মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-১২+১৩

0
99

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ১২

সিঁড়ির মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আভা। বারবার তাকাচ্ছে উপরের দিকে। কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছে তার। শাহানা নিষেধ করেছে তাকে উপরে যেতে। আসলে এই মেয়েকে নিয়ে তার বেশি দুশ্চিন্তা। মেয়েটা যে কেনো এতো রূপবতী হলো। বড় দুই মেয়ের আগে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলে শান্তি হতো তার।

বহ্নি গামলায় করে গরম পানি নিয়ে ছুটছে সিঁড়ির দিকে। আভাকে দেখে থেমে যায় সে।
“কি রে তুই এখানে কি করছিস? তোর বান্ধবীরা এসে বসে আছে। আর তুই এখানে মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে আছিস।”
আভা আস্তে আস্তে বললো,”বড় আপা তুই গামলা নিয়ে কোথায় যাস?”
“গরম পানির ভাপ দিতে হবে ছেলেটার কোমরে। কোমরে বেকায়দা লেগেছে। হাড় ভাঙলো কিনা কে জানে।”
আভা চমকে উঠে বললো,”হাড় ভেঙেছে?”
“আমি কীভাবে জানবো? কিন্তু যেভাবে পড়েছে, কি জানি কি হয়। তবে দুইদিন যাবৎ বিছানা থেকে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না।”
আভা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার শুধু মনে হচ্ছে তার জন্যই এমনটা হলো। যদিও তার কোনোই দোষ নেই এখানে। কিন্তু সে যদি লোকটার বারণ না শুনে ছুটে যেতো তাকে ধরে এগিয়ে আনতে তাহলে হয়তো এমন হতোনা।

বহ্নি ভ্রু কুঁচকে আভার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোর কি হয়েছে রে? শাড়ি পরেছিস বান্ধবীরা মিলে আনন্দ করবি তাই। তা না এখানে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছিস।”
আভার কেমন যেনো কান্না পায়।
“কি যে বলিস বড় আপা। বাড়িতে একটা মানুষ এমন অসুস্থ। আর আমি বান্ধবীদের সাথে আনন্দ করবো।”
বহ্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”আভা মা যেনো তোর এসব ঢং না দেখে। তোর চামড়া ছিলে মা ডুগডুগি বানাবে এই বলে রাখলাম। বয়স তুলনায় বেশি ঢং করিস তুই।”
“আমি ঢং করছি? এটা তুই বলতে পারলি বড় আপা?”
“সর তো সামনে থেকে। গরম পানি নিয়ে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো আমি? অসহ্য যতোসব।”
আভাকে পাশ কাটিয়ে বহ্নি উঠে যায় সিঁড়ি বেয়ে। নওশাদ সেখানেই আছে। পানি নিয়ে বহ্নিকে যেতে বলেছে সে।
আভা মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে থাকে। বান্ধবীদের ভালো লাগছে না তার এখন একদম। চলে যেতেও বলতে পারছে না। কতো কি করবে বান্ধবীদের সাথে ঠিক করে রেখেছিলো, এখন একদম ভালো লাগছে না, বিরক্ত লাগছে।

“শীতল।”
সকালেই নওশাদ মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে। কাঁচের টুকরো ভিতরে থেকে গেলে পরে সমস্যা হবে। ডাক্তার ড্রেসিং করে দিয়েছে। শীতল খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। বুকটা ভার হয়ে আছে তার।
মায়ের ডাকে চমকে ওঠে শীতল। মা সাধারণত তাদের ঘরে আসেনা। তাদের কোনো প্রয়োজন হলে তাদের ফুপুই দেখভাল করে।

“মা তুমি?”
“কেনো আসা বারণ নাকি আমার?”
“এমন বলছো কেনো? এসো না, আমার পাশে একটু বসো।”
শাহানা শীতলের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়। মেয়েটার চোখেমুখে একরাশ কষ্ট। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। এই এমন কষ্ট এই একরত্তি মেয়েটার। মা হয়ে সে জানেনা। ছোট্ট একটা মেয়ে, কি কষ্ট বুকে চেপে রেখেছে?

শাহানা শীতলের পাশ ঘেঁষে বসে। শীতল ঈষৎ কেঁপে ওঠে। শাহানা আরো একপ্রস্ত অবাক হয়।
“শীতল খুব বেশি ব্যথা করছে পায়ে?”
“না তো মা, একটুও ব্যথা করছে না।”
শাহানা চুপ করে থাকে। শীতল হঠাৎ করে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। শাহানা হাত বুলিয়ে দেয় মেয়ের মাথায়। সে কাউকে না বললেও, এটাই সত্যি যে সে তিন মেয়ের মধ্যে শীতলকেই একটু হলেও বেশি ভালোবাসে। কি ভীষণ মায়া লাগে এই মেয়েটাকে। চুপচাপ থাকে, একটু বোকা প্রকৃতির। কিন্তু পুরোটাই যেনো মায়ায় মোড়ানো।

“মা।”
“বল শীতল।”
“মা জানো আমার ঘুম হচ্ছেনা।”
শাহানা শিউরে উঠে বললো,”কেনো মা? কি হয়েছে আমার বল। কিসের কষ্ট তোর?”
শীতল চুপ করে থাকে। শাহানা টের পায় তার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে। মানে শীতল কাঁদছে?
“মা তুমি আমাকে নিয়ে কিছুদিন মামাবাড়ি থেকে ঘুরে আসবে?”
“হঠাৎ মামাবাড়ি যেতে চাচ্ছিস যে? তাছাড়া বহ্নির সামনেই পরীক্ষা। ও কি যেতে পারবে?”
“আপা আর আভা ফুপুর কাছে থাকবে। তুমি আর আমি যাবো শুধু।”
শাহানা মেয়েকে জোর করে উঠায়। চোখমুখ কেমন লাল হয়ে গেলো মেয়েটার মুহুর্তের মধ্যে।

“তোর কি হয়েছে বল তো? যে দুই বোন ছাড়া তোর রাতে ঘুমই আসেনা। তাদের রেখেই তুই ঘুরতে যেতে চাচ্ছিস?”
“মা আমি কিছুদিন এই যান্ত্রিক জীবন থেকে বিরতি চাই। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। তোমার সাথে দূরে কোথাও কিছুদিন ঘুরে আসতে ইচ্ছা করছে।”
শীতল আর কিছু বলেনা। সে মূলত কিছুদিন ওই মানুষটার মুখোমুখি হতে চাচ্ছেনা। বলতে গেলে একরকম পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে এখান থেকে।

শাহানা হতবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। শীতলের যে মারাত্মক কিছু হয়েছে সে বুঝতে পারে। মেয়েটা কি প্রেম করছে? এই বয়সে এসব অসম্ভব কিছু না। বয়সটাই আবেগের, সেই সাথে ভুল করারও।
“কি হলো মা বলো? যাবো তো আমরা মামাবাড়ি?”
শাহানার খুব খারাপ লাগে মেয়ের দিকে তাকিয়ে। কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মানা করতেও পারছে না।
আমতা আমতা করে শাহানা বললো,”আচ্ছা তোর বাবাকে বলে দেখি।”
“আজকেই বলো মা। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে চাই আমি। হতে পারে আজ বিকালেই।”
“কি বলছিস? আজ কীভাবে?”
শীতল ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে বললো,”আচ্ছা তাহলে কাল সকালে?”
মেয়েটা যে এমন ব্যস্ত হয়ে গেলো কেনো এটাই বুঝতে পারছে না শাহানা। মা হিসেবে ব্যর্থ মনে হয় নিজেকে। মা হয়ে মেয়ের মনের গোপন কুঠুরির খবর রাখেনা, সে আবার কেমন মা?
শাহানা মূর্তির মতো বসে থাকে। শীতল আবার মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে। সে ঠিক করেছে আজ সারাদিন মায়ের কোলে শুয়ে থাকবে। মা’কে কোনো কাজ করতে দিবে না আজ, একটুও উঠতে দিবে না তার কাছ থেকে।

আবিরের কোমরে গরম ভাপ দিচ্ছে নওশাদ। ডাক্তারকে খবর পাঠিয়েছে, এখনো আসেনি। উৎসের ঘরে খাটে শোয়ানো হয়েছে তাকে। বহ্নিও সাহায্য করছে বাবাকে। উৎসের সেদিকে খেয়াল নেই। মেঝেতে দুই পা ছড়িয়ে শূণ্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। রণ অদূরে দাঁড়িয়ে বহ্নির দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা এতো মায়াবতী কেনো? কোমরে ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে, চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করা। খুব সাধারণ সাজে কোনো মেয়েকে এতো অসাধারণ লাগতে পারে? রণ চাচ্ছেনা দূর্বল হতে। কিন্তু অবাধ্য চোখ দু’টো যেনো বেঈমানী করেই যাচ্ছে তার সাথে। চোখ সরাতেই পারছে না বহ্নির দিক থেকে।

