মায়াকুমারী পর্ব-১০

0
799

#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(১০)
___________________

আরেক লোকমা ভাত তুলে দিলেন ছেলের মুখে। বেশ সময় নিয়ে চিবুতে লাগলো ধ্রুব। মায়াবী দৃষ্টিতে ছেলের মায়া ভরা শ্যামবর্ণ মুখের দিকে তাকালেন। কে বলবে এই ছেলে পাথরের ন্যায় শক্ত পাহাড়ের ন্যায় কঠিন! আদেও ছেলেটার মন বলে কিছু আছে কি-না বুঝতে পারেন না তিনি। এই যে বাবার আত্মত্যাগ,মায়ের আদর,আকুতি-মিনতি কিছুই তার মনকে গলাতে পারে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লেটের দিকে তাকালেন।

“তোমার বাবাকে বলবো খুব দ্রুত ডিভোর্সের কাগজপত্র রেডি করতে। তুমি বিদেশে যাও,পড়াশোনা করে স্টাবলিশ এবং সেটেল্ড হও। আর নিশুর কথাটা মাথা থেকে একেবারেই ঝেড়ে ফেলো। মনে করবে সে তোমার জীবনের একটা অতীত; দুঃস্বপ্ন! তার আরেকটু বয়স হলেই আমরা না হয় ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিবো এইসব নিয়ে একদম চিন্তা করো না। নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। আর তোমার বাবা জিদের বশবর্তী হয়ে কাল যেটা করেছে সেটার জন্য সত্যিই লজ্জিত! আসলেই ওমনটা করা ঠিক হয়নি। আর ওমনটা করার কারণ হচ্ছে,উনি ভেবেছিলেন তুমি যদি দেশে না ফিরো কিংবা আমাদের প্রতি জেদের বশবর্তী হয়ে সেখানকার কোনো বিদেশী মেয়ের সাথে জড়িয়ে যাও এইজন্য আরকি সেই চিন্তা থেকেই এমনটা করেছেন। আসলেই বয়স এবং প্রচুর রোগ-শোকে ধরেছে তো তাই। উনি ভেবেছিলেন এক সপ্তাহ সংসার করলে,নিশুর সঙ্গে সময় কাটালে তোমাদের মধ্যে একটা বন্ডিং হবে তাই আরকি হুট করে ওমনটা করা। আর ধর্মীয় এবং আইনগতভাবে বিয়েটা আবারও সহীহ শুদ্ধ করা। কিন্তু হলো তার ব্যতিক্রম। পৃথিবীতে যত সফল ব্যক্তিবর্গ আছেন সবাই কিন্তু খুব দ্রুত অল্প বয়সে বিয়ে-শাদি করেছেন। বিয়ে হচ্ছে আল্লাহর রহমত,নিয়ামত,বরকত। জানো চাইনিজরাও বলে থাকে বিশেষ করে রাজা-বাদশারা। তারা বলেন,কর্মক্ষেত্রে ঢোকার আগে বিয়ে করে নেওয়া সর্বোত্তম। এতে নাকি অনেক মঙ্গল হয়। সে যাইহোক,তোমাকে নিয়ে উনি খুব দুঃচিন্তা করেন তো তাই উল্টাপাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। থাক বাদ দাও। ছেলেদের কোনো কলঙ্ক আছে নাকি! ছেলেদের কলঙ্ক বলে কোনো কথা নেই। কলঙ্ক তো শুধু মেয়েদের। কালো হয়ে জন্ম নেওয়াটাও মেয়েদের জন্য কলঙ্ক,অভিশাপ,পাপ! আল্লাহ তায়ালা নারীদের খুব সুক্ষ্মভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের একটা দাঁত বাঁকা কিংবা তারা একটু খাটো হলেও খুঁত,কলঙ্ক অভিশাপ।
এখন ভালো ক্যারিয়ার গড়লে নিশুর চেয়েও অনেক সুন্দরী,রূপবতী,গুণবতী,ধনবতী,ঐশ্বর্যবতী,সমৃদ্ধশালী বউ এবং শ্বশুরবাড়ি পাবে; জামাই আদরও পাবে। নিশুকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলে তো সেইসব পাবে না বরং বঞ্চিত হবে। আজকাল সব ছেলেরাই শ্বশুরবাড়ি থেকে অনেক কিছু আশা করে। ছেলেদের টাকাপয়সা হলে কলঙ্ক বলে কিছু থাকে না। থাকলে দু-তিন বাচ্চার বাবার প্রেমেও কোনো অবিবাহিত মেয়ে পড়তো না আর না পরকীয়া নামক কিছু থাকতো এই পৃথিবীতে। ছেলেরা সবসময়ই হিরো। তাদের কোনো কলঙ্ক নেই। তারা সবসময়ই নিষ্পাপ।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। সবটা সময় মৌন রইলো ধ্রুব। খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিলেন। ট্রে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব। তার মা যেন আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। যতক্ষণ তার মা কথাগুলো বলছিল ততক্ষণ তার মায়ের গলা কেমন কাঁপছিল,ভেজা ছিল,অন্যরকম স্বর ছিল,গলা জড়িয়ে যাচ্ছিল,চোখজোড়াও কেমন ভাসা ছিল; সমস্ত মুখশ্রীতে ছিল বিষাদ-বিষন্নতা,উদাসীনতা। আর কণ্ঠে অস্পষ্ট অভিমান,অভিযোগ-অনুযোগ এবং অনুরাগ। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো ধ্রুব। এর প্রায় আধঘন্টা পর কফি নিয়ে এলেন তিনি। ছেলের হাতে কফি তুলে দিলেন।

