জুলিয়েট পর্ব-১৭

0
120

গল্প #জুলিয়েট
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

১৭.

ফিনাইলের কটু গন্ধ।আর সেই সাথে স্ট্রেচারের কানে ধরা ঘচঘচ শব্দ।দু’টোই শরীরের ভেতর বিরক্তির উদ্রেক করছিলো।চারদিকে মানুষের কোলাহল,চিৎকার চেঁচামেচি,নার্স এবং ডাক্তারদের কেবিনে কেবিনে ছুটে যাওয়া।সব মিলিয়ে খুবই অসুন্দর একটি দৃশ্য।হাসপাতালে কয়জন মানুষ মনের আনন্দে আসে?

রূপসার হাসপাতাল যেতে যেতে রাত হলো।সেখান থেকে শোহরাবের কেবিন নম্বর বের করতে আরো একটু সময় খরচা হলো।শেষে যখন সে তার কেবিনের সামনে এসে পৌঁছুলো,তখন কেবিনের বাইরে উপস্থিত সবাই একবার মাথা তুলে তার দিকে তাকালো।

রূপসা ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করলো।সবার আড়চোখের চাহনিতে কেমন যে সংকুচিত হয়ে এলো।আড়ষ্ট হয়ে হাসপাতালের করিডোরের এক মাথায় দাঁড়িয়ে থাকলো।সবাই তাকে এক ঝলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিল।কেবল জোহরা এগিয়ে এলেন তার কাছে।

এসেই আলতো করে রূপসার একটা হাত চেপে ধরলেন।রূপসা চকিত হয়ে তার দিকে তাকালো।জোহরার ঠোঁট দু’টো তিরতির করে কাঁপছিলো।রূপসা তাকাতেই তিনি ভাঙা গলায় করুন সুরে বললেন,’রূপসা! শোহু আইসিইউ তে।আমার ছেলেটা ভালো নেই রূপসা।একদমই ভালো নেই।’

বলেই তিনি আরেক দফা কান্নায় ভেঙে পড়লেন।সেই কান্নার শব্দে রূপসার ভেতরের সবকিছু আন্দোলিত হলো।প্রত্যেকটা শব্দ,প্রত্যেকটা আহাজারি কোনো না কোনো ভাবে তার ভেতরে আরো একবার প্রতিধ্বনিত হলো।রূপসার নিজেকে সেদিন সত্যিই অপরাধী মনে হলো।

কিন্তু সে কি আদৌ কোনো অপরাধ করেছিল?সে তার দোষ খুঁজতে গিয়ে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে।কিন্তু একটা সূক্ষ্ম অপরাধবোধ তাকে ক্রমশ গুটিয়ে দিচ্ছিলো।তার মনে হচ্ছিল করিডোরভর্তি মানুষ তাকে অপরাধীর চোখে দেখছে।কিন্তু এতে তার দোষ কোথায়?সে কি ইচ্ছে করে তার এক্সিডেন্ট করিয়েছে?নাকি কোনোদিন তার অমঙ্গল চেয়েছে?

জোহরা তার হাত টেনে ধরে বললেন,’বসো না রূপসা।কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?’

রূপসা নড়লো না।আস্তে করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বুজে আসা স্বরে বলল,’না আন্টি।আমি ঠিক আছি,বসবো না।’

জোহরা আর জোরাজুরি করলেন না।তার চোখের সাদা অংশ তখন ঈষৎ লাল বর্ণ ধারণ করেছে।কাঁদতে কাঁদতে বোধহয় এমনটা হয়েছে।তিনি চলে গেলেন সামনে থেকে।রূপসা দাঁড়িয়ে থাকলো তার সেই চিরচেনা সঙ্গী একাকিত্ব কে সাথে নিয়ে।

বাবার মৃ’ত্যুর পর সে বরাবরই ঝামেলা এড়িয়ে যেতে চাইতো।শোহরাবকেও সে এরপর বাজে করে কিছু বলে নি।শুধু মুক্তি চেয়েছিল।জাগতিক সবকিছু থেকে অব্যাহতি চেয়েছিল।এর বেশি রূপসা কিছুই চায় নি।

