অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৬৪+৬৫+৬৬

0
116

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৪.

প্রায় বিকেল হয়ে এসেছিল। কিন্তু বড়ঘরে সময়-কাল ও আলোর অস্তিত্ব নেই।

আব্দুল আহাদ কয়েক লোকমা খাবার মুখে দিয়েই গলগল করে বমি করে ফেলল। এবং শেষের দিকে বমির সঙ্গে রক্তের ছোপ উঠে এলো। অন্তূ বসলে আব্দুল আহাদ অন্তূর হাতখানা চেপে ধরে। আবারও বমি করতে চায়। পেটে খাবার পড়ে না কতদিন ঠিকমতো। লালা ঝরল শুধু, সাথে রক্ত।

জয় গপাগপ আরামে খেয়ে উঠল।

আব্দুল আহাদ মেঝের ওপরই টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। অন্তূ জগ ভরে পানি এনে মাথায় দেয়। খাওয়ার পানি চাইল, কিন্তু খেতে পারল না। অন্তূ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আব্দুল আহাদের জীর্ণ মুখটার দিকে।

অন্তূ যতবার বড়ঘরে এসেছে, বাচ্চারা সস্তি পায়, সবাই অন্তূর দিকে চাতকের মতো চেয়ে থাকে। কিছু আশা করে। তারা জানেনা, অন্তূর হাত বাঁধা। এটাও জানে না, অন্তূ আজ ভীষণ নিঠুর, উদ্দেশ্যপ্রবণ, স্বার্থপর…!

অন্তূ কিছুই করল না। সে আজ একটুও তামাশা করতে চায় না, জয় আমিরের সঙ্গে আপাতত সে একটুও রেষারেষি চায় না। সে এখানে আজ ইনিয়ে-বিনিয়ে থাকতে চায়। জয়ের সঙ্গ চাই তার, ততটা গভীর সঙ্গ, যাতে সে জয় আমির নামক অতল গহ্বরের অন্তত মুখটার আপাত হদিশ পায়। বাকিটা সে বোঝে, সে জয় আমিরকে আত্মস্থ করেছে। সে জয় আমিরকে বিভিন্নভাবে বিভ্রান্ত করে, কখনও ক্ষেপিয়ে তুলে, কখনও অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করার নামে খুলে পড়ে দেখে নিয়েছে। শুধু জানা বাকি কিছুটা। তা জানলেই যেকোনো একটা গূঢ় সিদ্ধান্ত!

ওরা অনেকদিন পেটভরে খাবার পেয়ে কেউ-ই সইতে পারছিল না। চোখ-মুখ উল্টে আসছিল, অসুস্থতা বাড়ল সবার।

অন্তূ জয়ের খুব পাশে গিয়ে বসে, জয়ের এঁটো হাতে খুব ধীরে পানি ঢালতে ঢালতে বলে, “দেখতে ভালো লাগছে না ওদের দুর্ভোগ। হোক যে কারণেই, সেসব বিতর্কিত। আপাতত তা বুঝতে না যাই। শুধু জানা ভালো, ওরা নিষ্পাপ, নাবালক। ওদেরকে মেরে ফেলুন, অথবা বেঁচে থাকতে দিন।ʼʼ

জয় হাতদুটো আরাম করে ধুয়ে চোখ তুলে তাকাল, এরপর বলল, “ওরা মরে গেছে না বেঁচে আছে, সেইটা আগে ক্লিয়ার করো।ʼʼ

-“ওরা বেঁচে থেকে থেকে রোজ মরছে। আপনি বোধহয় বোঝেন এই বেঁচে থাকাটা।ʼʼ

জয় ভ্রু উঁচায়, “আমি বুঝি নাকি?ʼʼ

-“বোঝেন। আপনি এভাবেই বেঁচে বেঁচে মরেছেন বহুকাল।ʼʼ

-“তাই নাকি?ʼʼ তাকাল জয়, “আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লে আম পড়বে? দেখা গেল, ঢিল আমের গায়ে না লেগে গাছের ডালের মৌচাকে লাগল। এরপর?ʼʼ

-“মৌমাছির কামড়ের ভয় পেতে বলছেন?ʼʼ

জয় হেলেদুলে হাসল। ক্ষেত্রবিশেষ চরম সল্পভাষী হিসেবে ধরা পড়েছে জয়। তার যত বাজে কথা, আবোল-তাবোল রসিকতা বাহার। কাজের কথা অথবা নিজের কথা ভুলেও বেরোয় না জবান দিয়ে। অতি রসিকতার জেরে মানুষ সুযোগ পায় না ওর সঙ্গে আন্তরিক আলাপ পাড়ার। সেই সুযোগ কাড়তেই জয়ের রসিকতার আয়োজন, এত আন্তরিকতাহীন চলন। অন্তূর আবিষ্কার এসব।

-“তো আমি চরম মাপের খিলাড়ি তাইলে! তবু তুমি শালী কদর করলা না।ʼʼ

জয়ের চোখের মেটে রঙা মণিতে চোখের নজর ফেলে অন্তূ, “আফসোস, আপনার বাঁচার লোভ নেই।ʼʼ

-“মরার শখও নেই। চাইলেই মেরে দিতে পারতে। কত রাত সুযোগ গেল।ʼʼ

-“ভয় অথবা অনীহা নেই যে!ʼʼ

-“না-ন না! তুমি আসলে আমার প্রেমে পড়ছো। খালি স্বীকার যাও না। তো একটা চ্যালেঞ্জ জিতলাম। কী কও?ʼʼ চোখ মারল জয়।

অন্তূ বলে, “মৃত্যু কি আপনার শাস্তি হতে পারে? সত্যি বলুন। ভয় পান না আপনি মরণে। ব্যাপারটা জটিল হয়েছে এখানে।ʼʼ

-“অপবাদ দিচ্ছ, ডিয়ার। ছেড়ে দাও। আমি খুব ভীতু। তুমি জানোনা, তাই বলছো।ʼʼ অন্তূর ওড়না টেনে নিয়ে ভেজা হাতটা মুছল জয়।

অন্তূ তির্যক হাসল, “দুনিয়ার প্রতি দায়বদ্ধতা না জন্মে যায়, পাপকে পাপ মনে হতে যেন শুরু না করে, লোক আপনার কুৎসিত ব্যক্তিত্ব ছাড়াও এক সর্বহারা দূর্বল কাঙালকে না দেখে ফেলে, সেসব ব্যাপারে ভীষণ ভীতু আপনি। জানি তো। অস্বীকার করছি বুঝি!ʼʼ

অন্তূর বাক্যবিন্যাসে এক প্রকার অভিজাত নাটকীয়তা ছিল, যা শুনতে শ্রতিমধুর ও অদ্ভুত শোনালো।

জয় শব্দ করে হাসল, “সর্বহারা আমি? আমার ব্যাপারে এসব ভুলভাল কথা কোন শালা শেখায় তোমাকে?ʼʼ

অন্তূ নিঃশব্দে ঠোঁট বাঁকিয়ে সল্প হাসল, “আপনার সেই শালার নাম মোস্ট প্রোবাবলি–জয় আমির।ʼʼ

চকিতে তাকায় জয়। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে দেখে অন্তূকে কিছুক্ষণ। অন্তূর স্থির চোখের ঘন পাপড়িতে যে বিরোধের আগুন! মসৃণ ঠোঁটে কত আওয়াজহীন প্রতিবাদ! কঠিন ঢোক গেলার মাঝে অসহ্যকে সহ্য করার অব্যর্থ চেষ্টারা। আর মাথায় টানা লম্বা ঘোমটায় জড়িয়ে থাকা জয় আমিরের নাম। জয় দেখে সেসব। অল্পক্ষণ দেখে। এরপরই চট করে অন্তূর কালচে পানির পুরনো গভীর কূপের মতো চোখের মণি থেকে চোখ সরায়।

এক হাঁটু খাঁড়া করে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে দীর্ঘ এক টান দেয়। অন্তূ মেঝেতে ঠেসে বসে জয়ের পাশে। মাথার ওড়নাটা কপাল অবধি টানে। জয়কে দেখতে তখন পুরনো আমলের অহংকারী, অনৈতিক জমিদারের মতোন দেখায়, আর অন্তূ তার বিরোধী পূণ্যবতী গিন্নি।

আজ ক’দিন যেন আচরণ বদলেছে অন্তূর। জয়ের ব্যাপারে জানতে আগ্রহী সে শুরু থেকেই, কিন্তু আজকাল তা অন্যরকম রূপ নিয়েছে।

বসে থাকে দুজন অনেকক্ষণ। কেমন যেন পারিপার্শ্বিক হালটা। সাতাশটা ক্ষত-বিক্ষত, বন্দি দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এক বিশাল আলো-বাতাসহীন ইস্পাতের গুদামে। তার একপাশে দুটো নর-নারী পাশাপাশি খুব কাছে বসে থাকে চুপচাপ। কেউ কারও দিকে একবারও তাকায় না। প্রগাঢ় শ্বাসের উঠানামা চলে কতক্ষণ। নিগূঢ় রহস্যের পাক ঘোরে সেই শ্বাসের অদৃশ্য কুণ্ডলীর হাওয়ার মিলনে।

জয় নিজের বাঁ হাতের তালু মেলে ধরে অপলক চেয়ে থাকে সেদিকে। ভাগ্য নাকি ভবিষ্যত দেখার প্রয়াস! জয়ের যে কত সব উদ্ভট খেয়াল জাগে ক্ষণে! পাশে বসে অন্তূ দেখে পরিশ্রান্ত দেহগুলো। আশাপাশটা ভয়ানক। কিন্তু অন্তূর ভয় লাগে না। বিশাল বিশাল লৌহচুল্লি, ছাই, কয়লা, রাসায়নিক পদার্থ, ছাঁচ, হাতল, নোংরা চটের বস্তা, মানুষের হাড়, লোহার খণ্ড, কার্বন কোক সংরক্ষণের পাত্র, লোহার তৈরি খাম্বার আকৃতির বিশাল বিশাল গোলক—কত কী ছড়িয়ে আছে। টিমটিমে বাতি জ্বলছে। আধো অন্ধকারে ভ্যাঁপসা দুর্গন্ধ সব মিলিয়ে।

অন্তূ সেসবে চোখ নিবদ্ধ রেখে আস্তে কোরে ঠোঁট নাড়ায়, “আপনাকে আমি এর চেয়ে বেশি অসহায় হিসেবে দেখবো, জয় আমির। আমি জানি, দেখব। আপনার অসহায়ত্ব আর সবার মতো কাতর আর দৃশ্যমান হবেনা। আপনি হাসবেন, খুব হাসবেন সেদিন একবার। আমি আপনার সেই অসহায়ত্ব দেখব। সেদিন কেউ আপনাকে দেখলে আপনার পাপ ভুলে বরং আপনার জন্য মায়ায় কেঁদে উঠবে। আর আপনি ঠিক ততটাই হাসবেন। আমি আপনার সেই অসহায়ত্ব দেখব।ʼʼ

জয় হাতের তালুতে আস্তে আস্তে পাঁচটা আঙুল গুটিয়ে মুঠ পাকিয়ে গা দুলিয়ে হাসে, “তোমার আল্লাহ তোমার ফরিয়াদ মিছেমিছি হলেও কবুল করুন। জয় আমিরকে তিনি অসহায় করুন। আমিন।ʼʼ

-“অর্থাৎ আপনাকে অসহায় করা অসম্ভব? আপনাকে অসহায় করতে পারবেন না তিনি–বলছেন?ʼʼ

-“সহায় করতে পারেননি। অসহায় করতে পারবেন– ভাবছো কেন, ঘরওয়ালি? শ্যুড নট বি ফরগোটেন, ঘর ভাঙতে সেই ঘরামির দরকার পড়ে, যে ঘরামি ঘর বানিয়েছিল। অর্থাৎ, ভাঙতে পারেন কেবল তিনি, গড়েছেন যে।ʼʼ

-“আর আপনার ধারণা—আপনাকে আপনি গড়েছেন! ভাঙলে কেবল আপনি ভাঙতে পারেন, আর কিছুই না! তাই?ʼʼ

অন্তূ না তাকিয়েও টের পায় এতক্ষণে জয় তাকিয়েছে তার দিকে। সে তাকায় জয়ের চোখে। দুজনের চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলে ক্ষণকাল। কোনো এক মুহুর্তে দুজন একসাথে চোখ ফেরায় দু’দিকে। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো ভয়াবহ সম্পর্ক নয় তো তাদের! চোখের ভাষায় কথা বলা সম্পর্করা হয় ভীষণ ভয়ানক। ওসব সম্পর্ক তাদের নয়। তাদের সম্পর্ক আলাপ-আলোচনা সেরে, একত্রে বসে ছক-পরিকল্পনা এঁকে পরস্পরের বুকে ছুরি গাঁথার।

রিমি সবকিছু গোছগাছ করে আবারও এলো। তার মুখ স্লান, চোখদুটো স্থির কিন্তু বিষণ্ন। সেদিন জয় ওদের সরালো না। বেখেয়ালী লাগছিল তাকে ভীষণ।

