মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-১৪+১৫

0
100

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ১৪

অসহ্য গরম লাগছে নওশাদের। কপাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঘাম পড়ছে। রুমাল দিয়ে বারবার মুছছে সে কপাল। ঘরে এসি আছে, তবে চালানো হয়নি। মনে হয় এসি নষ্ট আবার হতে পারে তাকে এমন কেউ মনে করা হয়নি যাতে তার জন্য এসি চালাতে হবে।
লম্বা ধরণের ঘরটা। তাকে বসানো হয়েছে লোহার একটা চেয়ারে। মেরুদণ্ডে ব্যথা হয় তার এমন চেয়ারে বসলে। বারবার নড়াচড়া করছে সে। সামনে এক গ্লাস পানি। পিপাসা লাগলেও খেতে ইচ্ছা করছে না এখান থেকে কিছু।

প্রায় মিনিট দশেক পর বেঁটেখাটো, থলথলে মোটা শরীরের এক লোক ঘরে ঢোকে, পিছনে দুইটা কম বয়সী ছেলে। তাকে দেখে নওশাদ উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সাথে সাথে লোকটা তাকে আটকায়।

“আরে আরে করছো কি নওশাদ? বসো।”
নওশাদ কিছুটা বিরক্ত হয়। হাঁটুর বয়সী একটা ছেলে তাকে তুমি করে বলছে আবার নাম ধরে ডাকছে। বিন্দুমাত্র ভদ্রতা নেই।

“রুস্তম আমাকে ডেকেছো তুমি। কি বলতে চাও বলো।”
রুস্তম দুই গাল হেসে নওশাদের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রেখেছে, পানের রস গড়িয়ে পড়ছে ঠোঁটের নিচে। খুবই বিশ্রী লাগছে তাকে দেখতে। নওশাদের মোটেই ভালো লাগছে না এখানে থাকতে।

“আরে তোরা কি পাগল? তোদের সবকিছু নতুন করে শেখাতে হবে? তোদের চাচামিয়ার সামনে শুধু এক গ্লাস পানি? নাশতা আনবে কি তোদের বাবা? যা নাশতা নিয়ে আয়, মিষ্টি নিয়ে আয়। আর শরবত না দিয়ে হুদা পানি দিয়েছিস কোন হারা’মজাদা? এসিটাও ছাড়িস নি। তোদের আমি দেখে নিচ্ছি, অপেক্ষা কর।”
ছেলেগুলো তাড়াহুড়ো করে এসি ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
নওশাদ ইতস্তত করে বললো,”আমি কিছুই খাবো না রুস্তম। এসব ঝামেলা করোনা। কি বলতে ডেকেছো, বলো।”
রুস্তম আবারও হাসে। কারো হাসি এমন কদর্য হতে পারে এই লোককে না দেখলে বোঝা যেতো না। যার যেমন স্বভাব, তেমন হাসি।
“নওশাদের দেখি অনেক তাড়া। অবশ্য হবেই তো, পিকনিকের খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
নওশাদ অবাক হয়ে বললো,”তুমি কীভাবে জানলে?”
“নওশাদ, এই রুস্তমের জানার পরিধি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই।”
“আমি ধারণা করতে চাই-ও না রুস্তম। তুমি বলো তুমি কবে আমার জমির ভোগদখল থেকে বিরত হবে? আমার এখন টাকার দরকার।”
রুস্তম আনমনে হাসে। পকেট থেকে আরেকটা পানের খিলি বের করে মুখে পুড়ে দেয়।
নওশাদ অসহিষ্ণু হয়ে বললো,”রুস্তম আমি কিছু বলছি তোমাকে। জমি আমার, দলিল আমার। অথচ তুমি সেখানে কতোগুলো টিনের ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছো। আমি এতোদিন কিছু বলিনি। তবে আমার এখন টাকার দরকার, আমি জমি বিক্রি করবো।”
রুস্তম চাপা গলায় বললো,”এতোদিন কিছু বলোনি কেনো নওশাদ? বাড়িতে গুণ্ডা পোষার সময় নিলে বুঝি?”
“কি বলতে চাও তুমি?”
“বলতে চাইনা, বলছি। আমার বিরুদ্ধে গুণ্ডা লেলিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাই বাড়িতেই নিজের ভাগ্নেকে গুণ্ডা, মাস্তান বানিয়ে নিলে? ভেবেছো দুইদিনের পুচকে ছোড়াকে ভয় পাবো আমি?”
নওশাদ রাগান্বিত গলায় বললো,”দেখো রুস্তম, আমাদের ঝামেলার মধ্যে ওকে টেনে এনোনা। তাছাড়া ও গুণ্ডা বা মাস্তান কিছু না। হতে পারে ও ভার্সিটিতে ছাত্র রাজনীতি করে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকারের জন্য লড়াই করে। তার মানে এটা নয় যে ও ভার্সিটির বাইরেও এসব করবে।”
রুস্তম শব্দ করে হাসে।
“তাহলে ভাগ্নেকে এখনো চিনতে পারোনি নওশাদ। দুইদিন পর যখন বড় বড় মাফিয়াদের ভাড়াটে গুণ্ডা হিসেবে মানুষ খু’ন করবে সেদিন বুঝবে।”
“রুস্তম…..”
“আমার উপর চিৎকার করে লাভ আছে? বেশ আমি কিছু বলছি না। তবে তোমার ঘরে তো তিনটা মেয়ে। ওর জন্য যদি ওদের বিয়ে দিতে অসুবিধা হয়, সেদিন বুঝবে দুধকলা দিয়ে কি কালসাপ পুষেছো। তুমি ওর ততটুকুই দেখো, যতোটুকু তোমাকে দেখায়। এর বাইরে ওর পরিচয় কি তা আমার মতো লোকেরাই জানে।”
নওশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আমার মেয়েদের নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না রুস্তম।”
নওশাদের কথার মধ্যেই ছেলেগুলো নাশতা নিয়ে ঘরে ঢোকে।
“খাও নওশাদ। আর হ্যা নির্ভয়ে খাও। বিষ মেশাইনি আমি।”
রুস্তম আবারও হাসে, যেনো কি মজার একটা কথা বলে ফেলেছে।
“আমি খাবো না, যেখানে সেখানে খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার।”
রুস্তম মুখ টিপে হেসে বললো,”ও হ্যা, তোমার মেয়েদের কথা ওঠায় মনে পড়লো। তোমার মেজো মেয়ে, নামটা যেনো কি?”
নওশাদ উত্তর দেয়না। ভ্রু কুঁচকে তাকায় রুস্তমের দিকে। হঠাৎ ও শীতলের কথা কেনো তুলছে? উদ্দেশ্য কি?

“ও হ্যা শীতল। কিসব নাম যে রেখেছো মেয়েদের। মেয়েদের নাম হবে আলেয়া, রাবেয়া, মৌসুমি। যাই হোক, তোমার মেজো মেয়ে শীতলকে সেদিন দেখলাম কলেজ থেকে বাড়ি ফিরছিলো তখন। মানতেই হবে নওশাদ, তোমার মেয়েরা একেকটা জিনিস মাইরি। উফফফ…..”
নওশাদ চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়।
“রুস্তম তোমাকে শেষ করে দিবো আমি।”
রুস্তম শান্ত গলায় বললো,”আরে বসো বসো। এই বয়সে এতো উত্তেজিত হতে নেই। কখন রক্তচাপ উঠে হুট করে মরে যাবে, তখন মেয়েদের কে দেখবে?
নওশাদ রাগে কাঁপতে থাকে থরথর করে। অসভ্যটার গালে সপাটে চড় মারতে পারলে কিছুটা শান্তি হতো।

“আচ্ছা আচ্ছা এতো রাগ হতে হবে না। দলিলগুলো দেখি।”
নওশাদের হাত থেকে দলিল গুলো নিয়ে রুস্তম গম্ভীরভাবে দেখতে থাকে।

“সব তো তোমার নামেই, তাহলে সমস্যা কি? বিক্রি করো তোমার জমি তুমি।”
“সমস্যা কি তুমি জানোনা? একটা ক্রেতা গেলেই তাকে তোমার লোকেরা বলে দেয় এই জায়গা নাকি তোমার। তোমার কাছ থেকে নাকি আমি জমি বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছিলাম কবে। টাকা শোধ করতে পারিনি তাই জায়গা নিয়ে নিয়েছো তুমি। এসব মিথ্যা কথা কেনো রটাচ্ছো তুমি?”
রুস্তম রুমাল দিয়ে পানের রস মোছে। এই মুহুর্তে তাকে অতি জঘন্য লাগছে নওশাদের। এই শহরের একজব বড় মাপের মাফিয়া সে। তার ভাড়াটে গুণ্ডা পুরো এলাকা চষে বেড়ায়। নওশাদ শুধু তাকে কিছু বলতে পারছে না মেয়েগুলোর জন্য। মেয়েগুলো বড় হয়েছে, এখন অনেক ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নিতে হয়। রুস্তমের পক্ষে অসম্ভব কিছুই না। কিন্তু আজ সে কোনোভাবেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অসভ্যটা তার শীতলের দিকে চোখ দিয়েছে। ইচ্ছা করছে চোখ দু’টো খুবলে আনতে কোটর থেকে।

“বেশ তুমি তাহলে এক কাজ করো নওশাদ।”
“কি কাজ?”
“এই জায়গা তুমি আমার কাছে বিক্রি করে দাও।”
নওশাদ কঠিন গলায় বললো,”তোমার মতো একটা বাজে লোকের কাছে আমি আমার জায়গা বিক্রি করবো না।”
“আরে কি মুসিবত, তোমার দরকার টাকা। আমি তোমাকে কোনো ক্রেতার থেকে কম টাকা তো দিবো না।”
নওশাদ উত্তর দেয়না। ঘৃণা ভরে তাকায় রুস্তমের দিকে। রুস্তম দলিলগুলো নওশাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

“ভাবো ভাবো, সময় নাও। তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। তোমার কেনো টাকা লাগবে তাও আমি জানি।”
“কি জানো?”
“তুমি তোমার ভাঙা বাড়ি ঠিক করবে, দোতলা করবে। ভেবো না, আমার কাছে ভালো মিস্ত্রিও আছে। আমি বললে সাথে সাথে চলে যাবে ওরা। বানিয়ে দিবে ভালো করে।”
নওশাদ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা কি করবে। এই লোকের সাথে কোনো কারবারিতে যাওয়ার ইচ্ছা নেই তার। যে পরিমাণ ধুরন্ধর সে, জমি লিখে নিয়ে টাকা না-ও দিতে পারে।

“কি ভাবছো নওশাদ? আমি মানুষটা খারাপ, আবার যদি তোমার টাকা মেরে দিই, তাইতো?”
“অসম্ভব কিছু তো নয়।”
“হ্যা তা অবশ্য। তবে তোমাকে আমি ঠকাবো না নিশ্চিত থাকো।”
নওশাদ ম্লান হেসে বললো,”তো আমার প্রতি এতো দয়া দেখানোর কারণ?”
রুস্তম পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বললো,”যার ঘরে তিনটা পরী আছে, রুস্তম তাদের সাথে কোনো ঝামেলায় যায়না।”
নওশাদ নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারে না। ছুটে যেয়ে রুস্তমের শার্টের কলার চেপে ধরে। রুস্তমের পোষা ছেলেগুলো ছুটে এসে নওশাদকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। রুস্তম শান্ত থাকে।

“আরে ছাড় তোরা ওকে। নওশাদ শান্ত হও।”
“আমার মেয়েদের দিকে নজর দিলে কলিজা ছিঁড়ে কুকুরকে খাওয়াবো রুস্তম।”
রুস্তম হেসে নওশাদের হাতটা কলার থেকে ছাড়ায়।
“উত্তেজিত হয়ো না নওশাদ। উত্তেজনা খারাপ জিনিস, বড়ই খারাপ জিনিস।”
নওশাদ ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। উৎস তাকে একা আসতে দিতে চায়নি। অনেক কষ্ট করে তাকে রেখে একা এসেছে সে। উৎসকে কোনো ঝামেলাতে ফেলতে চায়নি সে। আজ এই কথাগুলো উৎসের সামনে হলে কি যে হতো! হয়তো রুস্তমের লা’শ পড়ে যেতো এখানে।

