অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0
103

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬১.

সকালের রান্নাটা তুলি করল। বাড়িতে কোয়েলসহ ওরা চারজন। ওয়ার্কশপে আজ ছয়জন খাটছে। আর বড়ঘরে আছে সাতাশজন।

সকাল এগারোটায় রিমি রুম থেকে বের হলো। হামজা সোফাতে বসে বই পড়ছে। ভীষণ মনোযোগ বইয়ের পাতায় তার। জর্জ অরওয়েলের লেখা ‘নাইনটিন এইটটি ফোরʼ বইটি তার হাতে। ইংরেজ লেখকের লেখা এই বইটি চমৎকার এক রাজনৈতিক ও সরকারব্যবস্থার আখ্যান। আগের দিন হল রিমি রাগ করতো। ওকে ঘুম পাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে এসব ভারী ভারী বই পড়ার অভ্যেস আছে এই লোকের।

চোখে সাদা চশমা। চৌত্রিশ বছর বয়সী সৌম্য পুরুষটির দিকে কতক্ষণ চেয়ে রইল রিমি। পরনে সবসময়কার মতোন ফতোয়া। কালো কুচকুচে চাপ দাড়ি-গোফের ভিড়ে পুরু ঠোঁট। কোয়েল এসে হামজার কোলে ঝেপে পড়ে বইটা কেড়ে নিলো, তখন রিমির মনোযোগ সরে।

হামজা রেগে গিয়ে আবার সামলায়। সে রাগে না। কোয়েলকে পাঁজা করে তুলে নাকে নাক ঘষে বলল, “তো আম্মাজান, আপনার খাওয়া হয়েছে?ʼʼ

-“জয় কোতায় গেতে, বলো। তাতাড়ি বলো।ʼʼ

-“উমম..বেড়াতে গেছে। তুমি যাবে বেড়াতে, আম্মা?ʼʼ

অভিমানে মুখ ফুলালো কোয়েল, “ওর বউতাকে ঠিকই সাথে নিয়ে গেল, আমায় নিলো না। আসুক এবার..ʼʼ

হামজা হেসে ফেলল। অভিমানে মুখ ছোট করে মামার গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকে কোয়েল। একটু পর ফুঁপিয়ে ওঠে, “মামা!ʼʼ

হামজা চমকে ওঠে। নরম, আধভাঙা কণ্ঠের মামা ডাকটা কেমন যেন শোনালো কানে হামজার। “বাবা!ʼʼ ঠিক যেন এমন।

ঘন চোখের পাপড়ি ভিজে উঠেছে কোয়েলের। এত্ত সুন্দরী হয়েছে তুলির মেয়েটা! তুলির চেয়েও সুন্দরী! ত্বকের ওপর দিয়ে রক্তের বর্ণ ছুটে আসে, গোলাপী চামড়ার রঙ বাচ্চাটার। সেই ছোট্ট চোখের ছলছলে দৃষ্টি হামজাকে অস্থির করল, জড়িয়ে ধরল অজান্তেই সে, “কী হয়েছে, আম্মাজান! কাঁদছেন কেন?ʼʼ

পানি গড়িয়ে পড়ল কোয়েলের চোখ বেয়ে, “পাপা’তা আসেনা কেন? তরুতাও নেই। কার থাতে খেলব বলো তো! পাপা বলেথিল, চলকেট আর টয় আনবে আমাদ্দন্য। এলোই না! আমি তাল ওপল লাগ কলেতি। শোনো, মামা। তরুকে কোতায় পাথিয়েছ? আমার খেলার লোকই তো নেই কেউ।ʼʼ

বই রেখে কোয়েলকে কোলে তুলে বলল, “আপনি কি মামার সাথে বেড়াতে যেতে চান, আম্মাজান? মামা যদি আপনাকে নিয়ে যেতে চায়?ʼʼ

কথাটা একটু সময় নিয়ে বুঝে হাসল কোয়েল। ভেজা চোখ, ঠোঁটে হাসি! হামজা আলতো হেসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কোয়েলকে। সে বাচ্চাদের আদর দিতে পারেনা, কীভাবে কী করবে, তা-ই বুঝে পায়না।

রিমি বিছানা গোছাচ্ছিল। সারারাত কেঁদেছে। শেষরাতে যখন হামজা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, তারপর একাধারে কেঁদেছে। হামজা দেখল ভারী মুখখানা রিমির। কিছু বলল না, চুপচাপ মানিব্যাগটা টাউজারের পকেটে পুরে কোয়লকে নিয়ে বের হলো।

রাস্তায় এত মানুষের অভিবাদন, সালাম, সম্মান—সবটাই মুখের রোবটিক হাসি দিয়ে সামলে নিলো। ভেতরে নাম না জানা এক অস্থিরতা। অসহ্য লাগছে বিষয়টা। অপরিচিত যন্ত্রণা এ এক।

ভোররাতে সে রুম থেকে বেরিয়ে দুই জগ পানি ভরে নিয়ে সোজা বড়ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। মেঝের ওপর ক্লান্ত দেহগুলো ছিটিয়ে পড়ে আছে। ক্লান্ত, অভুক্ত, ক্ষততে ভরা দেহগুলো ঘুমিয়ে আছে ওভাবেই। জেগে আছে তিনজন। কীসের যেন এক আলোচনা চলছিল, হামজার উপস্থিতিতে চুপ হলো সকলে।

জগদুটো রেখে হামজা বসল মোড়া টেনে নিয়ে। মুরসালীনকে বলল, “পানি খাবে?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দিলো না। চুপচাপ চেয়ে রইল। হামজা ক্লান্ত স্বরে বলল, “জেদ কমেছে?ʼʼ

মুরসালীন হাসে, “জেদ? উহু! আগুন, হামজা ভাই, খড়ের গাদায় লাগা আগুন। যা শুধু ধিকধিক করে বাড়ে। সাতটা বছর ধরে জমছে ছাইগুলো, নেহাত কমার তো না, কী বলেন? ভাই হারিয়েছি, বোন হারিয়েছি…ʼʼ

কথা কেড়ে নিলো হামজা, “ওরকম ছাই সবার ভেতরেই চাপা আছে। টুকটাক চাপা থাকা ছাই ভেতরে জমা ভালোই তো।ʼʼ


প্রতিটা গোয়েন্দা সংস্থা, লোকাল থানা, আইনি কার্যালয়—সবখানে, এমনকি রাস্তায় লোক নিযুক্ত করা। পুলিশ কোনোভাবে পলাশের এই বাড়ির দিকে ভিড়লেই খবর চলে আসবে।

সেদিন রাতে হামজা এসবিকে সুন্দর একটা তথ্য জানিয়ে রেখেছে কল করে। বলেছে, “পলাশ আজগর, দ্য মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল আইনের হাত থেকে বেঁচে দেশের সীমান্তে অবস্থান করছে। সুযোগ বুঝে ওপারে পাড়ি দেবে। আপনারা সীমান্ত এলাকাগুলো কড়া নজরদারীতে রাখুন।ʼʼ

আইন কর্মকর্তাদের ধারণা, তাদের তিনজন কর্মকর্তাকে
খু/ন করেছে পলাশ আজগরের লোক, এরপর তাদেরকে ঘোল খাইয়ে পালিয়েছে। এখন দেশ ছাড়ার মতলব। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ঝেপে পড়েছে তারা পলাশের পেছনে। কোনোভাবেই সীমান্ত পার হতে দেয়া চলবে না। হামজা পলাশকে ইচ্ছেমতো খাতির করার সময় পেল এতে।

সারাদিন রান্নাবাড়া করে, সকলকে খাইয়ে কাহিল অবস্থা জয়ের। সাদা লুঙ্গির ওপর কোমড়ে লাল গামছা বাঁধা, সাদা লুঙ্গি নোংরায় জর্জরিত। খাঁটি বাবুর্চি লাগছিল দেখতে। একটু পর পর গামছায় ঘাম মুছছে। সকলের খাওয়া হলো, সে তখনও অভুক্ত। প্রতিটা আয়োজনে তার সঙ্গে এটা হয়। এমনও হয়, সকলকে পেটপুড়ে খাইয়ে তার জন্য অবশিষ্ট কিছু বাঁচেনা। এটা তার রীতি। নিজের পেট ভেসে যাক, মেহমানদের কমতি রাখা যাবে না।

দুজনের গোসল-খাওয়া কোনোটাই হয়নি। রূপকথা সন্ধ্যার পর জয় ও পরাগকে খাইয়ে দিতে বসল। খাওয়া হলো না শুধু পলাশের।

সবে পরাগ দুই লোকমা ও জয় এক লোকমা খাবার গালে পুড়েছে, তখনই গুলির শব্দ এলো। অর্থাৎ, দারোয়ান বসির শেষ! ভাতটুকু না চিবিয়ে বরং থুহ করে ফেলে দিলো জয়। সময় নেই খাওয়ার। দৌঁড়ে ভেতরে গিয়ে পিস্তল ও কুড়ালটা বের করে নিয়ে বাহির আঙিনার দিকে চলে গেল। ছেলেরা তখন সিগারেট ফুঁকতে গেছে কোথাও। পরাগ দৌঁড়াল জয়ের পেছনে।

ছয়জন মুখোশধারী আততায়ী। পলাশের শুভাকাঙ্ক্ষীর এক ঝলক। ছয়জন ছয়দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। জয়ের সঙ্গে প্রথমে যার দেখা হলো, কুড়ালের আঘাতে তার হাত কাধ থেকে নেমে গেল। চিৎকারটা মিলিয়ে গেল। এত নির্জন একটা জায়গা! বিশাল এরিয়াটার গোটাটাই পলাশদের দখলে। ভুলেও কেউ পা দেয়না দূর-দূরান্ত অবধি। গাঙটা লাশের স্তুপ, তা জানে লোকে।

পরাগ পেছনের দিকে গেল। নৌকা বয়ে গাঙের কিনারা ঘেঁষে উঠে এসেছে তার সামনে দুজন।

বাকি তিনজন তখন বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। জয় দ্রুত ভেতরে ঢুকল। ওদের টার্গেট পলাশকে মুক্ত করা। এটা বুঝতে জয়ের যতটুকু দেরি লাগল, ততক্ষণে অন্তূর গলায় ড্যাগার ধরেছে ওরা। অন্তূকে জিজ্ঞেস করে, “পলাশ কই?ʼʼ

অন্তূর মনে হচ্ছিল, এ যেন সিনেমা! বলল, “আমি জানিনা। আমি এসেছি গতকাল রাতে। আপনারা কি পলাশকে মারতে এসেছেন?ʼʼ

একজন অন্তূর গলা টিপে ধরে খেঁকিয়ে উঠল, “বেশি কথা কস? নাটক করবি না, বল পলাশ ভাই কই?ʼʼ

অন্তূ দেখল, ওরা প্রচণ্ড উত্তেজিত। যখন-তখন ছুরি চালাবে সন্দেহ নেই। বলল, “উপরতলায় আছে। উপরতলার তিন নম্বর রুমে। দরজা খোলাই আছে, একটু আগে দেখে এসেছি আমি।ʼʼ অন্তূ আদতেও জানেনা, উপরতলায় তিন নম্বর রুম বলতে কিছু আছে কিনা! সে উপরতলায় ওঠেইনি আসার পর থেকে। পলাশ মূলত বেসমেন্টে আঁটক।

দুজন উঠে যায় উপরতলায়। একজন অন্তূকে আঁটকে রাখল। রূপকথা আছে উপরতলায়। অন্তূ আড়চোখে তাকায় একবার। ড্যাগারের চোখা মাথাটা অন্তূর গলার চামড়া ছিড়ে ফেলেছে ইতোমধ্যেই। তীব্র জ্বলুনি হচ্ছে। অন্তূর মাথা আর কাজ করছিল না। যেহেতু ওরা বাড়ি অবধি চলে এসেছে, অন্তূকে মেরে ফেললেও ওরা ঠিক পলাশকে ছাড়াতে পারবে।

তখন জয় ঢুকল। জয়কে দেখেই লোকটা খপাৎ করে অন্তূর চুল মুঠো করে ধরল। ড্যাগার আরও একটু শক্ত করে চাপলো কণ্ঠনালির ওপর, জয়কে বলল, “আর এক পা এগোবি তো…

-“উহুম! মেরে ফেল্।ʼʼ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু হাত উঁচু করে ধরল, ”বন্দুক থাকলে শ্যুট করে দে, ভাই। টপকে দে শালীকে। শালী চরম বেইমান। আমার খায়, আমার পড়ে, আমার পেছনেই বাঁশ নিয়ে দৌঁড়ায়। ও বেঁচে থেকে লস ছাড়া লাভ নাই আমার। খুলি-টুলি উড়িয়ে দে একদম।ʼʼ

লোকটা এক মুহুর্তের জন্য থমকালো এতে। তা যথেষ্ট। জয় অন্তূর দিকে কেবল একবার তাকাল এক মুহুর্তের জন্য। এরপর গুলি চালালো, ঠ্যাং বরাবর। লোকটা ব্যথায় ছিটকে ওঠার সময় ছুরির আঘাত লাগতো, লাগল না। অন্তূ জয়ের ট্রিগার লক্ষ করে মাথা পিছিয়ে নেয়। জয় এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে হাসল, “দুনিয়ায় গাছের চাইতে বিশ্বাসঘাতকের সংখ্যা বেড়ে গেছে রে মনসুর! এটা কি ঠিক? হামজা ভাই তোরে কত বছর পালছে। পলাশ তোরে কোন তাবিজে কিনছে, বাপ?ʼʼ জয় লোকটার মুখ বাঁধা থাকার পরেও কণ্ঠ চিনল।

কুড়ালের এক কোপে মাথাটা ঘাঁড় থেকে প্রায় আলাদা হয়ে গেল। এক ঝটকা রক্ত মুখে ছিটে এলো জয়ের। বুকের পশমের ফাঁকে রক্তের দানা আঁটকে রইল।

পরাগ ভেতরে উঠে আসে। ক্ষ্যাপা দুটো নেমে এলো উপরতলা থেকে। অন্তূকে পেলে এবার বলি দেবে, এমন মনোভাব। কিন্তু পরাগকে দেখে থমকে গেল, ওরা পরাগকে এখানে আশা করেনি। জয়ের দিকে নজর যেতেই মুখ শুকিয়ে এলো। রূপকথা নেমে আসল, “পলাশ এখানে নেই। ওপর থেকে শুনে এলে না আমার মুখে?ʼʼ

