অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
78

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩১.

জয় কপালে হাত রেখে সালাম দিলো মুস্তাকিনকে। মুচকি হাসল মুস্তাকিন, “বসুন। হালচাল ভালো?ʼʼ

-“খারাপ থাকার জন্য যে বিশেষত্বটা দরকার, সেইটা আমার নাই। খারাপ থাকে ভালো মানুষেরা। আমি খারাপ মানুষ।ʼʼ

অন্তূ আবার এসে বসতে বাঁধা দিলো জয়, “উহহহু। ভেতরে যাও, আরমিণ। দ্রুত তৈরি হয়ে এসো। তোমার এক্সাম আছে।ʼʼ

অন্তূ নিষেধ শুনেই বরং বসে পড়ল, “দুটোয় এক্সাম। এগারোটা বাজছে।ʼʼ

জয় ক্ষণকাল মেঝের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “আজ পরীক্ষা পিছিয়েছে। বারোটায় পরীক্ষা।ʼʼ

-“হঠাৎ!?ʼʼ

জয় বলল, “আজ শেষ পরীক্ষা। ভার্সিটিতে কিছু ঝামেলা হয়েছে, পরীক্ষার সময় পিছিয়েছে।ʼʼ

-“তো আপনি এ কথা এভাবেই সবার বাড়ি বাড়ি ও হলে গিয়ে জানিয়ে আসছেন?ʼʼ

-“তুমি অনুমতি দিলে তাই হবে। ভার্সিটির সব ছাত্রীগুলারে বিয়ে করব, এরপর সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসব। একটু জামাই আদরও পাওয়া হবে।ʼʼ

-“অনুমতি আছে। করে ফেলুন।ʼʼ

মুস্তাকিন চুপচাপ বসে ছিল। জয়ের মনে হলো, তার দ্বারা এর চেয়ে বেশিক্ষণ ভদ্র আচরণ করা অসম্ভব। সে বিশাল বড় হেসে মুস্তাকিনকে বলল, “তো মুস্তাকিন সাহেব, কী কাজে এসেছিলেন, সেসব যাক। আমার মনেহয় আপনার কাজ শেষ। এখন আসত পারেন। আমার বউডার পরীক্ষা আছে তো, বাইর হইতে হবে। ফর্মালিটির চোটে উঠে যাইতে পারতেছে না। ভদ্রলোকের মেয়ে তো। আপনি গেলে তবেই উঠে তৈরি হত যেতে পারবে।ʼʼ

অন্তূ চোখ বুজল। তামাশা তৈরি করতে জয়ের কোনো পূর্বপ্রস্তুতির দরকার পড়ে না। কিছুটা লেহাজ, সংকোচ নেই তার মাঝে।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মুস্তাকিন খুবই স্বাভাবিকভাবে বের হয়ে গেল। জয় একাই বসে রইল। কেউ উঁকি দিয়েও দেখল না জয়কে সেই ঘরে।

অন্তূ কিছুক্ষণ পর তৈরি হয়ে সামনে এলো। তার চোখ ফোলা, নাক লাল হয়ে আছে। কেঁদেছে সে।

-“বোরকা কই, তোমার?ʼʼ

-“চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।ʼʼ

-“বোরকা পরে এসো। বসছি আমি।ʼʼ

অন্তূ খুব সাবলীলভাবে মাথা নেড়ে বলল, “চলুন।ʼʼ

জয়ের স্বর বদলে গেল, “আমি উঠলে এমন একটা থাপ্পর মারব, কান দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে যাবে।ʼʼ

-“আচ্ছা, মারুন। তবে তাড়াতাড়ি। যত তাড়াতাড়ি মারা শেষ হবে, আমরা তত তাড়াতাড়ি বের হতে পারব।ʼʼ

জয় উঠে দাঁড়াল অন্তূর সামনে, “বোরকা না পরে কী প্রমাণ করতে চাইতেছ?ʼʼ

-“আমি কিছু প্রমাণ করতে চাইছি না। ওই দায়িত্ব আপনার ছিল। তা আপনি খুব ভালোভাবে পালন করেছেন। আর কিছু প্রমাণ করার নেই।ʼ

-“এই শালির মেয়ে! এইজন্য তুই ল্যাংটা হয়ে বাইরে যাবি?ʼʼ

-“যার ইজ্জত নেই, তার ঈমান নেই। আর ঈমান হলো পোশাক। সেই হিসেবে আমি ল্যাংটাই।ʼʼ

-“তোর যুক্তিরে চুদি আমি, শালি। যা বললাম, কর।ʼʼ

-“যুক্তির সাথে খারাপ কাজ না করে তার প্রেক্ষিতে পাল্টা যুক্তি দিলেও পারেন। ঘরে পরপুরুষ ঢোকানো মেয়েলোক বোরকার মতো সম্মানিত পোশাক পরবে না।ʼʼ

জয় চার আঙুলে অন্তূর গাল চিপে ধরল, “আমার কোনো কর্মে আমার জীবনে আফসোস হয় নাই। তা করানোর চেষ্টা করলে মেরে পুঁতে রেখে যাবো। আমার সামনে দুঃসাহস দেখিয়ে কম ভোগান্তি পোহাসনি। আগে যেভাবে চলতি, সেইরকম চলবি। বোরকা পরে আয়।ʼʼ

-“এটা আমার বাড়ি। আম্মু-ভাবী পাশের ঘরেই আছে। আপনি আমার সাথে এমন করে তাদের কষ্ট দিচ্ছেন। শুধু শুধু আমার ভেতরে জেদ বাড়ছে, কী লাভ?ʼʼ

জয় গাল ছেড়ে গলা চেপে ধরল, দুই হাত দিয়ে। অন্তূর শ্বাসনালি আঁটকে এলো।

জয় বলল, “তোর ভয় লাগে না আমাকে, না? কোনো একদিন একদম শ্বাস আঁটকে মেরে ফেলব, শালীর মেয়ে। আমারে কি বালব্যাটা মনে হয় তোর? আমি আমার মুখের ওপর কথা বলা সহ্য করা ভুলে গেছি বহুবছর। কেউ কথা কয় না, সেই সাহস রাখিনি কারও ভেতরে। তুই বলিস, একমাত্র তুই। ক্যান? তোরে কি বেশি প্রশ্রয় দেই আমি? নয়ত ভয় লাগে না ক্যা তোর আমারে।ʼʼ

অন্তূ কথা বলার প্রয়োজন মনে করল না। জয় নিজে গলা ছেড়ে দিলো। অন্তূর চোখের শিরায় রক্ত উঠে এসেছিল।
জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলল অন্তূ। গলা শুকিয়ে গেছে, পানি খাওয়ার দরকার। অন্তূর বড় দুর্দিন এসেছে। তার আব্বুর ঘরে ঢুকে কেউ তাকে আঘাত করে। কিন্তু অন্তূর কান্না পেল না। অসহায়দের কাঁদতে নেই।

সাদা রঙা একটা সেলোয়ার-কামিজ পরনে, সাদা ধবধবে ওড়না মাথায়-গায়ে জড়িয়ে ফাইইলটা হাতে ধরে বেরিয়ে গেল অন্তূ। গলাটা ব্যথা হবে খুব। কণ্ঠনালিতে চাপ লেগেছে, মাথায় চাপ অনুভূত হচ্ছে।

অন্তূ গলির ভেতরে অনেকটা এগিয়ে গেছিল। জয় বড় বড় পা ফেলে অন্তূর সামনে গিয়ে দাঁড়াল, “পেছনে গাড়ি দাঁড়ায়ে আছে। রাস্তাঘাটে মার খাস না আমার হাতে।ʼʼ

অন্তূ হেসে উঠল, “হুশ! রাস্তাঘাটে দেহব্যবসায়ী হিসেবে কত খ্যাতি অর্জন করেছি কোনো হিসেবে আছে আপনার? চারদিকে তাকান, দেখেছে জানালা-দরজা সবকিছুর ফাঁকে জোড়া জোড়া চোখ আমায় দেখতে মগ্ন। মার খেলে কী?ʼʼ

-“গাড়িত্ যায়ে বসো।ʼʼ

-“হেঁটেই যাব আমরা।ʼʼ

-“রাস্তাঘাটে ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস?ʼʼ

যতদূর পাড়ার রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল, লোকে কেউ কেউ নিজেদের পায়ের কাছে থুতু ফেলছিল। ঘুসুর ঘুসুর করছিল, ‘নষ্টামি করা স্বামী নিয়া দেখো কেমনে ঢ্যাংঢ্যাং কইরা রাস্তায় বাইর হইছে, আর এই জয় ছেড়াডা এত শয়তান.. খাটাশ..ছেড়া…ʼ

বিভিন্ন ধরণের কথা আসছিল। আজ আর শুধু অন্তূকে বলা হয়নি, শুনতে হলো জয়কেও। জয়ের হাত-পায়ে শিরশির করছিল। বেশ কয়েকবার অনিয়ন্ত্রণে চলে গিয়ে আবার সামলে নিলো নিজেকে।

মোড়ের ওপর তারা দুজন দর্শনীয় বস্তু হলো সবার কাছে। লোকে গাড়ি থামিয়ে হলেও তাদেরকে দেখার সুযোগ হাতছাড়া করছে না। করা উচিতও না। ক’দিন আগে জয় আমির নষ্টামি করে ধরা পড়ে এই মেয়েটাকে বিয়ে করেছে। দেখা দরকার। জয়ের ইচ্ছে করল অন্তূকে জবাই করে ফেলতে। তার মনে হলো, এই পরিস্থিতিতে ফেলার জন্যই অন্তূ হেঁটে এসেছে।

অন্তূ একটা রিক্সা ডাকলো, “ভার্সিটির গেইটে নামিয়ে দেবেন।ʼʼ

জয় লাফ মেরে উঠে বলল, “থানার দিকে গাড়ি ঘোরান, মামা।ʼʼ

অন্তূ তাকালো। জয় না তাকিয়েই বলল, “তোমার পরীক্ষা দুপুর দুটোয়।ʼʼ


রাত এগারোটা। কনকনে শীতের রাতে খালি পায়ে মেঝেতে দাঁড়িয়ে থাকা সাহসিকতার ব্যাপার। তরুর ভেতরে আজ সেই সাহস এসেছে। হু হু করে শীতল বাতাস নাকে-মুখে ঢুকছে।