“বাবা এখন কেমন লাগছে তোমার?”
আবিরের মনে হচ্ছে কোমরটা বোধহয় আলাদা হয়ে যাচ্ছে শরীর থেকে। লজ্জায় তাকাতে পারছে না সে কারো দিকে। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
“মামা আমি বাড়ি চলে যেতে পারবো। আমার জন্য আর কষ্ট করতে হবে না আপনাদের।”
“এই ছেলে তুমি কি পাগল? এই অবস্থায় তুমি কীভাবে যাবে?”
“আমি পারবো মামা, আমি একদম ঠিক আছি।”
নওশাদ উত্তর দেয়না আবিরের কথায়। আবিরের কথা শোনার সময় নেই এখন।
“এই রণ।”
রণ তখনও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বহ্নির দিকে। কোনোদিকে খেয়াল নেই তার।
নওশাদ বিরক্ত হয়ে আবার ডাকে,”রণ।”
ধাতস্থ হয়ে রণ তাকায় নওশাদের দিকে।
“হ্যা চাচা বলুন।”
“তুমি এসো আমার সাথে। ডাক্তার কেনো আসছে না দেখি। ওদিকে আবার আমার ছোট মেয়ের বান্ধবীরা এসেছে। বাজারে যেতে হবে।”
“চাচা আমি বাজার করি?”
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“তোমাকে বলেছি বাজার করতে? ছেলেগুলো এতো বেশি বোঝে কেনো?”
ধমক খেয়ে চুপসে যায় রণ।
“এসো ডাক্তারকে এগিয়ে আনবে।”
নওশাদ বাঁকা চোখে উৎসের দিকে তাকায়। উৎসকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছে। বন্ধুটার এই অবস্থাতেও তার মন নেই এদিকে। তাকে কিছু বলতে ভরসা পায়না নওশাদ। ছেলেটা দিন দিন আরো অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে।

রণকে নিয়ে নওশাদ চলে যায়। বহ্নি এতোক্ষণে বসে। হাঁপিয়ে গেছে সে ছুটতে ছুটতে। উৎসের পাশেই মেঝেতে বসে পড়ে সে।
“এই উৎস তোর কি হয়েছে বল তো?”
উৎস উত্তর দেয়না। বহ্নি বিরক্ত হয়ে উৎসের দিকে তাকাতেই থমকে যায়। উৎসের ট্রাউজারের এক পাশে ঘন কালচে র’ক্তের ছাপ। অনেকক্ষণ আগের বোঝা যাচ্ছে, শুকিয়ে গেছে।

বহ্নি চিৎকার করে বললো,”উৎস এই উৎস। কি হয়েছে তোর? র’ক্ত এলো কোথা থেকে? কি হয়েছে তোর?”
উৎস যন্ত্রের মতো বললো,”কিছু হয়নি।”
বহ্নি দ্বিগুণ স্বরে চিৎকার করে।
“পাগল তুই? কিছু হয়নি মানে? তুই এতো চাপা স্বভাবের কেনো উৎস? র’ক্ত এলো কোথা থেকে বল? কোথায় কেটে গেছে? আমি ড্রেসিং করে দিই।”
“আমার মন কেটে গেছে, দে ড্রেসিং করে।”
“উৎস কি বলছিস?”
“বহ্নি আমার সামনে থেকে যা এখন। তোকে দেখতে ইচ্ছা করছে না।”
“তাহলে কাকে দেখতে ইচ্ছা করছে?”
উৎস ভরাট চোখে তাকায় বহ্নির দিকে। বহ্নি নির্বিকার ভাবে বসে থাকে।
“অনুভূতি প্রকাশ করতে এতো আপত্তি কেনো তোর? কিসের ভয় পাস?”
“বহ্নি……”
“কি হয়েছে? আমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকাতে পারবি না তুই।”
“আমি কিছু লুকাচ্ছি না।”
বহ্নি মুচকি হাসে। ছেলে-মেয়ে দু’টো তার চোখের সামনে কষ্ট পাচ্ছে, সে সহ্য করতে পারছে না।

“অনুপমার চোখে জল কেনো উৎস?”
উৎস উঠে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে দমবন্ধ লাগছে তার। বাইরে যাবে।
“ট্রাউজারটা পালটে ফেল, ধুয়ে দিই।”
উৎস কঠিন গলায় বললো,”এই ট্রাউজার এমনই থাকবে, এটা কেউ ধরবে না। কোনো প্রয়োজন নেই ধোয়ার।”
বহ্নিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উৎস বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে। যাওয়ার আগে আবিরের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বললো,”আমি ডাক্তার ডেকে আনছি, নড়াচড়া করিস না বেশি।”
আবির অপরাধী মুখে বসে থাকে। উৎসের কাছেও কেমন লজ্জা লাগছে তার।

আজকের সারাটা দিন কেমন গুমোট গেলো ‘খাঁ’ বাড়িতে। দুপুরের পর আবিরের ব্যথা ভীষণ বেড়ে যাওয়ায় তাকে আর যেতে দেওয়া হয়নি। আজ সে এখানেই থাকবে। উৎস ডাক্তার ডেকে এনে কোথায় যেনো বেরিয়েছে, আর আসেনি বাড়িতে। শীতলও ঘর থেকে বের হয়নি সারাদিন। বহ্নি একবার উপর আরেকবার নিচ করেছে। ভীষণ ব্যস্ততায় গেছে সারাদিন। বাড়ির বড় মেয়ে হওয়ার জ্বালাও আছে। তবুও একফোঁটা বিরক্ত নয় সে। বরং আবিরের অসুস্থতা তাকে কষ্ট দিচ্ছে। বেচারা ছেলেটা পরিবার ফেলে ভার্সিটির হলে থাকে। একটু বেড়াতেই নাহয় এসেছিলো তাদের বাড়ি। এসেই এমন বিপদে পড়তে হলো। আভার দিনটাও ভালো যায়নি। বারবার উপরের ঘরে আসতে ইচ্ছা করেছে। মায়ের ভয়ে পারেনি। বান্ধবীদেরও সময় দেয়নি বেশি। ওরা চলে যাওয়ার পর শাড়ি পালটে মুখ অন্ধকার করে ফুপুরে ঘরে বসে আছে সে।

সন্ধ্যার পর ঠিক হলো যে আগামীকাল শীতলকে নিয়ে শাহানা তার বাপের বাড়ি যাবে কিছুদিনের জন্য। নওশাদ কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিলো না। শীতলকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে। সবার পরীক্ষা হয়ে গেলে একসাথে নাহয় যাবে সবাই। কিন্তু শীতল তার সিদ্ধান্তে অটল। সে যাবেই। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে নওশাদ রাজি হয়েছে।
বহ্নি আর আভা হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা ভাবতেই পারেনি বোনকে রেখে কোনোদিন তাদের থাকতে হবে। এ পর্যন্ত তিন বোন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেনি। শীতলকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে অনেক। কিন্তু শীতল কোনো কথা বলেনি তাদের সাথে, সে যাবেই।
আভা এলোমেলো ভাবে ঘুরতে থাকে ঘরের মধ্যে। একটুও ভালো লাগছে না তার। উৎস ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। সে এখনো জানেনা শীতল কাল বাড়ি থেকে চলে যাবে। আভার কেনো যেনো মনে হচ্ছে আর কেউ না পারলেও উৎস ভাই ঠিক পারবে শীতলকে আটকাতে। সে মানতেই পারছে না তার মেজো আপা অনেক দিনের জন্য তাদের সাথে থাকবে না। মধ্যবিত্ত সংসারে আর কিছু থাকুক না থাকুক একরাশ মায়া থাকে সবার মধ্যে। সেই মায়া কাটানো সম্ভব হয়না।

হাবিজাবি অনেক চিন্তা করে আভা সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। মা যা বলে বলুক, উৎস ভাইকে এখন জানাতেই হবে। সে যা পারে করুক রাতের মধ্যে। যেভাবেই হোক মেজো আপাকে আটকাতেই হবে।

ছাদে আসতেই আভা ঘরের মধ্যে উঁকি দেয়। আবির খাটের উপর শুয়ে আছে উপুড় হয়ে। রণ মেঝেতে বসে বই পড়ছে। উৎস কোথাও নেই ঘরে।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে আভা। ভিতরে ঢুকতে কেমন বাঁধা লাগছে তার। মা জানলে মেরেই ফেলবে হয়তো।

“আসবো?”
রণ ভয়ংকরভাবে চমকে উঠে দাঁড়ায়। দরজায় পরীর মতো সুন্দর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা জামা পরায় তাকে একদম সাদা পরীর মতো লাগছে। আচ্ছা এ বাড়ির মেয়েগুলো এমন পুতুলের মতো কেনো? রণ চোখ নামিয়ে নেয়।
আভার কণ্ঠ শুনে ধড়মড় করে ওঠার চেষ্টা করে আবির। আভা আটকায় তাকে।

