মাতাল প্রেমসন্ধি পর্ব-৩০+৩১

0
85

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ৩০

“মা আমাকে ডেকেছো?”
বহ্নির দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় শাহানা। এরপর আবার অন্যদিকে ফিরে বললো,”হ্যা কাছে আয়।”
বহ্নি মায়ের পাশে এসে বসে। অনেকগুলো শাড়ি বিছিয়ে রাখা বিছানায়। বহ্নি তাকিয়ে দেখে সবগুলো। সবই তার মায়ের শাড়ি। শাড়ির প্রতি অদ্ভুত একটা টান শাহানার। নওশাদ সংসার খরচ থেকে বাঁচিয়ে মাঝে মাঝেই স্ত্রীর এই শখটুকু পূরণ করার চেষ্টা করে। নতুন শাড়ি পেলে শাহানার মন ভালো হয়ে যায়, চোখ চকচক করে। সেই দৃশ্য খুব উপভোগ করে নওশাদ।

“মা তুমি কি কিছু বলবে আমাকে?”
শাহানা শাড়ি গুলোর উপর হাত বুলাতে বুলাতে বললো,”কেনো কিছু না বলার থাকলে মেয়েরা কি মায়ের কাছে আসতে পারবে না? তোমাদের সব আদর, আহ্লাদ তো ফুপুকে ঘিরে। আমার কাছে আসার সময় কোথায় তোমাদের?”
বহ্নি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে।
“তোমার একার কথা বলছি না। তোমার বাকি দুই বোনও তো তাই। মা’কে না হলেও তোমাদের চলে, ফুপু থাকলেই খুশি তোমরা।”
বহ্নির চোখটা কেমন জ্বালা করে ওঠে। মা এতো মায়া কাড়া কথা বলছে কেনো আজ?

ঈষৎ হেসে বহ্নি মা’কে জড়িয়ে ধরে জোরে। শাহানা অন্যদিকে ফিরে চোখ মোছে।
“থাক থাক আর এতো আদিখ্যেতা করতে হবে না। ছাড়ো আমাকে।”
“কি যে বলো না তুমি মা। তুমি হলে আমাদের মা, আমাদের গর্ভধারিণী। তোমার বিন্দু বিন্দু রক্ত থেকে আমাদের জন্ম, নাড়ির টান তোমার সাথে আমাদের। তোমার সাথে কার তুলনা? তবে হ্যা ফুপুকে আমরা অনেক বেশি ভালোবাসি। তাই বলে তোমার জায়গাটা তো আর কাউকে দিই নি আমরা। মা তো মা-ই হয়। মা মায়ের জায়গায়, ফুপু ফুপুর জায়গায়।”
শাহানা ছোট্ট করে হাসে, কিছু বলেনা।

“মা এবার বলো কি বলতে ডেকেছো।”
“আজ ক্লাসে যাবি না তুই?”
বহ্নি হালকা কেঁপে ওঠে। তার ক্লাসে যেতে ইচ্ছা করছে না। তার মন বলছে অসভ্যটা আজ আবার যাবে তার ভার্সিটিতে। সে ঠিক রাখতে পারবে না নিজেকে ওকে দেখলে। কোন অঘটন সে ঘটিয়ে ফেলবে তার ঠিক নেই।

“মা আজ যাবো না। শরীরটা ভালো লাগছে না।”
শাহানা চুপ করে থাকে, ওদিকে কথা বাড়ায় না।

বেশ কিছু সময় নীরব থাকার পর শাহানা মুখ খোলে।
“দেখো মা, ভণিতা করে আমি কথা বলতে পারিনা তুমি ভালো করেই জানো। তাই সোজাসুজি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, তুমি সোজাসাপটা উত্তর দিবে।”
বহ্নি কিছুটা অবাক হয়ে বললো,”কি কথা মা?”
শাহানা বহ্নির চোখে চোখ রেখে বললো,”তুমি কি রণের সাথে এই বিয়েতে রাজি?”
বহ্নি কিছুটা থমকে যায়। কিছু বলতে পারেনা।

“দেখো মা, চুপ করে থেকে তো লাভ নেই। তোমার বাবা এই বিয়েতে রাজি। তোমার বাবা কষ্ট পাক, এমন কোনো কাজ আমি করতে চাইনা। তোমার মতামতের উপর নির্ভর করছে সবটা। তুমি যদি রাজি হও তাহলে বিয়ের ব্যাপারে আমরা ভাববো। তাই তোমার মতামত জানাটা দরকার আমাদের। গতকাল কিছুই জানাওনি তুমি ওদের সামনে। আমি জানি এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া একটা মেয়ের জন্য কতোটা দুশ্চিন্তার, যেখানে তার সারাজীবন জড়িত। তুমি সময় চাইলে সময় নিতে পারো।”
বহ্নি যন্ত্রের মতো বললো,”মা তুমি রাজি নও?”
শাহানা শান্ত গলায় বললো,”যদি সত্যটা জানতে চাও, তাহলে আমার উত্তর ‘না’। জানি এটা শুনে কষ্ট পাবে তুমি। কিন্তু ওইযে বললাম, আমি ভণিতা করে কথা বলতে পারিনা।”
বহ্নি নির্বাক বসে থাকে।
“দেখো বহ্নি তোমাদের কষ্ট হোক, মা হয়ে এমন কিছু আমি কখনো চাইনা, সহ্য করতেই পারবো না তোমাদের কষ্ট। তবে এটা আমাকে মানতেই হবে যে রণ ছেলে হিসেবে অসাধারণ। তোমার বাবার ভাষায় মহাপুরুষ। মহাপুরুষ কাদের বলে জানো? যে পুরুষের কোনো অন্যায় নেই, পাপ নেই। এমন পুরুষ হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সবার মনেই পাপ আছে। তাই তোমার বাবার মতো আমি ওকে মহাপুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত না করলেও ও যে অসাধারণ একজন মানুষ তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। ও পরিশ্রমী, উদ্যোমী। দেখতেও আহামরি সুপুরুষ না হলেও খারাপ বলা যায়না কোনোভাবেই। একটা পুরুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা তা হলো তার চরিত্র। চরিত্রের পরীক্ষায় পাশ করা মানেই, চোখ বন্ধ করে বলা যায় সে পুরুষ স্বামী হিসেবে ভালো হবে।”
বহ্নি ক্ষীণ গলায় বললো,”তাহলে তোমার আপত্তি কোথায় মা?”
“আপত্তি কোথায় বুঝতে হলে যে তোমাকেও মা হতে হবে মা। আমরা যতোই বলি অর্থই যতো অনর্থের মূল, এটা একটা ভুল কথা। টাকাপয়সা জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনের অনেক ইচ্ছা অপূর্ণ আছে আমার এই টাকার জন্য। অনেক ইচ্ছা ছিলো তোমার বাবার সাথে ঘুরে বেড়াবো, হাতে হাত রেখে সমুদ্র দেখবো। হয়তো তোমার বাবাকে বললে সে যেভাবে হোক চেষ্টা করতো। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে আমি তো জানি তার অবস্থাটা। সামান্য চাকরি, এতোগুলো মানুষের সংসার। চারটা ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, সব তো ওই একজনের উপরই। এটা ভেবো না যে, সায়েরা বা উৎসের এখানে থাকা নিয়ে আমার খুব বেশি আপত্তি ছিলো। তোমরা সবাই ভাবো আমি ওদের ভালোবাসিনা। তবে এটা ভুল, আমি ওদের ভালোবাসি। মধ্যবিত্তের সংসারে আবেগ, আহ্লাদ কম থাকে মা। আবেগ প্রকাশও এখানে বিলাসিতা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ওদের আমি ভালোবাসিনা। তবে আমি বলছিলাম নিজের অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর কথা। টাকার অভাবে আমি অনেক কিছু করতে পারিনি। ত্যাগ করেছি অনেক কিছু। তুমি পারবে এই ত্যাগটুকু করতে?”
বহ্নি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বললো,”মা তুমি কি বাবার সাথে অসুখী?”
“কখনোই না, এ কথা যদি আমি বলি তাহলে আমার পাপ হবে। ওই মানুষটা তার সর্বস্ব দিয়ে আমাকে ভালোবেসেছে, ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। পরকালে আমি আল্লাহর কাছে চাইবো যদি দুনিয়ায় একটা ভালো কাজ করে থাকি তবে সেই ভালো কাজের উছিলায় যেনো আল্লাহ আমাকে উনার সাথে থাকতে দেন।”
বহ্নি স্মিত হাসে।
“তাহলে কেনো ভাবছো মা আমি অসুখী হবো? রণ সাহেব কি আমাকে ভালো রাখতে পারবে না, বাবা যেভাবে তার দোয়েল পাখিকে রেখেছে।”
শাহানা লাজুক মুখে হাসে কিছুক্ষণ, বহ্নিও হাসে।

“তার মানে তুমি রাজি এই বিয়েতে, তাই তো?”
বহ্নি মায়ের হাতের উপর হাত রেখে বললো,”তুমি হাসিমুখে রাজি না হলে আমি পৃথিবীর সব সুখ বিসর্জন দিতে পারি মা। আগে তুমি রাজি হবে, এরপর আমি ভেবে দেখবো।”
“সংসার করবে তুমি, তোমার রাজি হওয়াটাই মূখ্য। আমি শুধু তোমাদের মুখে হাসি দেখতে চাই।”
বহ্নি মায়ের কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। শাহানা মেয়ের চুলে আলতো করে বিলি কেটে দেয়।

