সাহেবা পর্ব-২৭+২৮

0
242

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
____

২৭.
নাজিরাকে দেখে পাত্রপক্ষ চলে গেছে৷ বাড়ির বড়দের ছেলেকে খুব পছন্দ। তারা আগামীকাল পাত্রের ঘরবর, অবস্থা, পাত্রের চারিত্রিক খোঁজ খবর নিবে। আর এরপর বিয়ের কথা পাকা হবে। পাত্রপক্ষ চলে যাওয়ার পর নাজিরার মা নাজিরাকে শুধালেন,

‘পোলা তোমার পছন্দ হইসে, নাজিরা?’

নাজিরা মাথা নিচু রেখেই জবাব দেয়, ‘আপনাদের পছন্দই আমার পছন্দ আম্মা।’

বড়রা বেশ খুশি হলেন। মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা-ই তো তারা শুনতে চেয়েছেন। বড় ভাবী, ছোট ভাবী আর নাজিরার সাথে উপরে যায় না। সাইরাহ্ নিজেকে সামলে নিয়েছে। তার জীবনে সমস্যার ছড়াছড়ি তা সে পরে সামলে নিবে কিন্তু আপাতত নাজিরার সাথে কথা বলা দরকার। তাই সে নাজিরাকে নিয়ে তার ঘরে যায়। নাজিরার গা থেকে গহণাগুলো খুলতে খুলতে বলে,

‘ছেলে তোমার সত্যি পছন্দ হইছে, নাজিরা?’

নাজিরা আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ সাইরাহ্ জবাবের আশায় চেয়ে আছে। নাজিরা সেভাবেই আয়নায় একপলক সাইরাহ্-র মুখ দেখে নিয়ে বলে, ‘ভাঙা মানুষের নিজের পছন্দ বলতে কিছু হয় না। আব্বা-আম্মা যা ভালো মনে করবে, করুক।’

‘তুমি বিয়েটা করবে? কিন্তু তুমি তো সীমান্ত ভাইকে ভালোবাসো।’

নাজিরা হাসে৷ সে হাসিতে প্রাণ না থাকলেও নিজের প্রতি তাচ্ছিল্য আছে। ঘুরে গিয়ে সাইরাহ্-র মুখোমুখি হয়ে বলে, ‘ভালোবাসাটা একপাক্ষিক ভাবীজান। আর একপাক্ষিক ভালোবাসায় পাওয়ার আশাটা কোনোভাবেই থাকে না। আমি সীমান্ত ভাইকে চাইবো কিভাবে? যার পুরো সত্তা জুড়ে তুমি তাকে আমি কিভাবে চাই? মানছি তুমি এখন বিবাহিত কিন্তু সীমান্ত ভাই এখনও তোমাকে ভালোবাসে। আর শুধু ভালোবাসায় ভালো থাকা যায় না। ভালোবাসার সাথে থাকতে হয় যত্ন, আগলে রাখার মতো ক্ষমতা, যেকোনো বিপদে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর মতো সাহস। যেগুলো সীমান্ত ভাইয়ের নেই। তোমাকে এতো ভালোবেসেও তোমাকে নিজের করতে পারেনি আর আমাকে তো বাসেই না। আমি ভালোবাসি এটা যেমন সত্য তেমন আমার আত্মসম্মানবোধও আছে এটাও সত্য।’

সাইরাহ্ কিছু বলতে পারে না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় নাজিরার মুখপানে। নাজিরা হুট করেই সাইরাহ্-কে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ ভিজে উঠেছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভাঙা স্বরে বলে,

‘নিয়তি মনের মানুষকে ভাগ্যে রাখে না, হয়তো ভাগ্যে রাখা মানুষটাকে এক সময় মনে স্থান করে দিবে।’

সাইরাহ্ হাত তুলে নাজিরার মাথায় রাখে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজেদের সম্পর্কের কথা ভাবে৷ আসলেই নিয়তি মনের মানুষকে ভাগ্যে রাখেনি। তবে যাকে ভাগ্যে রেখেছে সে মানুষটা যে ভালোবেসে তাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে৷ অথচ সে কী দিয়েছে? এতকিছুর পরও সে সাহিত্যের সাথে নিজের দূরত্বটুকুই দেখেছে। সাইরাহ্ দীর্ঘশ্বাস ফেলে অজান্তেই আওড়ায়,

‘ভাগ্যের মানুষটা হয়তো মনের মানুষের চেয়ে অনেক বেশি কল্যাণের। তাই আল্লাহ তায়ালা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি চাইবো, যে ভালোবাসাটুকু তুমি পাওনি তার চেয়ে আরো হাজারগুণ ভালোবাসা পাও। তোমার ভাঙা হৃদয়ে ফুল হয়ে ফুটুক অপর পাশের মানুষটা।’

দুজনেই নীরব থাকে। দরজার বাহির থেকে সাহিত্য সবটাই শোনে। সে ভেবেছিলো সীমান্তের সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে কিন্তু নাজিরার সব কথা সত্য। আর যেখানে নাজিরা চাচ্ছে জীবনকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে সেখানে তার এই বিষয় ঘাটানো বেমানান। সীমান্তের সাথে বিয়ে হলে তার বোনের ভাগ্যটা তার মতোই হবে। এক আকাশ ভালোবাসার বিপরীতে অপর মানুষটা অন্য কাউকেই ভালোবেসে যাবে। সাহিত্য দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে হাসে। বিড়বিড় করে বলে,

