অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৬৯+৭০

0
99

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৯. (প্রথমাংশ)

জয় আমির জন্মগ্রহণ করল দেশের এক উত্তাল রাজনৈতিক পরিবেশে। ১৯৮৭ সন। বাংলাদেশে সামরিক শাসন চলছে। উত্তাল দেশের অবস্থা। তখন সকল বিরোধী দল পারস্পারিক সংঘাত একপাশে রেখে স্বৈরাচার পতনের লক্ষ্যে হাতে হাত রেখেছে।

জাভেদ আমির ধীরে ধীরে আবারও রাজনীতিতে ফিরলেন ঠিকই। কিন্তু এবার তার দৃষ্টিকোণ ও মনোভাব বোঝা বড় দায়।

১৯৯০ এর শেষে স্বৈরাচারের পতন হলো।

জয়কে স্কুলে ভর্তি করা হলো চার বছর বয়সে। তার জিদেই। সে দেখেছে সকলে স্কুলে যায়। তারও যাওয়া দরকার। বাড়িতে দুটো মহিলা রাখা আছে জয়ের যত্নের জন্য। তাদেরকে সহ্য করা যাচ্ছে না। একটার বয়স কম। বিশ-বাইশ বছর হবে। খুব নজরে, যত্নে রাখে। অত যত্ন-আত্তি বড়লোকপনায় বিরক্ত সে। তার মাথায় ফুলদানী দিয়ে মেরে জখম করে দিয়েছে সে। তার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। তবু মেয়েটার লজ্জা নেই, আবার আসে জয়ের দেখাশোনা করতে। জয় তাই আরও বিতৃষ্ণ মেয়েটার ওপর।

জাভেদ আমিরের সাথে ঝামেলা তার। সে রোজ স্কুল থেকে বড়বাবা কাছে যায়। বাপের ছোটভাইকে সে ডাকে বড়বাবা। এটার কারণ আছে। বাবা শাসন করে। তার বাবাকে ভালো লাগে না। বাবার চেয়েও বেশি আপন ও বড় তার চাচা। তাই জয়নাল আমির তার বড়বাবা। এত চতুর সে কোত্থেকে হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ আছে হুমায়িরার।

জয়নাল আমির নিতে আসেন স্কুলের গেইটে। চাকরেরা ভয়ে সরে আসে, বাঁধা দিতে পারে না জয়নাল আমিরকে। জাভেদ একবার জিজ্ঞেস করলেন, “এই বেয়াদব! জয়নালের সাথে গেছিলি?ʼʼ

-“হ্যাঁ।ʼʼ

-“কেন?ʼʼ

দৌড়ে গিয়ে দাদুর কোলে চড়ে বলল, “আমার ভালো লাগে। তুমি আর নিষেধ করবে না। আমি যাবই।ʼʼ

তবু জাভেদ দুটো থাপ্পর মারলেন। খুব জোরে নয় তবে লাগল। কিন্তু জয়ের মুখ দেখে মনে হলো না, তার কিছু হয়েছে। পরেরদিন সে সন্ধ্যার পর ফিরল চাচার কাছ থেকে। আগে বিকেলে ফিরতো।

বাবা থাকলে তার বন্ধুদের আড্ডা মিস যায়। আমির বাড়ির ফটকের সামনে এসে তাকে ডাকার সাহস কারও নেই। তা মনেহয় একমাত্র বাবার জন্যই। দারোয়ানটা চরম খিটখিটে। একবার তাকে অবশ্য কুকুরের দৌড়ানি খাইয়েছিল সে। পুকুরে গোসল করার উপায় নেই। তাছাড়া তার কিছু অবলা শাগরেদ আছে। গোয়ালের গরুগুলো, ফটকের বাইরে বসে ঝিমানো কুকুরেরা, বাড়ির ছাদের চিলেকোঠায় বাচ্চা তোলা বিড়াল, কবুতর। এগুলোর পরিচর্যা করতে পারা যায় না বাবার জন্য। আরও আছে তার বাজিগর। বাজিগরগুলো দিয়েছে বড়বাবা। ছয়টা থেকে নয়টা হয়েছে ওরা। একটার জোড়া নেই। সে নাড়তে চাড়তে গিয়ে ডিম নষ্ট করে ফেলেছিল। সে কি কান্না! তার দোষ নাকি দাদুর। কারণ দাদু মাত্র চারবার ডিম নাড়তে নিষেধ করেছে। এর বেশি বলেনি। বাবার হাত থেকে ওগুলোকে বাঁচিয়ে রাখারও চাপ আছে। বাবা সুযোগ পেলেই বড়বাবার দেওয়া পাখিদের উড়িয়ে দেবে। কম চাপে থাকে না সে। বড় ব্যস্ত মানুষ।

এমন বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা জয়ের দ্বারা সম্ভব না।

হুমায়িরার কাছে একবার বিচার এলো, ক্লাসের চারটে ছেলেকে মেরে জখম করে দিয়ে এসেছে। কারণ, ওরা তাকে রাজাকারের ভাতিজা বলেছে। সে তখন টু-তে। সে ক্লাসে দল গঠন করেছে। একদল যারা জয়কে রাজাকারের ভাতিজা বলে না, দেশোদ্রোহীর ছেলে বলে না। আরেকদল যারা বলতে চায় কিন্তু এখন ভয়ে বলতে পারে না। তারা হলো জয়ের বিরোধী দল।

দাদুর সাথে খাতির তার ভালোই। কিন্তু রাগ হয় যখন দাদুর কাছে বন্দুক চালানো শিখতে চাইলে শেখায় না। দাদুর লাঠি লুকিয়ে সে সপ্তাখানেক ভুগিয়েছে দাদুকে। তাতে জলিল আমির আরও ক্ষেপেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, জয়কে আর কোনোভাবেই তিনি ভালোবাসবেন না। কিন্তু জয়ের তো ভালোবাসা লাগে না।

সে এমন সব কাজ করবে যাতে দাদুর পক্ষে তাকে ভালোবাসা সত্যিই কঠিন হয়। সে দাদুর সংবাদপত্র ছিঁড়ে কুটিকুটি করে রাখে। পান খায় দাদু। সে চুনের ভেতর পানি ঢেলে টলটলে বানিয়ে রাখে। নামাজে যাওয়ার সময় টুপি নিয়ে খেলতে চলে যায়। একবার দাদুর জন্য বেড়ে রাখা তরকারীতে মরিচের গুড়ো মিশিয়ে নেড়েচেড়ে রেখে দিয়েছিল। হুমায়িরা তাকে ঝাল খেতে দেন না। কিন্তু সে জানে মরিচের গুড়ো ঝাল। তা খেয়ে দাদুর অবস্থা খারাপ। পানি খেয়ে শান্ত হলে সে আস্তে কোরে গিয়ে দাদুর সামনে গিয়ে হাত পেছমোড়া করে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি মিশিয়েছি তোমার খাবারে ঝাল। বলো, আর কোনোদিন ভালো বাসবে না বলে হুমকি দেবে? চুপচাপ ভালো না বাসবে। বুঝলে?ʼʼ

এরকম বিরোধীতা চলল কিছুদিন। দাদু একদিন এসে খুব চোটপাট করলেন। জয় একটা কথাও অস্বীকার করেনি। সব স্বীকার করেছে। এমনকি যা অপরাধ করেনি তাও।

বড়বাবা বলেন, “লোকের কাছে ভালো হবার চেষ্টা করার দরকার নেই। মানুষ ভালোদের দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টায় মত্ত থাকে কেবল। একই কাজ খারাপ হিসেবে পরিচিত লোকেরা করলে ঠিক আছে। কিন্তু ভালো মানুষ হিসেবে তা তুই করেছিস এটা প্রমাণ হলে তারা তোকে আর বাঁচতে দেবে না।

খারাপ হিসেবে পরিচিতদের স্বাধীনতা বেশি। তারা যা খুশি করতে পারে। তুই যা খারাপ করছিস সেটাও তোর, আর নিজের কৃতকর্ম হোক ভালো বা খারাপ তা অস্বীকার করাটা ছোটলোকি। তুই খারাপ এটা তোর স্বীকার করার সাহস না থাকলে তুই কাপুরুষ। কারণ ওটা তোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। তুই যখন কারও কাছে ভালো সাজতে নাটক করবি বা কারও মনমতো চলবি, ব্যাপারটা অনেকটা এমন হলো না যে তুই তার কাছে দায়বদ্ধ! তোর কোনো নিজস্বতা নেই।

ভালো সাজতে চায় ভন্ডরা, ভীতুরা, খাতির পাওয়ার লোভীরা। আর এটাই দায়বদ্ধতা, দূর্বলতা, একপ্রকার বাধ্যতা। যেন কেউ তোকে খারাপ ভাবলে তোর যায় আসে। কখনও কারও কাছে ভালো হবার জন্য কোনোরকম সামান্য চেষ্টাও করবি না। কেউ তোর নিজস্বতাকে মেনে নিয়ে থাকলে আছে, নয়ত তোর কাউকে দরকার নেই নিজেকে ছাড়া!ʼʼ

জয় মনোযোগ দিয়ে শোনে। কিছু কথা বোঝে, আর যা বোঝে না তাও মনে রাখার চেষ্টা করে। সে টের পায়, চাচার চিন্তা-ধারার সবই তার ছোট্ট মস্তিষ্কের চিন্তাধারার সাথে প্রায়-ই মিলে যায়। বাবা তাকে হাজার মানা করলেও সে চাচার কাছে যাবেই।

দাদু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এসব কেন করেছিস?ʼʼ

সে মুখ গোমড়া করে বলল, “তুমি তো বললে ভালোবাসবে না। কিন্তু আমি তেমন কিছু করিইনি আগে। এখন করছি। যাতে ভালো না বাসার কারণ থাকে। অকারণে ভালোবাসবে না কেন?ʼʼ

ক্লাস থ্রি-তে তার একটা গৃহশিক্ষক রাখা হলো। মাস্টার আসার আগে সে যায় ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়তে। হামজা এসে সেদিন এক ঝুড়ি আম দিয়ে গেছে। কিন্তু চুরি করা আমের স্বাদই আলাদা।

জাভেদ ব্যবসার কাজে প্রায়-ই ঢাকা-চট্রগ্রাম থাকেন। তখন বিচার আসে জলিল আমিরের কাছে। হুমায়িরাকে ধরে মহিলারা বলে জয়ের কুকীর্তির কথা। সেদিন আম পাড়তে গেছে মন্ডলদের বাগানে। মন্ডল বাড়ির ছেলেরা এসে বাঁধা দিচ্ছিল। বড়দের ডেকে আনার হুমকি দিচ্ছিল।

আম না পড়ে যে ডাল-পাতা ভেঙে পড়েছে, তা-ই তুলে বেদম মেরেছে ওদের। ওদের অপরাধ, নিজেরা কোনো একশন না নিয়ে বড়দের ডাকার মতো এমন ছোটলোকি হুমকি ওরা কেন দিলো? যা করবে ওরা করবে। কাপুরুষের মতো বড়দের ডাকতে চেয়ে ওরা জয়ের মারামারির মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছে। যুদ্ধে-বিগ্রহ হবে সমান সমানে। তারপর দেখা যাবে কে জেতে।

মাস্টার এসে বসে আছেন আধঘন্টা। জলিল আমির দু’বার খড়ি নিয়ে খুঁজে এসেছেন। পাননি খুঁজে ওকে। পাবার কথা নয়। সে বাগানের ওপারে ভাঙা গোয়ালের কোণায় সভায় ব্যস্ত। ও পাড়ার কয়েকটা পুঁচকে জয়ের নামে নালিশ করেছে। জাভেদ আমির এলে ওদের বাবা-মা আসবে বিচার নিয়ে। এটা হতে দেয়া যায় না। ওদেরকে শাসাতে হবে। যাতে বাবা-মাকে গিয়ে বলে, জয় ভালো না। তবে ওদের কিছু করেনি। বিচার দেওয়া ক্যান্সেল।

শেষমেষ অধৈর্য হয়ে মাস্টার গেলেন খুঁজতে। খুব বিনয়ের সাথে বললেন, “জয়! বাবা। আসো পড়বে। পরে এসে খেলবে। আসো।ʼʼ

জয় বিরক্তিতে চোখে-মুখ খিঁচে তাকাল। উঠল না সভা ছেড়ে। মাস্টারকে বলল, “এখন ব্যস্ত আছি। বসেন ঘরে গিয়ে। পরে আসতেছি।ʼʼ

মাস্টার হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলেন।

-“কী হলো? যান! জরুরী কাজে আছি। আপনে কি এখন দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চাদের আলাপ শুনবেন?ʼʼ

মাস্টার রেগেমেগে একাকার। তবু চুপচাপ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ভেতরবাড়িতে ঢুকে হুমায়িরাকে বললেন, “আপনার ছেলেকে আর পাড়ার ছেলেদের সাথে মিশতে দেবেন না। ওর মুখের ভাষার শুদ্ধতা হারিয়ে যাচ্ছে।ʼʼ

হুমায়িরা রাতে শাসন করলেন। তারপর দিন মাস্টারকে আধঘন্টা বসিয়ে রেখে পরে এসে পড়তে বসল। পড়ার দশ মিনিট না-ই যেতে উঠে পড়ে বলল, “আর পড়ব না আজ। আপনে যান। আমার কাজ আছে।ʼʼ

হনহন করে বেরিয়ে চলে গেল।

সেই রাগটুকু মাস্টার চাপা রাখলেন। পরেরদিন পড়ার সময় মাস্টার পড়াচ্ছেন, সে কাগজ দিয়ে নৌকা, বাঁশি, ব্যাঙ ইত্যাদি বানাচ্ছে। মাস্টারের ধৈর্যচ্যূত হবার পর্যায়ে। তারপর তিন চারবার উঠে গিয়ে পানি খেয়ে এলো। টেবিলের ওপর মাথা রেখে ঝিমোতে লাগল। শেষমেষ মাস্টার স্কেল দিয়ে মারলেন দুটো ঠাস ঠাস করে।

জয় কাঁদতে কাঁদতে হুমায়িরার কাছে ছুটল। মাস্টারে কাছে সে আর পড়বে না। মাস্টার মারে। সে কি কান্না তার! সে সময় হামজা এলো। হুমায়িরা কান মলে ধরলেন, “এবার বল, মাস্টার কেন মেরেছে তোকে? বাদর ছেলে!ʼʼ

-“মাস্টার ভালো না।ʼʼ

জয় কাঁদছে। তার বানোয়াট কান্না দেখে হাসি পাচ্ছে হামজার।

-“তুই কিছু করিসনি?ʼʼ

-“না।ʼʼ

জয় জীবনে কাঁদে। কাঁদলে তা সত্যি, এটা না মানার উপায় পেলেন না হুমায়িরা। জলিল আমির রাজপুত্রের মতোন পালছেন নাতিকে। তবু হুমায়িরা বললেন, “সেদিন মাস্টার নালিশ করেছিল বলে বাদ দেওয়ালি?ʼʼ

কিন্তু সে তো তারপরেও দু’দিন পড়েছে।

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলো। এবং এটা করার জন্যই সে তারপরেও দু’দিন পড়েছে মাস্টারের কাছে। কিন্তু মাস্টারকে বাদ দেওয়ানোর একটা ছুঁতো দরকার বিধায় দুটো দিন খুব জ্বালাতন করে মার আদায় করেছে মাস্টারের কাছে।

হামজাকে দেখে শান্ত হলেন হুমায়িরা। সবার খোঁজ-খবর নিলেন। শাহানা ভাবী তেলের পিঠা বানিয়ে দিয়েছে হামজার কাছে। হুমায়িরার শরীরটা ভালো না। গর্ভাবস্থার চারমাস চলছে। কাজের মেয়ে দুটো গেছে গ্রামে। জয় সারাদিন বাদরামি করে বেড়ায়, তাকে সামলানো চার মজুরের কাজের সমান।

বিকেল পর্যন্ত রইল হামজা। ফুপু যতক্ষণ রান্না করল, সে দাঁড়িয়ে রইল ফুপুর পাশে। হামজার ছিপছিপে শুকনো শরীর, পরনের লুঙ্গি আর ফতোয়াটা ময়লা। মুখটা শুকনো। নরম চালচলন। মুখে স্মিত হাসি, তবে মলিন। বয়স চৌদ্দ। এই বয়সেই লম্বা হয়ে গেছে দেখার মতো।

জয় হামজাকে পেলে সব ভুলে যায়। জয়ের স্বাস্থচেহারা একদম আমির পরিবারের সবার মতোই অভিজাত হয়েছে। খালি স্বভাবটা দিনদিন বখাটের মতো হচ্ছে সঙ্গদোষে।

হুমায়িরা হামজাকে রেঁধে খাওয়ালেন, ও বাড়ির খবর শুনলেন। আজ ক’দিন হুমায়ুন পাটোয়ারী বাড়িতে নেই। সংসারের দায় তার নয়। হামজা, তুলি, শাহানা ভেসে গেলেও সে দায় তার নয়। সে দেশে-বিদেশে ঘুরছে, মহিলাদের বিয়ের প্রলভন দিয়ে তাদের ভোগের অপরাধে কত এলাকা থেকে মার খেয়েও ফিরেছে।

হামজা ক্লাস এইটে। বাসায় চাল নেই। হামজার স্কুলের বেতন দেয়া হয় না আজ চারমাস। মাস্টার বেতন না নিয়ে স্কুলে যেতে মানা করে দিয়েছে।

হুমায়িরা কিছু কাঁচা তরকারী, চাউল, পোশাক আর কিছু টাকা বের করে হামজার হাতে দিলেন। বাড়িতে লোক নেই। ছুটিতে গেছে কাজের লোকেরা। জয়কে সাথে নিয়ে হামজাকে এগিয়ে দিয়ে এলেন অনেকটা দূর। হামজা পায়ে পড়তে যায়, “ফুপু, তোর পায়ে লাগি। আমি একাই চলে যাব। আমার কিচ্ছু হবে না। তোর পেটে আমার ছোট বোন। এই রাইতে বাইরে বাইর হইলে যদি বোনুর কিছু হয়, তোর খবর আছে। বাইর হস না ফুপু আম্মা।ʼʼ

