#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____
২৫.
পরেরদিন সকাল বেলাতেই গ্রামের সব মানুষকে এক জায়গায় জড়ো করে তারেককে ন্যাড়া করে চুনকালি মাখিয়ে পুরো গ্রামে ঘোরানো হয়। তালিব উদ্দীন এই অপমান সহ্য করতে পারছে না। তাতে অবশ্য সাহিত্য বেশ মজা নিচ্ছে। তারেকের শা’স্তি চলাকালীনই প্রধান গ্রামে হাজির হয়। তারেকের এই অবস্থা দেখে তিনি হতবাক। আ’ঘাত পাওয়া অবস্থাতেও এগিয়ে এসে সবাইকে থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,
‘কিসের শা’স্তি দিতাছো ওরে? থামো!’
সাহিত্য এগিয়ে আসে৷ দাঁত বের করে হেঁসে বলে, ‘মামাসাহেব, কেউ থামবে না। ‘ও’ লুবনার সাথে অ’ন্যায় করতে চেয়েছিলো যার শা’স্তি হিসেবে ওকে ন্যাড়া করে, চুনকালি লাগিয়ে পুরো গ্রাম ঘোরানো হবে এবং ৫০ টা বেতের বা’রি দেওয়া হবে।’
প্রধানকে দেখেই তালিব উদ্দীন দৌড়ে আসে৷ কাঁদো কাঁদো মুখ করে তারেককে ছেড়ে দিতে বলে। প্রধান গম্ভীর ভাবে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে সাহিত্যকে বলে,
‘গেরামের প্রধান কী তুমি নাকি আমি? আমার অনুপস্থিতিতে তোমরা ওরে শা’স্তি দেওয়ার ক্যাডা?’
‘আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে মানবতা আছে, যেইটা আপনার মধ্যে নাই। অ’ন্যায় করলে শা’স্তি দেওয়ার অধিকারও আমাদের আছে।’
প্রধান কেবলই সাহিত্যকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রমিজ মোল্লা আর আনসার আলী তাকে টেনে ধরে৷ সামান্য দুরে নিয়ে গিয়ে কানে কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে৷ প্রধান সাহিত্যের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধু বলে,
‘কামডা ভালা করো নাই। এইডা আমি পরে দেইখা নিমু।’
সাহিত্য পাত্তা-ই দেয় না। তালিব উদ্দীন প্রধানের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে যায়। প্রধানকে বার বার বলে তারেককে বাঁচাতে। কিন্তু প্রধান তাকে শুধু শান্ত হতে বলে। এতে তালিব উদ্দীন শান্ত হওয়ার বদলে আরো ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সাহিত্য বাঁকা হাসে৷ তামজীদ তার কাছে এসে শীতল গলায় বলে,
‘এগুলো এতো সহজে শেষ হবে সাহিত্য?’
‘না। এতো সহজে বা এতো দ্রুত কিছুই শেষ হবে না। এরা আরো হিংস্র হবে। আর আমাদের তার আগেই প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।’
তামজীদ আর সাহিত্য একে অপরের দিকে তাকায়। দৃষ্টি বিনিময়েই কথা আদান-প্রদান হয়ে যায়। দুজনেই নিঃশব্দে হাসে। তামজীদ যায় তারেকের শা’স্তি দেখতে আর সাহিত্য যায় বাড়ির দিকে। তামজীদ তারেককে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে ভাবতেই পারে না তার আপন ভাই এমন। এতো চেষ্টা করেও সে কোনোভাবেই পারেনি তাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে। তামজীদের ভাবনার মাঝেই চোখ পড়ে খানিকটা দুরে গাছের পিছে। সেখানে বেলী লুকিয়ে আছে। তামজীদ ঘাড় ফিরিয়ে একবার পিছে তাকিয়ে ব্যস্ত পায়ে ছোটে বেলীর কাছে। তামজীদকে তার কাছে আসতে দেখেও বেলী ভয় পায় না। সে জানে এই পুরুষটি তার জন্য নিরাপদ। তামজীদ বেলীর কাছে এসে কোনো কথা না বলেই আগে হাত টেনে সরিয়ে আনে দুরে। বেলী থেমে গিয়ে বলে,
‘এভাবে টানছেন কেনো তামজীদ ভাই? আমি তো ওখানে দাঁড়িয়ে তারেক ভাইয়ের মা’র গুলো দেখছিলাম। ক’টা ঘা আমাকেও দিতে দেন।’
তামজীদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোমার বড় আব্বা যদি জানে তুমি এখানে তাহলে তোমার পিঠে ক’টা ঘা পড়ে যাবে। জলদি বাড়ি যাও।’
‘না যাবো না।’
‘কেনো যাবে না?’
‘আমার ইচ্ছা।’
‘এটা কেমন জেদ, বেলী?’
‘যেমন আপনি।’
তামজীদ অবাক হয়। বেলীকে আজ তার অন্যরকম লাগে। বেলী তার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসছে৷ অথচ বেলী সহজে তার মুখের দিকেও তাকায় না৷ আর আজ সরাসরি চোখে চোখ রেখেছে৷ এ পর্যায়ে নিজেকে স্বপ্নের মাঝে মনে হলো তামজীদের। নিজেই নিজেকে চি’মটি কাটে। সাথে সাথেই আর্তনাদ করে উঠলে বেলী হেঁসে ওঠে। সশব্দে হেঁসে বলে,
‘এগুলো তো আমার কাজ ছিলো তামজীদ ভাই৷ আপনি কবে থেকে এসব শুরু করলেন?’
