অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
598

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫৫.

মিস ক্যাথারিন সংসারত্যাগী, ধর্মভীরু ও নরম মনের সরল নারী। এসব হিংস্রতাকে খুব সহজে নিতে পারছিলেন না। একটু একটু করে বুঝতে পারছিলেন, তার সম্মুখে বসে থাকা নারীটি এমন শামুকি-খোলসে আবদ্ধ কেন? কী কী দেখে এই সময়ে এসেছে মাহেজাবিন, তা মেলাতে মেলাতে খেয়াল করলেন, মাহেজাবিন আনমনা হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞেস করলেন, “কী ভাবছো?ʼʼ

মাহেজাবিন চোখ তুলে তাকাল, “মাদাম, আপনি সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন না, আমার অনুশোচনা আছে কিনা? সেদিন হয়েছিল। আজ অবধি পিছু ছাড়েনি তা।ʼʼ

-“তরুর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছো?ʼʼ

-“দায়ী তো আমিই।ʼʼ

-“নেভার, মাই চাইল্ড!ʼʼ

মাহেজাবিন মলিন হাসে, “পলাশ আমার ক্ষোভটা ওই নিষ্পাপ, নিরীহ মেয়েটার ওপর ঝেরেছে। জয় আমির অনেকবার প্রোটেক্ট করেছে আমায়। তাই পলাশ আমার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। আর তার সবটাই পরোক্ষভাবে তরু সঁয়েছে। সেদিন না আমি পলাশের ডেরায় যেতাম, না শেষ অবধি জয় আমিরের সাহায্য দরকার হতো, আর না তার জের ধরে এতগুলো দিন পর ওই নাজুক মেয়েটা..ʼʼ

-“ইটস ইওর মিস-কন্সেপশন, গার্ল! তুমি তরুর জন্য অতিরিক্ত ট্রমাটাইজ হয়েছ, যে কারণে নিজেকে অপরাধী ভেবে খানিকটা বোঝা কমাতে চাইছো। আমি শুধু ভাবছি, জয় আমির কী করেছিল এর পেক্ষিতে!ʼʼ

মাহেজাবিন ক্ষীণ হাসল, “তার কাছে আশা করছেন কিছু? আপনি কি অধর্ম করতে চান, মাদাম?ʼʼ

মাদাম মুচকি হেসে ফেললেন, “আশা তো তুমিও করেছ! ওর ওপর আশা না করা যায় নাকি?ʼʼ

মাহেজাবিন ভ্রু কুঁচকাল, “আপনি কি বশীভূত হয়ে পড়ছেন সেই খল-লোকটির দ্বারা, মাদাম?ʼʼ

মিস ক্যাথারিন চুপচাপ চেয়ে থেকে কেবল মুচকি হেসে বললেন, “অধর্ম? না না, অধর্ম কেন বলছো? জয় আমিরকে এক শব্দে বর্ণনা করবার সাধ্যি আমার নেই। তথাপি সামথিং হ্যাজ ডিস্টিনিক্ট ফিচার ইন হিম, না? ক্যান ইউ ইগনোর দ্যাট? হি ইজ নট জাস্ট আ সিনার, বাট অলসো সামথিং মোর।ʼʼ

-“ইউ ক্যান’নট এভোয়েড হিজ ওফেন্স অলসো, মাদাম।ʼʼ

-“নন দ্য লেস!ʼʼ

-“হোয়াট!ʼʼ

মিস ক্যাথারিন তাকিয়ে রইলেন। মৃদুহাস্য চেহারা উনার। সরল-শুদ্ধ চাহনি।

তরুর লাশ নিয়ে যাবার পর অন্তূ সোফাতে বসেছিল। মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে তখন। তরুর মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। অন্তূ চুপচাপ বসে রইল। তার চোখে পানি নেই। কিন্তু মস্তিষ্কের পীড়ায় নিঃশ্বাস গ্রহণও অসহ্য হয়ে উঠেছিল। চোখের স্মৃতি অন্তূকে কঠিন ভোগান্তিতে ফেলছিল।

পোস্ট-মর্টাম করতে দেয়নি জয়। যে যে পুলিশ বোঝাতে এসেছে, তাদের বাপ-মা একাকার করে বকে দিয়েছে। শেষে থানার ওসি এলেন। বললেন, “দেখো, আইনকে তাদের কাজ করতে দাও।ʼʼ

জয় শান্ত স্বরে বলল, “আপনার আইনরে বহু আগে থাপায়ে রাখছি, স্যার। আমার কাছে আইনের কথা না বললেই না? আমরা যদি বিচার না চাই? আমাদের কোনো অভিযোগ নাই। ও ধোনের কেইস ফাইল হইছে, হইছে। আর হাজারটা ফাইলের মতো ওইটাও জমা রাখেনগা। থানার আলমারিগুলো কীসের জন্য?ʼʼ

এরপরের কথা কাটাকাটির কাজটা হামজা করেছে। নয়ত একটা তাণ্ডব শুরু হয়ে যেত। জয়ের ভাষায় দোষ আছে। সে পোস্ট-মর্টাম তো দূর, কোনও তদন্তই করতে চায়না। রিপোর্ট অবধি লেখাতে রাজী নয়। পুলিশ তো আর তা শুনবেনা। আর কিছু না করুক, আনুষ্ঠানিকতা দেখাতে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর জুড়ি মেলা ভার।

কবরে তরুর দেহ নামিয়ে যখন একমুঠো মাটি তুলে জয় তরুর ক্ষত-বিক্ষত মুখটার ওপর ফেলল, তা ঝরঝর করে পড়ল তরু বিচ্ছিন্ন দেহটার ওপর। জয়ের মনে হলো, এটা মাটি নয়, তরুর মায়ার মাঝে এক অন্তরায়, যা লাল ফুল, মাটি হয়ে ঝরছে। এই অন্তরালের পিছে তরু লুকিয়ে পড়ছে চির আরামে, স্বার্থপরের মতো। জয়ের রাগ হলো। সবাই স্বার্থপর! উফফ! কেন কেন? জয় কেন স্বার্থপর ছাড়া কাউকে পায়নি এই জনমে?

তার মায়ার মানুষ কেউ নেই কেন? কেউ কেন জয়কে কখনও মায়াভরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেনি, ‘খা বাপ। এই খাবারটা তোর পছন্দ, তোর জন্য বানিয়েছি!ʼ তরু বলতো, সে আজ চলে যাচ্ছে। কেউ বলেনি, ‘ও জয়! এত আঘাত কোত্থেকে পেয়েছিস? আর বাইরে যাবিনা খবরদার! এবার থেকে মারপিট করতে গেলে ঠ্যাং নুলা করে ঘরে বসিয়ে রাখব।ʼ
অনেক রাতে বাড়ি ফিরলে, কারও ভয় ছিল না। যে কেউ হয়ত, গম্ভীর স্বরে বলবে, ‘জয়, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? জয়ের মা, তোমার ছেলের চালচলন না বদলালে বলে দিলাম, আমার বাড়িতে ওই জানোয়ারের জায়গা হবেনা।ʼ

তরু বলতো, আস্তে আস্তে বলতো, ‘এসব না করলেই না? কাল থেকে কোথাও বের হবেন না। এই আঘাত না শুকানো অবধি কোথাও গেলে..ʼ
জয় জিজ্ঞেস করতো, ‘গেলে কী? তুই পুঁচকে আমার কী করবি রে?ʼ
তরু অভিমান আর ভয়ে চুপসে যেত। তবু চোখে কাতরতা। ওই চোখ বলতে চায়, ‘প্লিজ যাবেন না। আমার কষ্ট হয়। আপনি জানেন না, এইসব ঘা দেখে গিয়ে সারারাত ফুপড়ে কাঁদি আমি। আমার সহ্য হয়না আপনার ব্যথা! মারপিট করবেন না আর। এত শত্রু পয়দা করবেন না। ঠিকমতো নিজের খেয়াল রাখবেন।ʼ

জয়ের গোসলের গামছাটা, খাবারের প্লেটটা, নোংরা শার্টটা ধুয়ে দেয়া, জ্বরে পোড়া কপালটা টিপে দেয়া, তাতে সযত্নে জলপট্টি দেবার মায়ার নারীটাকে শেষবার দেখল জয়। আরামে শুয়ে আছে মেয়েটা। আর কোনো কষ্ট নেই ওর। আর জয়ের বিরহ সইতে হবেনা তরুকে, সারাদিন অক্লান্ত কাজ করতে হবেনা। জয়ের ফরমায়েশ খাটার দিন বুঝি ফুরোলো তরুর! জয় আর ধমকে ডেকে বলবে না, “এই! প্যান্টটা ধুয়ে দিসনি কেন? এখন কার বালডা পরে বাইরে যাব আমি?ʼʼ

সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে কত আরামে শুয়ে পড়ছে দেখো! জয়ের কপালের শিরা ফুলে উঠল ক্ষোভে! চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, “স্বার্থপর, বান্দির বাচ্চা! চলে যাচ্ছিস? এই! তাকা! ভয় ভয় চোখে তাকা একবার। আমার দেখ চোখ লাল হয়ে আসছে। গলায় কিছু দলা হয়ে আছে। সত্যি বলছি, মাল খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকব, আর বাড়ি ফিরব না কিন্তু। শেষবার বলছি, তাকাবি কিনা বল! আস্তে করে বল, মন খারাপ আপনার? বল বল বল। আমার সহ্য ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করিস না তরু। আমি কাঁচা। হেরে যাব এই চ্যালেঞ্জে! তরু….আমার কেউ নেই। আমার ধমক শোনার কেউ নেই, বাড়িতে মাছ রান্না হলে আমায় আলাদা করে ডাবল ডিমের অমলেপ বানিয়ে এনে পাতে দেবার কেউ নেই তুই ছাড়া। আমি মাছ খেতে পারিনা। ডিমের অমলেট কে বানাবে আমার?ʼʼ

কবরস্থান থেকে ফেরার পথে জয়ের মনে একটা খটকা লাগল। সে আজ তরুর মুখে মাটি ফেলতে গিয়ে যে আহাজারিটা করে এলো, এটা যেন আগেও কোথাও ঠিক একইভাবে হয়েছে। কেউ একজন এভাবেই করেছে! চোখের সামনে একটা মুখ ভেসে উঠল। কান্নারত এক নারীর মুখ। হাসপাতালের মেঝেতে বসা। চোখদুটো ঝাপসা থাকায় টের পাচ্ছিল না প্রথমে। পরে স্পষ্ট হলো—আরমিণ কাঁদছে, আমজাদ সাহেব শুয়ে আছেন। জয় দূরে দাঁড়ানো ছিল সেদিন। দেখেছিল আরমিণকে কাঁদতে।


ইশার আজানের সময় কবরস্থান থেকে ফিরল পুরুষেরা। হামজা এসে বসল অন্তূর পাশে, একটু দূরে। মেঝের দিকে ঝুঁকে বসে দু হাতে মুখ কপাল চেপে ধরে বসে রইল। তরুর মা বুক চাপড়ে কাঁদছিল তখন। অন্তূ ঠিক হামজার মতোই হাঁটুর ওপর ঝুঁকে বসল।

দুজন তখন পাশাপাশি বসা। একই ভঙ্গিতে। হামজা চিন্তিত, অন্তূ চাপা ক্ষোভ ও ঘৃণায় ভারাক্রান্ত।

অন্তূ খুব স্থির, শান্ত স্বরে বলতে শুরু করল, “পাপের আগুন সর্বপ্রথম তার জন্মদাতাকে ভষ্ম করে, মেয়র সাহেব। আপনাদের পাপ আপনাদেরকে জ্বালিয়ে কাঠকয়লার ছাইয়ে পরিণত করবে। মুমতাহিণাও ঠিক এভাবেই তরুর মতো ছটফট করেছিল, আপনারা এগিয়ে যাননি পলাশের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে। প্রতিশোধ! কোনো কারণে ওর ভাইদের ওপর প্রতিশোধে এত নিচে নামা যায় যদি, যে ছোট্ট মেয়ে রেহাই না পায়। তরুই বা কেন পাবে! সেও তো পাপ করেছে, আপনাদের আশ্রয়ে থেকে বড় পাপ করেছে মেয়েটা। শাহানা পাটোয়ারীর স্বামী যখন জানোয়ারের মতো খাবলে খেতে যেত মেয়েটাকে, তিনি হয়ত দ্বারে বসে পাহারা দিতেন স্বামীকে?ʼʼ

জয় এসে বসেছিল তখন সোফার অপর পাশে। চুপচাপ দুই ভাই শুনল শুধু অন্তূর ধিক্কার, “আমার সম্মান, বাপ, ভাই, আমার বিধবা ভাবি, তার জন্মের আগে হওয়া অনাথ অনাগত সন্তান…কার কার দীর্ঘশ্বাস থেকে বাঁচবেন আপনারা? যে জয় আমির আমার সম্মানকে মানুষের মুখের থুতুর ফেলার সমগ্রীতে পরিণত করেছিল, আজ আপনার বাড়ির দুটো মেয়ে সত্যি সত্যি ভ্রষ্টা। আমি তো দূর্বল, যা-ই করেছি, তা বোকামি হয়েছে। অথচ উপরে যিনি খেলেন, সেই মহান সত্ত্বার ঘুটির চাল বড্ড নিখুঁত হয়। তিনি ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না। আর তিনি ফিরিয়ে দিলে সীমাহীন দুর্ভোগ দেন।