হুমায়িরা শুনলেন না, “অন্ধকারে একা ছাড়ব? কেউ যদি টাকাটা কেড়ে নেয়?ʼʼ

-“তুই কি বাড়ি পর্যন্ত যাবি? তখনও তো নিতে পারে।

-“তবু আমার সান্ত্বণা থাকবে। চল।ʼʼ

জলিল আমির লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ফটকের কাছে পুত্রবধুর অপেক্ষায়।

হামজা ফুপুর ডান হাতখানা ছাড়ল না যতক্ষণ হাঁটল। জয় মায়ের হাত ছেড়ে ছুটে এসে হামজার হাত চেপে ধরে তিড়িং-বিড়িং ছুটছে।

দু’দিন পর জাভেদ ফিরলেন। ক্লান্ত চেহারা। হুমায়িরা দেখেই দেখে বুঝে ফেললেন, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু জাভেদ বড় চাপা মানুষ। রাজধানী থেকে ফিরেছেন, তা কেবল বুঝলেন জলিল আমির।

আমির নিবাসে লোকজন কম। ফটকের দারোয়ান মনসুর মিয়া, বাগানের মালী মন্টু, আর দুজন আছে বাংলো ঘরে বিপদ-আপদের জন্য।

জলিল আমিরের অভ্যাস সদর ঘরে আরাম কেদারায় দুলতে দুলতে ঘুমানো। লাঠিটা কেদারার সাথে হেলান দিয়ে রাখা। বুকের ওপর বই, চোখে চশমা আছেই। নাক ডেকে ঘুমোচ্ছেন।

মনসুর মিয়ার চাকরিটা সুখের। সারারাত সে ঘুমায় ফটকের ধারের চেয়ারটায় বসে। বাড়ির কর্তা জলিল সাহেব জানেন, ঝারিও মারেন, এমনকি কয়েকবার লাঠি নিয়ে তেড়েছেনও, কিন্তু চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেন না। মনসুর মিয়া নিশ্চিত ছাড়াবেনও না।

মাঝরাত। কয়টা, মনসুর জানে না। কেউ ডাকছে মনসুর মিয়াকে। খুব করুণ সুরে। তার খুব বিপদ। বাড়ির কর্তার কড়া হুকুম, “যত রাত হোক আর যা-ই হোক, কেউ সাহায্য চাইলে ফটক যদি না খুলিস, তোর চাকরি কইলাম শ্যাষ রে, মনসুর।ʼʼ

মনসুর দ্বিধায় ভুগল, তার ভয় করছে। তবু খুলল। কোনো অসহায় লোক না তারা। একজনও না। আট-দশজন। মুখে কালো কাপড় বাঁধা। চোখটা খুব সামান্য দেখা যাচ্ছে। ঘন্টাখানেক আগে আমির বাড়ির দোতলার বাতি নিভেছে।একঘন্টা পর এরা কী করতে এসেছে?

মনসুর মন্টু আর বাংলো ঘরের দুজনকে ডাকল। তারা উঠে এসে দাঁড়িয়ে রইল। মনসুরকে জবাই করা হলো। তারা খুব নরম মনের। তাই মুখ ফিরিয়ে রাখল। দেখল না দৃশ্যটা, বরং ফটকটা ভেতর থেকে ভালোভাবে আঁটকে এলো।

পথ দেখিয়ে দিলো। সদর দরজার নকল চাবিও তাদের কাছেই। দুর্বৃত্তদের হাতে চাবি তুলে দিয়ে তাদের কাজ শেষ। তারা বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল।

জলিল আমির সেদিন খুঁড়াতে খুঁড়াতে গিয়ে নিজের বন্দুকটা তুলে নিয়েছিলেন ঠিকই, তবে গুলি চালাতে পারেননি। তাঁর বুকের ওপর চড়ে বসে তাকে যখন জবাই করা হচ্ছিল, কেবল উনার গলা দিয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আওয়াজ আসছিল। তিনি শেষবার কালিমা শাহাদত পড়লেন। শেষ করতে পারলেন না অবশ্য, জবান বন্ধ হয়ে গেল।

জাভেদ আমির আব্বার ডাকে নিচে নেমে আসার আগে যে বন্দুক নিতে গেলেন দোতলার বড় বারান্দার ওপারে, ততক্ষণে কিন্তু দুর্বৃত্তরা শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে।

জাভেদ আমিরের গুলিতে চারজন পড়ে গেল। তখনও নয়জন আমির নিবাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জীবিত নয়জনের মাঝে কিন্তু জলিল আমিরের পালিত দুজনসহ মন্টুও আছে।

জাভেদ আমির মনোবল হারিয়ে ফেললেন কেমন যেন। তবু বিশ্বাসঘাতকদের বুকে গুলি চালাতে তার হাত কাঁপতে শেখেনি একজনের ঠ্যাঙয়ে শেষ গুলিটা করতে পেরেছিলেন উনি। উনাকে চারজন মিলে ধরে ছেঁচড়ে নিয়ে শোবার ঘরে হুমায়িরা আর জয়ের সামনে উপস্থিত করা হলো।

ছোট্ট জয় আমির ছোট্ট হাতে তার ছোট্ট সঙ্গীদের খুব মারে। সেদিন তার ঠাঁয় হয়েছিল মায়ে পিঠপিছে। সে বাবার পেছনে ছুটে গিয়ে সদর ঘরে দাদুর মাথা ছাড়া দেহটা দেখেছে। মাথাটা দেহর সাথে নেই দাদুর। তার পা নড়ছিল না, তবু সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে ঠিকই মায়ের কাছে। অবশ্য সিঁড়ি বইতে গিয়ে কয়েকবার পড়ে গিয়ে চামড়া-মাঃস ছিলে গেছে শরীরের কয়েক জায়গার! রক্ত ঝরছে, জ্বলছেও। কিন্তু তার বুক ভেঙে কান্না আসছে। দাদুর মাথাটা কোথায়? দাদু কি তাকে কাল সকালে বাগানের ভেতর লাঠি নিয়ে তাড়বে না? বলবে না, “শোন জয়! যতবড় বিপদই সামনে এসে দাঁড়াক, কেবল আল্লাহকে ডাকবি।ʼʼ

জয়ের প্রশ্ন, “আল্লাহ কে?ʼʼ

-“আমাদেরকে যিনি বানিয়েছেন।ʼʼ

-“সে আমাদের রক্ষা করবে?ʼʼ

-“সব অবস্থায়। ধর, বারবার ডাকছিস তবু তোর বিপদ উদ্ধার হচ্ছে না, তবু বিশ্বাস হারাবি না। তাহলে কাফের হয়ে যাবি!ʼʼ

-“কাফের কী?ʼʼ

-“খারাপ।ʼʼ

-“বড়বাবা বলেছে, খারাপ হওয়াটা খারাপ না।ʼʼ

-“চুপ। ওই কুলাঙ্গারের কথা বলবি না।ʼʼ

হুমায়িরা নামাজ পড়লে সে গিয়ে জ্বালাতন করে। ঘাঁড়ে উঠে বসে, সামনে গিয়ে জায়নামাজের ওপর বাবু মেরে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেটকিয়ে হাসে। তখন নামাজ শেষে হুমায়িরা বলতেন, “এমন করতে নেই, আব্বা। আল্লাহ নারাজ হয়।ʼʼ

-“আল্লাহ নারাজ হলে কী?ʼʼ

-“ছিঃ। এসব বলতে নেই। আল্লাহ আমাদের রক্ষাকর্তা আব্বা। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হয়।ʼʼ

জয় আজ মায়ের পেছনে লুকিয়ে মনে মনে ডাকছে আল্লাহকে, “আল্লাহ! রক্ষা করেন আল্লাহ।ʼʼ

চলবে…

[সতর্কতা: পর্বটিতে সহিংসতা রয়েছে।]

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৬৯. (বর্ধিতাংশ)

জাভেদ আমিরকে চেয়ারে বসানো হলো। উনাকে ঘিরে ধরে রইল চারজন। জলিল আমিরের রাখা লোকেদের মাঝে একজনকে মেরে ফেলেছেন জাভেদ, আরেকজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, চোখদুটো তার সুযোগসন্ধানী। জাভেদ আমির ঘৃণাভরে একবার দেখলেন। উনার শক্তিশালী দেহটাকে ধরে রাখা দরকার। ছটফট করছেন বড়।

দড়ি দরকার। একটা ভালো ব্যবস্থার কথা মাথায় এলো ওদের। হুমায়িরার বুকের আঁচলটা ভালো কাজে দেবে। শরীর থেকে শাড়ির আচলটা টান মারল। শাড়ি দেহে পেঁচানো থাকে। সেই টাল সামলাতে না পেরে গর্ভবতী হুমায়িরা পড়ে গেলেন মেঝেতে, আর্তনাদ করে উঠলেন। সে অবস্থায় দুটো পুরুষালি লাত্থি মারতে কিন্তু ভুলল না ওরা। কোমড় বরাবর কষে মারল লাত্থিদুটো।

জাভেদ আমির গর্জে উঠলেন, ওদের গায়ে হাত দিলে তোর বংশ নির্বংশ করে ছাড়ব, “শুয়োরের বাচ্চা। ওদেরকে ছুঁবি না।ʼʼ

উনাকে তখন দুজন চেপে ধরে রেখেছে।

শাড়িটা ছিঁড়ে নিয়ে ওরা তা দিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধল জাভেদ আমিরকে।

কেউ উপহাস করল, “ছোঁবো না! ঠিক আছে বস! ছুঁইলাম না। গুলি কইরা খুলিডা উড়াই দেই?ʼʼ

জয় কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ল মায়ের পাশে। তার কান্না খুবই বিরক্তিকর ঠেকল। তাই তাকে একটা বড়সড় লাত্থি মারা হলো। ঠোঁটটা থেতলে গেল। জয় বুঝল কাঁদা যাবে না। তার কান্নার শব্দ ওদেরকে বিরক্ত করছে।

হুমায়িরা অসহ্য যন্ত্রণায় মেঝেতে পড়ে রইলেন। জয় হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে মায়ের দিকে এগোয় আবার ওদের দিকে তাকায়, আবার যদি লাত্থি মারে! গুটিসুটি মেরে মায়ের কাছে মেঝেতে আধশোয়া হয়ে ঝুঁকে মায়ের হাতটা চেপে ধরে রাখে। বাবার কাছে যাবার উপায় নেই। তার অবশ্য ইচ্ছে করছিল, আলমারি থেকে একটা শাড়ি এনে মাকে দিতে। মা বোধহয় লজ্জা পাচ্ছে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে। সবসময় যে শাড়ি পরে থাকে। বাইরের কেউ এলে আরও টেনেটুনে ঘোমটা দেয়। সে দেখেছে।

কিন্তু তার কিছু করার নেই। সে মনে মনে রক্ষাকর্তাকে ডাকছে, ‘আল্লাহ! রক্ষা করেন। এই শয়তানদেরকে মেরে ফেলেন। এরা খারাপ লোক।ʼ

তার মাথায় এই চিন্তাও এলো, খারাপ হওয়া তো খারাপ না। কিন্তু এই রকম খারাপকে কী বলে? এই খারাপদেরকে জয়ের ভালো লাগছে না। এখন আল্লাহ নামক রক্ষাকর্তার উচিত, এই খারাপদেরকে শাস্তি দেয়া।

ফাঁড়া খড়ি দিয়ে জাভেদকে মারতে লাগল ওরা। আর্তনাদটা আর নেয়া যাচ্ছে না। শাড়ির এক টুকরো জাভেদের মুখেও গুঁজে দেয়া হলো। একেকটা আঘাতে চামড়া ছিঁড়ে মাংস থেতলে উঠছিল জাভেদের শরীরের। কয়েকটা আঘাতে ঝিমিয়ে গেলেন জাভেদ। সাদা ফতোয়াটা রক্তের ছোপ দেখা যাচ্ছে। এবার মুখের কাপড় সরিয়ে নেয়া হলো।

এবার উনার উচিত ওদের কাছে প্রাণভিক্ষা অথবা আক্রমণের কারণ বা তারা কে এসব জানতে চাওয়া। কিন্তো জাভেদ করলেন অন্যকিছু। তিনি স্ত্রীর কাছে মিনতি করে উঠলেন, “চলে যাও হুমু। তোমার পায়ে পড়ি। জয়, চলে যা আব্বা। আমি আসব তোদের সাথে দেখা করতে। হুমায়িরা প্লিজ। দয়া করো। আমার সন্তানদেরকে নিয়ে চলে যাও তুমি। আমি আসব। খুব তাড়াতাড়ি।

এই তোরা ওদের যেতে দে। ওরা তো কিচ্ছু করেনি, তাই না? ওদেরকে বের হয়ে যেতে দে।ʼʼ

হুমায়িরা বুকের ওপর দুটো হাত আড়াআড়িভাবে ধরে ইজ্জত ঢাকার বৃথা চেষ্টাটা করছেন। দেখতে উনাকে তখন বড় বোকা বোকা লাগছে। বোকা নারী কেবল দু’পাশে মাথা নেড়ে বলেন, “এরা কারা গো জয়ের বাপ!ʼʼ শুনতে বড় অদ্ভুত লাগে তা।

রক্তাক্ত গালে হাসলেন জাভেদ, “পুরোনো দুশমনী। চলে যাও হুমু। পরে বলব।ʼʼ

কথাটা জয়ের মনে রইল। বড়বাবা বলে, তাদের পুরোনো দুশমন হলো সৈয়দ পরিবার।

হুমায়িরা ভাবেন, পরে বলবে? এই লোক মিছে সান্ত্বণা দিতে বড় তৎপর!

তাদের পারিবারিক নাটক বেশিক্ষণ সহ্য করল না ওরা। একেকটা আঘাতের সাথে সাথে জাভেদ আমিরের দেহের মাংস খড়ির সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে আসছিল। পরনের ফতোয়া ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে উঠেছে।

জয় মুখ গুঁজে আছে মায়ের বুকের ভেতরে। সে মায়ের বুক খোঁড়ার চেষ্টা করছে বোধহয়। ঢুকে যেতে পারলে ভালো হবে।

ওদের লুটপাট শেষ হয়েছে। ভাগাভাগি পরে হবে। আলমারী খালি। আমির নিবাসের ঐতিহ্যবাহী কাসার তৈজসপত্রও ছাড়েনি। যুদ্ধের ডাকাতরা যত পেয়েছিল, এরা কিন্তু তত পেল না। এক প্রকার লোকসান হলো আগেরজনেদের তুলনায়। তবু কিছুই ছাড়া যাবে না। যা পাবে হাতে, তাই যাবে সাথে।

হুমায়িরার কানে মোটা স্বর্ণের ঝুমকা। তা খুলে নেবার মতো অত সময় বা ধৈর্য আছে তাদের? হেঁচকা টানে হুমায়িরার কানের ফুঁটো ছিঁড়ে দু’ভাগ গেল, তা যাক, ঝুমকো জোড়াও বেরিয়ে এলো। গলার হাড়, বালা সব নিলো।

মজার ব্যাপার হলো, লুটপাটে দুর্বৃত্তদের আগ্রহ নেই বিশেষ। বারো আনা আগ্রহই জলিল আমিরের রাখা লোকদুটোর মাঝে বেঁচে থাকা সেই একজনের। সে ওদের ডেকে বলল, কুড়াল দিয়ে আলমারির তালাটা ভেঙে দিতে। সে নিজে হাতে হুমায়িরার অর্ধনগ্ন দেহ থেকে অলংকার খুলল। এই বাড়িতে থাকার সময় এসব চোখে চোখে দেখে যে লোভ সংবরণ করা কত কঠিন ছিল, তা তারা দুজন ছাড়া কেউ জানে না। ভালো হয়েছে একজন মরেছে। ভাগ কমেছে।

তারা অসন্তুষ্ট। জাভেদকে আরও কষ্ট দিয়ে মারার ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না।

জাভেদকে মেরেই তাদের কাজ শেষ না। তাদেরকে জয়নালের আবাসে যেতে হবে। জয়নাল দিনাজপুরে এখন।

জয় দেখল, বাবা আর কথা বলছেন না। মাথা ঝুঁলে পড়েছে। উনার কোলের ওপর কয়েক সেকেন্ড পর পর আঠালো রক্ত ও থুতুর মিশ্রণ টুপটুপ করে পড়ছে। ট্যাপের পানি পড়ার কথা মনে পড়ল জয়ের। এভাবেই ট্যাপ বন্ধ করার পরেও টুপটুপ করে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে।

সে মনে মনে তখনও আল্লাহকে ডাকছে। রক্ষা পেতেই হবে আজ। সে আল্লাহকে ডেকে এ-ও বলেছে, বড়বাবাকে এখন পাঠিয়ে দিতে। হুমায়িরা বলতেন, আল্লাহ চাইলে সব পারেন। বড়বাবাকে পাঠিয়ে দিতেও পারেন নিশ্চয়ই!

