#মায়াকুমারী ❤
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(০২)
__________________
মায়ের ডাকে রুম থেকে বেরিয়ে এলো দ্যুতি।
“কী আম্মু?”
“নিশুকে নিয়ে একটু পার্লারে যা।”
“কেন?”
“একটা ফেসিয়াল করিয়ে আন। কী জানি বলে এইসব আমি তো জানি না। তোরা তো জানবি।”
“বুঝতে পারলাম কিন্তু কেন?”
“কেন মানে বুঝিস না কিছু?”
“ও আচ্ছা বুঝলাম।”
“যা নিশু।”
“না ফুপি।”
“কি না না! যা একটা ফেসিয়াল করিয়ে আয়।”
“এইসবের কী দরকার!”
নিশুর মুখটা মলিন।
“মেয়েটা সারাক্ষণ মুখটাকে পেঁচার মতো করে রাখে। হাসিখুশি থাকবে তা না কী মেয়ে এটা!”
বিরক্ত হোন তিনি।
“কয়দিন পর ভার্সিটিতে উঠবি এত আনস্মার্ট হলে কীভাবে হয়! এখন যা রেডি হয়ে নে।”
মলিন মুখে দাঁড়িয়ে রইলো নিশু।
“এই শুন,চুলে একটা কাটিং দিস। আর ভ্রু প্লাক কী জানি ওইসব করিয়ে আনিস।”
মায়ের কথায় দ্যুতি হাসলো।
“চিন্তা করো না আম্মু,তোমার ছেলের বউকে এই দ্যুতি দ্যুতি ছড়িয়ে ম্যাডাম ফুলি বানিয়ে আনবে জাস্ট ওয়েট!”
“আর কাজ নেই তো! কীসের ম্যাডাম ফুলি!”
“আমার উপর ছেড়ে দাও আম্মু। কচকচে কয়েকটা বড় নোট বের করো তাড়াতাড়ি!”
“মেয়েটা আছে শুধু ধান্দা করার বেলায়।”
“ওহ আম্মু! একটু হালাল ইনকামই তো! প্লিজ করতে দাও!”
“তোর ইনকামের গুষ্টি!”
“টাকা দাও জলদি।”
বিরক্ত হয়ে আলমারির ড্রয়ার খুলে টাকা বের করে দিলেন।
“নে তোর হালাল ইনকাম।”
“থ্যাংক ইউ আম্মু। এই নিশু দ্রুত রেডি হয়ে নে।”
“নিশু বলে ডাকিস কেন ভাবী ডাকবি।”
“আমরা তো সমবয়সী।”
“যা-ই হোক! নিশু তোর বড় ভাইয়ের বউ। সম্পর্কে ভাবী। সমবয়সী হলেও সম্পর্ক এবং সম্মানের দিক দিয়ে সে তোর বড় তাই ভাবী বলে ডাকবি। তোরা যদি নাম ধরে ডাকিস তাহলে তোর ভাইয়ের মনে বউ বউ ফিলিংস আসবে কীভাবে বল?”
খিলখিল করে হেসে উঠলো দ্যুতি।
“তাই তো! এটা তো কখনো ভাবিনি আম্মু! ওমা আমার আম্মু কত রোমান্টিক!”
মায়ের গালগুলো টিপে দিলো।
“নিশু তোর রোমান্টিক শ্বাশুড়ি!”
“ভাবী ডাকবি। তোর ভাইয়ের সামনে বেশি বেশি করে ডাকবি। দেখবি বউ বউ ফিলিংস আসবে। কতদিন আর ওইভাবে দেবদাস হয়ে থাকবে!”
“ওরে আমাদের বান্ধবী আম্মু।”
দিলরুবা খাতুন হাসলেন।
“আম্মু আজ থেকে তুমি আমাদের বেস্টফ্রেন্ড ওকে!”
“এখন যা। আমার রান্নাবান্না নষ্ট হচ্ছে।”
“বেশি বেশি ভাবী ডাকার জন্য আরো পাঁচশ টাকা দাও আম্মু।”
“আর এক টাকাও নেই।”
“আছে আমি দেখেছি।”
“বললাম তো নেই।”
“দাও বলছি নয়তো যাবো না।”
বিরক্ত হয়ে আরো পাঁচশ টাকা দিলেন।
“এই মেয়েটাও না বদের হাড্ডি!”
