সাহেবা পর্ব-১৯+২০

0
230

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____

১৯.
শাহিন শেখের লা’শ নিয়ে চারপাশে হৈচৈ পড়ে গেছে। পুলিশ এসেছে। শাহিন শেখের লা’শ দেখার মতো অবস্থায় ছিলো না৷ পুলিশ ভেবে পায় না এই ছোট্ট এক গ্রামে এতো গুলো লা”শ পাওয়া কারণ কী! প্রধানের সব সদস্যরা আতঙ্কে আছে৷ হঠাৎ করে শাহিন শেখ-ই কেনো? শাহিন শেখকে যেখানে পাওয়া গেছে তার থেকে একটুখানি দুরে দাঁড়িয়ে তালিব উদ্দীন প্রধানকে শুধায়,

‘প্রধান মিয়া, আমনের কি মনে হইতাছে? শাহিনরে মা’র’লো ক্যাডা? কী কারণে মা’রলো কন তো!’

প্রধান সুক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকে৷ পাশ থেকে আরো দুজন সদস্য রমিজ মোল্লা আর আনসার আলী তালিব উদ্দীনের সাথে কথা বলতে থাকে। রমিজ মোল্লা ভয়ে ঢোক গিলে বলে,

‘আচ্ছা কেউ আবার আমাগো ব্যাপারে সব জাইনা যায় নাই তো? পতিশোধ নিতাছে নাকি?’

প্রধান বিরক্ত হয়ে বলে, ‘তোমরা একটু মুখটা বন্ধ করবা? কামের কাম তো পারো না খালি পারো বকবকাইতে। শাহিনরে ক্যাডা মা’রলো, ক্যান মা’রলো এইডা বাইর করা লাগবো। তার আগে ভাবো পুলিশরে ক্যামনা আটকাইবা? কারণ শাহিন শেখের খু’নের তদন্ত হইলে আমাগো ফা’সতে সময় লাগবো না।’

সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। তাদের কথার মাঝেই হঠাৎ করে সাহিত্য এসে বলে ওঠে, ‘মামাসাহেব, আপনারা এইখানে কী করেন? চলেন, চলেন। ওদিকে চলেন।’

৪ জনই চমকায়। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলে। সাহিত্য ফের তাড়া দিয়ে বলে, ‘আরে মামাসাহেব, চলেন! পুলিশের সাথে কথা বলা লাগবে তো।’

প্রধান মাথা নাড়ায়। রমিজ মোল্লা ভয়ে এগোয় না। বাহানা দিয়ে বলে, ‘প্রধান ভাই, আমি বাড়ি যাইগা। আমার শরীলডা ভালা লাগতাছে না।’

সাহিত্য যেভাবে হাওয়ার গতিতে এসেছিলো সেভাবেই হাওয়ার গতিতে যেতে যেতে বলে, ‘কাকাসাহেব, বাড়ি যাচ্ছেন যান। সাবধানে থাইকেন। শাহীন কাকার সাথে যা হইলো!’

সাহিত্যের কথায় রমিজ মোল্লা আরো ভয় পায়। সাহিত্য দুরে দাঁড়িয়ে সুক্ষ্ম চোখে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সকলকে। তামজীদ চারপাশে একবার ঘুরে নিয়েছে। সাহিত্যের কাছাকাছি আসতেই সাহিত্য বলে,

‘প্রধানের সদস্যগুলার মুখগুলো দেখ! মনে হচ্ছে না অনেক ভয়ে আছে? ব্যাপারটা কী বল তো!’

তামজীদ ঘাড় ফিরিয়ে সবার দিকে তাকায়৷ কপালে ভাজ ফেলে বলে, ‘হ্যাঁ। শাহিন কাকার মৃ’ত্যুতে ভয় পাইছে নাকি অন্য কাহিনি?’

সাহিত্য রহস্যময় ভাবে হাসে। সে অনুমান করতে পারে হয়তো। তামজীদ আর সাহিত্য দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে থাকে। সেসময় কোথা থেকে হাজির হয় সীমান্ত। সামনাসামনি এসে দাঁড়াতেই সাহিত্যের চোখে মুখে কাঠিন্যতা ফুটে ওঠে। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সীমান্তকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে সীমান্ত বলে ওঠে,

‘তোর সাথে আমার কথা আছে সাহিত্য।’

সীমান্তের মাথা নত। সাহিত্য দাঁড়িয়ে সহজ ভাবে বলে দেয়, ‘তোর সাথে আমার কোনো কথা আছে বলে আমার মনে হয় না।’

‘কিন্তু আমার কথা আছে৷ তোর শুনতে হবে।’

সাহিত্য দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তামজীদ এগিয়ে এসে সাহিত্যের কাঁধে হাত রেখে চোখ দিয়ে ঈশারা করে। সীমান্তকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘সীমান্ত, আমার মনে হয় না তুই যা করেছিস তারপরও কোনো কথা থাকতে পারে! আর এখানে আশে পাশে অনেক মানুষ। দু ভাই এমন কিছু করিস না যাতে অস্বস্তিতে পড়তে হয়।’

‘শুধু আমিই দোষ করেছি? সাহিত্য কিছু করেনি?’

সীমান্তের কথায় সাহিত্য চট করে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে অবুঝ কন্ঠে বলে, ‘মানে?’

সীমান্ত সাহিত্যের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে, ‘তুই কেনো বিয়ে করলি সাইরাহ্-কে? ওকে আমার জন্য আনছিলি, আমি আব্বার ওপর যাইতে পারিনি তাতে তুই ওকে বিয়ে করে নিবি?’

‘আর তুই তোর আব্বার ওপর কেন যাইতে পারলি না? গতরাতে তুই বলিস নি তুই সাইরাহ্-কে চাস? আমি যেনো এনে দিই?’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম। আমি আমার আব্বা-মায়ের একমাত্র ছেলে। আমি উনাদের ওপর যাইতে পারিনি কিন্তু ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতাম। তুই কেন সাইরাহ্-কে বিয়ে করলি?’

