মায়াকুমারী পর্ব-১১

0
692

#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(১১)
___________________

প্রায় ঘন্টা তিনেক ফ্রেন্ডদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এরপর শপিংয়ে গিয়ে টুকটাক কেনাকাটা করে রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরলো ধ্রুব। রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে চোখ পড়তেই দেখল হাজার তারার মেলা বসেছে। ভীষণ সুন্দর লাগছিল তারাভরা আকাশের সঙ্গে শীতল মুহূর্তটাও। কিছুক্ষণ পর পর হিমেল হাওয়া এসে শরীরটা নাড়িয়ে দিচ্ছে। শীত লাগছে তবে ওতটাও আহামরি নয়। থেকে থেকে জাম্বুরা কিংবা লেবুফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা দায় হয়ে পড়ছে! এতএত সুগন্ধি নিঃশ্বাস নিতেই শ্বাসনালীতে ঢুকে যাচ্ছে মাতাল করা ঘ্রাণটা। কাছে কোথাও থেকে কিচির-মিচির পাখির কলরব শোনা যাচ্ছিল মুহূর্তটিকে আরেকটু আবেগঘন করতে। অবশ্য বাসার পিছনে বেশ কতগুলো নারিকেল গাছ,আম,জাম,কাঠাল,লিচু,পেয়ারা,জাম্বুরা,করমচা,ইয়া বড় একটা ঝোঁপালো সফেদা গাছ,আমড়া গাছ,কামরাঙাগাছ,মাঝারি সাইজের পাঁচটি দেশী কাঠবাদাম গাছ,আর বাসার পিছনের গেট দিয়ে বের হতেই মাঝারি আকৃতির ঝোঁপালো একটা টগরফুল গাছ রয়েছে। এককোণ জুড়ে রয়েছে কমলা রঙের বেশ কতগুলো মনোমুগ্ধকর রোজ ক্যাকটাস। ঝাঁকে ঝাঁকে রোজ ক্যাকটাস ফুটে থাকে। আছে একটা হাসনাহেনা আর রক্তজবা গাছও। সফেদা গাছের মধ্যে বেশ কতগুলো কাকের বাসা,তদ্রূপ নারিকেল গাছটায়ও। আমগাছেও বেশ কয়েকটা পাখি এবং কাকের বাসা দেখেছিল; হতে পারে সেখানে নতুন কোনো দম্পতির ছানাপোনারা কিচির-মিচির কলরব তুলছে। ও হ্যাঁ নারিকেল গাছের ফাঁকফোকরে বাসা বেঁধেছে বেশ কয়েক জোড়া টিয়াপাখি। এছাড়াও সারা বছর সফেদা ধরে থাকে ঝোঁপালো গাছটায়। কয়দিন পর পর কোথ থেকে কতগুলো বানর এসে কাঁচা-কচড়া সবগুলো সফেদা খেয়ে সাবাড় করে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। আসাদ সাহেবের শখ এবং বিলাসিতার অভাব নেই। এই বাড়িটি একখন্ড জমির উপর তৈরী হলেও বাকি খন্ডটিতে তিনি বাড়ি তুলেননি। সেখানেও আস্ত ইয়া বড় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি হবে। কিন্তু তিনি সেখানে বাড়ি না করে দেশী-বিদেশী নানান রকমের ফলগাছ লাগিয়ে ছিলেন। শীতকালে সকালবেলা পিছনের গেট দিয়ে এসে রোদ পোহান একটা চেয়ারে বসে আর উনার সহযোগী রাসেলকে দিয়ে পুরো জায়গাটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখেন। অথবা সময় পেলে মাঝেমধ্যে বিকেলবেলায়ও সেখানে বসে চা পান করতে পছন্দ করেন। মাঝেমধ্যে রাসেলকে দিয়ে সেই পুরো জায়গাটি কুপিয়ে পালংশাক,লালশাক,ডাঁটাশাক অথবা ধনেপাতার বীজ ছড়িয়ে দিলে এতএত হয় যে খেয়ে শেষ করা যায় না। বিস্তর জায়গাজুড়ে বিলাতি ধনিয়াপাতাও রয়েছে এককোণ জুড়ে। সেখানে দুটি আমগাছের সঙ্গে একটি দোলনা বেঁধেছে নিশু-দ্যুতি। মনখারাপ থাকলে বিকেলে সেখানে গিয়ে বসে,সময় কাটায়,বই পড়ে কিংবা বাবল ওড়ায়। বাসার সামনে দিয়ে বুঝাই যায় না যে এত সুন্দর মস্তবড় বাড়ির পিছনে আরেকটি খন্ড রয়েছে গাছগাছালির। পিছনের ব্যালকনিতে এলেই গ্রামীণ গ্রামীণ একটা ভাইব পাওয়া যায়। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়াগুলো উড়িয়ে দিলো আকাশের দিকে। হঠাৎ চোখ পড়লো পাশের ব্যালকনিতে। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সম্ভবত নিশু। অন্ধকারে তেমন একটা চেনার উপায় নেই। কোমর অব্ধি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খোলা চুলগুলো হিমেল হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সম্ভবত তারাভরা আকাশ দেখছে। সিগারেটটা ফেলে পায়ের তলায় পিষে রুমে ঢুকে গেল।
__