“তোমার মেয়ে তো!”
“হাঁসের মতো প্যাক প্যাক কম করিস। শোন আসার সময় টেইলর্স যাবি।”
“কেন?”
“নিশুর ব্লাউজ-পেটিকোটের মাপ দিয়ে আসিস।”
“আচ্ছা।”
রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল ওরা। সেদিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা বন্ধ করে কিচেনে ঢুকলেন।
“খালা আপনের মতো শ্বাশুড়ি পাইতে ভাইগ্য লাগে। এমন শ্বাশুড়ি জিন্দেগীতে দেহি নাই।”
মলিন হাসলেন দিলরুবা খাতুন। ছাঁদ থেকে নামলো ধ্রুব। দেখল তার মা ব্যস্ত হয়ে রান্না করছে। কিছু বললো না লিভিং স্পেসে এসে বসল। ছেলেকে দেখে চুলার আঁচ কমিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে এগিয়ে গেলেন।
“বাবা কিছু লাগবে তোমার?”
“ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিল।”
“বলো।”
“পরে।”
“সমস্যা নেই বলো।”
“বাবা কী বলেছে?”
“তোমার সাথে উনার কিছু জরুরি কথা আছে।”
ভ্রু কুঁচকায় ধ্রুব।
“কীসের?”
“সেটা তোমার বাবার সাথে আলাপ করে নিও।”
নীরব রইলো ধ্রুব।
“চা-কফি কিছু খাবে?”
“না।”
রুমের দিকে পা বাড়াল ধ্রুব।
___
পার্লারে পৌঁছালো ওরা। নিশুর জন্য একটা প্যাকেজ নিয়ে নিলো। ফেসিয়াল সহ পেডিকিওর,মেনিকিওর,ভ্রু ঠিক করলো,তারপর চুলের মধ্যে সুন্দর একটা কাটিং দিলো। পুরো লুক বদলে গেল নিশুর। অবাক হয়ে দ্যুতি তাকিয়ে রইলো। হাত-মুখ চকচক করছে। ফেসিয়ালটা নেওয়ায় নিশুর মুখে গ্লো এসেছে দ্বিগুণ। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা। তারপর টেইলর্স দোকানে গিয়ে নিশুর ব্লাউজ-পেটিকোটের মাপ দিয়ে বেরুলো ওরা। ততক্ষণে প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। ফুটপাতে ফুচকাওয়ালাকে দেখতেই উল্লসিত হলো দ্যুতি।
“নিশু ফুচকা খাব চল।”
“ফুটপাতের ফুচকা ভালো না। পেট খারাপ হবে। আর জানিসই তো আমি ফুচকা পছন্দ করি না।”
“একদিন খেলে কিছু হবে না।”
“তুই খা আমি খাব না।”
“মামা রিকশা থামান।”
ভাড়া মিটিয়ে ফুচকাওয়ালার কাছে গেল।
“মামা এক প্লেট ফুচকা দিন।”
আশেপাশে তাকালো নিশু।
“নিশু তুই কী খাবি?”
“কিছু না।”
“না করিস না।”
“তুই তো জানিস..”
“বার-বার এক কথা বলিস না। ঝালমুড়ি খাবি?”
“না।”
“মামা বিশটাকার ঝালমুড়ি দেন তো।”
বিরক্তিকর চোখে তাকালো নিশু।
“পেট খারাপ হলে তোর খবর আছে।”
“সমস্যা নেই তোর জামাই তো আছে,সে তোকে নিয়ে হসপিটালে দৌঁড়াবে।”
“তোর মাথা।”
ফুচকা খেতে লাগলো দ্যুতি। ঝালমুড়ি নিলো নিশু।
“মামা আরেকটু ঝাল দেন।”
“হ বেশি বেশি ঝাল খাও এরপর বড়ঘর আর ছোটঘরে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে পারবা।”
চমকে তাকায় দু’জন। ভয়ার্ত চোখে তাকাল নিশু।
“জরিনার মা কী খবর?”
তেঁতে গেল দ্যুতি। এই বখাটে অনিক কথায় কথায় তাকে জরিনার মা বলে।
“আপনার মাথা।”
“জরিনার খালা কী খাও?”
