সাহেবা পর্ব-২৩+২৪

0
423

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____

২৩.
সাহিত্য আর সাইরাহ্ ফিরেছে দেখেও সুফিয়া কোনো কথা বলে না। চুপচাপ উঠে চলে যায়। বড় ভাবী, ছোট ভাবী আর নাজিরা মিলে সাইরাহ্-র সাথে গল্প করতে বসে যায়। বড়রা অন্যান্য কাজ করছে৷ সাহিত্য ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েও পড়েছে হয়তো। সারারাত সে ঘুমায়নি৷ সাইরাহ্ বোঝে না রাতে মানুষের শহরে কী কাজ থাকতে পারে! তাদের গল্পের মাঝেই একজন মহিলা আসে৷ সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকে,

‘বাড়ির মানুষ আছেনি?’

বড় ভাবী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আপনে ক্যাডা? কী চান?’

মহিলা মুখের পানের পিক ফেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, ‘বাড়ির মাইয়ার লাইগা বিয়া আনছি। বাড়ির বড়রে ডাকো দেহি।’

বড় ভাবী কথা না বাড়িয়ে তার শাশুড়িকে ডাকা শুরু করে৷ একসাথে বড়রা সবাই আসে। মহিলাকে বসালে তিনি ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে দেন। পান খাওয়া লাল দাঁতে হেঁসে বলে,

‘পোলা পাশের গেরামের। এই গেরামে তাগো আত্মীয় আছে। হেই বাড়িত আইসাই পোলার মা নাজিরারে দেখছিলো। তাগো মাইয়ারে পছন্দ। পোলার বাড়ি গেরামে হইলেও পোলা শহরে চাকরী করে৷ বউ নিয়াও শহরে থাকবো।’

নাজিরা মা ছেলের ছবি দেখে বেশ সন্তুষ্ট হন। সাইরাহ্ নাজিরার দিকে তাকিয়ে দেখে সে অনুভূতিশূণ্যের মতো বসে আছে। সাইরাহ্ সবার অগোচরে নাজিরার হাতে হাত রাখে। নাজিরা চোখ তুলে তাকালে নিচু স্বরে বলে,

‘বিয়ে আসলেই তো হয়ে যায় না। চিন্তা করো না।’

নাজিরা হাসার চেষ্টা করে৷ বড়রা বিয়ে নিয়ে কথা বলতে থাকে৷ এর মাঝে নাজিরার বাবাকে ডেকে আনা হয়। তিনি সব শুনে বলেন ছেলে এবং তার পরিবারকে আসতে। ঘটক মহিলাটি বলেন দু একদিনের মাঝেই তিনি ছেলের পরিবারসহ হাজির হবেন। সাইরাহ্ সেটুকু শুনেই সেখান থেকে সরে পড়ে। সোজা নিজেদের ঘরে গিয়ে দেখে সাহিত্য হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। সাইরাহ্ কপাল চাপড়ে ঘরের মাঝেউ পায়চারি শুরু করে। জোড়ে জোড়ে হাঁটার দরুণ তার শব্দে সাহিত্য নড়েচড়ে ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে,

‘এক জায়গায় চুপচাপ বস সাহেবা। বিরক্ত হচ্ছি আমি।’

সাইরাহ্ ব্যস্ত ভাবে বিছানার কাছে গিয়ে বলে, ‘বিরক্ত হইয়েন পরে, এখন জলদি ঘুম থেকে উঠেন।’

সাহিত্য না শুনে সাইরাহ্-র হাত ধরে টেনে তাকে বিছানায় ফেলে দেয়। আকস্মিক ঘটনায় সাইরাহ্ থতমত খেয়ে যায়। কোনো রকমে নিজেকে ঠিকঠাক করে শোয়ার আগেই সাহিত্য হাত দিয়ে পেঁচিয়ে নেয় তাকে৷ সাইরাহ্ তাড়া দিয়ে বলে,

‘কী করছেন? ছাড়েন, ছাড়েন। দরজা খোলা আছে৷ কেউ চলে আসবে।’

‘আসবে না। তুইও ঘুমা।’

‘আরে আমি ঘুমাবো না। ছাড়েন।’

সাহিত্য ছাড়ে না। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে। সাইরাহ্ সাহিত্যের দিকে ঘুরে গিয়ে কাৎ হয়ে শোয়। সাহিত্যের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শোনেন না!’

সাহিত্য ঘুম ঘুম কণ্ঠে কোনোরকমে ‘হু’ বলে। সাইরাহ্ দু হাতে সাহিত্যের চোখের পাতা মেলে দিতে দিতে বলে, ‘আরে গুরুত্বপূর্ণ কথা।’

‘শুনছি। তুই বল।’

‘নাজিরার জন্য সম্বন্ধ এসেছে। দু-একে দেখতে আসবে।’

‘এই খবর কী আমি পরে পাইতাম না? আমার ঘুমের পেছনে কেন লাগছিস সাহেবা?’

‘আরে মাথামোটা লোক, ঘুম পরেও হবে। জলদি কিছু করেন।’

সাহিত্যের কপালে ভাজ পড়ে। তবে চোখ টেনে খুলতে পারে না। একেই সারারাত ঘুম হয়নি তারওপর ভোরে একটু ঘুমালেও সকাল সকাল উঠতে হয়েছিলো আবার। তাই চোখ না মেলেও সাহিত্য সাইরাহ্-র দিকে আরেকটু চেপে এসে বলে,

‘আপাতত ঘুমাবো, এর বেশি কিছু করতে পারবো না।’

সাইরাহ্ আহম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে। মানে? কতক্ষণ চুপ থেকে পুরো বিষয়টা ভাবতেই বুঝতে পারে সাহিত্য কিসের কথা বলেছে! নিজের কথার মানে এভাবে উল্টো হয়ে গেছে ভেবেই তার লজ্জায় গলা থেকে আওয়াজ বের হয় না। দু হাতে সাহিত্যের গলা টিপে দেওয়ার মতো করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘মাথায় কী সবসময় উল্টা পাল্টা বিষয়গুলোই ঘোরে? আমি নাজিরার বিয়ে ভাঙার কথা বলছি।’

সাহিত্য এবার চোখ মেলে তাকায়। বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘নিজের বোনের বিয়ে ভাঙবো? কোন শখে?’