শিষ বাজাতে বাজাতে বাসার কলিংবেল চাপতেই ডোর খুললেন অনিকের বাবা।

“চাচা হেনা কোথায়? স্যরি হেনা না ফিতা আম্বানি!”

শক্ত চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। গুরুত্ব না দিয়ে বাসায় ঢুকল অনিক। ডোর অফ করে ছেলের দিকে তাকালেন। সোজা বেসিনের সামনে দাঁড়ালো অনিক।

“সে যাইহোক,চাচা আমার জীবনটা ছন্নছাড়া কেন? আমার জীবনের কামব্যাক কোথায়?”

আয়নায় তাকিয়ে কথাগুলো বলতে বলতে হাত ধুতে লাগলো অনিক।

“শ্লার কী একটা হ্যান্ডওয়াশ রেখেছে ফ্যানাই হয় না ধূৎ!”

হাত ধুয়ে টাওয়ালে মুছে রুমের দিকে পা বাড়ালো।

“চাচা আমার জীবনটা এত এলোমেলো কেন? আমার গার্লফ্রেন্ড কেন আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না! কী হ্যান্ডওয়াশটা রাখলো সেটাতেও কেন যে ফ্যানা হয় না!”

হঠাৎ চিৎকার শুনতে পেয়ে ঘাবড়ে গেল অনিক। রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

“কীরে ছাগলি চিৎকার করিস কেন?”

“পরশু এখানে রাখলাম এটা এখন দেখছি অর্ধেক হয়ে গেছে! এটা এভাবে শেষ করলো কোন জা’নোয়ার!”

কনফিউজড হয়ে তীর্যক চোখে তাকালো অনিক।

“ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক কর।”

“আমার এটা শেষ করলো কে?”

“আমি করছি এবার ভাগ! কী রাখছে ফ্যানা-ট্যানা কিছুই হয় না! আরো কত্তগুলা নেওয়া লাগে! যত্তসব ফাউল! ডেটওভার জিনিস আনছে ঘরে। এটার জন্য এত চিৎকার চেঁচামেচির কী আছে ফাজিল!”

“ডেটওভার মানে! তোমার মাথা বুঝলে! তুমি কি অন্ধ? পড়তে জানো না এটা কী! এটা আমার ফেইসওয়াশ। সাড়ে চার হাজার টাকা দিয়ে কিনে এনেছি পরশু।”

অনিক বুঝতে পারলো না ঠিক কী বলবে! সে-তো হ্যান্ডওয়াশ মনে করে আজ দু-তিনদিন থেকে ইউজ করছে।

“ধূৎ!”

গুরুত্ব না দিয়ে রুমে ঢুকে গেল অনিক। বকাবকি করতে লাগলো বুশরা।

“ফকির কোথাকার! ফেইসওয়াশও চিনে না।”

“চাচা এখানে আমার কী দোষ? আমি কেন আমার বোনের বকুনি খাচ্ছি? আমি কি জানতাম ওটা ফেইসওয়াশ!”

বিরক্তিকর চোখে তাকালেন অনিকের বাবা।

“পাগল-ছাগলের পাল্লায় পড়লাম!”

চুপসে রইলেন অনিকের মা। দিনকে দিন অনিকের পাগলামি বাড়ছেই!

“ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলো না!”

