মনকাননের সুর পর্ব-০৪

0
433

#মনকাননের_সুর – [০৪]
লাবিবা ওয়াহিদ
[কপি সম্পূর্ণ নিষেধ]

রামিশার বয়স এই বছর তেইশের কোঠায় পড়বে। তবে তার পরিবার তাকে এখনো বাচ্চাদের মতো ট্রিট করে। তার সমস্ত শখ-আহ্লাদ, চাওয়া-পাওয়া নির্দ্বিধায় পূরণ করে। ওইযে, কথায় আছে না— বাবা-মায়ের কাছে সন্তানরা সবসময়ই ছোটো। তবে এটা সচরাচর সবাই না মানলেও রামিশার পরিবার যেন ভিন্ন নিয়মে চলতে পছন্দ করে। রামিশা জানে না তার পরিবার তাকে বিগড়ে দিচ্ছে নাকি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা দিচ্ছে। তবে সে এটুকু জানে তার পরিবার তাকে অঢেল ভরসা করে। আর পরিবারের জন্যই আজ অবধি তার ভেতরকার চঞ্চলতা বেঁচে আছে। সে একদিন চুপ হয়ে গেলে তার পরিবার অস্থির হয়ে যায়, তাদের মন অশান্ত হয়।

তবে এবার রামিশার চটপটে ভাবের বিরতি চলছে। এই বিরতি মূলত রাকিবের বিয়ে থেকেই শুরু। রাহেলা এ ব্যাপারে চিন্তিত হলে রামিশা তাঁকে বলে,
–“তুমিই তো বলেছিলে এই বয়সে এসব মানায় না। এজন্যে একটু দায়িত্বশীল হবার চেষ্টা করছি।”

রাহেলা অবশ্য এই ভেবে স্বস্তি পেয়েছিলেন যে মেয়ে নিজের ভালোটা বুঝতে শিখছে। আগে মেয়ের কোনো বিষয়ে আপত্তি না থাকলেও শাহিনার ইতিবাচক প্রস্তাবের ইঙ্গিত পাওয়ার পর থেকেই মেয়েকে তিনি মেয়ের উড়নচণ্ডী স্বভাব পছন্দ করছেন না। যতই হোক, মেয়ে আজীবন তাদের কাছে থাকবে না। বিয়ে-শাদি দিতে হবে, আর মেয়ে মানুষের জন্য তার সংসার জীবন-মরণের মতোই। এখানে তাঁর মেয়েকে নিয়ে কেউ নেতিবাচক ধারণা মাথায় আনুক তা একজন মা হয়ে তিনি কোনোদিন চাইবেন না। যতই শাহিনা ওদের পরিচিত হোক না কেন, শাদিফ দেশের বাইরে থাকা ছেলে। সে নিশ্চয়ই এই ব্যাপারগুলিতে একসময় বিরক্ত হবে। রাহেলা জানেন, তাঁর মেয়ে লাখে একজন। সে যতই উড়নচণ্ডী স্বভাবের হোক না কেন, ভালোবেসে সবাইকে আগলে রাখার নিদারুণ গুণ তার মাঝে আছে। মেয়ে সপ্তাহে একদিন তার পুরো সংসারের দায়িত্ব নিয়ে তাকে ছুটি দেয়। এতে মেয়ের সাথে তর্কও করা যায় না। আর কী, পুরো একটা দিন তখন অলস সময় কাটাতে হয়। মেয়েটা তাঁর বড্ড আদুরে। আদুরে মেয়ের জন্যে এত ভালো প্রস্তাব এসেছে, ভাবলেই উনার চোখে জল জমে। ওইযে, বলে না.. আল্লাহ ভালোদের সাথে ভালোটাই করেন?

