মায়াকুমারী পর্ব-০৯

0
866

#মায়াকুমারী ❤
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(০৯)
___________________

নাস্তা খাওয়ার জন্য সবাইকে ডাকলেন দিলরুবা খাতুন। নিশুকে ডাকার জন্য খুশি মনে পা বাড়ালেন ছেলের ঘরের দিকে। দেখলেন দরজা খোলা। তবুও নক করতেই ধ্রুব এসে দাঁড়াল।

“নাস্তা করবি না বাবা?”

“ইচ্ছে নেই।”

“নিশু কই?”

“জানি না।”

আঁড়চোখে দেখলেন পুরো রুম কেমন এলোমেলো। ভড়কান তিনি।

“রুমের এই অবস্থা কেন?”

“আমি কী করে জানবো!”

“নিশু কোথায়?”

“বললাম তো জানি না।”

“কী করেছিস মেয়েটাকে?”

“বিরক্ত করো না আম্মা।”

ডোর অফ করে দিলো ধ্রুব। মনঃক্ষুণ্ন হলেন দিলরুবা খাতুন। সব মাথার উপর দিয়ে গেল। রাতে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে-সুঝিয়েই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কী এমন হলো যে পুরো ঘর লণ্ডভণ্ড! দ্যুতির রুমে ঢুকতেই দেখলেন শুয়ে আছে নিশু।

“নাস্তা করবি না তোরা?”

“করবো।”

“নিশু কখন এসেছে?”

“রাতে।”

“কী হয়েছিল?”

“জ্ঞান হারিয়েছে রাতে তাই নিয়ে এলাম। তোমার যে ঘাড়ত্যাঁড়া ছেলে ওর আশায় সেখানে রেখে আসলে প্যারালাইসিস হয়ে বেঁকে থাকতো।”

চুপসে গেলেন দিলরুবা খাতুন।

“আচ্ছা নাস্তা করতে আয়।”

চলে গেলেন তিনি।

“নিশু উঠ। নাস্তা খাব। দশটা থেকে কোচিং আর তিনটা থেকে প্রাইভেট আছে।”

শাড়ি বদলে নিলো নিশু।
___

সবাই নাস্তা করতে বসলেও ধ্রুব এলো না। গম্ভীর রইলেন আসাদ সাহেব। নীরবে নাস্তা সেরে যে যার যার মতো উঠে গেল। কোচিং-এ যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে বেরিয়ে এলো দু’জন। গ্যারেজ থেকে বাইক বের করলো ধূসর।

“রেডি হওয়া শেষ হয়েছে তোদের?”

“হয়েছে।”

“আর কত সাজবি?”

“হয়েছে তো!”

“চল।”

বাইকে উঠে বসলো দু’জন। উপর থেকে দৃশ্যটি দেখল ধ্রুব। দু’জনের মুখে মাস্ক আর হিজাব বাঁধা। প্রথমে চেনা না গেলেও পরে নিশুর চুল দেখে চিনতে পারলো। হিজাবের নিচ দিয়ে চুলগুলো ঝুলে আছে কোমরের নিচ অব্ধি।

“রোগীটা মাঝখানে বস। পিছনে বসলে রাস্তায় থেকে যাবি। পরে তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

মাঝখানে বসল নিশু কিন্তু ধূসরকে ধরলো না।

“তুই তো আজ রোডে থেকে যাবি। কাঁধে হাত রাখ!”

কাঁধের উপর হাত রাখল নিশু। বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল ওরা।
___

নক পড়লো ধ্রুবর ডোরে। গম্ভীর হয়ে ডোর খুলতেই দেখল তার মা।

“কী হয়েছে?”

“তোমার বাবা ডাকছে।”

“কেন?”

“আমি কীভাবে জানব!”

চলে গেলেন দিলরুবা খাতুন। টাউজারের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে লিভিং স্পেসে গেল ধ্রুব। পূর্ব থেকে বসে রয়েছেন আসাদ সাহেব। ছেলের উপস্থিতি টের পেতেই মুখের সামনে থেকে পেপার সরালেন। চশমা ঠিক করে একপলক তাকালেন ছেলের দিকে।

“ডেকেছেন কেন?”