এলো বড়বাবা। ওরা যখন জাভেদকে শেষবার শ্বাস নিতে বাধ্য করছে, তেমনই চরম মুহুর্তে পেছনে প্রাচীর টপকে বাগানের ভেতর দিয়ে কার্ণিশ বেয়ে উঠে এলেন জয়নাল আমির। তিনি একা। হাতে শুধু একটা রামদা, পরনে কাছা মারা লুঙ্গি। জাভেদ আমির অর্ধচেতনায় ছোট ভাইকে দেখলেন কিনা বোঝা গেল না। তাঁর সারা শরীর ফাঁড়া মেহগনির খড়ির আঘাতে কাচা-কাচা।

দুর্বৃত্তরা একচোট একে অপরের দিকে তাকিয়ে মহানন্দের হাসি হাসল। জয়নাল আমির এখানেই চলে এসেছে অবশেষে।

জয়নাল আমির কিন্তু ভাইকে বাঁচাতে গেলেন না। একদমই না। তিনি ভাবীকে ধরে উঠালেন। হুমায়িরা অসহ্য পেটের ব্যথায় কুঁকড়ে গেছেন। ছুটে যেতে চাইলেন স্বামীর কাছে। জয়নাল আমিরের কঠিন মুষ্ঠি থেকে মুক্ত হতে পারলেন না কেবল। কোমড়ের গামছাটা খুলে বড়ভাবীর শরীরে জড়িয়ে অপর হাতে জয়ের হাতটা চেপে ধরলেন। রামদা তখন দুই হাঁটু দিয়ে চেপে ধরা।

ওরা একটু ধীর-স্থির হয়েছে। জয়নাল আমির নামটাতে এক আতঙ্ক আছে, তা দিনাজপুর জানে।

জয়নাল ভাবী ও ভাতিজাকে ধরে নিয়ে কক্ষের বারান্দায় বসালেন হেলান দিয়ে। জয় বড়বাবার হাত ছাড়ছে না। আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করে, “বাবার কী হয়েছে, বড়বাবা?ʼʼ

বড়বাবা জবাব দিলেন না। বরং ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলেন জয়কে পেছনের দিকে মায়ের কাছে। জয়ের অভিমান হলো।

জয়নাল আমির ডাকলেন ওদের, “আয়। কার কার মায়ের বুকের দুধের জোর পরীক্ষা করবি, আগায়ে আয়। আজ দেখব তোদের মায়ের বুকে দুধের জোর বেশি নাকি আমার হাতের ধাতুর।ʼʼ

একজনের অবশ্য হাত কাটা পড়েছিল। হাতটা তিনি কাটলেন বামহাত দিয়ে। তবু নিখুঁত আঘাত। জয় তখন বড়বাবার ডান কোলে। সেদিন প্রথমবার জয় আমির রক্তের সংস্পর্শ পেলো। ছলাৎ কোরে এসে এক খাবলা গরম তরল ছোট্ট জয়ের শরীরে লেগে গেল। গা’টা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছিল। ঘিনঘিনও করেছিল। বড়বাবার আধখোলা শার্টের প্রান্ত মুঠো করে ধরেছিল সে। বড়বাবার মুখ পাথরের মতো শক্ত তখন। বড়বাবার মুখেও রক্তের ছিটা।

হাত কাটার থমকাথমকির মাঝে কক্ষের দরজা দিয়ে ভাবী ও ভাতিজাকে বের করে দোতলার লম্বা বারান্দায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন জয়নাল। কিন্তু সেখানেও দুজন, পেছনের গুলোও এগিয়ে এসেছে। একহাতে ভাবীকে ধরে জয়কে বুকের সাথে মিশিয়ে রামদাটা চেপে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন।

উনার হাতের রামদা চরকীর মতো ঘুরছে। কমপক্ষে দু’ফুটের মাঝে কেউ এসে দাঁড়ালে মাথা নেমে যাবে ঘাঁড় থেকে।

কিন্তু তার ভাবী জাভেদকে ছেড়ে যাবেন না। বারবার পিছু ফিরে চায়। জয় অস্ফূট স্বরে ‘বাবা বাবাʼ বলে ডাকছে। নারীর আবেগে ঘেন্না এলো জয়নালের। তিনি ভাইকে বাঁচাতে যাননি কেন, তা বুঝেও তো অবলা নারী চুপচাপ সাথে হাঁটতে পারে। ভাই তার বাঁচবে না। বড়জোর মিনিট কয়েক জান আসা-যাওয়া করবে আর! কিন্তু বাঁচাতে হবে জয় আমিরকে! আমির বংশের শেষ প্রদীপ। আর জয়ের লালন-পালনের জন্য জয়ের মাকে।

জয়নাল আমির নরকের দেবতার মতোন নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে পিতার মাথাকাটা লাশও পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন নির্বিকার চিত্তে। তখন কিন্তু জয় ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। বাবার জন্য নাকি দাদুর জন্য, জানা নেই।

বড়বাবার বাম বাহুতে রক্তের ছড়াছড়ি। মাংস অবধি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, এমন গভীর ক্ষত। অথচ বড়বাবার চোখদুটো জ্বলছে, দাউদাউ করে জ্বলছে। র-ক্তের মতো লাল, ছলছলে। বড়বাবা সেদিন জয়কে এক কঠিন ধমক দিয়েছিলেন, “কাদলে তুলে আঁছাড় মারব একটা। আমির বংশের রক্ত তুই। কাঁদবি তো জীবিত গেঁড়ে রাখব। কাঁদছিস কেন? হাসবি। হাস। হাস এখন।ʼʼ

জয় আশ্চর্যজনকভাবে দেখল, লোকগুলো দোতলায় থেমে গেছে। আর ওদেরকে ধরতে এগিয়ে আসছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। বাবা তো পড়েই রইল শোবার ঘরে চেয়ারে। বাবা যাবে না ওদের সাথে?

জয়নালকে বাগানের মালি মন্টু খবর দিয়েছে। নিজের সাথে নিজের দাবা খেলার অভ্যাস আছে জয়নাল আমিরের। সেই দাবার গুটি ফেলে চলে এসেছেন মন্টুর ডাকে। মন্টু বলেনি কী হয়েছে, শুধু বলেছে, “ছোট ভাইজান একবার এক্ষুনি চলেন বাড়িত্।ʼʼ

শার্টের বোতাম তিনটা লাগিয়ে বেরিয়ে এসেছেন জয়নাল। দুটো এখনও খোলা।

আমির বাড়ির পেছনে ঝোপঝাড়। বিস্তর ভূমি পড়ে আছে। জঙলি এলাকা প্রায়। সেদিক দিয়ে হুমায়িরা আর জয়কে বের করে দিতে পেছনের ফটকের কাছে গেলেন জয়নাল। ওরা কিন্তু তখন সবে সদর বাড়ির সামনের প্রাঙ্গনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তাদেরকে তাড়া করার কোনো তাগিদ নেই ওদের মাঝে।

মন্টু কোত্থেকে যেন এসে দ্রুত চাবি দিলো, “ছোট ভাইজান, এই লন ছুড়ান (চাবি)। পিছনের দরজার ছুড়ান।ʼʼ

একবার পেছনে তাকালেন জয়নাল, তারপর মন্টুর দিকে। জয়কে কোলে ধরা হাত দিয়ে ভাবীকে দাড় করিয়ে রাখার চেষ্টা করে শ্লথ হাতে জং ধরা তালাটা খুলতে খুলতে আবারও একবার পেছন মুখোশধারী ও মন্টুর দিকে একবার তাকালেন।

তালা খোলা হলো। ফটক খুলে গেল বিকট শব্দ কোরে। জয়নাল আমির অল্প হাসলেন এবার। ছয়জন মুখোশধারী একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে তাদের অপেক্ষা করছে। দূরত্ব চার-পাঁচ হাত। সেই দূরত্বের মাঝ দিয়ে সাপের মতো শরীর বেঁকিয়ে বেরিয়ে এসে ভাবীর হাত ছেড়ে জয়কে নামিয়ে তাড়া করলেন, “যান। চলে যান। আর পেছনে তাকাবেন না। সময় বেশি পাবেন না, ভাবী। খুব অল্প সময় পাবেন। যান যান যান।ʼʼ

জয় বড়বাবার হাত চেপে ধরে। খুতখুত কোরে কেঁদে কিছু বলতে যাবার আগে বড়বাবা এক বিশ্রী ধমক মারলেন, “এক কোপে গলা কেটে ফেলব। চুপচাপ তোর মায়ের সাথে চলে যা। দৌঁড়া!ʼʼ

জয় অবিশ্বাসে বড়বাবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। বড়বাবা কেন যাবে না তাদের সাথে? অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না বড়বাবার কঠিন মুখখানা। বড়বাবা হুংকার ছাড়লেন, “যা, শুয়োরের বাচ্চা। যাহ! চলে যা, জয়..ʼʼ

সেই অন্ধকারের মাঝেই ওদের দিকে তাড়া করল দুজন। জাভেদের স্ত্রী-সন্তানকে ছাড়া যাবে না। কিন্তু একটা বাগড়া বাঁধল। জয়নাল আমির প্রাচীরের মতো মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পেছন ফিরে অন্ধকারেই কঠোর স্বরে হুমকি দিলেন, “জোরে হাঁটেন ভাবী। জয়কে চেপে ধরে জোরে হেঁটে জঙ্গল পেরিয়ে যান।ʼʼ

ওদেরকে ঠেকাতে গিয়ে হাঁটুতে কোপ লাগল উনার। হাতের দুটো আঙুল ঝুলে রইল চামড়ার সঙ্গে। কে জানে ততক্ষণে মা-ছেলে কতদূর পৌঁছাল!

হুমায়িরা ওই অবস্থায় বেশিদূর যেতে পারবেন না অন্ধকারে জঙলি পথ পেরিয়ে। জয়নাল আমির ওদেরকে ঠেকাতে গিয়ে গোটা শরীরে কতকগুলো গভীর জখম পেলেন। রক্তক্ষরণ ততক্ষণে শরীরটাকে দূর্বল করে ফেলেছে উনার। কিন্তু তা বলে তিনি জয়ের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারেন না! জয় আমিরকে বাঁচতে হবে।

অবশেষে লাভ হলো না বটে। তিনি বন্দি হবার আগে কেবল একটা মহাকর্মই করতে পেরেছিলেন। ওদের পথ ছেড়ে দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে এগিয়ে এলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ওরা তখন ক্ষুধার্ত কুকুরের মতোন ছড়িয়ে পড়েছে জঙলি এলাকার ভেতরে মা-ছেলের খোঁজে।

জয়নাল আমিরের ঠ্যাংয়ে মাংস ছিঁড়ে গিয়ে গর্ত হয়ে গেছে। কলকল করে রক্ত ঝরছে সেখান থেকে। কিন্তু উনাকে হত্যার চেষ্টা করা হচ্ছে না কোনোভাবেই। করা হবেও না, তা তিনি জানেন। কোনোরকম এগিয়ে গেলেন। মন্টু তখনও ফটকের সাথে দাঁড়িয়ে। জয়নাল আমির কেবল একবার হাস্যজ্জ্বল মুখে ডাকলেন, “মন্টু মিয়াহ্!ʼʼ

মন্টু বড় বিনয়ের সাথে জবাব দেয়, “জি, ছোটভাইজান।ʼʼ

মন্টুর কথা ফুরোয় না। জয়নালের হাতের রামদা মন্টুর গর্দান স্পর্শ করে, এবং মুহুর্তের মাঝে তা নেমে ছিটকে পড়ে দেহ থেকে আলাদা হয়ে কোথাও।

বেইমানরা দুনিয়ায় থাকলে দুনিয়ার এত চমকপ্রদ সৌন্দর্যে দাগ দেখা দেয়। জয়নাল আমির সৌন্দর্যের ওপর দাগ পছন্দ করেন না তেমন একটা।

দুর্বৃত্তদের চূড়ান্ত এক লাভ হয়েছিল। যে লাভটা মূলত তারা নিজেদের অজান্তেই চাইছিল। তা জয়নাল আমির আরেকটু সহজ করে দিলেন।

জয়নাল আমির গ্রেফতার হয়েছিলেন। নিজের ভাই, বাপ ও মন্টু মিয়াসহ আরও কয়েকজনকে আহত ও নিহত করার অপরাধে। নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড।

যখন ভোরের আলো ফুটছে। সে সময় জাভেদ আমিরকে হিঁচড়ে নামিয়ে আনা হলো বাগানের প্রাঙ্গনে। শুকনো পাতারা পড়ে আছে। হাঁটলে মরমর শব্দ হয়। জয়নাল আমিরকে ধরে রেখে তার সম্মুখে জাভেদ আমিরের কণ্ঠনালি বরাবর চারবার ছুরিকাঘাত করা হলো। ছোট্ট ধারালো, বাঁকা হান্ট নাইফ। প্রথমভাগে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসে তারপর ধীরে ধীরে চুইয়ে পড়তে থাকল।

জয়নাল আমির আস্তে কোরে চোখদুটো বুজে ফেললেন। শরীরটা ঝিমিয়ে আসছে। ওরা মুখের মুখোশ খুলে ফেলছে আস্তে আস্তে। ভদ্রলোক হয়ে উঠছে। পুলিশ আসবে এবার। ওরা সাক্ষী দেবে কীভাবে জয়নাল আমির সঙ্গীদের সাথে নিয়ে নিজের বাড়িতে হামলা করেছে এবং বাপ-ভাই সহ আরও কয়েকজনকে হত্যা করেছে। আর যে লোকগুলো গুলি খেয়ে মরেছে, তারা মূলত জয়নালেরই লোক। আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে জাভেদ আমির গুলি চালিয়েছেন তাদের ওপর।


আমির নিবাস দিনাজপুরের ঘোড়াহাট উপজেলায়। প্রসিদ্ধ এক অঞ্চল। মোঘল, নবাব, পর্যায়ক্রমে রাজা দ্বারা শাসিত করতোয়ার তীর ঘেঁষে অবস্থিত অভিজাত, পুরোনো অঞ্চল দিনাজপুরের ঘোড়াহাট। সেই অঞ্চলের অভিজাত পরিবারের বড়বধূ হুমায়িরা সে রাতে নেহাত এক অসুস্থ গর্ভবতী কাঙালিনী।

ঘোড়াহাটে আজ সেসব রাজা-সামন্ত নেই তেমন, তবু আছে। ঘোড়াহাট দুর্গ থেকে খুব বেশি দূর নয় আমির নিবাস। দিনাজপুরের প্রশাসনিক অঞ্চল। করতোয়ার কলতান যেন কলকল রবে কানে ধরা দিচ্ছিল হুমায়িরার।

তিনি ভাবলেন, কোনোভাবে বাপের বাড়ি যাওয়া যায় কি? বাঁশেরহাট ঘোড়াহাট থেকে পায়ে হাঁটা পথে কমপক্ষে এক-আধদিন। কখনও বাঁশেরহাটে একা যাননি হুমায়িরা। জলিল আমির সঙ্গে কোরে নিয়ে গিয়ে আবার সঙ্গে নিয়ে আসতেন। বাড়ির বউদের একা চলতে নেই, বাপের বাড়িতেও রাত বাসী করতে নেই।

আর চলার ক্ষমতা নেই হুমায়িরার। জয়কে বুকের সাথে চেপে ধরে ঝোপের ওপর লুটিয়ে পড়লেন। উনার মনে হচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তলপেটের চিনচিনে ব্যথা ভালো আশঙ্কা জাগাচ্ছে না। জয় বারবার জিজ্ঞেস করে, “তোমার কী হইছে?ʼʼ

হুমায়িরা জয়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কিছু হয় নাই আব্বা। আল্লাহরে ডাক।ʼʼ

জয় আল্লাহকে ডাকছে সেই তো তখন থেকেই। একবার ডেকে বড়বাবা এসেছিল। সুতরাং আল্লাহকে ডাকাটায় একটু ভরসার ব্যাপার আছে বটে। সে ডাকল। ডেকে বলল, মায়ের ব্যথা কমিয়ে দিতে। তাদের পেছনে যারা তাদের ধরতে আসছে, তাদের শাস্তি দিতে।

জঙলি এলাকাটা খুব বড় নয়। ওদের হাতে মশাল বা টর্চ ধরণের কিছু ছিল না। হতে পারে নেই।

রাতের কত বাজল জানা নেই। কিন্তু পাতার খচমচ, ঝোড়ঝোপ পেরিয়ে এগিয়ে আসার আওয়াজ এলো। তিক্ত যন্ত্রণাকে চেপে হুমায়িরা টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন জয়কে নিয়ে। নিঃশ্বাসের আওয়াজ খুব জোরে লাগছিল কানে। জয়ের মুখটাও চেপে ধরে ছিলেন।

সে রাতে ধরা পড়লেন না। সকালের আলো ফুটলে বেরিয়ে পড়েছিলেন জঙলি এলাকা ছেড়ে। হুমায়িরা জানেন না, তিনি কোন পথে এগোচ্ছেন। মানুষ বসবাসের এলাকা দিয়ে যাবার উপায় নেই দিনে। কেউ দেখবে গর্ভবতী হুমায়িরার খুঁড়িয়ে পথচলা, রক্তে জর্জরিত পেটিকোটের ওপর একটা লাল গামছা জড়ানো শরীর, ছিঁড়ে যাওয়া ব্লাউজ।

দুটো রাত কাটলো নির্জন ঝোপে ঝাড়ে। রাত শেষ হবার আগেই হেঁটে যদি কোনো ঝোপ পাচ্ছিলেন, সেখানেই থেমে যাচ্ছিলেন। দিনের আলো ফুটতে ফুটতে যদি লোকালয় অবধি পৌঁছান, এই ভয়।

এই দু’দিনে ছোট্ট জয়কে দুবার গন্ধ, নোংরা পুকুরের পানি খাওয়ানো হয়েছে। জয় খিদেয় কাঁদতে চায়, কিন্তু মায়ের দিকে চেয়ে আর কাঁদে না, তার জেদ ওঠে, হাঁটতে চায় না।

রাতে ঝোপ পেরিয়ে পথচলা, অনাহারী অবস্থা এবং নির্ঘুম হেঁটে চলার পরিশ্রম হুমায়িরার গর্ভাবস্থার অভিশাপকে বাড়িয়ে রক্তক্ষরণের মাত্রা বাড়াল। হামাগুড়ি দিয়ে পথচলারও উপায় আর নেই।

বড় আশ্চর্যের বিষয়, ওরকম অবস্থায় এত প্রতিকূলতার মাঝে অনাহারী গর্ভবতী হুমায়িরা কীসের জোরে যে পরের দুটো রাতও পথ চলেছেন একটু একটু কোরে! তিনি জানেন না কোনদিকে এগোচ্ছেন।

তিনদিনের রাত। হুমায়িরার মনে হলো, প্রাণরস ফুরিয়ে এসেছে অবশেষে, জীবনের দায় মেটানোর সময় এসেছে। গর্ভের সন্তানের কাছে মা হিসেবে ধিক্কার মেনে নিয়ে তখন তিনি পথ চলা বন্ধ করে দিলেন। জয় হাঁটতে চায় না, কিন্তু হুমায়িরার সাধ্যের বাইরে জয়কে কোলে তুলে নেয়া। নিষ্ঠুরের মতো হুমায়িরা জয়ের মুখের দিকে তাকান না। তাকালে উনার মা হয়ে বেঁচে থাকার স্বাদ ফুরোবে, এই ভয়।

ঘোড়াহাট পেরিয়ে হুমায়িরা তখন হাকিমপুরে, হিলি সীমান্তের অঞ্চলের এক নির্জন ঝোপে পড়ে আছেন। তিনি জানেন না, তিনি কোথায়! পাখির ডাকাডাকি জানান দিলো রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে। সকাল হতে খুব দেরি নেই।

জয় মায়ের কাছে খাবার চাইল। জেদে কয়েকটা খামছিও মারল। মারা উচিতও। এক সময় হুমায়িরা খাবার নিয়ে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াতেন জয়ের পেছনে। আজ সে খাবার চাইছে, কিন্তু হুমায়িরা দিচ্ছে না। জেদ হবে না কেন?

