#মাতাল_প্রেমসন্ধি
পর্ব: ২৮
গাঢ় কমলা রঙের একটা জামদানী পরেছে শীতল। বাবাকে রাতেই বলে রেখেছিলো তার ফুলের মালা লাগবে, খোঁপায় পরতে। নওশাদ এনে দিয়েছে মালা কিন্তু কোনোভাবেই খোঁপা পছন্দ হচ্ছে না শীতলের। শাহানা, বহ্নি, আভা সবার গলদঘর্ম অবস্থা। এই মেয়েটা এতো খুঁতখুঁতে। বিরক্ত হয়ে শাহানার তো ইচ্ছা করছিলো চড় মেরেই বসে মেয়েটাকে। নেহাৎ একটু পর তার গানের অনুষ্ঠান। এজন্য বহু কষ্টে রাগ চেপে আছে সে।
“তোর সমস্যা কি শীতল? এতো রকম খোঁপা বেঁধে দিচ্ছি। তাও তোর ভালো লাগছে না।”
শীতল ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,”আমি যাবো আজ গান করতে, যাবোই না।”
বহ্নি হতাশ হয়ে বললো,”মা তুমি শীতল হওয়ার আগে কি অন্য কিছু না খেয়ে শুধু পানি-ই খেতে? এতো পানি ওর চোখে আসে কোথা থেকে?”
আভা মুখ টিপে হেসে বললো,”এখন কাঁদলে মেজো আপাকে একদম একটা পেত্নীর মতো লাগবে, তাইনা বড় আপা?।”
বহ্নি কঠিন চোখে তার দিকে তাকাতেই আভা মুখ অন্ধকার করে ফেলে।
শীতল চিৎকার করে মালা ছুড়ে ফেলে দেয়। অসহ্য লাগছে সবকিছু।
শাহানা রাগে ঘরের বাইরে যেতে যেতে বললো,”বহ্নি মাত্র দশ মিনিটে এই বেয়াদবটাকে তৈরি করে দিবি। আর কোনো ঝামেলা যদি করে, গান করা আজীবনের মতো বন্ধ করে দিবো ওর। মনে থাকে যেনো। তোর বাবা আর কতোক্ষণ অপেক্ষা করবে? তার আর কাজ নেই?”
বহ্নি হতাশ গলায় বললো,”আচ্ছা মা চিৎকার করোনা তো। তুমি যাও, আমি দেখছি।”
শাহানা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। মেয়ের বাবার নির্দেশ মেয়ের গানের অনুষ্ঠান, সবাইকে যেতে হবে সেখানে। শাহানার মোটেই ইচ্ছা ছিলো না। নওশাদ জোর করায় তাকে বাধ্য হয়ে যেতেই হচ্ছে। আজ সকাল থেকে গরমও পড়েছে মারাত্মক। শাহানার রাগে শরীর জ্বলছে। মেয়েগুলো আর তাদের বাবা তাকে জ্বালিয়েই মেরে ফেলবে বলে তার ধারণা।
বহ্নি আভার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো,”এই তুই যা এখান থেকে। তখন থেকে সমানে বিরক্ত করে যাচ্ছিস।”
আভা অবাক হয়ে বললো,”কি আশ্চর্য, আমি কি করেছি? মেজো আপা-ই না তখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে। তার কোনো সাজই পছন্দ হচ্ছেনা।”
বহ্নি তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকাতেই আভা মুখ কালো করে চলে যায়।
বহ্নি শীতলের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।
“দেখি তাকা আমার দিকে।”
শীতল তাকায় না, অন্যদিকে ফিরে বসে থাকে।
বহ্নি জোর করে শীতলের মুখ টেনে ফেরায় তার দিকে।
“কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো বল তো? মন খারাপ খুব?”
শীতল কান্নাজড়িত গলায় বললো,”উৎস ভাইয়ের আজ আমার সাথে গান করার কথা। আর আজকেই উনাকে বাইরে যেতে হলো? সকাল সকাল কাউকে কিছু না বলে চলে গেলো। উনি যদি না আসেন সময় মতো, কীভাবে কি হবে আপা? সবাই তো হাসাহাসি করবে আমাকে নিয়ে। এতোটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হলে চলে না।”
বহ্নি মুচকি হেসে শীতলের চুল আঁচড়াতে থাকে আবার।
“তুই হাসছিস আপা? আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি। এমনিতেই লাভলী আপার সাথে ইচ্ছা করে ঝামেলা করলো। এবার উনি আমাকে ছেড়ে কথা বলবে? সবার মধ্যে আমাকে অপমান করবে তুই দেখিস। ওই লোকটা তো তা-ই চায়। আমি অপমানিত হই সবার সামনে।”
বহ্নি শীতলের মুখ তুলে ধরে দুই হাতে।
“শীতল, এই নিয়ে তিনবার তোর চোখে কাজল পরালাম। দয়া করে আর কাঁদবি না। এবার সত্যিই কাজল লেপ্টে তোকে পেত্নীর মতো লাগবে, বলে দিলাম।”
“তোমার একটুও দুশ্চিন্তা হচ্ছে না? উনি যদি সময় মতো না পৌঁছান?”
“না হচ্ছে না।”
শীতল অবাক হয়ে বললো,”একটুও হচ্ছে না?”
“না হচ্ছে না। কারণ কি জানিস? আমি উৎসকে খুব ভালো করে চিনি। উৎসকে আমি নিজের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করি। ও যদি কোনো কথা দেয়, জীবন দিয়ে হলেও সেই কথা ও রাখে। ও ঠিক সময়মতো পৌঁছে যাবে দেখিস। তবে তুই যা শুরু করেছিস, তোর পৌঁছানোর আগেই উৎস পৌঁছে যাবে।”
শীতল মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। বহ্নি খুব যত্ন করে শীতলের চুলে খোঁপা করে দেয়, মালাটা পরিয়ে ক্লিপ আটকে দেয়।
“আয়নার দিকে এবার তাকা তো শীতল, কেমন লাগছে দেখ।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও শীতল তাকায় আয়নার দিকে। সে জানে মন ভালো না থাকলে দেখতেও ভালো লাগেনা। তার মনটা অনেক খারাপ হয়ে আছে। অন্তত তাকে একবার জানিয়ে বাইরে যেতে পারতো উৎস ভাই!
তবে আয়নার দিকে তাকাতেই মনটা একটু হলেও ভালো হয়ে যায় শীতলের। এতো সুন্দর লাগছে তাকে। এটা সত্যি সে? শীতল খানিকটা লজ্জা পেয়ে যায়, লাজুক হাসে মুখ টিপে।
বহ্নি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,”যাক বাবা, তোর পছন্দ হলো সাজ, অবশেষে। এখন ঝটপট বাকি যা সাজগোজ আছে টুকটাক সেরে বেরিয়ে পড়। আমিও বের হই।”
শীতল ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমিও বের হই মানে? তুই আগে কোথায় যাচ্ছিস?”
“সে কি রে? গত রাতেই না বললাম ফার্স্ট হাফে আমার একটা পরীক্ষা আছে?”
“তার মানে? তুই আমার অনুষ্ঠানে যাবি না?”
বহ্নি শীতলের মুখে আলতো চাপ দিয়ে বললো,”কে বললো যাবো না? পরীক্ষাটা দিয়েই সোজা ওদিকে চলে যাবো। তোর গান তো অনুষ্ঠানের মাঝামাঝিতে। তার আগেই দেখবি আমি পৌঁছে গেছি।”
শীতল মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার আপা তার শক্তি। সে পাশে না থাকলে সে সেই শক্তি পাবে কোথায়?