“আরে কি করছেন? উঠছেন কেনো?”
“আভা তুমি….”
“আচ্ছা কথা বলতে হবে না।”
“আভা আমি ঠিক আছি। আই অ্যাম ফাইন।”
“উফফ থামুন তো আপনি। অনেক বীরপুরুষ সেজেছেন আর দরকার নেই।”
আবির থতমত খেয়ে যায়। আভাকে দেখতে ইচ্ছা করছে তার দুই চোখ ভরে। আজকে তাকে আরো রূপবতী লাগছে। চোখ সরানোই দায়।
আভা কিছুটা কোমল গলায় বললো,”কিছু খেয়েছেন আপনি?”
আবির ঢোক চাপে।
“হ্যা বহ্নি আপা খাবার দিয়ে গেছে।”
“ওষুধ খাচ্ছেন তো?”
“খাচ্ছি খাচ্ছি।”
আভা আর কথা খুঁজে পায়না। এমন বলিষ্ঠ একটা ছেলে কীভাবে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে, দেখতেই খারাপ লাগছে তার।

“উৎস ভাই কোথায়?”
রণ উত্তর দেয় মাঝ থেকে।
“উনি ছাদে গেছে, মনে হয় ঘরের মধ্যে এতো মানুষ ভালো লাগছে না উনার। আমি বলেছি আমি ছাদে ঘুমাবো….”
আভা তার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,”আপনি একটু বেশি কথা বলেন।”
রণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কি অদ্ভুত এই মেয়েগুলো!

“আচ্ছা আমি দেখছি।”
আবির তাড়াতাড়ি করে বললো,”এখনই চলে যাবে?”
আভা অবাক হয়ে তাকায়।
“কেনো বলুন তো?”
“না না এমনি।”
রণ একবার আভার দিকে আরেকবার আবিরের দিকে তাকায়। কিছু একটা বুঝে মিটমিট করে হেসে দেয় সে।

আভা আবিরের দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হেসে বললো,”আবার আসবো, আপনি বিশ্রাম করুন।”
আবির তাড়াতাড়ি করে বললো,”কখন?”
বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটে সে। ইশ! কি বললো এটা। এখন নিশ্চয়ই বেহায়া ভাববে তাকে।
আভা কিছু না বলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায়। রণ মুচকি হেসে আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আবির চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে।

দূরে সিগারেটের আগুন দেখে আভা বুঝতে পারে উৎস ভাই দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।
ধীর পায়ে হেঁটে উৎসের পিছে যেয়ে দাঁড়ায় সে।

“হাবা কিছু বলবি।”
আভা অবাক হয়ে যায়। পিছনে না ফিরে কীভাবে বুঝলো উৎস ভাই যে সে এসেছে?
“আপনি আবার আমাকে হাবা বলছেন?”
“কিছু বলবি?”
“বলবো, আগে সিগারেটটা ফেলুন।”
উৎস ঘুরে তাকায় আভার দিকে।

“বলার হলে বল, নাহয়ে ভাগ এখান থেকে।”
আভা হতাশ গলায় বললো,”আপনি এমন কেনো উৎস ভাই?”
উৎস ধোঁয়া ছাড়ে।

“উৎস ভাই আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি। বলতে পারেন অনুরোধ করতে।”
“আবার ফেইল করেছিস? আমি আর যেতে পারবো না তোর স্কুলে।”
“সবসময় আপনি এভাবে কথা বলেন কেনো?”
“কারণ আমি মানুষটা খারাপ। খারাপ মানুষ ভালো কথা বলতে পারেনা।”
আভা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
কয়েক মিনিট এভাবেই যায়। এরপর আস্তে আস্তে করে বলে,”মেজো আপা কাল বাড়ি থেকে চলে যাবে উৎস ভাই।”
উৎস চমকে ওঠে। হাত থেকে আলগোছে সিগারেট পড়ে যায় নিচে। সেদিকে একবার তাকায় আভা।

“মানে? কোথায় যাবে?”
“উৎস ভাই, শান্ত হোন।”
“আভা নাটক করিস না। চুপ করে আছিস কেনো? বল ও কোথায় যাবে?”
আভা বুঝতে পারেনা উৎসের এমন আচরণের কারণ। এমন করছে কেনো সে?
“আভা….”
জোরে ধমক শুনে কেঁপে ওঠে আভা।
“চুপ করে আছিস কেনো?”
“উৎস ভাই, মেজো আপা কাল মায়ের সাথে মামাবাড়ি যাবে অনেকদিনের জন্য। আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, বাবাও অনেক অনুরোধ করেছে। কিন্তু মেজো আপা কারো কথা শুনছে না। সে যাবেই। কতোদিনের জন্য যাবে তাও বলছে না। মন ভালো না হওয়া পর্যন্ত নাকি আসবে না।”
উৎস জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। উত্তপ্ত শ্বাস বের হচ্ছে। কান গরম হয়ে যাচ্ছে তার। বুক ওঠানামা করছে দ্রুত।

“উৎস ভাই আপনি ঠিক আছেন?”
“এই কথা আমাকে বলছিস কেনো তুই? আমি কি করবো?”
আভা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,”আপনি একটু আটকান।”
উৎস চিৎকার করে ওঠে।
“আমার কি দায় পড়েছে? আমি কেনো আটকাবো? যার যেখানে যেতে ইচ্ছা হয় যাক।”
আভা কিছু বলতে যেয়ে থেমে যায়। উৎসকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। তার কেমন ভয় ভয় লাগছে।

“তুই এখন যা আমার সামনে থেকে।”
“আপনি কিছুই করবেন না?”
উৎস রাগী লাল চোখে আভার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”না।”
আভা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারেনা। ভয় লাগছে তার উৎসকে। ধীর পায়ে হেঁটে চলে যায় সে। যেতে যেতে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে উৎসের দিকে তাকাতে থাকে সে। উৎস দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একবারও তাকায় না আভার দিকে।

আভা চলে যেতেই নিচে পড়ে থাকা আধখাওয়া সিগারেট তুলে ধরে সে। বাম হাতের মুঠোর মধ্যে আগুনটা চেপে ধরে। যন্ত্রণা যতোটা হওয়ার কথা হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে আরো যন্ত্রণা দরকার তার, আরো।

“না তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না আমি। তুমি শুধু দেখো আমি কি করি। তোমার স্থান শুধু আমার চোখের সামনে। এখান থেকে কোথাও ছুটি নেই তোমার। সাহস থাকলে যাও আমার সামনে থেকে। দেখি কীভাবে পারো।”

উৎসকে দূর থেকে ওই অবস্থায় দেখে ছুটে আসে রণ। তার হাত থেকে জোর করে সিগারেটটা ফেলে দেয়। দগদগে ঘা হয়ে গেছে। উৎস সেদিক তাকায় না, কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না সেখানে।
“এ কি করেছেন উৎস ভাই? হাত তো পুড়িয়ে ফেলেছেন।”
উৎস রণের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটে যায় সিঁড়ির দিকে।
“এতো রাতে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
“ওষুধ আনতে।”
“পোড়ার ওষুধ?”
“হ্যা তবে এটা হৃদয় পোড়ার।”
উৎসের কথার আগামাথা কিছুই বোঝেনা রণ। মাথা চুলকে বিড়বিড় করে বললো,”কিন্তু এতো রাতে ওষুধের দোকান খোলা পাবেন?”
উৎস মুচকি হেসে বললো,”এই ওষুধ কিনতে পাওয়া যায়না, আদায় করে নিতে হয়।”
রণকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উৎস চলে যায়। রণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে উৎসের এক হিংস্র রূপ।

(চলবে……)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব : ১৩

শীতলের খাটে আধশোয়া হয়ে বসে আছে নওশাদ। তার বাহুতে মাথা দিয়ে শুয়ে শীতল বাবার সাথে গল্প করছে। মেয়েদের ছোটবেলা থেকেই নওশাদ এমনটা করে। মেয়েরা পরীক্ষায় খারাপ করলে বা মায়ের বকুনি খেলে যখন মন খারাপ হতো তাদের তখন এভাবে অনেক রাত পর্যন্ত নিজের বাহুর উপর শুইয়ে তাদের সাথে গল্প করতো। মেয়েদের মন নাকি এতেই ভালো হয়ে যেতো। আস্তে আস্তে ওরা বড় হলো, বাবার কাছ থেকে দূরে চলে গেলো। এখন মন খারাপ হলেও নিজের মধ্যে রাখে, কাউকে জানায় না। মেয়েদের এই পরিবর্তন ভালো লাগেনা নওশাদের।
আগামীকাল তো মেয়েটা অনেক দিনের জন্য মামাবাড়ি চলে যাবে। কোনো বারণই শুনবে না। নওশাদের বুকটা কেমন খালি খালি লাগে। তিন মেয়ের কোনো একজন তার থেকে দূরে চলে গেলে তার যেনো শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। শাহানা অবশ্য বলে এসব আদিখ্যেতা। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তো থাকতেই হবে। নওশাদ সেসব কথায় পাত্তা দেয়না।