সাহিত্য তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে জবাব দেয়, ‘ততদিনে ওরা সাইরাহ্-কে মে’রে ফেলতো।’

সীমান্ত এবার বেশ রুক্ষ আর রাগী কন্ঠে বলে, ‘না। কেউই কিছু করতো না। আমি ঠিকই একসময় সব সামলে নিতাম। কিন্তু তোর মনে তো অন্যকিছু ছিলো। তুই চাস নি সাইরাহ্ আমার হোক। তুই ওকে বিয়ে করতে চাইছিলি বলেই এতো তাড়াহুড়ো করে সব করছিলি। তুই আমার বন্ধু হয়েও আমার পিঠেই ছু’ড়ি মা’র’ছিস। তুই…’

কথা শেষ হওয়ার আগেই রাগে সাহিত্য সীমান্তের কলার ধরে হাত উঁচু করে ঘু’সি মা’রতে যায়। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়। ঘৃ’ণায় শরীর রি রি করে ওঠে। তামজীদ জলদি সাহিত্যকে থামায়। সাহিত্য রাগে জোড়ে সরিয়ে দেয় সীমান্তকে। কঠোর স্বরে বলে,

‘তোর চিন্তা ভাবনা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। তুই আমার বন্ধুত্বের ওপর আঙুল তুলেছিস? সেদিন তুই বলেছিলি বলে আমি সাহেবা-কে এনেছিলাম। গোটা গ্রামের সামনে ঝুঁকি নিয়ে আমি সাহেবা-কে তোর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য এনেছিলাম কিন্তু তুই বে’ই’মা’নি করেছিলি। তুই ওকে মানতে চাসনি। এমনকি মুখ ফুটে একবারও বলিসনি তুই সাহেবাকে ভালোবাসিস! আর এখন আমি তোর পিঠে ছু’ড়ি বসিয়েছি? আসলেই তুই স্বার্থপর৷ তোর জন্য মেয়েটার নামের পাশে কলঙ্ক লাগিয়ে দিচ্ছিলাম বলেই সেই কলঙ্ক দুর করতেই আমি ওকে বিয়ে করেছি।’

সাহিত্য সীমান্তকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। খানিকটা দুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আল্লাহ যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন। ভাগ্যিস সাহেবাকে তুই মানতে চাসনি। তুই সাহেবার যোগ্যই না। সাহেবার সুখ তোর কাছে নাই।’

সাহিত্য চলে যায়। তামজীদ সীমান্তের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়। সীমান্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তামজীদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তোর আর যায় হোক এসব বলার আগে একবার ভাবা উচিত ছিলো। সাহিত্য যা করেছিলো তোর জন্য আর বিয়েটার করেছিলো সাইরাহ্-র জন্য।’

তামজীদও চলে যায়। সীমান্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। সাইরাহ্-র পাশে এখন সাহিত্য। যে নারীকে নিয়ে তার এতো স্বপ্ন ছিলো সে নারীর পাশে অন্য পুরুষ। তার প্রিয় বন্ধু এবং ভাই। দোষ তো তার-ই। কিন্তু সাহিত্য কেনো বিয়ে করলো! সীমান্ত চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নেয়। বন্ধুতের সম্পর্কে ফাটল ধরে গেছে।


সাহিত্য সোজা বাড়ি চলে এসেছে৷ নিজের ঘরে গিয়ে ধাম করে দরজা আটকে দেয়। সাইরাহ্ তখন ঘরে ছিলো না। সাহিত্য রাগে হাত মুঠো করে কয়েকবার বা’রি দেয় দেয়ালে। রাগে নিজের চুল চেপে ধরে। সাইরাহ্-কে বড় ভাবী আর ছোট ভাবী নিয়ে গেছিলো। সাহিত্যকে ফিরতে দেখে তারা-ই পাঠিয়ে দেয়। সাইরাহ্ এমন শব্দে একটু চমকায়। কি হয়েছে বুঝে উঠতে পারে না। একটু ভীত ভাবে ঘরের দরজা খুলে দেখে সাহিত্য বিছানার ওপর বসে আছে। তবে চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। সাইরাহ্ আস্তে করে ঘরে ঢুকে বলে,

‘কি হয়েছে?’

সাহিত্য মাথা উচু করে তাকায়৷ হাত মুষ্টিবদ্ধ রেখেই নিজের রাগকে গিলে নেওয়ার চেষ্টা করে। ঠান্ডা চোখে সাইরাহ্-র দিকে তাকিয়ে দুদিকে মাথা নাড়ায়। উঠতে উঠতে বলে, ‘কিছু হয়নি। তুই বস, আমি আসতেছি।’

সাইরাহ্ না বুঝে মাথা নাড়ায়। সাহিত্য ঘরের সাথে লাগোয়া গোসলখানায় ঢুকে যায়। সরাসরি একবারে গোসল করে বের হয়ে আসে। তার দেয়ালে আ’ঘাত করা হাতটায় তখনও একটু একটু র’ক্ত বের হচ্ছে। হাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেড়িয়ে আসে। সাইরাহ্ তখনো নিজের জায়গায় বসে আছে। সাহিত্যকে বের হতে দেখে বলে,

‘মাথা ঠান্ডা হয়ে গেছে?’

‘তুই কিভাবে বুঝলি আমার মাথা গরম?’

‘এটা আর বোঝার কী আছে! আ’ধা’পা’গ’ল মানুষদের মাথা সবসময় গরম-ই থাকে।’

সাহিত্য কপালে ভাজ ফেলে তাকায়। সাইরাহ্ দাঁত বের করে হাসে। সাহিত্য আয়নার দিকে এগোতে এগোতে বলে, ‘দাঁত বের করে ডাইনীদের আর অ’প’মা’ন করিস না।’

‘মানে?’