শীতলের মন খারাপ দেখে বহ্নি ছোট্ট করে হাসে। শীতলের দুই বাহু চেপে ধরে বললো,”আমার বোনটাকে তো আজ রাজরানীর মতো লাগছে রে। দেখি একটু কাজল ছুঁইয়ে দিই ঘাড়ে। কারো যেনো নজর না লাগে।”
“সরে যা আপা, ভালো লাগছে না।”
“আচ্ছা আমি তো যাবো আর আসবো। মঞ্চে ওঠার আগেই দেখবি তোর আপা তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”
শীতল ভারী গলায় নাক টানতে টানতে বললো,”সত্যি বলছিস? কথা দে।”
“সত্যি সত্যি সত্যি, তিন সত্যি। হলো এবার?”
শীতল সুন্দর করে হাসে, বহ্নিও হাসে। হাসতে হাসতে অবাক হয়ে বোনটাকে দেখে। কি মিষ্টি, নিষ্পাপ একটা মুখ, হাসি। মেয়েটা যেনো আজীবন এমন নিষ্পাপ, ছিঁচকাঁদুনেই থাকে। একটুও যেনো পালটে না যায়, একটুও না।
উৎসের সামনে হা করে তাকিয়ে আছে প্রায় দশ জোড়া কৌতুহলী চোখ। উৎসের সেদিকে খেয়াল নেই। সে মনের সুখে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে। তার সামনে যে এতোগুলো উৎসুক চোখ, তার খেয়ালই নেই।
আজাদই প্রথম সাহস করে কিছু বলার।
গলা খাঁকারি দিয়ে উৎসের দিকে তাকিয়ে একটা তেলতেলে হাসি দিয়ে বললো,”ভাই কিছু না মনে করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
উৎস একবার তাকায় আজাদের দিকে, কিছু বলেনা।
“ভাইয়ের কি আজ বিয়ে?”
“কি বললি?”
আজাদা তাড়াতাড়ি করে বললো,”না না ভাই, আসলে আপনাকে এতো সুন্দরভাবে সাজতে আগে দেখিনি তো, তাই।”
আসলেই আজ উৎসকে অসাধারণ লাগছে, মনে হচ্ছে একটা রাজপুত্র। এলোমেলো দাড়ি,চুলগুলো আঁচড়ানো, পরিপাটি করে আঁচড়ানো না হলেও বেশ সুন্দর লাগছে। রুক্ষতার ছাপ নেই কোথাও। অনেকদিন হয় চুলগুলো ছোট করেনি। ঘাড়ের অর্ধেক পর্যন্ত নেমে এসেছে। যদি উৎস জানতো এভাবে তাকে কতোটা সুদর্শন লাগছে, সে আর কোনোদিন চুলই কাটতো না।
নওশাদ কিছুদিন আগেই তাকে একটা কালো পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছে, ওটাই পরেছে। এই মুহুর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছে এই রংটা শুধু তার জন্যই বোধহয়। সবাই হতবাক হয়ে দেখছে তাকে। হঠাৎ এতোটা সুন্দর হয়ে যাওয়ার মানে কি তার?
আবির উৎসের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে নিজে টানতে থাকে।
“কাহিনী কি ব্রাদার? সত্যিই কি বিয়ে করতে যাচ্ছো? আমাকে না বলেই?”
“তোকে বলতে হবে কেনো? এমন ভাব করছিস যেনো বিয়ে করবো আমি আর বাসর করবি তুই। ভাগ শালা।”
আবির মুখ গোমড়া করে বললো,”সময় আমারও আসবে, আমিও বাসর করবো।”
“করিস তোর স্বপ্নে। যে নাক ডাকিস, বউ জানালা দিয়ে ভাগবে প্রথম রাতেই। বাপ রে, ওটা নাক নাকি মালবাহী ট্রেন কে জানে।”
সবাই একযোগে হাসে, আবির কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে-ও হেসে দেয়।
“থাক তোরা, আমাকে যেতে হবে।”
“আচ্ছা বলে তো যা কোথায় যাচ্ছিস? ক্লাসও করলি না কোনো।”
“আনোয়ার স্যার ডেকেছিলো একটা কাজে, নাহলে মোটেই আসতাম না। আমার অনুপমা আমার জন্য অপেক্ষা করছে, কীভাবে ক্লাসে মন দিবো আজ?”
সবাই সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে।
“তার মানে? আজ সত্যিই বিয়ে করবি তুই?”
উৎস উত্তর না দিয়ে আজাদের বাইকের আয়নায় চুল ঠিক করতে থাকে। সানগ্লাসটা পরে মুচকি হাসে নিজের দিকে তাকিয়েই। নিজেকে নিয়ে কিছু ভাবার ইচ্ছা কখনোই হয়নি, সাজগোজ কখনো করেনি সেভাবে। হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছা হচ্ছে ইদানীং খুব। নিজেকে একটু পরিপাটি করে, গুছিয়ে রাখতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে জীবনটা আসলেই খুব সুন্দর। ভীষণ এলোমেলো মানুষটাকেও কেউ গুছিয়ে দিতে পারে, এটা প্রেমে না পড়লে বোঝা যায়না। প্রেম? নিজের মধ্যেই শিউরে ওঠে উৎস। প্রেম সে তো শীতের সকালে ঘাসের চিকচিক করা শিশিরবিন্দু। সূর্যের প্রখর রোদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে প্রেম সুন্দর!
“এই উৎস।”
উৎস ভ্রু কুঁচকে তাকায় পিছনে। প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। চুল খোলা, স্লিভলেস জামা, কড়া লিপস্টিক ঠোঁটে। আবেদনময়ী কিংবা লাস্যময়ী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে বোধহয়। উৎস চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে এখানে থেকে। শীতল অপেক্ষা করছে তার জন্য। তাকে দেখতে না পেয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা করবে। কেঁদেই সাজগোজ নষ্ট করে ফেলবে গাধীটা।
আবির বিরক্ত মুখে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি আমার ওকে নাম ধরে ডাকছো? তোমাকে না কতোবার করে মানা করা হয়েছে? লজ্জা হয়না তোমার?”
প্রত্যাশা আবিরের দিকে একবার তাকায়, উত্তর দেয়না।
দ্রুত পায়ে হেঁটে আসে উৎসের কাছে। উৎস সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তীব্র কড়া একটা পারফিউমের গন্ধ আসছে তার শরীর থেকে। উৎস কিছুটা পিছিয়ে যায়, মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে ওর পারফিউমের গন্ধে।
“উৎস আমার খুব পায়ে ব্যথা করছে। আমার গাড়িটা খারাপ হয়েছে। এখন আমি কীভাবে বাসায় যাবো? তুমি কি আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দিতে পারবে?”
উৎস অবাক হয়ে তাকায় প্রত্যাশার দিকে। মেয়েটা কতোদূর বাড়তে পারে তাই দেখছে। কতোটা স্পর্ধা ওর।
“উৎস…”
প্রত্যাশা উৎসের গায়ে হাতে দেওয়ার চেষ্টা করতেই উৎস পিছিয়ে যায়।
“সমস্যা কি তোমার? আমার মেজাজ খারাপ করাবে না, চলে যাও এখান থেকে।”
“আমাকে একটু সাহায্য করবে না তুমি? তুমি না সব মেয়েদের সাহায্য করো? সবার বিপদে আগে এগিয়ে আসো?”