সে এক্সিডেন্ট করলো।রূপসা দায়িত্ববোধ থেকে এক প্রকার ছুটে এলো তার কাছে।আচ্ছা,সে কাল রাতে তাকে এমন একটি মেসেজ কেন দিলো?কখনো কখনো মানুষ অল্পতেই কেমন মিইয়ে যায়।রূপসার সম্ভবত তেমন কিছুই হলো।ঘটনা টা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলল।

শোহরাবের অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হলো।সার্জন আনিসুল আকরাম জানালেন,হি ইজ আউট অব ডেঞ্জারাস।তার কাঁধে আঘাত লেগেছে।ইঞ্জুরিটাও সেখানেই হয়েছে মূলত।মাথায় তুলনামূলক তেমন আঘাত পায় নি।তবে হাতের হাড় ভেঙেছে দু’টো।

তিনি যখন বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলছিলেন,রূপসা তখন চুপচাপ করিডোরের এক কোণায় দাঁড়িয়েছিল।তার স্বস্তি হচ্ছিল এই ভেবে যে শোহরাব বেঁচে আছে।

পর পর আরো কিছুদিন সে হাসপাতালে এলো।শোহরাবের জ্ঞান ফিরেছিল চারদিন পর।সে ধীরে ধীরে কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করলো আরো দুইদিন পর।রূপসা বলতে গেলে রোজই হাসপাতালে এসেছে।কখনো রূপমের সাথে।কখনো একা।রূপম বোনের হাতটা ধরে করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকতো।দিদিয়ার দোলাচল সে বোঝে।কি বিচ্ছিরি মানসিক পীড়ার ভেতর দিয়ে দিদিয়া যাচ্ছিল,সেটাও সে জানে।
রূপমের শুধু তার জন্য কষ্ট হয়।এক বুক কষ্ট।দিদিয়ার স্বভাব-খুব অল্পতেই নিজেকে দোষী ভাবা।শোহরাবের এক্সিডেন্টে তার কোনো হাত নেই।এ কথা সে ভালো করেই জানে।তবুও সে অপরাধবোধে ভুগছিলো এই ভেবে যে তার বাড়ি আসতে গিয়ে শোহরাবের এই অবস্থা হয়েছে।রূপম তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকে।দিদিয়া আজকাল লো প্রেসারের রোগী হয়েছে।বলা নেই,কওয়া নেই,হুট করেই মাথা ঘুরে নিচে পড়ে যায়।

শোহরাব জ্ঞান ফেরার পর যখন কথাবার্তা বলতে সক্ষম হলো,তখন কথার ফাঁকে একবার রূপসার খোঁজ করল।মারুফ সাহেব মুখ শক্ত করে বললেন,’এই অবস্থায় কি তোমার তার সাথে দেখা করা খুব জরুরি?’

শোহরাব কাটকাট জবাব দিলো,’হুম।জরুরি।’

এরপর রূপসার সাথে তার সত্যি সত্যিই দেখা হয়েছিল।মারুফ সাহেব হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।জোহরা রূপসার হাত ধরে টেনে কেবিনে থাকা একটা চেয়ারে নিয়ে বসালেন।সেখান থেকে শোহরাবকে স্পষ্ট দেখা যায়।

রূপসা জড়তা আর অস্বস্তিতে খচখচ করছিলো।মনে হচ্ছিল গলায় কোনো কিছু আটকে আছে।না উগলে দিতে পারছে,আর না গিলে ফেলতে পারছে।দু’টো শ্বাস ফেলে সে মাথা টা আরো বেশি ফ্লোরের দিকে নামিয়ে আনলো।

জোহরা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।পুরো কেবিন ফাঁকা।একদম নিস্তব্ধ।নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিল রূপসা।শোহরাব অনেকটা সময় কোনো কথা বলে নি।দু’জনের মাঝে যে নিরবতা ছিলো,সেটা কিছুক্ষণের জন্য শোহরাবের ভালোই লাগলো।শেষে কেবিনের ভেতর বিরাজমান পিনপতন নীরবতা অবসানও সেই ঘটালো।

‘মিস!’

