মায়াকুমারী পর্ব-০৫

0
1069

#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(০৫)
__________________

চিন্তায় ঘুমাতে পারলেন না দিলরুবা খাতুন। প্রাপ্তবয়স্ক তিনটি ছেলে এক বাসায়। নিশু সেখানে একা। ভীষণ টেনশন হচ্ছে। কোন অঘটন ঘটে আল্লাহই জানে!

“দিলরুবা ঘুমাওনি?”

“ঘুম আসছে না।”

“কেন?”

“মেয়েটা বাসায় একা।”

“টেনশন করো না ওরা তো আছে।”

“প্রাপ্তবয়স্ক তিনটা ছেলে এক বাসায়। ধীরাজ কি এখন আর ছোট আছে নাকি!”

“ফোন করে বলে দাও তোমার ছেলেকে।”

ল্যাপটপে কাজ করছে ধ্রুব। হঠাৎ ভাইব্রেট করে উঠলো ফোন।

“হ্যালো মা।”

“বাবা ঘুমিয়েছ?”

“না।”

“নিশু একা টেনশনে আমার ঘুম হচ্ছে না।”

“টেনশেনের কী আছে ঘুমাও।”

“বাবা তুমি আর রাগ করে থেকো না। যা হয়েছে হয়ে গিয়েছে আল্লাহর ইচ্ছায়। তোমার কপালে নিশু ছিল তাই যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়েছে। হয়তো একটু ব্যতিক্রম হয়েছে,এতে তোমার মতামত ছিল না মা তো সব বুঝি। কিন্তু বাবা তখন কিছু করার ছিল না। বাবা-মাকে ভুল বুঝে আর থেকো না। আর কত বছর জেদ,অভিমান পুষে থাকবে?একটু কোমল হও। মেয়েটা এতিম। আমরা ছাড়া মেয়েটার আর কেউ নেই। বাবার বাড়ি দু-দিন গিয়ে থাকতে পারে না সৎ মা এবং ভাই-বোনদের অত্যাচার আর কোণঠাসা মার্কা কথায়। তুমি আপন স্বামী হয়ে মেয়েটাকে দীর্ঘ আট বছর অবহেলা করেছ আর কত করবে?”

নীরব রইলো ধ্রুব। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মেয়েটার কথা শুনলেই তার মেজাজ গরম হয়ে যায়।

“এইসব বলার জন্যই কি ফোন করেছ?”

“নিশুর কাছে যাও বাবা। নিশু তোমার স্ত্রী। ওকে মেনে নাও। বাসায় তোমরা প্রাপ্তবয়স্ক তিনজন। আমার টেনশন হচ্ছে। নিয়ে আসতাম তোমার ফুপিরা পছন্দ করে না বিধায় আনলাম না।”

“আচ্ছা রাখি।”

“ধ্রুব! বাবা যাও নিশুর কাছে যাও।”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সুইচড অফ করে ছুঁড়ে ফেললো। বিছানা থেকে উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরালো। লম্বা লম্বা সুখটান দিয়ে ধোঁয়াগুলো উড়িয়ে দিতে লাগলো আকাশের দিকে। বার কয়েক ফোন করলেন কিন্তু সুইচড অফ পেলেন। বুঝতে পারলেন রেগে গিয়েছে ছেলে। ফোন করলেন ধূসরকে। কিছুক্ষণ পর নক পড়লো নিশুর ডোরে। হকচকিয়ে ডোর খুলতেই চমকালো।

“ধর তোদের ফোন। মা কল দিবে।”

“আচ্ছা।”

