#মায়াকুমারী ❤️
#ইয়ালিনী_আনজারা
#পর্বসংখ্যা-(২৫/খ)
___________________
স্বর্ণালংকারগুলো বের করে দেখতে লাগলেন দিলরুবা খাতুন। শপে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন আসাদ সাহেব। স্ত্রীর দিকে লক্ষ্য করলেন একবার। কেমন পুলকিত দেখাচ্ছে! গলা খাঁকারি দিলেন।
“খুশি মনে হচ্ছে তোমাকে?”
হকচকিয়ে উঠলেন।
“কই না তো!”
“গয়নাগুলোর কী হয়েছে আবার?”
“নিশুর জন্য একটা চেইন বানাতে দিব ভাবছি!”
“পুরোন স্বর্ণ ভাঙানোর দরকার নেই। অর্ডার দিয়ে বানিয়ে নিব।”
“তাহলে ছোট্ট ছোট্ট একজোড়া চুড়িও বানাতে দিয়েন। যেন একটু গাঢ় হয়। এক ভরির মধ্যে দেখিয়েন।”
“ছোট্ট চুড়ি কার জন্য।”
“ভবিষ্যতে নাতি-নাতনি হবে।”
বেরিয়ে গেলেন তিনি। গয়নার বক্সগুলো তুলে রাখলেন। নিশুর জন্য গড়িয়েছেন বিয়ের সময় দিবেন বলে। কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলেন। আজ ধ্রুবর পছন্দের খিচুড়ি করবেন। নিশু-দ্যুতি দু’জনে আবার ভর্তা খেতে পছন্দ করে।
__
হসপিটালে ভর্তি করালো নিশুকে। রক্তশূন্যতা এবং থাইরয়েড ধরা পড়েছে! ধীরাজকে ফোন করে নিয়ে দু’ভাই মিলে রক্ত দিলো নিশুকে। ঘুমিয়ে রয়েছে নিশু। খবরটি শুনতে পেলো আবির। ঢাকায় ছিল সে। মাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছিল ডক্টর দেখাতে তখন ওদেরও ঢুকতে দেখেছিল। কেবিনে ঢুকতেই চমকায় ওরা। অপ্রস্তুত হয় আবির। তাকে দেখতেই রাগ হয় ধূসরের।
“নিশু কেমন আছে?”
“ভালো।”
“কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি।”
ভালো লাগলো না ধূসরের কথাগুলো। তাকে হাজতে ঢুকানোর পর থেকে সহ্য হয় না আবিরকে।
“কীরে হালা তুই এখানে কী করছ?”
চমকিত নয়নে পিছু ফিরে তাকালো সবাই। মেজাজ খারাপ হলো আবিরের।
“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ।”
কলার খাঁড়া করলো অনিক।
“শান্তির ছেলে এখানে কী কাজ তোমার?”
“মুখ সামলে কথা বলো!”
“মাসুদ ভালো হয়ে যাও।”
আবির বুঝতে পারলো আর এক মিনিট এখানে থাকলে মানসম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। তাই মানে মানে এখান থেকে কেটে পড়া ভালো। অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেল আবির।
“হ্লায় কামডা করলো কী! ম্যারিড মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরে। হ্লা ছ্যাঁছড়া! ঘুষ খাইতে খাইতে পেট বাইর কইরা ফালাইছে! চাচা-মামার মতো লাগতাছে!”
দ্যুতির দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেজাজ খারাপ হলো। জিন্সের প্যান্ট আর টপস পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় হিজাব বাঁধা। সব বাদ জিন্সের প্যান্ট কেন পড়লো!
“আফা আপনি কোন দেশের ফকিন্নি? ইয়ে মানে কোন দেশের ভিখারি? উগান্ডা নাকি আফ্রিকা? নাকি এন্টার্কটিকার?”
রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো দ্যুতি।
“খবর্দার আমার এরিয়ায় ভিক্ষা করতে আসবেন না আফা। আপনার মতো ফকিন্নির জায়গা আমার এরিয়ায় নাই।”
দাঁতে দাঁত চাপলো।
“এই গাঞ্জাখোর এখানে কী কাজ তোর?”
