#প্রথম_পর্ব
#ছাদ
#অনিন্দিতা_মুখার্জী_সাহা
” হ্যালো বাবা শুনছো? শুনতে পারছো? হ্যালো ” – ফোনটা নিয়ে একবার বাইরে একবার ভেতরে – এই করে যাচ্ছে জয়া। ধুর এমন একটা জায়গা টাওয়ারই পাওয়া যায় না!” – জয়ার বলা কথা মাটিতে পড়ার আগে ধরে নিলো নিলয়।
নীলাজিৎ সিকদার। একটা বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মালিক। ঠিক কতটা বড়ো যদি বলতে হয় তাহলে বলে রাখা ভালো যে কলকাতার বুকেই দুটো ব্রাঞ্চ। এছাড়া বিভিন্ন রাজ্যেও আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ।
” আরে থাকে তো ওই গ্রামের ভেতরে, টাওয়ার পাওয়া এতো সহজ! বৌয়ের বাবার সম্পর্কে খুব ভালো মানসিকতা কোনোদিনও নিলয়ের নেই। সবসময় কথা উঠলেই গ্রাম্য, অন্ধকার, শিক্ষার অভাব এগুলো বলতেই থাকে।
কি করবে জয়া! ছেড়ে দেবে বাবাকে! সম্ভব নাকি ! সেই ছোটো বেলায় মা চলে গেল চাষ বাস জমি এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকা প্রতাপ বাবু কেমন উদাসীন হয়ে গেলেন তারপরেই। সারাদিন নিজের খেয়ালে নিজের মতো। না ঠিকঠাক কাজ করতেন না খাওয়া দাওয়া। মেয়ের দেখাশোনা তো অনেক দূর! জয়ার বয়সও তখন মাত্র সাড়ে সাত। কি ভাগ্যিস ওর মাসি ওকে নিয়ে এসেছিলো কলকাতায়। সত্যি কিছু বুঝতো না তখন জয়া। সাড়ে সাত এমনই বয়স না নিজের মা বাবাকে ভুলে মাসিকে মেসোকে মা বাবা বলে ডাকতে পারতো জয়া না নিজের অমন উদাস বাবার কাছে থাকতে পারতো। বাবা আছে এটুকুই যা শান্তি।
” বলছি কতবার ওখানকার জমিটা আমায় দাও! একটা ইন্ডাস্ট্রি বানাই। তোমার বাবা থাকুক এসে এই বাড়িতে! নীচের গেস্ট রুমটা তো খালিই পড়ে আছে। আর তাছাড়া তোমার মাসির বাড়িও যথেষ্ট বড়ো। উনি থাকুন না! যা লাগবে দিয়ে দেবে! বলছি কথা বলো ওঁর সাথে। ওই তো শরীরের অবস্থা! না খাওয়া দাওয়া না যত্ন! এখানে এলে তুমিও তো দেখে রাখতে পারো!”
গলার টাইটা বেশ যত্ন করে বাঁধতে বাঁধতে বললো নিলয়। শুধু আজ নয় এই কথাগুলো প্রায়ই বলে নিলয়। মাসি মেসোর সামনে গিয়েও বলেছে যে প্রতাপ বাবুর দায়িত্ব নিতে চায়! কিন্তু এর পিছনের উদ্দেশ্য মানে জমি ইন্ডাস্ট্রি এগুলো বারবার উহ্য রেখেছে। এই কথা গুলো নিলয় শুধুমাত্র জয়াকেই বলেছে। যাতে জয়া কায়দা করে বিষয়টা দেখে নেয়।
বিষয়টা সত্যি দেখে নেওয়ার কিছু নেই। ঠাকুরদার অতো জমি বাবার পর সবই জয়ার। আর সত্যি তো কেউ নেই। এবার জয়া ভালোবেসে বিতানকে দেবে কিনা সেটা ওর সিদ্ধান্ত। আর না দিয়ে কি করে হবে! মাসি মেসোর ওই একটাই ছেলে বিতান! মাসিমনি বিতান আর জয়াকে কি কখনো আলাদা করে দেখেছে! মাছের পেটি মেসো বরাবর দুটোই কাটিয়ে এনেছে। মাংসের মেটে সমান দুভাগ হতে দেখেছে জয়া।
” আইনত তুমি ওই জমির পুরো মালিক। অতো বড়ো জমি এতো পুকুর, গাছ সব তোমার, মানে আমাদের। আর ওটা বেকার ফেলে রেখে কি লাভ বলো দেখি জয়া। আর তোমার বাবার বয়সটা কি কম হলো! একা থাকেন! কখন উল্টো সিধে কি হয়ে যাবে তখন তোমার ওই গ্রামের লোকজনই বলবে মেয়ে জামাই দেখে না! ”
আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চেহারার, পোশাকের আজ খুব যত্ন নিচ্ছে নিলয়। ফোনটা হাতে নিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে সেসব শুনে যাচ্ছে জয়া। বোকাই জয়া নিলয়ের কাছে তো বোকার হদ্দ।
মেসো যখন প্রথম এসে যেদিন বলেছিলো ওঁর অফিসের একজন বড়ো ক্লায়েন্ট মেয়ে খুঁজছে বিয়ে করবে বলে! মাসি আর মেসোর কত রকম আলোচনা। ভালো ছেলে, অমায়িক ছেলে, বাবা মা নেই মানে জয়ার দুঃখ বুঝবে। এতো অল্প বয়সে এতো দাঁড়িয়েছে যে এই ছেলেকে হাত ছাড়া করা যাবে না!
