#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____
১৫.
সাইরাহ্ অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে আছে৷ বার বার চোখ ফিরিয়ে ঘরটা দেখছে। দাদীমা তার সামনেই বসে পানকুটায় পান কুটছে। সাহিত্য তামজীদের পিছে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সাইরাহ্ বুঝে উঠছে না তার কি করা উচিত! তার কাছে পরিচিত গ্রামটাও এখন অপরিচিত মনে হচ্ছে। তার ভাবনার মাঝেই দাদীমা পান মুখে নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে,
‘তা কিলো বউ তোর নাম কী?’
সাইরাহ্ নিচু স্বরে বলে, ‘সাইরাহ্।’
দাদীমার মুখ চালানো বন্ধ হয়ে যায়। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে শুধায়, ‘সাহিত্য তোরে কি কইয়া ডাকে?’
সাইরাহ্ সহজ ভাবেই বলে, ‘সাহেবা।’
দাদীমা অবাক হলেন নাকি খুশি হলেন তা বুঝে আসে না। অদ্ভুত এক দৃষ্টি দিয়ে বসে রইলেন। সাইরাহ্ ভড়কে যায়। মিনিট খানেক বাদে দাদী খুশিতে উত্তেজিত হইয়া সাইরাহ্-র হাত চেপে ধরে বলে,
‘ওরে বউ রে, তুই আগে কইবি না আমারে!’
সাইরাহ্ ভয় পেয়ে যায়। ভীত কন্ঠে বলে, ‘কী বলবো দাদীমা?’
দাদীমা হাত ছেড়ে দেন। তবে তার ঠোঁটের কোণের হাসিটুকু যেনো আরো প্রশস্ত হয়। সাইরাহ্ বোকার মতো তাকিয়েই থাকে। দাদীমা নিজের জায়গা থেকে উঠতে উঠতে বলেন,
‘বউ, তুই বইয়া থাক। আমি রাইন্দা আইতাছি।’
দাদীমা উঠে ঘর থেকে রান্নাঘরের দিকে যায়। সাইরাহ্-ও পিছু পিছু যায়। দাদীমা একা একা-ই সবজি, চাল আরো অনেক কিছু বের করে আনলেন। এরপর সাইরাহ্ কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘তোর জামাইডা কই গেলো রে?’
‘তা তো জানি না।’
দাদীমা বিড়বিড় করে কি যেনো বললেন! সাইরাহ্ বুঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না। দাদীমা কলপাড় থেকে চাল ধুয়ে আনলে সাইরাহ্ বলে, ‘দাদীমা আমি আপনাকে সাহায্য করি!’
‘তুই আবার কি করবি? তুই নতুন বউ। চুপচাপ বইয়া থাক।’
সাইরাহ্ তবুও শোনে না। ইতস্ততবোধ হওয়া সত্বেও জোড় করে কাজ করা শুরু করে। সবজি কাটতে কাটতে প্রশ্ন করে, ‘আপনি কি এখানে একা-ই থাকেন দাদীমা?’
‘হ। একাই থাকি। সাহিত্য আয়ে তো মাঝে মইধ্যে।’
‘আপনার ছেলে-মেয়ের নেই?’
‘একটা পোলা আছে। পোলার বউও আছে। ওরা শহরে থাকে। আমারেও কয় যাইতে কিন্তু সোয়ামীর এই ভিটাডা ছাড়তে পারি না রে বউ। ওরা আয়ে মাঝে মইধ্যে।’
সাইরাহ্ কাজ করছে আর গল্প শুনছে৷ গল্পে গল্পে দাদীমা নিজের জীবন নিয়ে বলে, ‘আমার ওই একখান-ই পোলা। আমার সোয়ামী ম’ইরা গেছিলো তহন যহন আমার পোলার বয়স কেবল দুই বছর। তহন আমার বয়স ম্যালা কম। কম বয়সে বিধেবা হওয়ার দোষে প্রধানের আমারে এক ঘরে কইরা দিছে। শ্বশুর শাউড়ি আমার মুখও দেহে নাই। আমি অ’পয়া দেইখাই নাকি আমার সোয়ামী ম’রছে। বাপ মায়ের কাছে যাওয়ার মতো অবস্থাও আমার আছিলো না। কি করমু! চুপচাপ সব মাইনা নিয়া পোলাডারে বুকে নিয়া এই বাড়িত থাকছি। কাম কইরা পোলাডারে মানুষ করছি। এই বাড়িডা আমার সোয়ামী খুব শখ কইরা বানাইছিলো। এই বাড়ির চারপাশে তাকাইলেও আমার সোয়ামীর গন্ধ পাই। তাই আর ছাড়তে পারি না। পোলাডা কত কথা কয়! যেই গেরাম আমার থেইকা খালি কাইড়াই নিলো আমি নাকি হেই গেরামই ছাড়তো পারি না। পোলাডারে কেমনে বুঝাই! এই বাড়িত আমি ওর বাপরে দেখি।’
সাইরাহ্ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দাদীমার দিকে। মানুষের জীবনের কত গল্প। কত মানুষ কত ভাবে বেঁচে থাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের কাজের দিকে মন দিয়ে বলে,
‘তাহলে তো আমার কষ্টটা আপনার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না দাদীমা।’
দাদীমা শুনলেন। নিজের কাজ এগিয়ে হেঁসে বলেন, ‘তোরে একখান কথা কমু বউ?’