তরু দাঁড়িয়ে রইল বারান্দার গ্রিল ধরে। তুলি ঘরের ভেতরে কোয়েলকে ঘুম পাড়াচ্ছে। জয়ের গান গাইতে গানতে ঢুকল,

—তুমি মা হারা ছেলে জাহানারা ইমামের, একাত্তরের দিনগুলি, তুমি নকশি কাঁথার মাঠের জসিমউদ্দীনের মুঠো মুঠো মাটির ধুলি…

তুলি গম্ভীর মুখে তাকাল, “গান যখন ভুলভাল নিজের মনের মতো গাইবি, তখন নিজে গান বানিয়ে গাইতে পারিস না?ʼʼ

জয় আরও জোরে চ্যাঁচালো, “তুলি, ও তুলি, ও তুলি তুলি তুলিরে, দোলনায় উঠে আমি দুলি, গাছের ওই ডাল ধরে ঝুলি…ʼʼ

তুলি রেগে উঠল, “চিৎকার করলে লাত্থি মারব একটা, বের হ আমার ঘর থেকে। বাবু ঘুমাচ্ছে, যা বের হ।ʼʼ

জয় বারান্দায় গিয়ে তরুর পাশে দাঁড়াল। তরু চমকে উঠল, “কিছু লাগবে আপনার? ডাকলেই হতো আমাকে।ʼʼ

-“শোন তরু! তোকে এমন একটা যোগ্য পাত্রের কাছে বিয়ে দেব, তুই তখন আমায় ভেবে গান গাইবি,

—চলে গেছো তাতে কী, নতুন একটা পেয়েছি, সরকারী চাকরিজীবী।ʼʼ

পোলের আলো এসে অন্ধকার দূর করেছে বারান্দার। সৈ আলোয় তরুর ছলছলে চোখদুটো সজল হয়ে উঠল।

জয় গ্রিলের ওপর একটা ঘুষি মারল, “চোখের মায়ায় বাঁধার চেষ্টা? শীট, শীট ম্যান! বাঁধা পড়ার সিস্টেম নাই ভেতরে।ʼʼ এরপর বাচ্চাদের মতো করে আহ্লাদ করার নাটক করে বলল, “আমি পাখি ঘর বুঝিনা রে…ʼʼ

তরু হাসল, “তবুও ঘর বাঁধলেন, না বুঝেই বাঁধলেন।!ʼʼ

-“ঘর বাঁধিনি। এক জঙলি-বিলাইকে খাঁচায় পুড়ছি, সেইটাও পরিকল্পনাহীনভাবে। তুই দেখিস নাই ওই শালীরে, শালী একদম ফায়ার, দেমাগ দেখলেই ভয় লাগে…ʼʼ

-“আজ দেমাগী না হয়ে হেরে গেলাম নাকি!ʼʼ

-“জিতে গেলি। কারণ তুই আমায় পাসনি।ʼʼ

-“খুব সুন্দরী সে?ʼʼ

-“মানুষ হিসেবে তোর মতো সুন্দর না। শালীর তেজ খুব বেশি।ʼʼ

-“আর রূপ?ʼʼ

-“হ….সুন্দর আছে।ʼʼ

-“আচ্ছা। এত সাফাই গাইতে হবে না। শুনুন, না পেতে পেতে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, আজকাল চেয়ে কিছু পাওয়ার কথা ভাবলেও খুব ভয় লাগে, যেন কোনো অস্বাভাবিকতা তা। ছোট থেকে বাপের আদর পাইনি, মায়ের কোল, আঁচল কিছুই পাইনি। নিজের একটা ঠিকানা পাইনি, হুট করে আপনাকে পেয়ে গেলে সামলাতে পারতাম না। চা খাবেন আপনি? আদা-চা খেতে ইচ্ছে করছে। আমার জন্য বানাতে যাচ্ছি , আপনার জন্য বানাবো?ʼʼ

তরু চলে যায় জয়ের সামনে থেকে। জয় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তুলি এসে বসল পেছনে বেতের মোড়ায়।

আজকাল জয়ের মনেহয়, সে পাপ করে। আগে মনে হয়নি। আগে মনে হতো, ওসব ক্ষমতা। ক্ষমতা আছে, করবেই, এসব তার স্বাধীনতা। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অনুশোচনারও নয়। তরুর প্রতি যে স্নেহ এবং মায়াটা কাজ করে, সেটা খুব জ্বালাতন করছে।

পররক্ষণেই মনে পড়ে, অনুশোচনা হতেই পারে। পাপ বেশি হলে অনুশোচনা হয় মাঝেমধ্যেই, তবে সেটাকে ধরে রেখে পাপ করা থামানো উচিত নয়। হামজা ভাই বলেছে। পাপ জয়ের রক্তকণিকায় মিশে গেছে। তা ছেড়ে দিলে চলবে? এ চলবে, যতদিন না নিঃশ্বাস থামে।

জয় চলে এলো। তুলি অন্ধকারচ্ছন্ন বারান্দার কোণায় বসে থাকে। আজ কতগুলো মাস বাপের বাড়ি এসে পড়ে থাকা মেয়েটার চোখদুটো উদাস। জয়ের সাথে কথা বললে ভালো লাগে। জয় ছাড়া আর কারও সাথে সংলাপ বাড়ে না তার। চাপা স্বভাব। কিন্তু জয়ের ঠ্যাস মারা, কপট কটূক্তিতেও তুলির ভেতরে শান্তি কাজ করে। পাগল জয় ঠ্যাস মারতে মারতে সমস্যাটা শুনে নেয়, এরপর ধমকে উঠে আরেকটা গালি দিয়ে কান্না থামায়। কিন্তু আজ জয় নিজেই অশান্ত, ওকে থামিয়ে নিজের বিষাদ চাপাতে ইচ্ছে করল না তুলির।

রাত দেড়টায় দাবার বোর্ড নিয়ে বসল জয়। অনেকক্ষণ দেখল বোর্ডটাকে। এলোমেলোভাবে ইচ্ছেমতো একেকটা ঘুটিকে আরেকটা দিয়ে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো। হামজা এসে বসে পাশে। জয় না তাকিয়ে হেসে উঠল, “বউ রেখে আমার কাছে আসছো রাত দুপুরে। মতলব তো ভালো ঠেকে না।ʼʼ

হামজা কষে একটা ঘুষি মারল বাহুতে। বোর্ডটা ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। ঘুটি সাজাতে সাজাতে হঠাৎ-ই স্বর বদলে বলল, “সব সয়, বদনামি ছাড়া। সেটাই কানে আসছে তোর বদৌলতে। তোকে কী করা যায়, তুই বল।ʼʼ

-“কোথায় শুনলে বদনামি?ʼʼ

-“আরমিণ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে দশ গ্রামে।ʼʼ

জয় ভ্রু কুঁচকায়। আজ যে সে তা নিজে প্রত্যক্ষ করেছে, সেটা চেপে গিয়ে বলে, “কোন খা-ন-কির চেংরা কী বলে বেড়াচ্ছে? ওই বাড়িতে আছে, লোকে কথা শোনাচ্ছে। এই বাড়ি আসলে তো আর কোনো শুয়োরের বাচ্চার সাহস হবে না কথা শোনানোর! সামনের শুক্রবার তুলে আনতেছি…এরপর দেখব কোন সম্বন্ধির পোলার পেছন চুলকায়.. ʼʼ

-“শিওর!ʼʼ

-“হ। আমি দেখবার চাই, কোন বা-ই-ঞ্চ-দে-র জয় আমিরের ঘরের বউকে কথা শোনানোর হিম্মত হয়। আমি জাস্ট এইটা দেখার জন্য হলেও তুলে আনবো। ওই বাড়ি, চেংরী শালী পড়ে আছে, কথা তো শুনবেই। এইডা তো আমার দোষ না। কিন্তু সমস্যা হলো, লোকজন খুব উড়াউড়ি করতেছে। আচ্ছা, আমি কি মরে গেছি? এরা আমায় আজকাল পাত্তা দিচ্ছেনা। যা তা করে বেড়াচ্ছে। আর আমিও সহ্য করে যাচ্ছি। ঠিক করতেছি? শ্যাহ! লোক দামই দিচ্ছেনা আজকাল।ʼʼ

হামজা ঘরে ঢুকল। রিমি হামজার পাঞ্জাবী ইস্ত্রি করছিল। অলস ভঙ্গিতে বিছানায় শুয়ে বলল, “তোমার ভাই-চাচারা হাত-পা ধুয়ে আমার পিছনে লেগেছে। শ্বশুরবাড়ির লোকের সাথে দ্বন্দ করতেই যদি দিন যায়, আর সব পার্টি সামলাবো কখন?ʼʼ

রিমি হাত থামিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল হামজার দিকে। তখনই তড়াক করে উঠে বসে হামজা, রিমির হাত থেকে ইস্ত্রি কেড়ে নিয়ে কপাল টান করে, “পাঞ্জাবী পোড়াবে? এত বেখেয়ালী হয়েছ কবে?ʼʼ

চলবে..
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩২.