আতঙ্কিত চোখে তাকায় নিশু। শ্বাস আঁটকে দাঁড়িয়ে রইলো। নিশুর হাত থেকে ঝালমুড়ির প্যাকেট টেনে নিয়ে খেতে লাগলো অনিক।
“এই আপনি নিশুর ঝালমুড়ি নিলেন কেন?”
“জরিনার মা চুপ থাকো।”
“এখন আপনি আমাদের বিল দিবেন।”
“দিব সমস্যা কী!”
“চল নিশু।”
“জরিনার খালা শোনো। একটু থাকো।”
“রুচি নেই!”
“সখিনার মা বড্ড বাড়ছো।”
“যত্তসব ফাউল। নিশু আয়রে!”
রিকশা ডেকে দ্রুত উঠে পড়লো ওরা। এই অনিক বখাটে তাদের দেখলেই হলো,জরিনার মা,সখিনার মা এইসব ডাকবে। যত্তসব!
___
বাসায় ফিরল দু’জন। দরজা খুললো ধুসর। নিশুর দিকে চোখ পড়তেই তাকিয়ে রইলো। কেমন জানি চকচকে একটা ভাইব এসেছে। চোখ সরাতে পারলো না। অস্বস্তি হলো নিশুর। ধূসর সারাক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে তার ভীষণ অস্বস্তি হয়। ধূসর বুঝেও যেন ইচ্ছে করে এমনটা করে। হয়তো তাকে বিব্রত করতে।
“কোথায় গিয়েছিস তোরা?”
“তোমাকে বলব কেন?”
ভাইকে ঠেলে ভিতরে ঢুকল দ্যুতি। মাথা নুয়ে নিশুও ঢুকল। সেই মুহূর্তে ধীরাজ এসে ঢুকল।
“ওরা দু’জন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেয়েছে ভাইয়া।”
তেঁতে গেল দ্যুতি।
“তাতে তোর বাপের কী?”
শক্ত চোখে তাকালো ধূসর।
“আজ আবারও রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেয়েছিস?”
“খেয়েছি তাতে তোমার কী?”
“ভাইয়া,অনিক বখাটেও ছিল ওদের সঙ্গে।”
চোয়াল শক্ত করে তাকালো নিশুর দিকে। আতঙ্কিত হয় নিশু। বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করতে লাগলো।
“ওরে আমরা ডাকছি নাকি! ওতো বখাটে। বখাটেদের কাজ হচ্ছে সবজায়গা বিচরণ করা। তেলাপোকা একটা।”
“তুই তেলাপোকা একটা।”
তর্কবিতর্ক শুরু হলো দ্যুতি আর ধীরাজের মধ্যে। সামনের বছর নিউ টেনে উঠবে ধীরাজ। ভাইবোনের বাকবিতন্ডা শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলো ধ্রুব। তাকে দেখতেই আড়াল হয়ে গেল নিশু। ভয়ে বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করলো।
“কী হয়েছে?”
“কিছু না।”
গম্ভীর মুখে বললো ধূসর। ধীরাজকে বলল,”তুই স্কুল থেকে চলে এলি কেন?”
“আজ বৃহস্পতিবার জানো না!”
“এখন আর পণ্ডিতি না করে রুমে যা।”
ধীরাজের মাথায় গাট্টা মে’রে বললো দ্যুতি। রুমের দিকে পা বাড়াল ধ্রুব।
“নিশু! নিশু! নিশু কইরে!”
“জ্বী ফুপি।”
“এদিকে আয়।”
রুমের দিকে নিয়ে গেলেন।
“মাশা-আল্লাহ! তোকে এখন সুন্দর লাগছে!”
লাজুক হাসলো নিশু। চুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন।
“সুন্দর হয়েছে। লম্বা চুলে তোকে ভালো লাগে। আমার তো চিন্তা হচ্ছিল না জানি সত্যি তোকে ম্যাডাম ফুলি বানিয়ে আনে মেয়েটা।”
বিছানার উপর থেকে বেশ কয়েকটা বক্স আনলেন।
“তোর আব্বু (ফুপা) দেখ তোর জন্য কতগুলো শাড়ি কিনেছেন।”
নিশু তাকায়।
“কি সুন্দর! একেকটা একেক রঙের। প্রতিদিন একেক রঙের একটা পরবি বুঝলি?”