‘বলেন।’
‘তোর জীবনে কী হইছিলো এইডা নিয়া ভাবিস না। তোর জীবনে তুই এমন একটা মানুষরে পাইছোস যে তোর লাইগা তার জান লড়াই দিবো। তোরে সব বিপদ থেইকা আগলায়া রাখবো। খুব ভাগ্য কইরা মানুষ এমন সোয়ামী পায়। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া কর।’
সাইরাহ্ বোঝে কী! হয়তো বোঝে আবার হয়তো বোঝে না। এক ধ্যানে নিজের কাজ করতে থাকে। এর মধ্যে সাহিত্য হাতে একটা জবাই করা মুরগী নিয়ে আসতে আসতে বলে,
‘ও দাদীমা! মুরগী জবাই কইরা আনছি। ধরো!’
দাদীমা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলেন, ‘বিয়া কইরা দেখি তোর বুদ্ধি বাড়ছে। আমি তো ভাবছিলাম আরো কমু। তা মুরগী পাইলি কই?’
‘নদীর পাড় ছিলো। কার মুরগী কে জানে!’
সাইরাহ্ অবাক কন্ঠে বলে, ‘আপনি অন্যের মুরগী চু’রি করে আনছেন? তাও এই দিনে দুপুরে!’
সাহিত্য চোখ মুখ কুঁচকে হাতের মুরগী নিচে রাখে। তারপর হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, ‘তো তোরে মুরগী দিবে কে? আশে পাশের মানুষ কি তোর শ্বশুরবাড়ির লোক!’
সাইরাহ্ টিটকারির স্বরে হেঁসে বলে, ‘শ্বশুরবাড়ির লোক তো বাড়িতেই উঠতে দিলো না মুরগী তো অনেক দুরের ব্যাপার।’
সাহিত্য গম্ভীর চোখে তাকায়। সাইরাহ্ সবজি এক পাশে রেখে মুরগী হাতে নেয়। সাহিত্যকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘আপনাকে মুরগী চু’রি করতে বলছে কে? আমি বলছি? নাকি আমি চাইছি মুরগী?’
‘চাওয়া লাগবে কেন? বিয়ের প্রথমদিন। ভালো-মন্দ না দিলে তো পরে বলবি, ‘বিয়ে করছেন শখে শখে, ভালো মন্দ খাবারও দিলেন না।’
সাইরাহ্ কটমট করে তাকায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আপনি সবসময় আমার সাথে ঝ’গড়া করেন কেন? ছেলে মানুষ হয়ে এভাবে ঝ’গড়া করতে লজ্জা লাগে না?’
‘আমি ঝ’গড়া করছি? করি নাই। তাই আমার লজ্জাও লাগে নাই।’
সাইরাহ্ পারে না সাহিত্যকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে। দুজনের ঝ’গড়া থামে না বলে দাদীমা দুটোকেই ধমক দেয়, ‘তোরা কি শুরু করছোস? তোগো দেখলে কেউ কইবো যে তোরা নতুন জামাই-বউ!’