উৎস প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বললো,”আমি যাদের সাহায্য করি ওরা সবাই অসহায়। তোমার মতো ধনীর দুলালীদেফ সাহায্য করতে অনেক মানুষ আছে। আমি তাদের পাশেই থাকি, যাদের কেউ নেই।”
“আমি সত্যিই এখন অসহায় উৎস। আমার পায়ে ভীষণ ব্যথা করছে। তুমি দেখো নিজেই।”
প্রত্যাশা পায়ের উপর থেকে কাপড় সরায়। উৎস তাকায়না সেদিকে।
“তোমার পায়ের ব্যথা দেখা ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে। সাহায্য লাগবে তোমার তাইনা? এই আজাদ, ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আয়।”
আজাদ লাফ দিয়ে উঠে বললো,”অসম্ভব, আমি এখন কোথাও যাবো না। আমি আপনার সাথে যাবো।”
উৎস বিরক্ত হয়ে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির বললো,”মাফ চাই, আমি পারবো না। এখানে কেউ পারবে না, সবার ক্লাস আছে।”
প্রত্যাশা আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে উৎসের দিকে। তার চোখ ছলছল করছে। দৃষ্টিতে অনুরোধ ঝরে পড়ছে। উৎস মুচকি হাসে তার দিকে তাকিয়ে।
বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে আর ছটফট করছে শীতল। ঘামে ভিজে সারা শরীর জবজব করছে। খুব কান্না পাচ্ছে তার। অনেক কষ্টে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখে সে। বুকটা ধকধক করছে। শেষ মুহুর্তে যদি উনি না আসে? সবার সামনে কি অপমানিতটাই না হতে হবে তাকে। ইচ্ছা করছে চুলগুলো ছিঁড়ে ফেলতে। আজ যদি উনি না আসে, আর জীবনেও উনার সাথে কথা বলবে না সে, জীবনেও না।
“শীতল।”
লাভলীর ডাকে চমকে ওঠে শীতল। ঠিক এই ভয়টাই করছিলো সে। এখন এসে একগাদা কথা শোনাবে তাকে।
শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়ায়।
“বলুন লাভলী আপা।”
লাভলী ভ্রু কুঁচকে তাকায় শীতলের দিকে। মেয়েটা কেমন কাঁপছে, স্বাভাবিক মনে হয় না তাকে দেখে।
“অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, তোর বাড়ির লোকরা ভিতরে বসে আছে। তুই বাইরে কেনো?”
শীতল জোর করে হেসে বললো,”এমনিই লাভলী আপা। ভিতরে খুব গরম লাগছিলো তাই বাইরে এলাম।”
“শুধু কি সেই কারণ?”
শীতল ফ্যাকাসে মুখে বললো,”তার মানে?”
লাভলী শীতলের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো,”আর মাত্র দুইটা গানের পর তোর গান। এদিকে তোর পার্টনার আসেনি এখনো। কার সাথে গান করবি শীতল? তূর্য স্যারের সাথে?”
“লাভলী আপা….”
লাভলী হাসে, কারো হাসি যে এতোটা কদর্য হতে পারে এই মেয়েটার হাসি না দেখলে বোঝা যেতোনা। কি বিশ্রী হায়েনার মতো হাসি। রাগে, কষ্টে শীতলের ইচ্ছা করে চিৎকার করে কাঁদতে।
আচমকা অগ্নি এসে শীতলের গায়ের উপর যেনো একরকম উড়ে এসে পড়ে।
“এই শীতল কে আসছে জানিস?”
শীতলের কোনোদিকে খেয়াল নেই। অগ্নির কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না তার।
“আরে তোর উৎস ভাই আসছে, কতোগুলো বাইকে করে কাদের যেনো নিয়ে আসছে সাথে। রাস্তা পুরো ব্লক হয়ে গেছে। সবার সামনে তোর উৎস ভাই। একদম বলিউডের হিরো লাগছে।”
শীতলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ঝট করে মাথা তুলে তাকায় সে অগ্নির দিকে।
“তুই ঠিক দেখেছিস? এই অগ্নি বল।”
“নিজেই দেখ।”
লাভলী থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো। অগ্নি তার হাত ধরেও টানতে থাকে।
“এই তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? ছাড় আমাকে।”
“আরে আসুন তো, আসুন না।”
শীতল আগে ছোটে, পিছনে অগ্নি আর লাভলী।
পাশাপাশি বসে আছে নওশাদ আর শাহানা। শাহানা আজ একটা কুসুমরঙা শাড়ি পরেছে, পাড়টা লাল। তাদের ষোলোতম বিবাহবার্ষিকীকে নওশাদ এটা উপহার দিয়েছিলো তাকে। শাহানা কোনোভাবেই এটা পরবে না। তার ধারণা এসব লাল-হলুদ পরার বয়স এখন তার নেই। নওশাদ জোর করে এটা পরিয়েছে তাকে। মেয়ের জন্য ফুলের মালা আনার সময় বউয়ের জন্যও গাদা ফুলের মালা এনেছে। শাহানা পরেনি, এতে নওশাদ রাগ করেছে তার উপর।
“এই শুনছো?”
নওশাদ উত্তর দেয়না।
“আহা কি মুশকিল, কথার উত্তর দিচ্ছো না কেনো?”
“চুপ থাকো তুমি।”
শাহানা রাগী গলায় বললো,”এখন কি আমার ছোট মেয়েগুলোর মতো খোঁপায় গাদা ফুলের মালা লাগানোর বয়স আছে? বাচ্চাদের মতো করছো কেনো?”
“তুমি বুড়িদের মতো করছো তাতে কিছু হচ্ছে না?”
“বয়সটা যেনো কমছে উনার দিন দিন।”
“হ্যা কমছে।”
শাহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে ব্যাগ থেকে মালাটা বের করে। নওশাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“তুমি মালাটা এনেছো সাথে করে?”
শাহানা লাজুক মুখে হাসে।
আচমকা শাহানার হাত থেকে মালাটা নেয় নওশাদ। কোনোদিকে না তাকিয়েই শাহানার খোঁপায় পেঁচাতে থাকে সে মালাটা।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় শাহানা। এসব কি করছে লোকটা? চারদিকে হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়ে। তার মেয়ে দু’টোও তো আছে, কোথায় কে জানে। দেখে ফেললে কি কেলেঙ্কারি হবে। এই লোক কি ধ্যানজ্ঞানহীন হয়ে গেলো? লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছে নিশ্চিত। শাহানা মাথা নিচু করে রাখে। সে ঠিক করেছে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত মাথা তুলবে না সে, কোনোভাবেই না। ছেলেমেয়েগুলো নিশ্চয়ই অবাক হয়ে দেখছে তাদের। ভাবছে, এই বুড়ো-বুড়ি দু’টোর আবার কি হলো? কিসের এতো রঙ লেগেছে তাদের মনে? কি লজ্জা! কি লজ্জা!
মালা পরিয়ে বউয়ের দিকে তাকাতেই হকচকিয়ে যায় নওশাদ। একদম পুতুলের মতো লাগছে তার বউটাকে। এতো সুন্দর কেনো মানুষটা? এতো সুন্দর কেনো?
শাহানা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,”তামাশা অনেক করেছো, এবার সামনের দিকে তাকাও দয়া করে।”
“সামনে তো কিছু দেখার নেই। যা দেখার পাশে আছে, তাই দেখছি।”
“হয়েছে কি তোমার আজ?”
“সবসময় যা হয়, কখনো কি দেখেছো কিছু না হতে? যখন যেভাবে চেয়েছো নিজেকে উজাড় করে দিয়েছি। নতুন করে তো কিছু হয়নি।”
শাহানা হঠাৎ মিটমিট করে হেসে দেয়। নওশাদ বুকে হাত দিয়ে বসে থাকে।
“হেসো না দোয়েল পাখি, আমার বুকে লাগছে।”
“অসভ্যতা গুলো এখন না করলেই নয়? মেয়েরা দেখলে কি বলবে?”
“মেয়েদের জন্যও প্রেম উন্মুক্ত, তবে আমি একা হবো কেনো নিষিদ্ধ?”
শাহানা নওশাদের হাতের উপর আলতো আঘাত করে কপট রাগ করে। কে যেনো মঞ্চে তখন গেয়ে চলেছে, প্রেমের জোয়ারে, ভাসাবো দোহারে, বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও দাও……
“মনে পড়ে সেই নিয়ন জ্বলা রাতে
অনন্ত প্রেম দিয়েছি উজাড় করে
নিঃসঙ্গ নিশি পথিক পেছনে ফেলে
পথ হেঁটেছি বাঁধা দু’টি হাতে
দূর আঁধারের ভালোবাসায় হারাতে
ছুটেছিলাম সেই রুপালী রাতে।”
শীতল ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে, কোনোভাবেই এই লোকটার দিকে সে তাকাবে না। তাকে দুশ্চিন্তায় রাখা? আবার এখন এসে গান করে রাগ ভাঙানো হচ্ছে?