‘আমার ভালোবাসাটুকু আমার থাক। যদি এতেই তোর সুখ হয় তবে আমি এতেও রাজি।’


সাহিত্য সারাদিন বাড়িতে ছিলো না। কোথায় ছিলো সাইরাহ্ জানে না। সারাদিন সাইরাহ্ কাজের ফাঁকে ফাঁকে বার বার দরজার দিকে দেখেছে। কিন্তু সাহিত্যের খবর নেই। ভেতরে ভেতরে সে ছটফট করছে৷ কেনো, কিসের জন্য তার জানা নাই। কিন্তু সাহিত্যের মুখে ডাকা সেই ‘সাইরাহ্’ সম্বোধন তার সব উলটপালট করে দিয়েছে। সে কিছুতেই সবটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছে না। বার বার তার মাথায় ঘুরতেছে সাহিত্য কেনো তাকে সাইরাহ্ বলবে? গোটা দুনিয়া তাকে যেই নামে ইচ্ছে ডাকুক কিন্তু সে কেনো সাহেবা বাদ দিয়ে সাইরাহ্ বলবে? বাচ্চাদের মতো মনে হলো নিজেকে। সাইরাহ্ ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করেছে। এ মাথা থেকে ও মাথা শুধু দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মাথার মধ্যে হাজারটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। তার এই পায়চারির মাঝেই সাহিত্য ঘরে ঢোকে। ক্লান্ত পায়ে ঘরে ঢুকে সাইরাহ্-কে এভাবে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে দেখেও কিছু বলে না। সাইরাহ্-ও থেমে যায়। অনুভব করে তার হৃদপিন্ডের গতি দ্রুত হয়েছে। সাহিত্য সরাসরি গোসলখানায় ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে একবারে আসে। কোনো কথা ছাড়া-ই বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। সাইরাহ্ এতক্ষণ অনেক কথা ভাবলেও সাহিত্যকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচল নিয়ে আঙুলে পেঁচাচ্ছে। হুট করেই সাহিত্য প্রশ্ন করে,

‘কিছু বলবি?’

হঠাৎ প্রশ্ন করায় সাইরাহ্ একটু থতমত খায়। একটু এগিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে বলে, ‘সারাদিন কোথায় ছিলেন? এসেই শুয়ে পড়লেন। শরীর খারাপ লাগতেছে?’

সাহিত্য কপালের ওপর থেকে হাত সরায়৷ চোখ মেলে সাইরাহ্-কে দেখে। সরাসরি চোখে চোখ রেখে অদ্ভুত কন্ঠে বলে, ‘তোর চিন্তা হচ্ছে আমাকে নিয়ে?’

সাইরাহ্ জবাব দেয় না। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। সাহিত্য চোখ বন্ধ করে হাসে। নিজ থেকেই বলে, ‘হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিয়ের পর মেয়েরা তো স্বামীকে নিয়ে চিন্তা করবেই। এটা তাদের দায়িত্ব যে!’

সাইরাহ্ চমকায়। ঢের বোঝে সাহিত্য কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সে তো সেভাবে কিছু বোঝায়নি। আবার কি বোঝাতে চেয়েছে তাও তো স্পষ্ট। সাহিত্যের কথার বিপরীতে সাইরাহ্ কি বলবে বোঝে না। বাহিরে মেঘ ডাকছে। সন্ধ্যার আগের সময়। জানালা দিয়ে তাকাতেই দেখে বাহিরে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। সাইরাহ্ ছুটে বাহিরে যায়। সাহিত্য একবার সেদিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে নিজেও পিছু পিছু যায়। ছাঁদ থেকে শুকনো কাপড়গুলো তুলে নিজেদের কাপড়গুলো ঘরে রেখে বাকিগুলো নিয়ে ছোটে নিচের দিকে। যাওয়ার আগে সাহিত্যকে বলে,

‘ভিজবেন না, জ্বর হবে। আপনি ঘরে যান। আমি আসছি!’

সাইরাহ্ দ্রুত পায়ে নেমে যায়। সাহিত্য কথা না শুনে দু পা এগোয়। বৃষ্টির পানির ঝাপটা এসে লাগে তার গায়ে। বাতাসও উঠছে। বৃষ্টির মাত্রা বাড়ছে। সাহিত্য হেঁসে মাথা উচু করে চোখ বন্ধ করে নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে,

‘বৃষ্টি একটা শুদ্ধতম অনুভূতি। এই অনুভূতির সাথে নিজের অনুভূতি ভাসিয়ে দিলে ক্ষতি কী? যে যন্ত্রণা আমার বুকের গভীরে হচ্ছে সেই যন্ত্রণা, ক্ষতর তো কোনো ঔষধ নেই। তবে এই বৃষ্টির পানিতে যদি শরীর আর মন দুটোই ঠান্ডা হয় তবে ক্ষতি কী?’

