অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0
90

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৪৬.

হামজা বের হবার সময় অন্তূ ড্রয়িং রুমে ছিল। আজ একটা জিনিস খেয়াল করল, হামজার ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুলে ঠেলে ওঠা সেলাইয়ের দাগ। খুব বেশি। যেন আঙুল কেটে পড়ে যাবার থেকে রক্ষা করতে কোনো সময় তাতে সেলাই দেয়া হয়েছিল।

জয় বেরিয়ে গেলে অন্তূ রিমির ঘরে গেছিল। ওরা দুজন আজ রাতে ফিরবে বলে মনে হয়না।

রিমি তখন উদ্ভ্রান্তের মতো বসা। অন্তূকে পেতেই গরগর করে সব বলে বোধহয় নিজের ওপরে চাপা মারি বোঝাটা নামায়। অন্তূ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। নিচ থেকে লোহার ধাতব শব্দ আসছে ভেসে। নীরবতা ভেঙে অন্তূ প্রথম যে কথাটা চট করে বলল, “তাহলে তুলি আপু কে?ʼʼ

রিমি আরেকবার হতবাক হয়ে তাকায়। ব্যাপারটা তার মাথাতেই আসেনি। সে হামজার মুখে কথাটা শুনে এতটাই হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল, আর কিছু ভাবার ফুরসৎ পায়নি। অথচ আজকাল অন্তূকে বিশেষ অবাক হতে দেখা যায়না, সে যেন সে-সবের ঊর্ধ্বে চলে গেছে।

অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “আপনি হামজা সাহেবকে ভালোবাসেন। কেন?ʼʼ

রিমি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “মাঝেমধ্যেই আমাদের বাড়িতে এই গোমড়ামুখো বিশালাকায় লোকটা যেত। দোতলার সিড়ি থেকে বসার ঘর দেখা যায়। কেন যে দাঁড়িয়ে দেখতাম লোকটাকে। একটা কথা বেশি বলেনা, এদিক-ওদিক তাকায় না। এত শান্ত মানুষ, রাগ হতো কেন জানি। অথচ কোনো কারণ ছিল না, জানেন! আমি কী করে জানব যে, লোকটা বেশ জানে, তাকে এক পুঁচকে মেয়ে ভ্রু কুঁচকে দেখে। আবার এটাও জানে, কী করে চট করে চোখ তুলে একনজর দেখে সেই মেয়েকে কঠিন লজ্জায় ফেলে দেয়া যায়? দিলো। আমি কাচুমাচু হয়ে গেলাম। ভূত দেখলে যেমন পা ভারী হয়, ওরকম আঠার মতো লেগে রইল পা জোড়া। মাঝেমধ্যেই যেত। যখন ঝন্টুবাবাদের বাসায় যেত, আমি বাহানা করে যেতাম।

অথচ একদিন এই গভীর জলের মাছ লোকটা কী করল জানেন? কানাঘুষা শুনলাম, লোকটা প্রস্তাব দিয়েছে। বাড়িশুদ্ধ কেউ রাজী না এতবড়, গম্ভীর লোকের সাথে আমার বিয়ে দিতে। ঝন্টুবাবা আর মাজহার ভাই দিয়ে দিলো। আমি ‘নাʼ করিনি। কেন করিনি, কে জানে!

ছোট বয়সে বউ হয়ে আসার পর থেকে লোকটার স্পর্শ, কথা, চোখের চাহনি আর তার ঘরণীর কাজ করতে করতে কবে যে কঠিনভাবে আঁটকে গেলাম। জানেন? কোনোদিন বলেনি আমায় কিছু করতে। অথচ তখন বয়স ছোট ছিল। একটা তাগড়া পুরুষ, যে আমার স্বামী। তার তোয়ালেটা, লুঙ্গিটা এগিয়ে দেয়ার মাঝে যে শিহরণ আছে, তাতে বুক কাঁপতো। আমায় বলতো, খাইয়ে দিতে। আমার ছোট্ট হাতের লোকমা লোকটার মুখে তুলে দেবার সময় শিরা-উপশিরার যে আন্দোলন, ও আপনি বুঝবেন না, আরমিণ। লোকটা বাইরে গেলে অপেক্ষা করা, মুরগীর বাচ্চার মতো তার বিশাল বুকের কোটরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা, তার পছন্দের রান্নাটা করা, তার ছোট ছোট ধমক…ʼʼ

রিমি হু হু করে কেঁদে ওঠে। অন্তূর খুব হাসফাস লাগছিল। অস্থির সে কতরকমই তো হয়েছে, এরকম অস্থিরতা নয় সেগুলো। বিষাক্ত অস্থিরতা। সে বুঝবে না এগুলো, রিমি বলল। ঠিকই তো। এসব সে কেন বুঝবে? জয় আর তার মাঝে হতে পারে বিয়ের খোৎবা পড়ে শরীয়ত মতে বিয়ে তো হয়েছিল, জয়ের খিদে পেলে কাছেও টেনে নেয় জোর-জবরদস্তি করে। তবে এইসব তো নেই তাদের মাঝে!

অন্তূ রিমিকে কান্নারত রেখে উঠে গিয়ে জানলার ধারে দাঁড়ায়। ইশার নামাজ পড়ে মুসল্লিরা বেরোচ্ছে মসজিদ থেকে। অন্তূ উদাস চোখে চেয়ে থাকে আলো-আঁধারির গোধূলিতে। জয়কে নিয়ে তার কেবল কৌতূহল আছে, আর আছে মহাবিশ্বের মতো বিস্তৃত এক বিশ্ব ঘেন্না। লোকটা ভালোবাসতে জানে কি-না, জানেনা অন্তূ। কারণ সে সুযোগ দেয়নি। তবুও জানে, জয় অন্তূর ওপর শুরু থেকেই উদার। নয়ত অন্তূর গোটা বংশ নির্বংশ করতে বাঁধা কোথায় জয়ের।

সুযোগ দেয়া উচিত। একটু মায়ায় পড়া উচিত জয়ের, অনেকটা পড়লেও দোষ নেই। একবার জয়ের বেঁচে থাকার, জগৎ সংসারে নিজেকে নিযুক্ত করার অথবা স্নেহ-ভালোবাসার হাহাকারে ভিজে ওঠা উচিত। সে জয়কে আবিষ্কার করতে চায়। তারপর বিচার করতে চায়।

তুলির ঘরে গিয়ে অন্তূ তুলিকে জিজ্ঞেস করে,“আপনার সাথে এ বাড়ির সম্পর্ক কী?ʼʼ

তুলি হাসে, “বের করে দেবে আমায়?ʼʼ

-“ইচ্ছে, অধিকার কোনোটাই নেই। জানতে চাই।ʼʼ

-“জেনে কী?ʼʼ

-“না জেনেও কিছু নয়। তবু জানা ভালো।ʼʼ

-“আব্বুর অবৈধ মেয়ে।ʼʼ

অন্তূ চোখ বোজে। এটা বাড়ি না ডাস্টবিন? সবার ভেতরে দোষ। আর সব এক বাড়িতে জোট বেঁধেছে। অন্তূর জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, আপনার নিজের মাকে চেনেন? তবু হামজা আপনাকে ভালোবাসে, উল্লেখযোগ্য ভালোবাসা না যদিও। এজন্যই কি আপনার এভাবে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে আসা নিয়েও এ বাড়ির কারও মাঝে কোনো হেলদোল ছিল না? এমনকি আপনার বাপেরও?

অন্তূর মনেহয়, সে নরকে এসে পড়েছে। যার অবস্থান সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূর। সমাজে বা মানুষের ভেতর ভেতর বহুত দৃষ্টিকটু-শ্রুতিকটু ঘটনারা অবাধে ঘটে যায়, কানাকানি হলে বদনাম নয়ত ওটাই সভ্যতার নামে চালিয়ে দেয়া হয়, এই তো?

বাড়িটাতে সবাই একসাথে বাস করে। অথচ মনেহয় এটা কোনো হোস্টেলের হল যেন। একসাথে থাকা ছাড়া আর পরস্পরের মাঝে তেমন কোনো মেলবন্ধন থাকার নয়। অন্তূ অবাক হতো, আজকাল সব কিছুর যোগসূত্র খুঁজে পায়। তরু শাহানার বোনের মেয়ে, তুলির মা হুমায়ুন সাহেবের উপ-স্ত্রী, হামজা কোথাকার কে, আর জয়? একমাত্র জয় আর হুমায়ুন পাটোয়ারী এ বাড়ির কেউ না কেউ।

রাত এগারোটার পর ওয়ার্কশপ বন্ধ হয়ে যায়। অন্তূ বারান্দা থেকে দেখে সব আলো নিভিয়ে সশব্দে সাটার ডাউন করে যে যার মতো বিদায় নিচ্ছে কর্মচারীরা।

মাঝরাত হয়ে আসে। অন্তূ নামাজ পড়ে। এদিক-ওদিক পায়াচারী করে। রাত একটার দিকে চাবিটা বের করে নিয়ে রিমির কাছে যায়। রিমির মানসিকতা বিদ্ধস্ত। তা সত্ত্বেও অন্তূ বলে, “চলুন, ঘরটা দেখে আসি।ʼʼ

-“খুব একটা ভালো লাগবে না আপনার ওখানে গিয়ে?ʼʼ

-“খুব খারাপ কিছু?ʼʼ

-“ভালোও না।ʼʼ

-“তাহলে তো যাওয়াই যায়।ʼʼ

-“বুঝবেন না কিছু। কৌতূহলবশে জিজ্ঞেস করবেন জয় ভাইয়াকে, এরপর হাঙ্গামা হবে আবার। আবার ঝামেলা হবে।ʼʼ

-“হবেনা। আমি আর নাক গলাবো না। শুধু দেখব। দরকার পড়লে আপনি বুঝিয়ে দেবেন।ʼʼ

-“আমি নিজেও জানিনা কিছুই।ʼʼ

তরু-তুলির ঘরের দরজা আঁটকানো। শুয়েছে ওরা। দুজন যায় চুপচাপ। রিমি লম্বা বারান্দার শেষ প্রান্তে স্টোররুমের ডান পাশে দাঁড়ায়। উদাস স্বরে অন্তূকে বলে, “আপনি যান। আমার ভালো লাগেনা ওখানে যেতে। আপনারও লাগবে না।ʼʼ

অন্তূর বুকে ধুকপুকানি ওঠে। হাতে শুধু একটা দিয়াশলাই। টর্চ আনেনি। কী বা দেখবে! খুব খারাপ কিছু? দেখে কী করবে? কী থাকতে পারে? কোনো অনৈতিক ব্যবসার জিনিস, বা অন্য কী? জয় বলে, ওখানে ইস্পাত, লোহা ইত্যাদি থাকে। গোডাউন ওটা। লোহা গলানোর কাজ হয়।

এই সরু বারান্দাটা গা ছমছমে। ঠিক পুরোনো ভূত-বাংলোর নির্জন করিডোরের মতোন। লাইট জ্বালাতেই অন্তূ চমকে উঠল। আজব! লাল টকটকে র-ক্তের মতো লাইট এই বারান্দায়। অন্তূ কোনোদিন জ্বালিয়ে দেখেনি। ভয়ও হচ্ছিল, সেখানে কোনো পাহারা নেই তো? না থাকার কী? হামজা-জয় ঝানু লোক।

আঁধারে লাল আলো আরও রহস্যময়তা তৈরি করছিল। অকারণেই। অন্তূ সেই দরজার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কান পাতে। ওপাশে কারও আওয়াজ নেই। হয়ত পাহারা নেই। কেউ তো আসেনা এদিকে। এ বাড়ির দোতলাতেই কেউ আসেনা। বাড়ির লোকেরাও একেকটা অস্বাভাবিক মানুষ।

