“#প্রণয়_সমাচার
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ২৭
“সরি”
উসামা কাঁচুমাচু করতে করতে অপলাকে বললো। অপলা বিনিময়ে কোনো জবাব দিলো না। বিনাবাক্যে টেবিলে খাবার সাজাতে লাগলো। উসামা টেবিলের ওপরে হাত রেখে বললো,
” বউ সরি।”
অপলার সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। নিজের কাজে মহাব্যস্ত সে। উসামা অসহায়ের মতো অপলার দিকে এগিয়ে এলো। অত্যন্ত নরম স্বরে বললো,
” বউ বললাম তো সরি। এত রাগ কেন তোমার? এভাবে বরকে রাগ দেখানো কী ঠিক? দ্যাট’স নট ফেয়ার আপেল।”
অপলা কোনো শব্দ করলো না। খাবার টেবিলে গুছিয়ে রেখে জেসমিনকে ডাকতে চলে গেল। উসামা নামক কোনো জীবকে যেন সে চেনেই না। উসামা মুখ ভোঁতা করে বসে রইলো। পঁচা আপেলটা তাঁকে পাত্তা দিচ্ছে না কেন?
খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে ঢুকতেই উসামা চমকে গেল। অপলা বিছানার মাঝে এক মস্ত বড় কোলবালিশ রেখেছে। যাকে বলে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার। উসামা চোখ কুঁচকে কোলবালিশটাকে দেখলো। এই কোলবালিশটা তাঁর সতান। সতীন হচ্ছে নারীবাচক শব্দ। এর পুরুষ ভার্সন হলো সতান। উসামা বিছানায় উঠেই এক লাথি দিয়ে কোলবালিশটাকে নিচে ছুঁড়ে মারলো। অপলা ফের বালিশটাকে মেঝে থেকে তুলে আনলো। বিছানার মাঝে কোলবালিশটাকে রাখলো। অতি নিষ্ঠু’রতার ভঙ্গিতে বললো,
” যদি কেউ আর একবারের জন্যেও বালিশটাকে মেঝেতে ফেলে; কিংবা বিছানার মাঝখান থেকে সরায় তাহলে; তাঁকে আজ ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমাতে হবে। এই ঘরে কিংবা বিছানায় তাঁর কোনো স্থান নেই।”
উসামা টু শব্দটিও করলো না। চুপচাপ বিছানার মাঝখানে বালিশটা রেখেই শুয়ে পরলো। পিটপিট করে অপলার দিকে তাকিয়ে রইলো। কোলবালিশের ওপরে মাথা রেখে বললো,
” সরি বউ। আসো আদর করে তোমার রাগ ভেঙে দিচ্ছি। কাছে আসো বউ; উম্মাহ!”
উসামা অপলাকে ঠোঁট কুঁচকে চুমুর ভঙ্গিমা প্রদর্শন করলো। অপলা ক্ষুদ্ধ হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। চিৎকার করে বললো,
” মানুষের মধ্যে আল্লাহ একটু হলেও হায়া, লজ্জা দিয়েই দুনিয়াতে পাঠান। কিন্তু, আপনার মস্তিষ্কে বিরাট গন্ডগোল! আপনার মায়ের উচিত ছিল আপনি হওয়ার পর আপনাকে তিনবেলা লজ্জাবতী গাছের পাতার রস খাওয়ানো। তাহলে যদি আপনার মধ্যে একটুখানি উন্নতি আসতো।”
উসামা গড়াগড়ি করে অপলার কাছে এসে তাঁর পিঠে মুখ গুঁজে বললো,
” আসলে লজ্জাবতী গাছের পাতার রসে আমার এখন আর কোনো কাজ হবে না। সাধু পীর বলিয়াছেন ••হে বৎস! তিনবেলা চারবার করিয়া বউকে চুম্বন করিবে। তবেই তোমার মস্তিষ্কের উন্নতি সাধন ঘটিবে••”
অপলা ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো,
” ওরে আমার ভন্ড পীরের মুরিদ ছানা! যেমন পীর তেমন তাঁর মুরিদ!”