পুরুষ মানুষ কাঁদে না। এই যুক্তি অবলম্বন করেই সাহিত্য কাঁদছে না। নিজেকে সে দুর্বল করবে না। একটা সময় তো ছিলো যখন কোনো কিছুর প্রতিদান না ভেবেই সে তার সাহেবাকে ভালোবেসেছে! তবে আজ তার ভালোবাসার প্রতিদানে সাহেবার ভালোবাসা পাওয়াটা কি গুরুত্বপূর্ণ? উহু, না। তাই সেও আর সাহেবার কাছে কোনো আশা রাখবে না। কিন্তু মন আর মস্তিষ্ক কি কখনো এক কথা বলে? মস্তিষ্ক প্রতিদান না চাইলেও মন বলে উল্টোটা। সে যতটা ভালোবাসে ততটা ভালোবাসা তো সেও চায়। তারা দুজন স্বামী-স্ত্রী তবুও তাদের মাঝের দূরত্ব কেনো এতো? তার ভাবনার মাঝেই তার হাতে একটা ঠান্ডা হাত পড়ে। শীতলতায় তার শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। চোখ মেলে দেখে সামনে সাইরাহ্। সাইরাহ্-র ঠোঁট ঠান্ডায় তিরতির করে কাঁপছে। সাহিত্যকে তাকাতে দেখে সাইরাহ্ জোড় গলায় বলে,

‘ভিজছেন কেনো? আমি তো আপনাকে মানা করলাম! জলদি ঘরে চলেন!’

সাহিত্যের কান অব্দি কথা গুলো পৌঁছেছে কি না বোঝা গেলো না। সে শুধু সাইরাহ্-র কাঁপতে থাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছে। মন এক অযাচিত আবদার করে বসছে। অযাচিত? সত্যিই? তারা তো স্বামী-স্ত্রী। এটুকু আবদার তো অযাচিত নয়। তবে সাইরাহ্-র তো অনুমতি নেই। মস্তিষ্ক লজিক দিলেও মন মানলো না। সাইরাহ্ পুনরায় তাকে ঘরে যেতে বলে। হাত টেনে এগোতে গেলে সাহিত্য তাকে টেনে কাছে আনে। সাইরাহ্ চমকে ওঠে। তাদের দুজনের মাঝে একটুও দূরত্ব নেই। সাহিত্যের মুখ বেয়ে বৃষ্টির পানি সাইরাহ্-র মুখের ওপর পরে। সাইরাহ্ চোখ বন্ধ করে নেয়। নিজের হৃদপিণ্ডের গতির শব্দ নিজে যেনো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সাহিত্য কোনো কথা ছাড়া-ই হুট করে সাইরাহ্-র ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। সাইরাহ্ চোখ বড় বড় তাকায়। পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে নেয়। সাহিত্যকে সে বাঁধা দেয় না। এক হাতে নিজের শাড়ি এবং অন্য হাতে সাহিত্যের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। সাহিত্য যখন তাকে ছেড়ে দেয় তখন সাইরাহ্ হাঁপাচ্ছে। চোখ বন্ধ করেই সে তখনও বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। সাহিত্য কি করেছে বুঝতে পেরে দুজনেই খানিকটা ছিটকে যায়। সাইরাহ্ একা ঘরে যেতে গিয়েও যায় না। উল্টো ফিরেই সাহিত্যকে টেনে নিয়ে ঘরে চলে যায়। সাহিত্য হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আলমারি থেকে নিজের কাপড় নিয়ে বলে,

‘আমি ঘরেই পাল্টে নিচ্ছি। তুই গোসলখানায় যা।’

সাইরাহ্ কথা বাড়ায় না। সাহিত্যের দিকে তাকাতে তার লজ্জা লাগছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সে নিজের শাড়ি নিয়ে গোসলখানায় ঢুকে যায়। দরজা লাগিয়ে দিয়ে বুকে হাত দিয়ে বসে পরে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাত রাখে নিজের ঠোঁটে। কি ঘটে গেলো তা ভেবেই চোখ বন্ধ করে নেয়।

রাতে সাহিত্যের গা কাঁপিয়ে হঠাৎ-ই জ্বর আসে। সাইরাহ্-র নিজেরও জ্বর জ্বর লাগছে। তবে সে আগেই রাতে খাওয়ার পর ঔষধ খেয়ে নিয়েছিলো কিন্তু সাহিত্য খায়নি। সন্ধ্যায় ওমন হওয়ায় সাইরাহ্-রও কথা বলতে খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু সাহিত্যের উত্তপ্ত অবস্থা দেখে নিজের অস্বস্তি দুর করে দেয়। সাইরাহ্ কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে ঘরে থাকা একটা নাপা এগিয়ে দেয় সাহিত্যের দিকে। মুখে বলে,

‘ঔষধটা খেয়ে নেন।’

সাহিত্য নেয় না, কোনো কথাও বলে না। সাইরাহ্ তার হাত টেনে উঠানোর চেষ্টা করে তা দেখে সাহিত্য চোখ মেলে তাকায়৷ জ্বরে তার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। সাইরাহ্ আঁতকে উঠে বলে,

‘ঔষধটা খেয়ে নেন। আপনার জ্বর বাড়তেছে।’

সাহিত্য নিজের নিয়ন্ত্রণেই আছে তবে তার অনুভূতিগুলো আর নিয়ন্ত্রণে নেই। গম্ভীর মুখে বলে, ‘বাড়ুক। তুই ঘুমা।’

‘আপনার ভাবা লাগবে না। আপনি আগে ঔষধ খান, উঠে বসেন।’

সাহিত্য শোনে না। সাইরাহ্-র রাগ হয়। জোড় করে সাহিত্যের মুখে ঔষধ দিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। মুখ এমনি তেঁতো হয়েছিল তার মধ্যে তেঁতো ঔষধ দেওয়ায় তার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে যায়। চোখ মেলেও কিছু না বলে পানিটা খেয়ে নেয়। সাইরাহ্ উঠে পানি আনতে গেলে সাহিত্য তার হাত টেনে নিজের কাছে আনে। অপর পাশে খানিকটা সরে গিয়ে সাইরাহ্-কে নিজের বাহুতে শুইয়ে নেয়। সাইরাহ্ প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে,

‘জলপট্টি দিতে হবে তো! পানি আনি?’