তালাটা খোলার সাথে সাথে অন্তূর বুকটাও ধুপ করে ওঠে। আস্তে আস্তে দরজা ঠেলে সে। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কবরের মতো অন্ধকার। আন্দাজ করা যায়না, সামনে আদৌ কী আছে। হাত বাড়ায়। টের পাবার চেষ্টা করে, তার সামনে কিছু আছে কিনা। আশ্চর্য, পেছনের লাল আলো এক রত্তিও এই দরজার ওপারের অন্ধকার কাটাতে সাহায্য করছে না। অন্তূর এত বুক কাঁপছে কেন, সে বোঝেনা। নিজেকে ধমক দেয় একটা। সামনে কালগর্ভের মতো অন্ধকার।

বদ্ধ বাতাসে কেমন এক গুমটে ভোঁতা আওয়াজ কানে বাজে, সেটা খুব বিশ্রী লাগছিল। কমপক্ষে তিন-চার মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে অন্তূ অন্ধকারটাকে চোখে সহনীয় করার উদ্দেশ্য। কিছু স্পষ্ট হলোনা, তবে অন্ধকার চোখে সয়ে গেল।

সামনে দু-কদম সমতল ভেবে পা রাখতেই পা ছিটকে যায়। চাপা এক আর্তনাদে আশপাশের কিছু চেপে ধরার চেষ্টা করে। ধরেও ফেলে কিছু একটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বুক দ্রিমদ্রিম করে ঢোল বাজাচ্ছে যেন। বুকে হাত রেখে ওকে থামানো দরকার, নয়ত স্পন্দিত হতে হতে বেরিয়ে না আসে। যে তার গতি বেড়েছে!

পায়ের অনুভবে টের পায় সে কোনো সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে, এবং হাতে ধরে আছে দুপাশের হাতল। অন্তূ অবাক হয়। এটা সে কোথায় নামছে? পাতালে? কবরখানা?

তখনই মাথায় আসে, সে দোতলা থেকে আসছে। তাহলে এই সিঁড়ি নেমে কোথায় যায়? দোতলা থেকে নামলে নিশ্চয়ই নিচতলায় যায়? নিচতলায় ওয়ার্কশপ! সে তাহলে যাচ্ছে কোথায়? ওয়ার্কশপে? তার মানে অহেতুক সন্দেহ করে এত নাটক! অন্তূর রাগ হয় নিজের ওপর এক মুহুর্ত। দৌড়ে ফিরে যেতে পা টানে।

তখনই মনে হয়, তার মস্তিষ্ক তার সাথে খেলছে। সে ভয় পাচ্ছে, চরম ভয়। এবং মস্তিষ্ক তাকে সহজভাবে ভুলিয়ে দ্রুত বিষয়টাকে কাটাতে চাইছে।

গায়ে এক ধরণের শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিল। এটা অজানা ভয়ও হতে পারে। আসলেই সহজভাবে চিন্তা করলে, দোতলা থেকে এই সিঁড়ি যদি নিচে নেমে যায়, অর্থাৎ এটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে গেছে। এটা নিচতলার গুপ্ত সিঁড়ি। বাড়ির সামনের যে সিঁড়ি দিয়ে উপর-তলায় আসা হয়, সেটা মূখ্য। এটা গৌণ একটা রাস্তা। বাগানের সেই লোহার গেইটের কথা মনে পড়ল। তাহলে ওটা কী? ওটার পেছনে কী আছে?

এক সিঁড়ি পিছিয়ে সে দুপাশের দেয়াল হাতিয়ে বাতির সুইচ পেল। ঢালাই সিঁড়ি। দুপাশে সিমেন্টের বস্তা থেকে শুরু করে দালান বাড়ি তোলার সময় যেমন বাড়ির এখানে-ওখানে কত বাঁশ, ঢালাইয়ের যন্ত্রপাতি, চটের বস্তা ইত্যাদি ধুলো জড়ানো পড়ে থাকে, সেসব। অন্তূ তবু নেমে যায়। কোনো আগ্রহ পাচ্ছিল না। এখানেও সুইচ আছে। আলো জ্বালায়।

কিন্তু সিঁড়ি পার করে অন্তূ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়। একটা বিশাল এপার্টমেন্ট ইউনিট! এটা ওয়ার্কশপ নয়! দোতলার মতো সেম পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা গ্রাউন্ড ফ্লোর। তা কেবল ইটে গাঁথা। পুরো কাঠামো তৈরী, তবে প্লাস্টার-রঙ কিছু নেই। ফেলে রাখা হয়েছে। অন্তূর শরীরটা ঝাঁকি মেরে মেরে উঠছিল। লাইটে অল্প একটু আলোকিত হয়েছে। বাকিটা সেইরকম কবরস্থানের মতো নিস্তব্ধ, অবরুদ্ধ। রাত বাড়ছে প্রকৃতিতে।

অন্তূ আচমকা বিদ্যুতে শক খাওয়ার মতো চমকে ছিটকে দেয়ালের সাথে মিশে দাঁড়ায় একদম। বাচ্চা কাঁদছে! একজন নয় অনেকে যেন! ভৌতিক সেই স্বর। এত করুণ! শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে ওর। এই অবরুদ্ধ ইটের গাঁথুনির গোপন এপার্টমেন্টে ছোট মানুষের কান্নার আওয়াজ! অন্তূ পাগলের মতো এগিয়ে যায়। গা ঘেমে ভিজে উঠেছে। চুলের খোঁপা খুলে কোঁকড়ানো লম্বা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে যাওয়ায় আরও গরম লাগছিল। খটাং করে একটা আওয়াজ হয় তার পা কিছুতে বেঁধে।

কান্না থেমে যায়। অন্তূ থমকায়। আর আসছে না কান্নার আওয়াজ। একটা রুমে উঁকি দেয়। দিয়াশলাই জ্বালায়। রুমে কিছুই নেই। বালির মেঝে, ইটের দেয়াল। অবাক করা বিষয় হলো, জানালা নেই রুমের। অন্তূর মনে হচ্ছিল পেছনে বুঝি কেউ আছে। সে একা নয়। এত আঁধার! সে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁটছিল। সাহস সবটুকু কোথাও বিশ্রাম নিচ্ছে যেন। শরীরে জোর পাওয়া যাচ্ছিল না আর। মৃত্যুপুরীতে এসেছে সে, পুনরায় এই ভাবনা মানসিকতাকে পুরো সম্মোহনগ্রস্থ করে রেখেছে।

একেকটা রুম পেরিয়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে কোথাও গভীরে। বিস্তৃত বিশাল এপার্টমেন্ট। পরের রুমটায় উঁকি দেয়। দিয়াশলাইয়ের আলোয় এ রুমের সুইচ পেল। আলো জ্বালাতেই দু-কদম পেছায়। বিশাল কক্ষ। কমপক্ষে বিশ হাত দৈর্ঘ্য ও পনেরো-ষোলো হাত প্রস্থবিশিষ্ট ঘরে বিশাল বিশাল লোহার খণ্ড, দণ্ড, কীসব মেশিন পাতি, বীম। সারি সারি সব সাজানো। যেন লোহার খনিতে চলে এসেছে সে।

আবার আসছিল সেই কান্নার আওয়াজ। অথচ কেউ নেই কোথাও। পশমগুলো অবাধ্যের মতো খাঁড়া হয়ে আছে, পা জড়িয়ে আসা আড়ষ্টতা।

অন্তূ তটস্থ হয়ে ওঠে। বাচ্চা কাঁদছে। আবার! বিশাল এই কক্ষটিতে পনেরো ওয়াটের একটি মাত্র হলদে বাতি জ্বলছে, একাংশ আলোকিত তাতে, তাও সামান্য। অন্তূর শরীরের লোমকূপে কাঁপ ওঠে। তবু সে গভীরে হারায়। এগিয়ে যায় সামনের দিকে। দুপাশের লৌহখণ্ডের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা। কক্ষের শেষটায় ফাঁকা।

মোটা মোটা ইস্পাতের ধাতব খণ্ডের ভিড়ে এদিক-ওদিক তাকায় অন্তূ। এক কর্নারে একটা যেন কাটা হাত পড়ে আছে। অন্তূ বিশ্বাস হয়না, বোধহয় চোখে ভুল দেখল। ছিটকে পিছিয়ে যায়। মানুষের কাটা হাত। কোনো ভুল নেই। অন্তূ এগিয়ে যায়। হাতটা হাতে তুলে নেবার সাহস হয়না। আজ তার সব সাহস তলানিতে জমেছে। কেটে নেবার স্থান থেকে চুইয়ে পড়া রক্ত, ছিঁড়ে আসা শিরা-উপশিরা, থকথকে কষানিগুলো শুকিয়ে গেছে। পুরুষের হাত। হাতের কব্জিতে ঘড়ি। আঙুলগুলো থেতলানো। তাতে রূপার আংটি এখনও আছেই। অন্তূর বমি আসে, চোখদুটো ঘোলা হয়ে ওঠে। সে কল্পনা করে, জীবন্ত অবস্থায় এই বিশালাকায় লোহার পাতের ওপর কারও হাত রেখে হাতুরি দিয়ে আঙুলের অস্থি-সন্ধিগুলো ছুটিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে হাতটাকে থেতলানো হয়েছে। লোকটা কতটা চিৎকার করেছিল? করেনি বোধহয়। কাপড় গুঁজে দেয়া যায় মুখে অথবা এই বদ্ধ ঘর ছেড়ে আওয়াজ দোতলায় কেন উঠবে?

অন্তূ উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায়না। সে মার্ডার তো দেখেছে। হামজা সীমান্তকে মেরেছে, আগুন্তুক হুমায়ুন পাটোয়ারীকে মেরেছে! তখন কষ্ট হয়নি। কারণ কী? ওই দুই ভিক্টিমের পাপ গাঢ় ছিল তাই? এই কাটা হাতের মালিকের পাপ থাকতে পারেনা?

অন্তূ ওঠে কোনোমতো। কয়েক পা এগোতেই বিকট দূর্গন্ধে মাথাটা ঘুরে আসে। এত বিশ্রী গন্ধ কীসের? অন্তূ হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে। লোহা গলানোর বিশাল বিশাল অনেকগুলি চুল্লি। বাইরে থেকে ওয়ার্কশপকে এতটাও বড় লাগেনা, যতটা এখানকার যোগান। তা বড়, তবে এতটা না বোধহয়। আশপাশে বিভিন্ন ধরণের ফ্রেম ও যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। ফ্রেমগুলো অস্ত্রের। ধাতব গলন ঢেলে লৌহ-অস্ত্র বানানো হয় সে-সবে।

তার পাশেই গলিত মাংসপিণ্ড। মানুষের দেহ। থকথকে জেলির মতো পড়ে আছে। মানব দেহের আকার নেই সে-সবে। অন্তূ শক্ত করে নাক চেপে ধরে ওড়নায়, তাতে শ্বাস আঁটকে আসে। তবু গলিত মাংস পঁচার গন্ধ নাকে মুখে ঢুকছে। মানুষের দেহ পুড়ে, ঝলসে, কুঁকড়ে উঠেছে। তাতে ছত্রাক বাসা বেঁধেছে, আরও ক্ষয় হচ্ছে, দূর্গন্ধ হচ্ছে।

লোহা গলানো হয় প্রায় ১৬০০° সেন্ট্রিগেড তাপমাত্রায়। মানবদেহের সহনশীলতা কতই বা—কমবেশি ৪৫° সেন্ট্রিগেড!