“এই কে আছিস? তোদের চাচামিয়াকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়। আজ তার বাড়িতে পিকনিক বলে কথা।”
“কিন্তু রুস্তম ভাই, উনি যে আপনাকে…..”
রুস্তম চোখ লাল করে তাকায়, থেমে যায় ছেলেটা।

“চলুন আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসি।”
নওশাদ ঠান্ডা গলায় বললো,”কোনো প্রয়োজন নেই, আমি রিকশা করে চলে যাবো।”
রুস্তম নওশাদের কাঁধে হাত রেখে বললো,”আর হ্যা, ভাগ্নের লাগাম টেনে ধরো এখনই। আর যা করে করুক, আমার মাথাব্যথা নেই। আমার পিছনে যেনো না লাগে। নাহলে লাগামটা আমি নিজে টেনে ধরতে বাধ্য হবো।”
নওশাদ মুচকি হেসে বললো,”ভয় পাচ্ছো নাকি রুস্তম?”
রুস্তম থতমত খেয়ে বললো,”মানে? কাকে ভয় পাবো?”
“আমার ভাগ্নেকে।”
রুস্তম থমথমে মুখে বললো,”কি বললে তুমি? আমি ভয় পাবো দুইদিনের পুচকে ছেলেকে? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা আছে তোমার?”
“যদি তা না হবে, বারবার আমার ভাগ্নের কথা কেনো বলছো? দুইদিনের পুচকে ছেলেকে নিয়ে তোমার মতো মানুষ এতো ভাববে কেনো?”
রুস্তমের মুখের হাসি নিভে যায় মুহুর্তেই। তার বদলে একরাশ রাগ ভর করে চেহারায়।

“ওর মতো পাতি নেতারা না আমার বগলের তলায় দু’চারটা থাকে। দুই মিনিটে উঁকুনের মতো টিপে পিষে ফেলতে পারি আমি ওরকম নেতা। কি বলছো জানো তুমি?”
নওশাদ কিছু না বলে বেরিয়ে যায়। অপমানিত মুখে রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে রুস্তম পিছনে।

সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে উৎস বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। নওশাদ সেই দুপুরে আসার পর থেকে চুপ করে ঘরে বসে আছে। শাহানা বা তিন মেয়ে বা উৎস কেউ তার সাথে কথা বলার সুযোগ পায়নি। হঠাৎ সে কোথায় গেলো, কি বা কথা হয়েছে কিছুই বলতে চাচ্ছে না কাউকে। পরে উৎস সবাইকে মানা করেছে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে। বলার হলে সে নিজেই বলবে। শুধু শুধু তাকে বিরক্ত না করাই ভালো।

শুধু উৎসবের আমেজটা কেটে গেছে। সবাই খাওয়াদাওয়া করলেও কারো মন ছিলোনা এদিকে। আবির চলে গেছে বিকালের দিকেই। যাওয়ার আগে আভার সাথে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো সে, সুযোগ পায়নি। রণও ঘরে চলে গেছে সেই তখন আর নামেনি নিচে। শুধু উৎস কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিলো, পরে সন্ধ্যার আগেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে।

বহ্নি, শীতল আর আভা নিজেদের ঘরে মুষড়ে বসে ছিলো। হঠাৎ মাগরিবের আজানের সাথে সাথেই গেটে আওয়াজ শুনে বেশ চমকে যায় তারা। এই অসময়ে কে এসেছে? এমন সময় কেউ তো আসেনা আর উৎসের কাছে তো চাবি আছেই।
বহ্নি গেট খুলতে গেলে শাহানা তাকে আটকায়। সে নিজেই যায় গেট খুলতে।

গেটের বাইরে আগের দিনের সেই পরীর মতো রূপবতী মেয়েটাকে দেখে বেশ অবাক হয় শাহানা। এই ভরসন্ধ্যায় এই মেয়ে এখানে কি করছে? আজ যেনো তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে এসেছে। আজ আবার শাড়িও পরেছে সে। হলুদাভ ফর্সা শরীরে কালো দামী শাড়ি, রূপ যেনো ঠিকরে বের হচ্ছে। পাতলা শাড়ির নিচে উন্মুক্ত পেট স্পষ্ট। শাহানা নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়।
তারপরেও মুখে হাসি টেনে শাহানা বললো,”কি ব্যাপার মা? কিছু বলবে তুমি?”
প্রত্যাশা স্মিত হেসে বললো,”যদি কিছু মনে না করেন, ভিতরে আসি?”
শাহানা পাশ কেটে দাঁড়ায়। কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে সে। তাছাড়া উৎসের পরিচিত মেয়ে কিন্তু উৎস বাড়িতে নেই।

“আসলে খালাম্মা, কি হয়েছে বলুন তো। আমি এদিকেই একটা পার্টিতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে আমার গাড়িটা নষ্ট হয়ে যায়৷ ড্রাইভার সারানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এই সন্ধ্যায় আমি একা কীভাবে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবো। তাই ভাবলাম পাশেই যখন আমার পরিচিত কারো বাড়ি আছে, সেখানেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যায়। গাড়ি ঠিক হলেই ড্রাইভার ডেকে নিবে আমাকে। আমি আসলে গাড়ি বাদে কোনো ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে পারিনা। আমি আসায় অসুবিধা হলোনা তো আপনাদের?”
শাহানা হেসে বললো,”না না অসুবিধার কি আছে? তুমি বসোনা।”
“ইয়ে মানে, উৎস কোথায়?”
শাহানা জোর করে হাসার চেষ্টা করে।
“ও তো বাড়িতে নেই মা, বেরিয়েছে কিছুক্ষণ আগে।”
মেয়েটাকে একটু বিমর্ষ মনে হলো এটা শুনে।
“কখন আসবে ও?”
“তাতো বলতে পারবো না। ওর কোনো ঠিকঠিকানা নেই বাড়ি ফেরার। এখনই চলে আসতে পারে আবার রাতও হতে পারে।”
“আচ্ছা আমি তাহলে ওর ঘরে বসি? ও ঘরটা কোনদিকে?”
শাহানা কিছুটা বিরক্ত হয়। অতিরিক্ত বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে নয় তো আবার? জামাকাপড়ের যে অবস্থা, তাতে তারই লজ্জা লাগছে। ছেলেদের কথা আর কি বলবে।
“আসলে ওর নিজের ঘর বলতে দোতলার ছাদের সাথে ছোট্ট একটা ঘর। ওখানে এখন অন্য একজন আছে। তাই তোমার তো এখন ওখানে যাওয়া হবে না।”
প্রত্যাশার মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।
“তুমি দুশ্চিন্তা করোনা। তুমি আমার মেয়েদের ঘরে এসো বসো। ওরা তোমার কাছাকাছি বয়সের। আশা করি সময় খারাপ কাটবে না তোমার। আর উৎস এরমধ্যে চলে এলে তো হয়েই গেলো।”
প্রত্যাশাকে দেখে মনে হলোনা খুব একটা খুশি হলো। জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে রাখে শুধু।

“বহ্নি, এই বহ্নি।”
বহ্নি বেরিয়ে আসে। মায়ের পিছনে প্রত্যাশাকে দেখে চমকে ওঠে সে। এই মেয়ে এই অসময়ে? কি চায়?
“হ্যা মা বলো।”
“ওর সাথে কিছুক্ষণ গল্প কর তোরা। ওর গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। সারানো হলেই চলে যাবে।”
বহ্নি অপ্রস্তুত হেসে বললো,”হ্যা অবশ্যই, এসোনা তুমি।”
“হ্যা তোরা গল্প কর। আমি একটু আসছি।”
বহ্নি প্রত্যাশার কাছে এসে বললো,”ঘরে এসো।”
প্রত্যাশার মনে হলোনা খুব একটা ভালো লাগছে। শুধুমাত্র উৎসের জন্য আসা এখানে। নাহলে এমন ছোট ছোট ঘরে দমবন্ধ লাগে তার।

শীতল আর আভা খাটের বসে মুড়িমাখা খাচ্ছিলো। প্রত্যাশাকে দেখে উঠে দাঁড়ায় তারা, চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই মেয়ে আবার এসেছে?
প্রত্যাশা হাসার চেষ্টা করে তাদের দিকে তাকিয়ে।
বহ্নির তার হাত ধরে খাটে বসায়।
“প্রত্যাশা বোধহয় তোমার নাম, আগের দিন ফুপু বলছিলো।”
প্রত্যাশা ছোট্ট করে হাসে।
শীতল স্বাভাবিক হতে পারেনা। মেয়েটাকে দেখে কেমন অস্বস্তি হচ্ছে তার। যদিও সে এখন জানে, সে ছাড়া তার উৎস ভাইয়ের জীবনে আর কোনো নারী নেই, প্রেম নেই। তবুও তার ভালো লাগছে না মেয়েটাকে। তার উন্মুক্ত হাত, পেট কেমন অসহ্য লাগছে তার। সে মনেপ্রাণে চাচ্ছে উৎস ভাই যেনো এখন না আসে।
আভা বিরক্তিতে শীতলের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”মেজো আপা দেখ কি পরেছে। বড় আপা এখানে কেনো এসে বসিয়েছে ওটাকে?”
শীতল উত্তর দেয়না।
“প্রত্যাশা ও আমার মেজো বোন শীতল আর ও আভা। আমাদের সবার ছোট বোন।”
“আচ্ছা।”
প্রত্যাশা চুপ করে থাকে। কেউ কিছু বলতে পারেনা, বলার খুঁজে পায়না কিছু।
প্রত্যাশাই নীরবতা ভাঙে।
“এই ঘরটা আপনাদের মধ্যে কার?”
“কার আবার? আমাদের তিন বোনেরই। এইযে তিনটা খাট দেখছো না?”
প্রত্যাশা হতবাক হয়ে তাকায়। আড়াআড়ি ভাবে কোনোরকমে তিনটা খাট পাতানো ঘরে, একটাই ড্রেসিং টেবিল, একটা দুই পাল্লার কাঠের আলমারি এক কোণায় আর একটা আলনা। ছোট্ট একটা ঘরে গাদাগাদি করে জিনিসগুলো ঠাসা। দেওয়ালের চুন খসে পড়ছে জায়গায় জায়গায়। ঘরটা যদিও খুব পরিপাটি করে সাজানো, তবুও অনেক ছোট।

“কি বললেন? এতো ছোট ঘরে আপনারা তিনজন থাকেন? অসুবিধা হয়না? আমার নিজের ঘরটাই তো এরচেয়ে তিনগুণ বড়। আমি একাই থাকি, তবুও আমার কেমন দমবন্ধ লাগে। মনে হয় আরো বড় দরকার। বাবা বলেছে আমাদের নতুন বাড়িতে ওটার চেয়েও বড় ঘর বানাবে আমার জন্য।”
তিন বোন কিছুটা অপমানিত বোধ করে। মেয়েটা নাক উঁচু, অহংকারী তা কথাবার্তায় স্পষ্ট। সে খুব সূক্ষ্মভাবে তাদের অপমান করার চেষ্টা করছে।

