অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
109

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫২.

অন্তূ নির্বাক হয়ে চেয়ে ছিল অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করেছিল, “মুমতাহিণার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?ʼʼ

-“আমার ছোট বোন।ʼʼ সঃক্ষিপ্ত জবাব দিলো মরসালীন।

অন্তূ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শান্ত হলো। এরপর জিজ্ঞেস করল, “মুমতাহিণার ভাইকে তো শুনেছি মেরে ফেলা হয়েছে!ʼʼ

মুরসালীন নিশ্চুপ মেঝের দিকে চেয়ে থাকে। দৃঢ়, সু-স্থির চোখদুটোয় অবাধ অটলতা। অন্তূ শরীরের ভার ছেড়ে একটা লৌহখণ্ডের ওপর বসে। ওদের গোঙানির আওয়াজ অবরুদ্ধ কুটুরির দেয়ালে কাঁপন ধরাতে চাইছে। স্পটলাইটের তীব্র হলদে আলোতে মাথা ধরে যাবার যোগাড়। এরা ঘন্টার পর ঘন্টা পার করছে। ঘুমানো অসম্ভব এই আলোর তলে।

-“আপনি চিনতেন আমায় সেই রাতের আগে?ʼʼ

-“না।ʼʼ

-“তবু প্রথম দেখায় কোনো বিরূপ আচরণ করেননি।ʼʼ

-“আপনি করেননি বিধায়। তাছাড়া পাটোয়ারী বাড়ির কোনো সদস্যের সঙ্গেই আপনার সম্পর্ক বিশেষ ভালো নয়। তাদের ওপর আপনার মায়া বা ভালোবাসা থাকবে এমনটা আশা করিনি আমি। আর দুঃখিত আমি, সেদিন কিছুটা ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলাম। এবং সেক্ষেত্রে দু একবার ‘তুমিʼ সম্বোধন করেছিলাম আপনাকে বিভ্রান্ত করার জন্য।ʼʼ

অন্তূ ভাবে, লোকটা কে? ভেতরের খবর জানে বেশ! অন্তূর চোখে মানুষ চেনার বিশেষ ক্ষমতা আছে তো অল্প-সল্প। সে চট করে মানুষ বিচার করে ফেলতে পারে। শুধু পারেনা অভিব্যক্তি লুকোতে। তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দেখানোর নির্বোধ স্বভাবটা খুব দৃষ্টিকটুই বটে।

মানুষের অভিব্যক্তি ও চোখের দৃষ্টি কথা বলে। সেই কথা বোঝে সে। সেদিন তার হাতে অস্ত্র ছিল। তবু অজ্ঞাত পুরুষটিকে সে আঘাত করেনি। সেই নির্দেশ তার মস্তিষ্ক তাকে দেয়নি। ভরসা অথবা এরকম দ্বিধা সে আজ অবধি তিনটে পুরুষে করতে পেরেছে সে।

আব্বু, আগুন্তুক আর….তৃতীয়জনের কথা ভাবতে সংকোচে কুঁচকে এলো ভেতরটা—জয় আমির। অপ্রিয় এক অন্যতম ঘৃণ্য ব্যক্তিত্ব। তাকে সে ভরসা করে নাকি আশা রাখে, সেটা জানা নেই। প্রথম দুজন তার ভরসার মান পুরোদমে রেখেছে। তাদের দ্বারা এ অবধি ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি সে। অথচ তৃতীয়জনের পাপ-পূণ্যের তুল্যরাশি অসংজ্ঞায়িত। পরিমাপ করলে পাপ এবং ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে প্রথম চালেই।

-“আপনারা হামলা করেছিলেন বিয়ের গাড়িতে?ʼʼ

জবাব দিলো না মুরসালীন। অন্তূ বুঝল, ঘটনা সত্যি। জয়ের সাথে সাথে অন্তূর ভেতরে সল্পভাষী এই পুরুষটাকে নিয়েও কিছু কৌতূহল জন্মে গেল।

লোহার গেইটের ওদিক থেকে ধাতব আওয়াজ ভেসে আসছিল। মুরসালীন সতর্ক করল, “আপনি ভেতরে যান। নিজেকে বিপদে ফেলবেন না এখানে আসার খাতিরে। আপনার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই আমাদের। আল্লাহ পাক সহায় হলে আমরা যেভাবেই হোক দিন কাটিয়ে নেব। আপনি আর আসবেন না এখানে।ʼʼ

কথাগুলো মুরসালীন সম্পূর্ণটা ঢালাই মেঝের দিকে দৃষ্টি অবনত করে বলেছিল। একবারও অন্তূর দিকে ফিরে তাকায়নি। অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরের একরাশ আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছিল তার কণ্ঠস্বর থেকে। চেহারাটা মুরসালীনের আরবীয়দের মতো অনেকটা। সবুজাভ চোখের মণি। কালচে-বাদামি চাপদাড়িতে সুপুরুষ বটে।

আবারও বলল মুরসালীন, “ওরা ভেতরে আসবে এখনই। আপনি বেরিয়ে যান। থাকবেন না এখানে।ʼʼ

অন্তূ খেয়াল করল, মুরসালীনের বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছে টসটসে ক্ষত। পুরো শরীরটা বিদ্ধস্ত। চোখে ক্লান্তি-কাতরতা আছে, তবে উদ্বেগ নেই।

মুরসালীন আব্দুল আহাদকে বলল, “তুমি এগিয়ে যাও উনার সঙ্গে। সিঁড়িঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে। একা ফিরতে পারবে তো অন্ধকারে?ʼʼ

-“জি ভাই, পারব। আপা, আসেন আমার সাথে।ʼʼ

অন্তূর কানে তখনও ওদের ভোঁতা গোঙানি লেগে ছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করছে ওরা।

তুলির ঘরের সামনে দিয়ে ফেরার সময় দেখতে পেল, তুলি কোয়েলের মাথায় পানি ঢালছে। অনেকক্ষণ সেখানে বসেছিল অন্তূ। জ্বরে গা পুড়ছে ছোট্ট মেয়েটার। তরুরও জ্বর। অথচ মেয়েটা অতিরিক্ত চাপা স্বভাবের। অন্তূ শিয়রে বসে অনেকক্ষণ ধরে কপাল টিপে দিলো তরুর। মাথায় পানি দিতে চাইলে রাজী হলো না। অন্তূর নিজের রুম থেকে একটা ওষুধ নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিয়ে এলো।


রাতে ফিরে খাবার খেয়ে হামজা বড়ঘরে এবং জয় রুমে এলো। অন্তূ তখন বিছানা ঝারছিল। জয় শরীরে ঠান্ডার প্রকোপ নিয়ে লম্বা একটা গোসলে গেল। গায়ে পানি ঢালছিল আর গান গাইছিল গলা ছেড়ে,

কেমন আছেন বেয়ান সাব,
বুকে বড় জ্বালা।
কীসের জ্বালা বেয়ান সাব,
নয়া প্রেমের জ্বালা।
এই জ্বালাতে মরে নাই কোন শালী-শালা…

গোসল করে এসে বলল, “ঘরওয়ালি, খাবার রুমে আনো।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ আনলো। জয় বেহায়ার মতো আবদার করে, “খাইয়ে দাও।ʼʼ

অন্তূ বেশ নরম সুরে বলল, “আপনি খেয়ে নিন। আমি পড়তে বসব।ʼʼ

জয় আস্তে করে বলে, “হাত কাটা।ʼʼ

অন্তূ দেখল, জয়েল হাতে ব্যাণ্ডেজ জড়ানো। আশ্চর্য লাগে তার। একটা মানুষ মাসে কয়বার আহত হয়? অন্তূ ধারণা করল, মুরসালীনের কপালটা বোধহয় জয় ফাটিয়েছে। বিয়ের দিন আঘাত পেয়ে কপালের পাশে বিশাল জখম হয়েছিল, তার শোধ!

অন্তূ খাওয়াতে বসল, প্রথমবার। জয় তাকিয়ে ছিল। এক পর্যায়ে বলল, “পাখির আহার করাচ্ছ, শালী? তোমার হাতের চার বারের খাবার আমি একবার মুখে ঢুকাই।ʼʼ

অন্তূ হেসে ফেলল। জয় অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, “হাসছো, তুমি? তুমি?ʼʼ

অন্তূ বড় এক লোকমা তুলে দিলো জয়ের গালে। তারপর কত শান্ত আর বয়স্ক মেয়ের মতো বলল, “আপনি আমায় হাসতে দেখেননি, না? দেখার কথাও নয়। সামনে এলেই পশুর মতো আচরণ নিয়ে এসেছেন। তখন হাসি পাবার নয়। আমি মেজাজ খারাপ নিয়ে হাসতে পারার মতো ভারী বুদ্ধিমতি নই।ʼʼ

-“আজ কি ভালো আচরণ করতেছি?ʼʼ

-“সঁয়ে গেছে।ʼʼ মনোযোগ পুরোটা তার ভাতের প্লেটে।

জয় অপলক অন্তূকে দেখল শুধু। প্রকাশ্যে ঠিক যেমন নিখুঁত অবহেলা, নীরবেও অন্তূর অবহেলা তেমনই নিখুঁত। টের পাওয়া যায় কিন্তু অভিযোগ করা যায়না। তবু আগে কখনও এত শান্তিপূর্ণ মুহুর্ত আসেনি তাদের মাঝে। অন্তূকে সে অন্তত প্রথমবার হাসতে দেখল আজ। মলিন হাসি তবু দেখতে সুন্দর।

-“আমার মনেহয় তুমি জন্মেছিলেই গোমরামুখো হয়ে।ʼʼ

-“না তো।ʼʼ

-“তাই নাকি?ʼʼ

-“তা-ই।ʼʼ

জয় মাথা দোলায় দু’দিকে, “উহু।ʼʼ

অন্তূ মৃদু বিরোধ জানায়, “হাসতে ভুলেছি কিছুকাল হলো। তার আগে ক্ষেত্রবিশেষ খুব চঞ্চল আর সরল মেয়ে ছিলাম। এটা স্বীকার করছি, আমি বরাবরই একটু….ʼʼ

-“মারাত্মক কড়া।ʼʼ

অন্তূ হাসল মৃদু। দু’পাশে মাথা নাড়ল, “আমি মায়া করতে, প্রতিদান দিতে, সম্পর্ক রক্ষা করতেও জানি, আমি অন্তর দিয়ে খুব তীব্র ভালোবাসতেও জানি। কলিজায় টান লাগলে খুব অসহায়ের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে জানি, আবার আঘাতকারীকে এতটা জ্বালাতন দিতেও জানি, যে লোকে তখন আমাকেই স্বার্থপর ভেবে বসবে। এটা বুঝবেন হয়ত পরে। যারা যেমন আচরণের যোগ্য আমি তাদের সামনে কেবল তেমন। শুধু একটু বোকা। বোকামিটা কী জানেন?ʼʼ

-“হু?ʼʼ জয় খুব মনোযোগী শ্রোতা, সে পলকও ফেলছে না। অন্তূ তাকায় না তার দিকে। নিচের দিকে তাকিয়ে প্লেটে হাত নাড়াচাড়া করতে করতে কথা বলছে।

-“নিজের ভেতরের আক্রোশগুলো লুকিয়ে বুদ্ধিমানদের মতো মিথ্যা তোষামোদ করতে পারিনা। তেল মেরে মন জয় করতে জানিনা। আমার ওপর আঘাত এলে তা সহ্য করে চুপ থাকতে পারিনা। তাতে করে শত্রুর সংখ্যা বয়সের তুলনায় কয় গুণ বেশি হয়ে গেছে। স্টুপিড!ʼʼ