মার্জিয়ার শরীরে দিনদিন গর্ভাবস্থার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, শরীরটা অসুস্থও হচ্ছে ঘনঘন। ডাক্তার দেখিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাস্তার মোড়ে রিক্সা নামিয়ে দেবার পর হাঁটতে হাঁটতে মার্জিয়া আনমনেই বলল, “বোরকা ছাড়া তোমাকে দেখতে একটুও ভাল্লাগে না, অন্তূ।ʼʼ

-“জয় আমির কী বলে জানেন? ‘আমার খুব ভালো লাগে, যখন কারও আমাকে ভালো লাগে না।ʼ কথাটার মর্ম আছে, তাই না?ʼʼ

-“তোমারও কি তাই? মানে আমার এখন তোমাকে দেখতে ভাল্লাগতেছে না, এইটা তোমার ভাল্লাগতেছে?ʼʼ

অন্তূ অল্প হাসল, “চরিত্রহীনদের বোরকা পরতে নেই, ভাবী।ʼʼ
মার্জিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, “তাহলে ওই জানোয়ারের কথা বলবা না আমার সামনে। হইতে পারে তোমার স্বামী। কিন্তু আমার শ্বশুর একটা কথা বলতো, ‘গু এর এপিঠ-ওপিঠ সমান। তা খোঁচাতে গেলে তুমি নিজেই নাপাক হবে, ছিটে তোমার গায়ে লাগবে, তাতে তোর শরীর নোংরা হবে, এতে গু-এর কি কোনো ক্ষতি আছে?ʼ তুমি কী করতে চাও বলো তো? তোমার কিছুই বুঝি না আমি।ʼʼ

-“কিছুই করতে চাই না। কিছু না করতে চাওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় করতে চাওয়ার বিষয় আমার।ʼʼ

মার্জিয়া ক্যাটক্যাট করে উঠল, “আবার শুরু করলা? বলছি না, তোমার এসব হেঁয়ালি কথা শুনলে রাগ হয় আমার? সহজভাবে কথা বলবা আমার সাথে।ʼʼ

-“কঠিনের কী আছে? আপনাদের সমস্যা আমার বোরকা না পরা নিয়ে। আম্মু এজন্য কথা বলে না আমার সাথে।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ কিছুটা দূর হেঁটে হঠাৎ-ই বলতে লাগল, “আপনি ছিলেন না সেদিন। আমার গায়ে থুতু পড়েছিল মানুষের ছুঁড়ে দেয়া। কেন জানেন? পুরুষ ঘরে ঢুকিয়ে কাপড় খোলার অপরাধে। শুনতে খারাপ লাগছে? আরও খারাপ কথা শুনুন। টেনে হিচড়ে খুলে ফেলা হয়েছিল আমার বুক থেকে ওড়নার পর্দা। মাথায় জড়ানো গামছাটা কেঁড়ে নিয়ে চুলগুলোকে আলগা করে ফেলা হয়ছিল। এই সুন্দর যাত্রাপালার দর্শক ছিল সেদিন হিউজ পরিমাণ। কিছু বলবেন?ʼʼ

মার্জিয়ার হাঁটার গতি কমে যায়। অন্তূ নিঃসংকোচে, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “ওড়না ছাড়া আমাকে অতগুলো দর্শক দেখলো, চোখের তৃষ্ণা মেটালো, নোংরামি করে ধরা পড়ার দ্বায়ে বিয়ে দিয়ে দিলো নাংয়ের সাথে। এরপর সেই শরীরে বোরকা জড়ানো, মুখ ঢাকাটা পাগলামী হবে না?ʼʼ

মার্জিয়া তাকিয়ে রইল অন্তূর দিকে। অন্তূ সাবধান করল, “সামনে তাকিয়ে হাঁটুন, হোঁচট খাবেন।ʼʼ

বাড়ির গলি সামনেই, আর কয়েক পা এগোতে হবে। রাস্তায় লোক নেই। ওদের পার করে একটা গাড়ি গিয়ে থামল সামনে। ওরা দুজন হেঁটে গাড়িটা পার করে এগিয়ে যাওয়ার সময় কেউ ডাকল, “শোনো!ʼʼ

অন্তূর বুকটা ধুক করে ওঠে। প্রখর মস্তিষ্কে কণ্ঠস্বরটা চাপ ফেলল। এই কণ্ঠ চেনে অন্তূ। ফিরে তাকায়। হুডির টুপি মাথায় পলাশের। মার্জিয়া জানতে চায়, “কে এইটা, অন্তূ? চেনো তুমি? এইটা জয়ের বড় ভাই নাকি?ʼʼ

অন্তূ জবাব না দিয়ে ভাবীর হাতখানা চেপে ধরল। পলাশ আজগর এগিয়ে আসে, ঠোঁটে লেগে আছে স্থায়ী সেই হাসি।

অন্তূ শুধায়, “ভালো আছেন?ʼʼ

পলাশ হেসে উঠল, “তোমাদের ওখানেই যাচ্ছিলাম। সেই কবে থানা থেকে আসলাম, এরপর আর খোঁজ নাই। অন্যসব লোকের এতদিনে বউ, বাচ্চাসহ সব চলে যায়। তোমাদের সাথে কিছুই করলাম না তেমন। আগের সব ঋণকারীদির সাথে না-ইনসাফি হয়ে যাবে। দেখা যাবে, ওরা অভিযোগ তুলবে, ওদের সাথে যা হয়েছে, তোমাদের সাথে নয় কেন? ঠিক বলিনি?ʼʼ

-“হ্যা ঠিক বলেছেন। আসলেই আমাদের এত সুযোগ দিয়ে ঠিক করেননি। আমরাও ঋণী, ওরাও ঋণী। ওরা যদি এতকিছু হারায়, এত অত্যাচারিত হয়, আমরা কেন না?ʼʼ

পলাশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “চলো, গাড়িতে ওঠো। একসাথে যাই।ʼʼ

অন্তূ মার্জিয়াকে বলল, “ভাবী আপনি চলে যান এটুকু। আমি আসছি খানিক বাদে।ʼʼ

পলাশকে বলল, “বাড়িতে গিয়েও আমার সঙ্গেই কথা বলবেন। চলুন আশপাশেই কোথাও বসে কথা বলি। ভাবী, আপনি বাড়িতে চলে যান। আমি আসছি।ʼʼ

এটাই পলাশ আজগর। মুখরা, বদমেজাজী মার্জিয়া একদম মিইয়ে গেছিল। ভয়াতুর চোখে অন্তূর দিকে চেয়েছিল। অন্তূ চোখে আশ্বাস দিয়ে বলল, “যান। কিচ্ছু হবে না আমার। এটুকু ভরসা রেখেছি নিজের ওপর। আম্মাকে বলবেন, ওষুধ কিনতে গেছি। আপনার অসুস্থ লাগছিল, আগে ফিরেছেন। আমি চলে আসব, ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ।ʼʼ

মার্জিয়া যেতে যেতে বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল। পলাশ অন্তূকে বলল, “আচ্ছা তোমার বাড়িতে আজ আপাতত গেলাম না। গাড়িতে ওঠো। অন্য কোথাও যাই।ʼ†

-“পায়ে হেঁটে যাই চলুন। একটু হাঁটাও হবে। সন্ধ্যার রাস্তায় হাঁটতে খারাপ লাগবে না।ʼʼ

পলাশ ভ্রু কুঁচকে ঠোঁটদুটো একপাশে বাঁকিয়ে হাসছিল। অন্তূর ভেতরে ধুকপুক করছে। মস্তিষ্ক সেই আতঙ্ক ভুলতে পারেনি। পলাশ যে কফিশপে নিয়ে গেল, কফিশপ হিসেবে বেশ লাক্সারিয়াস। ভেতরের আলোকসজ্জা ডার্ক। পলাশকে দেখে ম্যানেজার দৌড়ে এসে সালাম দেয়। অন্তূ বুঝল, কফিশপটা পলাশের নিজস্ব।

পলাশ গা ছেড়ে দিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। অন্তূ চারপাশে তাকাচ্ছিল। লোকজন নেই। ভেতরের পরিবেশটা তৈরি করা হয়েছে আলো আঁধারের সংমিশ্রণে। টেবিলের ওপর তিনটে গ্লাস, একটাতে টিস্যু রাখা। একটা পানির বোতল, আর একটা কাঁচের ফুলদানি।

-“ভয় পাচ্ছ?ʼʼ

অন্তূ উপর-নিচ ঘাঁড় নাড়ল, “পাচ্ছি।ʼʼ

পলাশ হো হো করে হাসল, “প্রয়োজন নেই। বসে পড়ো। পাবলিক প্লেসে দুষ্টুমি করার ক্লাস পেরিয়ে এসেছি বহুদিন আগে। ছোট বয়সে ওসব করতাম। যাকে তোমরা ভদ্রলোকেরা বলো, ওই বখাটেপনা। পাবলিকের সামনে খেলি দেখানোটা প্রাথমিক ছাত্রদের কাজ, আমি হাইস্কুলের মাস্টার।ʼʼ

অন্তূ পলাশকে যতবার, যতক্ষণ দেখেছে, ততবার ততক্ষণ পলাশের ঠোঁটে হাসি আর জ্বলজ্বলে চোখদুটোয় ভয়ানক এক ইশারা খেলতে দেখেছে। পলাশ কফি আনতে বলল একটা ছেলেকে।

-“আপনার টাকা দু’দিনের মধ্যে দিয়ে দেব। আপনি ছাড়াও আরও কিছু পাওনাদার আছে। জমি বিক্রি করতে হবে। জমি নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো মীমাংসা হচ্ছে না বিধায় দেরি হচ্ছে। এর মাঝে আব্বুর ইন্তেকাল হলো। আমি আপনার কাছে দু’দিন সময় চাইছি। এবার আমি সময় নিচ্ছি।ʼʼ

-“তোমার বাবা মারা গেছে? ইন্না লিল্লাহ।ʼʼ

পলাশ দুঃখিত হওয়ার নাটক করল। অন্তূর শরীরকে বেশ কিছুক্ষণ চোখে গিলে হাসি প্রসারিত করে বলল, “সুন্দর একটা ঘ্রাণ পাচ্ছি, তোমার শরীর থেকে আসছে বোধহয়।ʼʼ

অন্তূ তাকাল, “আমি কোনো সুগন্ধি ব্যবহার করিনি।ʼʼ

হা হা করে হেসে ওঠে পলাশ, “গরু মরলে শকুন খোঁজ পায় কীভাবে? গরু মরার আগে সুগন্ধি মেখে মরে? মেয়েদের শরীরের নিজস্ব একটা ঘ্রাণ আছে, তার তুলনা বিশ্বের কোনো পারফিউমের সাথে হয় না।ʼʼ

অন্তূর শরীরটা ঝাঁকি দিয়েছ উঠল। জীবন তাকে কোন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তা এখনও বুঝে ওঠা যাচ্ছে না।

পলাশ গা ছেড়ে আরাম করে বসে ঘাঁড় বেঁকিয়ে বলল, ভাবছি, “তোমার পাশে গিয়ে বসলে গন্ধটা আরও ভালো পাওয়া যাবে। তাছাড়া খালি খালি চেয়ার ফাঁকা রয়েছে তোমার পাশেরটা।ʼʼ

অন্তূর দৃষ্টি টেবিলের দিকে ছিল। মুচকি হেসে ফেলল, “শুধু ভাবছেন? এতটাও আশা করিনি আপনার কাছে। আপনার এতক্ষণে বসে পড়ার কথা ছিল। আপনার সাথে ব্যাপারটা মানায়।ʼʼ