হাঁটু খাঁড়া করে মেঝেতে বসল। মুরসালীন ঢালাই দেয়ালে পিঠ ঠেকায়। গোটা শরীরে ক্ষত। চিকিৎসা অথবা ওষুধ পড়েনি সেসব ক্ষততে। ওরা মোট সাতাশজন। তার মধ্যে বড় ছয়জন। মুরসালীন বাদে আরও আছে তারিক, আশরাফ, নাঈম, তওফীক, ইমদাদ।

এরা সব ২০১৪-১৫ এর শুরুর জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলনের সহিংসতায় জড়িত ছিল। রাজধানীর বিরোধী দলীয় ছাত্র আন্দোলনে সরব সবগুলো। গাড়ি জ্বালিয়েছে, মানুষ পুড়িয়েছে, ইট-পাটকেল, ককটেল ছুঁড়েছে, রাস্তায় অবরোধ করেছে। কঠিন অপরাধ। পুলিশ পেলে ছাড়বে না।

হামজা এলো অন্ধ কুটিরে। সাথে বাপ্পী মণ্ডল, কামরুল, চয়ন, দোলন। এই সাতাশজনকে পিটিয়ে মেরে ফেললেও তাদের শান্তি। এখন আর স্টেটমেন্ট বা হদিশ দরকার নেই। তবে একদম আলোচনাহীনভাবে কারও গায়ে হাত লাগানো যায় না।

জয় ও হামজা বসে রইল চুপচাপ। তাদের কোনো কাজ নেই। অন্তূর ওড়নার একপ্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে রইল রিমি।

মুরসালীন নিজেদের স্বপক্ষে কথা বললে কথাও বলা যায়না। কথা ও যুক্তিতে পটু। হওয়া উচিতও। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সরকার ও রাজনীতি অর্থাৎ পলিটিক্যাল সাইন্স বিভাগের ছাত্র ছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ভরা।

মুরসালীনের চেহারার কাঠামো নিরেট। অযত্নে দাড়ি বেড়ে যাওয়ায় দেখতে আরও কেমন যেন লাগছিল দেখতে।

বদিউজ্জামান দোলন আপিল বিভাগের আইনজীবী হলেও তিনি রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত আইনজীবী হিসেবেই খ্যাত কর্মী। শিক্ষিত মানুষ। রাজনীতির ভালো জ্ঞান ধারণা রাখেন।

তিনি মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই যে এইসব র-ক্তার-ক্তি কর্মকাণ্ড করে বেড়াও, লাভ কী হচ্ছে?ʼʼ

মুরসালীন স্বভাবসুলভ হাসল, “একটা গল্প শুনবেন, স্যার?ʼʼ

-“গল্প?ʼʼ

-“জি, স্যার। গল্প।ʼʼ

দোলন সাহেব তাকিয়ে রইলেন। মুস্তাকিন মহানের মতোই দেখতে অনেকটা। তবে মুরসালীনের চেহারাটা কিছু ধারালো। মুস্তাকিন খুব গম্ভীর ছিল, এবং সল্পভাষী, চুপচাপ, নিঃশব্দ চলন। ছোটটা হয়েছে চতুর, চঞ্চল।

মুরসালীন বলল, “পাশাপাশি দুই মহিলার বাড়ি ছিল। তাদের মধ্যে একটুও বনিবনা ছিল না। কিন্তু সারাদিন চেঁচাতে দেখা যেত এক মহিলাকে। সে সারাটাদিন অপর মহিলাকে খিস্তি করতো। লোক বিরক্ত ছিল সেই মহিলার ওপর। একদিন তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে গিয়ে আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ও তো একদম চুপ। অথচ তুমিই খালি এমনে চেঁচাও, পাড়ায় নাম খারাপ হয় তোমার।ʼ

মহিলা দুঃখের সাথে বলল, ‘আপনারা খালি আমার চেঁচানোটা দেখেন, শোনেন। অথচ ও রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দরজায় দাঁড়িয়ে বেড়ার ওপর দিয়ে আমাকে ঝাটা উঁচিয়ে পেটানোর ইশারা করে চুপ করে থাকে। আর আমি সেই দুঃখে সারাদিন চেঁচাই।ʼʼ

দোলন সাহেব কপাল জড়ালেন। মুরসালীন হাসল, “আপনি কি বুঝতে পারছেন আমার কথা, স্যার?ʼʼ

দোলন সাহেবকে পেরিয়ে চয়ন এগিয়ে এলো, “শুয়োরের বাচ্চা, তোর ফ্যাঁদা প্যাঁচাল শুনতে আসি নাই আমরা এইখানে।ʼʼ

দোলন সাহেব চয়নকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, “তোমার অপরাধ কী জানো তুমি?ʼʼ

-“বর্তমান সরকার ও সরকার বিরোধী আমি। এটা আপনাদের ধারণা।ʼʼ

-“আমাদের ধারণা? সত্যি নয়?ʼʼ

-“আংশিক সত্যি।ʼʼ

-“বাকিটা মিথ্যা কীভাবে?ʼʼ

-“সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।ʼʼ

-“আচ্ছা পরে শুনছি।ʼʼ কিছুক্ষণ চুপ থেকে দোলন সাহেব বললেন, “শিক্ষিত ছেলে তুমি। জানাশোনা নেহাত কম নয়। পথটা কি ঠিক তোমাদের?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দিলো না সাথে সাথে। চতুর লোকটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। প্রশ্নের ধরণ ও গলার স্বরেই মানুষকে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী বানিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখেন দোলন সাহেব।

-“স্যার, আমি নিরপেক্ষ কেউ একজন।ʼʼ

-“নিরপেক্ষ?ʼʼ হাসলেন দোলন সাহেব।

-“জি, স্যার। আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, বোধহয়।ʼʼ

-“না পারারই তো কথা। তাই না?ʼʼ

-“আমি কোনো দলের সমর্থক নই। আমি শুধু কার্যক্রমগুলোকে সহ্য করতে পারায় ব্যর্থ। আবার আপনাদের সমর্থন করা যায় না বলে যে বাকিদের করতে পারি, এটা আরও কঠিন ভুল।ʼʼ

-“তাই নাকি? অথচ তুমি কোনো এক দলের প্রতি অনরাগী। তুমি যে দলের দিকে বেশি গড়িয়েছ, তারা খুব মানবিক?

-“অন্তত আপনাদের চেয়ে।ʼʼ

কামরুল দোলন সাহেবকে পার করে চপাৎ করে এক ঘুষি মারল মুরসালীনের মুখে। দাঁতের কোণা বেয়ে রক্ত বেরিয়ে মুখটা ভরে গেল। মুরসালীনের হাত খোলা ছিল, তবু প্রতিক্রিয়া দেখাল না কোনো।

-“আমাদের চাইতে ওরা মানবিক? যারা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন নিয়ে জোট করে আর দেদারসে মানুষ মারে, ওরা মানবিক?ʼʼ বাপ্পী মন্ডল খেঁকিয়ে উঠল।

-“মানুষ মারার কথা বলছেন? কী আশ্চর্য! সাগর কেন নদীকে দোষারোপ করবে বুকে পানি ধারণ করায়?ʼʼ

-“কী বলতে চাও, তুমি?ʼʼ দোলন সাহেব বললেন।

-“স্যার, কথা বললে অনেক হয়ে যাবে। বলব কি? আর শর্ত হলো, আমি যতক্ষণ কথা বলব, আপনারা শুধুই শুনবেন। না কোনো জবাব, না প্রতিক্রিয়া। পরে দেখাবেন, যা জমে ততক্ষণে। আমি তো পালাচ্ছি না।ʼʼ

অন্তূ দীর্ঘ করে শ্বাস টানলো। তার নিজের ওপর থেকে আত্মগ্লানির বোঝা নামছে। তার প্রতিবাদ তাকে তিলে তিলে ক্ষয় করেছে, সাথে সব কেড়েছে। এই গ্লানি টানা বড় কষ্টের। অথচ আজ সৈয়দ মুরসালীন মহানের মুখের আত্মগরিমা, একেকটা সূঁচালো বাণের মতো কথার তীর, আর যুক্তি তার ভয় কাটাচ্ছিল। মুরসালীনের শরীরে ব্যথা নেই, চোখে মৃত্যুর ভয় নেই, কথায় জড়তা নেই। তবে সে কেন এত জমে গেছে!

দোলন সাহেব বললেন, “বলো।ʼʼ

-“বলাটা ব্যাপার না। সমস্যা হলো, আপনারা নিতে পারবেন তো! না, আসলে স্বাধীন বাংলাদেশে আবার কথা বলা পাখিদের লোকে খাঁচায় পোষে তো!ʼʼ

কটমট করছিল সবগুলো। মুরসালীনের কথাবার্তার সুর ভীষণ তীক্ষ্ণ, সরল উপহাস। কিন্তু দোলন সাহেব বিঁষ গিলে হাসলেন, “বলো।ʼʼ

মুরসালীন বলল, “আমার আব্বা খু-ন হয়েছে ২০০২-এ। কে মেরেছে জানেন?ʼʼ

-“আন্দাজ করতে পারি।ʼʼ

মুরসালীন মৃদু হাসল, এরপর বলল, “আপনি জেনে থাকবেন হয়ত, সেই বছর বিরোধী দলীয় প্রধানের নির্দেশে ৮৫ দিনের একটি অপারেশন চলেছিল। সন্ত্রাসবাদ নিপাতমূলক ব্যবস্থা– অপারেশন ক্লিনহাট। যদি বলেন ওই দলকে সাপোর্ট করার একটা মাত্র কারণ বলো। সেই একটা কারণ এটা হতে পারে।ʼʼ

দোলন সাহেব হেসে উঠলেন, “এই একটা কারণে ডুম হয়ে গেলে? কাঁচা বুদ্ধি তো না তোমার। বিবেচক তুমি।

মুরসালীন হাসল, “মিছেমিছি সুনাম করবেন না। আর আমি ডুম হইনি, স্যার। একটা মাপকাঠি পেয়েছি মাত্র।আপনাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ আজ অবধি কী পেয়েছে কী, স্যার? নাহ, বহুত কিছুই পেয়েছে অবশ্য, সেসব থাক। মূলত, তথাকথিত স্বাধীনতা যুদ্ধে জিতে পাওয়া এই তথাকথিত স্বাধীন বাংলাদেশ আজ অবধি বাংলাদেশের রাজনীতির দখলে থাকা কোনো পক্ষের কাছেই কিছু পায়নি, শুধু ক্ষয় ছাড়া। অবশ্য কী পেল সেটা বিষয় না, কিছু পেয়েছে, এ-ই অনেক।ʼʼ

মুরসালীনের গা জ্বালানো কথাবার্তায় স্থির থাকা দায়। দোলন সাহেবের জন্য ওরা চুপ করে বসে আঙুলে মেঝে খুঁটতে লাগল।

দোলন সাহেব কেমন করে যেন হাসলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার গন্ধ আসছে তোমার কথা থেকে।ʼʼ

মুরসালীন হেসে ফেলল, “অর্থাৎ আমি সেইসকল রাজাকার, যু-দ্ধা-পরা-ধীদের অন্তর্ভুক্ত। দিয়ে দিন স্যার ফাঁ-সি। দেশের শত্রু দশের শত্রু নিপাত হোক নিপাত হোক।ʼʼ

এমদাদ সমস্বরে বলে উঠল, “নিপাত হোক…ʼʼ একটা ঝংকার উঠে গেল এবার সবার স্বরে, “নিপাত হোক নিপাত হোক।ʼʼ সেইসব ক্লান্ত কণ্ঠে মলিন উপহাস!

মুরসালীন বলল, “স্যার, বর্তমান দেশে যে কয়টা দল শীর্ষে আছে, তাদের একটাও দেশ পরিচালনাকারী নয় স্যার। চোষক, শোষক, মিশ্র, ভন্ড সব, স্যার। সবাই শুধু দেশটাকে হাতে রাখতে চায়। তবে এটাও ঠিক। চাইবে না-ই বা কেন? তাদের সবার কারও না কারও কৃতিত্ব আছে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে। তার একটা প্রতিদান তো সবার প্রাপ্য। সেই প্রতিদানটা হলো দেশের গদি। যা কেউ ছাড়তে রাজী নয়।ʼʼ

মুরসালীন হাসল, “ছাড়বেটা কেন? কারও বাপের দেশ, কারও স্বামীর দেশ। ছাড়ার মতো ব্যাপার নাকি? উত্তরাধিকারসূত্রে আইনতভাবে দেশ তাদের। কিন্তু সমস্যা হলো স্যার, ভাগী-শরীক অনেক, কিন্তু দেশ একটাই। আমরা যতই নিজেদের দুঃখী বলি, সবচেয়ে বিপদে কিন্তু স্যার দেশই আছে, ভেবে দেখুন। একা সে কতজনের হবে? কতলোকে মিলে তাকে পাকিস্তানের শাসন থেকে মুক্ত করেছে! ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ যাবার পর সেখানেও এমনই হয়েছিল, জানেন তো! যেসব বিপ্লবীরা ইংরেজ তাড়িয়ে ভারত স্বাধীন করল, স্বাধীনতার পর দেশের গদি নিয়ে ওদের মধ্যেই কামড়াকামড়ি লেগে গেল। স্বাধীনতার পর নিজেদের এই দেশ ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। যা ইংরেজ সরকারের আমলের চেয়েও ভয়ানক। কারণ গৃহযুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু নেই।ʼʼ

অন্তূ নির্নিমেষ তাকিয়ে শুনছিল সেসব। তার বুকটা কাঁপল। ইচ্ছে করল মুরসালীনকে বাঁধা দিতে। মুরসালীনদের বাঁচতে হবে। ওরা ফুরিয়ে গেলে কেয়ামত হবে দুনিয়ায়। অন্তূ মনে হলো–মুরসালীনের ভাবনার মতো খাঁটি ভাবনা আর হয়না। দেশের সব দলই তো একমাত্র ক্ষমতাই চায়, নিজেদের অস্তিত্বের জোগান অর্থাৎ ক্ষমতা! কেউ তো ছাড়তে চায়না, কেউ ত্যাগ করতে রাজী নয়! কিন্তু মুরসালীনের কি ভয় পাওয়া উচিত নয়? ওকে মেরে ফেলবে এরা, তারপর এভাবে এসব ভাববে কে?