ওরা আজ আর মালকিনকে পরোয়া করছে না। রূপকথাকে হাতের কাছে পেয়ে ওকেই জিম্মি বানালো। এটা পলাশের অর্ডার। পলাশের বউ পলাশের দুশমন। বউকে ছাড় দিয়ে লাভ নেই।

দুজন রূপকথাকে অস্ত্রের তলে ধরে পিছিয়ে গেল কয়েক কদম। জয় আঙুল ঢুকিয়ে দাঁত থেকে মাংসের টুকরো বের করছে। ওরা সতর্ক দূরত্ব বাড়িয়ে একটা ছুরি ছুঁড়ে মারল জয়ের দিকে। জয় তড়াক করে ছুরিয়ে দিকে পরাগকে ধাক্কা মেরে নিজেকে বাঁচায়। পরাগের হাতে লাগল ছুরি। এরপর দুটো মোট তিনটা লাশ পড়ল মেঝেতে।

অন্তূর ওড়না টেনে নিয়ে দাঁতের রক্ত মুছল জয়, “বিশ্রী স্বাদ এই শালাদের র-ক্তেও, ঠিক বলিনি, পরাগ?ʼʼ

পরাগ বদলে বকে উঠল, “তোর রক্তের চেয়ে অন্তত ভালো স্বাদ।ʼʼ

জয় ভাব নিয়ে ঠোঁট বাঁকায়, “রক্তটা আমার বলে কথা। কিন্তু কথা হইল, তুমি টেস্ট কবে করছো , ভাই ফ্রগ?ʼʼ

ফ্রগ শব্দের অর্থ–ব্যাঙ। পরাগ থেকে ফ্রগ, জয়ের আবিষ্কার এসব। পরাগ হাসল, “তোমার পেছন যে মারব আমি, বাট দ্য লেডিস ইন ফ্রন্ট অফ মি…ʼʼ রক্তে শার্ট ভিজে উঠেছে পরাগের।

অন্তূর ওড়না হাতের এক ছোট্ট ক্ষততে প্যাঁচাচ্ছিল জয়। তাতে অন্তূর গায়ের ওড়না সর আসছে। অন্তূ হেঁচকা এক টান মারল ওড়নায়, পড়তে পড়তে বাঁচে জয়। একটা থাপ্পড় তুলল অন্তূর দিকে, আবার মারল না।

খানিক আগে অল্প খাবার খেয়ে বমি করেছিল অন্তূ। মুখটা শুকনো।

অন্তূকে বেসমেন্টের সামনে এনে বলল, “একটা মজার জিনিস দেখাই চলো। তারপর বাড়ি কেন, জাহান্নামে যেতে চাইলেও দুইজন একসাথে পাড়ি দেব সেই পথ! আফটার অল তুমি আমার ঘরের শালী!ʼʼ

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালায় জয়। অন্তূ সোজা হয়ে দাঁড়াল। কেউ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের শুকনো দাগ। পায়ে তার শিকলের বেড়ি।

জয় এগিয়ে গিয়ে লাত্থি মেরে দেহটা উল্টে চিৎ করল। অন্তূর শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে শিউরে ওঠে। পলাশের ছেঁড়া-ফাঁড়া দেহ। ছ্যাঁচড়ার মতো হাসল পলাশ। প্যাচপ্যাচে হাসি। চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। সরু নাকের পাটার নিচে শুকনো রক্ত। হাত তুলে যখন অন্তূকে ঈশারা করল, অন্তূর গা-টা ঘিনঘিনিয়ে উঠল। ওর পুরো হাত ঠেতলে গেছে। আধমরা হাল। এতটা বেহাল অবস্থায় কেউ জীবিত থাকতে পারে? শরীরের থকথকে ঘা-গুলো থেকে কষানি ও পুঁজ ঝরছে, কোথাও কোথাও জমে আছে। জীবন্ত মাংসে পোকা হলে যেমন গলে গলে পড়ে, কষানি জমে ক্ষতগুলো সেইরকম দেখাচ্ছিল।

অন্তূ নিজের অজান্তে দু-কদম পিছিয়ে গেল। আব্বুর সেই চেহারাটা মনে পড়ল। ছেঁড়া শার্ট, ঠেতলে যাওয়া মুখ, কানের কাছে সিগারেটের আগুনের পোড়া, শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে পড়া অসংখ্য ক্ষত….অন্তূ চোখ বোজে। কী আশ্চর্য! অন্তূর শরীরটা কাঁপছে, চোখ ভরে আসছে! আব্বুর কানে যখন সিগারেটের আগুন চেপে ধরা হয়েছিল, পুড়েছিল জায়গাটা, আব্বু কি চিৎকার করেছিল ব্যথায়!

চোখ খোলে অন্তূ। সেই তো কতদিন আগের ব্যথা, আব্বু নেই, এর মাঝে অন্তূর সাথে কত কী হয়েছে, কত সহনশীলতা এসেছে অন্তূর মাঝে, তবু কেন সইছে না!

তরু! ব্লেডে ছিন্নভিন্ন শরীর, দু’পায়ের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে মেঝে ভেজানো পাঁজা ধরা রক্তের স্রোত, নগ্ন শরীর। মুমতাহিণার খুবলে খাওয়া অর্ধপঁচা নষ্ট শরীর…

জয় আরাম করে একটা চুরুট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। মুখে রক্ত লেপ্টানো। কবীর পলাশকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে বাঁধে। বেশ শক্তিশালীই লাগছিল তখন পলাশকে। হাসছে, দূর্বল চিত্তে ওমন বিশ্রী হাসি অদ্ভুত দেখায়।

অন্তূ তাকায় জয়ের দিকে। জয় স্থির চোখে ইশারা করে পলাশের দিকে, এগিয়ে যেতে বলে। তাতে কীসের যেন প্রশ্রয়, বহুদিনের পরিকল্পনা বোধহয়, অন্তূর জন্য এক উপহার নাকি? ঠিক যেমন বাচ্চার জন্মদিনে অভিভাবক দিয়ে থাকে, জয় সেভাবেই ইশারা করল উপহারের বাক্সের দিকে।

অন্তূ বিক্ষিপ্ত ভারী শ্বাস ফেলে। নাক শিউরে ওঠে তার, গলার ভেতরে দলা পাকায়। অন্তূ এগিয়ে যাবার সময় জয় একহাতে সিগারেট ঠোঁটের ভাজে ধরে অন্যহাত দিয়ে অন্তূকে সেই কুড়ালটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “জানটা আমার জন্য রেখো।ʼʼ

অন্তূ এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে এলো। শরীর কাঁপছে তার। হাতে বল নেই। তার হাত এখনও বুঝি মানুষ খুন করার মতো অথবা পৈশাচিক যন্ত্রণা দেবার মতো শক্ত হয়নি! অন্তূ হতাশ হয়, তার হাতে এখনও নমনীয়তা অবশিষ্ট। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে পিছিয়ে এসে জয়ের হাতে কুড়াল ফিরিয়ে দেয়।

জয় হাসল। সে জানতো এমনটা হবে। নয়ত কেউ কুড়াল হাতে তুলে দিয়ে শিকারের জান রক্ষার আশা করতে পারে? শেষ একটান দিয়ে গোটা অর্ধেক চুরুটটাই ফেলে দিলো। চোখে-মুখে লেগে থাকা রক্ত তখন জমাট ধরেছে। কবীর একটা বাক্স নিয়ে এলো। তাতে হাতুর, বাটাল, ছেনি, র‌্যান্স, স্ক্রু ড্রাইভার ইত্যাদি সব যন্ত্র মজুত।

পলাশের দুই হাতের পেরেকের আঘাতের জায়গাগুলো পঁচে-গলে পড়ার মতো থকথকে। হাত দুটো যেন আগুনের আঁচে বেশ যত্ন করে ঝলসানো হয়েছে, অবর্ণনীয় সাঁজা।

সেই হাতদুটোকে জয় ইস্পাতের বীমের ওপর রাখে। মানুষের হাতের প্রতিটা আঙুলে তিনটা করে হাড়ের সন্ধি থাকে। জয়ের লোহা পেটানো হাত। হাতুর দিয়ে লোহা পিটিয়ে সোজা করার মতো পিটিয়ে পিটিয়ে পলাশের হাতের একেকটা গিড়া ছুটালো। কী যে আর্তনাদ আর চিৎকার সেসব। রূপকথা ছুটে এলো। দরজার কাছে দাঁড়াল। ওকে দেখে পলাশ কয়েক মুহুর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়। জয় যখন আরেকটা আঙুলের সন্ধিতে আঘাত হানে, আবার সেই চিৎকার! রূপকথা এবার চলে গেল, একবার পেছন ফিরে তাকালো, আবার চলে গেল। পলাশ তাকিয়ে দেখল তা।

দুই হাতের ত্রিশটা অস্থি-সন্ধি, তালুর সাথেকার আঙুলের সন্ধি, শেষ অবধি কব্জিসন্ধিটা। খুব যত্ন করে সেগুলো ভাঙল জয়। হাতদুটো লুলা হলো পলাশের। শুধু চামড়ার সাথে ঝুলে রইল। কোথাও কোথাও ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। জয়ের হাত ঢেকে গেল সেই নতুন তরল রক্তে। জয়ের মনে হলো, এই রক্তটুকু বোধহয় তরুর রক্তের ওপর পড়লে তরুর রক্তের স্রোত থামতো, ধুয়ে যেত সবটা।

পলাশের চিৎকারে কবীর হাতে কান চাপে। ওমন পৈশাচিক যন্ত্রণাকাতর চিৎকার সহ্য করা যায়না। মনে হচ্ছে, নরকের দূত যেন কোনো পাপীকে তার কর্মফল দিচ্ছে, এত্ত ভয়াবহ কাতর চিৎকারে মানসিক অবস্থা বিগড়ে যায় মানুষের। অন্তূর এলোমেলো শ্বাস উঠেছিল। পলাশ চিৎকার করছিল। অথচ অন্তূ শুনল, আমজাদ সাহেবকে পলাশ মারছে, সিগারেটের আগুন চেপে ধরে কান ঝলসাচ্ছে, আমজাদ সাহেব আর্তনাদ করছেন, কেউ নেই বাঁচানোর সেই আওয়াজগুলো অন্তূ শুনতে পাচ্ছিল।

এক সময় মস্তিষ্কের উন্মদনা আর সইতে না পেরে জোরে করে চেঁচিয়ে উঠল অন্তূ কানে হাত চেপে। পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ে ছটফট করল। জয় হাতুর ফেলে দৌড়ে উঠে আসে। আগলে ধরে অন্তূকে, শান্ত করার চেষ্টা করে। অন্তূ চোখ-মুখ খিঁচে বুজে হাউমাউ করে কাঁদছে, ‘আব্বু আব্বুʼ করে ডাকছে, যেমনটা বাচ্চারা ঘুম ভেঙে মাকে ডাকে। জয় অস্থির হয়ে উঠল, সামলানো যাচ্ছিল না অন্তূকে। পলাশ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায়। কবীরের মনে হলো, পলাশের চিৎকার তার ভালোই লাগছিল এতক্ষণ, কিন্তু বুক ফাটা কান্নাটা অন্তূ কাঁদছে। কবীর টের পায় তার চোখ ভরে উঠেছে। এত করুণ শোনায় কোনো মেয়ের কণ্ঠে বাপের নাম ধরা কান্না!

জয় নিজের রক্তমাখা হাতদুটো অন্তূর গালে রেখে ছোট বাচ্চা বোঝানোর মতো বলে, “ঘরওয়ালি, তাকাও। শোনো, আমি আছি। কিচ্ছু হয়নি। আমার বাপ-মা কোনোদিনই নাই। আমার কেউ নেই। মরে গেছি আমি? ওসব বালের ঝামেলা না থাকলেই ভালো, বিন্দাস লাইফ। চুপ করো। তোমার কাছে আমি আছি আপাতত। শোনো, আরমিণ! ঘরওয়ালি…ʼʼ

অন্তূ আরও বেসামাল হয়ে ওঠে, পলাশের দিকে ইশারা করে, “ও আমার আব্বুকে মেরেছিল, আপনি সেদিন কিচ্ছু. …

কথা শেষ হয়না, রক্তমাখা ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে গিয়ে শক্ত করে একটা চুমু খায় জয় অন্তূর ঠোঁটে। ঠোঁট সরাতেই অন্তূ আবার ছটফটিয়ে ওঠে, “আপনি ছিলেন ওখানে, তবু কিচ্ছু করেননি, আমার কেউ নেই, সুযোগ আসলে আমি আপনাকে….ʼʼ

জয় এবারও কথা শেষ করতে দেয়না। অন্তূর চোয়ালদুটো দু-হাতে চেপে ধরে আবার ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে থামায়। এবার আরও গাঢ় ছিল সেটা। জয়ের ঠোঁটের জমাট রক্ত অন্তূর ঠোঁটে লাগে। অন্তূর ছটফটানিতে ওড়না পড়ে যাচ্ছিল কাঁধ থেকে। অন্তূ কাতরাতে কাতরাতে ডুকরে কেঁদে ওঠে পাগলের মতো, “আপনাকে আমি ক্ষমা করব না। সবাই যেভাবে শেষ হচ্ছে, আপনিও হবেন, ওদের থেকে আলাদা নন আপনি…ʼʼ

জয় রক্তমাখা হাতে অন্তূর ওড়না তুলে কাধে জড়িয়ে দিয়ে আঁকড়ে ধরল অন্তূকে ঠোঁট দিয়ে। জয়ের উন্মাদনায় অন্তূ পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে ছারখার দুজন তখন। অঝোরে কাঁদছে অন্তূর চোখদুটো। জয় ছাড়ল না আর তৃতীয়বার। তার চটা ভ্রুতে রক্ত, মুখের সিংহভাগ রক্তে জর্জরিত। সেই অবস্থায় অন্তূকে তৃতীয়বারে এতটা শক্ত করে চেপে ধরে চুমু খেল, অন্তূর দেহটা আড়াল হয়ে গেল জয়ের শরীরের বাঁধনে। চোখদুটো খিঁচে বুজে রইল। পানি খাওয়ার মতো অন্তূর দুঃখটুকু শোষন করল জয়। টপটপ করে পানিগুলো অন্তূর গাল বেয়ে পড়ছিল, জয় তার তোয়াক্কা না করে গিলল সবটা। বারবার দুইগালে হাত বুলায় জয়। অন্তূ থামছে না। কান্নার তোড় বাঁধ ভাঙা, উপচে পড়া বিক্ষিপ্ত স্রোতের মতো। সেই উন্মাদ স্রোতের বাহ্যিক কঠিন, আর অভ্যন্তরীণ দুর্বোধ্য এক বাঁধ তখন জয় আমির।

কবীর মলিন হাসে। তার কাছে দৃশ্যটা সেদিন রোমান্টিক লাগেনি। মনে হয়েছে, এ এক মহাবিচ্ছেদের ক্ষণ বুঝি! কী আশ্চর্য! এটাকে কেউ মহাবিচ্ছেদ বলতে পারে বুঝি!

