#অতঃপর_প্রণয়
#তাফসিয়া_মেঘলা
২২
নিরবতা বহমান৷ চারোপাশে পাখির কলতান ছাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না৷ ব্যাস্ত নগরী ব্যাস্ত হচ্ছে সবে৷ শীতের সকাল তাই কুয়াশা আচ্ছন্ন সব৷ আবছা অস্পষ্ট দূর দুরান্ত৷ শীত বেশ প্রগাঢ় ভাবেই রপ্ত করেছে ধরনীকে ৷ বিভাবসুর চিহ্ন মাত্র নেই৷ কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে বোধহয়৷ গাছ গুলোতেও শিশিরের ছোঁয়া৷ অলিন্দের গ্রীল গুলো ও ভিজে আছে৷ ঘুমকাতুরে নগরী ঘুম ভাঙছে সবে৷ সময়ের ব্যাবধানে কত কি ঘটেছে৷ কত কি পাল্টেছে৷
সব কিছুতে অদ্ভুত মৌনতা ঘ্রাস করেছে৷ কথারাও যেন গলা চেপে ধরেছে৷ আজ সে কিছু বলবেই না৷ মন বলে মৌনতা তার ভিষণ প্রিয় অথচ সে যে চঞ্চল৷ মৌনতা প্রিয় হলো কবে? মস্তিষ্ক বলে ফের কিছু শুধা৷ তবে মস্তিষ্ক বেশ কৌতুহলী৷ মন মস্তিষ্কের এমন বিড়ম্বনায় মেঘলাও ক্লান্ত৷ কৌতুহল আর দমাতে পারছে না৷ অলিন্দে থাকা দুটি মানুষ চুপই ভিষণ৷ জীবনের অদ্ভুত এক জায়গায় এসে থমকেছে যেখানে পথ নেই কোনো৷ বিয়েটা না হলেই হয়তো ভালো হতো? লোকটার হয়তো রাগ হচ্ছে এখন? হয়তো ভাবছে বিয়েটা করলো কেন? কিন্তু ওর কি দোষ? ও তো বলেছিলো কথা আছে৷ শুনেনি ওর কথা৷ লোকোতা সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি৷
ভাবে নিজে যা করে তাই ভালো৷ ঠিক আছে এখন পস্তাক৷ মেঘলা অতশত ভাবে না, যা হবে হবে সে জীবন নিয়ে আর অভিযোগ করে না৷ তবে ভয় হচ্ছে এ লোক যা রাগী৷ কি করবে?
মেঘলা বেশ কাচুমাচু খেয়ে মাথা নিচু করে আছে৷ মাঝে মাঝে বেশ কৌতুহল নিয়ে শোভনের পানে তাকাচ্ছে যদি লোকটা বলে কিছু৷ সে তো ভেবেছিলো জানার পরই লোকটা রেগে যাবে তবে চুপই আছে৷
কোনো ভাবান্তর নেই যেন এমনকি খুব স্বাভাবিকই আছে৷ শোভনের বারান্দাটা বেশ বড় আর চওড়া একটা টেবিল দুটো চেয়ার আছে৷ পাশেই বেয়াম করার সরঞ্জাম এক পাশে শেল্ফে কিছু বই আছে৷
শোভন সে চেয়ারে বসে আছে৷ অদুরেই মেঘলা দাঁড়ানো৷ কথাটা বলার পর শুধু চেয়ারে গিয়ে বসেছে৷
শোভনকে চুপ দেখে মেঘলার বোধগম্য হলো না কিছু৷ তবে শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
“আমি বিয়ের আগেই বলেছিলাম আমার কথা আছে আপনার সাথে কিন্তু শুনলেন না কোনো কথা৷ আমি জানি এখন আপনার রাগ হচ্ছে আমার উপর৷ আর সে দিন আপনাদের অসম্মান করা আমার ইনটেনশন ছিলো না৷ আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য বিয়ে করতে রাজি ভেবে নিয়েছি যা হবে ভাবা যাবে৷ কিন্তু যখন শুনলাম আমার বাবা আমায় টাকার বিনিময় বিয়ে দিচ্ছে৷ তাও বয়সের অধিক লোকের কাছে আমি তাই বেরিয়ে আসলাম৷”
এইটুকু বলে থামলো মেঘলা৷ টুপ টুপ করে চোখ থেকে অবাদ্ধ দু-ফোটা পানি ঝড়লো৷ শোভন দেখলো তা৷ মেয়ে মানুষ বড়ই আশ্চর্য! চোখের পানি কি এসেই থাকে? হুট হাট কান্না আসে কি করে? এখানে কান্নার কি আছে?