‘কারণ নাজিরা সীমান্ত ভাইকে ভালোবাসে।’

সাহিত্যের চোখে যতটুকু ঘুম ছিলো তা উবে যায়। এক লাফে উঠে বসে অবাক কন্ঠে বলে, ‘মানে? কী বললি? কে কাকে ভালোবাসে?’

সাইরাহ্ হতাশ হয়। মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে, ‘এতক্ষণে হুশে আসছেন?’

‘তুই আগে বল কী বলছিস! নাজিরা সীমান্তকে ভালোবাসে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোকে কে বললো? কেমনে কী?’

সাইরাহ্ সামান্য হেঁসে বলে, ‘বলতে হবে না। যারা ভালোবাসে তাদের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। আপনার তো এগুলা ভালো বোঝার কথা কিন্তু আপনি বোঝেন নাই। তার মানে আপনার ভালোবাসায় ভেজাল আছে।’

সাহিত্য ভ্রু কুঁচকায়। তার ভালোবাসায় ভেজাল? এতো বড় কথা কী সহ্য করা যায়? অসম্ভব। তাই গম্ভীর ভাবে বলে, ‘তোর মনে হয় খুব অভিজ্ঞতা আছে।’

‘আছেই তো।’

সাহিত্য শীতল দৃষ্টিতে সাইরাহ্-র দিকে মাথা এগিয়ে নেয়। সাইরাহ্ চমকে পিছে সরতে গেলে সাহিত্য হাত চেপে ধরে। সাইরাহ্ দৃষ্টি এদিক ওদিক করে। সাহিত্য শুধায়,

‘ভালোবাসা কাকে বলে সাহেবা? বুঝিস?’

সাইরাহ্ জবাব দিতে পারে না। কোনো রকম চোখ মুখ খিঁচে বলে, ‘সবসময় নিজের চরিত্রে ঢুকে যান কেনো? এখন নাজিরার বিষয়ে ভাবেন। সীমান্ত ভাইয়ের সাথে কথা বলেন।’

সাহিত্য সরে যেতে যেতে বলে, ‘সীমান্ত এখন শহরে৷ মামাসাহেবের কাছে৷ আর দেখতে আসলেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। দেখতেছি কী করা যায়!’

সাইরাহ্ তাড়া দিয়ে বলে, ‘যা করবেন তাড়াতাড়ি করবেন।’

‘কিন্তু সীমান্ত তো নাজিরাকে ভালোবাসে না। ওর সাথে বিয়ে হলে নাজিরা সুখী হবে?’

সাইরাহ্ বিছানা থেকে উঠতে উঠতে অন্যমনষ্ক হয়ে বলে, ‘হবে। বিয়ের মধ্যে একটা রহমত থাকে। ভালোবাসাটা আপনাআপনি সৃষ্টি হয়ে যায়। সবার অধিকার আছে ভালো থাকার। অন্তত কেউ তো নিজের ভালোবাসাটা পাক। নাজিরারটা কেনো অপূর্ণ থাকবে?’

সাহিত্য বিড়বিড় করে বলে, ‘যেমন আমি পেয়েছি।’

এরপর জোড়ে বলে, ‘তোর মনে হয় আমার ঘুমটা সহ্য হয় না। একটু ঘুমাইছিলাম দিলি সুন্দর মতো উঠায়া।’

‘ভালো করছি।’

‘এরকম বউ থাকলে বেশিদিন আর জীবনে ঘুম থাকবে না। ভেগে যাবে।’

‘যাক, অন্ততপক্ষে বরের জীবন থেকে কিছু তো ভাগাতে পারবো।’

‘ভাগাতে চাইলে বরের আশে পাশের নারী ভাগা। নয়তো কবে দেখবি বরও ভেগে গেছে।’

সাইরাহ্ ভ্রু কুঁচকে, কপালে ভাজ ফেলে তাকায়। সাহিত্য নিষ্পাপ মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে৷ সাইরাহ্ একটা বালিশ ছুড়ে মারে। কটমট করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে,

‘অ’সভ্য লোক। সবগুলো পুরুষ মানুষ এক। শুধু বাইরের মেয়েদের দিকে নজর।’

সাহিত্য ঠোঁট কামড়ে হাসে৷ সাইরাহ্ দরজা পেরোতেই সাহিত্য জোড়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘তোর বর আলাদা সাহেবা। সে তোকে ছাড়া কাউকে দেখে না।’

তারপর হাসতে থাকে। বিছানায় আবার গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে, ‘তোকে ছাড়া কাউকে দেখার মধ্যে সুখ নেই সাহেবা। সবাই তো আর তুই না। আমার সাহেবা না।’


বেলী মন খারাপ কমাতে হাঁটতে হাঁটতে পছন্দের সেই বকুল ফুলের গাছের নিচে এসে দাঁড়ায়। গাছে না উঠে নিচেই গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ অন্যমনষ্ক হয়ে ভাবতে থাকে গতদিনের কথা। সকাল থেকে ছন্দও দুরে দুরে থাকছে। কারণটা বেলী বুঝতে পারে না। তার ভাবনার মাঝেই কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পায়৷ চমকে পেছনে তাকাতেই দেখে তারেক দাঁড়িয়ে আছে। বেলী দু পা পিছিয়ে যায়। তারেক দাঁত বের করে হেঁসে বলে,

‘একা একা দাঁড়ায়া আছো কেন বেলী? কি হইছে?’

বেলী চোখ পিটপিট করে। তারেককে তার খুব একটা পছন্দ না। তাকে দেখলেই কেমন ভাবে যেনো তাকিয়ে থাকে! তামজীদ আর তারেক দুই ভাই কিন্তু দুজনে সম্পূর্ণ আলাদা৷ বেলী পায়ের নখ দিয়ে মাটিতে খুড়তে থাকে৷ তারেক ফের শুধায়,

‘কথা কও না? খারাপ লাগতাছে? পানি খাইবা?’