যদিও তার অবাধ্য চোখজোড়া তাকে এক মুহুর্ত স্বস্তি দিচ্ছে না। এই মানুষটাকেই আজকেই কেনো এতো সুন্দর দেখতে লাগতে হবে? কেনো?
“শীতল।”
ঈষৎ কেঁপে ওঠে শীতল। তবুও তাকায়না।
“আমি এসেছি তো, তাকাও আমার দিকে।”
শীতল অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আজ ভালোমতো রাগ দেখাবে সে। কোনো কথা শুনবে না।
আচমকা খোঁপা খুলে যায় শীতলের। শীতল অবাক হয়ে তাকাতেই দেখে উৎস তার খোঁপা খুলে দিয়েছে। অবাধ্য চুলগুলো মুখের সামনে এসে ভিড় করে। মোহনীয় আবেশের আস্তরণ পড়ে উৎসের বুকে। অজানা ধূম্রজাল তৈরি হয় মস্তিষ্কে। প্রেয়সীর দৃষ্টি, সে তো দামী মদের চেয়েও মাতাল করা। সে যে উত্তপ্ত বহ্নিশিখা, হৃদয় জ্বালিয়ে দেয় সাথে সাথে।
“আপনি আমার খোঁপা খুলে দিলেন কেনো?”
“খোলা চুলে তোমাকে যতোটা মোহনীয় লাগে, খোঁপাতে তা লাগেনা। আমি গানটা করতে চাই হৃদয় দিয়ে, তোমার দিকে তাকিয়ে। তাই আমার চোখে তোমার জন্য মুগ্ধতা লাগবে, আর কিছু না।”
শীতল চুলগুলো কানে গুঁজে দেয়, মিটিমিটি হাসে ঠোঁট চেপে। উৎস পকেট থেকে একটা কালচে খয়েরি গোলাপ বের করে শীতলের কানে গুঁজে দেয়।
“প্রেমিকার ঠোঁট যেনো এলাচ দেওয়া চা, পান করতে ইচ্ছা করে। তবে ছেঁকা খেয়ে পুড়ে যাওয়ার ভয়ও নেহাৎ কম না।”
শীতল উৎসের হাত ধরে বসে আচমকা। উৎস কিছুটা অবাক হলেও প্রকাশ করেনা। তুলার মতো কোমল হাতের স্পর্শে ভ্রম হয় তার, নেশা নেশা লাগে।
“চলুন তো…”
“ভাই ভাই, আপনি তো ভালোই প্রেম করছেন। আমার ঘাড়ে ওই গায়ে পড়াটাকে উঠিয়েছেন কেনো? ওকে এখানে আনার কি দরকার ছিলো?”
“আজাদ তুই প্রত্যাশাকে নিয়ে বোস। আমার গান শুনে ওর পায়ে ব্যথা ঠিক হয়ে যাবে।”
“তার মানে?”
“মানে কিছু না, ওর দায়িত্ব তোর আপাতত।”
উৎস চলে যায়, আজাদ মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে থাকে। এই আপদটাকে তার গলাতেই ঝুলিয়ে দিলো ভাই?
উৎস প্রত্যাশাকে ইচ্ছা করে এখানে এনেছে। শীতলের সাথে গান গাওয়ার মুহুর্তটা ও দেখুক, ও দেখুক ও যাকে চাচ্ছে তার দৃষ্টি উন্মাদের মতো অন্য কারো উপর নিবদ্ধ, শুধু তার উপর আর কারো উপর না।
“উফফ দেখে চলতে পারেননা নাকি? দিলেন তো পায়ে পাড়া দিয়ে।”
“ও ম্যাডাম, একই কথা যদি আমি বলি? আপনি ইচ্ছা গায়ে পড়েছেন আমার। দেখছেন এমন একটা সুদর্শন লোক, আগে কখনো দেখেননি। অমনি গায়ে পড়ে গেলেন তাইনা?”
অগ্নি হতভম্ব হয়ে আজাদের দিকে তাকায়।
“কি বললেন আপনি? নেহাৎ আপনি উৎস ভাইয়ের সাথে এসেছেন। নাহলে আমার কলেজে এসে আমাকে এতো বড় কথা বলার মূল্য আপনাকে দিতে হতো।”
“আরে যান যান, এটা আমার বোনেরও কলেজ। আপনার একার নাকি? আজকাল মেয়েগুলোও হয়েছে। সুন্দর ছেলে দেখলে ভাব জমাতে আসে। যাই হোক, আপনার নাম কি? চেহারা তো ভালোই দেখা যায়।”
অগ্নি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললো,”দেখুন….”
“হ্যা হ্যা দেখছি তো অনেকক্ষণ থেকে। নাম কি? বাড়ি কই?”
“অসহ্য….”
অগ্নি এগোতে থাকে। আজাদ পিছন থেকে চিৎকার করে বললো,”আলাপ হবে না নাকি? ও ম্যাডাম, রাগ করেন কেনো?”
অগ্নি পিছনে তাকিয়ে একবার মুখ বাঁকিয়ে সোজা হেঁটে চলে যায়। পাগলের সাথে বকে লাভ নেই।
“এই আজাদ, উৎস কোথায় গেলো?”
আজাদ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে দেখে প্রত্যাশা উৎসুক হয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে। এই আপদটা তাকে এক মুহুর্ত শান্তি দিবে না।
“আমার দাদুর শ্রাদ্ধ করতে গেছে। চলো ভিতরে, চলো।”
প্রত্যাশা আজাদের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। এখানে উৎস কেনো তাকে নিয়ে এলো সে বুঝতে পারছে না।
আবিরও এসেছে আজ উৎসের সাথে। আভার পাশে একটা চেয়ার ফাঁকা ছিলো। সে জায়গাটা রেখেছে বহ্নির জন্য। তব্র বহ্নি এখনো আসেনি। আভা বারবার তাকাচ্ছিলো বাইরের দিকে আপাকে খুঁজতে। তখনই আবির কোথা থেকে উড়ে এসে ঝপ করে বসে পড়ে। আভা হতভম্ব হয়ে যায়।
“আপনি?”
“কেমন আছেন মিস নিলামে ওঠা হাবা?”
আভা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে আবিরের দিকে সে।
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, আপনি সত্যি এখানে?”
“আপনি খুশি হননি?”
আভা আমতা আমতা করে বললো,”আমি কেনো খুশি হবো?”
“আচ্ছা তাহলে বরং চলে যাই…”
আবির উঠেই যাচ্ছিলো, আভা তাড়াতাড়ি করে ডাক দেয় তাকে পিছন থেকে।
“এই দাঁড়ান দাঁড়ান।”
আবির উল্টোদিক ফিরে হাসে।
“এসেছেন যখন উৎস ভাই আর মেজো আপার গানটা শুনেই যান।”
আবির বসে, মনে মনে লাড্ডু ফোটে তার। তবুও মুখটা বিরস করে রাখে।
“মিস আভা…”
“কি হয়েছে?”
“আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে জানেন? একদম আমার মায়ের ওই ছবিটার মতো।”
আভার বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে। ঝট করে তাকায় আবিরের দিকে। আবির সামনের দিকে তাকায়, এই মুহুর্তে নিষ্পাপ ওই চাহনীর মুখোমুখি হতে পারবে না সে। তার ভিতর ভেঙেচুরে কান্না আসবে।
“আপনাকে শাড়িতে খুব মানায় মিস আভা। আপনাকে আমি এক বস্তা শাড়ি উপহার দিবো, পরবেন?”
“আমাকে আপনি এক বস্তা শাড়ি দিবেন? কেনো?”
“বলতে পারেন আমার ভালো লাগার জন্য।”
“মানে?”
