সাহেবা পর্ব-১৩+১৪

0
54

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____

১৩.
প্রধানের বাড়ির সামনে সবাই দাঁড়িয়ে। পরিবেশ নীরব তবে গম্ভীর। প্রধানের বাড়ির সবাই বেড়িয়ে এসেছে। সাথে সীমান্তও আছে। সাইরাহ্-র হাত তখনও সাহিত্যের হাতের মুঠোয়। সীমান্তকে দেখেই সাইরাহ্-র হাত ছেড়ে দেয় সাহিত্য। সীমান্ত দেখে বিষয়টা। সাইমা আর তাহেরা এগিয়ে এসে সাইরাহ্-র পাশে দাঁড়ায়। দুজন দুপাশ থেকে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রাম প্রধান গম্ভীর গলায় বলে,

‘কি হইসে? এইহানে এতো গন্ডগোল কিয়ের?’

সাহিত্য একপলক তার দিকে তাকিয়ে সীমান্তের দিকে তাকায়। সরাসরি সীমান্তকে বলে, ‘আয়!’

সীমান্ত নড়ে না। প্রধান ফের শুধায়, ‘কই যাইবো ওয়? সাহিত্য কি শুরু করসো?’

সাহিত্য আবারও প্রধানের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলে, ‘সীমান্ত, তোকে আমি আসতে বলেছি! তুই আসবি? সাইরাহ্-কে আনছি একমাত্র তোর জন্য। তুই বলেছিলি আনতে, এখন দুরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়! মসজিদে যাবো।’

সীমান্ত কোনো কথা বলে না, এমনকি নিজের জায়গা থেকে নড়েও না। সাইরাহ্ একবার সাহিত্যের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার সীমান্তের দিকে। সীমান্তকে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে থমকায়। বুঝে যায় সীমান্ত আসবে না। সাহিত্যকে ডাকার আগেই প্রধান বলে,

‘ওয় যাইবো না। তোমরা যাও এইহান থেইকা।’

‘মামা সাহেব আমি আপনার সাথে পরে কথা বলছি। সীমান্ত তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’

সীমান্তের চুপ থাকা দেখে তামজীদও চমকায়। তামজীদ বুঝে যায় সীমান্ত ওর পরিবারের বিরুদ্ধে যাবে না। ভেতরে ভেতরে তার নিজেরও অস্থিরতা শুরু হয়। সদর দরজার পাশেই বেলী আর ছন্দ দাঁড়িয়ে আছে। তারা বেশ ভীত। কি হচ্ছে তাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তামজীদ এগিয়ে গিয়ে সাহিত্যের পাশে দাঁড়ায়। সীমান্তের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সাহিত্য কি বললো তুই শুনিস নাই? আসছিস না কেন? দেড়ি হয়ে যাচ্ছে। দেখ সীমান্ত! তুই সাইরাহ্-কে চেয়েছিলি আমরা তোর ওপর জোড় করে চাপিয়ে দিচ্ছি না।’

প্রধান চেচিয়ে ওঠে। দু পা এগিয়ে এসে ক্ষে’পা ষাঁড়ের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে বলে, ‘তোমরা আজগুবি কথা বন্ধ করবা? নিজেরা আকাম কইরা এহন আমার পোলার লগে ওই মাইয়ারে মিলাইতাছো ক্যান? ওই মাইয়ারে আনছো তোমরা, আমার পোলা গেছিলো? ওর লগে যদি কিছু থাকতোই তাইলে তোমরা না যাইয়া ওয় যাইতো। আর এই মাইয়া! লাজ লজ্জা বলতে কিছু নাই? পরপুরুষের হাত ধইরা ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা আইসা পড়লা! না”গর লাগে নাকি?’

সাইরাহ্-র কান ঝা ঝা করে ওঠে। সাহিত্য রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এতোগুলো কথারও পরেও সীমান্ত একটা কথাও বলে না। সাইরাহ্ ফাঁকা ঢোক গিলে তার দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়,

‘আমি নাচতে নাচতে চলে আসিনি প্রধান কাকা। উনি আমারে আনছে। তাই আমার নামে যা তা অপবাদ দিবেন না। আর যেই প্রশ্নগুলা আপনি আমাদের করতেছেন একই প্রশ্ন আগে নিজের ছেলেরে করেন!’

‘সাইরা!’

প্রধানের ধমকে সাইরাহ্ মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাহিত্য অতি মাত্রার শান্ত গলায় বলে, ‘মামা সাহেব, আমি আপনার-ই বোনের ছেলে। আপনি জানেন আমি কি পারি আর কি পারি না! তাই আমার সামনে ওরে এমন কিছু বইলেন না যেইটা আপনার গলায় পরের বার কাঁটার মতো বিঁধে!’

এর মাঝেই প্রধানের সব সদস্য হাজির হয়ে যায়। সবাই এক প্রকার দৌড়ে এসে প্রধানের পাশে দাঁড়ায়। তারা সব শুনেছে। এখানে এসে সাহিত্যর বলা বাক্যগুলোও শুনেছে। প্রধানের সদস্যের তালেব উদ্দীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সাহিত্যের দিকে৷ পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে বলেন, ‘তোমার এতো লাগতাসে কেন মিয়া? তোমার লগে যদি ওর কিছু নাই থাকে তাইলে তোমার এতো দরদ ক্যান? তুমি কেডা লাগো ওর?’

প্রধান ঠান্ডা মাথায় বলে, ‘দেহো সাহিত্য! এইসব ঝামেলা বাদ দিয়া তুমি ওরে ওর বাড়ি দিয়া আসো। আর নিজেও বাড়ি যাও।’

প্রধানের কথায় সাহিত্য নড়ে না৷ সাইরাহ্ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাহিত্যের মুখের দিকে। যাকে সে পাশে আশা করেছিলো সে আসেনি আর যাকে সে আশা করেনি সে এসে তার পাশে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ এও সম্ভব? নীরব ব্যাথায় ভেতরটা তিতকুটে হয়ে আসে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রয়। প্রধানের আরেক সদস্য শাহিন শেখ বলেন,

‘তুমি এই গ্রামের পোলা। তোমারে আমরা ছোট থেইকা দেখতাছি। তুমিও তো জানো এই মাইয়া বি’ধবা। তাও এসব ঝামেলা করতাছো কেন? তোমার এই সব বিষয়ে কথা কওয়ার দরকার নাই। বাড়ি যাও!’

