ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব-১৭+১৮

0
78

#ভূমধ্যসাগরের_তীরে
#পর্বঃ১৭
#লেখিকা_দিশা_মনি

মিষ্টি এখন কিছুটা সুস্থ অনুভব করছে৷ তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতাল থেকে দ্রুত আবার ফিরে যাবে৷ এমন ভাবনা থেকেই সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ইয়াসিন এসে দাঁড়িয়ে আছে মিষ্টির সামনে৷ মিষ্টি ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“সব ফর্মালিটিস পূরণ করা হয়ে গেছে? এখন আমি ফিরতে পারবো তো?”

ইয়াসিন বলে,
“হুম, পারবেন।”

মিষ্টি এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“এবার আমি যত দ্রুত সম্ভব নিজের দেশে ফিরে যেতে চাই।”

মিষ্টির মুখে এই কথা শুনে ইয়াসিন চপসে গেল। তার মুখে যেন আধার নেমে এলো। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
“কেন? আপনি নিজের স্বামীকে আর খুঁজবেন না?”

মিষ্টি আবারো মনে পড়ে যায় ইমানুয়েল পলের কথা। যদিও সে নিশ্চিত নয় এটাই রাফসান কিনা কিন্তু তবুও তার ব্যবহার মিষ্টিকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। না চাইতেও তার বুকের বাঁ-পাশটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে। মিষ্টি আনমনে বলে ফেলে,
“যে ধরা দিতে চায়না, লুকিয়ে থাকতে চায় তাকে আর খুঁজে কি লাভ?”

ইয়াসিন মিষ্টির কথা শুনে অবাক হয়ে বলে,
“মানে? আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।”

“কিছু না। আমার বাড়ির লোকের সাথে অনেক দিন থেকে কোন যোগাযোগ নেই৷ তারা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে৷ এবার আমায় ফিরতে হবে।”

ইয়াসিন আর কিছু বললো না৷ শুধু উদাস চোখে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল।

★★
মিষ্টিকে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরল ইয়াসিন। মিষ্টিকে ফিরতে দেখে ফাতিমা বিবি আর আমিনা তো ভীষণ খুশি৷ ফাতিমা বিবি হরেক রকম রান্না করেছেন মিষ্টিকে খাওয়ানোর জন্য। আয়োজনের কোন কমতি রাখতে চান না তিনি। এদিকে আমিনাও মিষ্টির সাথে চিপকে আছে। সে প্রথমেই মিষ্টির পাশে বসে দুঃখ প্রকাশ করে বলে,
“আমার জন্যই তোমাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হলো, মিষ্টি আপু। না আমি তোমাকে জোর করে মার্সেই শহরে ঘুরতে নিয়ে যেতাম আর না তোমায় এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পড়ত হত। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।”

মিষ্টি হালকা হেসে বলে,
“কি যে বলো না তুমি! তোমার কি দোষ এখানে? এটা তো একটা দূর্ঘটনার মতো ছিল।”

ফাতিমা বিবি খাবার নিয়ে আসতে আসতে বলেন,
“তবে দোষটা আমাদেরও কম নয়। তুমি নাহয় এখানে নতুন কিন্তু আমরা তো নয়। আমাদের উচিৎ ছিল আগেই থানায় একটা জিডি করে রাখা তাহলে আর এই দিন দেখতে হতো না। যাইহোক, যা হবার হয়েছে এখন তো আর বলেকয়ে কিছু বদলানো যাবে না। এই নাও, তুমি এই চিকেন স্টু টা খেয়ে নাও। শরীরে একটু বল পাবে।”

মিষ্টি খুশি হয়ে বাটিটা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করে। এমন সময় হঠাৎ করে এলিস সেখানে চলে এসে বলে,
“ভেতরে আসতে পারি?”

এলিসকে দেখে ফাতিমা বিবি ভীষণ খুশি হন। বলেন,
“আরে এলিস, হ্যাঁ, এসো ভেতরে এসো।”

এলিস ধীর পায়ে হেঁটে ভেতরে আসে। অতঃপর ইয়াসিনের দিকে তাকায়। ইয়াসিনের দৃষ্টি ছিল মিষ্টির দিকে। এলিস এসেই বলে,
“আপনাদের সবার জন্য একটা ভালো খবর আছে।”

ফাতিমা বিবি জানতে চান,
“কি খবর?”

