#মনকাননের_সুর
লাবিবা ওয়াহিদ
|সূচনা পর্ব|
আমাদের এলাকাতে এক গবেষক পরিবার আছে। গবেষক পরিবারটা আমাদেরই দূরসম্পর্কের আত্নীয়। বাড়ি পাশাপাশি না হলেও খুব বেশি দূরেও না। তাদের পরিবারের একটা উটকো ঝামেলা নামক ছেলে আছে। যে অতিরিক্ত পঁড়ুয়া স্বভাবের। খুলনা বোর্ডে সেকেন্ড হয়েছিল সে পিএসসিতে। আমি আবার পঁড়ুয়া ছেলে মানুষ দেখতে পারি না। তাই শাদিফও আমার অপছন্দের তালিকার শীর্ষে। ওহ হ্যাঁ, জাতির এই ভবিষ্যতের নাম শাদিফ আরফান। যার নাক উঁচু স্বভাব, বোবা, সবসময় নাকের ডগায় গোল পাওয়ারের চশমা পরতে পরতে নাকে মোটা দাগ বসেছে। এখন চেহারা কেমন হয়েছে তা অবশ্য আমার জানা নেই।
ছোটো থেকেই বেশ উড়নচণ্ডী, চঞ্চল স্বভাবের আমি। যারা চুপ করে থাকত, তাদের খোঁচালে আমি দারুণ পৈশাচিক আনন্দ পেতাম। সেই আনন্দের ফায়দা বেশি তুলতাম শাদিফের থেকেই।
গুণে দেখেছি আমার থেকে সে মাত্র তিন বছরের বড়ো। তবুও ছোটোবেলায় পিঠেপিঠিই ছিলাম। তাকে অপছন্দ করার কারণ শুধু পড়াশোনার জন্যে নয়। বেশি কিছু কারণের পাশাপাশি আরেকটা কারণ আছে।
একবার ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। শাদিফ তখন কিসের লতাপাতা দিয়ে একটা মডেল বানিয়েছিল। প্রায় শেষ সেই কাজ। শুনেছিলাম সেই মডেলের ওপর ভীষণ পরিশ্রম করেছে সে। আমার বেখেয়ালি অবস্থাতে সেই মডেল কিছুটা নষ্ট করে ফেলি, অবশ্যই ইচ্ছেকৃত নয়। সেদিন বোবা শাদিফকে খুব রাগতে দেখেছিলাম। খুব ঝগড়া হলো আমাদের। ঝগড়ার এক পর্যায়ে হাতাহাতি। হাতাহাতির চক্করে শাদিফও একটা ভুল করে ফেলল। আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গেলাম। হাসপাতালে ভর্তিও হলাম। সেই থেকে শাদিফের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করলাম, বন্ধ করলাম শাদিফের সাথে কথা বলাও। তবে আমার চঞ্চলতাকে আমি আজ অবধি নিয়ন্ত্রণ করিনি।
শাদিফ কী ভেবে দুই মাস পরপরই আমার সাথে দেখা করলো, হাতে করে আনলো একটা ফুলের টব। টবটা বেলিফুলের। আমার সুগন্ধি ফুলগুলো ভীষণ পছন্দের। সেদিন ক্লাস ফাইভে পড়া শাদিফ সেই গাছ এনে আমার রাগ ভাঙালো। অবশ্য নিজ ইচ্ছাতে আসেনি। পরে জানতে পারি শাদিফের মা তাকে জোর করে উপহার দিয়ে পাঠিয়েছে। শুনে ভীষণ হাসি পেয়েছিল। ফুলের টবটা দেখেই সেদিন ছোট্ট আমি’র রাগ গলে গেলেও আমি প্রকাশ করিনি। বোবা শাদিফ সেদিন বলেছিল,
–“মডেলটা জলে গেল আমার, রাগ করার কথা আমার, অথচ রাগ ভাঙাতে হচ্ছে তোমার।”
সেদিন আমিও ক্ষেপে গিয়ে বাম হাতের কনুইয়ের নিচের কাঁটা দাগ দেখিয়ে বলেছিলাম,
–“হাত-পা, শরীর আমার— অথচ ধাক্কা দিয়ে ফেলে হাসপাতাল পাঠিয়েছ তুমি।”
আমার সেই ঝগড়ার দিনগুলো হাতে গোণা কিছু মাসই ছিল। আচমকা ওরা বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে স্ব-পরিবারে মিলে পাড়ি জমায় জার্মানিতে। আমি তখন হয়ে পড়লাম একা। বছরখানেক শাদিফকে ছাড়া ভালো না লাগলেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম, বয়সই বা কত ছিল এত মনে রাখার?
