মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-০৬

0
45

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ৬

সকালে ফজরের নামাজ শেষে এক ঘন্টা হাঁটার অভ্যাস নওশাদের। শরীর আর মন দুইটাই ভালো থাকে এতে। সকালের তাজা বাতাস শরীরে লাগালে সারাদিন ভালো যায় তার।
আজও হাঁটার জন্য তৈরি হচ্ছে সে। এতো সকালে বাড়ির কেউ সাধারণত ঘুম থেকে ওঠে না।
“মামা।”
দরজার বাইরে উৎসের গলার আওয়াজ শুনে কিছুটা চমকে ওঠে নওশাদ। এতো সকালে উৎস তাকে ডাকছে? কোনো বিপদ হলো না তো?
তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতেই দেখে উৎস ভীষণ শান্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ওর চেহারা দেখে কখনোই বোঝার উপায় নেই কোনো সমস্যা কিনা। সবসময়ই কেমন নির্লিপ্ত থাকে ছেলেটা।

“উৎস তুই এতো সকালে? কিছু বলবি?”
“মামা আসলে আজ থেকে ক্লাসে যাবো। অনেকদিন তো হলো। বাড়িতে থাকতে আর ভালো লাগছে না। তাছাড়া সামনেই টার্ম ফাইনাল।”
“অনেকদিন কোথায় হলো? মাত্র তিনদিন হলো এমন একটা বিপদ থেকে উঠেছিস। এখনো শরীর সুস্থ না। ক্ষত শোকায়নি, হাঁটছিসও খুঁড়িয়ে। এই অবস্থায় তোকে ভার্সিটিতে যেতেই হবে?”
উৎস ক্ষীণ গলায় বললো,”সমস্যা হবে না মামা।”
নওশাদ ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বললো,”তুই কি আমার কাছে অনুমতি চাইতে এসেছিস নাকি নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছিস?”
উৎস উত্তর দেয়না, নওশাদ যা বোঝার বুঝে যায়। উৎস যখন একবার ঠিক করেছে সে আজ থেকেই ক্লাসে যাবে, তার মানে সে যাবেই। কেউ আটকাতে পারবে না তাকে। তবে নওশাদ চায়নি এতো তাড়াতাড়ি ছেলেটা ভার্সিটিতে যাক। পরিবেশ এখনো গরম, অপরাধীদের ধরাও হয়নি এখনো। উৎসের শত্রুপক্ষ বুক ফুলিয়ে হাঁটছে ক্যাম্পাসে। যদি কোনো বিপদ হয়? কিন্তু উৎস কি কিছু শুনতে চায়?

“বেশ যাবি যখন ঠিক করেছিস আমি আর কি বলবো।”
“মামা রাগ করলেন আপনি?”
নওশাদ সুন্দর করে হাসে উৎসের দিকে তাকিয়ে।
“তোর উপর আমি কখনোই রাগ করতে পারিনা উৎস। এটা আমার একটা দূর্বলতা বলতে পারিস। আমার তিন মেয়ের উপর আমার রাগ হলেও তোর উপর কখনোই আমার রাগ হয়না।”
উৎস মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে নিজেও যে এই মানুষটাকে অসম্ভব ভালোবাসে এটা কি তার মামা বোঝে? নিশ্চয়ই বোঝে, মুখ ফুটে তো কিছুই বলতে পারবে না ও কখনো।

“মামা।”
“বল।”
“আপনি না বললেন সেদিন আগের মতো আর আড্ডা দেওয়া হয়না আমার সাথে। আজ আমি আপনার সাথে হাঁটতে বের হই?”
নওশাদ অবাক হয়ে উৎসের দিকে তাকায়। আজ সূর্য কোনদিক দিয়ে উঠলো? উৎস কিনা তার সাথে গল্প করার জন্য হাঁটতে যেতে চায়? নিজের খোলসের বাইরে জোর করেও যাকে টেনে বের করে আনা যায়না।
“তুই সত্যি হাঁটতে যাবি আমার সাথে?”
“আপনার যদি খুব অসুবিধা না হয়।”
নওশাদ শব্দ করে হাসে।
“আমার আবার কি অসুবিধা রে বোকা ছেলে। কিন্তু তোর পায়ের যা অবস্থা।”
“ও কিছু না মামা, চলুন বের হওয়া যাক।”
নওশাদের চোখে পানি চলে আসে। এই ছেলেটাকে সে এতো ভালোবাসে কেনো? কি মায়া আছে ছেলেটার মধ্যে?

