মায়ায় জড়ালে পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
472

#মায়ায়_জড়ালে
#পর্ব_৩ (সমাপ্তি পর্ব)
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা

বিয়ের পর প্রথম সকাল। নতুন জীবনের নতুন শুরু। প্রিয়ন্তি এখনো ঠিকভাবে বুঝতে পারছে না, সে সত্যিই আওসাফের স্ত্রী হয়েছে!

আওসাফ সকালেই নামাজ পড়ে এসে খেয়াল করল, প্রিয়ন্তি এখনো ঘুমাচ্ছে। একটা মিষ্টি হাসি ফুটল তার মুখে। নতুন বউয়ের প্রথম সকালটা একটু স্পেশাল করতে চায় সে।

কিচেনে গিয়ে নিজেই চা বানিয়ে আনল। তারপর ধীরে ধীরে প্রিয়ন্তির পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “বোকাপ্রেয়সী আমার আর কত ঘুমাবে?”

প্রিয়ন্তি চোখ কচলাতে কচলাতে তাকাল। আওসাফের হাতে চায়ের কাপ দেখে চমকে উঠল।
— “আপনি চা বানিয়েছেন?”
— “হ্যাঁ, তোমার জন্য!”

প্রিয়ন্তি মনে মনে অবাক হলো। একজন ছেলে, বিশেষ করে তার স্বামী, সকালে নিজে চা বানিয়ে দিচ্ছে—এটা তার কল্পনার বাইরের ব্যাপার ছিল।সে মেকী রাগ দেখিয়ে আওসাফকে বললো,

— “আপনার এটা করা উচিৎ হয়নি!”
— “তোমার হাসিটা পাওয়ার জন্য সবকিছু করতে পারে এই আওসাফ আবসার!বুঝলে আমার রাণী?”

প্রিয়ন্তি কিছু বলল না। লজ্জায় মুখ নিচু করল। আওসাফের এমন যত্নশীল আচরণ তাকে আওসাফের সাথে সহজ হতে সাহায্য করছে।

এরপর দু’জন একসাথে নাশতা করল। দিন কেটে গেলো একে অপরকে জানার, বোঝার আর খুনসুটির মধ্য দিয়ে।

রাতের দিকে, প্রিয়ন্তি বাগানে বসে ছিল। হালকা বাতাস বইছে। আওসাফ এসে চুপচাপ পাশে বসলো।

— “কি ভাবছো?”
— “কিছু না…”

আওসাফ একটু হেসে বলল,
— “তুমি না খুব বেশি ভাবো!”

প্রিয়ন্তি মুচকি হাসল।

— “আচ্ছা, একটা কথা বলো তো?” আওসাফ জানতে চাইল।
— “কি?”
— “তুমি সত্যিই আমাকে পছন্দ কর?”

প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “জীবনের এতোকিছুর পর… আমি শুধু সুখী হতে চাই। আপনি যদি সত্যিই আমার জন্য ভালো হন, তবে ইন শা আল্লাহ, আপনাকে মন থেকে ভালোবাসবো।”

আওসাফ প্রিয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল,
— “আমি চেষ্টা করব, প্রিয়ন্তি, তোমার জীবনের সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে।”

তারপর….দু’জন একসাথে পাশাপাশি বসে রইলো কিছুক্ষণ!
______

বিয়ের পর ধীরে ধীরে নতুন জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে প্রিয়ন্তি। আওসাফ যেন একেবারেই অন্য রকম মানুষ! প্রিয়ন্তি তাকে যতটা কঠোর হবে ভেবেছিল,আসলে ততটাই কোমল আর যত্নশীল।সংসার জিনিসটা আসলে অতোটাও খারাপ না। জীবনসঙ্গী ভালো ও সঠিক হলে আর মানিয়ে নিতে পারলে সংসার সুন্দর ও সুখের।

আজ বিকেলে বাসায় কোনো কাজ ছিল না। প্রিয়ন্তি বাগানে গিয়ে বসেছিল, আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছিলো। ঠিক তখনই আওসাফ এসে চুপচাপ পাশে বসলো।

— “কি ভাবছো?”