টেন পাশ করার পর যখন এদিক সেদিক কলেজের জন্য আমি আবেদন করতে ব্যস্ত তখনই একদিন দেখলাম সেই বদ্ধ বাড়িটার তালা খোলা। আমি দিকবিদিক না চেয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। সেদিন দেখলাম মামা-মামী ফিরেছেন। তবে ফিরেনি চিরচেনা নাক-উঁচু মানুষটা। জার্মানিতেই উচ্চ-ডিগ্রীর জন্যে থেকে গেছে। তখনো নাকি তার হাই-স্কুল জীবন শেষ হয়নি। মামা-মামী তাকে বহুবার ফিরে আসার জন্য মানানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এত ভালো সুযোগ হাতছাড়া করে কোন পাগল? মামা-মামী নাহয় আপনজনদের টানে, দেশের টানে ফিরেছেন। কিন্তু শাদিফ ভাইয়ের তো কোনো পিছুটান ছিল না। তবে সে-বার আমার খুব অভিমান হলো। মানুষটা অপছন্দের হলেও একটু হলেও তাকে দেখার আক্ষেপ জেগেছিল মনে। একটুর জন্য মনে হয়েছিল, এই বুঝি নাকউঁচু, বোবা মানুষটাকে দেখতে পাব। দেখতে পারব কতটুকু বড়ো হয়েছে সে? এখনো কী সেই আগের মতোন নাকউঁচু, বোবা শাদিফই আছে?
——————–
–“রামিশা? তোকে ফুল আনতে বলেছিলাম না? এখানে এভাবে বসে আছিস কেন?”
রামিশা ভাবনার ঘোর ছেড়ে বেরিয়ে পিছে ফিরে তাকায়। মা বিরক্তমুখে তার পানে চেয়ে আছে। রামিশা চুলের স্ক্রাঞ্চিটা কোনোরকমে হাতে ব্রেসলেটের মতো পরে চশমাটা হাতে নিয়ে নিলো। বিয়ের আনন্দে বাড়ি জুড়ে উৎসবের ঘ্রাণ। রামিশা ঝটপট মায়ের পাশ কাটিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। রামিশার একমাত্র বড়ো ভাইয়ের বিয়ে। ছোটোখাটো দোতলা বাড়িটা নানান ফুলে, আলোতে সজ্জিত। রামিশা বেরিয়ে ফুটপাত ধরে কিছুদূর হাঁটতেই শাদিফের বাড়ির সামনে চলে আসে। চোখের চশমাটা টেনে ভেতরে নজর বুলায় সে। আজকে এই বাড়িতেও মোটামুটি উৎসব লেগেছে, তা রামিশা অনুভব করতে পারছে।
রামিশা ফুলের ঝুড়ি নিয়ে আবার রিকশায় উঠে বসে। একা একা আর কত দিক সামলাবে ভাবতেই রামিশার কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ল। তবে বিরক্তির ভাজ বেশিক্ষণ রইলো না। আজ শাদিফ দেশে আসবে। তার ভাইয়ের বিয়ের উপলক্ষ্যেই আসা। আগেও একবার এসেছিল, তবে একাডেমিক প্রেশারে লম্বা সময় থাকেনি। এবার সম্ভবত লম্বা সময়ের জন্যেই আসছে।
রামিশা এখন ডিগ্রীর থার্ড ইয়ারে পড়ছে। চশমাটাও এতদিনে তার বন্ধু হয়ে গিয়েছে। একসময় গোল চশমার শাদিফকে কত খোঁচাত, কটাক্ষ করত। এখন সে নিজেই চাশমিশ হয়ে গেছে। রামিশা আজকে অনুভব করলো সে বারবার শাদিফের ভাবনায় তলাচ্ছে, যা এই অসময়ে একদমই অনুচিত।
বাড়ি ফিরতেই রামিশার এক কাজিন মনিষা তাকে চেপে ধরলো। মনিষার আজকাল ওজন বাড়ছে। এটা নিয়ে সে রামিশাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছে। এই ব্যাপারটায় রামিশা চরম বিরক্ত। এক সময় রামিশাও গুলুমুলু ছিল। তবে দেড় বছর যাবৎ সে অনেকটাই চিকন হয়ে গিয়েছে। এমন না যে মানুষের কথা শুনে রামিশা এমন হয়েছে। তার এত ওজন ভালো লাগত না, অল্প কাজ করলেই কেমন কাহিল লাগত। এজন্য একপ্রকার জেদ ধরেই ডায়েট, ওয়ার্কআউট যেভাবেই পেরেছে— ওজন কমিয়েছে। তবে এতে রামিশার মা রাহেলার আফসোসের শেষ নেই। রামিশার চোখে দেখা একমাত্র মা, যিনি কি না মনে-প্রাণে মেয়েকে গুলুমুলু, মোটা হিসেবেই দেখতে চান। আর রামিশার জীবনের বিশ্রী অভিজ্ঞতা হলো, আগে মানুষ বলত,
“তুমি এত মোটা কেন?”