মাথা নাড়ায় নিশু।
“একটু সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাকিস। ধ্রুবর আশেপাশে ভিড়িস। টুকটাক কথা বলিস। কী লাগবে জিজ্ঞেস করিস। দূরে দূরে থাকলে কেমনে কী! সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা দরকার! পুরুষ মানুষ নয়তো অন্যদিকে চোখ চলে যাবে।”
মলিন হাসলো নিশু।
“এখন গোসল সেরে শাড়ি পরবি। সুন্দর করে সেজেগুজে চুলগুলো খোলা রাখবি। চুল বাঁধিস না। খোলা চুলে তোকে ভালো লাগে।”
আড়ষ্ট হয় নিশু। তার ফুপি খেয়াল ও রেখেছে তাকে কীভাবে দেখতে ভালো লাগে।
“এগুলো নিয়ে যা। রান্না হয়ে গেছে। গোসল সেরে নামাজ আদায় করে খেতে আয়। আমিও গোসল করতে যাচ্ছি।”
সায় দিয়ে শাড়িগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেল নিশু। গোসল সেরে রুমে ঢুকল। সবগুলো সুতির তাতের শাড়ি। মণিপুরী শাড়িও আছে কয়েকটা। নিশু লাল কমলা কালারের একটি মণিপুরি শাড়ি পরে নিলো। শাড়িটা এত সুন্দর লাগছিল নিশুর চোখে। আয়নায় দেখল সত্যি তাকে দারুণ লাগছে! আচ্ছা ধ্রুব কি তাকে পছন্দ করবে এইরূপে দেখে? রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখে। ব্যালকনি থেকে এলো দ্যুতি।
“মাশা-আল্লাহ! মাশা-আল্লাহ! কি অপূর্ব! তোকে সত্যি বউ বউ লাগছে নিশু! স্যরি ভাবী!”
ভাবী বললে লজ্জা পায় নিশু।
“আমার ভাই তোকে দেখলে পাগল হয়ে যাবে।”
দ্যুতির দিকে তাকায়। সত্যি কি তাই? কিন্তু নিশুর বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছে। ঘূর্ণন হচ্ছে,টর্নেডো বয়ে যাচ্ছে অস্থিরতায়। উষ্ণ স্রোত বয়ে যাচ্ছে হৃদয় অলিন্দে। মানুষটা কি একটু পরিবর্তন হয়েছে? নাকি আগের চাইতেও রাগী হয়েছে? কি জানি! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে রইলো। সেদিন যখন নিশুকে বিয়ে করতে বলেছিল তখন পনেরো বছর বয়সী ধ্রুব বজ্রপাতের মতো তেঁতে উঠেছিল। কিছুতেই বিয়ে করবে না দশ বছর বয়সী নিশুকে। নিশু দেখতে আহামরি সুন্দরী ছিল না তখন। বাবা-মায়ের অনাদরে,অবহেলায়,অযত্নে এবং দীর্ঘদিনের অভুক্ত অনাহারে ছোট্ট নিশুর হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। হাড়জিরজিরে নিশুর দিকে তাকালেও ধ্রুবর গা গুলিয়ে আসতো। তারপর ছোট্ট ছোট্ট চুল,ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড়,শরীরে কতশত মারধরের দাগ। শুধু রূহটা ছিল ওইটুকুন শরীরে। আসা-যাওয়া করতো। ফুপি যদি সেদিন জিদ করে তাকে পুত্রবধূর করে না আনতো আজ সত্যি নিশু নামক কেউ থাকতো না পৃথিবীর বুকে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এখন মানুষটার কথা শুনলেই তার ভীষণ ভয় লাগে।
“নিশু খেতে আয়!”
ফুপির ডাকে ধ্যান ভাঙ্গলো নিশুর। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অশ্রু মুছে নিলো শাড়ির আঁচলে। লাল কমলা রঙের শাড়ির সঙ্গে চোখ ভরে কাজল লাগালো। ঠোঁটে একটু গোলাপি রঙের লিপস্টিক। গলায় সোনার চেইনটা। আর কানে সোনার ছোট্ট ছোট্ট ঝুমকো জোড়া পরে নিলো। একপলক তাকালো আয়নায়। সত্যি খারাপ লাগছে না,ভালো লাগছে; মায়াবী লাগছে।
“দ্যুতি তোর কথা বলা শেষ হয়েছে?”
“আর একটু।”
“ফুপি ডেকেছে আয়।”
ফোন রাখল দ্যুতি।
“চল।”
ড্রাইনিংয়ে সবাই বসেছে। কিন্তু নিশুর লজ্জা লাগছে সাথে ভয়ও।
“নিশু এসেছিস?”