“হ্লা পোলিও আম্বানি চুপ থাক!”
“গ্যাদারিং করবি না বলে দিচ্ছি বেরিয়ে যা।”
“হ্লা তোর পোলিও রোগের চিকিৎসা করা আগে। আর না হয় কৃমিনাশক ঔষধ খা।”
আচমকা টান দিয়ে দ্যুতিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। হতভম্ব হলো সবাই।
“ওরে কই নেস?”
“চুপ থাক!”
পিছু নিলো ধূসর।
“ছাড়ুন আমাকে! কী শুরু করলেন?”
বাইকে উঠে চলে গেল দ্যুতিকে নিয়ে। মেজাজ খারাপ হলো। থামলো একটি রেস্তোরাঁর সামনে।
“কী সমস্যা আপনার? অভদ্রতামি করছেন কেন?”
“এটা কী পরছো?”
“আপনার সমস্যা কোথায়?”
“ফকিন্নির মতো লাগতেছে! মনে হইতাছে ভিক্ষা করার জন্য বাইর হইছো! ভিক্ষা কইরা কয় টাকা পাইছো?”
“মুখ সামলে কথা বলুন! যা নয় তা বলছেন।”
রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। স্ন্যাকস-কফি অর্ডার করলো।
“এখানে কেন আনলেন?”
“ব্রেকফাস্ট করিনি।”
ধূসর ফোন দিতেই কেঁড়ে নিয়ে পিক করলো অনিক।
“তোর বোন আমার সঙ্গে। টেনশন করিস না হ্লা!”
কিছু বলার পূর্বেই কল কেটে অফ করে দিলো। ফোন নিয়ে বেরিয়ে যেতেই হাত টেনে ধরলো।
“বসো।”
“বাড়াবাড়ি আমার অপছন্দের!”
“বাড়াবাড়ি কই করলাম?”
“আপনি কোন সাহসে কীসের ভিত্তিতে আমার সাথে এমন আচরণ করছেন?”
চমকায় অনিক।
“ফাউল কথাবার্তা বাদ দিয়ে আপনি কি কোনোদিন ঠিক হবেন না?”
“না।”
“জীবনের প্রতি সিরিয়াস হবেন কবে?”
“সিরিয়াস হওয়ার মতো কিছু দেখি না।”
“আসলেই আমার বুঝতে ভুল হয়েছে। আমি একটা পাগলের সঙ্গে কথা বলছি! রাসকেল!”
উঠে বেরিয়ে যেতে নিতেই আবারও হাত টেনে ধরলো। দাঁতে দাঁত চাপলো দ্যুতি।
“আপনার কোনো রাইট নেই আমার হাত ধরার। আপনার সেই যোগ্যতা নেই আমার হাত ধরার। মাইন্ড ইট! আগে নিজেকে যোগ্য করে আসুন তারপর আমার হাত ধরবেন।”
অপমানিতবোধ করলো অনিক।
“কী বলতে চাও?”
“আমাদের জীবন থেকে সরে যান। দেখতে চাই না আপনাকে।”
“আমি কী করলাম?”
“হুটহাট আমাদের মধ্যে এসে ইন্টারফেয়ার করছেন। কে আপনি হ্যাঁ?”
বেরিয়ে গেল দ্যুতি। কিছুদূর যেতেই ধূসরকে দেখলো। চোখের জল মুছে নিলো গোপনে। দ্যুতির দিকে তাকায় ধূসর। দেখলো তার চোখের লম্বা লম্বা পাপড়িগুলো জবুথবু।
“ও তোর সঙ্গে কী করেছে?”
“কিছু করেনি।”
“সত্য কথা বল!”
“কিছু করেনি চলো।”
হাত টেনে ধরে হাঁটতে লাগলো। মস্তিষ্ক টগবগ করছে!
___
বিকাল পর্যন্ত হসপিটালে ওরা সবাই। নিশুর জ্বর,ঠান্ডা লেগেছে। শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে। রান্নাবান্না সেরে বসে রইলেন দিলরুবা খাতুন। একটা ছেলেমেয়েও আজ বাসায় নেই। ধ্রুব যে সেই কখন বেরিয়েছে ফোন করলেন পিক করলো না। টেনশনে পড়ে গেলেন। ধূসরকে ফোন করতেই পিক করে বলল,”কী আম্মা?”
