মায়াকুমারী পর্ব-১৩

0
560

#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(১৩)
___________________

নিশুর মেডিসিনের বক্সটা টেবিলে রাখলেন দিলরুবা খাতুন। সবগুলো মেডিসিন চেক করে খুলে নিশুর হাতে দিলো।

“নে এগুলো খা। ঔষধ খাওয়ার পর এক ঘন্টা তুই বসে থাকবি। কোথাও যেতে পারবি না। একটা ঔষধ ফেলে দিয়েছিস তো তোর খবর আছে। সত্যি তোকে পাবনায় পাগলাগারদে দিয়ে আসবো।”

নীরবে ঔষধগুলো খেয়ে নিলো নিশু। একসঙ্গে তাকে অনেকগুলো ঔষধ খেতে হয় মুড়ির মতো। সে পাগলাগারদে যেতে চায় না,সেখানে নাকি মানুষকে ধরে ধরে পিটায় আর ইনজেকশন দেয়। এরপর তারা আরো পাগল হয়ে যায়। সে পাগল হতে চায় না!

“ডাক্তার বলেছে এক বেলার মেডিসিনও যেন মিস না যায়। মিস হলেই তো আশা করি বাকিটা বুঝতে পারছেন কী হয় ওর! ওকে মেডিসিনের মাধ্যমেই কন্ট্রোল করা হচ্ছে। সামনে ওর এডমিশন। কীভাবে কী হবে আমি দিকদিশা কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না!”

ছেলের মুখের দিকে তাকান আসাদ সাহেব। সত্যিই ধূসরকে চিন্তিত দেখাল। আহ! এই চিন্তা বড় ছেলের মধ্যে তিনি কেন দেখতে পান না? অথচ দু’জনই তো উনার ছেলে। একই রক্ত গায়ে। ধ্রুব-ধূসরের ফেইস সেইম। ধীরাজেরটাও কিছুটা প্রায়ই একই। পার্থক্য শুধু গায়ের রং। ধ্রুব উনার গায়ের রঙ অর্থাৎ উজ্জ্বল শ্যামলা হলেও ধূসর আবার একটু ফর্সা হয়েছে মায়ের মতো। নয়তো তাদের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নেই। ও হ্যাঁ আরেকটা পার্থক্য আছে,ধ্রুব ইস্পাতের মতো শক্ত,কঠিন কিছুটা সেলফিশ হলেও ধূসর তার বিপরীত। অর্থাৎ তাদের সেইম ফেইস হলেও স্বভাব হচ্ছে হাতের এপিঠ-ওপিঠের মতো।

“এবার হয়তো মিস যাবে। থাক চিন্তা করিস না।”

“না আব্বা কিছুতেই ইয়ার গ্যাপ দেওয়া যাবে না।”

“এখন ওর তো মেমোরি টোটালি ড্যামেজ।”

“তাই বলে কি ট্রাই করবো না!”

“কীভাবে কী! ওকে উত্তর বললে ওত দক্ষিণে যাচ্ছে।”

নীরব হয়ে সব শুনতে লাগলো নিশু।

“যাইহোক ইয়ার গ্যাপ দেওয়া যাবে না আব্বা। আর আমি চাই নিশু পড়াশোনা করে স্টাবলিশ হোক। ফিনান্সিয়াল একটা দিক হোক। আজ-কাল মেয়েদের ইনকাম সোর্স থাকা অত্যন্ত জরুরি! কোটিপতির মেয়েরাও তাদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করে সেখানে যাদের কিছু নেই অর্থাৎ ফিনান্সিয়াল এবং পারিবারিক সাপোর্ট নেই তাদের উচিত সর্বপ্রথম নিজেকে স্বাবলম্বী করা। এছাড়াও নারীরা আঘাত না পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না; হোক সেটা শারিরীক কিংবা মানসিক। তাই প্রতিটি নারীর জীবনে যেকোনো একটা আঘাতই পারে তাকে স্ট্রং করতে; তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে! একবার! অন্তত একবার হলেও তুমুলভাবে ভেঙে যাওয়া উচিত সেটা নারী কিংবা পুরুষ! নয়তো নিজেকে পুনরায় শক্তভাবে দাঁড় করানো যায় না! কারণ মানুষ ব্যর্থ না হলে নিজেকে শক্ত খোলসে মোড়াতে পারে না,কষ্ট সহ্য করায় অভিজ্ঞ না হলে মানুষ দ্বারা দুঃখ পাওয়ার ব্যপারেও আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না!”