বলেই খপ করে হাত ধরে ফেলে। বেলী আঁতকে উঠে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে, ‘না তারেক ভাই। আমি পানি খাবো না। হাত ছাড়েন।’

‘আর হাত ছাড়লে হবে? চলো পাশে যাই।’

তারেক বি’শ্রী ইঙ্গিত করে। বেলী ইঙ্গিত বুঝতে না পারলেও স্পর্শগুলো বুঝতে পারে। তার গা ঘিনঘিন করতে শুরু করে। জোড় করতে থাকে হাত ছাড়ানোর জন্য। তারেকও ছাড়ছে না। বরং আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। বেলী আতঙ্কিত কন্ঠে বলতে থাকে,

‘তারেক ভাই, হাত ছাড়েন। আমি কিন্তু আব্বা, বড় আব্বারে বলে দিবো। হাত ছাড়েন।’

তারেক বি’শ্রী বি’শ্রী কথা বলতে থাকে। বেলী প্রায় কেঁদেই ফেলবে ভাব। আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে আরো বেশি অসহায় মনে হয় তার৷ তারেক বেলীর হাত ধরে টানতে শুরু করলেই তামজীদ ছুটে আসে। বেলী তামজীদ-কে দেখেই কেঁদে ফেলে। তামজীদ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,

‘ওর হাত ছাড়।’

তারেক বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘আমারে কিন্তু একদম জ্ঞান দিবে না ভাই। যাও এইখান থেকে। ‘

‘তুই জাতের মানুষ হইলে অবশ্যই তোরে জ্ঞান দিতাম কিন্তু তুই তো অমানুষ। তোরে জ্ঞান না সোজা শিক্ষা দিবো।’

বলতে দেড়ি হলেও তারেকের নাকের ওপর ঘু’ষি পড়তে দেড়ি হয়নি। তারেক ছিটকে পড়ে মাটিতে। বেলী ছাড়া পেয়ে দ্রুত তামজীদের পিছে লুকায়। তামজীদ নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারেক মাটি থেকে ওঠার আগেই গিয়ে আরো দুটো লা’থি বসিয়ে দেয়। তারেক শব্দ করে হাসতে হাসতে বলে,

‘কী ভাই? দরদ লাগে? বুঝি না মনে করো!’

তামজীদ মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে। এক হাতে তারেকের কলার চেপে ধরে বলে, ‘বুঝিস তখন দুরে থাক। বেলীর দিকে হাত বাড়াইলে ওই হাত আমি দু টু’করো করে রেখে দিবো। সেই হাত যার-ই হোক না কেনো!’

তারেককে ছুড়ে ফেলে তামজীদ বেলীর কাছে আসে। শান্ত গলায় বলে, ‘ঠিক আছো?’

বেলী মাথা নাড়ায়। তামজীদ বেলীর হাত ধরেই উল্টো পথে হাঁটা লাগায়। যাওয়ার আগে তারেককে বলে যায়, ‘শুধু বেলী না, সব নারীই একেকটা বেলী। তাই নিজেকে শুধরে নে তারেক। আমার ভাই বলে কিন্তু আমি ছাড় দিবো না।’

তামজীদ আর বেলী চলে যায়। তারেক সেখানেই মাটিতে শুয়ে পড়ে। চোখ উল্টে তাকিয়ে থাকে তামজীদ আর বেলীর দিকে। একটু দুরে আসলেই বেলী তামজীদকে বলে,

‘নিজের ভাইকে মা’রতে আপনার খারাপ লাগে না, তামজীদ ভাই?’

তামজীদ মলিন হাসে৷ দৃষ্টি সামনে রেখে বলে, ‘লাগে না। আমার আব্বার লাই পেয়ে পেয়ে ‘ও’ আর মানুষ নাই। বড় ভাই হিসেবে যতটুকু শা’সন করার আমি করি কিন্তু মনে হয় না কাজে লাগে!’

বেলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তামজীদ বেলীকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। এবং পরবর্তীতে যেনো একা বের না হয় সে বিষয়ে কড়া আদেশ দেয়। বেলী জানে এই আদেশ তার ভালোর জন্য। তাই চুপচাপ মেনে নেয়। বেলী বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলে তামজীদ বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারেকের অসভ্যতামো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। যেমন নেশা করে পড়ে থাকে তেমন মেয়েদেরকে বিরক্ত করে। তালেব উদ্দীনের সব কাজ তারেক দেখে এটা তামজীদ জানে। তারেকের সব অ’নৈতিক কাজে তার বাবা-ই তাকে সাপোর্ট করে৷ তামজীদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এবার এ ব্যাপারে কিছু একটা করতে হবে। নয়তো কোনো অঘটন ঘটে গেলে বিরাট বড় ঝামেলা হবে।


লুবনা সাহিত্যদের গ্রামেই ছিলো। তারেক সন্ধ্যার একটু আগে আগে লুবনাকে নিচে আসতে বলে। জানালা দিয়ে একটা চিরকুট ছুড়ে মারে। লুবনা সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে খুব সাবধানে নিচে যায়। বাড়ির পাশের সেই বাগানে দাঁড়াতেই তারেক লুবনাকে জড়িয়ে ধরে৷ লুবনাও বাঁধা দেয় না। তারেক বলে,

‘সাহিত্যরে বিয়ার আশা তো গেছে। এবার কি করবা?’

লুবনা হতাশ শ্বাস ফেলে বলে, ‘যা হইছে ভালো হইছে। এবার চলো আমরা বিয়ে করে নিই। আমার বাড়িতে তোমার আব্বারে পাঠাও।’

তারেক মনে মনে গালি দেয়। তবে মুখে হাসি ধরে রেখে লুবনার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে বলে, ‘আচ্ছা পাঠাবো।’

লুবনা তারেককে সরিয়ে দেয়। তারেক আবারও চেষ্টা করলে লুবনা আবারও সরিয়ে দেয়। বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘তারেক বিয়ের আগে আমার এসব পছন্দ না। ক’দিন পর বিয়ে হলে তো আমি তোমারই। তখন যা ইচ্ছে করো, এখন না। দুরে যাও।’

এমনিতেই বেলীর ব্যাপারটা নিয়ে তারেকের মাথা গরম ছিলো। তাই লুবনার প্রতিক্রিয়ায় সে আরো ক্ষেপে যায়। লুবনার চুলের মুঠি চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে যা তা ভাষায় গালি দেয়। লুবনার কান ঝা ঝা করে ওঠে। কোনো রকমে বলে,

‘তারেক, কী করতেছো এসব?’