মেয়েটার কান্নারত মুখঅবয়ব যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে৷
শোভন এবার মৌনতার সাথে বিচ্ছেদ ঘটালো৷ বললো গম্ভীর স্বরে,
“আমায় কি বয়স্ক মনে হয়?”
মেঘলা থতমত খেলো৷তাকালো শোভনের পানে৷ চোখাচোখি হলো চোখ নামালো মেঘলা শোভন এখনো তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে যেন পলক ফেলা মানা৷ পলক ফেললেই অনর্থ হবে৷ লজ্জায় আড়ষ্ট হলো মেঘলা৷ আশ্চর্য লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
মেঘলা মিনমিনিয়ে বললো,
“না! আমি আপনাকে দেখিনিতো তখন৷ ”
শোভন বাকা হেসে বললো,
“দেখলে কি বিয়ে করে নিতে?”
শোভন কে রিয়েক্ট না করতে দেখে অবাকের উপর অবাক হচ্ছে মেঘলা৷ লোকটা এত শান্ত আছে কি করে?ধমকাচ্ছে না কেন তাকে? লোকোটা তো সব বিষয়ে রাগ দেখায়৷
মেঘলা কঠিন স্বরে বললো,
“না, করতাম না৷ আমি কি পন্য নাকি টাকার বিনিময়ে বিয়ে করবো?”
শোভন শুনলো৷ মেয়েটার মুখ জুড়ে কঠিনত্ব বিরাজ করছে৷ লজ্জায় লাল মুখ খানা কঠিন রুপ নিলো৷বললো সে ও,
“কি বলছো কি মেয়ে? তুমি শুধু তোমার ফ্যামিলিকে না আমায় ও ছোটো করছো৷ কোনো টাকা দেইনি আমরা৷ তোমাকে যে বলেছে এসব সে কেন বলেছে জানিনা৷ তবে যাচাই বাছাই না করে বেরিয়ে আমাদের ছোটো করা উচিত হয়নি৷”
মেঘলা নরম হলো৷ অবাক হলো কি বলছে কি? রাজের বোন তবে মিথ্যা বললো? অস্বাভাবিক কিছুনা যদিও৷ ওরা ওকে পছন্দ করে না৷
মেঘলা বললো,
“এসব সত্যিই বলছেন? আর আমি কালই বিয়েটা থামাতে চেয়েছিলাম৷ বলতে চেয়েছিলাম শুনেননি৷”
উঠলো শোভন টেবিল ছেড়ে কাছে এলো৷ খুব কাছে, যতটা কাছে এলে নিশ্বাসের শব্দ গণনা করা যায়৷ ঠিক ততটা কাছে৷ কিঞ্চিৎ ফারাক মাঝে গা ছুঁই ছুঁই ভাব৷
ফু দিলো মেঘলা চোখ মুখে অদ্ভুত রকম হাসলো৷ বললো,
“শোভন কে তোমার কাঁচা মনে হয়? আমার নাকের ডগায় বসে আমাকে প্রত্যাখ্যান করা মেয়ে ঘুরে বেড়াবে আমি জানবো ও না কিছু? তুমি সব যতটা কঠিন ভালো সব ততটা আদৌ কঠিন মেয়ে? শোভনের কাছে কিছু কঠিন না৷তোমাকে নিয়ে প্রথমদিন খটকা লাগলেও যেভাবে সন্দেহকে পাত্তা দেইনি৷ তোমার উপর আমার নজর পরেছেতো সে দিনই৷ আর শোভনের দৃষ্টিতে যে আসে তাকে সে খুটিয়ে দেখে৷ শোভনের হৃদয়ে দখল দারিতা চালাচ্ছে যে মেয়ে তার খোঁজ শোভন নেবে না?”
চমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘলা৷ যেন চোখ টা বেরিয়ে আসবে এখনি৷ তব্দা খেয়ে আছে বেশ৷ শোভন জানে সবটা? কি বলছে এই লোক? জানলো কি করে? এ কথাতো সে ছাড়া কেউ জানেনা৷ অহনা কে ও জানায়নি মেঘলা৷ বিস্ময়কর চোখে হা করে তাকিয়ে আছে মেঘলা৷
ভারী নেত্র পল্লব ঝাপটালো৷মুখ জুরে বিস্তৃত অবাকের রেশ৷ বিস্ময়কর চাওনি তার৷ কৌতুহলতা হু হু করে বাড়লো৷ এবার আর নিজেকে মৌন রাখতে পারলোনা৷ তড়িৎ গতিতে শুধালো,
“আপনি জানেন? কিন্তু কি করে? আপনি না বললেন আপনি মেয়েকে দেখেননি? আর আমার জানা মতে আপনার খালা আমাদের সব ঠিকঠাক করেছিলো৷ সত্যি বলছেন?আর বাড়ির সবাই কি এ কথা জানে?তাদের জানানো উচিত”
শোভন হাসলো খানেক৷ মেয়েটা এমন বোকাই? নাকি বোকা হওয়ার ভান করে? এইটুকু খবর শোভনের কাছে আর কি? একটা ফোন কলেই সব খবর নেওয়া সম্ভব৷ কোন মেয়ে তাকে এমন রিজেক্ট করলো তা সে জানবে না? আর একই দিনে একই সময় একটা মেয়ে স্টেশনে আসলো এটা নিয়েও সন্দেহ হবে না মনে? তারপর একটা মেয়ে আর আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আবার তার মনে অনুভূতি ঝড় চলছে এই মেয়েটাকে নিয়ে কৌতূহল বাড়বে না? সেই কবে থেকেই যানে সে৷ তবে তার এটা মাথায় আসে না ওই মেয়েটা মেঘলা কে এসব বলেছে কেন?
শোভন এবার ভাবুক হয়ে বললো,
“জানি সেই কবে থেকেই৷ কাল বাবা মা কে ও জানিয়েছি৷ আমার বাবা মা চমৎকার মানুষ তারা ভুল ধরে রাখে না৷ তবে সে দিন তোমার বোন সে সব বলেছিলো কেন? তুমি যাওয়ার পর তোমার বোনকে আমার সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলো আমি সেখান থেকে রেগে বেরিয়ে যাই৷ তারপ অদ্ভুত ভাবে পথে তোমার সাথে দেখা৷”
মেঘলা অবাক হলো আরেক দফা, দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালো৷ মানে ইচ্ছে করেই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে ছিলো যেন বিয়েটা ও করতে পারে? কিন্তু কেন? বিয়েটা তো বাড়ির সবাই মিলেই ঠিক করেছিলো৷ তাহলে এখানেও কেন এত ঝামেলা?
শোভন ফের বললো,
“সৃষ্টি কর্তার পরিকল্পনা অদ্ভুত কখন কি ঘটায় বোঝা বড় দায়৷ তোমাকে আমার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে তাই পালিয়েও সেই আমার পথেই আসতে হলো৷ আমার নামে হতে হলো৷”
বলে এক হাতে জড়িয়ে নিলো মেঘলাকে৷ মাঝখানে থাকা দুরত্ব টুকু ঘুচলো৷ স্পর্শ হলো, আলিঙ্গন হলো৷ নতুন প্রেমের সুর তুললো অনুভূতিরাও সমান তালে উপচে পরলো৷
চলবে,