“মন্দ বলোনি তবে আল্লাহ কি আমাদের কম দিয়েছেন না-কি! নিশুর এইসবের প্রয়োজন নেই।”

দিলরুবা খাতুন বললেন,”আপনার তিন ছেলে। বড় ছেলে তো সংসার করবে না ওর সাথে। এখন তিন ছেলে বিয়ে করলে তিন ঘরের তিনটি মেয়ে আসবে। দ্যুতিকে বিয়ে দিলে সেও পরের ঘরে চলে যাবে। নিশুর বাড়ির অবস্থা ভালো নয়। না বাবার আর না মায়ের সাপোর্ট আছে; কিছুই নেই। এখন ছেলের বউরা কেমন না কেমন পড়ে! সবগুলো যে খারাপ হবে তা নয় আবার যে ভালো হবে তাও নয়। ভালোমন্দ মিলিয়েই মানুষ। প্রথম প্রথম হয়তো ভালো থাকবে পরে নিশুকে বোঝা মনে করে সাংসারিক সমস্যা করতে পারে। নিশু রোগী মানুষ। কেউ সিম্প্যাথি দেখিয়ে হয়তো বিয়ে করবে কিন্তু দিন-রাত খোঁটা তো দিবেই। জাহান্নামের ভিতর সংসার করবে কীভাবে ভাঙ্গাচোরা মেয়েটা! ধূসরের কথায়ই ঠিক। নিশুর পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত। তবে আমি কখনও মেয়েদের চাকরি করার পক্ষপাতী নয়। প্রত্যেকটা মেয়ের এডুকেটেড হওয়ার প্রয়োজন আছে। একান্ত অর্থনৈতিক সংকটে না পড়লে জব করা ঠিক না। নিশুর পড়াশোনার দরকার আছে। ইয়ার গ্যাপ দেওয়ার মানেই হয় না।”

“এখন কীভাবে কী?”

“নিশুকে হায়াদ্রাবাদ নিতে চাই আব্বা। ওখানের ট্রিটমেন্ট ভালো। আমার বিশ্বাস নিশু সুস্থ হয়ে যাবে।”

“ঠিক আছে যা ভালো হয় কর। টাকা লাগলে নিয়ে নিস।”

“নিশু যা রেডি হ কোচিংয়ে যাবি।”

উঠে গেল নিশু।

“কোচিংয়ে ও কী করবে?”

“বাসায় থাকলে মানসিকভাবে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার চেয়ে বরং কোচিংয়ে যাক। দ্যুতির সাথে বসে থাকবে। আর দ্যুতিরও একা একা ক্লাস করতে ভালো লাগবে না।”

“যা ভালো মনে করিস।”

“আজ আমার পরীক্ষা আছে। আমি ওদের পৌঁছে দিচ্ছি আপনি নিয়ে আইসেন। পরীক্ষা দিয়ে ইনানের বাবাকে দেখতে যাবো হসপিটালে। আর গুলশান যেতে হবে নিশুর একটা ইনজেকশনের জন্য।”

“আচ্ছা।”
__

রেডি হয়ে বাসা থেকে বেরুলো ওরা। বাইকে উঠলো ধূসর,তারপর দ্যুতি বসলো। নিশু দাঁড়িয়ে রইলো উঠলো না। স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে রইলো নিশু। সে এবার উল্টোপথে হাঁটতে লাগলো।

“নিশু ঠিক আছেরে গাধী?”

দ্যুতি লক্ষ্য করলো নিশু নেই।

“ভাইয়া থামো নিশু নেই।”

“কী!”

ব্রেক কষলো ধূসর। দেখল নিশু নেই। চোয়াল শক্ত করলো।

“তুই দেখিসনি ও উঠেনি?”

কিছু বললো না দ্যুতি।

“তোর মন কোথায়?”

নীরব রইলো দ্যুতি।

“আর এই মেয়েটা এত জ্বালাচ্ছে কেন!”