“বসো।”

বাবার মুখোমুখি বসলো ধ্রুব। পেপার ভাঁজ করে রাখলেন।

“বলো কী চাও তুমি?”

“কী চাইবো!”

“ঘরে বউ রেখে সারা রাত কোথায় ছিলে?”

“ছাঁদে।”

“কেন?”

“সব কি আপনার জানা জরুরি?”

“অবশ্যই! আমার খাচ্ছ,পরছো আমি না জানলে কে জানবে?”

বিরক্ত হয় ধ্রুব।

“সোজা কথা বলুন।”

“সংসার করবে না?”

“না।”

“কাল শুধু বিয়েটাই হয়নি জানোই তো তুমি কী কী পেপারে সাইন করেছ?”

চুপসে গেল ধ্রুব।

“এতদিন ম্যারিজ সার্টিফিকেট ছিল না কাল সেটা বিয়ে পড়িয়ে করে ফেলেছি কি অহেতুক!”

শক্ত চোখে তাকায় ধ্রুব।

“যুক্তরাষ্ট্রে হায়ার স্টাডি করার শখ মিটে যাবে যদি নিশু এম্বায়সিতে কম্প্লেইন করে।”

নীরব রইলো ধ্রুব।

“তুমি আমাকে নয় আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি। মানতেই হয় আমি তোমার বাপ!”

চশমা ঠিক করলেন আসাদ সাহেব।

“ব্ল্যাকমেইল করছেন?”

“না। মনে করিয়ে দিচ্ছি কী কী করতে পারি!”

শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। বাঁকা হাসলেন আসাদ সাহেব।

“আসো সমঝোতায় আসি।”

পিতার চোখে চোখ রাখল ধ্রুব।

“নিশু-দ্যুতি দু’জনই ভালো স্টুডেন্ট। আমরা আমাদের বাচ্চাদেরকে সেভাবেই যত্ন করেছি,গাইড করেছি,গার্ড দিয়েছি। মাশা-আল্লাহ! দু’জনই স্কলারশিপ পেয়েছে। চাইলেই দু’জনকে বিদেশ পাঠাতে পারি কিন্তু একজন অভিভাবক দরকার। তার কারণ নিশু মানসিক রোগী। মাঝেমধ্যে নিজেকে চিনতে পারে না। হঠাৎ হঠাৎ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এখন দ্যুতিকে পাঠাতে চাইলে ও একা যাবে না নিশুকে ছাড়া। তাই বলছি,তুমি যদি ওদের দু’জনের দায়িত্ব নাও তাহলে আমি বরং তোমাদের তিনজনকে একসঙ্গে পাঠিয়ে দিই কী বলো?ক্যারিয়ারে ফোকাস করে তোমরা ফিউচার ব্রাইট করো এইটুকুই চাই! তোমার টাকাপয়সা কিছু চাই না! আল্লাহ আমায় যথেষ্ট দিয়েছেন! দশটা ফ্যামিলি চালানোর সার্মথ্যও আল্লাহ দিয়েছেন।”

নীরব রইলো ধ্রুব।

“তা না মানলে শুধু নিশুকে তোমার সাথে নিয়ে যাও। আমার মেয়ে আমার কাছে থাকুক। যদি নাও তাহলে তোমাদেরকে একটা এপার্টমেন্ট আর একটা গাড়ি এবং মাস শেষে তোমার একাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা পাঠানো হবে যেটা দিয়ে তোমরা দু’জন অনায়সেই চলতে পারবে। এখন বলো রাজী কি-না?”

“না।”

“আবারও বলছি সুযোগ দিচ্ছি লুফে নাও।”

“ওই মেয়ের দায়িত্ব কিছুতেই নিতে পারব না।”

“ভেবে দেখিও।”

উঠে গেলেন আসাদ সাহেব।

“তোমার একমাত্র গতি কিন্তু এখন আমিই।”

মস্তিষ্ক টগবগ করছে ধ্রুবর।

“নারীদেরকে কাঁদিয়ে যেই পুরুষ জীবনে বড় হতে চেয়েছে তার সারাজীবন ভাঙতে ভাঙতে গিয়েছে। না জানি তোমার হাল কী হয়!”