উৎসের পায়ের অবস্থা বিবেচনা করে আজ বেশিক্ষণ হাঁটে না নওশাদ। খুব ছোট থাকতে মাঝে মাঝেই বহ্নি, উৎস আর শীতলকে নিয়ে সকালে বাইরে নাশতা করতো নওশাদ। আভা অনেক ছোট থাকায় ওকে রেখেই আসা হতো।
সেই দোকানটা এখনো আছে। নওশাদ উৎসকে নিয়ে দোকানে ঢোকে। উৎস যদিও আসতে চায়নি, নওশাদ জোর করে ধরে এনেছে।

“কি খাবি?”
“আপনি যা চান অর্ডার দেন। আমার খিদা নেই।”
“তোরা এই বয়সের ছেলেগুলো যে কি, বুঝিনা।”
বেশ কিছুক্ষণ দুইজন চুপ করে থাকে। চাইলেও আগের মতো আড্ডা দেওয়া হচ্ছে না। কেউ কথা খুঁজে পায়না। কোথায় যেনো সুরটা কেটে গেছে।

“উৎস একটা কথা বলবো?”
“বলুন মামা।”
“মশাকে কখনো শরীরের উপর বসতে দেখেছিস?”
“দেখবো না কেনো?”
“মশা যখন তোর শিরা রন্ধ্রে নিজের সুঁচ ঢুকিয়ে দেয়, সাথে সাথে যদি তুই মারতে যাস ও উড়ে যাবে। কিন্তু তুই যদি ওকে রক্ত খাওয়ার সময় দিস। ও আস্তে আস্তে ডুবে যাবে রক্তের মিষ্টতার মধ্যে। নেশায় পেয়ে বসবে ওকে। ও মনের সুখে রক্ত খেয়েই যাবে, কারণ ও আনন্দ পাচ্ছে। শেষ মুহুর্তে এমন একটা অবস্থা হবে যে ও চাইলেও আর উড়তে পারবে না, নড়তে পারবে না৷ সহজেই তুই মেরে ফেলতে পারবি ওকে।”
উৎস চুপ করে থাকে। সে বুঝতে পারে মামা এই উদাহরণ কেনো দিলো তাকে।
“রাজনীতি জিনিসটাও এমন। না আমি তোকে অনুৎসাহিত করছি না। আমি জানি, তুই খারাপ কিছু করতেই পারিস না। তবে কখন তোকে ফিরে আসতে হবে এটা তোকে বুঝতে হবে। নাহলে একদম এটার মধ্যে ডুবে বুঁদ হয়ে গেলে, পরে আর ফিরে আসার সুযোগ থাকবে না। চাইলেও পারবি না। পিষে ফেলা হবে তোকে। তুই কি বুঝতে পারছিস আমি কি বলছি?”
“বুঝতে পারছি মামা। কিন্তু…..”
“কিন্তু?”
“একদিন না একদিন তো মশাটিকে মরতেই হতো। সে যে রক্তটুকু চুষে নিলো, এতে কিছুটা তো ক্ষতি মানুষের হলো। তাইনা?”
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,”তুই কি বলতে চাস? শত্রুর ক্ষতি করার জন্য তুই মরতেও পিছপা হবি না? তোর মায়ের কথা একবার ভাববি না তুই? আমাদের আর কারো কথা না ভাবিস, কিন্তু ওই মানুষটা? সারাজীবন কি পেলো? আমার নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারে কোনো সুখ দিতে পারলাম না। কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে তোর দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন কাটালো। চেয়েছিলাম আবার বিয়ে দিতে, রাজি হয়নি। শুধুমাত্র তোর জন্য একটা মানুষ নিজের পুরো জীবনটা শেষ করলো। তার উপর তোর কোনো দায়িত্ব নেই?”
নওশাদ থামে, উৎস তাকে বলতে দেয়। থামানোর চেষ্টা করে না একবারও।