জয় শুধু চেয়ে রইল। তাদের বন্ধনটা রণতরীর ন্যায় ভাসমান, জলন্ত। আজ অন্তূকে অন্যরকম অদ্ভুত লাগল।এইদিন জয়ের প্রথমবার মনে হয়েছিল, এই মেয়েটার কাছে তার পাপ সীমা ছাড়িয়েছে। বুকে এক প্রকার অস্থিরতা ডানা ঝাপটেছিল প্রথমবার জয়ের। অন্তূর সুকরুণ ভাষাগুলো তাকে উপলব্ধি করিয়েছিল, সে কারও আসামী। প্রথমবার এমনটা হলো।

-“সরল ছিলে না কোনোদিনই। প্রচুর অহংকার তোমার ভেতরে।ʼʼ

-“না। ওগুলো আমার নির্বুদ্ধিতা। আমি নিজের কষ্ট ও দূর্বলতাকে পুঁজি করে মানুষের সহানুভূতি কামাতে আগ্রহী নই কখনোই। ব্যক্তিগত দুঃখকে মুখে করে ঘুরে নিজেকে অসহায় দেখাতে পারিনা। তাই আমার মিছেমিছি কাঠিন্য আর অসভ্যতাই সবসময় নজরে আসে। আবেগ কখনও মুখোরিত হয়না।ʼʼ

বিস্ময়ে জয়ের হৃদযন্ত্র থেমে রইল। অন্তূ যেন জয়কেই বর্ণনা করল এতক্ষণ। এত গাঢ় মিল আর বৈশিষ্ট্যগত সাদৃশ্য নিয়েও তারা দুজন দুজনের থেকে কত দূরে! কত বিরোধ তাদের মাঝে! অথচ গঠনগত দিকটা এক সুঁতোয় গিঁট দেয়া! প্রতিটা বৈশিষ্ট্যে অন্তূ জয়ের মাফিক। শুধু মেয়েটার শক্তি নেই জয়ের মতো, তাই বুঝি এত দুর্ভোগ! জয়েরও তো ছিলনা এককালে! দুজনের মাঝে নিজেকে লুকোনোর পদ্ধতিতে কেবল অল্প ফারাক আছে। জয়ের হাতিয়ার রসিকতা, অন্তূর গাম্ভীর্য।

জয় খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নাড়ল, “মানছি।ʼʼ জয় আরেক লোকমা খাবার চিবিয়ে শেষ করে বলল, “মেয়েদের এত গাম্ভীর্য ভালো না।ʼʼ

-“কী ভালো তবে? ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদা, শুধুই স্বামীর সেবা করা, স্বামী তার যেমনই হোক! আর কুকুর-বেড়ালের মতো বছরে বছরে শুধু বাচ্চা জন্ম দেয়া? স্বামী যা-ই করে বেড়াক, দুমুঠো ভাত পেলেই হলো! মারধরগুলো নীরবে সহ্য করে চিহ্ন লুকোতে শাড়ির আঁচল বাড়িয়ে পরা? জাহেলি যুগের মেয়ে না আমি।ʼʼ

জয় সন্তুষ্ট হাসে। একসময় হাসিটা প্রসারিত হতে হতে সুবিশাল হয়ে ওঠে। আস্তে করে উচ্চারণ করে, “অস্থির চিন্তাধারা, মাইরি! ড্যাম ড্যাম!ʼʼ শব্দ করে হেসে ফেলল, “ঘরওয়ালি, তুমি মাল্টিপুল পার্সোনালিটিতে চলে গেছ। নিজের এক সত্ত্বা তোমাকে ধিক্কার দিলে আরেক সত্ত্বা তার প্রতিবাদ করে। নিজের সাথে খুব তর্ক হয়, তাইনা? এটা খারাপ না বটে।ʼʼ

-“আপনারও আছে রোগটা।ʼʼ

-“তুমি কী করে জানলে?ʼʼ মুখ ফসকে বলে ফেলল জয় অবাক হয়ে।

অন্তূ হাসল, “আপনার এক সত্ত্বা বলে, আপনি পাপ করেছেন, যা করছেন তা ঠিক নয়। আরেক সত্ত্বা তার বিরোধিতা করে পয়েন্ট কাটিয়ে দেয়। যেটাকে আপনি বলেন, ‘জয় আমির কখনোই নিজের কর্ম নিয়ে আফশোস করেনা।ʼʼ

জয় বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। অন্তূ নিজে থেকেই আলতো হাসে, “আমার নব্বই শতাংশ পড়া ও আত্মস্থ করা বই আপনি, জয় আমির। এতগুলো দিন শুধু বোকামিই করিনি, কিছু ন্যাকামিও করেছি। যেটাকে হিপোক্রাইসি বলা হয়।ʼʼচোখ মারল অন্তূ, “তার বদলে অবশ্য স্থায়ী বিনিময় শোধ করেছি কিছু।ʼʼ

জয় আবোল-তাবোল বলল যেন, “আমার মনে হয় তুমি আমার প্রেমে পড়ে যাচ্ছ, ঘরওয়ালি। না বাসলেও, ভালো বাসবে, একটু দিন গেলে।ʼʼ

অন্তূ গভীর চোখে চেয়ে মসৃণ, স্মিত হাসল, “সূর্য পশ্চিমে উদিত হয়ে পূর্বে অস্তমিত হতেই পারে।ʼʼ

জয় হো হো করে হেসে ফেলল, “হতেই পারে।ʼʼ

-“তা হলে তো হলোই। সূত্রানুযায়ী আমিও আপনাকে ভালো বাসতেই পারি।ʼʼ

জয়ের হাসি ঠোঁটেই রইল, শুধু সেটার জ্যোতি নিভে অন্ধকার হয়ে এলো হাসিটা। অন্তূ খাবার এগিয়ে নিয়ে গেলে জয় মানা করল, “আর খাবো না।ʼʼ

-“আর কিছুটা আছে। নিন।ʼʼ

-“খেতে ইচ্ছে করছে না আর। জোর কোরো না, ঘরওয়ালি।ʼʼ

সে উদাস পায়ে উঠে দাঁড়ায়। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া গিলতে থাকে। অন্তূ প্লেট রেখে এক গ্লাস পানি এনে ধরিয়ে দেয়। জয় আনমনে ছিল, চমকে উঠে গ্লাস নেয়। জয় আচমকাই জিজ্ঞেস করে, “আমায় অনেকেই ঘৃণা করে। কোনোদিন কারণ জিজ্ঞেস করিনি। তোমায় করছি।ʼʼ

মুখে কিছু না বলে শুধুই মুচকি হাসল। সেখানে কত জবাব শব্দহীন পড়ে আছে। সেসব চেপে বশল, “আমি কৃতজ্ঞ আপনার ওপর। ধন্যবাদ।ʼʼ

জয় বিভ্রান্ত হলো কিনা বোঝা গেল না। নারীর ছলনায় জয় আমিরের মতো পুরুষেরা কেমন প্রভাবিত হয়, তা তার অভিব্যক্তিতে অন্তত ধরা গেল না।

অন্তূ বলল, “কাল সকালে একটু ওই বাড়িতে যেতে চাইছি। কয়েক ঘন্টা থাকব। একটা ছেলেকে সঙ্গে দেবেন। একা যেতে ভয় লাগে। চারদিকে যা চলছে।ʼʼ

এবার জয় অবাক অথবা সন্তুষ্ট হয়ে তাকায়। তার ওপর অন্তূর এই ভরসা ভীষণ দুর্লভ! পরক্ষণেই নিজেকে বকে উঠল।


সকাল হতে হতে তুলির মেয়ের শরীর একেবারে নেতিয়ে পড়ল জ্বরের তোপে। তরুকে নিয়ে যেতে চাওয়া হলো। অথচ চাপা স্বভাবের মেয়েটা সকাল সকাল উঠে কাজবাজ করা শুরু করেছে। সে যাবেনা। প্যারাসিটামল খেয়ে সে নাকি খুব চাঙ্গাবোধ করছে।

তুলি রিমিকে সাথে নিয়ে মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। হামজা সঙ্গে দুজন ছেলেকে পাঠালো। তারা দূরে দূরে থাকবে, লক্ষ্য রাখবে ওদের।

পৌরসভায় নতুন বাজেট বরাদ্দের কাজ চলছে। হামজা ওদিকেও বেশ ব্যস্ত। সকালে তাকে কার্যালয়ে চলে যেতে হলো। জয় তখনও ঘুমাচ্ছে। খানিক পর উঠে সেও কোথায় বেরিয়ে পড়বে। পলাশের খোঁজ পেয়েছে। পলাশ নাকি চেষ্টা করছে, জয়ের নামে থানায় চাপা পড়ে থাকা পুরোনো অভিযোগের ফাইল তাজা করতে।

অন্তূ তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। রোদের তেজে মুখটা ঘেমে লাল হয়ে ওঠে। অথচ ঠোঁটে স্মিত হাসি। জয় আমিরের চোখের বিভ্রান্তি এত শান্তিদায়ক!

ব্যবচ্ছেদ

অফ-হোয়াইট রঙা দেয়ালের ডানপাশে একটি বর্ষপঞ্জিকা ঝুলছে। পাতাটা আগের মাসের। আজ সবে মাস বদলেছে। পঞ্জিকার পাতা উল্টানো হয়নি। সালটা ঠিক আছে—২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ।

মাহেজাবিন স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে ধীর পায়ে উঠে গিয়ে পাতাটা উল্টে দিলো পঞ্জিকার। গতপরশু জুন মাসের ২৯ তারিখ, জয় আমিরের ৩১তম জন্মদিন ছিল। আজ জুলাইয়ের ০১ তারিখ যাচ্ছে।

বিকেল হয়ে আসছে। জানালা বাইরে তাকিয়ে দেখলেন মিস ক্যাথারিন। মাহেজাবিন কাহিনির মাঝে চট করে থেমেছে, এরপর উঠে গেছে পঞ্জিকা ঠিক করতে। এই মেয়েটা এত অদ্ভুত চলনের! বুঝতে পারেন না তিনি।

মাহেজাবিন ফিরে এসে সোফাতে বসল ফের। তিনি খুবই বিরক্ত হলেন। ভ্রু কুঁচকে তাকালেন সম্মুখে বসে থাকা ছাব্বিশ বর্ষীয়া নারীটির পানে।

অতি-হালকা এক ধরণের নীল রঙ যেটাকে বলা হয় ক্যাডেট-ব্লু কালার। সেই রঙা খাদি কাপড়ের শাড়ি পরনে। বাঁ-হাতে জোড়া স্বর্ণের চুড়ি। গলায় চিকন সোনালী চেইন। কুঁকড়ানো লম্বা চুলগুলো ঘাঁড়ের ওপর হাতে খোঁপা করা। কোনো প্রসাধনী নেই, তবু যেন কোনো অভিজাত কুমারীকা! কাজের চাপে নিজের বিশেষ যত্ন ছাড়াও এত অলংকারহীন ঐতিহ্য আর গাম্ভীর্য! রোজ মুগ্ধ হলেও সেদিকে তাকিয়েও মিস ক্যাথারিন বিরক্ত হলেন আজ।

মাহেজাবিন চেয়ে আছে জানলার বাহিরে। শাড়ির বিশাল আঁচলটা বিছিয়ে আছে মেঝেতে। পা দুটো মেলে দেবার মতো বসে আছে। সোফার হাতলে হাত মেলে রেখেছে।রাজ্যের ভাবুকতা কাজলহীন চোখদুটোয়। উদাস-উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিজোড়া প্রকৃতিতে বিছিয়ে আছে।

চট করে কাহিনির মাঝে থেমেছে, আর শুরু করছে না। তিনি বৈকালিক প্রার্থনা ভুলে শুনছেন কাহিনি। তাতেও বেশ বিরক্তই হচ্ছিলেন বটে। আজ এই মেয়েকে দেখে কে বলবে, সে একসময় এত হুটমেজাজি ছিল? সমুদ্রের মতো গভীরতা, নিশ্চুপ চলন, বিনয়ী ভঙ্গিমা, শব্দহীন পদক্ষেপ আজ তার। সেসব কি পূর্বের সেই হুটহাট ক্ষেপে ওঠা অভিজ্ঞতারই প্রাপ্তি?

কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই মাহেজাবিন হাত উঁচিয়ে ধরে মুচকি হেসে বলল, “ক্ষমা চাইছি, মাদাম। একটু বিরতি প্রয়োজন আমার। এক কাপ চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। তা মিটিয়ে বরং আপনার প্রশ্নের উত্তর দেই!ʼʼ

তখনও দৃষ্টি জানালার বাহিরেই। ওভাবেই মাহেজাবিন ডাকল, “লতা? দু-কাপ চা করে দে!ʼʼ

এরপর জানালা থেকে নজর ফেরালো, মুচকি হেসে বলল, “আপনার প্রশ্ন করুন এবার।ʼʼ

-“অনেক প্রশ্ন করেছি এ যাবৎ। কোনোটারই উত্তর না দিয়ে একরোখার মতো গল্প বলে গেছ।ʼʼ

-“অসন্তুষ্ট হবেন না। এবার কিন্তু আমি নিজেই প্রশ্ন করতে বলছি।ʼʼ

-“ঠিক আছে, সব পরে হবে। আগে এটা বলো, তুমি মাইন্ড-ট্যাঙ্গল ইন্টার‌্যাক্ট প্লে করেছ ওদের সঙ্গে?ʼʼ ভ্রু জড়িয়ে ফেললেন মিস ক্যাথারিন।

-“তা বলছেন কেন?ʼʼ

-“মনে হলো।ʼʼ

-“না। সেসব পারিনা আমি।ʼʼ

-“ইশ্বরের দোহাই, মিথ্যে বলবে না। জয় আমির এ পর্যায়ে তোমার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছিল।ʼʼ

-“তাতে কী প্রমাণিত হয়?ʼʼ

-“তুমি তো এটাই চাইতে—তার জীবনের প্রতি মোহ জন্মাক।ʼʼ

-“তার সাথে শুধুই লড়াই চলেছে আমার। সেটাও আমার খালি হাতের। এত গভীরভাবে ভাবছেন কেন?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন হাসলেন, “সংসারত্যাগ কি অ-ভাবুকেরা করে? তোমার রুক্ষ্ণ আচরণ জয় আমিরকে তোমার দিকে মনোযোগী করেছিল, আর সেই মনোযোগ তোমাকে নিয়ে তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে, আর তা থেকে তোমার প্রতি সে… কারণ তুমি ছিলে সবার থেকে ব্যতিক্রম তার দৃষ্টিকোণে… তার সম্মুখে তুমিই প্রথম কেউ, যে তাকে সমীহ না করে ধিক্কার জানিয়েছে বারবার। বিয়ের পরে কি এ কাজটা ইচ্ছাকৃত একবারও করোনি?ʼʼ

মাহেজাবিন অদ্ভুতভাবে সূক্ষ্ণ হাসল, “তা কেন মনে হলো?ʼʼ

-“বলো, সত্যি কিনা!ʼʼ

-“কিছুটা।ʼʼ

-“আই বিলিভ দ্যাট, তুমি জয় আমিরকে কখনও কখনও ইচ্ছাকৃত ক্ষেপিয়ে তুলেছ। এবং জেদ ধরে সেটাকে তামাশার পর্যায়ে নিয়ে গেছ।ʼʼ

সোফাত হাতল থেকে হাত তুলে, “ভুল বলছেন, মাদাম। শুধু তাকে প্রশ্রয় দেইনি, ভয় পাইনি পরিণতি অথবা পরিস্থিতিকে বিশেষ। এটা কাজ করেছিল বেশ। সকলেই ভয় পেত, আমি চেষ্টা করেছি নিরুদ্বেগ থাকার। এটা ওদের জন্য চিন্তার ছিল। আর তাতে আমার বেশ সাময়িক ভোগান্তিও হয়েছিল।ʼʼ

-“এটা কার্যকর ছিল। তাহলে স্বীকার করছো না কেন?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন থেমে গেলেন। মাহেজাবিন মুচকি হাসল। তিনি চট করে বললেন, “আচ্ছা! জয় আমির ভালোবেসেছে তোমায়?ʼʼ

-“জিজ্ঞেস করিনি কখনও।ʼʼ

-“তুমি কোনগুলোকে নিজের বোকামি বলো?ʼʼ

‘“আজ কিছুকেই না। তখন মাঝেমধ্যে মনে হতো, হয়ত বোকামি করছি।ʼʼ

-“তা কেন?ʼʼ

অন্তূ শুধু হাসল মুচকি, কথা বলল না। মিস ক্যাথারিন বললেন, “তোমার বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করো।ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠেনা। মৃত্যু অবধারিত সত্য। তার জন্য দায়ী যদি কেউ থেকে থাকেন সেটা তো সৃষ্টিকর্তা! সেই মহান সত্ত্বাকে দায় দেওয়া?….আসতাগফিরুল্লাহ! আল্লাহ পাক মাফ করুন আমায়।ʼʼ

-“তখন কেন ভাবতে?ʼʼ

-“তখন আমি অন্তূ ছিলাম, কারও কারও আরমিণ ছিলাম। আজ তা নই!ʼʼ

-“প্রতীকী কথা ভীষণ বলো, তুমি। উফফ! বুঝতে বেগ পেতে হয়।ʼʼ হেসে ফেললেন মিস ক্যাথারিন।

ফের গম্ভীর হলেন তিনি, “আর অন্তিকের মৃত্যু। সেটার জন্য কাকে দায়ী করো? নিজেকে মনেহয় না?ʼʼ

-“কখনোই না। আপনার তা মনে হয়?ʼʼ

-“তুমি হামজা-জয়ের প্রকাশ্য বিরোধিতা না করলে এমন হতো না। আমি মানি তা। এখানে স্টুপিডের মতো কাজ করেছ তুমি।ʼʼ

-“এবার নিয়ে পুরো কাহিনিতে কথাটা শতবার বলেছেন। অথচ এটা ভুলে যান ওদের কাছে মানুষ খুন করার জন্য সবকিছুর প্রয়োজন হলেও। কারণের প্রয়োজন কখনোই ছিল না। এরকম হাজার অন্তিককে রোজ মেরে আসতো। তাদের সকলের কয়টা করে আমার মতো বোন ছিল?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন ভ্রু কুঞ্চিত করে চেয়ে রইলেন।

অন্তূ রহস্য জড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “আমি ক’দিন বাদে হবো অ্যাডভোকেট মাহেজাবিণ আমির। রোজ কতশত অপরাধীর বিরুদ্ধে কেইস লড়ে ফিরব। তার পরিণাম কী হবে, তা ভেবে কি আদালতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ফন্দি আঁটবো যে, কীভাবে পরে লুকিয়ে প্লান-প্রোগ্রাম করে নিরপরাধকে মুক্তি এবং অপরাধীকে ছক এঁকে ফাঁসি দেয়া যায়? আদালতে চুপ থাকি, নয়ত আমার বাপ-ভাই মরে যাবে। আর চুপচাপ হজম করলে তারা চিরকাল বেঁচে থাকবে। অমর হয়ে যাবে ওরা!ʼʼ কথার মারপ্যাচে উপহাস করে উঠল মাহেজাবিন।

এরপর বলল, “ইন্টেলিজেন্ট সবাই পরিবার বাঁচাক, আমার পেশা এবং নেশা কেবল তা নয় এক জীবনে। স্বাধীনভাবে চলে যতদিন দুনিয়ায় টেকা যায়, যথেষ্ট।ʼʼ

মিস ক্যাথারিন একটু লজ্জা পেলেন। অন্তূ নরম হাসিমুখে বলল, “আমাকে কথা বলে, শত লোকের সম্মুখে যুক্তি দিয়ে তর্ক করে কেইস ডিসমিস করতে হবে, মাদাম। আর সেটা অপরাধীর বিরুদ্ধে, ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে উঁচু আওয়াজে করতে হয়। সেখানে অপরাধীদের পুরো গ্যাঙ উপস্থিত থাকবে। কাল যেমন ক্ষতির ভয় না করেও দিব্যি অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের জন্য আওয়াজ তুলব, তখনও তুলেছি। এরপর যা হয়েছে, সেটা হয়েছে রং টাইমিংয়ের জন্য। তখন যা-ই করতাম, ধারাবাহিকভাবে হিতে বিপরীত অর্থাৎ আমার খারাপই হতো। আজ তেমন হয় না, অন্তত তেমন খারাপ হয়না। হিড়িক বোঝেন? ক্ষতিগ্রস্ত হবারও একটা হিড়িক থাকে, যখন যার পালা, তখন শুধু তারই। একে তকদীরও বলা যায়!ʼʼ

-“কৌশল খাটাতে পারতে। বুদ্ধিমানেরা নীরবে চাল চালে। তুমি বারবার ধরা পড়ে গেছ। কারণ তুমি সতর্ক ছিলেনা।ʼʼ

মাহজাবিন শাড়ির আঁচল তুলে হাতের কব্জিতে রেখে শীতল হাসল, “আমি কি ঢাকঢোল পেটাতাম? ক্ষেত্রটাই এমন ছিল যে, সেখানে কোনো গোপনীয়তার সুযোগ ছিল না। ওরা ছিল মাত্রাতিরিক্ত চতুর। এখানে বসে যতটা সহজে সতর্কতার কথা বলছেন…আচ্ছা আমি যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি এখন যে, আপনি ওখানে থাকলে আমি যা করেছি সেইসব বোকামি না করে তার বদলে আপনি কী কী কৌশল খাটাতে পারতেন?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন জবাব দিতে পারলেন না। চুপচাপ চেয়ে রইলেন অন্তূর দিকে। অন্তূ সোফাতে হেলান দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলো। মিস ক্যাথারিনকে ইশারা করল কাপ তুলে নিতে।

কাপ নামিয়ে রেখে বলল, “কৌশল খাটানোরও বিশেষ জায়গা থাকে, মিস ক্যাথারিন।ʼʼ

মিস ক্যাথারিন তাকালেন। মাহেজাবিন বলল, “ধরুন, আপনার সম্মুখে কাউকে খুন করা হচ্ছে। আপনি বাঁধা না দিয়ে মনে মনে বুদ্ধি আঁটছেন, কারণ আপনি বুদ্ধিমান, ঠান্ডা মাথার খূনি। কারণ আপনার ভয়, এখন কথা বললে আমারও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। ততক্ষণে লোকটাকে মারা শেষ—ওটা আপনার বুদ্ধির লাভ? বাচ্চাগুলো না খেয়ে ছটফট করতো, চাবি নেই আমার কাছে, আপনি কী কৌশল খাটাতেন?

আমি কোনো মাফিয়া চক্র নই, যে থাপ্পড়ের বদলা কঠিনভাবে নিতে সেখানে হেসে পরে তার প্রতিশোধ নিতে গভীর প্লান বানাবো। আমি চিরকাল সাধারণ মেয়ে। খুব নির্বোধ। আর সবসময় শান্ত থাকাটা মানব মস্তিষ্কও প্রেফার করেনা। সে উদ্দীপনার আধার। আপনার মাঝে সেন্স থাকলে তা তখনই সেন্সিটিভিটিতে জ্বলে উঠবে, এটাকে সেন্স-রিফ্লেকশন বলে। যেমন আমার হতো। আমি চেয়েও জয়-হামজা-পলাশের সম্মুখে মিথ্যা তোষামোদ দেখাতে পারিনি। ভেতরের ঘৃণা ও সমগ্র পারিপাশ্বিক পরিস্থিতি আমায় অত সুস্থভাবে ভাবার সুযোগ দেয়নি কখনও। ভেতরের আক্রোশ বেড়িয়ে আসতো ঝটপটিয়ে।ʼʼ

-“অন্তিকে মৃত্যু? ওটা কি তোমার কারণে হয়নি?ʼʼপুনরায় বললেন মিস ক্যাথারিন।

মাহেজাবিন আবারও হাসল শুধু, “শুধু জেনে রাখুন, ‘নাʼ। তাছাড়া আমি মনে করি, ওটা কর্মফল এবং কাকতালীয় পরিণতি। অন্তিকের মতো অন্তিকেরা রোজ হাজারটা পিষে যাচ্ছে হামজা পাটোয়ারীর মতো রাজনৈতিককদের শুধু ইচ্ছাতে। তাদের সবার বোন আমি নই।ʼʼ

লতা এসে পা ঝেরে দাড়াল, “দিদিমণি, আর কিছু চাইবা না কইলাম। আমি সিনেমা দেখতেছি। এই নেও বিস্কুট।ʼʼ

মাহেজাবিন জবাব দিলো না কোনো। লতাও আশা করল না। সে তার ম্যাডামসাহেবার কাছে জবাব পেলেই অবাক হয়। তার ধারণা তার ম্যাডাম বাংলা জানেনা ঠিকমতো, তাই কথাও কয়না প্রয়োজন ছাড়া। কিন্তু আজ রাগ হলো। আজ তো বেশ কথা বলছে এই খ্রিষ্টান মহিলার সাথে!