বহ্নি একগাল হেসে বললো,”কি যে বলো তুমি। অসুবিধা হবে কেনো? অনেক বছর যাবৎ তো আমরা একই খাটে ঘুমাতাম। পরবর্তীতে আমরা বড় হওয়ার পর আলাদা খাট দেওয়া হলো। তবে এখনো বৃষ্টির রাতে আমরা এক খাটে ঘুমাই। আমাদের ফুপুও আসে আমাদের সাথে ঘুমাতে। ফুপুর কাছ থেকে ভূতের গল্প শুনি আমরা। একসাথে মুড়িমাখা খাই, আড্ডা দিই। খুব বেশি মন ভালো থাকলে আমরা তিনবোন একসাথে খাটের উপর উঠে নাচানাচি করি। আমরা যে আনন্দ করি, আমি নিশ্চিত তুমি তোমার ওই আলিশান বাড়িতে এগুলোর কিঞ্চিৎও মজা পাওনা। শুধু ঘর বড় হলেই হয়না, সেই ঘরে আনন্দ না থাকলে দমবন্ধ হতে বাধ্য। তোমার বাবা হয়তো তোমাকে আরো বড় ঘর বানিয়ে দিবে। কিন্তু সত্যিটা কি জানো? সেখানেও তোমার দমবন্ধ লাগবে। কারণ তোমার এই আনন্দটা নেই। একসাথে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনাও যে কতোটা আনন্দের এটা বুঝবেই না তুমি। কিন্তু আমরা ভালোভাবেই বুঝি। আমরা তিনবোন যখন সারাদিনের সকল ব্যস্ততার পর একসাথে ঘুমাতে যাই, মনে হয় বুঝি স্বর্গে আছি।”
প্রত্যাশা থমথমে মুখে বসে থাকে। কিছুটা অপমানিত বোধ সে-ও করে।
“একটু বেশি বলে ফেললাম, রাগ করোনি তো?”
প্রত্যাশা কিছু বলেনা, ছোট্ট করে হাসে।

আভা মাঝখান থেকে ফট করে বলে বসে,”উৎস ভাইয়ের ঘর তো আরো ছোট, এই এত্তোটুকু। সেখানেও আবার বাবা রণ ভাইকে নিয়ে এসেছে। আমাদের না অভ্যাস আছে। একটুও দমবন্ধ লাগেনা আমাদের।”
প্রত্যাশা শীতলের দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি কিছু বলছো না যে?”
শীতল কিছুটা চমকে ওঠে।
“না না এইতো, সবাই বলছে শুনছি।”
প্রত্যাশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে শীতলের দিকে। মেয়েগুলোর পোশাক খুব সাধারণ হলেও তারা পরীর মতো সুন্দর। বিশেষ করে এই শীতল মেয়েটা। আভা মেয়েটা বেশি সুন্দরী হলেও এই শীতলের মাঝে কিছু একটা আছে। সহসা চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায়না। ভাঙা ঘরে যেনো এই রূপ বেমানান। গোবরে পদ্মফুল ফোটার মতো। লম্বা চুলগুলো খাট ছাড়িয়ে মেঝে ছুঁইছুঁই। প্রত্যাশার মনে ঈষৎ ঈর্ষা জন্মায় তাকে দেখে।

বহ্নি কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করে।
“তা প্রত্যাশা তোমার নামটা কিন্তু ভারী সুন্দর।”
“হ্যা, তবে আমার কাছের লোকেরা আমাকে আশা বলে ডাকে। উৎসও তো আমাকে আশাই বলে।”
কথাটা বলে প্রত্যাশা আড়চোখে শীতলের দিকে তাকায়। তার অনুভূতির পরিবর্তন বোঝার চেষ্টা করে। কিন্তু শীতল নির্বিকার।
আভা ভ্রু কুঁচকে বললো,”কেনো? উৎস ভাই কি আপনার কাছের লোক?”
বহ্নি আভার দিকে তাকিয়ে বললো,”আভা চুপ কর না।”
“কেনো বড় আপা? আমি কেনো চুপ করবো? তাছাড়া উৎস ভাই শুনেছি সিনিয়র উনার ভার্সিটিতে। তাকে নাম ধরে ডাকছে কেনো?”
প্রত্যাশা বিরক্ত হয়ে তাকায় আভার দিকে। মেয়েটা অতিরিক্ত বেশি কথা বলে, বাচাল।
“আচ্ছা তুই চুপ থাক।”
আভা মুখ বাঁকায়।

“আসলে উৎসই আমাকে বলেছে ওকে নাম ধরে ডাকতে।”
শীতল ঈষৎ কাঁপা গলায় বললো,”উৎস ভাই বলেছে?”
প্রত্যাশা মনে মনে হাসে। মেয়েগুলোকে তার সহ্য হচ্ছেনা। বেশি অহংকার একেবারে। আরেকটু জ্বালানো যাক এদের।

“হ্যা ও বলেছে। সন্ধ্যার পর আমরা যখন একসাথে ক্যান্টিনে বসি, ও অনেক গল্প করে আমার সাথে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে আমার মুখে। কি যে দুষ্টু।”
গা-পিত্তি জ্বলে যায় তিন বোনের। মেয়েটাকে ঘাড় ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দিতে ইচ্ছা করে।

কেউ কিছু বলার আগে শীতল বাঁকা হেসে বললো,”এতো গল্প করে আপনার সাথে, তাহলে নিশ্চয়ই অনুপমার গল্পও করেছে।”
বহ্নি আর আভা দুইজনই অবাক হয়ে শীতলের দিকে তাকায়। শীতল সরু চোখে তাকিয়ে আছে প্রত্যাশার দিকে।

“অনুপমা? সে কে?”
“বাহ রে, এতো গল্প করে আপনার দুষ্টু আপনার সাথে। আর তার জীবনের এতো গুরুত্বপূর্ণ একজন নারীর গল্প করেনি?”
বহ্নি আর আভা কিছু না বুঝে তাকিয়ে আছে শীতলের দিকে। প্রত্যাশা অসহায় বোধ করে। মিথ্যা বলতে এসে ফেঁসে গেলো মনে হচ্ছে।

বহ্নি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বললো,”আচ্ছা থাক সেসব। তুমি কি খাবে বলো? গল্প করতে করতে ভুলেই গিয়েছি।”
প্রত্যাশা থমথমে গলায় বললো,”আমি কিছু খাবোনা। আমি একটা স্ট্রিক্ট ডায়েট মেইনটেইন করি। যখন তখন গামলাভর্তি খাবার নিয়ে বসে থাকিনা।”
বলাই বাহুল্য, শীতল আর আভার সামনে তখন গামলাভর্তি মুড়িমাখা।
আভা মুখ টিপে হেসে বললো,”কি লাভ বলুন তো তাতে। আপনি না খেয়েও যেমন আর আমরা গামলাভর্তি খেয়েও তেমন চিকন। ক্ষতি আপনারই, সরু ফিগারের চক্করে দুনিয়ার এতো মজার মজার খাবার মিস করে গেলেন।”
শীতল ফিক করে হেসে দেয়, বহ্নি বহু কষ্টে হাসি চেপে ধরে রাখে। প্রত্যাশা রাগে লাল হয়ে ওঠে। এই কারণে এই মিডল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েগুলোকে তার সহ্য হয়না। ভদ্রতা জ্ঞানটুকু নেই।

বহ্নি কথা ঘুরিয়ে বললো,”সে যাই বলো, উৎস কিন্তু আমাদের রাজপুত্র। আমাদের ঘরটা ভাঙা তবে আমাদের একজন রাজপুত্র আছে কিন্তু।”
প্রত্যাশা লাজুক মুখে হাসে।
“হ্যা তা ঠিক, ও রাজপুত্রই। আর রাজপুত্রের জন্য হুরপরীর মতো রূপবতী রানী প্রয়োজন।”
মাথা নিচু করে কুটকুট করে হাসে প্রত্যাশা। রাগে ঘন ঘন শ্বাস ফেলে শীতল। বহ্নি চুপ করে থাকে। আভার যে কি ইচ্ছা করছে! তা করলে তো আবার বাবা রেগে যাবে। অতিথির সাথে খারাপ আচরণ তার পছন্দ না, সে যেই হোক। কিন্তু অতিথি যদি এমন নির্লজ্জ হয়, তাহলে তাকে কি করা উচিত?

শীতল হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়, প্রত্যাশার একদম মুখোমুখি এসে সুন্দর করে হাসে।
“রানী হতে গেলে শুধু রূপবতী নয়, যোগ্যতা থাকতে হয়। সুন্দর চেহারা তো বাজারেও নাচে।”
ভয়াবহভাবে চমকে প্রত্যাশা তাকায় শীতলের দিকে। মেয়েটার মুখে বিদ্রুপের হাসি চোখ এড়ায় না প্রত্যাশার। বহ্নি আর আভাও হতভম্ব হয়ে শীতলের দিকে তাকিয়ে আছে। শীতল স্রোতের মতো শীতল এভাবে কথা বলতে পারে তাদের মাথাতেও আসেনি কখনো।
শীতল আর কিছু না বলে নি:শব্দে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।

উৎস ফিরেছে রাত নয়টার দিকে। প্রত্যাশা অপেক্ষা করে করে চলে গেছে। দেখা হয়নি উৎসের সাথে। এ ব্যাপারে উৎসকে কিছু জানানোও হয়নি। পুরোটা সন্ধ্যা শীতল উঠোনেই কাটিয়েছে, উৎস না ফেরা পর্যন্ত।
উৎসকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেই অন্ধকার থেকে হঠাৎ বেরিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে যায় উৎস। শীতলের চোখমুখ ফ্যাকাসে লাগছে কেমন।

“শীতল।”
শীতল ঠান্ডা গলায় বললো,”রাত ঠিক দশটায় ছাদে অপেক্ষা করবেন আমার জন্য, কথা আছে।”
উৎসকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝড়ের বেগে সেখান থেকে চলে যায় শীতল। শীতল তার সাথে এভাবে কথা বলেনি কখনো। সবসময় ভয়ে ভয়েই কথা বলতো। আজকাল সুর দেখি পাল্টেছে। খুব আদেশ দেওয়া হচ্ছে। মায়ের আদেশ ছাড়া আর কোনো নারীর আদেশ তার পছন্দ না। তবুও আজ কেনো যেনো ভালো লাগছে তার। মনে হচ্ছে তার অগোছালো জীবনটা আবার নতুন করে গুছিয়ে নিতে এমন ধমক খুব দরকার তার। জোর করে হলেও রাগ করতে পারেনা সে মায়াবতীটার উপর।

প্রায় পৌনে এক ঘন্টা যাবৎ ছাদে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছে উৎস। শীতলের দেখা নেই এখনো। শীতল আসুক বা না আসুক, ডেঙ্গু যে চলে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সিগারেটের তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসছে। কোনো এক অজানা কারণে সিগারেট ধরাতে ইচ্ছা করছে না। তবে কি তার অবচেতন মন কোনোভাবে শীতলকে কষ্ট দিতে চাচ্ছে না? শীতল সিগারেটের ধোঁয়া নিতে পারেনা।
আরো কতোগুলো মিনিট কাটলো। শীতলের দেখা নেই। কাউকে এভাবে সহ্য করেনা উৎস। আজ কেনো করছে তাও জানেনা সে।
রাগে সিগারেট ধরায় সে শেষমেশ। একবার টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার সাথেই পিছন থেকে মিষ্টি রিনরিনে একটা গলার আওয়াজ শুনে উত্তপ্ত বুকটা শান্ত হয়ে যায় উৎসের।
“উৎস ভাই।”