“তুই রাজনীতি করিস, সিগারেট খাওয়া শুরু করেছিস আমি সব জানি আগে থেকেই। তুই হয়তো আমাকে ধর্তব্যের মধ্যেই মনে করিস না। কিন্তু আমি সব খবর রাখি। তোর ব্যাপারে এমন আরো কিছু জানি, যা তুই ভাবতেও পারছিস না।”
উৎস নওশাদের চোখের দিকে তাকায়। এই মুহুর্তে সামনে বসে থাকা মানুষটাকে অনেকটাই অপরিচিত লাগে উৎসের। তার ব্যাপারে আর কি জানে এই মানুষটা?

“সে যাই হোক, আমি যা বলছিলাম….”
“মামা।”
নওশাদকে হঠাৎ থামিয়ে দেয় উৎস।
“বল।”
“এখানে দমবন্ধ লাগছে। নদীর পাড়ে বসে কথা বলি কিছুক্ষণ?”
নওশাদ বুঝতে পারে উৎস তাকে কিছু বলতে চায়। এজন্যই সে বের হয়েছে তার সাথে। অথচ তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, সে নিজেই বকাবকি করে যাচ্ছে।
নওশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”চল।”

সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে সকাল সকাল নদীর পাড়টায়। সারাদিনে বিভৎস গরম পড়লেও সকালের এই সময়টায় ঠান্ডা হাওয়া দেয়। বেশ ভালো লাগে।
নওশাদ ঘাটে বসে। উৎস দুই সিঁড়ি নিচে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে নদী দেখে।

“তুই কি সিগারেট ধরাতে চাস? ধরালে ধরাতে পারিস। তবে কথা কি ছিলো মনে আছে তো? আমাকেও একটা দিতে হবে।”
উৎস সুন্দর করে হাসে। নওশাদ কিছুক্ষণ হাসি দেখে উৎসের। ছেলেটাকে একটু রাগ করারও উপায় নেই। এতো সুন্দর হাসি নিয়ে কেনো কোনো পুরুষ দুনিয়ায় আসবে? মায়াবতীর যে কোনো পুরুষবাচক শব্দ নেই।

“না মামা সিগারেট প্রয়োজন হবে না। তবে আমি আপনাকে আমার জীবনের একটা তিক্ত সত্যির কথা জানাতে চাই। আমি ছোট থেকেই বড্ড চাপা স্বভাবের, আপনি জানেন। আমি ব্যথা পেলেও কাউকে জানাইনা, খুশি হলেও তাই। তবু আজকে আমার মনে হচ্ছে আপনাকে জানানো দরকার।”
“কি ব্যাপার উৎস? কি হয়েছে?”
উৎস একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,”আমি কেনো বা কীভাবে এই ভয়ংকর জীবনে জড়িয়ে গেলাম তা বলবো আপনাকে। হয়তো আমার প্রতি থাকা রাগ বা অভিমান একটু হলেও কমবে আপনার।”
নওশাদ বেশ অবাক হয়ে উৎসের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ অপরিচিত লাগছে তাকে। পরিণাম না ভেবে কিছুতে জড়িয়ে যাওয়ার ছেলে তো উৎস নয়।