‘মানে হাসলে তোকে ডাইনীর চেয়েও দেখতে বাজে লাগে।’

সাইরাহ্ কটমট করে ওঠে। বালিশ ছুড়তে গিয়ে চোখ পড়ে সাহিত্যের হাতে। সাইরাহ্ আঁতকে উঠে বলে, ‘আপনার হাতে র’ক্ত কেন? কী করছেন আবার?’

সাহিত্য ভড়কে যায়। হাত পেছনে নিতে নিতে বলে, ‘কিছু করি নাই। তুই নিজের কাজ কর।’

সাইরাহ্ এগিয়ে আসে। হাতটা আলগোছে টেনে নিয়ে হাতের দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়, ‘আপনার মা যদি আপনার এই হাত দেখে তাহলে এসে আমার গলা চেপে দিয়ে বলবে ‘বিধবা অ’লক্ষী! তোর সাথে বিয়ে হতে না হতেই আমার ছেলের হাত কা’ইটা র’ক্ত পড়তেছে।’ তখন এইগুলা তো আর আপনি শুনবেন না, শুনতে হবে আমার।’

সাহিত্য গম্ভীর চোখে তাকিয়ে থাকে। সাইরাহ্ হাতে ফু দিয়ে আস্তে আস্তে নিজের শাড়ির আঁচল চেপে ধরে হাতে৷ সাহিত্যের রাগ, অভিযোগ সমস্তটা যেনো একমুহূর্তেই উবে যায়। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়। অন্য হাত বুকের ওপর রেখে বিড়বিড় করে আওড়ায়,

‘হোক মিথ্যে, হোক বাধ্য হয়ে তবুও তোর এই প্রেমটুকু আমার হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ তুলেছে সাহেবা।’

সাইরাহ্ অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। সাথে সাথেই সাহিত্য হাত নামিয়ে নেয়। সাইরাহ্ ভ্রু কুঁচকে শুধায়, ‘কিছু বললেন?’

‘না। বলিনি।’

‘কাপড়ের টুকরো আছে? হাতটা বেঁধে দিলে ভালো হবে।’

সাহিত্য পেছনের ড্রয়ারের দিকে দেখিয়ে বলে, ‘ওটার মধ্যে ব্যান্ডেজ আছে। আব্বা শহর থেকে আনছিলো। মলমও আছে।’

‘আচ্ছা! চুপ করে বিছানায় বসুন। আমি আসছি।’

সাহিত্য বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ায়। চুপচাপ বিছানার ওপর বসে পড়ে। সাইরাহ্ ড্রয়ার থেকে ব্যান্ডেজ আর মলম আনে। ফু দিয়ে দিয়ে মলম লাগিয়ে দিতে থাকে। সাহিত্য দেখে সব। সীমান্তের কথাগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে। এক দৃষ্ঠে সাইরাহ্-র দিকে তাকিয়ে শুধায়,

‘তোরও কী মনে হয় আমি তোকে বিয়ে করার জন্য সীমান্তকে ঠ’কিয়েছি? আমি চাইনি তোর আর সীমান্তের বিয়ে হোক?’

সাইরাহ্-র হাত থেমে যায়। চোখ তুলে তাকায় সাহিত্যের মুখের দিকে। বুঝতে না পেরে বলে, ‘মানে?’

সাহিত্যের যেনো হুশ ফেরে। ব্যস্ত ভাবে নিজের হাত টেনে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বলে, ‘কিছু না।’

সাইরাহ্ কতক্ষণ নীরব থাকে। তারপর ফের সাহিত্যের হাত টেনে নিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলে, ‘আমি এতো মা’রপ্যাচ বুঝি না। আমি জানি আপনি কী! আর আমি এটাও জানি সীমান্ত ভাই কী! সেদিন উনি আমাকে সবার সামনে প্রত্যাখ্যান করেছেন, এখানে তো আর আপনার দোষ নাই। আমার এসব নিয়ে কোনো যুক্তি, তর্ক, রাগ, অভিমান, অভিযোগ কিছুই নেই। কারোর প্রতিই নেই। কেবল নিজের ভাগ্যের প্রতি আছে।’

সাহিত্য শোনে মন দিয়ে। সাইরাহ্ উঠে ব্যান্ডেজের বাকি অংশ আর মলম ড্রয়ারে রাখে। সাহিত্য ফের শুধায়, ‘তোর আমার সাথে থাকতে, আমাকে মেনে নিতে, এই বিয়েটা মেনে নিতে অনেক কষ্ট হয় তাই না সাহেবা? আমার জায়গায় তো তুই সীমান্তকে চেয়েছিলি। ভালোবাসিস ওকে।’

সাইরাহ্ ফিরে হাসে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে বলে, ‘ভালোবাসা কাকে বলে আমি জানি না সাহিত্য ভাই। মিথ্যা বলবো না তবে সত্যিই আপনাকে মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে আমার কষ্ট হয় নাকি অদ্ভুত জড়তা হয় আমি বুঝি না। কোথাও যেনো একটা কিছু গলায় কাঁটার মতো বিঁধে যায়। কিন্তু আমি ততটাও ছোট নই, অবুঝ নই। বিয়ের মূল্যটা আমি বুঝি। এই ছোট্ট জীবন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে তার মধ্যে একটা হলো ‘বিয়ে’। এই পবিত্র সম্পর্কটা আমার মেনে নিতে কষ্ট হলেও এটাই সত্য। তাই এটা আমার মেনে নিতে হবে। আর পৃথিবীর সবথেকে একটা বড় সত্য কী জানেন! বিয়ের পর মেয়েদের অতীত থাকে না, অতীতের কোনো ভালোবাসাও থাকে না। মেয়েরা তখন বর্তমান নিয়ে ভাবে৷ অতীতের অনুভূতি, আবেগ, মায়া, মোহ নিয়ে ভাবার মতো সময় তখন তারা পায় না। তখন ভাবে ‘কিভাবে সংসারটা গোছানো যাবে, কিভাবে শ্বশুর শাশুড়ির মন জয় করা যাবে, কিভাবে একটু একটু করে সংসারটা নিজের করে গড়ে তোলা যাবে’।’

‘বিয়ে হয়েছে বলে থাকতে বাধ্য হচ্ছিস?’