“মা, ও মা।”
“বল।”
“এই শাড়িগুলো বের করেছো কেনো হঠাৎ?”
শাহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”রণ তোর বাবাকে জানিয়েছে ও আজ তোকে নিয়ে একটু বের হতে চায়। সম্ভবত একান্তে তোর কাছ থেকে তোর মতামত শুনতে চায়। তাই দেখছিলাম এগুলোর মধ্যে কোন শাড়িতে তোকে বেশি ভালো লাগবে।”
বহ্নি লজ্জায় লাল হয়ে যায়, উঠে বসে সে। শাহানা আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

“ও তোর জন্য যে শাড়িগুলো এনেছে সেখান থেকেও চাইলে পরতে পারিস।”
“না মা আমি তোমার শাড়ি-ই পরবো। ওই আকাশী বালুচরি শাড়িটা দিবে মা আমাকে?”
শাহানা শাড়িটা হাতে নিয়ে ছোট্ট করে হেসে বললো,”সাথে একটা নীল টিপ পরতে ভুলিস না যেনো।”
বহ্নি মাথা নিচু করে কুটকুট করে হাসে। শাহানার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। ঘর আলো করে রাখা মেয়েটা ঘর অন্ধকার করে চলে যাবে? সময় হয়ে গেছে বুঝি কন্যা বিদায়ের?

উৎসকে দেখে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় রণ। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে তার। বেশ অবাক হয়েছে বোঝাও যাচ্ছে।

“আরে রণ ভাই, দাঁড়ালেন যে? বসুন বসুন। আপনার বস আসেনি তো যে দাঁড়াতে হবে।”
রণ হেসে বললো,”বসকেও এতো ভয় পাইনা যতোটা আপনাকে পাই।”
“কেনো? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক?”
রণ নিজেই এসে উৎসকে চেয়ার এগিয়ে দেয়। উৎস বসার পর নিজে বসে।

“আগে বলুন কি খাবেন? চা, কফি বা ঠান্ডা?”
“আমার ওসবে টান নেই। বরং জিজ্ঞেস করতে পারেন, গোল্ডলিফ নাকি মালব্রো।”
রণ হাসতে হাসতে বললো,”উৎস ভাই আপনি…”
“আগে আমাকে তুমি বলাটা প্রাকটিস করুন তো। কি আপনি আপনি করে যাচ্ছেন। দুইদিন পর শালাবাবু হচ্ছি, আর আপনি এখনো আপনি বলে ডেকে যাচ্ছেন।”
রণ উৎসের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললো,”শুধুই কি শালাবাবু? আর কিছু না?”
“আর কি?”
“কেনো ভায়রা ভাই?”
উৎস হতভম্ব হয়ে তাকায় রণের দিকে। রণ টেবিল কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে থাকে।
উৎস ধাতস্থ হতে পারেনা, মানে উনি কীভাবে জানলো?

“কি হে প্রেমিক পুরুষ, ভেবেছিলে ডুবে ডুবে পানি খাবে আর কেউ জানতে পারবে না? মিস বহ্নি আমাকে যতোই বোকা ভাবুক, আমি কিন্তু অতোটাও বোকা নই।”
“মিয়া, ডুবে ডুবে পানি তো আপনি খেলেন। তবে আপনাকে সালাম। বহ্নির মতো মেয়েকে প্রেমে ফেলানো যেনোতেনো কাজ নয়। এলেম আছে আপনার বলতে হবে। কীভাবে করলেন এই অসাধ্য সাধন?”
“তুমি কি অসাধ্য সাধন করোনি? রূপবতী হুরপরী তোমার উথালপাতাল প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। এটাই বা কম কি?”
উৎস কিছুটা আনমনে বললো,”আমি শীতলকে প্রেমে ফেলতে চাইনি রণ ভাই। আমি নিজেও ওর প্রেমে পড়তে চাইনি। আমার অনিশ্চিত এই জীবনে ওর মতো একটা পদ্মফুল জড়িয়ে পড়ুক আমি সত্যিই চাইনি। কিন্তু জানেন তো রণ ভাই, মায়া জিনিসটা ভয়ংকর। আপনি যদি একবার কারো মায়ায় জড়িয়ে যান, আপনি কোনোভাবেই তাকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না। শীতল বোকা নয় রণ ভাই, ও ভীষণ চালাক। আর চালাক বলেই ও প্রথমে আমাকে ভালো না বেসে আমাকে মায়ায় ফেলেছে। যখন বুঝেছে আমি ওর মায়ায় ডুবতে বসেছি, খেই হারাচ্ছি প্রতিনিয়ত, তখন ও ওর আসলে টোপ ব্যবহার করেছে। ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলেছে আমাকে। ওকে বেশিক্ষণ না দেখলে এখন আমার দমবন্ধ লাগে। একই সাথে বড় হয়েছি, কৈশোরের শুরুতেই তার প্রেমে পড়েছি কিন্তু এতোটা মায়ায় পড়িনি। ও আমাকে ওর চোখ দু’টো দিয়েই শেষ করে দিতে পারে এখন জানেন আপনি? আমার সামনে হাজারটা শত্রু এলেও আমি মৃত্যুর ভয় পাইনা কিন্তু আমার শীতল আমার অনুপমা আমার সামনে দাঁড়িয়ে দুই ফোঁটা চোখের পানি ফেললে আমি আমার মৃত্যুকে দেখি, মনে হয় ওই দুই ফোঁটা চোখের পানিতেই ডুবে মরবো আমি। সাঁতরেও শেষ রক্ষা হবে না।”

রণ চোখ বড় বড় করে তাকায় উৎসের দিকে। এটা সত্যি উৎস নাকি উৎসের বেশে অন্য কেউ? সে এভাবে কথা বলেছে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

উৎস সম্বিত ফিরে পেয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,”ধুর কিসব বলে যাচ্ছি।”
“উৎস ভাই তোমার অবস্থা তো দেখছি আমার চেয়ে খারাপ। চাচাকে কি বলবো দুই বোনকে যদি একসাথেই…..”
“কি যে বলেন রণ ভাই। আমরা হলাম বেকার মানুষ। সমাজের চোখের বাজে ছেলে, অসভ্য ছেলে। নিজেকে প্রমাণ না করে এতো বড় গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিই কীভাবে?”
“তোমার মতো মেধাবী আর অসাধারণ একটা ছেলেকে যে বাজে ছেলে বলবে সে-ই বাজে।”
উৎস হেসে বললো,”বাদ দিন তো। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে এসব বলে। এরচেয়ে যা বলতে এসেছি বলে চলে যাই।”
“বলো তো কি ব্যাপার?”

উৎস শরীর এলিয়ে বসে চেয়ারে। এরপর স্থির দৃষ্টিতে রণের দিকে তাকিয়ে বললো,”সজীব দেশে ফিরেছে রণ ভাই। ও গতকাল বহ্নির সাথে দেখাও করেছে ওর ভার্সিটিতে। সম্ভবত নোংরা কিছু বলেছে ওকে। এজন্য গতকাল ও একটা ট্রমার মধ্যে ছিলো। আপনার সাথে কোনোরকম কথা বলতে পারেনি বিয়ে নিয়ে।”
উৎস খেয়াল করলো রণের মুখের রেখাগুলো আস্তে আস্তে কঠিন হয়ে উঠছে। শান্ত মুখটা এমন রেগে লাল হয়ে যেতে আগে কখনো দেখেনি উৎস।

“আমি ওকে শেষ করে দিতে চাই উৎস ভাই।”
“শান্ত হোন। শেষ ওকে করা হবে, তবে মেরে ফেলে নয়।”
“তার মানে?”
“তার মানে ওর যা ব্যবস্থা নেওয়ার আমি নিবো। ও বেঁচে থাকতেই দুনিয়ায় আযাব ভোগ করবে। আমি যখন একবার এই কথা শুনেছি, বাকি দায়িত্ব আমার। আপনাকে জানাতে আসার একটাই কারণ, বহ্নির এখন খুব মানসিক সহায়তা দরকার। ও অনেক শক্ত একটা মেয়ে। তবে ওর জীবনে যা ঘটে গেছে, ও শক্ত থাকতে পারছে না। এই দায়িত্বটা আপনাকে নিতে হবে। বাকি যা দেখার আমি দেখে নিবো।”
এই বলে উৎস উঠে দাঁড়ায়।

“আজ চলি রণ ভাই। অন্য কোনোদিন এসে চা, কফি খেয়ে যাবো।”
উৎস চলে যেতে গেলেই রণ পিছন থেকে তাকে ডাকে। তার কণ্ঠ গম্ভীর।

“উৎস ভাই আমার একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে।”
“বলুন।”
“শাস্তিটা আমি ওকে দিতে চাই। আমার হবু স্ত্রীর অসম্মানকারীকে শাস্তি দেওয়ার এটুকু অধিকার কি আপনি আমাকে দিবেন না?”
উৎস ঠোঁটের কোণে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটিয়ে বললো,”সময়মতো আমার এক ছেলে আসবে আপনার কাছে। চলে আসবেন জায়গা মতো। রসুনের ব্যবসাটা দুই ভায়রা ভাইতেই শুরু করে দিই তাহলে।”
“বুঝলাম না তোমার কথা। তুমি ব্যবসা শুরু করেছো নাকি? তাই বলে রসুনের?”
“এ রসুন সে রসুন নয় রণ ভাই। এ রসুন শুধু পুরুষ মানুষের রসুন। কাপুরুষদের এ রসুন মানায় না। আজ চলি?”
রণকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উৎস চলে যায়। রণ থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ ভেবাচেকা খেয়ে। উৎস কি করতে চাচ্ছে আসলে? সে যা ভাবছে তবে কি তাই?