ফোনটি হাতে নিলো নিশু। একপলক তাকায় নিশুর দিকে। চুলগুলো খোলা আর এলোমেলো হয়ে আছে। কেন জানি নিশুকে ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে। আর জাম কালারের জামদানি শাড়িটায় এত্ত স্টানিং একটা লুক এসেছে যতবার যেভাবে দেখছে ততবারই মুগ্ধ হচ্ছে। চেহারায় অনেক মায়া আছে মেয়েটার। দেখলেই নজর সরানো যায় না। আরেকটা ব্যপার হচ্ছে,অতি সাধারণ সাজেও অসাধারণ লাগে মেয়েটাকে। হ্যাঁ হয়তো মারাত্মক সাদা সুন্দরী নয় নিশু কিন্তু তার মতো এই রকম স্নিগ্ধ সুন্দর কোমল চেহারার,টানা টানা ডাগর ডাগর সুন্দর চোখের,সুন্দর হাসির মেয়ে বোধহয় এই এশিয়া মহাদেশেও নেই। তবে মেয়েটাকে দেখলে মনে আলাদা শান্তি লাগে,তাকে দেখলেই অশান্ত মনও হুট করে শান্ত হয়ে যায়,মনখারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যায়। শুকনো ঢোক গিলে বেরিয়ে গেল ধূসর। ডোর অফ করলো নিশু। দ্যুতি আর ওকে এই ফোনটা কিনে দিয়েছে ধূসর। দু’জনেই একটা ফোন ইউজ করে। নিশুর তেমন একটা ফোন লাগে না তবে মাঝেমধ্যে চাইনিজ,কোরিয়ান,তামিল আর পাকিস্তানি ড্রামাগুলো দেখে দু’জন মিলে। আর তাকে ফোন করবেটা কে? না বাবা,না মা আর না স্বামী কেউ না। তাই লাগে না। দু’জনকেই চাইলে ফোন দেওয়া যায় কিন্তু ধূসর চায় না ওরা পড়াশোনা রেখে ফোনে আসক্ত হোক! এই তো দ্যুতি সারাদিন ফোন দেখে। অনিকের সাথে চ্যাট করে। নিশুকে ফোন দিলে সেও যে এমনটা করবে না তার কী গ্যারান্টি? টিনএজ মেয়ে। আজেবাজে ছেলেদের সঙ্গে জড়াতে কতক্ষণ! ফোন করলেন দিলরুবা খাতুন।

“হ্যালো ফুপি!”

“নিশু ধ্রুবর কাছে যা।”

নীরব রইলো নিশু।

“লজ্জা কিংবা ভয় পাওয়ার কী আছে তোর স্বামী তো!”

আমতা আমতা করলো নিশু।

“যদি ধ্রুব আসে তো দরজা খুলিস। আজেবাজে কিছু বলিস না। যা বলে মন যুগিয়ে করিস। তোদের সম্পর্কটা ঠিক করা উচিত। আর কতদিন এভাবে থাকবে।”

নীরব রইলো নিশু।

“কী বলেছি বুঝেছিস?”

“জ্বী।”

“আচ্ছা রাখি সাবধানে থাকিস!”