দোলন সাহেব শক্ত হয়ে বসে রইলেন। মুরসালীনের শর্ত অনুযায়ী কথা বলা যাবেনা।

মুরসালীন বলল, “আমার আব্বা ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন। উনার প্রাক্তনেরা ছিলেন–শহীদ জিয়াউর রহমানের মতো কিংবদন্তিগণ। বলাই বাহুল্য আব্বা কোন দলের প্রতি সামান্য হলেও অনুরাগী ছিলেন। অপারেশন ক্লিনহার্টে পলাশ আজগরের বাবাকে দেশছাড়া এবং ওর দাদাকে বন্দি করেছিলেন তার জুনিয়রেরা। পলাশ আজগরের দাদা কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। সেই শোধ নিতে গিয়ে পলাশ আজগর আমার খোঁজ না পেয়ে আমার বোনকে ধ/র্ষ/ণ ও খু/ন করেছে। আমার ভাইকে জয় আমির আগেই মেরে ফেলেছে। স্যার, আমি রাজনীতিতে নয়, রাজনীতি আমাতে জড়িয়েছে। এতসবের পরও নিরপেক্ষ থাকি কী করে? ব্যক্তিজীবনকে এড়ানো দ্বায়, স্যার! তার ওপর বংশ পরম্পরায় পাওয়া এই রোগ।ʼʼ

ঘরে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। জয় আঙুলের ভাঁজে চাবি ঘোরাচ্ছে বসে। হামজা লৌহখণ্ডের ওপর আঁকিবুকি করছে। অন্তূ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মুরসালীনের কথা। জয়ের দিকে তাকাল। এক ফোঁটা অনুশোচনা অথবা অভিব্যক্তিল পরিবর্তন নেই মুখে। বিরক্তিও নেই এসব কথা শোনাতে, আগ্রহ তো নেই-ই।

দোলন সাহেব বললেন, “অনেক ভুল-বোঝাবুঝি আছে তোমার মাঝে।ʼʼ

মুরসালীন হাসল, “মানুষ মাত্রই ভুল।ʼʼ

চয়ন উঠে এসে মুরসালীনের সামনে দাঁড়াল। হ্যাংলা পাতলা চেহারা, হাতের আঙুল ছয়টা। কালো কুচুটে চেহারা। দাঁতের মাড়ি চেপে ধরে বলল, “সব কথার ওই এক কথা—দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তুমার ব্যথা আছে।ʼʼ অশ্রাব্য এক গালি দিয়ে বলল, “তুই রাজাকারই তো শালা। যুদ্ধে তোর আমিরদের ফাটছে একসময়। এহন তোরও ফাটে। আর কস তুই যুদ্ধা-পরাধী-গোরে সমর্থক না?ʼʼ

মুরসালীন মাথা নাড়ল, “এখনও বলছি।ʼʼ

আর কে ঠেকায়! চয়ন একাধারে কয়েকটা কঠিন আঘাত করে গেল মুরসালীনের শরীরে।

থেতলানোর ওপর থেতলে গেল মুখটা। রক্তে মুখ ভরে উঠল। পুরোনো চটা পড়া ক্ষত তাজা হয়ে উঠল সব। চয়ন বলল, “তুই আন্দোলন করিস, ওগোর সাহায্য করোস, আমাদের বিরুদ্ধে কথা তুলোস, পুরোপুরি এক্টিভ তুই, শালা। তবু বাটপারি? নটকি মাগীর পুত। তোরে জিন্দা কব্বরে গাইড়া রাখমু একদম।ʼʼ

মুরসালীন কিছুটা সময় নিলো। হাত দিয়ে রক্ত মুছলো। কয়েকটা শ্বাস নিলো জোরে জোরে। এরপর বলল, “কোনো দলের জন্য নয় সেসব। ব্যক্তিগত সমস্যা আর মানুষের দুর্ভোগ দেখে টুকটাক হাত চুলকায়…ʼʼ

-“তোমার ধারণা নয় খালি, গোড়া থেকে ভুল।ʼʼ

ভীষণ শান্ত মানুষ হিসেবে আবিষ্কৃত হলেন দোলন সাহেব। রাগছেন না, কাউকেই বাঁধা দিচ্ছেন না। সুন্দরভাবে মুরসালীনের মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন।

মুরসালীন একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, “তাহলে তো অনেক পেছনে যেতে হয়, স্যার।ʼʼ

-“কতদূর?ʼʼ দোলন সাহেব হাসলেন, “মোঘল আমলে?ʼʼ

-“না। অতদূর না। ভারত বিভাগের কাছে গেলেই আপাতত চলবে।ʼʼ

-“চললেই হলো।ʼʼ

-“স্যার, এই পৃথিবীতে যতগুলো দেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে লড়েছে, তারা সবাই ছিল একেক নম্বরের স্টুপিড। আপনার ওই জোয়ান শরীরের গরম রক্ত, ভীষণ এডভেঞ্চার চায় স্যার। শরীরের তেজে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে যেতে রক্ত টগবগ করে তখন। আপনি জানেন, বেশির ভাগ বিপ্লবী যুবক ছিল!ʼʼ

কামরুল বলে উঠল, “তাই নাকি? আমি তোমাকে এতটাও স্বাধীনতাবিরোধী ভেবেছিলাম না! বাপরে! ভয়ই লাগতেছে তোমারে এখন। পাকিস্তানের গোলামি করতে এত সৌখিন তুমি, অথচ এতগুলা দিন বাইরে ঘুরছো! এখন তো দেখছি, তোমাকে ফাঁসি দিয়েও শাস্তি পুরো করা যাবেনা।ʼʼ

মুরসালীন হেসে উঠল। দাঁতের ফাঁকে জমাট রক্ত দেখা গেল। বলল, “শূলের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হবে। পাঁচ খণ্ড করে দেশের একেকটা জাদুঘরে স্থাপনা হিসেবে রাখলে ভালো। নামফলকে লেখা থাকবে–’সেরা দেশদ্রোহীদের মাঝে একজন সৈয়দ মুরসালীন মহানের দেহখণ্ড। কেউ হাত ছোঁয়াবেন না।ʼʼ

দোলন সাহেব বরাবরের মতো শান্ত স্বরে বললেন, “কেন এই বিরোধ! যুক্তিযুক্ত মানুষ তুমি, দু চারটে যুক্ত-ব্যাখ্যা দাও, শুনি।ʼʼ

-“আমি যৌক্তিক মানুষ নই। পর্যবেক্ষক টুকটাক। আমার পর্যবেক্ষণ মতে–যুদ্ধ করে কী পেয়েছি আমরা? একটা স্বাধীন ভূখণ্ড? আর সেক্ষেত্রে স্বাধানীতার সংজ্ঞা হয় এমন—পরের দেশের শাসক পেছন মারবে কেন? পেছন মারবে মারুক, নিজের দেশের শাসক মারুক। আমরা এরকম একটা স্বাধীন ভূখণ্ড পেয়েছি। স্বাধীনতাপ্রবণ বাঙালি আজ অবধি স্বাধীনতা মানে এটাকেই বুঝে ষোলোই ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উদযাপন করে আসছে। অথচ আমি বলি—১৬ই ডিসেম্বরে পাক বাহিনী দেশ স্বাধীন করে দিয়ে যায়নি, নিজেদের হাত থেকে অন্য আরেক হানাদার বাহিনীর কাছে কেবল দেশটা হস্তান্তর করে রেখে গেছে। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের কাছে দেশ থাকলেই বা কী, অথবা দেশের হানাদারের কাছে! আমরা তো জন্মেছিই কেবল শোষিত হবার জন্যই। যার তার হাতে হলেই হলো!ʼʼ

মুরসালীন একটু থেমে বলল, “স্বাধীনতার আগে আর পরের পার্থক্য শুধু–পরের দেশের শাসক এবং নিজের দেশের শাসক। অনেকটা ওরকম—নিজের লোক চিবিয়ে খেলে সহ্য হয়, পর টোকা দিলেও না। বুঝতে পারছেন স্যার?ʼʼ

-“তুমি যা বোঝাতে চাচ্ছ, তা যারা বুঝবে তারা এখন ফাঁসির অপেক্ষায়। আমরা বুঝব না এসব।ʼʼ

-“একটা গল্প শুনবেন স্যার?ʼʼ

-“অনেক গল্প জানো তুমি।ʼʼ

-“তা জানি টুকটাক। তবে এখন গল্প থাক। ব্যাপারটা হলো–অবুঝকে বোঝানো গেলেও যারা বুঝে বোঝেনা, তাদেরকে বোঝানো অসম্ভব। ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম পাড়ানো যায় না, স্যার।ʼʼ

মাথা দুলিয়ে হাসলেন দোলন সাহেব, “তোমার নিজের স্বাধীনতা বিরোধি মানসিকতার স্বপক্ষে আরও অনেক ধারণা থাকবে। সেগুলোও শুনতে ইচ্ছে করছে।ʼʼ

-“জি স্যার, জানা দরকার। নয়ত আমার ফাঁসিটাকে জনগণের কাছে জায়েজ করতে কষ্ট হবে। তা যেমন ধরুন, আগে বিদেশীরা আমাদের দেশে এসে আমাদের জনগণ ও সম্পদ শোষন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যেত। স্বাধীনতার পর বিদেশীদের এই খাটুনিটা কমেছে। অর্থাৎ বিপ্লবীরা রক্ত ঝরিয়ে দেশ স্বাধীন করে এখন নিজেরাই জনগণ ও দেশের সম্পদ শুষে নিয়ে গিয়ে ইংরেজদের দেশে দিয়ে আসছে। এটা ভালো, স্যার। ওরা এসে কেন নিয়ে যাবে, আমরা গিয়ে দিয়ে আসব। পরোপরকারী শাসকগোষ্ঠী।ʼʼ

মুরসালীনের মুখটা কঠিন হলো, “স্যার, আমি শুধু দেখেছি ওরা নিজেদের অতীতের কৃতিত্ব তুলে ধরে নিজেদেরকে দেশের সর্বেসর্বা প্রমাণ করা ছাড়া বিশেষ কিছু করেনি। আর তা নিয়ে দলীয় বিবাদে ওরা চুল ছেঁড়াছিড়ি করছে, আমরা আম জনতা বলি হচ্ছি। স্যার, আমি কোনো দলেরই সমর্থক নই। কেবল মাঝেমধ্যে দোলাচলে গড়িয়ে পড়ি একেক পাশে, এই যা।ʼʼ

সব কথা রেখে দোলন সাহেব ভ্রু উচিয়ে সতর্ক কণ্ঠে বললেন, “আর সবশেষে কথাটা কিন্তু এ-ই আসছে, ওরাও যুদ্ধের বিরোধী ছিল, তুমিও। ওরাও কওমী জামায়াতের সমর্থক ছিল, তুমিও।ʼʼ

-“খুব ভুল বললেন। সেগুলো কি ব্যাখ্যা করব, স্যার।ʼʼ

-“করো করো। আমি শুনতে চাই।ʼʼ

-“ছোটবেলায় যখন যুদ্ধের গল্প অথবা উপন্যাস পড়তাম, পাকিস্তানিদের ওপর এত কঠিন ক্ষোভ জমতো, ইচ্ছে করতো এখন সুযোগ পেলে এখনই ঘাঁড়ে রাইফেল আর হাতের ওপর জানটা নিয়ে যু-দ্ধে চলে যাই, ওদের জাহান্নামে পাঠিয়ে দেশবাসীকে রক্ষা করি।ʼʼ

মুরসালীন জোরে জোরে হাসল, “বাচ্চা ছিলাম, স্যার। বুঝতাম না। কিন্তু একটু একটু করে বড় হলাম–এরপর দেখলাম–পরের দেশের শাসকেরা এতটা ভয়নাক ছিলই না বাঙালি জাতির ওপর, তথাকথিত সেই স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালির সাথে যা যা হয়ে আসছে! তো সেই একই পরাধীনতা যদি এখনও বাঙালিকে গ্রাস করে রাখে, তবে আপনার মনে হয় না স্যার, যুদ্ধটা কেবলই দেশপ্রেমিক বিপ্লবী শহীদদের র-ক্তের অপচয় ছিল? কারণ আমরা বাঙালি তো আজও স্বাধীনতা পাইনি। শুধু নাম পেয়েছি স্বাধীন জাতির। এই ফাঁপা নাম কামানোর জন্য এত আয়োজন ছিল! এত র-ক্ত, এত ত্যাগ, এত সম্মানহানি, এত হাহাকার!ʼʼ