পড়ন্ত বিকেলে ছেলেদের খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যে প্রশস্ত রাস্তাটা চলে গেছে তা ধরে হাঁটছে উৎস আর শীতল। মেরুণ রঙা একটা জামা পরেছে শীতল। খুব সাধারণ একটা জামা, তেমন দামী নয়। কিন্তু এই কম দামী জামাটাতেই উৎসের সবচেয়ে দামী রত্নটাকে দেখতে যে এতো সুন্দর লাগবে উৎস ভাবতেই পারেনি আগে। সাজ বলতে সরু ভ্রু যুগলের মাঝে ছোট্ট একটা কালো টিপ, চোখের নিচে হালকা কাজল যা সারাদিনের ক্লান্তিতে লেপ্টে গেছে। আচ্ছা, মায়াবতীর সংজ্ঞা কি? উৎসের কাছে মায়াবতীর সংজ্ঞা শুধুই অনুপমা, শুধুই শীতল। যাকে সামনে বসিয়ে দেখতে দেখতে কতোশত যুগ পার হয়ে গেলেও দেখার তৃষ্ণা তার কোনোদিনই মিটবে না।

“আচ্ছা শীতল একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম বলুন না।”
শীতলকে এক ঠোঙা বাদাম কিনে দিয়েছে উৎস। শীতল খুব মনোযোগের সাথে বাদামের খোসা ছিলছে। আপাতত কোনোদিকে নজর নেই তার।

“তোমার কাছে সুখ মানে কি?”
“সুখ?”
“হ্যা সুখ।”
শীতল কিছুক্ষণ চিন্তা করে। আসলেই তো সুখটা কি? এই যে দিব্বি আছে এটাই তো সুখ। উৎস ভাই পাশে, আপা, আভা, মা বাবা, ফুপু সবাই কাছে আছে এরচেয়ে সুখের আর কি আছে? আলাদা করে সুখ আবার কি?

“কিছু মাথায় আসছে না উৎস ভাই।”
“ভেবে বলো। ধরো এমন কোনো জিনিস, যা পেলে তোমার মন ভালো হয়ে যায়।”
শীতলের মুখ পরক্ষণেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
“হ্যা মনে পড়েছে।”
“বলো।”
“আমার আলমারিতে অনেক গুলো চুড়িদার আর শাড়ি থাকবে। নতুন নতুন সবগুলো। কাচের চুড়ি, বিভিন্ন রঙের টিপ, নুপুর এগুলো থাকবে।”
উৎস দাঁড়িয়ে পড়ে।

“এগুলোই সুখ তোমার কাছে?”
শীতল মাথা চুলকে বললো,”কেনো উৎস ভাই? ভুল কিছু বললাম?”
উৎসের সহজে কান্না আসেনা। সেই ছোট থেকেই। অদ্ভুত ব্যাপার, ব্যথা পেলেও তার চোখে পানি আসতেই চায়না। এটা নিয়ে সায়েরা আগে দুশ্চিন্তায় ছিলো। ছেলে এমন কেনো? কাঁদে না কেনো? পরে জানা গেলো তার স্বভাবটাই এমন, সে কাঁদতে পারেনা।

তবে কি যে হয়েছে তার, এই মেয়েটা নিজের স্বভাব তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে বোধহয়। এই সামান্য কথার মধ্যে কি এমন ছিলো? তার চোখটা এমন জ্বালা করে উঠলো কেনো? আহামরি দামী জামা কখনোই ওরা তিন বোন পরেনা। কি নিষ্পাপ চাওয়া ওদের। সুখ বলতে নাকি কিছু জামা আর শাড়ি। ওরা এতো ভালো কেনো?

“উৎস ভাই, কি হলো আপনার?”
উৎস ঢোক চেপে কান্নাটা গিলে ফেলে। অন্যদিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বললো,”কিছু হয়নি, চলো।”
“না না কিছু তো হয়েছেই। বলুন আমাকে কি হয়েছে।”
“ময়না রে, আমি যদি তোমারে এক ট্রাক চুড়িদার, শাড়ি আর টিপ, চুড়ি কিনে দিতে পারতাম, এই সময়ে তাহলে ওটাই আমার কাছে সুখ হতো।”
শীতল থমকে যায়। শরীর কেঁপে ওঠে তার। উৎসের এমন আর্তনাদ ভরা কণ্ঠ সে শোনেনি। বরফের মতো জমে যায় সে। শ্বাস আটকে যায়।

“উৎস ভাই…..”
উৎস মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, যেদিন নিজে রোজগার করবে সেদিন তার মা আর শীতলের জন্য অনেক কিছু কিনবে, অনেক কিছু। না না শুধু ওদের জন্য না। মামা, মামি, বহ্নি, আভা সবার জন্য। তবে এই মেয়েটাকে সত্যিই সে এক ট্রাক ভর্তি চুড়িদার আর শাড়ি দিতে চায়। সে দেখতে চায় মেয়েটা কি করে ওগুলো দেখে। তার জানটা ঠান্ডা হয়ে যাবে মেয়েটার উচ্ছ্বাস দেখে।

“একটা কথা বলবো উৎস ভাই?”
উৎস নেশাক্ত গলায় বললো,”একটা ক্যান? যতো ইচ্ছা বলো।”
শীতল মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বললো,”আমার কাছে সুখ মানে আপনি উৎস ভাই, শুধুই আপনি।”
উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে নিচু গলায় বললো,”তাই?”
“হ্যা তাই।”
“তুমি তো আমার কাছ থেকে আসল সুখ পাওনি এখনো, কীভাবে বুঝলে?”
শীতল ভীতু গলায় বললো,”আসল সুখ মানে?”
“যখন পাবে তখন বুঝিয়ে দিবো। একদম ষোলো আনা বুঝিয়ে দিবো, কোনো কমতি রাখবো না।”
শীতলের কান লাল হয়ে যায়। উৎসকে রেখেই জোরে জোরে হাঁটতে থাকে সে।

উৎস দুই হাত প্যান্টের পকেটে রেখে খোলা গলায় বেশ উঁচু করে দুই কলি গান করে ওঠে।

“আব্দুল করিম বলে ময়না তোমারে বলি,
তুমি গেলে হবে সাধের পিঞ্জিরা খালি।”

শীতল অদূরে দাঁড়িয়েই উৎসের গান শোনে। কে বলেছে সুখ তার কাছে নেই? এইতো সুখ, এরচেয়ে সুখের আর কি আছে? নাই তো। সুখের আবার আলাদা সংজ্ঞা হয় নাকি? যা হৃদয়ে প্রশান্তি আনে তাই তো সুখ। পৃথিবীর বুকে এক পাগল প্রেমিকের মাতাল ভালোবাসা পেয়েছে সে। এতোটা সৌভাগ্যবতী একটা মেয়ের সুখের কমতি আছে?

কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে রণ আর বহ্নি। সন্ধ্যা মেলাবে কিছু সময়ের মধ্যেই। এই মুহুর্তে মেয়েটাকে মধ্যযুগের ধাতুতে গড়া কোনো পৌরাণিক রাজ অলংকার। যে দিকে এক ঝলক তাকালেই সহসা চোখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হতে হয়। একেই বুঝি বলে ভয়ংকর সুন্দর।

“তুমি পাশে থেকো, আমি বিশ্বজয় করে এনে দিবো,
তুমি কাছে থেকো, আমি পাহাড় জয় করে ফেলবো।
তোমাকে কি নামে ডাকবো?
নীলাঞ্জনা, নিরুপমা নাকি স্বর্গ থেকে আসা হুরপরী?
তুমি রাত জয় করা ঊষার আলো, ওগো বধূ সুন্দরী।
প্রিয়তমার চোখে চোখ, হাতে হাত এই বেশ আছি ভালো।
খুব হিংসা হচ্ছে, যদি আমি নিজেই হতে পারতাম ওই কন্যা সুন্দর আলো।”

বহ্নি অভিভূত হয়ে তাকায় রণের দিকে। পাঞ্জাবিতে এই প্রথম দেখা তাকে। বহ্নির ধারণা ছিলো হ্লুদ রঙটা শুধু মেয়েদের জন্য, ছেলেদের এই রঙে অতি বাজে দেখায়। তবে তাকে পুরোটাই ভুল প্রমাণ করে হলুদ পাঞ্জাবিতেই রণ দিব্বি তার সামনে বসে আছে। তাকে রাজপুত্রের মতো সুন্দর লাগছে। বহ্নি একটু ভালো করে তাকাতেই পারছে না, যতোবার তাকাচ্ছে দেখছে রণ মুগ্ধ হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটাবারও কি চোখ সরাবে না সে?