রুমের দিকে পা বাড়ালেন। ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। এই বিষাক্ত সাপ নিশুর জন্য তাকে এতগুলো কথা বললো তার জন্মদাতা পিতা! মুষ্টিবদ্ধ করলো হাত। ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ডিভোর্স লেটার পাঠাবে তাই কবুল এবং সাইন করেছে কোনো জোরজবরদস্তি ছাড়াই! কিন্তু কে জানতো তার বাবা কৌশলে তার হাত দিয়ে স্টাম্পেও সাইন করিয়ে নিবে! এত বোকা সে হলো কী করে!
___

কোচিং শেষে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন। অপেক্ষা ধূসরের। হঠাৎ অনিক বখাটে এলো তার গ্যাং নিয়ে। তাকে দেখতেই চমকায় ওরা।

“ব্লক দিলা ক্যান রাতে?”

“ইচ্ছে হয়েছে।”

“ব্লক দিয়ে কী লাভ! সেই তো হাশরের ময়দানে দেখা হবে আমাদের।”

“বিরক্ত না করে এখান থেকে যান।”

পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় দ্যুতির দিকে। অস্বস্তি হয় দ্যুতির।

“লিফ্ট দিই চলো।”

“লাগবে না।”

বাইকে করে ধূসরকে আসতে দেখে ঘাবড়ে গেল দ্যুতি।

“ভাইয়া আসছে চলে যান।”

“তাতে কী?”

“চলে যান বলছি!”

দ্যুতিকে অস্থির হতে দেখে একপলক তাকিয়ে সরে গেল অনিক। ধূসর আসতেই বাইক চেপে বসল ওরা। রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল ওদের। মেন্যুবুক নিয়ে পছন্দসই একটা কমপ্লিট সেট অর্ডার করলো। থাই স্যুপ,অন্থন,ওয়েজেস দিয়ে শুরু করে ফ্রাইড রাইসের সাথে চিকেন এবং এ্যাপাটাইজার এর কম্বিনেশন এক কথায় অসাধারণ একটা প্লেটার সেট। অর্ডার আসতেই খেতে শুরু করলো ওরা। খাওয়া-দাওয়া শেষে রেস্তোরাঁ থেকে বেরুতেই আইসক্রিম পার্লার দিকে চোখ পড়লো দ্যুতির।

“ভাইয়া কোণ আইসক্রিম খাব কিনে দাও।”

“কোণ আইসক্রিম মানে?”

“কোণ আইসক্রিম চিনো না?”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় ধূসর।

“সেটা আবার কী?”

“সেদিন যে কিনে দিলে ওইটা।”

“তোকে অহেতুক গাধী বলি না।”

“কী করলাম?”

“কোণ না কর্নেটো আইসক্রিম।”

“কিন্তু আমি তো আজীবন কোণ আইসক্রিম বলে এসেছি।”

“এজন্যই তোকে গাধী বলি!”

দু’জনকে দুটি কর্নেটো আইসক্রিম কিনে দিলো ধূসর।

“ভাইয়া শপিংয়ে চলো না প্লিজ।”

“কী করবি?”

“ডাক্তার বলেছে আমার ভিটামিন এস এর অভাব।”

“সেটা আবার কী?”

“মানে শপিং।”

কান টেনে ধরলো।

“ফাজলামো হচ্ছে! চল বাসায়।”

“হাড়কিপটে!”

“তোর বাপে আমাকে কয়েক লাখ টাকা দিয়ে বসিয়ে রেখেছে তো!”

“নিশু বললে ঠিকই শপিংয়ে নিয়ে যেতে,আমার বেলায় যত তাল-বাহানা! সবই বুঝি!”
__

বিকেল বেলা মনের দুঃখে বসে রইলো অনিক। শালাবাবুর জন্য কথা বলা যায় না হবু বউটার সঙ্গে! ধূৎ! কাঁধে হাত রাখল রিফাত।

“কী দোস্ত মনখারাপ কেন?”