যেখানে জয় আমিরের মতো এক জন্মগত ছিন্নভিন্ন প্রলয়ঙ্কর ঢেউ, তার নিজস্ব প্রবাহে ছুটে গিয়ে কোনো বিক্ষিপ্ত নদীকে আলিঙ্গন করছে, তার অতল গহ্বরে একবার ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে নিজের তলহীন তলদেশ দেখিয়ে বলছে, ‘আমি এক চির শূণ্যতর কৃষ্ণগহ্বর, তার গভীরতা অসীম, সেই অসীমতায় তোর দুঃখ কেন আরমিণ, গোটা বিশ্ববহ্মাণ্ডকে তলিয়ে নিতে পারি।ʼ

অন্তূ সেদিন এক সময় এলোমেলো হয়েছিল। শক্ত হাতে বাঁধা দেওয়া হাতদুটো নরম করে গুটিয়ে জয় আমিরের রক্ত মাখা শার্টটা আঁকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদেছিল। বলেছিল, “আমি আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করব না, জয় আমির। যেমন ওরা পায়নি শেষ অবধি, আপনিও প্রকৃতির কাছে ক্ষমা পাবেন না অন্তত।ʼʼ

জয় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কাউকে জড়িয়ে ধরেনি সেদিন। জড়িয়ে নেবার সম্পর্ক তো নয় তাদের। অন্তূ হিংস্র হাতে জয়ের শার্ট খামছে ধরে বুকের ওপর কপাল ঠেকিয়েছিল। রক্তমাখা জয় আমির তখন বেসমেন্টের নষ্ট ব্যাটারীহীন ঘড়ির দিকে চেয়ে ছিল অপলক।

পরাগ জয়কে মারতে এলো। দৃশ্যটা দেখে আলতো হাসল। কবীর তার দিকে তাকিয়ে হাসল, এরপর বেরিয়ে গেল বেসমেন্ট থেকে।

জয়ের ফোন বাজছিল বিগত পাঁচ মিনিট ধরে। কবীর ফোন এনে দিলো। অন্তূর পাশে বসে একগ্লাস পানি দিয়ে বলল, “ভাবী, পানি খান। অল্প একটু খান। আপনার শরীর তো ভালো না এমনিই।ʼʼ

কল রিসিভ করতেই হামজার দারাজ গলা ভেসে এলো, “এই শুয়োরের বাচ্চা। কোথায় মদ গিলে পড়ে আছিস? হুশ থাকেনা?ʼʼ

জয় গম্ভীর হয়ে বলল, “এমনও তো হতে পারে, হানিমুন যাপন করছিলাম। জোয়ান ভাই বউ নিয়ে ঘুরতে এসেছে, আক্কেল নাই তোমার?ʼʼ

হামজা এই রসিকতায় আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল, “জানোয়ারের বাচ্চা, তোর আব্বারা দেখ মনেহয় এতক্ষণে পৌঁছে গেছে গাঙের কূলে।ʼʼ

শুধু রূপকথা থাকল সেখানে। সবাই বেরিয়ে পড়ল উল্টো পথ ধরে। পলাশকে পেছনের ছিটে শুইয়ে দেয়া হলো। পরাগ অন্য পথে গেল। জয় অন্তূ, কবীর ও পলাশ এক গাড়িতে গেল।

গাঙের কূলের রাস্তায় কোথাও কোথাও হাঁটু পানি। শ্মশানের পাড় ঘেঁষে পরিত্যক্ত এলাকা। এরপর শুধু ইটের ভাটা, মেল-কারাখানা এসব। রাত দশটাকে মনে হচ্ছে মাঝরাত। জনশূন্য পথঘাট। ধীরেধীরে ওরা আরও ভয়বহ এলাকার দিকে পাড়ি দিচ্ছিল।

কাঠের মিল অনেকগুলো এবার। আলোও কম সব ওদিকে। ঘন জঙ্গল, ও বিস্তর মাঠ। শনশনে মাঠ। অভিশপ্ত এক রাত। কবীরকে গাড়ি চালাতে দিয়ে পলাশকে জাগাতে চেষ্টা করল জয়।

গাড়ি এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে কোনো আশ্রয় খুঁজতে গেল জয়। এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলে বড়জোর আধাঘন্টার মধ্যে পুলিশের হাতে পড়তে হবে নির্ঘাত। কোনো বসতিতে ঢুকে পড়ার চেয়ে ভালো কাজ নেই এই মুহুর্তে।

সব মিল মালিকেরা দূরবর্তী। চৌকিদাররা পাহারায় আছে। পাহারা বাদ দিয়ে ঝোপে-ঝাড়ে গাঁজা টানতে বসেছে সব। এখানে বসতি নেই। বহুদূর পর পর বসত বাড়ির মতো। জয় কয়েকটা বাড়িতে গেল, কিন্তু ডাকতে দ্বিধা হলো। তার ওপর তার পরনের শার্ট-লুঙ্গি, মুখ-গলা রক্তে মাখামাখি। পিস্তল দেখিয়ে আশ্রয় আদায় করা ছাড়া উপায় নেই। পিস্তল বের করে তা মিছেমিছি লোড করল। বুলেট নেই কাছে। ম্যাগাজিনও খালি।

কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে একটা ছোট্ট টিনের বাড়ির সামনে গিয়ে ডাকল। একজন মহিলা বেরিয়ে এলো। অন্ধকারে কেউ কারও মুখ চিনছিল না। মহিলা ভেতরে আলো আনতে গেল বোধহয়। জয় হাত পিছমোড়া করে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা ডানহাতে রাখল। তার যা অবস্থা, তা দেখে যেকোনো মহিলা ভয়ে একটা কান ফাটানো চিৎকার পাড়বেই পাড়বে।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬২.

মুরসালীন ও হামজা দুজনেই অনেকক্ষণ কথা বলেনি সেদিন। বাচ্চারা জেগে উঠেছিল। ভয়ে ভয়ে এসে পানি খাচ্ছে কেউ কেউ। খুব পিপাসা তাদের। একটু মুক্তির পিপাসা, মায়ের কোলে ফেরার পিপাসা, দুনিয়ার আলো দেখার পিপাসা! এত পিপাসা থাকা ঠিক না। তবু ওরা পিপাসার্ত।

হামজা বলল, “দলের বহুত লোক জিম্মি তোমাদের কাছে। তাদের হদিশ দাও।ʼʼ

মুরসালীন চুপ। হামজা নিজেকে দমন করল। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বলল, “একই কথা বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, তুমি হচ্ছো না শুনে শুনে!ʼʼ

-“ফজরের আজান পড়ছে। নামাজ পড়ব।ʼʼ

হামজা বেরিয়ে এসেছিল।

ওদের হাত-পা বাঁধা নয়। কিন্তু সবাই আঘাতপ্রাপ্ত, ক্ষত-বিক্ষত। না হলেও ওই অবরুদ্ধ কুঠুরি ছেড়ে বেরোবার উপায় নেই। ওযু করে মুরসালীনের ইমামতিতে এক বদ্ধ দেয়ালের বেষ্টনিতে ফজরের নামাজ আদায় করল সকলে। নামাজ শেষে অনেকক্ষণ মোনাজাতে হাতে তুলে বসে রইল মুরসালীন।

ওকে বোঝা যায়না। গায়ে পাঞ্জাবী বা জুব্বা চড়ায় না। পরে জিন্স প্যান্ট, গালে সুন্নতি দাড়ি নেই, নেই কোনো ইসলামী লেবাস। দেখতে উচু-লম্বা আর্মিদের মতো। শুধু নামাজটা পড়ে। কথাবার্তা স্পষ্ট। বংশ পরম্পরায় এইটুকু ধর্মীয় আচার পেয়েছে বোধহয়, অথবা অন্যকিছু! জাতীয়তাবাদী দলের নেতাকর্মী আর জামায়াত একই জলীয় দ্রবণের মিশ্রণ তো!


সেইরাতে মহিলা যখন হারিকেন নিয়ে এসে দাঁড়াল, জয় দ্রুত সতর্ক করল, “চিৎকার করবেন না। আমি সাহায্য চাইতে এসেছি।ʼʼ

এরপর দুজনই চুপ। অবাক হয়ে দেখল দুজন দুজনকে। লতিফের স্ত্রী আসমা। মহিলা আতঙ্কে জড়িয়ে গেল। জয় ওদেরকে দেশের শেষ সীমান্তে চলে যেতে বলেছিল, নয়ত দেখা হলেই মেরে ফেলবে। ওরা জয়ের থেকে আত্মগোপন করেছে, কিন্তু জেলা ছাড়েনি। আজ কি খোঁজ পেয়ে জয় এসেছে!

জয় হাসল, “কথা রাখেননি, ভাবী। ভেরি ব্যাড।ʼʼ

আসমা কথা বলতে পারেনা। জয় বলল, “দরজা খোলা রাখুন।ʼʼ

সে গাড়িটাকে নিয়ে এসে টিনের ফটক খুলে উঠোনে ঢুকিয়ে রাখল। উঠোনটা ছোট। লতিফ ঘামছে। এখনও ক্রাচে ভর করেও ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। সমস্ত সম্পত্তির প্রায়টাই পায়ের চিকিৎসায় খরচা হয়ে গেছে।

কবীর ও জয় মিলে পলাশকে নামিয়ে বারান্দায় রাখল। মাটির ঘর, পাঠখড়ির বেড়া। পাশে টিনের কাঠের মিল।

জয় জিজ্ঞেস করল, “লতিফ ভাই, উডমিল কি আপনার নাকি?ʼʼ

লতিফের শরীরটা কাঁপছে। সে কোনোমতো ঘাঁড় নাড়ল। জয় বলল, “আপনার একটা ক্ষমার পথ আছে। মানে আমি কাউকে ফার্স্ট টাইম সেকেন্ড চান্স দেব।ʼʼ

আসমা পলাশের অবস্থা দেখে বমি করে ফেলল। এত বিদঘুটে জীবিত লা/শ সে দেখেনি আগে। দ্রুত ঘরে চলে গেল। সঙ্গে অন্তূকে নিয়ে গেল টেনে। জয় আমিরের স্ত্রী বলে কথা।

জয় বাড়ির সমস্ত আলো নিভিয়ে একদম স্বাভাবিক ও নীরব থাকার আদেশ দিলো সবাইকে। আপাতত আগামী তিন-চার ঘন্টা চুপ থাকতে হবে। পুলিশ রাস্তা দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই বিরান জায়গায় অথবা কোনো বসতিতেই সার্চ করে দেখবে না। প্রশ্নই ওঠেনা।

আসমা কিচ্ছু শুনল না। সকলের জন্য রান্না করতে গেল। অন্তূ গিয়ে বসল তার পাশে। বিভিন্ন কথাবার্তা হচ্ছিল। রান্নাঘরটা ভেতরে। অন্তূ সাহায্য করছিল। তার আসমাকে ভালো লাগছে। আসমারও তাকে চরম পছন্দ হয়েছে। অন্তূর ভেতরে শঙ্কা কাটছিল না, তবু সে স্বাভাবিক থাকতে চাইল। আজকাল এসব আর গায়ে লাগেনা।

জয় রাত আড়াইটার দিকে গোসল করে লতিফের একটা লুঙ্গি পরল। কবীর রাস্তার পাশে পেশাব করার ভঙ্গি করে আশপাশ দেখে এলো। কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। জয়ের উপস্থিত বুদ্ধিতে তার বুক গর্বে ফুলে উঠলো। কারণ সে জয়ের মতো চতুর লোকের বিশ্বাসভাজন লোক। পুলিশ কল্পনাও করতে পারবে না, ওরা এত কাছে এমন এক বাড়িতে উঠে আরাম করছে। পুলিশ হোক বা সাধারণ লোকও সবসময় এসব ক্ষেত্রে দূরবর্তী চিন্তা করে।

লতিফের মেয়ে জেগে উঠে জয়কে চিনতে সময় নিলো। সে হাসপাতালের সেই ক্ষণ ভোলেনি। জয়কে বলল, “এই তুমি আমাকে একটা মদার গেলা দেখাতে চাইছিলে না? এখন দেখাও?ʼʼ

জয় বলল, “তোমার আব্বু বোধহয় সেই খেলাটা পছন্দ করবে না, আম্মা।ʼʼ

-“কেন করবে না? আব্বু আমাকে খেলতে দেয়। কিতু বলে না। দেখাও।ʼʼ

জয় লতিফকে বলল, “ভাই, মেয়ে পিস্তলের খেলা দেখতে চায়। বাপ হিসেবে প্রাণটা উৎসর্গ করতেই পারেন। বাচ্চা মানুষের আবদার ফেলা ঠিক না।ʼʼ

তারপরই মনে পড়ল, তার কাছে এক্সট্রা বুলেট নেই, ম্যাগাজিন খালি। কিন্তু এই দূর্বলতা তো প্রকাশ করা যাবেনা। পিস্তল হতে পারে মানুষের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও কার্যকর সঙ্গী, হোক তার ভেতর ফাঁপা। দেখলেই লোক ডরায়।

রাত সাড়ে তিনটার পর পলাশকে কাঠের মিলে নেয়া হলো। পলাশের শ্বাস পড়ছে ধীরে ধীরে। লতিফ ঠকঠক করে কাঁপছে। তার চোখে-মুখে নিদারুণ আতঙ্ক। জয় যা করতে চাইছে, তা সুস্থ মানুষ দেখতে পারেনা।

