#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(১৯)
___________________
বাসায় ফিরতেই দেখলো তোড়জোড় করছেন দিলরুবা খাতুন। চমকায় নিশু।
“নিশু এসেছিস?”
“হুম।”
“ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“কেউ আসবে ফুপি?”
“হুম।”
“কে?”
“জানতে পারবি। এখন একটু বিশ্রাম নিয়ে গরুর মাংসটা তুই রান্না কর।”
“আচ্ছা।”
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
“আম্মু কী বলছে নিশু?”
“মনে হচ্ছে বাসায় গেস্ট আসবে।”
“কে?”
“জানি না।”
আতঙ্কিত চোখে তাকায় দ্যুতি।
“আবার কেউ দেখতে আসবে না তো?”
“আমিও তো চিন্তায় আছি।”
ড্রেস চেঞ্জ করে নিলো দু’জন। দু’জনের মুখই চুপসানো। এই সাড়ে তিন বছরে কতশত বিয়ের অফার এসেছে। কত কষ্টে দু’জন বিয়ে ভেঙেছিল। দ্যুতির বিয়েগুলো ভাঙতে খুবই কষ্ট হয়ে যেতো। আর নিশুর মানসিক সমস্যা রয়েছে এটা শুনলে অটোমেটিক ভেঙে যেতো।
“আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে নিশু!”
“চিন্তা করিস না।”
শান্ত হয়ে একটা শ্বাস ফেলে নিচে কিচেনে চলে গেল নিশু। সবকিছু তৈরী করা আছে। শুধু রান্নাটা করবে সে। ইদানীং ওরা দু’জন ইউটিউব দেখে রান্না ট্রাই করে। গরুর মাংসটা নিশু খুব ভালো পারে। সব পেস্ট করা মশলা একসাথে দিয়ে কষিয়ে নিলো মাংস। তারপর হালকা আঁচে রান্না করতে লাগলো। গোসল সেরে এলো ধূসর। কিচেনের দিকে উঁকি দিতেই দেখলো নিশুকে।
“কী করিস?”
“মাংস রান্না করছি।”
“গোসল করিসনি?”
“রান্না সেরে একেবারেই করবো।”
লিভিং স্পেসে গিয়ে বসলো ধূসর।
“তুই সাতটার সময় এয়ারপোর্টে চলে যাস?”
“কেন আব্বা?”
“আসতেছে।”
বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো।
“আচ্ছা।”
উঠে রুমে ফিরে গেল।
___
লাগেজ গুছিয়ে ফ্রেন্ডদের থেকে বিদেয় নিয়ে একেবারেই এয়ারপোর্টে চলে গেল ধ্রুব। প্লেনে উঠতেই দেখলো নীলি তার অপরদিকের পাশের সিটে বসে আছে। বিরক্ত হলেও নীরব রইলো। ভাগ্যিস পাশাপাশি সিট পড়েনি। তবে তার পাশে অন্য একটি মেয়ের সিট পড়েছে। ভীষণ বিরক্ত হলো ধ্রুব। সে কি মেয়েদের যন্ত্রণা থেকে এবার একটু নিস্তার পাবে না? নীলি বোধহয় ভীষণ খুশি! বারবার তাকাচ্ছে! এদিকে তার পাশের সিটের মেয়েটাও বারবার তাকাচ্ছে। দুটি মেয়ের মধ্যে নিজেকে এলিয়েন বলে মনে হচ্ছে ধ্রুবর। এই দুটি মেয়েকে দীর্ঘ ২৪/২৫ ঘন্টা সহ্য করতে হবে তাকে। তপ্তশ্বাস ফেললো। মুখে মাস্ক লাগিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো। ছটফট করলো দু’জনই। ধ্রুবর মস্তিষ্ক টগবগ করছে! কখন না জানি এদের গায়ে হাত তুলে ফেলে! সে টেম্পার কন্ট্রোল করতে পারে না। মেয়ে মানুষ দেখলেই তার মাথায় রক্ত উঠে যায়। বিশেষ করে ছাপড়ি মার্কা ছ্যাবলামো করা ছ্যাঁছড়া মেয়েদেরকে দেখলে। আর ম্যারিড জানার পরেও গায়ে পড়া মেয়েদেরকে।
“ডিজগাস্টিং!”