পলাশ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে অন্তূর দিকে ঝুঁকে আসে। চোখের পলকে অন্তূ টেবিলের উপরে থাকা কাঁচের ফুলদানিটা তুলে কাঠের চেয়ারে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে ফুলদানি ভেঙে তিন টুকরো। হাতে থাকা টুকরোটাপলাশের গলায় উঁচু হয়ে থাকা স্বরনালীর ওপরে ধরল।

পলাশ চমকে গিয়ে ঝুঁকে পড়া থেকে সোজা হলে অন্তূ উঠে দাঁড়াল। ভাঙা কাঁচের চাপে পলাশের গলার চামড়ায় ছেঁদ পড়ে, কয়েক বিন্দু রক্ত বেরিয়ে আসে।

-“ভুললে চলবে, সেদিন কোনোরকমে আপনার ডেরায় ছিলাম, আজ পাবলিক প্লেসে। জবাই করে রেখে যাব একদম। তারপর মরার পর যা করার করবেন আমার।

জয় আমির আর আপনার মধ্যে ফারাক একটাই—জয় বেঁচে থাকা নিয়ে খুব বিরক্ত, মৃত্যুকে বোধহয় খুব একটা ভয় পায় না। কিন্তু আপনি মৃত্যুকে খুব ভয় পান।ʼʼ

অন্তূ কাঁচের টুকরো ফেলে দিলো ছুঁড়ে। ফ্লোরে পড়ে খানখান হয়ে গেল। অন্তূ বসে পড়ে চেয়ারে। পলাশ ধীরে ধীরে দু-কদম পেছায়। টেবিলের উপর থেকে টিস্যু নিয়ে গলার রক্তটুকু মুছে নেয়ার সময় মুখ বিকৃত করে। আচমকা রেস্তোরা কাঁপিয়ে তোলে পলাশের ফেটে পড়া অট্টহাসির শব্দ। বাচ্চাদের মতো হাতে তালি দিলো পলাশ, “মাইন্ড ব্লোয়িং!ʼʼ

আবারও হাসে হা হা করে। চেয়ারে বসে পড়ে ধপ করে। দৃষ্টি স্থির অন্তূর ওপর, “আমি ভাবতেছিলাম। আমি সত্যিই খুব হয়রান ছিলাম, জয় কাত হলো কীসে? তুমি জানো? মানুষ যেমন ঠোঁটের সিগারেট কেঁড়ে নেয়, ও সেভাবে মেয়ে ভাগাভাগি করেছে আমার সাথে। আর ও তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেল সেদিন আমার সাথে ঝামেলা করে। অথচ ও আমায় চেনে। কিন্তু তুমি সেদিন যেভাবে কাঁদছিলে, ছেঃ! আর পাঁচটা মেয়ের মতো লেগেছিল। মাগার এরপর একটা চমক, ‘থুহ!ʼ সোজা জয়ের মুখে। আমি খুব ভেবেছি, আমার বউকেও বলেছি তোমার কথা।ʼʼ

পলাশ চট করে থামল। কিছুক্ষণ চেয়ে রইল ধুম ধরে চুপচাপ। কিছু মনে পড়েছে যেন, এভাবে তুড়ি বাজালো, “ওয়েট! আসছি। এক মিনিট।ʼʼ

হাই-কমিশন ব্রান্ডের, ব্যালেন্ডেড স্কট্চ উইস্কি মদের বোতল নিয়ে ফিরল। গলগল করে গ্লাসে ঢেলে তাতে চুমুক দেবার আগে বলল, “নেবে এক সিপ?ʼʼ

অন্তূ মাথা নাড়ল, “উহু।ʼʼ

চোখ বুজে পুরো এক শট শেষ করে গ্লাস টেবিলে রেখে বলল, “এবার কথায় এনার্জ আসবে। তোমাকে সেদিন একদম সাধারণ লেগেছিল। শিট! হতাশ আমি নিজের ভাবনায়।ʼʼ

উঠে যেতে যেতে বলল, “জয় যেমনই হোক, ওর রুচি ভালো এটা আমি জানতাম। বড় বংশের ছেলে তো! আজ প্রমাণ হলো আর একবার।ʼʼ

একটা ট্রে এনে বসল আবার। তা থেকে এক টুকরো আদা, কয়েকটা পুদিনা পাতা, সোডার কৌটা থেকে খানিকটা সোডা, দু টুকরো লেবু, দুই চামচ চিনি দিয়ে তাতে উইস্কি ঢাললো। দুই চুমুক খেয়ে বলল, “বারবার ভালো লেগে যাচ্ছে তোমাকে। আমার বউ না থাকলে একটা চান্স নিতাম তোমার ওপর। তোমাদেরকে একরাত পর ছেড়ে দেয়া যায় না, বুঝলে! রেখে দেবার মতো, তুমি। কিন্তু আমি আমার বউকে খুব ভালোবাসি।ʼʼ

-“আসলেই। বোঝা যায়। অনেক বেশি ভালোবাসেন আপনার স্ত্রীকে আপনি।ʼʼ

-“তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কী?ʼʼ

-“বুঝি না।ʼʼ

অন্তূর দিকে কফি এগিয়ে দিয়ে বলল, আমার সমস্যা কী জানো? আমাকে ভয় পাওয়া লোকের তো অভাব নেই, সেসবের ভিড়ে ব্যতিক্রম হিসেবে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা কারও সামনে খুব কাবু হয়ে যাই। দুনিয়ার খারাপ মানুষের আরেকটা স্বভাব আছে। এরা ভালো মানুষের ওপর খুব সহজে পিছলা খায়। একে বলে বিপরীতে আকর্ষণ বোধ করা। পজিটিভ-নেগেটিভ তারের মতো ব্যাপার আর কী! বুঝছো?ʼʼ গা দুলিয়ে হাসল পলাশ।

সাধারণ দেখতে লোকটা। কোনো জাকজমকতা নেই। অভিজাত্য আছে, তবে তা প্রকাশের যেন তাগিদ নেই ভেতরে। হুডির টুপি নামানো। নকশালদের মতো অস্বাভাবিক লম্বা কাঠামো। জ্বলজ্বলে চোখের মাঝ দিয়ে খিলানের মতো নাক। হাসলে গা ছমছম করে ওঠে। অথচ সারাক্ষণ হাসে ঠোঁটদুটো।

পলাশ জিজ্ঞেস করল, “আর তো কথাই বলছো না? শুধু কি টাকার জন্য এখানে এনেছি তোমাকে? তুমি চাইলে এই মুহুর্তে টাকা সব মওকুফ করে উল্টো আমি তোমাকে টাকা দিতে পারি।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ বসে রইল। মাথাটা ফাঁকা লাগছে। উঠে যাবার জন্য পা চলছে না।

-“আচ্ছা, আর কী কী পর্যবেক্ষণ করেছ আমার? বলো শুনি। তোমার কথা শুনতে খারাপ লাগছে না। শ্যাহ! গলার কাছে জ্বলছে, এই একটা কাজ করলে?ʼʼ

অন্তূ বলল, “এখনও তেমন কিছুই জানা হয়নি। সাধারণ জ্ঞান দিয়ে বিচার করতে জানাশোনার দরকার পড়ে না। যা পর্যবেক্ষণ একদিনেই করেছি।ʼʼ

পলাশ আবারও ঝুঁকে পড়ে অন্তূর কানে ফিসফিস করে বলল, “তোমার পর্যবেক্ষণ আর আমার অভিজ্ঞতা, তোমার মানুষ খুন করার ইচ্ছা–বিদ্রোহ আর আমার পেশা। চলো এই নিয়ে একটা সিন্যামাটিক খেলা খেলা যাক।ʼʼ

ম্যানেজার এসে পলাশের হাতে একটা ইনটেক্ট মদের বোতল ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। পলাশ হিপফ্লাস্কে মদ ঢেলে নিতে নিতে বলে, “তোমার পেছনে আমার লোক পড়ে থাকবে। আমার আদেশেই থাকবে। ছেড়ে তো দিতে পারি না তোমাকে। বিন্দু জলের মতো বহুদূর গড়াবে তুমি, যা বুঝলাম। তুমি আজকের মতো শিউরে উঠে যতদিন বাঁচতে পারবে, ততদিন খেলা তোমার। কিন্তু হারলে দামী মূল্য চেয়ে নেব আমি।ʼʼ

-“আমি কোনো খেলা খেলছি না যদিও। আপনি আমার ভাইয়ের পাওনাদার। ভাই অপারগ টাকা পরিশোধ করতে, তাই তা আমার জিম্মায়। তবুও যদি ধরুন, আমি জিতে যাই…ʼʼ

পলাশ হুডির টুপি মাথায় তুলল, “কী চাও?ʼʼ

-“তখন চেয়ে নেব।ʼʼ

পলাশ মাথা দুলিয়ে হাসে, “সাবধানে থেকো। আসছি, খোদা হাফেজ।ʼʼ কপালে তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল ঠেকিয়ে সালাম জানানোর ভঙ্গিমায় ইশারা করে মদের বোতলটা হাতে ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “রুবেল! ম্যাডামকে কফি না খাইয়ে যেতে দিস না।ʼʼ


সোমবার বিকেল চারটা। ছাঁদের ওপর পাশের বাড়ির পুঁচকে ছেলের ঘুড়ি এসেছিল। তখন জয় কবুতরকে দানা খাওয়াচ্ছিল। ঘুড়িটা ছাদে পড়তেই ধরেছে। তা তো পুঁচকেটাকে ফেরত দেয়-ইনি, লাটাইটা অবধি জোর করে কেঁড়ে নিয়ে সে এখন নিজে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সাদা লুঙ্গিটা দুপাশ থেকে এনে দুই ঠ্যাঙের মাঝে আঁটকে রেখেছে। খালি গায়ে গলায় লাল টকটকে চওড়া গামছা ঝুলছে। কিন্তু লুঙ্গি-গামছার সাথে পায়ে কালো চামড়ার বেল্টওয়ালা ফ্ল্যাট স্যান্ডেল। এটা এক অসঙ্গতি, তার ওপর আবার চামড়ার স্যান্ডেলটার বেল্ট খোলা।