“মিসেস মিষ্টির পাসপোর্ট ও ভিসা পাওয়া গেছে। যেই চোরটা এগুলো চুরি করেছিল সে গতকালই পুলিশের হাতে পড়েছে এবং তার কাছ থেকে এসব উদ্ধার হয়েছে।”

এলিসের কথা শুনে মিষ্টি খুশি হয়ে বলে,
“কি বলছেন কি আপনি মিস এলিস? তাহলে আমার পাসপোর্ট, ভিসা সব পাওয়া গেছে৷ আমি তাহলে এবার দেশে ফিরতে পারবো!”

“হ্যাঁ!”

মিষ্টির মুখে তৃপ্তির হাসি। ফাতিমা বিবি, আমিনাও খুশি হন৷ তবে ইয়াসিনকে একটুও খুশি লাগছিল না। এরইমধ্যে আমিনা একটু বিসাদের সুরে বলে ওঠে,
“তাহলে কি তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে মিষ্টি আপু?”

মিষ্টি বলে,
“যেতে তো আমাকে হবেই৷ তবে তোমাদেরকে আমি কখনো ভুলব না। এরপর সময় পেলেই তোমাদের সাথে দেখা করতে চলে আসব আবার মার্সেইতে।”

ফাতিমা বিবি মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“আমি তোমার জন্য এটাই দোয়া করব যে, যেখানেই যাও তুমি সুখী হও। কখনো কোন দুঃখ, কষ্ট তোমায় স্পর্শ না করুক। আর জীবনের সব কষ্ট কাটিয়ে উঠো।”

ইয়াসিন মিষ্টির কাছে এসে বলে,
“আপনার কি এখনই ফিরে যাওয়ার খুব দরকার? আপনার স্বামীর সম্পর্কে কোন তথ্যই তো এখনো জোগাড় হয় নি। আর একটু চেষ্টা করে দেখুন না!”

মিষ্টি ইয়াসিনকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“আমি আর ওনাকে খুঁজতে চাই না। ভাগ্যে যদি থাকে তাহলে উনি আবার একদিন ফিরবেন ইনশাআল্লাহ। ততদিন পর্যন্ত আমি নাহয় অপেক্ষা করে নিলাম।”

ফাতিমা বিবি বলেন,
“এটা তুমি ঠিক বলেছ। সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও। তাছাড়া তোমার পরিবারও নিশ্চয়ই তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করছে। তোমার উচিৎ তাদের কাছে ফিরে যাওয়া।”

ইয়াসিন এসব কথা শুনে যে বড্ড নাখোশ সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এলিস ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। অতঃপর মিষ্টিকে বলল,
“আপনি নিজের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করুন। তারপর আমি আপনার ফ্লাইটের টিকিট ম্যানেজ করছি।”

“আচ্ছা।”

★★
ইমানুয়েল পল চিন্তিত মুখে নিজের রুমে পায়চারি করছিল। এমন সময় হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে। ইমানুয়েল দরজাটা খুলে এলিজাকে দেখে। কিছুটা বিরক্তির ছাপ ভেসে ওঠে তার চোখেমুখে। এলিজা সেটা খেয়াল করে বলে,
“কি হয়েছে? তোমার চোখমুখ এমন কেন লাগছে সুইটহার্ট?”

ইমানুয়েল এলিজাকে জোরপূর্বক ভেতরে এনে অতঃপর দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বলে,
“এখন অন্তত এই নাটকটা বন্ধ করুন মিস এলিজা ল্যুঁই। আমরা এখন একা আছি, এখন এসব নাটকের প্রয়োজন নেই।”

এলিজা বলে,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তো বলুন এখন আপনার পরবর্তী প্ল্যান কি? আমাদের বিয়েটা কি হবে?”