সাহিত্য, সাইরাহ্ জবাব দেওয়ার আগেই পাশ থেকে সবুর মিয়া ঠেস দিয়ে বলে, ‘দিয়া আসো কইলেই কি হইয়া যাইবো প্রধান সাহেব? এরা আমার মাইয়ারে বিয়ার আসর থেইকা তুইলা আনছে। আপনের কি মনে হয় এই ঘটনা পোলাপক্ষের কানে যাইবো না? বিয়া হইবো আমার মাইয়ার?’

প্রধান কটমট করে তাকায়। সবুর মিয়া সে দৃষ্টি পাত্তা দিলেন না। যেনো সে দেখেইনি। সাহিত্য ঘটনা বুঝে ত্যাড়া ভাবে হেঁসে জবাব দেয়, ‘কথা বলার দরকার আছে দেইখাই তো বলতেছি চাচা সাহেব। আপনাদের এইসব অ’ন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি আগেই কথা বলতাম তাইলে এই মেয়েটার আর আজকে এইসব দেখতে হইতো না। শুধু মুখে মুখেই শিক্ষিত হইছি। পুরোপুরি শিক্ষাটা এখনো অর্জন করতে পারিনি। আর মামা সাহেব! সীমান্ত সাইরাহ্-কে ভালোবাসে। ওর জন্য আমি সাইরাহ্-কে আনছি, আবার ওর গায়ে আপনারা একটা ক’লঙ্ক দিতেছেন! এতোকিছুর পর চলে যাবো? তা তো হয় না। সীমান্ত তোকে আমি শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করতেছি, ‘তুই আসবি কি না?’

এবারও জবাবটা প্রধান-ই দেয়, ‘আমার পোলা কোথাও যাইবো না। তোমরা বিদায় হও।’

‘উনি আসবে না সাহিত্য ভাই। আমারে যাইতে দেন। বাড়ি যাবো।’

সাইরাহ্-র কন্ঠে প্রাণ নেই। অনেক কষ্টে যেনো বাক্যগুলো আওড়েছে। সাহিত্য কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে দৃঢ় স্বরে বলে, ‘আমি যখন তোরে আনছি তখন সব দায়িত্ব-ই আমার।’

এরপর ফের সীমান্ত-কে প্রশ্ন করে, ‘তুই জবাব দিবি?’

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সীমান্ত বলে দেয়, ‘ওরে ওর বাড়ি রাইখা আয়। আমি ওরে বিয়ে করতে পারবো না।’

সাহিত্য রাগে সীমান্তের দিকে এগোতে নিলে তামজীদ আটকে ধরে। জোড়েই বলে, ‘ওর সাথে কথা বলাও শুধু সময় ন’ষ্ট। ওয় এখন বাপের পা চাটা কু’ত্তা হয়ে গেছে। চল এইখান থেকে!’

প্রধান ক্ষেপে যায়। তামজীদের বাবা তালেব উদ্দীন তামজীদরে ধমক দেয়। সাইরাহ্ দাঁড়ানো অবস্থায় পড়ে যেতে নিলে তাহেরা আর সাইমা ধরে ফেলে। সাইরাহ্ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বড় বড় শ্বাস নেয়। নিজ মনেই আওড়ায়, ‘এটা হওয়ার ছিলো, আর আমি তা জানতামও। তাহলে এতো অবাক হচ্ছি কেনো?’

এর মাঝেই সবুর মিয়ার বাড়ির পাশের দুই লোক ছুটতে ছুটতে আসে। সবুর মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘সবুর ভাই! বরপক্ষ আইছিলো। কেডা জানি এইসব কথা তাগো কানে তুলসে! তারা বিয়া ভাইঙ্গা গেছে গা।’

সবুর মিয়া হা হুতাশ করা শুরু করে। তাহেরাও আঁচলে মুখ গুজে কাঁদে। মেয়ের মাথায় একটা বোঝা ছিলোই এখন আরেকটা বোঝা চেপে গেলো। সাইমা বোনকে আগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিয়েটা ভেঙে যাওয়ায় মনে মনে শুকরিয়া আদায় করে। অ’পমান, অ’ন্যায় সব তো সহ্য করেই আসছে সাইরাহ্ এবার না হয় আরেকটু করবে কিন্তু একটা বুইড়া ব্যাটার সাথে বিয়ে হওয়া থেকে তো বোনটা বেঁচে গেলো। সাইরাহ্-র কোনো অনুভূতি নেই। সে শুধু চুপচাপ শুনে যায়। সাহিত্য জোড়েই টিটকারি করে বলে,

‘যে না এক বুইড়া ব্যাটা! তার আবার বিয়া ভাঙ্গা।’

তাহেরা সাইরাহ্-কে নিয়ে চলে যেতে গেলে পেছন থেকে গ্রাম প্রধান সদস্যের সবাই থামিয়ে দেয়। সাহিত্য ভ্র কুঁচকে তাকায়। শাহিন শেখ বলে, ‘এহন এই অ’পয়া মাইয়ারে আমরা গেরামে রাখমু না। একে তো বি’ধবা মাইয়া তারওপর আবার বিয়া ভাইঙ্গা গেসে। এরে গেরামে রাখা মানে গেরামের অ’মঙ্গল ডাইকা আনা।’

‘অ’মঙ্গল কি আপনার আত্মীয় লাগে শাহিন কাকা? যে ডাকবেন আর চইলা আসবে!’