তামজীদ বোকার মতো হেঁসে মাথা চুলকায়। চমৎকার কন্ঠে বলে, ‘বেলীর মুগ্ধতায় আটকে গিয়ে বেলীর স্বভাব পাওয়া অবাকতার কিছু না। যেখানে পুরো আমিটাই বেলীর তখন কিছু স্বভাব না হয় পেলাম।’
বেলীর মুখের হাসি গায়েব হয়ে যায়। স্পষ্ট শুনতে পায় নিজের হার্টবিট। তামজীদ ঠোঁট কামড়ে হাসে। সে এই মেয়ের কথা বলা, হাসা, কান্না সবকিছুই থামিয়ে দেওয়ার বিশাল এক ক্ষমতা রাখে। বেলী দৃষ্টি এদিক ওদিক করে আমতা আমতা করে বলে,
‘আমি যাই।’
তামজীদ পথরোধ করে দাঁড়ায়। অবাক হওয়ার ভান করে বলে, ‘একটু আগেই না বললে তুমি যাবে না! এখন যেতে চাচ্ছো কেনো?’
বেলী আঁচল পেঁচাতে শুরু করে৷ না যেতে পারছে আর না কথা বলতে পারছে! তামজীদ বেলীর অবস্থায় মজা পায়। গলা পরিষ্কার করে মুখ সামান্য এগিয়ে নিয়ে বলে,
‘প্রেম প্রেম পাচ্ছে বেলী?’
বেলী শ্বাস আটকে তামজীদকে ধাক্কা দেয়। তামজীদ শব্দ করে হেঁসে ওঠে। বেলী তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে তামজীদ জোড়ে বলে ওঠে, ‘আমার কিন্তু বড্ড বিয়ে বিয়ে পাচ্ছে বেলী। সাহিত্য বিয়ে করে সংসার শুরু করেছে দেখে এখন আর অবিবাহিত থাকতে একদমই ইচ্ছে করছে না। কবে বিয়ে করবে?’
বেলী দাঁড়িয়ে যায়। পেছনে না ফিরেই বলে, ‘আপনার ভাই আমাকে ভাবী মানতে পারবে তো?’
তামজীদ হাঁসা বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকায়। বেলী পিছে না ফিরেই হাসে। এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে বলে, ‘তামজীদ ভাই, আপনি শুধু একাই আমার হাসি বন্ধ করতে পারেন না! আমিও পারি। সবটা না হয় সমানে সমানে হোক।’
‘ভালোবাসাটাও?’
বেলী জবাব না দিয়ে শুধু হাসে। নুপুরের আওয়াজ তুলে সামনে এগোতে থাকে। নীরবতা নাকি সম্মতির লক্ষণ! তবে কী সত্যি? তামজীদের মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে থাকে। বেচারা কিছুতেই সমীকরণ মেলাতে পারে না।
—
ঘর এলোমেলো হওয়ায় সাইরাহ্ সব গোছাচ্ছিলো। আলমারির এলোমেলো কাপড়গুলো গোছাতে গোছাতেই তার হাতে চলে আসে একটা কার্ড। সাইরাহ্ ভ্রু কুঁচকে কার্ডটা হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে। কার্ডের তথ্য পড়ে তার চোখ রীতিমতো চড়কগাছ। সে সব কাজ বাদ দিয়ে এই কার্ড নিয়েই বসে থাকে। এর মাঝেই হাজির হয় সাহিত্য। পড়নের শার্ট খুলতে খুলতে সাইরাহ্-কে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ওরকম ‘থ’ মেরে বসে আছিস কেনো? মনে হচ্ছে কারো মা’রা যাওয়ার শোক পালন করছিস!’
সাইরাহ্ রয়ে সয়ে জবাব দেয়, ‘মা’রা যাওয়া না, তবে শোক নাকি আনন্দের বুঝতেছি না।’
‘কেন? কি হইছে?’
‘নিজেই দেখেন।’
সাইরাহ্ কার্ডটা সাহিত্যের দিকে এগিয়ে দেয়। সাহিত্য কপালে ভাজ ফেলে কার্ডটা নিতেই চমকে যায়। চমকানো স্বরে বলে, ‘তুই এইটা কোথায় পাইলি?’
‘তার আগে বলেন লুকিয়েছেন কেনো গোয়েন্দা সাহেব?’
সাহিত্য সাইরাহ্-র মুখে ‘গোয়েন্দা সাহেব’ শুনেই চট করে দরজার দিকে তাকায়। ছুটে গিয়ে দরজা আটকে এসে নিচু স্বরে বলে, ‘যা বলেছিস তা বলেছিস। আর বলিস না। কারোর সামনে তো না-ই।’
‘কেনো বলবো না? গোয়েন্দা হয়েও এমন ভাব নিচ্ছেন মনে হচ্ছে চো’র।’
‘নিজের বর’কে কী শহীদ করতে চাচ্ছিস?’