মঞ্চে তখন শীতল আর উৎসের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ওদের আলোচনা ওখানেই অসমাপ্ত রাখতে হয়। যদিও আভার বুকটা কেমন করতে থাকে, গলা শুকিয়ে আসে তার মুহুর্তের মধ্যে।
পরীক্ষা শেষ করেই তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গোছাচ্ছিলো বহ্নি। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব শীতলের কলেজে পৌঁছাতে হবে তাকে। মেয়েটাকে যে সে কথা দিয়েছে। কথা রাখতে না পারলে সে কেমন বড় বোন?
“কি রে বহ্নি? আর ক্লাস করবি না? ব্যাগ গোছাচ্ছিস যে?”
“না রে অরু, আজ আর ক্লাস করবো না। আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে।”
বহ্নি দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে, হঠাৎ তার এক বান্ধবী তার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে আসে।
বহ্নি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,”কি ব্যাপার নীরা? কিছু বলবি?”
নীরা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”তোর সাথে একজন দেখা করতে এসেছে। বিল্ডিংয়ের উত্তরের গেটে অপেক্ষা করছে। তোকে এক্ষুনি যেতে বলেছে।”
বহ্নি অবাক হয়ে বললো,”কি যা তা বলছিস? আমার সাথে কে দেখা করতে আসবে?”
“যেয়েই দেখ।”
“আমার এখন সময় নেই, আমাকে এক্ষুনি বের হতে হবে। নাহলে সময়মতো পৌঁছাতে পারবোনা।”
“তুই কোথায় যাবি আমি জানিনা। তবে যে দাঁড়িয়ে আছে তার সাথে দেখা করা এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তোর জন্য।”
“বলবি তো কে।”
“তুই যেয়ে দেখ, আমি বলতে পারবো না।”
বহ্নি হাল ছেড়ে দিয়ে উত্তরের গেটের দিকে ছুটতে থাকে। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার, এখন আবার কাকে দেখা করতে আসতে হলো তার সাথে?
বরফের মতো জমে দাঁড়িয়ে আছে বহ্নি। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে তার। মনে হচ্ছে যে কোনো সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। গা’টা গুলিয়ে ওঠে তার। মুখভর্তি করে বমি করতে পারলে ভালো লাগতো বোধহয় কিছুটা। কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছে সে রোবট হয়ে গেছে। শ্বাস পড়ছে খুব ধীরে, খুব।
“বহ্নি, আমি জানতাম তুমি আসবে। তুমি কেমন আছো?”
বহ্নি দুই’এক পা করে পিছাতে থাকে। সামনে দাঁড়ানো যুবকটা হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
“না এ হতে পারে না, না না…”
“বহ্নি কি বলছো বিড়বিড় করে। কাছে এসো, তোমার সাথে কথা আছে আমার।”
বহ্নি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কতোটা নির্লজ্জ হলে জানোয়ারটা তার সাথে কথা বলতে চায়। গলা টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছে পশুটাকে।
“এসো বহ্নি। দেখো তোমার জন্য কতো উপহার এনেছি। আজ সকালেই বাড়ি ফিরেছি। সবার আগে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি। তুমি কাছে আসবে না?”
“সজীব তুই……?”
সজীব দুই হাত বুকে বেঁধে মুচকি হেসে বললো,”যাক ভুলে যাওনি তবে আমাকে। অবশ্য ভোলার কথাও না। যে সুখ তোমাকে দিয়েছি…..”
বহ্নি কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগের চেইন খোলে। পিতলের একটা সূচালো চুলের কাঁটা গত মাসেই উৎস তাকে উপহার দিয়েছিলো। আচ্ছা এটা সোজা বুকে গেঁথে দিলে কি একটা মানুষ মরে না?
(চলবে……)
#মাতাল_প্রেমসন্ধি
পর্ব: ২৯
সুরের মোহনায় আবেশিত দর্শক সারির সবাই। সবাই এতোটাই বিমুগ্ধ যে হাততালি টুকু দিতেও ভুলে গেছে। নওশাদের চোখে পানি, লুকানোর চেষ্টা করছে না আজ পানিটুকু। শাহানা শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। মেয়েটাকে আজ দেখতে একটা পরীর মতো লাগছে। চুলে খোঁপা করা ছিলো আসার সময়, এখন চুল খোলা। খোলা চুলে তাকে এতোটা সুন্দর লাগবে জানলে খোঁপাই করতে দিতো না সে। আর উৎস? ওকে তো এতোটা সুদর্শন আগে কখনো মনে হয়নি। হ্যা এটা ঠিক, ছেলেটা তার বাবার মতোই সুপুরুষ হয়েছে। তবে আজ কি তাকে একটু অতিরিক্ত ভালো লাগছে? ওদের এতো সুন্দর গানের পিছনে কি শুধুই দু’জনের অসাধারণ কণ্ঠ? নাকি সুরের মিলন ছিলো অন্য কোথাও? মা হয়ে একেবারে যে কিছু সে বুঝবে না তা না। তবে মা হওয়া এতো সোজা না, অনেক সময় অনেক কিছু বুঝেও চুপ থাকতে হয়। ওরা এখন ভঙ্গুর, বেশি চাপ দিলে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
নীরবতার মধ্যেই চিৎকার করে ওঠে প্রথমে আজাদ, পরে আবির সহ বাকিরা।
আজাদ আঙ্গুল দিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে চিৎকার করে বললো,”ভাই অসাধারণ, কি দিলেন। আর ভাবী… আরে ধুর কি বলি, শীতল আপা তো যেনো লতা মুঙ্গেশকরের বোন পাতা মুঙ্গেশকর।”
কোথাও জায়গা না পেয়ে অগত্যা অগ্নিকে আজাদের পাশেই বসতে হয়েছিলো। বান্ধবীর গানে সে নিজেও মুগ্ধ। কিন্তু এই ছেলেটা এমন তারছেঁড়া পাগলের মতো চিৎকার কেনো করছে সে বুঝতে পারছে না। উৎস ভাইকে তো মানুষ ভালো মনে হয়। এসব কোন নমুনার সাথে মিশে সে?
“উফফ এভাবে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছেন কেনো? গলা তো নয় যেনো ফাটা বাঁশ। এটা কোনো মানুষের গলা?”
আজাদ অবাক হয়ে তাকায় অগ্নির দিকে। কথাগুলো যে তাকে বলা হয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
“এইযে ঘুগনি, কথাগুলো কি আপনি আমাকে বললেন?”
অগ্নি চরম আশ্চর্য হয়, এই লোক কি বলে?
“এই আপনি ঘুগনি কাকে বললেন?”
“ওমা আপনার নাম ঘুগনি না? ওইযে কিছুক্ষণ আগেই আপনাকে কে যেনো ডাকলো ওই নামে।”
অগ্নি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”ওটা অগ্নি, ঘুগনি নয়।”
“ওহ তাই বলুন। আমি আরো ভাবলাম আপনার নাম ছোলা বেগম ঘুগনি।”
“আর একটা বাজে কথা বললে দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধরে বের করে দিবো।”
“তাই নাকি? ডাকেন তো দেখি কোন দারোয়ানকে ডাকবেন। আপনার দারোয়ান আমাকে ‘আব্বাজান’ ডেকে কোলে উঠে যাবে, ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া দূরে থাক।”
অগ্নি রাগে কাঁপতে কাঁপতে একবার ‘অসহ্য’ বলে সেখানে থেকে চলে যায়। একটু পর তার নাচ হবে, এই লোকের সাথে ফালতু প্যাচাল পেড়ে লাভ নেই। এটা একটা বদ্ধ উন্মাদ।
অগ্নির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে আজাদ। ঠিক তখনই প্রত্যাশা আজাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। আজাদের মুখটা বাংলার পাঁচের মতো হয়ে যায়।
“তুমি এখনো যাও নাই? তোমার পায়ে ব্যথা ঠিক হয়নি? নাকি তোমার দুষ্টুর গান শুনে পা ব্যথা বেড়ে গেছে?”