“কবিতাটা কি আপনার লেখা?”
“কি মনে হলো শুনে?”
বহ্নি গাঢ় গলায় বললো,”খুব সুন্দর হয়েছে।”
“আপনাকে উপমা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা মিস বহ্নি। হাজারটা কবিতার কলিও ব্যর্থ হবে আপনার সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে। লিখতে বসলে ফেরদৌসী শাহনামা লেখা হয়ে যাবে, তবুও আমি ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে পারবো না আমার মুগ্ধতা আপনার প্রতি।”

বহ্নির মনে হলো এক দলা বোবা কান্না তার গলার কাছে এসে জমাট বেঁধে আছে। এই লোকটা এতো ভালো কেনো? কেনো এভাবে কথা বলছে সে? সত্যিই তার কপালে এতো সুখ আছে?

“আপনাকেও খুব সুন্দর লাগছে রণ সাহেব।”
“আমাকে সুন্দর লাগছে না। আপনি আমাতে মুগ্ধ হয়েছেন আমার অকৃত্রিম ভালোবাসায়। সেই মুগ্ধতা আপনার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে বারবার। আপনার কোটি কোটি নিউরন ভাবতে বাধ্য করছে আপনার সামনে বসা মানুষটি সুদর্শন। তবে তা হয়তো সত্য নয়। আমার পরম সৌভাগ্য হবে যদি আপনার এই মুগ্ধ দৃষ্টি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেখে যেতে পারি। আমি আমার জীবন দিয়ে চেষ্টা করে যাবো আপনাকে সেই অকৃত্রিম ভালোবাসায় মুড়ে রাখতে, যাতে আপনার মুগ্ধ দৃষ্টি আমাকে ঘিরে থাকে সর্বক্ষণ। বিশ্বাস করুন মিস বহ্নি, আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমি প্রমাণ করে দিবো আমি ভালোবাসতে জানি, পৃথিবীর সব সুখ উজাড় করে আপনাকে দিবো। এটা রণের প্রতিজ্ঞা তার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার কাছে।”

বহ্নি উঠে দাঁড়ায়। শীতলের রোগটা বোধহয় তাকে ছুঁয়েছে। কেনো এভাবে কান্না পাচ্ছে তার। চারপাশে অনেক মানুষ। নিজের দূর্বলতা সে এখানে দেখাতে চায়না। খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কিছুক্ষণ কাঁদতে ইচ্ছা করছে তার। সে কেনো ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনা?

বহ্নি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রণ একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলে। শক্ত করে চেপে ধরে বহ্নির হাত। বহ্নি স্থাণুর মতো জমে যায়। এই প্রথম স্পর্শ তার। পূর্বের ভয়ংকর সেই স্পর্শকে পা দিয়ে শক্ত করে মাড়িয়ে দিয়েছে এই স্পর্শ।
রণ সাথে সাথে হাত ছেড়ে দেয়।

“আমাকে ক্ষমা করবেন মিস বহ্নি। আমি আসলে….”
বহ্নি রণের কথার মধ্যেই তাকে চরম অবাক করে দিয়ে নিজেই রণের হাত ধরে। রণ হতবাক হয়ে তাকায় বহ্নির দিকে।

“এবার কি বলবেন?”
“মিস বহ্নি…”
“উহু, শুধু বহ্নি।”
“বহ্নি।
“বলুন।”
“আপনি এই বিয়েতে রাজি তো?”
“কেনো? রাজি না হলে কি করবেন?”
“রাজি না হলে তৃষ্ণায় মরেই যাবো আমি।”
বহ্নি মুখ টিপে হেসে বললো,”আপনার জায়গায় উৎস হলে কি বলতো জানেন? বলতো রাজি না হলে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আসবো।”
“আমার তো উৎস ভাইয়ের মতো সেই শক্তি নেই। তবে আমার যে শক্তি আছে, তা দিয়ে আপনাকে তুলে আনতে পারবো। আপনি নিজেই আসবেন আমার কাছে।”
“তাই? কি শক্তি আছে আপনার?”
রণ ক্ষীণ গলায় বললো,”হৃদয়ের সমস্ত অনুভূতি নিংড়ে ভালোবাসার শক্তি।”
বহ্নি থমথমে মুখে তাকায়। সে কি স্বপ্ন দেখেছে? নাকি সত্যিই এক অপার সম্ভাবনার সামনাসামনি সে? যেখানে কেউ তাকে অসম্মান করবে না, শুধুই ভালোবাসবে? যদি এটা স্বপ্ন হয়, বহ্নি চায় তবে সেই ঘুম কখনোই না ভাঙ্গুক।

অফিস থেকে তাড়াতাড়ি-ই বাড়ি ফিরেছে আজ নওশাদ। সায়েরাকে নিয়ে উৎস গেছে ডাক্তারের কাছে। শীতল আর আভা বেড়াতে গেছে অগ্নির বাড়িতে, আজ অগ্নির জন্মদিন। তাই দাওয়াত করেছে তাদের। উৎস ফেরার পথে ওদের নিয়ে আসবে। বহ্নি এখনো ফেরেনি। রণ তাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে।

বাড়িতে একাই ছিলো শাহানা। স্বামীকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে দেখে কিছুটা চমকে যায় সে।

“তুমি এই অসময়ে? শরীর ঠিক আছে তো? কোনো ঝামেলা হয়নি তো আবার?”
নওশাদ শাহানার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হেসে বললো,”দুই কাপ চা নিয়ে বাগানে এসো তো শাহানা। আজ তোমার সাথে একটু গল্প করবো।”
“তুমি গল্প করার জন্য অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এসেছো?”
“কেনো? কম বয়সী ছেলেমেয়েরা স্কুল, কলেজ ফাঁকি দিয়ে প্রেম করতে যায়না?”
“কি আশ্চর্য, ওরা তো বাচ্চা ছেলেমেয়ে। আজ বাদে কাল শ্বশুর হবে, আর এখন….?”
“আমিও প্রেম করবো, ক্ষতি কি? আর কোথায় লেখা আছে যে বয়স হয়ে গেলে প্রেম করা যাবে না?”
“তোমাকে আর কিছুই বলার নেই আমার।”
“বলো-ও না। চুপচাপ দুই কাপ চা না না এক কাপ নিয়েই এসো। আমি তোমাকে পিরিচে ঢেলে ফুঁ দিয়ে ঠান্ডা করে খেতে দিবো।”
নওশাদ বাগানে চলে যায়। শাহানা হাসতে হাসতে বললো,”পাগল লোক একটা।”

শাহানা চা নিয়ে এসে দেখে নওশাদ ভৃঙ্গরাজ গুলো তুলে মালা বানাচ্ছে একা একাই। শাহানা একটা তৃপ্তির শ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় তার দিকে।

“তোমার চা।”
নওশাদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হাসে তার দিকে তাকিয়ে।
“বসো আমার পাশে।”
শাহানা বসে। হালকা জাম রঙের একটা তাঁতের শাড়ি পরেছে শাহানা। তাকে অবিকল সেই ছোট্ট কিশোরী বউটা লাগছে। পায়ে আলতা লাগিয়ে সারা ঘরময় হাঁটতো শাহানা তখন। নওশাদ অবাক হয়ে দেখতো তার পিচ্চি বউটাকে।

শাহানা পাশে বসতেই নওশাদ ভৃঙ্গরাজের মালাটা শাহানার খোঁপায় পরিয়ে দেয়।
“সবসময় খোঁপা ফুল পরে থাকো না কেনো?”
“হ্যা ওটাই বাকি আছে। তোমার বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে ধরেছে, আমাকে তো আর নয়। মেয়েরা দেখলে হাসবে তো।”
“না হাসবে না। আমার মেয়েরা মোটেই ওরকম নয়।”
দুইজন চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
নীরবতা ভাঙে প্রথম নওশাদই।

“বহ্নির বিয়ের ব্যাপারে কি ভাবলে শাহানা? তুমি রাজি তো?”
শাহানা চাপা গলায় বললো,”তুমি রাজি, মেয়ে রাজি তাহলে আর আপত্তি কিসের?”
“তুমি রাজি নও?”
শাহানা চুপ থাকে।
নওশাদ শাহানার বাম হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললো,”শাহানা আমি মানুষ চিনতে ভুল করিনা। রণ একটা খাঁটি সোনা গো। আমি জহুরির চোখ দিয়ে পরখ করেছি। তোমার শাহজাদীকে ও বেগম বানিয়ে রাখবে, তুমি বিশ্বাস করো।”
“তুমি আমাকে যতোটা ভালোবেসেছো ততটা ভালোবাসা পাবে তো আমার মেয়েটা?”
নওশাদ দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে বললো,”স্বীকার করলে তবে আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি?”
“উফফ সবকিছুতে তোমার ইয়ার্কি।”
নওশাদ নিজের পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বললো,”ইয়ার্কির মধ্যেই তো বেঁচে আছি গো দোয়েল পাখি। তোমার জন্য একটা জিনিস আছে। খুব সস্তা, তবে তোমার পছন্দ হবে।”
“আবার কি?”