সেই চুল্লিতে মানুষের শরীর ঝলসানো হয়েছে। গলিত লোহার লাভা ঢালার জন্য হাতলবিশিষ্ট পাত্র। যা লোহার দণ্ডে চেপে ধরে গলিত ধাতু ঢালা হয় ধাঁচে। ঝলসানো মাংস পঁচেছে এখানে থেকে। আচ্ছ! এখানে কি কর্মচারীরা আসেনা? শুধু জয় আর হামজা আসে?

আন্দাজ করা যায় এখনও কক্ষের অর্ধেকটার বেশি বাকি। পুরোটা অন্ধকারে ছেঁয়ে আছে। অন্তূ সুইচ খোঁজে।

তার শরীর ঘেমে চুপচুপে হয়ে উঠেছে। হৃদযন্ত্রের ধরাস-ধরাস আওয়াজটা কঠিন অস্থিরতার জানান দিচ্ছে। অন্তূর দেয়াল ঘেঁষে বসতে চায়। পারেনা। পাশেই মানুষের ঝলসানো মাংস, হাড়, চুল, কাটা হাত, জাহান্নামের মতো আগুন জ্বলার চুল্লি পড়ে আছে, ফায়ার পাইপগুলো কালশিটে ধরা। মেটাল বার্নার মেশিন এখানে কেন, অন্তূ বুঝল না। বড় কোনো কারবারের গোডাউন হিসেবেও এটা ব্যবহৃত হয় হয়ত।

অন্তূ চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। নিস্তব্ধ চারপাশ, শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা নেই এই বদ্ধ ধাতব বেষ্টনীর মাঝে। দম ঘুটছিল খুব। আবারও আচমকাই অন্তূর মনে হলো, সে ছাড়াও আরও কেউ শ্বাস ফেলছে। কেউ নয়, কারা বুঝি। অনেকের শ্বাসের আওয়াজ। আঁটকে থাকা শ্বাসের আওয়াজ। কারা বোধহয় দেখছে ওকে। জ্বলজ্বলে চোখে। কিন্তু তাকে দেখে চুপটি করে আছে। শ্বাস আঁটকে তাকে লক্ষ্য করছে অনেক জোড়া চোখ। অন্তূর দেহটা নেতিয়ে পড়তে চায়।

আবার অস্ফূট স্বরে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে অন্তূর শরীরটা ঝনঝন করে ওঠে। একবার গলা চিড়ে আওয়াজ বেরিয়েই যেন থেমে গেল। কেউ বুঝি চুপ করালো! মুখ চেপে ধরে!

বিশাল এক গুমোট আলো-বাতাসহীন কক্ষ। টিমটিম করে হলদে আলো জ্বলছে। এই কান্নার আওয়াজ সে বহুবার শুনেছে হয়ত। রুমের বারান্দায় দাঁড়ালে মাঝেমধ্যে এই আওয়াজই কি কানে যেত? জয় তখনই ওকে ভেতরে ডেকেছে, যেকোনো বাহানায় থাকতে দেয়নি বারান্দায় আর।

অন্তূ অন্ধকারে এগিয়ে যেতে যেতে প্রথমত একটা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোহার পেরেক পায়ের নগ্ন তালু ভেদ করে বিঁধল। কমপক্ষে এক ইঞ্চ। অন্তূর মাথার চাঁদি ঘুরে ওঠে। তীক্ষ্ণ আর্তনাদে কুঁজো হয়ে পড়ে অন্তূ। দাঁতে দাঁত আঁটকে একটানে লোহাটা টেনে বের করে। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসে। যেন ট্যাপের পানি ছাড়া হলো। আবার পা চালায়। বিভিন্ন সব যন্ত্রে অথবা কীসে পায়ের ত্বক ছিঁড়ে-ফেঁড়ে যায়। সে থামেনা। পুরো শরীরে বিঁষ ছড়ানো অস্থিরতা, যন্ত্রণা!

অনেকটা এগিয়ে গিয়ে তিন-চারটা কাঠি একসাথে জ্বালায়। বেশ কিছুটা আগুনের বহরে সাদার সমরোহ চোখে ভেসে ওঠে। ঠিক বুঝে ওঠার আগেই কাঠির আগুন আঙুলে এসে লাগায় কাঠি ছেড়ে দেয় অন্তূ। এগিয়ে গিয়ে সুইচ দাবায়। আরেকটা হলদে বাল্ব জ্বলে ওঠে। মৃদু আলো। সামান্য একাংশ আলোকিত হয় তাতে কেবল। সামনে এক সারি সাদা। অন্তূ চুপচাপ চেয়ে থাকে শুধু সামনের দিকে।

পালা ধরা মানুষ। তারা সব ছোট মানুষ। পাঁচ বছর থেকে শুরু করে বয়স সর্বোচ্চ বছর পনেরোর বেশি নয় একটারও বয়স। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী সবগুলোর। মাথায় টুপি। পাঁচ-কলির, কওমি মাদ্রাসার টুপি পরা। জরা-জীর্ণ হয়ে আছে সবগুলো। অন্তূকে দেখেই তারা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে আরও জড়িয়ে বসে। এখানেও বড়গুলো ছোট কয়েকজনের মুখ চেপে ধরে আছে। কাঁদতে দিচ্ছে না। চোখে-মুখে কীসের ভয়। পিপাসা-ক্ষুধা, আতঙ্ক, কাতরতা। সে কী নিদারুণ অসহায়ত্ব। ছোট্ট ছোট্ট মানুষ ওরা। এই মৃত্যুপুরীতে কী করছে?

তারা বিস্ফোরিত চোখে দেখে। রোজ যে নারীটি তাদের চব্বিশ ঘন্টায় একবার খাবার দিতে আসে, সে নয়। এ তো অন্যকেউ! কে এ? রাণী গোলাপি লম্বা কামিজের সাথে চওড়া একটা হালকা গোলাপি ওড়না জড়ানো শরীরে। হাতে দিয়াশলাই। ঘামে ভেজা মুখটা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছিল না ভেতরটা। অথচ চেহারাটা প্রথম দেখায় ‘সুন্দরী, সুন্দরীʼ বলে ওঠার মতো। চোখদুটো গভীর, ঘন পাপড়ির অলস ঝাপটানিতে আত্মবিশ্বাস, অল্প বিস্ময়, কিছুটা হতাশা! ওরা আরও জড়িয়ে বসে, আরও জড়োসরো হয়ে। ছোটগুলোর চোখের পানি শুকায়নি। অনবরতই কাঁদে ওরা। বড় যারা একটু, ছোটরা ওদের জাপটে ধরে বসে আছে। মুরগীর বাচ্চাগুলোর মতো ওদের পাখার নিচে আশ্রয় চায় বোধহয়।

কবরখানার চেয়েও ভয়ানক এই অবরুদ্ধ কুটুরিতে, যে তিমির আঁধার, তাতে আঁটকে আছে এরা। কেউ কাউকে দেখেতেও পায়না বুঝি! দিনেও আলোও আসেনা সেখানে।

ছোট্ট এক পুঁচকে। মাথার এলোমেলো টুপিটা ঠিক করে কোনোমতো অন্তূকে বলে, “একটু পানি দিবে? পানি…পিপাসা… আমি একটু পানি খাব…ʼʼ

অন্তূর বুকের ভেতরটা এক মোচড়ে উলোট-পালোট হয়ে ওঠে। ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে। ওরা পানি চায়, ওরা পিপাসার্ত। ওরা ছোট্ট ছোট্ট মানুষ।

চলবে…

[প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য]]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৪৭.

পায়ের ব্যাণ্ডেজ দিকে তাকিয়ে থেকেও অন্তূ নিজের রুম, পা, ব্যাণ্ডেজ, আশপাশের কিছুই যেন দেখছিল না। চোখের সামনে পর্দা পড়েছে। আলো-আঁধারির ভিড়ে হলদে বাতির টিমটিমে আলোর পর্দা। রিমি জ্বর মেপে গেছে—১০৩° ফারেনহাইট। মাঝেমধ্যেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বরের তোপ বাড়ছে। চোখদুটোতে বিঁষের মতো জ্বালা ধরেছে।

সেসব গায়ে লাগছিল না অন্তূর। সে যেন অচেতন এখনও। কীভাবে রুমে এসেছে, তা ঠিকমতো মনে পড়ছে না। রিমি ধরে এনেছিল, এটুকু মনে আছে আবছা করে।

ওরা পানি চাইছিল। অন্তূ তো পানি নিয়ে যায়নি! সে সামনে বসে পড়েছিল আস্তে করে। দেহটা থরথরিয়ে কাঁপছিল। ওদের চোখে-মুখের সেই কাতর-আতঙ্কিত চাহনি! অন্তূর শরীরটা নেতিয়ে পড়তে চায়। জিজ্ঞেস করতে জিহ্বা সরে না—তোমরা কারা? এখানে কেন?

অনেকক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমরা কি মাদ্রাসায় পড়ো? হাফেজিয়া মাদ্রাসায়?ʼʼ

একজন মাথা নাড়ে, সায় দেয়। অন্তূ আবার চুপ। সে এ বাড়িতে এসেছে মাস কয়েক হলো। প্রথমবার এদের কান্নার আওয়াজ পেয়েছিল বিয়ের পর জয় আমির যেদিন রাজধানী থেকে ফিরল, সেই শেষরাতে। এরপর বহুবার শুনেছে, এদিকে আসা-যাওয়াও দেখেছে ওদের। সেদিন এদের ধরে আনা হয়েছে। ঢাকা থেকে ফিরে। রাজধানী থেকে অর্ডার পেয়ে এসব করছে এরা?

-“তোমাদের কবে আনা হয়েছে এখানে?ʼʼ

-“কয়েকদিন আগে।ʼʼ

অন্তূ ভাবে, তাহলে তখন কাদের কান্নার আওয়াজ অল্প-সল্প উপরতলায় যেত? এদের আগেও আরও আনা হয়েছিল? আজ প্রায় দু সপ্তাহ যাবৎ জয়-হামজার পায়ের সুঁতো ছিঁড়েছে। রাত-দিনের ঠিক নেই, ছুটছে ওরা। অন্তূ উঠে দাঁড়াতে চায়। পা টলছে, অসহ্য যন্ত্রণায় অসাড় হয়ে এসেছে পা-টা। শক্তি নেই চলার।

চুপচাপ বসে থাকে শ্বাস আঁটকে। বাচ্চাদের মুখে আতঙ্ক কমেছে। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “তোমরা কারা?ʼʼ

বয়স পনেরোর মতো একটা ছেলে। দৃষ্টি অস্তমিত তবু দৃঢ় স্বরে জানায়, “শিবিরের ছেলে আমরা।ʼʼ কথাটা বলতে পেরে যেন সে খুব গর্বিত।

-“নাম কী তোমার?ʼʼ

-“আব্দুল আহাদ।ʼʼ

-“তুমি হাফেজ?ʼʼ

-“হ্যাঁ।ʼʼ

-“কয় পারার?ʼʼ

-“কোরআন কয় পারা?ʼʼ

অন্তূ চেয়ে দেখে আব্দুল আহাদের দিকে। প্রথম থেকে ওকে লক্ষ্য করছে অন্তূ। চোখে ভয় নেই আর সবার মতো। সে-ই যেন সবার জন্যই চিন্তিত। অন্তূ বলে, “ত্রিশ পারা।ʼʼ