” হ্যাঁ গো, কি দেখে পছন্দ করবে ও জয়াকে? ” এখনও মনে আছে মাসি মেসোকে প্রশ্নটা করেছিল। রূপ আছে জয়ার! একটু নয় বেশ অনেকটাই। কিন্তু আজকের দিনে শুধু রূপ দিয়ে খুব কিছু হয় না! টাকা পয়সাটা খুব দরকার! সদ্য এম. এ তে ভর্তি হয়ে দুটো টিউশনের টাকাটা আর যাই হোক কোনো পাত্রীর আয়ের মাপকাঠি হতে পারে না। আর নিলয়ের মতো চৌখশ পাত্রের তো নয়ই।
” তাহলে? ” – মাসির কাছে চাপ দাড়ি নিলয়ের ছবি দেখে বারবার এটাই মনে হয়েছে জয়ার। মিথ্যে বলে লাভ নেই বেশ মনে ধরেছিলো নিলয়কে। আর জয়া বুঝেও গেছিলো ওর মতো পাত্রীর ভাগ্যে এমন পাত্র মাত্র লটারি লাগার মত!
” কি জয়াদেবী কানে ঢুকছে আমার কথা? ” – সেজেগুজে একমাত্র বৌয়ের সামনে এসে গাল দুটো টিপে বললো নিলয়।
ফুলো ফুলো গাল গুলোতে বেশ লেগেছে জয়ার। আগে হলে এটাকে সোহাগের সাথে গুলিয়ে ফেলতো জয়া। কিনতু এখন বেশ বোঝে- কোনটা আদর আর কোনটা….
” হুম বুঝেছি। চলো তোমাকে খাবার বেড়ে দি!” – একটু আলগোছেই বললো জয়া। আজকাল নিলয় সামনে আসলেই বড্ড অস্বস্তি হয় ওর। কারণ জয়া এখন বেশ বোঝে মন আর শরীরের পার্থক্য!
জয়ার খুব কাছাকাছি ওর মাত্র এক বছরের পুরোনো বর দাঁড়িয়ে! ওর খুব কাছাকাছি। কিন্তু দূরে সরে যেতে পারলে ভালো লাগতো জয়ার। কিন্তু সরে গেলে সে আরেক দৃশ্য তৈরী হবে ! এরকম মুহূর্ত গুলোতেই নিলয়ের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে!
“ফোন বাজছে তোমার!” – জয়া বললো। ফোনটা বাজতে যেন একটু স্বস্তি পেলো ও। জয়া দেখেছে ওর জীবনে এই বিষয়গুলোর খুব সুন্দর চট জলদি সুরাহা হয়!
মা মারা গেল। বাবা উদাস হয়ে গেল। ব্যস মাসি এসে গেল জীবনে। ইউনিভার্সিটিতে রক্তিম কি সাংঘাতিক পিছনে পড়ে গেছিলো ! একটুও পছন্দ ছিল না জয়ার। কিভাবে পছন্দ হবে! বাবা নেই মা সেলাই করে! কিভাবে এতো সাহস পায় প্রেম করার সেটাই বোঝে না জয়া!