“উফফ আজাদ, তুমিও কিন্তু ভীষণ দুষ্টু হয়ে গেছো আজকাল।”
আজাদ লাফ দিয়ে উঠে সরে যায়।
“মাফ চাই হতাশা। তোমার দুষ্টু আছে একজন, তাই থাক। আমি হতে চাইনা।”
“এই হতাশা নাতো, প্রত্যাশা।”
আজাদ বিড়বিড় করে বললো,”কোন মাথামোটা যে তোমার নাম প্রত্যাশা রেখেছিলো তাকে সামনে পেলে নাক ফাটিয়ে দিতাম।”
“এই কিছু বলছো?”
আজাদ জোর করে হেসে বললো,”না গো, গান শুনেছো না? এবার তোমার রিকশায় উঠায় দিই। বাড়ি চলে যাও।”
“আমি কখনো রিকশায় উঠিনি, আমার ভয় করে। তবে উৎস পাশে থাকলে যেতে পারি।”
প্রত্যাশা হাসে লাজুক মুখে। আজাদের অসহ্য রাগ হয় উৎসের উপর। আর কাউকে পায়নি সে? আমার ঘাড়েই উঠায় দিলো এই শুয়োপোকাটাকে?
আবির আভার দিকে তাকিয়ে দেখে তার চোখে পানি। ব্যস্ত হয় যায় আবির।
“এ কি আভা? কি হলো তোমার? কাঁদছো কেনো? তোমার কি পেটে ব্যথা করছে?”
আচমকা কান্নার মধ্যে হেসে দেয় আভা ফিক করে। আবির অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মেয়েদের ব্যাপারস্যাপার সে ভালো বুঝে না। কান্নার মধ্যে কেউ কেনো হাসবে? এ কি কথা?
“আবার হাসছো যে? হাসির মতো কিছু বলেছি কি?”
“আপনি এতো বোকা কেনো আবির ভাই? কেমন নেতা আপনি?”
“আমি বোকা?”
“অবশ্যই আপনি বোকা। আমি কি ছোট বাচ্চা যে পেটে ব্যথায় কাঁদবো?”
চিন্তায় মাথা চুলকায় আবির।
“আসলেই তো, তাহলে কাঁদছিলে কেনো?”
আভা আনমনে বললো,”উৎস ভাই আর মেজো আপাকে পাশাপাশি এতোটা সুন্দর লাগবে আগে কেনো বুঝিনি আমি? উৎস ভাই ঠিকই বলে, আমি আসলেই হাবা।”
আবির আভার দিকে তাকায় পূর্ণ দৃষ্টি মেলে। মেয়েটাকে আজ পুতুলের মতো সুন্দর লাগছে। মনটা খারাপ হয়ে যায় আবিরের। এতো মিষ্টি একটা পরী কি তার ভাগ্যে আছে? যদি থাকে তবে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হবে। তার এলোমেলো, একাকীত্ব ভরা জীবনে একটা আশার প্রদীপ হয়ে যদি মেয়েটা আসে, তবে সে সবকিছু ছেড়ে দিতে রাজি আছে। রাজনীতি, মারামারি সব, সব।
“তবে আপনি আসলেই বোকা আবির ভাই।”
আবির চমকে ওঠে আভার দিকে তাকিয়ে। আভা এখনো মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে, তবে কথা বলছে তার সাথে।
“কীভাবে বুঝলে?”
আভা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। আবিরের দিকে অল্প ঝুঁকে আস্তে আস্তে করে বললো,”বড় আপার ডায়েরীতে একটা কথা লেখা দেখেছিলাম, আপা-ই লিখেছিলো। ‘নারীর মন, সে তো বহু সাধনার ধন। সময় ফুরালে হবে না সাধন।’ কথাটার মানে বোঝেন?”
আবির হতভম্ব হয়ে মাথা নাড়ে, সে বোঝেনি।
আভা শব্দ করে হেসে বললো,”এইযে, এই কারণেই আপনি বোকা?”
“কীভাবে আমি নিজেকে চালাক প্রমাণিত করবো?”
“আগে কথাটার মানে বুঝুন, তারপর ভেবে দেখবো আপনি বোকা না চালাক। তবে মানেটা আপনি একাই খুঁজে বের করবেন, আর কারো সাহায্য নিবেন না।”
আবিরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আভা চলে যায় সেখান থেকে। আবির স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। আভা তাকে কি বলে গেলো?
শীতল ঈষৎ কাঁপছে, উৎস একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আচ্ছা এই মেয়েটা এতো মায়া মায়া কেনো? সে চাইলেও তো মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে দিতে পারবে না এখন। অনুভূতি প্রকাশ না করে ভালোই ছিলো। দূরে থাকা যেতো। কিন্তু এখন? মেয়েটা তো জেনেই গেছে, সে উৎসের অমূল্য রত্ন, তার কাব্যের উপমা, তার অনুপমা। এরপর থেকেই তার আদুরে উপস্থিতি উৎসের বুকের ফাঁকা স্থানটা ভরাট করে দিয়েছে। এখন সে কি করবে? কোনো জায়গা ফাঁকা থাকা একরকম মানা যায়, কিন্তু একবার সেই জায়গা ভরাট হয়ে গেলে সেই স্থান ফাঁকা করলে মৃত্যু ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। সে তো হারাতে চায়না কখনো, কিন্তু সে যে পথে পা দিয়েছে তা যে ধারালো কণ্টকে ভর্তি। যদি সে হেরে যায়? যদি তাকে খুবলে খায় শকুনের দল? যদি জান নিয়ে বেঁচে না ফিরতে পারে? তবে এই মেয়েটার কি হবে? ও তো সহ্য করতে পারবে না। উৎসের আজকাল অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে, অনেক অনেক বছর। দিন যাচ্ছে, মেয়েটা তার সমস্ত উষ্ণতা উগড়ে দিচ্ছে উৎসের প্রতি। উৎস শীতের দিনে আদুরে বিড়াল যেমন গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে উষ্ণ জায়গায়, তেমনই গুটিশুটি মেরে যাচ্ছে শীতলের উষ্ণতায়। খুব আরাম লাগে তার, খুব।
“গান তো ভালো হয়েছে শীতল, তাও এমন করছো কেনো?”
শীতল ক্ষীণ গলায় বললো,”আমার কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে উৎস ভাই। জীবন যদি এভাবেই চলে যেতো, কতো ভালো হতো।”
“এভাবে চলবে না ভাবছো কেনো?”
“জানিনা।”
উৎস এদিক ওদিক তাকায়। অনুষ্ঠান চলছে, চারদিকে মানুষ গমগম করছে।
“শীতল তাকাও আমার দিকে।”
শীতল গাঢ় গলায় বললো,”না।”
“কেনো? ভয় পাচ্ছো?”
“কিসের ভয় পাবো?”
“যদি নিজেকে ধরে রাখতে না পারো?”
“উফফ আপনি…..”
শীতল উৎসের বুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে তাকায় তার দিকে। দৃষ্টিটাই যেনো অন্যরকম এই মানুষটার। তাকালে মনে হয় অনেক দূর থেকে কেউ তাকে দেখছে, দৃষ্টি বহুদূরে নিয়ে যায় তাকে।
শীতল ঘোর লাগা চোখে সেদিকে তাকিয়ে খুব ধীর কণ্ঠে বললো,”আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন উৎস ভাই? শক্ত করে, খুব শক্ত করে।”
উৎস চোখ বড় বড় করে তাকায় শীতলের। শীতল ধাতস্থ হতেই চমকে ওঠে। ভীষণ অপ্রস্তুত বোধ করে সে।
“আমি যাই, অগ্নির নাচ এখন।”
শীতল এগোতে গেলেই উৎস পিছন থেকে তার হাত টেনে ধরে। জমে যায় শীতল।
“করছেন কি? এতো মানুষ চারদিকে, ছাড়ুন।”
“জড়িয়ে ধরার কথা বললে যে? তুমি ভালো করেই জানো আমি পারবো।”
“পাগল নাকি আপনি?”