-“আমি সেই ত্রিশ পারা কোরআনের হাফেজ।ʼʼ

-“তোমাদের কেন ধরে আনা হয়েছে, জানো?ʼʼ

-“জানব না কেন?ʼʼ

-“কেন?ʼʼ

-“ওরা ভয় পায় আমাদের।ʼʼ

-“ওরা ভয় পায়? কীসের ভয়?ʼʼ অন্তূ একটু অবাক হয়।

-“আমরা বড় হলে একেকটা শিবিরের ছেলে হবো, ওদের বিরোধী দলের কর্মী ভারী হবে। কিন্তু আমাদের মারলে আমাদের আমিররা দূর্বল হয়ে পড়বে।ʼʼ

-“তারা দূর্বল হচ্ছেনা?ʼʼ

-“কারাগারে পুড়ে দেয়, ফাঁসি দিয়ে দেয়, গুম করে দেয়। ট্রাক ভরে তুলে নিয়ে যাইয়ে গুলি করে মেরে র-ক্ত ধুয়ে ফেলে। দূর্বল হয়না আবার? এত কিছু করছে, কী-ই বা করতে পারছে?ʼʼ

অন্তূ চুপ করে বসে থাকে। আব্দুল-আহাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগছে তার। দাড়ি-গোফের রেখা দেখা দিয়েছে, তবু মুখটা কচি। সেই কচি মুখে এতসব ভারী কথা! ধর্মবিশ্বাসের শক্তি? সৃষ্টিকর্তার প্রণিত বাণী বুকে ধারণের শক্তি? অন্তূ ভাবে।

সবাই তো ভালো হয়না। টুপি-দাড়ি পরা সবাই ভালো না, নামাজী সবাই ভালো না, হাফেজও সব ভালো না। কিন্তু বাকিগুলো? অন্যান্য দলের নেতাকর্মীদের মাঝে একশো-তে কয়টা ভালো আছে? বর্বর, মূর্খ, অসভ্য, জানোয়ার একেকটা। কিন্তু এদের মাঝে যদি নব্বইজনকেও খারাপ ধরা হলো, বাকি দশটা? এরা কি দশজনও নৈতিকতা জানেনা? যত যুদ্ধাপরাধ, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ–সব এরা করে বেড়াচ্ছে? তার চেয়ে বড় কথা, যারা এখনও পাপ করেইনি, তাদের জান নিয়ে খেলাপাতি খেলার অধিকার কে দিলো স্বৈচারারদের? ওরা নাবালক শিশুরা কী পাপ করতে পারে? হাজারও মায়ের বুক খালি করে, ছোট ছোট মানুষগুলোর বুকের তাজা র-ক্ত মাটিতে মিশিয়ে দেশের অপরাধমুক্ত করে ফেলছে ওরা? তাহলে দেশে যা সব ঘটছে তা এদের মরা-আত্মারা উঠে এসে করছে? বাকিরা বেহেশতের দূত! হবে তা-ই।
পলাশরা কারা? রাজনরা কারা? এরাই যদি সব পাপের ভাগী এবং শাস্তির দাবীদার হয়?

অন্তূ ভাবনা ছেড়ে উঠতে চায়। আব্দুল আহাদ চোখ নত করে রেখেছে। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “তুমি মরতে ভয় পাও না?ʼʼ

-“ভয় পেলে কি মরণ মাফ?ʼʼ

অন্তূ এ কথার কী জবাব দেবে! জিজ্ঞেস করে, “এসব কে শিখিয়েছে তোমাদের?ʼʼ

-“কে শেখায়? মাঝরাতে যখন অল্প সময়ের জন্য ঘুমাতে যাই, খবর আসে কারা যেন মাদ্রাসা ঘিরেছে, পালা পালা ধরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ওরাও তো মরবে। তার পরের পালা নাহয় আমাদের। ভয় করে লাভ কী?ʼʼ

-“সবাইকে এখানেই আনা হয়েছিল?ʼʼ

-“এরা ছাড়া আর কি লোক নাই? কতলোক ওদের।ʼʼ

সহপাঠিদের চিৎকার আর অসহায়ত্ব এইটুকু মানুষগুলোর মাঝে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছে। এই আগুনে কি কোনো একদিন পুড়ে মরে যাবেনা দেশের ক্ষমতাধর স্বৈরাচার? মানুষের দীর্ঘশ্বাস, অবিচার, অধিকারহীনতা, রাহাজানি, হাহাকার—কতদিন?

অন্তূ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পায়ের সমস্ত স্নায়ু যেন একসাথে তীব্র উদ্দীপনায় ফেটে পড়েছিল। এখনও চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। আব্দুল আহাদ এগিয়ে আসে। অন্তূ চমকায়।

-“দেখি, পা দেখি।ʼʼ

অন্তূ তাকায় আব্দুল আহাদের মুখে দিকে। চোখের দৃষ্টি নত, মুখটা গম্ভীর। তার জুব্বার প্রান্ত ছেঁড়া, ঝুলছিল। তা টান দিয়ে ছিঁড়ে নিয়ে অন্তূর পায়ে বেঁধে দেয়। অন্তূ পায়ে হাত দেয়া থেকে বাঁধা দিলে বলে, “আমি তো ছোট আপনার। কিছু হবেনা। বেঁধে দিই। রক্ত পড়ছে।ʼʼ

বাঁধা শেষ হলে বলল, “এই অসময়ে কেন এসেছেন জানিনা। আপনি কে তাও জানিনা। ও একটু পানি খেতে চাচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে। পানি আনেন নি?ʼʼ

অন্তূর বুকে শূল বিঁধল বোধহয়। ‘পানি আনেন নি?ʼ বাক্যটা ফলার মতো বেঁধে বুকে।

অন্তূ ঝারা মেরে উঠে পড়ে। আব্দুল আহাদ ওকে ধরতে হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নেয়। অন্তূ নিজে চেপে ধরে ওর হাতটা, ওর হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ছোটভাই তো তুমি আমার। হাত ধরলে কী?ʼʼ

মলিন হেসে বেরিয়ে আসে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বড়ঘর পার হতেই অন্তূর দম বেরিয়ে যাচ্ছিল। পা দুটো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।

অন্তূ যখন দোতলায় ফিরে বড় বড় জগ ভরে পানি নিচ্ছিল, রিমি হায় হায় করতে এগিয়ে আসে, “কী করছেন, আরমিণ? পাগল হয়ে গেছেন? ওদের একবেলার বেশি পানি বা খাবার দেবার হুকুম নেই।ʼʼ

-“কার হুকুম নেই? আপনার নরকের দেবতা, স্বামীদেবের? তা না-ই থাকতে পারে, আপনিও পতিভক্তা নেউটা মেয়ে হতে পারেন। কিন্তু জানেন তো, আমি খুব পাপীষ্ঠা, আর স্বামীর অবাধ্য, অভিশপ্তা একজন স্ত্রী। আমার এসব মানার কথা নয়।ʼʼ

-“আপনি বুঝতে পারছেন না। প্লিজ…ʼʼ

-“এ বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাই না। যদি আজ বাঁধা দেন, তো সুযোগ পেলে আপনাকেও ছাড়ব না। আর আমার বিশ্বাস, সুযোগ আমি পাবোই।ʼʼ

অন্তূকে তখন ঠিক মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাগছিল, যেন তাকে বশ করা হয়েছে। জয় একগাদা বিস্কুট, কেক ইত্যাদি খাবার-দাবার এনে রাখে ঘরে। অন্তূ সেইসব এবং পানি ও টর্চ নিয়ে খুঁড়িয়ে নিচতলায় পৌঁছায়।

ওরা খেতে চায়না, শুধু ওদের পানি চাই। বুক চৌচির পিপাসায়। অন্তূ খাওয়ায় ওদের। ওদের হাত বাঁধা নেই। তবু সম্ভব নয় ঘুটঘুটে অন্ধকারে উঠে এসে সুইচ খুঁজে বাতি জ্বালায়। অন্তূ বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে। পায়ের ব্যথায় মাথা ফাঁকা হয়ে আসছিল।

বড়ঘরের বাইরে বিস্তৃত ফ্ল্যাট। নোনা ধরেছে ইটের গায়ে। কোথাও খানিক আলোর দিশা নেই। খসখসে ঢালাই মেঝে হল-গ্রাউন্ডটাতে। তাতে পায়ের চামড়া খসে আসছিল যেন। এক পা ফেলতে পারছিল না। যেদিকে তাকায়, অন্ধকারের সমুদ্র ঢেউ খেলছে। রাত শেষের দিকে। দুর্গের মতো দরজা-জানলাবিহীন কুটুরি। টর্চের আলো সামনের দিকে সরু হয়ে পড়ছিল, তাতে আরও গা ছমছম করা পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

কারও পায়ের শব্দ পায় অন্তূ। থমকে দাঁড়ায়। তার পেছনে কেউ হাঁটছে। তার সাথে পা মিলিয়ে। চোখ বুজে শরীরের শিরশিরানি অনুভব করল। পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হয়না। কেউ খুব কাছে আসছে, এগিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছে। এরপর ফিসফিস করে অন্তূকে বলে, “আপা। আমি, আব্দুল আহাদ। ভয় পাবেন না।ʼʼ

অন্তূ আব্দুল আহাদের হাতটা চেপে ধরে শ্বাস ছাড়ে। বলে, “তোমাদের কোন পথ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল?ʼʼ

-“তাতে কী?ʼʼ

-“শুনি।ʼʼ

-“চোখে পটি বাঁধা ছিল। মুখে কাপড় গোঁজা ছিল। গভীর রাতে আনা হয়েছিল এটুকু আন্দাজ আছে। আপনি এখানে কেন আসছেন আজ বারবার?ʼʼ

-“তোমার খারাপ লাগছে?ʼʼ

গম্ভীর হয়ে রইল আব্দুল আহাদ, জবাব দিলো না। দুজন মিলে ঘুরে ঘুরে দেখে পুরো ফ্লোরটা। এক কক্ষে সারি সারি মদের বোতল সাজানো কেসে ভরা। উটকো গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া দায়। একটুও পা দেবার জায়গা নেই মেঝের কোথাও। আব্দুল আহাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও ভৌতিক ঠেকছিল নিস্তব্ধ বদ্ধতায় অন্তূর কাছে।

এত মদ! এগুলো পলাশের হোটেলের মনোরঞ্জনের মাল, এখানে রাখা আছে। টর্চের আলো সরু হয়ে পড়ে। সেভাবেই অন্তূ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘরটা দেখে ফিরে আসতে উদ্যত হয়ে আবার ঘুরে তাকায় চট করে। আব্দুল আহাদ শুধায়, “কী?ʼʼ
অন্তূ মেঝেতে রাস্তা খোঁজে। মদের বোতলের কেইসগুলো গিজগিজ করছে। ঘরের পশ্চিম কোণায় দরজা একটা। লোহার দরজা। অন্তূ নিঃশব্দে কেইস সরাতে চায়। ঠুকঠাক শব্দ তবু হচ্ছিল। অন্তূ আব্দুল আহাদকে দাঁড় করিয়ে রেখে নিজে এগিয়ে যায়। লোহার ভারি দরজা চাপানো। অন্তূ তা খুলে ফেলে আস্তে করে।

ঠিক যেন বেকারীর কারখানার মতো। অস্তমিয সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছে ভেতরটা। কড়া পাওয়ারের হলদে লাইট। অন্ধকারে লাইটের আলোতে গুমটে মারা অবরুদ্ধ ঘরটাকে দেখে অন্তূর আনন্দই হলো। সে জীবিত চোখে নরক দেখে নিলো। বেকারী কারখানার তুন্দুরিগুলো যেমন আগ্নেয়গিরির লাভার মতো জ্বলে, ঠিক তেমন তিমির অন্ধকারে হলদে আলো সেরকম পরিবেশ তৈরি করেছে। সেখানে মহিলাদের এক ঝাঁক নজরে আসছে।