“কই তোরা?”
“ঘুরতে এসেছি ঢাকার বাইরে।”
হসপিটালের কথা বললে টেনশন করবে তাই বললো না।
“ওহ। কখন আসবি?”
“একটু পর।”
“তাড়াতাড়ি আয়। আমি বসে আছি টেবিলে।”
“আম্মা আমরা তো লাঞ্চ করেছি। তুমি করে নাও।”
“তোর ভাইয়াও নেই।”
“কোথায় গিয়েছে?”
“জানি না ফোন তোলেনি।”
“আচ্ছা আমি দেখতেছি।”
ধ্রুবকে ফোন দিলো কিন্তু পিক করলো না। কয়েকবার দেওয়ার পরেও একই কান্ড। হতাশ হয় ধূসর। মাকে ফোন করে বলল,”আম্মা টেনশন করো না। ভাইয়া একটা কাজে আছে। তুমি খেয়ে নাও।”
“আচ্ছা।”
মলিন মুখে খাবারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেমেয়ে ছাড়া উনার মুখে খাবার উঠে না।
___
ডিসচার্জ নিয়ে বাসার পথে রওনা দিলো ওরা। নিশু হসপিটালে থাকবে না কিছুতেই। বমি-টমি করে ভাসিয়ে ফেললো সব।
“রমনা যাবি তোরা?”
নিভু নিভু চোখে তাকায় নিশু।
“ভাইয়া আমি যাবো!”
“তুই তো সবখানে যাস।”
“রমনা চলো ভাইয়া। নিশুর ভালো লাগবে।”
রমনার দিকে চলতে লাগলো গাড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর রমনায় পৌঁছালো ওরা। গাড়ি থেকে নামলো। উচ্ছ্বসিত প্রকাশ করলো দ্যুতি। পুরো রমনা পার্ক ছেয়ে গিয়েছে মনিমালা ফুলের অপরূপ সৌন্দর্যে! এত্ত সুন্দর নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতেই দু-হাত প্রসারিত করে ঘুরতে লাগলো দ্যুতি। ভালো লাগলো নিশুরও। ঝরে পড়া কিছু মনিমালা ফুলের পাপড়ি কুড়িয়ে নিলো দ্যুতি! হাঁটতে লাগলো ওরা চারজন। ধীরাজ এখন বড় হয়েছে লাজুকও হয়েছে। কথাবার্তা কম বলে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। কিছুটা হাঁটতেই আকস্মিক চোখ পড়লো দু’জন মানুষের উপর। শ্বাস আঁটকে তাকিয়ে রইলো নিশু। এমন দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না। চোখ কচলে নিলো। হ্যাঁ ঠিক দেখেছে সে। নিশুর চিনতে ভুল হয়নি। বিষয়টি নিতে পারলো না। দুঃখ-কষ্টে চোখজোড়া জলে টইটম্বুর হলো ভরা বর্ষার বিলের মতো! নিশুকে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো দ্যুতি।
“কীরে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলি কেন?”
নীরব রইলো নিশু। নিশুর দৃষ্টি বরাবর তাকাতেই দেখলো ধ্রুব নীলির সঙ্গে। থমকায় দ্যুতি!
“চল বাসায় ফিরি। রমনা দেখা হয়ে গেছে। অনেক সুন্দর রমনাপার্ক!”
পা বাড়ালো গাড়ির দিকে। কিছু ভেবে এদিকে তাকাতেই ওদের দেখে ফেললো ধ্রুব। অপ্রস্তুত হলো সে। নীরবে গাড়ির দিকে পা বাড়ালো দ্যুতিও। গাড়িতে উঠে বসলো সবাই। একটু আগে লক্ষ্য করেছিল নিশুর মন ফুরফুরে হঠাৎ কেমন গুমোট হয়ে রয়েছে। নীরব রইলো ধূসর।
“ভাইয়া হোস্টেলের কথা বলেছিলাম কিছু জানাওনি যে?”