মিস ক্যাথারিন বললেন, “সব স্থানে উকিলগিরি? নিজেকে খুব ডিফেন্স করতে জানো, দেখছি! দেখি এত যুক্তি শেষ অবধি তোমার জীবনকে কতটা যুক্তিযুক্ত অবস্থানে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে।

মাহেজাবিন মুচকি হাসল, “আত্মরক্ষা ফরজ। আর যুক্তি হলো মনের বুঝ। ভুললে চলবে না—জীবন তার পরিকল্পনা মাফিক প্রবাহিত হয়। আমরা কেবল জীবনের দাস। তার পেছনে নিরুপায় এগিয়ে চলি। জীবনের পরিকল্পনার সামনে যুক্তি খাটেনা। শুধু কাযকর্ম ব্যাখ্যা করার মাধ্যম হলো যুক্তি।ʼʼ

-“সেদিন ছেলেটাকে সঙ্গে কেন নিয়েছিলে ইচ্ছাকৃত? মন থেকে নাওনি তা আমি জানি।ʼʼ

মাহেজাবিন কাপ নামিয়ে রেখে বলল, “মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুব সহজ। সেদিন আমি নিজে থেকে লোক চেয়ে নিয়েছিলাম। তাতে কি আর আমার ওপর সন্দেহ আসবে, যে আমি অন্য কোনো কাজে যাচ্ছি। তাহলে তো লোক সঙ্গে নিতাম না। তাছাড়া…ʼʼ

মিস ক্যাথারিন কথা কেড়ে নিলেন, “তাছাড়া জয় আমিরের মনে হয়েছিল যে, তুমি তাকে ভরসা করছো। কৃতজ্ঞতা আর ভয়ে তার সাহায্য গ্রহণ মানে তো সব মেনে নেয়াই।ʼʼ

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫৩.

বাড়ির সামনে অযত্নে লতাপাতা জন্মেছে কত! অন্তূ তালা খুলে দরজার সামনে ছেলেটার দিকে ফিরে তাকাল, “আপনি কতক্ষণ থাকবেন?ʼʼ

-“আপনে যতক্ষণ আছেন, ভাই আশেপাশেই থাকতে বলেছে। সমস্যা নাই, আমি আশেপাশেই আছি।ʼʼ

-“হ্যাঁ। দূরে যাবেন না যেন। বাড়ির আশেপাশেই থাকুন। আমি কয়েক ঘন্টা থাকব এখানে।ʼʼ

অন্তূ ভেতরে ঢুকে দরজা আঁটকে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে অবাক হবার মতো করে হাসল, “আরে! দাঁড়িয়েই আছেন দেখছি। যে রোদ বাইরে, ঘেমে যাচ্ছেন। এতক্ষণ তো আর এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যায়না। চাইলে আপপাশের দোকান থেকে চা-টা খেয়ে আসতে পারেন।ʼʼ

লজ্জা পাচ্ছিল লোকটা। অন্তূ কিছু টাকা বের করে এগিয়ে দিয়ে সুন্দর করে হাসল, “নিন। আর অনেক ধন্যবাদ। বেশি দূরে যাবেন না যেন। আশেপাশেই দোকানপাটে বসুন। বাড়ির দিকেও খেয়াল রাখবেন।ʼʼ

অন্তূ জানে এসব লোক নেহাত বড়ভাইদের মন জয় করতে এসব কাজ করে। মোটেও তার মনোযোগ থাকবে না বড়ভাইয়ের বউ বাপের বাড়িতে ঢুকে কী করছে না করছে, সেদিকে। আন্তরিকতা শূন্য তেলবাজী যাকে বলে। যেটা সে পারেনা। এইসব পার্টির ছেলেরা খুব জানে।

লোকটা চলে যাবার পর অনেকদিন পর অন্তূ নিজের পুরাতন বোরকাটা পরল। গায়ে চড়ানোর সময় বুক আঁটকে আসছিল। ধমকে নিজেকে সামলে ওড়না দিয়ে মুখটাও আবৃত করে নিলো। বহুদিন পর এই সম্মানিত পোশাক গায়ে চড়িয়ে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। টেনেটুনে খুলে ফেলে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। সম্মান অবশিষ্ট নেই আর তার। তার সম্মানে আবৃত শরীরটাকে অনাবৃত করে লোকচোখের লোভী চাহনি ও মিথ্যা নাটকীয় অপবাদের আঘাতে ছিন্নভিন্ন করা পুরুষটা আজ তার স্বামী। আর আজ সে-ও মন ও চলনের দিক থেকে সেই সরল-শুদ্ধ মেয়েটা নেই পুরোপুরি।

জয়ের ছেলেটা আড্ডায় বসে গেছে মোড়ের টঙে। উল্টো পথ ধরে মুস্তাকিনের ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা ধরল। লোকটাকে তার সন্দেহের সাথে মিলিয়ে দেখার পালা এবার। ফ্ল্যাটে না পেলে কার্যালয়ে যাবে। যদিও এতেও সন্দেহ আছে, সে আসলেই চাকরিটা করে কিনা! না পেলে কী করবে, এটা ভেবে উত্তেজনায় ঘেমে ভিজে উঠল শরীরটা। তবু মন বলছিল পাবে, পাবেই!

তালা ছিলনা ফ্ল্যাটের দরজায়। অন্তূ খুশি হলো। দরজায় বেল টিপে অপেক্ষা করল। হাতের তালু ঘামলে খুব অস্বস্তি হয়। উত্তেজনায় হাত ভিজে উঠছে। কয়েকবার বেল চাপলো। খুলছে না কেউ। বারবার বেল চাপাটাও এক প্রকার অভদ্রতা। তবু আরও কয়েকবার করাঘাত করল।

দরজা খুলল মুস্তাকিন। দরজাটা অল্প একটু ফাঁক করে দেখল অন্তূকে। তার চোখ-মুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ল, যা সচরাচর দেখা যায়না। অন্তূ অবাক হলো, যখন দেখল, মুস্তাকিনের হাতে লোডেড পিস্তল ছিল, সেটা অন্তূকে দেখে চট করে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করল।

মুস্তাকিন মেকি হাসে, “উড-বি উকিল মহোদয়া! চমকে দিয়েছেন পুরো! আমি ভেবেছি পুলিশ!ʼʼ

অন্তূ উপহাস করে ওঠে, “পিবিআই অফিসার সৈয়দ মুস্তাকিন মহান কোন সংস্থার পুলিশকে ভয় পেতে পারে? সেটা ভাবার বিষয়। পুলিশকে অপরাধীরা ভয় পায় বলেই জানতাম। কত ভুল যে জানি আমি!ʼʼ

মুস্তাকিন বুঝল খোঁচাটা। তার ওপর গাঢ় সন্দেহের তীর তাক করেই এই নারীটি আজ তার দরজায় কড়া নেড়েছে। সে জানতো, আসবে। এবার দিনাজপুর ফিরলে এই রমনীর সম্মুখীন তাকে হতে হবে, এই প্রস্তুতি ছিল তার। ঘাঁড় চুলকে হাসল, “ভেতরে আসুন, দরজায় দাঁড়িয়ে কেন? ভয়-টয় পাচ্ছেন নাকি? ওসব মানায় না আপনাকে। তার ওপর জয় আমিরের বিবাহিতা স্ত্রী আপনি। লোক কাঁপবে আপনাকে দেখে।ʼʼ

-“ভয় তো পাচ্ছিই। আজকাল ভয়টা ঘামের মতো হয়ে গেছে। সাধারণ তাপমাত্রায়ও ঠিকরে বেরোয়।ʼʼ

-“আমাকে ভয় পাবার কী?ʼʼ

-“অনেককিছুই আছে, জনাব.—ʼʼ বাকিটা বলল না। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আপনি যেন কে? জনাব—ʼʼ


জয় ঘুম থেকে উঠে বড়ঘরে গিয়ে আধঘন্টার মতো কাটিয়ে এরপর ফিরল বাড়ির ভেতরে। তরুর জ্বর। চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠেছে। তবু ছুটে এসেছিল জয়কে খাবার দিতে। জয় ধমক মারল একটা, “বেশি গিন্নিগিরি দেখাবি না আমার সঙ্গে। আমার লম্বা দুটো হাত আছে। বেড়ে নিয়ে খাচ্ছি। তুই তৈরি হয়ে নে। চল তোকে ডাক্তার দেখিয়ে এরপর যাব কাজে।ʼʼ

-“আমি সুস্থ আছি।ʼʼ

-“থাপড়ে কান গরম করে দেব। চোখ উল্টে মুখ ভেঙচালো, আমি তুস্থ, আমাল কিতুই হয়নি। সিনেমা করো? ওইহ্ চেংরী! খাইছিস সকালে? বস।ʼʼ

তরু হেসে ফেলল। জ্বরের তোপে শুকনো মুখের হাসি মেয়েটার মুখে অদ্ভুত দেখালো। জয় মায়াভরে চেয়ে থেকে নরম করে বলল, “বস। আয় একসাথে খাই। একা একা খাইতে ভাল্লাগেনা আমার।ʼʼ

এই ডাক উপেক্ষা করার সাধ্যি নেই তরুর। বসে মনে মনে বলল, ‘জানি না কি তা আমি? একা খেতে পারেন না, আর তাই ছোটবেলা থেকে বসে বসে খাওয়া পাহারা দিতে গিয়ে আমার কত বড় সর্বনাশ হয়েছে, তার খোঁজ রাখলেন না, নিষ্ঠুর পুরুষ। তবু আপনি এত মায়াময় কেন বলুন তো?ʼ

তরু খেতে পারছিল না। জয় তুলে তুলে দিলো, সাথে ধমক ফ্রি। চোখ দেবে গেছে কোটরের ভেতর। জয় দাঁত খিঁচে উঠল, “ইচ্ছা করতেছে, তোর চুলের ঝুঁটি ধরে ঘুরান্টি মারি চারটা। ওরা গেছে ডাক্তারের কাছে, তুই যাস নাই ক্যান? এখন যদি তোরে ধরে দুটো চড় মারি, ঠেকাবে কে?ʼʼ

তরুর হাসি পেল। একমাত্র মানুষ এটা, যার সামনে কারও গাম্ভীর্য চলে না, সে না চাইলে। ঠোঁট উল্টে একটু আহ্লাদ করে, “ধুর। আমার ডাক্তারের কাছে যেতে ভাল্লাগে না। ওষুধ দেয় একগাদা। ওষুধ ভাল্লাগেনা। তিতা…ʼʼ

-“তো ওষুধ কি আবার চানাচুরের মতো টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদ লাগবে খেতে? এই জন্যই কওয়া হয়—মেয়েলোকের নাই বারো হাত কাপড়ের কাছা।ʼʼ