তারা অবাক হয়ে অন্তূকে দেখে। শুয়ে, বসে, হেলান দিয়ে আছে তারা, একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে বসে আছে তারা। তাদের সবার শরীরে এক টুকরো করে সাদা কাপড়। যেমনটা মেয়েরা গোসল করে তোয়ালে জড়ায় শরীরে, ঠিক সেভাবে দেহের উপরিভাগ ঢেকে রেখেছে যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও। এরাও পলাশের হোটেলের মাল সবগুলো।

অন্তূ শরীরটার ঝিনঝিন করে ঝাঁকি মেরে ওঠে। ভাগ্যিস আব্দুল আহাদ আসেনি, সে দেখতো এই নারকীয় পরিবেশ! অন্তূ বাকহারা হয়ে চেয়ে থাকে। সে টেরই পেয়েছিল না— ওই বাচ্চাগুলো ছাড়াও এই বদ্ধ কুটুরিতে আরও প্রাণের অস্তিত্ব আছে।

অন্তূ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবার চেষ্টা করে—এইসব লেওয়াজের কারণেই কি পলাশ ও হামজা-জয় একে অপরের দলকে এত সমীহ করে চলে? গাঢ় কারবার-বন্ধন। এজন্য যত যা-ই হোক, যেমন আগুনই দপ দপ করে জ্বলে উঠুক, মোটেই তারা একে অপরের দলকে হিট করেনা! সন্ত্রাসবাদ, রাজনীতিবিদ, স্বৈচারার, নরহত্যাকারীরা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে চারদিকে। দাউদাউ করে জ্বলছে নরকের আগুন, সেই আগুনের আঁচ জনতাদের সবার গায়ে সবসময় না লাগলেও লেগে যায় কদাচিৎ।

অন্তূ জ্বরের ঘোরে বেশি ভাবতে পারেনা। অবচেতনায় লুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ে থাকে।


জয় এলো রাত বারোটার দিকে। তার চোখ-মুখ ক্লান্ত হলেও কীসের এক খুশির রেখা ঝকমক করছে। পরনে সিলভার রঙা ডেনিম, হাইবুটের সাথে গটগট শব্দ তুলে রুমে ঢুকল। এত অভিজাত ভদ্রলোকের মতো লাগেনি কখনও। খোচা খোচা দাড়ি অল্প বেড়েছে, ফেঞ্চকাট চুলে খুব অসভ্য-ভদ্রলোকের মতো দেখায় তাকে।

রুমে ঢুকে প্রথমে অন্তূর দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, “আমার একদিনের বিরহ বইতে পারোনি? জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছো? তোমার আমার প্রেম আমি আজও বুঝিনি…ʼʼ সুর করে গাইল শেষটুকু।

কথা শেষ না করতেই যখন অন্তূর পায়ের দিকে চোখ গেল। এত জোরে ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে হো হো করে, অন্তূ চোখ খুলে তাকাল। হাসির তোরে নুইয়ে পড়তে চায় জয়। পুরুষ মানুষ হাসলে গলাটা দারাজ হয়ে ওঠে কেমন। প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরতে পরতে বলে, “আমাকে কি তোমরা নিজের ওপর থেকে কনফিডেন্স কমাতে দেবে না, হ্যাঁ? শালা যা ভাববো তা হয়ে বসে থাকে, যা আন্দাজ করি, তা আলবাৎ ঘটে যায়, খালি ভাবার দরকার, মিস নাই।ʼʼ

সাদা লুঙ্গিটা পরে জ্যাকেটটা খুলে ছুঁড়ে উড়িয়ে দিলো।
প্রচুর গরম লাগছে। দরজাটা লক করে এসি অন করে অন্তূর সামনে এসে মেঝেতে উবু হয়ে বসে হাঁটু ভাঁজ করে। কপালে ও গলায় হাত রেখে আস্তে করে বলে, “তোহ ঘরওয়ালি! অনুভূতি কেমন নিষিদ্ধ জায়গায় পা রেখে?ʼʼ

অন্তূ চোখ খোলেনা। জয় মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, অগোছালো চুলগুলো হাতের ছোঁয়ায় গুছিয়ে দেয় আলগোছে। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে নিচু আওয়াজে জিজ্ঞেস করে, “এত জ্বর বাঁধালে কী করে? ওষুধ খেয়েছ?ʼʼ

অন্তূর চোখের কোণা দিয়ে পানি পড়ছিল। চোখ জ্বলছে, জ্বর এলে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। জয় তা আঙুলের ডগায় মুছে সেই পানিটুকু মনোযোগ সহকারে দেখতে দেখতে বলল, “পা কেটেছে কীসে? ইস্পাত খণ্ডে? কতখানি কেটেছে?ʼʼ

-“ওদের কেন ধরে এনেছেন?ʼʼ তিরতির করে কাঁপছে অন্তূর কণ্ঠস্বর।

জয় উঠে বাথরুমে গিয়ে বালতি ভরা পানি ও মগ এনে মেঝেতে রাখে। অন্তূকে পাঁজাকোলে কোরে তুলে বিছানার একপাশ থেকে অপর পাশে নিয়ে যায়। হাঁটার সময় আবার নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্তূর মুখটা তার বুকে গোঁজা। মুচকি হাসে আনমনে। খুব সুখ সুখ লাগছে। হাজারো পাপের মাঝে কখনও-সখনও পাপকে অবহেলা করতে সে গান গায়, গিটার বাজায় আরও কত কী করে! আজাকাল সেসব বাদ দিয়ে অন্তূকে জ্বালায়।

আড়াআড়ি শুইয়ে দিয়ে মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করে, “ডাক্তার আনব?ʼʼ

-“এসেছিল।ʼʼ

-“কী বলেছে? ওষুধ দেয় নাই?ʼʼ

-“দিয়েছে।ʼʼ

-“খাওনি কেন?ʼʼ

অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢালল জয়। জ্বর খানিক নামলো কিনা বোঝা গেল না। তবে কপাল ও মাথাটা ঠান্ডা হলো।

জয় লুঙ্গির ওপর গলায় এক লাল টকটকে গামছা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। কী সব হোটেলের খাবার কিনে আনে। অন্তূকে খাওয়াতে চায়। সেই রুচি বা মানসিকতা নেই অন্তূর। জোর করে ওষুধ খাওয়ায়। সাথে একটা ছোট্ট স্লিপিং ড্রাগও। সারারাত অচেতন ঘুমালো অন্তূ। তার হুশ নেই।

জয় চেয়ার টেনে নিয়ে বিছানার পাশে বসে চেয়ে থাকে অন্তূর দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কিউব মেলায় আনমনে। বিশাল ট্রমায় পড়ে গেছে মেয়েটা। তেজী মুখখানা একদম কুঁচকে গেছে।

শেষরাতের দিকে নিচতলার বড়ঘরে যায় একবার। সব ঠিকঠাক। খালি পানির জগ ভরে রেখে গেছে বাচ্চাগুলোর সামনে। জয় হাসল তা দেখে। বাচ্চারা ভয় পায় জয়কে দেখে। সেখান থেকে বেরিয়ে যখন মদের ঘরে গেল, মাথাটা গরম হলো। সব এলোমেলো করে সাজানো। অন্তূ অতসব বোঝেনি। মদের কেস সাজানো হয়েছে এখানে ক্রম অনুসারে। সে তো চেনেনা। হুইস্কি, রাম, জিন, বিয়ার, ওয়াইন, ভোদকা ইত্যাদি মাফিক সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। মহিলাদের ঘরে ঢুকবার পথ পেছন দিকে। ওই রাস্তা দিয়ে বাগানের রাস্তা চলে গেছে লোহার ফটক পেরিয়ে। এদিক দিয়ে ঢুকেতে হয় ওই কক্ষে। অন্তূ জানেনা।

মহিলাদের কামরায় আওয়াজ যেতেই ওরা থরথর করে কেঁপে ওঠে। ঢালাই মেঝেতে চামড়ার স্যান্ডেলের আওয়াজ, সাথে খোলা বেল্ট ঘেঁষে আসছে। এই আওয়াজ চেনে তারা। জয় আমির সাদা লুঙ্গির কুচি উঁচিয়ে ধরে এগিয়ে আসছে। লোকটা কিচ্ছু বলবেনা, তাকাবেও না। তবু জয়কে ওদের চরম ভয়। ঘেন্না করে ভীষণ, ঠিক ডাস্টবিনে, আবর্জনার মতো।

মানুষ হয়ত ড্রেনের পানিকেও অতটা ঘেন্না করেনা, যতটা ঘেন্না জয় ওদের করে। ওরা সব একসাথে জড়োসরো হয়ে দাঁড়ায়। জয় নাক কুঁচকে দেখে চারদিকটা। একটাবারও ওদের অর্ধবস্ত্রে অনাবৃত দেহটার দিকে তাকাল না। তার রুচি ভালো। যারা শরীর ঢেকেঢুকে রাখে, সম্মানবোধ আছে, তাদের প্রতি তার আগ্রহ আসে। যারা খুলেই রেখেছে, তাদের আবার দেখার কী আছে? সস্তা দেহ, সস্তা মেয়েলোক। এইসব ধারণায় বিশ্বাসী জয় আমির পলাশের কাছে দারুণ খাতিরের লোক।

মাঝেমধ্যেই হোটেলরুমে জয়কে মেয়ে নিয়ে ঢুকতে দেখে অভ্যস্ত মেয়েরা। অথচ শখ মিটলেই কুকুরের মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবার এই নোংরা স্বভাবের জন্য ওর কাছে কোনো মেয়ে যেতে চাইতো না। বিয়ের পর ধীরে ধীরে যাওয়া বন্ধ তার। তার রেস্ট্রিকশন বহুত। প্রথমত কড়া নিষেধ হলো, তাকে কোনোভাবেই চুমু খাওয়া যাবেনা। এছাড়াও জড়িয়ে ধরা যাবেনা, গা ঘেঁষা যাবেনা, নির্লজ্জের মতো অঙ্গভঙ্গি দেখানো যাবেনা। মেয়েলোকের বেহায়াপনা আর ঢঙে জয়ের গা জ্বলুনি রোগ আছে। সে নিজে যা করবে, সেটুকুই।

এই নিয়ে পলাশ খুব হাসিমজা করতো। একবার একটা মেয়ে জয়কে খুশি করার লক্ষ্যে অথবা টাকা হালাল করার উদ্দেশ্যে বোধহয় ওকে জাপটে ধরে চুমু খেয়েছিল। এক থাপ্পড়ে কান দিয়ে রক্ত বের করে রুম থেকে বের করে দেবার রেকর্ড আছে জয়ের। এসবে হোটেলে ভীষণ হাসাহাসিও লেগে যেত। মেয়েরা জয়কে ভীষণ ভয় পায়। যারা একটু লজ্জা পায়, সংকোচ থাকে ভেতরে, নতুন আসে, তাদের দেয়া হতো জয়ের সাথে।

অন্যদিকে তাকিয়ে জয় জিজ্ঞেস করল, “কেউ এসেছিল তোদের কাছে?ʼʼ

-“এক মাগী আইছিল কেডা জানি….. দেইখা গেল আমারে সকলরে..ʼʼ

আর রেহাই হলো না। জয় ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে কণ্ঠনালিটা চিপে ধরল দুই আঙুলে, “আমার বউ সে। তোদের মতো স্লাট না। বল কে ছিল, বল বল বল… আমার বউ ওটা। কথা বল, শালী খা-ন-কির চেংরী। বল কে ছিল যেন? স্পিক আপ—ʼʼ