সেদিন শেষরাতের দিকে লতিফের কাঠের মিলের উডওয়ার্কিং সারফেস মেশিন চালু করা হলো। যা দিয়ে শত শত বছরের হাতির মতো মোটা মোটা গাছ এক নিমেষে ফালা ফালা করে ফেলা হয়।

পলাশকে সেই মেশিনের ওপর শোয়ানো হলো। হাত-পা বাঁধা। জয় অপেক্ষা করল ওর চোখে-মুখে মৃ/ত্যু/র করুণ সেই অসহায় ভয়টা ফুটে ওঠার। পলাশ তো পাগল। তবু বোধহয় মৃত্যু বিষয়টাই এমন, যাকে-তাকে গ্রাস করে তার অন্ধকার গর্ভে।

পলাশের চোখের সেই কাতরানি জয়কে খুব শান্তি দিচ্ছিল।পলাশের দেহটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল চলন্ত ব্লেডের দিকে। চিইচিইই শব্দ হচ্ছে। কবীর ও লতিফ বেরিয়ে গেল।

সারা মেঝেতে ত্রিপল বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। রক্ত আঁটকে থাকতে পারে এমন সব যন্ত্র সরিয়ে নেয়া হলো।

পলাশ সেই চলন্ত উডকাটার ব্লেডের দিকে চেয়ে দেখল। সাথ সাথে চোখটা বন্ধ করল। হাতদুটো থেতলানো কিমা। হাড়ের সন্ধি নেই। ঝুলছে। সেই যন্ত্রণা ভুলে গেল সে। তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। তবে অদ্ভুত এক ভয় গ্রাস করেছে। তার এত ক্ষমতা, এত বড়াই! পলাশ নামে মানুষ থরথরিয়ে উঠেছে, এই তো ক’দিন আগের কথা।

সে মানুষের বসত জমি, ব্যবসার পয়সা, বউ, সন্তান, মেয়ে, দেশের সম্পদ কিছুই ছাড়েনি। মানুষ এভাবেই কাতরেছে। কত লোকই যে এই জীবনে তার নোংরা পা দুটো জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদেছে। কেউ প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে। কেউ বা বলেছে, ‘আর মারবেন না। আর মারবেন না। ওরে আল্লাহ!ʼ

পলাশ সেই সব আহাজারি শুনতে পাচ্ছিল। রূপকথার চিৎকারও কানে এলো। কী আশ্চর্য! কত মেয়ে হাতজোর করে সম্মান প্রার্থনা করেছে, তার খারাপ লাগেনি। মানুষ ভাতের চাল কেনার পয়সাটুকুও তার হাতে সঁপে দিয়েছে জানের ভয়ে। তারপর নিশ্চয়ই না খেয়ে থেকেছে! সামান্য মুদির দোকানিকেও যে ছাড়েনি পলাশ! মৃত্যুর ভয় এত তাদের? বোকা ওর। ওরা কি জানে, ওদের চেয়ে পলাশেরা কত কঠিন শাস্তির ভোগ করে বিদায় হয়! তা জানলে ওরা ভয় পেত কি?

সবচেয়ে বড় আশ্চর্য হলো পলাশ, সে সেইসব লোকের হাতে মরছে না। না, তারা তাকে শাস্তি দিচ্ছে না। আজব ব্যাপার! তার কাল আজ জয়। জয় আমির। যার নিজের পাপেরই অন্ত নেই। আর সে আবার শাস্তিকে ভয় পায়না।

প্রথমে পলাশের কোমড় সমান দুইভাগ হয়ে গেল। একভাগ দুটো পা ও কোমড়, অপর ভাগ পেট থেকে মাথা। গোসল করে বিশেষ লাভ হলো না। ফোয়ার মতো রক্ত ছুটছে চারদিকে। জয়ের গোটা দেহ ভিজে উঠল পলাশের র-ক্তে।

উপরের ধড়টাকে ঘুরিয়ে মেশিনের ব্লেডের নিচে দিলো। ছোট ছোট টুকরো হলে বহন করতে সুবিধা হবে। তার শুধু মাথা চাই। বাকিটা অপ্রয়োজনীয়।

দুটো হাত ও মাথা সহ মোট চার টুকরো হলো। বাকি টুকরো গুলো বিশাল এক পলিথিনে ভরে তারপর ছালার বস্তায় ভরল। মাথাটা আলাদা করে আরেক বস্তায় ভরে লতিফকে ডাকল।

হামজাকে কল করল। লোক দরকার। এরকম ভয়ানক কাজ কারা করতে পারবে, তাদের যেন পাঠায়। চর্বি, রক্ত, মাংসের টুকরো, শরীরের কত রকমের কী রক্তের সাথে মিশে মেশিনে পড়ে আছে। মেশিনটা খুলে ফেলে দিতে হবে। ত্রিপল উঠিয়ে ফেলল, গোটা ঘর পরিস্কার। ত্রিপলটাও ভাঁটার পুকুরে ধুয়ে আনলো কবীর। অন্ধকার থাকতে থাকতে সব করলে ভালো।

তা বোধহয় হবেনা। হামজা এখন লোক পাঠাবে না। সেটা ঝুঁকিপূর্ণ।

পরদিন সকালে নিজেই বেরিয়ে গিয়ে কোত্থেকে যেন বড় বড় ইলিশ কিনে আনলো জয়। ইলিশ মাছে তার জন্মের দূর্বলতা। লেজ ভর্তা, ইলিশ মাছ ভাজা, সেটাকে জ্বালিয়ে খাওয়া অথবা যেকোনো পদে তার ‘নাʼ নেই। ইলিশ মাছ খেতে খেতে তার নিজেকে খাঁটি বাঙালি মনে হয়।

খাওয়া দাওয়া করে অন্তূ কবীরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল জয়। বাকিটা হামজা সামলাবে। কবীরকে দিয়ে একটা ভালো এমাউন্ট লতিফকে দিলেই সে খুশি। রাজনীতি ছেড়েছে দায়ে পড়ে, ভেতরের সেই ছোটলোকি তো যায়নি!

গাড়ি উল্টোদিক থেকে ঘুরিয়ে দ্রুত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করল। যখন-তখন পুলিশ বাড়িতে হানা দেবে তাদের। সন্দেহের তালিকার সবচেয়ে আগে হামজা পাটোয়ারী ও জয় আমিরের নাম থাকবে। স্বাভাবিক। বাড়িতে এসে না পেলেই আইনের লোক দুই দুইয়ে চার মিলিয়ে নেবে।

ড্রাইভিং করতে করতে জয় গান ধরল,

আমি যত চাই আমার মনরে বোঝাইতে…
মন আমার চায় রঙের ঘোড়া দৌড়াইতে
ও পাগল মনরে, মন কেন এত কথা বলে…..

লতিফের লুঙ্গি প্রিন্টের। তার বিরক্ত লাগছিল। লুঙ্গি হবে সাদা। এসব প্রিন্ট কেন?


কাস্টডিতে বসে রূপকথার ভীষণ গরম লাগছিল। মাথার ওপরে স্পটলাইট জ্বলছে। তাতে অস্বস্তি বাড়ছিল। খানিক বাদে দুজন কর্মকর্তা এলো। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।

রূপকথার পিপাসা নেই। সে কক্ষের চেয়ারের টেবিলের মতো নির্লিপ্ত। অফিসার জহিরুল আলমগীর জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার স্বামী এখন কোথায়?ʼʼ

-“আমি জানিনা।ʼʼ

-“খুব কমন একটা জবাব। কানে পঁচন ধরেছে এই শব্দ দুটো শুনে শুনে। নতুন কিছু বলুন।ʼʼ

রূপকথা বলল, “আমি জানিনাʼ কথাটিকে নতুন আর কীভাবে বলা যায়, সেটা জানা নেই। জানা থাকলেও আপাতত মাথায় আসছে না।ʼʼ

-“খুব পেরেশানীর মধ্যে আছেন?ʼʼ

-“জি না। পেরেশানী কী? ভালোই তো লাগছে।ʼʼ

-“ভালোই লাগছে?ʼʼ

-“লাগছে।ʼʼ

-“লাগবে না বেশিক্ষণ। আর কিছুক্ষণ ‘জানিনাʼ বলতে থাকলে খারাপ লাগার কাছে নিয়ে যাব।ʼʼ

রুপকথা চুপচাপ। জহিরুল বলল, “পানিটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।ʼʼ

-“আমার খারাপ লাগছে না।ʼʼ

কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল জহিরুল। খানিক বাদে কক্ষে আরও কয়েকজন কর্মকর্তা এলেন। সাথে একজন মহিলা কনস্টেবলও। রূপকথার নির্বিকার, দুর্বোধ্য মুখখানাও সুন্দর। শাড়ির আচলটা চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে।

-“আমাদের কাছে খবর আছে, কুখ্যাত স-ন্ত্রা-সী পলাশ আজগর নিজের তৃতীয় আবাসে আমাদের দুটো অফিসারকে খু/ন করে পালিয়েছে, এরপর গাঙের পাড়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। আর সেখানে আপনি আগে থেকেই ছিলেন।ʼʼ

-“জি, খবরটা ঠিক।ʼʼ

-“আর আপনি বলছেন, আপনি জানেন না? আমরা কি বোকামির ফাণ্ড খুলে বসে আছি? ভালো কথায় জীবনেও আপনারা মুখ খোলেন না। তখন ক্যালানি দিতে হয়, আর লোকে বদনাম করে ডিপার্টমেন্টের। আপনি ওখানে উপস্থিত ছিলেন, আর আপনি জানেন না?ʼʼ

-“হ্যাঁ। যতক্ষণ সে ওই বাড়িতে ছিল, ততক্ষণ জানতাম। এরপর ও বাড়ি থেকে যখন পালালো, তখন তো আমাকে বলে যায়নি, সঙ্গে নিয়েও যায়নি। আপনারা আমাকে ওই বাড়িতে একা পেয়েছিলেন।ʼʼ

-“একা পাইনি, ম্যাডাম। আশপাশ থেকে কয়েকটা ছোঁকরাদেরও সাসপেক্ট করা হয়েছে। তাদের পরেই ধরি। আগে আপনারা জন্মের বাটপারি করে নেন।ʼʼ

-“বাড়িতে আমি ছিলাম। ছোঁকরাদের হিসেব আমার সাথে নেই, অফিসার।ʼʼ

-“তা ছিলেন। তার মানে এই নয় যে, আপনাকে বলে যায়নি।ঘরের বউকে বলে যায়নি।ʼʼ

রূপকথা হাসল। অবর্ণনীয় হাসির রেখা। উপস্থিত কর্মকর্তারা একে অপরের দিকে তাকাল রূপকথার সেই হাসিতে।

-“পলাশ আজগর এত বড় কুখ্যাত সন্ত্রাসী, তার মাথা খারাপ তো থাকার কথা না। সে এটুকু নিশ্চয়ই জানে, যত আপনই হোক, পুলিশের মার খেলে সবাই সত্যি কথা গড়গড় করে বলে দেয়। আমাকে বলার হলে আমাকে সঙ্গেও নিতো।ʼʼ

সকলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। জহিরুল খুব তীক্ষ্ণ সন্দেহীন চোখে চেয়ে বলল, “আপনি খুব শেয়ানা মহিলা। যুক্তির মারপ্যাচে পুলিশকে ঘোল খাওয়াতে চাচ্ছেন, অ্যা?ʼʼ

খুব উগ্র হয়ে উঠল অফিসার। রূপকথা চুপচাপ। জহিরুল ছোট দুটো অফিসারকে আদেশ করল, “রিমুভ হার টু রিমান্ড।ʼʼ

রূপকথা নির্দিধায় চুপচাপ সাথে চলল। তার চলনে উদ্বেগ নেই, ভয় নেই, চিন্তা নেই। মুখে কঠোর নির্লিপ্ততা। চোখদুটো ভীষণ জ্বলছে। জীবনের গড়মিলে হিসেবগুলো সামনে আসছে, মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা।

-“রূপ!ʼʼ

রূপকথা তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরাগ হাসল সামান্য, “ভালো আছিস?ʼʼ

পরাগের হাতে ব্যান্ডেজের ওপর হাতকড়ার পরানো হয়েছে। রূপকথাও হাসল, “ভালোই তো।ʼʼ

দুজনকে দুইদিকে নিয়ে চলে গেল কর্মকর্তারা। পরাগ একবার পেছন ফিরে রূপকথার নিঃশব্দ চলন দেখল। শাড়ির আঁচল মেঝের ওপর ছেঁচড়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে হাটিহাটি এগিয়ে যাচ্ছে রূপকথা। সে রাজন আজগরকে কত নিষেধ করেছিল, রূপকে পলাশের ঘরে বিয়ে না দিতে।


জয়দের আসনের এমপি সাহেবের ভাগনি বাপ্পী মণ্ডল। বিরাট নেতা। সে এলো বড়ঘরে। হামজা বিরক্ত হয়ে গেছে। হামজার বিরক্তি মানে আস্তে করে খালাস করে দেয়া। কখন জানি মেরে-টেরে ফেলে। কিন্তু হুট করে মেরে ফেললে স্বীকারক্তি কে দেবে?

হামজা জিজ্ঞেস করে, “তুমি হেফাজতে ইসলামীর সমর্থক, মুরসালীন?