“শীতল মা।”
“বলো বাবা।”
“তোর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই? দেখবি ঘুম এসে যাবে।”
শীতল নিচু স্বরে বললো,”ঘুম আসবে না বাবা, আমার ঘুম আসেনা।”
নওশাদ বিচলিত হয়। তার তিন মেয়ে তিন রকম। বহ্নি শক্ত ধাঁচের, মন খারাপ থাকলেও সে কাউকে কিছু বুঝতে দিবে না। দিব্বি হাসিমুখে ঘুরে বেড়াবে। ওর উপর সব দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকলেও ও তার বাবাকে নিরাশ করবে না।
আভা চঞ্চল, বয়স তুলনায় একটু বেশি ভারিক্কি ভাব নেয়। তবে মেয়েটা তার অসাধারণ। ও যেনো একটা খোলা বই। যখন যে পৃষ্ঠা থেকে ইচ্ছা সেখান থেকেই পড়ে নেওয়া যায় ওকে। ওকে বুঝতে একটুও কষ্ট হয়না নওশাদের।
তবে ব্যতিক্রম শীতল। নামের মাহাত্ম্য রেখেছে সে। আসলেই শীতল সে। অল্পতেই আবেগী হয়ে যাওয়া, ঝরঝর করে কেঁদে দেওয়া আবার পরক্ষণেই মনটা একটু ভালো হলে উচ্ছল হয়ে যাওয়া। তবে সে জেদী, কোনো কিছু করবে বলে মন:স্থির করলে সে করবেই। কেউ তাকে আটকাতে পারবে না। নিজের আবেগ প্রকাশ করতে ভীষণ লজ্জা তার।

“একজন সুস্থ মানুষের ঘুম কেনো হবে না?”
শীতল গম্ভীর গলায় বললো,”আমি সুস্থ না বাবা।”
নওশাদ উঠে বসে। বাকি দুই মেয়ে যে যার খাটে ঘুম। শুধু শীতল নির্ঘুম শুয়ে আছে।
“সুস্থ না মানে? কোথায় সমস্যা তোর? আমাকে বলতে কি অসুবিধা? ডাক্তার দেখাতে হবে তেমন কিছু হলে।”
“কিছু হয়নি বাবা। তুমি না বললে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, দিচ্ছো না কেনো?”
নওশাদ কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের মাথা স্পর্শ করে, ঈষৎ কেঁপে ওঠে শীতল।

“মা রে তুই তোর নামের মতোই শীতল। তোর মায়ের তোর এই নাম রাখা স্বার্থক।”
শীতল ম্লান হেসে বললো,”বাবা আমাদের নামগুলো কি সব মা-ই রেখেছে? নামগুলো কিন্তু ভারী সুন্দর। যে শোনে সে-ই বলে। আপার নামটা ওর চরিত্রের সাথে বেশ যায়। ও বহ্নিশিখার মতোই জ্বলজ্বলে আর উত্তপ্ত। আর আমাদের আভা তো ওর নামের মতোই প্রাণবন্ত আর দিকে দিকে আলো ছড়ানোর মতো।”
নওশাদ কিছুটা ভারমুক্ত হয়। মেয়েটা স্বাভাবিক কথায় ফিরে এসেছে।
“হ্যা রে তোদের নামগুলো তোদের মা-ই রেখেছে। তবে তোর ফুপু যখন উৎসের বাবা মারা যাওয়ার পর এ বাড়িতে আসে তখন সে তোদের অন্য নাম রেখেছিলো। খুব গল্পের বই পড়তো তো ও। তাই সেসব বই থেকেই কিছু চরিত্রের নামে তোদের নাম দিয়েছিলো।”
শীতল বেশ অবাক হয়। এমন কথা আগে তো শোনেনি সে।
“তাই নাকি বাবা? আমার তো মনে নেই।”
“তোদের আর কি মনে থাকবে? তোরা তখন কতো ছোট। সায়েরা তোদের ওই নামেই ডাকতো বেশ কিছুদিন। তবে তোর মায়ের সেসব নাম পছন্দ না হওয়ায় তোর ফুপু পরে আর নামগুলোতে ডাকেনি তোদের।”
শীতল উঠে বসে।
“কি কি নাম রেখেছিলো ফুপু আমাদের?”
“বহ্নির নাম রেখেছিলো উপমা। আর আভার নাম রেখেছিলো নিরুপমা। নামগুলো নাকি কোন গল্পের বইতে পড়েছিলো সে।”
শীতলের বুকটা হঠাৎ ধকধক করে ওঠে। পানি তেষ্টা পায় তার। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে।

“আর আমার নাম কি রেখেছিলো বাবা?”
নওশাদ চিন্তিত মুখে বসে থাকে, নামটা মনেই আসছে না তার।
“ও বাবা চুপ করে আছো কেনো? আমার নামটা কি ছিলো?”
“কি যেনো নামটা, মনেই পড়ছে না। তোর ফুপু নাকি ঠিক করে রেখেছিলো তার মেয়ে হলে ওই নামটা দিবে। সেই নামটাই তোকে দিয়েছিলো।”
শীতল অস্থির হয়ে যায়। অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”মনে করোনা বাবা। তোমার স্মৃতিশক্তি এতো দূর্বল কেনো?”
নওশাদ অবাক হয়ে বললো,”আমার স্মৃতিশক্তি দূর্বল?”
“এতো কথা না বলে নামটা মনে করোনা।”
নওশাদ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করে, কোনোভাবেই মনে পড়েনা।

“আচ্ছা সকালে তোর ফুপুর কাছ থেকে শুনে তোকে বলবো, এখন ঘুমিয়ে পড়। অনেক সকালে উঠতে হবে তোদের।”
“না না তুমি এখনই বলে যাও। দরকার হয় ফুপুকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করো।”
নওশাদ হতবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেলো?
“কি বলছিস বাবা তুই? এতো রাতে মানুষটাকে ঘুম থেকে টেনে তুলবো নাম শোনার জন্য?”
শীতল অস্থির হয়ে বললো,”তাহলে তুমি মনে করোনা।”
নওশাদ ভেবেই পায়না মেয়েটা এমন করে কেনো? নাম দিয়ে কি হবে এতো রাতে?
শীতল উদগ্রীব হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবার না মনে করা পর্যন্ত সে চোখের পলকই যেনো ফেলবে না।

হঠাৎ নওশাদ তুড়ি বাজিয়ে বললো,”মনে পড়েছে, মনে পড়েছে।”
শীতলের হৃৎপিণ্ডটা যেনো গলার কাছে এসে ধকধক কর‍তে থাকে। কিছু বলতে পারেনা সে।

“অনুপমা, অনুপমা।”
শীতল বরফের মতো জমে যায়। স্থির দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“শরৎচন্দ্রের লেখা একটা ছোটগল্প আছে, নাম ‘অনুপমার প্রেম’। সেখান থেকেই সায়েরা তোর নাম দিয়েছিলো অনুপমা। আমারও ভীষণ ভালো লাগতো নামটা। তোর মা নামটা রাখতে দিলো না। তবে সায়েরা আর উৎস এখনো তোদের ওই নামগুলোতেই ডাকে নিজেরা কথা বলার সময়……”
নওশাদ আরো কি কি বলে যায়। শীতলের কোনো কথা কানে যায়না। ঠোঁট কাঁপতে থাকে তার তিরতির করে।

“বাবা।”
“হ্যা বল।”
“তুমি নিশ্চিত তো? অনুপমাই ছিলো নামটা?”
“হ্যা রে বাবা, আমি নিশ্চিত।”
শীতল আচমকা বাবার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে। নওশাদ কিছুই বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। মেয়ের মাথাটা মনে হয় একেবারেই গেলো।

“কি হয়েছে মা? তোরা এতো লুকোচুরি কেনো করিস বল তো? এখন আবার কাঁদার কি হলো?”
শীতল আরো জোরে বাবাকে চেপে ধরে বললো,”আমি কাল কোথাও যাবো না বাবা, কোথাও না।”
“সে কি রে, মামাবাড়ি যাবি না?”
“না না না। আমি এখানেই থাকবো। কোথাও যাবোনা।”
শীতলের চিৎকারে কাঁচা ঘুম ভেঙে আভা বসে পড়ে খাটে।
“মেজো আপা তুই ঘুমাবি না?”
শীতল আভার দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হেসে বললো,”আভা আমি মামাবাড়ি যাবোনা।”
আভা চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,”মামাবাড়ি যেতে চেয়েছিস নাকি?”
শীতল আর নওশাদ দুইজনই হেসে দেয়। ঘুম থেকে ওঠার পর মিনিট পনেরো আভা দিকবিদিকশুন্য হয়ে যায়, কিছুই মনে থাকে না তার।
নওশাদের বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে যায়। মেয়েটার উচ্ছলতা দেখতে ভালো লাগছে। কি কারণ সে জানতে চায়না। মেয়েটা খুশি হোক, এতেই শান্তি। বেশি ঘাটাঘাটির কি দরকার?