-“আপনি আসার সময় জ্বর আর শরীর ব্যথার কথা বলে ওষুধ আনবেন নাহয়। আমি যেতে পারব না। হাঁটতে গেলে শরীর বেশি খারাপ লাগছে। এতদূর যাব আবার। আপনিই আনবেন নাহয়!ʼʼ

তরুর আস্তে আস্তে অল্প আদুরে আহ্লাদ নিয়ে বলা কথাগুলোতে জয় হাসল। এই চাপা মেয়েটার কিঞ্চিৎ আহ্লাদটুকুর সবটাই একমাত্র জয়ের কাছে। হামজাকে তরু বড় ভয় পায় ছোট থেকেই। জয় মাথা নিচু করে আলতো হাসিমুখে খাবার গিলছে। চোখে-মুখে বিরক্তি দেখিয়ে ঠোঁটে হাসলে জয়ের মতো খিটখিটে পুরুষদের বুঝি একটু বেশিই সুন্দর দেখায়, তরুর তাই মনে হলো।

জয় খাওয়া শেষে ডাকে, “এদিক আয়।ʼʼ

তরু এলে কপালে হাত রেখে তাপমাত্রা দেখে বলল, “জ্বর মেপেছিস?ʼʼ

-“হ্যাঁ। একশো চার ছিল সকালে। এখন কম মনেহয়। ভালো লাগছে শরীরটা।ʼʼ

জয় কড়া চোখে তাকায়, “বাটপার কেন তুই এত? নিজের সমস্যা না থাকলেও লোক বানিয়ে সমস্যা বলে সুবিধা নিয়ে বড়লোক হয়ে যাচ্ছে। তুই আর আমার বউ দুই মহিলা, যাদের নিজের জন্য কিছু চাওয়ার নাই। অন্যের জন্য নিজে বাঁশ খেয়ে লক হয়ে থাকে।ʼʼ

খেয়ে গোসল করে তৈরি হয়ে নিলো। পলাশ এখন জয়পুরহাটে আছে। জয় এটা ভেবে হাসে, তার নামের শুরুটা দিয়ে জেলার নামের শুরুতে পলাশের সাথে একটা মিটিং করলে খারাপ হবেনা। গুনগুন করে গান ধরল,

এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা সুরমা নদী তটে
আমার রাখাল মন গান গেয়ে যায়…
কী আমার দেশ, কী আমার প্রেম…কী আনন্দ, বেদনা, মিলনও বিরহ সংকটে..

গান ছেড়ে আয়নায় নিজেকে দেখে সন্তুষ্ট হলো। দারুণ বলিষ্ঠ আর হ্যান্ডসাম লাগছে দেখতে। বউটা গেছে বাপের বাড়ি। তা ভেবে দুঃখ হলো। এখন থাকলে একটু জ্বালাতন করা যেত। বদমায়েশের মতো মুচকি হাসল। ওর বউয়ের চোখদুটোকে ওর বড় ভয়। নিজের জন্য ওই চোখে ঘৃণা দেখলে খুব রাগ হয়, মন চায় থাপড়ে চোখের দৃষ্টিতে নিজের জন্য একটু ভয় আনতে। আর সবাই পায়, ঘরের বউ ভয় কেন পাবেনা? এই দুঃখে, হতাশায় জোরে করে স্লোগান দিয়ে উঠল, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।ʼ

পরে ভাবল, আহারে! বঙ্গবন্ধুর বউটা তার বউ হলেও পারতো। তার বউয়ের মতো এমন কড়া ছিল না হয়ত।

বের হবার সময় তরুকে ডাকল, “নিচে ছেলেরা আছে। কোনো দরকার পড়লে ডাকবি শুধু একবার।ʼʼ

তরু ঘাঁড় নাড়ল।

-“মাথায় পানি নিবি? চল, দুই বদনা হট-কুল পানি মাথায় ঢেলে যাই। জ্বর নেমে যাবে।ʼʼ

-“না না। আপনি কোথাও যাবেন, যান। আমার শরীর ভালো আছে বললাম তো। দরকার হলে বাথরুমের ট্যাপকল ছেড়ে পানি মাথায় নেব আমি নিজেই।ʼʼ

জয় গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তরু হন্তদন্ত পেছন থেকে ডাকল, “দাঁড়ান দাঁড়ান।ʼʼ

জয় পেছন ফিরল, “আবার কী?ʼʼ

তরু টলমলে পা নিয়ে ফ্রিজের কাছে যায়। ছোট্ট কনটেইনার-বক্স নিয়ে এসে জয়ের সামনে ধরে বলল, “গতদিন সুজির হালুয়া বানিয়েছিলাম কোয়েলের জন্য, সেটা দিয়ে পরে বরফি বানিয়েছি। আপনার খুব পছন্দ। এই দুটো খেয়ে যান।ʼʼ

জয় দাঁত কিড়মিড় করে বিরবির করল, “থাপড়ে তোর.. ওই! তুই কি ধরেই নিয়েছিস আমি রাস্তায় মরে যাব, নাকি তুই-ই বাঁচবি না? রেখে দে। এসে খাব আরামে বসে। ফিরলে মনে করে দিবি কিন্তু।ʼʼ

তরু মুখটা ছোট করে দাঁড়িয়ে রইল। জয় বলল, “ভুলে যাস না। আসলেই দিবি। ফ্রিজে রাখ এখন। আমি কাউকে দিয়ে প্রাথমিক ওষুধ পাঠাচ্ছি। ফেরার পথে ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওষুধ আনবো। সাবধানে থাকিস। বেহুশ হয়ে পড়ে-টে থাকার আগে গলা দিয়ে টুকটাক আওয়াজ বের করিস।ʼʼ

জয় চলে গেলে তরু খাবারটা ফ্রিজে রেখে দিলো। জয় ফিরলে বের করে দিতে হবে। জ্বর শরীরে নিয়ে সে গতদিন বরফি বানিয়েছে, লোকটার খুব পছন্দ সুজির বরফি।


-“কবে ফিরেছেন দিনাজপুর?ʼʼ আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল অন্তূ। ফ্ল্যাটের হাল দেখে বোঝা যাচ্ছে, বহুদিন লোক ছিল না এখানে।

মুস্তাকিন বিভ্রান্ত হলো কি-না, বোঝা গেল না। মুচকি হেসে বলল, “নাশতা হিসেবে কী খেতে পছন্দ করবেন আমার হাতের?ʼʼ

-“একগ্লাস পানি এনে রাখুন।ʼʼ

-“শুধু পানি?ʼʼ

অন্তূ আশপাশে চোখ ঘুরাতে ঘুরাতে শুধু মাথা নাড়ল মৃদু।

মুস্তাকিন পানির সঙ্গে ট্রে ভর্তি কিছু শুকনো খাবার ও দুই কাপ অদক্ষ হাতে বানানো চা এনে রাখল। অন্তূ একদৃষ্টে তাকিয়ে চোখের মণি ঘুরিয়ে লক্ষ করছিল মুস্তাকিনকে।

কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলছিল না। মুস্তাকিন আজ খুব হাঁসফাঁস করছিল। যেটা তার মাঝে আগে দেখা যায়নি। বলল, “কেন এলেন, কিছুই তো বলছেন না। কিছু নিচ্ছেনও না। আমাকে দেখতেই এসেছেন?ʼʼ

-“হ্যাঁ। দুনিয়াতে দেখা ছাড়া আর কাজ কী বিশেষ!ʼʼ

-“হেঁয়ালি বুঝিনা, ম্যাডাম।ʼʼ

-“আমিও বুঝতাম না।ʼʼ

মুস্তাকিন তাকিয়ে রইল। অন্তূ নিজের দৃষ্টি তীরের মতো মুস্তাকিনের চোখের মণির ওপর স্থির রেখে জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?ʼʼ

মুস্তাকিন চট করে হেসে ফেলল, “আমি? চেনেন আপনি আমায়। পিবিআই অফিসার সৈয়দ মুস্তাকিন মহান।ʼʼ

-“আপনি কে, সেটা জিজ্ঞেস করেছি। কল্পকাহিনী খুব বেশি পছন্দ না আমার। আব্বু ছোটবেলা থেকে বাস্তব গল্প বেশি শোনাতো। রূপকথার গল্প বিরক্ত লাগে আমার।ʼʼ

-“কল্পকাহিনী? তাহলে বাস্তবটা আপনিই বলুন।ʼʼ

-“সেটা আপনার কাছে জানব। শুধু এটুকু জানি, আপনার আপাত-পরিচয়টা কল্পকাহিনির অংশ।ʼʼ

-“তা কী করে বলছেন?ʼʼ

-“কথার লাইন কাটছেন, আপনি। যেটুকু জিজ্ঞেস করেছি, তার জবাব দিন।ʼʼ

অবাক হবার ভান করল মুস্তাকিন, “মাই গড! সবে আপনি অনার্স থার্ড ইয়ার। অথচ এক সেকেন্ডের জন্যও এতক্ষণে মনে হয়নি যে আমি কোনো উকিল মহোদয়ার সামনে বসে নেই। এমন জেরা করার দক্ষতা নিয়েই জন্মেছিলেন নাকি? তারপর উকিল হবার স্বপ্ন দেখেছন?ʼʼ

অন্তূ কপট হাসল, “রসিকতা বিরক্ত লাগছে।ʼʼ

-“আগে শুনি, আমার ওপর আপনার সন্দেহের শুরুটা কবে?ʼʼ

-“অনেক আগে।ʼʼ

-“অনেক আগে? তবু আপনি…ʼʼ

-“পাকাপোক্ত প্রমাণ একত্র না করে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়না। বড়জোর সাসপেক্টিভ হিসেবে মার্ক করা যায়। যেটা আমি অনেক আগেই করেছি আপনাকে।ʼʼ

মুস্তাকিন সামান্য ভ্রু কুঁচকে কেমন বিব্রত মুখে তাকিয়ে রইল। অন্তূ বলল, “প্রথমত আপনাকে আজ অবধি কোনোদিন পুলিশের ইউনিফর্মে দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। একবার কার্যালয়ে গেছিলাম, আপনি তখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, ডেস্কে বসিয়েছিলেন ঠিকই, তবে সবার পরনে পোশাক থাকলেও আপনি কিন্তু তখনও অর্থাৎ কার্যালয়ের ভেতরেও সিভিল ড্রেসে ছিলেন।ʼʼ
মুস্তাকিন চুপচাপ বসে রইল। অন্তূ বলে, “আপনি আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। আব্বুকে পরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘উনি কি সৈয়দ পরিবারের ছেলে?ʼ আব্বু হেসে বলেছিল, ‘না। পুলিশের চাকরির সময় এটা নাকি ছদ্মনাম লাগিয়েছে।ʼ এন্ড দেয়ার ওয়াজ মাই ব্ল্যাডি ফল্ট দ্যাট— সেদিন আব্বুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, তাহলে আপনার আসল নামটা কী?ʼʼ

-“তাতে কী প্রমাণ হয়?ʼʼ

অন্তূ মাথা নাড়ল, “বিশেষ কিছু না। কিন্তু এরপর? আমি যেদিন পলাশের ডেরায় গেলাম, আপনি আমায় জিম্মি করে পাঠিয়ে আপনারাই ব্যাক-আপে রইলেন। হাস্যকর না? পুলিশেরা সন্ত্রাসীর খোঁজ পেলে নিজেরা চার-পাঁচ ফোর্স মিলে একসাথে অফারেশন চালায়, পেছনে আরও লোকাল থানা ও কত রকমের সংস্থা এবং ব্যাটেলিয়ন ইত্যাদিরা ব্যাক-আপে থাকে। আর আপনি সেদিন আমার মতো একটা নিরীহ মেয়েকে পাঠালেন তো পাঠালেন, এক ঘন্টা সময় দিলেন, এরপরও আমি না বেরোলে আপনি যাবেন! আপনার হাসি পাচ্ছেনা?ʼʼ