“আজেবাজে টেনশন করো না বাবা। তুমি শুধু তোমার লক্ষ্যের প্রতি মনোযোগ দাও। বাকিটা সামলে নেওয়ার জন্য তোমার বাবা-ভাইয়েরা আছে।”

বেরিয়ে গেলেন তিনি।
___

আসরের নামাজ আদায় করে বসলেন আসাদ সাহেব। উনার হাতে এক কাপ লেবু চা তুলে দিলেন। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন কেমন থমথমে।

“কী হয়েছে দিলরুবা?”

“কী হবে!”

কণ্ঠে কেমন অভিমানের পাহাড়।

“তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

“আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করেন।”

ভ্রু কুঁচকালেন।

“কী করেছি?”

“দরকার ছিল কাল ওমন নাটক করার?”

“তোমার ছেলে যে বউ রেখে ওই দেশে উল্টাপাল্টা কাজ করবে না তার কী গ্যারান্টি?”

“যা ইচ্ছে তাই করুক। সেটা তার জীবন সে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমাদের নেই। আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য আছে সন্তানের প্রতি সেগুলো পালন করা। তাদের প্রতি কোনো অধিকার দেখানো না। তার জীবনে কেউ আসবে-যাবে সেটা তার ইচ্ছে। তার জীবন সেখানে আমরা বলার কোনো অধিকার রাখি?”

“কী বলতে চাও?”

“আপনি আর কোনো জোরজবরদস্তি করবেন না। এটা খুবই খারাপ। জলদি ডিভোর্সের কাগজপত্র রেডি করুন। আমি চাইনা আমার ছেলে সারাজীবন কষ্ট পাক আমাদের জন্য। ভুল যেহেতু করে ফেলেছি সংশোধন করতে চাই! তাকে মুক্তি দিন নিশুর থেকে। জোরজবরদস্তি করে ভালো কিছু হয় না। নিশুর জন্য পাত্রের অভাব হবে না আর আমার ছেলের জন্যও মেয়ের অভাব হবে না।”

“ঠিক আছে যা ভালো মনে করো। ধূসরকে বলো কাগজপত্র রেডি করতে।”