টি-শার্ট খুলে উবু হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ফোন নিলো হাতে। অনলাইনে ঢুকতেই দেখল দ্যুতি এক্টিভ। উশখুশ করলো অনিক। কীভাবে কথা বলবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ একটা আইডিয়া এলো মাথায়। প্রোফাইলে গিয়ে সবগুলো পোস্টে হা হা রিয়েক্ট দিয়ে আসতেই হঠাৎ টেক্স এলো-“এই বখাটে কী সমস্যা আপনার?”

“কোনো সমস্যা নেই জান।”

“তাহলে হা হা রিয়েক্ট দিলেন কেন?”

“আসলেই কেউ পাত্তা দিচ্ছিল না তাই সবার পোস্টে হা হা রিয়েক্ট দিয়ে এসেছি। তারমধ্যে বোধহয় তুমিও ছিলে। কি কপাল!”

“ডিজগাস্টিং!”

“বলো আই লাভ ইউ!”

“ফাউল!”

“তা তুমি সারা রাত অনলাইনে থাকো নাকি জরিনার মা?”

“হ্যাঁ থাকি তো জরিনার বাপ! উৎসাহ পেলে আরও থাকব। আপনার বাপের কী? আপনার দাদার কী? আপনার চৌদ্দ গুষ্টির কী?”

“আমাদের কারো কিছু না। সবাই তোমার মতো এত আজাইরা না ওকে!”

“তো জিজ্ঞেস করেন কেন?”

“এমনিই,তা কী করো?”

“আপনাকে বলব কেন?”

“আমাকে না বললে কাকে বলবা?”

“আচ্ছা আপনার লজ্জা করে না?”

“লজ্জা করবে কেন? লজ্জার কী আছে?”

“বয়সে বড় হয়েও সেদিন আমার ভাইয়ের হাতে মা’র খেয়েছিলেন এই ছ্যাঁছড়ামোর জন্য। আপনার কি শিক্ষা হয়নি?”

“ধূৎ! ওইরকম দু-চারটা থাপ্পড় আমার জন্য কিছু না। থাপ্পড় খাওয়ার পরেও ভালোবাসি তোকে!”

“ভণ্ড!”

“শুধু তোমার জন্য।”

“আপনার কারণে আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে!”

“কেন?”

“আব্বু দেখে ফেলেছে বুঝতে পারছেন না ব্যপারটা?”

“ধূৎ বাদ দাও!”

“এটা বাদ দেওয়ার বিষয়?”

“শ্বশুরমশাই কিছু বললে সোজা আমাকে ফোন করবা। আর না হয় আমার বাড়িতে চলে আসবা ওকে। ব্যস আমরা বিয়ে করে শ্বশুরমশাইকে সারপ্রাইজ দিবো। তারপর দশ-পনেরোটা বাচ্চাকাচ্চার বাপ-মা হয়ে যাব ওকে!”

“মাথার মধ্যে সব গোবর।”

“চিল করো জান! ডোন্ট প্যানিক!”

হঠাৎ নক পড়লো ডোরে। কেঁপে উঠলো দ্যুতি। দ্রুত মেসেজগুলো ডিলেট করে ব্লক দিলো অনিককে। মোবাইল লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে কম্পিত পায়ে এগিয়ে ডোর খুলতেই দেখল ধ্রুব দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে অষ্টম আশ্চর্য দেখছে দ্যুতি! এই রাতের বেলায় সূর্য ঠিক কোনদিকে উঠলো বুঝতে পারছে না!

“ভা..ভাইয়া তুমি!”

নীরব রইলো ধ্রুব। ধ্যান ভাঙ্গলো নিশুর। চট করে পিছু ফিরে রুমের দিকে তাকাতেই ধ্রুবকে দেখতেই কেঁপে উঠলো বুকের ভিতর। কেন এসেছে এখানে কিছু বুঝতে পারছে না। কেঁপে উঠে শক্ত করে ওড়না খামছে ধরে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রইলো। সারা শরীর কাঁপতে লাগলো অনবরত। নিশু বুঝতে পারে ধ্রুবর উপস্থিতিতে সে অসুস্থতা ফিল করে। হয়তো ধ্রুব নামটি অথবা মানুষটি তার জন্য একটি ফোবিয়া। কিছু বলতে নিবে হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতেই ভড়কে গেল ধ্রুব। কিছু না বলে রুমের দোরগোড়া থেকে বেরিয়ে যেতেই শুনতে পেলো তার দাদীমার গোঙানি। ছুটে গেল ধ্রুব। উনার রুমে যেতেই দেখল ওয়াশরুমে পড়ে আছেন। দ্রুত পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে বিছানায় শোয়ালো উনাকে।

“ওয়াশরুমে কীভাবে পড়লেন দাদু?”