শাহিনসহ সবাই ক্ষেপে ওঠে। সাহিত্যের ত্যাড়া কথা তাদের হজম হয় না। সাহিত্য যে দমবে না তাদের সিদ্ধান্তে তা তারা বুঝে গেছে। তাই যত আজগুবি কথা বলে গ্রামবাসীকে ক্ষে’পিয়ে তোলে। সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। চুন কালি মাখিয়ে, চুল কেটে পুরো গ্রামে ঘুরানো হোক বলে সবাই দাবি করেন। তাহেরা আর সাইমা সাইরাহ্-কে ধরে কাঁদতে শুরু করে। এর মাঝে সাহিত্যের বাড়ির সবাইও চলে এসেছে। সাইরাহ্ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সাহিত্যের দিকে এগিয়ে যায়। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,

‘আপনি আমার ভালো করতে গিয়ে আমাকে ক’লঙ্কে লেপ্টে দিলেন সাহিত্য ভাই। আপনি কেন করলেন? ওই লোকটাকে বিয়ে করার ইচ্ছে তো আমারও ছিলো না কিন্তু আমার সাথে এখন যা হবে তা? আপনি যার জন্য আমাকে সবার সামনে থেকে টেনে আনলেন সে কিন্তু কাপুরুষের মতো পিঠ লুকিয়ে দুরে দাঁড়িয়ে আছে৷ অথচ দেখেন! সাইরাহ্-র জীবনের কষ্ট এজীবনে আর ফুরোবে না। সুখ সন্ধান অনেক পরের ব্যাপার।’

সাহিত্যের বুকের চিনচিনে ব্যাথাটা বাড়ে। একবার সীমান্তের দিকে ঘৃ’ণিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সাইরাহ্-র দিকে তাকায়। সাহিত্য মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রামবাসী চেঁচামেচি শুরু করেছে। প্রধান সবাইকে থামিয়ে নিজে যখন সিদ্ধান্ত জানাতে যান তখন সাহিত্য থামিয়ে দেয়। সবাই তাকায় সাহিত্যের দিকে। সাহিত্য শক্ত করে সাইরাহ্-র হাত ধরে। সাইরাহ্ বিস্ময় নিয়ে তাকায়। সাহিত্য সরাসরি সাইরাহ্-র মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘আমি তোর ক’লঙ্ক চাইনি সাহেবা। আর না তোর অ-সুখ চেয়েছি।’

এরপর প্রধানকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ওর বিয়ে ভাঙ্গা নিয়ে সমস্যা তো আপনাদের! আচ্ছা আমি সমস্যা মিটিয়ে দিচ্ছি। আমি ওকে বিয়ে করবো। আজ-ই, এখন-ই।’

সাহিত্য কথা শেষ করে সাইরাহ্-র হাত ধরা অবস্থাতেই তাহেরার দিকে এগিয়ে যায়। সাইরাহ্ থমকায়, চমকায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাহিত্যের দিকে। কি বলছে লোকটা? বিয়ে করবে মানে? তার অবাকতার ওপরেই সাহিত্য তাহেরার কাছে গিয়ে নরম স্বরে বলে,

‘কাকি! আমি সাহেবারে বিয়ে করতে চাই। এখন আর এই মুহুর্তেই। আপনি কি আমার হাতে ওরে তুলে দিবেন? আমি কথা দিতেছি, আমি আপনার মেয়ের এই হাত কোনোদিন ছাড়বো না। কখনো এতটুকু আঁচও আসতে দেবো না। ওর সকল বিপদের আগে আমি দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো। যেমন আজ থাকছি৷ আপনি দেবেন আপনার মেয়েরে?’

তাহেরা শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায়। সে জানে এই বিচারসভা শুধুমাত্র চুন কালি আর চুল কাটাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এই বিচারসভা তার মেয়েকে কেড়ে নেবে। তার থেকে না হয় মেয়েকে একটা ভরসাযোগ্য হাতেই তুলে দিক! অন্তত তার মেয়ে বেঁচে থাকুক। তাহেরা বিয়েতে সম্মতি দিলেও ঝামেলা বাধায় প্রধান আর সাহিত্যের মা সুফিয়া। ছুটে এসে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

‘তোর মাথা খারাপ হইসে সাহিত্য? তুই কি কইতাছোস এইসব? কিয়ের বিয়া করবি ওরে?’

সাহিত্য মায়ের মুখের দিকে তাকায় না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘আমার জন্য ওর বিয়ে ভাঙছে, এই সমাজ ওরে আবার মা’রার ফন্দি আঁটছে! আমি এতো সহজ সব মেনে নিবো? কোনোদিনই না। আপনি আমারে আটকাইতে পারবেন না আম্মা। আমি বিয়ে করবো ওরে।’

পাশ থেকে সাইরাহ্ খুবই শান্ত ভাবে বলে, ‘কিন্তু আমি আপনারে বিয়ে করতে চাই না।’

সাহিত্য কপালে ভাজ ফেলে বলে, ‘তো?’

‘তো মানে কী? আমি করবো না আপনারে বিয়ে।’

‘তুই করবি না তোর ঘাড়ও করবে।’

‘আপনি আমারে জোড় করবেন?’

সাহিত্য জবাব দেয় না। সাহেবাকে সে বার বার দুরে সরিয়ে দিয়েছে, নিজের অনুভূতি কোনোদিন প্রকাশ করেনি। কিন্তু ভাগ্য যদি এটাই চায় তবে সব পা’প, অ,ন্যায় সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়েই এবার সে সাহেবাকে আপন করে নেবে৷ সুফিয়া কিছুতেই মানবে না। সাথে যোগ দেয় প্রধান। বার বার আটকে দিতে থাকে সাহিত্যকে৷ সাহিত্যর স্পষ্ট জবাব,

‘আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল আম্মা এবং মামাসাহেব। আমি সাইরাহ্-কে বিয়ে করবো মানে করবোই। সে আপনি কেনো আপনার মতো দশ গ্রামের প্রধানও আমাকে ঠেকাতে পারবে না।’