একটু থেমে মুরসালীন বলল, “স্যার, এ কারণে হলেও সে-সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, তাদেরকে আমার সচেতন মনে হয়। আর স্যার–ʼʼ

থামল মুরসালীন। দোলন সাহেব বললেন, “বলো বলো। থামলে চলবে না আজ। বলে যাও।ʼʼ

মুরসালীন হাসল, “আপনারা যাদের যুদ্ধাপরাধী বলে শাস্তি দিচ্ছেন, তাদের বয়স হিসেব করলে আপনাদেরকে মূর্খ অথবা শয়তান ছাড়া কিছু বলা যায় না। নাবালক শিশু ছিল তারা বয়স হিসেবে, তাদের দিচ্ছেন দেশদ্রোহীর শাস্তি একালে এসে। আবার আজও যারা শিশু, তারাও আপনাদের শিকার! স্যার মূলত, আপনাদের সমস্যাটা কোথায় বলুন তো! সমস্যা মূলত ইসলামে। কারণ ইসলামের জীবনবিধান আপনাদের একরত্তি কর্মকাণ্ডকেও সমর্থন করে না। সমস্যা আপনাদের মূলত, কথা বলা মুখে। যে মুখগুলো মূর্খ-বোকা বাঙালদের সম্মুখে আপনাদের স্বরূপ তুলে ধরে নিজেদের বয়ানের মাধ্যমে। সমস্যা মূলত, আপনাদের অ-নীতিতে। যে নীতি শিবিরের ছেলেরা গুড়িয়ে দিতে চায়। তাই যেন দেশে আর কোনো বিবেচক মুক্তিপ্রেমী গরম রক্তের যুবক তৈরি না হয়, সেই ব্যবস্থা করছেন আপনারা। যারা তৈরি হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাদের মিটিয়ে দিচ্ছেন। আপনাদের সমস্যা নেই জয়েদের থেকে। কারণ ওরা আপনাদের কাছে অনৈতিক সুবিধা আর সব রকম প্রশ্রয় পেয়ে অন্ধ, ওরা অবিবেচক, ওরা আপনাদের কাছে ঋণী, তাই বিরুদ্ধে বলার মানসিকতা হব না ওদের। অথচ আপনারা কোথাকার কোন মিছেমিছি যুদ্ধাপরাধ, কোথাকার কী টেনে এনে পথ সাফ করছেন! কৌশল ভালো, তবে সস্তা।ʼʼ

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৫.

কবীরকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সন্দেহভাজন হিসেবে। গোটা জিজ্ঞাসাবাদের সবটাই ছিল—জয় ও হামজার গতিবিধির ব্যাপারে।

অফিসার বললেন, “যেদিন পলাশকে ধরতে যাওয়া হয়েছিল, সেদিন জয় ও হামজা কোথায় ছিল?ʼʼ

কবীর জানে না এখন কেমন মিথ্যা বলা উচিত। কোথায় ছিল বললে জয়ের ক্ষতি হবে না! সে বলল, “স্যার, আমি ওই কয়টা দিন খুব অসুস্থ ছিলাম। জ্বর, সর্দি, কাশি। ক্লাবে যাইনি, যোগাযোগ ছিল না ভাইদের সাথে।ʼʼ

অফিসার মাথা নাড়লেন, “খুবই অবিশ্বাস্য গল্প। আচ্ছা, জয় ও হামজার সাথে পলাশ আজগরের সম্পর্ক আসলে কেমন ছিল?ʼʼ

-“খুব ভালো, স্যার। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।ʼʼ

-“এজন্যই পলাশের কুকর্মের হদিশ জয়ের গোপন মারফতে এসবি ডিপার্টমেন্ট পেয়েছে? তোরা কী ভাবিস? আমরা কিছুই জানি না? পলাশদের মতো অপরাধীদের ছেঁদ ওদের আপন কেউ-ই করতে পারে কেবল।ʼʼ

পানিভর্তি গামলায় কবীরের মুখ চুবিয়ে ধরে রাখা হলো। নাকে মুখে পানি উঠে চোখমুখ উল্টে এলো কবীরের। টর্চারের এক পর্যায়ে কান দিয়ে রক্ত উঠে এলো।

জ্ঞান হারাবার আগ দিয়ে পানি থেকে টেনে তুলে ফের সেই প্রশ্ন, “কী জানিস, বল! সব জানিস তুই, শালা। তুই খুব ক্লোজ লোক ওদের।ʼʼ

কবীর কথা বলে না। সে অত চতুর নয়। তার ভয় হয়, মুখ খুললে ভুলভাল বেরিয়ে যেতে পারে। চুপচাপ থাকতে হবে। কিচ্ছু বলা যাবে না। হামজা, জয়ের সাথে গাদ্দারি সে করতেই পারবে না।

কবীরের বাবা হামজার ট্রাক ড্রাইভার ছিল। দুর্ঘটনায় চিরতরে পঙ্গু। তবু হামজা এখনও মাসে মাসে বেতন দেয়। চারটা বোন কবীরের। তিনটার বিয়ে পরপর হামজা নিজে দায়িত্ব নিয়ে দিয়েছে। জয়কে কবীর ‘ভাইʼ মানে। সে ঠিক করে নিয়েছে–মরে গেলেও বলবে না ব্যাপারটা।

কবীরকে চামড়ার বেল্ট দিয়ে পেটানো হলো। পিঠের চামড়াগুলো বেল্টের সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠে পড়ছিল। কবীর বলল না কিছুই। তার মুখে কথা আসছে না। সে বলতে পারছে না–জয় পলাশকে কীভাবে মেরেছে। তার চোখের সামনে তরুর লা-শ ভেসে উঠছে। জয়ের রসিক মুখখানা হাসছে। সাদা লুঙ্গি উঁচিয়ে হেঁটে এসে জয় কবীরের সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, “তুমি কি শালা হাফ লেডিস হে? এইটুকু আঘাতে কেউ এরম কাত হয়ে পড়ে? এনার্জি ড্রিংক এনে দেব? দুই চুমুক দিবি?ʼʼ


রূপকথাকে ওপর নরক নামলো কারাগারে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বিভিন্ন মানসিক ও যৌন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছিল। তাকে যে সকল নারী কয়েদীর মাঝে রাখা হয়েছিল, তারা আবার জঙলি পুরুষের চেয়েও বেশি ভয়ানক।

রূপকথা দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এই দুনিয়ায় তার নিজস্ব কেউ নেই। পরাগ আছে, কিন্তু পরাগের সাথে এক প্রকার সৎ-ভাইগত বিরোধও ছিল, সেটা খুনশুটির মতোই লাগে এখন। রূপকথা জানে, পরাগ রূপকথাকে বোনের চেয়ে কম ভালোবাসেনি। তবে সেই ব্যাপারটা জটিল।

রূপকথার আজ কয়দিন পরাগকে দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ওর ক্ষতগুলি দেখতে। নিশ্চয়ই ওকে খুব মেরেছে! ওর অপরাধ অনেক, আর ভয়ানক! পলাশের জোরে বেঁচে ছিল এতদিন। এবার কি পরাগের ফাঁসি না হয়ে যায় আর?

পলাশের কথা মনে পড়ে রূপকথার। কখনও কখনও রূপকথার ওই লোককে ভালোবাসতে ইচ্ছে করতো। স্বামী তো! পলাশ স্যাডিস্ট ছিল। পাগলামির সময় বাদে বাকিসময় খুব ভালো থাকতো। ঠিক চাচাতো ভাই পলাশের মতো। বাপের ওপর রূপকথার একসময় খুব ভালোবাসা ছিল, সেটা বিয়ের পর লজ্জা ও আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। রাজন আজগরকে সে প্রচণ্ড ভয় পেত তারপর। পলাশের চেয়েও বেশি।

যতদিন না সে পলাশের নিখোঁজ হবার ব্যাখ্যা দেবে, তাকে ছাড়া হবে না। এমনকি তার পরেও না বোধহয়। এই কাহিনি তো বহুদূর বিস্তৃত। তা গোটাটা আইন জানলে এই গল্পের প্রতিটা চরিত্রের জন্য শাস্তি বরাদ্দ।

রূপকথার মৃত্যুতে আগ্রহ বাড়ছে দিনদিন। শরীরের ব্যথাকে সে বহু আগে জয় করেছে। আর বর্তমান মানসিক যন্ত্রণা তাকে শুধু মরতে পরামর্শ দেয়।

দুইদিন রূপকথা কিছু খায়নি। শেষবার সাত-আটঘন্টা আগে এক গ্লাস পানি খেয়েছিল। পিপাসা পাচ্ছে। কিন্তু রূপকথার বুকে ও গলায় প্রচণ্ড ব্যথা। পানি গিলতে আজাব হয়। হাতের ক্ষততে পঁচনের মতো ধরেছে। শুকছে না, স্থানটা গলছে। তার ওপরও আবার মারা হয়েছে। সেসব শরীরের যন্ত্রণা বিশেষ কিছু মনে হয়নি রূপকথার। পলাশ তাকে এসব জয় করতে শিখিয়েছে গেছে সেই কবে!


পলাশের মাথা দাফন করার পর জয় আর অন্তূ প্রায় শেষরাত অবধি গোরস্থানের প্রাচীরের পাড়ে বড়পুকুরের ধারে বসে ছিল।

কবীর কিছু পয়সা দিয়ে খাদেমকে খুশি করে একটা ইটের গাদার ওপর বসল।

অন্তূ বসে রইল চুপচাপ। তার ভেতরের প্রশ্নরা বড্ড উতলা! জয়ের শরীরে ও লুঙ্গিতে তখন মাটি ভরা। কবীরের কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিলো। তাতে আগুন ধরিয়ে পাঁজা পাঁজা ধোঁয়া গিলতে লাগল।

-“আপনি খুব অস্থির!

সিগারেট ঠোঁটে গুজে অস্পষ্টভাবে বলল, “তাই নাকি?ʼʼ

-“অস্থির না হলে সচরাচর আপনাকে সিগারেট টানতে দেখা যায় না।ʼʼ

-“বাপরে! আপনি খুব জানেন আমায়?ʼʼ

-“আপনি নিজেও জানেন না নিজেকে। আমিও না।ʼʼ

-“জেনে কী হবে? পুরষ্কার পাব?ʼʼ

-“দায়সারা জবাব দেবেন না। বিরক্ত লাগে।ʼʼ

জয় হো হো করে হেসে উঠল, “দায়সারা লাগছে?ʼʼ

অন্তূ আচমকা সিগারেটটা জয়ের ঠোঁট থেকে কেঁড়ে নিয়ে ফেলে দিলো পুকুরের ঢালে। বাতাসের ঝাপটায় নাকেমুখে ধোঁয়া ঢুকছিল।

জয় কেমন করে যেন হাসল, “ভয় লাগেনা আমারে? এত বিরোধিতা ক্যান আমার সাথে তোমার?ʼʼ

-“আপনি শুরুটা করেছেন। স্মৃতিশক্তি দূর্বল হয়ে পড়েনি তো!ʼʼ

নাটকীয় স্বরে বলল “আ? আমি? অপবাদ দিচ্ছ, ঘরওয়ালী! প্রথমদিন আমার সঙ্গে কে বিরোধিতা শুরু করেছে?