মুস্তাকিন কিচ্ছু বলল অন্তূর এমন শক্ত ধিক্কারে। একগ্লাস পানি খেল ঢকঢক করে।

অন্তূ থেমে এবার চোখ তুলে তাকাল, “অথচ এক ঘন্টায় একটা মেয়েকে ছিঁড়ে-ফেঁড়ে রান্না করে খেয়ে ফেলা যায়। আপনি পলাশের ডেরা থেকে খুব দূরে ছিলেন না। তবু এত চিৎকার চেঁচামেচিতে উঠে আসেননি। তাছাড়া জয় আমিরের সঙ্গে আপনার কথাবার্তা বরাবর রহস্যজনক ছিল। যেন দুজন দুজনকে খুব চেনেন, জানেন।

আমার সঙ্গে যখন জয় আমির মজার খেলা খেলছিল, তখন আপনি নাকি জেলার বাইরে ছিলেন। আমার তথাকথিত বিয়ে হলো, আব্বুর ইন্তেকাল হলো, দান খয়রাত হলো সেই উপলক্ষে। এরপর আপনি একদিন চট করে ফিরলেন। আপনার পরিবারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম, এড়িয়ে গেলেন।ʼʼ

অন্তূ থেমে কপাল চুলকালো, “ধুর! এত ফিরিস্তি দিতে ভালো লাগছে না। মোটকথা সাসপেকশন আপনার ওপর আমার বহুদিনের, কিন্তু আজকের আগে বিশেষ প্রয়োজনবোধ করিনি তা ক্লিয়ার, তাই জানতে আসিনি।ʼʼ

মুস্তাকিন চুপচাপ বসে ছিল। এবার জিজ্ঞেস করল, “আজ এমন কী বিশেষ হয়েছে যে, জানতে এসেছেন?ʼʼ

অন্তূ কোনো কথা না বলে কেবল সামান্য হাসল যেন।

সৈয়দ মুরসালীন মহানের বোন সৈয়দ মুমতাহিণা মহান। কিন্তু আরেকটা কথা থেকে যায়, সেটা হলো–মুমতাহিণার ভাইকে জয় আমির খুন করেছে। কিন্তু সেটা মুরসালীন নয়, কারণ মুরসালীন এখনও জীবিত। তাহলে মৃত ভাইটা কে? এটা ভাবতে গিয়ে অন্তূ খুঁজে পেয়েছিল, সৈয়দ মুস্তাকিন মহান নামটা। অথচ যখনই তার চেনা-জানা সৈয়দ মুস্তাকিন মহানের মুখটা ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে, বিষয়টা খাঁপে খাঁপ খায়নি।

এই মুস্তাকিন মহানের জন্য অন্তূর মনে মনে যে সন্দেহ গেঁথে ছিল, তা ছিল—এই লোকটা একটা ছদ্মবেশী ভন্ড। জয় আমির ভন্ডদের দেখতে পারেনা, মুস্তাকিনকেও দেখতে পারতো না। অথচ মুরসালীনের চোখের আগুন বলেছিল, ওর ভাই ওর মতোই আগুনের দলা হবে। সৈয়দ পরিবারের রক্তে ভন্ডামি আর কলুষ থাকতে পারেনা, এটা যেন কেউ অন্তূকে ডেকে বলেছিল। যে মুরসালীন বোনের সম্মান ও প্রাণহানীর বদলায় হুমায়ুন পাটোয়ারীর মতো জানোয়ারটাকে কমবেশি সত্তরটা ছুরিকাঘাত করে মারতে পারে, তার সাথে অন্তূর চেনা মুস্তাকিন মহান মেলেনি মুরসালীনের ভাই হিসেবে। মুমতাহিণার আরেক ভাই এই মুস্তাকিন মহান হতে পারেনা।

এই হিসেবটা অন্তূ সেদিন বড়ঘরে দাঁড়িয়ে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে কষেছিল। এরপর বসে পড়েছিল লোহার বীমের ওপর।

এইসব কিছুই চেপে শুধু জিজ্ঞেস করল, “আপনি কে?ʼʼ

মুস্তাকিন এতক্ষণে হাসল মৃদু, “আমি?ʼʼ

-“জি, আপনি। কে আপনি?ʼʼ

-“আমি পরাগ আজগর। সরি—আমি জানিনা জারজ বাপের নামের সারনেম জারজ সন্তান ব্যবহার করতে পারে কি-না! কারণ আমার নামটাকেই কখনও ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি কোথাও, সারনেমের প্রশ্নই ওঠেনা। স্কুলে আমার নাম পারভেজ দেয়া হয়েছিল।ʼʼ

অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল, “আপনি পলাশ আজগরের ভাই?ʼʼ

পরাগ দুপাশে মাথা নাড়ে, “আমি রূপকথা আজগরের সৎ ও জারজ ভাই।ʼʼ

-“অর্থাৎ আপনার মা রূপকথার মা নয়?ʼʼ

-“আমার মা সালমা বেগম। আপনাদের ভার্সিটির খন্ডকালীন আয়া। রূপকথার মা রূপকথাকে ছোট রেখে বাপের বাড়ি চলে গেছিল। পরে অন্য ঘরে বিয়ে হয়েছে।ʼʼ

অন্তূ কপাল চেপে ধরে চুপ করে বসেছিল বেশ কিছুক্ষণ। পরাগ চা-য়ে চুমুক দিচ্ছিল শব্দ করে। অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “সৈয়দ মুস্তাকিন মহানটা কে?ʼʼ

-“আপনার পতি-পরমেশ্বরকে জিজ্ঞেস করবেন। সে ভালো বলতে পারবে।ʼʼ

-“সে কি জীবিত?ʼʼ

-“তাকে জয় আমির নিজহাতে খু-ন করেছে।ʼʼ

-“শুধুই কি রাজনৈতিক রেষারেষি?ʼʼ

-“এছাড়াও অন্যকিছু আছে। যা শুধু জয় আমিরই জানে হয়ত। আমি যেটুকু জানি, শুধুই ধান্দা-পার্টনার হিসেবে। আপনার স্বামী মালটা ব্যাপক চাপা আর ঘাউরা। সহজ জিনিস না।ʼʼ আজ চট করে মুস্তাকিনের চিরচেনা ভদ্রতায় পরাগের অসভ্যতা ফুটে উঠছিল একটু একটু করে।

-“আপনি সৈয়দ মুস্তাকিন মহানের নাম ধারণ কেন করেছিলেন?ʼʼ

-“সে আইনের কর্মকর্তা ছিল। আমারও সেরকমই একটা মিছেমিছি পদের দরকার ছিল।ʼʼ

অন্তূ কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থেকে আন্দাজ থেকে বাকিটা বলল, “তাকে খুন করার পর তার স্থল পলাশ আজগর আপনাকে দিয়েছিল আপনাদের অনৈতিক ব্যবসা ডিফেন্স করার জন্য?ʼʼ

বাহ-বা দেবার মতো ঠোঁট ফুলিয়ে নাটকীয়তা নিয়ে পরাগ বলল, “আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা, ম্যাডাম!

-“শুধুই সাধারণ জ্ঞান।…. কিন্তু এমনও কি হয়? একজন মৃত আইন কর্মকর্তার জায়গা আপনি নিয়ে তার স্থলে তার নাম নিয়ে অন-ডিউটিতেও থেকেছেন।ʼʼ

-“প্রতিটা থানা ও তদন্ত সংস্থায় যদি আমরা পেইড-এজেন্ট রাখতে পারি গাদা করে, এ আর এমন কী? তাছাড়া উপরমহলের আদেশে মুস্তাকিন মহানের উপরের টিকিট কাটা হয়ে গেছিল। আদেশ ছিল টুপ করে যেন ওকে কোনো কেইসে অভিযুক্ত করে ফাঁসিয়ে দেয়া অথবা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার। কিন্তু তার আগেই জয় আমির তাকে টপকে দিয়েছে।ʼʼ

-“এটা কতদিন আগের ঘটনা?ʼʼ

-“২০১৩-এর মাঝামাঝি। তবে আমাকে এর ফায়দা দেয়া হয়েছিল মাসকয়েক আগে। আমি শুধু অফিসারের রোল প্লে করেছি লোকের সামনে। কার্যালয়ের ভেতরের কোনো কাজে আমার হস্তক্ষেপ ছিল না। সরকারী কার্যালয়ের ব্যাপার-স্যাপার অতিরিক্ত সহজও না। তবে মাল ছাড়লে আর পাওয়ার থাকলে কঠিনও না। সবাই টাকার বিনিময়ে আমাকে মুস্তাকিন মহানের পদের অফিসারের মতো ট্রিট করেছে।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ বসে রইল মেঝের দিকে তাকিয়ে। মুস্তাকিন মহান নিশ্চয়ই আইনের কর্মকর্তা হয়েও ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষ আচরণ করেছিল প্রকটভাবে। তাই তাকে সরিয়ে দেবার অর্ডার এসেছিল! এমন কত জজ, ব্যারিস্টার, মেজর কত রকম কর্মী-ই তো বরখাস্ত হলো অথবা জীবন দিয়ে মূল্য শোধ করে গেল সেই ভয়ানক সময়টাতে! আব্বু এসব বলতো টুকটাক। শুধুই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মৃদু আওয়াজ তোলার দায়ে নয় কি এসব? এবং নিজের কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করতে চাওয়ার অপরাধে!

অন্তূ ভাবে, তাহলে সে আর এমন কী হারিয়েছে? সে তো এখনও জীবিত! সে এমন চুনোপুটি হয়ে যা টুকটাক কথা বলেছে, হিসেবে তার সাথে কমই বিট্রে হয়েছে। অন্তূর ভেতরটা একপ্রকার নিদারুণ শক্তিতে গমগম করে উঠল। সে একা বেঁচে আছে, জয় আমিরের সুপ্ত-ইচ্ছার জোরে।জয় আমিরকে সেটুকুর কৃতজ্ঞতা, আর বাকিটা অথবা অনির্দিষ্ট হারে অগ্রহণযোগ্যতা।

পরাগের জীবনকাহিনির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ এখনও বাকি। দুপুর সাড়ে এগারোটা বাজছে। গরম বাড়ছে প্রকৃতিতে।


তরুকে ওষুধ দিয়ে গেল একটা ছেলে। দুটো ব্যথার, কয়েকটা প্যারাসিটামল এবং গ্যাসের ওষুধ। জয় পাঠিয়েছে। হাতুরে ডাক্তারদের প্রাথমিক চিকিৎসা। খেল না সে-সব। ওষুধ তার জন্মের শত্রু।

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর বারোটা ছুঁইছুঁই। শরীর একেবারে আওলে গেছে তখন। কোনোমতো হুশ আছে যেন। মাথার ব্যথা ও সর্দিতে গোটা মুখমণ্ডলের সাইনাস ভেঙেচুড়ে আসছিল। অসহ্য ব্যথায় ছটফট করছিল বসার ঘরের সোফাতে আধশোয়া হয়ে বসে।

রিমি ও তুলি মেয়েকে প্রাইভেট এপোয়েনমেন্টে দেখাতে গেছে। অনেকক্ষণের ব্যাপার। সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকতে হবে। কখন ফিরবে জানা নেই। এখন মনে হচ্ছিল, সে সঙ্গে গেলেই পারতো। ঠান্ডার প্রকোপে শ্বাস-প্রশ্বাস আঁটকে আসছিল।

বেলা বারোটার পর দরজায় করাঘাত পড়ল। অন্তূ এসেছে নিশ্চিত সে। খুশি হলো। এই মেয়ে এখন জোর করে ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েই ছাড়বে। এখন আর না গেলেই নয়। অন্তূকে খুব প্রয়োজন ওর। ওই মেয়ে গম্ভীর মুখে দুটো ধমক মারবে এরপর জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে।

তরু দরজা খুলতেই দেখল দুজন পুরুষ দাঁড়িয়ে। একজনকে সে চেনে—রিমি ভাবীর চাচাতো ভাই মাজহার আলমগীর। আরেকজনকে সে চিনলো না। ফর্সা, উঁচু লম্বা চেহারা। চোখদুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। বিড়ালচোখা।ঠোঁটের কোনে প্যাচপ্যাচে হাসি। তরু টলমলে পায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। শরীরটা অজান্তেই ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। তলপেটে একটা আতঙ্কিত পাক জড়িয়ে এলো। শরীরের ওড়নাটা দূর্বল হাতে টানলো। কেউ নেই বাড়িতে। একবার কেন জানি ইচ্ছে করল চিৎকার করে নিচের ছেলেদের ডাকতে। বোকামি হবে। এরা তো কেন এসেছে সে-সব বলেইনি!