হকচকায় মেয়েটি।
“আমাকে বললেন?”
নীরব রইলো ধ্রুব।
“এক্সকিউজ মি! আমি শিশির! পরিচয় হতে পারি?”
“নো!”
মুখটা চুপসে গেল শিশিরের। শিশিরকে কথা বলতে দেখে ভীষণ রাগ হয় নীলির। নিশ্চয়ই ধ্রুব মেয়েটার সঙ্গে সারা পথ কথা বলবে! রাগে-দুঃখে কান্না পেলো নীলির। বারবার পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো দু’জনকে। কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লো শিশির। বুঝাই যাচ্ছে খুব ঘুমকাতুরে মেয়ে কিন্তু বার-বার ধ্রুবর দিকে মাথাটা চলে আসছিল। ভীষণ বাজে একটা জার্নি হলো তার। আর এদিকে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইলো নীলি।
__
উৎকণ্ঠা হয়ে আছেন দিলরুবা খাতুন। বারবার ব্যালকনিতে যাচ্ছেন তো আবার ফোন চেক করছেন। আসাদ সাহেবের ভাবভঙ্গি তেমন একটা বুঝা গেল না। গম্ভীর হয়ে লিভিং স্পেসে বসে টিভি দেখছেন। রান্নাবান্না করে টেবিল ভর্তি করে ফেলেছেন দিলরুবা খাতুন। যতটুকু নিশু বুঝতে পারলো ধ্রুব ফিরছে! কাঁপতে লাগলো সমানে। রুমের ভিতর যে ঢুকলো আর বেরুলো না। দ্যুতি অনেক খুশি তার ভাই ফিরছে! মলিন মুখে রিডিং টেবিলে বসে রয়েছে নিশু। দৃষ্টি তার বইয়ের মধ্যে নিবন্ধ থাকলেও মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঠিক যতটা শান্ত দেখা যাচ্ছে তারচেয়েও হাজার গুণ অস্থিরতা তার ভিতরটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে! নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ডায়েরিটা নিয়ে তাতে লিখলো,”বসন্ত নয় আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিল অবহেলা!”
“আমি অনেক খুশি!”
চমকায় নিশু।
“কেন?”
“ভাইয়া আসছে এবার বিয়ে-শাদি করবে। নতুন ভাবী আসবে আর বড়সড় একটা পার্টি হবে হুর রে!”
বিয়ে-শাদি করবে কথাটা কর্ণগোচর হতেই যেন বুকের ভিতর একশো চুল্লির আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো। শ্বাস আঁটকে রইলো নিশু।
“অনেকদিন বড়সড় কোনো প্রোগ্রাম হয় না এবার হবে!”
নীরব রইলো নিশু।
“নিশু লিভিং স্পেসে চল! ভাইয়াকে কংগ্রাচুলেশন জানাতে হবে!”
“তুই যা।”
“আরে ভাইয়া আসবে তো!”
“আমি কী করবো!”
“চল।”
“যাবো না।”
লিভিং স্পেসে চলে গেল দ্যুতি। বিছানায় এসে কাঁপতে কাঁপতে শুয়ে রইলো নিশু। আশ্চর্য! তার এমন লাগছে কেন? শরীরটা হঠাৎই কেমন দূর্বল হয়ে কাঁপছে! শ্বাস আঁটকে আসছে ক্রমশ! আবারও কি পুরোনো ব্যামো উঠবে? না না আল্লাহ না করুক! প্রতিটি পরিস্থিতিতে তাকে শক্ত থেকে মোকাবিলা করতে হবে যেন তার কিছু যায়-আসে না। চোখ বুজে শুয়ে রইলো। হঠাৎ নিচ থেকে গাড়ি ব্রেক কষার শব্দ শুনতে পেলো। বুঝতে পারলো এসে পড়েছে! শ্বাস আঁটকে চোখ বুজে রইলো নিশু। ঘামতে লাগলো সমানে। ঢিপঢিপ করছে বুকের ভিতর। শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। টুপ করে এক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মোবাইল হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকে ধ্রুবর একটি পিকচারের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুকের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে সহ্য করতে। খুব অসহায় লাগছে নিজেকে। স্ক্রিনের উপর হাত বুলিয়ে বলল,”ধ্রুবতারা! আপনার মায়া আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না! প্রেমে পড়লে হয়তো ফেরার রাস্তা থাকতো তবে আমি তো পড়েছি মায়ায়। তাই ফেরার কোনো রাস্তা নেই! সে যাইহোক,আপনি আমাকে কষ্ট দেন বলে আমি কি আপনাকে ভালোবাসবো না তা কী করে হয়! ফুলপ্রেমী মানুষ কখনো কাঁটার পরোয়া করে না! তবে আমি চাই আপনি নামক ভুল মানুষটির জন্য জন্ম নেওয়া অনুভূতিগুলোর মৃত্যু হোক! মৃত্যু হোক! খুব শীঘ্রই মৃত্যু হোক!”