সাহিত্য আর সাইরাহ্ একে অন্যের দিকে তাকায়। সাইরাহ্ মুখ বাঁকিয়ে ফের অন্য দিকে তাকায়। সাহিত্য ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। দাদীমা সাহিত্যকে নির্দেশ দেয়, ‘তুই যা এন্তে। কাম হইয়া গেলে আসিস।’
সাহিত্য চলে যায়। সাইরাহ্ একবার সাহিত্যের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দেয়। দাদীমা দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসে। বিড়বিড় করে বলে,
‘দুইডার মনেই বি’ষ, আর বি’ষ তো পেরেমের পইলা ধাপ।’
—
সাইরাহ্ আর সাহিত্যের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে মাটির ঘরের উপরতলায়। দাদীমা নিচেই থাকবেন। সন্ধ্যার পর পর-ই দুটোকে ধরে খাইয়ে দিয়েছেন দাদীমা। সাহিত্য খেয়ে আর বাহিরে যায়নি। সাইরাহ্-কে দাদীমা কয়েকবার উপরে যেতে বললেও সে যায় না। দাদীমার সাথে গল্প জুড়ে দেয়। আড়চোখে বার কয়েক তাকায় কাঠের সিড়ির দিকে। কেমন হাসফাস একটা অনুভূতি জাপটে ধরে। বিয়ে নিয়ে প্রথমবার ই তার ধারণা হয়ে গেছিলো। বিয়ে, বিয়ের প্রথম রাত, তার পরের ঘটনা সবাই তাকে মূখস্থ শুনিয়েছিলো। তাই সেই কথাগুলো এখনও মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা সাহিত্য ভাই কী তার অধিকার ফলাও করবে? যদি সে তার স্বামী, যেমন পরিস্থিতিতেই বিয়েটা হোক না কেনো বিয়েটা হয়েছে। তাই তার পুরো অধিকার আছে তার ওপর কিন্তু সে যে এই বিয়ে টুকুই হজম করছে অনেক কষ্টে তাহলে আদৌও কী পরের ঘটনাগুলো হজম করতে পারবে? টেনশনে ঘাম ঝড়তে শুরু করেছে সাইরাহ্-র। দাদীমার সাথে গল্প করলেও তার মন যে অন্যদিকে এটা দাদীমা টের পান। মুখের হাবভাব দেখে তিনি আন্দাজও করে নেন সাইরাহ্-র মনের কথা। পানের বাটা থেকে একটা পান নিয়ে মুখে দিতে দিতে বলেন,
‘আমার নাতিডারে যতডা খারাপ ভাবতাছোস হেয় কিন্তু অতোডাও খারাপ না। তাই ভয় না পাইয়া নিশ্চিন্ত মনে ঘরে যা দেহি।’
সাইরাহ্ কি বলবে বুঝে ওঠে না। দাদীমা এবার জোড় করেই উপরে পাঠায়। আল্লাহর নাম নিয়ে মনে মনে অনেক ভয় নিয়ে এগোয় ঘরের দিকে। উপর তলার ঘরটা খুব সুন্দর। সাজানো, গোছানো। সাইরাহ্ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আশে পাশে দেখতে থাকে। ঘরের সাথে বড় একটা জানালা। সেখানেই সাহিত্য দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশ থেকে নদী আর চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সাইরাহ্ শাড়ির আঁচল নিজের হাতে পেঁচাতে থাকে৷ কী বলবে বা কী করবে তার বুঝে আসে না। যাকে নিয়ে কখনো এমন ধারণা মনেই আসেনি সে আজ তার সাথে এক ঘরে। এমন অদ্ভুত কাহিনিতে সে জীবনের ওপর যতটা না অবাক তার চেয়েও বেশি বিরক্ত। ভাবতে ভাবতেই তার মুখে একটা বিরক্তিসূচক ভাব ফুটে ওঠে। তার ভাবনাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে সাহিত্য বলে ওঠে,
‘চু’রি করা মুরগী খাইলি কেমন? স্বাদ পাইছিস? মজা লাগছে তাই না?’
সাইরাহ্-র মুখের বিরক্তি ভাবটা আরো বৃদ্ধি পায়। সাহিত্যের দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘চু’রি করা মুরগী খাইয়ে এখন কী খোঁটাও দিবেন!’
‘দিবোই তো। আনার সময় তো খুব ঝ’গড়া বাধাই দিলি! তা ওই চু’রির মুরগী খাইলি কেন?’
সাইরাহ্ দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আপনার মতো মানুষ আমি দুটো দেখিনি। একে তো চু’রি করা মুরগী খাইয়েছেন আবার ওই মুরগী নিয়ে বড় গলায় খোঁটাও দিচ্ছেন! একেই মনে হয় বলে ‘চো’রের মায়ের বড় গলা’।’
সাহিত্য জানালায় বসে। ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমার আম্মারে কই পাইলি তুই?’
সাইরাহ্ কটমট করতে থাকে। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে লোকটাকে কোথাও গুম করে দিতে কিন্তু কাজটা সে পারবে না। তার অতো ক্ষমতাই নেই। কিন্তু লোকটা কানের কাছে থাকলেই প্যাঁ প্যাঁ শুরু করে। নিজ মনেই দুদিকে মাথা নাড়িয়ে জোড়ে বলে বসে,
‘অসম্ভব। এরকম একটা আধাপাগল লোকের সাথে আজীবন থাকা অসম্ভব। সংসার তো কী! সংসারের ‘স’ও হবে এমন আধাপাগল লোকের সাথে।’
বলেই উল্টো ফিরে যেতে শুরু করলে সাহিত্য ঠান্ডা গলায় বলে, ‘তুই কী আজীবন থাকতে চাস সাহেবা? সংসার করতে চাস?’