দ্রুত ছুটলো। দেখল বাসার সামনে নেই। সিকিউরিটি গার্ড বললো অন্যদিকে চলে গেছে নিশু। সেদিকে যেতেই দেখল আনমনা হয়ে নিশু হাঁটছে। হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে বাগানবিলাস দেখে থামলো নিশু। এক থোকা বাগানবিলাস ছিঁড়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,”ইশ! জীবনটাও যদি এই ফুলগুলোর মতো এত সুন্দর হতো!”

হঠাৎ ওর সামনে ব্রেক কষলো ধূসর। ভড়কে উঠলো নিশু।

“এই! এত জ্বালাচ্ছিস কেন?”

“তোমরাই তো আমাকে নাওনি।”

“উঠ!”

ধমকায় ধূসর।

“মাঝখান দিয়ে বস রোগী! নয়তো আবার থেকে যাবি রাস্তায়। গন্ডগোল একটা! বিষাক্ত মেয়ে!”

নিশু উঠলো তারপর দ্যুতি।

“ও বাইকে উঠলো না আরেক গাধীর কোনদিকে ধ্যান ছিল আমি বুঝতে পারছি না। সারাক্ষণ কাকে ভাবিস ওই বখাটেকে?”

“চুপ করবা এবার!”

“চড়িয়ে তোর গাল ফাটিয়ে দিবো।”

মুখ গোঁজ করলো দ্যুতি। কোচিং সেন্টারের সামনে নামিয়ে দিলো।

“রোগীর দিকে খেয়াল রাখিস। আর ওই বখাটের সঙ্গে কথা বললে খবর আছে। যা ভাগ!”

চলে গেল ধূসর। খানিকটা দূর থেকে নিশুর দিকে তাকিয়ে রইলো ইন্সপেক্টর আবির। মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলো নিশুকে। আবির বুঝতে পারলো সে নিশুকে পছন্দ করে ফেলেছে। নিশুর সম্পর্কে সব ডিটেইলস সে বের করে ফেলেছে। ক্লাসরুমে ঢুকে গেল ওরা। নিশুর একটি পিকচার আবিরের কাছে আছে। কাল অনিকের বাবা নিশুকে খোঁজার জন্য পাঠিয়েছিল। উনাকে দিয়েছিল বুশরা। সেভাবেই আছে। ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে পিকটা বের করে তাকিয়ে রইলো। নিশুর সঙ্গে দ্যুতি আর বুশরা এবং আরো দু-তিনটে মেয়ে আছে। হাস্যজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে রয়েছে নিশু। চুলগুলো খোলা এবং লম্বা লম্বা। স্ক্রিনের উপর হাত বুলিয়ে বলল,”তুমি সুন্দরী সুস্নিগ্ধা! আসমানের চাঁদের চেয়েও অপরূপা! আমি সাধারণ তোমার পাশে মানায় না!”

মৃদু হাসল। আনমনে আওড়ালো,”সুস্নিগ্ধা!”
__

যুক্তরাষ্ট্রে রাত তখন সাড়ে এগারোটা। ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে। স্নো পড়ছে অবিরাম। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কফি পান করতে করতে বরফের সৌন্দর্য দেখতে লাগলো ধ্রুব। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো। আননোন নাম্বার দেখে পিক করলো না। বারকয়েক রিং হতেই এবার পিক করতেই ভেসে এলো একটি মেয়েলি কণ্ঠ।

“হায় হ্যান্ডসাম কী করছো?”

ধ্রুব বুঝতে পারলো এটা অ্যানি। প্রতিত্তোর না করে সোজা ব্লক করলো। কিছুক্ষণ পর আরেকটি নাম্বার থেকে কল এলো। পিক করলো না। দেখল আননোন নাম্বারটি থেকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এসেছে।

“ব্লক করলে কেন? তুমি কি ডিস্টার্ব?”