কত মায়ের বুক খালি করা ধন আপনার কুটুরিতে খিদের জ্বালায়, পানির পিপাসায়, প্রাণের আকুতি নিয়ে ছটফট করে। তাদের যন্ত্রণা আর কাতরতার ভার বইতে পারবেন তো? সবে শুরু। এখনও সময় আছে, ফিরে আসুন। আপনার তো পরিবার নেই। তবু যে মানুষগুলোকে নিয়ে একটা পরিবারের মতো গড়েছিলেন, তারা একে একে সব বিদায় হচ্ছে নৃসংশভাবে। তারা কোথায় এখন? নরকের আগুনে বসে আপনাদের অপেক্ষা করছে না? তৈরি হন সেই মহাক্ষণের জন্য। তবে আফশোস কী জানেন? আপনাদের পাপের দাম এক জনমদুখী নিষ্পাপ মেয়ে পরিশোধ করে গেল খানিকটা। রবের বিচার কেন যে এমন হয়, বুঝিনা তাঁর খেলার চাল।ʼʼ

অন্তূ কাঁদেনি। বুকের আগুনে কাঁপছিল শরীরটা, সেই সাথে কম্পিত ঝংকার তোলা গলার আওয়াজ! হামজা-জয় কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি। চুপচাপ বসে শুনেছিল দুই ভাই।


তরুর লাশ দাফন হয়েছিল বাদ মাগরিব। সকল আনুষ্ঠানিকতা, ইনভেস্টিগেটর, লোকাল পুলিশ, মানুষের ভিড়—ইত্যাদি সামলে পাটোয়ারী বাড়ি খালি হলো টানা আট-দশঘন্টা বাদে রাত দশটার দিকে।

জয় রুমে এলো সাড়ে এগারোটার দিকে। অন্তূ তখন বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসা। দৃষ্টি ছাদের দিকে। জয় ওয়্যারড্রোব, আলমারি, খাটের নিচ, বাথরুমের ফেইক-ছাদ তামাম ঘরে কিছু খুঁজে হন্য হলো। জয়কে দেখতে তখন মন্ত্রপুত পুতুলের মতো লাগছিল। যেন কেউ মন্ত্র দিয়ে বশ করে অথবা চাবি ঘুরিয়ে ছেড়ি দিয়েছে, জয় সেই ঘোরে পাগলের মতো কিছু খুঁজছে।

ঠুকঠাক আওয়াজ বাড়ছিল। জয় উদ্ভ্রান্তের মতো কিছু খুঁজে চলেছে। অন্তূ বলল, “কী খুঁজছেন? ঘর উলোট-পালোট না করে বলুন আমায়। কী হয়েছে?ʼʼ

জয় একবার ফিরে তাকিয়ে আবার খোঁজায় মনোযোগ দিয়ে বলল, “ঘরওয়ালি, আমার চাপ্পর পাচ্ছিনা। কোথাও সরাইছো নাকি? কই রাখছি, মনে পড়তেছে না।ʼʼ খুব ক্লান্ত আর কঠিন তার কণ্ঠস্বর।

অন্তূ অবশ পায়ে উঠে দাঁড়ায়। জয় তখন ড্রয়ার খুলে দুটো ছোট-বড় ড্যাগার বের করল। শার্টের প্রান্ত উচিয়ে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কোমড়ে লুঙ্গির গিঁট শক্ত করল। ড্যাগারদুটোর চকচকে মাথা সাদা লুঙ্গির থানে ঘঁষে মুছে তা গুঁজল কোমড়ে। একটা ছোট্ট স্ক্রু ড্রাইভার, এক প্যাকেট ব্লেড, দুটো দিয়াশলাই ইত্যাদি শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রাখল।

অন্তূ এগিয়ে গিয়ে আলমারীর নিচের চেম্বার খুলে একটা কাপড়ের পুঁটলি বের করে। এটা অন্তূর সেই ওড়না। ওড়নাটা সে পেয়েছিল কয়েকদিন আগে। এর ভেতরে জয় নিজের একমাত্র বিশ্বস্ত সাথীটাকে যত্নে জড়িয়ে রেখে দিয়েছিল—নিজের ব্যবহৃত সেমি-অটোমেটিক নাইন এম-এম ক্যালিবারের পিস্তলটা। অন্তূ সেটার ভেতরেই জয়ের ব্যবহৃত আরেক প্রিয় অস্ত্র–চাপ্পরটা রেখে দিয়েছে। যা দিয়ে সাধারণত পশুর মাংস ছড়ানো হয়। জয় এটাকে কী কাজে ব্যবহার করে, তা তখনও জানা হয়নি।

সেটা বের করে অন্তূ নিজের ওড়না দিয়ে অস্ত্রটার ধারালো প্রান্তটা সযত্নে মুছতে মুছতে এনে জয়ের হাতে তুলে দিলো, “এই নিন।ʼʼ

জয়ের মুখের অভিব্যক্তি দুর্বোধ্য। সেখানে কাঠিন্য আছে, সাথে আছে এক প্রকার ঘোর, পাগলাটে নেশা। অন্তূর দিকে তাকিয়ে রইল কেমন করে যেন। অন্তূ সেদিন অস্ত্রটা জয়ের হাতে যত্ন করে তুলে দিয়ে বলেছিল, “যান। পাগলা জানোয়ার বধ করতে যাচ্ছেন, জয় আমির। জয়ী হয়ে ফিরুন। আমি অপেক্ষায় থাকব আপনার বিজয়ের।ʼʼ

জয় চাপ্পরটা দুই ঠ্যাঙের মাঝে চেপে ধরে লাল গামছাটা তুলে গলায় পেঁচালো। এক হাতে চাপ্পর ধরে অপর হাতে অন্তূর চুলগুলো আলতো হাতে মুঠো করে ধরে কপালে একটা কঠিন-ভেজা চুমু খেল। লাল গামছাটা মুখে মুখোশের মতো করে পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে বেরিয়ে গেল চুপচাপ রুম থেকে।


পরাগকে সেদিন অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো রাজন আজগরের বাড়িতেই মানুষ হয়েছেন, তাই না?ʼʼ

পরাগ ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল, “দাসীর ছেলের আর মানুষ হওয়া কী, ম্যাডাম? রাজন আজগরের বউ চলে গেছিল মুখে লাত্থি মেরে। রাজন আজগর শুদ্ধ পুরুষ নয়। তার দ্বিতীয় বিয়ের দরকার নেই। আর সেক্ষেত্রে জায়েজ একটা পুত্রসন্তান হবার সুযোগও ছিল না, যে তার উত্তরসূরী হতে পারে।ʼʼ

অন্তূ বুঝল, তবু বলল, “আপনি তো ছিলেন। উত্তরসূরী আপনি হতে কেন পারেন না? তার ঔরসেই জন্ম আপনার। সে চরিত্রহীন তাই আপনার মাকে বিয়ে করেনি…ʼʼ

-“আপনি এত অজ্ঞ তো নন, ম্যাডাম। শোনেননি, রাজারা দাসীর সাথে নষ্টামি তো করতো ঠিকই, কিন্তু সেইসব সন্তানেরা দাস হয়েই রয়ে যেত। সিংহাসনের ভাগ কিন্তু বিয়ে করা রাণীর সন্তানদেরই। হাজার হোক পলাশ রাজনেরই ভাইয়ে ছেলে, ওরই রক্ত। আর আমি দাসীর গর্ভের জারজ সন্তান। আমি দাস হয়ে রয়ে গেলাম পলাশের।ʼʼ

-“আব্বুর স্কুলে পড়তেন আপনি। পড়ালেখা কে করালো?ʼʼ

“এ কারবার সামলাতে অথবা সহকারী হিসেবে থাকতে পড়ালেখার মেলা দরকার ম্যাডাম। আমাকে পড়ালেখা করানো হলো। আমার মা রূপকথা আর পলাশকে মানুষ করল নিজের সন্তানের মতো, কিন্তু সেসবের ভিড়ে আমার জন্যই তার সময় থাকতো না। আমি তার আশেপাশে ঘেঁষার সুযোগই পেতাম না। পলাশের গেলামকে পালা হচ্ছিল ওই বাড়িতে। পলাশ যখন কারবারে হাত দেবে, বড় হয়ে আমি তার দাসবৃত্তি খাটবো, এই তো।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ শুনছিল। পরাগ মলিন হাসল, “অথচ জানেন ম্যাডাম, আমি রূপকথাকে বোনের মতোই ভালোবাসতাম। ছোট থেকেই। কিন্তু রাজকন্যা আর দাসীর ছেলে কি কখনও ভাই-বোন হতে পারে। যত বড় হতে থাকলাম, পদে পদে টের পেলাম—আমার মা একটা দাসী সাথে পতিতাও, আর আমি দাস। কলেজ পাশ করার পর ভার্সিটিতে ভর্তি হবার আগে সুন্দর একটা ঘটনা ঘটল। পলাশ জীবনে খুন আর ধর্ষণ কত করেছে, সে হিসেবে আমার কাছে নেই। তবে সেইবার সে এক প্রভাবশালীর বউকে তুলে এনে ছিঁড়েছুটে খেয়েছিল। ওই কেইসটা আর লুকাতে পারা যাচ্ছিল না। তখন কী করল জানেন?ʼʼ

অন্তূ বলে উঠল, “তার দায় আপনাকে দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হলো।ʼʼ

পরাগ জোরে জোরে হাততালি মেরে পাগলের মতো হেসে উঠল, “উফফফ! ম্যাডাম, আপনি যা ব্রিলিয়ান্ট না! আই লাইক ইউ সো মাচ।ʼʼ

অন্তূ মুচকি হেসেছিল, “ভার্সিটিতে আর ভর্তি হওয়া হলো না আপনার?ʼʼ

-“আইনের খাতায় লাল দাগ পড়ে গেল আমার নামের। তারপর আর কী করে? অথচ আমার ইন্টারের রেজাল্ট কিন্তু ম্যাডাম সেই ভালো ছিল। ভালো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স হতে পারতো।ʼʼ

-“কত বছর জেলে ছিলেন?ʼʼ

-“আড়াই বছরের মতোন। তারপর জামিন করা হলো। ততদিনে আমার ক্যারিয়ার শেষ। ওপপস! শালা, গোলামের আবার ক্যারিয়ার। ধ্যাৎ!ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ চেয়ে দেখল পরাগের মিথ্যা হাসির আড়ালে থাকা মলিন মুখখানা। পরে বলল, “আপনাকে যখন একজন মৃত মানুষের জায়গা নিতে বলা হলো, আপনি রাজী হয়ে গেলেন অভিনয় করতে?ʼʼ

শব্দ করে হেসে উঠল পরাগ, “যেখানে পলাশের খুন আর ধর্ষণের দায়ে চুপচাপ জেল খাটতে পেরেছি, পড়ালেখা বরবাদ করতে পেরেছি, দেদারসে ওর হুকুমে মানূষ খুন করতে পেরেছি, এ আর কী? তাছাড়া আমি আর মা ওদের পারিবারিক দাস। কতকিছু করেছি ওদের জন্য, এই সামান্য অভিনয়টুকু কী এমন?ʼʼ

অন্তূ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “তবে যাই বলুন, আপনার কথাবার্তা এবং চালচলনে কিন্তু আপনাকে মোটেও মাত্র ইন্টারপাশ লাগেনা। বেশ উন্নত একটা ব্যক্তিত্ব আছে আপনার, কাজে লাগাতে পারেন। একজন ভালো মানুষ হতে পারেন।ʼʼ

-“প্রশংসা করলেন? উফফ, জীবন ধন্য এই পরাগের। ক্ষমা করতে পারেন আপনি আমায়?ʼʼ

অন্তূ যেন শেষ কথাটা এড়িয়ে গেল। তাতেই বোঝা গেল, তার দৃঢ়তা। ক্ষমা! এই শব্দটাকেই অন্তূ এড়িয়ে চলে। সে নিজের আপন ভাইকে ক্ষমা করেনি আজ অবধি, পরাগকে কেন করবে? প্রশ্নই ওঠেনা। তা বুঝে পরাগ হাসল মাথা নিচু করে। সেদিন সে এগিয়ে যায়নি পলাশের হাত থেকে এক রমনীকে বাঁচাতে। জয় আমির দান মেরে দিয়েছে। তার হাত-পা দাসত্বের বেড়িতে বাঁধা না থাকে কি সে যেত? আর এই চমৎকার বুদ্ধিমতি মেয়েটিকে জিতে নিতে পারতো? কে জানে!