প্রিয়ন্তি একটুও চমকালো না। কারণ গত কয়েকদিন ধরে সে বুঝে গেছে, আওসাফ যেকোনো সময়, যেকোনোভাবে এসে তার পাশে বসে পড়তে পারে।

— “কিছু না।”

— “নিশ্চয়ই কিছু একটা!” আওসাফ কৌতূহলী কণ্ঠে বলল।

প্রিয়ন্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
— “জীবনটা অদ্ভুত, তাই না?”

— “অবশ্যই। বিশেষ করে যখন তুমি আমার মতো একজন অদ্ভুত মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাও!” আওসাফ হেসে বলল।

প্রিয়ন্তিও হেসে ফেলল। আওসাফ তার হাসিটা দেখেই খুশি হয়ে গেলো।

— “আচ্ছা, তুমি এখন কেমন লাগছে? মানে… নতুন একটা জীবনে এসে?” আওসাফ জানতে চাইল।

প্রিয়ন্তি একটু ভেবে বলল,
— “ভালো… কিন্তু মাঝে মাঝে ভয় লাগে।”

— “কিসের ভয়?”

— “যদি আবার কিছু খারাপ ঘটে?”

আওসাফ গভীরভাবে প্রিয়ন্তির দিকে তাকাল।

— “আমি আছি, প্রিয়ন্তি। ইনশাআল্লাহ, কিছু খারাপ হবে না। আর যদি হয়ও, আমি তোমার পাশে থাকব।”

প্রিয়ন্তির চোখে জল চলে এলো। দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেলতে গেলো, কিন্তু আওসাফ টিস্যু এগিয়ে দিলো।

— “কান্না করার অনুমতি নেই, বুঝলে?”

প্রিয়ন্তি মাথা নাড়ল।

— “এখন চলো, ভেতরে যাই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর এক কাপ চা বানাই, তোমার জন্য!”

প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে বলল,
— “আপনি আবার চা বানাবেন?”

— “হ্যাঁ! কারণ বোকা প্রেয়সীর হাসি দেখার জন্য সবকিছু করা যায়!”

প্রিয়ন্তির মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল।

আওসাফ তার অফিস থেকে কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছে।সে আর প্রিয়ন্তি একসাথে অনেক সময় কাটাচ্ছে। তাদের সম্পর্ক দিনে দিনে আরও গভীর হয়ে উঠছে। তবে, কখনও কখনও কিছু ছোটখাটো অসঙ্গতি বা মজার মুহূর্তের মধ্যে তাদের মধ্যে হাসিঠাট্টা চলে আসে। তবে, তাদের ভালোবাসা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে।

একদিন দুপুরের খাবারের সময়, আওসাফ হঠাৎ বলে উঠলো,
— “একটা কথা কি তুমি জানো?”
প্রিয়ন্তি বলল,
— “কী কথা? বিশেষ কিছু?”
—“ তোমার জন্য কেমন জানিনা,তবে আমার জন্য বিশেষ বলতে পারো!”
—“ এমন কি হতে পারে যা…..উমমম..যা…..

প্রিয়ন্তি আরো কিছু বলবে, এমন সময় আওসাফ তাকে চোখে চোখ রেখে একটা কথা বললো,
— “তুমি কি জানো, তোমার হাসি আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিস?”