এমন একটা আজগুবি প্রশ্নে সাইরাহ্ ‘থ’ মেরে যায়। এটা কেমন প্রশ্ন? কেমন কথা? সে নিজের বর’কে শহীদ কেনো করতে চাইবে? আর এই সামান্য একটা কথাতে শহীদ হওয়ার কী সম্পর্ক? এটা তো ভালো কাজ। তার সব প্রশ্নের উত্তর সাহিত্য দেয়,
‘এ ব্যাপারে কেউ জানলে এক কান, দুই কান করতে করতে তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। আর আমরা সোজা উপরে। বুঝেছিস?’
সাইরাহ্ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে, ‘কিচ্ছু বুঝিনি৷ সব মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে।’
‘যাবেই তো। মাথামোটা যে তুই।’
সাইরাহ্ ফোঁস করে শ্বাস নেয়। সাহিত্য কার্ড নিয়ে চলে যেতে নিলে সাইরাহ্ তার হাত টেনে ধরে৷ সাহিত্য জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালে সাইরাহ্ বোকার মতো হেঁসে বলে,
‘গল্প শুনবো।’
‘কিসের?’
‘আপনার গোয়েন্দা হওয়ার। এতো এতো প্রশ্ন পেটের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।’
‘প্রশ্নগুলো জলের সাথে গিলে হজম কর।’
সাহিত্য না বলে চলে যেতে গেলে সাইরাহ্ আটকে দেয়। অনেকক্ষণ জোড়াজুড়ির পর সাহিত্য আর না পেরে সবটা বলতে রাজী হয়। সাইরাহ্ বিজয়ের হাসি হাসে৷ দুজন বিছানার দুপাশে বসে। সাইরাহ্ গলা পরিষ্কার করে বলে,
‘তো আপনার জন্য প্রথম প্রশ্ন হলো, আপনি কবে গোয়েন্দা হয়েছেন?’
‘৩-৪ বছর।’
‘এতোদিন! তাহলে কাউকে জানাননি কেনো?’
‘কারণ আমরা কাজটাই করি এমন। আমাদের নিজেদের পরিচয় গোপন রেখেই কাজ করতে হয়। একমাত্র অফিস ছাড়া আমাদের সম্বন্ধে কেউ জানে না। আর যে কেইস আমরা নিই তার সাথে জড়িত ভিক্টিম, তার পরিবার, সাসপেক্ট এরাই আমাদের চেনে। তবে সেভাবেও চেনে না বলা যায়।’
সাইরাহ্ বুঝতে না পেরে বলে, ‘তাহলে কাজ করেন কিভাবে? পুলিশ আর উকিলের মতো না আপনার কাজ?’
সাহিত্য হেঁসে বলে, ‘হ্যাঁ ওরকমই। তোর আর বেশি বুঝা লাগবে না। এবার যাইতে দে।’
সাইরাহ্ ব্যস্ত ভাবে ওপাশ থেকে এপাশে ছুটে আসে। সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘একদম না। অনেক প্রশ্ন বাকি আছে।’
সাহিত্য পড়েছে যাতাকলে। এই মেয়ে প্রশ্ন করতে করতে নাড়িভুড়ি টানতে গেলে আরেক বিপদ হবে। আবার এড়িয়ে যেতেও পারবে না। ভাবতে ভাবতেই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধির উদয় হয়। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলে,
‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে৷ তুই কী দিবি বল!’
‘আমি কী দেবো? আমার তো কোনো রহস্য নাই।’
‘তাহলে চু’মু দে।’
সাইরাহ্ ছিটকে দুরে সরে যায়। চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘অ’ভদ্র লোক।’
সাহিত্য শব্দ করে হাসতে থাকে৷ নিজের জায়গা থেকে উঠে সাইরাহ্-র নাকে টোকা দিয়ে চলে যেতে নিলে এবারও সাইরাহ্ আটকে দেয়। সাহিত্য পারে না শুধু কপাল চাপড়াতে। পিছু ফিরে আগের মতো দুষ্টুমি করে বলে,
‘দিবি? এজন্য দাঁড় করিয়েছিস?’
‘না। শোনেন না!’
‘শুনছি। বয়রা না আমি৷ বলতে থাক।’
সাইরাহ্ আমতা আমতা করে বলে, ‘আমি বেশি প্রশ্ন করবো না। আর একটা..না না দুইটা..না না তিনটা। এর বেশি একটাও না।’
সাইরাহ্-র মুখ দেখে সাহিত্য এড়িয়ে চলে যেতে পারে না। মনে মনে প্রার্থনা করে এই ৩ টা প্রশ্নে যেনো গভীর কোনো প্রশ্ন না করে! হতাশা নিয়ে সাইরাহ্-র কপালে গাট্টা মা’রে৷ ঘুরে গিয়ে বিছানায় বসতে বসতে বলে,
‘বল! যা প্রশ্ন করবি দ্রুত। আর তিনটার বেশি এক ইঞ্চিরও জবাব দিবো না আমি।’
সাইরাহ্ চোখ মুখ কুঁচকে নিজের কপাল ডলতে থাকে। ধপ করে বিছানার ওপর বসে প্রশ্ন করে, ‘আপনি যে গোয়েন্দা এটা কাউকে জানালে শহীদ হবেন কেনো?’