ঘরের মধ্যে ভালো লাগছে না শীতলের। বাবাকে জোর করে ঘরে পাঠিয়ে ছুটতে ছুটতে উঠোনে এসেছে সে। বুকভরে শ্বাস নিবে এখন সে। কি মনে করে আসার আগে এক জোড়া রূপোর নুপুর পরে এসেছে সে। হাঁটলে সুন্দর রুমঝুম একটা শব্দ হয়, মেলোডির মতো শোনায়। শীতলের মন খুব বেশি ভালো হলে সে নুপুর জোড়া পরে। নবম শ্রেণিতে উঠলে তার ফুপু এটা তাকে গড়িয়ে দিয়েছিলো। সবসময় পরেনা পাছে আবার রঙ উঠে গেলে। মন অসম্ভব ভালো হলেই নিজের ড্রয়ার থেকে বের করে পায়ে পরে।
ঘর ছেড়ে বারান্দা, বারান্দা ছেড়ে উঠোন শীতলের নুপুরের ঝুমঝুম শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে রাতের নিরিবিলি পরিবেশটা।

ঝুমঝুম শব্দে ধাতস্থ হয় উৎস। উঠোনের এক কোণায় জাম গাছ আছে একটা। তার নিচে একটা ইট পেতে সেখানে সিগারেট খাচ্ছিলো উৎস। সে ঠিক করেছে আজ সারারাত সে এখানে বসে থাকবে। হঠাৎ আওয়াজ শুনে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় সে। এতো রাতে নুপুর পরে হাঁটবে কে? ভূত-পেত্নী নয় তো?

ভূত-প্রেতে আজীবন অবিশ্বাস উৎসের। সে এসবে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এতো রাতে নুপুরের ঝুমঝুম আওয়াজে ভ্রম হয় তার। সত্যিই কি তবে পেত্নী আছে? নিজের চিন্তায় নিজেই হেসে দেয় সে।
তবে হঠাৎই হাসি বন্ধ হয়ে যায় তার।

পেত্নী কোথায়? এটা তো পরী। সিগারেটটা কি একটূ বেশি খাওয়া হয়ে গেলো? ধোঁয়া ঢুকে গেছে মস্তিষ্কে? মস্তিষ্ক ভুলভাল তথ্য পাঠাচ্ছে? পরী আসবে কোথা থেকে এখন?

সাদা জামার উপর হালকা নীল জরিসুতার কাজ, সাদা চুড়িদার, সাদা ওড়না। জামাটা শীতল পরলে মনে হয় এই রঙটা বোধহয় শুধু ওর জন্যই বানানো হয়েছে। ভরা পূর্ণিমায় জ্যোৎস্না থইথই করছে সর্বত্র। তার কিছু অংশ খাঁ বাড়ির উঠোনে পড়তেও ভোলেনি। সেই তীব্র রূপোলী আলো তীর্যকভাবে এসে পড়েছে শীতলের চুলে, মুখে, চিবুকে। উৎস মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে। সে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে বুঝতে পারছে। শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য তার সামনে, সে এগোতে পারছে না। সে পরী দেখেনি, পরী বলে কিছু আছে কিনা তা-ও সে জানেনা। তবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই সামান্য মানবীর অসামান্য রূপের কাছে রূপকথায় বর্ণিত পরীদের রূপের বর্ণনা ফিকে। আচ্ছা সে যদি এখন উন্মাদ হয়ে যায়, প্রকৃতি কি তাকে ক্ষমা করবে? তার কি কিছু অঘটন ঘটার আগেই এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত? কিন্তু সে যাবে কীভাবে? তার নিয়ন্ত্রণ তো পুরোপুরি এক জ্যোৎস্নাময়ী নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিচ্ছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।

উৎসকে দেখেনি শীতল। অদ্ভুত এক আনন্দে বুক ভরে আছে তার। সে নিশ্চিত সে-ই উৎসের অনুপমা। উৎস তার জন্যই বিভোর, তার প্রেমেই দিশেহারা। এরচেয়ে সুখের আর কি হতে পারে তার কাছে?
নায়িকাদের মতো নাচতে ইচ্ছা করে শীতলের। পরক্ষণেই আবার লজ্জা পায়। যদিও কেউ দেখছে না, তাও কি লজ্জা। শীতল হাসে। গাছের নিচটা অন্ধকারে হওয়ায় উৎসকে সে দেখতে পায়নি, তবে উঠোনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকায় চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে শীতলের উপর। উৎস স্পষ্ট দেখতে পায় তার হাসি।
শীতল ওড়না খুলে ছুড়ে ফেলে দূরে। লজ্জা না পেয়ে কিছুক্ষণ সময়টা নিজে উপভোগ করবে। বাড়িভর্তি মানুষ, রাত ছাড়া নিজের উপভোগের জন্য সুযোগ কই?
উৎস চোখ নামিয়ে নেয়। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার। ঠোঁট সজোরে কামড়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে যায় সে প্রাণপণে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দিয়ে শীতল কিছুক্ষণ ঘোরে একা একা। উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে গাছে হেলান দিয়ে দেখে তাকে। এতো খুশি লাগছে কেনো শীতলকে? ওর মন খারাপ থাকার কথা যে! কে ওর মন ভালো করে দিলো?

কতোক্ষণ এভাবে গেছে কারোই খেয়াল নেই। না শীতলের না উৎসের। আচমকা কোথা থেকে ঠান্ডা একটা হাওয়া আসে। তীব্র গরমের শেষে এমন ঠান্ডা হাওয়ায় যেনো শরীর জুড়িয়ে যায় শীতলের। ইশ! আজ রাতটা এতো সুন্দর কেনো? মন তো জুড়িয়েছে অনেক আগেই, শরীরটাও কেমন আবেশিত হয়ে আসছে।
উৎস আকাশের দিকে তাকাতেই দেখে চাঁদটা ঢেকে যাচ্ছে নিকষ কালো মেঘে। তবে কি বৃষ্টি নামবে?
এই মেয়ে ঘরে যাচ্ছে না কেনো? বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগাবে নাকি?

মেঘ দেখে খুশি হয় শীতল নিজেও। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয়না। মনটা এতো খুশি হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টিতে ভেজা, দারুণ আনন্দ হয় শীতলের।
মিনিট দশেকের মধ্যে একরাশ ধূলো উড়িয়ে বাতাস শুরু হয়, ঠান্ডা শীতল হাওয়া। শীতল খোঁপা খুলে দেয়। লম্বাচুলগুলো সরু কোমর বেয়ে নিচে এসে পড়ে। চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় সে।

উৎস ঠিক করে সে চলে যাবে। সে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উন্মাদ হতে চায়না। কিন্তু যেতে হলে শীতলের সামনে দিয়ে যেতে হবে। এই মুহুর্তে সে শীতলের সামনে যেতে চাচ্ছেনা। যে কোনোভাবেই হোক শীতলের মন ভালো। সে সামনে গেলে যদি মন খারাপ হয়ে যায় তার আবার?

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে আকাশ ভেদ করে। চাঁদ কতো আগেই লুকিয়েছে কালো মেঘের আড়ালে! হালকা আলোয় পূর্নাঙ্গ চন্দ্রাবতীর মতো লাগছে শীতলকে। চিৎকার করতে করতে ভিজতে থাকে সে। প্রতিটা ফোঁটায় যেনো সজীবতা উপচে পড়ছে তার। চুল, কপাল, ঠোঁট থেকে বুক, নিরলস বৃষ্টি ধারায় ভেসে যেতে থাকে। আজকের মতো আনন্দ তার জীবনে আগে খুব বেশি আসেনি। সবকিছু ভালো লাগছে তার আজকে। মাচায় উঠে যাওয়া লাউগাছ কিংবা শ্যাওলা পড়া দোতলার সিঁড়ি অথবা লাল পিঁপড়ের গর্ত আজ সব সুন্দর লাগছে। এই রাতটা শুধুই তার। সে কাঁদবে, হাসবে, বৃষ্টিতে ভিজবে যা ইচ্ছা তাই করবে।