এবারও ব্লক করলো। রাগে-জিদে আরেকটি নাম্বার থেকে ফোন করলো এবারও ব্লক দিলো। এরপর ফোন অফ করে রাখল। অ্যানি তার নাম্বার কীভাবে সংগ্রহ করলো বুঝতে পারছে না! তবে এখানে তার দু-তিনজন ফ্রেন্ড হয়েছে। ওরা নাম্বার নিয়েছিল। হতে পারে ওদের থেকে কালেক্ট করেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাকি কফিটুকু আর পান করলো না। শুয়ে পড়লো। ঘুমানোর চেষ্টা করতেই ভেসে উঠলো অ্যানির মুখটা। অ্যানি সুন্দরী হলেও বিরক্ত লাগে ধ্রুবর। সস্তাটাইপ মেয়ে একটা। যার পারসোনালিটি নেই। কিছুক্ষণ পর চোখ লেগে এলো।
__

বাইক নিয়ে কোচিং সেন্টারের সামনে অপেক্ষা করছে অনিক। দ্যুতি-নিশু ও তার ফ্রেন্ডরা বের হলো। দ্যুতি দেখল তার বাবা এখনও আসেনি।

“ধুতি চলো পৌঁছে দিই।”

“লাগবে না আব্বু আসবে।”

“সমস্যা নেই উঠো।”

“আপনি যান প্লিজ। সমস্যা হবে।”

“ছাগলটাকে ভয় পাচ্ছ তুমি?”

নীরব রইলো দ্যুতি৷ দ্যুতির মুখের দিকে তাকায় অনিক। মুখটা কেমন মলিন দেখাল।

“কী হয়েছে তোমার?”

“কিছু হয়নি।”

“চলো দু’জন ঘুরে আসি। নিশুকে না হয় বুশরা পৌঁছে দিবে।”

“না প্রয়োজন নেই।”

বুশরা বলল,”ভাইয়ার সাথে আজ না হয় যা।”

“না।”

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো ওরা। বুশরা তার প্রাইভেট কারে করে চলে গেল।

“শ্বশুর মশাই হয়তো বিজি চলো আমি পৌঁছে দিই।”

“বললাম তো লাগবে না।”

আচমকা হাত টেনে ধরে বাইকে উঠালো।

“চুপচাপ বসো। নিতা আম্বানি তাড়াতাড়ি পিছনে বসো।”

দ্যুতির দিকে তাকিয়ে নীরবে পিছনে বসলো নিশু। বাইক স্টার্ট দিলো অনিক।

“কাঁধে হাত রাখো।”

“পারবো না।”

“রাখো বলছি।”

“রাখব না।”

“ঠিক আছে জড়িয়ে ধরো।”

“ফাজলামো কম করুন।”

“ওকে।”

স্টার্ট দিয়ে জোরে স্পিড দিতেই অনিককে খাঁমছে ধরলো দ্যুতি। বাঁকা হাসল অনিক।

“এখন ধরলে কেন?”

“নাটক কম করুন।”

“ভালোই লাগছে ধুতি।”

“অসভ্য!”

“এই পথ যদি শেষ না হয় তবে কেমন হতো বলো তো!”

“আপনার মাথা হতো!”

“তুমিই বলো! না না তুমিই বলো।”

বিরক্ত হয় দ্যুতি। কপালে আজ শনি অপেক্ষা করছে!

“ওহ ধুতিপুতি! আমার না শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে!”

“কেন?”

“কারণ বাতাসে নাকি বহিছে প্রেম!”

“ভণ্ড!”

“এই ভণ্ডের প্রেমে একদিন তুমি পিছলে খেয়ে পড়বা।”

“যত্তসব!”

কিছুদূর এসে রেস্তোরাঁর সামনে বাইক থামাতেই চেঁচাল দ্যুতি।

“থামলেন কেন?”

“ওয়েট।”

“কী শুরু করলেন?”

“কিছু খাব চলো।”

“না।”

“কিচ্ছু হবে না চলো।”

“বললাম তো খাব না খুব বাড়াবাড়ি করছেন।”

সেই পথেই কারে করে আসছিলেন আসাদ সাহেব। ওদের দৃশ্যটুকু চোখে পড়লো উনার। এই নিয়ে তিনবার অনিককে দেখলেন তিনি। ব্যপারটি বুঝতে বাকি নেই উনার। আজ-কালকার ছেলেমেয়ে না বুঝার কী আছে! তবে টেনশনে পড়লেন। নাকউঁচু মন্ত্রীর ছেলে অনিক। এই সম্পর্কের পরিণতি ঠিক কী হতে পারে ঢের জানেন। সেই জন্যই হয়তো সকালে ধূসর বকাবকি করেছিল। ওদের রেখে রেস্তোরাঁয় ঢুকে অনিক বেশকিছু খাবার পার্সেল করে আনলো। কিছুতেই নিতে চাইলো না দ্যুতি। একটা ধমক দিতেই কেঁপে উঠে হাতে নিলো। নীরবে সবই দেখলেন আসাদ সাহেব। এরপর বাসার সামনে নামিয়ে দিলো ওদের।

“ধুতি শোনো!”