সাহিত্য হতাশ হয়। এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর সে দিতে পারবে না। দিলেই আরো হাজারটা প্রশ্ন করবে। তাই সংক্ষেপে বলে, ‘এটার কারণ তোকে আমি পরে বলবো। শুধু এটুকু জেনে রাখ আমি এটাতে যুক্ত আছি জানলে বিপদ হতে পারে।’
‘আচ্ছা। পরে বলবেন কিন্তু মনে করে।’
‘বলবো। পরের প্রশ্ন কর!’
‘আপনি যে সেদিন শহরে গেলেন এটার জন্যই তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তার মানে তামজীদ ভাইও গোয়েন্দা?’
সাহিত্য কাঁদো কাঁদো মুখে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। সাইরাহ্ খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। পরের প্রশ্ন করতে গেলেই সাহিত্য ব্যস্ত কন্ঠে বলে, ‘খবরদার আর না। তুই ৩ টা প্রশ্ন করবি বলেছিলি, আর ৩ টা হয়ে গেছে।’
সাইরাহ্ অবাক কন্ঠে বলে, ‘কোথায়? কেবল তো দুটো প্রশ্ন করছি।’
‘তিনটা করছিস। ভেবে দেখ। খবরদার আর আটকাবি না। নাহলে সত্যি সত্যি চু’মু দিয়ে দিবো।’
সাইরাহ্ আর সাহস করে ওঠে না। সাহিত্য নিজের কার্ডটা আবার আলামারিতে তবে ভালোভাবে রেখে দেয়। আরেকটা শার্ট বের করে গোসলখানায় ঢুকতে গেলে সাইরাহ্ পেছন থেকে বলে ওঠে,
‘গোয়েন্দা সাহেব!’
সাহিত্য ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়৷ সাইরাহ্ হেঁসে উত্তেজনা নিয়ে বলে, ‘উফফ, নামটা অনেক সুন্দর হইছে। আমি এখন থেকে এটাই ডাকবো। গোয়েন্দা সাহেব।’
শেষেরটুকু টেনে টেনে বলে। সাহিত্য দুদিকে মাথা নাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘যা মন চায় ডাকিস কিন্তু তা ঘরের মধ্যে। বাহিরে না।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু বাহিরে যদি মুখ দিয়ে বের হয়ে যায় তাহলে আমার কিন্তু দোষ নাই গোয়েন্দা সাহেব।’
‘দোষ নাই? মুখে আঠা লাগিয়ে দিবো।’
‘দিয়েন।’
সাইরাহ্ মুখ বাঁকায়। সাহিত্য গোসলখানায় ঢুকে হেঁসে ফেলে। মেয়েটা আসলেই পাগল। কখন কী করে তা নিজেও জানে না! সাইরাহ্ মনের সুখে গান গাচ্ছে। সাহিত্য গুণ গুণ করার শব্দ পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ যা সাইরাহ্ জেনেছে তা যদি অন্য কেউ জানে তবে বিশাল ঝামেলা হয়ে যাবে। যা যা তারা লুকিয়েছে আর যা যা লুকাতে চাচ্ছে সব সামনে চলে আসবে। আর অ’পরাধী পার পেয়ে যাবে। কিন্তু এটা হতে দেওয়া সম্ভব না। তার জন্য তাদের আরো সাবধান হতে হবে।
চলবে..
#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_____
২৬.
আজ নাজিরাকে দেখতে এসেছে৷ নাজিরা অনুভূতিশূণ্যের মতো বসে আছে। তার মুখে কোনো আওয়াজ নেই। সাইরাহ্ চুপচাপ শুধু তাকে দেখে যাচ্ছে। সাথে বড় ভাবী, ছোট ভাবী থাকায় কিছু বলতেও পারছে না। এর মাঝেই নিচ থেকে ডাক আসে৷ মেয়েকে নিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। নাজিরা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে সামলায়। চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নেয়। সাইরাহ্ সব দেখে তবে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া তার কাছে কোনো উপায় নেই। জীবন আমাদের অদ্ভুত ভাবে, অদ্ভুত সমীকরণে বেঁধে রাখে যা বোঝার সাধ্য কারোর নেই। সাইরাহ্ নিঃশব্দে নাজিরার হাত চেপে ধরে শক্ত করে। নাজিরা তাকায়, হাসে। সাইরাহ্ মাথা নাড়িয়ে আশ্বাস দেয়। নাজিরাও মাথা নাড়ায়। বড় ভাবী, ছোট ভাবী নাজিরাকে লজ্জা দিতে থাকে। নাজিরা নিশ্চুপ। ৩ জন মিলে নাজিরাকে নিয়ে নিচে নামতেই চোখে পড়ে পাত্রকে। সামনেই একটা চেয়ারে মাথা নত করে হাতের তালুতে হাত ঘষছে। সাইরাহ্ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে। পাশেই ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে সাহিত্যও ছিলো। নাজিরাকে আনতেই সে উঠে গিয়ে সাইরাহ্-র পাশে দাঁড়ায়। সাইরাহ্ মাথার কাপড় ঠিক করে নিয়ে সাহিত্যের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘ছেলেটা কী সীমান্ত ভাইয়ের থেকে বেশি ভালো? নাজিরাকে মানাবে এর সাথে? নাকি সীমান্ত ভাইয়ের সাথে বেশি মানাবে?’