তারেক হিংস্র বাঘ হয়ে যায়। লুবনার চুল ছেড়ে শক্ত করে হাত চেপে ধরে। লুবনা চিৎকার করতে গেলে চেপে ধরে মুখ শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরে। টেনে গাছের আড়ালে নিয়ে যায়। লুবনা বার বার ছুটতে চেষ্টা করে। তারেকের শক্তির সাথে পেরে ওঠে না। তারেক ততক্ষণে নিজের মধ্যে নাই। এক টানে লুবনার জামার অংশ ছিড়তে থাকে৷ লুবনা আটকানোর চেষ্টা করে। লুবনার জামার অংশই লুবনার মুখে পুড়ে দেয়। লুবনা ছটফট করতে শুরু করে৷ তারেক লুবনার সালোয়ারের নিচের অংশ ছিড়তেই লুবনা তারেকের বুক বরাবর লা’থি দেয়। তারেক ছিটকে পড়ে। লুবনা দ্রুত মুখ থেকে কাপড় বের করে পালাতে গেলে তারেক আবার ধরে ফেলে। লুবনা ধস্তাধস্তিতে এক সময় তারেকের গোপন অ*ঙ্গে লা’থি বসিয়ে দেয়। তারেক গগনবিদারী চিৎকার দেয়। সেই সুযোগে লুবনা পালিয়ে যায়। সাহিত্য তখন কেবল বাড়ির মধ্যে ঢুকছে৷ লুবনা যত জোড়ে সম্ভব ছুটে এসে সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরে। সাহিত্য হকচকিয়ে যায়। লুবনার এরকম অবস্থা দেখে ব্যস্ত গলায় বলে,

‘কী হইছে লুবনা? তোর এই অবস্থা কেন?’

লুবনা কথা বলতে পারে না কান্নার চোটে। সাহিত্য দ্রুত উঠানে শুকাতে দেওয়া একটা শাড়ি এনে লুবনার শরীরে পেঁচিয়ে দেয়। লুবনা কোনোরকমে বলে, ‘সাহিত্য ভাই, তারেক!’

তারেকের নাম শুনেই মাথায় রক্ত উঠে যায় সাহিত্যের। লুবনাকে ধরে বাড়ির মাঝে ঢোকাতে গেলেই লুবনার মা বাহিরে চলে আসে। লুবনার এই বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে হায় হায় করে ওঠে। সাহিত্য মহিলার দিকে বিরক্তির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লুবনাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে গেলে লুবনা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে। সাহিত্য বাধ্য হয়ে লুবনাকে কোলে তুলে নেয়। বাড়ির ভেতর ঢুকে জোড় গলায় নাজিরাকে ডাকে। সাহিত্যের ডাকে সবাই বেড়িয়ে আসে। সাইরাহ্ সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে দেখে লুবনা সাহিত্যের কোলে। সে আর এগোয় না। সিঁড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। বারান্দায় রাখা চৌকির ওপর লুবনাকে শুইয়ে দেয় সাহিত্য। নাজিরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘জলদি পানি আন।’

সুফিয়াও ছুটে আসে৷ ওদিকে লুবনার মা-ও ছুটে আসে। মেয়ের পাশে বসে বিলাপ করতে থাকে৷ তার কান্না থেকে একটাই কথা বুঝা যায় যে তার মেয়ের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এবং সে বার বার সাহিত্যের দিকেই তাকায়। নাজিরা লুবনার চোখে মুখে পানি ছিটাতে গেলে সুফিয়া ভাঙা স্বরে বলে,

‘সাহিত্য, তুই!’

সাহিত্য চোখ মুখ কুঁচকায়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি কী আম্মা?’

সুফিয়া ধপ করে বসে পড়ে। সাহিত্য বোঝে না সে কী করেছে! তবে মা আর ফুপির কথায় বুঝে যায় সম্পূর্ণ দোষটা তার ওপরই আসতে চলেছে। সে লুবনার থেকে দুরে ছিটকে গিয়ে বলে,

‘পাগল নাকি? আম্মা, আপনি আমারে এই চিনছেন! আমি এতো নিচু কাজ করবো? মানুষরে সাহায্য করলেও এখন বিপদে পড়া লাগে। আজব দুনিয়া!’

সাহিত্য উঠে সাইরাহ্-র কাছে যায়। সাইরাহ্ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সাহিত্য থমকে দাঁড়ায়। নিজ পক্ষে কিছু বলতে গেলেই গ্রামের প্রধান সদস্য আর কিছু গ্রামের মানুষ হৈ হৈ করতে করতে বাড়িতে ঢুকে পড়ে।

চলবে..

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___

২৪.
বাড়ির ভেতর এক কথায় হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে৷ লুবনার মা আর নাজিরা লুবনাকে আগলে বসে আছে। বাড়ির পুরুষরা তখন একে একে ফিরেছে। সাহিত্য ভ্রু কুঁচকে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। তালিব উদ্দীন গম্ভীর গলায় বলে,

‘আমরা সব হুইনাই আইছি। এরহম কলঙ্কিত মাইয়া আমরা গেরামে রাখমু না।’

সাহিত্য ফট করে বলে দেয়, ‘তা আপনাদের গ্রামে থাকছে কে? লুবনা এই গ্রামের না ভুলে গেছেন?’

‘সাহিত্য, তুমি কিন্তু আমাগো অপমান করবা না।’

সাহিত্য অবাক হওয়ার ভান করে বলে, ‘আমি কখন অপমান করলাম কাকা? আমি তো শুধু সত্যিটা আপনাকে মনে করিয়ে দিলাম। এখন দেখি সত্যি কথা বললেও বিপদ। চারদিকে শুধু বিপদ আর বিপদ।’

সাহিত্যের কন্ঠে আফসোস। সবাই ঢের বুঝতে পারে যে সাহিত্য মজা নিচ্ছে। সাহিত্যের বাবা গম্ভীর গলায় শুধান, ‘আপনারা ঠিক কেনো এসেছেন তা যদি স্পষ্ট করে বলেন তাহলে ভালো হয়। আর আমাদের ঘরের মেয়ের খবর আমরাই পেলাম না, আপনারা কিভাবে পেলেন?’