“হঠাৎ পড়ে গেলাম।”

“একটু সাবধানে থাকবেন তো! দেখি কোথায় ব্যথা পেয়েছেন?”

“কোমরে।”

নীরব রইলো ধ্রুব। দিলরুবা খাতুন রসুন থেঁতলে তেল বাগার নিয়ে এসে কোমর মালিশ করতে লাগলেন। পিটপিট করে তীর্যক চোখে ধ্রুবর দিকে তাকালেন সুফিয়া বেগম। কিছু না বলে সোজা ফার্মেসিতে গেল ধ্রুব। দাদীর জন্য ঔষধ কিনে এনে মায়ের হাতে দিলো কিন্তু কিছু বললো না। ছেলের দিকে একপলক তাকালেন দিলরুবা খাতুন। নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো ধ্রুব।
___

কেটে গেল দুটো দিন। সব পূর্বের মতো থাকলেও সময় তার গতিতে চলছে। ডিনারের পর আলমারি খুলে একটি ফাইল বের করলেন আসাদ সাহেব। ফাইলটা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সোফায় বসলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে চশমা পরলেন। ফাইল খুলে বেশকিছু কাগজপত্র বের করলেন। এক কাপ লেবু চা এনে উনার সামনে রাখলেন দিলরুবা খাতুন।

“ওগো শুনছো!”

“জ্বী কিছু বলবেন?”

“এইগুলো সাইন করিয়ে আনো।”

চমকিত নয়নে তাকান দিলরুবা খাতুন।

“ক..কীসের?”

“ডিভোর্স পেপার।”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকান স্বামীর দিকে। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো মাথায়।

“এইভাবে রয়েছ কেন?”

“না মানে..”

“তুমিই তো বললে ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে। এখন সাইন করিয়ে আনো।”

উনি বলেছেন অভিমান থেকে তাই বলে সত্যি সত্যি করতে হবে! স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। উনারা দু’জন ধূসরকে বলেছিলেন ডিভোর্স পেপার তৈরি করতে; কিন্তু সে সাফ সাফ নিষেধ করে দিয়েছে। পরে তাকে আজীবন দোষারোপ করবে সবাই। তাই সে এই বিষয় সম্পর্কে দূরে রইলো। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে আসাদ সাহেব নিজেই করে আনলেন।

“কী হলো?”

“এই তো!”

“ধরো।”

কম্পিত হাতে পেপারগুলো নিলেন।

“যাও তাড়াতাড়ি সাইন করিয়ে আনো।”

“আচ্ছা।”

কম্পিত পায়ে এগিয়ে গেলেন নিশুর রুমের দিকে। নক করতেই ডোর খুললো দ্যুতি।

“কী আম্মু?”

“নিশু কই?”

“আমরা পড়তে বসেছি আম্মু।”

ভিতরে ঢুকলেন তিনি। উনার শুকনো,ভয়ার্ত এবং চিন্তিত মুখের দিকে তাকালো নিশু।

“কী হয়েছে ফুপি?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

“কিছু না।”

টেবিলের উপর পেপারগুলো রাখতেই বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো নিশু। ছ্যাঁত করে উঠলো কলিজাটা। বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেন তার মাথায়ও। কাঁপতে লাগলো নিশু। এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। ইশারা দিলেন নিশুকে।

“এ.এ..এইসব কী ফুপি!?”

বুকের সাথে নিশুর মাথাটা চেপে ধরে আচমকা কেঁদে ফেললেন।

“মারে আমার ছেলে তোকে চায় না ও মুক্তি চায়। আমরা তো অনেক চেষ্টা করলাম,জোরজবরদস্তি করলাম,ঠাণ্ডা মাথায়ও বুঝালাম কিন্তু কিছুর কিছুই হলো না। কী করবো বল! সে যদি নিজ থেকে রাজি থাকতো তাহলে একটা কথা ছিল কিন্তু সে-তো এই বিয়েটাই মানে না। আর পরিবারের চাপে পড়ে রাজি হওয়াটাও ভালো কিছু না। জোরজবরদস্তি করে কবুল বলানো যায় কিন্তু জোর করে প্রেম-ভালোবাসা কিংবা সংসার কোনোটাই তৈরি করানো যায় না। তার চেয়ে বরং ওকে মুক্ত করে দে আর তুই ও মুক্ত হয়ে যা। এত অবহেলিত হয়ে সংসার করার চেয়ে না করাই উত্তম!”