সাহিত্যের বাবা তখন গ্রামে ছিলেন না। সুফিয়া কি করবেন বুঝে ওঠে না। প্রধান, সাহিত্যের কাকারা সবাই আটকানোর চেষ্টা করে। সাহিত্য কাউকে মানে না। সাইরাহ্ যাবে না বললে সাহিত্য তাকেও মানে না।
সাহিত্য সাইরাহ্-র হাত টেনে নিয়ে এগোতে থাকে গ্রামের বড় মসজিদের দিকে। তবে যাওয়ার আগে সীমান্তের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে,

‘ভালোবাসলে পুরুষের মতো বাসতে হয় সীমান্ত। কাপুরুষের মতো পিঠ লুকিয়ে থাকতে হয় না। সবার সামনে ‘ভালোবাসি’ বলার মতো সাহস থাকতে হয়। আর এই সাহস না থাকলে ভালোবাসতে নেই।’

সীমান্ত চোখ তুলে তাকায় না। ভেতরটা ভেঙে চুড়ে চুরমার হয়ে যায়। সাহিত্য সাইরাহ্-কে নিয়ে যায় মসজিদে। সাইরাহ্ ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। একদিকে যাকে অনুভূতিতে রেখেছিলো তার নীরব প্রত্যাখান যেনো সূচের মতো বিঁধছে, অন্যদিকে আরেকজনের জিদের কাছে সবাই হার মানছে। সাহিত্য সাইরাহ্-র কোনো কথা শুনছেও না। সাইরাহ্-কে মসজিদে এনে দাঁড় করাতেই সাইরাহ্ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,

‘আমার ওপর দয়া দেখাবেন না। আমি করবো না বিয়ে।’

সাহিত্য শুধু তাকায় কিছু বলে না। তবে হাতও ছাড়ে না। তাহেরা মেয়ের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায়। সাইরাহ্ ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। তাহেরা কান্নাভেজা স্বরে বলে,

‘আমার লাইগা তো ওই বুইড়া ব্যাটাকেও বিয়া করতে রাজি হইসিলি! এহন আরেকবার আমার মুখের দিকে তাকাইয়া সাহিত্যরে বিয়া কর মা। আমি মা হইয়া তোর কাছে ভিক্ষা চাইতাছি আমার মাইয়ার জীবন।’

সাইরাহ্ শান্ত হয়ে যায়। একবার সাইমার দিকে তাকায়। তার গায়ের দাগগুলোর কথা মনে পড়ে। এমনিতেই তার শ্বশুরবাড়ির লোক তার দোষ খোঁজে। কাল সাইরাহ্-কে নিয়েও যে দোষ খুঁজবে না, সাইমার গায়ে হাত তুলবে না এর কোনো মানে নেই। সাইরাহ্ নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে। অস্ফুট স্বরে বলে,

‘যেদিন বিধবা হয়েছিলাম সেদিন-ই সবাই আমাকে মে’রে ফেলেছিলো। আর কিভাবে মা’রবে আম্মা?’

সাইরাহ্-র বাড়ির লোক, সাহিত্যের বাড়ির লোক, প্রধানের সকল সদস্য আর গ্রামের মানুষদের সামনে ইসলামিক নিয়মে ৩ কবুলে বিয়ে হয়ে যায় সাহিত্য-সাইরাহ্-র। দুজনে আবদ্ধ হয়ে যায় হালাল সম্পর্কে। সবচেয়ে পবিত্র একটা সম্পর্কে। বিয়ে শেষে যার যার মতো গ্রামবাসী চলে যায়। সুফিয়া আর সাহিত্যের বাড়ির লোকও ফিরে যায়। ছেলের এই কাজে তার আর মুখ দেখানোর অবস্থা নাই। প্রধান মুখ ফিরিয়ে নিজের বাড়ির রাস্তায় হাঁটে। তাহেরা সাইরাহ্-র মাথায় আঁচল তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। সাইরাহ্ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাহেরা সাহিত্যকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘তোমার আম্মায় তো আমার সাইরা-রে মানবো না বাবা। তুমি কি ওরে আমার ঘরেই রাইখা যাইবা?’

সাহিত্য জবাব দেয়ার আগেই সবুর মিয়া বলেন, ‘মানেডা কী? ওই আপদরে বিয়া কইরা আবার আমার ঘরে রাখবো ক্যান? হুনো সাহিত্য! ওরে নিয়া গেলে নিয়া যাও নাইলে কোনোহানে ফালাইয়া যাও। আমার বাড়িত জানি আর ওর ছায়া না পড়ে!’

সাহিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তাহেরার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বিয়ে করছি কী বউ রেখে যাওয়ার জন্য কাকি? আমার বউ আমি নিয়েই যাবো। অন্তত এই রকম দা’নবের বাড়িতে আমার বউ রাখবো না। সাহেবা চল!’

সাইরাহ্ থেমে থেমে বলে, ‘কোথায় যাবো?’

‘আমার বাড়ি।’

সবুর মিয়া মুখ বাকিয়ে হাঁটা লাগায়। তাহেরার থেকে বিদায় নিয়ে সাইরাহ্-র হাত ধরেই সাহিত্যও হাঁটা লাগায়। তামজীদ ছিলোই সাথে। কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বলে,

‘অভিনন্দন বন্ধু।’

সাহিত্য জবাব দেয় না। তামজীদ মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ‘কেউ জানুক আর না জানুক, তুই স্বীকার করিস আর না করিস! আমি জানি, তোর চোখ বলে তুই তোর ‘সাহেবা’-কে ভালোবাসিস। তাই তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য তোকে অভিনন্দন।’

চলবে..