সাহিত্য শোনে না। সাইরাহ্-কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সাইরাহ্ এভাবে আগেও সাহিত্যের বুকে মাথা রেখেছে তবে আজ সন্ধ্যার ঘটনার জন্যই তার হৃদপিণ্ডের গতি অস্বাভাবিক ভাবে বাড়ছে। তার ভাবনার মাঝেই সাহিত্য জিজ্ঞাসা করে,

‘তুই এখনো সীমান্তকে ভালোবাসিস, সাইরাহ্? ওর কাছে ফিরবি তুই?’

সাইরাহ্ পুরো কথার জবাব না দিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করে, ‘সাইরাহ্ কেনো বলছেন? আপনি তো আমাকে সাহেবা ডাকেন!’

‘আজ ডাকতে ইচ্ছে করছে না।’

সাহিত্যের এমন জবাবে সাইরাহ্ চুপসে যায়। তার মোটেও ভালো লাগেনি সাহিত্যের মুখে এমন ডাক। পরক্ষণেই সাহিত্য তাকে আবার জিজ্ঞেস করে,

‘দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে চাস?’

সাইরাহ্ ছোট্ট করে ‘উহু’ বলে। সাহিত্য শুনলেও তার মন মানতে চাইলো না। সীমান্তের সাথে কথোপকথনগুলো তাকে পীড়া দিচ্ছে। তার ভেতর সত্তা বার বার বলছে একটু কেঁদে নিজেকে হালকা কর কিন্তু সে পারছে না। গলায় এসে কান্নাগুলো আটকে আছে। সাহিত্য কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,

‘তুই আমাকে ভালোবাসতে পারলি না কেনো, সাহেবা? আমার এতো এতো ভালোবাসাও তোর কাছে তুচ্ছ হয়ে থাকলো কেনো? আমি জানি আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক ছিলো না কিন্তু তবুও তুই শুধু দায়িত্বের জেরে বেঁধে আছিস এই বাক্যটা আমি নিতে পারছি না। আমার বুকের বা’পাশটায় বড্ড ব্যাথা হচ্ছে। অন্তরটা কেমন পুড়ে যাচ্ছে।’

সাহিত্য সম্পূর্ণ জ্বরের ঘোরে আছে। সাইরাহ্-র বড্ড অপরাধবোধ হলো। সাথে সাহিত্যের মুখে শোনা ‘সাহেবা’ ডাকটায় হৃদয় শান্ত হলো। সে সাহিত্যের বুকের অংশের শার্ট চেপে ধরে। সাহিত্যের চোখের কোণ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সে ঘুমিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ঘুমের মধ্যেও মনে হলো তার সাহেবা তার থেকে অনেক দুরে সরে গেছে। তবে চোখ মেললে দেখতো তার সাহেবা তার সাথে আরও লেপ্টে গেছে। সাহেবার এক একটা হার্টবিটই জানান দিচ্ছে সাহেবা এই আধাপাগল, ত্যাড়া লোকটার প্রেমে পড়েছে।

__
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বেলী ছন্দকে পাশে পায় না। আশে পাশে তাকিয়ে তাকে না দেখে উঠতে নিলেই বিছানার ওপর পায় একটা চিঠি। আগ্রহবশত সে চিঠি খুললেও তার শরীর হিম হয়ে যায়। এলোমেলো পরে থাকা ওড়নাটা কোনো রকম গায়ে টেনে নিয়ে ছুট লাগায় বাড়ির পিছন দিকে। বড় বাগানের একটা গাছের সাথে ঝুলছে ছন্দর নিথর দেহ। তা দেখে বেলী চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে আশে পাশে থাকা মানুষ ছুটে আসে। বেলী এত বড় আঘাত সইতে না পেরে ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে।

চলবে..

#সাহেবা
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___

২৮.
ছন্দের লা’শ নামানো হচ্ছে। সাহিত্য, সাইরাহ্-সহ ও-বাড়ির সবাই এসেছে। প্রধান গিন্নি একটু দুরে বসেই বিলাপ করে কাঁদছেন। তামজীদ তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে। মেয়েটার অবস্থা বেশি ভালো নয়। একমাত্র বোন এবং বান্ধবীর এমন মৃ’ত্যুতে সে বেশ ভেঙে পড়েছে। বিধ্বস্ত, এলোমেলো হয়ে বসে মাটিতে বসে আছে৷ তাকে এমন অবস্থায় দেখে তামজীদের একটুও ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে এক্ষুণি গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিতে তবে সে অধিকার তার নেই। তাই অসহায় চোখে শুধু দেখছে। বেলীর হাতের মুঠোয় চিঠিটা এখনো আছে। তার আঁচলে বাঁধা। ছন্দের এমন নিথর মুখ দেখতে তার একটু ভালো লাগে না তবে ছন্দের এ অবস্থার জন্য যে দায়ী তাকেও ছেড়ে দেয়া যায় না। অনুভূতিশূণ্যের মতো উঠে দাঁড়ায় সে। কাউকে পরোয়া না করে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। নিজেদের মতো ব্যস্ত থাকায় কেউ টের পায় না বেলী নেই তবে তামজীদ ঠিকই তার পিছু পিছু ছুট লাগিয়েছে। বেলী এলোমেলো খোলা চুলেই গ্রামের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করে শাহিদের বাড়ি অনুসরণ করে। তামজীদ পেছন থেকে বেলীর হাত টেনে ধরে। বেলী তাকাতেই বেশ অস্থির কণ্ঠে বলে,