হঠাৎ শোরগোল শোনা গেল লিভিং স্পেস থেকে। রাত প্রায় একটা। ধ্রুব ফিরেছে। ছুটে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন দিলরুবা খাতুন। আনন্দে চোখে জল চলে এলো। মাকে বুকের সাথে মিশিয়ে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে মৃদু হাসলো,ঠোঁট ছোঁয়ালো মাথায়। আসাদ সাহেবকে গম্ভীর দেখালো। উনার মনেই হয়নি কেউ এসেছে মনোযোগ দিয়ে টিভিতে নিউজ শুনছেন। আশেপাশে সুক্ষ্ম দৃষ্টি বুলিয়ে মায়ের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে দ্রুত রুমের দিকে পা বাড়ালো। নিশুদের রুমের সামনে দিয়েই যেতেই দেখলো অন্ধকার। নিজের রুমে ঢুকে হট শাওয়ার নিতেই ডাক পড়লো ডিনারের জন্য। ফিটফাট হয়ে ডাইনিংয়ে গেল ধ্রুব। দেখলো হাস্যজ্জ্বল মুখে সবাই বসে রয়েছে। দৃষ্টি সরিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। পুত্রের দিকে তাকাতেই মন ভরে গেল দিলরুবা খাতুনের। আগের থেকেও অনেক ফেয়ার হয়েছে,শরীর-স্বাস্থ্যেও ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। আগে তো হ্যাংলা-পাতলা ছিল। এখন ঢের স্বাস্থ্য হয়েছে। ব্যক্তিত্বেও কেমন একটা গাম্ভীর্য এসেছে। ভারী হয়েছে আগের থেকেও অনেক। কণ্ঠও ভারী হয়েছে,মুখে চাপদাড়ির শেইপ দেখতে দারুণ লাগছে! কেন জানি বয়সটাও বেশি বলে মনে হচ্ছে! হয়তো জিম করা বডি আর না হয় স্বাস্থ্যের কারণে। তবে মন্দ লাগছে না! একদম পারফেক্ট একজন পুরুষের মতো লাগছে! অর্থাৎ অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সবমিলিয়ে ধ্রুবকে কেমন জানি অদ্ভুত অন্যরকম লাগছে। পুত্রের পরিবর্তনে ভীষণ খুশি দিলরুবা খাতুন। ভাইয়ের দিকে তাকায় দ্যুতি। চোখে পড়ার মতোই! ভীষণ খুশি হয়! নিশু দেখলে নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাবে! চোখই সরাতে পারবে না। কিন্তু বোকা মেয়েটা তো ডোর অফ করে শুয়ে আছে। নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করছে! মলিন হয়ে গেল মুখটা। মনে পড়লো অনিকের কথা! অনিকেরও তো ফিরার কথা! আচ্ছা অনিক কেমন আছে? আর সে দেখতে কেমন হয়েছে? আগের মতোই কি ফালতু রয়ে গেছে! একটু কি সিরিয়াস হয়েছে কিংবা পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে?এখনও কি ফালতু কথাবার্তা বলে?চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে গেল। সেদিনের পর অনিক আর তাকে ফোন করেনি সেও করেনি। অভিমানে অভিমানে সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও অনিককে ভুলতে পারেনি দ্যুতি। অনিক হয়তো তাকে ভুলে গিয়েছে। দ্যুতিরই বুঝতে ভুল হয়েছে। ওইসব অনিকের আবেগ ছিল! আর সে কি-না সিরিয়াস ভেবেছিল! ঠিক বলেছিল ধূসর। টুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আড়ালে মুছে নিলো। ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো নিজেকে। এটা-সেটা ছেলের প্লেটে তুলে দিচ্ছেন দিলরুবা খাতুন।
“সবাই আজ এতো দেরিতে ডিনার করছে যে!”
“তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল সবাই।”
নীরব রইলো ধ্রুব।
“গরুর মাংসটা কেমন হয়েছে বাবা?”
“ভালো।”
দিলরুবা খাতুন ভেবেছিলেন ধ্রুব হয়তো আরো কিছু জিজ্ঞেস করবে! নির্লিপ্তে খেতে লাগলো ধ্রুব।
“দ্যুতির পড়াশোনা কেমন চলছে?”
হকচকায় দ্যুতি।
“ভালো।”
দেখলো দ্যুতির চোখের পাপড়িগুলো কেমন ভেজা।
“কী হয়েছে তোর?”
“কিছু হয়নি।”
আগের থেকেও অনেক পরিবর্তন এসেছে দ্যুতির। আরেকটু বড় হয়েছে লম্বায়। সুন্দরীও হয়েছে!
“আম্মা খাচ্ছ না যে নাড়াচাড়া করছো কেন?”
“এই তো খাই!”
মলিন হাসলেন তিনি। চিন্তিত এই ভেবে ধ্রুব যদি বলে আমি নিশুকে ডিভোর্স দিয়েছি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই তাহলে! কেন জানি বুকের ভিতরটা খুব কাঁপছে! গম্ভীর হয়ে খাচ্ছেন আসাদ সাহেব। সবাই থাকলেও নিশুকে দেখতে পেলো না। আঁড়চোখে সবদিকে তাকালো।
“কাউকে খুঁজছো ভাইয়া?”
“না।”
“মনে হচ্ছিল খুঁজছো!”
“বাসার অনেক পরিবর্তন হয়েছে তাই!”
“ও হ্যাঁ,পুরাতন আসবাবপত্র চেঞ্জ করে নতুন এনেছে।”
ডিনার শেষ করে রুমের দিকে ফিরে গেল ধ্রুব। টায়ার্ড থাকায় ঘুমিয়েও পড়লো।
___
সকালবেলা ছেলের জন্য নাস্তা সাজিয়ে অপেক্ষা করছেন দিলরুবা খাতুন। লুচি,মাংস,সন্দেশ,পায়েশ,পুডিং,জুস সহ বেশ কয়েক আইটেমের ফল। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে গেল ধ্রুব। ব্রেকফাস্ট করতে বসলো। একপলক তাকালো সবার দিকে। সবাই উপস্থিত থাকলেও নিশুকে দেখা গেল না। নিশু কি এখানে থাকে না? অবশ্য সে বার তো বাসায় আসার পর সারাক্ষণ নিশুর নামটাই শোনা যেতো। নিশু এই কর! নিশু সেই কর! অবশ্য দারুণ কাজও দিয়েছে! নিশুকে না দেখেই..সে যাইহোক,রাত থেকে এই অব্ধি শোনা গেল না নিশুর নামটি। মনে হচ্ছে এই নামের কেউ নেই। নীরবে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তেমন একটা কেউ কারো সঙ্গে কথা বললো না। নীরবে যে যার যার মতো খেতে লাগলো। কিচেনের দিকে একবার তাকালো। রিনা খালা আর হ্যাল্পিং হ্যান্ড জোছনাকে দেখা গেল।
“কাউকে খুঁজছো বাবা?”