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____

১৪.
সাইরাহ্-কে নিয়ে নিজেদের বাড়ি ফিরে আসে সাহিত্য। প্রধানদের মতোই আগেকার আমলের বাড়ি। আহামরি কোনো ক্ষমতা না থাকলেও এই বাড়ির ইতিহাস বেশ অনেক বড়। তাই এই পরিবারের দাপটও কোনো দিকে কম নয়। বাড়ির গেইটে দাঁড়াতেই নাজিরা আর লুবনা তাদের দেখে ছুটে গিয়ে বাড়ির সবাইকে ডাকে৷ বউকে বরণ করে ঘরে তোলা হবে বলেই সাহিত্য আগে বাড়িতে ঢোকে না। সাহিত্যর মা সুফিয়া ছেলের এই কাজটা যেনো কোনোভাবেই হজম করতে পারেননি। ছেলের অবাধ্যতায় তার মেজাজ চরমে। কোনো রকমে নিজেকে সামলে এগিয়ে আসলেন ছেলের দিকে। বাড়ির সবাই হাজির হলেন সদর দরজার কাছে। সাইরাহ্-র হাত সাহিত্যের হাতে। সাইরাহ্ কঠিন কিছু শোনার অপেক্ষা করে। পাশেই তামজীদ দাঁড়িয়ে। সাইরাহ্-র ধরে রাখা হাতটার দিকেই সুফিয়া তাকায়। সাইরাহ্ হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে সাহিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কন্ঠস্বর নিচু করে বলে,

‘সা’পের মতো মোচড়াবি না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’

সুফিয়া সরাসরি ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘এই মাইয়া এহানে ক্যান সাহিত্য?’

সাহিত্যের স্পষ্ট, গম্ভীর জবাব, ‘আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী তো আমার সাথেই থাকবে তাই না আম্মা! তাছাড়া আমি যেহেতু এই বাড়িতে থাকি তাহলে আমার স্ত্রীও তো এই বাড়িতেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক।’

সুফিয়া ফুঁসে উঠলেন। তেড়ে এগিয়ে যেতে চাইলেন সাইরাহ্-র দিকে। সাহিত্য তার আগেই সাইরাহ্-র সামনে দাঁড়ায়। সুফিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘তুই কোন সাহসে ওরে বিয়া করছোস? একবারও আমাগো কথা ভাবলি না? এই মাইয়া তোরে জাদু করছে? নাইলে তুই এমন বি’ধবারে কেমনে বিয়া করলি!’

‘আম্মা, ‘ও’ বিধবা ছিলো এখন কিন্তু নাই। এখন ওর স্বামী আছে। আর এটাই ভালো হয় আপনিও আপনার ছেলের বউকে অ’পমান না করে সামান্য সম্মান দিন। অন্তত একজন মেয়ে হিসেবে, মা হিসেবে।’

সুফিয়া মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাইরাহ্ অবাক হয়ে সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে সামনে থাকা সাহিত্যের মা-কে দেখে। এই মহিলাকে সে বহুবার দেখেছে। বিধবা হওয়ার আগে, বিয়ের আগে ছোট বেলায় এই বাড়িতেও সে বহুবার এসেছে। কিন্তু মানুষ কত দ্রুত বদলে যায় তা এদের দেখেই শিখতে হয়৷ অবশ্য যেখানে নিজের আপন মানুষগুলো বদলে যায় সেখানে আর এরা এমন কী! সাইরাহ্-র স্বামী মারা যাওয়ার কিছুদিন পর সুফিয়ারর সাথে তার দেখা হয়েছিলো রাস্তায়। বিধবা বলে এমনভাবে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন সাইরাহ্-র মনে হয়েছিলো সে হয়তো কোনো ন’র্দমার কী’ট! অথচ ভাগ্যের পরিহাসে সে এই বাড়িরই বউ হয়েছে। প্রাণহীন তাচ্ছিল্য করে হাসে সাইরাহ্। তাকে যে এরা মেনে নেবে না তা সে জানে কিন্তু সাহিত্যও যেভাবে জিদ ধরে বসে আছে তাতে সামনে কি হতে পারে তা ভেবে পায় না। তবে মা, ছেলের নীরব যুদ্ধ চলছে ভেবেই সাইরাহ্-র হাসি পায়। সুফিয়া ছেলের গম্ভীর স্বরের পিঠে আরো গম্ভীর হয়ে বলে,

‘তোর এই সব আজগুবি বিয়াশাদী আমরা মানি না সাহিত্য। এই মাইয়ারে যেইহান থেইকা আনছোস ওইহানে দিয়া আয়!’

‘বিয়ে করেছি ফিরিয়ে দিয়ে আসার জন্য না আম্মা। আমি যেখানে থাকবো আমার অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে সাহেবাও সেখানেই সসম্মানে থাকবে।’

‘সাহিত্য!’

‘আপনি জানেন আম্মা সাহিত্য কথার খেলাপ করে না।’

সুফিয়া ফুঁসে উঠলেন। বাড়ির সকলে ততক্ষণে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করা শুরু করেছে। বাড়ির পুরুষরা তখন ছিলেন না। সুফিয়া ছেলের জিদ, স্বভাব সম্পর্কে জানেন। একবার যখন বলেছে সাইরাহ্ এখানে থাকবে তখন সে এখানেই রাখবে। কিন্তু এমন বি’ধবা, অ’পয়াকে নিজের বাড়িতে ঠায় দেয়া মানে অ’মঙ্গল ডাকা। যা তিনি কোনোদিনও হতে দেবেন না। সাহিত্য তার ভাবনার মাঝেই বলে,

‘আম্মা! বরণ করবেন না?’

সুফিয়া উল্টো ফিরে যেতে যেতে বলে, ‘কহনোই না। আমি ওই অ’পয়া মাইয়ারে আমার বাড়িতে পা’ও রাখতে দিমু না।’

‘তাহলে আমিও আপনার বাড়িতে পা রাখবো না আম্মা।’

সুফিয়া অবাক হয়ে পিছে তাকায়। সাহিত্য স্বাভাবিক। সাইরাহ্ রীতিমতো হা হয়ে গেছে৷ আজ সারাদিন একটার পর একটা যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা তার মাথার ওপর দিয়েই যাচ্ছে। সাহিত্যের এই জেদী রূপ তার জানা ছিলো না। সুফিয়া অবাক হওয়া কন্ঠ নিয়েই বলে,

‘তুই ওই মাইয়ার জন্য আমাগোরে ছাইড়া দিবি?’