‘কোথায় যাচ্ছো এভাবে? কি অবস্থা এগুলো তোমার? চুল বাঁধো, বেলী।’

বেলী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চুল বাঁধে না, কোনো জবাবও দেয় না। উল্টো তামজীদের হাত আঁকড়ে ধরে বলে, ‘আপনিও আমাকে মে’রে ফেলবেন, তামজীদ ভাই? আপনিও শাহিদ ভাইয়ের মতো করবেন?’

তামজীদ বেশ অবাক হয়। বেলীর অবস্থা তার ঠিক লাগে না। বেলী নিজের মধ্যে নেই তা বুঝে বেলীকে টেনে নিজের একদম কাছে আনে। আশে পাশে দেখার মতো পরিস্থিতি তার নাই। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনো রকমে জিজ্ঞাসা করে,

‘কি হয়েছে, বেলী? এসব কি বলতেছো? আমি তোমাকে মা’রবো কেনো? ছন্দের সাথে কি হয়েছে?’

বেলী তামজীদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কোনো কথা ছাড়া-ই আবার হাঁটতে শুরু করে উল্টো পথে। তামজীদ বেলীকে একা ছাড়ে না। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ তার পিছু পিছু যায়। বেলী শাহিদের বাড়ির সামনে এসে নিজেকে শক্ত করে নেয়। চোখ বন্ধ করে বড় শ্বাস নিয়ে নিজের চুলগুলো বেঁধে নেয়। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ ফুলে গেছে। তামজীদ তখনো কিছু বলে না, সে শুধু দেখতে চাচ্ছে বেলী কি করে! বেলী শাহিদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে জোড়ে ডেকে ওঠে,

‘শাহিদ ভাই, এই শাহিদ ভাই! বের হয়ে আসেন।’

তার চেঁচানো দেখে তামজীদ এসে তার হাত চেপে ধরে। বেলী শুধু তার দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়। আবারও জোড় গলায় ডাকে শাহিদকে। শাহিদ ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে দেখে বেলী আর তামজীদ দাঁড়িয়ে আছে। স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে,

‘বেলী, তুমি এখানে?’

শাহিদের এতো স্বাভাবিক থাকাটা বেলী নিতে পারে না। তার চোখের সামনে ভাসে ছন্দের নিথর মুখটা। যেখানে প্রাণ ছিল না, হাসি ছিল না। তামজীদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সরাসরি দাঁড়ায় শাহিদের সামনে। ততক্ষণে শাহিদের নতুন বউও এসে দাঁড়িয়েছে। বেলী তার দিকে একবার তাকিয়ে হুট করেই নিজের গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে থা’প্পড় বসায় শাহিদের গালে। অপ্রস্তুত থাকায় শাহিদ খানিকটা পিছিয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকায় বেলীর দিকে। মাথা উচু করে তাকাতেই বেলী আরও একটা থা’প্পড় বসায়। তামজীদ ছুটে এসে বেলীকে থামায়। শাহিদের বউ এসে শাহিদকে আগলে দাঁড়ায়। তামজীদ ব্যস্ত কণ্ঠে বলে,

‘কি করছো, বেলী? ওকে মা’রছো কেনো? কি হয়েছে? বেলী!’

বেলী পাগলের মতো নিজেকে ছুটাতে চায়। তবে তামজীদের সাথে পেরে ওঠে না। শাহিদ তখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই বেলী কখনোই তার সাথে উচু গলায় কথাও বলেনি অথচ আজ তাকে মা’রলো! সে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে বলে? বেলী নিজেকে ছাড়াতে না পেরে ততক্ষণে শব্দ করে কাঁদছে। নিজের আঁচল থেকে চিঠিটা বের করে ছুড়ে মা’রে শাহিদের দিকে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

‘বেইমান কোথাকার! আপনার জন্য আমার বোনটা ম’রে গেছে। ‘ও’ তো শুধু আপনাকে ভালোই বেসেছিল আর আপনি কী দিলেন ওকে? মৃ’ত্যু? আপনি কিভাবে করলেন এটা? স্বার্থপর, বিশ্বাসঘাতক!’