-“কে করেছে?ʼʼ

-“আমি জয় আমির। এণ্ড আই ক্যান ডু এনিথিং দ্য ফাক আই ওয়ান্ট! এইটুকু এখতেয়ার অর্জন করেছি আমি। তাই বলে তুমি ওইরকম ভাব দেখাবে?ʼʼ

-“ছিঃ! কী যে মারাত্মক পাপ ছিল ওটা। ভাবলে লজ্জাই লাগে এখন। আপনি কোথায় জয় আমির, আর আমি হলাম এক জলে ভাসা পানা। মাফ করেছেন তো আমাকে সেইসব অপরাধের জন্য? নাকি এখনও বাঁধিয়ে রেখেছেন? এখন ক্ষমা চাইব? পা দুটো দেখি আপনার, এগিয়ে দিন তো!ʼʼ

-“উফহহ!আবার শুরু করলে সেই বাদ-প্রতিবাদ!ʼʼ

-“খারাপ লাগছে?ʼʼ

-“না। ভালোই লাগছে।ʼʼ

অন্তূ করল কী! আস্তে কোরে জয়ের কাঁধে মাথা ঠেকালো। জয়ের মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে আসে। বুকের ভেতর কেমন যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল। দাঁতে দাঁত আঁটকায়। খানিক ধাতস্ত হয়ে বলে, “দুশমনের কাধে মাথা রাখছো! ঘেন্না লাগছে না?ʼʼ

-“এতগুলো দিন ঘর করার পরেও সেই সেন্সিটিভিটি থাকতে আছে?ʼʼ

জয় একটু মুখ নামিয়ে ফিসিফিস করে অদ্ভুত গলায় বলে, “যার জন্য সীমাহীন ঘৃণা পুষছো ভেতরে, তার কাধে মাথা রেখে তাকে ধ্বংসের পরিকল্পনা-ছক কষছো। তোমরা এই ছলনায় খুব দক্ষ, না!ʼʼ

-“হলে কী? তা তো আর আপনার গায়ে লাগবে না!ʼʼ

-“ছলনা মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। খুব ভয়াবহ ব্যাপার-স্যাপার এটা।ʼʼ

-“আপনার সঙ্গে ছলনা করার কিছু নেই। আপনি সব জানা-বোঝা অবুঝ।ʼʼ

-“ছলনা বুঝি না।ʼʼ

-“সব বোঝেন আপনি।ʼʼ অন্তূ গাঢ় শ্বাসের সাথে কথাটা বলে।

আলতো করে মাথাটা ঠেকানো জয়ের কাধে। বুকের ভেতর পুড়ছে। ঘাঁড় ফেরালেই আব্বুর কবরটা চোখে পড়বে। আব্বু তাকে সেদিন বলেছিল– ‘আমি তোকে মৃত্যুর চেয়েও নিকৃষ্ট মৃত্যু দিচ্ছি, অন্তূ।ʼ ‘লোকেরা বলছে, ব্যবসা যারা করে, তারা বিয়ে করতে চায় না।ʼ

অন্তূ বিয়ে করে নিয়েছে। জয় আমিরকে বিয়ে করে নিয়েছে। চোখ বুজে জয়ের কাঁধের ওপর মাথাটা আরও শক্ত করে চেপে রাখে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে–লোকেরা অন্তূর ওড়নাটা খুলে ফেলল বুকের ওপর থেকে। সেদিন কেউ ছিল না অন্তূর সম্ভ্রম রক্ষা করার! তবে নষ্ট করার মূলে ছিল সেই পুরুষটি, যার নামের পরিচয়ে অন্তূকে বাঁচতে হচ্ছে।

একদলা থুতু এসে জড়ো হয়েছিল অন্তূর মুখের ওপর। সেদিনের সেই লোক সমাগম, সেই সকল ধিক্কারবাণী…অন্তূকে নিয়ে আজও ভার্সিটিতে কত রটনা! মাথায় জড়ানো গামছাটাও সেদিন ছিল না মাথায়। জয় তখন কী করছিল? চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিল। চোখে তৃপ্তি, মুখে বিরক্তি।

অন্তূর শ্বাস উঠল। এইসব ভাবলে কঠোর অন্তূটা কেমন এলোমেলো হয়ে যায়!

জয়ের কাধে গরম নিঃশ্বাস পড়ছিল। বাহুর স্নায়ুতে অন্তূর বুকের তোলপাড় অনুভূত হচ্ছিল। জয় হাসল, “ঘরওয়ালি! এবার মনে হচ্ছে আপনি খুব অস্থির। একটা সিগারেট দেব? ওয়ান্না ট্রাই এ লিটল?ʼʼ

অন্তূ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল, “পলাশকে মারলেন কেন?ʼʼ

-“তরুর কাছে ওয়াদা করেছিলাম।ʼʼ

-“আপনি তো দায়বদ্ধ না কারও কাছে! তার ওপর আপনি যখন ওয়াদা করেছেন, তরু তখন জীবিত ছিল না। এক মৃতদেহের কানে কানে করা ওয়াদার খাতিরে জয় আমির এত ঝুঁকি ওঠাতে পারে?ʼʼ

-“সেক্ষেত্রে তুমি কী ভাবতেছ?ʼʼ

অন্তূ মাথা তুলে সোজা হলো, “কাঙাল আপনি। স্নেহের কাঙাল, মায়ার কাঙাল। কারও মায়ার দায়বদ্ধ আপনাকেও কয়েদ করে ফেলতে পারে।ʼʼ

জয় হাসে, “এত ভুল ধারণা পুষো না আমার ব্যাপারে। আমার জীবনে, সমস্যা, ব্যথা, কষ্ট, আবেগ, অনুভূতি—ছাড়া সব আছে। তুমি জানো না আমায়।ʼʼ

-“জানতে চাই।

-“দরকার কী?ʼʼ

-“জানি না। আর এমনও না যে আমি আপনাকে একটুও জানিনা।ʼʼ

-“তাহলে তো হলোই! জানোই তো!ʼʼ

-“আপনি আপনার অতীতকে ভয় পান?ʼʼ

-“আমার কোনো অতীত বা ভবিষ্যত নেই। আছে একটা বর্তমান। যতক্ষণ শ্বাস চলবে, প্রতিটা চলমান মুহুর্তের বর্তমানকে মানি আমি শুধু। আমি তোমাকে আগেও বলেছি, আমি খারাপ, তাই আমি খারাপ, কারণ আমি খারাপ। এর আর বিকল্প আর যুক্তি বা ব্যাখ্যা নেই।ʼʼ

-“আপনি মুস্তাকিন মহানকে মেরেছেন কেন?ʼʼ

-“ইচ্ছে।ʼʼ

-“আপনার সম্পর্কে কোনো কথা বলতে আগ্রহী নন আপনি। তো এটাই তো আসে হিসেবে, আপনি নিজেকে লুকোতে চান।ʼʼ

জয় অন্তূর কানের কাছে মুখ নিয়েছিস ফিসিফিস করে বলল, “ফিল্মি ডায়ালোগ মারছো, ঘরওয়ালি! কী লুকাতে চাই? মানে আমাকে আবার সেইসব হিরোর মতো ভাবতে চাইতেছ না তো–যারা নিজেদের ভালোকে লুকিয়ে রেখে খারাপটা দেখায়, কিন্তু আসলে তারা ভালো। এমনটা ভাবছো?ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ

-“উঠিও না কখনও। জয় আমির আগাগোড়া নষ্ট। তুমি কী যেন বলো না! হ্যাঁ, পাপীষ্ঠ। যদিও পাপ শব্দটাকে বুঝি না আমি।ʼʼ

-“অতীতটা খুব দূর্বল ছিল আপনার?ʼʼ

-“তার মানে এখন আমি খুব শক্তিশালী?ʼʼ

-“এত হেঁয়ালি করেন কেন? মানুষ জানে না, আপনি কতটা রহস্য করে কথার মারপ্যাচ খাটাতে পারেন।ʼʼ

জয় হাসল, “সহজ ভাষায় কথা বলছি আমি। বলো, কী জানতে চাও?ʼʼ

-“আপনি মাজহার, পলাশ, ঝন্টু সাহেব এদের কেন মেরেছেন? যেখানে আপনি নিজেও একই গাছের ফল! ওদের মারতে আপনার এত আয়োজন! পাপীর হাতে কেন পাপীরা মরবে? তা যদি হয়-ই! তবে আপনি আপনাকে কেন মারেন না?ʼʼ

জয় হাসল, “আত্মহত্যা মহাপাপ।ʼʼ

অন্তূ হেসে উঠল, “পাপ? ইশ, মহাপাপ? আপনি বলছেন?ʼʼ

জয় নিজেও হেসে ফেলল গা দুলিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি মেরে দাও। কেউ একজন বলেছিল, বউয়ের হাতে মরলে নেকি হয়। কোন সম্বন্ধির ছাওয়াল বলেছিল, কে জানে!ʼʼ

-“আমার হাতে মরার খুব শখ? আজকাল কেমন নিজেকে সঁপে দেন। ব্যাপারটা যায় না আপনার সঙ্গে?ʼʼ

-“যায় না?ʼʼ জয় হাসল, “কী যায় আমার সঙ্গে? তুমি কি আমায় অবজার্ভেশনে রেখেছ নাকি? প্রেমে-টেমে পড়ে যাওনি তো?ʼʼ

অন্তূ হাসল, “অবজার্ভেশন! হ্যাঁ, অবজার্ভেশন। আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি।ʼʼ

-“তোমার মতে তোমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি আমি। তো তার শাস্তি হিসেবে মেরে দাও, নাকি আরও কঠিন প্লান-প্রোগ্রাম আছে? তাও যদি তৃপ্তি পাও।ʼʼ

-“আমার মতে? অর্থাৎ আপনার মতে আপনি কোনো অন্যায় করেননি আমার সঙ্গে?ʼʼ

-“না।ʼʼ

দুজন কেউ কারও দিকে তাকায় না। এটা জয় ও অন্তূর পারস্পারিক নিজস্বতা। কিন্তু অন্তূ তাকাল এবার, “কোনো অন্যায় করেননি?ʼʼ

অকপটে বলল জয়, “না।ʼʼ

-“মারলেও তবে আমি সেদিনের অপেক্ষা করব, যেদিন আপনার মনে হবে আপনি আমার সঙ্গে অন্যায় করেছেন।ʼʼ

-“তাহলে আর তোমার হাতে মরার সাধ মিটলো না এ জনমে।ʼʼ

-“অনুশোচনাকে ভয় পান?ʼʼ

-“আজ আমার ভয়ের তালিকা তৈরি করতে বসেছ নাকি? কী কী বিষয়ে ভয় আমার?ʼʼ

-“তালিকা প্রস্তুত।ʼʼ

-“সর্বনাশ। শুনি দেখি, তালিকায় কী কী বিষয় অন্তর্ভূক্ত করলে!ʼʼ


হামজা যখন ভার্সিটির ছাত্রনেতা হয়ে উঠছিল, সালটা ২০০২। জয় কেবল তখন দশম শ্রেণীতে, বয়স কমবেশি পনেরো। তখন সে জীবনের প্রথম খু-ন হিসেবে সৈয়দ মুরসালীন মহানের বাবা সৈয়দ ফরহাদ মুহাম্মাদ বারী সাহেবকে খু/ন করল। বিরোধী দলের রাজত্ব চলছে তখন বাংলাদেশে।

পুলিশ ফেরত হবার পর জয়কে তারপর প্রায় তিন সপ্তাহের বেশি সময় পাওয়া গেল না। একটা কবরের মতো অন্ধকার বেসমেন্টে সপ্তাহখানেক আঁটকে রাখা হলো। এক গ্লাস করে পানি পেত সে চব্বিশ ঘন্টায় একবার, সাথে দুটো ছোট্ট ছোট বিস্কুট।

আলোহীন কুঠুরি। জয় কখনোই সেই ঘরের বর্ণনা দিতে পারবে না। সে ঘরটাকে দেখেনি। শুধু জানে কোনো এক খসখসে মেঝেতে তাকে বসে থাকতে হতো। চোখের সামনে কবরখানার মতো নিকষ কালো অন্ধকার। জয় চোখ বুজে থাকতো। চোখের সামনে একটা নির্দিষ্ট সময়ের বেশি অতি আলো অথবা অতি অন্ধকার মানব মস্তিষ্ক সইতে পারে না। জয় বুঝতে পারছিল, সে পাগল হয়ে যাবে। কিন্তু চোখ বুজলেও সেই অন্ধকারই! মস্তিষ্কে কত রকমের বিভ্রম তৈরি হয়। কতকিছু যে দেখে জয়, অনুভব করে নিস্তব্ধ আঁধারি আশাপাশটা!

চারদিকে কোথাও আওয়াজ নেই। জন-মানবের শ্বাসের শব্দটুকুও নেই। নিজের বুকের শ্লথ হৃদস্পন্দন আর গাঢ় শ্বাসের আওয়াজ অদ্ভুত শোনায় কানে।

কেউ ছিল না তার কাছে তখন। কিন্তু কেবল মৃত্যুর সঙ্গ পেয়েছে বারবার সে এসব সময় গুলোতে। মৃত্যু এসে বসে জয়ের সম্মুখে। গল্প করে জয়ের সঙ্গে। মৃত্যুর সঙ্গে যেতে চায় জয়, অনুরোধও করে। কিন্তু মৃত্যু বলে, ‘এত দ্রুত নয়। অপেক্ষা করতে হবে।ʼ

জয় অপেক্ষাকে ঘৃণা করে। সে মৃত্যুর প্রেমে পড়েছে খুব ছোটবেলায়। গভীর প্রেম। কিন্তু মৃত্যু বরাবর শেষ পর্যায়ে প্রত্যাখ্যান করেছে জয়কে। প্রতারণা করেছে জয়ের সাথে। ছোটবেলা থেকে করে আসছে। বারবার আসে, বহুদিন জয়ের সঙ্গে সময় কাটায়, জয়ের ভেতরে নিজের জন্য মায়া তৈরি করে। কিন্তু আলিঙ্গন করে না!