হুমায়িরা জয়কে বুকের ওপর নিয়ে গালে-মুখে হাত বুলিয়ে বললেন, “আল্লাহকে ডাক জয়। এই দুনিয়ায় এখন তোর আমার কেউ নেই। আমাদেরকে রক্ষা করার কেউ নেই তিনি ছাড়া।ʼʼ

জয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝেই তবু মনে মনে ডাকছিল আল্লাহকে। কিন্তু তিনদিনের না খাওয়া, প্রাণের ঝুঁকি, মায়ের অবস্থা এবং সব মিলিয়ে ভেতরের জেদে শক্ত হয়ে বসে রইল। চোখের পাতা লেগে আসছে। হাঁটুতে ব্যথা। সেই অনাহারী অবস্থায় পেট পিঠের সাথে লেগে গেছে। ক্লান্তি ও ক্ষুধায় মাটির ওপর মায়ের বাহুতে আস্তে কোরে মাথাটা রেখে শুয়ে পড়ার পর কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল!

বিকট হাসির আওয়াজ ও হুমায়িরার বাহু নড়েচড়ে ওঠায় ঘুম ভাঙল। চারজন লোক তাদের খুঁজে পেয়ে খুব খুশি। সকাল হয়ে গেছে! ওরা খুঁজে পেয়ে গেছে ওদেরকে, এবার?

হুমায়িরার বাহু চেপে ধরে ঝারা মেরে টেনে তোলা হলো। করুণ আর্তনাদ করে উঠলেন হুমায়িরা। জয়ের অভুক্ত ছোট্ট শরীরটা টেনে তুলে দাড় করানো দায়। কিন্তু সে গিয়ে এলোপাথারি কয়েকটা আঘাত করার চেষ্টা করল লোকটিকে। মুখভর্তি দাড়ি তার। আরেকজন এসে জয়কে ধরে ওর দুহাত পিছমোড়া করে ধরে চাপ দিলো। মনে হলো, কচি হাতের বাহুগুলো মটমট করে উঠল।

সীমান্তের পার্শ্ববর্তী কোয়ার্টার এলাকা। সেসব কোয়ার্টার আজ পরিত্যক্ত ও নির্জন লাশকাটা ঘরের মতো দেখতে। বাইরের লোহার জানালা-দরজা মাদকাসক্ত ও চোরেরা খুলে বিক্রি করে খেয়েছে। দেয়ালে শেওলা, প্লাস্টার খসে খসে পড়ছে।

চারপাশে ঘন জঙ্গল গজিয়ে গেছে। বন্দর সংলগ্ন এসব কোয়ার্টার মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী হিলি সীমান্ত দখলের সময় পুড়িয়ে দিয়েছিল।

পোড়া বিল্ডিংগুলো এখন মদের আসর ও জুয়ার আড্ডাখানা হিসেবে খুব ভালো। এসব জায়গায় লোক দিনেও পা রাখে না। তাদের জানের ভয় আছে।

ভেতরের বিল্ডিংয়ের এক দোতলায় জয়কে বাইরে রেখে হুমায়িরাকে নগ্ন করার কাজে লেগে পড়ল ওরা। ভাঙা জানালার গ্রিল ধরে জয় চেঁচাচ্ছে। তার গলার আওয়াজ আঁটকে আসছে। সে দেখল, বড়বাবার জড়িয়ে দেয়া গামছাটা মায়ের শরীর থেকে খুলে মুখে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। মা আর চিৎকার করতে পারছে না। চোখের পানি ভেসে ভেসে এসে গালে গোঁজা গামছায় ঠেকলে শুষে নিচ্ছে গামছা। মায়ের শরীরে একটুও জোর নেই।

জয় বন্ধ দরজায় এলোপাথারি ধাক্কাধাক্কি করে বড় ক্লান্ত হয়ে গেল। তিনদিনের না খাওয়া ছোট্ট দেহটা আর চলতে চায় না। সে আবারও জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মায়ের দিকে তাকাতে খুব ভয় হচ্ছে তার। খুব ভয়াবহ দৃশ্য। বুকের ভেতরটা এত নিষ্ঠুরভাবে ঢিপঢিপ করছে। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।

ওরা মাকে পুরো নগ্ন করে ফেলেছে। মায়ের পেটটা উঁচু হয়েছে একটু। পেটের ভেতরে তার বোন আছে। বোন কি কষ্ট পাবে না! ওরা খুব জোরাজুরি করছে মায়ের সাথে। একটা ব্যাপার খেয়াল করল জয়, মায়ের দুই উরুর মাঝ দিয়ে রক্ত শুকিয়ে আছে। আগে ঝরা রক্ত। পুরোনো সেই শুকনো রক্তের ওপর দিয়ে নতুন রক্তের প্রবাহ আসছে।

ওরা মায়ের শরীরের ওপর চেপে শুয়ে পড়ছে। মা হাত-পা ছটফট করলে ওরা খামছে চেপে ধরে রাখছে দুজন। ওরা যখন উলঙ্গ হলো লুঙ্গি খুলে, দৃশ্যটা খুবই খারাপ লাগল জয়ের কাছে। সে চোখের ওপর ছোট্ট দুই হাতের তালু চেপে ধরল।

জয়ের তখনই হুট করে আল্লাহর কথা মনে পড়ল। রাতেও হুমায়িরা পিঠে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে ক্ষীণ গলায় বলেছিলেন, “তোর আর আমার সাথে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই। আল্লাহকে ডাকবি যেকোনো বিপদে। ক্ষুধা পেলে, কষ্ট পেলে, আঘাত পেলে…সবসময়।ʼʼ

সে সেদিন চিৎকার করে করে আল্লাহকে ডেকেছিল, “আল্লাহ আপনে আসেন। কোথায় আপনে, আল্লাহ? আমার আম্মুকে ওরা মেরে ফেলবে আল্লাহ! ও আল্লাহ…..আপনে শুনছেন? রক্ষা করেন আমার আম্মুকে।ʼʼ
মনে হয় আস্তে ডাকা হচ্ছে। জয় আরও জোরে জোরে ডাকল আল্লাহকে। আল্লাহ যদি রক্ষা করতে দেরি করে ফেলে, তাহলে মায়ের খুব কষ্ট হয়ে যাবে। সে বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েও ডাকল। আকাশ থেকে কখন আসবে আল্লাহ! ঘরের ভেতরে খুব খারাপ কিছু হচ্ছে। কিন্তু কান্নার তোড়ে জয়ের গলা আঁটকে আসছে। ডাকতে ডাকতে হেঁচকি উঠে গেল, কাশতে কাশতে গলায় জ্বলুনি শুরু হলো। বুকটা লাফাচ্ছে।

তার এত চিৎকার বোধহয় খুব বিরক্তিকর ছিল। দরজার খুলে একজন লোক লুঙ্গির গিট্টু বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে এলো। জয় দৌড়ে যাবার চেষ্টা করেছিল ঘরের ভেতরে।

কিন্তু লোকটা জয়কে ধরে ফেলল। মেঝেতে শুইয়ে ফেলে বুকের ওপর চড়ে বসল লোকটা। জয়ের দম বন্ধ হয়ে এলো। তাতে জয়ের আবার একবার আল্লাহর কথা মনে পড়েছিল অবশ্য। লোকটা তাকে জবাই করবে। আরেকটু সময় সে পেতে পারতো। কিন্তু এত চিৎকারের ফলে সময় এগিয়ে এলো।

সে লোকটার হাতে চাপাতির মতো দেখতে মৃত্যুকে দেখেছিল। তখন তার বয়স সাত। তার আল্লাহর কথা মনে পড়লেও সে ডাকল না। একটুও ডাকতে ইচ্ছে করল না। খুব আগ্রহী নজরে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে রইল চাপাতির চকচকে ধারালো প্রান্তের দিকে।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭০. (প্রথমাংশ )

জয়ের গলার কচি ত্বক বিদীর্ণ হয়ে চিনচিন করে রক্ত বেরিয়ে এলো। কিন্তু কেন যে কণ্ঠনালিতে ছুরির বসার আগেই দ্বিতীয়জন এসে বাঁচিয়ে নিয়েছিল জয়কে! সেদিন জয় ফুরিয়ে যেত। তার জীবনটা সংক্ষিপ্ত। সে জানে। এবং অনিশ্চিতও। কিন্তু সেদিন জয় আমির ফুরিয়ে গেলে অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত হতো। কিন্তু তার জীবনটা অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত নয়, শুধু সংক্ষিপ্ত। সেই সংক্ষিপ্ত জীবনটায় অভিজ্ঞতা ও ঘটনার কমতিটা থাকা যাবে না। তাই এরপর তার জীবনে অভিজ্ঞতা ও ঘটনার স্রোত-তরঙ্গ বিরামহীন তেড়ে এলো। আর শান্ত হলো না সেই স্রোত।

তখন জয় আচমকা মৃত্যুর ওপার থেকে জেগে উঠে খুবই অসন্তুষ্ট। তাকে বাঁচানোওয়ালা লোকটা সেই দাড়িওয়ালা। কোকড়ানো বাবরি চুল। গলায় তাবিজ। পরনে লুঙ্গি। মুখে তৃপ্তির হাসি।

নিভু চোখে শেষবার লোকটাকে দেখেছিল জয়। কিন্তু তার ভেতরে এক প্রকার প্রেমের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে।অনুভূতিটা অদ্ভূত। প্রেমটা তার মৃত্যুর ওপর। একটা সুন্দর অন্ধকারত্ব। যেখানে জীবন নেই, বিরোধ নেই, রাজনীতি নেই, ক্ষুধা নেই, ব্যথা নেই, চাহিদা অথবা ক্ষমতার লড়াই নেই। মৃত্যুর এত এত সৌন্দর্য ছোট্ট জয়কে মুগ্ধ করেছিল, সেই মুগ্ধতা আর কাটেনি কখনও।

জয় মরে গেল। গলার চিনচিনে ব্যথাটা আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকার। শরীরের ভর অনুভূত হচ্ছে না, শূন্যের ওপর ভাসমান হালকা দেহতে একটুও ক্ষুধা-ক্লান্তি আর লালসা নেই।

কতক্ষণ পর তার মৃত্যু ঘুম ভেঙেছিল! আবারও মাথার ওপরে আকাশ। আকাশটাকে ঠিকমতো দেখার উপায় নেই। বিশাল বিশাল কড়ই গাছের ডালগুলো আকাশকে জমিনের চোখের আড়াল করতে খুব তৎপর। চোখদুটো ঘোলা। প্রকৃতিও মেঘাচ্ছন্ন, আবার সাঁঝের বেলা।

জয় উঠে বসল। গলার ব্যথায় গা কেঁপে উঠল। শরীরের তাপে চামড়া ঝলসে যাবার উপক্রম। পরনের জামাটা ভেজা, প্রকৃতিও। অর্থাৎ বর্ষণ নেমেছিল প্রকৃতিতে।

হুমায়িরার দেহটা পড়ে আছে। নগ্ন দেহ, রক্তাক্ত। পেটটা উঁচু তখনও। জয় দৌঁড়ে গিয়ে বসে পড়ল মায়ের পাশে। ডাকল কয়েকবার। তার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদতে ইচ্ছে করছে না। সে জেনে গেছে দুটো কাজ খুবই অহেতুক। এক আল্লাহ নামক রক্ষাকর্তাকে ডাকা আর দ্বিতীয়টা কাঁদা। বড়বাবা বলেছে হাসতে। সে হাসতে চেষ্টা করল। না! হাসিটা আসছে না। না আসুক, তবু কান্নাও করা যাবে না। কেঁদে কিছু হয় না। লোকে দেখলে বা শুনলে আরও বিরক্ত হয়ে জবাই করতে আসে।

সে মরেনি! কীভাবে সম্ভব! সে জ্ঞান হারিয়েছিল। ওরা এখানে ফেলে গেছে! জয়ের খুব ভয় লাগছে। এত অন্ধকার কেন? বিভিন্ন ধরণের আওয়াজ কানে আসছে। সেসব আওয়াজ ভোঁতা। একটাও স্পষ্ট-প্রকট নয়। তাতে ভেজা আঁধারে মোড়ানো প্রকৃতিটা গুমোট হয়ে উঠেছে।

সে কয়েকবার হুমায়িরাকে ডাকল, “আম্মু! আম্মু গো! ওঠো আম্মু! আম্মু, আমার একটু খিদে পাচ্ছে। চলো যাই আমরা। আম্মু!ʼʼ

তার রাগ হলো। হুমায়িরা কথা বলছেন না। মাঝরাত অবধি জয় থেমে থেমে অনেকবার হুমায়িরার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছে। হুমায়িরা ওঠেন না। শেষরাতে জয় কাঁদল। জঙ্গলের ভয়াবহতা, ক্ষুধার জ্বালা, মায়ের কথা না বলা তাকে কাঁদালো। কিন্তু শব্দ করে কাঁদল না। সে কাঁদল নিচু স্বরে। জোরে কাঁদলে ঝুঁকি আছে। তার ভেতরে আবারও মৃত্যু-প্রেম জেগেছিল। সেদিন সে বুঝতে পারেনি বটে, তার ভেতরে যে একটা নাম-পরিচয়হীন কিছুর প্রতি নিগূঢ় টান কাজ করছে, তা আসলে মৃত্যু। যে মৃত্যু তার কাছে আসছে বারবার, দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, জয় এগিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু মৃত্যু তখনই জয়কে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। এই লুকোচুরির জন্য জয়ের ভেতরে মৃত্যুর জন্য যেমন নেশা পয়দা হলো, তেমনই এক বিরহ-বিদ্রোহও।

সকালের আলোয় গাছের পাতাগুলোকে দেখে তার খাবার মনে হলো। পাতা অনেক ওপরে। হাতের নাগালে জমিনের মাটি আছে। জয় আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খামচে মুখে নিলো। চিবিয়ে চিবিয়ে গিলতে চেষ্টা করল। স্বাদটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জঙ্গলটা চোখের সামনে ঘুরছে। কিন্তু খাওয়াটা দরকার। সে পড়ে থাকা গাছের শুকনো ডাল দিয়ে মাটি আচড়ে তা তুলে খেলো। মা উঠলে তাকেও খাওয়াতো। মা শুয়ে আছে, তাই মায়ের খিদেও নেই। জয়েরও উচিত শুয়ে পড়া। তার মাথা ঘুরছে আসলেই। খুব বেশিক্ষণ জেগে থাকা চলবে না। নিঃশ্বাস নিতে পারা যাচ্ছে না।

জয়ের মাথায় এই বুদ্ধি এসেছিল, সে দৌড়ে জঙ্গল পেরিয়ে কারও বাড়িতে যাবে, সাহায্য চাইবে। কিন্তু উঠে দাঁড়ানো গেলে তা সম্ভব হতো। সে উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। শুয়ে শুয়ে আরও কিছুটা মাটি সে গালে নিয়ে চিবিয়েছিল। মাটিতে ক্ষুধা নিবারণ হচ্ছে না। রোদ উঠছে আস্তে আস্তে। নিভে যাচ্ছে সেই সাথে জয়ের চেতনা। জয় গিয়ে মায়ের নগ্ন বুকটার ওপর তার ভরশূন্য মাথাটা রেখে আস্তে কোরে শুয়ে পড়ল।


সৈয়দ বাড়ির মসজিদে হুমায়িরার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জয় তখন অন্দরে অচেতন পড়ে আছে।

সে শেষবার যখন হুমায়িরাকে দেখেছিল, তখন সে প্রায় জীবন্মৃত। জীবন ও মৃত্যুর সেতুর ওপরে সাত বছর বয়সী জয় টলমলে পায়ে একা দাঁড়ানো। তাছাড়া হুমায়িরার পরিণতিগত অবস্থা ছেলে হিসেবে স্মৃতিতে ধারণ করতে নেই। মায়ের ওই চিত্র যুবক ছেলের স্মরণে আসতে নেই। জয় তা ধারণ করতে চায়নি। স্মৃতিতে রাখতে চায়নি। যা মানুষ স্মৃতিতে রাখতে অস্বীকৃতি জানায়, মস্তিষ্ক তা ধারণ করে না সচরাচর। এক্ষেত্রে মস্তিষ্ক মানুষের অনুগত।

জয়ের মস্তিষ্কে বিকৃতি হয়েছিল। খুব ছোট বয়সের সেই বিকৃতি খুব নিখুঁত, সূক্ষ্ণ আর জটিল। তা হামজা জানে। জয় জানে না, মানেও না। সে নারীসঙ্গকে নিজের মতো করে রীতিগত করে নিয়েছিল, অনেকটা অধিপত্যের মতো। কিন্তু আবার সম্মানের দায় ছিল না তার। নারীর অসম্মান তার কাছে বিশেষ কোনো সংবেদনশীল ব্যাপার নয়। কিন্তু ধ-র্ষণে তার তীব্র বাতিক, এমনকি ধর্ষণের আশেপাশে থাকার জটিল ও অসীম অনীহা! কিন্তু জয় জানে ও মানে সে সব ভুলে গেছে। কড়া ড্রাগ ও একাধিকবার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন তাকে উদ্দীপনাহীন করে তুলেছে। এটা তার ধারণা।

মাঝেমধ্যে মনে এলে হামজা জয়কে ড্রাগ ধরিয়ে দিয়েছে। মনে আসাটা হুমায়িরার মুখ নয়। হুমায়িরার চেহারা জয়ের মনে পড়ে না, এটা তার ধারণা। কিন্তু কখনও যদি হুমায়িরার পরিণতিগত চিত্র মনে পড়ে আবছা হয়ে, তখন সে কড়া ড্রাগ সেবন করে।