রমিজ মোল্লা মুখ বাকিয়ে বলেন, ‘এগুলা কথা বেশি চাইপা থাকে না মিয়া।’

এর মধ্যেই লুবনার জ্ঞান ফিরে আসে। কয়েক মিনিটের জন্য তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। যখন মনে পড়ে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা তখনই আঁতকে ওঠে। মা’কে মাথার কাছে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। প্রধান সদস্য আনসার আলী আফসোসের সুরে বলেন,

‘আহারে! ফুলের মতো মাইয়াডার কি হইয়া গেলো!’

সাহিত্য সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘অনেক আফসোস লাগতেছে কাকা?’

‘হ, লাগতাছেই তো।’

‘কিন্তু আমার তো সবই নাটক মনে হচ্ছে। নাহলে এমনে দলবল নিয়ে আসতেন!’

আনসার আলী হুংকার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সাহিত্য পাত্তা-ই দেয় না। শেখর সাহেব ধমকে বলেন, ‘সাহিত্য!’

সাহিত্য বাবার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাজিরার দিকে তাকায়। গম্ভীর ভাবে আদেশ দেয়, ‘লুবনার কাপড় পাল্টে আন আগে। যা!’

নাজিরা মাথা নাড়িয়ে উঠতে গেলেই তালিব উদ্দীন, রমিজ মোল্লা আর আনসার আলী হৈ হৈ করে ওঠেন। লুবনা, নাজিরা ভয় পেয়ে যায়। শেখর সাহেব সবাইকে থামিয়ে বলেন, ‘কি হয়েছে?’

রমিজ মোল্লা বলেন, ‘আপনেরা তো পেরমাণ ন’ষ্ট করতে পারবেন না মশাই। এই মাইয়ার লগে যা হইছে তা তো আপনেরা অস্বীকার করবেন।’

সাহিত্য খুবই ঠান্ডা গলায় বলে, ‘দেখেন কাকা, এসব বিষয় নিয়ে কী করতে চাইতেছেন খুব ভালোমতো বুঝতেছি। কিন্তু এটা একটা নারীর নাজুক বিষয় তাই ওরে আগে যাইতে দেন। তারপর যা মন চায় বইলেন। নাজিরা, ফুপি ওরে নিয়ে যান।’

নাজিরা আর লুবনার মা তাকে নিয়ে যায়। তালিব উদ্দীন বেশ ঠেস দিয়েই বলে, ‘এতোই যহন মাইয়াগো ব্যাপার বুঝো তাইলে এমন একটা কাম করলা ক্যান?’

‘আমি কী করছি?’

সাহিত্যের কপালে ভাজ পড়ে। তালিব উদ্দীন আর রমিজ মোল্লা একে অন্যের দিকে তাকায়। চোখে চোখে বেশ অনেক কথা আদান প্রদান হয়ে যায়। তাদের হাব ভাবে বোঝা যায় তারা ভাবছেন ‘এবার পেয়েছি সাহিত্যকে হাতে। মজা দেখাবো।’ কিন্তু তারাও তো জানেন না সাহিত্যকে কাবু করা এতো সহজ না। তালিব উদ্দীন গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘তোমারে আর ওই মাইয়ারে এক লগে দেখছে এক পোলা। হেয় দেইখা যাইয়াই তো আমাগো খবর দিছে।’

‘তা কে দেখছে আমিও তার চাঁদ মুখখানা একটু দেখি। দেখান তো কাকা!’

‘সে কী আর সামনে আইবো? তুমি কেমন পোলা হেয় জানে। নিজের জানের ভয় হক্কলেরই আছে।’

‘কাকা শোনেন! আমি কী, কেমন এইটা আপনারাও ভালোই জানেন। আমি কিছু করিনি।’

তালিব উদ্দীন ধমকে উঠে বলে, ‘বেয়াদব পোলা! একে তো অন্যায় করছো আবার বড় বড় কথা কইতাছো!’

সাহিত্য শব্দ করে হেঁসে দেয়। প্রধান সদস্যরা হকচকিয়ে যায়। এরকম একটা পরিস্থিতিতে কেউ হাসতে পারে? সাহিত্য সিঁড়ির ওপর বসতে বসতে বলে, ‘কাকা, যখন সত্যিটা জানবেন তখন আপনি মুখ লুকানোর জায়গা পাবেন না। আমি তো সৎ, আমার মধ্যে কোনো ভেজাল নাই। তাই আমার মাথাও উঁচু আর গলার জোড়ও। আপনার কতক্ষণ থাকে এটাই দেখার ব্যাপার।’

তালিব উদ্দীন ক্ষেপে গিয়ে যা তা বলতে থাকে৷ শেখর সাহেব সাহিত্যকে চুপ থাকতে বলেন। লুবনার পোশাক পাল্টে তাকে আবার আনা হয়। লুবনা জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। রমিজ মোল্লা নাক সিটকে বলেন,

‘এই মাইয়ার মুখ দেখলেও আমাগো অমঙ্গল হইবো। জলদি এরে চুনকালি মাখাইয়া দুর করো৷ এসব ন*ষ্টা মাইয়ারে গেরামে রাখন যাইবো না।’

সাহিত্যর শান্ত মুখটা শক্ত হয়ে যায়। বসা থেকে উঠে এগোতে গেলে শেখর সাহেব মানা করেন। তবে সাহিত্য সে মানা শোনে না। রেগে গেলে সাহিত্যের কন্ঠ বরাবরের মতো শীতল হয়ে যায়। এবারও ব্যাতিক্রম হলো না। পুরো বাড়ি কাঁপিয়ে বলে,

‘বিধবার মুখ দেখলে অমঙ্গল হয়, একটা মেয়ের ওপর জোরজবরদস্তি করা হয়েছে তার মুখ দেখলেও আপনাদের অমঙ্গল হয়! তাহলে কী দেখলে আপনাদের মঙ্গল হয় কাকা? আপনাদের মুখের একটাই বুলি ‘অমঙ্গল’। যে নারীর পেট থেকে আপনাদের জন্ম তারাই যদি অমঙ্গল হয় তাহলে আপনারা কী? অমঙ্গলের কারণ ওরা না। আপনারা স্বয়ং।’

‘সাহিত্য!’