‘উহু, না। থাকার চেষ্টা করছি। ভাগ্য কিংবা নিজের জন্য।’

এরপর থেমে বলে, ‘কিংবা আপনার জন্য।’

সাহিত্য চমকায়। সাইরাহ্-র দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে যায়। সাহিত্য অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সাইরাহ্ উঠে চলে যেতে যেতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে বলে, ‘আপনি আমার জন্য এতোকিছু করলেন, এতো ভালোবাসলেন! আমি না হয় সেই ভালোবাসার বিপরীতে সামান্য মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে থেকে গেলাম। খুব একটা ক্ষতি তো হবে না।’


বাড়ির পরিবেশ বেশ গমগমে। তাই বেলী আর ছন্দ আজও এসেছে বড় বকুলফুলের গাছটার নিচে। বেলী গাছের ওপর বসে আছে আর ছন্দ শাহিদের সাথে দুরে আছে। বেলী পা দুলিয়ে দুলিয়ে নিজের বেনুনি নাড়তে থাকে। সাথে গুণ গুণ করে গান গাইতে থাকে। নুপুরের ছন্দে আর গুণ গুণ করা গানে বেশ একটা তাল উঠেছে। তা ভালোই উপভোগ করছে সে৷ এরমধ্যেই তামজীদ আসে। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বেলীকে ধমকে ওঠে,

‘এ্যাই মেয়ে! তুমি এই সময় গাছে কী করো? ভয় লাগে না তোমার? আবার বেনুনি নাচাচ্ছো! যদি ভুত আসে!’

বেলী হঠাৎ কথায় ভয় পেয়ে যায়। সে মূলত গান গাইতে গাইতে অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিলো। নিচে তামজীদকে দাঁড়াতে দেখে গলা উচু করে বলে,

‘আপনি এভাবে হুটহাট ভুতের মতো আসেন কেনো? আমি সবসময় ভয় পেয়ে যাই।’

তামজীদ ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলে, ‘আমার মুখ কী ভয় পাওয়ার মতো?’

‘না। কিন্তু আগমন ভয় পাওয়ার মতো।’

‘নিচে নামো আগে!’

বেলী মুখ বাঁকায়। এক লাফে নিচে নামে৷ তামজীদ চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘ব্যাথা পেলে কী হতো?’

বেলী উল্টো প্রশ্ন করে, ‘কী হতো?’

তামজীদ বেলীর বেনুনি টেনে দেয়। বেলী আর্তনাদ করে নিজের চুলে হাত বুলাতে থাকে। তামজীদ পকেট থেকে বেলী ফুল বের করে বেলীর হাতে দেয়। বেলী ফুল নিয়ে হেঁসে বলে,

‘আপনি সবসময় আমার জন্য ফুল আনেন কেনো? তাও এতো যত্ন করে!’

তামজীদ জবাব দেয় না। মাথা চুলকে হাসে। বেলীও হাসে। দুজনে একসাথে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে শুরু করে। বেলী বেলীফুল কানের পৃষ্ঠে গুঁজে নেয়। আজ তার মনটা ভীষণ ভালো। অকারণেই ভালো। নুপুরের ছন্দে তাল মিলিয়ে তার হৃদয় যেনো দুলে উঠছে। তার খুশির মাঝেই অবাক করে দিয়ে তামজীদ বলে ওঠে,

‘বেলী, বিয়ে করবে আমাকে?’

বেলী চমকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। মুখের হাসি গায়েব হয়ে যায়। ভুল শুনেছে ভেবে প্রশ্ন করে, ‘কি বললেন?’

তামজীদ ফের শুধায়, ‘বেলী, বিয়ে করবে আমাকে?’

বেলী পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয়। তামজীদের শীতল মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি তামজীদ ভাই না। আপনি ভুত তাই না?’

বলেই উল্টো ফিরে বলে, ‘আম্মাগো, আমারে ভুতে ধরছে। বাঁচাও।’

বলেই ছুট লাগায়। বেচারা তামজীদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বেলীর যাওয়ার পথে তাকিয়ে ভাবে ‘কি হলো এটা?’ পরমুহূর্তেই বেলীর কান্ড মনে করে শব্দ করে হেঁসে ওঠে। মেয়েটা তাকে ভুত ভেবে পালালো! জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষকে রীতিমতো ভুত বানিয়ে দিলো! তামজীদ হাসতে হাসতে বসে পড়ে। হাসি থামিয়ে আওড়ায়,

‘তোমার পছন্দের বেলীফুল যেভাবে যত্ন করে হৃদ বরাবর রাখি তেমনই তোমাকেও রাখি। প্রিয় বেলী, তুমি আমার হবে কি?’

চলবে..