দাঁতে দাঁত চাপলো দ্যুতি।

“আমার নাম দ্যুতিধারা! ধুতি না। দ্যুতি ডাকতে না পারলে ধারা বলে ডাকবেন।”

“জ্ঞান কম দাও। শোনো ধুতি টেক্সট দিলে রিপ্লাই দিও।”

“আর দিব না।”

বাসায় ঢুকে গেল ওরা। মাথার চুলগুলো পিছনে ঠেলে সানগ্লাস পরে স্টার্ট দিয়ে চলে গেল অনিক। কিছুক্ষণ পর আসাদ সাহেব এসে থামলেন গেটের সামনে।
__

ধূসর-ধীরাজ ছাড়া লাঞ্চ করতে বসলো বাসার সবাই। গম্ভীর রইলো দ্যুতি। বাবার দিকে বার-বার আঁড়চোখে তাকাচ্ছে। তারা কীভাবে আসলো কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না; দ্যুতিও বললো না। তবুও আতঙ্কিত রইলো। খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো সবাই।

“ছেলেটা কে?”

থমকায় দ্যুতি। বাবার দিকে তাকাতেই দেখল তাকিয়ে রয়েছে। আমতা আমতা করলো।

“কে?”

“কার কথা বলছে আব্বু?”

“যার বাইকে করে এলে।”

বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় দ্যুতি।

“আব্বু ও বুশরার ভাই।”

“ওকে বলবে আমার সাথে দেখা করতে।”

মাথা নোয়ায় দ্যুতি।
___

“তুই একটুও সুন্দর না নিশু। আগের মতোই দেখতে বিশ্রী।”

“তুমি বুঝি সৌন্দর্যের পূজারী?”

“কখন বললাম?”

“ঠিক বলেছ আমি সুন্দর না তাই তো আমায় তুমি ডিভোর্স দিয়ে চলে গেলে।”

“তুই ভুল বুঝছিস আমাকে।”

“ভুল না ঠিক বলেছি।”

ঝুনঝুন আওয়াজ তুলে চলে গেল নিশু। কান চেপে ধরলো ধ্রুব।

“বন্ধ কর নিশু বন্ধ কর! কান ফেটে যাচ্ছে! বন্ধ কর! তোর জন্য একদিনও ঘুমাতে পারি না! আমি ঘুমালেই তুই ঝুনঝুন আওয়াজ তুলে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াস! বল এমনটা কেন করিস তুই? তুই কি আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবি না? আমাকে কি শান্তিতে ঘুমাতে দিবি না?”

প্রতিত্তোর করলো না নিশু। লাল কমলাভ শাড়িতে,খোলা চুলে এলোমেলো ঝংকার তুলে নিশু চলে যাচ্ছে।

“বন্ধ কর! বন্ধ কর! বন্ধ কর! সহ্য হচ্ছে না! পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি!”

চিৎকার করে উঠে বসলো ধ্রুব। ঘেমে-নেয়ে একাকার! হাঁফাচ্ছে সমানে। হঠাৎ আযান হলো। বুঝতে পারলো সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছে। চোখ বুজে রইলো ধ্রুব। ঠিক সেদিন থেকে একটা দিনও ধ্রুব ঘুমাতে পারে না। কমলা কিংবা হলুদ শাড়ি পরনে নিশুকে ওই অবস্থায় দেখতে পায়। সেদিন নিশুর পিছনের দিকে তাকানোটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
___

রাত প্রায় দুইটা। কিচেন থেকে ঠুনঠুন আওয়াজ আসছে। লাইট জ্বালানো। চমকায় ধূসর। এগিয়ে এসে উঁকি দিতেই দেখল নিশু কিচেনে। ভড়কায় ধূসর। লক্ষ্য করলো ভীষণ মনোযোগ দিয়ে চুলায় কিছু একটা করছে নিশু।

“নিশু কী করছিস?”

