মায়ায় জড়ালে পর্ব-০২

0
284

#মায়ায়_জড়ালে
#পর্ব_২
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
একটা নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে ছেলেমেয়েদের কথাবলার জন্য আলাদা করে ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন আওসাফের বাবা আশকাফ।প্রিয়ন্তি সেখানেই বাবার দেখা পাত্র আওসাফের সাথে দেখা করতে আসে।

প্রিয়ন্তি একটা বোরখা আর হিজাব পড়ে এসেছিলো।সে এসে দেখে একটা ছেলেটা বসে আছে।টেবিলের নাম্বার আর পর্দা দেওয়া পরিবেশ দেখে সে সহজেই আওসাফকে চিনতে পারে।সে এগিয়ে হেসে স্বলজ্জ ভঙ্গিতে আওসাফকে সালাম দেয়।

আওসাফ প্রিয়ন্তির বর্ণণা শুনেছিলো।সে প্রিয়ন্তিকে দেখামাত্রই চিনে ফেলে।সে প্রিয়ন্তিকে চেয়ার এগিয়ে প্রিয়ন্তিকে দিয়ে বসতে বললে প্রিয়ন্তি বসে।তারপর আওসাব প্রিয়ন্তিকে দেখে।প্রিয়ন্তি মাথা নিচু করে বসেছিলো।এর ফাঁকেই আওসাফ প্রিয়ন্তিকে ভালোভাবে পরখ করে নেয়।

গোলগাল চেহারা,লম্বা নাক,চিকন গোলাপী ঠোঁট, ভরা গাল,ডান গালে সুক্ষ তিল,টানা টানা চোখ সবকিছুর সমন্বয়ে সৃষ্টিকর্তা এ মেয়েটিকে অপরুপা করে সৃষ্টি করেছেন।কার ভাষায় কি জানি না,তবে আওসাফের দৃষ্টিতে প্রিয়ন্তি অপরুপা।

তারপর আস্তে আস্তে আওসাফ পরিবেশ স্বাভাবিক করে তুলে।সে কথা বলে প্রিয়ন্তির জড়তা কাটায়।প্রিয়ন্তি তার জীবনে ঘটে যাওয়া এই আকস্মিক ঘটনাটা আওসাফকে জানায়।

প্রিয়ন্তি ভেবেছিলো,তার আগে বিয়ে হয়েছে এ কথা শুনে হয়তো আওসাফ তাকে এড়িয়ে যেতে পারে‌। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।আওসাফ বললো,সে প্রিয়ন্তিকে গ্রহণ করবে।

কথাবার্তার মাঝখানেই আওসাফ প্রিয়ন্তিকে কিছু খাওয়ার জন্য বলে। কিন্তু আওসাফের সামনে কিছু খেতে প্রিয়ন্তির খেতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো।আওসাফ সেটা বুঝতে পেরে দুইটা পিৎজা পার্সেল করে প্রিয়ন্তিকে দিয়ে দেয়।

প্রিয়ন্তি নিতে চাইছিলো না।এটাতেও তার অস্বস্তি হচ্ছিল।তখন আওসাফ প্রিয়ন্তিকে বলে,

—“ আপনাকে কি আমি এমনি এমনি পিৎজা খাওয়াচ্ছি নাকি!”

প্রিয়ন্তি আওসাফের কথা বুঝতে পারে না।সে বলে,

—“ আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”

—“ বলছি আমি কি আপনাকে এমনি এমনি পিৎজা খাওয়াচ্ছি নাকি?আমি তো আপনাকে ট্রিট দিচ্ছি!”

—“ কিসের ট্রিট?”

—“ আমি আজকে একজন পাত্রী দেখেছি,তাকে পছন্দ হয়েছে। এইজন্য আমার তরফ থেকে আপনার জন্য ক্ষুদ্র ট্রিট দিলাম!”