সৈয়দ বাড়িতে বেশ কয়েকটা তার বয়সী বাচ্চা ছিল। সৈয়দ ফরহাদ মোহাম্মদ বারীর দুই সন্তান মুস্তাকিন ও মুরসালীন। আরও আছে রুবাইয়াত। সে মুস্তাকিনের চাচাতো বোন।

ওরা বারবার এসে জয়কে দেখে যাচ্ছে। ওদের বয়সী একটা ছোট্ট ছেলে বিছানায় অচেতন পড়ে আছে। খুব অবাককর ঘটনা। দু’দিন আগে রুবাইয়াতের মামা অর্থাৎ মেজো চাচার শালা ছেলেটাকে সৈয়দ বাড়িতে এনেছে। তারা ছেলেটাকে চেনে না।

মুস্তাকিনের বয়স নয় পেরিয়েছে। সে নাজেরা শেষ করে হিফজ্ বিভাগে গেছে। মুরসালীনের বয়স সাত। সে আরবী পড়তে চায় না, চরম ফাঁকিবাজ। নামাজের সময় তার পেট ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে। এখনও কায়দা, আমসিপাড়াই শেষ করেনি।

সন্ধ্যা অবধি ওরা বারবার ঘুরে ঘুরে অচেতন বাচ্চাটাকে দেখে গেছে। সন্ধ্যার পর সবক থাকে, হুজুর মারবে খুব। এজন্য অগত্যা চলে যেতে হলো মাদ্রাসায়। মাগরিবের নামাজ না পড়লে আব্বা ফিরে শুনলে বেত দিয়ে পিটাবে।

মুস্তাকিনের মেজো চাচি হাজেরা। স্বামীর সাথে রাতে তার খুব বড়সড়ো একটা ঝগড়া হয়ে গেছে। আমির বাড়ির ছেলেকে সৈয়দ বাড়িতে আনার মতো কাজ কী করে করতে পারল তার স্বামী! উনার বড় বোনের স্বামী আজ উনার স্বামী। বড়বোনকে জয়নাল আমির ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। এরপর মৃত বোনের সঙ্গে হাজেরাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বাড়ির সকলে সেসব ভুলে গেলেও হাজেরা বোনের সাথে হওয়া অন্যায় ভোলেনি। সে জানিয়ে দিয়েছে স্বামীকে, আর থাকবে না এ বাড়িতে, অন্তত যতদিন ওই ইবলিশের বাচ্চা এই বাড়িতে আছে।

কাজ হয়নি। বলাৎকার হওয়া আমির বাড়ির বউকে যখন এ বাড়িতে এনে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা হলো, হাজেরার ইচ্ছা করেছে মৃতদেহটা কুচি কুচি করে কাটতে। এখন ছেলেটাকেও তাই করতে ইচ্ছে করছে তার।

ইবলিশের বাচ্চাকে রেঁধে খাওয়ানো, যত্ন করে বাঁচিয়ে তোলার পাপ তিনি করতে পারবে না। যার চাচার হাত এ বাড়ির রক্তে রঙিন, তার ভাতিজাকে হাজেরা যখন-তখন গলা টিপে মেরে ফেলতে পারে।

পরদিন সকালে জয়ের ঘুম ভাঙল। স্যালাইন চলছে তার শরীরে। সে চারদিকের কিছুই চেনে না। আতঙ্কে বুক খালি হয়ে এলো। আবার কোথায় আনা হয়েছে তার মা আর তাকে? সে টলমলে পায়ে এক দৌড়ে ঘরের বাইরে এলো। মনে হলো কিছু ছিঁড়ে এলো। হাতের ক্যানোলা। তা খুলে এসেছে, হাতের শিরাতে রক্ত জমেছে। আশপাশে লোক নেই। মাকে খুঁজে বের করে তাকে নিয়ে পালাতে হবে।

চারপাশে ঘর। একতলা বাড়ি। সব ঘরগুলো গোল হয়ে একের পর এক সজ্জিত হয়ে মাঝখানে গোলাকার উঠান তৈরি করেছে। সে বুঝতে পারল না কোন ঘরে তার মা আছে। ঘরের দরজাগুলো সবুজ রঙের। হাতটা জ্বলছে। তাকিয়ে দেখল, সুঁচ ফোটানো শিরাটা রক্ত জমে কালো-খয়েরি হয়ে গেছে।

কেউ ঢুকছে। লোহার গেট খুলে আবার সিটকিনি লাগানোর শব্দ এলো। জয় তবু নড়ল না। সে কোথায় আছে, তা জানা দরকার। লোকটা ঢুকে কাঁধ থেকে হাজী রুমালটা খুলে দড়ির ওপর রাখল। চেঁচিয়ে ডাকল, “হাজেরা বুবু! গামছাটা দে বুবু। গা ঘাইমা শ্যাষ।ʼʼ

জয়ের পা দুটো কাঁপছে। থামানো যাচ্ছে না। সে চাইছে দৌড়ে পালাতে, কিন্তু পা সরছে না। এটা সেই দাড়িওয়ালা, বাবরি চুলের লোকটা। তার মা কোথায়? লোকটা ঘেমেছে কেন? সেদিন মায়ের সাথে খারাপ কিছু করার পরেও লোকটা ঘেমেছিল খুব। জয়ের হাড্ডিসার বুকের পাজরটায় তুফান উঠল। ঢিপঢিপ করছে।

লোকটা তাকিয়ে জয়কে দেখেই কেমন করে যেন হাসল, “কী খবর আমির সাহেব? আমি ভাবছিলাম আপনের ইন্তেকাল হয়ে যাবে। কৈ মাছের জান, এহ? হা হা হা! খুব ভালো। আল্লাহ হায়াৎ দিছে। থাকেন বাইচা।ʼʼ

জয় ছিটকে একদৌড়ে ঘরে যেতে গিয়ে ঢালাই করা উঠানের ওপর পড়ে ঠ্যাংয়ের চামড়া ছিলে গেল। উঠে হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে সেই ঘরে গিয়ে দরজটা চাপিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথা ঘুরছে নাকি ঘরটা, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ঘুরছে। চারপাশটা চোখের সামনে স্থির হচ্ছে না। সে এই ঘরে, কিন্তু মা কোথায়? বুকটা এত নিষ্ঠুরভাবে কাঁপছে!

সে লোকটাকে ছাড়বে না। কিন্তু সামনে যেতেই তো পারবে না। নিজের ওপর খুবই রাগ হলো। সে লোকাটাকে আঘাত করতে চায়, কিন্তু লোকটার চেহারা মনে পড়লেই চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে, বুকের ভেতরে লাফালাফি চলছে, শরীরটা ঘামছে।

সে দরজা আটকানোর সময় খুব জোরে দরজার কপাট চাপিয়েছে। বিকট শব্দ। পুকর পাড় থেকে বাড়ির মহিলারা ছুটে এলো। জয়ের ছোট্ট দূর্বল দেহটা দরজা চাপিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো। একজন মহিলা এগিয়ে এলেন। আলতো হাতে জয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী হইছে আব্বা তোর! ভয় পাইছো?ʼʼ

মহিলাটিকে সে চেনে না। কিন্তু ভালো মনে হলো। পেছনের জনের দৃষ্টি কিন্তু জয়ের ওপর ভালো না। সে জয়কে বড় ঘেন্নার নজরে দেখছে। জোহরের আজান হলো সৈয়দ বাড়ির মসজিদে। মনে হলো যেন ঘরের মধ্যে হচ্ছে আজান।

পেছনের মহিলা সেই বাবরিওয়ালাকে গামছা দিলো। তা জয় আড়চোখে দেখে চোখদুটো বুজে রাখল।

দুপুরের পর দুটো বাচ্চা আসে বাড়িতে। তাদের পরনে টুপি, সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা। জয়কে বারবার দেখে। ভালো মহিলাটি ওদের মা, মরিয়ম। মরিয়ম জয়কে নিজের ছেলেদের সঙ্গে বসিয়ে খাওয়ান। জয় কথাবার্তা বলে না। লোকজন কম দেখলে ঘরে ঘরে মাকে খোঁজার চেষ্টা করে।

সৈয়দ বাড়ির পেছনের সীমানার একটু দূরে আরেকটা বাড়ি। বাড়ি নয় ঠিক, কোয়ার্টারের মতোন আবাসিক। সেখানে অনেক যুবকের বাস। ওরা এ বাড়ির অধীনেই থাকে, সেটা বুঝেছিল জয়।

বাবরিওয়ালাও এই বাড়িতে নিয়মিত আসে। সে জানতে পেরেছে রুবাইয়াতের মা হাজেরার ভাই হলো বাবরিওয়ালা। বাবরিওয়ালার নাম সেলিম ফারুকী।

বাবরিওয়ালার হাতে বিভিন্ন পাথরের মোট তেরোটা আংটি আছে। একেক আঙুলে দুটো-তিনটে কোরেও। গলায় তাবিজ আছে কয়েকটা।, মাঝেমধ্যে তসবীহ ঝুলতে দেখা যায়। রাতে নাকি সে ধ্যান করে। চোখদুটো নেশা নেশা। ধ্যান করলে চোখ নেশা নেশা হয়। আল্লাহর ধ্যান। রুবাইয়াত তার মামার ব্যাপারে এসব জানিয়েছে জয়কে।

জয়ের আল্লাহর প্রতি বিরাগটা বাড়ছে দিনদিন। যে আল্লাহর ধ্যান সেলিম ফারুকী করে, সে কিনা তার মাকে রক্ষা করবে সেই আল্লাহকে কত বিশ্বাসের সাথে ডেকেছিল সে! নিজের বোকামিতে সে লজ্জিত। সেলিম যার ধ্যান করে সেই আল্লাহ অবশ্যই সেলিমের পক্ষেই থাকবে, তার মাকে বাঁচাতে আসবে কেন?

মাস দুয়েকের মাঝে তাকে বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হয়নি। বড়কর্তার হুকুম। জয় জানে না বড়কর্তা কে। গোল উঠান, একটা খোপের মতো ঘর, আর গোসল করার জন্য কলপাড়। সেই কলপাড়ের পাশে পুকুর, তার ওপারে কলার বাগান, ঝোপ-ঝাড়। এটুকুই জয়ের সীমানা। জয় ঘরের ভেতরেই থাকে। বাইরে বের হলে হাজেরা এবং সেলিমের সাথে দেখা হয়। তার ভয় লাগে।

দুই মাস পর বাড়িতে একজন বিশেষ কেউ ঢুকলেন। ব্রিগেডিয়ার সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারী সাহেব। জয় বুঝল এই সেই বাড়ির কর্তা। মুস্তাকিনের আব্বা।

ফরহাদ সাহেব জয়কে সৈয়দদের কওমী মাদ্রাসায় পড়তে দিলেন। জয় বুঝতে পেরেছিল এই গোটা পরিবারের অর্থাৎ যে পরিবারকে ঘেন্না করতে শেখানো হয়েছে তাকে ছোটবেলা থেকে, তা অহেতুক নয়। বড়বাবা কেন সৈয়দ পরিবারকে এত ঘেন্না করতেন, তা সে বুঝল। এটাও বুঝল, এখন সৈয়দ বাড়ির সবকিছুর প্রতিনিধিত্ব করছেন সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারী।

তিনি রোজ সকালে উঠে কোরআন তেলওয়াত করেন। জয়ের কানে খুবই বিরক্ত লাগে। যে আল্লাহই সেলিমের মতো মানুষের, তার বাণী যে এত যত্ন করে পাঠ করে তার প্রতিও জয়ের বিদ্বেষ। আজ অবধি তার মায়ের ব্যাপারে কিছু জানা যায়নি। উনার নির্দেশে জয়কে বন্দি রাখা হয়েছে।

তিনি দুই মাসের ছুটিতে এসেছেন। ফরহাদ সাহেবের কাছে একবার খবর এলো, জয়কে পিটিয়ে শরীরের চামড়া ছিলে ফেললেও সে পড়ে না। জিহ্বা অবধি নড়ায় না। নামাজে যায় না। গেলেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মোনাজাত করে না কখনও।

এ নিয়ে জয়কে ওই ছোটবেলায় যে পরিমাণ মার খেতে হয়েছিল হুজুরদের হাতে, তার শরীরটা হয়ে উঠল ব্যথাহীন। দু চারটে চামড়া ছিলা বেতের আঘাত তখন আরামদায়ক ব্যাপার তার কাছে।

জয় জেনে গেছে, এই কোরআন সেই আল্লাহর বাণী যাকে ডাকার পরেও তিনি তার মাকে বাঁচাতে আসেননি। সে এই দুই মাসেও ডেকেছিল আগের সব ভুলে। সে এখন আর মাকে চায় না, কিন্তু বড়বাবা তো পারে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে! এই রক্ষাটুকু সে আবারও বেহায়ার মতো চেয়েছিল আল্লাহর কাছে। আল্লাহ করেননি।

আলিফ–টা অবধি উচ্চারণ করানো গেল না জয়কে দিয়ে। বোবাও মুখ দিয়ে আওয়াজ করে, জয় দাঁতে দাঁত আটকে বসে থাকে চুপচাপ। মুরসালীন তাকে খোঁচায়, “বল জয়। পড়। গুনাহ হয়। এমন করিস না। হুজুর তোকে আরও মারবে। ওরা তোকে কাফের ভাবে। তুই কি আসলেই তাই? পড় জয়।ʼʼ

তাতে জেদ বাড়ে। জয় পড়ে না তো পড়েই না। মার খেয়ে হাতের তালু ফেটে যায়, কখনও মারের চোটে ছোট্ট শরীরটায় জ্বর আসতো। কিন্তু হিফজখানায় রাত তিনটের সময় তাহাজ্জুদের নামাজে ডেকে তোলা হয়। জ্বর নিয়ে উঠে বসতে হতো। না উঠলে ঘুমন্ত অবস্থাতেই বেতের সপাৎ সপাৎ বাড়ি। এছাড়া সবাই জেনে গেছে জয় কাফের। নেহাত ফরহাদ সাহেবের নির্দেশ না হলে কবেই জয়কে বের করে দেয়া হতো মাদ্রাসা থেকে। তার ওপর নামাজে না দাঁড়ালে জ্বর আসা শরীরে মার পড়ে।

তাদেরকে সুন্নতী তরিকায় এক খাঞ্চায় কয়েকজনকে খেতে দেয়া হয়। এতে মুসলমান ভাইদের মাঝে স্নেহপ্রীতি বাড়ে। জয় খাওয়ার আগে বিসমিল্লাহ পড়ে না। বিসমিল্লাহর শেষে আল্লাহ আছে। সে একবার মুস্তাকিনকে জিজ্ঞেস করল, বিসমিল্লাহ মানে কী?

মুরসালীন খুব খুশি হলো। হয়ত জয়ের ভেতরের গোমরাহি দূর হচ্ছে। সে হেসে জানালো, “আল্লাহর নামে শুরু করা। আল্লাহর নামে খাওয়া শুরু করলে বরকত হয়। খাওয়াটা ইবাদতের শামিল হয়।ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “আল্লাহ বলতে কিছু নেই। খাওয়া আল্লাহর নামে শুরু করারও কিছু নেই।ʼʼ

সেদিন আর খাওয়া হয়নি। হুজুর খুব মারলেন। মারার কারণ আছে। তাকে অনেক স্নেহের সাথে বোঝানোর চেষ্টা করতে গেলে সে আরও বেশি কটূক্তি করে, এমন সব কথাবার্তা বলে যা সহ্য করা যায় না। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে মেরে বোঝানোর চেষ্টাটাই করা হয় এখন। তাছাড়া জয়ের ওপর রাগ তাদের কম না তার কর্মকাণ্ডে।

দু’দিন কিছু খাওয়া নেই, মুখে স্বাদ নেই, জ্বরে গা তিরতির করে পুড়ছে। এখানে মরিয়ম নেই, মা হারিয়ে যাবার পর মরিয়মের কাছে একমাত্র যা স্নেস সে পেয়েছে। তাকে সেবা করার কেউ নেই। সব ছাত্ররা জেনে গেছে, সে কাফের। তার যেকোনো কষ্ট ওদেরকে সুখ দেয়। মাদ্রাসায় একটা নাস্তিক আছে, এটা খুব কলঙ্কের বিষয়। মুরসালীন আর মুস্তাকিন ছাড়া কেউ তার পাশ অবধি মারায় না, পারলে বিভিন্নভাবে মার খাওয়ায়, জ্বালাতন করে, আঘাত করে, গালি দেয়।

শেষ অবধি না পেরে সৈয়দ বাড়ির অন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হলো জয়কে। মরিয়ম মাথায় পানি ঢালেন। ওষুধ খাওয়ার আগে মরিয়ম জয়কে খেতে দিয়ে পানি আনতে গেলেন। হাজেরা এসে পা দিয়ে থালাটা উল্টে দিলো। কান মলে ধরে বলল, ইবলিসের বাচ্চা, “তোরে বলছি না বাড়ির ভেতরে আসবি না। তোরে আমি সহ্য করতে পারি না। বাইরেই মরবি। আসবি না অন্দরে। শয়তানের বাচ্চা।ʼʼ

পরের ছুটিতে ফরহাদ সাহেব এসে জয়কে একদিন ডাকলেন, পড়িস না কেন আব্বা? অবিশ্বাস কেন এত?

আমার মা কোথায়?

ফরহাদ সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। খানিক পর বললেন, আল্লাহর আমানত আল্লাহ নিয়ে গেছে..