“জ্বী।”
নিশুর দিকে চোখ পড়লো ধূসরের। চোখ সরাতে পারলো না। শাড়িতে এত সুন্দর লাগলো মেয়েটাকে।
“জগটা খালি। ফিল্টার থেকে জগটা ভরিয়ে আন।”
“আচ্ছা।”
নিশু ইন্ট্রোভার্ট। চুপচাপ আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। তাই দিলরুবা খাতুন ওটা-সেটার কথা বলে এক্টিভ রাখেন। নয়তো নিশু যেই টাইপের মেয়ে ঘূর্ণিঝড়েও তাকে বোধহয় উড়িয়ে নিতে পারবে না ঘাপটি মে’রে বসে থাকবে। ফিল্টার থেকে জগ ভরিয়ে টেবিলের উপর রাখল। নিশুর দিকে তাকায় ধূসর। গলায় সোনার চেইনটা চকচক করছে। কেন জানি দেখতে আকর্ষণীয় লাগল। আশ্চর্য! মেয়েরা গলায় সোনার চেইন পড়লেও বুঝি আকর্ষণীয় লাগে! লাগে তো! নিশুকে লাগছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে ধূসর। লক্ষ্য করলেন দিলরুবা খাতুন।
“ধূসর কী দেখিস?”
হকচকিয়ে দৃষ্টি সরায়।
“কিছু না।”
“নিশুকে আজ খুব সুন্দর লাগছে তাই না?”
“হুম।”
“নিশু ধ্রুবকে ডেকে আনতো যা।”
আতঙ্কিত চোখে তাকায় নিশু। আমতা আমতা করলো।
ধূসর বলল,”দ্যুতি ভাইয়াকে ডেকে আন যা।”
“নিশুর জামাই ও যাক।”
“যেতে বলেছি।”
বাধ্য হয়ে তাই করে দ্যুতি। বুকের মধ্যে কম্পন টের পাচ্ছে নিশু। সারা শরীর কাঁপতে লাগলো অস্বস্তিতে। ধূসর তাকিয়ে রইলো। নিশুর প্রতিক্রিয়া দেখছে সে। রুম থেকে বেরুল ধ্রুব। ধ্রুবকে দেখতেই দ্রুত ছুটে আড়ালে চলে গেল নিশু। সেদিকে তাকিয়ে রইলো ধূসর।
“এটা কী ছিল?”
খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললো দ্যুতি।
“ও এমন করলো কেন?”
ধূসর বলল,”কে?”
“আর কে নিশু।”
চেয়ারে বসলো ধ্রুব।
ধূসর বলল,”কী করেছে?”
“পালিয়ে গেছে। যেন বন্য নেকড়ে আসছে তার দিকে।”
“নিশু! নিশু! নিশু কইরে!”
ডাকতে লাগলেন দিলরুবা খাতুন।
“নিশু কে?”
চমকে ধ্রুবর দিকে তাকালো সবাই। অপ্রস্তুত হলো ধ্রুব।
“সবাই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”
দ্যুতি বলল,”নিশুকে চিনো না?”
“নিশু কে?”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় নেত্রে তাকালো সবাই। ধীরাজ বলল,”আশ্চর্য! তুমি তোমার বউকে চিনো না ভাইয়া?”
“বউ!”
ধ্রুবর আচরণ অস্বাভাবিক লাগলো। মনঃক্ষুণ্ন হলেন দিলরুবা খাতুন।
“নিশু খেতে আয়।”
সাড়াশব্দ শোনা গেল না। খাবার সার্ভ করলেন সবাইকে। ফুপির রুমে বসে রইলো নিশু। সেদিকে গেলেন তিনি।
“তোকে ডেকেছি না!”
আতঙ্কিত চোখে তাকায় নিশু। আমতা আমতা করলো। হাত ধরে বললেন,”চল একসঙ্গে খাব।”
“না ফুপি তোমরা খাও। আমি পরে খাব।”
“আরে আয়।”
হাত টানতেই আতঙ্কিত গলায় বলল,”আমার ভয় করছে ফুপি! উনি আমাকে দেখলে মা’রবেন!”