গমগম করে আওয়াজ হচ্ছে বৃষ্টির, দূর থেকে যেনো আরো ধারা টেনে আনছে। প্রকৃতি যেনো আজ বদ্ধপরিকর, মায়াবতীটার মুখে আরো হাসি ফোটাতে হবে। আজ এই উঠোনেই সমস্ত সুখবৃষ্টির ধারা বর্ষণ হবে।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। এই আলোর ঝলকানি ভীষণ ভয় পায় সে। মুহুর্তের মধ্যে দানবের মতো চিৎকার করে মেঘে গর্জন করে ওঠে। অদূরেই কোথাও বোধহয় বাজ পড়েছে। শীতল খুব ভয় পায় এই শব্দ। ভয়ে কানে হাত চেপে বসে পড়ে সে। উদ্বেগে সোজা হয়ে দাঁড়ায় উৎস।
“গাধী মেয়েটা ভয় পাচ্ছে যখন ঘরে কেনো চলে যাচ্ছে না? পাগল নাকি?”
পরপর আরো দুইবার গর্জন শোনা যায়, আগের চেয়ে বেশি। শীতল কানে হাত চেপে কাঁপতে থাকে বসে বসে। উৎস রাগে দাঁত কিড়মিড় করে। জীবনে অনেক বোকাচন্দ্র দেখেছে সে, এই মেয়ের কাছে তারা নস্যি। ভয় পাচ্ছিস যখন ঘরে চলে যাচ্ছিস না কেনো? একে গাধী বললেও, গাধা জাতের অপমান করা হবে।

শীতল কেমন নিস্তেজ হয়ে যায় ভয়ে। উৎসের বুক কেঁপে ওঠে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপেও উঠছে মেয়েটা। বৃষ্টির পানি বরফের মতো ঠান্ডা। ঠান্ডা লেগে নির্ঘাত বাঁধাবে একটা রোগ।
আর কিছুই মনে নেই উৎসের। ছুটে চলে যায় শীতলের কাছে। দুই বাহু চেপে তাকে দাঁড় করায়। শীতল অবাক হওয়ার আগেই তীব্র শব্দে বাড়ির খুব কাছে বাজ পড়ে একটা। শীতল উপয়ান্তর না পেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উৎসকে। উৎসের শরীর হালকা হয়ে যায় সাথে সাথে। শীতলের দুই বাহু থেকে হাত নামিয়ে নেয়।

“শীতল, ঘরে চলো।”
শীতল ধাতস্থ হতেই ছিটকে যায়। তার চোখকে বিশ্বাস হয়না। এই লোক এখানে কি করে? এটা কি কোনো ভ্রম? নিশ্চয়ই তা-ই হবে।

হঠাৎই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে শীতল। চুলগুলো সামনে এনে অস্থিরতা প্রকাশ করে। উৎস বুঝতে পেরে অন্যদিকে তাকায়। দূরেই শ্বেতশুভ্র ওড়নাটা কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। উৎস এগিয়ে যেয়ে ওড়নাটা তুলে আনে। সামনে তুলে ধরে শীতল।
দ্রুততার সাথে শীতল ওড়নাটা গায়ে পেঁচায়। ঠান্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে তার। কাঁপছে একটু পর পর। ঠোঁটজোড়া গাঢ় নীল বর্ণ ধারণ করেছে।

“ঘরে যাও।”
শীতল ভয়ার্ত গলায় বললো,”আপনি কখন থেকে এখানে এসেছেন?”
উৎস ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে বললো,”এইযে যখন ওড়না ছুড়ে ফেলে দিয়ে নাচানাচি করছিলে।”
শিউরে ওঠে শীতল। লজ্জায় কুঁকড়ে যায় নিজের মধ্যে। তাকাতে পারেনা উৎসের দিকে।
“লুকিয়ে দেখছিলেন নাকি আমাকে?”
উৎস নেশাক্ত গলায় বললো,”কেনো লুকিয়ে না দেখলে এভাবে নাচতে না আমার সামনে?”
শীতল উৎসের অসভ্যতা দেখে চরম অবাক হয়ে যায়। ভিতর ভিতর এই ছেলে এতোটা অসভ্য বোঝাই যায়না। ছি, কি লজ্জা!

“নাচ দেখার এতো শখ?”
“না তবে ওড়না ছুড়ে ফেলে দিলে অন্য ব্যাপার।”
শীতল লজ্জায় উৎসের বুকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়াতেই উৎস পিছন থেকে তার হাত চেপে ধরে। দুইটা সাদা কাঁচের চুড়ি আলগোছে ভেঙে নিচে পড়ে যায়।
“পালিয়ে যাচ্ছো কেনো?”
“ছাড়ুন, কি করছেন?”
উৎস আচমকাই শীতলকে টেনে নিজের দিকে ফেরায়।
পকেট থেকে একটা নথ বের করে শীতল। এক হাতে শীতলকে শক্ত করে ধরে আরেক হাত দিয়ে পরিয়ে দেয় শীতলের নাকে। শীতল নিজের মধ্যে নেই, তার বাস অন্য কোনো জগতে। যে জগতে কষ্ট বলে কিছু নেই।

“কোনো মামাবাড়ি যাওয়া চলবে না এখন বোঝা গেছে?”
“কেনো? আপনার কথা মতো?”
“হ্যা আমার কথা মতো।”
শীতল নিচের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হেসে বললো,”কেনো আপনি আমার কে?”
উৎস উত্তর দেয়না, ঠান্ডা চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শীতলের দিকে।

“তোমাকে আমার কিছু বলার আছে শীতল।”
“আমারও আপনাকে কিছু বলার আছে।”
“বেশ তুমি আগে বলো।”
“না না আপনি বলুন আগে।”
“উহু, লেডিস ফার্স্ট।”
শীতল অসহায় বোধ করে। কীভাবে বলে বসলো কিছু বলার আছে। এখন কি বলবে সে? কীভাবে বলবে সে কথা?

“কি হলো বলো।”
“আমার এখন বলতে ইচ্ছা করছে না। আপনি বলুন।”
“আমি বলার পর বলবে?”
“বলতে পারি।”
উৎস নিজের মুখটা শীতলের কানের কাছে নিয়ে আসে। শরীর শিরশির করে ওঠে শীতলের।

“শীতল।”
শীতল অস্ফুটে সাড়া দেয়।
“তোমাকে না….”
“আমাকে কি?”
“তোমাকে আমার….”
“উফফ কি বলুন না।”
“তোমাকে আমার একদম পেত্নীর মতো লাগে।”
ভয়াবহভাবে চমকে উঠে শীতল উৎসের দিকে তাকায়। উৎস ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকায়। বৃষ্টির বেগ কমে গেছে অনেকটা। হালকা ঝিরঝির করে পড়ছে এখন ধারা। মেঘটা কেটে আবার চাঁদ ফোটা শুরু করেছে।
শীতল রাগে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস নিতে থাকে। না, এই লোক ভালো হবে না। সম্ভবই না। এই লোক ভালো হওয়া মানে সূর্য দক্ষিণ দিক থেকে ওঠা।

“আমি গেলাম।”
“কি হলো তোমার কথাটা বলে গেলে না?”
শীতল লাল চোখে উৎসের দিকে তাকিয়ে বললো,”না।”
উৎস চুলে হাত দিয়ে পানি মুছতে গেলেই হঠাৎ যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে। শীতল চমকে পিছনে তাকাতেই দেখে উৎস বাম হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ।
এতোক্ষণ পর যন্ত্রণাটা টের পাচ্ছে উৎস। ঘা টা দগদগে হয়ে আছে।
শীতল ছুটে এসে হাতটা টেনে ধরে নিজের দিকে। উৎস বারণ করা সত্ত্বেও টেনে নেয়। তাকাতেই হতভম্ব হয়ে যায় সে।

“এসব কি? কীভাবে হলো?”
উৎস হাত টেনে নেয়।
“ও কিছু না।”
“কিছু না মানে? এতো বড় ক্ষত আর আপনি বলছেন কিছু না?”
“বললাম তো কিছু না। ঘরে যাও, জামা পালটে নাও।”
“একদম চুপ।”
শীতল ঘরে চলে যায়া, একটু বাদেই ফিরে আসে ওষুধ আর একটা কাপড় নিয়ে।
খুব যত্ন করে উৎসের হাতে ওষুধ লাগিয়ে দেয়, এরপর কাপড়টা বেঁধে দেয়। পুরোটা সময় উৎস ঘোরলাগা চোখে শীতলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো উচ্চবাচ্য করেনা। প্রেমিক পুরুষ বুঝি এমনই হয়। সাতটি মহাদেশ শাসন করা পুরুষটিও হয়তো প্রেমিকার সামনে অসহায়। মহাদেশ শাসন করা প্রেমিকটিকে শাসন করে তার শখের নারী।

“কীভাবে হলো এসব?”
“জানিনা।”
শীতল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”মহাপুরুষ সাজার খুব ইচ্ছা বুঝি আপনার?”
“কেনো আমি কি তা নই?”
“না মহাপুরুষ হওয়া এতো সহজ না।”
“তাহলে কি করতে হবে আমাকে মহাপুরুষ হতে?”
শীতল গাঢ় গলায় মাথা নিচু করে বললো,”ভালোবাসতে জানতে হবে আগে।”
“সেটা কেমন?”
“আগে প্রেমিক হতে হবে, উন্মাদের মতো ভালোবাসতে হবে। ভয়, লজ্জা ভুলে কাছে আসতে হবে।”
“তাতেই আমি মহাপুরুষ হয়ে যাবো?”
“তাতে প্রেমিক পুরুষ হবেন, মহাপুরুষ হওয়া যে আরো সাধনার বিষয়।”
“মহাপুরুষ হওয়ার চেয়ে নারীর মন পাওয়া বেশি সাধনার বিষয়।”
শীতলের আরো অনেকক্ষণ থাকতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু না, তার মা মাঝরাতে উঠে মাঝেমাঝেই বারান্দায় হাঁটে। দেখে ফেললে খারাপ কিছু হয়ে যাবে।