মানসিক অবস্থা যখন উলোট-পালোট হবার দিকে, সে-সময় দরজা খোলা হলো। লেপ-তোষক সেলাই করার সুঁচ, যাকে বাঁশসুঁই বলা হয়। জয়ের শরীরে গাঁথা হতো তা। কখনও এবরো-থেবরো ইটের টুকরো দিয়ে পেটানো হতো। শরীরের মাংসপেশী ছিঁড়ে আসতো। কিশোর বয়সের ছিপছিপে লম্বা শরীরটায় গভীর সহ্যক্ষমতা জন্মে যাচ্ছিল জয়ের।

অতিরিক্ত ড্রাগ দেবার ফলে নাক-মুখ দিয়ে গবগবিয়ে রক্ত আসতো। প্রায় মাসখানেক অবিরাম ড্রাগ সেবন করানোর ফলে জয় আসক্ত হলো। দিনদিন ক্রমাগত কড়া হতো ড্রাগের ডোজ। অসীম যন্ত্রণায় জর্জরিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জয় মৃত্যুকে খুব ডেকেছে। মৃত্যু আসে, দূর থেকে চেয়ে দেখে জয়কে। কিন্তু বরাবরের মতো ছলনা করে চলে যায়।

জয়ের মাঝেমধ্যেই নিজেকে নির্লজ্জ মনে হয়েছে। মৃত্যু তার প্রেমকে এত্ত অবহেলা করেছে, এত ছলচাতুরি করেছে। তবু জয় বিমুখ হতে পারে না। তার প্রেম ফুরোয় না মৃত্যুর ওপর থেকে।

হামজা পাগলের মতো চারদিকে ঘুরেছে। দেশে কড়াকড়ি আইন চলছিল তখন। চারদিকে অপরাধী গ্রেফতার, আর দণ্ডের দিন চলছিল। হামজা প্রতিকূল এক পরিবেশে, তখনকার বিরোধী দলের পক্ষে খোলাখুলি দলীয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা কর্মী। কারণ তার বিশ্বাস ছিল—সামনে দিন বদলাবে। নতুন এক শাসনব্যবস্থা আসবে বাংলাদেশের সংসদে।

একদিন পুলিশ এলো হামজার কাছে জয়ের খোঁজে। সৈয়দ মুজাহার মহানকে হ-ত্যার দায়ে প্রথম সাসপেক্ট জয় আমির। হামজাকে গ্রেফতার করা হলো জয়ের নিখোঁজ হবার সতেরো দিনের দিন।

প্রসাশনের দৃঢ় বিশ্বাস, সে জয়কে লুকিয়ে রেখেছে। হামজা বলল, “স্যার, আমি নিজেই ওকে খুঁজে হয়রান। আপনারা যেভাবে জয়কে সন্দেহ করছেন মুজাহার সাহেবের মৃত্যুর জন্য, মুজাহার সাহেবের দলীয় কর্মীরাও তাই করছে, স্যার। ওরা জয়কে গুম করেছে। আপনারা ওকে খুঁজতে সাহায্য করুন আমায়।ʼʼ

হামজার সুচতুর কথাবার্তায় প্রসাশন কর্মকর্তারা ভিজলেন না। বললেন, “তাহলে আগে কেন রিপোর্ট করোনি? বেশি শেয়ানা ভাবো নিজেকে? যদি এটাই মনে হতো, তো আগে নিখোঁজ ডায়েরী করতে। নিজে লুকিয়ে রেখে তো আর ডায়েরী করা যায় না!ʼʼ

হামজা ওদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করাতে পারেনি, সে জানে না জয় কোথায়! আবার এটাও ঠিক, জানলেও বলতো না, প্রশ্নই ওঠে না। আর এটাও ঠিক–জয় খু-নটা করেছে। কিশোর অপরাধ। জয় তখন ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ ফাঁসি হতো না হয়ত। কিন্তু আইনের হেফাজতে থাকবে সাবালক হওয়া অবধি, এরপর দণ্ড। অথচ হামজার চিন্তা জয়ের ক্যারিয়ার নিয়ে। সামনে ওর এসএসসি পরীক্ষা।

হামজা বুঝতে পেরেছিল, খুব শীঘ্রই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে। এই সরকারের পতন ঘটবে। এরপর দিন আসছে সামনে বোধহয় তাদের।

হামজারকে কারেন্টের শক দেয়া হলো। একেকবারে শরীরটা রিকেটস রোগীর মতো বেঁকে উঠছিল। শরীর থেকে যেন একেকবারে এক লিটার করে রক্ত শুষে নিচ্ছিল বিদ্যুৎ। অবশ হয়ে উঠল স্নায়ুকোষগুলো, থরথর করে কাঁপছিল শরীরটা। ঠোঁটের কোণ ও নাক দিয়ে র-ক্ত বেরিয়ে এলো।

তবু হামজা বোবা। তাগড়া-দূর্বল দেহখানা চেয়ারের পিঠে ঠেকিয়ে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে রইল। শ্বাস পড়ে না ঠিকমতো, দুই হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছে। শরীরের প্রতিটা রগ ঝিনঝিন করছিল। হামজার মুখ থেকে ব্যথার পেক্ষিতে আর্তনাদও বের হচ্ছিল না। জয়ের নামটাও মুখে আনলো না।

এরপর হামজার হাতের আঙুলের উপরিভাগ কেটে ফেলা হলো। অল্প একটু চামড়ার সঙ্গে বেঁধে রইল আঙুলের অংশটুকু। তখনও হামজা নিশ্চুপ। ওকে জিজ্ঞেস করা হলো, “শেষবার জিজ্ঞেস করছি, বল তোর জয় কোথায়?ʼʼ

হামজা হাসল, “শেষবার নয়। আবার জিজ্ঞেস করবেন। এবং প্রতিবার আমার উত্তর থাকবে—আমি জানি না জয় কোথায়! শুধু জানি, মানে পাক্কা আন্দাজ করতে পারি জয়কে কারা ধরেছে। আমার ধারণা জয়কে তারা মারবে না। মারলে গোটা দলটাকে আগুন লাগিয়ে দেব। আর না মারলে এই দুনিয়ার যেকোন প্রান্ত থেকে আমি হামজা একা জয়কে খুঁজে বের করে আনব। আপনাদের সাহায্যের আর দরকার নেই আমার।ʼʼ

হামজার হাতের আঙুল সেলাই করা হলো। দাগটা পরবর্তীতে মেলেনি আর।

জয়কে উদ্ধার করলেন বাপ্পী মণ্ডলের চাচা গিয়াস মণ্ডল। দলের সেই সংকটের সময়ও উনি উল্লেখযোগ্য এক বিরোধীদলীয় নেতাকর্মী। জয় ও হামজার মতো দুটো বারুদকে দলে পেলে দলের ভর বাড়ে। এভাবেই দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি করতে হচ্ছিল তখন। ছাত্রলীগ ও সন্ত্রাস এবং যে সকল অসাধু রাজনীতিবিদেরা অপারেশন ক্লিনহার্টে ধরা পড়েছিল, তারা এমনিতেই দল ছেড়ে এই দলের প্রতি ঝুঁকছিল। এবং বাপ্পী মণ্ডলেরাও তাদের সাদরে গ্রহণ করছিলেন।

জয়কে ছাড়িয়ে আনারও প্রায় তেরোদিন পর্যন্ত হামজা আইনের হেফাজতে রইল। সে তখন উঠতি ছাত্রনেতা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের কমতি নেই। বড় বড় নেতাকর্মীদের সুনজর হামজার ওপর তীব্র। রাজধানী থেকে রোজ ডাক আসছে।

জয় ড্রাগের নেশায় পাগল তখন। তার বুক-পিঠের ক্ষতগুলো গর্তের রূপ নিয়েছে। হিতাহিত জ্ঞান অনেকটাই লোপ পেয়েছে। দরজা-জানালা খুলতে দিতো না রুমের। দিনের বেলা বাইরে যেত না। আলো সহ্য করা দায়। তার জন্য ড্রাগ জোগাড় করাটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। হামজা থামাতে পারতো না জয়কে।

তরু নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে জয়ের সেবা করেছে। সেই দিনগুলোতে স্কুলে অবধি যেত না মেয়েটা।

শরীরের ব্যথানাশক হিসেবেও কড়া সব ড্রাগের ব্যবহার করতে হয়েছে জয়ের শরীরে। জয়কে ঘরে আঁটকে রেখে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করা হলো। জয় ২০০২-এর এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। সে-বছর পরীক্ষাও দেয়া হলো না। ইয়ার-লস।

মানসিক ও শারীরিক অবস্থা একেবারে বিগড়ানো। সে র-ক্ত ও মৃত্যুর প্রেমে খুবই ছোটবেলায় পড়লেও প্রত্যক্ষভাবে নিজের হাতে প্রথম খুনটা সেবারই করেছিল।

পলাশের হোটেলে তার নিয়মিত যাতায়াত শুরু হলো। পলাশের সঙ্গ তাকে অনেকটা চাঙ্গা করে তুলল। পলাশ জয়কে প্রচুর সঙ্গ দিয়েছে। পলাশের কত নারকীয় অপরাধের সাক্ষী জয়! অদ্ভুত এক সম্পর্ক তৈরি হলো ওদের। মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন ড্রাগ ও নারীনেশায় লেলিয়ে দিলো হামজা।

কলেজে ভর্তি হবার পর পড়ালেখার সাথে সমান্তরাল হারে দুই ভাইয়ের আগ্রাসী যাত্রা শুরু হলো। হামজার তখন অনার্স শেষের দিকে। সে ধীরে ধীরে ছাত্র সংগঠনের কর্ণধার হয়ে উঠেছে। সমাজে পরিচিতি বাড়ছিল, সাথে বদনাম ও পুলিশের খাতায় অপরাধ-অভিযোগও!

জয় জীবনে স্বীকার করে না সে কখনও পুলিশের হেফাজতে গেছে।

হামজা দিন যেতেই আরও গভীর পথিক হয়ে উঠছিল। তার নজর, চাহিদা ও গন্তব্যের বহর বাড়ছিল। অপরাধের সীমাবদ্ধতার সুঁতো ছিঁড়ে-ফেঁড়ে অসীম হয়ে যাচ্ছিল।

রাজধানীতে বড় বড় নেতাকর্মীদের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে উঠল। বিশাল বিশাল পরিকল্পনার সঙ্গী হতে থাকল হামজা।

চলবে..

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৬.

গাড়িতে উঠতে গিয়ে হামজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ড্রাইভিং সিটে কবীর নেই। নিটু বসে আছে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে হালকা। সকাল দশটা বাজে।

গাড়ি ছাড়ার সময় হলে অন্তূ ছুটে এসে পেছন থেকে ডাকল, “মেয়র সাহেব!ʼʼ

হামজা ফিরে তাকালে অন্তূ বলল, “শুভ সকাল, মেয়র সাহেব!ʼʼ

হামজা কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মাথা নামায়, আলতো হেসে বলে, “শুভ সকাল!?ʼʼ

-“কোথাও যাচ্ছেন, নিশ্চয়ই! আমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাবেন। বৃষ্টির ভেতরে রিক্সা পাওয়া ঝামেলা।ʼʼ

হামজার ভ্রু কুঁচকে উঠল। অদম্য সাহস মেয়েটার। আড়ষ্ঠতা, সংকোচ কিচ্ছু নেই। হামজার সঙ্গে কথা বলার সময় এমনকি রিমির কণ্ঠেও এক প্রকার জড়তা ও সমীহ থাকে। কতকাল হামজা নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে কাউকে কথা বলতে শোনেনি, দেখেনি।

হামজা জানায়, “আজ ভার্সিটিতে যাবে না, তুমি। আমার অনুমতি নেই।ʼʼ

অন্তূ এগিয়ে এসে হামজার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্তস্বরে বলল, “আপনার আদেশ-নিষেধের পরোয়া করি না আমি, মেয়র সাহেব। জানেন তো আপনি।ʼʼ

অন্তূ হামজার পাশে উঠে বসে। গাড়ি চলতে শুরু করে। বসে থাকে দুজন পাশাপাশি। হামজার শরীর থেকে হ্যাভি বডি-স্প্রে-এর গন্ধ উড়ছে। দুজনের মাঝে আধা-ফিট ফাঁক। কেউ কারও দিকে তাকায় না। রাস্তারা পিছনের দিকে পিছিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি এগিয়ে যায়। দুজনের এই নীরবতা এক ক্ষমতাধর ধূর্ত পুরুষের সঙ্গে এক আঘাতপ্রাপ্তা ঘায়েল নারীসত্ত্বার অঘোষিত যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে যায় নিঃশব্দে। অনেক পুরোনো এই বিরোধ! সাধারণ সম্পর্কে অন্তূর এই বিরোধ ভাসুরের সঙ্গে।

এক সময় হামজা সিটের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে অল্প হাসে, “থাবা দিয়ে ধরলে আর পার পাবে না। অনেককিছু করেছ, করছো। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, আমাদের বিরোধীতা করে জেতা যায় না।ʼʼ

-“আপনাদের নয়, মেয়র সাহেব। ‘আপনাদেরʼ বলছেন কেন? বিরোধীতা কবে আপনাদের সঙ্গে ছিল? বিরোধিতার সম্পর্ক আমার জয় আমিরের সঙ্গে। আগুন-পানির মতো। হয় আমি, নয় সে। আমি সক্রিয় হলে সে নিভে যাবে। সে সক্রিয় হলে আমি বাষ্প হয়ে নিঃশেষ হব।ʼʼ

অন্তূ অল্প থেমে তাকাল হামজার দিকে, “আপনার সঙ্গে আমার যা, তা বিরোধিতা নয়, মেয়র সাহেব। ওটা কারবার, এক প্রকার লেনদেন। তা শুধু আপনার সঙ্গে, শুরু থেকেই তা কেবলই আপনার সঙ্গে।ʼʼ

হামজা হাসে, “কোন শুরু?ʼʼ

অন্তূও কেমন করে যেন হাসে, “আমার ইজ্জত, আমার জীবন, আমার আব্বুর অবসান! ভুললে চলবে?ʼʼ

হামজা গা দুলিয়ে হেসে উঠল, “এসবের দায় আমার নাকি?ʼʼ
অন্তূ প্রগাঢ় চোখে তাকাল, তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছিল। শ্বাসের ভারে বুকের উঠানামা বাড়ল, মুখটা কঠিন হয়ে উঠে আবার শান্ত হয়ে এলো।

-“আপনি সেদিন যখন বলেছিলেন—’লোকজন চাইলে আপনি আমাকে জয় আমিরের বউ করতে পারেন।ʼ তখনও বুঝিনি। কিন্তু বুঝেছি সেই কয়দিনে, যে কয়দিন আব্বুর শোক কাটাতে আমি ও বাড়িতে কাটিয়েছি।ʼʼ

হাসি মুখে রেখে হামজা ভ্রু উঁচায়, “কী বুঝলে?ʼʼ

-“পলাশ আজগর নয়, আপনি আব্বুকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর পলাশের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবং সেটা শুধুই আমাকে দমাতে। কয়দিন আপনার সামনে আমার খুব আলোচনা উঠছিল বারবার, তাই না?