“ভুলে গিয়েছি।”
___
বাসায় এসে পৌঁছালো ওরা। গাড়ি থেকে নামতেই বাসার সামনে থাকা ক্যাটস ক্ল ভাইন গাছটির দিকে দৃষ্টি গেল দ্যুতির। প্রতি বছর এই গাছের ফুল দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে সে। এই বছর মন উজাড় করে অজস্র ফুল ফুটেছে। কয়েকটি ফুল ছিঁড়তেই শুনতে পেলো,”ফুল ছেঁড়া ভালো নয়!”
চমকিত নয়নে পিছু ফিরে তাকালো দ্যুতি। তাহমিদের মতো আরেকটা ছেলেকে দেখতেই চমকায়। তাহমিদ সুঠাহ দেহের হলেও এই ছেলেটা তার চেয়েও কম। কিন্তু দেখতে মন্দ না সুদর্শনই! আমতা আমতা করলো নিশু। কারে উঠে চলে গেল ছেলেটি। বাসায় প্রবেশ করতেই দেখলো বেশ কয়েকজন মহিলা বসে রয়েছেন লিভিং স্পেসে। মৃদু হাসলেন দিলরুবা খাতুন। মিনমিন করে সালাম দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই দিলরুবা খাতুন বললেন,”নিশু এদিকে আয়।”
সেদিকে যেতেই পাশে বসালেন। তাহিয়া বেগম বললেন,”ও নিশু তাই না?”
“জ্বী ভাবী।”
“খুব মিষ্টি!”
নিশু লক্ষ্য করলো সবাই তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে রয়েছে। আমতা আমতা করলো।
“মেয়েকে পছন্দ হয়েছে আমাদের।”
মলিন হাসলেন দিলরুবা খাতুন। হকচকায় নিশু। নিশু লক্ষ্য করলো ভদ্রমহিলার মুখচ্ছবি তাহমিদের সঙ্গে মিল।
“উনারা কে ফুপি?”
“পাঁচ তলায় এসেছেন উনারা।”
“ওহ। ফুপি আমি রেস্ট নিতে যাচ্ছি। আসলেই ক্লান্ত লাগছে!”
“আচ্ছা যা।”
চলে গেল নিশু।
“ভাবী মেয়ে কিন্তু আমাদের পছন্দ হয়েছে।”
“আসলেই আমার বড় ছেলের ব..”
হঠাৎ বাসায় ঢুকলো ধ্রুব। একসঙ্গে সবাইকে বাসায় ঢুকতে দেখে ভীষণ খুশি হলেন দিলরুবা খাতুন। ভাবলেন নিশ্চয়ই সবাই ঘুরতে গিয়েছে। আরো ভাবলেন নিশুর সঙ্গে সব ঠিক হয়ে গিয়েছে। উনার খুশিটা কাউকে প্রকাশ করতে পারছেন না।
“এই প্রসঙ্গে আমরা অন্যদিন কথা বলি কেমন ভাবী?”
“আচ্ছা।”
উনারা ফিরে গেলেন। কিচেনে ঢুকে উড়িষ্যার বিখ্যাত নরম তুলতুলে মণ্ডা পিঠা বানাতে লাগলেন। ধ্রুবর পছন্দের এটা। রুমে ঢুকলো নিশু। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলো দ্যুতি।
“কেন এসেছেন উনারা?”
“কী জানি!”
“মনে হয় তোকে দেখতে এসেছে।”
“হতে পারে।”
“এজন্যই আমি বাসা থেকে কম বের হই। বাইরে গেলেও মাস্ক ছাড়া বের হই না। যেই দেখবে বিয়ের জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসবে।”
“নিশু শুনছিস?”
“জ্বী ফুপি।”
“এদিকে আয়।”
শাড়ি চেঞ্জ করে বেগুনি রঙের একটি পরে হাত-মুখ ধুয়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল।
“কী ফুপি?”
“একটু পায়েস রান্না করতো!”
“আচ্ছা।”
পায়েসের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়লো পুরো বাসায়। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে আসতেই লক্ষ্য করলো কিচেনে নিশু।
_____
চলবে~