দুপুরে উঠোনে মেলে দেওয়া কাপড়গুলো আজ তুলতে ভুলে গেছে বহ্নি। রাতে মনে পড়ায় তড়িঘড়ি করে তুলতে এসেছে সে। আজকাল প্রায় মাঝরাতের দিকে বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টিতে জামাকাপড় ভিজে গেলে পরে আবার সমস্যা।
কতোগুলো কাপড় তোলা হয়ে গেছে। আচমকা তার চোখ যায় জামগাছের নিচে জড়সড় এক অবয়বের দিকে। সাথে সাথে তার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়। চোর ডাকাত নয় তো?
কিন্তু ভয়টা উপরে প্রকাশ করেনা সে। হালকা চিৎকার করে ওঠে সে,”কে? কে ওখানে? বেরিয়ে আয় বলছি। নাহলে আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।”
কম্পিত পায়ে তাড়াতাড়ি করে অবয়বটা বহ্নির সামনে আসতেই হতবাক হয়ে যায় সে।
“এইযে মিস্টার রণ, আপনি এখানে? চোরের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেনো? চুরি করতে যাচ্ছেন নাকি?”
রণ ভেবাচেকা খেয়ে বললো,”ছি ছি এগুলো কি বলছেন? আমি চুরি করতে যাবো কেনো? আমাকে কি চোর মনে হয় আপনার?”
“আপনাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার। আপনি চোর নাকি ডাকাত তা জেনে আমি কি করবো? আপনি এখন বলুন, এভাবে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আপনার না নিচে নামা নিষেধ কোনো কাজ ছাড়া?”
রণ ফ্যালফ্যাল করে হাসার চেষ্টা করে।
বহ্নি কঠিন গলায় বললো,”হাসবেন না, মুখ বন্ধ।”
রণের হাসি থেমে যায়।
“কি হলো বলছেন না কেনো? এখানে কি কাজ আপনার?”
“হ্যা? ওই হাওয়া হাওয়া।”
“হাওয়া?”
“হাওয়া খেতে এসেছি। উপরে খুব গরম তো। আর ছাদে উৎস ভাই। উনি ছাদে থাকলে আমার ছাদে যেতে ভয় করে।”
বহ্নি হেসে বললো,”কেনো? আপনাকে নিচে ফেলে দেয় কিনা ছাদ থেকে, এই ভয়ে?”
“যে মানুষ উনি, ফেললেও অসম্ভব কিছু না।”
বহ্নি বাকি কাপড় গুলো তুলতে তুলতে আপন মনে হাসে। রণ মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
“দেখুন রণ সাহেব, আজ এসেছেন ভালো কথা। আর এভাবে রাত-বিরেতে হাওয়া খেতে এখানে আসবেন না। আমার মা জানতে পারলে আপনার হাওয়া বের করে দিবে। তিনি সাংঘাতিক ভদ্রমহিলা।”
রণ মাথা নিচু করে রাখে।
“তা আপনার চাকরির পরীক্ষার কি হলো? ফলাফল পেলেন?”
রণ কোমল গলায় বললো,”চাকরিটা আমার হয়নি মিস বহ্নি।”
বহ্নির বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে। সহজ সরল ছেলেটার বিষাদে মাখা কণ্ঠে মন খারাপ হতে বাধ্য যে কারো।
“মন খারাপ করছেন কেনো? একটা না হলে অন্যটা হবে।”
“মিস বহ্নি আপনার কি দু’টো মিনিট সময় হবে?”
“কেনো বলুন তো?”
“যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতাম। আসলে গ্রামের ছেলে আমি। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে বড় হয়েছি। শহরে এসে চার দেওয়ালের মধ্যে সারাদিন একাকী পড়ে থাকতে থাকতে কেমন যেনো কষ্ট হচ্ছে। উৎস ভাই দেরি করে ঘরে ফেরে। খুব একটা কথাও বলেনা সে। আমার কেমন দমবন্ধ লাগছে।”
বহ্নি ভ্রু কুঁচকে বললো,”তো আপনার কেনো মনে হচ্ছে আমি কথা বলবো আপনার সাথে?”
রণ থতমত খেয়ে যায়। এই মেয়েটার সামনে কথা বলতে আসলে কেমন অসহায় বোধ করে সে।
বহ্নি শব্দ করে হাসে। তার হাসির শব্দে দু’টো রাত জাগা পাখি তারস্বরে ডাকতে ডাকতে চলে যায় উড়ে। রণ ঢোক চাপে, সুন্দর জিনিস বেশিক্ষণ সহ্য করা যায়ন।

“আচ্ছা আপনার গল্প শুনবো আমি। তবে একটা শর্ত আছে।”
“শর্ত?”
“হ্যা শর্ত। কথায় কথায় লজ্জা পাবেন না। লজ্জা মেয়েদের ভূষণ। আপনি কি মেয়ে?”
রণ কি মনে করে হেসে দেয়। মেয়েটা কঠিন হলেও অসাধারণ। মুহুর্তের মধ্যে মন ভালো করে দিতে পারে।

‘কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তোমারে চাই: বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি— কুয়াশার পাখ্‌নায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে-আলোক
জোনাকির দেহ হ‌তে— খুঁজেছি তোমাকে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে
সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে
তোমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।

দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা:
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিং-এর মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।

কড়ির মতন শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে-আগুনে হায়।

চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্র— কবেকার শঙ্খিনীমালার;
এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।’

রণের গমগমে কণ্ঠে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বহ্নি মুগ্ধ হওয়ারও মাত্রা অতিক্রম করেছে। হঠাৎ রণের কবিতা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছে বহ্নি। এতো দরদমাখা গলায় কবিতা আবৃত্তি করতে পারে যে, সে কিনা একটা লাজুক পুরুষের আবরণে নিজেকে আবৃত রাখে সবসময়?

রণ বহ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,”জীবনানন্দ দাশের শঙ্খমালা কবিতা। আমার ভীষণ প্রিয়। আমি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, এই কবিতা আবৃত্তি করে আমি পুরষ্কার পেয়েছিলাম স্কুল থেকে। হঠাৎ কেনো যেনো আবৃত্তি করতে ইচ্ছা করলো।”
বহ্নি গাঢ় গলায় বললো,”অসাধারণ হয়েছে। আচ্ছা একটা অনুরোধ করি?”
“অনুরোধ বলছেন কেনো? আদেশ করুন না।”
“আমাকে মাঝে মাঝে এমন কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবেন যদি আপত্তি না থাকে?”
রণ অবাক হয়ে বহ্নির দিকে তাকায়। চাঁদের আলো তীর্যকভাবে এসে পড়েছে বহ্নির মুখজুড়ে। শ্যামলা গায়ের বরণে চকচকে রূপোলী জ্যোৎস্না যেনো ফুটে উঠেছে। বহ্নির দুই গাল ঈষৎ ভেজা। তবে কি সে কেঁদেছে? অস্থির হয়ে যায় রণ। তার কোনো ব্যবহারে কি কষ্ট পেলো এই অসাধারণ রমণীটি?

“মিস বহ্নি…..”
“আমি আসলে আমার ভিতর অসম্ভব চাপা একটা কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি প্রতিনিয়ত। কাউকে বলতে পারছি না। না আমার বোনদের, না বাবা-মাকে, না ফুপু বা উৎসকে। আমার কোনো বন্ধুও নেই। যাকে বিশেষ বন্ধু মনে করেছিলাম সে আমাকে চরম ভাবে ঠকিয়েছে। আমি উপরে কঠিন হলেও আমার ভিতরটা আবেগী। আমি প্রকাশ করিনা। কারণ আমাকে ভেঙে পড়তে দেখলে আমার ছোট বোন দু’টো ভেঙে পড়বে। ওদের কাছে ওদের বড় আপা হলো লৌহমানবী, তাদের আদর্শ। প্রতিটা মুহুর্তে তাদের সামনে শক্ত থাকার অভিনয় করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। আমারও একটা ঠান্ডা শীতল আশ্রয় লাগবে, যেখানে আমি আমার অনুভূতি গুলো নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারবো। এই ক্লান্তি বয়ে নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না আমার পক্ষে।”
হতভম্ব হয়ে যায় রণ। তার এখন কি বলা বা করা উচিত সে জানেনা। কাঠিন্যের আড়ালে থাকা নারীটিকে যেনো নতুন করে আবিষ্কার করছে সে। যে কথা সে কাউকে বলতে পারছে না, তাকে কেনো বলছে? তবে কি সেই ঠান্ডা শীতল আশ্রয়টা সে নিজেই? না না তা কি করে হয়? সে বামন আর এই রাজকন্যা হলো চাঁদ। না বামন কখনো চাঁদ ছুঁতে পারে আর না তো চাঁদ কখনো বামনের কাছে এসে ধরা দেয়। চাঁদ খুব বেশি হলে নিজের উথাল-পাতাল জ্যোৎস্নার ঢেউ দিয়ে বামনের আঙিনা আলোকিত করে দেয়, আর তো কিছু না।

মিনিট দুয়েক পর ধাতস্থ হয় বহ্নি। আবেগী হয়ে এ কি করছিলো সে? বাইরের একটা ছেলের সামনে এভাবে নিজের আবেগ প্রকাশ করছে।
গাল মুছে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে সে, রণ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত বেঁধে।
“আমাকে মাফ করবেন রণ সাহেব। অন্যদিন আপনার গল্প শুনবো। আজ আসি, অনেক রাত হয়েছে।”
রণকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বহ্নি ছুটে ঘরে চলে যায়।
রণ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর গুণগুণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে।
‘আলোটুকু তোমায় দিলাম, ছায়া নিলাম কেড়ে।
আমার রৌদ্রছায়ার মিলনমেলায় তোমায় নিলাম আপন করে।’

শীতল ধীর পায়ে হেঁটে এসে উৎসের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। মেয়েটার সাহস দেখে উৎস যারপরনাই অবাক। এ কি কান্ড! এই মেয়ে তার সব ব্যাপারে কেমন খবরদারি করা শুরু করেছে। নিজে এসেছে ঘন্টা খানিক পরে, আবার এসেই সাহস দেখাচ্ছে। উৎস রাগ করতে যেয়েও করতে পারেনা।

উৎস রেলিঙে ভর করে দুই হাত বুকে বেঁধে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি শীতলের দিকে।
“কি ব্যাপার?”
শীতল সোজাসুজি তাকায় উৎসের চোখের দিকে।
“প্রত্যাশার সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
“কি?”
“কি মানে? এমন একটা ভাব করছেন যেনো চিনতেই পারছেন না।”
“শীতল তুমি এই ফালতু কথা বলার জন্য আমাকে এক ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছো? তোমার মনে হয় এসব ফালতু কথা শোনার সময় আছে আমার?”
শীতলের দুই চোখে পানি ভরে যায়। উৎস অবাক হয়ে বললো,”শীতল হচ্ছেটা কি? তোমার কি এমন কথায় কথায় কান্নার বয়স আছে?”
“না আমি তো বুড়ি, আমার কাঁদতেও বারণ।”
উৎস কিছুক্ষণ শীতলের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে দেয়।
রাগে শীতল চলে যেতে উদ্যত হলেই উৎস সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দেয়। পায়ে বেঁধে তাল সামলাতে না পেরে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে গেলেই উৎস তার বাহু চেপে ধরে বাম হাত দিয়ে।

“হাঁটতেও শিখলে না এখনো ঠিকমতো।”
“বাজে কথা বলবেন না একদম। আপনি পা বাড়িয়ে দিলেন কেনো?”
“পা আমার জায়গাতেই আছে। নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।”
“ছাড়ুন আমাকে, আমি নিচে যাবো।”
“এসেছো নিজের ইচ্ছায়, আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করেছো। এখন যাবে আমার ইচ্ছায়।”
শীতল জোর করে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।