সাইরাহ্ থেমে যায়। তার রাগ, অভিযোগ, ঝ’গড়া কোথায় যেনো মূহুর্তেই হারিয়ে যায়। সে ঝোঁকের মাথায় বলে ফেললেও কথাটা সত্য। বিয়েটা তো হয়েছে। এটা তো মজা না। সত্যিই তো এটা আজন্মের সম্পর্ক। তাহলে তারা কী সত্যিই আজন্ম এই বন্ধনে থাকবে? সাইরাহ্ দৃষ্টি এদিক ওদিক ফেরায়। সাহিত্য ফের বলে,
‘জীবন গোলকধাঁধার মতো। আমরা ঘুরে ফিরে একই বিন্দুতে এসে বার বার থেমে যায়। তোর জীবনের কেন্দ্রবিন্দু দুঃখ, আর আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু তুই। আমি যেভাবেই যাই, যেখানেই যাই ঘুরে ফিরে সাহেবাতে এসে থেমে যাই।’
সাইরাহ্ চট করে তাকায়। কথাগুলো নিজ মনেই কয়েকবার আওড়ায়। বুঝতে চেষ্টা করে। সাহিত্য তাকে কী বুঝাতে চায়? সাহেবাকে সে ভালোবাসে? নাকি অন্যকিছু? সাইরাহ্ সাহিত্যের চোখের দিকে তাকায়। তবে বুঝে ওঠে না কিছুই। বরং চোখের গভীরতায় ডোবার আগেই চোখ নামিয়ে নেয়। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে শতগুণ হয়। সাইরাহ্ নড়তে পারে না। সাহিত্য হেঁসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘নদী তোর খুব প্রিয় সাহেবা?’
সাইরাহ্ সহসাই জবাব দেয় না। সাহিত্য তাকালে শুধু উপরনীচ মাথা নাড়ায়। সাহিত্য সরে গিয়ে বলে, ‘এখানে আয়। এখান থেকে নদীটা স্পষ্ট দেখা যায়। আর চাঁদের আলো পড়লে নদীটা জ্বলজ্বল করে।’
সাইরাহ্ ভাবে কী করবে! এগোবে নাকি এগোবে না। ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে যায়। জানালার পাশটায় দাঁড়িয়ে সামনে তাকাতেই মুগ্ধ হয়। সামনেই চাঁদের আলোয় নদীর জল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মনের সব দ্বিধাদ্বন্দ, সব জড়তা এক নিমিষেই কেটে যায়। উৎফুল্ল দৃষ্টিতে দেখতে তাকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। সাহিত্য সাইরাহ্-র মুখের উজ্জ্বলতা দেখে হাসে। বুকের বাম পাশে হাত রেখে মনে মনে আওড়ায়,
‘তুই আমার জন্য হালাল সাহেবা। তোরে দেখলেও এখন আমার পাপ নাই। অথচ তোরে দেখলেই আমার হৃদয় পু’ড়ে ছাড়খাড় হয়। আজীবন কী পু’ড়িয়েই যাবি নাকি বৃষ্টির মতো হৃদয়কে শীতলও করবি?’
অনেকক্ষণ দুজনে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। রাত ধীরে ধীরে বাড়ছে। সাইরাহ্-কে তখনো বাহিরে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাহিত্য বলে,
‘প্রকৃতিকে কী আজ গিলেই খাবি? এবার তো দেখা বন্ধ কর।’
সাইরাহ্ চোখ মুখ কুঁচকিয়ে তাকায়। চট করে জবাব দেয়, ‘আপনার সমস্যা কী? আমি কী আপনার সম্পত্তি দেখতেছি? না তো। তাইলে নিজের কাজ করেন।’
‘আমি আমার কাজ-ই করতেছি। তুই সারারাত জাইগা এই চাঁদ আর নদী দেখে পেট ভরা, আমি ঘুমাবো।’
ঘুমানোর কথা মাথায় আসতেই সাইরাহ্ চট করে তাকায় সাহিত্যের দিকে। একবার পিছে তাকিয়ে দেখে সেখানে একটাই চৌকি। দুজনে কী একসাথে ঘুমাবে! কথাটা মাথায় আসতেই সারা শরীর বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বেয়ে যায়। সাহিত্য হাই তুলে বলে,
‘তুই কোথায় ঘুমাবি? এখানে চাইলে দাদীমার কাছে ঘুমাতে পারিস। কিন্তু আমাদের বাড়ি গেলে তখন আলাদা থাকার কোনো উপায় নাই। এখন তুই এইখান থেকেই আমার সাথে থাকার অভ্যাস করবি নাকি পরে করবি তোর ব্যাপার। আমি গেলাম ঘুমাতে।’
‘আপনার মনে হয় আপনার বাড়ির লোক ওই বাড়িতে আমারে ঠায় দিবে?’
সাহিত্য ঠোঁট বাকিয়ে হাসে। সাইরাহ্ মজা নিয়ে বলে, ‘আল্লাহ! আপনাদের পুরো বাড়িই কিন্তু অ’পয়া হয়ে যাবে আমার ছায়া পেলে।’
বলেই হাসতে শুরু করে। সাহিত্য চৌকির ওপর বসতে বসতে বলে, ‘অ’পয়া, অ’মঙ্গল তো তোদের সবার আত্মীয় লাগে। আজগুবি প্যাচাল না পাইরা ঘুমা তো।’
সাইরাহ্ জানালার দিকে ফিরে তাকায়। বাহিরে নজর দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের জীবনের সমীকরণ মিলাতে মিলাতে সাহিত্যকে বলে,
‘আমার জন্য আপন মানুষদের সাথে ঝামেলা করতেছেন কেন সাহিত্য ভাই? আপনি কী আজীবন আমার সাথে এই সম্পর্কে থাকবেন?’