নওশাদ একটা আলতার প্যাকেট বের করে শাহানাকে দেয়।

শাহানা অবাক হয়ে নওশাদের দিকে তাকিয়ে বললো,”আলতা এনেছো? কার জন্য?”
“আবার কার জন্য? তোমার জন্য?”
শাহানা রাগী গলায় বললো,”আমি এখন এই বয়সে মেয়েদের সামনে আলতা পায়ে দিয়ে ঘুরবো? তোমার বিবেকটা কি?”
নওশাদ পাত্তা দেয়না শাহানার কথার। তার বাঁধা সত্ত্বেও তার বাম পা’টা জোর করে নিজের উরুর উপর রাখে। অতি যত্নে আলতা পরিয়ে দিতে থাকে শাহানার পায়ে। শাহানা কিছুক্ষণ বাঁধা দিলেও পরে আর দিতে পারেনা। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে চুপচাপ। সন্ধ্যা মিলিয়েছে অনেক সময়। তারা উঠে গেছে আকাশে। ঝিলমিল করে জ্বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছু তারা বোধহয় শাহানাকে আশ্বাস দিয়ে চলেছে, এতো ভাগ্য নিয়ে দুনিয়ায় আসা খুব কম সংখ্যক নারীর মধ্যে তুমি একজন, সেই ভালোবাসার হেলাফেলা করোনা যেনো ভুলেও।

একই সময়ে, একই আকাশের নিচে রণ আর বহ্নি হাঁটছে পাশাপাশি। বহ্নির হাতে এক গুচ্ছ কদম ফুল। আচ্ছা এটা কি কদম ফুলের সময়? রণ কোথা থেকে পেলো এই ফুল?
সে অবাক চোখে দেখছে কদমগুলোকে। সদ্য পরিস্ফুটিত কদম থেকে খুব সূক্ষ্ণ তবে মাতাল করা ঘ্রাণ আসছে। বহ্নির মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে সেই ঘ্রাণে। যতোটা মুগ্ধতা নিয়ে বহ্নি কদম দেখছে, তার চেয়ে শতগুণ বেশি মুগ্ধতা নিয়ে রণ দেখছে বহ্নিকে। এই সাধারণের মাঝে অসাধারণ মানবীটি তার হতে যাচ্ছে, একান্তই তার এই সুখ বোধহয় তাকে অনেক অনেক নির্ঘুম রাত উপহার দিয়ে যাবে।

(চলবে…..)

#মাতাল_প্রেমসন্ধি

পর্ব: ৩১

তিনদিন পর আজ বহ্নি ভার্সিটিতে এসেছে। কেনো যেনো আসতেই ইচ্ছা করছে না তার ভার্সিটিতে। আসলেই মনে হচ্ছে জানোয়ারটার মুখ দেখতে হবে তাকে। ইচ্ছা তো হয় মেরেই ফেলতে অসভ্যটাকে। কিন্তু আজকাল তার বাঁচতে ভীষণ ইচ্ছা করে। একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখে সে ভীষণভাবে। ছোট্ট একটা ঘর, পাশে ভালোবাসার মানুষ। এই চাওয়াটা কি খুব বেশি অন্যায়?

বহ্নিকে দেখেই ছুটে আসে অরু আর নীরা। তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।
“বহ্নি তুই ঠিক আছিস? কি হয়েছে তোর? ভার্সিটিতে আসিসনি কেনো এতোদিন?”
বহ্নি ছোট্ট করে হেসে বললো,”আমি ঠিক আছি, কিছু হয়নি।”
“কিছু না হলে আসিসনি কেনো এতোদিন? তুই জানিস সজীব ভাই এ কয়দিন রোজ এসেছে তোর খোঁজ করতে।”
রক্ত টগবগ করে ওঠে বহ্নির। বিস্ফারিত চোখে তাকায় অরুর দিকে।

“তুই কেনো মানুষটাকে কষ্ট দিচ্ছিস বল তো? তোকে ভীষণ ভালোবাসে লোকটা।”
হালকা চিৎকার করে ওঠে বহ্নি।
“তোরা একটু চুপ করবি? আমার এসব শুনতে ভালো লাগছে না।”
দুইজন কিছুটা দমে যায়। অবাক হয়ে তাকায় বহ্নির দিকে। তাদের জানামতে বহ্নির সাথে সজীবের খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো। হঠাৎ কোনো একটা ঝামেলা হয় তাদের মধ্যে। ওরা খবর পায় সজীব অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। কিন্তু সে তো আবার ফিরে এসেছে। বারবার আসতে চায় বহ্নির কাছে। বহ্নি কেনো তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে? তবে ওরা আর ঘাঁটায় না বহ্নিকে।

বহ্নি রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজের জায়গায় যেয়ে বসে। অসম্ভব রাগ হচ্ছে তার। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে সে। তার বাবা শিখিয়েছে খুব রাগ হলে একশ থেকে উলটো গুণতে। বহ্নি চোখ বন্ধ করে উলটো গুণতে থাকে। একশ, নিরানব্বই, আটানব্বই…..

পুরোটা ক্লাস আজ মনমরা থাকে বহ্নি। কেনো যেনো কিছুতে মন বসে না তার। এতোদিন পর সজীব তার কাছে কি চায়? কেনো তার পিছনে পড়ে আছে এভাবে? যা সর্বনাশ করার সে তো করেছে, তাতেও শান্তি হচ্ছে না? আর কি করতে চায় সে? কেনো তার খোঁজ নিচ্ছে বার বার? কি মতলব আবার আঁটছে সে?

ক্লাস শেষে গেটে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছে বহ্নি। সারাদিনের ক্লান্তিতে কেমন বিষন্ন লাগছে তার। রণ বলেছে আজ তার ছুটির পর তাকে নিয়ে বের হবে একটু। বিয়ের কেনাকাটা কিছুটা এগিয়ে রাখতে চায় সে। বহ্নির এসবে আগ্রহ কম। এক শাড়ি পরে স্বামীর বাড়ি গেলেও তার সমস্যা নেই। অযথা রণের টাকা খরচ হোক তা সে চায়না। কিন্তু রণ নাছোড়বান্দা। তার ইচ্ছা একদম পুতুলের মতো সাজিয়ে সে বউকে ঘরে তুলবে। ইচ্ছা করে পুরো দোকান কিনতে বহ্নির জন্য। সামর্থ্যের জন্য পিছিয়ে যায়। ওদিকে একটু একটু করে ঘর গোছানোও চলছে। তার বউটা এসে কি মাটিতে ঘুমাবে? খাট কেনা হয়েছে, নতুন চাদরও কেনা হয়েছে। রণের পাগলামি চোখে পড়ার মতো। বহ্নির মনে পড়তেই সে হেসে দেয়। মানুষটা যে এতো পাগল বোঝাই যায়না।

“বহ্নি।”
ভয়াবহ ভাবে চমকে বহ্নি পিছনে তাকায়। ঠিক যে ভয় করছিলো তাই। সজীব দাঁড়িয়ে আছে। তার থেকে মাত্র সাত/আট হাত দূরেই। রুক্ষ এলোমেলো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, নির্ঘুম লাল চোখ। কেমন এলোমেলো লাগছে তাকে। বহ্নির রাগে ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে থাকে। এই অসভ্যটাকে পাত্তা দিলে বেশি মাথায় উঠে বসবে। ওকে এখন থেকেই শায়েস্তা করতে হবে। যাতে পরবর্তীতে আর কোনো অসভ্যতা করার সাহস না পায়।

“বহ্নি তোমাকে আমি অনেক খুঁজেছি এই কয়দিন। তোমার বাড়ির সামনে থেকেও ফিরে এসেছি। বিশ্বাস করো তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। দয়া করে আমার কথা শোনো।”
বহ্নি রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”কিন্তু আমার তোর সাথে কোনো কথা নেই। তোর মতো জারজের বাচ্চার মুখ দেখতেও ঘৃণা লাগছে আমার।”
সজীব কিছুটা এগিয়ে আসে, বহ্নি পিছিয়ে যায়।

“বহ্নি আমি জানি তোমার আমার উপর অনেক রাগ, অনেক ঘৃণা। আমি যে কাজ করেছি তা ঘৃণা করার মতোই। তোমার জায়গায় আমি থাকলে আরো বেশি করতাম। কিন্তু তুমি আমার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি বহ্নি, এখনো।”
বহ্নি হতভম্ব হয়ে যায়। ও কোন মুখে এখনো এভাবে কথা বলছে?

“ভালোবাসিস তুই আমাকে? আমাকে একটা জ্বলন্ত আগুনের প্রকোষ্ঠের মধ্যে ফেলে চলে গিয়েছিস, মনে পড়ে? এরপর আমি কীভাবে বেঁচে আছি জানিস তুই? তোর সাত জনমের ভাগ্য আমি তোকে এখনো খু’ন করিনি। আমি তা করতে পারি। তোকে মেরে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে।”
“আমি জানি বহ্নি, আমি যে অপরাধ করেছি তাতে তোমার আমার প্রতি এতোটা বিদ্বেষ হওয়া অসম্ভব নয়। তুমি আমার পুরো কথাটা শোনো, তারপর আমাকে মেরে ফেলো তুমি। আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে জেনে রেখো আমি আসলেই তোমাকে ভালোবাসতাম, আর এখনো বাসি।”
“আর একটা ফালতু কথা বললে তোর জিভ ছিঁড়ে টেনে ফেলবো আমি। এক্ষুনি আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। নাহলে আমি কি করে বসবো, ঠিক নেই।”
“বললাম তো, তুমি চাইলে আমাকে মেরে ফেলতে পারো। তবে শেষবারের মতো আমার একটা কথা শোনো। আমি সেদিন অল্প মদ্যপান করেছিলাম। তুমি যখন আমার বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলছিলে, আমি নিজের ঘরে যেয়ে এই কাজ করি। এরপর আমার যে কি হলো। অন্ধকার ঘর, প্রেয়সী আমার সামনে, আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না।”
বহ্নি আচমকা ছুটে যেয়ে সজীবের কলার চেপে ধরে। চারপাশে অনেক মানুষ অবাক হয়ে তাদের দেখছে, বহ্নির সেদিকে খেয়াল নেই।

“আচ্ছা? আর তাই তুই একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলি? শুধুমাত্র তোর মাতলামির জন্য আর কতো মেয়ের সর্বনাশ করেছিস তুই? বল, চুপ করে আছিস কেনো?”
সজীব নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।

“বহ্নি এরকম করছো কেনো? আমার পুরো কথাটা শোনো।”
“তোর আর কোনো কথা আমি শুনবো না। তোকে খু’ন করেই ফেলবো আজ আমি। মেয়েরা তোর হাতের পুতুল তাইনা? তুই মাতলামি করে একটা মেয়ের ক্ষতি করবি, এরপর তাকে ঠকিয়ে বিদেশ চলে যাবি। তারপর ফিরে এসে ক্ষমা চাইলেই ক্ষমা পেয়ে যাবি?”