আর এখন বলে,
“তুমি এত চিকন কেন?”
অদ্ভুত দুনিয়া।
সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ। রামিশা শাড়ির কুচি ধরে নিচে ছুট লাগিয়েছে। শাড়ি পরে দৌড়-ঝাপের অভ্যেস আছে তার। খোলা চুল, চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। পেছন থেকে রামিশার বড়ো ভাই রেহান তাকে দেখে পিছুডাক দিলো। রামিশা পেছন ফিরে না তাকিয়েই আওড়াল,
–“শাদিফ ভাই আসছে। আমি ঘুরে আসি।”
বলেই রেহানের কোনো কথা না শুনে সে চলে যায়। শাদিফদের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ায় সে। ভেতর থেকে মামীর চাপা উচ্ছ্বাস ভেসে আসছে। শাদিফকে তার ভালোও লাগে, আবার ভালোও লাগে না। ভালো না লাগার অনেক কারণ আছে, তবে ভালো লাগার কারণটা সে জানে না।
–“রেশমি চুড়ি?”
ভরাট পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে রামিশা ভীষণ চমকে যায়। এই কণ্ঠস্বর তার অপরিচিত লাগলেও, ডাকনামটা ভীষণ পরিচিত। রামিশা এক মুহূর্তের জন্যে সেভাবেই জমে দাঁড়িয়ে রইলো। পরপর পিঠে কিছু একটার খোঁচা খেল। রামিশা এবার পিছে ফিরে তাকায়। চোখ তুলে তাকাতেই লম্বাটে, সুদর্শন এক পুরুষকে দেখতে পায় সে। পুরুষটির চোখে চিকন ফ্রেমের গোল চশমা। রামিশা আবারও জমে যায়।
সামনের পুরুষটি কপালে ভাজ ফেলে রামিশাকে আপাদমস্তক লক্ষ্য করলো। আচমকা রামিশার চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে সেটা পরখ করতে লেগে গেল। রামিশা শুরুতে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে না পারলেও পরপর চোখে হাত দিয়ে বলল,
–“কী হচ্ছে শাদিফ ভাই! আমার চশমা দেন।”
শাদিফ চশমা হাতে নিয়েই অবাক হয়ে তাকাল। ভীষণ চমকে গিয়ে বলল,
–“তুমি থেকে আপনি, শাদিফ থেকে শাদিফ ভাই?? আসলেই ঠিক শুনলাম তো?”
রামিশা বিরক্ত হয়ে বলল,
–“তখন ছোটো ছিলাম।”
–“এখনো ছোটোই আছিস। লিলিপুট।”
শাদিফ থেমে রামিশাকে কিছু বলতে না দিয়ে আবার বলল,
–“আমাকে চশমা নিয়ে পচানো মেয়েটা নিজেই চাশমিশ? ইম্প্রেসিভ।”
–“আমি তোমার মতো অন্ধ না। মাথা ব্যথার জন্য নিয়েছি।”
–“অন্ধ হলে তোকে দেখতাম কী করে?”
–“সে আমি জানি না। চশমা দেন।”
শাদিফ তর্কে না জড়িয়ে চশমাটা ফিরিয়ে দেয়। অতঃপর শার্টের হাতা কনুই অবধি টানতে টানতে বলল,
–“এখন থাক, বাড়ি যা। আমি ফ্রেশ হয়ে প্রোগ্রামে আসছি। তখন নাহয় তোর সাথে পুরানো হিসাব নিয়ে বসব। বাই, লিলিপুট লেইডি।”
চলবে~~