‘তা তো বলি নাই আম্মা। আমি আপনাদেরকে ছাড়বো না। আপনারা আমার বাবা-মা। আমার ওপর দায়িত্ব আছে আপনাদের। কিন্তু সাহেবা আমার বউ। আমি ওর দায়িত্ব নিজে নিয়েছি। আমি এতো সহজে এই দায়িত্বও তো অস্বীকার করতে পারি না৷ তাই আপনার বাড়িতে ওর জায়গা না হলে আমিও থাকবো না।’

‘খুব বুইঝা গেছো নিজের দায়িত্ব? তাইলে এই মাইয়ারে বিয়া করার লাইগা যে লুবনার স্বপ্ন ভাংলো এইডা অস্বীকার করবা কেমনে?’

‘আমি তো ওরে স্বপ্ন দেখাই নাই আম্মা। বরং আমি ওরেই বলে দিছিলাম যে আমি ওরে বিয়ে করবো না। আপনি যতবার বলছেন আমি ততবারই বলছি ‘আমি বিয়ে করবো না’ তাহলে ওর মন ভাঙার দায় আমার ওপর কেনো?’

সাহিত্য সরাসরি তাকায় লুবনার দিকে। তাকে অনুসরণ করে সাইরাহ্, তামজীদ এবং বাকিরাও তাকায়। লুবনা সদর দরজা ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে করুণ ছাপ স্পষ্ট। সাহিত্য কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে বলে,

‘এমন নাটকবাজ মেয়ে আমি আজন্মে দেখিনি।’

সুফিয়া আর কথা বাড়ান না। সবাইকে বাড়ির ভেতর যেতে বলে সেও সদর দরজা পেড়োয়। সরাসরি বলে দেয়, ‘এই মাইয়ার জায়গা আমার বাড়িত হইবো না।’

মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়। সাহিত্য নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সরে দাঁড়ায়। পাশ থেকে তামজীদ বলে,

‘এখন কি করবি?’

‘৩ রাস্তার মোড়ে বসে ভি’ক্ষা করবো।’

তামজীদ না চাইতেও হেঁসে ফেলে। সাইরাহ্ এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে যেখানে না ইচ্ছে আছে কথা বলার আর না কথা বলে থাকা যাচ্ছে! সাইরাহ্ মাথার আঁচল টেনে নিয়ে আশে পাশে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

‘ভি’ক্ষা করার মতো চেহারা অবশ্য আপনার আছে। যে কেউ মুখ দেখেই ভি’ক্ষা দিয়ে দিবে কিন্তু কেউ থাকতে দিবে না।’

সাহিত্য ভ্র কুঁচকায়। সাইরাহ্ টিটকারি করে বলে, ‘খুব তো বিয়ে করার শখ ছিলো, বউ বউ করলেন এবার তা বউরে কী রাস্তায় নিয়ে ঘুরবেন? শখ মিটসে তো বিয়ের?’

‘মিটে নাই। বিয়ে করে এখনো একদিনও পার করতে পারিনি তাতেই শখ মিটলে চলবে? তাই এখনো মিটে নাই। আর বউরে আমি বটগাছের নিচে রাখবো। সমস্যা আছে?’

সাইরাহ্ কপালে ভাজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। তামজীদ দুজনের কথা শুনে শব্দ করে হেঁসে দেয়। সাহিত্য আর সাইরাহ্ দুজনেই তার দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়। তামজীদ মুখে হাত চেপে বলে,

‘হাসছি না। বের হয়ে গেছে।’

‘তুই হাসতে থাক। সমস্যা নাই। সাহেবা চল!’

‘কোথায় যাবো আবার?’

সাহিত্য জবাব দেওয়ার আগেই তামজীদ বলে, ‘আমাদের বাড়ি চল তোরা। কাকিমা যা-ই করুক একটামাত্র ছেলেকে দুরে রাখতে পারবে না। তাই যতক্ষণ এসব শেষ না হয় ততক্ষণ আমার বাড়ি থাকবি।’

সাহিত্য বেশ রম্য স্বরে বলে, ‘হ্যাঁ তাই তো৷ তোর বাপ তো আমার শ্বশুর লাগে যে তার বাড়িতে থাকতে দিবে। নিজেই তো থাকিস বাপের বাড়ি, নাকি তালেব কাকা বাড়ি তোর নামে লিখে দিছে? কবে দিছে? মিষ্টি দিলি না তো!’

তামজীদ এবার চোখ মুখ কুঁচকে তাকায়। সাইরাহ্-রও একই অবস্থা। সাহিত্য দুজনের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে সামনে এগোতে এগোতে বলে, ‘এ্যাই সাহেবা, চল!’

তামজীদ প্রশ্ন করে, ‘এখন কই যাবি? তোর শ্বশুরবাড়ি?’

সাহিত্য স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেয়, ‘না৷ ওই জ’ল্লাদের বাড়িতে বউ নিয়ে যাওয়া আর বউয়ের কপালে আরেকবার কু’ড়াল মা’রা একই কথা।’

সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তামজীদ অসহায় চোখে তাকায়৷ পরিস্থিতি কঠিন অথচ সাহিত্যের কন্ঠে কাঠিন্যতার চেয়ে আজগুবি একটা ভাব। ৩ জনের আর কেউ-ই কোনো কথা বলে না। সাহিত্য সাইরাহ্-কে নিয়ে গ্রামের শেষের দিকে যায়। এদিকটা বেশ শুনশান। পাশ দিয়েই নদী বয়ে গেছে। সাইরাহ্ আশে পাশে তাকিয়ে সাহিত্যের হাত চেপে ধরে। সাহিত্য কপাল কুঁচকে সেই হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘তোকে মে’রে ভাসিয়ে দিবো না। চিন্তা নাই।’

‘মা’রবেন না যখন তখন এই শুনশান জায়গায় আনলেন কেন? মতলব কী আপনার?’

‘আমার কী মতলব থাকবে সাহেবা? আমার মতো ভদ্র একটা ছেলের গায়ে রীতিমতো ক’লঙ্ক দিচ্ছিস তুই!’