জয়ের ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। সে কটূক্তি করে বেজায় আপত্তিকর মন্তব্য করে বসল। যা সহ্য করা যায় না। কিন্তু ফরহাদ সাহেব অসীম ধৈর্যের সাথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন। কিন্তু সেলিম পাশেই ছিল। সে জয়কে কখনোই ফরহাদ সাহেবের কাছে একা ছাড়ে না। সে এসে জয়ের গাল চিপকে ধরে চুল মুঠো করে ধরল।

ফরহাদ সাহেব বললেন, “ছেড়ে দাও সেলিম। ছোট মানুষ। বুঝবে ইনশাআল্লাহ। আমি মানা করেছি ওকে আঘাত করতে।ʼʼ

-“জানেন না ভাইজান ও কতটা বাড় বাড়তেছে দিনদিন। মাদ্রাসায় ওর জন্যে ছাত্ররা অভিভাবকরা অতিষ্ট। ওরে এমনে শাস্তি না দিলে ও নিজের সাথে সবাইরে নষ্ট বানাই ফেলবে। আমি বলে রাখলাম আপনারে।ʼʼ

ফরহাদ সাহেব জয়কে বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবেশটা ভেঙে গেল, উনার মেজাজটা থমকে গেল জয়ের আচরণে। জয়কে সেলিমের হাত থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে উনি উঠে চলে গেলেন কোয়ার্টারের দিকে।

জয়ের শরীরটা কালো হয়ে গেছে। শরীরে বেতের আঘাত, হাতের মার, না খাওয়া, অনাথ-অসহায়ত্বের ছাপ খুব তীব্র।

মুরসালীন ও মুস্তাকিন জয়ের সাথে মেশার চেষ্টা করতো। কিন্ত জয়কে বোঝা যায় না। তার ভেতরে খাওয়া, গোসল, আদর-যত্নের কোনো চাহিদা দেখা যায় না। মার খেলে কাঁদে না, হাসে। উন্মাদের মতো হাসে। তার হাসিটা তার ঠোঁটে সেভ করা। কিছুতেই তা মোছে না। বড়বাবা হাসতে বলেছে।

বাড়ির লোকেদের অবশ্য পছন্দ ছিল না জয়ের সাথে দুই ভাইয়ের মিশতে চাওয়া। জয় একটা শয়তান, তার ঘাঁড়ে শয়তানের বাসা আছে, সেখানে অনেকগুলো শয়তান বাস করে—মাদ্রাসায় ছেলেরা সবাই এটা জানে।

চোখের সামনে রোজ সে সেলিমকে দেখে। মাজার থেকে মাদ্রাসায় তসবীহ জপতে জপতে আসে। বৈরাগী লোক। বিয়ে সাদীহীন সংসারত্যাগী একজন সাধু গোছের লোক সেলিম। খুব আল্লাহভীরু, ধার্মিক, মাজারপ্রেমী মানুষ। জয় তাকে দেখলেই লুকিয়ে পড়ে। ছোট্ট মস্তিষ্কে সুগভীরভাবে জড়ানো আতঙ্ক কাটতে চায় না।

সে তিনবছর ছিল সৈয়দ বাড়িতে। সেই তিন বছরের বন্দি জীবনে মাদ্রাসা থেকে বাইরে বেরোবার সুযোগ হয়নি। তাকে আলাদা পাহারায় রাখা হতো। বিকেল হলে ছেলেরা বাইরে হাঁটাহাঁটি ও খেলাধুলা করতে গেলেও তার সেই সুযোগ ছিল না। জয় বুঝতে পেরেছিল, মাদ্রাসায় একটা সংগঠন চলে। সেটার ঘোর বিরোধী ছিল বড়বাবা। তাকেও হতে হবে।


হুমায়ুন পাটোয়ারী মাসে চার-পাঁচটা বিয়ে করে বেড়ান। খুবই দক্ষ মেয়েলোক পটাতে। কিন্তু ফাঁসলেন তুলির মায়ের কাছে। তুলির মা দেখতে তুলির চেয়েও সুন্দর ছিল। মহিলা গর্ভবতী হলো। হুমায়ুন পাটোয়ারী বারবার গর্ভপাত করতে বলেও লাভ হলো না। বরং মহিলা পুলিশে যাবার হুমকি দিচ্ছিল। হুমায়ুন আশ্বাস দিলেন, বাচ্চাটা হয়ে গেলে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু পাড়ার লোক মেরে তেড়ে দিয়েছিল দুজনকেই।

শাহানার সন্তান নেই। হামজাকে মানুষ করছেন। এর পর একটা মেয়ে পেলে খারাপ হয় না। ফুটফুটে তুলির জন্মের পর তুলিকে রেখে দিলেন নিজের কাছে। এক রাতে হুমায়ুন তুলির মাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে মাঠের ডিপটি কলের নালিতে শুইয়ে জবাই করে ফেললেন। লাশটা গুম করে ফেললেন। শাহানা তাতে খুবই খুশি। নিজেরাই খেতে পান না, আবার সতীনকে কী খাওয়াবেন। বারবার জেল-জরিমানা দিতে আর সংসার চালাতে বিঘা বিঘা জমি বিক্রি করে সব শেষ করে ফেলেছেন হুমায়ুন।

হুমায়িরা তাদের সংসার চালাতেন, বিশেষত হামজার পড়ার খরচ। হুমায়ুন হামজাকে নিয়ে খুবই বিরক্ত এ ব্যাপারে। ছেলেটা পড়ালেখা ছাড়তে চায় না। শান্ত স্বরে শুধু বলে, “আমি পড়ব, আব্বা।ʼʼ

এরপর হুমায়ুন দু-তিন দিন ধরে অবিরাম চেঁচালেও আর কোনো জবাব দেবে না হামজা, এবং নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবে এটা ভাবাও যায় না।

কতবার যে হুমায়ুন মেরে ধরে হামজাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। ছেলে থাকতে তিনি কেন কাজ করবেন? কিন্তু হামজা পড়ালেখা ছাড়ে না। হুমায়িরা নিখোঁজ হবার পর হামজার পড়ার খরচ বন্ধ হয়ে গেল, সংসার আর চলে না। হামজা না খেয়ে থাকতে পারে। তার নির্লিপ্ততা কঠিন। দু’দিন না খেয়ে থাকলেও ভাত চায় না। কারও সাথে বেশি কথা নেই, হাসি নেই। মলিন কাপড়, শীর্ণ দেহ কিন্তু চেহারাটা ভারী।

হুমায়ুন পাটোয়ারী ঢাকায় সিকান্দার আলী সরদারের লোহার কারখানায় কাজে লাগিয়ে দিয়ে এলেন হামজাকে। অত বড় প্রতিষ্ঠান, অত বড় নাম, বড় প্রাসাদের মতোন সরদার বাড়ি, বিশাল ক্ষমতা হামজার চোখে লাগল। তার চেয়ে কত ছোট রুদ্র ইয়াজিদ সরদারের রাজকীয় লালন-পালন সব সে দেখতে লাগল। রাজধানীর শীর্ষ ত্রাস পরিবার সরদার পরিবার। সেখানে থেকে হামজার ভেতরের সুপ্ত চাহিদার আসমান বাইরে আসার রাস্তা পেল। সে যে দুনিয়াকে জিততে জন্মেছে, তার খবর ও ঝলক বাইরে বেরিয়ে এলো রাজধানীর মাটিতে পা রেখে।

শাহানা বলে দিয়েছিলেন, তুই কী করবি জানি না। শুধু সংসারের খরচা চাই।

সে কী করবে তার পরোয়া নেই। শুধু তার কাছে সংসারের খরচ চায়। হামজা কী করবে? যা খুশি করতে পারে, কিন্তু সংসারের খরচ জোটাতে হবে, ব্যাস। সে ছিনতাই দিয়ে শুরু করল। এরপর তা থেকে ধরা পড়ার মাঝ দিয়ে গেল এক সন্ত্রাসের কাছে। সরদার পরিবারের দুশমন, প্রতিপক্ষ। এই গাদ্দারির অপরাধে তখন তাকে সরদর পরিবার খুঁজছে। কিছুদিন প্রাণ বাঁচিয়ে লুকিয়ে থেকে তার এক বছর লস গেল। কিন্তু পড়লেখা চালাতে হবে তাকে। তার জন্য পয়সা দরকার, অনেক।

এরপর সে বড়ভাইদেরকে পেলো। তৎকালীন সরকার-বিরোধী দলীয় বড় ভাই। যারা খুব সহজে শুধু মুখের সমর্থনের জন্য হামজার মতো পুঁচকে ছেলেদের পেছনে পয়সা খরচ করে। শুধু এটাই যে তখনকার সরকারী দলের প্রতি হামজার ক্ষোভের কারণ ছিল তাও না। জয়নাল কাকার কারাবাস, ফুপুর মৃত্যু, জয়ের বন্দিদশা সবের পেছনে ওদের লোকই! সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারী ওই দলেরই সমর্থকগোষ্ঠীর একজন। এটার একটা ভিত্তি আছে। ফরহাদ মহম্মদ বারী সাহেব বিরোধী দলীয় প্রধানের জুনিয়ত অফিসার। অনুরাগের সম্পর্ক। তাকে পেলে হামজা টুকরো টুকরো করে কেটে লোহার চুল্লিতে ঝলসাবে।

হামজা শান্ত-শিষ্ট ভাবনার ছেলে। সে বুঝে বুঝে কিছুদিনে এমন দু-একটা কিশোর বয়সের ঊর্ধ্বে যাওয়া কিছু কাজ করে ফেলল, যা বড়ভাইদের নজর কাড়তে যথেষ্ট ছিল। সে স্কুলে ভর্তি হলো আবার। বাড়িতে টুকটাক খরচা দিতে গেলে পড়া বা বিলাসিতা হয় না। এখন আর রোজ নিয়ম করে বাড়ি ফেরাও হয় না। রাস্তায় থাকার প্রবণতা ও প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। মানুষকে অমানুষ বানাতে রাস্তার অবদান অনেক। হামজার মানুষ সত্ত্বার বিদায়ক্ষণ চলছে।

একদিন শেষরাতে হামজা হাঁটতে হাঁটতে হাকিমপুর এলো। মাদ্রাসার চারধারে বাঁশের চ্যাগার। তা ডিঙিয়ে চড়তে গিয়ে বাঁশের ফাঁড়া অংশের আঘাতে ঠ্যাংয়ের মাংস ছিঁড়ে গেল। কলকল করে রক্ত বেরোচ্ছে। কপালের চামড়ি ছিলে গেছে।

সে জানে না জয়কে কোন বিভাগে রাখা হয়েছে। পেছনের পথ দিয়ে মাদ্রাসার সারি ধরা কক্ষগুলোর পেছনের দিকের জানালার দিকে পৌঁছাল।

চৌকিদারের হাতে ধরা পড়ল হামজা। সংগঠনের ছেলেরা সব বেরিয়ে এলো। হামজার নিশ্চুপতা প্রমাণ করল, সে কোনো বদ উদ্দেশ্যে অথবা কারও নির্দেশে মাদ্রাসা আঙিনায় অনিষ্ট করার লক্ষ্যে প্রবেশ করেছে। তাকে প্রায় আধঘন্টা যাবৎ জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, ‘সে কেন এই শেষরাতে এভাবে মাদ্রাসায় ঢুকেছে?ʼ

কতজনে কতরকম মধুর করে জিজ্ঞেস করল, তারা শুধু জানতে চায়, ‘কে এসেছে সে?ʼ

কোনো জবাব নেই। নিঃশ্বাসের শব্দও পাওয়া যায়নি হামজার কাছে। জয়কে ইশারায় বলে দিলো, “চুপ থাক। একদম চুপ। তুই চিনিস না আমাকে।ʼʼ

তার অনড়, অটল, স্থিরচিত্ত সবাইকে অবাক এবং ক্ষুব্ধ করল। কোনো ভালো উদ্দেশ্যেই যদি কিশোর ঢুকবে মাদ্রাসায় তাহলে বলতে বাঁধা থাকার কথা না। তাকে আঁটকে রাখা হলো। বেতের আঘাতে পরনের মলিন ফতোয়া ছিঁড়ে গেল। তবু কোনো কথা নেই। কিন্তু জয় সহ্য করতে পারছিল না। সে জানে বেতের আঘাত পিঠে সইতে কেমন লাগে। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমার ভাই। আমার সাথে দেখা করতে আসছে। আমারে মারেন, হুজুর। ছাড়েন হামজা ভাইরে।ʼ

সকলে অবাক হয়ে গেল। এবং এতে ক্ষোভটা বাড়ারই কথা, বাড়লও। মার এবং জিজ্ঞাসাবাদ কঠিন হয়ে উঠল। মাঠের প্রাঙ্গনে খাঁড়া গাছগুলোর মতোই অটল হামজা। চোখদুটো কথা বলে, ভয়ংকর তার নীরবতা। মাঝেমধ্যেই শীর্ণ পিঠটা বেঁকে আসছে। দেহের চামড়া ফেটে গেছে। ঝিমিয়ে এলো হামজার দেহটা। জয় বড় অবাক হয়েছিল। তার তো কেউ নেই। সে দুই বছরে খুব বুঝেছে এই জগৎটা তার কিন্তু সে জগতের কারও কেউ বা কিচ্ছু নয়। আজ হামজার এই নীরব আগ্রাসন অন্য বার্তা দিলো। এই বার্তা জয় আর ভোলেনি কখনও। তার জীবনে মৃত্যু, আঘাত ও হামজার জন্য যে অশেষ অনুরাগ ও নেশা জন্মেছিল, তা কাটেনি আর। তিনটা তার জীবনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেল। এই তিনটার যেকোনো একটার জন্য বাকি দুটো কবুল। হামজার জন্য মৃত্যু ও আঘাত, মৃত্যুর জন্য হামজা ও আঘাত, অথবা আঘাতের জন্য মৃত্যু ও হামজা সাদরে গ্রহণযোগ্য হলো জয়ের জন্য। এই তত্ত্বটা দিনদিন আরও তীব্র হয়েছিল। কারণ এখানেই শেষ হয়নি মৃত্যু, আঘাত ও হামজার উপস্থিতি তার জীবনে। যতদিন না মৃত্যু তাকে গ্রহণ করে সাথে নিচ্ছে ততদিন আঘাত ও হামজার সাথে তার বিচ্ছেদ নেই।

ফজরের নামাজের ওয়াক্তে সেলিম এলো মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে। সে খুবই অবাক এতটুকু কিশোরের এতখানি ধৃষ্টতা দেখে। সে খুবই হতাশ হয়ে বলল, “এইজন্যেই কইছিলাম আমিরের ব্যাটারে আমার হাতে তুলে দেয়া হোক। ফরহাদ ভাই ক্যান ওরে মানুষ বানাইবার বৃথা চেষ্টা করতেছে? আবার নিজেগোরে ধ্বংস করবার লাইগাই তো। একবার ওর চাচায় যা করছে তাতে দিল ভরে নাই। আল্লাহ কবে যে একটু সচেতন বানাইব ফরহাদ ভাইজানরে। হক মওলা, ইয়া খুদা তেরা ফরমান! শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা থেকে সবাইরে রক্ষা করেন মওলা!ʼʼ

হামজা চুল চিমটি মেরে ধরে সন্দেহিন স্বরে বললেন, “কার হুকুমে মাদ্রাসায় ঢুকছিস কইয়া ফেল তো, বাবা।ʼʼ সবার উদ্দেশ্যে বলল, “ওর ছোটকাকা কারাগার থেইকা ফেরোয়ার। এখন কতকিছু হইব, দেইখো আমি কইয়া রাখলাম। দেখো এইডারে জয়নাল পাঠাইছে কিনা! এই চেংরা কাম না সারতে পারলে আবার কোন আক্রমন করবো, তার ঠিক আছে?ʼʼ

জয় পুলকিত হয়ে উঠে হামজার দিকে তাকাল। কিন্তু বাকিরা আৎকে উঠল। আরও বেশি তৎপর হলো হামজাকে মেরে কথা বের করতে।

হামজা কথা বলল না। সেলিম কয়েকটা চড়-থাপ্পরও লাগালো। কিছু উস্কানিমূলক কথা বলে আরও দু একটা লাত্থি খাওয়ালো।

নামাজের পর আবার আলোচনায় বসা হবে। জয় এই ফাঁকে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “হামজা ভাই, এইখানে আইছো ক্যান? তুমি কেমনে জানলা আমি এইখানে?ʼʼ

হামজা হাসল। ঠোঁট ফেটে গেছে। হাসিটা কেমন যেন দেখতে লাগল। হেসে বলল, “শুনছি শেষরাতে তোদেরকে উঠায়ে তাহাজ্জুদ পড়ানো হয়, তাই না? ভাবছিলাম কলপাড়ে দাঁড়াব, তুই মখ ধুইতে আসলে দুইজন পালাবো। ব্যাড লাক।ʼʼ

জয়ও হাসল। হামজা অবাক হয়। এমন এক সময়ে জয়ের হাসিটা অস্বাভাবিক। কিন্তু সে হাসছে। সবে জয়ের বয়স মাত্র তখন কমবেশি নয়, দশ হয়নি। তাকে কে শিখিয়েছে এমন হাসি হাসতে? জয়কে জিজ্ঞেস করলে জয় বলতো, “বড়বাবা তত্ত্ব দিয়েছে, পরিস্থিতি সেটা প্রমাণ করে সূত্রে পরিণত করেছে।ʼʼ

হামজা জিজ্ঞেস করল না। জয় হেসে বলল, “তো এই কথাটা বললেই তো কম মারতো ওরা।ʼʼ

জয়ের ছোট্ট হাতটা চেপে ধরে হামজা উঠে বসে বলল, “সিক্রেট প্ল্যান বলে দিলে আবার নতুন প্লান বানাইতে হতো পরেরবার। আমি এই প্ল্যানেই তোকে আজাদ করব এইখান থেকে। জয় বাংলা!ʼʼ চোখ মারল হামজা।

জয় হেসে ফেলল, আস্তে করে বলল, “হু? জয় বাংলা? বলো, বলো জয় আমির।ʼʼ

কথা ফুরোয়নি। কিন্তু জয়কে টেনে মসজিদের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। হামজার কী হবে জানা নেই। হামজা আবার শুয়ে পড়ল মাটির ওপর। গা থেতলে গেছে, শরীরে জোর নেই, যন্ত্রণায় ভেঙে আসছে। জয় পেছন ফিরে একবার তাকাল। হামজা তাকিয়ে আছে তারই দিকে নিভু নিভু চোখে।

চলবে…

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭০. (বর্ধিতাংশ)

হামজার শরীরের চামড়ার নিচে রক্ত জমাটবদ্ধ হয়ে গেছে। নিচের পাটির একটা দাঁত নড়ে গেছে। মাড়ি থেকে রক্ত বের হবার ফলে গাল নোনতা লাগছিল।