পলাশ মাজহারের দিকে মুখ এগিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এইটা কে রে?ʼʼ

-“কে জানি লাগে হামজা লোটির বাচ্চার।ʼʼ

পলাশ ঠোঁট হেলিয়ে মাথা দুলিয়ে হাসল। ঠিক যেমন রক্তচোষা প্রাণীরা— রক্তের গন্ধে তাদের জিভ লকলক করে ওঠে ওমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল পলাশের চোখ-মুখের ভাষা।

তরু কম্পমান গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনারা কে এসেছেন? কিছু দরকার? কেউ তো বাসায় নেই আমি ছাড়া।ʼʼ

-“চলবে তো তাতেই। আর কাউকে আপাতত দরকার নেই। পলাশ ভেতরে ঢুকে পড়ল।

মাজহার হেসে উঠল। পলাশের বুট জুতোর গটগট আওয়াজে তরুর শরীরটা ঝাঁকি মেরে ওঠে। পুরুষটা এগিয়ে আসছে। কেমন এক ভঙ্গিমা। কাধদুটো হেলিয়ে-দুলিয়ে হাঁটছে। ঠোঁটের ওই হাসি নরকের দেবতার খেয়াল এনে দিচ্ছে। হৃদযন্ত্রের ধরাস-ধরাস আওয়াজে শরীরটা শেষ পর্যায়ের নিস্তেজ হয়ে এলো মেয়েটার। মাজহার সে-সময় দরজা আঁটকে দিলো।

মাথা টলছিল তরুর। ওর ক্ষমতা নেই দাঁড়িয়ে থাকার। অন্তূর মুখটা ভাসছিল খুব তখন। তার স্থলে অন্তূ হলে এতক্ষণে নিশ্চিত দৌঁড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে এসে সামনে দাঁড়াতো। মাথাটা চক্কর মেরে উঠছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পা টাল খেয়ে আসছিল তরুর।

খানিক বাদে যোহরের আজান পড়বে। জয় কোথায়? সে এতক্ষণ রাস্তায় পলাশের খোঁজে।

চলবে…

[সতর্কতা: সহিংসতা আছে। ]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫৪.

ক্লাবঘরে ফের আগুন জ্বলেছিল সেদিন। তখন দুপুর বারোটা। ওয়ার্কশপের দুজন ছেলে বাদে সবগুলো একচোটে দৌঁড়াল ক্লাবের দিকে। ওটা ওদের প্রাণের স্থল। রাতে শুধু ঘুমানো হয় বাড়িতে। সকাল থেকে রাত, ওখানেই কাত। আজ কিছুদিন পাটোয়ারী বাড়ির নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে ওদেরকে এ বাড়ির একতলা ভবনে থাকতে হচ্ছে। হন্য হয়ে লাঠি-ছুরি-দা নিয়ে ছুটল সবগুলো। কোনোদিকে খেয়াল নেই। যারা আগুন লাগিয়েছে, তাদের রক্ত দিয়ে আগুন নেভানো হবে আজ। দুর্ভাগ্যবশত কাউকেই পেয়েছিল না ওরা। শুধু আগুন জ্বলছে, বহর বাড়ছে।

ওয়ার্কশপের দুজন দেখল তার খানিক পর পলাশ ও মাজহার ঢুকছে। দুজন উঠে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম দিয়েছিল তড়িঘড়ি। পলাশ এবার বেশ কিছুদিন পর আসলো, আগে প্রায় দিনই তাকে গোডাউনে আসতে দেখা যেত। কিন্তু মাজহার কেন সাথে এসেছে, তা জিজ্ঞেস করার সাহস পলাশের কাছে ওদের নেই। রাগ হলো মাজহারকে দেখে। তবু কিছু বলার নেই। পলাশ মানুষ নয়। তাছাড়া ওরা দুজন দুশ্চিন্তায়— জয় ও হামজা ফিরে এই ঘটনার জন্য কী করবে? পৌরসভার জরুরী অধিবেশনে থাকলে হামজাকে কল বা কোনো প্রকার তলব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দুশ্চিন্তায় সিটিয়ে ছিল দুজন। পলাশ হেলে দুলে বাড়ির মেইন ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছিল।

ক্লাবঘর এমনিতেই বিরোধী পক্ষের আগের হামলায় ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। আজকের আগুন পেট্রোল ঢেলে জ্বালানো হয়েছে। দাউদাউ করে শুধু উপরে উঠছিল। অতগুলো ছেলে মিলেও হিশশিম খেয়ে যাচ্ছিল আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে। সাধারণ লোকজন এসব থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে সবসময়ই।

পলাশ গতরাতে জয়কে কল করে একটা প্রস্তাব রাখল, “বাপ, আয় একটা ডিসকাশনে যাই। আমার কাঁচামাল বর্ডারে আঁটকে আছে। দুজন গিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। এই ফাঁকে কথা হবে।ʼʼ

-“আপনি কোথায়?ʼʼ

-“এখন জয়পুরহাট।ʼʼ

-“বর্ডারে তো আপনার মাল আসেনা। জয়পুরহাট বর্ডারের কাছাকাছিও না তেমন। আর আপনার মাল আসে বন্দরে। তো জয়পুরহাট কী করছেন?ʼʼ

-“একটা কাজে এসেছিলাম। আচ্ছা তুই আমায় বিশ্বাস করতে পারিস না ক্যান?ʼʼ

-“আপনি বিশেষ কী? জয় আমির নিজেকেও বিশ্বাস করেনা, পলাশ ভাই।ʼʼ

-“এত সতর্কতা দিয়ে কী হবে? তুই আমার যা ক্ষতি করেছিস, আমি ফুল-ড্যামেজ, জয়। চাইলেও কিছু করার নেই। অন্তত আপাতত।ʼʼ হো হো করে হাসল পলাশ, “আয়, মালগুলো ছাড়িয়ে আনি। কাকার কেইসটা নিয়ে খুব ঝামেলায় আছি। তোকে দরকার।ʼʼ

জয় চুপ ছিল। পলাশ জানে, জয় কচুর পাতা। হাজার টন পানি ঢাললেও ভিজবে না। চতুরতার ঊর্ধ্বে চলে সে। পলাশ বলল, “আমি যদি ক্ষমা করে দেই তোকে? আমি তোর ক্ষতি করেছি, তুই আমার। কাটাকাটি। আমার তোকে দরকার। তোর আমাকে..ʼʼ

জয় হাসল, “আপনাকে আমার কোনো দরকার নেই, তা জানেন আপনি। জয় আমির হ্যাজ রানস অন হিজ ওউন ডিস্টিনিক্ট স্ট্রেন্থ। আর না সে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। এত নাটক করবেন না আমার সাথে। ঘুরতে যাই না বহুদিন। এই ফাঁকে ঘুরতে আসছি। এর বেশি কিছু না।ʼʼ

জয় জানতো না, পরিস্থিতি এমন হবে। সে বাড়িতে যে কড়া পাহারা বসিয়েছে, তার ওপর হামজা ভাই তো জেলাতেই থাকছে। হামজাও বলল, “গিয়ে, ঘুরে আয় একবার। বিট্রে হলেও আছি আমি সামলাতে।ʼʼ


অন্তূ থাকলে পলাশ ও মাজহার হয়ত তার হাতে বলি হয়ে যেত আজ। পরিস্থিতি ঠিক তরুকে একলা করে ছেড়ে দিয়েছিল সেদিন দুজন রাক্ষসের হাতে। দূর্বল তরু, মানসিকভাবেও দূর্বল। পেরে ওঠেনি।

তরুর ওড়না খুলে একপ্রান্ত ছিঁড়ে সেটা তরুর মুখে গুঁজে দিয়েছিল পলাশ। গোঙানির আওয়াজটুকুও বের হয়নি গলা থেকে। মাজহারকে তরুর দিকে ঠেলে দিয়ে সে সোফায় বসল, যেমনটা নাটকের দর্শকেরা মঞ্চের সম্মুখে বসে। তরুর চোখের কাতরতায় পলাশ নিজের সবকিছু হারানোর যন্ত্রণার একটু একটু মূল্য ফেরত পেয়েছে। যা সে জয়ের বউয়ের সাথে করতে পারেনি, সেই অতৃপ্ততাটুকুও পূরণ করেছে। অন্তূকে জয় ছাড়িয়ে এনেছিল তাকে অপমান করে, সেই শোধটুকুও শোষন করে নিলো।

এরপর গেল সে তরুর শেষ সময়ে। বিশাল পাটোয়ারী বাড়ির মাঝ-মেঝেতে নরক নেমেছিল সেদিন। তরুর ছিন্নভিন্ন দেহটা বেহুশ পড়ে আছে তখন। প্যান্টের চেইন লাগিয়ে তৃপ্ত মুখে পলাশের পাশে এসে ধপ করে বসল মাজহার। পলাশ পিঠ চাপড়ে হাসল, নীরবে সাব্বাসী জানালো মাজহারের পুরুষত্বকে।

অজ্ঞান তরুকে তোলা দরকার। এমনিতেই মুখে কাপড় গোঁজা থাকায় চিৎকার শোনা যাচ্ছিল না। পলাশ খুব অসন্তুষ্ট তাতে। আবার যদি বেহুশ থাকে, হলো? পানি ছেটালো মুখে। শরীরে হাত দেয়া যাচ্ছিল না। জ্বরে চিরচির করে পুড়ছে যেন ছোট্ট, নাজুক দেহটা।

তরুর শ্বাসের গতি তখন খুব ধীর। চোখ খুলতে পারছিল না ঠিকমতো। চোখ বুজে খুব ধীরে শ্বাস টেনে নেবার চেষ্টা করেছিল। শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঁচড়-খামছিতে চামড়া খসে গেছে। চোখের কোণা দিয়ে টসটসে গরম নোনাজ্বল টুপ টুপ করে কয়েক ফোটা মেঝেতে পড়ল। তরু পলাশকে চোখের ইশারায় সাবধান করার চেষ্টা করল, ‘জয় আমির তোকে ছাড়বেনা রে। একটু চিন্তা কর। আমি তোর ভালোর জন্য বলছি। শোন, একটু সময় দে আমায়! ওই লোকটাকে কথা দিয়েছি আমি—ফিরলে সুজির হালুয়া বের করে দেব। এই শেষ কর্তব্যটুকু করতে দে। ওর আর কেউ নেই রে। আমি না দিলে কেউ দেবে না। খাবেও না আর…বড় বেপরোয়া, বেখেয়ালি লোক সে। একটু সময় দে….ʼ

শেষ মুহুর্তে তরু হেসেছিল। জয় ঝুঁকে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। গলার শিকলের মতো দেখতে চেইনটার লকেটে ঝুলন্ত লেটারটা তরুর শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। তরু অনুভব করল। জয় কি কাঁদছে? তরুর যন্ত্রণায় বুঝি! ছিঃ! একটুও ভালো লাগছিল না দেখতে জয়কে। জয় আমিরকে হাস্যরত সুন্দর দেখায়। ওই কঠিন অবয়বের মুখে মলিনতা একটুও সাজে না। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু-রসিক হাসি আর চটা ভ্রুর নিচে পড়া গভীর চোখদুটোয় জীবনের ক্লান্তির সংমিশ্রণ বড় মানায়।

তরু শেষবার দেখল তার জয়কে। জয় চেয়ে আছে। আরেকজনের কথা তরুর মনে পড়ছিল। উকিল আরমিণকে দেখা হলো না তরুর। ও থাকলে কি এমন হতো ওর সাথে? হামজা ভাইয়ের মুখটা ভেসে উঠেছিল। গম্ভীর, বিশালাকায় দাড়ি-গোফের মুখটায় একরাশ শ্যামলা মায়া।

তরু আস্তে করে চোখ বুজল। খুব শান্তি লাগছে। জীবনের অবসানে এত সুখ! হবে না? জীবন তো অতি নিষ্ঠুর। তার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়া তো সুখেরই! তবু বুকে কলিজা ছেঁড়া যন্ত্রণা! মায়ার টান বলে না এটাকে? তাই তো! কিন্তু কীসের মায়া? দুনিয়ার? নাকি কয়েকটা পরিচিত মুখের। একটা আস্ত ছন্নছাড়া জয় আমিরের মায়া নয় এটা! এ তো এক চঞ্চল, অদ্ভুতুরে পুরুষের মায়া! যার পারফিউমের কৌটাটাও তরু এগিয়েছে! ধুর! কালোজিরে বেটে খাওয়াবে কে জয় আমিরকে? আর কাজুবাদামের পাত্রটাই বা বেড-সাইড টেবিলের ওপর নিঃশব্দে রেখে আসবে কে?