সাহিত্যও তার মতো করেই বলে, ‘তোর কী মনে হয়?’
‘সীমান্ত ভাইয়ের সাথে ভালো মানাবে।’
‘আচ্ছা।’
সাইরাহ্ বেশ উত্তেজনা নিয়েই বলেছিলো তবে সাহিত্যের এমন গা ছাড়া ভাবে তার উত্তেজনা উবে যায়। পাত্রের মা বেশ সুন্দর এবং ভদ্র ভাবে নাজিরার সাথে কথা বলছিলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নাজিরাকে তার বেশ মনে ধরেছে। নাজিরা ভুল করেও একবারও সামনে তাকিয়ে পাত্রকে দেখেনি। আলাদা করে কথা বলার সুযোগও তাদের নেই৷ বিয়ে হলে কেবল বড়দের কথা বার্তার মাধ্যমেই হবে। নয়তো না। সব জেনেও নাজিরা তাকায় না। অনুভূতিতে ঘুণ ধরেছে, নতুন সম্পর্কে তার আগ্রহ নেই। সাইরাহ্ বেশ মনোযোগ দিয়েই পাত্রকে দেখছিলো। ছেলেটা বেশ অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে৷ সাইরাহ্ সাহিত্যের হাতে চিমটি কা’টে। সাহিত্য কড়া চোখে তাকায়৷ সাইরাহ্ নিষ্পাপ মুখ নিয়ে বলে,
‘পাত্রের নাম কী?’
‘তুই জেনে কী করবি? তুই বিয়ে করবি?’
‘আপনি রাজি থাকলে আমি করতে পারি।’
সাহিত্য গম্ভীর ভাবে ঘাড় ফিরায়। সাইরাহ্ নিষ্পাপ মুখে হাসে৷ সাহিত্য পারে না সাইরাহ্-র মাথা ফাটিয়ে দিতে। নিজেকে সামলে আবারও পাত্রের দিকে তাকালে সাইরাহ্ আবারও খোঁচা দেয়। সাহিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘ছেলের নাম নীড়। এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’
সাইরাহ্ বিড়বিড় করে দু’বার নামটা উচ্চারণ করে। নামটাও মন্দ না, ছেলেটা দেখতেও মন্দ না। হাবভাব দেখেও মনে হয় ভদ্রই হবে। নাজিরার কী বিয়ে হওয়া উচিত? কিন্তু নাজিরা ভালো তো বাসে সীমান্তকে। আর ভালোবাসা ছাড়া একটা সংসার শুধু সংসার-ই হয়, আর কিছুই হয় না। সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এর মাঝেই সীমান্ত চলে আসে। সে জানতো না আজ নাজিরাকে দেখতে আসবে। শেখর সাহেবের সাথে একটা কাজেই সে কথা বলতে এসেছিলো নয়তো সাইরাহ্ আর সাহিত্যকে সামনে থেকে দেখার সাহস তার আজও নেই। বাড়ি ভর্তি মেহমান দেখেই সীমান্ত দাঁড়িয়ে যায়। শেখর সাহেব চোখ তুলে বেশ নরম সুরেই বলেন,
‘আরে সীমান্ত! ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ভেতরে আসো।’
নাজিরা ‘সীমান্ত’ নাম শুনেই ঝড়ের গতিতে তার দিকে তাকায়। এতক্ষণে নিজেকে ধরে রাখা সত্তাটা আর ঠিক থাকতে চায় না৷ বড় বড় শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। সীমান্ত মাথা নিচু করে বলে,
‘একটা কাজে এসেছিলাম ফুপা। মনে হয় আপনারা ব্যস্ত আছেন। আমি পরে আসবো।’
‘আরে কিসের ব্যস্ত? ভেতরে আসো।’
সীমান্ত ইতস্তত করা সত্বেও ভেতরে যায়। পাত্রপক্ষের সাথে তার পরিচয় করানো হলে তাকেও মিষ্টি আর নাশতা দেওয়া হয়। সীমান্ত মিনিট দুয়েক বসেই কোনোমতে বলে,
‘ফুপা, আপনি কথা শেষ করে আসেন। আমি ছাঁদে যাই একটু।’
শেখর সাহেব মাথা নাড়ালেন। সীমান্ত ঘাড় ফিরিয়ে একবার নাজিরার দিকে দেখে। নাজিরা হাত মুঠো করে নিজেকে শক্ত করে বসে আছে। সামান্য হাসে সে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়ায়। মনে মনে আওড়ায়,
‘সুখী হও।’
সাইরাহ্ সীমান্তের যাওয়া দেখে নিজেও সাহিত্যকে কিছু না বলেই ছুট লাগায়৷ সবাই নিজেদের কথায় ব্যস্ত ছিলো বলে টের পায় না। সাহিত্য দেখে তবে প্রতিক্রিয়া করে না। সে সীমান্তকেও চেনে আর সাইরাহ্-কেও চেনে। এই চেনায় কোনো খাত নেই তাই সন্দেহ আসার প্রশ্নই আসে না। সাবলীলভাবেই কথা বলতে থাকে।
সীমান্ত ছাঁদে পা রাখার আগেই সাইরাহ্ হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে ডাকে। সীমান্ত থমকে দাঁড়ায়। ফাঁকা ঢোক গিলে দু হাতের মুঠো শক্ত করে থাকে। সাইরাহ্ সামনে এসে বলে,
‘জলদি আসেন, কথা আছে।’
সীমান্ত হকচকানো গলায় শুধায়, ‘কী হইছে? কোনো সমস্যা?’