“শ্লা বাবুটা বেশি বাড় বেড়েছে!”

“চিন্তা করিস না দোস্ত! ওই মেয়ের জন্য কী কত মেয়ে আছে!”

“আমার ওকেই লাগবে!”

“ধ্যাৎ! এটা কোনো মেয়ে হলো নাকি! উড়াধুরা প্রেম কর দোস্ত। তারপর ছ্যাঁকা খাইলে আমি আছি স্যাড সং শোনানোর জন্য একদম টেনশন নিস না।”

“চল জরিনার মারে দেখতে যাই।”

“কোথাই?”

“শ্বশুরবাড়ি!”

অতঃপর গোলাপফুল কিনলো অনিক। বাইকে নিয়ে এসে থামলো দ্যুতিদের বাসার সামনে। দ্যুতির ফোনে কল দিলো। পিক করতেই বলল,”জান তাড়াতাড়ি নিচে আসো।”

“কেন?”

“আসতে বলছি শোনো না!”

বিরক্ত হয় অনিক। চুপি চুপি নিচে গেল দ্যুতি। দেখল বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনিক। চোখে সানগ্লাস। অনিককে ওমন রূপে দেখতেই হৃদয়টা দুলে উঠলো দ্যুতির। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে এগিয়ে গেল।

“কেন এলেন?”

গোলাপটা বাড়িয়ে ধরলো।

“তোমার জন্য।”

“আমার ভাইয়া দেখলে আপনার খবর আছে চলে যান বলছি!”

অস্থির হয় দ্যুতি।

“ও ধুতি! ফুলটা নাও আমার ভীষণ লজ্জা করছে!”

“আমার নাম দ্যুতি,ধুতি না।”

“ওই একই!”

“না এক না।”

“একটা ডাকতে পারলেই হয়েছে।”

“না হবে না। আমাকে দ্যুতি ডাকতে না পারলে ধারা বলে ডাকবেন।”

“এতকিছু পারুম না ওকে। তুমি আমার ধুতিপুতি।”

“গণ্ডমূর্খ! পড়াশোনা কিছুই নেই!”

“অনলি ফর ইউ!”

“ফিরে যান।”

“ম্যারি মি প্লিজ,আই হেট স্টাডিং।”

“যাবেন এখান থেকে!”

বিরক্ত হয় দ্যুতি।

“আরে প্রপোজাল এক্সেপ্ট করে তাড়াতাড়ি ফুলটা নাও।”

“নিবো না।”

“আমার লজ্জা লাগছে জান! প্লিজ ফুলটা তাড়াতাড়ি ধরো!”

কাঁচুমাচু অঙ্গাভঙ্গি করে লজ্জার হওয়ার ভান করলো অনিক। আকস্মিক গাড়ি থেকে নামলেন আসাদ সাহেব। ভড়কালো দু’জন। আমতা আমতা করলো দ্যুতি।

“ইয়ে মানে..ফুলটা আপনার জন্য আংকেল। নিন আজ বিশ্ব আংকেল দিবস।”

ফুলটা বাড়িয়ে ধরলো উনার দিকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন অনিকের দিকে। ইগনোর করে বাসায় ঢুকে গেলেন।

“ভাবা যায় এগুলা,হবু শ্বশুরমশাই আমাকে ইগনোর করে রিজেক্ট করলো!”

ভয়ে ভয়ে বাসায় ঢুকল দ্যুতি। ব্যালকনি থেকে এতক্ষণ ব্যপারটি লক্ষ্য করলো ধ্রুব। দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে ডোর অফ করে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলো দ্যুতি। সবে গোসল সেরে এলো নিশু।

“কীরে কী হয়েছে?”

“আমি কিছু জানি না নিশু।”

“মানে!”

“আমি কিছু বলতে পারব না।”

“কী হয়েছে বলবি তো!”

“আব্বু দেখে ফেলেছে!”

“কী?”

“অনিক এসেছে।”

“নিচে গিয়েছিস?”

“হ্যাঁ।”

“এখন কী হবে?”