“আমি আসি উৎস ভাই।”
“পোড়ার ওষুধ দিয়ে যাও।”
“দিলাম তো।”
“আর হৃদয় পোড়ারটা?”
“তার মানে?”
উৎস শীতলের কাছাকাছি এসে বললো,”তার মানে বোঝার জন্য যে উর্বর মস্তিষ্ক থাকার কথা, তা শুধু মানুষদেরই থাকে। গাধা সম্প্রদায়ের কোনো ভদ্রমহিলার থাকে না।”
“আপনি আবার আমাকে গাধা বললেন?”
“না গাধী বলেছি।”
শীতলের রাগী দৃষ্টি উপেক্ষা করে উৎস চলে যায়। শীতল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরেই লাজুক হাসি দেয় মাটির দিকে তাকিয়ে। সে যা বোঝার বুঝে গেছে। এই রাত তাকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। আজ রাতটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত।

ঘরে ঢোকার মুখে সায়েরাকে থমকে যায় শীতল। ফুপু এতো রাতে এখানে? সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সায়েরা। সে কি কিছু দেখেছে?

“ফুপু তুমি এখানে?”
সায়েরা উত্তর দেয়না। শীতল নি:শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে কি উৎস ভাইয়ের সাথে দেখে নিয়েছে ফুপু? খুব রাগ করবে?
“শীতল।”
“বলো ফুপু।”
সায়েরা একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”অসময়ে ভিজলে যে তো ঠান্ডা লাগে এটা মনে থাকে না?”
“ফুপু ওই আসলে হঠাৎ করে……”
“ঘরে চল, আমি মুছে দিচ্ছি।”
“ফুপু আমি পারবো।”
সায়েরা শান্ত চোখে শীতলের দিকে তাকাতেই শীতল নুইয়ে যায়।
“চলো ফুপু।”
শীতলের হাত ধরে সায়েরা তাকে তার ঘরে নিয়ে চলে। শীতল শুধু বোঝার চেষ্টা করে তার ফুপু কিছু বুঝে গেলো কিনা। চাপা স্বভাবের মানুষ, তাকে বোঝা প্রায় অসাধ্যের কাছাকাছি।

শীতল মামাবাড়ি যাচ্ছে না এই খুশিতে সবাই আজ বাড়িতে। নওশাদও অফিস যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। বাজার করা হয়েছে, পিকনিক হবে আজ বাড়িতে। আয়োজন খারাপ না। খিচুড়ি, ডিম ভাজি আর বেগুন ভাজি। সায়েরা আবার উৎসকে বাজারে পাঠিয়ে মুরগি আনিয়েছে কারণ শীতল বেগুন ভাজি খায়না। সবকিছুর বাইরে সায়েরার শীতলের দিকেই নজর।
আবিরের ব্যথাটা কম হলেও তাকে যেতে দেয়নি নওশাদ। বাড়িতে যতো সামান্যই আয়োজন হোক না কেনো, ছেলেমেয়েগুলো আনন্দ করবে আর ও চলে যাবে এটা সে মানতে পারছে না। শাহানার সাথে সকাল সকাল একপ্রস্ত বিবাদও হয়ে গেছে। শাহানার ধারণা তার স্বামী তাদের বাড়িতে চিড়িয়াখানা খুলে বসেছে। দুইদিন পর পর নতুন নতুন চিড়িয়া ধরে আনছে। নওশাদ বিপরীতে কিছুই বলেনি, শুধু হেসেছে। এতে আরো রাগ হয়েছে শাহানার। এমনিতেই শীতলের উপর রেগে আছে সে। কতো করে চেয়েছিলো বাপের বাড়ি যাবে কতোদিন পর। মেয়েটার মাথায় নির্ঘাত ভূত চাপে মাঝে মাঝে। রাগ করে সে শুয়ে আছে নিজের ঘরে। সে ঠিক করেছে আজ সে ঘর থেকেই বের হবে না।

উঠোনে নওশাদ চুলা বানিয়েছে ইট দিয়ে। সায়েরা আর বহ্নি মশলা, সবজি কাটাকাটিতে লেগে পড়েছে। শীতলও সাহায্য করছে টুকটাক। আজ তার মন মাত্রাতিরিক্ত ভালো। এতোটাই ভালো যে তার শখের কাজলটা আভা সকালে ভেঙে ফেলেছে তাও তাকে কিচ্ছু বলেনি, ক্ষমা করে দিয়েছে। আভা তো অবাক। মেজো আপার মুখে এমন হাসি আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না।

“শাহানা এই শাহানা।”
শাহানা উত্তর দেয়না। স্বামীর উপর অসম্ভব রাগ হচ্ছে তার কেনো যেনো।
নওশাদ একটু হেসে দরজা ভেজিয়ে শাহানার পাশে এসে বসে। সে খুব ভালো করে জানে স্ত্রীর রাগ ভাঙাতে হয় কি করে।
“দোয়েল পাখি।”
“চুপ থাকো, একদম চুপ।”
“আরে বাবা! এটা তো দোয়েল হতেই পারেনা, দাঁড়কাক মনে হয়।”
শাহানা রাগে উঠে বসে।
“তো যাওনা কোথায় কোকিল পাও নিয়ে এসো। এই সংসারে আমি তো উটকো ঝামেলা একটা। মেয়েরাও মা’কে মানেনা, আমার স্বামীও আমাকে পাত্তা দেয়না।”
নওশাদ স্মিত হেসে বললো,”আমি তোমাকে পাত্তা দিই না?”
“না দাও না। বাড়িতে এতো বড় বড় মেয়েরা, সেদিকে খেয়াল নেই? বাইরের ছেলেদের ঘরে এনে রেখে দিয়েছো। সর্বনাশ একটা না ঘটিয়ে শান্ত হবে না তুমি।”
“তুমি কি রণ আর আবিরের কথা বলছো?”
রাগে গজগজ করে ওঠে শাহানা। বাইরের আর আছে কে? এই লোক কি বোকা?
“ওরা তেমন ছেলেই নয় শাহানা। ওদের সাথে একটু কথা বললেই বুঝবে। ওরা খুব ভালো।”
“হ্যা তোমার কাছে তো আমি বাদে সবাই ভালো। ভালোমানুষির মুখোশ পরে যখন একটা সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলবে সেদিন বুঝবে।”
নওশাদ শাহানার হাতের উপর হাত রাখে।
“তুমি অযথাই চিন্তা করছো শাহানা। আর আবির আজকেই চলে যাবে খাওয়া দাওয়ার পর। সকালেই চলে যেতো, আমি থাকতে বলেছি। বাড়িতে পিকনিক আর ছেলেটা চলে যাবে? একা একা হলে থাকে, কি খায় না খায়। বড় মায়া লেগেছে ওকে আমার।”
“হ্যা এই মায়ার সাগর মহাপুরুষের যন্ত্রণায় আমি শেষ।”
নওশাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”শাহানা একটা অনুরোধ করবো রাখবে?”
শাহানা যতোই রেগে থাকুক। স্বামী নরম সুরে কথা বললে সে গলে যায়। তবুও নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে সে।
“আবার কি?”
“ছেলেমেয়েগুলো আজ একটু আনন্দ করুক না। ওদেরকে ডেকে নিচে আসতে বলি? মানে রণ, আবিরকে, সাথে উৎস।”
শাহানা রাগে দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। বিরক্তিতে স্বামীর দিকে তাকাতে পারেনা।

“তুমি আর না করোনা শাহানা।”
“বলছি ডেকে আনার পর এখানে অনুমতি নিতে এসেছো তাইনা? জানো যে আমি না করতে পারবো না একটু ভালো করে কথা বললে।”
নওশাদ আমতা আমতা করতে থাকে। শাহানা ভালোই চালাক, বহ্নি মায়ের মতো চালাক হয়েছে।

“নওশাদ সাহেব এতোগুলো বছর আপনার ঘর করলাম, আপনি আমাকে ভালো করে না চিনলেও আমি আপনাকে খুব ভালো করে চিনি। ভালোই আমার ভালোমানুষির সুযোগ নেওয়া হচ্ছে।”
নওশাদ মুচকি হেসে মাথা চুলকায়। তার নিজের মনেও ভীষণ শান্তি আজকে। বেশ অনেকদিন পর খাঁ বাড়িটা এমন গমগম করছে। মেয়েগুলোর হাসির আওয়াজ যেনো সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচিরের মতো। কি ভালো লাগছে শুনতে। মেয়েগুলো বড় না হলেই বোধহয় ভালো হতো। ছোট ছিলো, ভালো ছিলো। অল্পতেই আনন্দিত হতো, হাসতো, খেলতো বাড়িজুড়ে। বড় হচ্ছে আর কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে নিজের মধ্যে। হঠাৎ হঠাৎ এমন আনন্দের দিন জীবনে আসলে নেহাৎ খারাপ লাগেনা, খুব ভালো লাগে। সন্তানদের নিয়েই আমুদে মানুষ নওশাদ আলম খাঁ।