তালিব উদ্দীনের ধমকে লাল টকটকে চোখ নিয়ে তার দিকে তাকায় সাহিত্য। শেখর সাহেব বলে, ‘চুপ করো সাহিত্য।’

‘না, আব্বা। আজ আমি বলবোই। এরা আজীবন অমঙ্গলের নাম নিয়ে মানুষের সাথে অন্যায় করবে এটা হতে দেবো না আর।’

‘তুমি আমাগো চোখ দেখাইতাছো?’

‘চোখ দেখাবো কেন? সত্যি কথা বলতেছি। আর একটা কথা স্পষ্ট শোনেন, লুবনার সাথে সেরকম কিছুই হয়নি যেগুলো আপনারা ভাবতেছেন। ওর ওপর শুধু হামলা হইছিলো।’

রমিজ মোল্লা চট করে প্রশ্ন করে, ‘আর তুমি এইডা কেমনে জানলা? অবশ্য জানবাই তো। তুমিই তো সব করছো।’

সাহিত্য ঘাড় বাকিয়ে তার দিকে তাকায়। বাঁকা হেঁসে বলে, ‘আমি শেষ বারের মতো একটা কথা বলতেছি কাকা! কান খুলে শোনেন। আমি কিছুই করিনি। আর যা করিনি তার দায় আমাকে দিলে আমি কখনোই নিবো না।’

আনসার আলী বলে, ‘না নিলা। তাইলে কথা বাদ দিয়া মাইয়ার মুখে চুনকালি লাগাইতে দাও। এরপর ওরে বিদায় করা লাগবো।’

লুবনা শক্ত করে মায়ের হাত ধরে। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ‘না।’ লুবনার মা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নাজিরাও অসহায় চোখে তাকায়। সাহিত্য ফের বলে,

‘অন্যায় তো ‘ও’ করেনি তাহলে ‘ও’ কেনো শা’স্তি পাবে?’

‘তুমি ওরে চুনকালি মাখাইতে দিবা না?’

তালিব উদ্দীনের কথায় সাহিত্য সরাসরি বলে দেয়, ‘না।’ তালিব উদ্দীন ফের বলে, ‘বুইঝা শুইনা কইতাছো?’

‘আপনার কী মনে হয় আমি মজা করতেছি কাকা?’

‘তাহলে ওই মাইয়ারে তোমার বিয়া করা লাগবো।’

পুরো বাড়িতে একটা বোম ফাটার মতো অবস্থা হয়। পেছনের গ্রামবাসীরাও তাতেই তাল দেয়। লুবনার মা-ও সাহিত্যকে অনুরোধ করে বিয়ের জন্য। সাহিত্য ছিটকে পিছে গিয়ে বলে,

‘আরে পাগল নাকি! আমার বউ থাকতে আমি কোন দুঃখে আবার বিয়ে করতে যাবো? আমার বিয়ের এখনও ৬ মাসও হয়নি, আমি আবার বিয়ে করবো কেন?’

কেউ কোনো কথা মানে না। হয় লুবনার মুখে চুনকালি মাখিয়ে চুল ন্যাড়া করে পুরো গ্রামে ঘোড়ানো হবে নয়তো সাহিত্যের বিয়ে করতে হবে৷ সাহিত্য দুটোর কোনোটাই করতে পারবে না। বাড়িতে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। সাহিত্য কিছুতেই লুবনাকে বিয়ে করবে না। লুবনার শা’স্তিও ধীরে ধীরে বাড়াচ্ছিলো প্রধানের সদস্যরা। সাহিত্য যেনো অথৈ জলে পড়েছে। লুবনাকেও বাঁচানো দরকার কিন্তু সাইরাহ্-কেও সে আবার দুঃখের মুখে ফেলতে পারবে না। নিজের সিদ্ধান্তে সে অটল থাকে। দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেও সাহিত্য ২য় বারের মতো বিয়ে করবে না। তালিব উদ্দীন আচমকা সাহিত্যের হাত ধরে বাড়ির বাইরে টেনে নিয়ে যেতে গেলেই সাইরাহ্ সাহিত্যের হাত ধরে। সাহিত্য চমকে পিছে তাকায়। সবাই থেমে যায়। সাইরাহ্ তালিব উদ্দীনের থেকে সাহিত্যের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

‘আমার স্বামীকে ২য় বিয়ে করাতে নিয়ে যাচ্ছেন! আমার অনুমতি নিয়েছেন কাকা?’

তালিব উদ্দীন ক্ষ্যাপা গলায় বলে, ‘এহন তোর থেইকা অনুমতি নেওন লাগবো?’

‘অবশ্যই নিতে হবে। স্বামীকে ২য় বিয়ে করাতে হলে ১ম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়। জানেন না?’

‘তো এহন কি করমু?’

‘আমার অনুমতি নিবেন।’

‘তোর মতো অ’লক্ষী মাইয়ার থেইকা অনুমতি নিমু? এতো খারাপ দিন আমাগো আসে নাই।’

সাইরাহ্ হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে, ‘আচ্ছা, নিয়েন না। অবশ্য আপনি নিলেও আমি আমার স্বামীকে ২য় বিয়ে করার অনুমতি দিবো না।’

পেছন থেকে সুফিয়া ধমকে ওঠে, ‘বড়গো মইধ্যে তুমি কথা কইতাছো ক্যান?’

‘আমার বলতে হবে বলেই বলতেছি আম্মা। আমার বিষয়ে কিছু হলে তো আমি চুপ-ই থাকি। কিন্তু এইটা আমার ব্যাপার না। এইটা অন্য কিছু না! আমার স্বামী, আমার সোহাগের ব্যাপারে কথা হইতেছে। কেউ আসলো, চাইলো আর আমি ভাগ করে নিলাম! এটা হয়? আপনি দিবেন আপনার স্বামীরে ২য় বিয়ের অনুমতি? আম্মা, নারীর সবথেকে নাজুক জায়গা হয় তার স্বামী আবার শক্ত জায়গাও হয় তার স্বামী। আর দুনিয়া যায় বলুক, আমি জানি আমার স্বামী নির্দোষ। তার মনে পাপ নাই। তাই এই শা’স্তি তারে পাইতে দেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

সুফিয়া রাগী চোখে চেয়ে থাকে৷ সাইরাহ্ সে দৃষ্টিকে আমলে নেয় না। লুবনা, নাজিরা, বড় ভাবী, ছোট ভাবী সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সাইরাহ্ এভাবে এসে প্রতিবাদ করবে তা কেউ ভাবেইনি। সাহিত্য নিজেও স্তব্ধ হয়ে গেছে। সাইরাহ্-র মুখের কথাগুলো তার কানে বাজতেছে। আপনাআপনি তার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে,

‘সাহেবা!’