“কি রে শীতল? উঠবি না আজকে? কলেজ নেই নাকি?”
শীতল কম্বলে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। বহ্নির কথার উত্তর দেয়না। বহ্নি কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়। এই ভ্যাপসা গরমে মেয়েটা কম্বল পেঁচিয়েছে কেনো গায়ে?
বহ্নি এগিয়ে এসে শীতলের কপালে হাত রাখতেই চমকে ওঠে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। গতকাল রাতেও তো সুস্থ ছিলো, এতো জ্বর এলো কখন?
“শীতল, এই শীতল।”
শীতল ঘোলাটে চোখে তাকায় বহ্নির দিকে, চোখ রক্তের মতো লাল তার। বহ্নি ভয় পেয়ে যায়। তিন বোনের মধ্যে আভা একটু ঘন ঘন অসুস্থ হয়। কিন্তু শীতলের তেমন কিছুই হয়না। অনেক বছর পর এমন জ্বর এলো।
“আভা মা কে ডাক, শীতল অনেক অসুস্থ। ওর মাথায় পানি দিতে হবে।”
আভা আতঙ্কিত হয়ে শীতলের দিকে তাকায়। তিন বোনের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বাকি দুইজন দিশাহারা হয়ে যায়। শীতলের সাথে সারাদিন ঝগড়া করে সে। কিন্তু আজকে তাকে এই অবস্থায় দেখে ভীষণ কষ্ট হতে থাকে তার।

“মামা সেবার প্রথম প্রথম ভার্সিটিতে উঠেছি। আমি তো কারো সাথেই সেভাবে মিশতে পারতাম না জানেন আপনি। ক্লাসে যেতাম আবার ফিরে আসতাম বাড়িতে। এ বাদে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘোরাঘুরি কিছুই করতাম না। বন্ধুই তেমন ছিলোনা। ওগুলো আমাকে বিশেষ টানতো না। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম একটা ছেলে আমার সাথে মিশতে চাচ্ছে। আমার পাশে বসতো, যতোটা সময় ভার্সিটিতে থাকতাম ছায়ার মতো আমার পাশে থাকতো। আমার ভালোও লাগতো না আবার বিরক্তও লাগতো না। জানেন মামা, ওর মায়ের বানানো পিঠা, নাড়ু এগুলো খাওয়াতো আমাকে এনে। আমি চাইতাম না, জোর করে দিতো। গ্রাম থেকে আসা ছেলেটা নিতান্তই সাদামাটা। পারলাম না ওর থেকে দূরে থাকতে বেশিদিন। হয়ে গেলো বন্ধুত্ব। অবশ্য ওর সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার আরো একটা কারণ ছিলো। আমাদের মধ্যে একটা মিল ছিলো। ওর ও বাবা নেই, শুধু মা ছিলো। কিন্তু আমার মাথার উপর যেমন বটবৃক্ষের মতো আপনি ছিলেন, ওর মাথার উপর তা-ও ছিলো না। সেই কলেজ থেকেই নাকি টিউশন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতো আবার মা’কেও দিতো। ওর মা ওদের এলাকার চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতো। এখানে এসেও থেমে থাকতো না মামা। অমানুষিক পরিশ্রম করতো রাতদিন। ক্লাস শেষেই বেরিয়ে পড়তো টিউশন করাতে। চার থেকে পাঁচটা টিউশন করে রোজ হলে পৌঁছাতো অনেক রাতে। তার উপর আবার নিজের পড়া করতো। দুপুরে শুধু দুইটা সিঙ্গারা খেয়ে কাটাতো। আমি জিজ্ঞেস করলেই বলতো তার নাকি সিঙ্গারা খুব পছন্দ তাই খায়। কিন্তু আমি জানতাম এটা ও কেনো করে। দুইটা টাকা বাঁচলেও মা’কে পাঠাতে পারলেই তার ভালো লাগতো। আমি মাঝে মাঝেই মায়ের কাছ থেকে ভাত নিয়ে যেতাম ওর জন্য। সেদিন ও গোগ্রাসে খেতো ভাত। সাধারণ তরকারিও ওর কাছে অমৃত লাগতো। কি যে মায়া লাগতো মামা ওকে দেখে। এতো সহজ সরল একটা ছেলে, ওকে মারলেও যেনো হাসতো। ওর নাম ছিলো নিশান।”
নওশাদ টেরই পায়নি কখন তার চোখ পানিতে ভরে গেছে। উৎসের মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।
“তারপর কি হলো?”
“এভাবেই চলছিলো মামা। আমাকে কেনো যেনো ও ভীষণ ভালোবাসতো। বলতো আমি নাকি ওর ভাই। আমিও কেনো জানি ওকে অনেক ভালোবেসে ফেললাম। ওর সরলতা মুগ্ধ করতো আমাকে। ও জটিল কিছু ভাবতেই পার‍তো না। অনেক স্বপ্ন ছিলো ওর। ভার্সিটি থেকে পাশ করে অনেক বড় চাকরি করবে, মা’কে ভালো রাখবে।”
“তারপর?”