“আমি জানি না।”

দ্যুতির দিকে তাকিয়ে রইলো নিশু। ভয়ে ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে রয়েছে।

“তুই কেন গেলি?”

“আব্বু ডাকলে তুই কিছু একটা বানিয়ে বলিস প্লিজ।”

“পারব না।”

“নিশু!”

“যাস কেন!”

একটু বিরক্ত হয় নিশু। ধূসর শুনতে পেলে যে কী হবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত পোহায়। ধূসরের হাত চলে তীরের গতিতে। কখন না জানি দ্যুতিকে ধরে কয়েকটা চড়থাপ্পড় মা’রে! আতঙ্কিত হয় নিশু। ভীষণ টেনশনে পড়ে গেল। ওরা ভাবলো আসাদ সাহেব হয়তো ডাকবে,জিজ্ঞেস করবে কিংবা বকাঝকা করবে কিন্তু সেই রকম কিছুই হলো না। প্রাইভেটের টাইম হতেই রুমের মধ্যে খেয়েদেয়ে ওরা দু’জন দ্রুত মানে মানে বেরিয়ে গেল।
___

ব্রেকফাস্ট কিংবা লাঞ্চ কিছুই করলো না আজ ধ্রুব। খেতে ডাকলেও এলো না। ছেলেটা যে একটু জেদি আর ঘাড়ত্যাঁড়া সবাই জানে এটা। প্লেটে ভাত বেড়ে একটি ট্রেতে ছোট্ট ছোট্ট বাটিতে পরিমাণমতো তরকারি বেড়ে ছেলের রুমের দিকে পা বাড়ালেন দিলরুবা খাতুন। নক করতেই সময় নিয়ে ডোর খুললো ধ্রুব। মাকে দেখতেই বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালো। ভিতরে ঢুকলেন তিনি।

“খাবার খাওনি কেন?”

মৌন রইলো ধ্রুব। ছেলের গায়ের থেকে সিগারেটের গন্ধ পেতেই নাক-মুখ কুঁচকালেন।

“বাবা তুমি সিগারেট খাও?”

বিব্রতবোধ করলো ধ্রুব।

“পড়াশোনা জানা ছেলে তুমি। তুমি কি জানো না এইসব খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ!”

নীরব রইলো ধ্রুব। বিছানার উপর বসলেন।

“এইসব কেন আনলেন?”

“হাত-মুখ ধুয়ে আসো যাও।”

দাঁড়িয়ে রইলো ধ্রুব।

“যাও!”

কুলি করে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো ধ্রুব।

“খেতে আসো।”

“খাব না।”

“আবারও রাগ দেখাও!”

“বললাম তো খাব না।”

“আসবে তুমি!”

নীরব রইলো ধ্রুব।

“সামনে বসো ঘাড়ত্যাঁড়া ছেলে!”

মায়ের সামনে বসলো ধ্রুব। মুখাভঙ্গি শক্ত। ভাত মাখিয়ে ছেলের মুখের সামনে ধরলেন।

“হাঁ করো। এত রাগ কীসের! মাথা ঠাণ্ডা করো। তেইশ বছর বয়স কিন্তু কম না।”

নীরব রইলো ধ্রুব।

“বাবা একটা কথা বলি?”

জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালো।

“আমি জানি আমরা তোমার উপর জোরজুলুমি এবং চরম অন্যায় করেছি। জোর করে কিছু হয় না। সেটা প্রেম,ভালোবাসা কিংবা সংসার অথবা যেকোনো কিছুই। জোরজবরদস্তির কিছু ভালো বয়ে আনে না। শেষমেশ এর পরিণতি চরম ভয়াবহ হয়। সে যাইহোক,তুমি যদি সংসার করতে না চাও আজকের পর থেকে তোমাকে কেউ জোর করবে না। এই বিষয় এখানেই শেষ। তবে মায়ের একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল আরকি নিশুকে নিজের কাছে রাখার। খুব ছোট থেকে আদর-যত্নে পেলেপুষে বড় করেছি তো তাই একটু বেশিই মায়া মেয়েটার উপর। বাবা-মা থেকেও নেই; এতিম। অন্য বাড়িতে বিয়ে দিলে উঠতে-বসতে দিন-রাত খোঁটা শুনবে তাই আরকি। থাক বাদ দাও এইসব। কপালে যা আছে তাই হবে।”