‘আপনার পত্নী।ʼ কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে গালে রক্ত উঠে যাবার উপক্রম হলো মেয়েটার।

সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মদের কেসগুলো ফের সাজালো। দুটো রামের বোতল নিলো নিজের জন্য। আগামীকাল মদ ও মহিলাগুলো পৌঁছে যাবে পলাশের বাপের হোটেলে, রাজধানীতে। বড়ঘর পেরিয়ে আসার সময় পানির জগগুলো নিয়ে এলো। হামজা দেখলে পাছে রেগে যাবে। জয়কে দূর্বল ভাববে, বউয়ের খাতিরে দূর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। বউকে লাই দেয়া পুরুষের জন্য খুব একটা ভালো কথা না।

অন্তূ তখনও ঘুমাচ্ছে। খানিক বাদে ফজরের আজান হবে। খুব গরম লাগছিল বড়ঘর থেকে ফেরার পর। হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে যেতেই দেখল, তরু খাবার বাড়ছে। মেয়েটার অভ্যাস কাটেনি, অথচ কথা বলেনা। জয় নিঃশব্দে খাবারটা নিলো। ভাত একটু কমিয়ে রাখল। খিদে নেই খুব একটা। তরুকেও কিছু বলল না। তাকে সকলেই ঘেন্না করে, তরু খালি করতো না, এখন সেও করে। তাকে ঘেন্না করা এক প্রকার বিধান। মেয়েটা বিধান লঙ্ঘনে ছিল, এতদিনে লাইনে এসেছে। চুপচাপ চলে এলো ঘরে। আজ মনটা ভার লাগছে খুব।

অল্প খাবারের মাঝেও পুরোটা খেতে পারল না। বমি আসছে। ঘুম নেই চোখে। বোতল খুলে নিয়ে বসল। শরীরটা ঝিমিয়ে আসছে। লুঙ্গি গুটিয়ে চেয়ারের ওপর গা-হাত-পা ছড়িয়ে বসে তাকিয়ে থাকল অন্তূর ঘুমন্ত মুখটার দিকে। নেশা হয়, অথচ মাতাল হয়না সে। মদও ভালো লাগছে না। জীবনটা ঘনিয়ে আসছে, বেশিদিন নেই। তাতে খুশি খুশি লাগে আবার দুঃখ ঘিরে ধরে।

আরমিণ যা করছে, তা ঠিক। অন্তূর চরিত্র এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনার সাথে খুব যায়। তবু সাবধানতার মার নেই। জেদ বেশি মেয়েটার। জয় তাকিয়েই রইল। চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করেনা। মুচকি হাসে সে। তার বহুত বৃদ্ধা ভক্ত আছে। তারা থুতনি ধরে জয়কে কমবার বলেনি, “বউখান তোর সুন্দরী হইবো লো ছেঁড়া।ʼʼ

মিথ্যা বলেনি। বউ তার চরম সুন্দরী, সাথে চরিত্রের বৈশিষ্ট্যও কাড়াক! ফর্সা মুখের নিচে থুতনি থেকে গলা ছড়িয়ে অন্তূর বুকের জায়গাতে মাতাল হাওয়া লাগল জয়ের গায়ে, যা সে মদে পাচ্ছিল না।

ইচ্ছে করল বিছানায় গিয়ে কাছে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়তে। গেল না। জাগ্রত থাকলে তো কাছে যাওয়া পছন্দ না তার বউয়ের। মাঝেমধ্যেই যখন রাতে ওকে কাছে পেতে ইচ্ছে করেছে, জোর করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত হার মানলেও তা হতো ধর্মের দোহাই দিয়ে। স্বামী নারাজ হলেই লানত, এইসব দোহাই! অচেতন অবস্থায় কাছে যাওয়াটা সুযোগ নেয়া হয়। জয়ের সে অভ্যাস নেই। সে মানুষের সামনে ছিনিয়ে নেয় অথবা জিতে নেয়।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৪৮.

সকাল নয়টার দিকে ঘুম ভাঙে অন্তূর। এ বাড়িতে অভিভাবক একমাত্র হামজা। বাড়ির বড়ও সে-ই। তার কত কাজ! সকালে উঠে কোথাও গেছে হালকা কিছু খেয়ে।

রিমি ও তরু রান্না-বান্না করে। অন্তূর জ্বর কম তখন। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। উঠে দাঁড়াতেই চারদিকটা ঘুরে উঠল। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল বিছানায় বসে।

মেঝের ওপর পড়ে আছে জয়। হু হু করে এসির বাতাস ঘুরছে বদ্ধ ঘরে। মদের বোতলটা পড়ে আছে জয়ের মাথার কাছে। তরল গড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে।

সেদিন একবার রাতে খানিক সময়ের জন্য বেলকনিতে বসেছিল জয়। অন্তূর কাছে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চেয়েছিল। অন্তূ দেয়নি। তরুকে দিয়ে পাঠিয়ে পরে যখন রুমে এলো, তখন জয় বলল, “তোমার বাড়ির লোকেরা কোথায় গেছে?ʼʼ

-“জানিয়ে যায়নি।ʼʼ

এ নিয়ে জয় আর কথা বাড়ায়নি অবশ্য। অন্তূ ঘরে দু একটা কাজ করে বেলকনির পর্দা ধরে দাঁড়ায়। জয় একমনে সিগারেটের ধোঁয়া গিলছে বসে। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের ও বাড়িতে কেউ থাকেনা?ʼʼ

-“একজন কেয়ার-টেকার আর তার বউ থাকে।ʼʼ

-“আপনি এখানে কেন থাকেন?ʼʼ

-“অভ্যাস। ছোটবেলা থেকে আছি, আর যেতে চাইলেও হামজা ভাই ছাড়বে না।ʼʼ

-“কবে এসেছেন এ বাড়িতে?ʼʼ

-“আমি তখন ছোট, দশ-এগারো বছর বয়সী হবো। সেই থেকে আছি এখানে। এটাই আমার ঠিকানা। ও বাড়ির মালিকানাও পেয়েছি বড় হয়ে। কেন জিজ্ঞেস করছ?ʼʼ

অন্তূ চুপ রইল। জয় চোখ তুলে তাকিয়েছিল, “কেন? যাবে তুমি?ʼʼ

-“না।ʼʼ

-“যেতে চাইলে বলবে। নিয়ে যাব। তোমারও হক আছে শ্বশুরবাড়ি যাবার। এখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে কোনো?ʼʼ

-“এমন ভাব করছেন কেন, যেন আমি বললেই সব কবুল?ʼʼ

বদমাশের মতো হাসল জয়, “তা কিছু বিষয় তা-ই। যেতে ইচ্ছে করলে বোলো। ঘুরিয়ে আনব। শ্বশুরবাড়ি দেখলে না এখন অবধি।ʼʼ

অন্তূ মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। জয় বলল, “নামাজ পড়বে নাকি তুমি?ʼʼ

-“কেন? খিদে পেয়েছে?ʼʼ স্পষ্ট ঘৃণা আল তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে অন্তূর মুখে।

এতক্ষণের শান্ত জয় ধপ করে জ্বলে উঠল, “তোমার খোঁজ আমি শুধু খিদে পেলেই নিই?ʼʼ

-“তা নয়? তাই তো জানি আমি।ʼʼ

জয় উঠে দাঁড়াল, “কথাটা কোন লাইনে যাচ্ছে বুঝতে পারছো? স্বামী আমি তোমার।ʼʼ কথাটা বলতে বোধহয় একটু বাঁধল জয়ের। এইসব কথা ভদ্র পুরুষদের জন্য, সে তো তেমন না।

-“তাই নাকি? আপনি তা মানেন?ʼʼ

-“মানামানি পরে, আগে জানার কথা হোক। পুরা জেলা জানে, আমজাদ মাস্টারের মেয়েকে বিয়ে করেছি আমি। জয় আমিরের বউ সে।ʼʼ

-“আমিও কি তা-ই জানি?ʼʼ

-“কথাটার লাইন ধর্ষণের দিকে নিতে চাচ্ছ, ঠিক বলেছি?ʼʼ

-“ভুল বলার অভ্যাস নেই আপনার। ঠিক ধরেছেন।ʼʼ

-“হ রে শালী। আমারই উচিত হয়নি তোকে এত ভালোভাবে বিয়ে করে ঘরে তোলা। বিয়ের আগে খালি বদনাম করেছি, বাস্তবে তো ভেতর ফাঁপা। ছুঁইওনি। কামডা ঠিক করি নাই। কোনো একদিন ধরে রেইপ-টেইপ করে তারপর বিয়ে করলে…..কিন্তু রেইপ বিষয়টাতে এক প্রকার ফোবিয়া আছে আমার। নয়ত রোজ চাকরের মতো ট্রিট করলে তবে তোর আজকের কথা সহ্য হতো। বদনাম খারাপ লাগেনা আমার, কিন্তু অপবাদ ভালো লাগেনা। সর সামনে থেকে।ʼʼ

-“রেইপ বিষয়টাতে ফোবিয়া আছে?ʼʼ অন্তূ উপহাস করে।

গম্ভীর হলো জয়, “হু।ʼʼ লম্বা করে সিগারেটে টান দিয়ে হেসে ফেলল চট করে, “বিশ্বাস হচ্ছে না, না? খুব বেশি জবরদস্তি করি বলে মনে হয় তোমার তাই তো? সেটা রেইপ? বউকে? হাহহাআহ! তোমার আমাকে সহ্য হয়না, সেক্ষেত্রে আমার নরমাল টাচ-ও ব্যাড-টাচ মনেহয়। এটাকে রিলেটিভিটি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।ʼʼ

আজ এসব ভাবনায় আসতেই ইচ্ছে করল, বোতলটা তুলে জয়ের মাথায় আঘাত করতে। কিন্তু করা যাবেনা। প্রশ্ন অনেক, তা সব জয়ের কাছে। আবার ভাবে, সে এসবের মাঝে নিজেকে জড়াচ্ছে কেন? এসব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেলে হয়না? পরক্ষণে মনে পড়ে, তার ভবিষ্যত পেশা এসব নিয়েই তো! সে একজন ভবিষ্যত আইনজীবী। ঝামেলাকে তার রক্তকণিকার মতো রন্ধ্রে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে চিরকাল।

অন্তূ কীসের এক শক্তিতে যেন জ্বলে উঠল, উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণ মনটা গুমটে মেরে ছিল, কারণ বোঝা যাচ্ছিল না। এবার স্পষ্ট হলো। তাকে তো বড়ঘরে যেতে হবে। বাচ্চারা কী করছে? সরিয়ে নেয়নি তো আবার? শরীরটা ছটফট করে উঠল উত্তেজনায়। বাচ্চারা খেয়েছে?