“হ্যা এখন বলো, হঠাৎ ওর কথা উঠলো কেনো?”
শীতল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,”উনি এসেছিলো আজকে আমাদের এখানে।”
“মানে? কে এসেছিলো? প্রত্যাশা।”
“হ্যা প্রত্যাশা। সবার জন্য প্রত্যাশা আর আপনার জন্য আশা।”
উৎস রাগী চোখে তাকায়।
“কি যা তা বলছো? আমার জন্য কেনো আশা?”
“কেনো আপনি তাকে আশা বলে ডাকেননা? তাকে বলেননি আপনার নাম ধরে ডাকতে, আপনাকে তুমি বলে ডাকতে। ক্লাসের পর ক্যান্টিনে বসেননা ওর সাথে? সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছাড়েননা ওর মুখে? দুষ্টু।”
উৎস চোখ বড় বড় করে তাকায় শীতলের দিকে। শীতল হাত ছাড়িয়ে নেয় নিজের।
“এগুলো বলেছে তোমাকে?”
“হ্যা বলেছে। কি বলবেন এখন? মিথ্যা এগুলো?”
“তোমার মনে হয় সত্যি?”
শীতল অস্বস্তিতে এদিক ওদিক তাকায়। তারও বিশ্বাস এগুলো মিথ্যা। তা সত্ত্বেও জোরাজোরি করতে এসেছে কেনো সে? নিজেই বুঝতে পারছে না কি বিপদে পড়লো।
“কি হলো বলো? তোমার যদি মনে হয় এগুলো সত্য, তাহলে সত্য।”
শীতল আমতা আমতা করে বললো,”তাহলে উনি মিথ্যা কেনো বললো?”
উৎস নেশাক্ত গলায় শীতলের দিকে তাকিয়ে বললো,”দুনিয়ায় এমন কোনো শক্তি নেই যা আমাকে বিশ্বাস করাবে তুমি অন্য কারো প্রেমে আসক্ত। নিজের চোখেও এমন কিছু দেখলে আমি চোখ দু’টো বের করে হেক্সিসল দিয়ে ধুয়ে ফেলবো। আমার তো এই বিশ্বাস আছে, তোমার নেই?”
শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। যে আত্মবিশ্বাসের সাথে ঝগড়া করতে এসেছিলো, তা ফুঁস করে নিভে গেছে। রাগে এই লোকটা যদি তাকে ছাদ থেকে ফেলে দেয় তাহলেও সে অবাক হবে না একটুও।

“আমি ঘরে যাবো।”
“তোমাকে কি আটকে রেখেছি আমি?”
শীতল ভয়ে ভয়ে বললো,”আপনি কি রাগ করেছেন?”
“তোমার তো উজবুকের উপর রাগ করে নিজের সম্মান নষ্ট করার মতো দিন এখনো আসেনি আমার।”
শীতল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, চারদিকে পিনপতন নীরবতা। উৎস উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি আকাশের দিকে।

“আপনি অনুপমাকে যতোটা বিশ্বাস করেন, অনুপমা আপনাকে তারচেয়েও দ্বিগুণ বিশ্বাস করে উৎস ভাই।”
উৎস হতবাক হয়ে পিছনে তাকাতেই শীতল ছুটে চলে যায় সেখান থেকে। উৎস তাকে ছুঁতে পারেনা। শীতলের সরু কায়াটা যেনো বাতাসে ভাসতে ভাসতে চলে যায় তার সামনে থেকে। তার জন্য শুধু রেখে যায় রুনুঝুনু নুপুরের আওয়াজ, বেলী ফুলের মতো মিষ্টি একটা গন্ধ আর উত্তাল মস্তিষ্ক। অনুপমা জেনে গেছে তার পরিচয়, এজন্যই অধিকার খাটানোর এতো তাড়া?

(চলবে…….)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ১৫

ভোরবেলা দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে যায় উৎসের। রণ মড়ার মতো ঘুমায়। এতোটুকু আওয়াজে তার ঘুম ভাঙার কথা না। ঘুম ঘুম চোখে ঘড়ির দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে উৎস। এতো সকালে কেউ তাকে ডাকতে তো আসেনা। তাহলে কি কোনো সমস্যা হলো? লাফ দিয়ে উঠে বসে উৎস। ঘুম ততক্ষণে পালিয়েছে তার।

দরজার বাইরে নওশাদকে দেখে আরো একপ্রস্থ অবাক হয়ে সে। নওশাদের মুখটা কেমন থমথম করছে। অন্যদিনের মতো হাসি নেই ঠোঁটের কোণে।

“উৎস বিরক্ত করলাম?”
“মামা কি বলছেন? বিরক্ত করবেন কেনো? ভিতরে আসুন না।”
“আসলে এতো সকালে তোমার ঘুম ভাঙানোর কোনো ইচ্ছা ছিলোনা আমার। কিন্তু তোমাকে তো আজকাল পাওয়াই যায়না।”
উৎস নওশাদের কণ্ঠের উত্তাপ টের পায়। তার মামা রেগে গেলে তাকে তুমি বলে সম্বোধন করে। কিন্তু তার রাগের মতো কি এমন করেছে উৎস? ভেবে উত্তর পায়না। তাহলে শীতল কিছু বললো তার বাবাকে? উৎসের ঠোঁট শুকিয়ে আসে।

“যদি কিছু মনে না করো আমার সাথে হাঁটতে যাবে?”
উৎস বুঝতে পারে হাঁটা মূল উদ্দেশ্য নয়। তার মামা তাকে কিছু বলতে চায়, যা বাড়িতে বলা সম্ভব না।
“অবশ্যই মামা। আপনি ভিতরে এসে বসুন। আমি জামাটা পালটে আসি।”
“আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, তুমি এসো।”
উৎস কিছুটা ইতস্তত করে ভিতরে চলে যায়। তার মাথা কেমন এলোমেলো লাগছে। সে বেশ অনেকটাই নিশ্চিত শীতল বোধহয় বাবাকে কিছু বলেছে। মেয়েটার মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছুই নেই। সব মিলিয়ে তার মস্তিষ্কের ওজন সাড়ে তিন গ্রাম বলে ধারণা উৎসের। নিজের আবেগ চেপে রাখতে পারেনা। হয়তো আবেগের বশে বলেই ফেলেছে বাবাকে কিছু। এজন্যই কি এতো রেগে তার মামা? নিষেধ করে দিবে সে যেনো তার মেয়ের রাস্তা থেকে সরে দাঁড়ায়? তখন সে কি করবে?

এসব সাতপাঁচ ভাবছে আর হাঁটছে উৎস নওশাদের পাশাপাশি। ভোরটা অনেক বেশি সুন্দর আজ। হালকা মেঘের ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্য পুরোপুরি ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুনসান রাস্তা, এখনো কর্মব্যস্ততা শুরু হয়নি মানুষের। ঈষৎ দু’একজনের দেখা মিলছে। কিন্তু এতো সুন্দর পরিবেশেও কিছু ভালো লাগছে না উৎসের। ঘাম দিচ্ছে শরীরে কেমন। নওশাদ এখনো একটা কথা বলেনি তাকে। মুখটা ভার হয়ে আছে। উৎস কিছু বলার সাহসও পাচ্ছে না। নীরবতা অসহ্য লাগছে উৎসের।

“উৎস।”
“বলুন মামা।”
“আজ হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। চলো কোথাও বসে কথা বলি।”
“কোথায় বসতে চাচ্ছেন মামা, চলুন।”
“সামনের পার্কটায় চলো, ওখানের বেঞ্চে বসে কথা বলা যাবে।”
উৎস একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,”চলুন।”

“তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে উৎস? কিছুদিন আগে পরীক্ষা হলো, ফলাফল বেরিয়েছে?”
“বেরিয়েছে মামা।”
“কেমন করেছো?”
“বেশ ভালোই হয়েছে মামা। আমি থার্ড হয়েছি।”
নওশাদ রোমাঞ্চিত হয়। ছেলেটা ভীষণ মেধাবী। এতো কিছু সামলেও রাত জেগে পড়ে, ভালো ফলাফল করে সবসময়ই। ছেলেটাকে নিয়ে আগাগোড়াই খুব আশাবাদী নওশাদ।

“বাহ খুব ভালো।”
আবারও নীরবতা। পাখিগুলো খাবারের সন্ধানে কিচিরমিচির করতে করতে বের হচ্ছে। দু’একটা রিকশার টুংটাং আওয়াজ ছাড়া আর তেমন শোরগোল পড়েনি এখনো।
“মামা আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?”
নওশাদ তাকায় উৎসের দিকে। উৎসের চোখ মাটির দিকে।

“জানো উৎস, তোমার বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো তোমাকে নিয়ে। অসম্ভব ভালোবাসতো মানুষটা তোমাকে। তোমার মা যদি কোনোদিন তোমাকে চোখ রাঙিয়ে বকাও দিতো সেদিন তোমার মায়ের সাথে তোমার বাবা কথা বলাই বন্ধ করে দিতো। যেটুকু উপার্জন করতো, কিছু না জমিয়েই তোমার পিছনে খরচ করতো। মানে তার ধ্যানজ্ঞান সবই ছিলো তার ছেলেকে ঘিরে।”
উৎস চুপ করে থাকে। বাবার স্মৃতি বিশেষ মনে নেই তার। শুধু মনে আছে একহারা লম্বা গড়নের একজন সুপুরুষ, উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ আর মুখভর্তি উৎসের মতোই চাপদাড়ি। তাকে কোলে নিয়ে মেলায় যেতো এই স্মৃতি অল্পবিস্তর মনে আছে, এ বাদে আর কিছু তেমন মনে পড়েনা তার।

“সে মারা যাওয়ার আগে আমার হাত ধরে অনুরোধ করে গিয়েছিলো আমি যেনো তার কলিজার টুকরোকে মানুষের মতো মানুষ বানাই। কখনো বাবার অভাব বুঝতে না দিই। আমি এক মৃত্যুপথযাত্রীর হাত ছুঁয়ে তাকে কথা দিয়েছিলাম আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। হ্যা আমি আমার কথার বরখেলাপ করিনি। আমি আমার জীবন দিয়ে তোমাকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। কখনো বহ্নি, শীতল বা আভার থেকে তোমাকে আলাদা করে দেখিনি। আমি সবসময় মনে করেছি আমার চার সন্তান। তুমি শত অন্যায় করলেও আমি তোমাকে কখনো বকতে পারিনি, রাগ করে দু’টো কথা শোনাতে পারিনি। আমার মেয়েদের রাগ করলেও আমি তোমাকে শাসন করতে পারিনি কখনো। তোমার মা রাগ করতো আমাকে, আমি নাকি শাসন না করে করে তোমাকে আহ্লাদ দিয়ে নষ্ট করছি। তবে আমার তেমন কিছু মনে হয়নি। তুমি কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করোনি, পড়াশোনাতেও সবসময়ই তুখোড়। তোমার নামে আমার কাছে যতো নালিশ এসেছে, তার একটাই কারণ তুমি হয়তো রাস্তায় কোনো অন্যায় হচ্ছে, দেখতে পারোনি, মেরেছো। তবুও আমি তোমাকে কখনো রাগ করতে পারিনি কেনো জানো? আমার মনে হয়েছে, আমি যদি তোমাকে শাসন করি তোমার হৃদয়ের কোথাও না কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথা জন্মাবে। তোমার মনে হতেই পারে, আজ তোমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এটা করতো না তোমার সাথে। শেষ বিচারের দিন যদি তোমার বাবার সাথে আমার দেখা হয়, সে বলবে ভাইজান আমার বাচ্চাটাকে রাগ করেছেন আপনি? আমি বেঁচে থাকলে তো দিতাম না। সেদিন তাকে কি জবাব দিবো আমি? এই ভয়ে তোমার গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, কখনো উঁচু গলায় কথাও বলিনি। তবে জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে মনে হচ্ছে আমি ব্যর্থ। আমি বোধহয় তোমার মামা-ই থেকে গেলাম, তোমার বাবা হতে পারলাম না।”
উৎসের চোখে তেমন পানি আসেনা কখনো। যে কোনো পরিস্থিতিতেই সে শক্ত থাকে। তবে আজ নওশাদের কথা শুনে তার বুক ভার হয়ে আসে, চোখের কোণায় পানি চিকচিক করে ওঠে।