“বললে কেনো তাহলে?”
“আর বলবো না, দয়া করে ছাড়ুন আমাকে। বাবা, মা কেউ দেখে ফেলবে।”
উৎস শীতলের অনেকটা কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,”তোমার পাথরের মতো শক্ত বরফ গলিয়ে ফেলার ক্ষমতা আছে আমার। সমুদ্রে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কি ভয়? কাউকেই ভয় পাইনা।”
“ধুর ছাড়ুন।”
শীতল জোর করে উৎসের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলে যায়। উৎস মুচকি হাসে সেদিকে তাকিয়ে।
“বাড়িতে কেউ আছেন?”
সবাই অনুষ্ঠানে গেলেও সায়েরা যায়নি। গত রাত থেকেই তার পায়ে ভীষণ ব্যথা। উৎসকে আগে থেকে জানায়নি। জানালে হয়তো ঝামেলা করতো, ডাক্তারের কাছে নিতে চাইতো। তার গান গাওয়াটাই হতো না, শীতল মন খারাপ করতো। সাত পাঁচ ভেবে কাউকে জানানো হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না জানিয়ে ভুলই করেছে। ব্যথাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে।
কোনোরকমে পা টেনে টেনে গেট খুলতেই সায়েরা অবাক হয়ে যায়। রণ দাঁড়িয়ে আছে বাইরে, সাথে একজন বৃদ্ধ লোক। রণের হাতে অনেক মিষ্টি, আরো অনেক প্যাকেট। কাহিনী না বুঝে সায়েরা ফ্যালফ্যাল করর তাকিয়ে থাকে রণের দিকে।
“বাবা উনি সায়েরা ফুপু, নওশাদ চাচার বোন।”
বৃদ্ধ সুন্দর করে হাসে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে চোখে দেখেনা, কালো চশমা পরা চোখে।
“বোন তুমি আমাকে চিনতে পারোনি? আমি জাফর, নওশাদের শিক্ষক নওয়াব আলীর ছেলে আমি।”
সায়েরা হতবাক হয়ে বললো,”জাফর ভাই আপনি? এ কি অবস্থা আপনার? রণ তোমরা বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো বাবা? ভিতরে এসো।”
বাবাকে ধরে ধরে নিয়ে রণ হাঁটতে থাকে। ইতিউতি তাকায় বার বার। কাউকে খুঁজতে থাকে যেনো সে। কিন্তু কাউকেই চোখে পড়ছে না। বাড়িতে কি কেউ নেই নাকি?
বসার ঘরে রণ আর তার বাবাকে নিয়ে বসায় সায়েরা। কি খাওয়াবে কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না সে। বাড়িতে আজকেই কেউ নেই, এদিকে তার পায়ের ব্যথাটাও প্রবল। পাগল পাগল অবস্থা সায়েরার।
“ফুপু বাড়িতে কেউ নেই? এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে যে?”
“আসলে বাবা, বাড়িতে এখন আমি ছাড়া কেউ নেই। শীতলের গানের অনুষ্ঠান আজকে, সবাই সেখানেই গেছে। তবে তোমরা দুশ্চিন্তা করোনা, ওরা একটু পরই চলে আসবে। তোমরা আরাম করে বসো।”
রণ কিছুটা ইতস্তত করে বললো,”মিস বহ্নি ও কি গেছে?”
সায়েরা ভ্রু কুঁচকে তাকায় তার দিকে। এতো মানুষকে ছেড়ে হঠাৎ বহ্নির কথা জিজ্ঞেস করছে যে? তাছাড়া এতো মিষ্টি, শপিং ব্যাগ এগুলো কেনো? কি ব্যাপার কিছুই মাথায় আসেনা তার।
“ও ভার্সিটিতে গেছে, একটা পরীক্ষা আছে। ওটা দিয়েই শীতলের কলেজে চলে যাবে।”
রণ মাথা নিচু করে বললো,”সমস্যা নেই আমরা অপেক্ষা করছি। আসলে সন্ধ্যাতেই আসতাম। কিন্তু বাবাকে নিয়ে সন্ধ্যায় বের হওয়া যায়না। এই কয়দিন হলো বাবাকে এখানে নিয়ে এসেছি। তাই দিনের বেলাতেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এলাম। আপনাকে বিরক্ত করলাম না তো ফুপু?”
সায়েরা হেসে দেয়। ছেলেটা খুব মায়া মায়া করে কথা বলে। বেশ ভালো লাগে শুনতে। তাকে দেখতেও বেশ সুদর্শন লাগছে আজকে। শ্যামলা বর্ণের উপর কফি রঙের শার্টটা বেশ মানিয়েছে। আত্মবিশ্বাসী আর খুব ফুরফুরে লাগছে।
হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় আসতেই সায়েরার মনটা ভালো হয়ে যায়। আচ্ছা কেমন হয় যদি এই ছেলেটার সাথে বহ্নির বিয়ে হয়? অসম্ভব কিছু তো নয়। হ্যা ছেলেটার নতুন চাকরি, টাকাপয়সা অতোটা নেই। কিন্তু ছেলেটা যে সততার দিক থেকে একশো তে একশো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবনে টাকাপয়সার চেয়েও চরিত্রবান একজন পুরুষের খুব বেশি দরকার। তাছাড়া তার বহ্নি তো ভীষণ রূপবতী৷ রণ কি তাকে পছন্দ করবে না? অবশ্যই করবে, নাহলে তার কথাই কেনো জিজ্ঞেস করবে?
“একটুও বিরক্ত করোনি বাবা। তবে ছুটির দিনেই আসতে পারতে। অফিস ছুটি নিলে আবার।”
জাফর মুখ খোলে এবার।
খোলা গলায় হাসতে হাসতে বললো,”ওর আর তর সইছে না বোন। এজন্যই তো তাড়াহুড়ো করে আসা।”
সায়েরা অবাক হয়ে বললো,”কিসের জন্য তর সইছে না? ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
রণ তাড়াতাড়ি করে বললো,”ও কিছু না ফুপু। বাবা যে কখন কি বলে নিজেই জানেনা।”
জাফর হাসতে থাকে একমনে। রণ লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে। এমন অনুভূতি তার এই প্রথম। হাত-পা ঘামছে ভীষণ। আসার পর থেকে দুই গ্লাস পানি খেয়েছে। তবুও যেনো পানি পিপাসা মিটছে না, গলা শুকিয়ে আসছে। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। তা-ও কপাল চুইয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। যদি উনারা রাজি না হন? যদি তার মতো দরিদ্র একটা ছোট্ট চাকরিজীবীকে ভরসা করতে না পারেন? তাহলে সে কি করবে? উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে সে। জাফর ঠিক বুঝতে পারে ছেলের অবস্থা। সে শক্ত করে ধরে রাখে তার হাত। তার বিশ্বাস খালি হাতে তারা ফিরবে না। তার ছেলে লাখে একটা, তাকে ফেরানো অসম্ভব।
বিকালের দিকে টলতে টলতে বাড়িতে ঢোকে বহ্নি। অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় দাঁড়াতে পারছে না সে। সারাটা দিন উদ্ভ্রান্তের মতো রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছে সে। কোনো দিশা পাচ্ছিলো না। শীতলের কলেজ বা বাড়ি কোথাও যেতে ইচ্ছা করছিলো না। সে জানতো একদিন না একদিন ওই অসভ্যের সামনাসামনি তাকে হতে হবে। মনের দিক থেকে প্রস্তুতও ছিলো সে। কিন্তু সেটা এভাবে সে ভাবতে পারেনি। সে কি করতে যাচ্ছিলো সে জানেনা। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো। শেষ মুহুর্তে অরু আর নীরা না এলে কি হতে যাচ্ছিলো সে জানেনা। তারা আসার পর খুব অদ্ভুতভাবে মজা করা শুরু করেছিলো। এবার নাকি সজীব আর তার বিয়ের সানাই বাজবে। বহ্নি আর সহ্য করতে পারেনি। ছুটে বেরিয়ে এসেছে ভার্সিটি থেকে। সজীব পিছন থেকে ছুটেছিলো। বহ্নি রিকশাতে উঠে গিয়েছিলো, সজীব আর ধরতে পারেনি তাকে। তবে বহ্নি জানে সজীব এভাবে তাকে ছাড়বে না। তার জীবনটা শেষ করে দেওয়ার পরও শান্তি হয়নি তার। তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বে না।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থমকে যায় বহ্নি। তার বাবার গলা পাওয়া যাচ্ছে, সাথে অপরিচিত একজন পুরুষের কণ্ঠ। বহ্নির কোনোদিকে নজর নেই। এখন সোজা বাথরুমে ঢুকবে সে। কয়েক বালতি পানি ঢালতে হবে মাথায়, নাহলে শান্তি হবে না, কোনোভাবেই না।
বারান্দায় ফ্যাকাশে মুখে বহ্নিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সায়েরা চমকে ওঠে। খাবার নিয়েই যাচ্ছিলো সে।
“বহ্নি মা তুই এসেছিস?”