সকাল আটটায় বৈঠক বসল। হামজাকে বড়হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, “যদি তুমি বলতে না পারো কেন এসেছ ওত রাতে মাদ্রাসার ভেতরে, কঠোর শাস্তি পাবে।ʼʼ

হামজা ভীতু স্বরে বলল, “আমি বলব। কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করবেন না।ʼʼ

-“মানে? বিশ্বাস কেন করব না?ʼʼ

-“আমি সত্যি বললে বিশ্বাস হবে না আপনাদের।ʼʼ

-“কেন?ʼʼ

হামজা চুপ করে রইল। এতে উপস্থিত জনতার ভেতরের কৌতূহল মাত্রা ছড়াল। উত্তেজিত হয়ে উঠল তারা। জয় ভ্রু কুঁচকে হামজাকে বোঝার চেষ্টা করে পারল না।

-“বলো দেখি। বলো। কেন ঢুকেছ ওত রাতে ওভাবে?ʼʼ

হামজা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সেলিমের দিকে ইশারা করে বলল, “উনি আমারে আসতে বলছিলেন।ʼʼ

সেলিম আকাশ থেকে পড়ল। তেড়ে এসে গলা চেপে ধরল হামজার। হামজা মিছেমিছি কেশে উঠল করুণভাবে। সবাই জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নিয়ে অবিশ্বাসী স্বরে বলল, “এই ছেলে, বুঝে বলতেছ তো কী বলতেছ? জানো ও কে?ʼʼ

অবুঝের মতো বলল হামজা, “কে?ʼʼ

-“ও মেজো সৈয়দ সাহেবের শালা। ধার্মিক মানুষ। তুমি তারে আজেবাজে কথা বললে আবার মার খাবা। বুঝে শুনে কও যা কইবা।ʼʼ

হামজা ভীতু নজরে দু’বার মাথা তুলে সেলিমকে দেখল। ভাবটা এমন যেন সে সেলিমকে ভীষণ ভয় পাচ্ছে, কথা বলতে পারছে না ভয়ে। সেলিম ছটফট করছিল। বড়হুজুর অভয় দিলেন, “যাইহোক! বলু ক্যান আসতে কইছিল তোমারে? জয়ের সাথে দেখা করবার জন্য?ʼʼ

-“হ্যাঁ।….না।ʼʼ

-“কী বলতেছ?ʼʼ

-“মানে হ্যাঁ। এইটাও একটা কারণ। কিন্তু আরেকটা কারণ আছে।ʼʼ

-“সেটা কী?ʼʼ

এবার আরও ভয় ফুটে উঠল হামজার মুখে। সে ভীতু নজর তুলে সেলিমকে দেখছিল বারবার, আর আতঙ্কিত হয়ে চোখ নত করছিল। সেলিম রাগে দিশেহারা হয়ে তেড়ে এলো আবারও, “খচ্চরের বাচ্চা! ইবলিস। কী বলতে চাইতেছিস? মিথ্যা কথা কইলে জবান টাইনা ছিইড়া আনমু, হারামীর বাচ্চা। আল্লাহর গজব পড়বো তোর উপর।ʼʼ

সবাই সেলিমের আচরণে ভ্রুকটি করল। তার আচরণ আর হামজার কথা ও অঙ্গভঙ্গি অনুযায়ী আসলেই তাকে সন্দেহজনক লাগছিল। হামজা ভয়ে আরও সিটিয়ে গেল।

সবাই এবার তেঁড়ছা নজরে একবার সেলিম ফারুকীকে দেখে হামজাকে পুরোদমে অভয় দিলো। বড় হুজুর বললেন, “তুমি বলো, ছেলে। সেলিম খবরদার আর কোনো লাফালাফি করবা না। ওরে কথা কইতে দাও। এ কী অসভ্য আচরণ। ওরে কথা বলতে দিচ্ছ না কেন?ʼʼ

সেলিম দিশেহারা হয়ে উঠল,“বিশ্বাস করেন হুজুর, এই ইবলিসের বাচ্চা মিথ্যা কথা বলতেছে। আমি ওরে আজকের আগে খুদার কসম দেহিই নাই।ʼʼ

-“সেলিম! ও এখনও কিছু বলেইনি। তুমি নিজেই বেশি বেশি করছো। তাইলে কি ধরেই নেব, ও সত্যি কথা বলতেছে? সত্য মিথ্যা যাচাই আপনা-আপনিই হবে। তার আগে তুমি শান্ত থাকো দেখি।ʼʼ

সেলিম থমকে গেল। বড়হুজুর হামজাকে বললেন, “তুমি বলো।ʼʼ

হামজা আবারও ভয়ে ভয়ে তাকাল সেলিমের দিকে। বড় হুজুর এবার একটা ধমক দিলেন, “বললাম না ও কিছু করবে না তোমার। ভয় নেই কোনো। যা সত্যি নির্ভয়ে বলো। আমি আছি না!ʼʼ

হামজা ততক্ষণে সফল পুরো উপস্থিত জনতাকে কাবু করে ফেলতে। এবার সে বলল, “মাদ্রাসায় আগুন দেবার জন্য বলছিল আমায়। বলছিল রাতে যেন আসি আমি।ʼʼ

এবার আর সেলিমকে ঠেকানো গেল না। উড়ে এসে এক ঘুষি মারল হামজার চোয়ালে। ব্যথা ঠিকই পেল হামজা, মাড়ি থেতলে গেল। কিন্তু তার কিশোর শরীরটা পড়ে যাবার কথা না। কিন্তু হামজা খুবই অসহায় ভঙ্গিতে ইচ্ছাকৃতভাবে মাটিতে পড়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠল।

উপস্থিত জনতা এবার পুরোদমে সেলিমের হাতছাড়া হলো। ক্ষুব্ধ চোখে বড় হুজুর সাহেব একবার সেলিমকে দেখে হামজাকে নিজে হাতে তুলে বসিয়ে দ্বিগুন উৎসাহ ও উত্তেজনার সাথে তাড়া দিলেন, বল তো আব্বা! কী বলতেছিলি? সেলিম মাদ্রাসায় আগুন দিতে চায়? কিন্তু কেন? মিথ্যা বলা মহাপাপ, গুনাহ। তুমি মিথ্যা কথা বলতেছ না তো! তোমারে কেমনে চেনে সেলিম? মানে বুঝায়ে বলো তো!

-“আমি সত্যি বললে আপনারা আমায় মারবেন না তো আবার?ʼʼ

এমন করুণ করে বলল হামজা, সবাই অনুশোচনায় ফেটে পড়ল। একটা পনেরো বছরের কিশোরকে তারা কী নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে সব না শুনে।

বড় হুজুর বললেন, “আমি তখন ছিলাম না। এখন আছি। তোমার কোনো ভয় নেই। যা সত্যি সব বলবে। সত্য বললে মারবে মানে? সেটা যত তিতাই হোক। আর মারব না। আমি থাকলে তখনও এই জাহিলগুলো তোমার গায়ে হাত তোলার সুযোগ পাইতো না। এদের মধ্যে ধর্মীয় কোনো চেতনাই নাই। সবগুলা জানোয়ার হয়ে গেছে। বলো তুমি।ʼʼ

হামজা সুন্দর একটা গল্প বলল। প্রথম কথাটা একটু ইতস্তত করে বলল, “আমি বড়ভাইদের কাছে থাকি।ʼʼ

সবাই বুঝল, বড়ভাই কারা। হামজা সেলিমকে নির্দেশ করে বলল, “তো উনি সেইখানে যাতায়াত করে।ʼʼ

সবার চোখ বিস্ফরিত হয় সেলিমের বিশ্বাসঘাতকতায়। সেলিম এবার আর এসে হামজাকে আঘাত করাল সুযোগ পায় না। দুজন যুবক চেপে ধরল সেলিমকে।

হামজা বলল, “ওইখান থেকে আমি তার কাছে জানতে পারি জয় মানে আমার ফুপাতো ভাই এইখানে থাকে। আমি খালি উনার কাছে জয়ের সাথে দেখা করানোর কথা বলছিলাম। এরপরে উনি শর্ত দিছেন আমি যাতে উনারে হেল্প করি।ʼʼ

সবাই বুঝেও আবার জিজ্ঞেস করল, “কীসের হেল্প?ʼʼ

হামজা খুব লজ্জিত ভঙ্গিতে, ইতস্তত করে বলল, “মাদ্রাসায় আ’গুন দিতে…ʼʼ

চারপাশ নীরব হয়ে উঠল। সেলিম চেঁচিয়ে যাচ্ছে। হামজার চোখে-মুখে তীব্র ভয় ও লজ্জা। সেলিমের চেঁচানো কাউকে স্পর্শ করছে না। তাদের চোখের সামনে ভাসছে একটু আগে হামজার সাথে করা সেলিমের আচরণ। অবিশ্বাসের জায়গা রাখেনি হামজা।

সবাই যেন বুঝেও অবুঝ হলো। জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কেন মাদ্রাসায় আ’গুন দিতে চায়?ʼʼ

-“আমিও জিগাইছিলাম। কিন্তু বলে নাই আমারে। শুধু বলছে, দরকার।ʼʼ

সেলিম পাগল ষাঁড়ের মতো গর্জন করছিল। কিন্তু ততক্ষণে সবার সব হিসেব মিলে গেছে। সেলিমের সাথে মাদ্রাসার সবার এক প্রকার দ্বন্দ্ব অবশ্যই আছে। সে মাজার পূজারী, বাবার মুরীদ। তার সাথে প্রতিটা হুজুর ও সংগঠনের ছেলেদের তর্কা-তর্কী ও বিরোধের সম্পর্ক। সেলিম তাতে খুব উৎসাহী। যেচে পড়ে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে গিয়ে তসবীহ জপতে জপতে বাবার গুনগান এবং তর্কে জড়ানো তার স্বভাব। সবাই শুধু তাকে অনিচ্ছাকৃত সহ্য করে মেজো সৈয়দের শালা বলে। তার গলার তাবিজ, হাতের বালা, আংটি কারও চোখেই ভালো দেখায় না। সবাই এড়িয়ে চলতে চায়। কিন্তু সেলিমের সেসব গায়ে লাগে না। সে তিনবেলা ঘুরঘুর করে মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে।

এবং হামজার বলা–বড়ভাইদের সাথে লেওয়াজের ব্যাপারটাও বিশ্বাসযোগ্য হলো। কারণ সেলিমের কাছে মাদ্রাসার কার্যক্রম বিরোধী কর্মকাণ্ড, এটা সবাই জানে। আজ আরও জানল হামজার বদৌলতে, সে জামায়াত বিরোধীদের দোসর।

হামজার কাছে ক্ষমা চাইলেন বড় হুজুর। সেলিমকে সংগঠনের ছেলেরা ধরে কী করতো জানা নেই, কিন্তু বড় হুজুর ঘৃণা ভরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আঙুলের ইশারা করে তেড়ে দিলেন সেলিমকে। এক বিন্দু সাফাই গাইবার সুযোগ সেলিম পেলো না। সে সাফাই গাইবার জন্য ওখানে থাকলে বড় হুজুরকে টপকেই যুবকেরা সেলিমের হাল বেহাল করে ছাড়তো।

তার প্রায় সপ্তাহখানেক পর দেশপ্রেমিকগোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে মাঝরাতে মাদ্রাসার একাংশে আগুন দিলো হামজা। তার এখানে সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। সে জয়কে উদ্ধার করতে এসেছে। কিছু ছাত্র আহতের ঘটনাও এড়ালো না। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি এভাবেই হওয়া উচিত বটে। হয়ও এভাবেই।

সবাই যখন ছত্রভঙ্গ আকস্মিক হামলায়, তার মাঝে হামজা জয়কে নিয়ে জঙ্গল দিয়ে সীমানা পার। কিন্তু রাতের বেশিক্ষণ নেই। পায়ে হেঁটে হাকিমপুর পার হওয়া অসম্ভব অন্ধকার থাকতে থাকতে। হামজা নিজের ওপর অ’গ্নিকাণ্ডের দায় নেবে না। তা বড়ভাইদের বাহাদুরীর খাতায় উঠে থাক। জয় সেদিন নির্দিধার প্রতিশ্রুতি করেছিল হামজার খাতিরে জীবনটা উৎসর্গ করতে।

তিন বছরের অমানুষিক কারাবন্দি অবস্থা, এতিম-অসহায়ত্ব এবং আপনজনহীনতা থেকে মুক্তির অগ্রদূত হামজা জয়ের ছোট্ট কঠোর বুকটার গোটাটা দখলে নিলো।

দু’দিন পলায়নরত অবস্থায় আড়ালে চলে চলে দুজন শেষমেষ ঘোড়াহাট আমির বাড়িতে পৌঁছাল। আমির বাড়ি ততদিনে মালিকানাহীন বেওয়ারিস সম্পত্তি। অঞ্চলের সবাই জানে গোটা আমির পরিবার মিটে গেছে। জয়নাল আমির ফেরোয়ার আসামি। তার আর ভিটেতে ফেরার প্রশ্ন ওঠে না।

জয়কে ঠেলেও আমির নিবাসের ভেতরে ঢোকাতে পেরেছিল না হামজা। হামজা বুঝেছিল, জয়ের মস্তিষ্কটা মারাত্মকভাবে আহত তিন বছর আগের এই বাড়ির সেই অবরুদ্ধ নিশীথের প্রভাবে।

ঘোড়াহাঁট থেকে বাঁশের হাঁট নেহাত কম পথ নয়। তাদের কাছে পয়সা নেই। হেঁটেই চলতে হবে। পথে খিদের জ্বালায় জয়ের হাঁটু ভেঙে আসতে চায়। হামজা এক কাজ করল। গায়ের মলিন ফতোয়াটা খুলে খালি গা হয়ে ফতোয়াটা মুখে বেঁধে লোকালয়ে গেল। বাজারের শেষে এক জীর্ণ হোটেলের দুটো পরোটা খাবলা ধরে নিয়ে ঝেরে দৌড়। বুড়ো হোটেল মালিক দুটো পরোটার জন্য রোদের ভেতর খুব বেশিদূর ছুটলো না দুই কিশোরের পেছনে। কয়েকটা গালি দিয়ে ফিরে চলে গেল

কিন্তু হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে আসার সময় হাতের একটা পরোটা পড়ে গেল, কিন্তু তা তুলতে দাঁড়ানোর সময় নেই। বাকিটা জয়কে দিয়ে হামজা বলল, “খা।ʼʼ

-“তুমিও। জয় অর্ধেক ছিঁড়ে দেয়।ʼʼ

একটা ধমক মারল হামজা, “ভালোমানুষ সাজতে আসবি না, জয়। খা চুপচাপ। একটা পরোটাতে দু’দিনের খিদে মেটে না। আর তো অর্ধেক! পেট জ্বলবে। খা তুই।ʼʼ

জয় ঘাড় ঘুরিয়ে গভীর চোখে তাকায়,“তুমিও তো না খাওয়া, হামজা ভাই!ʼʼ

হামজা বলল, “আমি রোজা রাখছি।ʼʼ

জয়ের মনে পড়ল। মুস্তাকিন কয়দিন যাবৎ সারাদিন কিচ্ছু খাচ্ছিল না। সন্ধ্যার পর খেতো। জয় একা সকাল, দুপুরে খাবার খেতে চাইতো বলে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসিও করেছে। তবু সে খেয়েছে। ক্ষুধা পেলে খেতে হবে। জোর করে হলেও। চুপ থাকলে কেউ খেতে দেয় না। ছিনিয়ে নিলে সব পাওয়া যায়। আজও হামজা তা প্রমাণ করেছে। হাতের পরোটা সেই কথাই বলছে।

কিন্তু জয় সেদিন না বুঝলেও পরে আরেকটা কথা বুঝেছিল, দু’দিন একভাবে না খেয়ে রোজা হয় না। সেহরি, ইফতার কিছুই নেই, তবু হামজা যে কেন সেদিন রোজা রেখেছিল! এই জটিল, রহস্যজনক হামজার এসব রহস্যজনক ঋণ জয় চুকাবে কী দিয়ে? আছে একটা উপায়। নিজেকে দিয়ে। হামজা যা বলে, যা করে সবটা বিনা দ্বিধায় মেনে নিয়ে।

হামজা জয়কে স্কুলে ভর্তি করল। জয় ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় তার জীবন ঘড়ি আবর্তনের দিক বদলেছে। হামজা জয়কে সিক্সে ভর্তি করল। জয়ের নাদুস-নুদুস অভিজাত চেহারাখানা আজ শীর্ণ, রোদে পোড়া, মার খেয়ে জখম হওয়া, অযত্নে ছাই। শাল কাঠের ডাইনিং টেবিলে বসে নবাবী খানাপিনা সারা জয় আজ দিব্যি শুকনো মরিচ মাখা ও লবণ দিয়ে স্টিলের থালায় গপাগপ এক থালা ভাত খেয়ে উঠতে পারে।

হামজার সাধ্য অল্প। চাঁদাবাজিতে ভাইদের সঙ্গ দিলে কিছু জোটে। কিন্তু রোজ যাওয়ার সৌভাগ্য মেলে না। তার মতো পুঁচকেকে বড়ভাইদের দরকার পড়ে না। হুমায়ুন জয়কে নিয়ে বড় তেতো-বিরক্ত। শাহানা পারলে জয়কে মেরে ফেলে কোনো এক রাতে। কিন্তু হামজা মাকে খুব কার্যকর একটা আগ্রহ দিলো।

জয় আমির বাড়ির সম্পত্তির একমাত্র হকদার। রক্ত মুছে যায় না। আজ না হোক, আগামীতে ওই সম্পত্তি জয়ের। সোজাভাবে না হোক, হামজা যে বাকাঁ পথে পা রেখেছে সেই পথে জমির দখলদারী পরিচিত ঘটনা। সম্পত্তি জয়ের, আর জয় ওদের। ইজ ইক্যুয়েল– সম্পত্তি তাদের। শাহানার চোখ খুলে গেল। জয় খুব বেশি না হলেও তুলনামূলক কদর পেতে থাকল।

কিন্তু অর্থাভাবে সোনার ডিম দেয়া হাসের যত্নও ঠিকমতো করার উপায় নেই। নিজেদের পেট চলে না!