উৎস উঠে যেয়ে নওশাদের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে। নওশাদ অপ্রস্তুত হয়ে যায়।
“আরে কি করছো? এসব পাগলামি করে কেউ?”
“মামা আমি কোনো অন্যায় করলে আপনি আমাকে শাসন করুন, প্রয়োজনে আমাকে মারুন। মারতে মারতে আধমরা করে দিন আমাকে। তাও এসব বলবেন না। বাবার স্মৃতি আমার খুব একটা মনে নেই। আপনি আমাকে যে ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন, আমার কখনো মনেই হয়নি আমার বাবা নেই। কিন্তু আজকে আপনার এই কথাগুলো আমি সহ্য করতে পারছি না মামা। আমাকে মারুন না আপনি। আপনার এই জুতা দিয়ে আমার গালে মারুন। তবুও এগুলো বলবেন না, আমি সহ্য করতে পারছি না।”
নওশাদ পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে উৎসের দুই হাত ধরে জোর করে পাশে বসায়। উৎসের চোখ লাল হয়ে গেছে, কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছে সে।

“ধুর পাগল ছেলে, এতোদিন যখন মারিনি আজ কেনো মারবো তোকে?”
“তাহলে এগুলো কেনো বলছেন মামা? আমার জানামতে আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। মনের অজান্তে যদি করে থাকি, আপনি আমাকে শাস্তি দিন।”
নওশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”কাদের সাথে মিশছিস আজকাল? কাদের সাথে ওঠাবসা তোর?”
উৎস অবাক হয়ে বললো,”মামা ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা। আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেককেই তো চিনেন আপনি।”
“বন্ধুদের কথা বলিনি।”
“তাহলে?”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নওশাদ আস্তে আস্তে বললো,”ছোট রুস্তমকে চিনিস তুই?”
উৎস হতভম্ব হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কথা সরে না।

“কিরে বল? চিনিস?”
“মামা ওই আসলে……”
“এতো কথা না। হ্যা বা না।”
উৎস চোখ নামিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,”চিনি।”
“ওর মতো একটা কুখ্যা’ত সন্ত্রা’সের সাথে তোর চেনাজানা কেনো থাকবে? বল কেনো থাকবে?”
নওশাদের হালকা ধমকে উৎস চুপ করে যায়। নওশাদের মনটা পরক্ষণেই নরম হয়ে যায়।

“দেখ বাবা, লোকটা তো ভালো না। একদমই ভালো না। তুই টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করিস তা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে ভার্সিটির বাইরে একটা অসভ্য জানোয়ারের সাথে কেনো তোর কোনো সম্পর্ক থাকবে?”
“মামা আমাকে আমার কথাটা বলার সুযোগ দিন।”
“বেশ বল, আমি শুনছি।”

উৎস উঠে যেয়ে কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়ায়। বুকে হাত বেঁধে দূরে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টিতে।

“গত দুই মাস আগে আমাকে আমার এক জুনিয়র ছেলে এসে জানালো তাদের ক্লাসে একটা মেয়ে নাকি আত্মহ’ত্যা করতে গিয়েছিলো। পরের হলের অন্যান্য মেয়েরা দেখতে পেয়ে তাকে ঘরের দরজা ভেঙে উদ্ধার করে। মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি তখন সে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা মেয়েটাকে দেখার জন্য ছুটে চলে যাই আমি হাসপাতালে। সে কোনোভাবেই মুখ খুলতে চাচ্ছিলো না কেনো সে এমনটা করতে যাচ্ছিলো। আমরা সবাই ভেবেছিলাম হয়তো প্রেমিকের সাথে ঝামেলা। তবে ওর বান্ধবীরা জানায়, ওর কোনো প্রেমিক নেই। গরীব ঘরের মেয়ে, অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছে। পড়াশোনাতেও অনেক ভালো।”
নওশাদ অবাক হয়ে বললো,”তাহলে ও এমনটা কেনো করলো?”
উৎস ঘন ঘন শ্বাস ফেলে।
“সিগারেট ধরাতে চাইলে ধরাতে পারিস।”
উৎস ম্লান হেসে বললো,”দরকার নেই মামা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উৎস আবার বলা শুরু করলো,”জানতে পারলাম এমন কিছু মেয়েদের টার্গেট করে ওই ছোট রুস্তমের কাছে পাঠানো হয়। না যেতে চাইলে হুমকি দেওয়া হয়। কেউ জানতে পারেনা এসব। প্রতিনিয়তই এসব চলে আসছে। মেয়েগুলো ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারতো না। আমি হতভম্ব হয়ে যাই মামা এসব শুনে। নিজের জীবন বাজি রেখে আমি যাদের কথা ভাবি, তারা এতো কষ্টে আছে শুনে আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনা।”
ঘৃণায় ভিতরটা বিষিয়ে ওঠে নওশাদের। রুস্তম খারাপ সে জানে, তবে এতোটা নোংরা কোনোদিন বুঝতে পারেনি। একদলা থুতু ফেলে সে মাটিতে।

“মামা আমি আমার দলবল নিয়ে সাথে সাথে রওনা দিই। আমাদের দেখে ও প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায়। তবে পরে অনেক শাসায় আমাদের। আমরা ভয় পাইনি মামা। আমি বলেছি, এরপর যদি আর একটা মেয়েকে ওখানে আনা হয়, আর এ কথা যদি আমার কানে আসে তাহলে ওর কল্লা ফেলতে আমার ঠিক দেড় মিনিট সময় লাগবে।”
“কি বলছিস উৎস?”
“হ্যা মামা, যদিও ও আমাকে অনেক ভয় দেখায়, অনেক টাকার লোভও দেখায়। আমি কোনোকিছুতেই ভয় পাইনি বা লোভ করিনি। আমার আদর্শ যে আপনি মামা যে কোনোদিন কোনো অন্যায়ের সামনে মাথানত করেনি। আমি আমার জন্মদাতা পিতাকে হারালেও আপনাকে তো পেয়েছি। আপনার আদর্শ আমি কীভাবে ভুলে যাই?”
নওশাদ চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বুঝতে পারেনা কি বলবে উৎসকে।
“মামা এরপর থেকে ও আর একটা মেয়েকেও নিতে পারেনি, অনেক চেষ্টা করেছে। এজন্য ওর রাগ আমার উপর।”
“উৎস কতো বড় হয়ে গিয়েছিস বাবা তুই? এতো ঝড় মাথায় একা নিয়ে কীভাবে চলিস? আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি?”
“আমি আপনাকে দুশ্চিন্তা দিতে চাইনি মামা। এখন আপনি বলুন, আমি কি অন্যায় করেছি? যদি আপনার মনে হয় আমি অন্যায় করেছি তাহলে আপনি আমাকে যে শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নিবো। যদি বলেন রাজনীতি ছেড়ে দিতে, আমি আজই ছেড়ে দিবো। এরপর চোখ বন্ধ করে হাঁটবো। যাতে কোনো অন্যায় আমার দেখতে না হয়। কারণ দেখলে আমি সহ্য করতে পারবোনা।”
নওশাদ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে এখন উৎসকে কি করতে বলবে? সে নিজেও চায় উৎস নির্ভীক, সাহসী হোক। কিন্তু যতোই হোক ওর বয়স বা কতো? ক্ষমতাই বা কি রুস্তমদের মতো মাফিয়াদের সাথে পাঙ্গা নেওয়ার? এই বুকভর্তি সাহস আর গরম র’ক্ত ছাড়া কি আছে ওর?

“মামা আমি হয়তো দুনিয়ার সব অন্যায়কে প্রতিহত করতে পারবো না। কিন্তু কিছু তো পারবো বলুন? আপনিই তো ছোটবেলায় আমাদের ওই কবিতাটা পড়ে শোনাতেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’?”
নওশাদ কান্না আটকানোর চেষ্টা করে।
উৎসের কাঁধে হাত রেখে বললো,”আমি তোকে নিয়ে গর্ববোধ করি বাবা। তুই আমার সেরা সন্তান। প্রতিটা ঘরে যেনো তোর মতো ছেলে জন্মায় তাই চাই। তাহলে দুনিয়ায় আর এতো অন্যায়, অপরাধ হবে না। কিন্তু বাবা, আমি যে খুব দুশ্চিন্তায় থাকি। ওদের কাছে তুই একটা ছোট্ট প্রাণ মাত্র। কিন্তু আমাদের কাছে তো তুই আমাদের সবকিছু, সাত রাজার ধন। তোর কিছু হলে আমরা কীভাবে নিজেদের সামাল দিবো?”
উৎস হাসে। নওশাদের শরীর হালকা হয়ে যায় হাসি দেখে। এই হাসিটা এতো সুন্দর কেনো? কেনো?

“মামা বিড়ালের মতো ভীতু জীবন নিয়ে বছরের পর বছর বেঁচে না থেকে, সিংহের মতো একদিন বাঁচতে চাই। মামা আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা। আমি প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখতে দেখতে পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছি। যেদিন সত্যি মৃত্যুর মুখোমুখি হবো, একটুও ভয় না পেয়ে বুক চিতিয়ে মরবো। মুখে থাকবে এক চিলতে হাসি। আমি সেইদিনটার অপেক্ষা করি মামা।”
নওশাদ হতবাক হয়ে উৎসের দিকে তাকায়। কি আছে এই ছেলেটার মধ্যে? বারুদ? এভাবে জ্বলে ওঠে কিসের শক্তিতে ও?
“কিন্তু আমাদের কথা চিন্তা করবি না তুই? আমরা কাকে আঁকড়ে বাঁচবো?”
“মামা আমরা উত্তাল নদীর ঢেউ। এই পথে যখন পা বাড়িয়েছি তখনই শপথ নিয়েছি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত থামবো না। একটি ঢেউ থেমে গেলে, লক্ষ ঢেউ আছড়ে পড়বে। আমি যদি কোনোদিন না থাকি, সেই ঢেউকে পাশে পাবেন আপনারা।”
নওশাদ আর কথা বলতে পারেনা। হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে। উৎস তার বুকে টেনে নেয় নওশাদের মাথা। সূর্য উঠে গেছে ততক্ষণে। লোকালয়ে ভিড় জমতে শুরু করেছে। যান্ত্রিক জীবন শুরু হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। নাহ, আজকের সকালটা আসলেই সুন্দর।

ভার্সিটিতে ঢোকার মুখে রণকে দেখে চমকে যায় বহ্নি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। রুক্ষ এলোমেলো চুল, লাল চোখ। কি হয়েছে এই লোকের আবার?
বহ্নিকে দেখে একছুটে দৌড়ে আসে রণ। হাঁপাতে থাকে সে ছুটে এসে।
বহ্নি ভ্রু কুঁচকে কঠিন গলায় বললো,”আপনার সমস্যা কি? নেহাৎ একদিন ভালো করে কথা বলেছি বলে ভার্সিটি পর্যন্ত চলে এসেছেন? বাড়িতে মায়ের ভয়ে কথা বলতে আসতে পারেন না, তাই সোজাসুজি এখানে? আপনাকে দেখে ভদ্র ভেবেছিলাম। কিন্তু না, আপনি ভদ্র লোকের আড়ালে একটা নির্লজ্জ লোক। আর কোনোদিন যদি এখানে দেখি, আপনার খবর আছে।”
একদমে কথাগুলো বলে থামে বহ্নি। একটু খারাপ লাগলেও উপরে প্রকাশ করেনা। এই লোকের থেকে যতো দূরে থাকা যায় ততই ভালো। এই লোক তাকে মায়া লাগিয়ে দিচ্ছে একটু একটু করে। একবার ঠকেছে সে, বারবার ঠকতে চায়না। সে এই জীবনে হয়তো তার বাবা আর উৎস বাদে আর কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে পারবে না। গত রাতে আবেগী হয়ে একটু বেশি বলে ফেলেছে সে রণকে। সারারাত অনুশোচনা হয়েছে তার জন্য। কিন্তু আর না, এখানেই সবটা শেষ করে দেওয়া উচিত।