প্রিয়ন্তি ভাবে,আওসাফ হয়তো আজকে আরও কোথাও পাত্রী দেখেছে।ওই পাত্রীকেই বোধহয় আওসাফের পছন্দ হয়েছে।সে নিজের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারে না।সে আওসাফকে জিজ্ঞেস করে,

—“ আপনি আজকে এখানে আসার আগেও পাত্রী দেখেছেন?”
—“ কখন বললাম?”
—“ এইযে বললেন,আজকে একজন পাত্রী দেখেছেন,তাকে পছন্দ হয়েছে!”
—“ হ্যাঁ,বলেছি।”
—“ তাহলে কোন পাত্রীকে পছন্দ হয়েছে আপনার?”
—“ আপনি নামক বোকা পাত্রীকে!” আওসাফ মৃদু হেসে বলে।

আওসাফের কথা শুনে প্রিয়ন্তি আবারো লজ্জায় পড়ে যায়।লোকটা তাকে বোকা বলে লজ্জা দিচ্ছে!
প্রিয়ন্তি আওসাফকে জিজ্ঞেস করে,

—“ আপনি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবেন?”

আওসাফ প্রিয়ন্তিকে একটু বাজিয়ে দেখতে চায়।তাই বলে,
—“ যদি বলি,না।”

—“ এটা আমার ক্ষেত্রে অনেকবারই ঘটেছে,তাই কষ্ট পাবো না।”

—“ সত্যিই কষ্ট পাবেন না বোকাপাত্রী আমার?”
ফিসফিসিয়ে বলে আওসাফ!

আওসাফের ফিসফিসিয়ে বলা কথাগুলো প্রিয়ন্তির হৃদয়ে চরমভাবে আন্দোলিত হয়।হৃদয়ের রক্তকণিকা বক্ররেখায় সারিবদ্ধ হয়ে আঘাত হানে পাজরে।সে আঘাত ধীর, কিন্তু আঘাত করে তুমুলভাবে।ক্ষণে ক্ষণে হৃদয়ের কম্পন বাড়িয়ে তুলে।শিরশির এক অনুভুতি বয়ে চলে অস্থিমজ্জায়।কেমন যেন খালি খালি লাগতে শুরু করে প্রিয়ন্তির।সে কোলে থাকা ব্যাগ চেপে ধরে মাথা নিচু করে থাকে।

প্রিয়ন্তির মিইয়ে যাওয়া চোখমুখ দেখে তার ভাবানুবেগ বুঝতে কষ্ট হয়না আওসাফের।বোকা প্রেয়সীর বিষাদমাখা করুণ মুখ তার অন্তরকে পীড়া দেয়। নয়ন স্থির হতে চায় বোকা প্রেয়সীর মুখপানে। কিন্তু প্রেয়সীর বিষাদের আগুন পোহাতে সাহস পায় না আওসাফ। পরিস্থিতি সুন্দর করতে পূর্বের ন্যায় ফিসফিসিয়ে বলে,
—“ আর যদি বলি,আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি।যদি আমার উত্তর হ্যাঁ হয়?”

আওসাফের দ্বিতীয়বার ফিসফিসানি কানে যায় প্রিয়ন্তির।প্রথমবার যে মুখের ফিসফিস আওয়াজ তাকে মাথা নিচু করতে,মুখ মলিন করতে বাধ্য করেছে, দ্বিতীয়বার সেই ফিসফিস আওয়াজ প্রিয়ন্তির মুখে,অন্তরে সুখের বন্যা বইয়ে দেয়।চকিতে মুখ তুলে স্বলাজ হাসি হাসে সে।অপরুপার সে মুখের হাসি, প্রশান্ত করে দেয় আওসাফের হৃদয়কে।তার ক্ষুদ্র কথাটুকু বোকা প্রেয়সীর হৃদয়ে জ্বলতে থাকা আগুনকে নিভিয়ে দিয়েছে নিদারুণ ভাবে,এই ভেবে সে খুশি হয়।প্রেয়সীর পাশাপশি নিজের মুখে নিয়ে আসে খুশির আলোড়ন,উঠিয়ে ফেলে বিরসভাব,ফুটিয়ে তুলে মনের অভিব্যক্তি!