সাহিত্যের সহজ জবাব, ‘তুই থাকলে আমি রেখে দেবো।’
চলবে..
#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____
১৬.
সাইরাহ্ আর সাহিত্য পাশাপাশি-ই শুয়েছে। যদিও জানালার পাশ থেকে সরে এসেছে অনেক রাতে৷ সাইরাহ্-র অস্বস্তি হওয়া সত্বেও সে আর নিচে যায়নি। যখন একসাথে থাকা-ই লাগবে তখন শুধু শুধু দাদীমাকে ঝামেলায় ফেলে লাভ নেই। দুজন পাশাপাশি ঘুমালেও সাইরাহ্ কাঁত হয়ে আছে আর সাহিত্য চিৎ হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। সাইরাহ্ ভেবেছে সাহিত্য ঘুমিয়ে গেছে তাই ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। সাহিত্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে তখনকার কথোপকথনের কথা। তাদের কথা সেখানেই থেমে গেছিলো। কিন্তু সাহিত্যের বলা ‘তুই থেকে গেলে আমি রেখে দিবো’ বলা বাক্যটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। লোকটা কি তাকে ভালোবাসে? কিভাবে? কই কখনও তো দেখে বোঝা যায়নি। তাহলে? সে কী ঠিক ভাবছে? সাহিত্যের এতো এতো কথার মানে কী? আজকের বিয়েটা কী নিজের মনের ইচ্ছাতেই করেছে নাকি পরিস্থিতির চাপে পড়ে তাকে বাঁচাতেই বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছে! সাইরাহ্ ফিরে সাহিত্যের দিকে হয়ে শোয়। অপলক তাকিয়ে থেকে ভাবতে থাকে নানা কথা। হুট করেই সাহিত্য বলে ওঠে,
‘আমি জানি আমি সুন্দর, তার মানে এই না যে তুই আমার দিকে নজর দিবি! আমাকে কালো টিকা পড়ানোর কেউ নাই।’
সাইরাহ্ ভড়কে যায়। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে কতক্ষণ। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘আমি আপনার দিকে নজর দিতে যাবো কেন? আমি তাকাইনি আপনার দিকে।’
‘তাকাস নি?’
‘না।’
‘তাকিয়েছিস।’
‘না, তাকাইনি।’
‘তাকিয়েছিস।’
‘না।’
‘তাকিয়েছিস।’
সাইরাহ্ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, তাকাইছি। হইছে? শান্তি? এবার চুপ করেন।’
সাহিত্য চোখ বন্ধ করেই হাসে। সাইরাহ্ চট করেই বলে, ‘আমি যে আপনার দিকে তাকিয়েছি এটা আপনি কিভাবে বুঝলেন? আপনিও তাকিয়েছেন? কিন্তু আপনার তো চোখ বন্ধ।’
‘তাতে কী? ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলতেও একটা ব্যাপার আছে৷ অবশ্য তুই এগুলা বুঝবি না।’
‘কেন বুঝবো না?’
‘তোর তো ব্রেইনই কাজ করে না, তাইলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করবে কেমনে?’
সাইরাহ্ তেতে ওঠে। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘অ’ভদ্র, অ’সভ্য লোক। আমাকে অপমান করতেছেন আপনি!’
সাহিত্য চোখ মেলে তাকায়। অবাক হওয়ার ভান করে বলে, ‘তুই এতো ভারী হয়ে গেছিস সাহেবা! যে এক লাফে পুরো খাটসহ আমাকে নড়িয়ে দিলি! ওজন কত তোর?’
‘সাহিত্য ভাইইই!’
সাইরাহ্ রাগে, দুঃখে নিজের মাথার নিচের বালিশ নিয়ে ছুড়ে মা’রে সাহিত্যের মুখে। রাগে গজগজ করতে থাকে। সাহিত্য হাত দিয়ে বালিশ ধরতে ধরতে বলে, ‘তুই আবার ঝড় কবে থেকে শুরু করলি? না। তোর ভাবসাব তো ভালো না।’
সাইরাহ্ কী বলবে বুঝতে পারে না। রাগে আশে পাশে তাকিয়ে কটমট করতে থাকে। সাইরাহ্-র অবস্থা দেখে সাহিত্য ঠোঁট কামড়ে হাসে। সাইরাহ্ সাহিত্যের হাতে থাকা বালিশটাই ফের নিয়ে কয়েকটা বা’রি দেয় সাহিত্যের মুখে। সাহিত্য আরো ক্ষে’পিয়ে বলে,
‘বিয়ের প্রথম রাতেই বর মা’রার প্ল্যান করছিস নাকি সাহেবা!’