‘বোন ম’রে গেছে’ কথাটুকু শুনেই শাহিদ থমকে গেছে। শাহিদের বউ আর তামজীদ বুঝল না কি হয়েছে। শাহিদ নিচ থেকে চিঠিটা উঠিয়ে নিবে সে শক্তিও তার নেই। ধপ করে নিচে বসে পড়ে সে। তামজীদ বেলীকে ছেড়ে দিয়ে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করে। সে বেশ জোড়েই পড়ে,

‘বেলী,

আমি জানি না তোকে কথাগুলো কিভাবে বলবো! মুখে বলার মতো সাহস পাচ্ছিলাম না বলেই চিঠি লিখছি। ক’দিন থেকেই বুঝতে পারছিলাম আমি মা হতে যাচ্ছি। একদিনে একটা ভুল আমাকে এই পরিস্থিতিতে আনবে আমি বুঝতে পারিনি। বিশ্বাস কর! আমি চাইনি এরকম হোক তবে হয়ে গেছে। আমি এই পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার আগেই আরও একটা খবর পেলাম। শাহিদ বিয়ে করেছে। নিজ চোখে ওকে আর ওর বউকে দেখে আসলাম। আমি নিতে পারছি না, বেলী। আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। আমি আব্বা-আম্মাকে মুখ দেখাবো কিভাবে? উনাদের মান সম্মান আমার জন্য সব চলে যাবে। আমি কিভাবে এসব বাড়িতে বলবো? আমি জানি না আমার কি করা উচিত তবে বেঁচে থাকার মতো সাহসটুকু আমার আর নেই। আমাকে মাফ করে দিস, বোন। আমি কথাগুলো শুধু তোকে বললাম, তুই এটা রহস্যই রাখিস। আব্বা-আম্মাকে ছোট হইতে দিস না৷ আমার মতো ভুল কখনো করিস না। ভালো থাকিস! আমার ভাইজানটা ভালো নেই, ওকে একটু দেখে রাখিস। এখন তো বোন হিসেবে ওর আর কেউ রইল না।’

ছন্দ মা হবে এটুকু শুনেই সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। শাহিদের বউ ঘৃ’ণ্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তামজীদের প্রচন্ড রকমের রাগ হয়। সে চিঠিটা হাতের মুঠোয় নিয়েই রাগে গিয়ে শাহিদের নাক বরাবর দু’টো ঘুষি মে’রে দেয়। আরও মা’রতে গেলে বেলীই আটকায়। শাহিদ তখনও স্তব্ধ হয়ে আছে। বেলী কাঁদতে কাঁদতেই বলে,

‘একে আর মে’রে নিজের হাত ন’ষ্ট করবেন না, তামজীদ ভাই। চলেন!’

শাহিদের বউ মাথায় হাত দিয়ে বসে কাঁদছে। তার বিয়ে হয়েছে ক’দিন হলো অথচ এতো বড় সত্যি সামনে চলে আসলো! শাহিদের নাক থেকে র’ক্ত পড়ছে তা দেখেও বউটা এগোতে পারলো না। ইচ্ছেই করলো না এমন একটা পুরুষকে ছুঁয়ে দিতে। শাহিদ নিজেও নিজের নাক থেকে বের হওয়া র’ক্তটুকু মোছে না। কোনো রকমে এলোমেলো পায়ে উঠে ছন্দের কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। যাকে সে ভালোবেসেছিল তার সাথে সাথে নিজের অংশটুকুও হারিয়েছে সে। তার বুকের বা’পাশের ব্যাথায় মনে হয় এক্ষুণি মা’রা যাবে। শাহিদ অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত গিয়েই মাটিতে পড়ে যায়। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়ছে। ধীরে ধীরে কাঁদতে কাঁদতে শব্দ করে কেঁদে ওঠে। ছন্দর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে বলে,

‘তুমি একটাবার আমারে বলার সুযোগও দিলা না, ছন্দ! একটাবার জিগাইলাও না আমি তোমারে সত্যিই ভালোবাসছিলাম কি না? তুমি আমার অংশ-রে বড় করতাছিলা অথচ জানাইলাও না। ছন্দ! বিশ্বাস করো আমি এক জীবনে তোমারেই ভালোবাসছি। এই পৃথিবীতে আর কেউ এমন নাই যারে আমি ভালোবাসতে পারবো। আমি বিয়েটা করতে চাই নাই ছন্দ। বিশ্বাস করো! তুমি আমারে শাস্তি না দিয়া নিজেরে দিলা? কেন করলা এমন? আমি এখন কেমনে বাঁচবো? কেমনে?’

রাস্তায় পড়েই শাহিদ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ছন্দকে সে সত্যিই ভালোবেসেছিল তবে পরিস্থিতি দুজনকে দু’দিকে নিয়ে গেছে। তবে এখন? ছন্দের এই মৃ’ত্যুতে শাহিদ নিজেও যেনো আধম’রা হয়ে গেছে।


তামজীদ এসে সবটা সাহিত্যকে বলেছে। তার পাশে সাইরাহ্ ছিল সেও শুনেছে পুরোটা। তার বিশ্বাস-ই হচ্ছিলো না। সাহিত্য রেগে শাহিদকে মা’রতে যাচ্ছিলো তবে তামজীদ তাকে থামিয়ে দেয়। আপাতত ছন্দের পোস্টমর্টেম থামাতে হবে আর তাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো এরা ছন্দকে কবরও দিতে দিবে না। সাহিত্য আর তামজীদ পুলিশের সাথে কথা বলতে যায়। সাইরাহ্ তাদের দিকে তাকিয়ে বেলীর কাছে যায়। বেলী তাকিয়ে আছে ছন্দের দিকে। সাইরাহ্ তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নরম স্বরে বলে,