বহ্নির কথা শুনে চুপসে যায় রণ। আসলেই কি সে বাড়াবাড়ি করে ফেললো? কিন্তু সে কীভাবে বুঝাবে ওই কান্নাভেজা চোখগুলো দেখে সে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। বুকের ভিতর কোথায় যেনো একটা সরু কিন্তু তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা হয়েছে। এ অনুভূতি তার প্রথম। এর আগে আর কোনো নারীর জন্য এমন অনুভূতি হয়নি তার। ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছিলো। ঘুম ভাঙার পরেই ছুটে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিলো বহ্নিকে এক নজর দেখার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে বহ্নি বেরিয়ে গেছে, তাই বাধ্য হয়ে সে এখানে এসেছে। কেনো এখানে এসেছে তা-ও সে জানেনা। শুধু জানে বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব না তার জন্য।
“মিস বহ্নি আসলে….”
“দয়া করে এখানে কোনো ঝামেলা করবেন না। কি চান আপনি আমার কাছে?”
“আপনার কাছে আমার চাওয়ার কিছুই নেই মিস বহ্নি। তাছাড়া আমি বেকার, গরীব মানুষ। আমার সাথে আপনি কথা বলতে চান না তাও আমি জানি। বিশ্বাস করুন, আমি নিজেও জানিনা আমি এখানে কেনো এসেছি।”
বহ্নি একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে।
রণ নিজের হাতে থাকা একটা কালো মলাটের ডায়েরি এগিয়ে দেয় বহ্নির দিকে। বহ্নি ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
“কি এটা?”
“ডায়েরি।”
“ডায়েরি দেখতেই পাচ্ছি। এটা আমাকে দিচ্ছেন কেনো?”
রণ মাথা নিচু করে বললো,”সেই স্কুল থেকেই টুকটাক কবিতা লেখার বদ অভ্যাস আছে। অভাবের সংসারে কখনো প্রতিভাটা বিকশিত করার সুযোগ পাইনি। তবুও অবসরে লেখা ছাড়িনি। আমার অনেক শখের ডায়েরি এটা বলতে পারেন। আসলে আপনাকে দেওয়ার মতো কোনো উপহার আমার কাছে নেই, আমার সেই সামর্থ্যও নেই। তাই এটা ভাবলাম আপনাকে দিই। আপনি নিলে খুশি হবো।”
“আপনার শখের জিনিস আপনার শখের নারীর জন্য রেখে দিন। আমাকে কেনো দিচ্ছেন? আর তাছাড়া আমাকে আপনার উপহার দেওয়ার দরকারটাই বা কি?”
রণ ঢোক চাপে। কি বলবে ভেবে পায়না।
“কি হলো বলুন? দেখুন আপনার সাথে এখানে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় তো আমার নেই। যা বলার দ্রুত বলুন।”
“আসলে গত রাতে আপনি আমার কবিতা আবৃত্তি শুনে এতোটা বিমোহিত হবেন আমি ভাবতে পারিনি। এর আগে অনেক অনুষ্ঠানেই আবৃত্তি করা হয়েছে। অনেক প্রশংসাও পেয়েছি। তবে গত রাতে আপনার মুগ্ধতা দেখে আমার মনে হয়েছে আমার এই প্রতিভা স্বার্থক, স্বার্থক আমার আবৃত্তি। এজন্য ধন্যবাদ উপহার স্বরূপ এটা এনেছি। রাখলে আসলেই এই অধম খুশি হবে।”
বহ্নি মুচকি হেসে ডায়েরিটা হাতে নেয়।
“আচ্ছা আজ আসি।”
বহ্নি মাথা নাড়ে।
“আর একটা কথা।”
“আবার কি?”
রণ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললো,”আপনার যদি কখনো খুব মন খারাপ হয়, ভিতরটা ভেঙেচুরে কান্না আসে। যদি একটা শীতল আশ্রয় পেতে চান, যেখানে চিৎকার করে কাঁদতে পারবেন, ধারালো নখ দিয়ে আঁচড়ে ছিঁড়ে ফেলতে পারবেন, আমি থাকবো আপনার সেই আশ্রয় হয়। বিশ্বাস করুন, আপনার গোপন বিষয় আমার কাছে যত্নে থাকবে। আমি কাউকে কিছু জানাবো না কোনোদিন।”
রণ আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। ঝড়ের বেগে চলে যায় সেখান থেকে। বহ্নি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ডায়েরি হাতে নিয়ে। শেষের কথাগুলো বুঝতে পারলো না সে রণের। কি বললো সে? আর এই লোক এতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে? দেখে তো মনে হয়না। বহ্নির মনে হয় রণের সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানার আছে। তার মন বলছে যতোটা সাধারণ সে নিজেকে পরিচয় দিয়েছে, ততটা সাধারণ সে নয়। জোর করেও নিজের মস্তিষ্ক থেকে লোকটাকে সরিয়ে দিতে পারছে না। খুবই বিরক্তিকর, খুবই।

অগ্নির সাথে কলেজ থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছে শীতল। আজ টিউশন নেই, সোজা বাড়িতে। শীতলের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এসেছে। বুদ্ধিটা অবশ্য প্রথমে অগ্নিই দিয়েছে, পরে শীতলেরও ভালো লেগেছে। আজ যে টিউশন নেই, এ কথা বাড়িতে জানেনা। সে ঠিক করেছে আজ অগ্নির সাথে পাশেই একটা পার্কে ঘুরতে যাবে। ওখানে বিকেলে অনেক কপোত-কপোতী প্রেম করতে আসে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে থাকে তারা। দশ টাকার বাদাম কিনে খায়, একে অন্যকে বাদামের খোসা ছিলে দেয়। অনেক প্রেমিক তো আবার বেশি সাহসী। প্রেমিকার কোলে মাথা দিয়ে শুয়েই পড়ে মাটিতে। ওরা কলেজের মেয়েগুলো প্রায় দুষ্টুমি করতে এসব দেখতে যায়। হেসে হেসে একে অন্যের গায়ে পড়ে। মাঝে মাঝে ঈর্ষাও হয় শীতলের। ইশ! তার প্রেমিকটাও যদি এমন হতো। উৎস এসব কোনোদিনই করবে না। কোনোদিন পার্কেই যাবে বলে হয়না তার সাথে, আর তো এমন প্রেম!

“এই অগ্নি, মিথ্যা ধরা পড়ে যায় যদি?”
অগ্নি বিরক্ত হয়ে বললো,”ধরা পড়বে কীভাবে বোকা মেয়ে? টিউশন ক্লাস ছুটি হওয়ার মিনিট দশেক আগে ওখানে চলে যাবি। তোর বাবা এসে দেখবে মেয়ে উপস্থিত। জানতেই পারবে না তোর টিউশন ক্লাস ছিলো না আজ।”
“তাও আমার ভয় করছে। আমি মিথ্যা বলতে পারিনা, ধরা পড়ে যাই। বাবা আমাদের সব অন্যায় সহ্য করলেও মিথ্যা সহ্য করেনা। দুই/একদিন কলেজের ক্লাস মিস দিয়ে গেলেও, আজ তো ছুটির পর।”
অগ্নি রাগ দেখিয়ে বললো,”এতো ভয় করলে বাড়ি চলে যা, যত্তসব।”
শীতল মুখ ভোঁতা করে অগ্নিকে অনুসরণ করতে থাকে। অগ্নি মুখ বাঁকিয়ে বললো,”যাওয়ার ইচ্ছা ষোলো আনা, আবার ঢং।”

কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর হুঁস করে একটা মোটরসাইকেল এসে থামে শীতলের একদম পাশ কেটে। শীতল লাফ দিয়ে সরে দাঁড়ায়। অগ্নি শীতলের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,”আবার তোর কোন আশিক ফুল এনেছে দেখ।”
শীতল উত্তর দেয়না।
তবে এবার ফুল না, স্বয়ং উৎস নামে মোটরসাইকেলের পিছন থেকে। মোটরসাইকেলের চালক ওর নিজের বন্ধু, উৎস নেমে যাওয়ার পর সে অনুমতি নিয়ে চলে যায়।
উৎসকে দেখে পিলে চমকে ওঠে শীতলের। মুহুর্তের মধ্যে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে।

“কোথায় যাওয়া হচ্ছে?”
গম্ভীর গলার আওয়াজে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় শীতলের।
অগ্নি উৎসকে চিনেনা। সে লাফ দিয়ে সামনে আসে।
“সে কথা আপনাকে বলতে হবে? কে আপনি?”
শীতল অগ্নির হাত ধরে টানে। অগ্নি হাত ছুটিয়ে নেয়।
“এই তুই থাম তো। দিনদিন এই অসভ্যগুলোর চেংড়ামি বেড়েই চলেছে। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বিরক্ত করতে চলে আসে।”
শীতল কপাল চাপড়ে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে,’অগ্নিরে আজ তুই তো গেলি।’

উৎস খুব শান্তভাবে দুই হাত বুকে বেঁধে অগ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,”তাই নাকি? তা আপনাদের মধ্যে কাকে সুন্দরী দাবি করছেন আপনি?”
অগ্নি চোখ বড় বড় করে উৎসের দিকে তাকায়। শীতল তো সুন্দরী-ই, অগ্নিও কম যায়না। আর এই লোক কিনা সুন্দরী কে দেখতেই পারছে না?

“কি বললেন? আমাদের দেখে কি সুন্দরী মনে হচ্ছে না?”
“না মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে দুইটা পাতিকাক কা কা করতে করতে উড়ছে।”
শীতল রাগান্বিত চোখে উৎসের দিকে তাকায়। তাকে কাক বলা? অসভ্য। সে চুপ থাকে, উৎসের পরিচয় দেয়না। নিজে তো কিছু বলার সাহস পাবেনা, অগ্নি যদি কিছু বলে তো বলুক। নিজেকে কি না কি ভেবে বসেছে। এতো সুন্দর চেহারা তার, তাকে কিনা কাক বলা? তা সুন্দরী কে? ওই প্রত্যাশা? ছোট ছোট জামা পরে বলে? দাঁত কিড়মিড় করে শীতল।

“দেখুন আপনি কিন্তু অনেক বেশি বলছেন। আমরা কাক?”
“জ্বি, পাতি কাক।”
অগ্নি রেগে আঙ্গুল তুলে কিছু বলতে যাবে তার আগেই থমকে যায় সে। এতোক্ষণ তো চেহারাটা ভালো করে দেখেনি। এতো সুদর্শন একটা ছেলে, এতোক্ষণ খেয়াল করেনি কেনো সে?
অগ্নি আমতা আমতা করে থেমে যায়।
“হ্যা বলুন কি বলতে চাচ্ছেন?”
“না মানে, তেমন কিছু না।”
অগ্নির গলার সুর পাল্টাতে দেখে শীতল অবাক হয়। শুধু গলার সুর না, চেহারাও পাল্টেছে। রাগের বদলে লাজুক হাসি। পরিস্থিতি তো সুবিধার না।

শীতল অগ্নিকে সরিয়ে দিয়ে সামনে চলে আসে।
“চলুন উৎস ভাই, বাড়িতে যাবেন তো? আমিও বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।”
“বাড়ির রাস্তা বুঝি পাল্টেছে শীতল? এই রাস্তা দিয়ে বাড়িতে যাও কবে থেকে?”
অগ্নি অবাক হয়ে শীতলের দিকে তাকিয়ে বললো,”তুই চিনিস উনাকে?”
উৎস খপ করে শীতলের হাত ধরে অগ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,”শুধু চিনেই না, রোজ রাতে আমার গালে চকাস চকাস করে দুইটা চুমু খায়। আপনি খাবেন?”
শীতল ভয়াবহভাবে চমকে উৎসের দিকে তাকায়, এই লোক কি বলে? অগ্নি চোখ বড় বড় করে তাকায় শীতলের দিকে।
“অগ্নি বিশ্বাস কর, এসব কিছুই না। শোন আমার কথা….”
অগ্নি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”কাল কলেজে আয়, তোকে দেখছি।”
শীতলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অগ্নি চলে যায়। অগ্নি যাওয়ার সাথে সাথে উৎস হাত ছেড়ে দেয় শীতলের।
“এই আপনার সমস্যা কি? এসব কি বললেন ওকে? ও যে বিশ্বাস করলো।”
“করলে আমার কি?”
“আপনার কি মানে? মিথ্যা বললেন কেনো?”
“মিথ্যা কেনো বলবো? তুমি খাওনা?”
“ছি, কোনোদিন না।”
“এখন স্বপ্নে খাচ্ছো, কিছুদিন পর বাস্তবে খাবে। মিথ্যার কি আছে?”
শীতলের কান গরম হয়ে যায়। লোকটা মাঝে মাঝে কি বলে নিজেই জানেনা। মাথা নিচু করে এদিক ওদিক তাকায় শীতল। কেউ শুনে ফেললো না তো?