অন্তূ সব এড়িয়ে কেবল বলল, “চলে যান এসব ছেঁড়েছুড়ে।

-“খেলা শেষ না করে না।

অন্তূ ভ্রু কুঁচকাল, “খেলা?ʼʼ

পরাগ কূটিল হাসল, “পলাশের দাসবৃত্তি আর নয়, ম্যাডাম। একে একে গুড়িয়ে চুরচুর করে দেব আজগর প্রোপার্টিজের কারবার। এরপর নিরুদ্দেশ হবো চিরকালের জন্য। শেষ দেখা হলো আজ ধরুন আপনার সাথে।ʼʼ

অন্তূ একটু অবাক হয়েছিল, “আপনি কি জয় আমিরকে সহায়তা করেছেন?ʼʼ

-“না করার কী আছে? আমি পলাশের ঘরের শত্রু বিভীষণ। আমি ম্যাডাম অত খারাপ নই। মা চিরকাল দাসীগিরি করে এসেছে, রক্তে তা ছিল আমার। তাই বহুবছর দাস খেটেছি। কিন্তু পড়ালেখা করতে গিয়ে, সমাজের সাধারণ স্তরের ভালো মানুষদের সাথে মিশতে গিয়ে বিবেকের ঢাকনা একটু একটু করে খুলে যেত। আমি দেখতে পারতাম না পলাশ আর ওর চাচার এসব কুকর্ম, ওর আদেশ মানতে গিয়ে যেসব করতে হতো, তা করতেও বিবেকের দংশনে পড়তাম। এজন্যই তো দুবছরের জেলটা খাটালো আরও। আর না, ম্যাডাম। শেষ পাপটা করলাম এবার। বিশ্বাসঘাতকতা। মাফ না পাই। কিছু মানুষ বেঁচে যাচ পলাশের হাত থেকে। এতে যেটুকু পূণ্য হবে, চলবে।ʼʼ

অন্তূ বুঝেছিল, জয় আমির ও হামজাই নয় শুধু, আরও একজন পলাশের পেছনে লেগেছে এবার। কিন্তু জয় আমির শুধুই নিজেকে ধরা দিচ্ছে পলাশের কাছে। লোকটার কি জানের মায়া নেই? পরাগকে পলাশের সামনে সে আনেনি এই ঘটনায়, তা যেন অন্তূ নিশ্চিত। কারণ জয় আমির পাপের দায় নিতে খুব পছন্দ করে। পাগল-মাতাল লোক। কেউ একটু সহায়তা করলে তার জন্য জান হাজির। এইসব লোক ধ্বংস হয় খুব খারাপ ভাবে। তা জয় নিজেও জানে, তবু কোনো সতর্কতা নেই?

অন্তূ শেষে আন্দাজে আরেকটা ঢিল ছুঁড়েছিল, “আপনাকে কেউ একজন সহায়তা করেছে, সে কে?ʼʼ

পরাগ হেসেছিল শুধু। অন্তূ বলেছিল, “রূপকথা আজগর নামের কেউ নাকি?ʼʼ

অন্তূর রসিকতায় পরাগের হাসি চওড়া হয়েছিল। অনেকক্ষণ অন্তূর দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে বলেছিল, “আপনি আমার কোথাও একটা সুঁচালো ধাক্কা মেরেছিলেন ম্যাডাম। যেই ধাক্কা সামলে উঠতে চেয়েছি। আজ এই মুহুর্তে আবার নড়বড়ে লাগছে নিজেকে।

তখনই অন্তূ উঠে দাঁড়িয়েছিল এই পর্যায়ে, “অথচ আমি বিবাহিতা, মি. পরাগ। এ ধরণের কথা বলাও অসঙ্গত আমার সঙ্গে।ʼʼ

-“জানি ম্যাডাম। আর আপনার এই ব্যক্তিত্বই পুরুষের মরণের কারণ। যে জয় আমিরকে এত কঠিন ঘেন্না আপনার। তবু তার অগোচরে নিজের চরিত্রের সঙ্গে আপোষ নয়। আপনি তাকে মানেন?ʼʼ

অন্তূ গম্ভীর স্বরে শুধু বলেছিল, “আমি সেই বিয়ের খোৎবা ও তিন কবুলকে মানি কেবল। আর কিছু নয়। আসি আমি আজ।ʼʼ

অন্তূ উঠে দরজার দিকে যায়। পরাগ তবু অপলক চেয়ে ছিল। বুকটা চিনচিন করছে। সে জানে এই নারী আর ফিরে তাকাবেনা। তবু চেহারাটা দেখার লোভ সংবরণ করা বড় দুঃসাধ্য। পরাগ জোর করে বসে রইল। সংযমের বাঁধটাকে শক্ত করে বসে রইল। এগিয়ে গেল না। নারীটিকে বেরিয়ে যেতে দিলো। বুক চিড়ে যাচ্ছ। এই ক্ষত ভরাট হয়ে যাবে। তবে এই মুহুর্তে বড় ভোগান্তিতে ফেলছে। এটা তো বিরহ নয়, প্রবাহ। পরাগ হেসেছিল। অন্তূ বেরিয়ে এলে জোরে জোরে শব্দ করে হেসেছিল।


রাত সাড়ে চারটার দিকে জয় ফিরেছিল সে রাতে। ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে দূর মসজিদ থেকে। ঘোর অবরুদ্ধ রাত। আকাশে চাঁদ নেই। চাঁদটা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে সে রাতে বোধহয় জয় আমিরকে সুযোগ দিয়েছিল লহু রঙে হাত রাঙাবার খেলায় মত্ত হতে। সেই ভোররাতে র^ক্তে শরীর ধুয়ে সদর দরজা পেরিয়ে ঢুকল জয় আমির। আলত আঁধারির সদরঘরটায় তার ছিপছিপে কঠিন অবয়বের পেটানো লুঙ্গি পরিহিত দেহটার লম্বা ছায়া পড়ল।

সদর দরজার এপারে এগিয়ে দেয়াল ঘেঁষে র^ক্তাক্ত চাপ্পরটা থপ করে ফেলল। ধাতব অস্ত্রের ঝনঝনানিতে চমক উঠল অন্তূ। চাপ্পরটা মেঝেতে পড়ার সাথে সাথে চাপ্পরের গায়ে লেগে থাকা রক্ত ছিটিয়ে পড়ল মেঝের সাদা টাইলসের ওপর।

অন্তূ শান্ত পায়ে বেরিয়ে এল রুম থেকে। জয় আমির ফিরেছে। শিকার না করে ফেরেনি, দৃঢ় বিশ্বাস অন্তূর। সে জানে জয় আমির শিকার করায় ওস্তাদ। ঠিক যেভাবে চায়, পরিস্থিতি সেভাবেই প্রবাহিত হয়, তার অনুকূলে। এটা জয় আমিরের সতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অথবা জৌলুস-অর্জন।

হামজা বসে আছে তখনও সোফাতেই। তার অপেক্ষার অবসান হলো। শান্ত নজর মেলে তাকিয়ে দেখল বিদ্ধস্ত জয়কে। মুখে একপ্রকার তৃপ্তি। খুঁটিয়ে দেখল, জয়ের শরীরে আঘাত আছে কিনা! বোঝা যাচ্ছে না। তবু হামজা জানে, জয় শিকারে গেলে আঘাতপ্রাপ্ত হয়না। সে যতবার আঘআতপ্রাপ্ত হয়েছে, নিজে সারেন্ডার করে যেচে পড়ে মার খেয়েছে, তবু আইনের কর্মকর্তাদের কাছে নতি স্বীকার করেনি। যা মুখে এসেছে, বকে গেছে। উত্তর দেবার সময় একবারও চিন্তা করার অভ্যাস নেই, পরিণতি হবে। সামনে কে, কী হতে পারে তার সাথে। সেসবের ধার না ধারায় জীবনে আঘাতের কমতি অন্তত নেই দেহে।

এই গুণটা জয়ের বউয়ের মাঝে আছে। সব হারাতে রাজী তবু ভিত নড়তে দেয়া যাবেনা।

হামজা আস্তে করে বলল, “গোসল করে আয় এখানে। চোট পেয়েছিস কোথাও?ʼʼ

কথা বলল না জয়। কপালে মাটি। চোখদুটো শান্ত, স্থির। ঘড়ি দেখল সে চোখ তুলে। হাতের চটের বস্তাটা হাত থেকে ফেলে দিলো। এখনও বস্তার নিচ দিয়ে ঘন লাল তরল চুইয়ে চুইয়ে দু-এক বিন্দু মেঝেতে পড়ছে।

সাদা ধবধবে লুঙ্গিখানা র^ক্তে ধুয়ে উঠেছে। মুখে বাঁধা গামছাটা তখন মুখ থেকে নামানো, গলায় ঝুলছে। মুখ, গলা, হাতের কনুই অবধি র^ক্তের ছিঁটা। তার ওপর কাঁচা মাটির আস্তরণ। লুঙ্গিতে মাটি ভরা। গলার লাল টকটকে গামছাতেও মাটি, ঘাম, র^ক্ত। হাতের কব্জি অবধি মাটিতে ঢাকা। নখের ভেতর মাটি। খুবলে মাটি খুঁড়েছে বোধহয়।রক্তের সাথে মাটি মিশে একাকার পুরো শরীরটা। চাপ্পরের ধারালো দিকটায় শুকনো রক্তের ওপর এখনও অল্প-সল্প আধজমাট বাঁধা রক্ত। পায়ের চামড়ার স্যান্ডেলটা বস্তাতে বোধহয়। খালি পায়ের গোড়ালির ওপর অবধি মাটি। সেই মাটিতেও তাজা র^ক্ত মিশে আছে।

সেই মাটি পায়ের তালু থেকে ঝরে মেঝেতে ছড়াতে ছড়াতে রুমে ঢুকল। গামছা দিয়ে আরেকবার ঘাম ও র-ক্তে একাকার মুখটা মুছে গোসলে ঢুকল।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫৬.

গোসল করে কোমড়ে গামছা পেঁচিয়ে বের হলো জয়। পা থেকে হাঁটু অবধি পশমে আবৃত। খোলা বুকে পশমে ঢাকা। টপটপ করে পানি পড়ছে চুল থেকে। চুল মুছতে পারেনা ঠিকমতো জয়। পানি তার শরীরে লেগে থাকা মাটি ও রক্ত ধুয়ে নিয়ে চলে গেছে, নিতে পারেনি মুখের কাঠিন্য। তার ওপর বিভৎস সেই গায়ে কাঁটা দেয়া দাগগুলো। চোখদুটো লাল, তাতে বুঝি এখনও রক্তের নেশা!

অন্তূর মনে প্রশ্ন জাগে, খুন করলে কি পুরুষদের গোসল করতে হয়? যতবার জয় মরপিট করে ফিরেছে, যত রাতই হোক গোসল করতে দেখেছে। আজ নাহয় মাটি ছিল, আগেও দেখেছে গোসল করতে।

তখনও শরীরটাও প্রায় ভেজা। কোনোমতো শুধু গামছা পেঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। আচমকা এক অ-কাজ করল। অন্তূর বুক থেকে একটানে ওড়নাটা ছিনিয়ে নিয়ে গলায় পেঁচালো। গামছা ধরণের কিছু গলায় থাকলে সেটা বড় তৃপ্তিদায়ক লাগে তার। শরীর ঘামে প্রচুর। তার ওসর ছোটবেলার অভ্যাস—গলায় কিছু না রাখলে চলেনা যেন। সেই ওড়না দিয়ে ঘাঁড় এদিক-ওদিক কাত করে ভেজা শরীরটা মুছে লুঙ্গি পরলো।

হামজা রুমে ঢুকল। রিমি শুয়ে আছে। শরীরটা ভেঙে পড়েছে মেয়েটার। হামজা কপালে হাত রাখল। ঠোঁট, নাক লাল হয়ে আছে, মুখটা ফোলা ফোলা। অতিরিক্ত কান্না করেছে, ভয় পেয়েছে। জয় যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল হামজার সাথে দেখা করে, দৌড়ে হামজার কাছে গেছিল।

সোফাতে বসা হামজা তখন। রিমি দৌড়ে গিয়ে স্বামীর পায়ের কাছে লুটিয়ে বসল। হাঁটুদুটো দু’হাতের বাহুতে জড়িয়ে লাল চিকচিকে চোখ মেলে জিজ্ঞেস করেছিল, “জয় ভাইয়া কোথায় যাচ্ছে, মেয়র সাহেব? মাজহার ভাইকে মারতে?ʼʼ

কঠোর বলিষ্ট হাতের মুঠোয় হামজা রিমির থুতনিটা আলতো করে ধরে আঙুল দিয়ে আদর করে বলেছিল, “তোমার আরাম করা দরকার। রুমে যাও। আমি আসছি।ʼʼ

রিমি যায়নি। স্বামীর হাঁটুতে আস্তে করে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে আঁচল বিছিয়ে পা মেলে দিয়ে পড়ে ছিল। হামজা রিমির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গভীর ভাবনায় মত্ত হয়েছিল। থেকে থেকে তুলির মেয়ের কান্না ভেসে আসছিল। তরু ছাড়া কোয়েলকে কেউ চুপ করাতে পারেনা। রিমি আরও হাতরে ধরল হামজাকে। যেন সে আশ্রয় চায়। কঠিন দেবদূতের মতো চেহারার ওই শক্ত-সামর্থ্য পাষাণ্ড পুরুষটির খুব কাছে রিমির ছোট্ট দেহ ও দূর্বল মনটা একটুখানি আশ্রয় চায়।