ভড়কে উঠলো নিশু। কিচেনে ঢুকল ধূসর।

“খিদে পেয়েছিল তাই ডিম ভাজছি।”

দেখল একটা ডিম,তার উপর মরিচ-হলুদের গুঁড়া,এরপর চিনি দিয়েছে এক চামচ।

“এটা তুই খাবি?”

“হ্যাঁ।”

“তোর মাথা দেখছি পুরোই খারাপ হয়ে গেছে নিশু। সর কিছু করে দিই। কী খাবি?”

“খাব কিছু।”

নিশুর দিকে একপলক তাকিয়ে একটা ডিম সিদ্ধ বসালো।

“কেবিনেটের উপর বস।”

কেবিনেটের উপর বসলো নিশু। একটা ডিম পোঁচ করে হাফ প্লেটে দিয়ে কাঁটাচামচ দিলো।

“নে এটা খা। নুডলস খাবি?”

মাথা নাড়ায় নিশু।

“আচ্ছা বস। এখন চিকেন নুডলস করতে বেশ সময় লাগবে। চিকেন ভিজতে ভিজতেও; সবজি দিয়ে খাবি?”

মাথা নাড়ালো নিশু। নরমাল ফ্রিজ থেকে তিন রকমের ক্যাপসিকাম,গাজর,বরবটি,পেঁয়াজকলি,মটরশুঁটি,শসা,টমেটো,কাঁচামরিচ,ধনেপাতা আর টমেটো কেচাপ বের করলো। ডিপ ফ্রিজ থেকে সসেজ,চিকেন বল আর চিংড়ি বের করলো। চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে কুচি করে ধুয়ে আদা-রসুন,লবণ,লেবুর রস এবং সয়াসস দিয়ে মেরিনেট করে রাখল। এরপর পরিমাণমতো সবজি কেটে ফুটন্ত পানিতে লবণ দিয়ে তিন মিনিটের জন্য ফুটতে দিয়ে আরেক চুলায় সসেজ এবং চিকেন বলগুলো ফ্রাই করে নুডলস সেদ্ধ করে নিলো। এরপর সসেজ এবং চিকেনগুলোকে কুচি করে রাখল। একটা সসেজ আর তিনটে চিকেন বল একটি হাফ প্লেটে তুলে নিলো।

“নে এটা খা।”

ধূসরের কাজ দেখতে দেখতে খেতে লাগলো নিশু। হঠাৎ কিচেন থেকে বেরিয়ে একটি ওড়না নিয়ে এলো।

“নে এটা গায়ে জড়িয়ে নে।”

ওড়না গায়ে জড়ালো নিশু। টি-শার্ট আর প্লাজু পরনে নিশুর। দেখতে তার কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে! চুলা অন করে একটি ফ্রাইপ্যান বসালো স্টোভে। তাতে তেল গরম করে পেঁয়াজকুচি নেড়েচেড়ে চিংড়িগুলো ভাজতে লাগলো। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলো নিশু।

“তুই যে রাতদুপুরে উল্টাপাল্টা কাজ শুরু করেছিস এটা কি ঠিক ধুতরাফুল?”

ধূসরের দিকে তাকায় নিশু।

“এত আদর-যত্নে রাখার পরেও তুই মানসিক রোগে ভুগছিস,এখন নতুন করে যোগ হলো ডিমেনশিয়া। তোর কথা ভেবে মাঝেমধ্যে অবাক হই! তোর সৎমায়ের কাছে থেকে কিলগুঁতো খেয়ে না জানি কী হাল হতো তোর! এখানে না চাইতেই তোর জন্য হাজির করছি সব। আদর-যত্ন কীসের অভাব বল! এরপরেও তুই ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হলি ভাবা যায় এগুলো! আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় যে তুই তোর সৎমায়ের কাছে থাকলে সুখে এবং সুস্থ থাকতি! কারণ কিলগুঁতো খেয়ে তোর আজেবাজে বিষয় নিয়ে টেনশন করার সময় হতো না। সৎমায়ের কিলগুঁতো খেতি আর নাকের জল,চোখের ফেলে সব এক করে কান্না করতি আর দিনরাত সব কাজ করতি সে-ই ভালো থাকতি! সুখ জিনিসটা তোর জন্য না! কথায় আছে না সুখে থাকলে ভূতে কিলায় তেমন!”
_____

চলবে~