অপলা ফের মাঝে সোজা করে কোলবালিশ রাখলো। উসামা মুখ বাঁকা করে বসে রইলো। এই মেয়েটা তাঁকে কাছে ঘেঁষতেই দিচ্ছে না। উসামা কোলবালিশটা ফের মেঝেতে ছুঁড়ে মারলো। অপলা তেড়েফুঁড়ে উসামার দিকে তাকালো। উসামা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” দেখো অপলা, তোমার বেলায় আমি অনেক সিরিয়াস। আমি কাউকে তোমার পাশে সহ্য করতে পারি না। নেভার নেভা নেভার! এসব চিন্তা করলেও আমি কেমন জেলি জেলি ফিল করি।”
অপলা কপাল কুঁচকে বললো,
” জেলি জেলি?”
উসামা বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
” জেলাস। মানে তোমার বোঝা উচিত অপলা। তুমি এখন ম্যারিড। সো, স্বাভাবিক ভাবেই আমি যে সে ছেলের কথা তোমার মুখে শুনতে পারবো না।”
অপলা শোয়া থেকে উঠে কোমরে হাত রেখে বললো,
” নিজের বেলায় তো ষোল আনা। আমার বেলায় এক আনা! আকাশকে নিয়ে আপনি জেলি জেলি ফিল করেন? আপনি তো রূপার লাভবাইট নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ডিনারে নিয়ে গেছেন; তাঁর দেওয়া শার্ট পড়ে রং ঢং করেছেন। তখন আমি কিছু বলেছিলাম? এখন আপনারও আকাশকে নিয়ে কোনো প্রবলেম থাকার কথা নয়। আমি আকাশের সঙ্গে ঘুরবো ফিরবো, নাচবো যা খুশি করবো। অবশ্য ইচ্ছে করলে ডেটে গিয়ে চুমু টুমুও খেতে পারি।”
উসামা কেমন তেঁতে উঠলো। অতি রাগান্বিত গলায় বললো,
” একদম বাজে কথা বলবে না। তোমার আকাশ ডেটে যাওয়ার জন্য পা-ই খুঁজে পাবে না। ওর পা আমি ভে’ঙে চার টুক’রা করবো।আর তুমি কিছু বলোনি মানে? সেদিন কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়েছিল কে?”
অপলা উসামার দিকে তাকিয়ে অতি নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো,
” ওমা তাই? বাহ! খুব খুশি হলাম জেনে। আপনি না বললে জানতেই পারতাম না। তা আজ ড্রয়িংরুমে ঘুমানোর খুব ইচ্ছে হয়েছে বুঝি? ”
উসামা রাগে গজগজ করতে করতে বিছানায় শুয়ে পরলো। অপলা পাশ ফিরে মিটমিট করে হাসলো।বেশ হয়েছে! আঁতে ঘা লেগেছে এবার;বোঝো ঠ্যালা!