সে-তো বার দুয়েক গেল কিন্তু লোকটাই তো তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাহলে সে কেন বার-বার সস্তা হতে যাবে?সেও যাবে না। একা লোকটার মতামতের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিয়েছে তাকে দেয়নি?সেও তো তখন পরিস্থিতির কাছে নিরুপায় ছিল। আজ যদি ফুপি বউ করে না আনতো রাস্তার কুকুররা ছিড়েখুঁড়ে খেতো তাকে। বাবা-মা সবাই ফেলতে পারলেও রক্তের ফুপি তাকে ফেলতে পারেনি। তাকে বড় পুত্রবধূর সম্মান দিয়ে এনেছিল মাত্র দশ বছর বয়সে। বদমেজাজী,জেদি,একগুঁয়ে মানুষটার উপর অভিমানে টইটম্বুর হয়ে শুয়ে পড়লো নিশু। কিন্তু ঘুম এলো না। উঠে লাইট জ্বালালো। আলমারির ড্রয়ার খুলে একজোড়া রূপার নুপুর বের করলো। নুপুরগুলো তার মা দিয়েছিল ছোটবেলায়। যেন বড় হলে পরতে পারে। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে! নুপুরজোড়া পরলো। আজ আট বছর নিশু এমনই করে আসছে। মায়ের কথা মনে পড়লে পরে এরপর আবারও যত্ন করে রেখে দেয়। তার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর আর যোগাযোগ করেনি। কেন করেনি নিশু জানে না। কিন্তু ডিভোর্সের পরেও তার মা ভীষণ পাগল ছিল তার জন্য। সেই মায়ের বিয়ের পর হঠাৎ বদলে যাওয়া রূপ নিতে পারলো না নিশু। তার মা ইচ্ছে করেই কি যোগাযোগ করেনি নাকি তার সৎ পিতা যোগাযোগ করতে দেয়নি কিছু জানে না নিশু। কিন্তু ভীষণ কষ্ট হয় মায়ের জন্য। প্রতিটি মুহূর্তে ভীষণ করে মায়ের কথা মনে পড়ে। বর্ষার ভরা বিলের মতো টইটম্বুর হয়ে গেল নয়নজোড়া। জলপ্রপাতের ন্যায় টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো দুগাল বেয়ে। হঠাৎ কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো লিভিং স্পেসে। চমকে উঠে নিশু। কী পড়তে পারে ভেবে ডোর খুলে বেরুয়। দেখল ফুলদানিটা পড়ে রয়েছে। কে ফেললো?দেখতে পেলো তাদের দু’জনের পোষা ক্যাট জ্যাক-জেমি। খপ করে দু’হাতে দু’জনকে কোলে তুলে রুমের দিকে পা বাড়াল। ঝুন ঝুন আওয়াজ শুনতে পেলো ধ্রুব। এতরাতে এমন আওয়াজ শুনতেই কেমন অদ্ভুত লাগলো। শব্দটা কেমন প্রকট হলো। ডোর খুলে উঁকি দিতেই দেখলো খোলা চুলে হেঁটে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে নিশু। পিছনের দিকটা দেখলেও সামনে দেখল না আধো-অন্ধকারে। রুমে ঢুকে ডোর ভিড়িয়ে জ্যাক-জেমিকে নিয়ে শুয়ে পড়লো নিশু। মায়ের ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিওগুলো পাঠালো দ্যুতি। নোটিফিকেশন পাওয়া মাত্রই চেক করলো নিশু। ধ্রুবকে পিয়াসাদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে কেমন লাগল। ভীষণ কান্না পেলো নিশুর। হঠাৎই ইমোশনাল হয়ে পড়লো।
___

অনেক বেলা হলেও ঘুম থেকে উঠলো না নিশু। নাস্তার টেবিলে এলো ধূসর-ধীরাজ। রিনা খালা আর জোছনা টেবিল সাজিয়ে দিয়েছে।

“খালা,নিশু কই?”

“ঘুম থেইকা এখনও উঠে নাই।”

“কেন কী হয়েছে?”

“কইবার পারুম না।”

“ডেকেছিলে?”

“ডাকছিলাম কয়বার সাড়াশব্দ পাইলাম না।”

“মানে!”

“হয়তো রাত জাগছে তাই বেলা হইতাছে। থাক ঘুমাউক।”

কাজে মন দিলো রিনা খালা। চিন্তিত হলো ধূসর। নিশু কখনোই বেলা করে উঠে না। সকাল সকাল উঠে নামাজ-কালাম এবং কোরআন তিলাওয়াত করে তারপর তার মা এবং রিনা খালাকে কিচেনের কাজে টুকটাক সাহায্য করে। বিশেষ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে এমনটা দেখা যায়। এমন নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে! কিন্তু রাতে তো ভালো দেখল। মায়ের অনুপস্থিতিতে নিজ দায়িত্বে মেডিসিনও খাইয়ে দিলো।

“ধীরাজ আয় তো!”

ভাইয়ের পিছু পিছু এলো। দরজা ভিড়ানো ছিল। রুমে ঢুকল দু’জন। দেখল ঘুমিয়ে আছে। কপালে হাত রাখল দেখল ঠাণ্ডা। চমকায় ধূসর।

“নিশু! নিশু! এই নিশু!”

সায় দিলো না।

“কী হয়েছে ভাইয়া?”

“বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।”

“কেন?”