হামজা তখন উঠে রিমিকে কোলে তুলে নিলো। রিমি হু হু করে কেঁদে উঠে মুখ লুকায় স্বামীর বুকে। হামজা আর বোঝার চেষ্টা করল না, কেন কাঁদছে তার বউ। নারীকে বোঝার চেষ্টা করার অপচেষ্টা সে কখনোই করেনি। হামজার বিশ্বাস, নারীজাতকে বুঝতে চেষ্টা করলে এ জনম ফুরোবে, পুরুষ জন্মটা পুরোটা বৃথা পড়ে যাবে। নারীদের নিয়ে হামজার কোনোকালে বিশেষ জ্ঞানধারা নেই।

আস্তে করে এনে যখন রিমির কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো, রিমি তখনও গলা ছাড়েনি হামজার। হামজার ভারী পৌরুষ দেহটাকে অনেকক্ষণ ওভাবেই ফেলে রাখতে হয়েছিল রিমির শরীরটার ওপর। পরে একটু ঘুমিয়েছিল।

এখন আবারও কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে যখন সরে যাচ্ছিল, রিমি ধরল, অর্থাৎ সে জেগে উঠেছে। আস্তে আস্তে উঠে বসল হামজার বাহু আঁকড়ে ধরে। হামজাকে বসালো সামনে। হাতদুটো গুটিয়ে কোলের ওপর রেখে হামজার কাঁধে কপাল ঠেকালো। হামজা আস্তে করে ভারিক্কি গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে, বেগম?ʼʼ

রিমি ডুকরে ওঠে, কণ্ঠ কাঁপে মেয়েটার, “জয় ভাইয়া ফিরে এসেছে?ʼʼ

-“সাথে তোমার মাজহার ভাইয়ের দেহের বিভিন্ন খণ্ড এনেছে বোধহয়, দেখবে?ʼʼ

হামজার বরফশীতল কণ্ঠস্বর, তাতে রাজ্যের বর্বরতা যেন। রিমির কান্নারত দেহটা কেঁপে উঠল পুরুষটির নিঠুরতায়, তবু কেঁপে উঠে সেই পুরুষটিকেই আঁকড়ে চেপে ধরল খামছি দিয়ে। হামজা আবারও বিভ্রান্ত হয় নারীচরিত্রে। সে বোঝেনা এদের, কখনোই না, চেষ্টাও করেনা তাই। শুধু টের পেল, আজ মাজহারের ওপর পুরোনো স্মৃতির দমক আছে তার বউয়ের, তবু সাথে প্রশ্রয়ও আছে যে তারা মাজহারকে টুকরো টুকরো করে পশু দিয়ে খাওয়াতে পারে। রিমি তা কষ্ট ও সুখ দুটো মিশিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি সহকারে দেখবে। আপন লোকের অতি-পাপ মানুষকে অন্যরকম কষ্ট দেয়, তা ব্যাখ্যাতীত। সেখানে স্নেহের টান নয় বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা থাকে।

হামজা অনেকক্ষণ জড়িয়ে-চেপে ধরে বসে রইল রিমিকে। ছোট্ট শরীরটা কাঁপছে। ছটফট করছে হামজার বুকের ভেতর পড়ে। হামজা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কেমন লাগছে?ʼʼ

জড়িয়ে এলো রিমির কণ্ঠস্বর, “তরু…ʼʼ বলেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল হামজার অর্ধঘর্মাক্ত শক্ত শরীরটা। কয়েকটা খামছিও বসে গেল সেখানে। আরও আরও চেপে ধরতে চাইছে যেন, খামছিগুলো দিয়ে ক্ষোভ ও যন্ত্রণা লাঘবের চেষ্টা করে চলল। হামজা বাঁধা দিলো না, চুপচাপ চুলের ওপর হাত রেখে চেপে ধরে রইল নিজের সাথে। ফজরের আজান শেষ হয়ে গেছে। এখন আকাশ ফর্সা হয়ে উঠবে। হামজার ইচ্ছে করল, জয়কে সঙ্গে নিয়ে নামাজটা আদায় করে আসতে। সুযোগ নেই। কাজ আছে তার। বলল,

“ঘুমানোর চেষ্টা করো। সব ঠিক আছে, কিচ্ছু হয়নি। বড় বড় ঘটনার আগে এমন সব ছোট ছোট আভাস সইতে হয়। তাতে সহনশীলতা বাড়ে, রিমি। দেখো না, এডমেশন টেষ্টগুলো কত কঠিন মনে হয়! কেন কঠিন হয় বলো তো! কারণ, এডমিশন টেস্টের পর যে লেভেলটা, সেটা আরও বহুগুণ কঠিন। সেই এডমিশনের কাঠিন্য পাড়ি দিয়ে যে ক্যান্ডিডেটগুলো এগিয়ে যেতে পারে, ধরে নেয়া হয় এরা পরের ধাপের কাঠিন্য সইতে পারবে। নয়ত তো দেখতে যাকে-তাকেই ভালো কোথাও এডমিট নেয়া হতো। তা হয়না। বড় কিছুতে যোগদান করতে সেই সহনশীলতা চাই। এটুকুতে আমাদের ভাঙলে চলেনা, রিমি। আমি শিখিইনি তা। বয়স পনেরোতে থামিনি, তখনও এমন বহুত কিছু দেখেছি, তাই আজ এখানে। এখানে না থামলে আরও ওপরে। বুঝলে না তুমি! দরকার কী? সকাল হয়ে আসছে। ঘুমাও এখন। আমার কাজ আছে। জয় ডাকবে এখনই।ʼʼ

এত আদুরে গলায় এত হিংস্র সব কথা বলা যায়? এই প্রশ্নতেই আঁটকে থেকে রিমি দেখল তার স্বামী বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে। সে গুটিসুটি মেরে পড়ে রইল বিছনার সাথে। লোকটা কি তাকে অবহেলা করছে? এই ব্যস্ততা ফুরোবে কবে? এখন কি পারতো না রিমিকে জড়িয়ে নিতে একটু ঘুমিয়ে নিতে! আচ্ছা এই ব্যস্ততা কাটলেও কি রিমির পাশে শোবার জন্য ওই পাষাণ্ড পুরুষ থাকবে? রিমি আঁৎকে ওঠে। গলা শুকিয়ে আসে ওর। দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরতে ইচ্ছে হয় লোকটাকে। কিন্তু হাত-পা আঁটকে আছে বিছানার সাথে।

জয়ের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “ভাই? হামজা ভাই…ʼʼ


বড়ঘরে দিন-রাত নেই। ও জায়গা চিরকাল অন্ধকূপ। তৈরিটাই ওভাবে করে নিয়েছিল হামজা। তাতে কোনো জানালা নেই।

জয় হাতের চটের বস্তাটা মেঝেতে ঘঁষে ঘঁষে টেনে এনে রাখল। শরীর তখনও ভেজা। মুরসালীন বলল, “এখন গোসল করলি নাকি?ʼʼ

জয় একবার তাকিয়ে দেখে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল, “তোর ওযুর পানি চাই তো বল।ʼʼ

মুরসালীন বেশ ক্লান্ত স্বরে বলল, “তা তো চাই। শুধু আমার নয়, সবারই চাই। হাতটা খুলে দে। বাথরুমেও যেতে হবে।ʼʼ

জয় কঠিন মুখে উপহাস করে উঠল, “হ একটু ইবাদত বন্দেগী বেশি করে কর। টপকে যাবি যখন-তখন। পাপ-টাপের মাফ চেয়ে নে।ʼʼ

উপহাসের স্লান হাসি হাসল মুরসালীন মহান, “হ্যাঁ। তা তো চেয়ে নিতেই হবে। তোদের এইদিক দিয়ে খুব সুবিধা, জয়। তোদের পাপ-টাপ নেই জীবনে, সৃষ্টিকর্তার ইবাদত বা ক্ষমা চাওয়ার ঝামেলাও নেই…ʼʼ

তীব্র খোঁচা মারা কথাটা শেষ হলোনা মুরসালীনের। জয় এক খণ্ড লোহা তীব্র বেগে ছুঁড়ে মারল মুরসালীনের দিকে। তা লাগলে নির্ঘাত মাথাটা ফেটে এখনই খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো মুরসালীনের। কিন্তু আঘাতটা ফসকে গেল। আর সেটা জয়ের ইচ্ছেতেই বুঝি!

মুরসালীনের হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে এসে জয় ধাতু গলানোর চুল্লিতে গুঁড়ো চুনাপাথর ও কোক মেশালো। যখন চুল্লি জ্বললো, বড়ঘরের তাপমাত্রা প্রায় অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। ঘেমে আরেকবার গোসল করে উঠল জয় ও হামজা।

জয় চুল্লি জ্বালিয়ে কিছু গুড়ো লৌহ মেশাতে থাকল চুল্লিতে। হামজা চটের বস্তা উপুড় করে ঢালল। ঝরে পড়ল তাজা দুটো কাটা পা ও দুটো হাত। থকথকে হয়ে আছে শিরা-উপশিরা থেকে ঝরা কষানি ও জমাট বাঁধা রক্ত।এককোপে কেটে নিয়েছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এখনও হাতের আঙুলে মাজহারের ব্যবহৃত মেটে রঙা পাথরের আংটিটা আছে। বাচ্চারা ভয় পাচ্ছিল। মুরসালীন থামালো ওদের।

হামজার কোনো বিশেষ খেয়াল নেই আজ ওদের দিকে। সে চাপ্পর দিয়ে মাজহারের কাটা হাত-পা ছোট ছোট টুকরো করছে। হাড়গুলো ছড়ানোর সময় পাথর ব্যবহার করল। এরপর টুকরোগুলো ছুঁড়ে মারল এক এক করে জলন্ত চুল্লিতে।

এমনিতেই গলিত লোহার গন্ধ অসহনীয় হয়। জয়-হামজা দুজন খুব অভ্যস্ত। কিন্তু বাচ্চাগুলো অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। তার ওপর কাঁচা মানুষের মাংস, হাড় ইত্যাদি ঝলসে যেতে লাগল চুল্লিতে, অসহ্য দূর্গন্ধে বড়ঘরে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। মুরসালীন দেখল, জয় কিছু ঢালছে চুল্লিতে। হয়তা পেট্রোলিয়াম-কয়লা হবে।

বড়ঘরের ডানপাশে একটা ক্রুসেবল মেটাল-মেল্টিং মেশিন আছে। ওটা বোধহয় অচল। হামজা জিজ্ঞেস করল, “মাথাটা কোথায়?ʼʼ

-“পুঁতে রেখে এসেছি।ʼʼ

-“কবরস্থানে খাদেম ছিল?

-“বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।ʼʼ

-“টাকা দিতে হয়েছে?ʼʼ

জয় কথা বলল না। তার পুরো শরীরে ঝর্না বয়ে যাচ্ছে ঘামের। মুরসালীন নামাজ শেষ করে বসে দেখল দুই ভাইয়ের বর্বরতা চুপচাপ। মাজহারের মাথাটা কবর দিয়ে রেখে এসেছে, হাত-পা চারটা এখানে গলিয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলছে। অর্থাৎ কোথাও শুধু কোমড় থেকে গলা অবধি দেহখণ্ডটুকু ফেলে রেখে এসেছে। তা দেখে ওটা যে কার দেহখণ্ড তা শনাক্ত করাও মুশকিল।

মুরসালীনকে আবারও স্পটলাইটের নিচে বাঁধল জয়। মুরসালীন জিজ্ঞেস করল, “কাকে খণ্ড করে এলি? কী হয়েছে? কোনো পাপের পুরস্কার পেয়েছিপ নাকি আবার?ʼʼ

জয় মুরসালীনের দিকে কোমড় ঝুকিয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসল, “কলজেটা কচমচিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলব। কথাবার্তা মেপে বলবি।ʼʼ

মুরসালীন হাসল, “দাড়িপাল্লা কোথায়? আমার কথা মাপার আগে তোদের পাপ মাপতাম। কতটা পাপ জমা হলে বা তার প্রতিদান আসতে শুরু করে! তোদেরটা শুরু হয়েছে বোধহয়। অবশ্য শুধুই আন্দাজ আমার।ʼʼ

জয় ওর ডানহাত খোলা রেখে সামনে একটা মোড়া নিয়ে চেপে বসল। একটা কাগজ ও কলম এগিয়ে দিয়ে বলল, “একটা সুন্দর স্টেটমেন্ট দে তো, বাপ। বহুত জ্বালাচ্ছিস। এমনিতেই মন-মেজাজ ভালো না। যা বলছি, সেটা লেখ।ʼʼ

-“মন মেজাজের কী হয়েছে? বলবি তো।ʼʼ

-“যা বলছি, সেটা কর, মুরসালীন। কথা বলতে আগ্রহ পাচ্ছিনা।ʼʼ

মুরসালীন অটল পর্বতের ন্যায় মাথা নাড়ল, “এতই যদি সহজ হতো, তাহলে কি এতকিছু করতে হতো তোদের? এতদিনে পারলি না, আজ এমন কী হলো যে, সহজ ভাবছিস? আর কী বলতে বলছিস তোরা, যা আমি করিইনি। করলেও তা শুধুই প্রতিক্রিয়া। ক্রিয়া তোরা দেখিয়েছিলি শুরু থেকে। হাজার হাজার প্রাণ নিয়েছিস। সেসব অবিচারের এক ফোঁটা প্রতিক্রিয়ায় এত জ্বলন ধরেছে কেন তোদের? কিছুই করিনি আমরা। শুধু আল্লাহর নামে সয়ে যাচ্ছি।ʼʼ