-“আমি কিছুতেই খাঁটি নই, ভাই। আমি শুধু আপনাদের সমর্থক নই। আর এটা খাঁটি।ʼʼ

হামজা হাসল, “২০১৩ এর সেই রাজধানীর আন্দোলনে ছিলে না তুমি?ʼʼ

-“আমি ছিলাম না, মুস্তাকিন ভাই ছিল। জানেন তো, মুস্তাকিন ভাই হাফেজে কোরআন, আর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। আমি তো বেদুইন। আমি ওসব আন্দোলনে থাকব কেন?ʼʼ

-“আজ যা করছো, সেটা কী?ʼʼ

-“ওহ! এই বাচ্চাদের জন্য? কী করছি?ʼʼ

-“অনেককিছুই তো করছো।ʼʼ ক্লান্ত স্বরে বলল হামজা।

-“করলেও সেটা ওরা কওমী মাদ্রাসার ছাত্র অথবা জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত বলে নয়। ওদের জায়গায় যেকোনো বাচ্চারা থাকলেও আমার ব্যবহারে পরিবর্তন হতো না। তাছাড়া ওরা কোনো দলের সাথে সংযুক্ত নয়, অন্তত এই বয়সে। কেউ সাবালক নয় এখানকার। আপনারা জুলুম করছেন।ʼʼ

-“কী করছি?ʼʼ

মুরসালীন চুপ রইল। বাপ্পী মুখ খুলল, “জুলুম এখনও করিনি, মুরসালীন। করব। বিরোধী দলের একটিভ নেতাকর্মী তুমি।ʼʼ

-“তাতে কী? রাজনীতিতে কি বিরোধী দল থাকবে না? নাকি আপনারা একচ্ছত্র অধিপতিত্ব চান?ʼʼ

-“না, তা চাই না।ʼʼ

-“তাহলে তো হলোই।ʼʼ

-“তোমরা জঙ্গিবাদদের সাথে হাত মিলাইছো।ʼʼ

-“সে তো আপনারাও কত দলের সাথে মহাজোট করে ক্ষমতায় এসেছেন। আর এবার নির্বাচন ছাড়াই। এটাকে কীভাবে দেখেন?ʼʼ

বাপ্পীর মুখ লাল হয়ে উঠল। কষে এক ঘুষি মারল মুরসালীনের মুখে। ফাঁটা ঠোঁটে শুকনো ক্ষত তাজা হয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। মুরসালীন আলতো হাসে, সত্যি কথা নিতে পারেন না, এটা আপনাদের দলের সবচেয়ে বড় সংক্রামক ব্যাধি। সত্যি কথা কইতে গেলেই কারাবাস, খু/ন, গুম, মিথ্যা মামলায় ক্ষমতাচ্যুতি! খারাপই লাগে আপনাদের অবস্থা দেখলে।ʼʼ

আর কে ঠেকায়। বৃষ্টির মতো মার পড়ল মুরসালীনের গালে। তখন মুরসালীনের হাত-পা বাঁধা। রক্তাক্ত হয়ে উঠল গোটা মুখটা। দাঁত নড়ে গিয়ে মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে। হামজা থামালো, “পাগলামি করিস না, বাপ্পী। কিছুই হবেনা এতে। বড়জোর জ্ঞান হারাবে, সময় নষ্ট হবে। কথা বলতে থাক।ʼʼ

বাপ্পী বকে উঠল, “খানকি মাগীর চেংরা। তোরা মারোস নাই আমাগোরে? আমাদের ছেলেরা তোদের হাতে জখম হয়, খুন হয়। শুয়োরের বাচ্চা! সেসব হিসেব রাখোনা, মাগীর পুত।ʼʼ

মুরসালীন রক্তাক্ত মুখে চমৎকার হাসে। দেখতে অদ্ভুত লাগে। বলে, “এক পীর আর তার মুরীদ একবার ডালিম খাচ্ছিল। দেখা গেল, মুরীদের সামনে ডালিমের অনেক বীজ জড়ো হয়েছে। পীর ঠাট্টা করে বলল, ‘ওহে, বৎস। এত ক্ষুধা তোমার? এতটা ডালিম খেয়েছ?ʼ

মুরীদ তাকিয়ে দেখল, তার পীরের সামনে কোনো বীজ পড়ে নেই। মুরীদ হেসে বলল, ‘হুজুর, আমি ডালিম খেয়ে তাও বীজ রেখেছি। আপনি তো বীজও ফেলেননি যে, গুণে দেখা যাবে, কতটা ডালিম খেলেন। ক্ষুধা কি হুজুর আমার বেশি?ʼʼ

মুরসালীন হাসল, “আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা? আমাদের ছেলেরা যখন অত্যাচারিত হয়ে মরে আপনাদের হাতে, তখন ওদের মরদেহর হদিশটুকুও পাওয়া যায়না যে গুণে দেখব, কতগুলো মরল। অথবা তা দেখিয়ে আইনের কাছে বিচার চাইব বা মানুষের কাছে সিমপ্যাথি। কিন্তু আমরা মারলে তার একেকটা খামছিও দেশবাসীকে দেখিয়ে সমর্থন কামাচ্ছেন…ʼʼ কথা শেষ না করে হাসল মুরসালীন।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা মুর্তজা

৬৩. (প্রথমাংশ)

লুঙ্গির নিচে একটা আন্ডার-প্যান্ট পরা দরকার। কিন্তু জয় আমির জীবনে আন্ডার প্যান্ট কেনেনি। হামজা থাকতে সে আন্ডার প্যান্ট কিনবে কেন?

রাত সাড়ে বারোটা মতো বাজে। হামজা কিছু কাগজপাতি দেখছিল। কোয়েল পাশে বসে এটা-ওটা নাড়ছে, আর ঝগড়া করছে হামজার সাথে। আজকাল হামজা তাকে বেশ সময় দেয়। হামজার সাথে কোয়েলের মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। তেতো সম্পর্ক ছিল জয়ের সাথে। বলাই বাহুল্য জয়ের সাথে মিষ্টি সম্পর্ক গড়া যায়না।

-“সাহেব!ʼʼ

হামজা মাথা না তুলে বলল, “হু।ʼʼ

-“আপনার জাইঙ্গাটা খোলেন তো ভাই, তাড়াতাড়ি করেন।ʼʼ

হামজা গম্ভীর মুখে তাকালো, “মাল খেয়েছিস? তারতুর কেটে গেছে মাথার?ʼʼ

-“তার কাটা, ঠিক। তবে মাল খাই নাই। ফিরে এসে খাবো। এখন খালি আপনার জাইঙ্গাটা দরকার। ধার দ্যান। ফিরে এসে ফেরৎ দিচ্ছি।ʼʼ

হামজা ধুপ করে একটা লাত্থি মারল ঠ্যাংয়ের ওপর। ল্যাং খেয়ে পড়ে গিয়ে আবার উঠে জয় তাড়া দিলো, “খোলো, ভাই। জলদি খোলো। লুঙ্গির নিচে জাইঙ্গা না পরলে বেইজ্জতি হবার চান্স থাকে রাস্তাঘাটে।ʼʼ

কোয়েল বলল, “তুমি কোথায় যাবে, জয়? সেদিন আমাকে নাওনি। আমি যাব।ʼʼ

-“কবরে যাব। চল যাই। মিড-নাইট ডেটিং সেরে আসি।ʼʼ

-“কবরে কি দোলনা আছে? আমি দোলনায় উতবো।ʼʼ

-“আছে। সেইসাথে তোর আব্বাও আছে। সকাল বিকাল দুলতেছে ওইখানে। চল বেইমান, সাক্ষাৎ করে চা-পানি খেয়ে আসি। মজ্জাই মজা ওইখানে।ʼʼ

কোয়েল কান্না জুড়ে দিলো। সে কবরে যাবে। বাবার সাথে দেখা করতে যাবে।

তুলি এসে ঝারা মেরে মেয়েকে নিয়ে বলল, “বেলেহাজ কেন তুই এত? ধর্ম আর সৃষ্টিকর্তাকে একটু ভয় কর।ʼʼ

জয় মুখ বিকৃত করল, “সৃষ্টিকর্তা? কীসের সৃষ্টিকর্তা? আমার তো কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। দেয়ার ইজ নো গড, ফাকিং অনলি আই এম মাই ওউন গড অ্যান্ড ক্রিয়েটর। আদারওয়াইজ নো ওয়ান ইন দ্য স্কাই।ʼʼ

তুলি গর্জে উঠল, “চুপ্প! নাস্তিক। বাজে কথা না বলে বের হ তো। তোর কথা শুনলে গা জ্বলে আমার। তোর মতো শয়তানের আবার সৃষ্টিকর্তা কী? তুই তো বহিষ্কৃত।ʼʼ

জয় হো হো করে হাসল। তুলি দাঁত খিঁচে বলল, “তোর সৃষ্টিকর্তা নেই, না?ʼʼ

-“তোদের থাকলে থাকবে হয়ত। কিন্তু মূলত ওসব কিছুই থিউরেটিক্যালি অর প্রাকটিক্যালি কোনোভাবেই নেই। নয়ত মানুষ এত ডাকে এত ডাকে…..হা হা হা! নো হ্যাজ এনি রিলিজিয়ন অর ক্রিয়েটর ইন দ্য হোল ইউনিভার্স, সুইটহার্ট! ওসব আল্লাহ-বিল্লাহ কিছু হয়না।ʼʼ

-“চুপ কর জয়। এই! যদি তোর সৃষ্টিকর্তা না থাকে, তোকে পয়দা কে করেছে? নিজে নিজেই এতবড় দামড়া শয়তান হয়েছিস? তুই নিজে নিজে জন্মেছিস?ʼʼ

জয় হাসল, “উহু, বাপ! তুই তো রেগে যাচ্ছিস! আমাকে জন্মেছে আমার বাপ-মা। এ পর্যন্ত ওদের দায় শেষ। এরপর বাকিটা তোর ওই পয়দা বল আর এত বড় দামড়া হওয়া বল, ওটার ক্রেডিট আমার যায়, আমার আমার। জয় আমিরের।ʼʼ

-“তুই নাস্তিক হয়ে কী পেয়েছিস? কী আছে তোর? অন্তত ধর্মবিশ্বাসটুকু রাখতি জীবনে! ফাঁটা বাঁশ।ʼʼ

-“তোরা আস্তিক হয়ে কার বাল লাড়ছিস? তোর কী আছে?ʼʼ

-“তুই নাস্তিক হয়েও তো কিছু পাসনি!ʼʼ

-“আমার বিশ্বাসও নাই, পাওনাও নাই। সিম্পল হিসেব বোঝো না, শালীর মেয়ে? অথচ তোরা বিশ্বাস রেখেও পাসনা কিছু তোদের সেই আল্লাহর কাছে, এটা দুঃখজনক, উহ! আমি কারও উপাসনা করিনা, এবং কারও কাছে আবেদনও না। কোনোকিছুর জন্যই না। জয় আমির ইজ দ্য আলটিমেট।ʼʼ

তুলি রাগে কিছু বলতে পারল না। জয় হাহল, “হি হ্যাজ নো ওউনার, হি ইজ দ্য ওউনার, ডিয়ার!ʼʼ

তুলির মানসিক অবস্থা কেমন যেন হয়ে গেছে। দিনের পর দিন বোবার মতো চুপ থাকে। আর যদি কিছু বলেও, সেটাতে শুধু ক্ষিপ্ততা ছাড়া কিছু থাকেনা। মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে গেছে পুরো। রিমি কতদিন ওকে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে কাঁদতে দেখেছে সেসবের পর!

তুলি এবার চিৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। হামজা দারাজ গলায় ধমকে উঠল। পুরো বাড়ি ঠিক ঝড়ের আগের নীরবতার মতো থমকে উঠল। রিমি দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো। অন্তূ ঘরের দরজায় দাঁড়াল, সিঁড়িঘর থেকে কবীর ভেতরে এসে দাঁড়াল। তুলি পা ঝারা মেরে মেয়েকে নিয়ে রুমে চলে গেল।

জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ভাবী! একটা ফ্রেশ জাইঙ্গা এনে দ্যান তো। শালার জাইঙ্গার ধার করতে এসে কেলেঙ্কারী হয়ে গেল।ʼʼ

লুঙ্গির নিচে আন্ডার প্যান্টটা পরল। এগিয়ে এসে অন্তূকে দেখে ভ্রু কুঁচকে মাথা থেকে পা দেখল। এরপর বলল, “হোয়াট হ্যাপেনিং, সিস্টার? এমনে তয়-তৈয়ার হয়ে খাড়ায়ে আছো ক্যা?ʼʼ

-“আব্বুর কবর জিয়ারত করতে যাব।ʼʼ

হামজা এসে দাঁড়াল, “জয়, তুই কবীরকে নিয়ে বেরিয়ে যাব।

অন্তূ গলায় জোর দিয়ে বলল, “আমি যাব।ʼʼ

হামজা শান্তস্বরে জয়কে বলল, “যা যা। দেরি হচ্ছে তোদের।ʼʼ
-“মেয়র সাহেব!ʼʼ

হামজা তাকাল। অন্তূ শান্তস্বরে বলল, “আমি আব্বুর কবর জিয়ারত করতে যাব।ʼʼ

অন্তূ এক ভ্রু উচায়, ঘাড়টা কাত করে, “ওরা কবরস্থানে যাচ্ছে?ʼʼ

-“হ্যাঁ, মেয়র সাহেব। ওরা কবরস্থানে যাচ্ছে।ʼʼ

গলাটা ভরাট হয়ে এলো হামজার, “তাতে কী?ʼʼ

-“কিছু না তো। আমি সঙ্গে যেতে চাই।ʼʼ

হামজা হাসল, “আমি চাই না।ʼʼ

অন্তূ আগের চেয়ে নিচু গলায় বলল, “আর এজন্য হলেও আমি চাই, মেয়র সাহেব। অন্তত পলাশ আজগরের ধড়হীন মাথাটা দাফন হবার সময়ে সেই স্থানের খুব কাছাকাছি থাকার জন্য হলেও যেতে চাই। ওর শেষকৃত্যের সহযাত্রী হতে চাই। আবদারটুকু পূরণ করুন, মেয়রসাহেব। আপনি তো জনদরদী, সেবক!ʼʼ

দুজনের দুর্বোধ্য এক দৃষ্টি বিনিময় হলো। সেই দুই জোড়া চোখে আগুন জ্বলছে। ভিন্ন সেই আগুনের জ্বালানি। কারোটা কাঠখড়ি, কারোটা পেট্রোলিয়াম। কারোটা প্রজ্জ্বলন, কারোটা দহন। সেই আগুন চোখে চেয়ে হামজা যখন আলতো হেসে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করল, দেখতে ভয়াবহ লাগল।

অন্তূ তা অগ্রাহ্য করে মাথার চওড়া ওড়নাখানি কপাল অবধি টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল জয়ের পেছনে।

পলাশের মাথাটায় পঁচন ধরেছিল। গরমের কাল। তার ওপর বস্তায় বাঁধা ছিল একদিন। খাদেম দাঁড়িয়ে কাঁপছে। ছোট্ট একটা শাবল দিয়ে মাটি খুড়ছে জয় তরুর কবরের পাশে। কবীর বস্তা হাতে দাঁড়িয়ে।

অন্তূ ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে সেদিন আব্বুর জন্য দোয়া করেছিল, কিন্তু কাঁদেনি। আব্বুর সাথে কথা বলল, তবু কাঁদল না। আব্বুর কবরটা ডানপাশের সাড়িতে। তরুরটা অপর পাশে। সেই কবরের ডানপাশে জয় পলাশের মাথাটা পুঁতলো।