তারপর….
তারা দুইজন কিছুক্ষণ বসে থাকে।আওসাফ কিছু বলছে না দেখে প্রিয়ন্তি কিছু বলছে না।প্রিয়ন্তি কিছু বলছে না দেখে আওসাফ ও কিছু বলছে না।
সময় গড়িয়ে যায়,নিরব সময়ের নিরবতা ভাঙে আওসাফের ফোনের ভাইব্রেশনে।কে ফোন দিয়েছে দেখতে ফোন উঠায় আওসাফ।নাম দেখে ফোন রিসিভ করে।ফোনের স্পিকার বাড়িয়ে দেয়।

—“ আসসালামু য়ালাইকুম আব্বু!”
—“ হ্যাঁ বাবা।প্রিয়ন্তির সাথে দেখা করেছিস?”
—“ হ্যাঁ আব্বু,এখনো উনার সাথেই আছি।” আড়চোখে প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলে আওসাফ।
—“ তোকে পছন্দ হয়েছে ওর?” আওসাফকে করা আশকাফ সাহেবের এ প্রশ্ন প্রিয়ন্তির কানেও যায়।সে একটু অবাক হয়।সচরাচর ছেলেদের তাদের পরিবার থেকে জিজ্ঞেস করা হয় মেয়ে পছন্দ হয়েছে কি না।সেই জায়গায় তিনি কিনা ছেলেকে জিজ্ঞেস করছেন,তার আওসাফকে পছন্দ হয়েছে কী না! আশ্চর্য রকমের মানুষ এরা!

এদিকে আশকাফ সাহেবের প্রশ্ন শুনে আওসাফ প্রিয়ন্তির দিকে ভালোভাবে তাকায়।বাবাকে বলে,
—“ সেটা তো জানিনা আব্বু।উনি আমায় বলেনি কিছু। জিজ্ঞেস করবো?”
—“ হ্যাঁ জিজ্ঞেস কর।”

আওসাফ ফোনটা একহাতে একটু দূরে রেখে মাথা প্রিয়ন্তির দিকে একটু এগিয়ে যায়।প্রিয়ন্তি আওসাফের মনোভাব বুঝতে পেরে টেবিলে থাকা জগ থেকে পানির গ্লাসে পানি ঢেলে পানি পান করতে থাকে।তাও আওসাফের প্রশ্নের থেকে পরিত্রাণ পায়না সে।সে পানি পান করারত অবস্থায়ই আওসাফ তাকে জিজ্ঞেস করে,
—“ আমাকে পছন্দ হয়েছে আপনার?”
প্রিয়ন্তি বিষম খায়।আওসাফ ও ভিমড়ি খেয়ে যায়।দুষ্টুমি করতে গিয়েছিলো সে, প্রিয়ন্তিকে বিষম খাওয়াতে যায়নি।সে ফোন কানের কাছে এনে বলে,
—“ একটু পরে ফোন দিচ্ছি আব্বু।” বলে সে ফোন রেখে দেয়।

এখন কি করবে বুঝতে পারছে না আওসাফ।সে তো প্রিয়ন্তির পিঠে একটু হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত ও করতে পারবে ।প্রিয়ন্তি এখনো তার জন্য জায়েয হয়নি।এই ভেবে সে হতাশ হয়‌ সে।নিজের কাজের জন্য নিজেই আফসোস করতে থাকে।

প্রিয়ন্তি নিজেই নিজেকে সামলিয়ে নেয়।আওসাফ তার বিষম খাওয়া যতোটা গুরুতর ভেবেছে,তার অবস্থা ততোটাও গুরুতর হয়নি।

প্রিয়ন্তি স্বাভাবিক হলে আওসাফ তাকে জিজ্ঞেস করে,
—“ ঠিক আছেন আপনি?”
—“ ফুলফিল আলহামদুলিল্লাহ!”
—“ দুঃখিত!”
—“ কেন?” প্রিয়ন্তির কথায় বিস্ময়!
—“ এইযে আমার প্রশ্নের জেরে আপনি বিষম খেলেন।”
—“ না না আপনার দোষ না!”
—“ দোষ না দোষ পরের কথা।আগে আব্বুকে কল দিয়ে নিই !একটু ওয়েট করুন।”