দুর্দান্ত উড়ছে ঘুড়িটা। পুঁচকে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। জয়ের ভয়ে জোরে কাঁদার উপায় নেই। জয় বলে দিয়েছে, “কান্নার সাউন্ড কানে আসলে এখনই ধরে একদম দা দিয়ে কোপ মেরে সুন্নতে খৎনা করে দেবো।ʼʼ

পুঁচকে এমন ভয়ানক রিস্ক নেয়নি। সে নিঃশব্দে ফোপাচ্ছে, আর দেখছে নিজের ঘুড়িটা জয় কীভাবে হানাদার বাহিনীর মতো দখল করে উড়াচ্ছে। জয় জিজ্ঞেস করল, “তোর ঘুড়ির দাম কত রে?ʼʼ

-“কাগজ কিনে বানাইছি। তুমি আমার ঘুড়ি দাও।ʼʼ

-“তোতলু শালা, সেই কাগজ তো আর তোর রূপ দেখে দেয় নাই দোকানদার। যে ফটকা মারা সুরত তোর। কাগজের দামই ক হে।ʼʼ

-“ছয় টাকা।ʼʼ

-“তোর বোন আছে?ʼʼ

-“বিয়ে হয়ে গেছে।ʼʼ

-“শিট! আমি মানুষ খারাপ হলেও লোক ভালো। ভাবলাম, তোর বোনকে জ্বালানোর দামে তোর ঘুড়িটা ফিরিয়ে দেব। সেই বালিতে গুড়। মাইনষের এঁটোতে মিছেমিছিও মুখ রোচেনা আমার। বিয়ে দিবি ভালো কথা, আর ক’দিন পরে দিলেই আজ ঘুড়িটা ফেরত পেয়ে যাইতি।ʼʼ

-“এএঅ্যা! আমার ঘুড়ি দাও।ʼʼ

-“ওয়েট! ওই শালা তোতলু, তোরে আমি জিগাইছি, তোর বোন আছে কিনা? তুই ‘বিয়ে হয়ে গেছেʼ কইলি ক্যা? বিয়ের প্রস্তাব দিছি আমি? তুলে মারব এক আঁছাড়?ʼʼ

ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল পুঁচকে। জয় ঠোঁট কামড়ে থাপ্পড় তুলে শাসালো, “চুপ কর! এত বিশ্রীভাবে কেউ কাঁদে? হারুনফাটার মতো গলা নিয়ে কাঁদিস ক্যান, বোয়াল? যার কণ্ঠ ভালো না, তার উচিত জীবনে না কাঁদা।ʼʼ

নিচে থেকে কবীরের চ্যাঁচানো শোনা যায়, “ভাই, নামেন। আইছি।ʼʼ

-“তো কী? নাচবো একচোট? আইছিস, দাঁড়া। পায়ে মরিচা ধরছে?ʼʼ

ঘুড়ির সুঁতো লাটাইয়ে পেঁচিয়ে তা ছুড়ে দিয়ে বলল, “তোতলু, ধর তোর ঘুড়ি। আজ প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি, তোর ওই বিশ্রী কান্নার অভিশাপ সাথে করে গেলে, দেখা গেল গাড়ি উল্টে মরে পড়ে রইলাম। শ্বশুরবাড়ি তো যাওয়া হবেই না। জীবনে বাসর না করেই ম্যারিড-ব্যাচেলর অবস্থায় মরা লাগবে। বাসর না করে মরা ঠিক না। কতকাল স্ট্রিটফুড খাবো? এবার লিগ্যালি ঘরের খাবার খেয়ে মরব।ʼʼ

চলবে..

[পর্বটিতে অপ্রীতিকর ভাষা রয়েছে। এমনকি পুরো গল্পেই এমন অসংখ্য স্ল্যাং এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি রয়েছে, পড়ার আগে নিজেদের তৈরি করে নেবেন সবকিছু মেনে নিতে পারার মতো করে। নয়ত না পড়ার অনুরোধ রইল। ]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩৩.

গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কবীরকে জিজ্ঞেস করল, “জামাই জামাই লাগতেছে আমায়?ʼʼ

কবীর মুচকি হাসল। রাবেয়া দরজা খুলতেই সালাম দেয় জয়, “ভালো আছেন, আন্টি?ʼʼ জুতো পরেই ঢুকে পড়ল ভেতরে।

রাবেয়া কথা বললেন না। তার মুখে কালবৈশাখীর মেঘ জমেছে। জয় ঢুকল। হাতের মিষ্টিগুলো হাতে না দিয়ে নিজেই ভেতরে এগিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। কমপক্ষে পাঁচ-সাত কিলো মিষ্টি। পেছন ফিরে ঠোঁট কামড়ে হাসল, “সবাই স্বার্থপর, দেখেছেন? স্বার্থের কাছে সম্পর্ক, স্নেহ, আদর, আচরণসহ সব বদলে যায়, জীবনও। এর আগেরবার এসেছিলাম, আপনি আপনাকে ‘আম্মাʼ ডাকতে বলেছিলেন। কারণ আমি এতিম, খুব মায়া হয়েছিল আপনার। এর মাঝে আপনার কিছু ক্ষতি করেছি, আজ জবাবই দিচ্ছেন না। সুযোগ হলে জুতো তুলতেন আমার মুখে। অথচ আজও কিন্তু আমি সেই এতিমই আছি, নাকি বাপ মা বেঁচে উঠেছে আমার? এমন কেউ নেই দুনিয়ায় যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। এইজন্য আমার মানুষকে ভালো লাগে, তারা সচেতন খুব, বোকা না। আপনাকেও ভালো লাগছে।ʼʼ

বিকৃত মস্তিষ্কের জয়। তার যুক্তি ও ধারণা মানুষ সমাজে তুলে ধরার উপযোগী নয়। যার কাছে পাপকে পাপ মনে হয়না, সে পাপ এবং পাপীর ঊর্ধ্বে। আশপাশ দেখে জিজ্ঞেস করল, “অন্তিক আছে?ʼʼ

রাবেয়া কথা বললেন না। উনাক দেখে যতটা নিরুপায় লাগছিল, তার চেয়ে বেশি দৃশ্যমান চোখের তারায় জয়ের জন্য ঘৃণা।

জয় ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাতদুটো মাথার ওপরে তুলে শরীর বাঁকালো, “আচ্ছা, আপনিই ওকে জানিয়ে দেবেন। আমাকে আবার খুব ঘেন্না-টেন্না করে নিশ্চয়ই! আমি আবার আমার হেটার্সদের সামনে বেশি ঘুরঘুর করি। তখন মানুষ কটমটায়, কিন্তু সাহসে জোটে না কিছু বলার। তখন নিজের শক্তিকে অনুভব করি। তখন আবার একবার বুঝি, আমি শক্তিশালী। ভালো না ব্যাপারটা?ʼʼ

অসভ্যর মতো অল্প হেসে সিরিয়াস হলো, ”কাহিনি হচ্ছে, আমাদের বাড়ির বউয়েরা বাপের বাড়ি পড়ে থাকেনা। শুক্রবার আরমিণকে তুলে নিতে আসব। এখানে তেমন কিছু করতে হবেনা। খুব বেশি লোক আসবে না বরযাত্রী হয়ে। যাদের না বললেই না, টুকটাক ভাই-ব্রাদার আসবে কয়েকজন। বিশ-পঁচিশ জনের মতো। আপনাদের কোনো ঝামেলা করতে হবেনা। বৃহস্পতিবার বাজার পাঠিয়ে দেব। সকালে বাবুর্চি চলে আসবে। টুকটাক সহযোগীতা করলে ওরাই সব করে ফেলবে।ʼʼ

রাবেয়ার চোখে-মুখের বিরূপতা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেল ভেতরের দিকে। ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়াল। পলাশের কাছ থেকে ফিরে একগাদা কাপড়-চোপড় ভাঁজ করতে লেগেছে অন্তূ। পেছন ফিরে ছিল। জয় ঠোঁটদুটো ফাঁক করে একটা ঢোক গিলল। নিয়ন্ত্রণহীন চোখদুটো মাথা থেকে পা অবধি স্ক্যান করে অন্তূকে। ঠোঁট কাঁমড়ে সামান্য হেসে ডাকল, “ঘরওয়ালি!ʼʼ

অন্তূ পিছনে তাকায়। নির্বিকার, নির্লিপ্ত চাহনি। পুনরায় নিজের কাছে মনোযোগ দেয়। জয় হেলেদুলে হেঁটে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। ডাকটা শনতে এমন লাগে, “আরমেইণ!ʼʼ
অন্তূ জবাব দেয়না। গলা উঁচিয়ে বলে জয়, “সেদিন ঢোকার সময় তেমন একটা খেয়াল করিনাই। এইসব পড়ে থাকা জমি তোমার বাপের নাকি? হলে অন্ততপক্ষে দত্তরটা ভালো পাবো। তোমাকে বিয়ে করার কিছু তো বেনিফিট হবে!ʼʼ

ফোন ভাইব্রেট হচ্ছিল, নাক-মুখ কুঁচকে রিসিভ করল, “ক সম্বন্ধির পোলা! তোর বউ মরার সংবাদ দিলে একটা ললিপপ খাওয়াবো।ʼʼ

রাহাত মিনমিন করে বলল, “ভাই, আমার তো বউ নাই। কিন্তু আপনার বউ মানে ভাবীজানরে নিয়া কিছু বলার জন্য কল দিছি।ʼʼ

জয় জবাব না দিয়ে শিষ বাজালো দু’বার।

-“আপনি কি গেছেন শ্বশুরবাড়ি? ভাবী বাসায় পৌছাইছে?ʼʼ

জয় চুপচাপ কলটা কেটে দিলো। রুমে এসে অন্তূর বিছানার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল জুতো পরা অবস্থায়। পাশেই বসে অন্তূ মনোযোগ দিয়ে কাপড় ভাঁজ করছে। চোখদুটো বুজে শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গেছিলে?ʼʼ

-“ভাবীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছিলাম।ʼʼ

-“আর কোথাও যাওনি কেন?ʼʼ

-“পলাশের সাথে কফিশপে গেছিলাম।ʼʼ

জয় চোখ বুজেই হাসল নিঃশব্দে। হাসিমুখে বলল, “কেন? সেদিন তোমায় মারা খাওয়া থেকে আমি বাঁচিয়েছি বলে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না? দড়ি ছিঁড়ে মারা খেতে গেছিলে? নাকি পলাশ যা করতে গিয়েও ছেড়ে দিয়েছিল সেদিন, তার বাকিটুকু উপভোগ করতে গেছিলে?ʼʼ