সাইরাহ্ সবাইকে উপেক্ষা করে আবার তালিব উদ্দীনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সব ব্যাপারে, সব সময় কেনো নারীদেরই দোষীর তালিকায় ফেলা হবে কাকা? কেনো বার বার তাদেরই শা’স্তি দেয়া হবে? এখানে দোষটা তো লুবনার না। দোষ তো তার যে লুবনার সম্মানে হাত দিয়েছে। শা’স্তি হলে তার হবে, নির্দোষের কেনো?’

তালিব উদ্দীন ধমকে উঠে বলে, ‘তুই এহন আমাগোরে এগ্লা শিখাবি?’

বলেই সাইরাহ্-র দিকে এগোতে গেলে সাহিত্য সাইরাহ্-কে সরিয়ে দেয়। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ‘একদম না’। সাইরাহ্ লুবনার দিকে এগিয়ে যায়। কন্ঠস্বর শক্ত রেখেই বলে,

‘আমি জানি না তুমি সত্যিটা বলবে নাকি মিথ্যাটা! কিন্তু পুরো দুনিয়া এসে বললেও আমি বিশ্বাস করবো না সাহিত্য ভাই এরকম জঘন্য একটা কাজ করতে পারে! তোমার সম্মানের জন্য উনি তোমার জন্য লড়েছে, এবার তোমার নিজের পালা নিজের জন্য লড়াই করা। তুমি নারী, তুমি নিজের জন্য নিজে না লড়লে কেউ তোমার জন্য লড়বে না। আজ সাহিত্য ভাই আছে, কাল থাকবে না। নিজেকে নিজে বাঁচাও। তোমার সম্মানে যে হাত দিয়েছে তার হাত ভেঙে দাও। পরে কী হবে দেখা যাবে!’

রমিজ মোল্লা জোড় গলায় বলে, ‘তুমি ওরে উস্কাইতাছো! লাভ হইবো না।’

লুবনা নিজ থেকে সাইরাহ্-র হাত ধরে শক্ত করে। সাইরাহ্ চমকে তাকায়। লুবনা কাঠকাঠ গলায় বলে, ‘আমার সাথে তারেকের সম্পর্ক ছিলো বেশ অনেকদিন থেকে। আজকে ‘ও’ আমাকে ডেকেছিলো। আমি ভেবেছিলাম সাধারণ কথা বলবে কিন্তু!’

লুবনা ঢোক গিলে। তালিব উদ্দীন হৈ হৈ করে লুবনাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে থাকে। গ্রামের মানুষ আপোষে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে। রমিজ মোল্লা আর আনসার আলীও বোঝে এইটা তারেকের কাজ। তারা তারেককেও চেনে আর সাহিত্যকেও৷ সাহিত্য তালিব উদ্দীনকে থামিয়ে বলে,

‘এখনো শেষ হয় নাই কাকা। আর চিল্লাইলেই সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে না।’

লুবনা আবার বলতে শুরু করে, ‘চোখের সামনে জা’নো’য়া’রটা আমার সাথে জোরজবরদস্তি করা শুরু করে। আমি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ‘ও’ আমাকে ছাড়তে চায় না। শেষে আমি ওকে মে’রে পালিয়ে আসি। আর বাড়ির দরজায় এসেই আমার সাহিত্য ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। আমার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে তিনি আমাকে সাহায্য করে। সাহিত্য ভাইয়ের কোনো দোষ নাই। অযথা উনারে এগুলার মধ্যে টানবেন না।’

পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। লুবনা ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে৷ সাইরাহ্ পাশে বসে আগলে নেয়। সান্ত্বনা দেয়। লুবনা চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ সাহিত্য তালিব উদ্দীনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘আগে নিজের ছেলেরে মানুষ বানান তারপর অন্যদের দোষ ধরতে আসবেন। কোথায় আপনার গুণধর ছেলে? চুনকালি কারে মাখাবেন এবার? কার সাথে বিয়ে দিবেন?’

তার কথার মাঝেই কয়েকজন তারেককে ধরে আনে৷ সাথে তামজীদও ছিলো। তারেককে সরাসরি সাহিত্যের সামনে এনে বলে, ‘ভাই, ওর গলা কা’ইটা নিমু নাকি কন!’

তালিব উদ্দীন চমকে ওঠে৷ ছেলেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, ‘না না। আমার পোলারে মা’ইরো না। ছাড়ো।’

তামজীদ এগিয়ে এসে তালিবের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘তারেক যা করছে তাতে ওর শা’স্তি পাওয়া দরকার আছে। ছাড়েন আব্বা!’

‘তারেক তোর ভাই লাগে তামজীদ। তুই ওরে মা’রতে কস!’

সাহিত্য ঠেস দিয়ে বলে, ‘অন্যরে চুনকালি মাখাইতে ভাল্লাগে আর নিজের ছেলের বেলা! বুকে লাগে কাকা?’

তালিব উদ্দীন ভ’য়ং’কর দৃষ্টিতে তাকায়। সাহিত্য পাত্তা দেয় না। গ্রামের মানুষ তারেককে শা’স্তি দেওয়ার কথা বললে তালিব উদ্দীন সবাইকে থামিয়ে দেয়। ব্যস্ত ভাবে বলে,

‘আমার পোলা তো দোষ করছে আমি জানি। কিন্তু সাহিত্যের বেলা যেমন সবাই বিয়ার সুযোগ দিছিলো আমার পোলারেও দেওয়া উচিত। লুবনারে আমি তারেকের বউ বানায়া নিয়া যামু। আমাগো আপত্তি নাই। তারেক তোর আপত্তি আছে?’