সে সময় মুমতাহিণার মৃত্যু আর জয় আমিরের অসভ্যতা নিয়ে আমি খুব সোচ্চার হয়ে উঠেছিলাম। আপনার ভয় ছিল—কোথাও জয়ের রেপুটেশন আর আপনার ক্ষমতায় আঁচ না লেগে যায়। সেই যে ভার্সিটি পরিষদে আমার পক্ষ থেকে জয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ। আর তাতে জয়ের ক্ষমতাচ্যুতির আশঙ্কা! তা সামলাতে বেগ পেতে হয়েছিল আপনাকে!ʼʼ

হামজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে কোরে সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে ঠোঁটে গোঁজে। চোখ বুজে ধোঁয়া ছেড়ে চোখ মেলে তাকিয়ে বলে, “আর?ʼʼ

অন্তূ জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো। বৃষ্টির ঝাপটা কমেছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।

গাড়ির ছাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তারপর পাটোয়ারী বাড়িতে সেচ্ছায় পা রাখলাম। খুব আগ্রহের সাথে। তখনও জানতাম না মুমতাহিণার মরণক্ষেত্র এটাই। শুধু আন্দাজ ছিল। সেটা সত্যি মনে হতে থাকল ধীরে ধীরে। আমি তখন মাঝেমধ্যে ইচ্ছাকৃত আবার কখনও অনিয়ন্ত্রিত উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। বোকামির মতো দেখতে কিছু কাজ করেছি।

শেষে সত্যি হলো আমার ধারণা। তখন বুঝলাম, আপনার আমাকে দমাতে চাওয়ার এটাও আরেকটা আর প্রধান কারণ। আমি যেহেতু কার্যালয়ে ঘুরেছি, মুমতাহিণার ব্যাপারে খুব ভাবছি। আমার প্রচেষ্টায় এই জটিল প্যাঁচটা কোনোভাবে খুলে গেলে সবটা ক্ষতি মূলত আপনারই! শিকড় আপনি, মূল আপনি। এবং আশ্চর্যজনকভাবে এই কাহিনি গাছের কাঠামোটাও আপনি।

আপনি জানলেন, আমার দূর্বলতা দুটো—আমার আব্বু, আমার সম্মান। আপনি পলাশের মাধ্যমে এক্সাক্ট সেই দুই জায়গাতেই হাত মারলেন। আপনি খুব বোঝেন–আমার মতো মেয়েকে কাবু করতে লম্পট নজরের বিকল্প নেই। সেদিন আব্বুর অবস্থা আর পলাশের আগ্রাসী হামলা আমাকে যে পরিমাণ ভঙ্গুর করেছিল! আমি আপনার ফ্যান হয়ে গেছি সত্যি! এত্ত ধারালো আর হিসেবি বুদ্ধির মালিক আপনি। নিখুঁত, মেয়র সাহেব!

আমি বিষয়টা বুঝেছিলাম এটা ভাবতে গিয়ে—পলাশ চাইলেই অন্তিককে কেটে টুকরো করতে পারতো। কিন্তু সে অন্তিককে পালানোর সুযোগ দিয়ে আব্বুকে ধরলো! একবার অবশ্য মাথায় এসেছিল–পরিবারকে জিম্মি করাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার বদলে অন্তিককে টাকা নিয়ে নয় বরং পলাশের ডেরায় আমাকে ডাকা হলো ফোন করে। টাকার প্রসঙ্গ সাইডে রইল। মূখ্য হলো আমার অসম্মান আর আব্বুর আঘাত। আমাকে অসম্মান করতে চাওয়া, জয়ের নির্লিপ্ততা, আব্বুকে ওভাবে প্রায় অকারণে আঘাত করা।

সবকিছুর হিসেব কষতে গিয়ে একটাই সূত্র সামনে এলো—আমাকে ভেঙেচুড়ে গুড়িয়ে দেওয়া, আমাকে রুখতেই সব আয়োজন। আর তাতে খুব সহায়ক হয়েছিল অন্তিকের জেদের বশে করা একটা ভুল। মেয়র সাহেব, আমি কি ঠিক বলেছি?ʼʼ

হামজা বাহবা দেবার মতো ভঙ্গি করে হাসল, “তুমি সুযোগ পেলে আসলেই খুব ভালো ইনভেস্টিগেটর অথবা লয়্যার হতে পারতে। কিন্তু আফসোস! সেই সুযোগটা না পাবার ফলে তোমার এমন তীব্র মেধা বিফলে যাবে।ʼʼ

অন্তূ হাসল, “আব্বু একটা কথা বলতো।ʼʼ

ভ্রু উঁচায় হামজা, “আচ্ছা! কী বলতো?ʼʼ

-“বলতো—শিক্ষা সুযোগের অপেক্ষা করে! কিন্তু অভিজ্ঞতা সুযোগকে কেড়ে নেয়।ʼʼ

-“তোমার সেই অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে করছো তুমি যে, আমার কাছ থেকে সুযোগ কেড়ে নেবে?ʼʼ

অন্তূ গাড়ি থেকে নেমে ফিরে তাকাল, “আপনার পিঠ দেয়ালের কাছাকাছি। এটাকে সতর্কবার্তাই ধরে নিন, মেয়রসাহেব! খুব বেশি সময় পাবেন না নিজের ধারালো মস্তিষ্ককে কাজে লাগাতে। চাল চালতেও অল্প সময় দরকার পড়ে।ʼʼ

ততক্ষণে হামজাকে টের পেয়ে ভার্সিটির ছেলেরা গাড়ি ঘিরে ধরেছে। সেই ভিড়ের মাঝে মিশে গেল অন্তূ। হামজা শান্তভঙ্গিতে কেবল চেয়ে রইল সেই ভিড়ের কোলাহল ছাপিয়ে। তার মনে হচ্ছিল—অন্তূকে নিয়ে আরও সতর্ক হওয়ার ছিল। কিন্তু আর কত? নিজের ধারণ করা একটা কথা মনে পড়ল—’আঘাতপ্রাপ্ত কোনো নারী যদি কুচক্রী হয়ে ওঠে, সেই নারীর তৈরিকৃত ফিতনাকে মোকাবেলা করা অসাধ্য হয়ে পড়ে।ʼ


তুলি ঘর থেকে বেরোয় না। রিমিও নিশ্চুপ। গোটা বাড়িটা যেন মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে। সেখানে বসবাস ছয়জন মানুষের। কিন্তু তারা সকলে যেন মৃত। জয় বাড়িতে থাকে কদাচিৎ। যতক্ষণ থাকে হয় ঘুমায় নয়ত বেহেড থাকে।

এখন আর সবাই একসাথে টেবিলে বসে খাওয়া হয় না এ বাড়িতে। তুলির রুমে খাবার দিতে গিয়ে অন্তূ দেখল, তুলি নামাজে বসেছে। অন্তূ ভাবে—কেউ কেউ বেশি কষ্টে ধর্ম বিমুখ হয়ে পড়ে, কেউ-বা ধর্মমুখী। তুলির কাছে বসে থেকে লাভ নেই। সে কথা বলে না। হাসলে দেখতে উন্মাদিনীর মতোন লাগে।

অন্তূ রুমে ঢুকতেই জয় গোসল করে বের হলো। ক্ষত-বিক্ষত বুক-পিঠ। কী ভয়ানক সব দাগ! গর্ত হয়ে হয়ে আছে। কোথাও বা সেলাইয়ের দাগ, কোথাও চামড়া ঠেলে মাংস বেরিয়ে আছে। গলায় লাল গামছা ঝুলছে। পরনে আরেকটা গামছা। সে তোয়ালে ব্যবহার করে না। তার পোশাক গামছা, লুঙ্গি, শার্ট প্যান্ট, হাফ-প্যান্ট। পাঞ্জাবী পরে হামজার ধমকে লোক দেখাতে। নামাজটাও কয়েকবার তেমনভাবে পড়তে হয়েছে।

লোকের সামনে পড়ে গেলে ভালোমানুষী দেখাতে নামাজে যাবার ভঙ্গি করেছে হামজার কথায়। এতে একটা আলাদা মজা আছে তার মতে। মানুষকে ধোঁকা দেওয়া দারুণ এক মজার বিষয়! নয়ত তার কোনো ইচ্ছা নেই মানুষের কাছে ধার্মিক প্রমাণিত হবার।

অন্তূকে জিজ্ঞেস করল, “লুঙ্গি কই আমার, ঘরওয়ালি!ʼʼ

-“ছাদে।ʼʼ

-“এনে দাও।

-“দুঃখিত!ʼʼ

জয় ঠোঁট উল্টে কাধ ঝাঁকালো, “ওকে! তাইলে গামছাটা খুলে শুয়ে পরতে হবে। ভেজা গামছা পরে তো আর শোয়া যায় না।ʼʼ

জয় গামছার গিট্টুতে হাত রাখে। আর দেখল না অন্তূ। বিদ্যুতের গতিতে পেছন ফিরল, দুই চোখ খিঁচে বন্ধ করে বলল, “বেহায়া, নির্লজ্জ ব্যাটাছেলে। আল্লাহ, মুক্তি দিন।ʼʼ

পেছন থেকে উচ্চস্বরে হো হো করে হাসির শব্দ শোনা গেল জয়ের। সেই হাসিতে ঘর বাজছে। জয় বলল, “তাকাও তাকাও! পেছন ফিরে তাকাও, ঘরওয়ালি। সিনারি দেখাই।ʼʼ

অন্তূ চিবিয়ে বলল, “আপনার মতো নোংরা লোকই কেন ছিল তকদিরে?ʼʼ

-“তোমাদের মতে যিনি তকদির লেখেন তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত। আমি তো ওসব তকদির-ফকদির মানি না।ʼʼ

অন্তূ দুই হাতে মুখ ঢেকে দাঁত খিঁচে বলল, “পশুর চেয়েও অধম পুরুষ মানুষ, আপনি! জাহান্নামে যান।ʼʼ

তার ধারণা জয়ের দ্বারা সব সম্ভব। আসলেই যদি গামছা খুলে দাঁড়ায়! অন্তূর গা গুলিয়ে এলো। তখনই জয় সামনে এসে দাঁড়াল, “লুঙ্গি এনে দেবে নাকি হাতটা টেনে মুখ থেকে সরিয়ে দেব?ʼʼ

অন্তূ হাতে মুখ ঢেকে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। জয় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। গামছা সে খোলেইনি। তার সভ্য বউ তাতেই বেকাবু।

লুঙ্গি এনে দেখল জয় আলমারী থেকে নতুন একটা লুঙ্গি পরে সিগারেট ধরিয়েছে। ক্ষুব্ধ হাতে লুঙ্গিটা জয়ের সজোরে মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল অন্তূ। জয় লুঙ্গি সরিয়ে জোরে জোরে হাসে। তারপর বলে, “একটু ভাত-টাত খাইয়ে দেবে?ʼʼ
-“বিষ দেব।ʼʼ

-“তা দাও, সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার হাতে খাইয়ে দাও।ʼʼ

-“আপনার হাতে বোমা পড়েছে নাকি?ʼʼ

-“তোর মুখে বোমা পড়ুক, শালী। ভাত আন।ʼʼ

জয়ের অশিষ্টতা আজও অন্তূর ভেতরে আগুন জ্বালায়। এতগুলো দিনেও সয় না নিজের এমন অসম্মান। দুটো দীর্ঘশ্বাস টেনে শান্তস্বরে বলল, “এভাবে নয়। যেভাবে বললে আনবো, সেভাবে বলুন। নয়ত জানেন এখানে না খেয়ে মরলেও ভাত পাবেন না।ʼʼ