দেখল পাশে মোবাইল। মোবাইল অন করতেই দেখল হোয়াটসঅ্যাপের ভিডিওটা। বুঝতে পারলো সাধারণ একটা ভিডিও দেখেই নিশু আপসেট হয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই রাতে ইমোশনাল হয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিল। ধ্রুব সম্পর্কিত সামান্য নেগেটিভ কিছু নিতে পারে না নিশু। চোখে-মুখে পানি ছিঁটালো কিন্তু সেন্স ফিরল না। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে শক্ত হয়ে আছে। ঘাবড়ে গেল ওরা দু’জন।

“ভাইয়া,ভাবীকে হসপিটালে নিয়ে চলো।”

নিশুকে হসপিটালে নিয়ে গেল দু’জন। বাবা-মাকে ফোন করে বিস্তারিত জানালো ধীরাজ। উনারা এলেন হসপিটালে। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলো নিশুর। চোখ মেলতেই দেখল চিন্তিত মুখে বসে রয়েছেন তার ফুপি।

“নিশু ঠিক আছিস?”

মলিন হাসলো নিশু। গালে হাত রাখলেন।

“এত টেনশন করিস কেন? কীসের এত টেনশন তোর? আমরা আছি না। আমরা থাকতে তোর কীসের টেনশন!”

নীরব রইলো নিশু। উঠিয়ে হেলান দিয়ে বসিয়ে স্যুপ খাইয়ে দিতে লাগলেন। করিডোরে দাঁড়িয়ে রইলো দু’ভাই। কেবিন থেকে বের হলো দ্যুতি।

“এই এদিকে আয়।”

ভয়ার্ত চোখে তাকালো দ্যুতি।

“কেন?”

“আয়।”

ধমকে উঠতেই কেঁপে উঠলো। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসতেই কষিয়ে একটা থাপ্পড় মা’রলো। হতভম্ব হয়ে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো দ্যুতি।

“মা’রলে কেন?”

“চোখের সামনে থেকে দূর হ!”

কেবিনের দিকে পা বাড়ালো ধূসর।

“আম্মা বাসায় যাও।”

“নিশুর কাছে কে থাকবে?”

“আমরা দু’জন থাকব। আর বিকেলের দিকে নিয়ে যেতে পারব। ধীরাজ,আম্মা আর গাধীটাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়।”

“আচ্ছা।”

“আম্মু আসো।”

“নিয়ে যেতে পারবি?”

“পারব ভাইয়া।”

মা-বোনকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেল ধীরাজ। চোখ বুজে রইলো নিশু। তার মুখের দিকে তাকায় ধূসর। মেয়েটার পুরো চেহারায় নিষ্পাপতা আর অজস্র মায়ায় ভরা। দেখলেই নজর সরানো যায় না। গত কয়েক বছর ধরে প্যানিক ডিজর্ডার নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার হচ্ছে নিশুর। যেটা সে কাউকে বলতে পারে না,বুঝাতেও পারে না। চাপা আর শান্তশিষ্ট স্বভাবের হওয়ায় সে অনুভূতিগুলো কারো কাছে প্রকাশ করতে পারে না। নিজ দায়িত্বে ধূসর এই কয়েক বছর যাবৎ নিশুকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখায়। কিছু এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট দিয়েছিলেন ডক্টর সেগুলো খেয়ে প্যানিক এট্যাক আরো ট্রিগার করছে! কোনো ফলপ্রসূ পাচ্ছে না। সেদিন আবারও যখন সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে আসে তখন ডাক্তারকে বলতে শুনেছিল; সারাদিন বুক ধড়ফড় করে,মাথা ঘুরায়,শ্বাস নিতে কষ্ট হয়,হঠাৎ হঠাৎ ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়,ঠান্ডার মধ্যেও শরীর গরম থাকে প্রায় সময়। কোথাও একা যেতে পারে না,একা থাকতে পারে না,ভয় পায় এই বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে গেল,শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে বলা হয়েছিল কিন্তু তেমন কোনো কাজে দেয় না সেটাও জানালো। এছাড়াও নিশু ডিআইডি-এর মানসিক রোগী। সাইকোলজি সম্পর্কে যাদের ধারণা রয়েছে কেবল তারাই জানে এটা কতটা ভয়ংকর। সোজা ভাষায় বলতে গেলে,এটা এমন এক রোগ যেখানে একজন মানুষের ভেতর একাধিক সত্ত্বার বসবাস। যখন অতিরিক্ত কষ্ট হয় সবকিছু ভুলে যায় সে কে,তার বাবা-মা কে,পরিচয় কী ইত্যাদি। মেয়েটা এতএত ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ভেবেই মায়া হয় ধূসরের। অতিরিক্ত টেনশন করে তার ভাইকে নিয়ে। কিন্তু মানুষটা তার দম্ভ থেকে এক কদমও বেরুয় না। সে-তো চাইলে পারে নিশুর সাথে স্বাভাবিক হতে। সংসার করলে করবে না করলে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। এটা হচ্ছে মনের ব্যপার। জোর করে কিছু হয় না বরং উল্টোটাই হয়। নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“রাতে টেনশন করে ইমোশনাল হয়ে পড়েছিস তাই না?”