উৎস উঠোনের কোণায় মাদুর পেতে পা ছড়িয়ে বসেছে। মামার নির্দেশ আসতেই হবে নিচে, পিকনিক হবে নাকি। তার এসব ভালো লাগেনা। সে এসেছে শুধু শীতলের জন্য। সিগারেটের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ তার। মামার ভয়ে পারছেও না ধরাতে।
আবির হতভম্ব হয়ে আভার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েগুলো আজ শাড়ি পরেছে। সকাল সকাল নওশাদ মেয়েদের জন্য শাড়ি কিনে এনেছে। সাধারণ সুতী শাড়িতেও অপূর্ব লাগছে পরীগুলোকে। নওশাদ অবাক, তার মেয়েগুলো এতো রূপবতী কেনো? মনে হচ্ছে তার একফালি উঠোনে তিনটা জীবন্ত পুতুল ঘোরাঘুরি করছে।

বহ্নি পরেছে হালকা গোলাপি। চুলার ধোঁয়ায় মুখটা লালচে হয়ে আছে তার। রণ ভয়ে ভয়ে একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তবে ভয় নেই আবিরের। তার দৃষ্টি আকাশী শাড়ি পরা আভার দিকে। মনে হচ্ছে আকাশে এক খণ্ড তুলার মতো সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আভার চোখ সেদিকে গেলেই আবির অন্যদিকে তাকানোর ভান করছে। বহ্নি তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় আভার দিকে। আভা ভয়ে ভয়ে স্থান ত্যাগ করে।
শুধু শীতল তেমন কিছু করতে পারছে না। গতকাল পায়ের ব্যথাটা না বোঝা গেলেও সকাল থেকে ভালোই যন্ত্রণা করছে। তাকে কোনো কাজ দেওয়া হচ্ছে না। মোড়া নিয়ে বসে আছে বাবার পাশে। সে পরেছে গাঢ় বেগুনী রঙের শাড়ি, এলোমেলো খোঁপাতেও যেনো তাকে কি ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে। উৎসের বেহায়া চোখ সরছে না তার উপর থেকে।

“বন্ধু চোখ নামাও, তোমার শ্বশুর দেখলে খবর আছে।”
উৎস ভ্রু কুঁচকে আবিরের দিকে তাকায়। আবির মিটমিট করে হাসছে।
“অনুপমার দিকে চোখ দিলে চোখ উঠিয়ে ফেলবো, সাবধান।”
আবির ভেবাচেকা খেয়ে বললো,”মোটেই আমি ওদিকে তাকাচ্ছিনা।”
“কোনোদিকেই তাকাবি না তুই। আজ দিনের জন্য মনে কর তুই অন্ধ।”
“আমি অন্ধ?”
“হ্যা অন্ধ, চিরতরে অন্ধ হতে না চাইলে আজকের জন্য অন্ধ হয়ে যা।”
আবির মুখ ভোঁতা করে বসে থাকে। নিজে করলে ঠিক আছে, তার বেলাতেই যতো খবরদারি।

চুলায় কাঠ দিতে দিতে বহ্নি হঠাৎ তাকায় রণের দিকে। রণ তারদিকেই তাকিয়ে ছিলো একদৃষ্টিতে।
“ফুপু জ্বালটা একটু দেখো আমি আসছি।”
সায়েরাকে কাঠ ধরিয়ে দিয়ে বহ্নি উঠে দাঁড়ায়। রণ ভয়ে ভয়ে উঠোনের অন্য প্রান্তে চলে যায়।

“কি দেখছেন ওভাবে?”
“জ্বি আমাকে বলছেন?”
“নিজেকে অনেক চালাক মনে করেন?”
বহ্নির ক্ষিপ্র চেহারার সামনে অসহায় বোধ করে রণ।

“কাপুরষ আমার পছন্দ না, পুরুষ হবে সিংহের মতো হিংস্র। কোমলতা মেয়েদের অলংকার, পুরুষের নয়।”
“জ্বি আমাকে এগুলো বলছেন কেনো?”
বহ্নি যেতে যেতে ছোট্ট করে হেসে বললো,”কেনো বলছি এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি না থাকলে আমার দিকে আর ওভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। চুলা থেকে জ্বলন্ত কাঠ উঠিয়ে ছুড়ে মারবো চোখের দিকে।”
বহ্নি চলে যায়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে রণ। বাপ রে, এটা মেয়ে নাকি মানুষের রূপ ধরা এনাকোন্ডা? বিষ দিয়েই শেষ করে ফেলবে। সে ঠিক করে কোনোভাবেই আর তাকাবে না মেয়েটার দিকে। যে মেয়ে, জ্বলন্ত কাঠ তার চোখের দিকে ছুড়ে দিলেও বিন্দুমাত্র অবাক হবে না সে।

আবির গুণগুণ করে গান করতে থাকে আভার দিকে তাকিয়ে। উৎস কিছুক্ষণ সিগারেট খাওয়ার জন্য বাইরে গেছে।
‘এ কি খাওয়াইছো আমায়,
ঘোরে আসমান জমিন ভাই।
সবই উলোটপালোট লাগে আমি যেদিকে তাকাই।
আশেপাশে সুন্দরী এক পরী দেখতে পাই।’

“পরীর পাশে জ্বিন দেখতে পাস না?”
আবির বিরক্ত হয়, আবার চলে এসেছে ছেলেটা। শান্তিতে প্রেমটাও করতে দিবে না অসভ্যটা। উৎস পা ছড়িয়ে বসে আবার। শীতল বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে বারবার তার দিকে। তা দেখে আফসোস করে আবির। আভা টা যে কেনো পাত্তা দিচ্ছে না তাকে।

“নওশাদ আলম বাড়িতে আছেন?”
গেটে কারো গলার আওয়াজ শুনে তাকায় সেদিকে। নওশাদ সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়।
“আমাকে খুঁজছেন?”
“আপনিই নওশাদ আলম খাঁ?”
“হ্যা আমি, আপনার পরিচয়?”
“আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি ছোট রুস্তমের লোক।”
ছোট রুস্তমের কথা শুনে উৎস আর আবির উঠে দাঁড়ায়। তারা খুব ভালো করে লোকটাকে চিনে। এই লোকের সাথে মামার কি সম্পর্ক?

নওশাদ বিরস মুখে তাকায়, কপাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম ঝরে।
উৎস গম্ভীর গলায় লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো,”ছোট রুস্তমের লোক এখানে কেনো?”
“সেইটা উনাকেই জিজ্ঞেস করুন।”

উৎস নওশাদের কাছে এগিয়ে আসে। মুখটা লাল হয়ে গেছে তার। মনে হচ্ছে সে ভয় পাচ্ছে।

“মামা।”
“উৎস তুই এসবের মধ্যে ঢুকিস না।”
“কিন্তু….”
“চুপ কর তুই।”

“আপনাকে দলিল সহ ছোট রুস্তম ভাই ডেকেছে। আমার সাথে এখনই যেতে হবে।”
শাহানা এসে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে বারান্দায়। বুকটা অজানা কারণে কেমন ঘন ঘন কাঁপছে তার।

“তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
আলমারি থেকে দলিল খুঁজে বের করছে নওশাদ।
“কি বলছি শুনছো না?”
“শাহানা তুমি বাচ্চাদের পাশে বসো, আমি যাবো আর আসবো।”
শাহানা নওশাদের হাত ধরে নিজের দিকে ফেরায়।
“তোমাকে কোথাও যেতে দিবো না আমি।”
“শাহানা বোকার মতো কথা বলছো কেনো? যেতে হবেই আমাকে।”
“তাহলে উৎসকে সাথে নিয়ে যাও।”
নওশাদ শাহানার গালে আলতো করে হাত দিয়ে বললো,”কেনো শুধু শুধু ওকে নিয়ে ঝামেলায় জড়াবো? যে কাজটা আমি একাই পারবো। ওর মাথা গরম, কখন কি করে।”
শাহানা চিৎকার করে উঠে বললো,”আমি তোমাকে একা কোনোভাবেই যেতে দিবো না।”
নওশাদ শাহানার কপালে একটা চুমু এঁকে দেয়।
“তোমার দোয়া সবসময় আমার সাথে আছে শাহানা, আমার কিচ্ছু হবে না।”
শাহানার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নওশাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ঘরের বাইরেই উৎস দাঁড়িয়ে আছে দুই হাত পিছনে বেঁধে। মামাকে সে কোনোভাবেই একা যেতে দিবে না।

(চলবে…….)