এবার রাহেলা বুঝতেই পারলেন না, তাঁর উড়নচণ্ডী মেয়ের চুপসে যাওয়ার গোপন গল্পটা। রামিশা নতুন বেলি ফুলের গাছ নিয়ে নীরবে সেদিন বাড়িতে ফিরে আসে। সেদিনের পর থেকে তার মুখের রং পরিবর্তন হয়েছে যা সকলে দেখলেও রামিশার উলটো পালটা কথা-বার্তায় এতটা ভাবার সুযোগ পায় না। তবে সেদিনের পর থেকে রামিশা শাহিনার বাড়ি একবারও যায়নি। বরং পড়ার টেবিলে এমন ভাবে বসে থাকছে যেন সামনে পরীক্ষা, তার খুব পড়তে হবে। কিন্তু সত্যি বলতে কিছুই পড়ছে না সে। এসব সমস্ত নিজের ভেতরকার ক্ষত লুকানোর বাহানা মাত্র। সে আনমনে টেবিলে বসে জানালা ভেদ করে আকাশের পানে চেয়ে থাকে। তার চোখের পর্দায় তখন আকাশ এবং আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘকুঞ্জই ফুটে ওঠে। সে অজ্ঞাত কারণবশত শাদিফের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।

অতল সাহেব রামিশার উত্তর জানতে চেয়েছেন। তবে রামিশা বিশেষ কিছুই বলেনি। সে সময় চেয়েছে। অতল সাহেব যেহেতু মেয়ের ওপর সমস্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন সেহেতু মেয়েকে খুব একটা জোর দিলেন না। যতই হোক মেয়ের সারাজীবনের ব্যাপার। হুটহাট কিছু চাপানো যায় না।

এর মাঝে হঠাৎ শাহিনা নিজেই এসে হাজির হলেন। আক্ষেপ নিয়ে বলেছেন রামিশার সাথে দেখা করবেন, মেয়েটা যেন তাকে ভুলেই গিয়েছে। রামিশার ঘরে শাহিনা আসতেই দেখলেন রামিশা নেই। বারান্দায় যেতেই দেখলেন সে একটা গাছের সামনে বসে আছে। গাছটা সম্ভবত বেলিফুলের। শাহিনা আচমকা বলে ওঠে,
–“শাদিফের দেওয়া গাছটা তো সেই কবেই মরে গিয়েছিল। এটা কী নতুন এনেছিস?”

শাহিনার গলা পেয়ে রামিশা চমকে পিছে ফিরে উঠে দাঁড়ায়। আমতা আমতা করে বলল,
“মামী, তুমি?”
শাহিনা অভিমানী গলায় বললেন,
–“ভুলেই তো গিয়েছিস মামীকে। একবার দেখাও করতে আসছিস না!”

রামিশা হাসার চেষ্টা করে বলল,
–“ক্লাস টেস্ট, প্রেজেন্টেশন এবং এসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম মামী।”

কথা অবশ্য মিথ্যে নয়। শাহিনাও বিশ্বাস করে নিলেন। রামিশার স্বভাব হচ্ছে সে এসাইনমেন্ট জমিয়ে রাখে। যার ফলস্বরূপ নির্ধারিত ডেটের আগের দুইদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না ব্যস্ততার চক্করে। তবে এবার কয়েকদিন কাটিয়ে দিয়েছে মেয়ে। সত্যিই বুঝি অনেক চাপ?

শাহিনা বললেন,
–“আচ্ছা, যা। মেনে নিলাম। এখন যা গিয়ে আমার জন্যে রং চা বানিয়ে আন। শরীর খারাপ নিয়ে তোকে দেখতে এসেছি। জানিস না তোকে না দেখলে আমার কতটা অশান্তি লাগে?”

মামীর কথামতো রামিশা চলে যায়। এই প্রথম তাঁকে এমন মিথ্যে বলেছে সে, মন ভার লাগছে ভীষণ। মামী যত যাই হোক, তাকে যে খুব ভালোবাসেন। রামিশা চা নিয়ে আসতেই শাহিনা চুমুক দিলেন। সুখের শব্দ প্রকাশ করে বললেন,
–“বিয়ে-শাদির ব্যাপারে এখনো কিছু বলছিস না কেন? আমি কী বলেছি মনে নেই?”
–“শাদিফ ভাই জানেন যে তুমি তার বিয়ে দিতে চাচ্ছ?”

–“তা নয়তো কী?”
–“শাদিফ ভাই জানে না কিছু মামী। মিথ্যে বললে কেন আমায়?”

