#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_২৭
#জান্নাত_সুলতানা
-“মাই বিউটিফুল ওমেন।”
ফিজা আঁড়চোখে দেখে আবরাজ এর মুখের দিকে। পুরুষ টার চোখে-মুখে মুগ্ধতায় ছেয়ে আছে। ঠোঁটে জোড়া যেন হাসে। ফিজা আবরাজ এর বুকের উপরিভাগে স্বেচ্ছায় অধর ছুঁয়ে দেয়। আবরাজ চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে। ফিজা হেঁসে ফেলে। আবরাজ নিজেও রেডি হবে। তাই ফিজা ঠেলেঠুলে পাঠিয়ে দিলো রেডি হতে।
ফিজা আয়নায় নিজে কে দেখলো। আসলেই দারুণ লাগছে তাকে। বরাবর এর মতো সে নিজে নিজের প্রসংশা করতে ভুলে না। তার সৌন্দর্যই আবরাজ খান কে দুর্বল হতে বাধ্য করেছে। তা কতদিন থাকবে? মানুষ সৌন্দর্য ক্ষনস্থায়ী। এটা কি আবরাজ খান জানে না? হয়তো জানে। ক্ষণিকের মোহ হতে পারে। তবে কি তা এক সময় কেটে যাবে? হয়তো!
প্রায় দশ মিনিট এর মধ্যে আবরাজ ফিরে এলো। গায়ে তার সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা। কি চমৎকার দেখাচ্ছে সুদর্শন পুরুষ আবরাজ খান কে। পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় এই প্রথম ফিজা আবরাজ কে দেখলো। তাদের বিয়েতেও সে স্যুট পড়ে গিয়েছিল। পাঞ্জাবিতে চমৎকার মানিয়েছে বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ আঁটসাঁট লেপটে রয়েছে শরীর এর সঙ্গে।
ফিজার হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে আবরাজ এর নিকট স্বাভাবিক ঠেকালো। সে জুতো জোড়া হাতে নিয়ে সোফায় বসলো। মোজা জোড়া ফিজার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে নিলো। এরপর লোফার গুলো পড়ে ওঠে এসে ফিজার পাশে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। লাল টকটকে শাড়ী। পাশে দাঁড়ানো সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক সুদর্শন পুরুষ। ফিজার মনে মনে আওড়াল,
-“মাশা-আল্লাহ।”
আবরাজ চকচকে একটা ঘড়ি বক্স থেকে বেড় করে ঘড়ি টা হাতে দিলো। ফরসা হাতের পশমের আনাগোনায় ভরপুর। বেশ আকর্ষণীয় লাগে দেখতে। ফিজা তাকিয়ে দেখে নিলো। আবরাজ আজ চুলে জেল দিলো না। শুধু সিরাম দিয়ে চুল পরিপাটি করে নিলো। মুখেও কিছু দিলো। সব শেষ হাতে নিলো পারফিউম। রেডি হয়ে বউয়ের কপালে চুমু খেলো নিজের অজান্তেই। এরপর হাত টা ধরে বেরিয়ে এলো রুম থেকে।
নিচে আজ ফিজা একবার ও আসে নি। আসার প্রয়োজন পরে নি। সকালের ব্রেকফাস্ট রুমে দিয়েছে সার্ভেন্ট। মূলত শাশুড়ী রুমে গিয়ে দেখা করেছেন। সেইজন্য আর নিচে আসার দরকার পরে নি। আবরাজ ও সাথে সাথে ছিলো আজ। তাই সুযোগ ও হয় নি। এখন নিচে এসে ফিজা চমকে গেলো। পুরো বাড়ির শেইপ বদলে গিয়েছে। ডেকোরেশন দু’দিন নাগাদ হচ্ছিল। ফিজা ভাবে নি এভাবে এতো সুন্দর করে আবরাজ সব কিছু আয়োজন করবে। ফিজার মা মোহিতা বেগম নিজের মেয়ের সুখে সুখী। এখন ছোট মেয়ে কে ভালো একটা ছেলে দেখে দ্রুত বিয়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হতে চান। ঘটকের সাথে শীগ্রই কথা বলবেন। মেয়ে যে দেখতে মাশা-আল্লাহ সুন্দরী ভালোই হয়েছে তা তো তিনি খেয়ালই করে নি। দুই মেয়ে কে শাড়ী পড়া অবস্থায় একসাথে দেখে একজন আরেকজনের কপি মনে হলো। পার্থক্য টা শুধু একজন ছিমছাম গড়নের আরেকজন একটু নাদুসনুদুস। দু’জন কেই চমৎকার লাগছে। মন ভরে দো’আ করলেন মেয়েদের সুখের জন্য। ফিজা মা, শাশুড়ী, শ্বশুর সবার সাথে আগে কথা বলে গেলো। আবরাজ এরপর তাকে নিয়ে আস্তে আস্তে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। ফিজা খেয়াল করে দেখলো তেমন কেউ ওর দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে না। অফিসের স্টাফ বা আবরাজ এর ফ্রেন্ড। ফিজার ভালোই লাগলো। তবে ভালো লাগা দূর করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। যখন তৃণা সহ জুনায়েদ কবির কে দেখলো। ভদ্রতার খাতিরে কুশলাদি সারল মাত্র। তৃণা কে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না আবরাজ। যেটা নজরে পরে ফিজারও ভালো লাগে। আবরাজ মিষ্টি কে ডেকে ফিজা কে নিজে যেতে বললো। ফিজার নিজের ও অস্বস্তি হচ্ছিল। সুযোগ পেয়ে সেটা হাত ছাড়া করে না। ভালো লাগলো আবরাজ এর বউয়ের প্রতি কেয়ারিং হচ্ছে। ফিজা মিষ্টির সাথে চলেই যাচ্ছিলো। তখন পেছন থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,
-“মিস উফস্ সরি মিসেস আবরাজ খান আপনার ইয়ার রিং এটা?”