লম্বা বারান্দার কাছে রিমি জাপটে ধরে, “আপনি যাবেন না। মেয়র সাহেব এখনও বাড়িতে। ওয়ার্কশপেই আছে। জয় ভাইয়া ঘরে। আমাকে বিশ্বাসঘাতক বানাবেন না। আমি আপনাকে গোপনে সাহায্য করতে চেয়েছি। সেই ওয়াদা ভুলে যাচ্ছেন আপনি, আরমিণ!ʼʼ

অন্তূ ঘরে ফিরে চুপ করে বসে থাকে। সাড়ে নয়টার পর জয়ের ঘুম ভাঙল। বাইরে কাজ থাকলে তাকে ডাকতে হয়না কখনও, সময়মতো ঠিক ঘুম ভেঙে যায়। তাকে একবার কার্যালয়ে যেতে হবে। মিটিং আছে। অন্তূকে দেখে হাসল, “ফিলিং বেটার, ঘরওয়ালি?ʼʼ

অন্তূ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল শুধু। জয় হাত-মুখ ধুয়ে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পোশাক পরতে পরতে অন্তূকে বলে, “ভার্সিটিতে যাবে আজ আমার সাথে?ʼʼ

অন্তূর মনটা নেচে উঠল। তা লুকিয়ে আস্তে করে বলল, “শর্ত কী?ʼʼ

-“শর্ত?ʼʼ হো হো করে হেসে ওঠে জয়, “যা চাই দেবে? তো দাও, একটা চুমুই দাও নাহয়। ঠোঁটে না দিলেও চলবে, প্রথমেই অভার-ডোজ হয়ে যাবে তোমার। গালেই দাও। নো চিন্তা। চুমুগতভাবে কিন্তু জয় আমিরের গোটা শরীরটাই ভার্জিন। ওয়ান্না কিস মি? গাল এগিয়ে দেব?ʼʼ

অন্তূ কথা ঘোরায়, “সবসময় নিজের নাম জপার কী আছে? জয় আমির, জয় আমির!ʼʼ

জয় হাসল, “আমার নাম জয়, উপাধি আমির। ইজ ইক্যুয়্যাল টু— জয় ইবনে জাভেদ আমির।ʼʼ

-“আমিরʼ কিন্তু জামায়াতের প্রধান প্রতিনিধিদেরও বলা হয়! শুনেছি আপনি যুদ্ধাপরাধীর ছেলে! আপনার পরিবার শিবিরের কর্মী ছিল?ʼʼ

জয়ের মুখটা দগ্ধ হয়ে উঠল। ঠিক যেমন খড়ের গাদায় জলন্ত মশাল পড়লে আগুন জ্বলে ওঠে, সেটাও ছাইচাপা, নীলচে আগুন। তা খেয়াল করল অন্তূ আয়নায়। জয়ের দৃষ্টিতে খু-ন চেপেছে। দাঁতের মাড়ি পিষে বলল, “আমির আমার বাপ-দাদাদের বংশ উপাধি। পদবীর হিসেব আসছে কেন? বেশি বোঝা শিখেছ? খুব বেশি, হ্যাঁ? জামায়াত শিবির?ʼʼ পেছন ফিরল তো চোখে যেন ফুটন্ত আগুন, “আর একবার তোকে বড়ঘরে যেতে দেখলে কেটে টুকরো করে ফেলব, শালীর মেয়ে। আর বাচ্চাগুলোকে লোহার চুল্লিতে গলিয়ে তোর দলাদলী বের করব। পরবর্তিতে মাফ পাবিনা, সে তুই যে-ই হ।ʼʼ

অন্তূ কিচ্ছু বলল না। তার ভার্সিটি যাবার চান্স মিস করা যাবেনা, কোনোভাবেই না। থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে সেই কবে!

ভার্সিটিতে তারা দুজন পা রাখতেই বোধহয় উৎসব শুরু হয়ে গেল। কত কত দিন পরে যেন অন্তূ আবার চিরচেনা এই শিক্ষাপ্রাঙ্গনে পা রেখেছে। খুশি ও বিষাদ একসাথে চাপলে কেমন অদ্ভূত অনুভূতি হয়। সকলে হাঁ করে দেখছে, হাসছে, ইশারায় বোঝাচ্ছে, খুব মানিয়েছে। আসলেই মানিয়েছে। জয়ের উচ্চতার সাথে অন্তূর কাধ মিলেছে। খানিক চাপা শ্যামলা জয় আমিরের ফর্সা বউ, ভালো মানায় বাহ্যিকভাবে দুজনকে।

কত শুভেচ্ছা যে পেল ওরা। অন্তূ খালি দেখল, বাঙালি তেল মারতে কত দক্ষ! জয় কোনো দেবদূত—সবার অভিব্যক্তি তা-ই বলছে। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই এদের ডিএনএ-তে এক্সট্রা কিছু তেল জমা করে দেয়! যাতে সমাজের নোংরা লোকদের বিরুদ্ধাচারণ না করে বরং সেঁধে সেঁধে তেল মারতে পারে! অন্তূ তা পারলে আজ সে কিছুই হারাতো না। আফশোস! সে পারেনা।

সবাই এসে হাত মেলাচ্ছে জয়ের সাথে, জয়ের একটু হাতের ছোঁয়া পেতে কত উদগ্রীব তারা। অন্তূর মনে হলো, জয় যেন আরও ক্ষমতাসীন হয়ে উঠেছে দেশের এই হাঙ্গামায়। তা-ই তো হবার কথা! মজলুমরা যত এদের জুলুমের শিকার হয়ে দূর্বল হয়ে পড়বে, এরা অপেক্ষাকৃত তত দাপটে দেশ ঝলসাতে অগ্রসর হবে। এটাই তো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র! ল অফ রিলেটিভিটি! জয় এই সূত্রটায় চরম বিশ্বাসী।

অন্তূর এই দেশের কুকুরসম জনতার প্রতি আক্রোশ জন্মালো। এরা কুকুরের চেয়েও ভালো লেজ নাড়ানো প্রজন্ম। যারা আরামপ্রিয়। পরিবার ও নিজেকে নিরাপদে রাখতে ড্রেনের পানিকেও পবিত্র বলে ঠোঁট এলিয়ে হাসে। এরা প্রতিবাদ-পরবর্তি পরিণাম চিন্তা করে হিঃস্র হায়েনাকে গবাদি পশুর মতো উপকারী বলে স্বীকার করে নেয়।

জয় অন্তূর দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বলে, “এত সম্মান আগে পেয়েছ কখনও? যত অপদার্থ তুমি ভাবো আমায়, আমি ঠিক ততটাই পদার্থ। তোমার দেখার দৃষ্টিকোণ খারাপ, ঘরওয়ালি!ʼʼ

-“সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা থাকবে, এই দৃষ্টিকোণ যেন আজীবনেও এক ফোঁটা না বদলায়। চিরদিন এই দৃষ্টিতেই দুনিয়া দেখে মরতে চাই।ʼʼ

জয় বিরবির করল, “শালীর মুখ তো মুখ না, এসএজির রাইফেল। মিঠা কথা জানো না, শালি? মিথ্যা হলেও চলবে! তোর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে মরণ কবুল, বউ!ʼʼ

-“তুমি মিঠা কথা শুনতে চাও কেন শালা, যখন জানো আমার মুখে তা বেরোবে না। তবে যদি মরণ কবুল হয়, তো শেষবার একবার বলব। কবে মরতে চান। আমি প্রস্তুত হই মিঠা কথা বলতে!ʼʼ

জয় অবাক হয়ে তাকায়। গর্বিতভাবে বলে, “এজ হাসব্যান্ড, সো হিজ ওয়াইফ! সাব্বাস! কোন সম্বন্ধির ছাওয়াল কয়, আমাদের জুটি ভালো না? তার মাকে….. আসসালামু আলাইকুম।ʼʼ

শহীদ মিনার চত্বরে এসে হু হা করে হেসে ওঠে জয়। ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। এখানে কতবার অন্তূকে হেনস্থা করেছে! র‌্যাগ দিয়েছে। সেই মেয়ে আজ তার ঘরওয়ালী।

ক্লাস শেষে সেদিন অন্তূ জয়ের সাথেই বাড়ি ফিরেছিল। ফেরার পথে নতুন বর্ষের বই কিনে নিয়ে এলো গাদাধরে। জয় কোম্পানি আইন–বইটা হাতে নাড়েচাড়ে আর বলে, “কী বাল পড়ে সব! এসব পড়ে কোনো লাভ আছে? এই বয়সে আমরা বিক্রিয়া করতে গিয়ে সাইন্স-ল্যাবরেটরি ব্লাস্ট করে এসেছি, ওরা ব্যবসা আইন পড়ছে। দেশের কি অধঃপতন এমনি এমনি হলো? যাই হোক, জয় বাংলা। মামা, বইটা বউয়ের জন্য প্যাক করে দ্যান।ʼʼ

তারা অনেকক্ষণ রোদের তেজে ঘর্মাক্ত দেহে দাঁড়িয়ে ছিল ব্রিজের ওপর। এরপর জয়ের কত সব আস্তানায় ঘুরেছে জয় অন্তূকে নিয়ে। জোর করেই। ব্রিজের নিচের ছোট খুপড়িগুলো, টোস্ট বিস্কুট খেতে টঙের দোকান, গরমের মধ্যে বাচ্চাদের সাথে মাঠে নেমে ক্রিকেট খেলে শার্ট ভিজিয়ে এলো। তা খুলে অন্তূর হাতে দিয়ে শুধু গেঞ্জি পরে বাকিপথ পার। একগাদা লাল আইসক্রিম কিনে তা খেতে খেতে হেসে লুটিয়ে পড়ছিল বাচ্চাদের সাথে।

অন্তূ অবাক হয়। এরাও বাচ্চা, ওরাও। তবু এই বৈষম্য কেন? কীসের আক্রোশ! শহরের সব কুকুর, বিড়াল জয়কে চেনে যেন। দেখা হলেই লেজ নেড়ে পিছে হাঁটা শুরু করল। ওরা জয়ের হাতের বিস্কুট-রুটি-কেক সব খায়।


আজও কোথাও বেরোনোর আছে বোধহয় দুই ভাইয়ের। তারা কোনও কিছুর খোঁজে যাবে। সফল হয়ে ফিরবে আজ। গোসল করে দুজন কীসের এক আলোচনায় বসেছিল। সেখানে কারও উপস্থিতি নট-এলাউড। এরপর হামজা বেরিয়ে গেছে কোথাও। জয় ঘুমিয়ে পড়ল।

এই ফাঁকে অন্তূ যায় একবার নিচের তলার বড়ঘরে। বাকি সব ঠিক আছে। মেয়েগুলো আর নেই, মদের কেস অর্ধেকের বেশি চলে গেছে। যা আছে, তা সম্ভবত নিজেদের জন্য রাখা।

বাচ্চাদের খোরাক হিসেবে যা পানি এবং খাবার-দাবার দেয়া হয়, সেটাও অমানুষিকভাবে। যাতে ওরা মরবেও না, বাঁচাও হবে কঠিন। অন্তূর নিজ বিচক্ষণতায় এতে একটা আন্দাজ করে, এদের যদি মারা হবেও, তবে সেটা পরে। এবং খুব একটা শাস্তি দেবার নয়। কারণ ওরা এখনও কিছু করেনি। ছোট মানুষ। ওদের বড়জোর দুনিয়া থেকে মিটিয়ে দিতে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু এই যে শাস্তিগুলো ওদের দেয়া হচ্ছে, এটা কোনো উদ্দেশ্যমাফিক। এরা কাউকে খুঁজছে, কাউকে কাবু করতে চাইছে। বরশির আগায় যে টোপ দেয়া হয় মাছ শিকার করতে, বাচ্চাগুলো আপাতত সেই টোপ হিসেবে কাজ করছে।

দিনের আলো প্রবেশের ছোট্ট কোনো ছিদ্রও নেই সেখানে। সিঁড়ির ওপারের লম্বা বারান্দাও ঘুটঘুটে অন্ধকারচ্ছন্ন। সেখান থেকে আলো আসার জো নেই। অন্তূ তবু দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে আব্দুল আহাদের শুকনো মুখখানার দিকে আধো-অন্ধকারে। সে আছরের নামাজ আদায় করছে। তার পেছনে জামায়াত দাঁড়িয়েছে। পুঁচকে একটা সমাবেশ। তো স্বৈচারাররা ভয় পাবেনা কেন? এই সমাবেশকে এভাবে চলতে দিলে এই পুঁচকে সমাবেশ কি একদিন বিশালাকায় তাগড়া শিবির-যুবকের সমাবেশে পরিণত হবেনা? হবে তো! ভয় পাওয়া জায়েজ!