আরেক লোকমা ভাত তুলে দিলেন মুখে। মলিন হাসলেন তিনি। মাছের কাঁটা ছাড়ানোয় মনোযোগ দিলেন।

“তুমি সবসময়ই তোমার বাবার রাগ দেখেছ অথচ তার আড়ালে যে তোমার জন্য অজস্র ভালোবাসা রয়েছে সেটা কখনোই বুঝতে চেষ্টা করোনি। সবসময়ই ভুল বুঝে এসেছ তোমার বাবাসহ ভাই এবং আমাকেও। অথচ মাসের পনেরো দিন তোমার বাবা তোমার সাথে থাকতো আর আমাদের সাথে থাকতো বাকি পনেরো দিন। হিসেব করলে তোমার তিন ভাই-বোনের চেয়ে তোমার বাবাকে তুমি কাছে পেয়েছ অত্যাধিক বেশি। সেই তুলনায় আমার অন্য ছেলেমেয়েরা এর কানাকড়ি সমপরিমাণ সময়ও পায়নি। তোমার বাবার ফাস্ট প্রায়োরিটি কিন্তু তুমিই। তোমার মুখ থেকেই বাবা ডাক শুনতে পেয়েছেন তিনি। তাই তোমার উপর একটু বেশিই পসেসিভ। একটু বেশিই দায়িত্ব-কর্তব্যপরায়ণ আর অধিকারবোধ দেখায়। সে যাইহোক সেই সব বাদ। তুমি তো আমাদেরই ছেলে। বলতাম এই কথা,আবেগে হোক,বিবেকে হোক কিংবা বিপদে যাইহোক আমরা একটা ভুল কাজ করে ফেলেছি তোমার সাথে। তুমি চাইলে সেটাকে সুন্দর করে মীমাংসা করতে পারতে তা না করে সবার সামনে অর্থাৎ তোমার বৃদ্ধা দাদী ও তোমার ছোট ভাইয়ের সামনে পিতার সাথে বেয়াদবি এবং ছোট করেছ। যা আমার কাছে খুবই খারাপ লেগেছে। একবারও কি ভেবে দেখেছ তোমার থেকে ছোটরা কী শিখবে! তুমি কিন্তু চাইলে সুকৌশলে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিষয়টি সামলে নিতে পারতে তা না করে বোকা আর অবাধ্য ছেলের পরিচয় দিয়েছ। রাগারাগি করে সবসময় সবকিছু হয় না বরং নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করে। তাই সকল পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখা উচিত। তোমার কৃত কর্মকাণ্ডে আমি যেমন আহত হয়েছি হয়েছে তোমার পিতা এবং ভ্রাতারাও। সে যাইহোক অনেক কথা বলে ফেললাম। নিশুর বিষয়টি নিয়ে আমরা আর কখনো তোমাকে চাপ সৃষ্টি করবো না কথা দিচ্ছি আমি। তবে তুমি চাইলে ওর সঙ্গে সংসার করতেও পারো সেটা একান্তই তোমার ইচ্ছে। আর না হলে বাদ। এখন ভুলে যাও এই জঘন্য বিষয়টা। দু-একটা কলঙ্ক না চাইতেও মানুষের থাকে,লেগে যায় গায়ে। চাঁদের ও কলঙ্ক আছে। এখন আমরা না হয় ভুল করে পেলেছি। যার জন্য পস্তাচ্ছিও এবং পস্তাবোও। বান্দা পাহাড়-পর্বত সমান অপরাধ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি মাফ করে দেয়। এখন আমরা যেহেতু একটা ভুল করে পেলেছি তাই সবার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি তুমিও মাফ করে দাও আমাদের সবাইকে। আল্লাহ তার পাপিষ্ঠ বান্দাকে ক্ষমা করতে পারলে তুমিও পারবে।”

মৌন রইলো ধ্রুব।
______

চলবে~