অন্তূকে টেনে কাছে দাঁড় করিয়ে চোখের দিকে তাকায় জয়। অস্তমিত স্বরে বলে, “আমি যা বলব, সেটার বিপরীত যা হয়, তাই। না?ʼʼ

-“সম্পর্কটা তো তেমনই!ʼʼ

জয়ের হাতটা নিজের হাত থেকে ছাড়িয়ে দেয় অন্তূ। জয় অল্প হাসে মাথা নত করে। কোমলভাবে, স্মিত নজরে অন্তূকে স্পর্শ করলে অথবা কথা বললে অন্তূ সেটা খুব কঠিনভাবে, আলগোছে এড়িয়ে যায়। অর্থাৎ সে তাদের মাঝে বিরোধকে খুব যত্ন করে ঠাঁই দিলেও কোমলতাকে ভুলেও ঠাঁই দেয় না।

মাথা তোলে জয়, “সম্পর্ক বুঝি না আমি।ʼʼ

খানিক দূরত্ব রেখে বসে অন্তূ, “আমিও বুঝি না।ʼʼ

জয় যখন নরম, স্বাভাবিকভাবে কথা বলছিল, তখন অন্তূ গিয়ে খাবার এনে দিলো। তার আগে নয়। জয় হাসে। কপালে আঙুল চেপে ঠোঁটে ঠোঁট গুঁজে হাসে। তার বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবকিছু আছে অন্তূর মাঝে। কিন্তু সেসবের রূপটা বিপরীতের মতো। ঠিক যেমন বস্তু, ও সেটার আয়নায় দেখা যাওয়া প্রতিবিম্বের সরূপ! এজন্যই তাদের কোনো পরিণতি নেই। একই ধর্মী দুই পক্ষের কোনো পরিণতি থাকে না, শুধু বিরোধ ও বিকর্ষণ ছাড়া।

অন্তূ বা জয় কেউ কারও দিকে তাকায় না সচরাচর। অভ্যাস নেই তাদের। কিন্তু যখন তাকায় তখন দুজন একত্রে তাকায়। সেই দৃষ্টিতে কেবল দহন ছাড়া কিছু থাকে না।

জয় খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি খাইছো?ʼʼ

অন্তূ জয়ের খাওয়া দেখছিল মুখ বিকৃত করে। বিশাল বিশাল যেমন হাতের তালু, সেরকম একেকটা বিরাট সাইজের লোকমা। বিকট লাগে অন্তূর চোখে। হাতদুটো কঠিন, হাতের মোটা মোটা রগ চামড়ার ওপর ঠেলে ওঠা। কালো পশমে ঢাকা কনুইয়ের নিচ থেকে শ্যামলা হাত। বিশাল বিশাল আঙুল।

-“আপনি এভাবে খান কেন? ভদ্রভাবে, মানুষের মতো খাবেন।ʼʼ

এরপর জয় আরও বিশ্রীভাবে খাবার খেতে শুরু করল। অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ ফেরায়।

খাওয়া শেষে সফ্ট-ড্রিংকস হিসেবে দুই প্যাগ মদ খেলো।

রাত দেড়টা অবধি উপুড় হয়ে বিছানার ওপর পড়ে রইল। জয়ের রুমের বেলকনির দরজার পাশে একটা মরিচা ধরা রকিং চেয়ার আছে। অন্তূ সেই চেয়ারটায় বসে থাকে। কোলে বই। কিন্তূ অন্তূ পেছনের দিকে মাথা হেলিয়ে চেয়ারে বসে দুলতে থাকে। চোখ দুটো বোজা।

জয়ের রুমে একটা পেন্ডুলাম ঘড়িয়ে আছে। ঘন্টা পর পর ঢং ঢং করে বাজে। জয়ের খুব পছন্দের জিনিস এটা। হামজা কোথা থেকে কিনে এনেছিল, জয় কেড়ে নিয়েছে।

অন্তূ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে জয়ের দিকে। মুখ এদিকে ফেরানো। চোখ বুজে আছে। চোখের পাতা কাঁপছে। অর্থাৎ ঘুমায়নি। জয়কে সে রাতে ঘুমাতে দেখেনি। রোজ পাশাপাশি শুয়ে দুজন টের পায়–কেউ ঘুমায়নি।

পেন্ডুলাম ঢং ঢং করে বেজে জানায় রাত একটা বাজল। অন্তূ উঠে গিয়ে অল্প একটু জায়গা নিয়ে শোয়। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে থাকে। তার আর জয়ের মাঝে অসীম দূরত্ব। সেই দূরত্বকে সাথী করে দুজন রাতের পর রাত পাশাপাশি শুয়ে কাটিয়েছে। শেষরাতে কখনও কখনও জয়ের হাতটা এসে অন্তূর শরীরের ওপর পড়লে, অন্তূ তড়াক করে জেগে উঠেছে। সরিয়ে দিয়েছে জয়ের হাতখানা।

অন্তূ চিৎ হয়ে শোয়। একটু চুপ থেকে বলে, “জয়!ʼʼ

বেশ খানিকক্ষণ পর জবাব দেয় জয়, “হু!ʼʼ

অন্তূ আর কথা বলে না। ভেতরের জমে আসা সংশয়, দ্বিধা ভেতরের দাফন করে। তার কেউ নেই। এই পাশে শুয়ে থাকা মানুষটা কারও নয়, বা তারও কেউ নয়। ভাবীর খোঁজ জানে না সে। আম্মু কী হালতে আছে, জানা নেই। হামজা তার সঙ্গে কী করবে জানা নেই।

জয় উঠল। বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। অন্তূ উঠে বসে বলল, “আমি যাব আপনার সঙ্গে?ʼʼ

জয় জবাব দিলো না, তাকালও না। বেরিয়ে গেল। অন্তূ জগ ভরা পানি নিয়ে জয়ের পেছনে ছুটলো। জয় কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

সিঁড়িঘরের দরজা খুলে হনহনিয়ে কয়েক সিঁড়ি এগিয়ে গেল জয়। তার হাঁটার ধাপ বড়, লম্বা শরীর। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্তূ অভ্যস্ত নয়। তার পা ভড়কে যায়। জগটা শব্দ করে পড়ে গেল, পানি ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে। মুহুর্তের মাঝে হাত বাড়িয়ে পড়ন্ত অন্তূকে জাপটে ধরে জয়। পড়লে মৃত্যু অথবা সেরকম কিছু হতে পারতো।

অন্তূর বুকে অনেকক্ষণ ঢিপিঢিপ চলছিল। জয়ের থেকে নিজেকে ছড়াতে চায় অন্তূ। জয় আঁটকে ধরে, গম্ভীর স্বরে বলে, “আমার কাছে আসো কেন? যখন দূরত্বই সই, তখন প্রয়োজনেও বা আমাকে চাওয়া কেন? তোমরা ভালো মানুষেরা স্বার্থপর হও খুব।

অন্তূ স্থির হয়ে দাঁড়ায়, “সবটা ভুল নয় আপনার কথা। তবে আংশিক ভুল বুঝেছেন।ʼʼ

-“তাই নাকি?ʼʼ

অন্তূর হাতটা চেপে ধরে জয়। অন্তূ বলে, “আমি নামতে পারব।ʼʼ

জয় চাপা ধমক দেয়, “চুপ্প!ʼʼ

বাকি সিঁড়িটা অন্তূর হাত চেপে ধরে নামায় জয়।

স্থির হয়ে দাঁড়ায় দুজন। এমন অন্ধকারে, নিজের শরীরটাও কিঞ্চিৎ দৃশ্যমান নয়। অন্তূ বলে, “আপনি যেচে পড়ে উপকার করে খোঁটা দিচ্ছেন?ʼʼ

-“তো কি ফেলে দিয়ে মেরে ফেলার ছিল?ʼʼ

-“বাঁচিয়ে রাখার মানুষ তো নন আপনি আমার, জয় আমির। এই যে বললেন, আমরা স্বার্থপর। আপনি বুঝি স্বার্থহীন? আর স্বার্থহীন মানুষেরা সমাজে বসবাস করে, এবং সাথে এমন সব কুকর্ম করে বেড়ায়?ʼʼ

-“স্বার্থের জন্য খারাপ কাজ করি আমি?ʼʼ

-“নিঃস্বার্থে? নিঃস্বার্থে আপনি মানুষ মারেন, চারদিকে এতসব করে বেড়ান? নিঃস্বার্থে মানুষ সন্ন্যাসী হয়, সংসারধর্ম ত্যাগ করে পাগলবেশে ঘুরে বেড়ায়। ক্ষমার সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে মোহমুক্তির পথে চলে যায়। নিঃস্বার্থ শব্দের অর্থ বোঝেন? নাকি শুধু মুখে রসিকতার খই ফুটিয়ে বেপরোয়া বাতাসে গা ভাসাচ্ছেন? যে মানুষ আত্মত্যাগী, উপরন্তু সর্বত্যাগী হয়, তাকে নিঃস্বার্থ বলে। আপনি প্রতিনিয়ত কিছু হাসিলের লক্ষ্যে, কিছু পূরণ করার উদ্দেশ্যে ছুটছেন। হয়ত কোনো পুরোনো ক্ষোভ অথবা জমে থাকা ঋণ। আর তা ফেরত চান আপনি, সেটা নিঃস্বার্থতা? নাকি আমার সঙ্গে সামান্য ব্যাপার থেকে আপনারা যা যা করেছেন এ অবধি, সেটা নিঃস্বার্থতা? যদিও সেসব অপরাধ নয়, তবু যদি ক্ষমা চরতেন তবু ভাবা যেত। বদলার আগুনে জ্বলে এতসবের পরেও নিঃস্বার্থতা?

মুখে রসিক রসিক কথা বলে ভীষণ কুল সাজা যায়! ভং ধরা যায়, আপনি খুব চাপা, খুব বেপরোয়া, লালসাহীন, বিশাল রহস্যময় মানুষ আপনি..

শব্দের প্রয়োগ শিখবেন। আমি আপনার কাছে প্রয়োজন পুরাতে আসিনি। আপনারা সেই ব্যবস্থা করেছেন, যাতে আমি আপনাদের অধিনস্থ হই। এখন দায় উঠাবেন না? বউ হবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম? নাকি আপনার কাছে র‌্যাগ খেতে গিয়েছিলাম? অথবা আপনাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করব বলে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলাম যে, প্লিজ আমার সম্মুখে এসে অন্যায় করুন, আমি তা রুখি! আমার সম্মুখে অকাজ হবে, আমি চুপ করে থাকব না, এটা আমার নিজস্বতা।

আপনি কী, কেন আমি জানি না। কিন্তু আমি অন্তূ যা হারিয়েছি, তা অপরাধ না করার অপরাধে, সাধারণ একটা ক্ষমতাহীন মেয়ে হবার অপরাধে। তার একাংশ হারাননি আপনারা। আমি অজানাকে জানি বোধহয়, সেটুকু ভাবনার বিস্তৃতি আছে। সেই শক্তিতে আমি এটা বলতে পারি—আপনাদের সঙ্গে যদি কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, তো সেটার কারণ আপনারাও! কারণ আপনারা বংশগত রাজনৈতিক মানুষ, আপনাদের সাথে খারাপ হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি? সাধারণ জনতা আমরা। আমি কেন এতকিছু সহ্য করছি? শুধু আপনাদের অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়ায় তার দায় মেটাবেন না? মিটিয়ে যেতে হবে। আমি অন্তূ, আমার হারানোর সবটুকু শোধ পুরিয়ে নিয়ে মরব বোধহয়। কারণ আমি আপনার মতো নিঃস্বার্থ নই। আমারা মা-ভাবী, আমার সম্মান, আমার ক্যারিয়ার রাস্তায় ভাসছে। সেসবের হাল ধরতে হবে।ʼʼ

জয় অন্তূর চুল মুঠো করে ধরলে অন্তূ হাসে, “ইশ! সত্যি কথা নিতে পারেন না, আপনারা!ʼʼ

-“কী করবি তুই?ʼʼ

-“কখন বললাম কী করব? কী করার আছে আমার? হাত তো বাঁধা আপনার নামের শিকলে।ʼʼ

-“কথা ছলে ছলচাতুরী?ʼʼ

-“শুনেছিলাম–চোরকে কাবু করতে চোরের মতো করে ভাবতে হয়।ʼʼ

জয় অন্তূকে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো, ফিসফিস করে বলল, “আমি চোর না হে। খোলা বাজারে লোক ডেকে পাপ করে আসা পাপী আমি। চোর হবি তুই, পেছনে চাল চালিস।ʼʼ

-“তাহলে সেদিন পলাশের ছাদে যখন থুতু দিয়েছিলাম, তখনই ধরতেন। পরে অত ছক কষে, আয়োজন করে, নাটক সাজাতেন না। সংজ্ঞা কি মিললো ছলচাতুরী আর চোরের? আমার মুখ খোলাবেন না। বেশ তো চুপ আছি। খোঁচা মেরে ঘা তাজা করা কেন? আপনি জানেন, আমি মুখ খুললে আর সামনের জন কথা বলতে পারে না।ʼʼ

চলবে..