‘জ্বী।’

‘কেমন আছো?’

‘ভালো।’

‘আই অ্যাম সরি।’

রূপসা মাথা তুলে না।ক্লান্ত গলায় বলে,’সেটা আমার বলা উচিত।’

‘কেন?’

‘আমি জানি না।’

‘মিস!’

‘জ্বী।’

‘তুমি কি আমার সাথে রেগে আছো রূপসা?’

‘নাহ্।’

‘রূপসা!’

‘বলুন।’

‘আমার অকারণেই তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

রূপসা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’আমাদের ভেতর বলার মতো কিছুই নেই।বলতে গেলে দেখা যাবে শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘তাহলে শব্দ খুঁজতে খুঁজতেই কিছুক্ষণ কথা বলি চলো।’

রূপসা মাথা তুলল।একবার সরাসরি শোহরাবের দিকে তাকালো।তার কন্ঠ জমাট বাঁধা,উচ্চারণ অস্পষ্ট।

‘শোহরাব! আপনি রেস্ট করুন।’

‘রূপসা প্লিজ।আরো কিছুক্ষণ থাকো।’

রূপসা হাত দু’টো একসাথে করে বিনয়ী ভঙ্গিতে বলল,’জ্বী।আমি আছি।’

শোহরাব জবাবে মুচকি হাসলো।
‘সেই তো।তুমি আছো বলেই আমি আছি।’
.
.
.
.
রূপসা সেই ঘটনার পর আরো বেশ কয়েক বার হাসপাতালে গেল।কেন গেল,সে জানে না।বোধহয় নিজের ভেতরের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সে এই পথ বেছে নিয়েছিলো।নিজেকে দায়মুক্ত করার এর চেয়ে সহজ উপায় তো আর ছিলো না।

শোহরাব আজকাল বাচ্চাদের মতো আচরণ করে।কেবিনে গেলেই হাসিমুখে বলে,’এদিকে আসো রূপসা।কাছাকাছি এসে বসো।’

‘কাছাকাছি বসতে আসি নি।আপনার শরীর কেমন সেটা বলুন।’

‘উহু।কাছাকাছি না বসলে শরীর কেমন সেটা টের পাবে কেমন করে?’

রূপসা গিয়ে তার পাশে বসে।শোহরাব বলল,’কাল রাতে তোমায় স্বপ্নে দেখলাম।দেখলাম তুমি আমায় ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছো।’

‘ভালো।সুন্দর স্বপ্ন।’

‘তুমি কি স্বপ্ন টা পূরণ করবে না?’

‘নাহ্।’

‘প্লিজ মিস।প্লিজ।’

রূপসা চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকালো।সেই চাহনিতে রাগ,বিরক্তি,অনিহা সবকিছুই ছিলো।অথচ শোহরাব সেসব কিছুই দেখলো না।সে দেখলো প্রশ্রয়।রূপসা তার সমস্ত বায়নাকে প্রশ্রয় দেয়।

‘আমি সহানুভূতি দেখাচ্ছি।এর মানে এই না যে,যা মন চায় তাই করবেন।’

শোহরাব বলল,’তুমি আমায় একটিবারের জন্য খাইয়ে দেবে না রূপসা?’

রূপসা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ভ্যানিটি ব্যাগটা টুলের উপর রেখে নিস্তেজ গলায় জানতে চাইলো,’ওয়াশরুম কোথায়?হাত ধুয়ে আসি।’

শোহরাব খেতে খেতেই কয়েকবার তার দিকে তাকালো।তার মুখে রাজ্য জয়ের হাসি।রাজকন্যা হলো রূপসা।রাজকন্যার মন ভার।মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে রেখেছে।শোহরাব বলল,’আমার তিনটে আবদার আছে রূপসা,তোমার কাছে।’

‘আবার কি?’