উৎস কিছু সময় চুপ থেকে হঠাৎই একটা সিগারেট ধরায়, নওশাদ আটকায় না।
“মামা আমি এখন যে কথাটা বলবো, তার জন্য আমার মস্তিষ্কটা ঠান্ডা রাখা লাগবে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন।”
“সমস্যা নেই, আমি শুনছি।”
উৎস ধোঁয়া ছাড়তে থাকে, নওশাদ তাকে জোর করেনা।

“ফেব্রুয়ারির শেষ প্রায় তখন, ঠান্ডাটা কমে যেয়েও আবার কেনো জানি বেড়ে গেলো হঠাৎ। এরমধ্যে একদিন ভার্সিটির বড় ভাইরা রাতে আমাদের ক্লাসের কয়েকটা ছেলেকে হলে ডাকে। আমরা কিছু বুঝতে পারছিলাম না, হঠাৎ আমাদের কেনো? আমাদের মধ্যে নিশানের নামটাও ছিলো। তবে ওকে বলা হয়েছিলো আমাদের যাওয়ার কিছু সময় আগে একা যেতে। আমার মনটা কেমন কু ডাকছিলো। আমি ওকে একা ছাড়তে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিলো না।”
উৎস থামে। অর্ধেক সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে পানির মধ্যে। নওশাদ উঠে যেয়ে উৎসের কাঁধে হাত রাখে।
“তোর যদি বেশি খারাপ লাগে বলিস না, পরে শুনবো।”
“না মামা, আমি আজকেই বলবো। আমি ঠিক আছি, চিন্তা করবেন না।”
“বেশ, বল।”
“আমরা বাকিরা যখন ওখানে পৌঁছাই তখন ওখানে নিশানকে কোথাও দেখতে পাইনা। আমার খটকা লাগে। আমি ওই বড় ভাইদের জিজ্ঞেস করি নিশানের কথা। তারা উত্তর দেয়না। তারা যতো এড়িয়ে যায় আমার সন্দেহ ততো বাড়ে। মামা জানেন ওই সময় আমার মাথা কাজ করছিলো না। আমার মনে হচ্ছিলো নিশান ভয়াবহ কোনো বিপদে আছে আর যে কোনো মূল্যে আমাকে ওকে বাঁচাতে হবে। আমি ছাড়া ওখানে ওর জন্য কেউ ছিলোনা। ওর ও আমি বাদে আর কোনো বন্ধু ছিলোনা ক্লাসে। আমি জোর করতে থাকি নিশানের খোঁজ নেওয়ার জন্য। ক্লাসের বাকিরা আমাকে আটকানোর চেষ্টা করে, বলে বিপদ হবে। কিন্তু ওই মুহুর্তে নিশান ছাড়া আর কোনো বিপদের চিন্তা আমার মাথায় নেই। আমি কিছু চিন্তা না করেই বড় ভাইদের মধ্যে নেতা গোছের একজনের কলার চেপে ধরি। আমার দুনিয়ায় তখন আর কোনো চিন্তা নেই। ওদের মধ্যে কয়েকজন আমাকে ছাড়িয়ে নেয়। যার কলার ধরেছিলাম সে এসে বিরতিহীন ভাবে আমাকে ঘুষি দিতে থাকে। আমার মুখে, ঘাড়ে, বুকে, পেটে। মামা আমি নিজেকে যতো ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করি, ততো ওরা আমাকে বেশি চেপে ধরে। কেউ বাঁচাতে আসেনা আমাকে, কেউ না।”
নওশাদ শিউরে ওঠে। আসলেই তার মনে পড়ে সেদিনের কথা। উৎস বলেছিলো সে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, কিন্তু……?