সাইরাহ্ জানে এই লোকের সাথে লেগে লাভ নেই। তাই ঠা’স করে আবার শুয়ে পড়ে। ভুল করেও আর সাহিত্যের দিকে তাকায় না। সাহিত্য ঠোঁট কামড়ে হাসতে থাকে৷ এরপর নিজেও পাশে শুয়ে বিড়বিড় করে বলে,
‘তোকে রাগাতেও সুখ সুখ লাগে সাহেবা।’
—
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সাহিত্য কোথাও একটা চলে গেছে। সাইরাহ্ ঘুম থেকে উঠে দেখে সাহিত্য কোথাও নেই। খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে উঠে দাদীমার কাছে যায়। বাহিরে যতদুর নজর যায় তাকিয়েছি কিন্তু সাহিত্যের খবর নেই। দাদীমা সাইরাহ্-র কপালের ভাজ দেখে বলে,
‘কি’লো বউ! কিছু নিয়া চিন্তা করতাছোস নাকি? কিছু হইসে?’
সাইরাহ্ মাথার আঁচল টেনে নিয়ে হাতের কাজে মন দেয়। হাতের মেহেন্দির রং জ্বলজ্বল করছে। সেদিকে তাকিয়েই জবাব দেয়, ‘কিছু না দাদীমা।’
মুখে ‘কিছু না’ বললেও সাইরাহ্-র মনে ঘুরপাক খায় অনেক কথা। সাহিত্য কী তাকে ফেলে চলে গেছে! কোথায় গেছে? তাকে একবারও বলে গেলো না যে! বিভিন্ন প্রশ্নে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ে। দাদীমা হেসে বলেন,
‘হুন বউ! আমার সাহিত্য ভাই ওইরহম না। ওয় তোরে রাইখা কোথাও যাইবো না। আইয়া পড়বো।’
সাইরাহ্ কিছু বলে না। নিজ মনে কেবল কাজ করতে থাকে। দাদীমা ঝাপসা চোখে সাইরাহ্-র মুখ দেখে সামান্য হেঁসে বিড়বিড় করে আওড়ান,
‘যার লাইগা এতকাল ছটফট কইরা আইলো, তারে এহন পাইয়াও ছাইড়া দিবো! তুই যদি বুঝতি রে বউ তাইলে এতোকাল আমার ভাইডারে না বুঝার লাইগা আফসোস করতি।’
কথাগুলো সাইরাহ্-র কান অব্দি পৌঁছায় না। দুজনে হাতে হাতে রান্না শেষ করতেই বাজারের ব্যাগ হাতে বাড়িতে ঢোকে সাহিত্য। সাইরাহ্-র চোখ চঞ্চল হয়ে ওঠে। সাহিত্য এগিয়ে গিয়ে একটা ব্যাগ সাইরাহ্-র দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে,
‘বাজার আছে এইটাতে। ধর!’
সাইরাহ্ নেয়। দাদীমা শুধায়, ‘তুই এই হক্কাল বেলা বাজার করতো গেসিলি! গেরামের লোকজন কেউ দেহে নাই?’
‘দেখবে কেমনে? আমি তো এলিয়েন। অদৃশ্য হইতে পারি।’
সাইরাহ্ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকায়। বিড়বিড় করে বলতে গিয়ে সামান্য জোড়ে বলে বসে, ‘সব কথাতেই ত্যাড়া উত্তর না দিলে মনে হয় পেটের ভাত হজম হয় না।’
সাহিত্য চট করে তাকায়। দাদীমাও তাকায়। সাইরাহ্ থতমত খেয়ে যায়। সাহিত্য কপালে ভাজ ফেলে বলে, ‘না হয় না। কারণ এখনো আমি ভাত খাই নাই। তাই খাইতে দে, তারপর হজম হবে।’
দাদীমা হেঁসে সাহিত্যকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে বলে। সাইরাহ্-ও বাজারগুলো রেখে হাত মুখ ধুতে কলপাড় যায়। এরপর সাহিত্য, দাদীমা এবং নিজের জন্য খাবার বের করে। খাওয়া শেষে সব হাতের কাজ শেষ করে সাইরাহ্ ঘরে যায়। সাহিত্য তখন বিছানায় শুয়ে দু হাত মাথার নিচে রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সাইরাহ্ ওভাবে থাকতে দেখে বলে,
‘ওপরে কী আপনার বউয়ের নাচ দেখতেছেন?’
সাথে সাথেই সাহিত্যের জবাব, ‘তুই কী নেচে ওখানে দেখাচ্ছিস?’
সাইরাহ্ শুধু তাকায়, জবাব দেয় না। এখন কিছু বলা মানেই তাদের মধ্যে লেগে যাবে। তাই সাইরাহ্ এসে সরাসরি জানালার পাশে দাঁড়ায়। হালকা হালকা বাতাস বইছে। সাহিত্য উঠে বসে মাথার কাছ থেকে একটা ব্যাগ বের করে আনে। সাইরাহ্-র দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘নে।’
সাইরাহ্ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়, ‘কী আছে এটাতে?’