শ্বাস আঁটকে ভেজা ঢোক গিললো নিশু। বুক ঠেলে কান্না আসছে। দু’হাতে ফুপিকে জড়িয়ে ধরে আকস্মিক ডুকরে কেঁদে উঠলো।

“আমি ডিভোর্স চাই না ফুপি! কিছুতেই না! নিয়ে যাও এইসব!”

উনার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। উনাদের কান্না দেখে কেঁদে ফেললো দ্যুতিও। কেন জানি তারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে,কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু কেন? আশ্চর্য! ডিভোর্স হবে নিশুর তাহলে সে কাঁদছে কেন? পিছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো দ্যুতিও।

“সাইনটা করে দে নিশু।”

“আমি সাইন করতে পারবো না ফুপি নিয়ে যাও। আমি ডিভোর্স ভয় পাই! ভীষণ ভয়।”

তবুও নিজেকে শক্ত রাখলেন দিলরুবা খাতুন। চোখের জল মুছে শক্ত গলায় বললেন,”সময় নেই তাড়াতাড়ি কর তোর আব্বু বসে রয়েছেন।”

ফুপির বুকে মুখ গুঁজল নিশু। অনেকক্ষণ কাঁদলো।

“পারব না।”

পেপারগুলো এগিয়ে কলম তুলে দিলেন নিশুর হাতে। অশ্রুসিক্ত নয়নে অসহায় দৃষ্টিতে ফুপির দিকে তাকায় নিশু।

“কিছু করার নেই। সাইনটা কর।”

ঝাপসা নয়নে কম্পিত হাতে সাইন করতে…
__

চোখের জল মুছে গম্ভীর হয়ে ছেলের ডোরে নক করতেই বেশ সময় নিয়ে ডোর খুললো ধ্রুব। মাকে দেখতেই চমকাল।

“কী আম্মা?”

“ভিতরে ঢুকতে পারি?”

অপ্রস্তুত হলো ধ্রুব।

“কেন পারবে না!”

ভিতরে ঢুকলেন তিনি। হাত ধরে টেবিলের সামনে বসালেন ধ্রুবকে। পেপারগুলো রাখলেন ছেলের সামনে। কলম তুলে দিলেন ছেলের হাতে। গম্ভীর হয়ে থাকা মায়ের দিকে একপলক তাকাতেই চমকাল ধ্রুব। কেমন আঁধার মায়ের মুখজুড়ে। ইশারা দিলেন।

“সাইনটা করে দাও বাবা।”

“কীসের?”

পেপারগুলোর দিকে ইশারা দিলেন। পেপারের দিকে তাকাতেই চমকাল ধ্রুব। ডিভোর্স পেপার! পেপারগুলো কেমন ভেজা। জায়গায় জায়গায় ফোঁটা ফোঁটা পানি। চমকায় ধ্রুব। তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করলো ফোঁটা ফোঁটা ভিজে যাওয়া অংশে। নিশুর চোখের পানি হয়তো এগুলো! সাইন করতে নিতে নিশু বুঝি খুব কেঁদেছিল!

“সাইন করো।”

সাইন করার জায়গায় নিজের নাম লিখতে…
___

পরের দিন রাত আটটার দিকে রেডি হয়ে মাকে ডাকলো ধ্রুব। উনি আসতেই একটি কাগজের খাম বাড়িয়ে ধরলো।

“কী এটা?”

“এটা ওকে দিবেন।”

“কাকে?”

নীরব রইলো ধ্রুব।

“নিশুকে?”

“হুম।”

গম্ভীর রইলো ধ্রুব। রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন দিলরুবা খাতুন। কিছুক্ষণ পর বাসা থেকে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। অতঃপর রাত একটার ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিলো।
__

সকালবেলা কম্পিত পায়ে নিশুদের রুমে ঢুকলেন দিলরুবা খাতুন। ব্যালকনিতে হাঁটুতে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদছে নিশু। ওর সামনে গিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন খামটি। ঝাপসা নয়নে তাকায় নিশু।

“ধ্রুব দিয়েছে।”

খপ করে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেললো খামটি।

“বলেছিলাম আমি ডিভোর্স ভয় পাই!”