আগে জানলে জয়া এক পাও এগোতো না! কারণ জয়া বুঝে গেছে ওর নড়বড়ে ভবিষ্যত যদি ঠিক করতে হয় বড়োলোক জীবনসঙ্গীর দরকার। এই রক্তিম কবে দাঁড়াবে কবে বিয়ে করবে কেউ জানে না!
সেই রক্তিমের হাত থেকে বাঁচার জন্য চলেও এসেছিলো নিলয়। আর নিলয়ের হাত থেকে বাঁচতে এখন এই মুহূর্তে এই ফোনটা!
” হ্যালো অরিজিৎ! বলো সব অ্যারেঞ্জমেন্ট কমপ্লিট? ” – জয়া দেখলো ওকে ছেড়ে দিয়েছে নিলয়। ফোনে মন দিয়েছে! জয়া নিজেকে গুছিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেল! কারণ এই সুযোগটা আর দেওয়া যাবে না ওকে!
” গুড! শোনো গিফট গুলো রেডি তো? দেখো আমার অফিসের লেডি কলিগদের সম্মান জড়িয়ে আছে! ওরা যেন খুশি হয়! ওরা আমার লক্ষ্মী!” – এক নাগাড়ে বলছে কথা গুলো নিলয়।
মেয়েদের নামে প্রশংসা করছে নিলয়! ওর অফিসের পার্ক স্ট্রিট ব্রাঞ্চটায় মোট আটজন মেয়ে আছে জানে জয়া। আজ হঠাৎ ওঁদের নিয়ে এতো মাতামাতি!
” আর অরিজিৎ শোনো তুমি সত্যজিৎকে বলে দিয়েছো তো আজ বিকেলে যেন এসে ম্যাডাম কে নিয়ে যায়! ঠিক সাড়ে তিনটে! কারণ প্রোগ্রামটা আমি সাড়ে চারটের মধ্যে শুরু করতে চাই! কারণ মেয়েরা সব বাড়ি ফিরবে! ওদের সাড়ে ছটার মধ্যে ছেড়ে দিতে হবে! ”
বলতে বলতেই নিলয় তাকালো জয়ার দিকে। তারপর ইশারা করে চুলটা দেখালো। জয়া সত্যি বুঝতে পারলো না কি বলতে চাইছে নিলয়!
” আচ্ছা রাখি অরিজিৎ! কোনো সমস্যা হলে ফোন করো!” – বলেই জয়ার কাছে এলো নিলয়। ” এই আজ একবার অফিসে আসতে হবে। সেই যে তোমায় ব্ল্যাক শাড়িটা কিনে দিয়েছিলাম সাথে পার্ল সেট! ওটা দিয়ে আজ ভালো করে সেজো তো! আমি রত্নাকে বলে দিয়েছি ও পার্লারের লোক পাঠিয়ে দেবে! পার্টি মেকআপ করিয়ে দেবে এসে!
নিজের মতো কথা গুলো বলতে বলতে দামী সুগন্ধ টা ছড়িয়ে নিলো নিলয়। নিলয়ের ব্যক্তিত্ব আছে মানতেই হবে! এতো গুলো স্টাফ এতো লোকজন ভগবান মানে নিলয়কে।
আর মানবে নাই বা কেন এতটা কে ভাববে কর্মচারীদের নিয়ে! এই যে মহিলা স্টাফদের নিয়ে আজ কিছু প্রোগ্রাম আছে! ওদের বাড়ি যাওয়ার চিন্তা! ওদের গিফটের চিন্তা ওদের খাওয়া দাওয়া! এতো ভাবনা সত্যি নিলয়ের মতো এমন মানুষের পক্ষে ভাবা এটা ভাবনারই অতীত!
” শুনলেন ম্যাডাম কি বললাম!” – আবার জিজ্ঞেস করলো নিলয়! জয়া দেখলো অদ্ভুত সুন্দর লাগছে আজ নিলয়কে। সত্যি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ওর!
জয়া বুঝেছে নিলয়কে দূর থেকেই ভালো লাগে কাছে আসলে সেই তাপ সহ্য করা যায়না। জয়া দেখলো নিলয় দেখছে জয়াকে। এটা দেখা নয় অপেক্ষা করা! জয়াকে যেতে বলছে আজ ওর অফিসে! সেটার সম্মতির অপেক্ষা করছে!
” কিছু আছে আজ? ” – জিজ্ঞেস করলো জয়া।
( চলবে )