অন্তূর আব্বুটা নেই। ডাক্তার বলেছিলেন, পলাশ যেভাবে থেতলে মেরেছিল আমজাদ সাহেবকে, তাতে করে পরে সেসব দুষিত রক্ত জমে টিউমার এবং তা থেকে ক্যান্সার হবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। অন্তূ খেয়াল করল, তার যন্ত্রণা হচ্ছে না। কবরের ফটক ধরে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে দেখল জয়ের দক্ষ হাতের দাফনকার্য। অন্তূর মা কাছে নেই, ভাবী অন্তঃসত্ত্বা। সে পড়ে আছে এক কারাগারে। সে যতই গলাবাজি করুক, সে আছে খু-খার অধিপতিদের হাতের থাবার নিচে। তবু অন্তূর কোনো দুঃখ নেই। একটুও কষ্ট লাগছে না।

জয় সারা দেহে মাটি মেখে এসে দাঁড়াল। অন্তূ কাঁদছে না। তার মুখে একফোঁটা কাতরতা নেই। জ্বলজ্বল করছে মুখখানি। এখনও চেয়ে আছে পলাশের মাথার কবরের দিকে।

জয় ডাকল, “ঘরওয়ালি!ʼʼ

অন্তূ তাকাল, “হু! কাজ শেষ? যাব আমরা?ʼʼ

-“থাকবে নাকি?ʼʼ

-“বেশ তো লাগছে।ʼʼ

জয় হাসল। অথচ তার খেয়াল অন্তূর নির্লিপ্ত মুখটার দিকে। তাতে সন্তর্পণে ফুটে আছে অদ্ভুত হাসি। এই অন্তূ কেমন যেন। শুধু প্রতিবাদী অন্তূ বোধহয় সরল ছিল। সেই প্রতিবাদের সাথে এখন কী যুক্ত হয়েছে? আগেরবারও এখানে এসে অন্তূ পাগলের মতো কেঁদেছে।

ফটকের বাইরে বিশাল পুকুর। তরতরে পানি। আকাশে চাঁদ নেই। কালো হয়ে আছে। দুজন গিয়ে পুকুরপাড়ে বসল। কবীরকে জয় বলল, “বাড়ি গিয়ে কড়কড়া একখান ঘুম দে। যা।ʼʼ

-“আপনাকে রেখে কেমনে?ʼʼ

-“ওরে শালা! শোন কবীর, ইমানদাররা পেছন মারা খায়, মনে রাখিস।

কবীর হাসে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। অসীম দূরত্ব দুজনের মাঝে। এই দূরত্বের অস্তিত্ব অদৃশ্যে। আর এই যে দৃশ্যমান নৈকট্য, তা অস্তিত্বহীন।


চেয়ারের সাথে মাথাটা হেলে পড়ে ছিল রূপকথার। মহিলা কনস্টেবল এসে থুতনি চিপকে ধরে সোজা করে দিলে আবারও পড়ে গেল। চুলের কয়েকগাছি উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। ডানহাতের তিনটে ও বাঁ হাতের দুটো নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। রড দিয়ে পেটানো হয়েছে। অকথ্য গালিগালাজও করা হয়েছে। সেসব শুনলে কোনো সুস্থ মানুষ চুপ থাকতে পারেনা। রূপকথা আরাম করে শুনেছে সেসব।

মামলাটা যা-তা নয়। শীর্ষস/ন্ত্রা/স পলাশ আজগরের স্ত্রী। এত মার খেয়েও মুখ খোলার নাম নেই। পাথরের মূর্তির মতো চুপ থাকে। পুলিশগুলো অবাক হয়ে গেল। মেয়ে মানুষ এমন হয়না।

প্রতিটা আঘাতে রূপকথা চোখ বুজে ফেলে। দেখে মনেহয় যেন কিছু অনুভব করছে, কিছু মেলাচ্ছে।

রূপকথা পলাশের করা আঘাতের সাথে পুলিশের আঘাতগুলোর তুলনা করেছে। এখনও অবশ্য বুঝতে পারছে না, কোনটা যন্ত্রণাদায়ক বেশি। তার মনে হচ্ছে, পলাশেরটা। কারণ পলাশ আঘাত করলে সে চিৎকার করতো, কাঁদতো, পলাশের কাছে মুক্তি ভিক্ষা চাইতো। পুলিশ মারছে, তার চেঁচাতে বা কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। অলস লাগছে খুব। আঘাতগুলো বিশেষ কিছু লাগছে না।

অন্তূ একবার বলেছিল, আমজাদ সাহেব বলতেন, ‘ব্যথার ওপর ব্যথা দিলে আর ব্যথা লাগেনা। ব্যথাহীন হবার শর্ত হলো, ক্রমাগত ব্যথা পেতে থাকা ততক্ষণ, যতক্ষণ না ব্যথাটা আর ব্যথার মতো অনুভূত না হয়।ʼʼ

তার কি আবার তাই হলো? সে ব্যথাহীন হয়ে গেছে? আশ্চর্য আরেকটা বিষয় আছে। তার মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে রাজন আজগরের কন্যা হওয়ার খাতিরে। কারণ বাংলাদেশের আইন সক্রিয় হয় পাপীর ধ্বংসের পর।

যতদিন পাপী পাপ করতে পারে, করুক না। দোষ কী! শুধু শুধু পাকরাও করে পরিশ্রম করা, আর শরীরের ক্যালরি খরচা। এটা বাংলার আইনের বিধান। যখন পাপী মরে যায়, অথবা দূর্বল হয়ে পড়ে, তখন তার পাপের মাল বাজেয়াপ্ত করা থেকে শুরু করে সব রকম আইনি পদক্ষেপ নেয়া শুরু। স হিসেবে রূপকথার এখন ফাঁসি হতে পারে। রাজন আজগরের সম্পত্তি ও কালোধান্দা সবটা নিয়ে চরম তোলপাড় তদন্ত শুরু হয়েছে।

রূপকথার মৃত্যুকে ভয় লাগছেনা। সে শুধু সময় কাটাতে চাইছে, যাতে ততটা সময়ে জয় পলাশকে ফুরিয়ে সবটা কাটিয়ে উঠতে সুযোগ পায়।

চেয়ারের একদম ওপরে স্পটলাইট। অফিসার বারিক সামনে এসে বসলেন, সেখানে অন্ধকার। রূপকথার ব্লাউজের হাতাটা ফেঁড়ে গেছে। ফর্সা দেহে চামড়ার নিচে রক্ত জমাট বাঁধা কোথাও, তো কোথাও চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে শুকিয়েও গেছে।

সেই রক্তাক্ত খোলা দেহের দিকে বারিক লালসার চোখে চেয়ে রইল। মুখটা বিশ্রীভাবে আঘাতপ্রাপ্ত, তবু সুন্দরী তো রূপকথা। বারিকের ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো। এটা পাপ নয়। রিমান্ডের থার্ড ডিগ্রি টর্চারে নারী কয়েদিদেরকে ধ-র্ষ-ণের নজিরও আছে। ওসব কোনো ব্যাপার না। সব জায়েজ।

বারিকের আদেশে লোহার একটা রড গরম করে আনা হলো। বাহানা করে রূপকথার ছেঁড়া ব্লাউজটা আরেকটু ফেঁড়ে আচল নামিয়ে দিলো। লোহার রড গরম হয়ে আগুনের হল্কার মতো লাল টকটকে হয়ে গেছে। তা রূপকথার চামড়ায় ঠেকাতেই ছ্যাঁত করে শব্দ হয়ে নরম চামড়াটা গলে গেল। রূপকথা একটু আর্তনাদ করে ওঠে দাঁতে দাঁত চাপে। এরপরের ছ্যাঁকাটা রূপকথার বুকের স্পর্শকাতর নরম অংশে ঠেকানো হলো।

রূপকথা হাসল। লোকে শুধু পলাশদের দোষ দেয়। বোকা বাঙালি। কত পলাশ আইনরক্ষাকারীর ইউনিফর্ম পরে জীবন কাটাচ্ছে, তার খবর বোকা বাঙালি রাখবে? বারিক কি পলাশ নয়? উমমম, ভাবনায় পড়ল রূপকথা। বারিক বোধহয় পলাশের চেয়েও খারাপ! পলাশ তো পাগল, পলাশ তো খারাপ, খারাপই। কিন্তু বারিক?

রুপকথার বুকের মাংস অনেকখানি ঝলছে গলে গেল। হাতের বাহুতে গর্ত তৈরি হলো মাংস ক্ষয়ে। জ্ঞান হারিয়ে চেয়ারে হেলে পড়ল। উচিত ছিল মেঝেতে লুটিয়ে পড়া। পড়ল না। হাত-পা কাঠের চেয়ারে বাঁধা।

বারিক বিরক্ত হলো। এখন আবার হাসপাতালে সরাতে হবে। কাজের কাজ হলো না। কোনো তথ্য দিলো না।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৩. (বর্ধিতাংশ)

বিয়ের কমবেশি ছয়মাস পর অন্তূ প্রথমবার হামজার কাছে ভার্সিটি যাবার অনুমতি পেয়েছিল। একদিন জয় সঙ্গে নিয়ে কিছু বই কিনে দিয়েছিল, আর এরপর আবার।

অনুপস্থিতি ও বিস্তর পড়ালেখার ঘাটতি পড়ে গেছে। জয় কোথাও গেছে। তার কত কাজ থাকে চারদিকে!

কবীর ড্রাইভিং করতে করতে হঠাৎ-ই বলল, “ভাবী!ʼʼ

-“হু।ʼʼ

-“একটা কথা।ʼʼ

-“বলুন।ʼʼ

-“আপনে কি আমারেও ঘেন্না করেন?ʼʼ

-“আর কাকে কাকে করি?ʼʼ

কবীর থতমত খেলো একটু, পরে বলল, “জয় ভাইয়ের ওপর আপনার ঘেন্না আছে। আমি জানি।ʼʼ

-“ভুল জানেন।ʼʼ

কবীর চকিতে পেছন ফিরে তাকাল। অন্তূর অভিব্যক্তি নির্লিপ্ত।

-“আপনি খুব অদ্ভুত।ʼʼ

-“তাই নাকি?ʼʼ

কবীর আবার তাকাল একবার। অন্তূ বলল, “সামনে তাকিয়ে ড্রাইভিং করুন। নয়ত দুজনেই সোজা পরকালে পৌঁছে যাব।ʼʼ

কবীর একটু লজ্জিত হাসল, “আমি কত বেয়াদবী করছি আপনের সাথে।ʼʼ

-“ও কিছু না। ক্ষমতার দাপটে কতকিছু করে লোকে। ওসব আমাদের ধরতে আছে নাকি? ধরে কত খেসারত গেল, দেখেছেন? আপনি কিছু করেন নি, করেছে আপনার ক্ষমতা। আর আপনার ক্ষমতা কী, কে জানেন তো!ʼʼ

কবীর অবাক হয়ে যাচ্ছিল নতুন করে। এই নারীটির জন্য তার খারাপ লাগে, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত, তবু সত্যি। যেদিন জয় নারীটির সম্মানকে মানুষের মাঝে হরির লুটের মতো বিলিয়ে দিচ্ছিল, সেদিনও কবীরের এক অদ্ভুত জ্বালা উঠেছিল বুকে। আবার এটাও সত্যি সে জয়কে অন্ধের মতো ভালোবাসে। কিন্তু জয় খারাপ কাজ করলে তার খারাপ লাগে, তবু বাঁধা দেয়না।

ভার্সিটির ফটকের সামনে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত এলো কবীর গাড়ির দরজা খুলে দিতে। অন্তূ নিজে দরজা খুলে নেমে বলল, “এসব আনুষ্ঠানিকতা দেখাবেন না আমার সঙ্গে। আমি বিশেষ কেউ নেই। আগে যেই ভার্সিটি পড়ুয়া এক সাধারণ মেয়ে ছিলাম, আজও তাই আছি। কোনো পাপীষ্ঠর ঘরের বউ হওয়াটা সম্মানের নয়।ʼʼ

কবীর মাথা নিচু করে আস্তে করে বলল, “আমি ক্লাস শেষে নিতে আসব।ʼʼ

-“আসবেন।ʼʼ

অন্তূ ভেতরে চলে গেল। কবীরকে দেখে ছেলেরা এগিয়ে এলো, জয় আমিরের খোঁজ চাইল। কবীর তাকিয়ে দেখল অন্তূকে।


পরাগের সামনে চারজন কর্মকর্তা বসা। দুজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। আজিম মালিথা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ভাইয়ের প্ল্যান কী ছিল?ʼʼ

-“আউটডোর।ʼʼ

-“দেশের বাইরে আছে?ʼʼ

-“না। প্লান তাই ছিল।ʼʼ

-“তাহলে এখন?ʼʼ

-“বেঁচে নেই হয়ত।ʼʼ

একে অপরের দিকে তাকাল, “বেঁচে নেই মানে?ʼʼ

-“মানে মরে গেছে।ʼʼ

-“ইয়ার্কি মারছেন?ʼʼ

পরাগ হাসল, “রিমান্ডে বসে কেউ ইয়ার্কি মারে না।ʼʼ

-“ওকে মেরেছে কে?ʼʼ

-“তা তো বলতে পারি না।ʼʼ

-“পারেন না? পারবেন, পারবেন। কত না পারা-পারা হয়ে যায় এখানে।ʼʼ

পরাগ চুপ রইল।

-“তাহলে এটা কীভাবে বলতে পারেন, বেঁচে নেই।ʼʼ

-“না থাকারই কথা।ʼʼ

-“আপনি সিওর?ʼʼ

-“ওরকমই।ʼʼ

হাসল কর্মকর্তারা। আজিম অদ্ভুতভাবে মাথা দোলালেন, “মানুষ যেকোনো বিষয়ে দুই শর্তে নিশ্চিত থাকে। এক, সে ঘটনাটা নিজে চোখে দেখলে। দুই, কাজটা সে নিজে করলে।ʼʼ

পরাগ নির্বিকার বসে রইল। আজিম হাসল, “আপনার ক্ষেত্রে প্রথমটা হবার চান্স নেই। কারণ আপনি সেই রাত থেকেই আমাদের হেফাজতে। হাত থেকে রক্ত পড়া অবস্থায় আপনাকে আঁটক করা হয়েছে। এখন বাকি থাকে দ্বিতীয়টা।ʼʼ