অন্তূ আর বাড়িতে গেছিল না। সোজা পাটোয়ারী বাড়ির দিকে রওনা হলো। তরুর জ্বর। এতক্ষণে জয় আমির বেরিয়ে গেছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই একা। অসুখে মরবে তবু মুখ ফুটে বলবে না কিছু।

বাড়ির সামনে রিক্সা থামতেই ওয়ার্কশপের ছেলেদুটো দ্রুত এগিয়ে এসে সালাম দিলো, “আসসালামুআলাইকুম, ভাবী।ঠিক আছেন?ʼʼ

ভাড়া মিটিয়ে রিক্সা বিদায় করল দুজন। অন্তূ বলল, “ওয়ালাইকুমুসসালাম। কী ব্যাপার! আর সব কোথায় গেছে? এভাবে বাড়ি ফাঁকা রেখে কোথায় গেছে ওরা?ʼʼ

দুজন কাচুমাচু হয়ে গেল। অন্তূর এ পর্যবেক্ষক দৃষ্টিকে ওরা ভয় পায়, ঠিক জয়ের মতোই।

-“আসলে ভাবী…ʼʼ

-“এত হেজিটেশনের কী আছে? বাড়ি ফাঁকা রেখে এভাবে বেরিয়ে গেছে। চারদিকের অবস্থা তো জানেন! কখন কী হয়! তাছাড়া আপনাদের বড়ভাইয়েরা জানলে বিপদ আপনাদের।ʼʼ

-“আগুন লাগছে, ভাবী!ʼʼ কোনোমতো বলল একজন।

ভ্রু কুঁচকে ফেলল অন্তূ, “কোথায়?ʼʼ

-“ক্লাবঘরে। ওরা ওইখানেই…ʼʼ

অন্তূর গা শিউরে উঠল। মুহুর্ত দেরি না করে পা ঝারা মেরে মুহুর্তের মাঝে ফটক পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌঁড়াল।

দোতলার সদর দরজা খোলা দেখে সেদিন অন্তূর অন্তরাত্মা থরথরিয়ে উঠেছিল অজানা আশঙ্কাতে। অন্তূই প্রথম পেয়েছিল তরুর ছেঁড়া দেহটাকে। বিমূঢ় হয়ে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল দেয়াল চেপে ধরে।

তরুর দু-পায়ের মাঝ দিয়ে র^ক্তের ধারা নেমেছে, ঠিক যেমন গর্ভপাত হলে হয়। শরীরে র^ক্তের সাথে লেপ্টে থাকা খণ্ড খণ্ড জামাটায় অসংখ্য ব্লেডের কাটা। ঠিক তেমনই শরীরটা ব্লেডের আঘাতে কাচাকাচা করা হয়েছে। অন্তূ কুড়িয়ে কুড়িয়ে সেদিন তিনটা গোটা ও দুই টুকরো ভাঙা র^ক্তমাখা ব্লেড পেয়েছিল। যেগুলো তরুকে নরকযন্ত্রণা দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।

তখনও পুরো বাড়িটা কবরের মতো অন্ধকার। প্রতিটা জানালা দরজা বন্ধ। এখানে মানুষকে হাজার টুকরো করলেও আওয়াজ বাইরে যাবার নয়। তরু শুয়ে আছে। এখন তার আর কোনো যন্ত্রণা নেই। শুকনো রক্ত ও যন্ত্রণাগুলো শুষে নিয়ে দেহটা পরম আরামে শায়িত এখন। অন্তূ নিজের দেহ থেকে ওড়নাটা খুলে আস্তে করে তরুর নগ্ন দেহটার চাপা দিলো। হাতদুটো শক লাগা রোগীর মতো থরথর করে কাঁপছিল।

অন্তূর কান্না আর আত্ম-চিৎকারগুলো আর বাইরে আসেনি। সে বহুআগেই শব্দ করে কাঁদতে না ভুললে সেদিন তার কান্নায় আকাশের ভিত বুঝি কেঁপেই উঠতো!

মুমতাহিণার কথা মনে পড়ছিল। সেই ভার্সিটির মাঠ! শীতের সেই সকালে হামজা আর জয়ের বিশাল অবহেলা নিয়ে লোক দেখানো বসে থাকা। কালপ্রিট সেই পলাশই, ভিক্টিম সেই এক ধর্ষিতার ছিন্নভিন্ন লাশই! শুধু সময় বাজি পাল্টেছে। উপরওয়ালা বুঝি ভোলেন না কিছুই! এই বাড়িতেই ছোট্ট মুমতাহিণার দেহটাকে হুমায়ুন ও পলাশ মিলে খুবলে খেয়েছিল। দিন ফেরে তো! তুলনামূলক ভয়ানক হয়েই ফেরে। শুধু সময়ের আবর্তন। কিন্তু সময়ের ফেরাটায় ইনসাফ থাকেনা। একটুও না। কার পাপ কার ওপর দিয়ে এমন ভয়ানক হয়ে বয়ে যায়! তরুর অপরাধ কি শুধুই পাপীদের আশ্রয়ে আশ্রিতা হওয়া ছিল? এই অপরাধের এত চমকপ্রদ মাশুল! এটা না-ইনসাফি নয়! অন্তূ ওপরের দিকে চেয়ে অভিযোগ করে ওঠে মালিকের কাছে।

উঠে আস্তে আস্তে হেঁটে রুমে যায়। জয় আমিরের ছবিতে রুমের দেয়ার ভর্তি। সেদিকে তাকিয়ে একটা ওড়না গায়ে জড়িয়ে বাড়ির ফোন দিয়ে প্রথমবার হামজাকে কল করল, “মেয়রসাহেব! পাপ ফিরেছে, মেয়রসাহেব! তরুর ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। আসবেন একবার? আসুন বরং বাড়িতে একবার। পাপ দেখবেন।ʼʼ

তুলির কান্নার আওয়াজে বাড়ির ইটগুলোতে কাঁপন ধরে যাচ্ছিল সেদিন। এই ছোট্ট তরুকে সে ছোটবেলায় চুল ধরে কত মেরেছে কথা না শুনতে চাইলে, আবার ওই পুঁচকে মেয়েটাকে ছাড়া একা শুতেই পারতো না ঘরে। আজ থেকে
কী করে একা থাকবে ওই ঘরে! মেয়েকে সামলাবে কে? চিৎকার করে কাঁদছিল তুলি।

রিমি পাগলের মতো ফুপাচ্ছিল মেঝের এককোণে গুটিসুটি মেরে বসে। বারবার হেঁচকি উঠছিল। হামজা শক্ত করে ধরে রইল ওকে। হামজার বুকে মাথা লুকিয়ে চাপা কান্নায় গুঙরে উঠল মেয়েটা। পাগলের মতো গোঙাচ্ছিল। হামজা দু’হাতের বাহুবন্ধনে রিমিকে শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে রইল। ভয় পাচ্ছে রিমি। চোখই খুলছে না ভয়ে। হামজা শান্ত চোখে চেয়ে রইল সদর দরজার দিকে। পুলিশ আসবে, এ নিয়ে তার ভাবনা নেই। ওই পাগল আসবে। তারপর কী হবে? তরুর মায়ার মানুষ ঢুকবে এখনই।

জয় এলো। খুব ধীরে হেঁটে গিয়ে তরুর লাশের পাশে দাঁড়াল। আরমিণের ওড়না দিয়ে ঢাকা তরুর দেহটা। ওড়নাটা রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। রক্তের রঙটা বড় প্রিয় জয়ের। আজ ভালো লাগছিল না। চোখে শূলের মতো বিঁধছিল।

অন্তূ চুপ করে তরুর গা ঘেঁষে, তরুর হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে। জয় আস্তে করে হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে। অনেকক্ষণ সময় ধরে চেয়ে থাকে তরুর বোজা চোখদুটোর দিকে। আলতো হাসে।

অন্তূ শিউরে ওঠে সেই হাসিতে। এত ভৌতিক সেই হাসি! জয় পারে! কঠোর এক ভৌতিক হাসির মালিক সে। সেই হাসিতে কী থাকে, তা বলা মুশকিল। তবু আনমনে কীভাবে যেন হাসতে পারে এই লোক।

চোখের শিরা-উপশিরা রক্তিম লাল। সচ্ছ পানির দানা ভাসছিল। সেই চোখ মেলে চেয়ে জয় শুধুই হেসেছিল নিঃশব্দে। তরুর মুখের ওপর অল্প ঝুঁকে পড়ে বলেছিল, “তুই জয় আমিরকে ক্ষমা করিস না, তরু। তবু…. তবে সে মরেনি এখনও।ʼʼ

নিজের বাঁ হাতটা তুলে যখন তরুর তপ্ত কপালটা ছুঁলো, হাতের ধাতব রুপালি রিস্টলেটটা তরুর বন্ধ চোখের পাতায় বিছিয়ে পড়ে। জয় আরেকটু ঝুঁকে মুচকি হেসে ফিসিফিস করে বলেছিল, “আমি এখনও বেঁচে আছি। তোর কবরের ডানে-বাঁয়ে মাজহার আর পলাশের ধড়হীন মাথা দুটো দাফন করব আমি।…..কথা দিলাম। তবু ক্ষমা করিস না আমায়। একটুও না কিন্তু, খবরদার!ʼʼ

সেদিন কেউ দেখতে পায়নি—জয় আমিরের বাম গাল বেয়ে নেমে যাওয়া একফোঁটা নোনাপানি ঠোঁটের বিভাজনে গিয়ে মিশেছে।
ওভাবেই জয় আমির মেঝের দিকে ঝুঁকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে গিয়ে ফ্রিজ খুলে কনটেইনার-বক্সটা বের করে সুজির মিষ্টিদুটো একগালে ঢুকিয়ে খুব তৃপ্তিসহকারে চিবিয়ে গিলল। সে কম করে খেতে পারেনা। এই বড় বড় লোকমায় খাবার খাওয়া তরু কত্ত আবেশ নিয়ে দেখতো!

ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে জগ উপুড় করে ধরে ঢকঢক করে লিটারখানেক পানি খেল জয়। সে খুব রিল্যাক্স! আরাম করে গামছা টেনে নিয়ে মুখ মুছল। এরপর পায়ের টাখনুর ওপর প্যান্ট গোটাতে গোটাতে ঝুঁকে হেঁটে বেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরে। কত কাজ এখন! পুলিশ আসবে। ইন্টেরোগেট করবে। লোকজনের ভিড় জমবে। খবর বেরোবে…অনেক কাজ!

চলবে…

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]