“মিশনের কাজের বাইরে কোন কিছুতে আমার আগ্রহ নেই। আপনি সেটা খুব ভালো করেই জানেন।”

“কিন্তু আপনিও তো এটা খুব ভালো করেই জানেন যে, যদি আপনাকে নিজের পরিচয়টা লুকাতে হয় তাহলে আমাকে বিয়ে করতেই হবে। কারণ এখনো চারপাশে অনেক স্পাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরমধ্যে যদি কোন ভাবে আপনার সত্যটা তাদের সামনে ধরা পড়ে যায় তাহলে কিন্তু এই মিশন পুরো ব্যর্থ হয়ে যাবে।”

“এই নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও হবে মিস এলিজা। এই মিশন আমি কিছুতেই ব্যর্থ হতে দেবো না। এই মিশনটা আমার বহু বছরের স্বপ্ন, বহুদিনের আশার প্রতিফলন। এর সাথে পুরো মানবজাতির স্বার্থ জড়িয়ে,এই পৃথিবীর ভবিষ্যতও অনেকাংশে এর উপরই নির্ভরশীল। তাই আমি যে করেই হোক এই মিশনটা সফল করব৷ তবে আপনাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

“কিন্তু কেন জানতে পারি?”

“কারণ আমি বিবাহিত!”

★★
মিষ্টি রাত্রিবেলা হতাশ চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। রাত যত গভীর হচ্ছে তার উদাসীনতা যেন ততই বাড়ছে। একফোটা ঘুমও পাচ্ছে না। বরঞ্চ মনে জেগে উঠছে হাজারো প্রশ্ন। আর এই সব প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দু ঐ একটা মানুষই “ইমানুয়েল পল”

মিষ্টি আর কিছু সময় এভাবে কাটিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। দুচোখের পাতা বন্ধ করে মনে মনে স্বগতোক্তি করে বলল,
“না, আমি আর ভাবব না ওনাকে নিয়ে। উনি আমার স্বামী রাফসান শিকদার নন, আমার স্বামী এতটা নির্দয় হতে পারে না। উনি অন্য কেউ, এই সত্যটা আমায় মানতেই হবে। কিন্তু তাহলে রাফসান শিকদার কোথায়? উনি কি তাহলে সত্যিই হারিয়ে গেছেন?”

নিজেকেই নিজে এই প্রশ্ন করে মিষ্টি কোন উত্তর পেল না। আর কিছু সময় পর সে এভাবেই ঘুমিয়ে গেল। তার পাশে শোয়া আমিনা অবশ্য অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এদিকে মিষ্টি ঘুমানোর কিছু সময় পর কেউ একজন তার ঘরে এলো। মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমি তোমাকে নিজের থেকে দূরে কোথাও যেতে দেব না। কারণ..জ্যা তি আমে!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

#ভূমধ্যসাগরের_তীরে
#পর্বঃ১৮
#লেখিকা_দিশা_মনি

মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে মার্সেই মেট্রো স্টেশনের সামনে। এলিস তার ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তাই সে আজ প্যারিসের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিচ্ছে। সেখান থেকেই ঢাকার ফ্লাইটে নিজের মাতৃভূমিতে ফিরবে। মেট্রো স্টেশনে আমিনা ও ফাতিমা বিবি দুজনই মিষ্টির পাশে বিষন্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমিনা মিষ্টির উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“তুমি আর কিছুদিন থাকলে কি খুব বেশি অসুবিধা হয়ে যেত মিষ্টি আপু? তোমাকে খুব মিস করব।”

মিষ্টি আমিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“আমিও তোমাকে খুব মিস করব, শুধু তোমাকে কেন, তোমার মা, তোমার ভাইয়া এই মার্সেই শহর সবাইকে আমি ভীষণ মিস করব। কিন্তু কি আর করব বলো? আমার পরিবারের সবাই যে আমার ফেরার অপেক্ষায় বসে আছে। তাদের কাছে তো ফিরতে হবেই ”

ফাতিমা বিবি নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন,
“হ্যাঁ, মা। সেটাই, আমার তো তোমাকে যেতে দিতে একদম ইচ্ছা করছে না। কিন্তু তোমার পরিবারও যেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাই তাদের জন্য হলেও তোমার নিজের দেশে ফেরা জরুরি। তবে আমাদেরকে ভুলে যেও না৷ মাঝে মাঝে যোগাযোগ করো আমাদের সাথে আর পারলে আবারো এই গরীবের বাড়িতে ঘুরতে এসো।”

মিষ্টি ফাতিমা বিবির কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“আপনার কাছ থেকে আমি মায়ের মতো ভালোবাসা পেয়েছি। আপনার এই অকৃত্রিম ভালোবাসা আমি কখনোই ভুলব না৷ সুযোগ পেলে আবারো আসব। আপনিও আসবেন আমাদের দেশে।”