অন্তূ নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। রুকু থেকে যখন সিনা চওড়া করে আব্দুল আহাদ সোজা হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক যেন সিনাটা দশ মাইল প্রসস্থ পাহাড়ি ঢালের ন্যায় শক্ত, অটল। যে বুকে বুলেট লাগলে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসবে তাজা গরম রক্ত, তবু মাথা নোয়াবার নয়।

কেউ আসছে। হেঁটে আসছে এদিকেই। অন্তূর হৃদযন্ত্র অতি-সক্রিয় হয়ে উঠল। মেরুদণ্ড বেঁয়ে এক প্রকার আতঙ্কিত শিহরণ নিচে নামছে। হামজা আসছে! এরপর?

অন্তূ ফিরে তাকায় না। শরীরের সংবেদি পেশিগুলো অসাড় হয়ে আছে। পা থমকে দাঁড়িয়ে রইল।

কেউ হেঁটে এসে পেছনেই খুব কাছে দাঁড়ায় নির্লজ্জের মতো। শরীরের গন্ধটা অন্তূর চেনা। চোখদুটো শক্ত করে বুজে প্রস্তুত হয় সে পরিস্থিতি সামলাতে। বাচ্চারা তখনও নামাজ পড়ছে। ছোটগুলো ভয় পাচ্ছে, নামাজে হাত বেঁধেই আড়চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি ফেলছে জয়ের দিকে।

জয় কিচ্ছু বলল না মুখে। অন্তূর হাতটা চেপে ধরল, তাতে মনে হলো অন্তূর হাতের রগগুলো মটমট করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। পশুর মতো ভোঁতা রাগে গজরাতে গজরাতে টেনে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা আঁটকায়। তখন মাগরিবের আজানের সময় হয়ে এসেছে প্রায়।

আশ্চর্যজনক ব্যাপার এই—বড়ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই আরও দুজন ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল অন্তূ। জয় কেবল চোখের ইশারা করতেই ওরা দ্রুত সিঁড়ির দরজা আঁটকে দেয়। অর্থাৎ এখানে অন্য লোকেরাও আসে। তবে বাগানের পথ দিয়ে।

জয় দেয়ালে কনুই ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল কপালে ঘঁষছিল। বারবার ঠোঁট ভেজাচ্ছে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ ভালোই শিখেছে আজকাল। আজ আর অশ্রাব্য ভাষায় বকে উঠল না।

অন্তূ সামনে এসে দাঁড়ায়, “ওদের কেন আঁটকে রেখেছেন?ʼʼ

-“তা জেনে তোমার কাজ নেই। এসব থেকে দূরে থাকো।ʼʼ

-“আমি জানতে চাইছি, কেন ওদের আঁটকে রাখা হয়েছে? ওই পাঞ্জাবী পরা ছোট্ট ছেলেটা কে?ʼʼ

-“মাদ্রাসার ছাত্র।ʼʼ নির্বিকার জবাব দিচ্ছিল জয় একের পর এক।

-“ওর বুকে কোরআন ছিল।ʼʼ

জয় ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট বাঁকায়, “হু, হাফেজ ও।ʼʼ

-“ওদের আঁটকে কেন রেখেছেন?ʼʼ অন্তূ গর্জন করে উঠল।

-“নতুন তো না কিছু! এর আগে শোনোনি কখনও মাদ্রাসার ছাত্রদের আঁটক অথবা হ-ত্যা-র ঘটনা? আস্তে কথা বলো। থাপড়ে কান-টান দিয়ে রক্ত বের করে দেব একদম। গলার সাউন্ড আস্তৃ হয়না, না?ʼʼ

-“কেন করা হয় এসব?ʼʼ

-“জামায়াত শিবিরের ছেলে ওরা। দেশদ্রোহী, শালারা জঙ্গির দল। আর একটা প্রশ্নও করবে না।ʼʼ

-“ওদেরকে আপনারা কেন আঁটকে রেখেছেন?ʼʼ

-“উপরমহলের হুকুম।ʼʼ

-“উপরমহল? কোন উপরমহল? আপনি কে?ʼʼ

-“জয় আমির!ʼʼ

অন্তূর স্বর ধীরে ধীরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। বহুদিন পর তার এই রূপ। কিছুদিন বেশ শান্ত ছিল।

-“আপনার আব্বু জাভেদ আমির যুদ্ধাপরাধী ছিলেন?ʼʼ

-“দাদু জলিল আমির মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন।ʼʼ

-“আর?ʼʼ অন্তূ অবাক হয়ে যায়।

জয় ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে কপাল কুঁচকায়, এরপর আলতো হাসে, “আচ্ছা। তো ফ্যামিলি হিস্ট্রি জানতে চাও? আগে বলবে না? তোমার হক আছে তো। কিছুই জানো না তেমন শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে।ʼʼ

-“মুক্তিযোদ্ধার ছেলে যুদ্ধাপরাধী?ʼʼ

-“কোনো সংবিধান এমন নেই যে, মুক্তিযোদ্ধার ছেলে যুদ্ধাপরাধী হতে পারবে না। ছোটচাচা জয়নাল আমির রাজাকার ছিলেন। তো?…ʼʼ ঘাঁড় বাঁকা করে তাকায় জয়।

-“সোজা ভাষায় বলুন, পুরো পরিবারটাই কসাই ছিল।ʼʼ

দুপাশে মাথা নাড়ে জয়, “নাহ। তা আবার ছিল নাকি? আমার সাত-পুরুষের কেউ কোনোকালে মাংসের ব্যবসা করে নাই। আমার দাদুভাই ছিলেন মশলা ব্যবসায়ী। সেই আমলে বিদেশের সাথে মশলার কারবার-টারবার করতো। আমার বাপ-চাচার ছিল কাঁচামালের ব্যবসা। আমি অবশ্য বেকার। তবে তুমি যদি কোনোদিন সংসার-টংসার করতে আন্তরিকভাবে রাজী হও, তাইলে একটা কাম-কাজ শুরু করতে পারি। মেয়েলোক আবার বেকার ব্যাটাছেলে পছন্দ করেনা।ʼʼ

-“কথা ঘোরানো শেখাবেন আমায়? খুব দক্ষ আপনি বিষয়টাতে।ʼʼ

জয় গম্ভীর হলো, “তুমি এসব থেকে দূরে থাকো, আরমিণ। তোমার প্রতিবাদী চিন্তাভাবনা আজ তোমাকে এত দুর্ভোগে এনেছে। সহ্য করে যে, বেঁচে থাকে সে।ʼʼ

-“চিরকাল?ʼʼ

জয় তাকায়। অন্তূ তাচ্ছিল্য হাসে, “চিরকাল বেঁচে থাকে? যারা সহ্য করে তারা অমর হয়ে যায়? আর জীবনে মরে না?ʼʼ

-“স্বাভাবিক মৃত্যু আর সংগ্রামীদের মৃত্যু একরকম হয়না। পঁচে মরার শখ কেন হয়েছে?ʼʼ

-“সহ্য করে আজ বেঁচে থেকে আগামীতে যদি মৃত্যুর হাতে ধরা দিতেই হয়, তো আজ মরব। আজ মরব তো এখন মরব। কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে শ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাই না। সহ্য করে, চুপ থেকে, প্রতিবাদ না করে যদি গড় আয়ু হিসেবে বড়জোর ষাট বছরের বেশি না বাঁচা না যায়, তবে আমার বুকের ভেতরে যে আগুন জ্বলছে সেই আগুনে আপনাদের ঝলসে মারতে শুধু ষাট সেকেন্ড বাঁচতে চাই। এর বেশি একটা শ্বাসও ফেলব না এই নারকীয় দুনিয়ায়। এই অপরাধের সাম্রাজ্যে কয়েকযুগ বেঁচে থেকে শোষিতদের হাতে শোষন হবার চেয়ে কবরের মাটি অসীম শান্তিদায়ক। রক্তমাখা শরীরে আমি ওই মাটিতে মিশতে চাই।ʼʼ

জয় অনেকক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থাকে অন্তূর ক্ষিপ্ত মুখখানার দিকে। পরে বলে, “আর একবার ওই ঘরে যাওয়ার চেষ্টা করলে তোমার এই ইচ্ছেটা পূরণ করে দেব, ঘরওয়ালি। পা দুটো কেটে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে এডমিট করে রেখে আসব। বাঁচার ইচ্ছে না থাকলে কাউকে জোর করে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক না।ʼʼ

-“তার আগে আপনাকে আমি জাহান্নামের রাস্তা অবধি এগিয়ে দিয়ে আসব, জয় আমির। আপনাকে অনেক সুযোগ দিয়েছি। মানছি আপনাদের রাজত্ব চলছে। তবু মানুষই তো আপনারা! মেরে মরলে আর কী! আমার তো আর পিছুটান নেই কিছুর।ʼʼ

জয় দেয়াল থেকে সরে এসে ঝাঁকি মেরে অন্তূকে দুহাতের বাঁধনে পুরে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে ধরে। দাঁত চেপে চাপা গলায় বলে, “চুপ। এত কথা কস ক্যা তুই, শালী! চুপ থাক।ʼʼ

-“কেন বাঁচাতে চান আমায়? আপনার মতো জানোয়ারের সহায়তায় বেঁচে থাকার কোনো লালসা তো আমার নেই।ʼʼ

জয় কথা বলেনা কিছুক্ষণ। তাকিয়ে থাকে চুপচাপ। টুপ করে অন্তূর গলায় একটা চুমু খেয়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি ঘষে অন্তূর গলায়। ছিটকে যাবে তাই চেপে ধরে রাখে অন্তূকে। কিছুক্ষণ পর অন্তূর মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলে, “যা হচ্ছে দেখে যা, আরমিণ। তোর কিছু করার নেই বিশেষ। বড়জোর আমাকে মেনে নিতে পারিস। আমি খুব একটা খারাপ না, অন্তত তোর জন্য।ʼʼ

অন্তূ মুখটা শক্ত করে অন্যদিকে ফিরতে চায়, “আবার একবার জন্মাই যদি; প্রার্থনা থাকবে, সেবারেও যেন এই আপনাকে না ভুলি। আর আমার ঘৃণায় যাতে একরত্তি পরিমাণ কমতি না আসে সেকালেও।ʼʼ

জয় গা দুলিয়ে আওয়াজ কোরে হাসে, “আমিন আমিন। তোমার আল্লাহ কবুল করুন এই ফরিয়াদ।ʼʼ

-“আপনি নাস্তিক?ʼʼ

-“না নাহ। ঠিক তা না। কিন্তু আমার মতোন পাপীদের তোমার আল্লাহ উপাসক হিসেবে মানেন কি-না তা তো জানা নেই…ʼʼ

মাঝেমধ্যেই যখন ভদ্রলোকের মতো কথা বলে জয়, তখন খুব নিখুঁত লাগে শিক্ষিত হিসেবে। অন্তূ রুষ্ট চোখে অবুঝের মতো চেয়ে থাকে।

দরজায় করাঘাত পড়ে। জয় শীতল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তূ তাকায়। তার অস্থির চোখদুটো একবার শান্ত জয়কে দেখে আবার দরজার দিকে চায়। দরজার ওপাশ থেকে হামজা এবার ডেকে ওঠে, “জয়!ʼʼ

চলবে…