উৎস শীতলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,”অনুপমা কে যখন জেনেই গিয়েছো তাহলে এখন থেকে তোমার উপর এসব অত্যা’চার শুরুই হয়ে যাবে, কিচ্ছু করার নেই। না জানাই ভালো ছিলো তোমার জন্য। এখন নির্লজ্জ, ঠোঁটকাটা উৎসের এসব অত্যাচার সহ্য করতেই হবে, অনুপমা আ আ আ।”
মাথা তুলতেও লজ্জা লাগছে শীতলের। উৎস কিছুটা এগিয়ে যায়। ঘাম আর সিগারেটের ধোঁয়ার মিশেলে অদ্ভুত একটা গন্ধ ঘিরে থাকে শীতলকে। এতো বাজে একটা গন্ধকেও অসাধারণ লাগে তার। আসলেই কি ভুল হয়ে গেলো অনুপমার রহস্য জেনে? এখন কি এসব লজ্জা হরহামেশাই পেতে হবে তাকে? এ কি বিপদ!

শীতলকে নিয়ে পাশেই একটা মেলায় এসেছে উৎস। শীতল কল্পনাও করতে পারেনি, তাকে নিয়ে উৎস মেলায় আসবে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে উৎসের দিকে।
উৎস পাশেই একটা দোকানে দাঁড়িয়ে চুড়ি দেখতে থাকে।
“হ্যা আমি জানি আমি সুন্দর। কিন্তু লোকজনের মধ্যে এভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই।”
শীতল সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়।
“আমি মোটেই আপনার চেহারা দেখছিলাম না।”
“তাহলে কি দেখছিলে? আর তো কিছু এখনো দেখাইনি, দেখিও নি।”
শীতলের গলা শুকিয়ে আসে আরো। এই লোক এতোটা খারাপ কেনো? মানুষের সামনে দেখায় কি ভদ্র। আসলে তো মিচকা শয়তান, কীভাবে বোঝাবে সে সবাইকে?

“হাঁ করে না থেকে বাম হাতটা এগিয়ে দাও?”
“হ্যা?”
বিরক্ত হয়ে উৎস নিজেই শীতলের হাতটা টেনে নিয়ে একমুঠো নীল কাচের চুড়ি পরিয়ে দেয়। শীতলের সরু, ফরসা হাতে এতো সুন্দর লাগে, উৎস অবাক হয়ে দেখে। শখের নারী বুঝি একেই বলে, যাকে সামান্য অলংকারেও রাজরানী লাগে।

“এগুলো কার জন্য উৎস ভাই?”
ভালো মেজাজটা সাথে সাথে বিগড়ে যায় উৎসের। ইচ্ছা করে মেয়েটাকে একা ফেলে চলে যেতে। থাক তুই তোর অনুর্বর মস্তিষ্ক নিয়ে, গাধী কোথাকার।

“নিলাম একজনের জন্য।”
“কার জন্য? যে আপনাকে দুষ্টুউউউউ বলে ডাকে তার জন্য?”
উৎস দাঁতে দাঁত চেপে তাকায়, শীতল ভয়ে ভয়ে চুপ করে যায়।

আজকের বিকেলটা শীতলের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকেল ছিলো। সে আজ উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটেছে। এতোটা খুশি এর আগে কখনো হয়েছে কিনা মনে করতে পারেনা। উৎসকে যেনো নতুন করে আজ আবিষ্কার করেছে সে। কাঠখোট্টা একটা মানুষের আড়ালে এমন একজন প্রেমিকের বসবাস সে বুঝতেই পারেনি। মনে হচ্ছে এই বিকেলটুকু ফ্রেমে বাঁধিয়ে যদি আটকে রাখা যেতো, কতোই না ভালো হতো। কেনো সব ইচ্ছা পূরণ হয়না এ পৃথিবীতে? তার ভাগ্যটা এতো ভালো কেনো? এই শুদ্ধতম পুরুষের ভালোবাসা পাওয়ার ভাগ্য কি সব মেয়েদের হয়? হয়না তো। সে এতো ভাগ্যবতী কেনো? সেই খুশিতে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে তার।
আজ সবকিছু সুন্দর লাগছে। ছোট ছেলেমেয়েগুলো কলসিতে পানি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে, তাও সুন্দর। ঘাসের উপর যে ফড়িংগুলো উড়ছে, তাও সুন্দর। সব সুন্দর সব।
উৎস এতোদিক যে অনুভূতিগুলো জোর করে চেপে রেখেছিলো নিজের মধ্যে, আজ সে সব উন্মুক্ত করে দিয়েছে যেনো। পাগলের মতো ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে এই অসামান্য রমনীটিকে। তার বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে ইচ্ছা করছে। নিজের বুকের যতো হাহাকার, কষ্ট বের করে দিতে ইচ্ছা করছে। শীতলের থেকে শীতল আশ্রয় তার কাছে আর কিছুইনা এই মুহুর্তে।
দুইজন সবুজ মাঠে হেঁটেছে, না শুধু সে-ই হেঁটেছে। শীতল তো ছুটেছে শুধু। একটা রঙিন প্রজাপতির মতো ছুটে ছুটে বেরিয়েছে সে। উৎস শুধু বুকে দুই হাত বেঁধে তাকিয়েই ছিলো। মেয়েটার উচ্ছলতা দেখতেও ভালো লাগছে।
শুধু তাই নয়, আজ দুইজন চটপটিও খেয়েছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। তবে উৎস আজ নিজে ডেকচি থেকে বাটিতে পরিবেশন করেছে শীতলের জন্য। চটপটিওয়ালা মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে ছিলো। দুনিয়ায় অনেক পাগল কিসিমের লোক দেখেছে, এমন দেখেনি। শীতল তো হেসেই শেষ। তার হাসির দমকে নীল কাচের চুড়িগুলো রিনঝিন শব্দে দুলে উঠেছে বারবার। এই সামান্য শব্দটুকু মেলোডির মতো শোনায় উৎসের।
উৎসের ইচ্ছা করে, সব ছেড়েছুড়ে দিতে। আর কোনো ঝামেলায় সে জড়াবে না। বাকি জীবনটুকু এই মায়াবতীর চোখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে চায়, তাতে কি খুব অসুবিধা হবে?
পরক্ষণেই বুকটা ভার হয়ে ওঠে তার। সে যে জীবনের সাথে জড়িয়েছে, এতো সহজে কি নিস্তার মিলবে? সে কি ভুল করলো এই মেয়েটাকে সুন্দর জীবনে নিজেকে জড়িয়ে? সে যে কোনোভাবেই তাকে কষ্ট দিতে পারবে না। শীতল কোনো কারণ ছাড়াই হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। উৎসের সুর কেটে গেছে, সে চাইলেও আর হাসতে পারছে না। বুকের ঠিক মাঝখানটায় একটা জমাট কষ্ট দলা পাকিয়ে আছে, চাইলেই ঝেড়ে ফেলতে পারছে না। কি যে দুর্বিষহ কষ্ট।

শীতল আর আভা ঘুমিয়েছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নেয় বহ্নি। দুইজনকেই ঘুমাতে দেখে খুট করে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সে ঘর থেকে। হাতে কালো মলাটের সেই ডায়েরিটা।
আস্তে আস্তে পা টিপে বারান্দায় এসে বসে সে। বারান্দায় সবসময় হলুদ টিমটিমে একটা আলো জ্বলে। একটা মোড়া টেনে বসে লাইটের নিচে বহ্নি।

কিছুটা ইতস্তত করে ডায়েরিটা খুলতেই আলগোছে কতোগুলো শুকনো গোলাপের পাপড়ি ঝরঝর করে নিচে পড়ে যায়। বিচলিত হয়ে যায় বহ্নি। তাড়াতাড়ি করে সেগুলো খুঁটে আবার ডায়েরির ভাঁজে রেখে দেয়।
কি সুন্দর গোটা গোটা হাতের লেখা। দেখলেই পড়তে ইচ্ছা করে। এমন গোলগোল হাতের লেখা সাধারণত মেয়েদের হয়। লোকটা যে শুধু মেয়েদের মতো লজ্জা পায় তা না, হাতের লেখাও মেয়েদের মতো। মুখ টিপে হাসে বহ্নি।

‘নীলাঞ্জনা তুমি আমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর, আমার অপলক অক্ষী শুধু তোমার মায়ায় আটকে আছে।
আমি চাইলেও পারিনা এই কণ্টকপূর্ণ জীবনে তোমাকে বয়ে নিয়ে আসতে।
তুমি যে আমার মাতাল ঝড়। তুমি নিভে গেলে আমি যে অসহায়।’

‘শ্বেত ঝিনুক আমার, আমার প্রেয়সী।
কাজল যদি চোখকে সুন্দর করতে পারে তবে কষ্ট কেনো জীবনকে নয়?
আমি বারবার মরতে পারি তোমার হাতে,
তবুও ফিনিক্স পাখির মতো বেঁচে উঠে আবারও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে কড়া নাড়বো সেই তোমার হাতেই।’

পড়তে পড়তে কখন বুঁদ হয়ে যায় বহ্নি নিজেই জানেনা। ঘোর কাটে পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে। ভয়ে ভয়ে ডায়েরিটা বন্ধ করে জামার নিচে লুকায় সে।
আভা অবাক হয়ে বহ্নির দিকে তাকিয়ে আছে।

বহ্নি জোর করে হেসে বললো,”আভা তুই? ঘুম ভেঙে গেছে রে?”
আভা থতমত খেয়ে বললো,”বড় আপা, তুই কাঁদছিস কেনো?”
বহ্নি তাড়াতাড়ি করে গালে হাত দিয়ে দেখে গাল ভেজা। কখন যে দুই চোখ বেয়ে অবিরাম পানি পড়ছে সে টেরও পায়নি। সে কবে থেকে এতো নরম মনের হয়ে গেলো? এসব কি হচ্ছে? সে নিজের অনুভূতিগুলো এভাবে প্রকাশ করছে কেনো? তবে কি তার কঠিন হৃদয়টাও আহ্লাদ করা শুরু করেছে?

“আরে বোকা, কোথায় কাঁদছি? অনেকক্ষণ একদিকে তাকিয়ে আছি তো, এজন্য মনে হয়। চল ঘুমাতে চল।”
“আপা তুই কি লুকাচ্ছিস জামার নিচে?”
বহ্নি শক্ত করে ডায়েরিটা চেপে ধরে। আভার বেশি কৌতুহল সবকিছুতে।
“বেশি কথা বলিস তুই আভা। সকালে স্কুল আছে না? উঠতে দেরি করলে কিন্তু মা খুব বকবে।”
আভাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে চলে যায়। আভা কিছু বলতে পারেনা। শুধু অবাক হয়ে বড় আপার দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় আপার এই রূপের সাথে সে পরিচিত না। সবসময় চেহারায় একটা কাঠিন্য ধরে রাখে, সবাইকে বকাঝকা করে। আভা খুব ভালো করে বুঝতে পারে বড় আপার চোখের পানি কষ্টের। কিন্তু বড় আপা কি দেখে এতো কাঁদলো? কি কষ্ট তার বড় আপার? বাকি রাত চেষ্টা করেও বহ্নি বা আভা কেউ ঘুমাতে পারলো না। কেউ জানলো না যে উভয়ই নির্ঘুম রাত কাটালো সেদিন।

(চলবে……)