“পাগল মেয়ে! এখন তোরা বড় হয়েছিস মা’রবে কেন! তখনকার পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল এখন বদলেছে; আগের মতো নেই।”
“তবুও আমি যাব না মাফ করে দাও।”
চোখে-মুখে আতঙ্ক নিশুর। মায়া হয় দিলরুবা খাতুনের। রাগ করে বেরিয়ে এলেন। বুক ধরে হাঁফাতে লাগলো নিশু।
“ধূসর তুই কি বিকেলে কোথাও যাবি?”
“হ্যাঁ কেন?”
“যাওয়ার সময় একটু টেইলর্সের কাছে যাস তো।”
“কেন?”
“নিশুর ব্লাউজ-পেটিকোটের কাপড়গুলো দিয়ে আসিস।”
“আচ্ছা দিও।”
ধূসরের দিকে একপলক তাকিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো ধ্রুব।
“নিশু আমার শার্ট-প্যান্টগুলো ছাঁদ থেকে এনে আয়রন করে রাখতো।”
শুনতে পেলো নিশু। তাহলে তখন ছাঁদে কি নিশু গিয়েছিল? বড় করে ঘোমটা টেনে কম্পিত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো নিশু। দৃষ্টি পড়লো ধ্রুবর। কমলা রঙের শাড়ি মুখ দেখা গেল না। ও তারমানে ওটাই নিশু! চেহারা দেখার ইচ্ছে তারও নেই। নিশ্চয়ই সেই ছোটকালের মতো দেখতে। বিতৃষ্ণা জাগলো। দ্যুতি বলল,”তুমি সারাক্ষণ ভাবীর হাতে কাজ করাও কেন?”
ভাবী শব্দটা শুনতেই চট করে তাকালো ধ্রুব।
“ভাবী! ভাবী কে?”
“তোমার বউ নিশু ভাবী আরকি।”
চোয়াল শক্ত হয় ধ্রুব। কীসের বউ! কীসের ভাবী! সে বউ হিসেবে মানে নাকি! ধূসর বলল,”তাতে তোর কী?”
“আমার অনেক কিছু! তুমি আরেকজনের বউকে দিয়ে কাজ করাও কেন? কাজ করাবে তো তার স্বামী! আমার বড় ভাইয়া! ধ্রুব ভাইয়া।”
স্বামী! স্বামী শব্দ শুনতে কেমন জানি লাগলো ধ্রুবর। সত্যি কি সে নিশুর স্বামী? আর নিশু কি তার বউ? হ্যাঁ বউ তো! পনেরো বছর বয়সে তিন কবুল বলে নিশুকে বিয়ে করেছে সে। তারপর সেদিন এলাহীকাণ্ড বাঁধিয়েছিল। আজীবন শুনেছিল মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেয় কিন্তু সে ছেলে হওয়ার পরেও তাকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। বাবা-মা এবং নিশুর উপর জিদ করে সব ছেড়েছুঁড়ে হোস্টেলে উঠেছে। আটটি বছর সে আর কারো সামনে আসেনি। আড়ালে রয়েছিল। তারপর পড়াশোনায় ফোকাস করলো। তার ইচ্ছে ভালো রেজাল্ট করে বিদেশ চলে যাওয়া। এরপর নিশুকে তার জীবন থেকে বিদেয় করা। নিশু তার চরম শত্রু! তার বাল্যকালের শত্রু! তার স্বাধীনতা হরণ করার শত্রু! ওই নামটা কি এত সহজে ভোলা যায়? না যায় না! সে নিশুকে যতটা ঘৃণা করে তার চেয়ে বেশি ঘৃণা করে তার নামটিকে। এই নামটিই তার জীবনের আতঙ্ক! অভিশাপ! অভিশপ্ত অন্ধকার এক অধ্যায়। নিশু নাম আর মানুষটাকে ভুলার জন্য সব করেছিল সে। এই নাম তার জন্য একটি আতঙ্কের নাম! রোগ অসুখ-বিসুখের নাম! চোয়াল শক্ত করে খাবার অসমাপ্ত রেখে উঠে গেল ধ্রুব।
“কী হলো খাবি না?”
“খেয়েছি।”
“ভালো হয়নি?”
“হয়েছে?”
“তো উঠে গেলি কেন?”
প্রতিত্তোর করলো না। দ্রুত রুমে ঢুকে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। একটা সিগারেট ধরালো।
______
চলবে~