‘কষ্ট পেও না, বেলী। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

বেলী সাইরাহ্-র মুখের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। সাইরাহ্-কে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে থাকে। সাইরাহ্ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কাছের মানুষ হারিয়েছে তাই একটু কাঁদলে তাতে মেয়েটারই ভালো লাগবে। তামজীদ আর সাহিত্য উপরে কথা বলে পোস্টমর্টেম আটকায়। আত্ম’হ’ত্যা করা ম’রদেহগুলোকে জানাযা দিতে চায় না তারপরও সাহিত্য আর তামজীদ ইমামের সাথে কথা বলে অনেক অনুরোধ করে রাজি করায়। ধরা হয় যোহরের পর ছন্দের জানাযা হবে। ডবাই মিলে ছন্দের লা’শ নিয়ে প্রধানের বাড়ির সামনে যাওয়া হয়। সাইরাহ্ তখনো বেলীকে সামলাচ্ছে। বাড়ির সবার আহাজারি আরও বাড়ছে। ধীরে ধীরে সময় গড়াতে থাকে। যেখানে যত আত্মীয় ছিল সবাই আসে ছন্দকে দেখতে। কেউ কানাঘুষা করে তো কেউ এতো কম বয়সে মা’রা যাওয়ায় বেশ আফসোস করে। সবার মাঝে শাহিদও এসেছে, সাথে শাহিদের বউও আছে। তার আসার ইচ্ছে ছিল না তবে তার নিজেকেও বেশ অপরাধী মনে হয়েছে তাই একটাবার ছন্দের মুখটা দেখতে এসেছে। শাহিদ অনুভূতিশূণ্যের মতো ছন্দের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ছন্দের মুখের হাসিটা তার চোখে ভাসে। শাহিদ তাকায় ছন্দের পেটের দিকে। অনুভব করে সেখানে বাড়তে থাকা ভ্রুণটাও আর নেই। শাহিদের সহ্য হয় না এসব। তার বুক জ্বলতে শুরু করে। সেখান থেকে ছুটে বেড়িয়ে যায়। শাহিদের বউটা শেষ একবার ছন্দের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘আমাকে মাফ করে দিও, বইন। আমি জানতাম না কিছুই। জানলে কখনো তোমার শেষ হওয়ার কারণ হইতাম না। আল্লাহ তোমারে মাফ করুক।’

সাইরাহ্ শাহিদ আর তার বউকে দেখেছে। শাহিদকে দেখেই সে ধরে নিয়েছে পাশেরটা তার বউ। সাইরাহ্ একবার সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে দেখে সে বসে আছে। তার শরীরটা বেশি ভালো না। জ্বর কমলেও সে ভালোই দুর্বল এখনো। নাজিরার কাছে বেলীকে সামলাতে দিয়ে সে যেতে নেয় সাহিত্যের দিকে তবে তার কাছ অব্দি যাওয়ার আগেই নজরে পড়ে সীমান্ত। সীমান্তের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আদরের বোনটার এমন অবস্থা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। একবার বড় ভাইকে হারিয়েছে আজ আবার ছোট বোনকে হারালো। সময়টা তার বিপরীতেই কেনো এভাবে ছুটছে? মন ভাঙা ছিলোই এখন আরও দুর্বল হওয়ায় সে এসব নিতে পারে না। ট্রমায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। সাইরাহ্ সাহিত্যের দিকে না গিয়ে ছুটে যায় সীমান্তের কাছে। তার চিৎকারে বাকি সবাইও সেদিকে তাকায়। সাহিত্য আর তামজীদ ছুটে যায়। সাইরাহ্ সীমান্তের মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে ডাকতে শুরু করে। এ দৃশ্য দেখে সাহিত্যের পোড়ে। তবুও নিজেকে শক্ত করে নিয়ে সীমান্তকে ধরে। তামজীদকে বলে,

‘ওকে ঘরে নিতে হবে।’

এরপর অন্য একজনকে ডেকে ডাক্তার আনতে বলে। কয়েকজন মিলে ধরে সীমান্তকে ঘরে নেওয়া হয়। পিছু পিছু সাইরাহ্, নাজিরা, বেলীও যায়। সীমান্তের মা ছেলে-মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আরও জোড়ে জোড়ে কাঁদছেন। সীমান্তকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে সাহিত্য বলে,

‘পানি লাগবে।’

সাইরাহ্ নিজ থেকেই টেবিল থেকে পানি নিয়ে সাহিত্যের দিকে এগিয়ে দেয়। সাহিত্য পানি নিলেও তার দিকে তাকায় না। পানি সীমান্তের মুখে ছিটিয়ে দেয়। সাইরাহ্ চিন্তিত দৃষ্টিতে একবার সাহিত্যের দিকে তাকায় তো একবার সীমান্তের দিকে তাকায়। সীমান্তের জ্ঞান ফিরলে সে অসহায়ত্বে সাহিত্যকে জড়িয়ে ধরেই কাঁদতে শুরু করে। নাজিরা আর সাইরাহ্ একে অপরের দিকে তাকায়। দুজনেরই বেশ খারাপ লাগে। বেলী সীমান্তের বুকে হাত রেখে বলে,

‘ভাইজান, আপনি কাঁদবেন না। ছন্দ খুব কষ্ট পাবে আপনি কাঁদলে।’

এ কথা শুনে সীমান্ত আরও সহ্য করতে পারে না। সাহিত্য সব ভুলে বন্ধুকে আগলে রাখে। ততক্ষণে ডাক্তারও এসে পড়ে। সীমান্তকে দেখে ঔষধ দিয়ে শান্ত থাকতে বলে চলে যায়। এ পরিস্থিতিতে কি আর শান্ত থাকা সম্ভব? বোনটা যে বড্ড আদরের ছিল।


ছন্দের জানাযার শেষে সবাই আবার প্রধানের বাড়ি যায়। যে বাড়িতে সাইরাহ্-র পা দেওয়া মানা ছিল সে বাড়িতেই সে এখন বসে আছে। জীবন আসলেই অদ্ভুত নয়তো এমন হয় কেনো? সাহিত্যের শরীর দুর্বল ছিল তবুও সে প্রধানের সামনে যায়। আজ একে কয়েকটা কথা না বললেই নয়। সাহিত্য মাথার টুপি নামিয়ে নিয়ে প্রধানকে বলে,

‘কেমন লাগতেছে?’