‘তোর জন্য শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস।’
সাইরাহ্ অবাক হয়। সে ভেবেছিলো একবার এসবের কথা। কারণ এক শাড়িতে তো আর কাটবে না। সাইরাহ্ রয়ে সয়ে সরে আসে। সাহিত্যের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে খুলে দেখে সেখানে তিনটে শাড়ি আর তার বাকি প্রয়োজনীয় জিনিস। সবই রঙিন। সাইরাহ্ হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। অজান্তেই তাচ্ছিল্য করে হেঁসে বলে,
‘এই রং ১ দিন আগে অব্দি আমার জন্য মানা ছিলো। আর এখন এই রং আবার আমার হয়েছে। কি অদ্ভুত জীবন আর কি অদ্ভুত জীবনের নিয়ম!’
সাহিত্যের চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। অতীত মনে পড়ে যায়। মুখের ওপর কাঠিন্যের এক আবরণ তৈরি হয়। সাইরাহ্ ব্যাগটা রাখতে রাখতে বলে,
‘এগুলো কোথায় পেলেন?’
‘তামজীদ দিয়েছে। ‘ও’ গতকাল কিনে রেখেছে আর আজ ভোরে দিয়ে গেছে। ব্লাউজগুলো তোর পুরোনো। এতো দ্রুত তো বানানো সম্ভব না তাই শাড়ি বাদে বাকিগুলো তামজীদ তোদের বাড়ি থেকেই এনেছে।’
‘এগুলো আনতেই এতো সকাল সকাল বেড়িয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। বাজারও করতে হতো। ভোরেই তো হাঁট বসে তাই বেড়িয়েছিলাম।’
‘আপনাদের বন্ধুত্বটা অনেক সুন্দর। তামজীদ ভাই অনেক ভালোবাসে আপনাকে।’
‘সীমান্তকেও বাসে৷ আমাদের বন্ধুত্বটা অন্যরকম। একজন অন্যজনের প্রতি সৎ। একে অন্যকে বিশ্বাস করে খুব। তাই প্রয়োজনে একে অন্যের জন্য জীবনও বাজি রাখে।’
সাইরাহ্ চুপ হয়ে যায়। সীমান্তের কথা মাথায় আসতেই তার কথা ফুরিয়ে যায়৷ গতকালের অ’প’মা’নগুলো স্পষ্ট ফুটে উঠে স্মৃতির পাতায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকাতেই সাহিত্য বলে,
‘তোর পড়নের শাড়িটা কী তোর বাপ দিছে নাকি ওই বুইড়া ব্যাটা দিছে?’
সাইরাহ্ সাহিত্যের কথার ধরণে হেঁসে ফেলে। শাড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওই বাড়ি থেকে দিছে।’
‘পাল্টে আয়। বের হবো।’
‘কোথায় যাবো?’
‘তোরে মে’রে গুম করতে যাবো।’
সাইরাহ্ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তাইলে একা-ই যান, আমি যাবো না।’
সাহিত্য বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, ‘তুইও যাবি, তোর ঘাড়ও যাবে।’
‘ঘাড় গেলে নিয়ে যান। আমি যাবো না।’
সাহিত্য একবার পিছে ফিরে তাকায়। তারপর যেতে যেতে বলে, ‘এখন একটু শান্তিতে থেকে নে। দুদিন পর থেকেই তো তোর আবার হাজারটা কথা শুনে বাঁচতে হবে।’
সাইরাহ্ এ কথার পৃষ্ঠে জবাব দেয় না। ব্যাগ থেকে একটা লাল রঙের শাড়ি বের করে হাত বুলায়। তাচ্ছিল্য করে হেঁসে বলে, ‘এক জীবন গেলো অন্যের কথা শুনতে শুনতে। হয়তো এবার কথা শোনার সাথে সাথে জবাব দেওয়ারও একজন আছে। কিংবা জবাব দেওয়ানোর মতো কেউ আছে।’
—
একটু বেলা গড়াতেই তামজীদের বাড়িতে হাজির সাহিত্যের বাবা শেখর সাহেব। বাড়ির ভেতর না ঢুকেই গম্ভীর গলায় বাহির থেকে ডাকতে থাকেন তামজীদকে। ভদ্রলোক শিক্ষিত, বুদ্ধিমান। কথাও বলেন শুদ্ধ ভাষায়। তামজীদ শেখর সাহেবের গলার আওয়াজ শুনেই বেড়িয়ে আসে। সালাম দিয়ে বলে,
‘ভেতরে আসেন কাকা সাহেব।’
শেখর সাহেব কন্ঠস্বর আগের মতো রেখেই বললেন, ‘ভেতরে যাবো না তামজীদ। সাহিত্যরা কোথায়?’
তামজীদ নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই জবাব দেয়, ‘বাড়িতে নেই? কাকিমা ঢুকতে দেয়নি সত্যি সত্যি?’