-“করিসনি? শালা জঙ্গির দল। দেশদ্রোহী শালা তোরা। টুপি-দাড়ি গালে মাথায় ঝুলায়ে দেশের সাথে বেইমানি করে যাচ্ছিস যুগের পর যুগ।ʼʼ

-“কীসের বেইমানি, জয়? দেশটার অধঃপতনে কত আনা দায় আমাদের দিয়ে মিছেমিছি পাপমুক্তর অভিনয় করতে চাস তোরা? তোদের বিবেচনাবোধ খুলুক, আমিন।ʼʼ

হামজা শান্ত স্বরে বলল, “বেশি ঝটপটাচ্ছ, মুরসালীন। শান্ত হও।ʼʼ

-“নইলে কী করবেন?ʼʼ শান্তস্বরে বলল মুরসালীন, এরপর জয়ের দিকে ফিরল “তোদের বোঝাপড়া আমার সাথে। ওই বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দে। ওরা কিচ্ছু করেনি। তোদের শক্তি ক্ষমতার, আমাদেরটা দিলের। ভুলে যাসনা, প্রাণ নিয়ে যারা পালায় তাদের দৌড়ের গতি বেশি হয়। একবার ছেড়ে দিয়ে দেখ না! বেঁধে কেন রাখতে হয়, কারাগারে কেন দিতে হয়, রাতে আন্ধারে মেরে কেন ফেলতে হয়? রাজপথে সামনে আসার সৎ-সাহসটুকু বুকে নেই, তা জানিস তো তোরা। মিছেমিছি বাহাদুরী দেখাস না, ভাই। বিরক্ত লাগে।ʼʼ

জয় কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে কেবল শীতল স্বরে বলল, “স্টেটমেন্ট।ʼʼ

-“তুই শুধুই ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এসব করছিস, জয়। আর যেটা শুধুই ভুল বোঝাবুঝিতে সৃষ্টি হয়েছে তোর মাঝে।ʼʼ

জয় রোবটের মতো স্থির স্বরে কেবল উচ্চারণ করল শক্তমুখে, “স্টেটমেন্ট।ʼʼ

-“কীসের স্টেটমেন্ট?ʼʼ

-“দেশের সাথে গাদ্দারি করে আসছিস তোরা সেই পূর্ব পাকিস্তানের আমল থেকে। এখন আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেষ্টা করছিস দেশের ক্ষমতাকে উপড়ে ফেলে নিজেরা ক্ষমতায় বসতে। এসব লিখবি। কাকে কাকে মেরেছিস, আর কারা জিম্মি আছে তোদের কাছে, সেসবের হিসেব দিবি, সব স্বীকারক্তিমূলক একটা স্টেটমেন্ট চাই।ʼʼ জয়ের কণ্ঠ ফুঁড়ে আগুনের হল্কা ছুটছিল। আগুনটুকু গিলতে গিলতে যেন আবারও রিপিট করল কথাগুলো।ʼʼ

মুরসালীন শান্ত, স্থির কণ্ঠে বলল, “যে কথাগুলো বললি তার কোনো যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা বা প্রমাণ আছে তোর কাছে?ʼʼ

হামজা চুপচাপ বসে ছিল। এবার তাকাল চোখ তুলে। জয় বলল, “একটা স্টেটমেন্ট দে।ʼʼ

-“মিথ্যা স্বীকারক্তি দেব? কিন্তু কেন?ʼʼ

-“ওদের বাঁচাতে। তুই তো আমির ওদের, না? তোর সামনে মরবে, দেখতে ভালো লাগবে না তোর।ʼʼ

-“ওরা বাঁচবে না এতে।ʼʼ

জয় দাঁত খিঁচে উঠল, “জয় আমিরের কথার নড়চড় হয়না।ʼʼ

মূরসালীন মাছি তাড়ানোর মতো অবজ্ঞা করে বলল, “রাখ তোর জিকির। কথায় কথায় কী এত নিজের নাম জপিস মূর্খর মতো! নিজের ভেতরে কখনও ঝেঁকে দেখেছিস, কতবড় ফাঁপা ঢোল তুই? এক পর্বতসম হাহাকার নিয়ে শুধু দাপিয়ে বেড়াচ্ছিস ক্ষমতার দাপটে। আদতেও কি তোর বলতে কিছু আছে?ʼʼ

সজোরে একটা ঘুষি মারল জয় মুরসালীনের ক্ষত-বিক্ষত মুখটার ওপর। রক্ত বেরিয়ে এলো। মুরসালীন মলিন মুখে হাসল, “তুই ‘সত্যিʼ নিতে পারছিস না, জয়। তুই জানিস আমি ঠিক, তুই ভুল। তবু এই ক্ষমতার দাপট, আর অপশক্তির দ্বিধান্বিত লড়াই। পিছু হটে যা। পাপ করিস না আর। হামজা ভাইয়ের ক্ষমতার খিদে আছে। তোর তো তা নেই। শুধুই ব্যক্তিগত আক্রোশ। ছেড়ে দে এসব।ʼʼ

একটু থেমে মুরসালীন বলল, “খিদে বড় খারাপ জিনিস, জয়। জানিস তো ১৯৭২ এর আন্দেজ পর্বতে প্ল্যান ক্রাশের ঘটনায় ৭২ দিন যে যাত্রীগুলো বরফের পর্বতে আঁটকে ছিল, খিদে ওদের কী পর্যায়ে নিয়ে গেছিল? ওরা নিজেদের সহযাত্রীদের দেহের মাংস ছিঁড়ে খেয়ে বেঁচে ছিল। এ থেকে আন্দাজ করতে পারবি, খিদে কতটা ভয়াবহ রিপু। শুধু পেটের খিদেই নয়, জয়। মানুষের ষড়রিপুর মাঝে একটি এই লোভনীয়-খিদে। সেটা যেকোনো কিছুর খিদে হতে পারে। হোক ক্ষমতার। যা মানুষকে সর্বোচ্চ নিচে অবধি নিতে পারে। হামজা ভাই থামবে না। তুই কেন তার সঙ্গী ও সাক্ষী হচ্ছিস? তোর এ কী হাল হয়েছে, জয়? ….ʼʼ

-“তোর নীতির বাণী পকেটে রাখ, মুরসালীন। ভালোই মাইন্ড কন্ট্রোল করার ট্রিক্স শিখেছিস দেখছি, বাপ! রাজনীতি আর শিবির থুক্কু জঙ্গিবাদ ছেড়ে কি সাইকোলজি নিয়ে গবেষণা করছিস? বালের প্যাঁচাল ছাড়। রাজধানীতে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা জিম্মি আছে তোদের কাছে। তাদের খোঁজ দে। বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দেব।ʼʼ

মুরসালীন হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল, “তাহলে চল একটা সওদা করি।ʼʼ

জয় তাকিয়ে রইল। মুরসালীন বলল, “আমাদেরও অসংখ্য লোক তোদের কাছে বন্দি। যারা ধুঁকে ধুঁকে মরছে, আবার কতজন কারাবাসে যাচ্ছে, তাদের ছাড়িয়ে আন। আজ যা রাজধানীতে। তোর উপরমহলের কর্তাদের বল, ওদের ছেড়ে দিতে। দেশটাকে ক্ষমতার ক্ষুধা নিবারণের সুস্বাদু খাবার না বানিয়ে অন্তত কিছুটা ন্যায়নীতিতে বহাল রাখতে বল। দেশটা জঙ্গল, দেশের জনগণ জঙলি জানোয়ারে পরিণত হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ভালো লাগে এসব?ʼʼ

জয়কে সরিয়ে দিলো হামজা। ঠেলে বড়ঘর থেকে বের করে উপরে পাঠাতে চাইল, “যা। ঘরে যা। একটু ঘুমা।ʼʼ

জয় গেল না। চুপচাপ বসে রইল ইস্পাতের খণ্ডের ওপর। হামজা বসল মুরসালীনের সামনে।


তিনদিনের পর একটা কুলখানীর আয়োজন করা হলো পাটোয়ারী বাড়িতে। পুরো এরিয়ার লোকের নিমন্ত্রণ। হাজার হাজার লোক খাবে।

সকাল সকাল বাজারে গেছিল জয়। ভ্যান ভরে ভরে বাজার এলো। জয় ফিরল রিক্সাতে। তার বাইকের প্রতি কোনো মোহ ছিল না কখনও। যুবক বয়সেও কখনও বাইক নিয়ে অযথা ফুটেজ খেয়ে বেড়ানোর মতো কোনো প্রবণতা তার চরিত্রে দেখা যায়নি। একবার জয়কে এক নারী বলেছিল—’জয় আমির সাহেব, যে নদীর গভীরতা বেশি, তার বয়ে চলার আওয়াজ কম।ʼ

জয় মানে কথাটা। আর কখনও দেখা হয়নি নারীটির সঙ্গে তারপর। তবু জয় মানে, যার গভীরতা বেশি তার চলনে তর্জন-গর্জন থাকেনা। সেই নারী আরও বলেছিল—’রহস্য কোনটা জানেন? সেটা যে রহস্য, সেটাও এক প্রকার রহস্য, সেটাই রহস্য।ʼ

জয় বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘বালের কথা কইয়েন না। বুঝায়ে কন।ʼ

নারীটি ধারালো ঠোঁট কিঞ্চিৎ এলিয়ে হেসেছিল, ‘রহস্যকে আপনি দেখবেন, নাড়বেন, অনুভব করবেন, খুব কাছে থাকবেন। অথচ বুঝতে পারবেন না, ওটা এক রহস্যের দ্বার। সেটা হলো রহস্য। অর্থাৎ যা রহস্য, তা দেখে বোঝা যাবেনা সেটা রহস্য। রহস্যের রহস্যটাও এক প্রকার রহস্য।ʼ

এসব কেন মনে পড়ছিল আজ রিক্সায় চলাচলের সময়, জয় জানেনা। লোকের দিকে ওর খেয়াল নেই। তবু যে লোকে ঘটা করে ওকে সালাম ঠুকে যাচ্ছে, তা বুঝল। মনে মনে বকেও উঠল, তেলবাজ বাঙাল সম্প্রদায়! জয় রিক্সাওয়ালাকে বলল, “একটা শাবনূরের গান শুনবি?ʼʼ

উৎসাহে মাথা নাড়ে রিক্সাওয়ালা, হ ভাই, শুনি।

জয় গেয়ে উঠল, “যেই ডালে বান্ধি বাসা, ভাঙে সেই ডাল, আমার এমনই কপাল..ʼʼ

ফটকের সম্মুখে থেমে দেখল ছেলেরা বাজার নামিয়ে নিচ্ছে। সে রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে পেছনের ভ্যান থেকে খাঁচা নামালো। চারটে বিদেশী মাংসাশী কুকুর। সরু সরু ধারালো দাঁত সবসময় বেরিয়েই থাকে। ওরা ক্ষুধার্ত, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ছেলেরা চমকালো, “ভাই, এইডারে কী করবেন?ʼʼ

জয় হাসল, “জবাই করে গরুর মাংসের সাথে মেশাবো। অত হালাল মাংস কেনার ট্যাকা নাই।ʼʼ

সবাই তাকিতুকি করল। জয় আদেশে বিশাল খাঁচাটাকে নিয়ে গিয়ে ওয়ার্কশপের ওপারের ঘরে রাখা হলো। নির্দেশ রইল, কুকুরগুলোকে যেন এক ফোঁটা পানিও না দেয়া হয়।

রতন এগিয়ে এলো, “ভাই, একখান জরুরী কথা আছে।ʼʼ

-“ওমা! তাই নাকি? বল বল।ʼʼ

জয়ের রসিকতায় সবাই হাসল, রতন একটু মিইয়ে গেল। জয় বলল, “কী বলবি?ʼʼ

-“গতকাইল রাত্তিরে সাবেক মেয়র ঝন্টু সাহেবরে কেডা জানি খুব খারাপভাবে খু/ন করছে, ভাই।ʼʼ

জয় চমকে উঠল, “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ইশ! সকাল সকাল কী দুঃখের খবর শোনাইলি রে মফিজ! যাহোক, লোকটারে আল্লাহ বেহশতবাসী করুক। সবাই বলো, আমিন।ʼʼ

সবাই সমস্বরে স্লোগানের মতো করে বলে ওঠে, ‘আমিন।ʼ

শেষে আবার কেউ অভ্যসবশত মুখ ফসকে বলে ফেলল, “জয় বাংলা…ʼʼ

জয় ফিরে তাকালো। তারপর চট করে হেসে ফেলল। তা দেখে ছেলেদের যে কী খুশি! ওরা পরিস্থিতি বোঝেনা, ওরা খালি জানে, ওদের জয় ভাই হাসলে ওদের মুখ বেজার থাকার নয়। জয় হাত মুঠো করে বিপ্লবীদের মতো করে উচিয়ে ধরে বলল, “জয় বাংলা।ʼʼ