প্রধান মাথা তুলে তাকালেন। বুঝতে না পেরে শুধালেন, ‘মানে?’

‘মানে বোঝেননি, মামা সাহেব? ফিরোজ তাঁতির মেয়ে মা’রা যাওয়ার সময় কি কি বলছিলেন মনে আছে? ওর মেয়েও আত্ম”হ’ত্যা করছিল আর আপনার মেয়েও তা-ই করেছে। তা এখন আপনারা সমান তো? মেয়ে হারানো বাবা? তখন তো ওর মেয়েকে গালাগালি দিসিলেন এখন নিজের মেয়েকে দিবেন না?’

প্রধানের চোয়াল শক্ত হল। সে রাগী কণ্ঠে বলে, ‘সাহিত্য!’

‘কি? সত্যি কথা বলতেছি দেখে গায়ে লাগতেছে? ফিরোজ তাঁতির সাথে কি করছিলেন মনে আছে, মামা সাহেব? ওর মেয়ের বিয়ের আগেই বাচ্চা হবে বলে ওকে গ্রাম থেকে কিভাবে বের করছেন মনে আছে?’

প্রধান জবাব দেয় না শুধু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সাহিত্য চোখে চোখ রেখে চোয়াল শক্ত করে বলে, ‘আপনার মেয়ের পেটেও বাচ্চা ছিল। এখন কি করবেন? এখন বের হন গ্রাম থেকে।’

প্রধান হুংকার দিয়ে ওঠে। সাহিত্য একটুও দমায় না। নিজে দ্বিগুণ শক্ত গলায় বলে, ‘গলা নামায়ে কথা বলেন নাহলে সবাই জেনে যাবে। যা বলতেছি আর এক বিন্দুও মিথ্যা না। পোস্টমর্টেম কি এমনিই হইতে দেইনি ভাবছেন? ছন্দ আমার বোন না হইলে আজকে আপনার গলার ওপর উঠতো এসব। গ্রামবাসী জানলে কি করতো জানেন? সোজা আপনার ঘাড় ধরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতো।’

প্রধান পারছে না শুধু সাহিত্যকে উঠে মা’রতে। তবে সাহিত্যের এমন উঁচু গলা আর এমন বিশ্বাস ভরা কণ্ঠে কিছুই বলার থাকে না। এতো জোড় গলায় কেউ মিথ্যা বলবে না। সাহিত্য চুপচাপ উঠে যায়। এই লোকটাকে কে’টে টুকরো টুকরো করলেও মন শান্ত হবে না। কিছু মানুষ থাকে না যারা কখনো মানুষ হয় না? এরা ওই পর্যায়েই পড়ে। সাহিত্য এসে সাইরাহ্ আর নাজিরাকে বলে,

‘তোরা এখানে থাকবি? নাকি বাড়ি যাবি?’

সাইরাহ্ নিজের শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সবাই তো এখানে।’

‘আমি বাড়ি যাচ্ছি।’

সাহিত্য একাই বের হতে গেলে সাইরাহ্ পিছু পিছু যায়। সাহিত্যের ক্লান্ত লাগে। ছন্দ তারও বোন ছিল। ছন্দ, বেলী, নাজিরা কাউকেই কখনো আলাদা করে দেখেনি সাহিত্য। এক বোনকে কবরে রেখে এসে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। সীমান্ত তো নিজের দুঃখটুকু দেখিয়ে দিল সে কিভাবে দেখাবে? পুরো রাস্তা কেউ কারো সাথে কথা বলে না। সদর দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকতেই সাইরাহ্ সাহিত্যের হাত টেনে ধরে। সাহিত্য তাকাতেই সাইরাহ্ তাকে টেনে জড়িয়ে ধরে। সাহিত্য অবাক হয় তবে তাকে আরও অবাক করে দিয়ে সাইরাহ্ বলে,

‘আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। কাঁদতে মন চাচ্ছে তাই না? কাঁদেন, আমি আছি।’

সাহিত্য কান্না ভুলে যায়। সাহেবা তাকে বোঝে? সাহিত্য শক্ত করে দু হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে। কাঁধে মুখ গুজে দিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। সাইরাহ্ সাহিত্যের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। লম্বা শ্বাস নিয়ে মনে মনে আওড়ায়,

‘সীমান্ত ভাইয়ের প্রতি আজ যা ছিল তা কেবল মনুষ্যত্ব। তবে আপনার প্রতি আজ একটা প্রতিজ্ঞা। যতবার আপনার কাঁদতে ইচ্ছে হবে আমি ততবার আপনাকে কান্না করার সুযোগ করে দিবো, পাশে থাকবো।’

চলবে..