এমন একটা অশিষ্ট, নোংরা কথায়ও বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হলো না অন্তূর মাঝে। যেন সে অতি-স্বাভাবিক কিছুই শুনছে মাত্র। অল্প হাসল, “সবার চরিত্র তো আর আপনার মতো ময়লা, দুর্গন্ধে জড়ানো না। আপনার আর আমার কোনো তুলনা হয়? আপনি হলেন নর্দমায় জন্মানো পতঙ্গ, আমি মনেহয় অত খারাপ না। ঠিক না?ʼʼ

জয় সম্মতি জানালো, “ঠিক। তবে একদিনেই আমার সব পড়ে ফেলবে? নিজেকে লিখতে বহুবছর লাগিয়েছি আমি। একদিনে গড়িনি নিজেকে, অথচ তুমি আয়ত্ত্ব খুব দ্রুত করে ফেলছো আমায়। নট ফেয়ার, ঘরওয়ালি!ʼʼ

অন্তূর মন বিদ্রোহ করে ওঠে, ‘আপনার মতো নিচু মানের উপন্যাস পড়ার আমার রুচি কোথায়, জয় আমির?ʼ কথাগুলো চেপে জিজ্ঞেস করল, “মহাভারত পড়েছেন?ʼʼ

-“পুরোটা পড়িনি।ʼʼ

-“শকুনি মামা নিশ্চয়ই আপনার খুব প্রিয়?ʼʼ

-“দুর্যোধনকেও ভালো লেগেছিল।ʼʼ

-“স্বাভাবিক।ʼʼ

-“হু, আসল কথা বলো।ʼʼ

-“শকুনি মামা বলেছিলেন, ‘সুগন্ধ, দুর্গন্ধ এবং মানুষের স্বভাব কখনও লুকায়িত থাকেনা।ʼ অর্থাৎ এগুলো আবিষ্কার করার জন্য বেশি খাটুনি করার প্রয়োজন নেই। যার কাছে যা নেই, সে তার মর্যাদা বা কুফল কিছুই বোঝেনা। একজন সম্মানী ব্যক্তি আরেকজনের সম্মানকে খেলার বস্তু মনে করবে কোন দুঃখে? যার চরিত্র ভালো, সে অন্যকারও চরিত্রকে বাজারে তুলতে পারে?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “পারেনা। কথা ঠিক, আমার সম্মান নেই, আমি তোর সম্মানের মর্যাদা বুঝিনা, ভবিষ্যতে বোঝার কোনো সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু এখন তোর ভণ্ডামি তোর কাছে রাখ। পলাশ, মুস্তাকিনের সাথে নির্জনে সাক্ষাৎ করে আমার সামনে তোর সন্ন্যাসী সাজার চেষ্টা খুবই ভালো লাগছে আমার। তবুও এই ধরণের বালের প্যাচাল এখানেই থামা, নয়ত বালিশ চাপা দিয়ে খু-ন করে রেখে যাব। তোর লেকচার আমার কোনোকালেই ভালো লাগেনা। বউ মারা ভালো কাজ, কিন্তু ভালো কাজ আমি করিনা। মারার হলে ঠুকঠাক মেরে ফেলে রাখা কোনো কাজের কথা না। মারলে কোনোদিন জানটা একটানে বের করে নেব। যা বলতে এসেছি, শোন্।ʼʼ

অন্তূ ভাঁজ করা কাপড় র‌্যাকে সাজিয়ে রাখার জন্য উঠে দাঁড়ায়। জয় আবার টান হয়ে শুয়ে বলল, “শুক্রবার দিন লোক আসবে ও বাড়ি থেকে। মার্কেট করতে হবে। ভাবী বলল, আজকাল নাকি মার্কেট মেয়েরা নিজেরা করে, তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে মার্কেটে। তাছাড়া মা-গী মাইনষের বাজার জীবনে করিনাই, ওসব বালছাল আমি কিনতে পারব না। কাল সকালে তৈরি থেকো।ʼʼ

-“আপনাদের পছন্দ মতো কিনলেই চলবে। ফ্যাশন নিয়ে আমার কোনো সেন্সিটিভিটি নেই।ʼʼ

জয় খুঁটিয়ে দেখে অন্তূকে। নারীদেহের প্রতিটা ভাঁজে জয়ের পৌরুষ নজর পরিভ্রমন করে শেষ অবধি থামে অন্তূর কাধ থেকে বুক অবধি। নিঃশ্বাস ভারী হয়। জোরে করে শ্বাস ফেলে ঘাঁড় ঘুরায় অন্যদিকে। তখনই অন্তূ বলে ওঠে, “কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।ʼʼ

জয় বালিশটা খাটের বক্সের সাথে হেলান দিয়ে তাতে পিঠ এলিয়ে দিয়ে বলল, “এমন ভাব করছো, যেন আমি সব শর্ত মঞ্জুর করতে চেয়ে তোমায় ও বাড়ি নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছি? বিয়ে হয়েছে, তুমি দায়বদ্ধ। কী শর্ত দেবে? সিনেমার হিরোদের মতো আলাদা শোয়াবে?ʼʼ

অন্তূ কথা বলল না। জয় খ্যাকখ্যাক করে উঠল, “নাটক কোরো না, কী চাও বলো।ʼʼ আস্তে করে উঠে পা ঝুলিয়ে মাথা নত করে বসে, দু’হাতের তালু বিছানায় ঠেকালো।

-“কুড়িগ্রামে আব্বুর কিছু পৈত্রিক জমি আছে। মেজো চাচা সেটা দখল করে আছে, সেখানে নিজের খামার দিয়েছে। পলাশের পাওনা ছাড়াও আব্বুর বেশ কিছু ঋণ আছে। প্রতিদিন বাড়ি বয়ে লোক আসছে। আব্বু যাওয়ার পর ওরা ভয় পাচ্ছে, আমরা হয়ত টাকা আর দেব না। তাগাদা বেড়েছে। আপনি জমিটা কাকার কাছ থেকে দখল নিয়ে সেটা বিক্রি করে টাকা এনে দেবেন। খামার পরিস্কার না হলে ক্রেতা রেজিস্ট্রিতে যাবেনা।ʼʼ

জয় কিছুটা সময় নিয়ে মাথা তুলল, চোখা স্বরে বলল “আমাকে তোমার দখলদার মনেহয়?ʼʼ

অন্তূ অবাক হবার ভান করে সামান্য হাসল, “আপনার মনে হয় না? শুধু আমার কেন, সবারই মনেহয়। রাজনীতিবিদদের কাজ কী? দখল করা। সেটা হোক ক্ষমতা, সম্পত্তি, মানুষের অধিকার অথবা জনসাধারণের জীবনের সুখ। আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব— দখলদারী। তবুও লোকে আপনাকে পছন্দ করে? হতাশ আমি।ʼʼ

জয় বাঁকা হেসে ঘাঁড় ঘুরালো, “কারও পছন্দের হতে আসিনি দুনিয়ায়। বেঁচে থাকার জন্য এসেছি, নিজের মতো করে বাঁচবো।ʼʼ বেশ শান্ত দেখালো জয়কে।

-“কাল মঙ্গলবার। সকালের গাড়িতে কুড়িগ্রাম পৌঁছাতে বেলা সাড়ে এগারোটার মতো বাজবে। কাল রেজিস্ট্রি না হলে আগামীপরশু—বুধবার হবে। টাকাটা এনে হিসেব করে নিজহাতে পলাশকে দিয়ে আসবেন। পলাশের পাওনা–সুদসহ বারোলক্ষ দাবী করেছে ও। ওখানে জমি আব্বুর চার কাঠার বেশি। কমবেশি লাখ বিশেক টাকা আসতে পারে। বুধবারের মাঝে এই কাজগুলো শেষ করে ফেলুন। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠানের কাজের জন্য রইল।ʼʼ

-“আদেশ করছো?ʼʼ

-“আপনার মনে হচ্ছে?ʼʼ

-“না।ʼʼ

অন্তূ হাসল, “তাহলে করছি না।ʼʼ

-“তুমি যাবেনা কেন সাথে?ʼʼ

-“আপনি যাচ্ছেন তো। চলবে।ʼʼ

-“ভরসা করছো?ʼʼ

-“আপনার মনে হচ্ছে?ʼʼ

-“না।ʼʼ

-“তাহলে করছি না।ʼʼ

জয় মৃদু ধমকে উঠল, “আমি একা গিয়ে কার বাল ছিঁড়বো ওখানে? কাউকে চিনি আমি?ʼʼ

-“কল করব আমি। বলে দেব সব। আর এটুকু যদি সামলে নিতে না পারেন, তাহলে আর মাস্তান হওয়ার ফায়দা কী?ʼʼ

অন্তূর সূক্ষ্ণ অপমানে জয় ধৈর্য্যহারা হয়ে উঠল। এক চোটে বসা থেকে উঠে অন্তূর পেছনের চুলগুলো মুঠো করে ধরে হিঁচড়ে পিছনে ঠেলে নিয়ে গেল। তাতে সবে গুছিয়ে রাখা কাপড়ের র‌্যাকটা উল্টে পড়ে যায়। অন্তূ পিঠটা সজোরে ধাক্কা খায় দেয়ালে। পিঠে আঘাত পেতেই অন্তূ থাবা দিয়ে খাঁমচে ধরে জয়ের কলার। বুকের ওপর আঁচড় লেগে চামড়া উঠে যায় জয়ের বুকের। অন্তূ ছাড়েনা। মাংসাশীর মতো খাবলে ধরে চিবিয়ে বলে, “মাস্তান নন আপনি, আপনি কুকুর। ভুলটা শুধরে নিয়েছি। এবার ছাড়ুন। মানুষের ভুল হয়ে যেতেই পারে। মাস্তান তো ভালোই, আপনি কি আর তেমন? রাস্তায় রাস্তায় কিছু কালো কুকরেরা ঘুরে বেড়ায় না? মানুষ দেখলেই হামলে পড়ে। আপনি তাই।ʼʼ