দুই আঙুল দিয়ে প্রিয়ন্তির দিকে ইশারা করে পুনরায় ফোন নিয়ে আশকাফ সাহেবকে ফোন দিলো আওসাফ।
ফোন রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে আশকাফ সাহেব বলে উঠলেন,
—“ কি হয়েছিলো?ফোন হঠাৎ রেখে দিলি যে?কোনো সমস্যা?”
—“ হ্যাঁ আব্বু,বিরাট সমস্যা হয়ে গিয়েছে।”
আওসাফের কথা শুনে ফোনের এপাশ থেকে প্রিয়ন্তি হতবাক হলো।কি আবার সমস্যা হয়েছে!

ফোনের ওপাশ থেকে আশকাফ সাহেবের একই প্রশ্ন।“কি সমস্যা হয়েছে?”
—“ আমাকে বিয়ে রোগে ধরেছে আব্বু।আগামী তিন দিনের মধ্যে আমি প্রিয়ন্তিকে বিয়ে করতে চাই।”

ছেলের সমস্যার কথা শুনে একটু চিন্তিত ছিলেন আশকাফ সাহেব।এ কথা শুনে তিনি চিন্তামুক্ত হলেন।হালকা শব্দ করে হাসলেন।সে হাসি শুনতে ভালো লাগলো।
একটু বিরতি নিয়ে তিনি বললেন,
—“আচ্ছা তবে তাই হোক।আমি সব ব্যাবস্থা করছি।”
—“ তুমি খুব ভালো আব্বু!”
আবার হাসলেন আশকাফ সাহেব।রাখি বলে ফোন রেখে দিলেন তিনি।ছেলের ফোন কেটে বন্ধুকে ফোন করলেন তিনি।বললেন,
—“ সানাই বাজা বন্ধু!তোর মেয়ে নিতে আসছি।”
___
আওসাফ আর প্রিয়ন্তির কথা বলা শেষ হলো।দু’জনেই উঠলো।আওসাফ প্রিয়ন্তিকে তার বাড়ির সামনের রাস্তায় নিরাপদে এগিয়ে দিয়ে এলো।বিদায় নেওয়ার সময় প্রিয়ন্তিকে বললো,
—“ একটা কথা শুনুন!”
—“ জি বলুন।”
—“ আপনি নিজেকে আমি অসুন্দর বলেন! কিন্তু আপনি জানেন আমাদের প্রভু আমার আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেছেন: আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম আকৃতিতে!’
(সূরা- আত-ত্বীন- ৯৫:৪)
সুতরাং আর কখনো নিজের সুন্দর অসুন্দর নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না।আমি একটা সুন্দরী নারীকেই বিয়ে করতে যাচ্ছি।”

আওসাফের শেষোক্ত কথা শুনে প্রিয়ন্তির আবারো ঘোর লাগলো।কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো তার।সে জিজ্ঞেস করলো,
—“কাকে বিয়ে করবেন আপনি!”
—“ এক সুন্দরীকে!”
—“ সে কে?”
—“ আপনি!”

নিজের বেহুদা প্রশ্নের উত্তরে নিজেই লজ্জায় পড়লো প্রিয়ন্তি।যাই বলে সালাম দিয়ে সে চলে যাচ্ছিলো।তখন আওসাফ আবার প্রিয়ন্তিকে ডাকে‌।ডেকে বলে,
—“ যা বললাম মনে থাকবে তো?”
—“ সবসময় ইন শা আল্লাহ!”
—“ কি বলেছি বলুন তো।”
—“ আমি বলি, আমি দেখতে খুবই অসুন্দর! কিন্তু আল্লাহ বলেন: আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম আকৃতিতে!’”
—“ মা শা আল্লাহ্।মনে আছে দেখছি!মনে রাখবেন সবসময় আর নিজেকে অসুন্দর বলা থেকে বিরত থাকবেন।”
—“ আচ্ছা,ইন শা আল্লাহ!”

তিন দিন পর আওসাফ আবসার আর শাহনুর প্রিয়ন্তির বিয়ে হয়ে গেলো।

চলবে…..