“মামা আমাকে ওরা আধমরা করে ফেলে। আমি হাঁটতেও পারছিলাম না। এরপর আমাকে নিশানের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে বলা হয়। আমি ওই পরিস্থিতিতেও খুশি হই। মরি মরবো, তবুও আমার বন্ধুকে তো দেখতে পারবো। আমাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হয় ধরে। আমার মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে তখন, আমার শার্ট ভিজে যায় রক্তে। আমার রক্তেমাখা শার্টটা খুলে ছাদে যাওয়ার আগে ওদের একটা জামা পরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ছাদে যেতে না যেতে আমার খুশিটুকু উড়ে যায় মামা। আমি সেই দৃশ্যের কথা এখনো ভাবতে পারিনা।”
উৎস দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সে৷ হতবাক হয়ে যায় নওশাদ। উৎসকে এ পর্যন্ত কখনো কাঁদতে দেখেনি সে, কখনোই না। যতো কষ্ট পাক, ব্যথা পাক ও কাঁদে না। কিন্তু সেই ইস্পাতের মতো শক্ত ছেলেটাকে এভাবে কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে যায় নওশাদ। কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা।

শীতলের জ্বর হু হু করে বাড়ছে। শাহানা আর সায়েরা হতবিহ্বল হয়ে যায়। নওশাদ বা উৎস কেউ নেই বাড়িতে। এতো সময় তো নওশাদ বাইরে থাকে না সকালে। কোথায় গেলো দুইজন? কেউ হদিস পায়না। বহ্নি শীতলের মাথায় পানি ঢালে ব্যস্ত হয়ে। আভা শীতলের হাত চেপে ধরে বসে থাকে। ভীষণ অসহায় লাগে তার।
হঠাৎ দরজায় আঘাতের শব্দ শুনে আভা বাতাসের বেগে ছুটে যায়। এক্ষুনি ডাক্তার ডাকতে হবে, বাবা বা উৎস ভাই যে-ই আসুক।
কিন্তু দরজা খুলতেও থমকে যায় আভা। সামনের মানুষটাও অপলক দেখতে থাকে তাকে।

“আপনি?”
“আভা তুমি ঠিক আছো?”
আবির চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আভার দিকে। ওই ঘটনার পর আভাকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছিলো না আবির। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া তো হুটহাট চলে আসা যায়না। আজ উৎসকে ভার্সিটিতে নিয়ে যাওয়ার বাহানায় সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছে ‘খাঁ’ বাড়িতে। দরজা আভা খুলুক তাই চেয়েছিলো সে ঠিকই, কিন্তু তার এই চেহারা তো সে দেখতে চায়নি। কেমন আতঙ্কিত হয়ে আছে।

“আবির ভাই, উৎস ভাই কোথায়?”
“মানে কি বলছো? উৎস বাড়িতে নেই? আমি তো ওকে নিতেই এসেছি।”
আভা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বললো,”মেজো আপার খুব জ্বর আবির ভাই, এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। বাবা বা উৎস ভাই কেউ নেই বাড়িতে।”
আবির থতমত খেয়ে যায়। এই অবস্থায় তার কি করা উচিত বুঝতে পারেনা। কিন্তু যাই হোক, এই মেয়েটার মুখে হাসি ফোটাতেই হবে যে করেই হোক।

“আচ্ছা তুমি দয়া করে কেঁদো না। আমি দেখছি কি করা যায়। আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। তুমি কিন্তু কাঁদবে না হ্যা?”
“চুপ থাকেন তো আপনি। আমার মেজো আপা অসুস্থ, জ্বরে কাতরাচ্ছে আর আমি কাঁদবো না তো কি নাচবো?”
আবির চুপ করে যায়। চোখে পানি নিয়েও যে কোনো মেয়ে এভাবে কথা বলতে পারে তার জানা ছিলো না।
“আচ্ছা তুমি কাঁদো, আমি ব্যবস্থা করছি কেমন?”
আবির আর দাঁড়ায় না। যেতে যেতে আরেকবার পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখে আভা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রহস্যময়ী মেয়েটাকে অসাধারণ লাগে আবিরের।