-“পলাশ আজগরকে আমি মেরেছি?ʼʼ

-“সেটা তো আপনি বলবেন আমাদের।ʼʼ

“না, তা বলব না।ʼʼ

-“কেন?ʼʼ

-“মিথ্যাচার হবে।ʼʼ

উঠে দাঁড়ালেন আজিম, “নাটক পছন্দ না আমাদের। হেঁয়ালি শোনার চাকরি করিনা আমরা।ʼʼ

পরাগ হাসল, “এমন আরও কত কিছুই করেন, যেসবের চাকরি করেন না আপনারা। বরং সেসব চাকরির দায়িত্বের বিরোধ। এটাও শুনুন নাহয়, স্যার। ভালোই তো।ʼʼ

পরাগের ঘাঁড় বরাবর একটা বুটের লাত্থি পড়ল। মনে হলো, গলার কোনো শিরা বুঝি ছিঁড়ে গেছে। চোখ অন্ধকার হয়ে এলো।

-“যা জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তার জবাব দে, বাইঞ্চোদ।ʼʼ

পরাগ অল্প হাসল। দাঁত নড়ে গেছে কয়েকটা। মাড়ি ফেটে নোনতা রক্তে গাল ভরা। গিলতেও ঘেন্না লাগছে। তবু গিলে ফেলে হাসল, “ওকে মারার কারণ ছিল আমার কাছে, তবে আমার থেকেও জোরালো কারণ থাকা মানুষের তো অভাব নেই পলাশের। তাই আমার চান্সটা মিস গেল।ʼʼ

-“ঘরের শত্রু বিভীষণ। তোর মতো ছোট ভাইয়েরা কি জন্মায়ই রাবনদের পেছনে আঙুল দেবার জন্য রে?ʼʼ হাসল ওরা।

পরাগ মাথা নিচু করে আলতো হাসল। তা দেখা গেল না। থুহ করে থুতু ফেলল। থুতুর সাথে র-ক্তের ভাগ বেশি। চুল মুঠো করে ধরে মুখ তুলল অফিসার। ঘাঁড়টা মট করে উঠল পরাগের।

অফিসার বলল, “চান্স মিস যায়নি। হয়ত তুই হাতে মারিসনি, কিন্তু মার্ডারারকে সার্বিক সহায়তা তো করতে পারিস? কে মেরেছে, তার নাম বল। যে মেরেছে, সে-ই সেদিন পলাশকে উদ্ধার করেছে। এখন বুঝতে পারছি, সেদিন ওগুলো পলাশের লোক ছিল না। ওরই শিকারী ছিল। আমি নিশ্চিত, এমনই হয়েছে।ʼʼ

পরাগ মনে মনে প্রশংসা করল কর্মকর্তার আন্দাজ ও বুদ্ধির। তবু আফসোস। এই রকম বুদ্ধি জায়গামতো প্রয়োগ করেনা।

পরাগকে চুপ থাকতে দেখে হতাশ শ্বাস ফেলে ক্লান্ত হয়ে বসল অফিসার। প্লাস তুলে নিয়ে পরাগের ডান হাতের তর্জনী আঙুলে ঠেকিয়ে বলল, “বলে দে। টর্চার করার বিশেষ শখ নেই আমাদের। সেদিন দুজন কর্মকর্তার স্পটে মৃত্যু হয়েছে। শুধু নামটা বল। ধরে গরম তেলে ভাজবো, ওই বাস্টার্ডের বডিটারে।ʼʼ

পরাগ চুপ। নখের মাথায় প্লাস বাঁধিয়ে একটানে নখটা তুলে আনলো আঙুলের মাথা থেকে। আর্তনাদ করে উঠল পরাগ। শরীরটা বেঁকে এলো। এর চেয়ে মরণ ভালো। শরীরের যন্ত্রণায় মাথাটা ঝিমিয়ে আসছে। তার মা-টাকে পলাশ কোথায় যেন লুকিয়েছে। ভয় ছিল, পুলিশের কাছে সব গটগটিয়ে বলে দেবে। পরাগের চোখের সামনে ভেসে উঠল সালমার মুখটা।

সে মাকে ভালোবাসে খুব, এমন নয়। তবে মা তাকে ভালোবাসে। যখন পরাগ মুস্তাকিন বনেছিল, তখন রোজ কল করে খবর নিতো, ঢাকায় থাকতেও তাই। সে যখন পলাশের পাপের দায়ে জেল খেটেছে, সালমার অনুরোধে রাজন আজগর জামিন করেছিল পরাগের।

অফিসার বলল, “যাহ, তুই মনে মনেই তার নামটা নে। আমি শুনে নিচ্ছি। বল, উচ্চারণ কর তো একবার। কর কর। দেখি তোর মনের কথা শুনতে পাই কিনা!ʼʼ

পরাগ চোখ বুজে অল্প হাসে। মনে মনে বারবার উচ্চারণ করে, “জয় আমির, হামজা, জয় আমির, জয় আমির, হামজা, হামজা, হামজা…ʼʼ

অফিসার এবার নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করল। আলপিন দিয়ে পরাগের নখের ভিতর এলোমেলো খোঁচা দিতে লাগল। নখের নিচের মাংসের সাথ থেকে আলাদা হয়ে উঠেছিল নখগুলো। রক্তে ভরে উঠল হাতটা পরাগের। এতে সে অজ্ঞান হবেনা বোধহয়, মরবে না, তবে প্রতি মুহুর্তে মরবে।

-“নাম বল।ʼʼ

পরাগ নিশ্চুপ। পরাগকে সেলের ছাদের হ্যাঙ্গারে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। এক মুহুর্তে সমস্ত দেহের রক্ত মাথা মুখে ভর করল। শ্বাস নিতে পারা যায়না এ অবস্থায়, হৃদযন্ত্রে র-ক্তের ঘাটতি, অক্সিজেনের ঘাটতি, পুরো শরীরে র-ক্ত চলাচলে বিঘ্ন, শরীরটা অসাড়, অবস।

অফিসার আবার বলে, “নামটা বল। ছেড়ে দেব এখনকার মতো।ʼʼ

পরাগ হাতদুটো মাটির দিকে ঝুলে পড়ায় মাংসপেশিতে কঠিন টান লাগছে। দেহের সমস্ত ভর জড়ো হচ্ছে নিচের দিকে। সহ্যের মাত্রা ছড়াচ্ছে।

পরাগ জানে, তার মৃত্যুদণ্ড হবে। তার জীবনে পাপ ও দৃশ্যমান পাপের মতো দেখতে ভুল বোঝাবুঝি কম নয়। জয়ের নাম বলায় কোনো সমস্যা ছিল না তার। কিন্তু জয়ের কাজ ফুরোয়নি এখনও। ও জয় কাজবাজ সেরে মরুক গে, পরাগের কী! জয় বাঁচতে চাইলে তাকে মারতে চাওয়া যেত। ও ব্যাটা কখন জানি নিজেই আত্মসমর্পণ করবে।

পরাগের নাম বলতে ইচ্ছে করছে না। সে বোধহয় জ্ঞান হারাচ্ছে। তাহলে তো সোনায়-সোহাগা। যন্ত্রণা থেকে সাময়িক মুক্তি। চোখটা বুজে এলো। আস্তে আস্তে চেতনা লোপ পাচ্ছে তার।


অন্তূ রিক্সা থেকে নেমে দৌঁড়ে বাড়িতে ঢুকল। এতটা অস্থির ও চঞ্চল তাকে দেখা যায়না। কবীর দৌড়ে গিয়ে ভাড়া পরিশোধ করল। এখনও সময় বাকি কত! ফিরে এসেছে অন্তূ।

রিমি ও তুলি ছুটে গেল। অন্তূ জয়ের মতো জগ উচিয়ে ধরে ঢকঢক করে ঠিক জগের অর্ধেকটা পানি খায়। এরপর ধপ করে বসে চেয়ারে।

তুলি ঝাঁকাল অন্তূকে, “এই মেয়ে! কী হয়েছে? ভয় পেয়েছ? কেউ কিছু বলেছে? রাস্তায় কিছু হয়েছে?ʼʼ

রিমি বসে পড়ল অন্তূর কোল ধরে, “আরমিণ! কিছু বলছেন না কেন? কিছু হয়েছে?ʼʼ

অন্তূ চট করে হাসল, তা অদ্ভুত দেখালো, “আব্বুর কথা মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, বাড়ি ফিরলেই আব্বুকে পাব। তাই দৌঁড়ে এসেছি।ʼʼ

দুজনের কাছে খুবই বেমানান ও অবিশ্বাসযোগ্য লাগল কথাগুলো।

অন্তূ অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল সেদিন। বাথরুমে জয়ের তিন-চারটা ভেজা লুঙ্গি পড়ে আছে। এভাবে তিন-চারশো হয়ে গেলেও নতুন কিনে এনে পরবে, তবু ধুয়ে দেবে না। এই কাজটা তরু করতো। কখনও শাহানা। বিয়ে হয়ে এসে বউভাতের দিন রিমিকে জয়ের লুঙ্গি ধুতে হয়েছিল।

ভিজে পড়ে থেকে থেকে পিচ্ছিল হয়ে গেছে লুঙ্গিগুলো। অন্তূ ধুয়ে দিলো।

গোসল শেষ করে যোহরের নামাজ শেষে দীর্ঘ হলো তার মোনাজাত। মহান প্রতিপালকের কাছে হাত তুলে অনেকক্ষণ বসে রইল। কিন্তু কাঁদল না। ঠোঁট নড়ল না। তিনি অন্তর্যামী। তাঁর কাছে আহাজারী করার কী? বান্দার ভেতরের র-ক্তক্ষরণ তিনি দেখেন।

বড়ঘরে পাহারা নিযুক্ত করা হয়েছে। সবগুলো দরজা-পথে লোক মোতায়েন হয়েছে। অন্তূ ফিরে এলো। সেদিন দুপুরে খেলো না।

অন্তূর ভেতরে একটা সন্দেহ জেগে উঠেছে। হামজার তাকে হঠাৎ-ই ভার্সিটিতে যেতে দেবার অনুমতিটা ঠিকঠাক লাগছে না।


দু-ভাই ছাদে বসে অনেকরাত অবধি মদ খেল। হামজা জিজ্ঞেস করল, “রূপকথার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলি?ʼʼ

-“কথা আপা কারাগারে সেইফ না, ভাই।ʼʼ

-“কারাগারে সেইফটির প্রশ্ন?ʼʼ

দুজন হু হা করে হাসল। এক প্যাগ গিলে শান্ত হয়ে আকাশের দিকে তাকাল হামজা, “জয়!ʼʼ

-“হু!ʼʼ

-“কোনদিকে এগোচ্ছি রে আমরা?ʼʼ

-“যদি একটু আধ্যাত্মিক শব্দের মাধ্যমে বলতে চাও তো, আমরা এগোচ্ছি কালগর্ভের দিকে।ʼʼ

-“সময়ের গর্ভ?ʼʼ

-“তাও যে-সে সময় না। মহাসময়।ʼʼ

দুজন মাতালের মতো হেলেদুলে হাসল।

হামজা সিগারেটে দুটো টান দিয়ে চোখ ফিরিয়ে বলল, “রাতে খেয়েছিস?ʼʼ

-“পেট ভরা ভরা লাগছে। মনে হচ্ছে ভকভক করে বমি হয়ে যাবে।ʼʼ

-“গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি কর। আজ আর গিলিস না।ʼʼ

হামজাও শুয়ে পড়ল সটান হয়ে।

সেলের বাইরে রূপকথা জয়কে দেখে হেসেছিল। জয় জিজ্ঞেস করল, “দিনকাল ভালো তো?ʼʼ

রূপকথা উঠে এসে সেলের শিক ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বলল, “ভালোই তো। কেন এসেছিস? বেঁচে থাকতে ভালো লাগছে না?ʼʼ

-“লাগবে না কেন? বেঁচে থাকার জন্যই তো বেঁচে থাকা।ʼʼ

রূপকথাকে হাসপাতাল থেকে এনে সেলে রাখা হয়েছে। বাহুতে ব্যান্ডেজ জড়ানো। ছেঁড়া, নোংরা শাড়ির আচল মেঝেতে ঘেঁষছে। সুন্দর মুখটা বিবর্ণ, অথচ ঠোঁট হাসছে। ভয়ানক রহস্যেঘেরা মলিন সেই হাসি।

সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল জয়ের চোখের দিকে। জয় চোখ ফেরালো না। কিন্তু খানিকবাদে আচমকা যখন জয় হেসে উঠল একদৃষ্টে চেয়ে, রূপকথার বুকের ভেতরটা ছলকে উঠল সেই হাসিতে। শরীরটা শিরশির করে কেঁপে উঠল জয়ের চোখে তাকিয়ে। জয় তখন জোরে করে হেসে উঠল।

রূপকথা এগিয়ে এসে সেলের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে হাত ধরল জয়ের, “কী করছিস তুই, জয়? কী চাস জীবনে?ʼʼ
-“এত প্রশ্ন কেন?ʼʼ

-“জবাব দিলেই তো হয়।ʼʼ

-“না দিলেও হয়। আসলে আমি কিছুই করতেছি না। লাইফ এনজয় করতেছি।ʼʼ

-“কেন এসেছিস?ʼʼ

-“এলাম ঘুরতে ঘুরতে। জেলখানা একটা ভালো পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। হামজা সাহেব সংসদে সিট পেলে দেখি এই ব্যবস্থা করা যায় কিনা!ʼʼ

দুজন বসল। একজন সেলের ওপারে একজন এপারে। কিন্তু বসল কাধে কাধ মিলিয়ে। মাঝখানে লোহার শিকের ফারাক। রূপকথা আচমকাই বলে, “তোর কি আমাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে, জয়?ʼʼ

-“হচ্ছেই তো। কষ্টে বুক ফাটে, পাতিল হাড়ি কুত্তায় চাটে। এইরকম ধরণের কষ্ট হচ্ছে।ʼʼ

রূপকথা হাসল, “আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছিস?ʼʼ

-“তোমার স্বামীকে? ছিঃ। মেরে ফেলব কেন?ʼʼ

-“না মেরেই ভালো করেছিস।ʼʼ

জয় রূপকথার বাহুর থকথকে গলিত মাংসের দিকে চেয়ে রইল, ব্যান্ডেজ আলগা করে ফেলেছে রূপকথা। জয় হাসল, “আমার নাম জানতে চাইছিল ওরা!ʼʼ