‘তুমি যে সব জানো এটা আমি জানি তামজীদ। তোমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে ধারণা আমার বেশ গাঢ়। তাই বলো, ওরা কোথায়?’
তামজীদ কতক্ষণ চুপ থেকে ভীষণ শান্ত ভাবেই জবাব দেয়, ‘কাকা সাহেব, আপনি যখন জানেন আমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে তখন আরেকটু জানিয়ে দেই। বে’য়াদবি নিবেন না। আমি জানি ওরা কোথায় আছে কিন্তু আমি বলতে পারবো না। ওরা যেখানেই আছে ভালো আছে। ক’টা দিন ওদের ভালো থাকতে দিন। এখানে আসলেই আবার সমাজের মাঝে পড়ে দুজনের জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে।’
শেখর সাহেব সহসাই জবাব দিলেন না। সিনা টানটান করে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে ঘুরলেন। তবে যাওয়ার আগে বললেন, ‘ওকে বলো যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসতে।’
তামজীদ শুধু মাথা নাড়ায়। শেখর সাহেব চলে যায়। তামজীদের বাবা তালেব উদ্দীন ছুটে এসে ছেলেকে ধরে শুধান, ‘এ্যাই তামজীদ! তুই এগুলার মধ্যে ঢুকছোস ক্যান? সাহিত্য কই তুই জানলি ক্যামনে?’
তামজীদ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে যেতে যেতে বলে, ‘আমার বন্ধু, আমি তো তার ব্যাপারে ঢুকবোই আব্বা।’
পেছন থেকে তালেব উদ্দীন বকতে শুরু করেছেন। তামজীদ চোখ মুখ কুঁচকে সেদিকে কান না দিয়ে সোজা যাওয়ার চেষ্টা করে। বাড়ি থেকে কিছু দুর যেতেই দেখা হয়ে যায় বেলীর সাথে। বেলী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। আজও বেলী একা। তামজীদ ভ্রু কুঁচকে আশে পাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও ছন্দ নেই। তামজীদকে দেখে বেলীর আত্মার পানি শুকিয়ে গেছে। আজ কী হবে! মনে মনে ছন্দকে বকা দিতে দিতে বার বার বলতে থাকে,
‘ছন্দ রে! জলদি আয়।’
তামজীদ এগিয়ে যায়। বেলীকে শুধায়, ‘একা কেনো তুমি? ছন্দ কোথায়?’
বেলী কী বলবে বুঝে ওঠে না। বার কয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে বলে, ‘ওর সাথে আমার ঝ’গড়া হইছে। তাই আমি একা।’
তামজীদ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফের শুধায়, ‘সত্যি বলছো?’
বেলী ঘনঘন মাথা নাড়ায়। তামজীদের সন্দেহ না কাটলেও তামজীদ আর প্রশ্ন করে না। সেদিনের মতো আজও বেলীর পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করে। বেলী আমতা আমতা করে প্রশ্ন করে,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো তামজীদ ভাই?’
‘করো।’
অনুমতি পেয়েও কতক্ষণ থম মে’রে থাকে বেলী। তামজীদ নিজ থেকেই বলে, ‘সাহিত্য-সাইরাহ্ কে নিয়ে প্রশ্ন করবে?’
বেলী মাথা নিচু করে নেয়। তামজীদ সামান্য হাসে। তবে না রেগে বলে, ‘বলো, কী প্রশ্ন!’
বেলীর ইতস্তত বোধ কাটে না। তবে কৌতূহলও মেটে না। তাই একটু উত্তেজনা নিয়েই বলে, ‘উনারা কোথায় এখন? শুনেছি ফুপ্পির বাড়িতে নাকি উনাদের থাকতে দেয়নি। আচ্ছা আপনারা কাল ওমন করলেন কেন? সীমান্ত ভাইয়ার জন্য? সাইরাহ্ বুবুর বিয়ে ভেঙে দিলেন!’
একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন পেয়ে তামজীদ মাথা দুদিকে নাড়ায়। তারপর বলে, ‘প্রশ্ন করতে বলেছি বলে এতো প্রশ্ন করবে! তোমার সবগুলো প্রশ্নের উত্তর হলো ‘তুমি ছোট মানুষ। এগুলো নিয়ে ভাবা তোমার কাজ না।’
বেলী বাকরুদ্ধ ভাবে তাকায়। সে কত আশা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলো অথচ সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে তামজীদ ভাই ফুরফুরে মনে হাঁটছে। বেলীকে বিদ্যালয়ের গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে তামজীদ ঘুরে আসতে গেলেই তাদের দলের এক ছেলে ছুটে আসে। তামজীদ একটু হকচকায়। ছেলেটা কোনোরকমে শ্বাস আটকে বলে,
‘ভাইজান, প্রধান কাকার বাড়িত পুলিশ আইছে। চলেন জলদি।’
তামজীদ না বুঝে বলে, ‘মানে? কেনো?’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)