জয় এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখালো। ও বোধহয় শুনতে পেল না অন্তূর ভৎসনাগুলো। পাছড়াপাছড়িতে অন্তূর ওড়না পড়ে যায় একপাশ থেকে। এর আগেও দেখা হয়েছে এভাবে অন্তূকে। তখন যে চাহিদা জাগেনি, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করেনি, এমন নয়। পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতায় চাপা পড়েছে সেসব। আজ হলো না, ক্রমশ তীব্র পৌরুষ দেহটা পাগলামী শুরু করল জয়ের। বুকের আঁচড়ে যখন জ্বলন উঠেছে, জয়ের শরীরটা আচমকাই অন্য চাহিদায় মনোযোগ পেল। অন্তূ সুন্দরী, এত কাছ থেকে আরও বেশি লাবণ্যময়ী লাগছিল। ক্ষুধার্ত জয়ের এত কাছে, হাতের থাবায় মেয়েটাকে পেয়ে, এত কাছ থেকে ছুঁয়ে থেকে জয়ের ক্ষুধাটা জেগে উঠল। সাতাশ বছরের যুবক ছেলেটার সামনে অন্তূর ক্ষিপ্ত নিঃশ্বাসে উঠানামা করা বুকটা নেশাদ্রব্যের ন্যায় লাগল। জয়ের নিঃশ্বাস ভারী হলো, পশমে ঢাকা বুকের ভেতরটায় আলোড়ন উঠল। অন্তূর চুলে থাকা হাতটা শিথিল করে অপর হাত দিয়ে অন্তূর একপাশে ঝুলে থাকা ওড়নাটা একটু একটু করে টেনে নিয়ে হাতের মুঠোয় গোছাতে শুরু করল।

অন্তূ থমকে যায়। জয় অন্যমনস্কভাবে অদ্ভুত স্বরে বেহায়ার মতো আবদার করে, “একটা চুমু খাই তোমার ঠোঁটে?ʼʼ

অন্তূকে প্রতিরোধ করার সময়টুকু দেয়না জয়। বিরবির করে ওঠে, “মেয়ে মানুষ জীবনে স্বীকার করবে না।ʼʼ

দাড়িগোফের মুখটা অন্তূর ঠোঁটে লাগায়। শক্ত একটা চুমু। অন্তূর ওড়নাটা তখনও জয়ের হাতে পিষে যাচ্ছে। যতটা জোর জয় সুতোর ওড়নাতে দিচ্ছিল, ঠিক ততটা হিংস্র হয়ে ওঠে তার ঠোঁট, এবং অপর হাতটা। অন্তূ জয়কে বাঁধা দিতে হাত তুলতেই ওড়নাসহ হাতটা চেপে ধরে অন্তূর চোয়ালে অপর হাত গেড়ে দেয়। অন্তূর হাতের কব্জির নিচের র-ক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে চায়। জয়ের হাতের রিস্টলেটের আঁচড়ে নরম হাতের চামড়া বিদীর্ণ হয়।

এভাবে কেটে যায় মিনিটখানেক। জয় সরে দাঁড়ায়। হাঁপিয়ে উঠার মতো জোরে জোরে বিক্ষিপ্ত শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে, “এবার কী বলবে? ধ-র্ষ-ক? চলবে, তাই বলো।ʼʼ

আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায় না। অন্তূর ওড়নাটা হাতের মুঠোয় পেঁচিয়ে বেরিয়ে যায় ঘরের বাইরে। অন্তূ শান্তভাবে জয়ের যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে থুহ করে দু’বার থুতু ফেলে মেঝেতে। হাত দিয়ে ঠোঁট ঘঁষে। আবার থুতু ফেলে। ওপরের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে, “আমার স্বামী এই কুকুরটা। এভাবেই সহ্য করতে হবে প্রতিবার যখন কাছে আসবে? কী বিধান আপনার? মানা করলে নাকি আপনার ফেরেশতারা অভিশাপ দেয়! আপনি মহান, মালিক আমার!ʼʼ


অন্তিক আবার একটা ছোট্ট দোকানের খোঁজ করেছে। মানুষের ব্যক্তিত্ব নষ্ট হতে বাধ্যতামূলক একবার ব্যক্তিত্বহীনের মতো কাজ করাই যথেষ্ট। অন্তিকের জন্য তার পরিবারের সাথে যা হয়েছে, তা সে ভুলতে পারেনা। সব ভুলে নিজেকে সংসারে সক্রিয় করার মনোবলটুকু নিঃশেষ হয়ে গেছে কোথাও। রাতে মার্জিয়া বলল, জয় আমির এসেছিল। সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। যেভাবেই হোক বিয়ে হয়ে গেছে, আব্বু নিজে বিয়ে দিয়ে গেছে। আর বলার কী থাকে?

অন্তিকের কাছে জয় আমির, নর্দমার পঁচা নাপাক ময়লা। যা ঘৃণ্য, বর্জনীয়। তার কারণে অন্তূর সাথে যা হয়েছে তা ছিল অপরিকল্পিত। অন্তূর জন্য কলিজা ফাটে, অথচ সান্ত্বণা দেবার ভাষা নেই। আবার মনেহয়, ওর বোন এমন দূর্বল নয়। অন্তূর কাছে যুক্তি, ধৈর্য্য, কথার বাণ, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের সাহস সব আছে।

অন্তূ বারান্দায় এককাপ কড়া চা আব্বুর বসার চেয়ারখানাতে রেখে আব্বুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি চা-তে চিনি খাও না কেন, বলো? পানসে লাগে না? আমি তো জীবনে তোমার চা মুখেও দিতে পারিনা।ʼʼ

আমজাদ সাহেব বেতের তৈরি রকিং চেয়ারে বসা। চেয়ারটা তিনি যেদিন শখ করে বানিয়ে আনলেন, কী যে খুশি লেগে ছিল মুখে-চোখে। গাম্ভীর্য্যের পেছনে এক সৌখিন মানুষ ছিলেন। অন্তূ চেয়ারে হেলান দিয়ে আব্বুর দিকে চেয়ে থাকে। আজ কোনো কথা বলছে না, জবাব দিচ্ছে না। অন্তূ ছটফট করে উঠল, “কী হয়েছে তোমার, আব্বু? কথা বলছো না কেন? তোমার অভিমান সহ্য করার সাধ্যি আমার নেই। তোমরা আর কত কী সহ্য করাবে আমাকে?ʼʼ

অনেকক্ষণ পর বললেন আমজাদ সাহেব, “তুই চলে যাচ্ছিস, অন্তূ? ওই বাড়ি কিন্তু যাব না, আমি। তুই আসিস রোজ, আমি এখানেই থাকব।ʼʼ

অন্তূ চমকে উঠল। একথা কেন মাথায় আসছে? অন্তিক এসে বসে আব্বুর চেয়ারটায়। আব্বুর অবয়বটা মিলিয়ে যায়। অন্তূ চারদিকে তাকায় আকুল হয়ে। অন্তিক জিজ্ঞেস করল, “চা-টা আমি খাবো? একটু চিনি এনে দিবি?ʼʼ

দুই ভাইবোন অনেকক্ষণ যাবৎ চেয়ে থাকে একে অপরের চোখের দিকে, ঘোর নীরবতায় কাটে ততক্ষণ। অন্তূ পরে উঠে দাঁড়ায়। ছোট চিনির কৌটা এনে দুই চামচ চিনি দেয় অন্তিকের কাপে। অন্তিক যেন লজ্জিত বোধকে পাত্তা না দিয়ে বলে, “চা আব্বুর জন্য বানিয়েছিলি, তাই তো? বড় ভাই বাপের মতো হয়। চা-টা খাওয়া খুব বেশি অসঙ্গতি হবেনা। আমি তোর তেমন ভাই নই অবশ্যি! ঠিক বলেছি?ʼʼ

-“এমন ভং ধরিস কথাবার্তায়, যেন খুব শিক্ষিত আর বিজ্ঞ তুই। অনার্স পাশ না-ই করতে বরের মালা গলায় তুলেছিস। আমার সামনে বুজর্গী কথাবার্তা বলতে আসবি না। বিরক্ত লাগে।ʼʼ

অন্তূর ঠ্যাস মারা কথাতেও অন্তিক হেসে ফেলল, “পাপ আর বিদ্যুৎ প্রথমে এদের নিজেদের বাপকে মারে, শুনেছি। আমার পাপও ছাড়েনি আমায়।ʼʼ

অনেকক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে চুপচাপ বসে থেকে বলে অন্তিক, “পলাশ কী করেছিল তোর সাথে?ʼʼ

-“পলাশের ব্যাপারে কিছু জানিস? এমন কিছু যা জানা উচিত আমার?ʼʼ প্রসঙ্গ এড়িয়ে নিজে প্রশ্ন করল অন্তূ।

সকাল এগারোটার দিকে অন্তিককে সাথে নিয়ে অন্তূ রওনা হয় মুস্তাকিনের ফ্লাটের উদ্দেশ্যে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো হাতে খোঁপা করার মুহুর্তে রাবেয়া রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, “বোরকা ছাড়ছিস? এমনে চলাফেরা করে মেয়েমানুষ? জাহান্নামী হয়ে গেছিস, তুই? আল্লাহরে ভয় লাগেনা? বেপর্দা, বেহায়াদের মতোন চলাফেরা করতে শিখছিস?ʼʼ

অন্তূ খোঁপাতে ছোট্ট ক্লিপ লাগাতে লাগাতে বলে, “কীসের পর্দার কথা বলছো, আম্মা? বেশ্যার শরীরে বোরকার পর্দা? যে মেয়ে পুরুষ ঘরে ঢোকায়, তার পর্দা?ʼʼ মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়ে অন্তূ, “মূর্খ তুমি। মনের সান্ত্বণায় পর্দা করে রাস্তায় বের হয়ে মানুষের যে নোংরা ভাষাগুলো শুনব, তাতে পাপ বাড়বে, আম্মা। কী বলো তো, মানুষের আসল পোশাক সম্মান। তা আছে আমার? কাপড়ের পোশাকে শরীর ঢাকলেই কী আর না ঢাকলেই বা কী? নেহাত সভ্যতার খাতিরে পোশাক পরা। যখন সম্মানের ভূষন দেহ থেকে খুলে পড়ে গেছে! কীসের পোশাক গায়ে চড়াবো? লোক দেখানো হয়ে যাবেনা? আর ওটাকে ‘রিয়াʼ বলে। যা হারাম। ওষুধ খেয়ে নিও, বের হচ্ছি।ʼʼ