‘আহা! রাগ হচ্ছো কেন?একটা তুমি অলরেডি পূরণ করে দিয়েছো।আর বাকি দু’টো।’

শোহরাবের আবদার গুলো ছিলো অনেকটা এমন-

*রূপসা একদিন তাকে মেখে ভাত খাইয়ে দিবে।

*প্রথমবার বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় যেই শাড়িটা রূপসা পরেছিল,সেটা আরো একবার পরে সে কেবিনে আসবে।

*একদিন পুরো রাত সে কেবল শোহরাবের সাথে কথা বলবে।সেদিন রূপসা মন খারাপ করতে পারবে না,মুখ ভার করে রাখতে পারবে না,অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারবে না।বরং সুন্দর করে মিষ্টি হেসে তাকে শোহরাবের সাথে কথপোকথন চালিয়ে যেতে হবে।একটা পুরো রাত তারা দু’জন শুধু কথা বলে পার করবে।

প্রথম আবদার রূপসা আগেই পূরণ করে ফেলেছে।বাদ রইল অন্য দু’টো আবদার।এর মধ্যে দ্বিতীয় আবদারটাও রূপসা চট করেই পূরণ করে দিলো।ইউনিভার্নিটির কালচারাল ফেস্টে ঐ শাড়িটা পরেছিল।ফেস্ট থেকে সোজা হাসপাতালে গেল।গিয়ে শোহরাব কে দেখেই বিরস মুখে এগিয়ে গেল।

‘এই যে,পরেছি।দেখেন।
হয়েছে দেখা?
এবার আমি যাই।’

‘উহু।মাত্র এলে।বসে একটু এসির বাতাস খেয়ে যাও।’

‘প্রয়োজন নেই এসির বাতাস।আপনি খান।’

‘রূপসা!’

‘কি?’

‘একটু বসো।’

রূপসা তেতো মুখে বসল।শোহরাব বলল,’কেমন আছো?’

‘ভালো।’

‘রূপম কেমন আছে?’

‘ভালো।’

‘ভার্সিটি লাইফ কেমন যায়?’

‘ভালো।’

‘আমাকে কেমন লাগে?’

‘ভালো।’

রূপসা হোঁচট খায়।মাথা তুলে চোখ বড় বড় করে বলে,’কি অদ্ভুত প্রশ্ন!’

___

রূপসা সবচেয়ে বেশি বেগ পেল শোহরাবের শেষ আবদার টুকু পূরণ করতে গিয়ে।একটা পুরো রাত তাকে শোহরাবের সাথে কথা বলতে হবে।বিরক্তি ছাড়া।অথচ দু’জনের মধ্যে বলার মতো এমন কি আছে?

রূপসা চাইলেই মুখের উপর তার সমস্ত চাওয়া প্রত্যাখ্যান করতে পারতো।অবশ্যই পারতো।সে এই সম্পর্ক টেকাতে বাধ্য না।কিন্তু রূপমের “আবেগে ভরপুর দিদিয়া” একজন অসুস্থ শয্যাশায়ী রোগীর প্রতি ওমন রূঢ় হতে পারে নি।হাসপাতালের বেডে শোয়া কারো সাথে কঠোরতা দেখানো তার স্বভাব বিরুদ্ধ।রূপম এজন্য তাকে নাম দিয়েছে “গরীবের মাদার তেরেসা”।

রূপসা সেদিন রাতে হালকা আকাশী রঙের একটা শাড়ি পরল।তারপর চুলটা কোনোরকমে বেঁধে শোহরাবের কেবিনে গেল।শোহরাব তাকে দেখেই সৌজন্যসূচক হাসলো।
বলল,’আমি জানতাম তুমি আসবে।আমি ভীষণ খুশি হয়েছি রূপসা।’

রূপসা শম্বুক গতিতে হেঁটে তার পাশে এসে বসলো।শোহরাব বলল,’আজ পূর্ণিমা।’

‘তাই?’

‘হুম।আকাশ দেখো নি?’

‘নাহ্।’

রূপসা নিজ থেকেই জানতে চাইলো,’আপনি কি করে আকাশ দেখলেন?’

‘আমি দেখিনি।সানজানা বলল।’

‘ওহহ্।’

শোহরাব ডাকলো,’রূপসা!’