ফিজা পেছন ফিরে দেখলো জুনায়েদ এর হাতে ওর কানের দুল টা। নিজের কানে বাঁ হাতে চেক করে দেখলো বাঁ কানে জিনিস নেই। ফিজা থতমত খেয়ে হাসার চেষ্টা করলো। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলে উঠলো,
-“জি। ধন্যবাদ।”
ফিজা হাত বাড়িয়ে কানের জিনিস টা নিতে যাচ্ছিলো কিন্তু ওর আগে কেউ থাবা মেরে জুনায়েদ এর হাত থেকে সেটা নিয়ে নিলো। ফিজা দৃষ্টি ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে আবরাজ কে দেখলো। আবরাজ জিনিস টা নিয়ে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। ফিজা কে বাঁ হাতে ঠাশ করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। জুনায়েদ এর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
-“আমার বউ যার-তার হাত থেকে কিছু নিতে অভ্যস্ত নয়। তুমি বরং তোমার গার্লফ্রেন্ড কে দেখো।”
ফিজা কিছু বুঝতে পারে না। দুল টা স্বর্ণের। এভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো আবরাজ? সে বিস্ময় কিছু বলতে ভুলে গেলো। আবরাজ বউ কে নিয়ে হেলে-দুলে অন্য দিকে চলে গেলো। জুনায়েদ পেছন দাঁড়িয়ে রইলো দৃষ্টি স্থির রেখে।
তৃণা তখন নিজের ফুপিমণির সাথে কথা বলছে। মেহরিন পাশে দাঁড়িয়ে মেয়ে টাকে ভালো করে দেখে। একটু বেশি মর্ডান। তবে চেহারা সুন্দর।
তৃণা যখন আব্রাহাম এর সাথে একদম ফ্রেন্ডলি হেলে-দুলে কথা বলতে লাগলো তক্ষুণি মেহরিন মুখ ভেংচি কাটলো। বললো,
-“ঢং দেখে বাঁচি না।”
কথা টা বলেই আব্রাহাম এর দিকে নজর পড়তে দেখলো আব্রাহাম ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরিন বেচারি থতমত খেয়ে মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।
——
সেই বিকেলের পর থেকে ফিজা একটু নিস্তার পায় নি। মানুষ জন চারদিকে গিজগিজ করছে। আবরাজ এতো সময় ফিজার সাথেই ছিলো। এই মাত্র কিছু সনামধন্য ব্যাক্তি কে বাহিরে বিদায় দিতে গিয়েছে। মানুষ কিছু টা কমেছে। রাত বাড়ছে। তৃণা আসার পর গেস্ট রুমে গিয়ে ঢুকেছে মেয়ে টা আর বেরিয়ে আসে নি। আবরাজ তার সাথে কোনো কথা বলে নি। যা একটু ওই আসার পরপরই কুশলাদি করেছি। এতে তৃণা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে! পেলে পাক৷ তারই বা কি আসে যা এতে? মেয়ে মানুষ কেনো অন্যের জামাই নিয়ে টানাটানি করবে? নির্লজ্জের মতো ছেঁচড়ামি কেনো করবে? মেয়ে তো মেয়েই। তাদের আত্মসম্মান থাকবে। সেটা কেনো বিসর্জন দিতে যাবে মেয়ে! ফিজার মনে হচ্ছে তৃণা নিজের জেদের কাছে আত্মসম্মান টা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছে।
ফিজা কে ইলা বেগম সবার মাঝখান থেকে নিয়ে এলো।
সিঁড়ি বেয়ে ছেলের বউ কে নিয়ে ওপর উঠতে উঠতে বললো,
-“অনেক হয়েছে পরিচয়। রুমে গিয়ে রেস্ট করবে। নিচে আসার দরকার নেই। আমি খাবার পাঠিয়ে দেবো।”
-“শরীর গোলাচ্ছে মা। আমি আর কিছু খাব না। আপনি আপনার ছেলে কে খেয়ে নিতে বলবেন। দুপুরেও আমার সাথে খেতে বসে পরে কে যেন এলো তখন চলে গেলো।”
-“আচ্ছা। কাপড় গুলো ছেড়ে নিও। আমি কাউ কে পাঠাচ্ছি টক কিছু দিয়ে।”
ইলা বেগম অস্থির কণ্ঠে বলে উঠলো। ফিজা আঁড়চোখে তাকায় শাশুড়ির দিকে। গা গোলাচ্ছে তিনি অন্য কিছু ভেবে নিলো না-কি! ফিজা তেমন পাত্তা দিলো না। দরজার সামনে রেখে ফিজা কে ইলা বেগম চলে গেলো। ফিজা রুমের দরজায় বেশ কয়েকবার নক করলো। দরজা বন্ধ। এরমধ্যে মিষ্টি এলো সাথে মেহরিন। মিষ্টি বললো,