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____

২০.
কেটেছে কয়েকদিন। গ্রামের মানুষ একের পর এক মৃ’ত্যুতে আতঙ্কিত হয়ে আছে। সাইরাহ্-সাহিত্য’র ঝগড়া, খুনশুটিতে সংসার এগোচ্ছে। সীমান্ত লজ্জায় সাহিত্যদের বাড়ির দিকে যেতে পারে না। নাজিরাও নিজের মতো রয়েছে। সাহিত্যের বিয়ের পর লুবনা চলে গিয়েছিলো। তামজীদ বেলীর দেখা হয়নি আর। শেখর সাহেব সাইরাহ্ আর সাহিত্যের আবার পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক করেছে। আজ গায়ে হলুদ আর কাল বিয়ে। শেখর সাহেব সবুর মিয়ার সাথে কথা বলেছিলেন কিন্তু সে ১ পয়সাও খরচ করতে নারাজ। শেখর সাহেব নিজে সব দায়িত্ব নিতে চাইলেও সবুর মিয়া রাজি হন না। তাই অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউভাত সব দুজনের একসাথেই হবে৷ সাইরাহ্ মানা করেছিলো এতো কিছু করতে কিন্তু শেখর সাহেব সরাসরি বলে দিয়েছেন,

‘আমার একটাই ছেলে। তার বিয়ে ম’রা ম’রা করে হয়ে যাবে এটা আমি মানতে পারি না। ওর বিয়েতে গোটা গ্রামকে আমি দাওয়াত করে খাওয়াবো।’

এরপর আর সাইরাহ্-র বলার মতো কিছু ছিলো না। সুফিয়া কিছুতেই সাইরাহ্-কেই মানছে না তারওপর নতুন করে বিয়ে দেখে তার মরমর অবস্থা। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এই বিয়ের কোনো কাজ সে করবে না। শেখর সাহেবও জোড় করেননি। বাকিদের ওপর দায়িত্ব গুলো বুঝিয়ে দিয়েছেন। নাজিরা, বেলী, ছন্দ মিলে এসেছে সাইরাহ্-কে হলুদের জন্য সাজাতে। বড় ভাবী, ছোট ভাবী এবং বড়রা বাকি কাজে ব্যস্ত। লুবনা বিয়ে বাড়িতে আসলেও সাইরাহ্-র কাছে আসেনি। সাইরাহ্ ঘরে একাই বসেছিলো। সাহিত্যও ঘরে নেই। এসময় নাজিরাদের আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায়। নাজিরা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে,

‘ভাবীজান, হাত মুখ ধুয়ে আসেন জলদি৷ আপনাকে সাজাবো।’

সাইরাহ্ থতমত খেয়ে বলে, ‘এখনই?’

নাজিরা মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। পাশ থেকে বেলী বলে, ‘সাইরাহ্ বুবু, চলো আমি সাহায্য করি।’

‘এই বুবু বলিস ক্যান? উনি তো এখন আমাদের ভাবী লাগে।’

ছন্দের কথায় বেলী জিভ কাটে। সাইরাহ্ বেলীর সাথে এগোতে এগোতে বলে, ‘বুবু-ই বইলো বেলী। আমার সমস্যা নাই।’

বেলী মিষ্টি করে হাসে। হাত মুখ ধুয়ে এসে নাজিরা শাড়ি পড়াতে শুরু করে। শাড়ি পড়াটা সে শিখেছিলো মায়ের থেকে। এখন কাজে লাগছে। আটপৌরে করে শাড়ি পড়িয়ে ফুলের গহণা পড়িয়ে দেয়। মুখে খুবই কৃত্রিম সাজ দিয়ে তৈরী করে ফেলে। বেলী আর ছন্দ প্রশংসা করতে থাকে। নাজিরা অপলক সাইরাহ্-র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে সাইরাহ্ সামান্য হেঁসে বলে,

‘কিছু হইছে নাজিরা? এভাবে তাকিয়ে আছো যে!’

নাজিরা আলগোছে সাইরাহ্-র মাথার কাপড় তুলে দিতে দিতে বলে, ‘আপনি ভীষণ ভাগ্যবতী ভাবীজান। আপনাকে দুইজন পুরুষ অসম্ভব রকম ভালোবাসে অথচ কিছু মানুষ একজনের ভালোবাসাটাই পায় না।’

সাইরাহ্ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নাজিরার চোখে স্পষ্ট ফুটে ওঠে চাপা ব্যাথা। তবে এই ব্যাথা কার জন্য? সাহিত্য নাকি সীমান্ত? মুখ ফুটে প্রশ্ন করতে পারে না। নাজিরা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এর মাঝেই নিচ থেকে ডাক পড়ে। গায়ে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে উঠানের মাঝে। ৩ জন মিলে ধীরে ধীরে সাইরাহ্-কে নিয়ে নিচে নামে। ধরে স্টেজে বসিয়ে দিতেই আশে পাশের মানুষ ফিসফিস করা শুরু করে। সাইরাহ্ জানে এমন কিছু হবেই। একে অন্যের মাঝে ফিসফিস করতে করতে তো একজন জোড়েই বলে বসলেন,

‘সুফিয়া ভাবী, গেরামে, দেশে কী মাইয়ার অভাব আছিলো নাকি গো? শেষ পর্যন্ত একটা বিধবার লগে পোলার বিয়া করাইতাছেন? তাও আবার ঢাক ঢোল পিটাইয়া! পোলার মঙ্গল, অমঙ্গলের বালাই নাই দেকি।’

বলেই মহিলা মুখ চেপে হাসেন। সে সময়ই তামজীদ সাহিত্যকে নিয়ে স্টেজের কাছে আসে। যেহেতু একই বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে তাই বর বউকে একসাথেই হলুদ লাগানো হবে। সাহিত্যের পড়নে স্যান্ডো গেঞ্জি, লুঙ্গি আর কাঁধে গামছা৷ সাইরাহ্ হাতে হাত চেপে শক্ত হয়ে বসে আছে৷ সাহিত্য আরাম করে বসতে বসতে হেঁসে বলে,

‘আরে কাকি! আপনার দেখি আমারে নিয়ে অনেক চিন্তা। তা আমার বউরে কী ভাত আপনি দিবেন? দিলে নিয়ে যান। পাইলা পুইষা বড় করেন। এতে আমারও মঙ্গল হবে৷ ঠিক না?’