‘অনেক সমস্যা৷ আপনি আগে আসেন।’
সাইরাহ্ আর সীমান্ত একসাথেই ছাঁদে যায়। সাইরাহ্ কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই বলে, ‘নাজিরা আপনাকে ভালোবাসে। এই বিয়েটা ভেঙে দেন। আর ওকে বিয়ে করে নেন।’
সীমান্ত প্রথম বাক্যে স্বাভাবিক থাকলেও পরের দু বাক্যে বিস্ময়ে হা হয়ে যায়। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে সাইরাহ্-র মুখপানে। সাইরাহ্ কথাটা এতো স্বাভাবিক ভাবে বলেছে যেনো এটাই হওয়ার ছিলো। সীমান্ত অবাক কন্ঠেই বলে,
‘নাজিরাকে বিয়ে করবো? আমি?’
সাইরাহ্ উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। উপরে নিজেকে সে ভীষণ স্বাভাবিক রেখেছে তবে ভেতরে ভেতরে সেও নড়বড়ে। তার কিশোরী মনের প্রথম অনুভূতিতেই তো সীমান্তের নাম ছিলো। সীমান্তই সেই পুরুষ যে তাকে উন্মাদনা দেখিয়েছে। প্রেম দেখিয়েছে কিন্তু আগলে রাখতে পারেনি৷ সাইরাহ্ মাথা থেকে সে চিন্তা বের করে নিজেই নিজেকে শাসায়,
‘যা ছিলো তা বিয়ের আগে৷ বিয়ের পর অন্য পুরুষকে ভাবাও পাপ। সীমান্ত ভাই এখন তোর দেবর সাইরাহ্। উনাকে নিয়ে তুই ভাবতে পারিস না। আর ভাববিও না।’
আমাদের সমাজের মেয়েরা যেমনই হোক তারা বিয়ের পর সম্পর্কটাকে অন্যরকম গুরুত্ব দেয়। হাজারও মেয়ের বিয়ে তার অনিচ্ছায় হয় কিন্তু কিছু সংখ্যক মেয়ে ছাড়া সবাই বিয়ের পর পরপুরুষের কথা ভাবা বন্ধ করে দেয়। নিজের স্বামী, সংসারকে আগলে ধরে। আর গ্রামের মানুষরা নিজের স্বামীকেই সব মানে। সাইরাহ্-র ভাবনার মাঝেই সীমান্ত বলে ওঠে,
‘আমি জানি নাজিরা আমাকে ভালোবাসে কিন্তু ওকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
‘কেনো?’
সীমান্ত আহত দৃষ্টিতে তাকায়। এখন এই কারণটাও সাইরাহ্-কে খোলাসা করে বলতে হবে? তার বলতে দ্বিধা নেই, বাঁধা নেই৷ তবে সাইরাহ্-র শুনতে যে বাঁধা আছে৷ দ্বিধা আছে। তবুও সে মুখ খোলে। মনের সুপ্ত অনুভূতিকে আশকারা দিয়েই অসহায় গলায় আওড়ায়,
‘আমি নাজিরাকে ভালোবাসতে পারবো না সাইরাহ্। ভালো রাখতেও পারবো না। ভাগ্য তোমাকে আমার হতে দেয়নি ঠিক তবে আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি।’
সাইরাহ্ জানে সবই। তবুও স্তব্ধ হয়। মুখ থেকে আনমনেই বেড়িয়েই যায়, ‘ভাগ্য চাইলেও আপনি চাননি।’
সীমান্তের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে। ঢোক গিলে দম নেয়। দু হাতে নিজের মুখ মুছে হাসার চেষ্টা করে। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও তা কেঁপে কেঁপে ওঠে,
‘এটা সত্য আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছি তবে আমি বাধ্য ছিলাম। আমি কাপুরুষের মতো পিছিয়ে গেছিলাম এটা যেমন সত্য তেমন এটাও সত্য আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, বাসি আর ভবিষ্যতেও হয়তো বাসবো। ভবিষ্যতের কথা মানুষ জোড় দিয়ে বলতে পারে না তবে এটুকু বলতে পারি এ জীবনে সাইরাহ্ ছাড়া ২য় কোনো নারীর আসার সুযোগ নেই। আমি তোমাকে সুখী করতে পারিনি, অন্য কাউকেও পারবো না। এক জীবনে আমার সমস্ত ভালোবাসাটুকু তোমার নামে করে দিয়েছি, এটুকু তোমারই থাক। তুমি আমার না-ই বা হলে তবে এটুকু আমার থাক।’