“একদিন যাব ইনশাআল্লাহ।”

এরইমধ্যে প্যারিস গামী মেট্রোরেল চলে আসে৷ এলিস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে,
‘ঐ তো মেট্রোরেল এসে গেছে।’

মিষ্টি এদিক ওদিক তাকাতে থাকে৷ তার দুচোখ যেন কাউকে খুঁজছে। ফাতিমা বিবি সেটা খেয়াল করে বলেন,
“কাউকে খুঁজছ তুমি?”

মিষ্টি কিছুটা সংকোচ প্রকাশ করে বলে,
“মিস্টার ইয়াসিন আল খলিলি কোথায়? সকাল থেকে তো ওনায় দেখছি না। গতকাল শেষবারের মতো দেখা হয়েছে। কিছুদিন থেকেই উনি এভাবে আমায় এড়িয়ে চলছেন।আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। উনি কি কোন কারণে আমার উপর মনোক্ষুণ্ণ হয়েছেন?”

আমিনাও বলে ওঠে,
“হ্যাঁ, তাই তো। আজ সকালে উঠে তো আমি ভাইয়াকে অনেক খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও পেলাম না। কোথায় গেল ভাইয়া?”

ফাতিমা বিবি মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“ইয়াসিনকে কিছু জরুরি কাজে কাল রাতেই মার্সেই শহরের বাইরে যেতে হয়েছিল অনেক রাতে। তুমি তখন ঘুমাচ্ছিলে তাই তোমায় আর জাগায় নি। ও আমাকে বলেছে তোমাকে সুস্থভাবে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে। সুযোগ পেলে ও একদিন তোমার দেশে গিয়ে তোমার সাথেও দেখা করবে বলেছে।”

ফাতিমা বিবির কথা শুনে মিষ্টি কিছুটা স্বস্তি পায়। অতঃপর বলে ওঠে,
“ওনার কাছে আমি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকব। আজ আমি যে এখানে সুস্থভাবে দাঁড়িয়ে আছি তার পুরো কতৃত্বই ওনার। ওনার সাথে দেখা না করে যাওয়ায় ভীষণ খারাপ লাগছে।”

এলিস বলে,
“এত চিন্তা করবেন না। ভাগ্যে থাকলে আপনাদের আবার দেখা হবে। আচ্ছা, আপনি আর দেরি করবেন না। দ্রুত মেট্রোরেলে গিয়ে উঠে বসুন।”

মিষ্টি একবার সবার থেকে বিদায় নিয়ে নেয়৷ তার চোখেও জল চলে আসে। আমিনা ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল। ফাতিমা বিবিও নীরবে অশ্রু ফেলছিল। সবাইকে বিদায় জানিয়ে মেট্রোরেলে একটি বসে পড়ে মিষ্টি। অতঃপর জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,
“বিদায় মার্সেই..এখানে এসে অনেক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তার কিছু অভিজ্ঞতা ছিল সুমধুর আবার কিছু তিক্ত। তবে আমি সুমধুর স্মৃতিগুলোকেই মনে রাখতে চাই।”

বলেই সে চোখের জল মুছতে থাকে। কিছু সময় পরই মেট্রোরেলটা প্যারিসের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। মিষ্টি অবশেষে মার্সেই শহর থেকে ভীষণ দূরে চলে আসতে থাকে।

ছুটে চলা মেট্রোরেলের দিকে তাকিয়ে দূর থেকেই নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিল ইয়াসিন। তার কষ্টের সব সীমা যেন আজ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। মিষ্টি নামক মেয়েটা পরস্ত্রী, তাকে নিজের বন্ধুর মতো দেখে এসব জানে সে। তবুও তার প্রতি তৈরি হওয়া অনুভূতিকে মিথ্যা বলতে পারে না সে। ইয়াসিন ছুটে চলা মেট্রোরেলের দিকে তাকিয়েই বলে,
“আমাকে ক্ষমা করবেন মিষ্টি। আপনাকে বিদায় দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার সাথে দেখা করলে আমি আপনাকে আর যেতে দিতে পারতাম না। আপনাকে নিজের কাছে আগলে রাখার নিষিদ্ধ অনুভূতি যে তৈরি হয়েছে আমার মধ্যে। এত বড় পাপ আমি করতে পারতাম না। তাই আপনাকে নীরবে বিদায় দিলাম। ভালো থাকবেন, আপনার জীবনের সুখের আশা করি।”