-“না। পলাশ কোথায়, তা জানতে চেয়েছিল।ʼʼ

-“আমার কাছেই পলাশ ছিল। এ তথ্যটাই মূলত দরকার ছিল ওদের। বললেই ছেড়ে দিতো।ʼʼ

-“কিন্তু বলতে ইচ্ছে করল না।ʼʼ

জয় গা দুলিয়ে হাসল, “জয় আমিরের ওপর রক্তের ঋণ চাপিও না। ʼ

-“চাপালে কী?ʼʼ

-“অনবরত রক্ত ঝরে তার শরীরে, বয়ে যাবে কোথাও।ঋণ পরিশোধ হবেনা।ʼʼ

-“তোর কাছে আছে কী, কী দিবি আমায়। তুই তো কাঙাল। ʼʼ
-“তাও এক কথা। একটা চাকরি-বাকরি করা লাগবে। সামনের পর বেকার বলে বদনাম ঝারছো, মানবিকতার অভাব।ʼʼ

খানিক চুপ থেকে রূপকথা বলল, “কয় খন্ড করছিস রে?ʼʼ

-“মনে নেই এক্সাক্ট। কমবেশি চার-পাঁচ।ʼʼ

জয় আর দাঁড়ায়নি। চলে এসেছিল।

টানটান হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে ভালোই লাগে। কিন্তু চোখ-মুখ ঘোলা হয়ে আসছে। হ্যাং-অভার ধরছে। মাথার নিচে হাত। আকাশের দিকে তাকিয়ে গান ধরল জয়,

ইট-গামলায় ইট বানায়া, চৌদিকে ভাটা সাজাইয়া
মাঝখানে আগুন জ্বালাইয়া দিলো গোওও
ভেতরে পুড়িয়া সারা, মাটি হইয়া যায় অঙ্গারা
এখন আমি কী করি উপায়…

হামজা নিচে নেমে গেল। প্রেশার বেড়েছে বোধহয়। মদ্যপান নিষিদ্ধ তার জন্য। ঘরে ঢুকে দেখল রিমি শুয়ে আছে। তাকে দেখেও উঠল না, কথাও বলল না। মাথা ঝিমঝিম করছে। ঘরে শুতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে দূরে কোথাও জঙ্গলে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে আসতে।

জয় ঘরে এলো দুটোর দিকে। অন্তূ বসে আছে মেঝেতে। জয় দেখেও না দেখার মতো গিয়ে ধুপ করে শুয়ে পড়ল। অন্তূ কিছুক্ষণ পর ডাকল, “আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।ʼʼ

-“চুপ থাক। ঘুমাচ্ছি আমি। যা কথা পরে-টরে।ʼʼ

-“এখন বলাটা দরকার।ʼʼ

-“মুখ বন্ধ রাখ, শালী। মাথা ধরেছে খুব। ঘুমাবো আমি।ʼʼ

অন্তূ বসে রইল। তখন দুটো বাজছিল রাত। জয় ঘন্টা দুয়েক মরার মতো ঘুমালো। চারটার দিকে উঠল। অন্তূ বসে আছে ওভাবেই। বিরক্ত হয়ে বলল, “কী কথা, কও।ʼʼ

-“জয়নাল আমির আপনার চাচা, না!ʼʼ

-“ছোট চাচা। বলেছিলাম আমি।ʼʼ

-“জাভেদ আমির?ʼʼ

-“থিউরেটিক্যালি আমার বাপ।ʼʼ

-“বড় চাচার নাম কী?ʼʼ

জয় ভ্রু কুঁচকে ফেলল, “ভার্সিটিতে গিয়েছিলে?ʼʼ

-“গিয়েছিলাম।ʼʼ

অন্তূ জয়ের এমন অলৌকিক আন্দাজশক্তিতে একসময় ভীষণ অবাক হতো। এখন হয়না। মনে হতো জয় আধ্যাত্মিক ক্ষমতা জানে। মানুষের মন ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা সব তার আয়ত্ত্বে।

জয় লাফিয়ে নামল খাট থেকে, “জিন্নাহ আমির নামের কারও কথা বলেছে ওরা?ʼʼ

অন্তূ বিস্ময়ে ভ্রু জড়াল, “নিজস্ব জিন পোষেন নাকি?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল দুপাশে, “অভিজ্ঞতা বেশি।ʼʼ

-“ততটাও বোধহয় বেশি না, যতটা চতুর আপনি।ʼʼ

-“আমার বাপের বড়ভাইয়ের ছেলে।ʼʼ

-“জিন্নাহ আমির!ʼʼ

জয় আচমকা শক্ত হলো, “হ। কারা আইছিল?ʼʼ

-“কয়েকজন।ʼʼ

-“কী বলল?ʼʼ

-“মুরসালীন মহানকে ছেড়ে দিতে বলেছে। তাহলে জিন্নাহ আমিরকে ফেরৎ দেবে ওরা।ʼʼ

জয় খানিক চুপ থেকে থেকে মাথা ঝারা মেরে হাসল, “জিন্নাহকে গুম করেছে আজ আড়াইবছর। বেঁচে আছে কিনা, সন্দেহ। খানকির বাচ্চারা এখনও নাম ভাঙিয়ে খাইতে চায়। শুয়োরের বাচ্চাদের কে বোঝাবে, জয় আমির গু খায় না। তার নাম কয় নাই?ʼʼ

-“আনসারী মোল্লা বোধহয়।ʼʼ

-“সাথে আর কে কে ছিল?ʼʼ

অন্তূ কথা বলল না। গভীর চোখদুটোয় জীবনের কাতরতা! বারান্দার অন্ধকারে চেয়ে রইল।

জয় বলল, “তোমাকে কী বলেছে?ʼʼ

কাঠের পুতুলের মতো বলল অন্তূ “আপনাকে বুঝিয়ে বলতে বলেছে।ʼʼ

-“নয়ত?ʼʼ

-“আমার ভাবী আর আম্মু…ওহ সাথে আমাদের বাড়িও পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেবার কথা জানালো।ʼʼ

জয় হেসে উঠল, “তোহ ঘরওয়ালি! তোমার প্রাণপ্রিয় ধর্মীয় গোষ্ঠীর আগ্রাসী ব্যাপার-স্যাপার কেমন এনজয় করলে?ʼʼ

-“বুঝতে পারিনা আমি এসব। দৃষ্টিকোণ বদলাতে থাকে একেকসময়। আমি রাজনীতিকে বুঝতে চেষ্টা করছি, অথচ পারছি না।ʼʼ

জয় হো হো করে হাসল, “রাজনীতি বোঝার মতো বিষয় নয়, সিস্টার। ওটা একটা নীতি, দ্যাটস মিন পলিসি। ওটা মেনে চলতে হয়, ব্যাস। বুঝতে গেলে হারিয়ে যাবে, কূল পাবেনা।ʼʼ

-“কেমন পলিসি?ʼʼ

-“ব্ল্যাডি ডিপলোম্যাটিক পলিসি।ʼʼ

-“ওদের তিনজন প্রধান নেতাকর্মীর শাস্তির রায় কার্যকর হয়েছে।ʼʼ

-“ওরা যুদ্ধাপরাধী। মানবাধিকার বিচারে সাঁজা পাচ্ছে। তাতে কী?ʼʼ

-“ওরা ছাড়া আর কেউ নেই? ওরাই কেন? কারণ ওরা বিরোধী দলের সঙ্গে জোট করেছে তাই? ওরা নিজেদের বক্তব্যে আপনাদের সরকার ও শাসনব্যবস্থার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়, মানুষের মাঝে সেসব কথা পৌঁছায়, তাই নাকি অন্যকারণ! মুরসালীনও কি তাই?ʼʼ

-“মুরসালীনের বাপেরা ছিল মোল্লার বংশধর। ধর্মের প্রতি দুর্বল। কিন্তু ও মূলত বিরোধী দলের চামচা। আবার ধর্মীয় দলের ওপরও ব্যাপক টান।ʼʼ

-“সে হিসেবে চামচা তো আপনিও।ʼʼ

জয় তাকিয়ে রইল। অন্তূ হাসল, “ক্ষমতাসীনদের পেছনে লেজ নাড়ানো গাঢ় চামচামি। ওরা বরং হিম্মতদার, যারা ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও লড়ছে।ʼʼ

-“লড়ছে? ২০১৪ তে যেটুকু লাফিয়েছে, আর ২০১৫ এর শুরুতে তিন-চার মাস যা আগুন জ্বালানো অবরোধ করেছে। এরপর তো ওরা ডাউন, ঘরওয়ালি। তুমি হিজড়াদের সঙ্গ দিচ্ছ। ওরা মরে ভূত সব।ʼʼ

-“সঙ্গ আমি কারোই দিচ্ছি না। আমি শুধু চাইছি, ওদের মুক্তি দিন। ওরা অপরাধ করেনি। আর কিছু বলতে পারছি না। কারণ আমি রাজনীতি বুঝতে চেষ্টা করছি সবে, বুঝতে পারছি না মোটেই।ʼʼ

-“ওরা বরশীর আগায় ঝুলানো টোপ। মাছ ছিপে ওঠা না অবধি ছাড়তে পারি না।ʼʼ

-“ওরা এমনিতেও দূর্বল। থেমে গেছে সেই কবে। তবু এখনও? ওদের দলের লোক দেদারসে কারাগারে যাচ্ছে, মামলা খাচ্ছে। আর কত? অন্তত বাচ্চাগুলোকে মুক্তি দিন।ʼʼ
জয় মেঝের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। অন্তূ খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে বলল, “কেন করছেন এসব, বলুন তো!ʼʼ

জয় কিছুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইল। ফজরের আজান শেষ হলো।

-“ওরা যুদ্ধাপরাধী, মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ড করা জঙ্গি গোষ্ঠী। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে আর পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছে সেসময়। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ওদের ঘেন্না করাটা নিয়ম।ʼʼ

-“আর তাতে ক্ষমতা হাসিলও হয় খুব সহজে, কী বলেন!ʼʼ

জয় হাসল, “ওটা হামজা ভাইয়ের জন্য। আমার ওসব কিছু না।ʼʼ

-“অথচ আপনি নিজেকে কতন পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন! যেখান থেকে ফেরার পথ নেই।ʼʼ

-“মেরে ফেলবে?ʼʼ

-“মৃত্যু আপনার জন্য নয়, জয় আমির। মৃত্যু তাদের জন্য যারা মৃত্যুকে ভয় পায়। মৃত্যু অন্তত আপনার ‘শাস্তি’ হতে পারে না।ʼʼ

জয় নিঃশব্দে হাসল কেবল। কিচ্ছু বলল না।

-“আজ আমাকে ভার্সিটিতে যেতে দেয়া হয়েছিল। কোনো বিশেষ ব্যাপার নাকি? কী করেছেন ওদের সঙ্গে?ʼʼ

জয় দুপাশে মাথা এই ব্যাপারটাকে সাইড করে মাথা নেড়ে ভ্রু উঁচিয়ে গভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী হয়েছে?ʼʼ

অন্তূ তাকাল জয়ের দিকে। তাদের দুজনের নীরব এই বোঝাবুঝির মাঝে যে অসীম বিরোধ, তার কোনো পরিণতি নেই।

-“ভাবীর বাচ্চা পেটের ভেতরেই অসুস্থ। আম্মু কল করেছিল।ʼʼ

-“ব্যাপারটা মঙ্গলকর। তোমার ভাই নাই। বাচ্চাটা থাকা মানে ভাবীর জীবন ক্ষয়।ʼʼ

অন্তূ কঠোর চোখে তাকাল, “জানোয়ার, আপনি।ʼʼ


সকালবেলা জানা গেল, কবীরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। হামজা পাটোয়ারী পৌরসভার মেয়র। তাকে সরাসরি প্রথমেই আনা হলো না আইনি জিজ্ঞাসাবাদে। কিন্তু খুব শীঘ্রই যে আনা হবে, তা চিরন্তন সত্য।

জয় আমির খাঁড়া দুপুরে বড় ঘরে উপস্থিত হলো। পেছনে অন্তূ। জয় গলা চেপে ধরল অন্তূর, “তুই কোথায় যাচ্ছিস?ʼʼ

অন্তূর তপ্ত শ্বাস জয়ের হাতে পড়ছিল। আরও শক্ত করে চেপে ধরল গলাটা জয়, “রুমে যা। কুপিয়ে কেটে ফেলব একদম।ʼʼ

-“হয় কুপিয়ে কাটবেন, অথবা আমি আপনার সঙ্গে বড়ঘরে যাব।ʼʼ

জয়ের চোখে রক্ত ছুটে বেরোচ্ছে। ঘুম পুরো হয়নি। নেশার ঘোর কাটেনি, মাথা ঝিম মেরে আছে। ছেড়ে দিলো গলাটা। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ড্যাগ ভরে রান্না হয়েছে। খেতে দেবার জন্য বাড়ির মেয়েদের দরকার।

মুরসালীনের সামনে জয় সেদিন অবধিও সেভাবে বসেনি, ওকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। যা করার বাপ্পী, সোহাগ, আজাদ আর প্রধানত হামজা করেছে। সেদিন প্রথমবার জয় আমির সৈয়দ মুরসালীন মহানের সম্মুখে বসল।

চাটাই পেতে দেয়া হলো। সবাইকে একসঙ্গে খাওয়ানো হলো সেদিন অবরুদ্ধ কুঠুরিতে। জয় ওদের সাথে বসে পোগ্রাসে গিলল।

খেতে খেতে মুরসালীন বলে, “জয়! মনে পড়ে তোর? এভাবে দিনের পর দিন দস্তরখান বিছিয়ে কলার পাতায় খাবার খেয়েছি একপাতে?ʼʼ

জয় তাকাল না। কথাও বলল না। অন্তূ ওদের পেটপুড়ে খাওয়ালো। যতটা সম্ভব যত্ন করে খাওয়ালো। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অভুক্ত বাচ্চারা খাচ্ছে, নিদারুণ খিদে
আর পিপাসা ওদের। পরনের পাঞ্জাবী ছেঁড়া-ফাঁড়া, নোংরায় ঢাকা।

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]