একপলক তাকিয়ে মাথা নোয়ায় নিশু। কী বলবে সে ধূসর তো তার সম্পর্কিত এ-টু-জেড সব জানে। টুল টেনে দূরত্ব বজায় বসলো।

“তোকে ডক্টর নিষেধ করেছিল টেনশন করতে না। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে নিতে তবুও তুই টেনশন করিস।”

মৌন রইলো নিশু।

“শোন,তুই সহ আমরা চার ভাইবোন একসঙ্গে বড় হয়েছি শুধু বড় ভাইয়া ছাড়া। কারণ পনেরো বছর বয়স থেকে অর্থাৎ তোদের বিয়ের পর থেকে সে বাইরে বাইরে বড় হয়েছে। সে যাইহোক,আমার চোখের সামনেই তুই বড় হয়েছিস। তোকে কখনো ভাবীর চোখে দেখিনি। কখনো মনেই পড়েনি তুই আমার ভাইয়ের বউ। কারণ সর্বপ্রথম তুই আমার মামাতো বোন। ভাবীর সম্পর্কটা পরে এলো। তোকে আমি সবসময়ই ছোট বোনের মতো দেখে এসেছি বলে ভাইয়ের বউ তুই সেটা বেমালুম ভুলেই গেলাম। একসঙ্গে তোদের তিনজনকে বড় ভাইয়ের মতো সঙ্গ দিয়েছি আমি। বড় ভাইয়ের অবর্তমানে সব দায়-দায়িত্ব আমি পালন করেছি। আমার থেকেও বেশি তোকে কেউ জানে না। যেদিন আমার ভাই তোকে স্ত্রী বলে স্বীকার করবে,মর্যাদা দিবে সেদিন থেকে তুই আমার ভাবী। তার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তুই আমার বোন,মামাতো বোন। এনিওয়ে,এখন তোর বিয়ে হয়েছে এই বিষয়টা মাথা থেকে পুরোপুরি ঝেড়ে ফেল এবং লেখাপড়ায় সম্পূর্ণরূপে মনযোগী হো। আমার ভাই প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে স্টাডি করেছে। তাঁর জীবনের লক্ষ্য সম্ভবত অনেক উচ্চমানের। কারণ সে কিছুদিনের মধ্যেই ইউএসএতে মাস্টার্স কমপ্লিট করার জন্য যাবে ভিসা ম্যানেজ হলেই। তাই বলবো,তুই যদি তাঁকে তোর স্বামী হিসেবে পেতে চাস তাহলে নিজেকে তাঁর যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা কর। কারো মুখাপেক্ষী হয়ে বেঁচে থাকাটা অতি নিম্নমানের চিন্তাভাবনা। জীবনের কোনো একটা স্টেজে সে যদি তোকে মেনে না নেয়,তাহলে সেই বিষয়টা নিয়ে তার সাথে কোনো ঝামেলায় জড়াবি না। তোর সামনে এখন একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত,নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা,স্টাবলিশ হওয়া,ইনকামের পথ তৈরী করার জন্য পড়াশোনা করা,ক্যারিয়ারে ফোকাস করা। আর যাইহোক,এই যুগে মেয়েদের স্টাবলিশ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ! এই যুগে সকল নারীর একটা ইনকাম সোর্স থাকা উচিত। যা তাদেরকে পরবর্তীতে সাহায্য করবে। একজন পুরুষ যেমন আত্মনির্ভরশীল হয় ঠিক তেমনি একজন নারীকেও আত্মনির্ভরশীল ও দৃঢ় মনোবলের হতে হয় নিজের জন্য হলেও! এছাড়াও একটা কথা মনে রাখিস,কারো