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পা টলছিল। জ্বর চলে এলো কেন হঠাৎ-ই, বুঝতে পারছিল না জয়। গতরাতে বাড়ি ফিরেছে রাত তিনটায়। এরপর ঘুম হয়নি ঠিকমতো। গা টলছে। জয়ের চোখের সামনে তরুর জ্বরে কুঁকড়ে যাওয়া মুখটা ভেসে ওঠে। বকে ওঠে মাথা ঝারা মেরে, “হের শালা! কীসব ধোন-বাল ভাবিস হে! রিল্যাক্স জয়। কিচ্ছু হয়নাই। অল টাইম, অল রাইট। কী বললাম বল তো?ʼʼ

জয় বিকেল অবধি পড়েছিল বিছানায় ওভাবেই। বেহুশের মতো লাগছিল দেখতে। অন্তূ কাজের ব্যস্ততার মাঝেও কয়েকবার ঘরে এলো। ওভাবে জয়কে পড়ে থাকতে দেখে বেশ লাগছিল। প্রতিবার আনমনে স্লান হাসল। নিঃশব্দে মনে মনে জয়কে ডেকে বলল, “নিজের ঘা সাড়ে ষোলো আনা, জয় আমির! পাপ সামনে এসে দাঁড়ানোতে নিজেকে খোদা দাবী করা ফেরাউনও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তেগফার করেছিল। আপনারা তো নির্বোধ-মূর্খ মানব, যারা মিথ্যা দাপটে লুটেপুটে বেড়াচ্ছেন!ʼʼ

বাচ্চাদের সকাল থেকে কিছু খেতে দেয়া হয়নি বোধহয়। অন্তূও জয়কেও বিকাল অবধি খেতে ডাকল না, সামান্য কিছু এনেও দিলো না। রিমি যখন হামজাকে খেতে দিচ্ছিল, অন্তূর ইচ্ছে হয়েছিল, খাবার প্লেটটা এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে সবটুকু খাবার কোনো পশুকে বিলিয়ে দিতে। পারেনি।

সে নিজেও খায়নি সকাল থেকে। খিদে মরে গেছে আজকাল। পানির পিপাসাও সারাদিনে বিশেষ একটা টের পায়না। কোনোমতো একবেলা সামান্য খেতে গেলেও গলায় খাবার আটকায় যেন।

মাগরিবের ওয়াক্তের খানিক আগে নিচে গিয়ে ছেলেদের দিয়ে দুধ আনালো। সন্ধ্যার দিকে একগ্লাস গরম দুধ নিয়ে এলো জয়ের জন্য। জয় চিৎ হয়ে শুয়ে কিউব মেলাচ্ছে আনমনেই। তা মিলছে কিনা সেদিকে খেয়াল নেই। খালি গায়ে এসির বাতাসে লোমকূপ শিউরে শিউরে উঠছে মাঝেমধ্যেই। জ্বরের তোপে চোখদুটো লাল। তা দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অন্তূ।

অন্তূর আজকাল শুধু চোখের সামনে ভেসে ওঠে মুমতাহিণার ছিন্নভিন্ন ছোট্ট দেহটা। অথচ সেভাবেই যখন এ বাড়ির মেয়ে তরু অত্যাচারিত হলো, তখন দুইভাইয়ের হত্যাযজ্ঞের আয়োজন অন্তূকে অবাক করে তুলছে ক্ষণে ক্ষণে। দুজনই মেয়ে, সমান তাদের শেষ-যন্ত্রণা। অথচ দুই ভাইয়ের প্রতিক্রিয়া কত ভিন্ন!

জয়ের শরীর টগবগ করে ফুটছে যেন। অন্তূ হাত ছুঁইয়ে চমকে উঠল। দুধের গ্লাস ধরল মুখের কাছে, জয় ছিটকে সরে গেল, “ধুর শালী। কী এইডা? তোরে আনতে বলছি এই জিনিস। এর চাইতে বিষ ভালো। সরা!ʼʼ

অন্তূ টগবগে গরম দুধের গ্লাসে ঝাঁকি মেরে তা জয়ের হাতে ফেলল। জয় ছিটকে ওঠে। অন্তূ বলল, “আমার সঙ্গে মুখের ভাষা সংযত রাখবেন। লোক যা-ই জানুক, আপনি তো জানেন, আমি রাস্তার মেয়ে না। এটুকু খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।ʼʼ

জয় কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে আলতো করে প্রসন্নচিত্তে হাসল, “হ। বমিটা তোর গা ভরে করি। এরপর অবেলায় একটা গোসল দিয়ে আয়। সরা বাল, দুধ আমি খাইনা।ʼʼ

অন্তূ বলল, “পছন্দ না?ʼʼ

-“জীবনে খাই নাই। থুহ। সরাও।ʼʼ

-“অল্প একটু নিন। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।ʼʼ

জয় ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে দেখে অন্তূ বলল, “বিষ-টিস নেই। নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। এভাবে মারার হলে শত রাত সুযোগ পেয়েছি।ʼʼ

জয় হেসে মাথা নাড়ল, “আমি খাইনা, দুধ। তুমি খেয়ে ফেলো।ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দুধটা ঠান্ডা করল। এরপর এগিয়ে এলো। জয়ের বাহুটা ধরে এগিয়ে আনতে গেলএ ইচ্ছাকৃত জয় এসে অন্তূর কাধের ওপর হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে পড়ে রইল। অন্তূ আপাতত কিছু বলল না।দুধের গ্লাসটা জোর করে মুখের কাছে ধরল, “খান এটুকু। জ্বরে তো গা পুড়ছে। খুব সুখ লাগছে তাতে?ʼʼ

দুধটুকু খেয়ে মিনিট পনেরো বাদে জয় ঘুমিয়ে পড়ল। হামজা বাড়িতে ছিল না।

অন্তূ চাবি নিয়ে চলে যায় বড়ঘরের দিকে। পিপাসার্ত শিশুগুলো অন্তূকে বড্ড জ্বালায়। ওদের খাওয়া না হলে তার গলা দিয়ে পানি নামেনা। জয় ঘন্টাকয়েকের আগে উঠবে না।

অন্তূর ভেতর থেকে কেউ ডেকে ওঠে, “তুই ধোঁকাবাজ হয়ে উঠেছিস! নয় কি?ʼʼ

অন্তূ প্রতিবাদ করে, ‘পাপের ত্রাসে পিষ্ট হয়ে মরা আত্মহত্যা হতো। এটা ধোঁকা নয়, হয়ত কৌশল। বেঁচে থাকার কৌশল, বাঁচিয়ে রাখার কৌশল।ʼ একটু চুপ থেকে ফের বলল, ‘হয়ত আমি খুব খারাপ হয়ে গেছি।ʼ তাচ্ছিল্য করে হাসে, ‘খারাপের রাজ্যে ভালোর প্রবেশ খারাপকে ভালো করেনি, ভালোকে খারাপ করেছে। এরই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হলো। নয় কি?ʼ

চলবে..

[সতর্কতা: সহিংসতা আছে পর্বটিতে]]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৫৭.

রাত নয়টার দিকে ঘুম ছাড়ল জয়ের। বাইরে মহিলাদের কোলাহল। আগামীদিন একটা বিরাট আয়োজন পাটোয়ারী বাড়িতে। রসুন-পেয়াজ কাটাকুটো এবং বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা চলছে।

অন্তূ ঘরে ঢুকল। বাচ্চাদের পানি খাইয়েছে, টুকটাক শুকনো খাবার দিয়েছে। কিন্তু কীভাবে ওদের বের করা যায়? চতুর দুর্বৃত্তের মতো দুই ভাইয়ের চোখ। তা ফাঁকি দেবার উপায় খুঁজে পায়নি সে।

ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার দিকে। জয় বরাবরের মতো উপুড় হয়ে শুয়েছিল। হাতে মোটা চুরুট। ধোঁয়ার দুর্গন্ধে ঘরজুড়ে। জয় জিজ্ঞেস করল, “দুধে কী মাল মিশিয়েছিলে, ঘরওয়ালী? মাথা ঝিমিঝিম করতেছে এখনও।ʼʼ

-“ক্লোজেপাম ড্রাগস। অল্প পরিমাণে দিয়েছি। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকুন, রেশ কেটে যাবে।ʼʼ

-“তোমার ভয় লাগল না কথাটা স্বীকার করতে?ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠেনা। আমি নিজের কৃতকর্ম যেকোনো পরিস্থিতিতে স্বীকার করে নিতে অভ্যস্ত, হোক সেটা ভালো অথবা খারাপ। দ্বিমুখীতা আগে একদমই ছিল না আমার মাঝে।ʼʼ

জয় সন্তুষ্ট হাসে। তাদের দুজনের মাঝে অসংখ্য বৈশিষ্ট্যগত মিল। তবু তারা পরস্পরের বিপরীতে রক্তপিপাসু একে-অপরের! এটা কি নিয়তি অথবা অন্যকিছু?

অপ্রকৃতস্থর মতো জোরে করে হেসে উঠল জয়, “দুশমনী হো তো এইসি। তোমার-আমার এই ইকুয়েশন দুনিয়ার ইতিহাসে প্রথম না? যেখানে সব বুঝেশুনে….ʼʼ

-“বলতে পারেন। আর এটাও অনস্বীকার্য, অতি মাত্রায় ঝানু আপনি। অথচ এতসব অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা কুপথে ব্যায় করে ফেললেন। সেক্ষেত্রে এখানে আমিও জানি আপনি জানেন, আপনিও জানেন তা আমি জানি। সেটা আমরা দুজনই জানি, আমি আপনি সেটাও জানি।ʼʼ

-“কথাটা কার মতো জানি বললে।ʼʼ

-“কার মতো?ʼʼ

জয় চুপ থেকে বলল, বড়ঘরে ছিলে কতক্ষণ?

দরকার যতক্ষণ। আপনি শুয়ে থাকুন, বাইরে কাজ আছে।

জড়ানো কণ্ঠে জয় গান ধরল,
‘সোহাগের দিলাম বেড়া, ঘরের চারিপাশে
মায়ার লাগাইলাম আড়া নিন্দার বাতাসে গো,
নিন্দারও বাতাসে…..
সাধেরও পিরিতের ঘর, হয়না যেন নড়বড়,
তাই ধৈর্য্যের রাখলাম একটু ঢাল…
ও মন-ওরে..
সুখেতে রব চিরকাল, ও মনহ ওরে সুখেতে রব চিরকাল..ʼ


গতরাত একটার দিকে হামজা ও জয় বের হলো বাড়ি থেকে। রাস্তাঘাট নিস্তব্ধ প্রায়। লোকজন না থাকলে বের হওয়াটা ভালো। নয়ত ঘিরে ধরে সবাই।

জয় চুপচাপ হাঁটছে, কথা বলছে না কোনো। হামজা পকেট থেকে ছোট্ট একটা হিপফ্ল্যাস্ক বের করে দুটো চুমুক দিলো। জয় বলল, “কী ব্যাপার, ভাউ? মাল খাচ্ছ কেন?ʼʼ

-“রোজ রোজ তোর হাতে মানুষ তুলে দিতে পারিনা।ʼʼ

-“আমি তোমার হাতে মানুষ তুলে দিতে পারি না। অভ্যাসের খেলাপ হবে। তুমি শুধু বাড়ির সামনে অবধি যাবে। ভেতরে যাব আমি।ʼʼ

-“তুই বাইরে থাকবি।ʼʼ

জয় ঘাড় নাড়ল, “উহু। খু-ন করার আগে যাদের মাল খেতে হয়, তাদের হাতে মানুষ তুলে দিতে পারিনা আমি। মানুষের রুহুর একটা ইজ্জত আছে, ও একটা মাতালের হাতে দেহ ছাড়বে কেন?ʼʼ

জয়ের কথায় হামজা হেসে ফেলে কোমড়ে একটা লাত্থি মারল। তাতে পা ফসকায় জয়ের। হামজা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তুলল না জয়কে। বলল, “ওঠ। উঠে দাঁড়া।ʼʼ

এভাবেই গড়েছে হামজা জয়কে। পড়ে গেলে টেনে তোলেনি কখনও। ছেড়ে দিয়েছে। এরপর বলেছে, ‘নিজ শক্তিতে উঠে দাঁড়া তো, জয়। কাম-অন। গেট-আপ। বি স্ট্রং ইন ইওর অউন স্ট্রেন্থ! ইউ অনলি নিড ইওরসেল্ফ, ফাকিং নো ওয়ান ইলস! ইভেন ইনক্লুডেড মি।ʼ

জয় রক্তাক্ত হাঁটু নিয়ে জেদে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বারবার পড়ে যেত, তবু শেষ অবধিও হামজা হাত বাড়ায়নি কখনও। জয় যখন নিজে উঠে দাঁড়িয়েছে, তখন জাপটে ধরেছে জয়কে, তার আগে নয়।

আজও তাই করল। অথচ আজ আর চেষ্টা একবারের বেশি নয়, এক ঝারাতে সোজা উঠে দাঁড়ায় জয় মেরুদণ্ড সোজা করে।

পোলের লাইট কোথাও কোথাও নষ্ট। সেসব জায়গা অন্ধকার, ফাঁকা রাস্তা। কুকুরগুলো জোট পাকিয়েছে। জয়কে অন্ধকারে দেখেও চিনতে ভুল হয়না ওদের। পিছু নিলো। ঠিক যেন সৈন্যবাহিনী দুই ভাইয়ের পিছে পিছে নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে চলেছে।