সাহিত্যের ঠেস মা’রা কথায় মহিলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। সাহিত্যের ফুপু ধমকে উঠে বলেন, ‘বড়দের লগে এগ্লা কেমন ব্যবহার সাহিত্য? ভালা কইরা কথা ক!’

‘তাহলে উনারেও বলেন চুপচাপ বিয়ে দেখে বাড়ির দিকে যাইতে। তাইলেই তো আমিও মুখ বন্ধ রাখি।’

সুফিয়া চোখ গরম করে। সাহিত্য নিজের মতো স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকে। সাহিত্যের মুখে যে কিছু আটকাবে না এটা সকলেই ঢের বুঝে যায়। অনেকে ফিসফিস করে ‘বউ পাগলা’ উপাধি দিতে ভোলে না। সাহিত্য মাথা এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে সাইরাহ্-কে বলে,

‘আজীবন যন্ত্রের মতো শুধু শুনেই যা। ম’রার পর ভুত হয়ে এদের জবাব দিস।’

সাইরাহ্ ঘাড় বাকিয়ে তাকায়। সাহিত্য সোজা হয়ে বসে। সাইরাহ্ কিছু বলতে চেয়েও বলে না। আজ তার গায়ে হলুদ। কাল বিয়ে। বিয়ের কনে এভাবে মুখের ওপর ফটাফট জবাব দিলে সেইটা কী ভালো দেখায়? নিজেই তো জবাব দিয়ে আরেক বিপদ বাঁধালেন। এমনিতেই সুফিয়া তাকে দু চোখে সহ্য করতে পারে না। এখন তো নিশ্চিত আরোই পারবে না। বাকি মানুষরাও তার দিকে বাঁকা নজরে তাকাচ্ছে। সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুরু হয় হলুদ লাগানো। একজন একজন করে হলুদ লাগাচ্ছে আর মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। তামজীদ সাহিত্যকে বলে উঠে যায়। আশে পাশে দৃষ্টি বুলিয়ে বেলীকে খোঁজে। বেলী কী আর এক জায়গায় দাঁড়ানোর মতো মেয়ে! সে সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তামজীদ বেলীকে খুঁজে বেলীর দিকে এগিয়ে যায়৷ সামনাসামনি পড়ে যায় দুজনে। বেলী হকচকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা৷ ফাঁকা ঢোক গিলে এক আঙুল দিয়ে তামজীদের বাহুতে টোকা দেয়। তামজীদ ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কি হলো ব্যাপারটা?’

বেলী দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে জবাব দেয়, ‘কই? কিছু না তো।’

তামজীদ বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে হাত বগলদাবা করে ঠোঁট গোল করে সুর টেনে বলে, ‘ওহহহহ! তুমি দেখছিলে আমি মানুষ নাকি ভুত! তাই না?’

বেলী গোল গোল চোখে তাকায়। তামজীদ কি করে বুঝলো? মাথা চুলকে অবুঝ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তামজীদ ফের বলে, ‘সেদিন তো ভুত ভেবে পালিয়ে গেলে, আজও যাবে নাকি?’

বেলী চমকে যায়। তামজীদ সেদিন সত্যিই ছিলো নাকি আজকেও ভুত এসেছে? ভাবতেই দু পা পিছিয়ে যায়। তামজীদ বেলীর হাবভাব দেখে বুঝে যায়এই মেয়ের মনে কি চলছে! তাই ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলে,

‘আজও ভুত মনে হচ্ছে? ছুঁয়ে দেখবে? নাকি জড়িয়ে ধরবো? ধরবো?’

বলে এগোতে গেলে বেলী দ্রুত পিছিয়ে যায়। তামজীদ ভ্রু নাচিয়ে শুধায়, ‘কী?’

বেলী দুদিকে মাথা নাড়ায়। কাচুমাচু করতে থাকে সরে পড়ার জন্য। কিন্তু তার সামনেই তামজীদ দাঁড়িয়ে আছে। দুরে ছন্দকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ব্যস্ত ভাবে বলে,

‘ছন্দ ডাকছে। আমি যাই।’

‘আমি তো শুনিনি।’

বেলী ঠোঁট কামড়ে করুণ চোখে তাকায়। তামজীদ দু পা এগিয়ে আসলে বেলীও পিছিয়ে যায়। তামজীদ পকেট থেকে বেলীফুল বের করে নিজ হাতেই বেলীর কানের পৃষ্ঠে গুঁজে দেয়। বেলী চোখ বন্ধ করে শাড়ির অংশ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। তামজীদ খানিকটা মুখ এগিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলে,

‘বেলী, বিয়ে করবে আমাকে?’

বেলী চমকে তাকায়। তামজীদকে এতোটা কাছে দেখে ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত সরতে গিয়ে পড়ে যেতে নিলে তামজীদ হাত টেনে ধরে। ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলে, ‘পড়ে গেলে কোমড় ভেঙে যাবে। তখন লোকে আমাকে বলবে ‘তামজীদের বউয়ের কোমড় ভাঙা’।’

বেলী দ্রুত দাঁড়িয়ে কোনোরকমে বলে, ‘আপনাকে ভুতে ধরেছে আমি নিশ্চিত। জেঠাইকে বইলেন আপনার ভুত ঝাড়তে।’

‘সে তো তোমার ভুত ধরেছে। তুমিই নামিয়ে দাও।’

বেলী আর দাঁড়ায় না। হুটহাট লোকটা এতো বেপরোয়া হয়ে গেলো কেনো? ছুটে চলে যায় ছন্দের কাছে। তামজীদ একাই নিঃশব্দে হাসে। মেয়েটাকে তার লাগবে। এই মেয়েটা সে হারিয়ে ফেললে তার হৃদয়ের একাংশ ম’রে যাবে। বেঁচে থেকেও জীবন ফুরিয়ে যাবে।’