বরাবরের মতোই শান্ত এবং নির্ভার কন্ঠ।যেন কোথাও কোনো তাড়া নেই।জীবন কি কোনো বহমান নদী?শোহরাব চাপা স্বরে পুনরায় ডাকে,’রূপসা!’

মেয়েটা অপ্রস্তুত হলো।সহজেই চোখ তুলল না।খুব সংকুচিত হয়ে বলল,’জ্বী।’

‘কয়েক ঘন্টার জন্য ভুলে যাও,যে আমি সেই ব্যক্তি,যে কিনা তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম।জাস্ট ব্রেইন থেকে আউট করে দাও।কয়েক ঘন্টার জন্য ভাবো,আমি তোমার বন্ধু।খুব ভালো বন্ধু।’

রূপসা বোধহয় এই প্রথম কিছুটা অশান্ত হলো।শোহরাব দেখল,তার চোখে পানি।সমুদ্রের নোনা জলের মতোই চিকচিক করছে।শোহরাব বলল’এবার বলো।কি হয়েছে তোমার?কেন তুমি এতো কষ্টে থাকো সারাদিন?’

রূপসার সত্যিই সেদিন ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো।সে একহাত দিয়ে অন্য হাত খাঁমচে ধরে ভাঙা স্বরে বলল,’আমার খুব কষ্ট হয়।’

‘কেন?’

‘জানি না।’

রূপসা অনেকটা সময় কথা বলল না।শেষে রয়ে সয়ে বলল,’বাবার সাথে আমার শেষ একবার দেখা হয়নি।আমাদের শেষ দেখা কোনটা,আমি আর মনে করতে পারছি না।বাবা মৃ’ত্যুর আগে জানলেন না যে আমি পালিয়ে যাইনি।আমার উপর বাবার যে অভিমান হয়েছিল,সেটা ভেঙে দেওয়ার সুযোগও আমি পাই নি।’

বলেই সে আরো দুই তিনবার শ্বাস টানলো।
‘চারপাশের মানুষ এতো বাজে নজরে তাকায়! সেই দৃষ্টি আমি নিতে পারি না।আমার খুব অসহায় লাগে।আমার ভীষণ কান্না পায়।জীবনটা আর কখনোই আগের মতো হবে না।কোনোদিনও না।’

শোহরাব নিশ্চল জড় পদার্থ হয়ে ঠায় বসে থাকে।একবার কেবল চোখ ঘুরিয়ে রূপসা কে দেখে।রূপসা বলল,’আমি একটু শান্তিতে বাঁচতে চাই।আর কিছু চাই না।আমার খুব খারাপ লাগে আজকাল।’

‘তোমার প্রিয় ঋতু কি রূপসা?’

হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে রূপসা ভড়কালো।তারপরেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’শরৎ।’

‘কেন?’

‘শরৎের আকাশ আমার খুব ভালো লাগে।’

‘গুড।এবার বলো,পাহাড় না সমুদ্র?’

‘সমুদ্র।’

‘কেন?’

‘কারণ,সমুদ্রের গর্জন আমার ভালো লাগে।কেমন যে শান্তি শান্তি লাগে।’

রূপসা চোখ তুলল।এই মুহূর্তে তাকে প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে।রূপসা বলল,’সকাল নাকি সন্ধ্যা?’

‘সন্ধ্যা।’

‘সেম।আমারও।সন্ধ্যা খুব ভালো লাগে আমার।’

‘চা নাকি কফি?’

‘অবশ্যই চা।’

শোহরাব হাসলো।
‘আমারও তাই।’

রূপসা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’চায়ের কোনো তুলনা নেই।মানুষ ভাব দেখিয়ে কফিকে চায়ের আগে রাখে।লাভ নেই।চা চা ই।’

‘সহমত।’

রূপসা কপাল কুঁচকে বলল,’গাড়ি নাকি বাইক?’

‘বাইক অবশ্যই।’

‘হাত পা ভেঙেও শিক্ষা হয়নি।তাই না?’

শোহরাব হেসে ফেলল।’তুমি কিন্তু সত্যিই এখন মিসদের মতো শাসন করছো।’

‘আমি এমনই।’

শোহরাব বলল,’এবার বলো,পূর্ণিমা না অমাবস্যা?’