হামজা জিজ্ঞেস করল, “মাজহারের বডিটা কোথায় ফেলেছিস?ʼʼ

-“পুরোনো গোরস্থানের ধারে পঁচা পুকুরের পানিতে।ʼʼ

হামজা শান্ত চোখে চাইল, “অর্থাৎ আমার শ্বশুরবাড়ির লোক এখনও জানেই না যে, মাজহার উপরে পৌঁছে গেছে?ʼʼ
হামজার মুঠোতে পেঁচানো গামছাটা নিয়ে জয় মুখে জড়াতে জড়াতে বলল, “আশা করা যায়, বডি পঁচে পানির সাথে মিশে যাবে, তবু খবর পাবেনা। বডিই পাবেনা, খবর কেমনে?ʼʼ

-“তাছাড়া ওর বাপ জানে, তরুকে মেরে ও পলাশের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ড হয়েছে। খোঁজও করছে না। কাউকে করতেও দিচ্ছে না।ʼʼ

-“খোঁজ করতে বলার আগে সেও নিখোঁজ হয়ে যাবে, ভাউ। তোমার একটু দুঃখিত হওয়া উচিত। হাজার হোক, চাচা শ্বশুর।ʼʼ

হামজা দুঃখিত গলায় বলল, “দুঃখিতই তো আমি, খুব দুঃখিত। নিজ হাতে খাতির করতে পারছি না। এর চেয়ে বড় বড় দুঃখ কী হতে পারে? হাজার হোক চাচাশ্বশুর। উনার ভাইয়ের মেয়ে আমার বউ। আমার হাতে উনার রক্ত লাগবে, এটা অধর্ম হয়ে যাবে। অধর্ম আমার স্বভাবে নেই।ʼʼ

-“আমারও।ʼʼ জয় কথাটা উচ্চারণ করতেই দুইভাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। উন্মাদের মতো হাস দুজন। গায়ে কাঁটা দেয়া সেই নির্জন রাস্তায় ওদের অপ্রকৃতস্থ হাসির ঝনঝনে আওয়াজ ভৌতিক লাগল শুনতে।

মাজহারদের বাড়ির প্রাচীর দাঁড়িয়ে আছে একদম রাস্তার সাথে। পাশেরটা হামজার শ্বশুরবাড়ি। ওরা দুইভাই বাড়ির পেছনে গেল। জয় লুঙ্গিতে কাছা মেরে প্রাচীর টপকালো। হামজা পেছনের আশপাশ দেখে বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়াল। মাজহারদের বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। টের পেল না হামজা। দূরের পোল থেকে সামান্য আলো আসছে। সে ফাঁকা রাস্তায় পায়াচারী শুরু করল। চিন্তা হচ্ছে খুব জয়ের জন্য।

বাড়ির ভেতরে ঢোকার কোনো পথ খোলা নেই। জয় নিচে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে প্রতিটা জানালায় কয়েকটা করে ঢিল ছুঁড়ে মারল।

ঝন্টু সাহেব মাল খেয়ে মাতাল। তবু বকবক করতে করতে বেরিয়ে এলেন। জয় তখন বাড়ির পেছনের দিকের জানালায় ঢিল মারল। ঝন্টু সাহেব সেদিক গেলে জয় সামনের খোলা পথ দিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সোফাতে বসল আরাম করে। দোতলার সিড়ি প্যাঁচানো এ বাড়ির।

ঝন্টু সাহেব বকতে বকতে ফিরে এলেন কাউকে না পেয়ে। জয়কে দেখতেই পা ফসকে পড়ে যাবার মতো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লেন। জয় হাসল, “আরেহ কাকা! আস্তে-ধীরে আসেন। এই বয়সে দৌড়ঝাপ খারাপ।ʼʼ

ঝন্টু ঢোক গিললেন, “জয়, তুমি এত রাত্তিরে? কী ব্যাপার, কী হইছে?ʼʼ

-“রাতে ঘুম হয়না, কাকা। রোডে রোডে ঘুরি, আজ ঘুরতে ঘুরতে আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম আত্মীয় মানুষ আপনি, দেখা না করে গেলে রাগটাগ করবেন, মনে কষ্ট পাবেন। বসেন, দুটা দুক্কের কতা কই।ʼʼ

জয় আলো জ্বালায়নি। আধো অন্ধকার বসার ঘরটা। চোখদুটো লাল উনার। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মাথা টাল খাচ্ছে। তবু বসলেন। জয় সোফার ওপর থেকে ল্যাপটপ টেবিলে রেখে ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, “আনলক করেন, কাকা। মুভি-টুভি দেখি দুই চাচা-ভাতিজা বসে বসে। ভালো না আইডিয়াটা, কাকা?ʼʼ

ঝন্টু সাহেব বুঝতে পারছিলেন না কিছু, ভয়ে উনার দম পড়ছেনা ঠিকমতো। জয় একটা পেনডাইভ কানেক্ট করল ল্যাপটপে। এরপর একটা সুন্দর পজিশনে ল্যাপটপটা রেখে খুব আয়েশ করে বসল জয়। তার চোখে-মুখে যেন খুশি উপচে পড়ছে, ঠিক যেমন ছোট শিশুরা নতুন খেলনা পেলে উচ্ছ্বসিত হয়, তেমন!

ভিক্টিমের চোখে তীব্র ভয় না দেখলে জয় মারার জোশটা পায়না। ঝন্টু সাহেবের ঘেমে যাওয়া ছটফটে চেহারাটা দেখে যা শান্তি লাগছিল জয়ের, সেটুকু চোখ বুজে প্রসন্ন হেসে শোষন করল নিজের মাঝে সে। স্ক্রিনে ভিডিও চালু হয়ে গেছে—

মাটির ওপর একটা ইটের খণ্ড পড়ে ছিল। জয় সেটাকে তাকে রেখে মাজহারের মুখটা থুবরে ফেলল সেটার ওপর, যেমন বাস্কেটে বল ঢোকায় প্লেয়াররা। মুখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো মাজহারের। নির্জন একটা জঙলি জায়গা। দিনেও বোধহয় লোক যায়না। মাজহার রক্তাক্ত মুখ নিয়ে জয়ের দুটো পা আঁকড়ে ধরল, “মারিস না, আমায়। আমি কিছু করি নাই। পলাশ করছে যা করছে। আমি কিচ্ছু করি নাই।ʼʼ দরদর করে রক্ত পড়ছে মুখ দিয়ে।

জয় আরাম করে বসল সামনে মাজহারের। মুচকি হেসে নরম করে বলল, “ধুর! করলেই বা কী? দোষের তো কিছু না। ওভাবে বলছিস কেন, পাগল? স্বাভাবিক হ।ʼʼ

মাজহার বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইল। জয় কাধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করল,, “পলাশ কোথায় রে?ʼʼ

-“আমি জানিনা, জয়। বিশ্বাস কর।ʼʼ

-“করলাম। তবু আবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করতেছে, করি? পলাশ কোথায় রে, মাজহার?ʼʼ

শান্ত-শীতল মহান নমনীয়তা জয়ের মুখে। একটুও রাগ নেই ওখানে, আর না উগ্রতা, মুচকি হাসছে ঠোঁটদুটো, চোখে কী যেন! মাজহারের মনে হচ্ছিল, জয়ের সামনে পছন্দের খাবার রাখা হয়েছে, সেটা খাওয়ার আগে মানুষ যেমন খুশি খুশি থাকে, জয়ের মুখভঙ্গিটা ওরকম। বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল, বলল, “তাহলে ছেড়ে দিবি আমায়?ʼʼ

-“হ্যাঁ, ওর খোঁজ দেয়ামাত্র মুক্ত করে দেব।ʼʼ

মাজহার পলাশের সম্ভাব্য ঠিকানাটা বলল কোনোমতো।

ভিডিওর এ পর্যায়ে জয় হাততালি দিয়ে উঠল, “চমৎকার ভিডিওগ্রাফি না কাকা? কবিরের করা। ছেলেটা এত ভালো ক্যামেরাম্যান? ওর এক বোতল ব্রান্ডি পাওনা রইল আমার কাছে। আপনার ভালো লাগছে কাকা ভিডিওটা? হে হে! বাচ্চাদের মতো পা দুলিয়ে হাতে তালি দিলো জয়।ʼʼ

ঝন্টু সাহেব কখন জানি সোফা থেকে গড়িয়ে বসে জয়ের পা দুটো চেপে ধরবে। জয় তাড়া দিলো, “ধ্যাৎ, মনোযোগ দেন কাকা ভিডিওতে। আপনার জন্য আবার পেছাতে হবে ভিডিও।ʼʼ

ঝন্টু সাহেব তাকাতে চাচ্ছিলেন না। ছেলেকে এক জ্যান্ত রক্তখেঁকো পিশাচের সামনে দেখতে বাবাদের ভালো লাগে না। জয় উঠে দাঁড়িয়ে জোর করে উনার কপালের দুপাশে ধরে ভিডিওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখল। চোখ যাতে বুজতে না পারে, তাই দুই চোখের পাতা টেনে আঙুল চেপে ধরে রাখল।

কবির ক্যামেরা কোথাও রেখে মাজহারকে টান করে শুইয়ে পা দুটো চেপে ধরে আছে। জয় মাজহারের দু’হাতের ওপর দুই পা প্রসারিত করে চেপে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার একহাত ছেড়ে বসল। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সবটা মুখে গোজার সমি গালটা বোধহয় ফেঁড়ে গেল মাজহারের। এরপর খ্যাঁচ করে একটা শব্দ। বামহাতটা বাহু থেকে আলাদা হয়ে গেল। অথচ কোনো আওয়াজ হলো না। বামহাতটা কাটার পর কয়েকটা শিরা-উপশিরার সাথে ঝুলছিল, জয় পা দিয়ে চেপে ধরে হ্যাঁচকা একটা টান মারল। ছিঁড়ে এলো হাতটা।

বাঁধের ফুটো দিয়ে ছুটে আসা পানির মতো রক্তগুলো জয়ের সাদা লুঙ্গি ভেজাচ্ছিল।

মাজহারের চোখে যেন রক্ত উঠে গেছে। মৃত্যুসম যন্ত্রণা, অথচ চিৎকার করার উপায় নেই। জয় সামান্য হাসল, “ক্ষমা করিস, মাজহার। তরুকে কথা দিয়েছি তো। নয়ত তোর সাথে আমার কোনও শত্রুতা নেই রে। তোকে কথা দিয়েছি মুক্ত করে দেব, কথা রাখছি। ʼʼ

একটা কাঁচের শিশির মুখ খুলতে খুলতে আপনমনেই বিরবির করল, “জীবনে মেলা পাপ করছি, কিন্তু রেইপ করিনাই। করাটা বিষয়টা, কিন্তু আমার প্যানিক আছে, তাই এই পাপটা আমার হাত থেকে বেঁচে গেছে। মামাকে মুরসালীন আর আমার ঘরের শালী মিলে মেরেছে, আমি কিছুই মনে করিনি। কিছু বলিওনি এর বদলে ওদের। বলব কেন? মামা তো আসলেই কাজটা ভালো করেছিল না! খারাপ কাজ একটা, তাইনা বল?ʼʼ

মাজহারকে উলঙ্গ করে সবটুকু তরল ওর পুরুসাঙ্গের ওপর একটু একটু করে রয়েসয়ে ঢালল। আগুনের ছোঁয়ায় পলিথিন যেমন ঝলসে-গলে টপটপ করে পড়ে, ঠিক তেমন মাজহারের বিশেষ মাংসপিণ্ডটুকু গলে গলে পড়ে গেল। আন্দাজ করা যায় তরলটুকু গাঢ় কোনো এসিড অথবা সেরকমই কোনো কেমিক্যালই হবে।

এবং এরপর জয় খুব যত্নে দুই পা কাটল মাজহারের, খুব দক্ষ কসাইয়ের মতো। কবীরের বমি পেয়ে যাচ্ছিল। পেটে পাক গুলিয়ে আসছিল। কেমন মাথা ঝিমঝিমে অবস্থা।সে কখনও মর্গে মৃতদেহ কাটাও দেখেনি, আজ জীবিতদেহের ব্যবচ্ছেদ দেখতে হলো জয়ের বদৌলতে। মাজহারের দেহটা ততক্ষণে হয়ে এসেছে। রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে।

মাথাটা কেটে নিয়ে দেহটা একটু দূরে পুকুরে ফেলে এসে করে বস্তায় ভরে নিলো জয়। আফশোসে মুখ ছোট হয়ে এসেছিল জয়ের। শুধু মনে হচ্ছিল, মাজহার বোধহয় সুখে মরে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি যেন। রাগ হচ্ছিল এখন জয়ের।
তবু আর কী করার? মানুষের জীবন একটাই? আর তো সম্ভব না মাজহারকে আবার তুলে মারা! যথাসম্ভব প্রমাণ লুকিয়ে মূল গোরস্থানের দিকে চলল।

ভিডিও শেষ।

ঝন্টু সাহেবকে দাঁত চেপে সবটুকু দেখতে হয়েছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে উনার। জয় পেনডাইভ খুলে পকেটে রেখে সুন্দর হাসল, “ভালো লেগেছে তো কাকা? স্পেশালি আপনার জন্য এত পরিশ্রম করে ভিডিওটা বানিয়েছি।ʼʼ