সাহিত্যের বিয়েতে প্রধানের বাড়ির কেউ প্রথমে আসতে চায়নি। এমন অলক্ষুণে মেয়েকে এরা কিভাবে যে এতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘরের বউ করছে তাই ভেবে কুল পায় না। কিন্তু আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার্থে তারা সবাই এসেছে। আর মায়ের পিড়াপিড়িতে সীমান্তও আসতে বাধ্য হয়েছে। স্টেজের কাছে সে যায়নি। দুরে দাঁড়িয়েই দেখেছে সাহিত্য আর সাইরাহ্-র হলুদ দেয়া। সাইরাহ্-র দিকে তাকিয়েই বিড়বিড় করে আওড়ায়,

‘আজ আমার জন্য তোমার সাজার কথা ছিলো সাইরাহ্। তোমার পাশে সাহিত্যের জায়গায় আমার থাকার কথা ছিলো। অথচ আমি তোমাকে পেলাম না। আমার ভেতরটা পু’ড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে সাইরাহ্। তুমি বুঝলে না।’

শ্বাস আটকে সেখান থেকে সরে যায় সীমান্ত। ব্যস্ত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় ছাঁদে। সাইরাহ্ যে সীমান্তকে দেখেনি এমন না। তবে দেখেও তার কিছু করার নেই। সীমান্তকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কতক্ষণ বাদেই নাজিরাকেও ছাঁদের দিকে যেতে দেখে সাইরাহ্-র চোখ মুখ শীতল হয়ে যায়। ভেতর থেকে মনে হয় একটা বোঝা সরে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে আওড়ায়,

‘কার মনে কার বাস জানা নেই, তবে সঠিক পুরুষ বেছে নেওয়া বড় কঠিন। আমি পাইনি তাতে আক্ষেপ নেই। আমি মেনে নিয়েছি ভাগ্যকে। তোমরা সুখী হও।’

নাজিরা ছাঁদে এসে দেখে সীমান্ত দাঁড়িয়ে আছে। নাজিরা ধীর পায়ে সীমান্তের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সীমান্ত দৃষ্টির নড়চড় করে না। নাজিরা কতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সীমান্ত না তাকিয়েই বলে,

‘কিছু বলবে?’

নাজিরা ‘হ্যাঁ’ বলবে নাকি ‘না’ বলবে বুঝে ওঠে না। সে আসলেই কিছু বলতে এসেছিলো আবার হয়তো কোনো কথা বলার মতো নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুরে দৃষ্টি দেয়। প্রশ্নটার জবাব না দিয়ে নিজ থেকে বলে,

‘পৃথিবীর নিয়ম বড্ড অদ্ভুত তাই না, সীমান্ত ভাই? প্রতিটা গল্পে একটা করে ত্রিকোণ কাহিনি থাকে। কেউ কেউ জানে আবার কেউ কেউ জানে না। কিছু মানুষের ভালোবাসা পূর্ণতা পায় আর অন্যদিকে আরেকজনের মন ভাঙে। এটাই যদি নিয়ম হয় তবে হৃদয়ে প্রেম আসে কেনো?’

‘ভেঙে চুড়ে, গুড়িয়ে দিতেই প্রেম আসে।’

‘তবে প্রেম না আসুক জীবনে।’

দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ থাকে। সীমান্তের চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সাইরাহ্-র মুখের অবয়ব সরছে না। বার বার তার অস্থির লাগছে। নাজিরা দেখে। সীমান্তের হাসফাস অবস্থা দেখে সামান্য হাসেও। ফিরে চেয়ে আওড়ায়,

‘তবে কিছু মানুষের জীবনে প্রেম আসে রঙিন করতে কিন্তু তারা সেই রঙিন জীবনকে বেছে নিতে পারে না। নিজ হাতে দুরে ঠেলে দেয়। যেমন আপনি।’

সীমান্ত চট করে তাকায়। নাজিরা চোখে চোখ রেখে ফের বলে, ‘আপনি ভালোবাসা পেয়েও পাননি। এটারই শা’স্তি পাচ্ছেন। যাকে ভালোবেসেছেন তাকেই আগলে রাখতে পারেননি আর অন্যের ভালোবাসাটা বুঝবেন এটা ভাবাও বোকামো।’

সীমান্ত জবাব দিতে পারে না৷ কি জবাব দিবে তা বুঝেই ওঠে না। নাজিরা চোখ সরিয়ে নিয়ে নিচে নামার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যায়। চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ঘাড় সামান্য বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলে,

‘যে পুরুষ আমার চোখে চোখ রেখেও চোখের ভাষা বুঝতে অক্ষম, সে পুরুষ আমাকে ভালোবাসেনি এটাই বুঝি আমার স্বার্থকতা।’

নাজিরা নেমে যায়। সীমান্ত চোখ বন্ধ করে নেয়। নাজিরার কথাগুলো মাথার মধ্যে বার বার বাজতে থাকে। সে বুঝেছে নাজিরা তাকে ভালোবাসে। কিন্তু তার জীবনে ভালোবাসার কোনো পরিণতি নেই। মেয়েটা তাকে না পেলেই সুখী হবে।


গায়ে হলুদ শেষ হয়েছে। বাড়ি ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেছে। সাইরাহ্ ক্লান্ত শরীরে কোনো রকম এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। বড়রা গোসল করতে মানা করে দিয়েছে। একেবারে পরেরদিন সকালে সবাই মিলে তাকে গোসল করাবে। কিন্তু শরীর আর মন চায়ছে একটু গোসল করতে। তবুও মনের ইচ্ছাকে দমিয়ে নিচে গিয়ে গোসলখানায় ঢুকে হাত মুখের হলুদ গুলো ধুয়ে ফেলে। চোখে মুখে অনেকটা সময় নিয়ে পানি দিয়ে বেড়িয়ে আসে। তোয়ালে নিয়ে মুখ মুছে ঘরে ঢুকতেই খেয়াল করে বিছানার ওপর সাহিত্য বসা। সাইরাহ্ তব্দা খেয়ে চেয়ে থাকে। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে শুধায়,

‘আপনি এইখানে কেন? আপনাকে না বড় ভাবী মানা করলো এই ঘরে আসতে!’