সজীব ঘাবড়ে যায়। বহ্নি একদম বুনো সিংহীর মতো ধেয়ে এসেছে। চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে। যে কোনো সময় গলাটা টিপে ধরবে তার।

হঠাৎ সজীব বহ্নির দুই হাত শক্ত করে চেপে দূরে ঠেলে দেয়। দৌড়ে যেয়ে বহ্নির মুখ টিপে ধরে জোরে। বহ্নি আর্তনাদ করে ওঠে। আশেপাশের মানুষগুলো যেনো মজা পাচ্ছে ভীষণ। কেউ এগিয়ে না এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছে আর তামাশা করছে।

“অনেকক্ষণ ভালো কথা বলেছি, শুনিস নি। কিসের এতো তেজ তোর? ওইতো রূপের অবস্থা, হতদরিদ্র ঘরের মেয়ে। এতো তেজ কোথা থেকে আসবে? ভেবেছিলাম তোকে ঘরের বউ করবো। কারণ কি জানিস? তোর মতো মেয়েদের পায়ের তলে পিষে রাখতে পারি। কিন্তু না, তা আর হবে না। তোর মতো মেয়েদের বিয়ে না করেই ভোগ করা যায়। তোরে তো ভোগ করছিই, নতুন তো কিছু না তুই। তোরে ঘরে তোলার কোনো ইচ্ছাও আর নেই। দেমাগ দেখাস আমাকে? করবো না তোকে বিয়ে।”

বহ্নি হতভম্ব হয়ে যায়। পুরো দুনিয়া যেনো দুলছে তার সামনে। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করছে তার। এতোগুলো মানুষের সামনে জানোয়ারটা কি বললো?

“সে সুযোগও আপনাকে আর দেওয়া হবে না সজীব সাহেব।”
কারো মুখে নিজের নাম শুনে বহ্নিকে ছেড়ে দেয় সজীব। বহ্নি হাঁপাতে থাকে, গাল দু’টো লাল হয়ে আছে তার। সামনের দিকে তাকাতেই দেখে রণ দাঁড়িয়ে আছে প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে। খুব শান্ত ভঙ্গি, কালো চেক শার্ট, সাদা প্যান্ট, চোখে কালো সানগ্লাস, আর ঠোঁটে একটা রহস্যময় হাসি। যে হাসির অর্থ বহ্নি বুঝতে পারছে না। বহ্নির এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে এই মানুষটা ছাড়া কেউ তার আপন না, কেউ না।

“বহ্নি এদিকে এসো।”
রণ হাত বাড়িয়ে দেয়, বহ্নি কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখে রণের হাতে। ভরসার একটা আশ্রয় পেয়ে কেঁপে ওঠে সে। ঠোঁট দু’টো তিরতির করে কাঁপছে।

বহ্নির হাত ধরে রণ তাকে পাশে দাঁড় করায়।
“হ্যা বলুন কি বলছিলেন?”
সজীব শব্দ করে হেসে বললো,”এটা কে বহ্নি? নতুন পটিয়েছো? নতুন খদ্দের?”
বহ্নি দুই কানে হাত চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে।

রণের মুখে কোনো ভাবান্তর হয়না। সানগ্লাসটা খুলে হাসতে হাসতে পকেটে ঢুকায়।
আচমকা সজীব মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নাক থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়ে মাটিতে। রণ এক ঘুষিতেই তাকে শুইয়ে দিয়েছে।

“এই বাস্টার্ড, তোর এতো বড় সাহস?”
রণ শান্ত ভাবেই সজীবের কাছে এগিয়ে যেয়ে তার মুখের উপর নিজের জুতাসহ পা চেপে ধরে। সজীব নিজেকে বাঁচানোর জন্য তড়পাতে থাকে।

বহ্নি স্তম্ভিত হয়ে তাকায় রণের দিকে। এ কোন রণ? এ কি রূপ তার? মুখের রেখাগুলো একদমই স্বাভাবিক, অথচ…

বেশ কিছুক্ষণ সজীবের মুখটা পিষে রণ পা সরিয়ে নেয়। সজীব নিজের মুখটা ধরে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। কথাও বলতে পারছে না ঠিকমতো, জিভটা বোধহয় কেটেই গেছে অনেকটা।

রণ সেই একই শান্ত ভঙ্গিতে বসে সজীবের পাশে। সজীবের ঠোঁট দু’টো চেপে ধরে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে।
“কেমন লাগলো সজীব সাহেব? হালকার উপর ঝাপসা একটু বার্নিশ দিলাম। বাড়াবাড়ি করলে সোজা দোযখ ঘুরিয়ে আনবো। আমার হবু স্ত্রীকে অপমান করার সাহস যতোবার করবেন ততবার আপনাকে বিনে টিকিটে দোযখ ভ্রমণ করিয়ে আনবো। ইয়ে তো ট্রেইলার হ্যায়, পুরা পিকচার আভি বাকি। মানুষটা আমি আলাভোলা, গ্রামের ছেলে হলেও আমার ল্যাজে পা দিও না সজীব, কুকুর ছানা। আপনার গলার নলি টেনে ছিঁড়ে আনবো কখন টেরও পাবেন না।”
সজীব চিঁ চিঁ করে বললো,”তোকে তো আমি দেখে নিবো। জানিস না আমার বাবা কে। পৃথিবীর যে প্রান্তে তুই থাকিস তোকে খুঁজে বের করবো আমি। আজ যা করলি তার শাস্তি দিয়েই ছাড়বো।”
রণ খোলা গলায় হেসে বললো,”তাই নাকি? সে তোর বাপ যে হরিদাস পাল হোক, তুই যতোবার আমার হবু স্ত্রীকে অপমান করবি, ততবার তোকে ডলা দিবো। ডলা খাইতে খাইতে তুই হয়ে যাবি ডলি। রসুনও ফেলবি হারিয়ে। রসুন বুঝেছিস তো কি? যে জায়গায় তো চুলকানি বেশি। মেলা চুলকায় না? চুলকানি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তখন বুকে দুইটা মুসুম্বিলেবু ঝুলিয়ে, শাড়ি পরে, ট্রেনে তালি বাজাবি আর গান করবি। আমি মিস ডলি, শোনো তোমাদের বলি, রসুন হারিয়ে আমি যৌবন জ্বালায় জ্বলি।”

সজীব কথা বলতে পারেনা। দাঁত মনে হয় একটা ভাঙছে। ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে সে।

রণ উঠে দাঁড়ায়। একগাদা উৎসুক জনতা হাঁ করে তাকিয়ে আছে। পুরো যেনো একশন সিনেমা, এ দৃশ্য মিস দেওয়া যাবে না কোনোভাবেই।

রণ ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,”ও চাচা, কি দেখো? তামাশা? তুমিও নাচবা নাকি ডলি গানে? আসো, নাচো।”
লোকগুলো কেটে পড়ে আস্তে আস্তে। মুহুর্তের মধ্যে খালি হয়ে যায় জায়গাটা।

বহ্নি হতভম্ব হয়ে রণের দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা কি সত্যি রণ? নাকি তার রূপ ধরে অন্য কেউ?
রণ হেসে তার কাছে এগিয়ে আসে। এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেয় বহ্নির। বহ্নি ধাতস্থ হতে পারেনা।

বহ্নির গালটা লাল হয়ে আছে, রণ আলতো করে ছুঁয়ে দেয় সেখানে। বহ্নি চোখ বন্ধ করে শ্বাস আটকে দাঁড়ায়।
“কি ভাবছেন মিস বহ্নি? আপনার হবু বরটা আবার উৎসের মতো আচরণ করছে কেনো? আসলে কি বলুন তো, ভায়রা ভাই মিলে রসুনের ব্যবসা করবো তো। একটু সিমিলারিটি না থাকলে ঠিক মানাবে না। আপনি কি বলেন?”
“তার মানে?”
“ও বাদ দেন। চলুন আপনাকে নিয়ে একটু শহর ঘোরা যাক রিকশা করে।”
বহ্নি মাথায় হাত চেপে বললো,”আমি বাড়ি যাবো, আমি বাড়ি যাবো।”
“আরে চলুন তো। বাড়ি তো যাবেনই, একটু প্রেম না করলে বিয়ের পর আফসোস করবেন, আসুন।”
রণ বহ্নির হাত ধরে টানতে থাকে। বহ্নি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না কি থেকে কি হয়ে গেলো। এখনো থরথর করে কাঁপছে সে। রণ তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে হাঁটছে।
পিছনেই সজীব যন্ত্রণায় কোঁ কোঁ করছে মাটিতে বসে। ওঠার অবস্থাটাও নেই তার এখন।

কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে আছে আজাদ, উঁকিঝুঁকি মারছে ভিতরের দিকে। এখনো ছুটি হয়নি। উৎস ভাই তাকে মহান দায়িত্ব দিয়েছে। শীতলকে আজ তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। উৎসের নাকি কি কাজ আছে আজকে, আসতে পারবে না।

আজাদকে এভাবে ভিতরের দিকে উঁকি দিতে দেখে দারোয়ান বের হয়ে আসে। বিশালদেহী দারোয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো,”এখানে কি চাই?”
“মেয়েদের কলেজে মেয়ে ছাড়া আর কি চাইবো? এটা তো সিঙ্গারার দোকান না যে, এসে বলবো ওই মামা দুইটা সিঙ্গারা ফিক্কা মারো, এক্সট্রা পিঁয়াজ দিয়ে।”
দারোয়ান রাগী গলায় বললো,”মশকরা হচ্ছে? পাজি ছোকরা।”
“তুমি কি আমার বেয়াই লাগো নাকি যে তোমার সাথে মশকরা করবো। পেট মোটা দারোয়ান কোথাকার।”
দারোয়ান মহা রেগে আজাদের দিকে লাঠি উঠাতে যাবে ঠিক এমন সময় শীতল আর অগ্নি কি নিয়ে হাসতে হাসতে গেট থেকে বের হয়। আজাদ বুকে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। আহা রে, আহা রে কন্যা। কি হাসি, দিলে লাগে।

“ওই মিয়া আমি লাঠি দিয়ে কি করবো? তোমার লাঠি তুমি রাখো।”
দারোয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আবার মশকরা?”
আজাদ তার দিকে তাকিয়ে বললো,”পরের দিন এসে চুম্মা খেয়ে যাবো তোমাকে, আজ আসি হ্যা? এই দেখো তো আমার চুলটা ঠিকঠাক আছে তো?”
“বাঁদর কোথাকার।”
“তোমার পরিচয় চেয়েছি আমি?”
দারোয়ান আবার লাঠি উঠাতে যাবে সাথে সাথে দৌড় দেয় আজাদ। আচমকা এসে থামে শীতল আর অগ্নির সামনে। অগ্নি চোখ কটমট করে তাকায়।

শীতল হেসে বললো,”এ কি আজাদ ভাই আপনি এখানে? কোনো কাজ আছে?”
আজাদ মাথা চুলকে বললো,”এই এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম ঘুগনি খেয়ে যাই। শুনেছি আপনাদের কলেজের আশেপাশে নাকি খুব ভালো ঘুগনি পাওয়া যায়।”
অগ্নি দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে বললো,”অসভ্য কোথাকার।”
শীতল তো হেসেই শেষ।
“আপনি ভুল শুনেছেন আজাদ ভাই, এখানে কোথাও ঘুগনি পাওয়া যায়না। তবে আপনি চাইলে আপনাকে দারুণ ঘুগনি খাওয়াতে পারি।”
“তাই নাকি? কোথায়?”
শীতল অগ্নিকে চেপে ধরে বললো,”এই যে আমার বান্ধবীর কাছে। ও দারুণ ঘুগনি রান্না করে।”
অগ্নি রাগী গলায় বললো,”তুই চুপ করবি? আর ভালো রাঁধলেও বা কি? উনাকে খাওয়াতে যাবো কেনো?”
আজাদ দুঃখী দুঃখী মুখে বললো,”কি আর করা, আমার কপালে আর অগ্নি নেই…. ধুর কি বলি, ঘুগনি নেই।”
অগ্নি আঙ্গুল উঁচু করে বললো,”এই যে শুনুন….”
“জ্বি বলুন, শুনতেই চাচ্ছি।”
“অসহ্য, এই শীতল আমি যাচ্ছি। এই উল্লুকটার সামনে দাঁড়ানোর আর ইচ্ছা নেই আমার।”
শীতলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অগ্নি ছুটে চলে যায়। শীতল হাসতে হাসতে অস্থির।
আজাদ মাথা চুলকে বললো,”চলুন ভাবীজান, আপনাকে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিই। হাঁটতে পারবেন নাকি পালকির ব্যবস্থা করবো?”
শীতল লাজুক মুখে হেসে বললো,”আজাদ ভাই আপনি এমন কেনো?”
“কি করবো ভাবীজান? সবই আপনার হবু বরের আশীর্বাদ। গুরু যেমন শিষ্যও তো হবে তেমন।”
শীতল দ্রুত পা চালায়, এই লোকের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কখন কি বেফাঁস কথা বলে বসে ঠিক নেই। এরা সব এক ঝাড়ের বাঁশ। মানসম্মান নিয়ে কেটে পড়াই ভালো।

রণের বাবা আজ গ্রামে গেছে। জমিজায়গা নিয়ে একটু ঝামেলা চলছে, বাধ্য হয়ে যেতেই হলো। রণ বহ্নিকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে আসতেই নওশাদের মুখোমুখি হয়। নওশাদ তো তাকে না খাইয়ে ছাড়বেই না রাতে। বহ্নি কিছু খায়নি। তার নাকি শরীর খারাপ লাগছে। আসার পর সেই যে ঘরে যেয়ে শুয়েছে আর ওঠেনি। রণকে অগত্যা খেতেই হলো। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় নওশাদ তাকে জোরাজোরি করেছে থেকে যেতে। রণেরও নেহাৎ কম ইচ্ছা ছিলো না। ফলস্বরূপ আজও মহাপুরুষ খাঁ বাড়িতে রাত্রিযাপন করবেন, স্থান উৎসের ঘর।

“তোমার আক্কেলটা কি বলো তো? দিন দিন বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে নাকি তোমার?”
নওশাদ রাতে ঘুমানোর আগে যে চা খায়, তাই খাচ্ছিলো। হঠাৎ শাহানার কথায় তার ধ্যানভঙ্গ হয়।

“কেনো কেনো? এমন বলছো কেনো? আমি তো বহ্নি, শীতল, আভার আরেকটা ভাইবোন আনতে চাইনি।”
শাহানা রাগে গজগজ করে ওঠে।
“ইয়ার্কি মারবে না, একদম না। ঘর থেকে বের করে দিবো তখন বুঝবে। রাতে তোমার মহাপুরুষদের সাথে যেয়ে থাকতে হবে।”
নওশাদ কাপ রেখে বললো,”শাস্তি যদি এতো মধুর হয়, তবে সে শাস্তিই ভালো।”
“তাই না? তা যাও না, যাও। অতোটুকু ঘরে গাদাগাদি করে থাকো তিনজন।”
“যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন। আমাকে ওরা মাথায় করে রাখবে।”
শাহানা মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে।

“ও মা, ও বাবা এ তোমরা কার সাথে আমাকে বিয়ে দিলে। এই লোক এমন কেনো?”
“আমি কি করলাম দোয়েল পাখি?”
শাহানা রাগে লাল হয়ে বললো,”ওরে জ্ঞানী, বিয়ের আগে হবু জামাইকে বাড়িতে থাকতে দিচ্ছো। বলি মানুষ কি বলবে?”
“আশ্চর্য, হবু জামাই কি মানুষের কোলে উঠে হিসু করে দিচ্ছে নাকি? ওরা কেনো কিছু বলবে?”
শাহানা চুপ করে থাকে। নওশাদ ঝড়ের পূর্বাভাস টের পায়। ঝড় ছাড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে পরিবেশ এমন শান্ত থাকে। ঝড় ওঠার আগে ঘুমিয়ে যেতে হবে।
নওশাদ লাইট অফ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। নাক ডাকার শব্দ আসে মিনিট দুয়েকের মধ্যে। কি মনে করে ফিক করে হেসে দেয় শাহানা। সে খুব ভালো করে জানে নওশাদ ঘুমায়নি। তার হাত থেকে বাঁচতে নাক ডাকার নাটকও হচ্ছে। শাহানা পাশে শুয়ে পড়ে। খুব ইচ্ছা হয় একটা হাত মানুষটার শরীরের উপর রাখতে। কিন্তু না, হবে না। এই লোক লাই পেয়ে মাথায় উঠে যাবে।
মিনিট পাঁচেক পর নওশাদই শাহানার হাতটা ধরে এনে নিজের পেটের উপর রাখে। শাহানা মুখ টিপে হাসে কুটকুট করে। চাঁদের আলো জানালা ভেদ করে ঘরে ঢুকেছে। রূপোলী থালার মতো মায়াময় জ্যোৎস্না।

“রণ ভাই আপনার কি কিছু লাগবে?”
রণ আর উৎস দুইজনই চমকে উঠে তাকায় দরজার দিকে। শীতল ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। বড় একটা ওড়না মাথায় পেঁচানো।

রণ উৎসের দিকে তাকায়, উৎস সিগারেট খাচ্ছিলো। হঠাৎ যেনো টানতেও ভুলে গেছে। কেমন যেনো ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে শীতলের দিকে। তার ধারণা শীতল দিনদিন আরো সুন্দরী হচ্ছে।