সকাল সকাল লম্বা গোসল সেরে অপলা শাড়ি পড়ে গুনগুন করতে চুল আঁচড়ে নিতে লাগলো। উসামা কেমন বাঁকা দৃষ্টিতে অপলাকে দেখলো। ভেজা চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। চোখের পাপড়িতে বিন্দু বিন্দু পানি। ঘাড় গলা কেমন ভেজা পানি চকচক করছে। উসামা বড়সড় একটা ঢোক গিললো। পেছন থেকে অপলার কোমর চেপে ধরলো। ঠোঁটের ভাঁজে ঠোঁট মেলাতে যেতেই অপলা ত্বরিত সরে গেল। যাওয়ার সময় উসামার গালে চুলের ঝাপ্টা দিয়ে গেল। উসামার পুরো গালে অপলার চুলের পানি ফোঁটা চিকমিক করছে। উসামা অপলার হাত ধরে টেনে কাছে আনলো। গালের সঙ্গে গাল ঘষলো। কানে ফিসফিস করে বললো,
” ম্যাডাম, আপনার রাগ এখনও কমেনি? স্বীকার করলাম তো আমার অপরাধ। এবার আমায় মার্জনা করুন। লঘু পাপের গুরু দন্ড থেকে রক্ষা করুন।”
অপলা কোনো প্রতুত্তর করলো না। উসামার বাধঁন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে গেল।
উসামা অফিসে চলে গেছে। রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে রান্নার নুন চাখতে অপলা যে-ই না জিহ্বায় খাবার ছোঁয়ালো। তখনই তাঁর শরীর কেমন গুলিয়ে উঠলো। দ্রুত রান্নায় ঢাকনা চাপিয়ে অপলা বেসিনের দিয়ে এগোলো। হড়বড়িয়ে বমি করলো। মাথা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো। অপলার এরূপ গতিবিধি জেসমিনের কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগলো। তিনি এসে অপলার মাথায় পানি ঢাললেন। অপলা লক্ষ্য করলো জেসমিন তাঁকে কেমন বড় বড় চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে। অপলা এবার খুব অস্বস্তি বোধ করলো। মা তাঁর দিকে এভাবে তাকিয়ে রয়েছে কেন?
বিকেলে ছাঁদে কাপড় তুলতে গেল অপলা। আজ সকালে জেসমিন বালিশ, বিছানার চাঁদর শুকাতে দিয়েছেন। অপলা কাপড় তোলা শেষ করে শায়েলার কাছে গেল। শায়েলা দরজা খুলে অপলাকে জড়িয়ে ধরলেন। মমো এসে কেমন অভিমানী স্বরে অপলাকে বললো,
” বিয়ের পর তুমি আমাকে ভুলেই গেছো। এই আপুগুলো বিয়ের পর এমন হয়ে যায় কেন? আমাকে তুমি ভালোই বাসো না। সারাদিন শুধু বর বর করো।”
অপলা জবাবে বললো,
” মোটেও না। আমি তোকে মোটেও ভুলিনি। এসব অপবাদ আমাকে দিস না। সংসারিক কাজ, পড়ার চাপ এসব সামলে আমি আর সময় পাই না এখানে আসার। শরীরটাও আজকাল কেমন দূর্বল লাগে। কোনো কাজ করতে ইচ্ছেই হয় না।”
মমো গালে হাত দিয়ে বললো,
” তুমি একটা বোকা মেয়ে অপলা আপু। বিয়ের পর এত পড়ে কী হবে? আমি তো বিয়ের পর পড়াশোনা একদম বন্ধ করে দেবো। এত পড়তে টরতে আমার ভালো লাগে না। যদিও আমি পড়াশোনা করছি সুন্দর ছেলে বিয়ে করার জন্যই। আজকাল সুন্দর ছেলেগুলো শুধু শিক্ষিত বউ চায়। কী হবে এত পড়ে বলো তো? অদ্ভুত!”
শায়েলা মমোর মাথায় গাট্টা মেরে মমোকে চুপ করিয়ে দিলেন। এই বাঁচাল মেয়ে বকবক শুরু করলে থামতেই চায় না। শায়েলা অপলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কেমন সন্দেহজনক গলায় বললেন,
” অপলারে আমার কিন্তু খুব সন্দেহ লাগছে।”
অপলা চমকে গিয়ে থমথমে স্বরে বললো,
” কেন কী হয়েছে ফুপি? কোনো খারাপ কিছু হয়েছে নাকি?”
শায়েলা অপলার গালে হাত রেখে এদিকে সেদিক ঘুরিয়ে অপলাকে দেখলেন। অতি ভাবুক নারীর ন্যায় বললেন,
” তোর চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে আছে। আবার শরীরও দূর্বল লাগে বললি। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে।আচ্ছা, এরমধ্যে বমি-টমি হয়েছিল? মাথা-টাথা ঘুরিয়েছিল?”