জয় একবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি অও রিস্ক নিয়ে আমারে বাচাইছিলা ক্যান?ʼʼ

-“তোর মায়ের বহুত অবদান আছে আমার উপর।ʼʼ

-“শুধু এই জন্যেই?ʼʼ

-“আর কী শুনতে চাস?ʼʼ

জয় কথা বলল না।

হামজা হাসল, “কী? শুনতে চাস যে আমি তোকে খুব ভালোবাসি, এইজন্য ওই নরক থেকে উদ্ধার করছি তোরে?ʼʼ
জয় কথা বলল না।

-“শোন জয়! তোর কেউ নেই। আমিও না। কী বললাম বল তো।ʼʼ

-“আমার কেউ নাই।ʼʼ

-“তোর কোথাও কেউ নেই।ʼʼ

-“হ, তুমিও নেই।ʼʼ

-“হ্যাঁ। নিজেকে ভুললেও এটা ভুলবি না। তোর কেউ নেই। তুই একা। কিন্তু, কিন্তু তোকে বাঁচতে হবে। কীভাবে তা তুই ঠিক করবি। কী করে কী করবি, তা তুই ঠিক করবি চলার পথে। শুধু জানিস তোকে বাঁচতেই হবে, এবং ভালোভাবে রাজার হালে বাঁচতে হবে। বাঁচার জন্য যা দরকার, তা হাসিল করতে যা লাগে তা ভিতরে সঞ্চয় করতে হবে।ʼʼ

-“সেটা কী?ʼʼ

হামজা জয়ের কানের কাছে মুখ এনে বলল, “পাগলাটে জেদ, হৃদয়হীন হাসি আর ক্ষমতা অর্জনের নেশা।ʼʼ

জয়ের মনে পড়ল, বড়বাবাও এসবই বলতো।

-“তোকে আরেকটা কারণে এনেছি।ʼʼ

জয় আগ্রহ ভরে তাকাল। হামজা বলল, “আমার সঙ্গি দরকার ছিল। আমার তোকে দরকার ছিল, জয়।ʼʼ

-“কীসের সঙ্গি? কেমন সঙ্গি, হামজা ভাই?ʼʼ

হামজা কথা বলল না। জয়ের গায়ের গেঞ্জিটা খুলে নিয়ে বলল, “চল আজ তোকে সাতার শেখাবো।ʼʼ

পুকুরে নেমে জয়কে গোসল করিয়ে দিলো হামজা। সাবান মাখিয়ে, গা পরিষ্কার করে গোসল করিয়ে ঘঁষে ঘঁষে মাথাটা মুছে দিলো। মাথা ভেজা থাকলে জ্বর আসবে।

দুপুরে বাসায় ভাত নেই। জয়কে নিয়ে এক জায়গায় গেল। পথে হাটতে হাঁটতে বলল, “খিদে পেয়েছে তোর?ʼʼ

-“খুব।ʼʼ

-“চল। আজ যা খাবি, মনে থাকবে। তো রেডি?ʼʼ

দুজন হো হো করে হেসে উঠল। হামজা আজকাল প্রায়ই এমন সব ব্যবস্থা করে। কী যেন করে হামজা, জয় বুঝেও বোঝে না।

হামজার এক বড় ভাই। হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্র পলাশ আজগর। জয়কে অনেকক্ষণ পরখ করে দেখেছিল পলাশ। সেদিন জয় প্রথম দেখল পলাশকে। পলাশ ওদেরকে দুপুরে ভুরিভোজ করালো। দু’দিন পর হিলি বন্দর দিয়ে পলাশের মাল আসছে বিদেশ থেকে। হামজাকে পলাশের লোকদের সাথে যেতে হবে। রাজন আজগরের বিশাল ব্যবসা।

হামজা জয়কে সাথে নিলো না। তার পরীক্ষা। ধমকে পড়তে বসিয়ে রেখে নিজে গেল। এবং সেবার ফেরার পর হামজা ব্যাগ ভরে বাজার করে এনেছিল। মাছ-মাংসও এসেছিল বাড়িতে। হামজা সফল হয়ে ফিরেছে। তাদেরকে পুলিশ ধরতে পারেনি।

জয়কে বেরোতে দেয় না হামজা বাড়ি থেকে খুব বেশি। সেলিম ক্ষ্যাপা ষাঁড়। হামজা তার সাথে যা করেছে, তাতে সে জয়কে কেটে খেতে খুব ক্ষুধার্ত। হামজা নিজেকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে, জয়ের প্রশিক্ষণ বাকি। হামজা তা দিচ্ছে ধীরে ধীরে।

একবার বাড়িতে একটা পুঁচকে এলো। তুলির চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট। জয়ের রাগে গা জ্বলে গেল। তাদের দুটো ঘর। একাটাতে মামা-মামি থাকে। আরেকটাতে ছোট্ট চৌকি। সেটায় তিনজন শোবার জায়গা হয় না। তাছাড়া হামজা দিনদিন আরও লম্বা ও তরতাজা হচ্ছের পূর্ণ যুবক হয়ে উঠছে। জয়ের কিশোর বয়স। তুলিও বড় হয়ে গেছে। এর মাঝে আরেকটা পুঁচকে মেয়ে এসে জুটল।

জয় বাড়ির পেছনে ডেকে নিয়ে গিয়ে ঝুঁটি করা চুল ধরে মোট গুণে গুণে পনেরোটা চিমটি মারল। হুমকি দিলো, যদি না চলে যায় তাহলে তুলে এক আঁছাড় মেরে পেটের নাড়ি বের করে আনবে।

মার খেয়ে পুঁচকে মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগল। বিপত্তি বাঁধল। মেয়েটা মামির বোনের মেয়ে। এত বিশ্রী করে গাল ফেঁড়ে কে কাঁদে? আবার কাদার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়ছে। মুশকিলে পড়ল জয়। আবার একটু মায়াও লাগছে। নরম গায়ে চিমটির আঘাতে লাল টকটকে হয়ে নখ বসে আছে। তার কাছে কিছু টাকা আছে। দৌড়ে গিয়ে দুটো হজমি টেস্টির পাতা, বড়ইয়ের আচার আর দুটো ললিপপ এনে হাতে গুজে দিলো।

-“চুপ কর এই চেংরি চুপ। চিমটি তো মারছিই। এখন কাঁদলে কি চিমটির দাগ মিলে যাবে নাকি আমি আর পরে মারব না এমন বলেছি? খা, চকলেট খা। তোর জন্যে আমার কত ট্যাকা গচ্চা গেল। এবার কাঁদলে পানিতে ডুবিয়ে মারব।ʼʼ

মেয়েটা ভয়ে কাঁদছে কিন্তু শব্দ করছে না। জয় ঠাস করে থাপ্পর মেরে চলে এলো চকলেট গুলো কেড়ে নিয়ে। উঠোনের এককোণে বসে সবগুলো খেলো চেটেপুটে।

কিন্তু হামজা একটা অপ্রিয় কাজ করল। সেই পুচকেটাকেও স্কুলে ভর্তি করে দিলো। এবং তাকে আনা নেয়ার ভার জয়ের। সে জয়ের স্কুলেই পড়ে। সুতরাং জয়ের সাথে যাবে-আসবে। তুলি ঘাড়ত্যাড়া, খিটখিটে। তার বান্ধবী এক পাল। তাদের সাথে নাচতে নাচতে সে স্কুলে আসে যায়।

কিন্তু জয় পারলে পুঁচকেকে খেয়ে ফেলে। রাস্তায় চলার সময় এত পকপক করে কান খায়! জয় ঠুকঠাক লাগিয়েও দেয়, একটু কাঁদে আবার শুরু করে। মহা মুসিবত! পুঁচকের নাম তরুনীধি। অত বড় নাম কেউ ডাকে না, সবাই ডাকে তরু।

জয় জীবনে সপ্তাহে চারদিন স্কুলে যায় না, বড়জোর তিনদিন। রোজ রোজ এক জায়গায় যাওয়াটা কোনো ভালো কথা না। মাঝে একটু গ্যাপ দিয়ে গেলে আলাদা কথা।

স্কুল থেকে ফেরার পথে বেশি লাফালাফি করে রাস্তার মাঝখানে যাওয়া জয় পিঠের ওপর দুম দুম করে দুটো কিল মারল। বকলোও কয়েকটা। পথে খৈ ওয়ালাকে পেল। তরু নাক টানছে আর বারবার তাকাচ্ছে খৈ-য়ের দিকে। জয় তা লক্ষ করে ভ্রু কুঁচকে। গম্ভীর মুখে গিয়ে খৈ কিনে এনে হাতে দিলো তরুর। তরু সব ভুলে গেছে, চোখ-টোখ হাতের পিঠে মুছে তাড়াহুড়ো করে খৈ খুলছে। তা দেখে হাসি পেল জয়ের। তরুর নাক টানতে টানতে খৈ খাওয়া আড়চোখে দেখল।

পথটা সরু। পিচ উঠে উঠে গেছে। সেই রাস্তায় গাড়ির চলাচল নেই-ই প্রায়। সেই রাস্তায় আচমকা কোত্থেকে যেন একটা পটপটে আওয়াজ তোলা ইয়ামাহা বাইক এসে তাদের ছুয়ে যায়। জয় এক লহমা তরুর হাতের কব্জি ধরে নিজের পেছনে আড়াল করে মাটির ওপর ছুঁড়ে মারল। কিন্তু বাইক জয়কে ছিটকে ফেলে দিয়ে চলে যায়। জয়ের পাতলা দেহটা গিয়ে মাটির রাস্তার ওপর পড়ে

মাথার পেছনটা শক্ত ইটের খোয়াতে লাগায় ঘাড় বেয়ে তরতর করে রক্ত বেরিয়ে এলো। বাইকটা পাশ দিয়ে একাংশ ধাক্কা মারতে সক্ষম হয়েছে জয়ের তাৎক্ষণিক সচেতনতায়। নয়ত সেদিন বাইকওয়ালার উদ্দেশ্য সফল হয়ে যেত।

জয়ের আসল জখম ডাক্তার জানালেন। বাম পায়ের হাঁটুর অস্থি-সন্ধি খুলে গেছে। আর একটু হলে জোড়া লাগানোর উপায় থাকতো না। অথচ জয়ের বর্ণনা মতে তার কিছুই হয়নি। সে অধচেতন পড়ে রইল নিভু চোখে। মৃত্যু এসেছিল। জয়কে পরম যত্নে ছুঁয়ে গেল। এই তো জয় ঝাপসা চোখে আবার মৃত্যুর স্পর্শ পেল। অথচ মৃত্যু সেদিনও জয়ের সাথে ছলনা করে ছুঁয়েই পালালো। সঙ্গে নিলো না।

ব্যন্ডেজ করার আগে জয়ের পায়ের হাড্ডি সোজা করতে যখন চাপ দেয়া হলো জয় গা শিউরে ওঠা স্বরে ‘মা গোʼ বলে একবার চিৎকার মেরে অজ্ঞান হয়ে গেল। সেদিন সেই পুঁচকে মেয়ে কী কান্নাটাই কেঁদেছিল! লুটিয়ে পড়া কান্না। তার নিজের হাঁটুর মাংস ছিলে গেছে, তার ব্যথা তরু টের পাচ্ছিল না। চিৎকারটা জয়ের নয় তার নিজের। বড় ভয় পেয়েছে মেয়েটা।

কিশোর জয়ের শরীরটা প্রায় ব্যান্ডেজে মুড়ে গেল। রাত এলে অসহনীয় যন্ত্রণায় তার কাতর আর্তনাদে সবার ঘুম হারাম। তবু সবাই ঘুমায়। কিন্তু পুঁচকেটা জয়ের সাথে রাত জাগে। জয় ধমকায়, কখনও ঠুকঠাক মারেও। তবু বসে থাকে। ব্যথায় জয়ের শরীরে জ্বর আসে। তরু বিশাল টিনের বালতি ভরে একা পানি আনতে পারে না। ভয়ে ভয়ে গিয়ে হামজাকে ডাকে। হামজা পানির বালতি ভরে এনে দেয়। তরু সারারাত জয়ের মাথায় পানি ঢালে। হামজা বসে বসে দেখে।

হামজা আন্দাজ করেছিল, এরপর জয় একগাল হেসে জানালো, “বাবরি চুল দেখছি বাইকওয়ালার। বহুত খাস লোক সে আমার, হামজা ভাই। চিনতে ভুল হয় নাই। আল্লাহর বান্দা পরহেজগার সেলিম ফারুকী!ʼʼ

হামজা হাসল, “ধরব ধরব। একদিন ধরব, সেদিন খুব ছটফটাবে পাখি।ʼʼ

-“আজ ধরবা না?ʼʼ

-“ধরি মাছ না ছুঁই পানি। বাংলা বইয়ে পাবি এই প্রবাদ।ʼʼ

জয় তাকিয়ে রইল। হামজা বলল, “একটু শক্তিশালী না হয়ে ধরলে মনের খায়েশ মিটিয়ে নিতে পারা যাবে না। আমার ফুপুটা অকারণে বলি হয়নি জয়। ওদেরকে ধরে একটু তৃপ্তি সহকারে গিলবো বলেই তো ফুপুর এতবড় বলিদান। কাউকে গিলে তৃপ্তি না পেলে মারাটা বৃথা। কারণ মারাটা বড় কথা না, মনের অপূর্ণ তৃপ্তি মেটানো হলো কথা।
তুই অপেক্ষা কর জয়। এই যে তুই আরেকটু ব্যথা শুষলি, এতে ওর ব্যথার ভাগের সুদ আরেকটু বাড়ল।ʼʼ

মন্ত্রপুতের মতো বলল জয়, “কবে? কবে খাবে?ʼʼ

-“যেদিন সাপ মারব কিন্তু লাঠি ভাঙবে না। পরিস্থিতি আরেকটু নিয়ন্ত্রণে আসুক। সৈয়দ বাড়ির সাথে আমার দুশমনীর খবর সৈয়দ বাড়ি এত তাড়াতাড়ি পাবে না। বহুত কিছু হারানোর পর আমাকে টের পাবে। তুই আরেকটু অপেক্ষা কর। আর একটু!ʼʼ

জয়নাল আমির ফেরোয়ার হয়েছেন পাঁচ বছর খানেক। এর মাঝে জয় বহুবার বড়বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পায়নি। কিন্তু কিছুদিন আগে সে জানতে পেরেছে বড়বাবার একটা সন্তান হয়েছে। ছেলে সন্তান। জয়ের খুব হিংসে হলো। এখন কি বড়বাবার ভালোবাসা ভাগ হয়ে গেছে? এত বছর পরও যদি বড়বাবার সাথে জয়ের দেখা হয়, বড়বাবা পনেরো বছরের কিশোর জয়কে চিনবে? আগের মতো বুকের সাথে জড়িয়ে চেপে ধরবে? আচ্ছা বড়বাবা নিজের ছেলেকে কি জয়ের মতো করে ভালোবাসে?

জয়ের ভেতরটা যে পুলক ও শিহরণে তিরতির করছে তা জয় বুঝল না। লোকে তাকে জারজ বলে, নির্বংশ, লেজকাটা বলে। জয় কবে বড়বাবাকে মুক্ত করে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বুকে হাত রেখে বলবে, আমির পরিবার নির্বংশ হয়নি, হবে না। দেখ জয়নাল আমিরকে। দেখ জয়নাল আমিরের পুত্র জিন্নাহ আমিরকে, দেখ আমি, আমাকে। আমি, আমি জাভেদ আমিরের পুত্র জয় আমির। এখনও জীবিত। আমির বংশের জ্বালতে থাকা কয়টা বাতি চাস? দেখ এখনও তিনটে জীবিত!

এসব ভেবে জয়ের ভেতরে বড়বাবার সেই ছোট্ট সন্তান, আমিরদের বংশধর বাচ্চা জিন্নাহর জন্যও তার বুকের কোথাও আলোড়ন ওঠে।

জয় পাগল হয়ে উঠল বড়বাবাকে খুঁজতে। কিন্তু খুব সাবধানভাবে। বড়বাবা ফেরোয়ার, মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। তাকে ক্রস ফায়ারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

কিন্তু জয় সুযোগ পেল। সেই সুযোগ রাজন আজগর করে দিলো। কারণ রাজন আজগরের দাদা বৃদ্ধ হবার পরেও তার নামে মামলা, যুদ্ধের লুটপাট ইত্যাদিন মামলা অসংখ্য। বাংলাদেশ গঠনের পর ত্রাস গড়তে প্রথম প্রজন্মের সন্ত্রাস সে।

২০০২ সন। অপারেশন ক্লিনহার্ট এক্টিভ পুরোদেশে। বাদ যাচ্ছে না সেনাবাহিনীর কবল থেকে একটি অপরাধীও। তাদের মারফতে জয়নাল আমির পলাশদের মদদে জয়ের সঙ্গে দেখা করবেন। জয় খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলো। তার বড়বাবাকে সে কমবেশি আট বছর পর দেখবে।

কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম ঘটল। পলাশ আজগরের দাদা বন্দি হলো। আর জয়নাল আমির ক্রস ফায়ারড। সংবাদটা এমন সাবলীলভাবেই জয়ের কানে এসেছিল। এবং আরেকটা সংবাদ খুবই চমকপ্রদ ছিল। সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারীর নিক্ষেপিত গুলিতে প্রাণ গেছে মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল জয়নাল আমিররে।

জয়ের বয়স তখন পনেরো। সন ২০০২। জয়নাল আমিরের মৃত্যর ঠিক নয়দিন পর জয় নিজে হাতে সৈয়দ ফরহাদ মহম্মদ বারী সাহেবের খু-ন করে ফেলল। বুক চিড়ে হাত ঢুকিয়ে হৃদযন্ত্র টেনে ছিঁড়ে এনেছিল। সেটাকে ছুরি দিয়ে কেটে কয়েক টুকরো করে মৃতদেহের পাশে রেখে এসেছিল।

চলবে…

একবারও রিচেইক করিনি। টাইপিং মিসটেকসহ অসংখ্য ভুলত্রুটি থাকতে পারে। ক্ষমা করবেন। ]