মুস্তাকিন থাকে দিনাজপুর বাঁশেরহাটের ঢাকাদক্ষিন রোডের মিসরা উদ্দীন সরণীতে। ফ্লাট বলতে ছয় তলা বাড়ির এক ইউনিট। মুস্তাকিনের ঠোঁটের কোণে সেই মুচকি হাসি ঝিকমিক করছিল। নিজের হাতে নাশতা বানিয়ে আনলো। সোফায় বসে বলল, “কী ব্যাপার? রাস্তা ভুল করে?ʼʼ

-“প্রয়োজনে।ʼʼ

মুস্তাকিন হাসল, “প্রয়োজন ছাড়া মানুষ নিঃশ্বাসও ফেলতো না। নেহাত বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মিনিটে কমবেশি বিশবার শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে। কী প্রয়োজনে এসেছেন?ʼʼ

চুপচাপ তাকিয়ে রইল অন্তূ। মুস্তাকিনকে ওর কোনোদিন সাধারণ কেউ মনে হয়নি। কিছু একটা আছে লোকটার মাঝে, কিছু একটা! সেই কিছু একটা যে কী, তা আন্দাজ করা দুঃসাধ্য যেন। লোকটা যেকোনো পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক রকমের শান্ত থাকার বিশেষ গুণসম্পন্ন।
মুস্তাকিন হাসল, “উকিল হবার আগেই যদি এভাবে স্ক্যান করেন, এনার্জি লস, ম্যাডাম! এই জহুরী দৃষ্টিকোণকে বাঁচিয়ে রাখুন, আপনার ভবিষ্যত পেশায় অতি প্রয়োজনীয়। এখনই খরচা করবেন না অপ্রয়োজনে।ʼʼ লোকটা হাসে বেশি।

-“তো আপনি বলছেন, আপনাকে নিরীক্ষণ করার প্রয়োজন নেই? নিজেকে খাঁটি বলছেন?ʼʼ

ফের হেসে ফেলল মুস্তাকিন, “খাঁটি? সে তো স্বর্ণও হয়না। চব্বিশ ক্যারেটকে লোকে খাঁটি স্বর্ণ বলে জানে। অথচ এটা জানেনা, স্বর্ণে খাদ না মেশালে গহনা তৈরী করা যায়না। স্বর্ণ নরম ধাতু, ওতে খাদ না মেলালে তা দিয়ে অলংকার গড়া যায়না, গড়লেও তা মজবুত হয়না। আর খাঁদ মেশানো স্বর্ণ কখনও চব্বিশ ক্যারেট হয়না।ʼʼ

অন্তূ চোখে হাসল, “অর্থাৎ, খাঁটি মানুষেরা দূর্বল, তাই না? আমিও বুঝি আজকাল।ʼʼ

-“আমি একটু ব্যাকডেটেড মানুষ, কফিতে তৃপ্তি কম পাই। চা ভালো বানাতে পারি, টেস্ট করে দেখুন, নয়ত পরিশ্রম বৃথা যাবে।ʼʼ

-“কথা শেষ করে নেব। ঠান্ডা হোক। আপনি আমায় পলাশের ব্যাপারে বলুন। কিছুই লুকোবেন না। এবং এটা জিজ্ঞেস করবেন না, কেন জানতে চাইছি।ʼʼ

-“আপনার উকিল হওয়াও ঠিক আছে, শুনানী পেশ করায় খুব দক্ষ হবেন। তবে রাজনীতিতে গেলে ভালো হতো। কথার ভাষনেই পার্টি আপনার। ভালো কথা জানেন, খুব সাজানো।ʼʼ

অন্তূ চুপ রইল। অন্তিক দর্শকের মতো বসে আছে, দৃষ্টি অন্তূর মুখের দিকে। যেন মনেই নেই, এমন ভঙ্গিতে মুস্তাকিন জিজ্ঞেস করল, “এটা কত সাল চলছে যেন?ʼʼ

অন্তূ জবাব দিলো, “২০১৪ চলছে।ʼʼ

-“রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মাঝে পরস্পরের সম্পর্কগুলো যেমন উপরি হয়, ঠিক তেমনইভাবে রাজনীতিতে থাকতে গেলে বিভিন্ন ধান্দার বিভিন্ন ধরণের লোকের সাথে লেওয়াজ করে চলতে হয়। সেভাবেই একটা লেওয়াজ ছিল হামজা ও জয়ের পলাশের সাথে। হামজা পলাশের সমসাময়িক জুনিয়র। পলাশ হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করে বেরিয়েছে প্রায় আট বছর আগে। ভার্সিটিতে থাকাকালীন সে ছিল ওখানকার ছাত্রদলের এক সাধারণ সম্পাদক। অথচ ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে বের হতেই সে ছাত্রদল থেকে একদম অব্যাহতি নিয়ে নিলো। ব্যবসা শুরু করল নিজের। ধীরে ধীরে চাচা অর্থাৎ রাজন আজগরের সাথে মিলে হয়ে উঠল বিশিষ্ট এক সন্ত্রাস সাথে মহাজন ব্যবসায়ী। সে সামলায় এখানকার কারবার, ঢাকাতে আছে রাজন আজগর।

পলাশ রাজনীতি ছেড়েছিল এর অবশ্য একটা কারণ আছে। ওর অনার্স ফাইনাল ইয়ার পরীক্ষার আগে একটা ছাত্র সংগঠন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তার আগেই এক নোংরা কুকর্ম করে ফেলেছিল সে। এক গরীবের বউকে ক্লাবে তুলে এনে ধ-র্ষ-ণ ও শারিরীক নিপীড়ন করে ছেড়ে দিয়েছিল। সেই মহিলার পরেও তার বিরুদ্ধে ছাত্রী হোস্টেলের কোনো ছাত্রীকে এমন কিছু করার অভিযোগ উঠেছিল। এরপর ছাত্রসংসদ থেকে বের হয়ে আসতে হলো তাকে। এই ক্ষোভে রাজনীতি ছেড়ে সন্ত্রাসনীতিতে যুক্ত হয়ে যায় সে। মানুষকে টাকা ধার দিয়ে তা শোধের ব্যবস্থা রাখে না, পরে বাড়ির মেয়েরা তার শিকার হয়। যা অন্তূর সাথে হয়েছিল। জয় জানে সবই। কিন্তু সে জানতো না, অন্তূদের মতো রক্ষণশীল পরিবারের কেউ পলাশের কাছে ভিড়বে। পলাশ ছাত্র-রাজনীতি থেকে বেরিয়েছিলই কেবল নিজের অমানুষিক মস্তিষ্কের চাহিদাগুলো চরিতার্থ করবার জন্য।

দিনদিন এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল সে, তার শক্তির নিচে অল্প জায়গা পেলেও তা যে কারও জন্য বিশাল ব্যাপার। তবে ওকে দেখলে ওর শক্তি সহজে আন্দাজ করার জো নেই। খুব ঠান্ডা এবং সাধারণ চলন ওর। চালচলনে খুব সাধারণ এবং আকর্ষিক গুপ্ততা আছে। ওর যে মাথায় দোষ আছে, এটাও ওর শিকার ছাড়া কেউ ধরতে পারবেনা। তবে চার-পাঁচ বছর আগে পলাশের জন্য চারিপাশটা এতটাও অনুকূল ছিল না। প্রশাসন পুরোটা মরেনি তখনও। সাল–২০১০ এর শেষের দিক। রাজনৈতিক বিপর্যয় পুরো দেশ জুড়ে। বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার রায় কার্যকর হলো, আরেক দফা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো, বিএনপি নেত্রীর নিবাস পরিবর্তন। তখন দেশের অবস্থা খুব উত্তেজিত।

সেই সময় হামজা কেবলই মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল রাজনীতিতে। তার সাথে ভাবটা পলাশ গড়ে তুলেছিল নিজের সুবিধার্থে। এরপর থেকে দুই পক্ষ পরস্পরের জন্য ব্যাক-আপ সাইড হয়ে গেল। কিন্তু মাজহার তখন জয়ের বিপরীতে ভার্সিটির ছাত্র সংসদ থেকে ছিটকে পড়ার শোকে হতবিহ্বল। অথচ হামজার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তার বিপক্ষে সরাসরি লড়ার হাত কোনোদিনই শক্ত হয়ে ওঠেনি মাজহারের। বাপ মেয়র থাকা সত্ত্বেও তরুণ রাজনৈতিক নেতা, হামজার দাপট চলছিল চারদিকে। চাচাতো বোনকে বিয়ে দেয়ার পেছনে মাজহারের একটা দারুণ পরিকল্পনা থাকলেও তা কোনোদিন সফল হয়নি। হামজা ঠিক যতটা চতুর, তেমনই ভয়ানক। সে নিজের অর্জনের ভাগ দেয়না কাউকে। পলাশের সাথে নিয়মিত উঠাবসা শুরু করল। এরপর সমস্যাটা তৈরি হয়েছিল হামজা ও জয়ের বেপরোয়া চলন নিয়ে। মাজহার পলাশকে খুব মান্য করে চললেও জয় আর হামজার কাছে পলাশ তেমন একটা অধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি কোনোদিন।

আরও বহুত ব্যাপার আছে, যেগুলো শুধু ওরা জানে, ওরা। আপনার না জানা ভালো।ʼʼ

মুস্তাকিন কথা শেষ করল। অন্তূ উঠে দাঁড়ায়, “জয় আমিরের ব্যাপারে কী জানেন?ʼʼ

-“জয় আমির? এক যুদ্ধাপরাধীর ছেলে।ʼʼ খুব সংক্ষেপে জবাব দেবার চেষ্টা করছিল মুস্তাকিন।

অন্তূ বেরিয়ে আসে মুস্তাকিনের ফ্ল্যাট থেকে। রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়াতেই নজরে আসে, ছোট্ট একটা মেয়ে, বাবার সাথে রাস্তা পার হচ্ছে। অন্তূর বুকটা ধরাস করে ওঠে। তখনই ডান হাতটা চেপে ধরে অন্তিক। তাড়া দেয়, “রাস্তা ফাঁকা, চল পার হই।ʼʼ

চলবে…