অযু করতে চলে গেলেন দিলরুবা খাতুন। চোখগুলো ভিজে গেল উনার।
__

গোধূলি লগ্ন প্রায়। পশ্চিমাকাশে সিঁদুর রঙা লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে। রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই মুখোমুখি হলো নিশু-দ্যুতির। আতঙ্কিত হয়ে মাথা নুয়ে রইলো নিশু। ওদেরকে সাইড দিয়ে সরে দাঁড়ালো ধ্রুব। কম্পিত পায়ে এক সিঁড়ি করে উঠতে লাগলো নিশু। আঁড়চোখে নিশুর দিকে তাকালো ধ্রুব। মুখে মাস্ক এবং হিজাব বাঁধা। শুধু চোখের প্রলম্বিত পাপড়িগুলো দেখা গেল। নিশু তাকালো না গম্ভীর হয়ে দ্রুত উঠে গেল। নিচে নেমে গেল ধ্রুব। পিছু ফিরে তাকালো না নিশু। রুমে ঢুকে সোজা বিছানায় শুয়ে পড়লো।

“কী হয়েছে নিশু?”

“শরীরটা কেমন কাঁপছে!”

“কেন?”

“জানি না।”

হিজাব খুলে মাস্কও খুলে ফেললো। কপালে হাত রাখল দ্যুতি।

“কীরে তোর হঠাৎ জ্বর এলো যে?”

নিভু নিভু চোখে তাকালো নিশু।

“ভয় পেয়েছিস?”

মৌন রইলো নিশু।
___

প্রায় ঘন্টা তিনেক ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এরপর শপিংয়ে গিয়ে টুকটাক কেনাকাটা করে রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরলো ধ্রুব। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে চোখ পড়তেই দেখল হাজার তারার মেলা বসেছে। ভীষণ সুন্দর লাগছিল তারাভরা আকাশের সঙ্গে শীতল মুহূর্তটাও। কিছুক্ষণ পর পর হিমেল হাওয়া এসে শরীরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। শীত লাগছে তবে ওতটাও আহামরি নয়। থেকে থেকে জাম্বুরা কিংবা লেবুফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা দায় হয়ে পড়ছে! এতএত সুগন্ধি নিঃশ্বাস নিতেই শ্বাসনালীতে ঢুকে যাচ্ছে মাতাল করা ঘ্রাণটা। কাছে কোথাও থেকে কিচির-মিচির পাখির কলরব শোনা যাচ্ছিল মুহূর্তটিকে আরেকটু আবেগঘন করতে। অবশ্য বাসার পিছনে বেশ কতগুলো নারিকেল গাছ,আম,জাম,কাঠাল,লিচু,পেয়ারা,জাম্বুরা,করমচা,ইয়া বড় একটা ঝোঁপালো সফেদা গাছ,আমড়া গাছ,কামরাঙাগাছ,মাঝারি সাইজের পাঁচটি দেশী কাঠবাদাম গাছ,আর বাসার পিছনের গেট দিয়ে বের হতেই মাঝারি আকৃতির ঝোঁপালো একটা টগরফুল গাছ রয়েছে। এককোণ জুড়ে রয়েছে কমলা রঙের বেশ কতগুলো মনোমুগ্ধকর রোজ ক্যাকটাস। ঝাঁকে ঝাঁকে রোজ ক্যাকটাস ফুটে থাকে। আছে একটা হাসনাহেনা আর রক্তজবা গাছও। সফেদা গাছের মধ্যে বেশ কতগুলো কাকের বাসা,তদ্রূপ নারিকেল গাছটায়ও। আমগাছেও বেশ কয়েকটা পাখি এবং কাকের বাসা দেখেছিল; হতে পারে সেখানে নতুন কোনো দম্পতির ছানাপোনারা কিচির-মিচির কলরব তুলছে। ও হ্যাঁ নারিকেল গাছের ফাঁকফোকরে বাসা বেঁধেছে বেশ কয়েক জোড়া টিয়াপাখি। এছাড়াও সারা বছর সফেদা ধরে থাকে ঝোঁপালো গাছটায়। কয়দিন পর পর কোথ থেকে কতগুলো বানর এসে কাঁচা-কচড়া সবগুলো সফেদা খেয়ে সাবাড় করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। আসাদ সাহেবের শখ এবং বিলাসিতার অভাব নেই। এই বাড়িটি একখন্ড জমির উপর তৈরী হলেও বাকি খন্ডটিতে তিনি বাড়ি তুলেননি। সেখানেও আস্ত ইয়া বড় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি হবে। কিন্তু তিনি সেখানে বাড়ি না করে দেশী-বিদেশী নানান রকমের ফলগাছ লাগিয়ে ছিলেন। শীতকালে সকালবেলা পিছনের গেট দিয়ে এসে রোদ পোহান একটা চেয়ারে বসে আর উনার সহযোগী রাসেলকে দিয়ে পুরো জায়গাটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখেন। অথবা সময় পেলে মাঝেমধ্যে বিকেলবেলায়ও সেখানে বসে চা পান করতে পছন্দ করেন। মাঝেমধ্যে রাসেলকে দিয়ে সেই পুরো জায়গাটি কুপিয়ে পালংশাক,লালশাক,ডাঁটাশাক অথবা ধনেপাতার বীজ ছড়িয়ে দিলে এতএত হয় যে খেয়ে শেষ করা যায় না। বিস্তর জায়গাজুড়ে বিলাতি ধনিয়াপাতাও রয়েছে এককোণ জুড়ে। সেখানে দুটি আমগাছের সঙ্গে একটি দোলনা বেঁধেছে নিশু-দ্যুতি। মনখারাপ থাকলে বিকেলে সেখানে গিয়ে বসে,সময় কাটায়,বই পড়ে কিংবা বাবল ওড়ায়। বাসার সামনে দিয়ে বুঝাই যায় না যে এত সুন্দর মস্তবড় বাড়ির পিছনে আরেকটি খন্ড রয়েছে গাছগাছালির। পিছনের ব্যালকনিতে এলেই গ্রামীণ গ্রামীণ একটা ভাইব পাওয়া যায়। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো উড়িয়ে দিলো আকাশের দিকে। হঠাৎ চোখ পড়লো পাশের ব্যালকনিতে। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সম্ভবত নিশু। অন্ধকারে তেমন একটা চেনার উপায় নেই। কোমর অব্ধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খোলা চুলগুলো হিমেল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সম্ভবত তারাভরা আকাশ দেখছে। সিগারেটটা ফেলে পায়ের তলায় পিষে রুমে ঢুকে গেল।
__