তারেক মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘না।’ গ্রামের মানুষ ভাবে ‘ঠিক আছে’। সাহিত্য আর তামজীদ একে অপরের দিকে তাকায়। বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করলে সাইরাহ্ কিছু বলতে চায়। কিন্তু তার বলার আগেই লুবনা বলে ওঠে,

‘তারেকের আপত্তি না থাকলেও আমার আছে। একটা নারীর সবথেকে দামী জিনিস হয় তার ইজ্জত, তার সম্মান। আর যেই পুরুষ আমার ইজ্জতে হাত দিয়েছে, আমার সম্মান ন’ষ্ট করতে চেয়েছে সেই পুরুষকে বিয়ে করার চেয়ে আমি ম’রে যাওয়া ভালো মনে করবো। মামাসাহেব, আপনি আমার পিতার মতো। আমার ব্যাপারে এ ধরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাকে মে’রে নদীতে ভাসিয়ে দেন।’

সাইরাহ্ স্বস্তির শ্বাস ফেলে। কোনো কিছু না ভেবেই লুবনাকে জড়িয়ে ধরে। নারীর কিছুই নেই তবে তার থাকতে হয় সম্মান, আত্মসম্মান, জেদ। নিচু স্বরে বলে,

‘নিজের আত্মসম্মানরে ছোট হইতে দিবা না লুবনা। তারেক তোমার যোগ্য না।’

শেখর সাহেব লুবনার কথার ওপরই সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তারেকের সাথে বিয়েটা নাকোচ করে দেন। বিপরীতে তারেকের শা’স্তি হিসেবে চুল কেটে ন্যাড়া করে, চুনকালি মাখিয়ে পুরো গ্রামে ঘোরানো হবে। আর সাথে ৫০ টা বেতের বা’রি। তালিব উদ্দীন না মানলেও তাকে মানাতে বাধ্য করা হয়। রমিজ মোল্লা আর আনসার আলী আবহাওয়া গরম দেখে নিজেরাও শা’স্তির পক্ষে যায়। সাইরাহ্ প্রশান্তির হাসি হাসে। বিড়বিড় করে আওড়ায়,

‘নিজের পক্ষ আমি কোনোদিন নিতে পারিনি, অন্তত কোনো নারী নিজেকে প্রমাণ করুক। নারী শুধু হাতের পুতুল না। তারা মানুষ এবং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ। তারা পারে নিজের জন্য লড়তে।’

ধীরে ধীরে বাড়ি ফাঁকা হয়। কাল দিনের বেলায় শা’স্তি মঞ্জুর করা হবে৷ ততক্ষণ তাকে বেঁধে রাখা হবে। সবাই চলে গেলে লুবনা সাইরাহ্-কে জড়িয়ে ধরে ‘ধন্যবাদ’ দেয়। সাইরাহ্ হাসে৷ লুবনার মা আর নাজিরা লুবনাকে আবার ঘরে নিয়ে যায়। সাইরাহ্ বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে নিজেদের ঘরে যায়। সাহিত্য তামজীদকে বিদায় দিয়ে নিজেও ঘরে যায়। সাইরাহ্-কে বিছানায় বসে থাকতে দেখে গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘আজ মনে সূর্য অন্যদিকে ডুবেছে।’

সাইরাহ্ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘মানে?’

‘তোর মুখে বুলি ফুটলো কেমনে আজ? এতোদিন তো ঠিকই মুখে আটা লাগিয়ে রাখতি।’

সাইরাহ্ হেঁসে খোঁচা মে’রে বলে, ‘কারণ আমি আপনাকে চিনি। আপনার অতো ক্ষমতা আছে নাকি যে বাইরে গিয়ে আরেকটা মেয়ের ওপর ঢলে পড়বেন! তাছাড়া কোনো মেয়ে তো আপনাকে দেখবেও না। আর এগুলো তো অনেক দুরের ব্যাপার।’

‘কি বললি তুই? আমার দিকে কেউ দেখবে না?’

‘একদমই না।’

সাহিত্য সাইরাহ্-কে নিজের দিকে ফিরিয়ে জাপ্টে ধরে। সাইরাহ্ খিলখিল করে হেঁসে ওঠে। সাহিত্য দু হাতে শক্ত করে ধরে সাইরাহ্-র একটা হাত পিছে নিয়ে মুড়িয়ে ধরে। সাইরাহ্ হাসতে হাসতেই বলে,

‘ব্যাথা পাচ্ছি, সাহিত্য ভাই। ছাড়েন!’

‘কেউ দেখবে না যখন তুই দেখিস কেনো?’

‘আমি তো বাধ্য হয়ে দেখি। বিয়ে হয়ে গেছে না! আহারে।’

সাহিত্য নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে যায়। নিচু স্বরে বলে, ‘বাধ্য হয়ে আছিস?’

সাইরাহ্ হকচকিয়ে যায়। এতক্ষণ মজায় মজায় বুঝতে না পারলেও এখন অনুভব করতে পারে সাহিত্য তার কত কাছে! ফাঁকা ঢোক গিলে মাথা পিছিয়ে নিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, ‘দুরে যান।’

সাহিত্য যায় না। এক হাতে ভালো করে পেঁচিয়ে নিয়ে অন্য হাতে সাইরাহ্ মাথার পেছনে চেপে ধরে এগিয়ে আনে। সাইরাহ্-র হৃদপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়৷ বার বার ঢোক গিলে। সাহিত্য ফের শুধায়,

‘বাধ্য হয়ে আছিস?’

সাইরাহ্ ঘন ঘন দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ‘সে বাধ্য হয়ে থাকছে না।’ সাহিত্য ঠোঁট কামড়ে হেঁসে বলে, ‘তাহলে ভালোবাসিস?’

সাইরাহ্ থমকে যায়। এই প্রশ্নের উত্তর তার কাছে নেই৷ নিজের হৃদপিন্ডের গতির শব্দ সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। সাহিত্য মুখ আরেকটু এগিয়ে নিতে গেলে সাইরাহ্ চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। সাহিত্য নিঃশব্দে হেঁসে মুখ এগিয়ে নেয় সাইরাহ্-র কানের কাছে। ফিসফিসিয়ে বলে,

‘সাহেবা, প্রেমে পড়েছিস!’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)