-“ভাবি তুমি আমার রুমে চলো। ভাইয়া রুমে যেতে এখন না করেছে।”
ফিজা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অবুঝ নয় সে৷ আবরাজ নিশ্চয়ই আবার কিছু আকাম করছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মিষ্টির সাথে চলে গেলো। ফিজা মিষ্টি দু’জনেই রুমে গেলেও মেহরিন কি মনে করে ছাঁদে গেলো। গায়ে তার সেই শাড়ী এখনো।
ছাঁদে পৌঁছাতে সিগারেটের তীব্র গন্ধ এসে নাসারন্ধ্রে পৌঁছাল মেহরিন এর।
প্রতিদিন এর ন্যায় আজও মেহরিন এর উপস্থিত আব্রাহাম টের পেলো।
কিছু সময় ইচ্ছে মতো সিগারেট ফোঁকে তবেই ক্ষান্ত হলো পুরুষ টা। মেহরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আজ ছয় মাসের অধিক সময় ধরে সে আব্রাহাম নামক এই পুরুষ টা কে দেখে এসছে। একপাক্ষিক ভালোবাসার যন্ত্রণার একরকম উদাহরণ এই পুরুষ।
মেহরিন তপ্ত শ্বাস ফেললো। তার বুকে যন্ত্রণা হয় ইদানীং এই পুরুষের কথা ভেবে। আব্রাহাম মেহেরিন এর ভাবনার মাঝে ই থমথমে কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“শোনো মেয়ে, বিয়ে করবে আমায়? রানীর মতো করে রাখবো৷ ভালোবাসতে পারবো কি-না জানি না।”
মেহরিন চমকে উঠলো। নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত। মেহরিন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভালোবাসা ছাড়া রানী করে রাখবেন?”
-“রাখবো। একবার বিয়ে করেই দেখো না।”
আব্রাহাম মেহরিন এর দিকে ফিরে বলে উঠলো। মেহরিন এর আজ যেন সাহস একটু বাড়লো বৈ কমলো না। ফের জিজ্ঞেস করলো,
-“বিয়ে মানুষ দু’বার করে?”
আব্রাহাম এদিকওদিক তাকায়। হাতের সিগারেট ফেলেছে বহু আগে। দুই কদম এগিয়ে এলো। মেহরিন এর হাত টা আচমকাই টেনে ধরে অনামিকা আঙুলে একটা রিং পড়িয়ে দিলো। মেহরিন হতভম্ব হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো পুরুষালী হাতের দিকে। তার হাত ধরে রেখেছে এখনো আব্রাহাম। ধরে রেখেই বললো,
-“বেশি ভেবো না। আমি সামলে নেবো সব।”
——–
ঘুমের ঘোরে ফিজা অনুভব করলো গলায় উষ্ণ নিঃশ্বাস। তন্দ্রা হালকা হতে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আগে নজর পড়লো আবরাজ খান কে। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে। ফিজা আস্তে করে ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো। ফুলের গন্ধ চারদিকে মৌ মৌ করছে। লাল গোলাপের সংমিশ্রণে আরো বিভিন্ন ফুলে ফুলে সজ্জিত কক্ষ। আশ্চর্য হয় সে৷ বললো,
-“এ-সব কি আবরাজ? কখন করলেন?”
-“সারপ্রাইজ।”
-“কিন্তু আমি,,,
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আবরাজ মুখ গুঁজে বউয়ের গলায়। ফিসফিস করে বলে,
-“ডো ইউ নো, আমাদের ফার্স্ট নাইট স্পেশাল ছিলো না।”
অসহ্য ছোঁয়ায় শিহরিত হলো ফিজা। মুখের খেই হারিয়ে গিয়েছে যেনো। ব্যাক্তিগত পুরুষের স্পর্শে বারবার মাতাল হয় সে। এতো অবহেলার পরে-ও সে সব ভুলে গেলো। নিজের সাথে সে কি নিদারুণ নিষ্ঠুর অন্যায় টা না করছে। ভেবেই বুকে চাপ অনুভব করলো। সুখের মূহুর্তেও বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। তবে তা ক্ষনস্থায়ী মাত্র। অবহেলায় রাখা পুরুষ যে প্রেমিক পুরুষ হচ্ছে ইদানীং। ফিজা মনপ্রাণে চাইলো এখন এর দীর্ঘ শ্বাস যেমন ভুলিয়ে দিলো তেমন করে এতো বছর এর করা অবহেলাও পুষিয়ে দিতে সক্ষম হয় যেনো এক সময়।
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#জান্নাত_সুলতানা