“উৎস আমি আর শুনবো না বাবা। বাড়ি চল তুই। তুই এভাবে কাঁদলে আমি ঠিক থাকতে পারিনা তুই জানিস না?”
উৎস ব্যস্ত হয়ে চোখ মোছে। চোখ টকটকে লাল হয়ে যায় তার।
“না মামা আমাকে বলতে দেন। এই কথাগুলো বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। দুইটা বছর আমি কাউকে কিছু বলতে পারিনি। আমাকে বলতে দেন মামা।”
“বেশ বল, তবে নিজেকে শান্ত কর আগে।”
উৎস সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। পানিতে পা ভেজায়। মস্তিষ্ক ঠান্ডা করা দরকার তার।

“আমি দেখলাম নিশানকে ওই ঠান্ডার মধ্যে শুধুমাত্র একটা হাফপ্যান্ট পরিয়ে ছাদে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আর দুই পাশ থেকে তাকে অমানুষের মতো মারছে। ছেলেটা বোধহয় ততক্ষণে চিৎকার করতে করতে চিৎকার করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে। নিস্তব্ধ হয়ে আছে। শুধু প্রতিবার মারের সময় ঈষৎ কেঁপে উঠছে। মামা আমি আর সামলাতে পারিনি। আমার শরীরের অবস্থাও ভালো না। তবুও আমি ছুটে যাই। ওরা আমাকে আটকানোর চেষ্টা করে, তবুও আমি যাই। আমি দুই হাতে আমার ভাইয়ের মতো বন্ধুকে আগলে ধরি। আর ওর দোষ কি ছিলো জানেন মামা? ওর দোষ ছিলো ও কোন বড় ভাইকে সালাম দেয়নি। শুধুমাত্র এটুকু অপরাধের জন্য ওকে মারতে মারতে প্রায় শেষ করে দিচ্ছিলো জানোয়ারগুলো।”
উৎস একদলা থুতু ফেলে, ঘৃণায় জিভ অবস হয়ে আসে তার।
নওশাদের শরীরটা কেমন খারাপ লেগে ওঠে৷ মনে হয় মাথা ঘুরে পড়েই যাবে। কোনোদিনও চোখে না দেখা এক অসহায় মায়ের একমাত্র সম্বল নিশানের জন্য একরাশ মায়া অনুভব করে সে নিজের মধ্যে।

“ওই ঘটনার পর আমি না চাইতেও রাজনীতিতে ডুবে গেলাম মামা। ছাত্রদের যে সংগঠন ছিলো, ওরা আমাকে জোর করে ওদের দলে ঢুকিয়ে নিলো। এসব মিছিল, মিটিং আমার পছন্দ ছিলো না। কিন্তু ওরা বললো নিশানের মতো একটা অসহায়েরও যেনো ওই অবস্থা না হয় এটা আমাকে দেখতে। আমার মধ্যে নাকি এমন সাহস ছিলো যা ওরা খুঁজছে। আমার রক্তে তখন প্রতিশোধের মশাল জ্বলছে মামা। কিছু না ভেবেই সম্মতি জানালাম। এরপর একের পর এক কাহিনীতে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত এমনভাবে জড়িয়ে গেলাম আর নিজেকে সরিয়ে আনতে পারলাম না।”
নওশাদ ক্লান্ত গলায় বললো,”নিশানের কি হলো উৎস? ও এখন কোথায়?”
উৎস ম্লান হাসে, উত্তর দেয়না। নওশাদের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে যায়, তবে কি ছেলেটা?