শাহিনা চুপসে যায় ধরা খেয়ে। ছেলেকে এখনো তিনি কিছু জানাননি। যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণই তার একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে। রামিশা কৌশলে বলল,
–“আমি বাবা-মাকে এখনো বলিনি। তারা জানলে কিন্তু খুব রাগ করবেন। তাই বলছি কী মামী, শাদিফ ভাইয়ের ইচ্ছেটা শুনে নাও আগে। এভাবে তার অনিচ্ছায় বিয়ের কথা আগানো উচিত নয়।”

–“আমার জন্য তুই ইম্পোর্টেন্ট। তোর রাজি হওয়াটাই জরুরি। শাদিফকে আমি বললে কখনোই না করবে না। ওকে নিয়ে তুই ভাবিস না।”

রামিশা তাচ্ছিল্যের সাথে হাসল। বলল,
–“আমার সিদ্ধান্ত শাদিফ ভাইয়ের রাজি হবার ওপর।”

শাহিনার কপালে চিন্তার ভাঁজ। তিনি চিন্তিত সুরে বললেন,
–“এর মানে ওইদিন তোদের রেস্টুরেন্টে বিয়ে নিয়ে কোনো কথাই হয়নি?”

রামিশা নেতিবাচক মাথা নাড়ায়, অর্থাৎ না।

শাহিনা যাবার ঠিক একদিন বাদেই উষ্কখুষ্ক শাদিফ আসল। সে জরুরি ভিত্তিতে রামিশার সাথে দেখা করতে চায়। রামিশা তখন ঘুমোচ্ছিল। রাহেলা তাকে টেনে ঘুম থেকে ওঠায়। রামিশা চোখ আধো খুলে বিরক্তির সাথে তাকায় মায়ের দিকে। মায়ের দিক থেকে চোখ সরাতেই চশমা পরিহিত শাদিফকে দেখতে পেল। মুহূর্তেই তার চোখের ঘুম উড়ে যায়। সে সঙ্গে সঙ্গে গায়ের কাঁথা দিয়ে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে বলল,
–“এখানে কী?”

রাহেলা বললেন,
–“শাদিফ তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।”
–“তোমার শাদিফের কমনসেন্স নেই? হুট করে মেয়েদের ঘরে ঢুকে পড়েছে কেন?”

শাদিফ এতে করে লজ্জা পেল, সে সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রাহেলা তা দেখে মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন,
–“সবার আগে তোর মুখের লাগাম টান। কেউ এভাবে কারো মুখে তেতো কথা মেখে দেয়? ছেলেটা কোনো কিছু নিয়ে দুচিন্তায় হয়তো, এজন্য একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে।”

রামিশা বিরক্ত হয়ে কাঁথা সরিয়ে বলল,
–“মুখের লাগাম আছে বলেই এর চাইতে বেশি কিছু বলিনি। তুমি ওনাকে বলো আমি আসছি।”

রাহেলা মেয়েকে বকতে বকতে রুম থেকে বেরিয়ে যান। রামিশার ফ্রেশ হওয়ারও সুযোগ হয় না। সদ্য ঘুম থেকে উঠে, ফোলা চোখ-মুখ নিয়েই তাকে বের হতে হয়। ওড়নায় তার জড়িয়ে রেখেছে এলোমেলো চুল। শাদিফ তখন রাকিবের রুমের বারান্দায় পায়চারি করছিল। রাকিবের বউ নেই, সে বাপের বাড়ি আছে। রাকিবও বাড়িতে নেই। রামিশা হাই তুলে বলল,
–“আমার ঘুম নষ্ট করে নতুন গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে কী শোনাতে এসেছেন শুনি?”

শাদিফ থেমে তাকায় রামিশার দিকে। রামিশা কপালে বিরক্তির ভাঁজ। শাদিফ নিজেকে কিছুটা সামলে বলল,
–“আম্মা সারার ব্যাপারে শুনে ভীষণ রেগে গিয়েছেন। তার ওপর শুনছি উনি নাকি তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে, আনবিলিভেবল!! প্লিজ বিয়েতে না করে দাও। তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

চলবে~~