শিষ বাজাতে বাজাতে বাসার কলিংবেল চাপতেই ডোর খুললেন অনিকের বাবা।

“চাচা হেনা কোথায়? স্যরি হেনা না ফিতা আম্বানি!”

শক্ত চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। গুরুত্ব না দিয়ে বাসায় ঢুকল অনিক। ডোর অফ করে ছেলের দিকে তাকালেন। সোজা বেসিনের সামনে দাঁড়ালো অনিক।

“সে যাইহোক,চাচা আমার জীবনটা ছন্নছাড়া কেন? আমার জীবনের কামব্যাক কোথায়?”

আয়নায় তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে হাত ধুতে লাগলো অনিক।

“শ্লার কী একটা হ্যান্ডওয়াশ রেখেছে ফ্যানাই হয় না ধূৎ!”

হাত ধুয়ে টাওয়ালে মুছে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

“চাচা আমার জীবনটা এত এলোমেলো কেন? আমার গার্লফ্রেন্ড কেন আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না! কী হ্যান্ডওয়াশটা রাখলো সেটাতেও কেন যে ফ্যানা হয় না!”

হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে ঘাবড়ে গেল অনিক। রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

“কীরে ছাগলি চিৎকার করিস কেন?”

“পরশু এখানে রাখলাম এটা এখন দেখছি অর্ধেক হয়ে গেছে! এটা এভাবে শেষ করলো কোন জা’নোয়ার!”

কনফিউজড হয়ে তীর্যক চোখে তাকালো অনিক।

“ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক কর।”

“আমার এটা শেষ করলো কে?”

“আমি করছি এবার ভাগ! কী রাখছে ফ্যানা-ট্যানা কিছুই হয় না! আরো কত্তগুলা নেওয়া লাগে! যত্তসব ফাউল! ডেটওভার জিনিস আনছে ঘরে। এটার জন্য এত চিৎকার চেঁচামেচির কী আছে ফাজিল!”