“মামা বাড়িতে চলেন। অনেক দেরি হয়ে গেলো। আপনার অফিসের সময় হয়ে যাচ্ছে।”
নওশাদ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। উৎস কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে একাই হেঁটে কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়ায়। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে সে। নিজেকে শান্ত করতে পারছে না, কোনোভাবেই না।

বাড়িতে ঢুকতেই খটকা লাগে উৎসের। সামনের দরজা খোলা। ভিতর থেকেও কেমন অন্যরকম আওয়াজ আসছে। নওশাদের দিকে তাকাতেই দেখে তার চোখমুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ।
উৎসই ছুটে যায় প্রথম। পিছন পিছন নওশাদও আসে।
বাইরের ঘরে আবিরকে বসে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হয় উৎস। উৎসকে দেখে উঠে দাঁড়ায় আবির।
“তুই এখানে? কি হয়েছে?”
“উৎস তুই কোথায় গিয়েছিস? এদিকে কি অবস্থা।”
“কি হয়েছে বলবি তো?”
নওশাদ ওদের কথার মধ্যে না দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা মেয়েদের ঘরের দিকে ছোটে। সেখানে ডাক্তার বসে থাকতে দেখে হতবুদ্ধি হয়ে যায় সে। শীতল মূর্তির মতো বিছানায় শুয়ে আছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে রক্ত নেই মুখে, সাদা ফ্যাকাসে হয়ে আছে মুখটা।
নওশাদ গগণবিদারী চিৎকার দিয়ে ওঠে।
“শীতল মা।”

বাইরে থেকে নওশাদের গলার আওয়াজ শুনে হতভম্ব হয়ে যায় উৎস। শীতল? কি হয়েছে শীতলের? এক পা সামনে যাওয়ার মতো শক্তি পায়না সে।

দুইবার রক্তবমির পর একেবারেই ঠান্ডা হয়ে গেছে শীতল। গায়ে আকাশপাতাল জ্বর। শাহানা চিৎকার করে কাঁদছে, সায়েরা তাকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। নওশাদ কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে শীতলের পাশে এসে বসে।
আচমকাই উৎস ঘরে ঢুকে ডাক্তারের দুই বাহু চেপে ধরে তাকে দাঁড় করায়।
“এই ডাক্তার চুপ করে আছেন কেনো, কি হয়েছে ওর? বলেন না কেনো? বোবা নাকি আপনি?”
বহ্নি আর আভা অবাক হয়ে উৎসের দিকে তাকায়।
“দেখুন শান্ত হোন। উনাকে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না।”
“শীতলের অবস্থা ভালো না আর আপনি বলছেন শান্ত থাকতে? এই আপনাকে ডাক্তার বানাইছে কে? এই আবির ধর তো এই ডাক্তারকে। আজ ওর একদিন কি আমার একদিন।”
ডাক্তার ভয়ে ভয়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। এ কোন পাগল?
বহ্নি উঠে এসে কঠিন গলায় বললো,”উৎস হচ্ছেটা কি?”
“তুই শুনতে পাস নি ও কি বললো?”
“তুই এতো অস্থির হচ্ছিস কেনো?”
“কেনো হবো না? শীতলের এই অবস্থা কীভাবে হলো?”
“সেগুলো পরে জানলেও হবে। ওকে এখন হাসপাতালে নিতে হবে। বাবাকে দেখে তো মনে হচ্ছে সে নিজেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। যা রিকশা ডেকে নিয়ে আয়।”
উৎস বহ্নির পাশ কাটিয়ে শীতলের কাছে দাঁড়ায়। শীতলের ঠোঁট সাদা হয়ে গেছে। চোখ অর্ধেক খোলা। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই উৎস শীতলকে পাঁজকোলা করে কোলে উঠায়। গা যেনো পুড়ে যাচ্ছে তার। উৎস জমে যায় বরফের মতো।

“তোরা আয় মামাকে নিয়ে। আমি এগোচ্ছি।”
কেউ কিছু বলার আগেই উৎস বেরিয়ে যায় শীতলকে নিয়ে। সায়েরা সেদিকে তাকিয়ে ম্লান হাসে। মা হয়ে ছেলের মন বুঝতে ভুল করেনি সে।

(চলবে…….)