মূলত বিয়ের আগে সাহিত্য আর সাইরাহ্-কে আলাদা থাকতে বলা হয়েছে। বড় ভাবী নিজেই বলেছেন। সাইরাহ্ নাজিরার সাথে আপাতত তার ঘরে থাকবে আর সাহিত্য তার নিজের ঘরে থাকবে। সাথে থাকবে তামজীদ। তাই এসময় সাহিত্যকে এ ঘরে দেখে সে বেশ চমকেছে বলা যায়। সাহিত্য হাই তুলতে তুলতে জবাব দেয়,

‘তো?’

‘তো মানে? আপনাকে উনারা এই ঘরে দেখলে কী ভাববে? আর নাজিরা দেখলে কী মনে করবে?’

‘কী মনে করবে?’

সাইরাহ্ কটমট করে ওঠে। সাহিত্য পাত্তা না দিয়ে নিজের জায়গা থেকে উঠে আসে। সাইরাহ্-র কাছে এগোতে এগোতে বলে, ‘সবাই আমার বউকে হলুদ লাগাইছে, আমি বাদ যাবো কেন?’

‘মানে?’

বলতে বলতেই সাহিত্য হুট করে সাইরাহ্-কে এক হাতে পেঁচিয়ে নেয়। সাইরাহ্ চমকে ওঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাহিত্য নিজের গাল সাইরাহ্-র গালে ঘষে দেয়। সাহিত্যের মুখের ছোট ছোট দাড়িগুলোর ঘষা লাগে সাইরাহ্-র মুখে। সাইরাহ্ দু হাতে শক্ত করে নিজের শাড়ি চেপে ধরে। সাহিত্য ওভাবেই ফিসফিস করে বলে,

‘শুভ্র রঙে সাহেবা শুভ্রা লাগে, মুগ্ধতা আসে। আর বাসন্তী রঙে সাহেবাকে রঙিন রঙিন লাগে, আমার আমার লাগে।’

সাহেবা আরো জমে যায়। থমে যায় ‘আমার আমার লাগে’ শব্দগুলোয়। ফাঁকা ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে নেয়৷ সাহিত্য সরে সাইরাহ্-র কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সাইরাহ্ তাকায় না। সাহিত্য ঠোঁট কামড়ে হাসে। সাইরাহ্ বুঝতেও পারে না। সাহিত্য দুরে সরে দাঁড়ায়। সাইরাহ্ বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে চোখ মেলতেই দেখে সাহিত্য তার থেকে দুরে দাঁড়িয়ে। সাইরাহ্ দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। সাহিত্য নিঃশব্দে হেঁসে সাইরাহ্-কে জ্বালাতে বলে,

‘তোকে লজ্জা পেলে পুরো বা’নরের গালের মতো লাগে। এ্যাই সাহেবা, তুই লজ্জাও পাস? আমি তো ভেবেছিলাম তুই লজ্জা শরম সব বিক্রি করে দিয়েছিস।’

একটু আগের মুহুর্তকে শ্বাস আটকানো অবস্থায় নিয়ে গিয়ে এখন আবার তাতে লবণ ছিটাচ্ছে। সাইরাহ্ দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছুতেই এই লোকটার সাথে মুখ লাগাবে না। ঝ’গড়া করতে ওস্তাদ এই লোক। সাইরাহ্ বুঝে পায় না পুরুষ মানুষ এতো ঝ’গড়ুটে হয় কিভাবে? তার ভাবনার মাঝেই বাহির থেকে ডাক আসে। নাজিরা নিচু কন্ঠে ডাকছে,

‘ভাইজান, জলদি বের হন। বড় ভাবী চলে আসবে।’

সাহিত্য শেষ একবার সাইরাহ্-র মুখের পানে চেয়ে প্রশান্তির হাসি হাসে। এরপর সাইরাহ্-কে কিছু না বলেই বেড়িয়ে যায়। সাইরাহ্ তখনো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল খুঁটছে আর দৃষ্টি এদিক ওদিক করছে। নাজিরা ঘরে ঢুকে মুখে হাত চেপে হাসে। সাইরাহ্-কে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ভাবীজান, হলুদ ধুয়ে আর লাভ হলো না। আবার ধুয়ে আসেন। আর ভাইজান যে এঘরে এসেছিলো আমি কাউকে বলবো না।’

বলেই মুখ চেপে হাসতে থাকে। সাইরাহ্ লজ্জা পায়। উল্টো ফিরে ফের নিচে যাবে কি না ভাবতে থাকে। নাজিরা সাইরাহ্-কে টেনে আয়নার সামনে দাঁড় করায়। হেঁসে বলে,

‘আপনার বরের নিজে ছোঁয়ানো হলুদ। অনুভূতি হচ্ছে ভাবীজান?’

সাইরাহ্ অপলক শুধু নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার গাল ছুঁয়ে দেয়। সাহিত্য ঘরের বাইরে থেকে সে দৃশ্য দেখে হাসে। চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে আওড়ায়,

‘তোকে নিজের করে না চেয়েও যখন আমি পেয়েছি, তখন তোকে আমি রেখে দেবো সাহেবা। তোকে খুব যত্ন করে এই বুকে লেপ্টে রেখে দিবো।’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)