লেনের সেই দোতালা বাড়িতে তখন শোকের মাতম।অদ্ভুত স্তব্ধতায় বাড়ির প্রতিটা ঘর শোকাচ্ছন্ন।রূপসা পলক ফেলল,শ্বাস টানলো।কন্ঠে বোধহয় বলার মতো জোর ফিরে পেল।
সেই নিস্তেজ,নিষ্প্রাণ মানবী আচমকাই কাঁপা স্বরে বিড়বিড় করলো,’আপনি কি আমায় মুক্তি দিবেন শোহরাব?আপাতত এইটুকুই চাইছি।’
চলবে-