অপলা বিষ্মিত হয়ে বললো,
” হ্যাঁ।”
শায়েলা হাতে তালি দিয়ে বললো,
” যা ভেবেছিলাম! তুই এত বলদী কেন রে অপলা? পেটে পেটে এতকিছু লুকিয়ে রেখে কী ঢং-টাই করে বেড়াস। যেন কিছুই জানিস না বুঝিস না!”
অপলা জবাবে বললো,
” আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কী সব যে বিড়বিড় করছো তুমি!”
শায়েলা অপলাকে ফিসফিস করে বললো,
” এই মাসে সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছিল তোর? মানে মাসিক?”
অপলা পিলে চমকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
” না।”
শায়েলা উৎফুল্ল হয়ে বললেন,
” এবার বুঝেছিস?”
অপলা মিনিটখানেক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর মুখে যেন রা শব্দটি নেই। শায়েলা মমোকে চিরকুটে প্রেগনেন্সি কিটের নাম লিখে দিয়ে বললেন,
” নিচে গিয়ে ফার্মেসির দোকান থেকে এটা একটা কিনে নিয়ে আয়।”
মমো চিরকুটটা পড়তে পড়তে বললো,
” এটা দিয়ে কী করে মা? দোকানদারকে কী জিজ্ঞেস করবো এটা কয় বেলা খেতে হবে?”
শায়েলা চিৎকার করে মমোকে বললেন,
” এটা খায় নাকি মাথায় দেয় তা দিয়ে তোর কাজ কী? তোকে যা বলেছি তাই করবি। আর ভুলেও দোকানদারকে বলিস না এটা দিয়ে কী করে? কয়বেলা খেতে হবে সেটা আমি বুঝবো।”
মমো হেলতে দুলতে ফার্মেসি থেকে প্রেগেন্সি কিট কিনে এনে তা শায়েলার হাতে তুলে দিলো। শায়েলা অপলাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠালেন। অপলা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে শায়েলার হাতে;কিটটা তুলে দিতেই শায়েলার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। কিটে দুটো লাল দাগ যেন চকচক করছে। শায়েলা অপলাকে কাছে টেনে অপলার কপালে চুমু খেলেন। গর্বে বুক ফুলিয়ে বললেন,
” আমি জানতাম আমার চোখের আন্দাজ ভুল হতেই পারে না। তোকে দেখেই বুঝেছিলাম কিছু তো ঘাপলা আছে।”
অপলা কোনো জবাব দিলো না। পেটে হাত রেখে সটানভাবে বসে রইলো। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না কেন? এটা কী স্বপ্ন নাকি বাস্তব? অপলার নিরবতা দেখে শায়েলা ফের বললেন,
” কেমন মেয়েরে তুই অপলা? এত খুশির একটা খবর পেলি। কই বরকে ফোন করে বলবি। চুপচাপ মূর্তির মতো বসে আছিস। এই মমো উসামাকে ফোন লাগা।”
মমো ফোনের কাছে ছুটে যেতেই অপলা মুখ ফুলিয়ে বললো,
” কাল তাঁর সঙ্গে বিরাট ঝগড়া হয়েছে। আপাতত আড়ি চলছে। রাতে বাড়ি ফিরলে আবার যখন সরি বলবে তখন বলবো। সে ঘোরতর অন্যায় করেছে। এখন ড্যাং ড্যাং করে ফোন করলে আমাকে কোনো দামই দেবে না। ”
অপলা পেটে হাত দিয়ে নড়েচড়ে বসলো। সে এখন একটা বাবুর আম্মু। তাই, উসামার কাছে নিজের একটা ভাবমূর্তি বজায় রাখা দরকার। নাহলে, উঠতে বসতে বাবুর সামনেই উসামা তাঁকে টিপ্পনী কাটবে। তাই, আগেই ছাগলটাকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। বাবুকে মোটেও তাঁর বাবার মতো আধ-পাগলা হতে দেওয়া যাবে না।
চলবে…