‘আপনি কত ভদ্র তা আজ সারাদিনে অনেক দেখেছি।’

সাহিত্য জবাব দিতেই যাবে তার আগেই পাশ থেকে তামজীদ ধমকে ওঠে, ‘দুজনে থামবি! কী শুরু করছিস তোরা? সংসার শুরু-ই হলো না ঝগড়া শুরু করে দিয়েছিস, সারাজীবন সংসার করবি কেমনে তোরা?’

সাইরাহ্ আর সাহিত্য একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় সাথে সাথেই দুজনে চোখ ফিরিয়ে নেয়। সাহিত্যের ধরে রাখা হাতটা সাইরাহ্ ছেড়ে দেয়। তার মাথা থেকে হয়তো বেড়িয়েই গেছিলো যে সম্পর্কে তারা জড়িয়েছে তা কেবল আজ কালের নয়। তা সারাজীবনের। সারাজীবন তার এই পুরুষ টার সাথেই থাকতে হবে। সাইরাহ্ আনমনা হয়ে যায়। সাহিত্য আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে ফের সামনে তাকায়। নিজ মনেই আওড়ায়,

‘যে সম্পর্কে জড়াতে চাইনি সেই সম্পর্কেই জড়িয়ে গেছি। এই নড়বড়ে, এক পাক্ষিক সম্পর্কের আদৌও কোনো পরিণতি আছে কী?’

ভেতরে ঝড় বয়ে যাওয়া সত্বেও উপরে নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে সে তামজীদের দিকে তাকায় সন্দিহান দৃষ্টিতে। তামজীদ ভড়কে যায়। সাহিত্য সন্দিহান গলাতেই প্রশ্ন করে,

‘তার আগে বল, তোর ব্যাপারটা কী? তুই আমাদের পিছে পিছে আসছিস কেন?’

‘তুই বিয়ে করে বন্ধুকে ভুলে গেলেও, আমি বন্ধুর বিপদে তাকে ভুলিনি। তোরা কোথায় থাকছিস এটা দেখে তারপর আমি বাড়ি যাবো।’

সাহিত্য আর তামজীদ কথা বলতে থাকে। সাইরাহ্ শুনছে সবই তবে মন তখনো সেই এক বাক্যে। ‘সারাজীবন সংসার করবি কেমনে?’ আদৌও এই সম্পর্ক সারাজীবন যাবে তো! নাকি পরিবারের চাপে একসময় সাহিত্যও সীমান্তের মতো পিছে সরে যাবে। তার ভাবনার মাঝেই সাহিত্য সাইরাহ্-র হাত ধরে একটা বাড়িতে ঢুকে যায়। সাইরাহ্ ফট করে তাকায়। সামনে একটা মাটির দু তলা বাড়ি। তামজীদ প্রশ্ন করে,

‘এটা কার বাড়ি?’

সাহিত্য জবাব না দিয়ে ডাকতে শুরু করে, ‘দাদীমা, ও দাদীমা!’

মিনিট খানেকের মাঝেই এক বৃদ্ধা মহিলা বেড়িয়ে আসেন। চোখে হয়তো খানিকটা ঝাপসা দেখেন। তাই বেড়িয়ে এসে চোখ ডলে দু বার দেখে নিয়েও প্রশ্ন করে, ‘ক্যাডা? সাহিত্য ভাই?’

সাহিত্য সামান্য হেঁসে বলে, ‘হ্যাঁ দাদীমা, আমিই।’

দাদীমা এগিয়ে আসেন। মুখের সামনে দাঁড়িয়ে সাহিত্যের মুখ দেখেই তিনি হাসেন। কিছু বলার আগেই পাশে সাইরাহ্ আর তামজীদকে দেখে শুধায়, ‘এই পোলা আর মাইয়াডা ক্যাডা ভাই?’

সাহিত্যের সহজ জবাব, ‘একটা আমার বউ, তোমার নাতবউ। আর আরেকটা আমার বন্ধু।’

মহিলা বেশ অবাক কন্ঠে বললেন, ‘তুই বিয়া করলি কবে? আমারে তো জানাইলি না!’

‘সে অনেক লম্বা কাহিনি। পরে বলবো। এখন শুধু এটুকু শোনো আমার বাড়িতে আমার বউরে থাকতে দেয়নি। এখন বউ বরণ করে তোমার ঘরে তোলো।’

দাদীমা আর প্রশ্ন করলেন না। তবে সাইরাহ্-কে দেখে বেশ খুশিই হলেন। সাইরাহ্-র হাত ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বউ তো সুন্দরী আছে, তাইলে অগো কী সমেস্যা?’

‘বিরাট সমস্যা। পরে বলবো। এখন তুমি আমার বউরে ঘরে তুলবা নাকি বউ নিয়ে গাছতলায় যাবো?’

দাদীমা মুখ বাকিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন, ‘পোলার গোস্সা দেখছোনি! গোস্সা তো হমু আমি, আমারে না কইয়াই বিয়া কইরা ফালাইলো। তোরা দুইডা দাঁড়া। আমি আইতাছি।’

‘কই যাও?’

দাদীমা জবাব দিলেন না। সাইরাহ্ পুরো ঘটনা দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্যকে শুধায়, ‘আপনি আমারে কোন জায়গায় আনলেন? ছোট থেকে এই গ্রামেই আছি তাও কোনোদিন এই দাদীমা আর এই বাড়ি তো দেখি নাই আমি। এইটা ভুতের বাড়ি না তো আবার!’