সাইরাহ্ এলোমেলো ভাবে হাসে৷ এগিয়ে গিয়ে ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, ‘পৃথিবীর সমস্ত সত্যর সাথে এটাও সত্য যে আমি আপনার ভাইয়ের স্ত্রী। সম্পর্কে আমি আপনার ভাবী। আমার জন্য মনে কোনোরকম অনুভূতি রাখা আপনার জন্য পাপ সীমান্ত ভাই৷ এই পৃথিবীতে সবার অধিকার আছে সুখে থাকার। আপনারও আছে। আমি অনেক সুখী। তাই আপনিও সুখী হোন৷ ভাগ্য আপনাকে একদিক থেকে শূণ্য করে দিয়ে অন্যদিক পূরণ করতে চাচ্ছে। তা গ্রহণ করুন। নাজিরাকে ফিরিয়ে দিলে আপনি ভালোবাসা হারাবেন, সুখ হারাবেন। তাই নাজিরাকে আগলে রাখুন।’
‘ভালোবাসা আমি হারিয়েছে আরো আগে। আর কিছু হারানোর ভয় নেই। জীবন আমার থেকে সব ভয়, সঙ্কোচ, আশংকা কেড়ে নিয়েছে। বেঁচে থাকার কারণ শূণ্য করেছে।’
সাইরাহ্ দাঁড়াতে পারে না। এ কথাগুলোর মূল্য এখন আর নেই। পৃথিবী তাদের দুজনকে দু প্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। সেদিন সীমান্তের একটা পদক্ষেপ গ্রহণে আজ তাদের পথ অন্যরকম হতো। কিন্তু সেদিন সীমান্ত এগোতে পারেনি। এক ভরা গ্রামের সামনে প্রত্যাখান করেছিলো সাইরাহ্-কে। একবারও সাহস করে মুখ ফুটে বলতে পারেনি ‘আমি সাইরাহ্-কে ভালোবাসি’ তবে আজ এ ভালোবাসার কী মূল্য? সাইরাহ্ সীমান্তকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘আমার সংসার আছে। আমি সুখে আছি৷ আমাকে ভালোবাসার মানুষটাও আছে। আপনিও নিজের জীবন গুছিয়ে নিন। জীবন কারো থেকে বাঁচার কারণ কেড়ে নেয় না।’
সীমান্ত কিছু বলতে পারে না। সাইরাহ্ ততক্ষণে ছাঁদ থেকে নেমে গেছে। সিঁড়ির সাথের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। সাহিত্যকে সে ঠকাতে পারবে না। কোনোভাবেই না। ওই পুরুষটা তার জীবনে বার বার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব বিপদ থেকে আগলে রেখেছে। ভালোবেসেছে৷ সুখ এনে তাকে সুখী করতে চেয়েছে। এই পুরুষটির ঠকে যাওয়া প্রাপ্য নয়। সাইরাহ্ চোখের কোণ মুছে ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,
‘এ পৃথিবীতে সবথেকে স্বার্থপর হলো নারীজাতি। তারা প্রেমিক পুরুষকে ছাড়তে পারে। নিজের সংসারের কথা ভাবতে পারে। নিজের স্বামীকে আগলে নিতে জানে। তারা বিষাদ আঁকড়েও নির্দ্বিধায় আরেকটি পুরুষকে কাঁদাতে জানে। তারা স্বার্থপর বলেই তো মুখের ওপর বলে দিতে পারে ‘আমি সুখী। আমার সংসার আছে।’ তারা স্বার্থপর বলেই নিজের অতীত নিয়ে না ভেবে বর্তমান নিয়ে ভাবতে পারে। শুধু নিজের কথা ছাড়া তারা সবটুকু নিয়ে ভাবতে জানে। নিজের বিষাদ ছাড়া তারা সবার বিষাদকে দেখতে জানে।’
‘তবে তুইও স্বার্থপর সাইরাহ্? তুইও নিজের বিষাদ দেখিসনি? প্রেমিক পুরুষকে আগলে নিতে পারিসনি সংসারের দোহায়ে?’