কাছে ইম্পরট্যান্ট হতে গেলে এবং তার প্রায়োরিটি হতে গেলেও ভাগ্য লাগে। সে যাইহোক,তুই কোনও সস্তা মেয়ে নয় যে কেউ আসবে,তোকে অবহেলা করবে আর তোর মন ভেঙে দিয়ে ছুঁড়ে চলে যাবে। সকল পরিস্থিতিতে তোকে শক্ত থেকে মোকাবিলা করতে হবে। সামান্য একটা কারণে ডিপ্রেশনে গিয়ে আপসেট হয়ে পড়লে চলবে না। একটা সম্পর্কের ভিত্তি হলো বিশ্বাস ও স্বচ্ছতা। আমার ভাইয়ের প্রতি মারাত্মকভাবে তুই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিস। কিন্তু বিয়ে কেবল আবেগের ওপর ভিত্তি করে টিকবে না,বাস্তবতার ভিত্তিতে টিকবে। তোর বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে আমার বাবা-মা আজ আট বছর ধরে তোকে দেখে এসেছে তারা সবসময়ই চাইবে তোর ভালো হোক। তাই বাবা-মায়ের মতামতকে গুরুত্ব দিস। আরেকটা কথা হচ্ছে,কোনো সম্পর্ক যদি প্রথম থেকেই সন্দেহ,গোপনীয়তা ও মানসিক অশান্তির কারণ হয় তাহলে ভবিষ্যতে সেটি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। যদি সম্পর্কের ভিত্তি বিশ্বাস,সততা ও পারস্পরিক সম্মান থাকে তাহলে সেটা টিকে থাকবে। কিন্তু যদি সন্দেহ,মিথ্যা ও মানসিক অশান্তি থাকে,তাহলে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ। তুই যেটাই সিদ্ধান্ত নিস সেটি যেন তোর সুখ ও ভবিষ্যতের জন্য ভালো হয়। নিজের প্রতি সৎ থাক,নিজেকে ভালোবাস,নিজের মূল্য বুঝ। মনে যাই আসুক না কেন,জীবনে যাই হোক না কেন,সময় যত অসময়ই হোক না কেন তুই ফুরিয়ে যাসনি। তোর দ্বারা এখনো কিছু হবে,অনেক কিছুই হবে। হতে পারে তোর বন্ধুরা তোকে অবজ্ঞা করছে,হতে পারে তোকে নিয়ে তোর বাবা মা হতাশ,হতে পারে তোর জীবন আঁটকে আছে কোন কর্মক্ষেত্রে কিংবা ব্যর্থতার বৃত্তে,হতে পারে তুই দিনের পর দিন অন্যের উপর নির্ভরশীল,হতে পারে তোর সব চেষ্টা কারো কাজে এমনকি নিজের কাজে আসছে না,হতে পারে তুই তোর উপরই বিশ্বাস করতে পারিস না,নিজেকে ঘৃণা করিস,এমনও হতে পারে তোর জন্য সবাই চিন্তিত যে কী হবে ওর?এরকম হাজারটা হতে পারে তবে সত্যটা কী? তুই বেঁচে আছিস,তুই ভাবতে পারছিস,তোর ভ্রু কুঁচকে ভাবতে পারিস কী আর হবে তাতে?এখন তুই যদি মনে করিস এই সম্পর্ক তোকে সুখ দিবে না তাহলে এখনই বের হয়ে আসাই ভালো। আর যদি মনে করিস তুই এই সম্পর্ক ছাড়া বাঁচতে পারবি না তাহলে বলবো ধৈর্য ধর কিন্তু টেনশন করে তিলে তিলে মরিস না। যার জন্য টেনশন করে জ্বলেপুড়ে ম’রে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিস তার তো কিছু যায়-আসে না তোর জন্য। সে-তো দেদারসে আরাম-আয়েশে জীবন উপভোগ করছে!”
____

চলবে~