“ডেটওভার মানে! তোমার মাথা বুঝলে! তুমি কি অন্ধ? পড়তে জানো না এটা কী! এটা আমার ফেইসওয়াশ। সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে কিনে এনেছি পরশু।”

অনিক বুঝতে পারলো না ঠিক কী বলবে! সে-তো হ্যান্ডওয়াশ মনে করে আজ দু-তিনদিন থেকে ইউজ করছে।

“ধূৎ!”

গুরুত্ব না দিয়ে রুমে ঢুকে গেল অনিক। বকাবকি করতে লাগলো বুশরা।

“ফকির কোথাকার! ফেইসওয়াশও চিনে না।”

“চাচা এখানে আমার কী দোষ? আমি কেন আমার বোনের বকুনি খাচ্ছি? আমি কি জানতাম ওটা ফেইসওয়াশ!”

বিরক্তিকর চোখে তাকালেন অনিকের বাবা।

“পাগল-ছাগলের পাল্লায় পড়লাম!”

চুপসে রইলেন অনিকের মা। দিনকে দিন অনিকের পাগলামি বাড়ছেই!

“ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলো না!”

টি-শার্ট খুলে উবু হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ফোন নিলো হাতে। অনলাইনে ঢুকতেই দেখল দ্যুতি এক্টিভ। উশখুশ করলো অনিক। কীভাবে কথা বলবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ একটা আইডিয়া এলো মাথায়। প্রোফাইলে গিয়ে সবগুলো পোস্টে হা হা রিয়েক্ট দিয়ে আসতেই হঠাৎ টেক্স এলো-“এই বখাটে কী সমস্যা আপনার?”

“কোনো সমস্যা নেই জান।”

“তাহলে হা হা রিয়েক্ট দিলেন কেন?”

“আসলেই কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না তাই সবার পোস্টে হা হা রিয়েক্ট দিয়ে এসেছি। তারমধ্যে বোধহয় তুমিও ছিলে। কি কপাল!”

“ডিজগাস্টিং!”

“বলো আই লাভ ইউ!”

“ফাউল!”

“তা তুমি সারা রাত অনলাইনে থাকো নাকি জরিনার মা?”

“হ্যাঁ থাকি তো জরিনার বাপ! উৎসাহ পেলে আরও থাকব। আপনার বাপের কী? আপনার দাদার কী? আপনার চৌদ্দ গুষ্টির কী?”

“আমাদের কারো কিছু না। সবাই তোমার মতো এত আজাইরা না ওকে!”

“তো জিজ্ঞেস করেন কেন?”

“এমনিই,তা কী করো?”

“আপনাকে বলব কেন?”

“আমাকে না বললে কাকে বলবা?”

“আচ্ছা আপনার লজ্জা করে না?”

“লজ্জা করবে কেন? লজ্জার কী আছে?”

“বয়সে বড় হয়েও সেদিন আমার ভাইয়ের হাতে মা’র খেয়েছিলেন এই ছ্যাঁছড়ামোর জন্য। আপনার কি শিক্ষা হয়নি?”

“ধূৎ! ওইরকম দু-চারটা থাপ্পড় আমার জন্য কিছু না। থাপ্পড় খাওয়ার পরেও ভালোবাসি তোকে!”

“ভণ্ড!”

“শুধু তোমার জন্য।”

“আপনার কারণে আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে!”

“কেন?”

“আব্বু দেখে ফেলেছে বুঝতে পারছেন না ব্যপারটা?”

“ধূৎ বাদ দাও!”

“এটা বাদ দেওয়ার বিষয়?”

“শ্বশুরমশাই কিছু বললে সোজা আমাকে ফোন করবা। আর না হয় আমার বাড়িতে চলে আসবা ওকে। ব্যস আমরা বিয়ে করে শ্বশুরমশাইকে সারপ্রাইজ দিবো। তারপর দশ-পনেরোটা বাচ্চাকাচ্চার বাপ-মা হয়ে যাব ওকে!”

“মাথার মধ্যে সব গোবর।”

“চিল করো জান! ডোন্ট প্যানিক!”