রণ মুচকি হেসে বললো,”আমার কিছু লাগবে না শীতল, তোমার যা লাগবে নিয়ে যেতে পারো।”
শীতল ভেবাচেকা খেয়ে বললো,”আমার আবার কি লাগবে?”
“এই ঘরে তোমার যে মূল্যবান রত্নটি আছে।”
শীতল ঢোক চেপে বললো,”আচ্ছা আমি আসছি।”
রণ শব্দ করে হাসে, উৎস রণের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো,”সময় আমারও আসবে, গুণে গুণে উশুল করবো সব।”
“আরে আগে যাও তো, ম্যাডাম চলে যাচ্ছে যে।”
উৎস সিগারেট ফেলে দুষ্টুমি মিশ্রিত হাসি দিয়ে উঠে চলে যায়।

“কি হয়েছে? মুখটা এমন লাগছে কেনো?”
শীতল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“কি বলছি শুনতে পাচ্ছো না? কিছু বলবে?”
শীতল গাঢ় গলায় বললো,”না।”
“তাহলে এতো রাতে এখানে এসেছো কেনো?”
“ভুল হয়েছে চলে যাচ্ছি।”
শীতল যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উৎস পা এগিয়ে দেয়। পায়ে বেঁধে শীতল উলটো হয়ে পড়তে গেলেই উৎস তার হাত ধরে ফেলে। ঝট করে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলে। শীতলের চুল এসে লাগে তার নাকে, মিষ্টি একটা গন্ধে শিহরিত হয় তার শরীর, মন।

“রাগ করেছো কেনো?”
“রাগ করিনি, ছাড়ুন।”
“ছাড়ার জন্য ধরিনি।”
শীতলের অবাধ্য চুলগুলো কপালে এসে ভিড় করে। উৎস চুলগুলো কানে গুঁজে দেয় আলতো করে।

“এবার বলো কি হয়েছে?”
শীতল উৎসের চোখে চোখ দিয়ে তাকায়। উৎস থমকে যায়। বাদামী রঙা চোখের মণি জ্বলজ্বল করতে থাকে যেনো। চাঁদের আলো এসে পড়েছে শীতলের ঠোঁটে। এক নাম না জানা মোহমায়ায় উৎস নিবদ্ধ হয়ে যায়।

“খুব ব্যস্ত তাইনা? আমাকে কলেজ থেকে আনতে যাওয়ার সময় নেই। আজ পড়াতেও যাননি নিচে। এতোই ব্যস্ত যখন আমাকে দিয়ে কি কাজ?”
“ও এই ব্যাপার?”
“ছাড়ুন তো।”
উৎসকে জোর করে সরিয়ে দেয় শীতল। মুখ গোঁজ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। উৎস যেয়ে তার দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে।

“আচ্ছা আর এমন হবে না, এবার একটু হাসেন রানীসাহেবা।”
“ঢং করবেন না।”
উৎস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”মানুষের একটা হৃৎপিণ্ডের দাম জানো কতো? প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা। আর আমি তোমারে ফ্রিতেই দিয়ে দিয়েছি, আর কি চাও?”
শীতল ঝট করে তাকায় উৎসের দিকে। উৎস নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“আমি পুরোটাই তো তোমার। উজাড় করে দিয়েছি নিজেকে। আর কি পেলে খুশি হবা তুমি?”
শীতলের রাগ বরফ গলা পানির মতো গলতে থাকে। মাথা নিচু করে ওড়না দিয়ে আঙ্গুল পেঁচাতে থাকে সে।

“শীতল।”
“কি?”
“রাগ কমিয়ে দিবো পুরোটা?”
“কীভাবে?”
উৎস শীতলের পিছনে এসে দাঁড়ায়। তার তপ্ত শ্বাস পড়ছে শীতলের কাঁধে।

“তোমার রাগ কমাতে আমার বিশ্বজয় করা লাগবে না। এই উন্মুক্ত জায়গাটায়, যেখানে আমার শ্বাসটুকু পড়লে শিহরণ জাগছে তোমার, সেখানে ওষ্ঠ ছোঁয়ানোই যথেষ্ট।”
শীতল লজ্জায় লাল হয়ে বললো,”আমি আসছি।”
উৎস দুই হাত বুকে বেঁধে বললো,”দম ফুরিয়ে গেলো? এতো রাগ, এতো অভিমান? শেষ?”
শীতল উৎসের দিকে তাকায়। ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

“দম ফুরায়নি, দম দেখার জন্য অপেক্ষা করুন। সিংহের চেয়ে সিংহীর তেজ বেশি হয় জানেন তো? এতো সহজে দম ফুরালে তাদের চলে না। তার দম থেকেই তো ধার নিয়ে বনের রাজা হয় সিংহ।”
উৎস হতভম্ব হয়ে বললো,”শীতল……?”
শীতল উৎসকে হতভম্ব অবস্থায় রেখে চলে যায়। তার নুপুরের ঝুমঝুম আওয়াজ শোনা যায় সিঁড়ি থেকে। উৎসের বিষয়টা হজম হতে সময় লাগে, বললো কি ও?

মাঝরাতে রণ আর উৎস বসে আছে ছাদে। রণ উৎসকে বলতে চায়নি। ছেলেটার মাথা এমনিতে গরম। কখন কি করে বসে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে তাকে বলা উচিত। বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না জানোয়ারটাকে।

“রণ ভাই আপনি এই কথা এখন আমাকে বলছেন? আমার তো ইচ্ছা করছে এখনই যেয়ে কুত্তাটার কলিজা ছিঁড়ে আনি, দেখি ওর কলিজা কতো বড় হয়েছে। ওর মতো চুনোপুঁটিকে মারতে আমার খুব বেশি হলে আড়াই মিনিট সময় লাগবে।”
“উৎস শান্ত হও। যেটাই করতে হবে খুব সাবধানে। যেটাই করতে হবে বহ্নির যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকটা ভেবে।”
উৎস দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে। গলার শিরা ফুলে ওঠে তার।

রণ উৎসের পিঠে হাত দিয়ে বললো,”কি করতে চাচ্ছো তুমি বলো তো?”
“রণ ভাই, তেমন কিছু করবো না। শুধু ওরে খোজা বানায় দিবো। খোজা মানে বুঝেন তো? টুনটুনি কাইটা দিবো। মরবে না, মরতে ওরে আমি দিবো না।”
রণ দাঁত বের করে হেসে বললো,”বেঁচে থাকতেই যে মরণ জ্বালা ভোগ করবে ও। সামনে যে শিল্পপতির মেয়ের সাথে ওর বিয়ে হবে। তার কি হবে?”
উৎস সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো,”কি আর হবে? বাসর রাতে গান করবে, আমি জোয়ান একটা মাইয়া, খোজা জামাইয়ের কাছে আমায় বাবায় দিছে বিয়া। ও সে যৌবনজ্বা…….”
উৎস গান শেষ করতে পারেনা, হেসে দেয় শব্দ করে। রণ তো আগেই হাসতে হাসতে শুয়ে পড়েছে ছাদের উপরই।

“কি শুরু করেছিস তোরা?”
বহ্নির কথায় দুইজন হাসি থামিয়ে তাকায় তার দিকে।
উঠে দাঁড়ায় রণ।

বহ্নি তার দিকে না তাকিয়ে উৎসের দিকে তাকিয়ে বললো,”রাতবিরেতে কি অশ্লীল গান শুরু করেছিস? বাবার কানে গেলে কি হবে জানিস তো?”

উৎস কিছু বলার আগেই রণ বললো,”আমরা একটু মজা করছিলাম বহ্নি, দুঃখিত।”
“আপনি কোনো কথাই বলবেন না। এই বদমাশটার সাথে থাকতে থাকতে আপনিও ওর মতো হয়ে যাচ্ছেন। সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। আপনার সর্বনাশ হচ্ছে।”
উৎস উঠে দাঁড়ায়, প্যান্ট থেকে ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,”আর তো কয়টা দিন, এরপর তুই উনাকে স্বর্গবাস করাবি তো। ততদিন নাহয় একটু সর্বনাশ হোক।”
বহ্নি ক্ষিপ্ত গলায় বললো,”উৎস…..”
উৎস ছুটে ঘরে চলে যায়। রণ হাসতে হাসতে বললো,”এই ছেলেটা যে কি।”
হঠাৎ বহ্নির দিকে তাকিয়ে সে দেখে বহ্নি থমথমে মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাসি থামিয়ে দেয় সে সাথে সাথেই।

“ঘরে যান, ঘুমান। বিয়ের আগে আর একবারও যদি দেখেছি এখানে এসে ওই উৎসের সাথে থাকতে তাহলে গাছের সাথে বেঁধে রেখে দিবো আপনাকে।”
বহ্নি গটগট করে হেঁটে চলে যায়। কি সাংঘাতিক কথা, হবু বরকে নাকি গাছের সাথে বেঁধে রেখে দিবে। অসম্ভব কিছু না তার পক্ষে, করতেও পারে।

রণ তার যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে চলে যাওয়ার পরেও চারপাশে যেনো একরাশ কাঠগোলাপের সুক্ষ্ণ সুবাস রেখে গেছে। কবে এই সুবাস তার বুকে ভাসবে?

(চলবে…….)