‘জ্বলজ্যান্ত মানুষরে তুই ভুত বানায়া দে। খাইয়া তো আর কাজ নাই।’

সাইরাহ্ কটমট করে তাকায়। এর মধ্যেই দাদীমা হাতে করে একটা থালাতে দই আর পানি এনেছে। সাইরাহ্-র সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,

‘ঘরে মিষ্টি নাই বউ। দইডা আছিলো, এহনের জন্য এইডা দিয়াই কাম চালা।’

সাইরাহ্ মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘সমস্যা নাই দাদীমা।’

দাদীমা হেঁসে সাইরাহ্-কে মিষ্টি মুখ করিয়ে পানি পান করায়। তারপর নিজের গলা থেকে স্বর্ণের একটা চেইন খুলে নিয়ে সাইরাহ্-কে পড়াতে গেলে সাইরাহ্ ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘এইটার দরকার নাই দাদীমা। এইটা আপনিই রাখেন।’

‘আমি রাখমু ক্যান রে মাইয়া? আমি এইডা রাখছিলাম ই সাহিত্যের বউয়ের লাইগা। ওর বউ তো এহন তুই। এইডা তোর ই প্রাপ্য। তুই পইড়া থাকবি সবসময়।’

সাইরাহ্ ইতস্ততবোধ করে। পাশে থাকা সাহিত্যের দিকে তাকালেই সাহিত্য ঈশারায় বলে নিয়ে নিতে। সাইরাহ্ আর মানা করে না। দাদীমা নিজ হাতেই চেইনটা পড়াতে গেলে পারে না। চোখের সমস্যার কারণে বার বার ঝাপসা হয়ে যায়। শেষে আর না পেরে সাহিত্যকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ভাই, তুই পড়া তো এইডা। আমি পারতাছি না।’

সাহিত্য অবাক হয়ে শুধায়, ‘আমি?’

পাশ থেকে তামজীদ বলে, ‘না, আমি। বউ তোর, তাইলে তুই পড়াবি না তো কে পড়াবে? আমি?’

সাহিত্যও চট করেই বলে, ‘না।’

সাইরাহ্ বেশ ইতস্তত বোধ করছে। যতই তাদের বিয়েটা হোক তবুও সম্পর্কে জড়তা তো কেটে ওঠেনি। তাই আমতা আমতা করে বলে, ‘দাদীমা, আমি নিজেই পড়ে নিচ্ছি। সমস্যা নাই।’

‘তুই নিজে পড়বি ক্যা? সাহিত্য তোর জামাই। ওয়-ই পড়াইবো তোরে। এ্যাই পোলা! দাঁড়ায় আছোস ক্যান? পড়া।’

সাহিত্য বোঝে সাইরাহ্-র অস্বস্তি হচ্ছে। একবার দাদীমাকে বলতে গিয়েও দাদীমার চোখ গরম দেখে আর কিছু বলে না। চুপচাপ চেইনটা নিয়ে সাইরাহ্-কে পড়িয়ে দেয়। অনেক সাবধানেই পড়ায় যেনো তার হঠাৎ ছোঁয়াতে সাইরাহ্-র অস্বস্তি না হয়। তবুও সাইরাহ্ শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। বিয়ে হওয়া সত্বেও সাইরাহ্-র আগের স্বামী তার এতোটা কাছে আসতে পারেনি। বিয়ের রাতেই সে মা’রা গেছে। পুরুষের থেকে বরাবরই সে দুরে থেকেছে। আজ হঠাৎ সাহিত্যের এতো কাছে আসাটা তার কাছে প্রথমবারই ছিলো। সাইরাহ্ অন্যদিকে ফিরে বড় বড় দুটো শ্বাস নেয়। দাদীমা সাইরাহ্-কে ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। পেছন পেছন সাহিত্য আর তামজীদও যায়। তামজীদ সাহিত্যের কাছে এসে কন্ঠ স্বর নিচু করে বলে,

‘বন্ধু, প্রেম যারে ছোঁয় সে কী পারে প্রেমরে এতো সহজে ফিরাইতে!’

সাহিত্য ধাম করে তামজীদের পিঠে কি’ল বসিয়ে দিয়ে ঘাড়টা টেনে কাছে আনে। কন্ঠস্বর একদম নিচু করে বলে,

‘নিজের মুখ বন্ধ রাখ। তোর প্রেমের অভিজ্ঞতা তুই কাজে লাগা।’


বেশ অনেকক্ষণ দাদীমার সাথে গল্পগুজব করে তামজীদ বের হয় চলে যাওয়ার জন্য। সাহিত্য এগিয়ে দিতে নিজেও আসে। বাড়ির বাইরে বের হতেই সাহিত্য বেশ গম্ভীর হয়ে তামজীদকে বলে,

‘আমরা যে এইখানে আছি এইটা তুই ভুল করেও কাউরে বলবি না। আব্বা হয়তো যাবে খোঁজ নিতে, তুই সরাসরি বলে দিবি তুই কিছু জানিস না।’

‘কেন? কাকা সাহেবকে বললে তো উনিই একটা ব্যবস্থা করবে।’

‘না। আপাতত আমি আর সাহেবা এখানেই থাকি। তারপর দেখা যাবে।’

তামজীদ কথা বাড়ায় না। সাহিত্য কিছু বলছে যখন নিশ্চয় ভেবেই বলছে। তাই সম্মতি দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা বলবো না। সাবধানে থাকিস তোরা।’

তামজীদ বিদায় নিয়ে চলে যেতে গেলে সাহিত্য আরো একবার ডাকে। তামজীদ পিছু তাকাতেই সাহিত্য বলে, ‘সীমান্ত জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলবি না।’

তামজীদ আশ্বস্ত করে বলে, ‘চিন্তা করিস না। আমি বন্ধু আর বে’ইমান দুইটাকেই ভালোভাবে মনে রাখি।’

তামজীদ চলে যায়। সাহিত্য হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে যতই দেখাক সব ঠিক আছে কিন্তু সে জানে কিচ্ছু ঠিক নেই। সাহেবা তার জীবনে এসে সব আরো এলোমেলো হয়ে গেছে৷ এখন শুধু তার নিজের কথা ভাবলে হবে না। তার ভাবতে হবে সাহেবার কথা, ভাবতে কথা সাহেবার সুখের কথা। সাহিত্য ঘাড় ফিরিয়ে একবার ঘরের ভেতরে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলে,

‘তোর সুখের জন্য তোকে ছেড়ে দিতে চাইলাম, সেই সুখের ভার আমার ওপরেই পড়লো। সাহেবা, তোর সর্বনাশা প্রেম আমাকে শুধু জ্বালিয়েই গেলো।’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)