“না।”
দিলরুবা খাতুন আশা করলেন ধ্রুব হয়তো নিশুর কথা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু কিছুই হলো না। ব্রেকফাস্ট সেরে লিভিং স্পেসে বসলো। পেপার নিয়ে তাতে চোখ বুলালো। কফি এনে দিলেন দিলরুবা খাতুন। কফিতে চুমুক দিয়ে পেপার পড়তে লাগলো। পেপার রেখে কফিতে চুমুক দিতেই আকস্মিক চোখ পড়লো দেয়ালে। সেখানে পেন্সিল স্কেচ করা বিশাল একটি ছবি বাঁধাই করে টানিয়ে রাখা। আগ্রহী হলো ধ্রুব। কফি হাতে উঠে এগিয়ে গেল। পেন্সিল স্কেচে লম্বা চুলের দুটি মেয়ে। একটি মেয়ের চুল বেশি লম্বা! দুটি মেয়ের মধ্যে মনে হচ্ছে একটি দ্যুতি। আর লম্বা চুলের মেয়েটিকে চিনতে না পারলেও দেখতে ভীষণ মায়াময় লাগছে! চোখ,চুল যেন একটা আকুতি সৃষ্টি করছে মনে। মেয়েটির চোখগুলো একদম বড়বড়,টানাটানা কিন্তু মায়াবী। যেন চোখগুলো কথা বলে। সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছবিটা দেখতে লাগলো ধ্রুব। দ্যুতির পাশের মেয়েটা নিশু নাকি! বুকের ভিতর কেমন দুলছে!
“কী দেখছো?”
চমকে উঠে অপ্রস্তুত হলো ধ্রুব।
“কিছু না!”
“স্কেচটা দেখছো?”
“না।”
“আমি তো তা-ই দেখলাম!”
জ্যাককে কোলে তুলে চুমু খেয়ে সিঁড়িতে পা বাড়াতেই ধ্রুব বলল,”ওই লাগেজটা নিয়ে আয় তো!”
“কোনটা?”
“ব্ল্যাক।”
“বাহ! আসতে না আসতেই আমার হাতে কাজ করাচ্ছ ব্যপার কী ছাপড়ি ভাইয়া?”
চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব। ভ্রু কুঁচকায় দ্যুতি।
“আমি হলাম এই ঘরের প্রিন্সেস আর তুমি কি-না আমাকে অর্ডার দিচ্ছ মুডিবয়!”
“সামনে থেকে সর!”
ব্রেকফাস্ট সেরে ডাইনিং থেকে লিভিং স্পেসে এলো ধূসর-ধীরাজ।
“দ্যুতি ভার্সিটিতে যাবি না?”
“আজ যাব না।”
“কেন?”
“আজ ভাইয়া আছে বাসায়। ভার্সিটিতে মন বসবে না।”
“ধীরাজ,ব্ল্যাক কালারের লাগেজটা নিয়ে আয়।”
তাই করে সে। কফির মগ রেখে পায়ের উপর পা তুলে সোফায় বসলো ধ্রুব।
“লাগেজটা খোল তো!”
লাগেজ খুললো ধীরাজ। বেরিয়ে এলো লাগেজ ভর্তি চকলেট আর চকলেট এবং হরেকরকমের জেলি।
“এত্ত চকলেট!”
“তোদের জন্য! দ্যুতি এগুলো ফ্রিজে রাখ।”
জ্যাককে রেখে সবগুলো চকলেট ড্রিপ ফ্রিজে ঢুকাতে লাগলো।
“নষ্ট হয়নি তো?”
“না এখনও সব ঠাণ্ডা হয়ে আছে।
“বিমানে এসিতে ছিল।”
“হুম।”
“তাড়াতাড়ি ঢুকিয়ে রাখ গলতে শুরু করবে একটু পর। টায়ার্ড থাকায় রাতে মনে ছিল না।”
হঠাৎ লাভ শেইপের একটা বক্স ঢুকাতে নিতেই বলল,”ওটা ঢুকানো লাগবে না।”
“কেন?”
“আমার রুমে রেখে আয়।”
ভ্রু কুঁচকায় দ্যুতি।
“সত্যি করে বলো এটা কার জন্য এনেছো?”
“পাকনামি কম কর! যা বাইরে রাখ!”
“তোমার কোন প্রেমিকার জন্য এনেছো বলো তো?”
চোখ পাকায় ধ্রুব।
“ভয় পাই না তোমাকে ওকে!”