ইয়াসিন এসবই ভাবছিল তখন হঠাৎ কেউ তার পিঠে হাত রাখে। ইয়াসিন নিজের চোখের জল মুছে পেছনে ফিরে তাকিয়েই দেখতে পায় নিজের বোন আমিনাকে। তাকে দেখে কিছুটা চমকে ওঠে। আমিনা ইয়াসিনকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“তুমি কেন মিষ্টি আপুকে কিছু বললে না ভাইয়া? তুমি কেন বললে না তুমি আপুকে ভালোবাসতে শুরু করেছ!”

“আমিনা!”

“আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়েই তোমার মনের কথা পড়তে পারছি। তুমি কতটা কষ্টে আছ। আমি কিছু দিন থেকেই সবটা খেয়াল করেছি। কাল রাতে যে তুমি লুকিয়ে আমাদের রুমে এসেছিলে অতঃপর মিষ্টি আপুর মাথার কাছে বসে যা যা বলেছ আমি তার সবটাই শুনেছি। কেন এমন করলে ভাইয়া? মিষ্টি আপুকে আটকানোর চেষ্টাও করলে না আর না তো তাকে বিদায় জানাতে এলে। এসব করে যে তুমিই সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছ?”

ইয়াসিন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“পৃথিবীর সকল অনুভূতি প্রকাশ করতে নেই বোন। বিশেষ করে কিছু অনুভূতি থাকেই এমন নিষিদ্ধ। মিসেস মিষ্টি অন্য কারো স্ত্রী তার প্রতি অনুভূতি থাকাই তো পাপ।”

“কিন্তু তার স্বামী তো মারা গেছে।”

ইয়াসিন কিছু একটা ভেবে বলে,
“সত্যিই কি মারা গেছে?।”

“মানে?”

“কিছু না।”

বলেই সে মুখটা সরিয়ে নেয়।

★★
প্যারিস মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে গেল মিষ্টি। অতঃপর ধীর পায়ে মেট্রোরেল থেকে নামল। মার্সেইয়ে নিজের চেনা পরিবেশ থেকে এখন অনেকটাই দূরে সে। মিষ্টি নিজের ট্রলি ব্যাগটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগল। এই ব্যাগে তার যাবতীয় জিনিসপত্র রয়েছে। মেট্রোরেল থেকে বের হতে যাবে এমন সময় খেয়াল করল মেট্রোরেলে কিছু পুলিশ সবার জিনিসপত্র চেক করছে। মিষ্টি ব্যাপারটায় খুব একটা মাথা ঘামালো না। বাকি সবার মতো লাইন করে দাঁড়ালো। মিষ্টির পালা আসতেই তার ব্যাগ সার্চ করা হলো। মিষ্টি স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। তার ব্যাগ সার্চ করতে কর‍তেই হঠাৎ এক পুলিশ অফিসার আতকে ওঠেন৷ অতঃপর নিজের সহকর্মীকে কিছু একটা বলতেই সেই সহকর্মী মিষ্টির দিকে বন্দুক তাক করে। মিষ্টি তো ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পারে না এর কারণ কি। এমন সময় সে দেখে তার ব্যাগ থেকে কিছু গ্রেনেড ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। মিষ্টি পুরোপুরি হতবাক হয়ে যায়। এসব তার ব্যাগে এলো কি করে?

একজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে এসে মিষ্টিকে ধরে বলে,
“তুমি কোন জ**ঙ্গী সংগঠনের সাথে যুক্ত বলো। তোমাদের পরিকল্পনা কি? আর তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ। এসব অস্ত্র নিয়ে করছ।”

“আমি কিছু জানি না এসব অস্ত্র কোথা থেকে এলো। আমার কোন দোষ নেই।”

এমন সময় হঠাৎ করে পুরো মেট্রোরেলে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। চারিদিক ধোয়ায় ছেয়ে গেল। মিষ্টিও জ্ঞান হারালো সেই ধোয়ায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