রূপসা অবাক হলো।বলল,’অবশ্যই পূর্ণিমা।’

‘কেন?’

‘অদ্ভুত! আলো কার না ভালো লাগে?’

‘তাই তো।’

‘আপনার?’

‘আমি?আমি হলে অমাবস্যা বেছে নিতাম।’

‘কেন?’

রূপসাকে দেখালো খুব কৌতূহলী।যেন পূর্ণিমার ঊর্ধ্বে অমাবস্যাকে স্থান দেওয়া খুবই আশ্চর্যজনক একটি কাজ।শোহরাব আধশোয়া হয়ে নিরেট স্বরে বলল,’পূর্ণিমা শেষে চাঁদ একটু একটু করে এগিয়ে যায় অমাবস্যার দিক ।পূর্ণিমা হলো চাঁদের সবচেয়ে ঝলমলে রূপ।এরপর চাঁদের দ্যুতি কেবল কমতেই থাকে।নতুন করে বাড়ে না।আর শেষে গিয়ে তা হয় অমাবস্যা।

কিন্তু অমাবস্যার কথা ভাবো।নিকষ কালো,ঘুটঘুটে অন্ধকার রজনী।কিন্তু সেই ভয়ংকর অন্ধকারের মাঝেও একটুখানি প্রত্যাশার আলো আছে।আছে একটা নতুন জোৎসনা পাওয়ার প্রত্যাশা।অমাবস্যার শেষে প্রতিদিন চাঁদ একটু একটু করে জ্যোতি ছড়ায়।একসময় ধরণীতে নামে পূর্ণিমা।একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি থেকে ধীরে ধীরে একটা ভরা জোৎসনার দিকে পদযাত্রা।কি চমৎকার না বলো?’

রূপসা অভিভূত হলো।বিস্মিত হয়ে বলল, পদযাত্রা চমৎকার নাকি জানি না।তবে কথকের চিন্তা আর বর্ণনা চমৎকার।ভেরি ইমপ্রেসিভ।’

শোহরাব হাসলো।বলল,’তাহলে কথকের আরো একটা কথা শুনো।’

‘কি?’

‘মাঝে মাঝে অমাবস্যায় থাকা ভালো।পূর্ণিমার অপেক্ষায় দিন পার করা যায়।পূর্ণিমায় থেকে গেলে কি হতো জানো?ভীষণ যন্ত্রনায় পড়তে।সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো,এই বুঝি কৃষ্ণপক্ষ এসে গেল।’

রূপসা কিঞ্চিৎ হাসল।কিছুটা সহজ হয়ে শোহরাবের দিকে তাকালো।সেই সোজা সরল হাসি খুশী মুখটা শোহরাবকে শান্তি দিলো।বুকের ধড়ফড় কমিয়ে আনার মতো শান্তি।

সেই রাতে তারা খুব কথা বলল।শোহরাব বেশি বলে নি।রূপসাই বলেছে।কখনো নিজের গল্প,কখনো নিজের মায়ের গল্প।কখনো আবার জীবনের গল্প।বলতে গিয়ে সে কাঁদলো,ফাঁকে ফাঁকে আবার হাসলো।শোহরাব শুধু মনোযোগী শ্রোতা হয়ে তার সবটা শুনল।আকাশের চাঁদ জ্বল জ্বল করে ধরণী বুকে আলো ছড়াচ্ছিল।

শোহরাব পূর্ণিমার আলোয় খুব একটা খুশি হলো না।উল্টো মনে হলো,প্রলয়ংকারী অমাবস্যার আগমনের পূর্বে এই পূর্ণিমার কোনো অর্থই নেই।

শোহরাব আচমকাই কেমন ব্যাকুল হয়ে অনুরোধ করলো,
‘মিস! তুমি কি প্লিজ কিছুদিন আমার সাথে থাকবে?জাস্ট কয়েকটা মাস।এরপর আর কোনোদিন তোমায় জ্বালাবো না।কখনো না।আমার তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে।একটু কথা বলবে?’

চলবে-