রাগে গজগজ করে সবগুলো চকলেটের প্যাকেট ড্রিপ ফ্রিজে রাখলো,চকলেট সিরাপগুলো নরমাল ফ্রিজে রাখলো। কত কী এনেছে আল্লাহ! কফির ডিব্বা,মধু,নানারকমের সস,কেচাপ,অলিভ অয়েল,প্যানকেকের গুড়া এবং সিরাপ,মিক্সড ড্রাই ফ্রুট,ফ্রুটো চার রকমের। এটা ভীষণ মজা লাগে দ্যুতির। খেতে ম্যাংগোবারের মতো! পাঁচ-ছয় রকমের বাদাম,কিশমিশ,খেজুর,ড্রাই ত্বীনফল,জেলি,বাটার,মায়োনিজ,চিজ,চকলেট পাউডার,অরিও কুকিজ,নানারকমের কুকিজ,চাইনিজ কেক,বাদাম ভাজা ইত্যাদি সবই আনলো। হরেকরকমের দামী মশলা পাউডার এবং আস্ত মশলাও আনলো,চার-পাঁচ আইটেমের কালার পাস্তা,তন্দুরি এবং বিরিয়ানি মশলা আনলো ভীষণ খুশি হয় দ্যুতি। সবমিলিয়ে তার ভাই মোট বড় বড় সাতটি লাগেজে করে জিনিসপত্র এনেছে। বাকি সব বাদেই বিভিন্ন ফ্লেভারের শুধু ডার্ক চকলেটই এনেছে প্রায় ৪০কেজির উপর। এরপর তো রয়েছে নানারকমের জেলি। ভীষণ খুশি দ্যুতি। সবই তার পছন্দের।
“কয়দিন ধরে শপিং করেছো ছাপড়ি ভাইয়া?”
চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব। মুখ টিপে হাসলো ধীরাজ। বাকি লাগেজগুলো আনার জন্য ইশারা দিলো। ধূসর উপরে চলে গেল। সেদিকে একপলক তাকালো ধ্রুব।
“আব্বা-আম্মাকে ডাক।”
উনাদের ডেকে আনলো দ্যুতি। এক এক করে গিফট বের করে প্রথমে মায়ের হাতে তুলে দিলো লেদারের সাইড এন্ড হ্যান্ড ব্যাগ,একজোড়া গোলাপবালা,একটা সোনার হার,একখানি জামদানি শাড়ি,শাল এইসব সহ নানারকমের কসমেটিকস। যদিও উনি ব্যবহার করেন না এইসব তবে খুশি হলেন।
“আব্বা এইসব আপনার জন্য নিন।”
বাবার হাতে তুলে দিলো হ্যান্ডওয়াচ,আইফোন,পারফিউম,ওয়ালেট,ডায়বেটিস,প্রেশার মাপার যন্ত্র সহ পুরো এক সেট,নানারকমের ঔষধ,এলকোহল প্যাড,ইনস্যুলিন,সুই-সিরিঞ্জ,একখানি শাল,স্যুট-প্যান্ট সহ ইত্যাদি। সবই পছন্দ হয়েছে উনার। আজেবাজে জিনিস কিনেনি। তবে গম্ভীর রইলেন। পিতার অভিব্যক্তি বুঝা গেল না।
“পছন্দ হয়েছে আব্বা?”
“গিফটের জিনিস পছন্দ না হলেও বলতে নেই।”
চুপসে গেল ধ্রুব। ধীরাজকেও গিফট ধরিয়ে দিলো। ছেলেদের পছন্দ সম্পর্কে সে অবগত তাই বুঝতে পারে কী কী পছন্দ হবে। বাদ রইলো ধূসর-দ্যুতি।
“আর তোদের দুজনেরটা আমার ঘরে। রুমে চল।”
মুখটা মলিন দিলরুবা খাতুনের। নিশুর জন্য কি কিছুই আনেনি? ডিভোর্স হলে কি কিছু গিফট দেওয়া যায় না?বোনের দৃষ্টিতেও তো একটু কাছে ডেকে কথা বলতে পারে বা কিছু দিতে পারে! বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
“কী হয়েছে আম্মা? মুখ মলিন যে?”
“কই না তো!”
মলিন হাসলেন তিনি।
“পছন্দ হয়নি?”
“পাগল ছেলে! হবে না কেন! আচ্ছা থাক তোরা আমার কাজ আছে!”
নিজের রুমের দিকে ফিরে গেলেন।
______
চলবে~