হঠাৎ নক পড়লো ডোরে। কেঁপে উঠলো দ্যুতি। দ্রুত মেসেজগুলো ডিলেট করে ব্লক দিলো অনিককে। মোবাইল লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে কম্পিত পায়ে এগিয়ে ডোর খুলতেই দেখল ধ্রুব দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে অষ্টম আশ্চর্য দেখছে দ্যুতি! এই রাতের বেলায় সূর্য ঠিক কোনদিকে উঠলো বুঝতে পারছে না!

“ভা..ভাইয়া তুমি!”

নীরব রইলো ধ্রুব। ধ্যান ভাঙ্গলো নিশুর। চট করে পিছু ফিরে রুমের দিকে তাকাতেই ধ্রুবকে দেখতেই কেঁপে উঠলো বুকের ভিতর। কেন এসেছে এখানে কিছু বুঝতে পারছে না। কেঁপে উঠে শক্ত করে ওড়না খামছে ধরে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রইলো। সারা শরীর কাঁপতে লাগলো অনবরত। নিশু বুঝতে পারে ধ্রুবর উপস্থিতিতে সে অসুস্থতা ফিল করে। হয়তো ধ্রুব নামটি অথবা মানুষটি তার জন্য একটি ফোবিয়া। কিছু বলতে নিবে হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতেই ভড়কে গেল ধ্রুব। কিছু না বলে রুমের দোরগোড়া থেকে বেরিয়ে যেতেই শুনতে পেলো তার দাদীমার গোঙানি। ছুটে গেল ধ্রুব। উনার রুমে যেতেই দেখল ওয়াশরুমে পড়ে আছেন। দ্রুত পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে বিছানায় শোয়ালো উনাকে।

“ওয়াশরুমে কীভাবে পড়লেন দাদু?”

“হঠাৎ পড়ে গেলাম।”

“একটু সাবধানে থাকবেন তো! দেখি কোথায় ব্যথা পেয়েছেন?”

“কোমরে।”

নীরব রইলো ধ্রুব। দিলরুবা খাতুন রসুন থেঁতলে তেল বাগার নিয়ে এসে কোমর মালিশ করতে লাগলেন। পিটপিট করে তীর্যক চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালেন সুফিয়া বেগম। কিছু না বলে সোজা ফার্মেসিতে গেল ধ্রুব। দাদীর জন্য ঔষধ কিনে এনে মায়ের হাতে দিলো কিন্তু কিছু বললো না। ছেলের দিকে একপলক তাকালেন দিলরুবা খাতুন। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো ধ্রুব।
___

কেটে গেল দুটো দিন। সব পূর্বের মতো থাকলেও সময় তার গতিতে চলছে। ডিনারের পর আলমারি খুলে একটি ফাইল বের করলেন আসাদ সাহেব। ফাইলটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সোফায় বসলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চশমা পরলেন। ফাইল খুলে বেশকিছু কাগজপত্র বের করলেন। এক কাপ লেবু চা এনে উনার সামনে রাখলেন দিলরুবা খাতুন।

“ওগো শুনছো!”

“জ্বী কিছু বলবেন?”

“এইগুলো সাইন করিয়ে আনো।”

চমকিত নয়নে তাকান দিলরুবা খাতুন।

“ক..কীসের?”

“ডিভোর্স পেপার।”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকান স্বামীর দিকে। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো মাথায়।

“এইভাবে রয়েছ কেন?”

“না মানে..”

“তুমিই তো বললে ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে। এখন সাইন করিয়ে আনো।”

উনি বলেছেন অভিমান থেকে তাই বলে সত্যি সত্যি করতে হবে! স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। উনারা দু’জন ধূসরকে বলেছিলেন ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে; কিন্তু সে সাফ সাফ নিষেধ করে দিয়েছে। পরে তাকে আজীবন দোষারোপ করবে সবাই। তাই সে এই বিষয় সম্পর্কে দূরে রইলো। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে আসাদ সাহেব নিজেই করে আনলেন।

“কী হলো?”

“এই তো!”

“ধরো।”

কম্পিত হাতে পেপারগুলো নিলেন।

“যাও তাড়াতাড়ি সাইন করিয়ে আনো।”

“আচ্ছা।”

কম্পিত পায়ে এগিয়ে গেলেন নিশুর রুমের দিকে।
_____

চলবে~