এটা শুনে প্রিয়ন্তির হৃদয়ে আবারো এক উচ্ছ্বাসের অনুভূতি জন্ম নিলো। সে জানতো, তারা একে অপরের কাছে বিশেষ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে আবারো লজ্জায় পড়ে গেলো।

খানিক বাদে লজ্জা কাটিয়ে সে আওসাফকে প্রশ্ন করলো,

—“ আপনি কি একটা কথা জানেন?”
আওসাফ প্রিয়ন্তিকে অনুকরণ করে তার মতোই উত্তর দিলো,
—“ কি কথা বিশেষ কিছু?”
প্রিয়ন্তিও আওসাফের মতোই উত্তর দিল,
—“ আপনার জন্য কি জানি না,তবে আমার জন্য বিশেষ!”
—“ কি হতে পারে…উমম..”
—“ আপনি কিন্তু আমায় নকল করছেন?”
—“ তুমিও কিন্তু আমায় নকল করছো?”

আরো কিছু মিষ্টি তর্ক করার পর দু’জনেই হেসে উঠে!

তারপর, দিনগুলো আরও সুন্দরভাবে কাটতে থাকে। দুজনেই নিজেদের মধ্যে আরও অনেক ভালো মুহূর্ত তৈরি করতে থাকে। এমনই এক শান্ত, সুন্দর জীবনে তাদের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।
______
বিয়ের কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে। প্রিয়ন্তির মনে এখন আর কোনো সংশয় নেই। আওসাফ ধীরে ধীরে তার ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। সে জানে, আওসাফের ভালোবাসা নিছক কথার বাহার নয়—এটা একেবারে সত্যিকারের, গভীর অনুভূতি।

আজ রাতের আকাশটা চমৎকার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছিল প্রিয়ন্তি। হালকা বাতাস তার ওড়নাটা উড়িয়ে দিচ্ছিল। এমন সময় পেছন থেকে আওসাফ এসে দাঁড়ালো।

— “আবার কী ভাবছো?”

প্রিয়ন্তি মুচকি হাসলো।

— “তুমি সব সময় ভাবতে দেখলেই প্রশ্ন করো কেন?”

— “কারণ তোমার চিন্তাগুলো জানার অধিকার আমার আছে!”

প্রিয়ন্তি চুপ করে রইলো। সত্যিই তো! তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের অংশীদার এখন আওসাফ।

— “তাহলে বলো, কী ভাবছিলে?”

— “ভাবছিলাম… এই জীবনটা কেমন বদলে গেলো। কিছুদিন আগেও মনে হতো, আমার জীবনে ভালো কিছু আর আসবে না। কিন্তু তুমি… তুমি প্রমাণ করেছো, জীবনে ভালোবাসা এখনো আছে।”

আওসাফ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রিয়ন্তির দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলল,

— “তুমি জানো, প্রিয়ন্তি? আমি তোমার জীবনে আসিনি তোমাকে পাল্টে দিতে। আমি এসেছি তোমাকে বুঝতে, তোমাকে আগলে রাখতে, তোমার পাশে থাকার জন্য।”

প্রিয়ন্তির চোখে অশ্রু চিকচিক করছিল। কিন্তু এবার সেটা ছিল সুখের অশ্রু।

— “তুমি কি জানো, আওসাফ?”

— “কি?”

— “তোমার জন্য আমার হৃদয়ে একটা অনুভূতি তৈরি হয়েছে… খুব গভীর, খুব সুন্দর!”

আওসাফ মৃদু হেসে বলল,

— “কী অনুভূতি?”

প্রিয়ন্তি এবার আর কিছু বলল না। শুধু ধীরে ধীরে আওসাফের কাঁধে মাথা রাখল। আওসাফও আস্তে করে তার হাতের মুঠোয় প্রিয়ন্তির হাতটা নিয়ে শক্ত করে ধরলো। যেন পৃথিবীর কোনো ঝড় তাদের আলাদা করতে না পারে।

রাতের আকাশ সাক্ষী থাকলো, দুটি হৃদয়ের মিলনের—একটা সম্পর্কের যা শুধু কাগজের চুক্তি নয়, বরং মায়ার বন্ধনে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকা এক ভালোবাসার গল্প।

সমাপ্ত!