ঝন্টুকে সাহেবকে মারতে খুব একটা খাটুনি করল না জয়। কেউ নেমে আসল না এতক্ষণেও। বাসায় লোক থাকেনা। মাজহারের মা শ্বাসকষ্টের রোগী। ইনহেলার টেনে ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়েন। আর কেউ নেই বাসায়।

জয় সোফার কুশন দিয়ে মুখটা চেপে ধরে ব্লেড দিয়ে আস্তে আস্তে গলাটা কাটলো। এভাবেই তরুর গলা কাটা হয়েছিল। জয়ের ধারণা কাজটা তরুর বেহুশির সময়ে করা। খুব নিখুঁত সরলরেখায় কাটা হয়েছিল। একটুও এদিক-ওদিক হয়েছিল না। জয় চেষ্টা করল পলাশকে ফলো করতে। কিন্তু হলো না, ঝন্টু সাহেব খুব ছটফট করছিলেন। একেবেঁকে গেল। কোথাও কোথাও হাতের অনিয়ন্ত্রণে ব্লেড বেশি গেঁথে গিয়ে ভেতরের শ্বাসনালি অবধি কেটে ফেলল।

জয় বেরিয়ে এলো আস্তে করে। তখনও গলা কাটা মুরগীর মতো হাত পা আছড়াচ্ছেন ঝন্টু সাহেব। রুহু বের হতে একটু সময় লাগবে। দেহের র-ক্ত সবটুকু বের হওয়া অবধি ছটফট করবেন তিনি মৃ-ত্যুযন্ত্রণায়। জয়ের খুব ইচ্ছে করছিল দাঁড়িয়ে থেকে তৃপ্তিদায়ক দৃশ্যটা দেখার। কিন্তু ঝুঁকি নেয়া যাবেনা। বাড়ির পেছনের প্রাচীর টপকে বেরিয়ে এলো। লুঙ্গিতে চিরচিরে রক্তের ছিটা এসে লেগেছে। লুঙ্গিতে ফের কাছা মেরে গলার গামছাটা দিয়ে লুঙ্গির মতো বাঁধল কোমড়ে। সাবধানতার মার নেই।


পলাশ জেলাতেই আছে। ওকে কোনোভাবেই পুলিশের হাতে পড়তে দেয়া যাবেনা। পুলিশের কাছে অর্ডার আছে পলাশকে পাওয়ামাত্র ক্রসফায়ারে দেবার। তা হতে দেয়া যায়না। জ্বর একটু কমলেই পলাশকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে বেরিয়ে যেতে হবে।

রাত দেড়টার দিকে অন্তূ ঘরে এলো। জয় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ফিরে তাকাল না খাটের হেড-বোর্ডের ওপর রাখা মদের বোতলে নখ বাজাতে বাজাতে ষষ্ঠ সিগারেটটায় টান দিলো। দরজা আটকানোর শব্দেও ফিরে তাকাল না।

অন্তূ আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসল জয়ের পাশে। কিছুক্ষণ চুপচাপ উগ্র-উদাস পুরুষটিকে পরখ করে অদ্ভুত স্বরে বলল, “মায়ার মানুষ ফাঁকি দিয়ে খুব ভেতর পোড়ে, জয় আমির?ʼʼ

জয় তাকাল, লাল হয়ে থাকা চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি সে। চিৎ হয়ে পাশ ফিরল। অন্তূ বলল, “আমার বাপটাও তরুর মতো ফাঁকিবাজ ছিল, জানেন? সব আগুন নিজেরা শুষে আমাদের শীতলতা দিতেই জীবনে আসে এইসব ফাঁকিবাজেরা। আব্বু আমায় কতদিন অন্তূ বলে ডাকেনা!ʼʼ

অন্তূ একদৃষ্টে জয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলছিল। জয় উঠে হেড-বোর্ডে বালিশ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রইল। অন্তূ বলল, “অথচ তার অর্ধেক জীবন তার নিজের ছেলে নিয়েছে, বাকিটা আমি পূর্ণ করে দিয়েছি।ʼʼ

জয় হাসল, “নোপ! দিস ইজ নট ফেয়ার, ঘরওয়ালি। তুমি আমার নাম নিতে ভুলে গেছ। ভাগে আমিও আছি।ʼʼ

স্লান হাসল অন্তূ, “ওহ, তাই নাকি?ʼʼ

-“জি জি, ম্যাডাম!ʼʼ

-“আপনি কবে থেকে পাপ স্বীকার করতে শুরু করলেন?ʼʼ

-“চিরকালই করি।ʼʼ লম্বা টান দিলো। ধোঁয়ায় ভরে উঠল নাকমুখ।

-“সে তো ভাব হিসেবে। তাতে একফোঁটাও আফশোস থাকেনা, থাকে ভনিতা।ʼʼ

জয় হাসল, “যথার্থই বলেছেন, উকিল ম্যাডাম।ʼʼ

অন্তূর গলাটা অদ্ভুত দৃঢ় হলো, চোখে চোখ মিলিয়ে কেমন করে যেন বলল, “ফিরে আসুন।ʼʼ

-“ঠাঁই নেই।ʼʼ

-“ঠাঁই দরকার আপনার?ʼʼ

-“হু, দরকার ছিল।ʼʼ

-“ঠাঁই থাকলে খারাপ হতেন না?ʼʼ

-“আমি বলেছি তোমায়, আমার খারাপ হবার কোনো কারণ নেই। আমি খারাপ, তাই আমি খারাপ।ʼʼ

-“তাহলে ঠাঁইয়ের কথা বললেন কেন?ʼʼ

জয় দুষ্টু-রসিক হাসল, তবু তা স্লান, “আচ্ছা, ঠাঁই? তুমি হয়ে যাও?ʼʼ

অন্তূ বিদ্রুপের হাসি হাসল, “আমি? আমি নিজেই তো এক নড়বড়ে এক খুঁটি। আপনাকে সামলাতে গিয়ে বড়জোর উপড়ে যাব, আর তারপর আপনাকে নিয়ে পড়ব।ʼʼ

-“তুমি আমার ওপর, আর আমি তোমার ওপর ভর করলে তো দুজনই দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। কী বলো?ʼʼ চোখ মারল জয়।

অন্তূ সামান্য চোখ বুজে দৃঢ়চিত্তে মাথা নাড়ে, “পারিনা।ʼʼ

জয় অন্তূর দিকে তাকিয়ে থেকেই বোতলটা তুলে নিলো। অন্তূ তা কেড়ে নিলো, “খবরদার। আজ নয়।ʼʼ

-“একটু গিলতে দাও।ʼʼ

-“আজ অন্তত নয়। আমি কথা বলছি।ʼʼ

-“সেজন্যই একটু দাও। অল্প খাব।ʼʼ

-“সেজন্য?ʼʼ

-“হু। তুমি আর আমার সাথে কথা বলো না সচরাচর। মানে আমার অভ্যাস নেই। আজ বলছো, অস্বাভাবিক লাগছে। একটু খেতে দাও আজ।ʼʼ

অন্তূ বোতলটা ঝেরে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল। কাঁচের বোতলটা আওয়াজ তুলে ঝনঝন করে ভেঙে খানখান হয়ে যায়। জয় চোখ বুজে তা অনুভব করে, তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে, “উফফ! শালা কাঁচ ভাঙার আওয়াজ এত সুন্দর হয় কেন? এত্ত ভাল্লাগে! ফাকিং লাভ দিস!ʼʼ

অন্তূ তাচ্ছিল্য করে হাসে, “হৃদয় ভাঙার আওয়াজ এর চেয়েও ভালো লাগে আপনার। আর জানেন অধিকাংশ সময় হৃদয়কে কাঁচের সাথে তুলনা করা হয়।ʼʼ

জয় কথা বলল না। মাঝেমধ্যেই কেমন ভদ্রলোকের মতো আচরণ করে। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা, মিষ্টি হাসা, নরম আচরণ!

অন্তূ যেন আনমনা স্বরে বলল, “আমি তো একসময় বেশ আদর্শবতী ছিলাম…ʼʼ

জয় আড়চোখে চোখ তুলল, “হু, ছিলে।ʼʼ

-“ছিলাম নাকি?ʼʼ

-“ছিলে তো।ʼʼ

“ওহ, হ্যাঁ ছিলাম বোধহয়। সেসব সেই কবেকার কথা। ভুলেই গেছি!ʼʼ অদ্ভুত হাসল অন্তূ, “মাঝেমধ্যে মনেহয় কী জানেন? যদি আমাদের বিয়েটা হুটহাট, তামাশাবিহীন হয়ে যেত, মানে অন্য কোনোভাবে হয়ে যেতও, আপনি যেমনই ছিলেন, ছিলেন। আমি হয়ত মাফ করে দিতাম। তারপর নিজের আদর্শ দিয়ে আপনাকে হয়ত ভালো জয় আমির করে তুলতাম। খুব সিনেমাটিক চিন্তা তাই না?ʼʼ

হেসে মাথা নাড়ল জয়, “খুব সিনেমাটিক।ʼʼ

অন্তূ পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল। জয় বলল, “এরপর?ʼʼ

অন্তূ হেসে মাথায় নামায়, “অথচ আমি আপনাকে ক্ষমা তো দূর, শাস্তি না দিয়ে আমি মরেও শান্তি পাবো না। আসশোস! ইশ, যদি ওমন না হতো..ʼʼ

জয় দুধারে মাথা নাড়ে, “পারতে না, ঘরওয়ালি?ʼʼ

-“পারতাম না?ʼʼ

“পারতে না।ʼʼ

অন্তূ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। জয় কিছু বলবে। এই লোক নিজের ব্যাপারে একটা কথা বলতে যা ফুটেজ খায়! অনেকটা সময় দিতে হয়, চুপচাপ তা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তবে সামান্য বলে। আর মাঝখানে একটা শব্দ উচ্চারণ করলে চোখের পলকে প্রসঙ্গ বদলানোয় যা চমকপ্রদ দক্ষতা!

জয় সিগারেট শেষ করল, একটু সোজা হয়ে বসল। এরপর বলল, “কুমোর কারা বলো তো?ʼʼ

-“যারা মাটির জিনিসপত্র বানায়।ʼʼ

-“ব্রিলিয়ান্ট। ওরা একদল ভালো কারিগর। জানো ওরা মাটির জিনিসপত্র কীভাবে বানায়?ʼʼ

অন্তূ চুপ রইল। জয় বলল, “প্রথমে কাঁচা মাটি মাখানো হয়। কাঁচা, নরম মাটি কিন্তু। এরপর হাতের কারিগরিতে যেমন ইচ্ছা আকৃতি দেয়া হয়। হতে পারে সেটা ফুলদানী, থালা-বাটি অথবা রেনডম কিছু। এরপর শুকানো হয় সেগুলোকে। এখানেই শেষ হলে ঠিক ছিল।ʼʼ

কেমন করে হাসল জয়, “মাগার এখানেই শেষ না। তারপর সেই শুকনো জিনিসগুলোকে আগুনে ফেলে দেয়া হয়। কাঁচা মাটির তৈরি ওই জিনিসগুলো আগুনে পুড়তে পুড়তে পুড়তে পুড়তে একসময় লাল টকটকা, কঠিন মাটির পাত্র হিসেবে তৈরি হয়। তখন তুমি বড়জোর ওগুলোকে আছড়ে ভেঙে ফেলতে পারবে। ওতে আর হাজার পানি ঢাললেও তা আগের সেই কাঁচা নরম মাটিতে পরিণত হবে না, ঘরওয়ালি। যাকে তুমি আবার হাতে মাখিয়ে নতুন আকৃতি দিয়ে নতুন জিনিস বানাতে পারো।ʼʼ

অন্তূ ভ্রুটা সন্তর্পণে কুঁচকে ফেলল। জয় হাসল, “আমি যখন কাঁচামাটি ছিলাম, বালক জয় আমির, নরম, ভীতু এক ছোট্ট ছেলে। তখন আমাকে গড়া হয়েছে এই জয় আমিরের আকৃতিতে। এরপর আগুনে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি বছরের পর বছর পুড়েছি। এরপর এই শক্ত, কঠিন লাল মাটির জয় আমির তৈরি হয়েছে। তাকে তুমি বড়জোর আঘাত করে ভেঙে টুকরো থেকে আরও ছোট টুকরোতে পরিণত করতে পারবে। কিন্তু হাজার তোমার আদর্শের পানি আমার ওপর পড়লেও আমি আর সেই আগের কাঁচা জয় আমিরে কনভার্ট হবোনা, যাকে তুমি ইচ্ছেমতো শেইপ দিয়ে সাজাতে পারো।ʼʼ

অন্তূ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বুকের ওঠানামা দ্রুত হচ্ছিল। জয়ের ঠোঁটে সামান্য হাসি। সে সিগারেট ধরালো আরাম করে। খোলা প্যাকেটের শেষ সিগারেটটা ঠোঁটে গুঁজে লাইটার জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। এরপর চট করে অন্তূর কোলের ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। গাটা তখনও গরম ভীষণ।

চলবে…

[রিচেইক করিনি। অসংখ্য টাইপিং মিসটেক থাকতে পারে। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]