বহ্নি ম্লান হাসার চেষ্টা করে, হাসিটা ঠিক ফোটেনা। সায়ের খাবার রেখে বহ্নির শরীর থেকে ওড়না খুলে তার মাথায় দিয়ে দেয়।
বহ্নি অবাক হয়ে তাকায় সায়েরার দিকে।
“ফুপু এসব কি তামাশা শুরু করেছো? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?”
“আরে আয় তো আমার সাথে।”
বহ্নিকে জোর করে বসার ঘরে নিয়ে আসে সায়েরা। সাথে সাথে বহ্নির পা বরফের মতো জমে যায়। রণ বসে আছে তার সামনে৷ তার একদম সামনে। তার মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। অসম্ভব সুন্দর লাগছে আজকে। এতো সুন্দর লাগছে কেনো তাকে আজ?
“বহ্নি।”
উৎসের ডাকে বহ্নি একবার পিছনে ঘুরে তাকায়, আবার নিজের মতো বসে থাকে চুপ করে। জামগাছের নিচের বেঁদীতে বসে আছে বহ্নি। বাবা বলেছে এই গাছ নাকি কেটে ফেলা হবে। বহ্নির মনটা খারাপ হয়েছে শুনে। অনেক স্মৃতি আছে এই গাছকে ঘিরে। বড় বড় দালানকোঠা তাকে ঠিক টানেনা। তার ভালো লাগে এই গাছপালা ঘেরা ঠান্ডা পরিবেশ। কিন্তু বাবার অনেক স্বপ্ন, বড় বাড়ি বানানোর। বহ্নি তাকে নিরুৎসাহিত করবে না, সে প্রশ্নই ওঠে না।
বহ্নির কাছাকাছি এসে বসে উৎস। তার শরীর থেকে বিকট সিগারেটের গন্ধ আসে। অন্যদিন হলে বহ্নি চেচামেচি করতো। বলতো, ‘দূর হয়ে যা উৎস। তোর গায়ে সিগারেটের গন্ধ। বমি আসছে আমার।’
কিন্তু আজ কিছুই বললো না, নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। উৎস অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে।
“কেসটা কি তোর? আজ তো তোর খুশিতে নাচার কথা। যাকে চেয়েছিস, পেতে যাচ্ছিস। তবুও মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেনো?”
বহ্নি ম্লান হেসে বললো,”আমি তো দেখতে পেঁচার মতোই, কেমন আর দেখাবে?”
“বহ্নি, কি হয়েছে তোর?”
বহ্নি উঠে দাঁড়ায়, চলে যেতে গেলেই উৎস এসে দাঁড়ায় সামনে।
“উৎস সামনে থেকে সরে যা। মাথা যন্ত্রণা করছে, ঘুমাবো।”
“কি হয়েছে না বলে এখান থেকে যেতে পারবি না তুই।”
বহ্নি শান্ত চোখে উৎসের দিকে তাকিয়ে বললো,”কি বলবো? কিছু হয়নি তো।”
“অবশ্যই কিছু হয়েছে। রণ ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে? উনার সাথেও তো ঠিকমতো কথা বললি না। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন উনারা, তুই কিছুই জানালি না। কতো কেনাকাটা করে এনেছে তোর জন্য, ছুঁয়েও দেখলি না কিছু। উনি কষ্ট পেয়েছেন।”
বহ্নি স্মিত হাসে উৎসের দিকে তাকিয়ে। অল্প চাঁদের আলোয় উৎস স্পষ্ট দেখলো বহ্নির গাল ভেজা।
“বহ্নি কি হয়েছে তোর? রণ ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে? কষ্ট দিয়েছে তোকে?
“উৎস উনি একজম শুদ্ধতম পুরুষ। বাবার ভাষায় মহাপুরুষ। উনি কাউকে কষ্ট দিতেই পারেননা।”
“তাহলে কি হয়েছে?”
বহ্নি কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
আচমকা উৎসের হাত ধরে তাতে মাথা ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে বহ্নি। উৎস স্তব্ধ হয়ে যায়।
“বহ্নি….”
“উৎস আমার নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে। আমি কি করবো বল তো? এতোদিন আমার মধ্যে যে রাগ, জিদ ছিলো তা ভয়ে পরিণত হয়েছে। আমি ভয় পাচ্ছি উৎস।”
“ভয়? তোর এই ভাই থাকতে কিসের ভয় তোর?”
“আমি সবকিছু ভুলে ভালো থাকতে চাই উৎস। আমার খুব লোভ হচ্ছে ভালো থাকার। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে জানিস তো। একজন মহাপুরুষের সান্নিধ্য পাওয়া সহজ কথা নয়। পৃথিবীতে খুব কম মেয়েই এই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়। আমি হয়েছি উৎস। আমার যে ভীষণ ভালো থাকতে ইচ্ছা করছে।”
“অবশ্যই ভালো থাকবি তুই। কিন্তু এতে ভয়ের কি আছে? রণ ভাই সবকিছু জেনেশুনেই তো তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। তাহলে কিসের ভয়?”
বহ্নি উৎসের হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ মোছে। ঘন ঘন শ্বাস পড়তে থাকে তার। উৎস ধৈর্য্য ধরে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
“সজীব দেশে ফিরেছে উৎস। ও আজকে আমার সাথে দেখা করেছে।”
উৎস হতভম্ব হয়ে যায় বহ্নির কথা শুনে। তার কাছে খবর ছিলো সজীব আরো কিছুদিন পর আসবে।
“তোর সাথে দেখা করেছে?”
“উৎস আমি ওর চোখে নোংরামি দেখেছি। ও এতো সহজে আমাকে ছাড়বে না। ও আমাকে একটুও শান্তি দিবে না। ও আমাকে ভালো থাকতে দিবে না উৎস।”
উৎস দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”ঘরে যা বহ্নি।”
বহ্নি দাঁড়িয়ে থাকে, উৎসকে কিছুটা অস্বাভাবিক লাগে তার।
“ঘরে যা বহ্নি। ও ওর খেলা দেখিয়েছে, কারণ তখন ময়দানে উৎস ছিলোনা। এখন উৎস তার খেলা দেখাবে। তুই বিয়ের চিন্তা কর, বাকিটা আমি দেখে নিবো।”
“তুই কি করবি?”
উৎস বহ্নির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”ভাবতেছি রসুনের ব্যবসা করবো একেকটা রসুন দুই লাখ টাকা। বড়লোক হয়ে যাবো রে।”
বহ্নি কিছু না বুঝে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে উৎসের দিকে। উৎস শুধু একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বহ্নির দিকে তাকিয়ে বললো,”কাপুরুষকে পুরুষত্বহীন বানানো পাপ তো নয়, তাইনা?”
(চলবে…..)