চিৎকার করে উঠে আচমকা চোখ-মুখ উল্টে জ্ঞান হারালো।
___

নিশুকে ডাক্তার দেখানো হলো। দশ বছর বয়সে থেকে এই অব্ধি প্রায় পাঁচবার মানসিক আঘাত পাওয়ার ফলে ডিমেনশিয়া ধরা পড়লো নিশুর। পুরনো সব স্মৃতি ভুলে গেল। কাউকে চিনতে পারে না ইভেন নিজেকেও না। তার নামটাও সে জানে না। দুপুরবেলা নিশুকে শুয়ে থাকতে দেখে গোসল করার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকল দ্যুতি। হঠাৎ শোয়া থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়নায় কিছুক্ষণ নিজেকে দেখল। নিজে নিজে কথা বললো। একটা শব্দ তার মনে আছে শুধু ডিভোর্স! একটা কেঁচি দেখতেই বের করে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে চুলগুলো কাটতে লাগলো। কাটতে কাটতে পিঠ অব্ধি করে ফেললো তবুও কাটতে লাগলো আর বলতে লাগলো,”আমি ডিভোর্স ভয় পাই! আমি ডিভোর্স ভয় পাই! বলেছিলাম আমি ডিভোর্স ভয় পাই! ভয় পাই! ভয় পাই!”

কেঁদে চিৎকার করে উঠে আচমকা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পারফিউমের বোতলটা ছুঁড়তেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। একটা কাঁচ হাতে তুলে নিতেই ওয়াশরুম থেকে বের হলো দ্যুতি। নিশুকে এমতাবস্থায় দেখতেই আঁতকে উঠে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো। দ্যুতির চিৎকার শুনে ছুটে এলো ওরা দু’ভাই। ওদেরকে দেখতেই হাতের রগের মধ্যে পোঁচ দিতে নিতেই আচমকা একটা থাপ্পড় পড়লো নিশুর গালে।

“পাগল!”

হতভম্ব হয়ে গালে রাখলো নিশু।

“মা’রলে কেন! আমি তো বলেছিলাম ডিভোর্স ভয় পাই!”

“কী করতে নিয়েছিলি তুই?”

নিজের দিকে তাকায় নিশু। আমতা আমতা করতে লাগলো।

“চুলগুলোকে এভাবে নষ্ট করলি কেন?”

কাটা চুলগুলো হাতে নিলো নিশু। ওরা লক্ষ্য করলো উঁচু-নিচু করে চুল কেটে নষ্ট করে ফেলেছে।

“তোকে কী করতে মন চায় বলতো!”

আরেকটা থাপ্পড় দিতে নিতেই গালে হাত রাখল নিশু।

“আসলেই আমি বুঝতে পারিনি।”

“কী বুঝতে পারিসনি? চল তোকে পাবনায় দিয়ে আসি। খুব বেড়েছিস!”

হাত টেনে বাইরে নিয়ে যেতেই এবার চেঁচিয়ে উঠলো নিশু।

“আমি পাবনায় যাব না! আমি পাবনায় যাব না।”

“সত্যি তোকে আজ পাঠিয়ে দিবো।”

“ধূসর ওকে ছাড়!”

“আম্মা তুমি বুঝতে পারছো না ও কী করতে নিয়েছিল। ওকে পাবনায় দিয়ে আসি।”

“ছেড়ে দে।”

“সকালবেলা ঔষধ খাইয়েছ?”

“আমি খাইয়ে দিয়েছি ভাইয়া।”

“আমি খাইনি ফেলে দিয়েছি।”

“কেন?”

“ঔষধগুলো খুব তেঁতো তাই!”

দাঁত কিড়মিড় করলো ধূসর।

“কেন ফেললি?”

“প্রতিদিন এত ঔষধ খেতে ভালো লাগে না।”

“চল পাবনায় দিয়ে আসি।”

বাসা থেকে বের করে বাইক বের করলো।

“উঠ!”

“আমি কোথাও যাব না।”

“তোর চৌদ্দ গুষ্টি যাবে।”

বাইকে তুললো নিশুকে।
_____

চলবে~