সাইরাহ্ চমকে ওঠে। সামনে সাহিত্য দাঁড়িয়ে। তার কানে অন্য কোনো কথা পৌঁছাক বা না পৌঁছাক সাহিত্যের ‘সাইরাহ্’ ডাকটা ঠিকই পৌঁছেছে। সাইরাহ্ বিস্ময় নিয়ে তাকায়। সাহিত্য কখনোই তাকে ‘সাহেবা’ ছাড়া ডাকেনি। এমনকি গ্রামের মানুষের সামনেও সে অনেকসময় জোড় গলায় ‘সাহেবা’ ডেকেছে তবে আজ? সাহিত্য হাসে। এগিয়ে এসে সাইরাহ্-র চোখের জলটুকু মুছে দেয় সযত্নে। নিজের ব্যাথাটুকু আড়ালেই রেখে বলে,
‘কাঁদিস না। কাঁদলে তোকে বড্ড বেমানান লাগে। নিচে চল! বড় ভাবী ডাকে।’
সাহিত্য নিজের দিক থেকে স্বাভাবিক। তবে ঝড় উঠেছে সাইরাহ্-র মনে। তার মন কিছুতেই শান্ত হতে পারে না। সাহিত্য তাকে ‘সাইরাহ্’ কেনো ডাকলো? সামান্য একটা ‘ডাক’ কোনো ভাবেই শক্ত কোনো কারণ হয় না তবে সে জানে এইটুকু তার কাছে বিশাল কারণ। যে অনুভূতিটুকু সীমান্তের ক্ষেত্রেও তার হয়নি সেই অনুভূতিটুকুই সাইরাহ্ অনুভব করলো। তিতকুটে হয়ে আসে যেনো সারা দেহ, মন। অস্থির ভাবেই সে এলোমেলো ধাপ দেয়। মুখ থেকে একটা আওয়াজও বের করতে পারে না।
—
ছন্দ এখনো কাউকে বলেনি সে মা হতে চলেছে। বার বার শাহিদের বাড়ি গিয়েও ফিরে এসেছে। তার শেষ ভরসা শাহিদ। বেলী ছন্দের এমন এলোমেলো, উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণগুলো খেয়াল করেছে। তবে কি হয়েছে তা বুঝতে পারছে না। তাই নিজ থেকেই সে এগিয়ে আসে। নরম সুরে শুধায়,
‘ছন্দ! কী হয়েছে রে? তুই এমন করছিস কেনো? কিছু হয়েছে?’
ছন্দ চমকায়। তার ভীত মন বার বার ভীত হচ্ছে। কখন যে সবাই সবকিছু জেনে যাবে তার মাথাতেই আসছে না। বেলী ছন্দকে এভাবে ভয় পেতে দেখে আরো বেশি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। ছন্দ হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘কই! কিছু না তো।’
‘সত্যি বলছিস?’
‘হ-হ্যাঁ। মিথ্যা কেনো বলবো?’
বেলী আরো প্রশ্ন করতো তবে ছন্দ তাকে সুযোগ না দিয়েই নিজ থেকে বলে, ‘আমি একটু শাহিদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। বাড়িতে কিছু বললে তুই মানিয়ে নিস।’
বেলী থামানোর চেষ্টা করে। তবে এতে খুব একটা লাভ হয় না। ছন্দ কোনোরকমে এগিয়ে চলে শাহিদের বাড়ির দিকে। পুরো রাস্তা তার আতঙ্কে কাটে। মনে হয় এখনই কেউ এসে বলবে ‘তোমার সত্যটা আমি জেনে গেছি৷ এবার তুমি মুখ দেখাবে কেমন করে?’ বার বার তার কানে এসবই বাজতে থাকে। ভ’য়ং’কর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে যখনই শাহিদের বাড়ির সামনে আসে তখনই দেখে বাড়ির সামনে ভীড়। ছন্দ হাত দিয়ে চোখ মুখ মুছে খোলা চুল গুলো খোঁপা করে নেয়। দু পা এগোতেই একটা মহিলা সামনে দিয়ে যেতে নিলে সে খপ করে হাত ধরে। আটকে দিয়ে বলে,
‘এতো ভীড় কেন কাকি? কী হইছে?’
মহিলা বেশ উৎফুল্ল স্বরে বলে, ‘ওই বাড়ির পোলা আছে না! শাহিদ। হেয় তো বিয়া করছে। বউ নিয়া আইছে। সবাই তাই দেখতো যাইতাছে।’
ছন্দ নড়ে ওঠে। মহিলার হাত ছেড়ে দেয়। মহিলাটি চলে গেলেই ছন্দ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। পড়তে পড়তেও পড়ে না। কানে বাজতে থাকে ‘শাহিদ বিয়ে করেছে’ কথাটি। শাহিদ বিয়ে করেছে? কিভাবে? শাহিদ তো তাকে ভালোবাসে। তাহলে? শাহিদ কীভাবে পারে বিয়ে করতে? ছন্দের গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা মুছে নেয়। বড় বড় দুটো শ্বাস নিয়ে শাহিদের বাড়ির দিকে এগোয়। মনকে সান্ত্বনা দেয় শাহিদ বিয়ে করেনি। এটা মিথ্যা কথা। এক পা এক পা করে এগোলেই সামনে দেখতে পায় শাহিদকে। ভীড় ঠেলে সামান্য উঁকি দিয়ে দেখে বারান্দায় শাহিদ আর একটা মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে। মেয়েটার সাজ আর লাজরাঙা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে নতুন বউ। ছন্দের দুনিয়া ঘুরে ওঠে। অন্ধকার দেখতে পায় চারপাশে। কোনোরকমে সে সরে আসে দুরে। গাছ ধরে নিজের ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে। এই অবস্থায় এতো চাপ সে নিতে পারে না। খালি পেট হওয়ায় গড়গড় করে বমি করে দেয়। এরপর কোনোরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এলোমেলো ভাবে বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। চোখের সামনে তার সব স্বপ্নের মৃ’ত্যু ঘটেছে৷ একদিকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা অন্যদিকে পরিবারের সম্মান। ছন্দের মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে থাকে। মাঝ রাস্তাতেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে,
‘আমারে ঠকাইলা!’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)