অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব-৭১+৭২+৭৩

0
100

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭১.

ফজরের আজান পড়ছে কোথাও বা। কিন্তু বড়ঘরে শব্দ, আলো, বাতাস প্রবেশ নিষেধ। দেয়াল পুরু, মেঝে সমতল থেকেও বেশ কয়েক ফুট নিচে।

মুরসালীন শরীরের ব্যথায় ঝিমিয়ে বসল। জয় থেমে গেছে, তার গল্প বোধহয় শেষ! সে ক্লান্ত হলেও খুশি। তার একটা কারণ আছে। সে যতবার ফরহাদ মুহাম্মাদ বারীকে মারার বিষয়টা মনে করে, সে ভীষণ খুশি অনুভব করে। এইমাত্র সেই কথাটা বলার ফলে ভেতরে খুব খুশি অনুভূত হচ্ছে।

একবার রূপকথা বলেছিল, ‘অন্তূ! যতদিন তুমি জীবিত আছো, কোনো অভিজ্ঞতাকেই চূড়ান্ত ভাববে না। মৃত্যু মুহুর্তেও তোমার চিরস্থায়ী একটি ধারণা ভেঙে যেতে পারে।ʼ

কথাটা ভুল নয়। অন্তূ আজ গল্প শুনতে শুনতে উপলব্ধি করেছে বিষয়টা। সে জানতো সে চিরতরে আবেগহীন হয়ে পড়ছে। কিন্তু আজ তার বিপরীতে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটেছে।

জয় যতক্ষণ কথা বলেছে, জয়ের দৃষ্টি আঁটকে ছিল ঢালাই মেঝেতে। জয় আমির একটাবারও যদি অন্তূর দিকে তাকাতো, দেখে ফেলতো, অন্তূ আজও কাঁদে। অন্তূ যে হাতে ঘন্টা কয়েক আগে আগ্নেয়াস্ত্র চালিয়েছে, জয়েদের গল্প শোনার সময় আজ অন্তূর সেই হাতদুটোও শরীরের সাথে থরথরিয়ে কেঁপেছে, চোখ লাল হয়ে তারপর ভিজেও উঠেছে! এসব দেখে ফেললে কী বিশ্রী ব্যাপার হতো! কিন্তু এখন অন্তূর কান্না পাচ্ছে না।

জয় আমির কখনোই এক বিন্দুতে স্থির থাকে না। সে প্রতিক্ষণে তার রেখা বদল করে। এক মুহুর্তে তাকে শিকার মনে হলে পরের মুহুর্তে শিকারী লাগে। এই দ্বিধাটা অসহ্য জয়ের চরিত্রে। এই দ্বিধা অন্তূ আগে কখনও কারও চরিত্রে টের পায়নি।

সে জয়কে জিজ্ঞেস করল, “আপনি মেরে ফেললেন ফরহাদ চাচাকে?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “মেরে ফেললাম।ʼʼ

-“কেন মেরে ফেললেন?ʼʼ

জয় চোখ চোখ তুলে তাকাল, “কেন? আসলেই তো! মারলাম কেন?ʼʼ

-“তিনি আপনার চাচাকে মেরেছিলেন তাই।ʼʼ

-“ওহ হ্যাঁ। সে আমার বড়বাবারে মারছিল তাই।ʼʼ

-“তিনি আপনার বড়চাচাকে কেন মেরেছিলেন?ʼʼ

জয় সায় দিলো, “আরেহ! সেটাই তো! কেন মেরেছিলেন?ʼʼ

অন্তূ ধমকাল, “ইয়ার্কি নয়। ফরহাদ চাচা জয়নাল আমিরকে কেন মেরেছিলেন?ʼʼ

জয় হাই তুলল একটা। সে বিশাল ক্লান্ত। অন্তূ বলল, “আমি বলব? আপনি নিতে পারবেন তো? নাকি ক্ষমতা উগড়ে আসবে?ʼʼ

-“আসবে না। আপনি বলুন, উকিল মহোদয়া!ʼʼ

-“কারণ আপনার চাচা একজন সন্ত্রাস ছিলেন। পরে যখন আমির নিবাস থেকে নিজের বাপ-ভাইকে মারার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়, সেটা অপবাদ হলেও উনি আপনার নিষ্পাপ চাচা নন।ʼʼ

জয় ছাদের দিকে তাকিয়ে হাসে, “শুরু করলে উকালতি!ʼʼ

-“জি না। এখনও ল তেই ভর্তি হইনি। অত জ্ঞান বা দক্ষতা নেই আমার। সাধারণ জ্ঞান। সেক্ষেত্রে আমি কি ভুল বলেছি?ʼʼ

-“নাহ তো!ʼʼ

-“আপনার হেঁয়ালি আমাকে অস্থির করে তুলছে। আপনি কথা বলুন, স্পষ্ট কথা।ʼʼ

জয় বিজ্ঞের মতো মাথা দুলালো, “তুমি আমাকে অভিযোগ করতে বলতেছ?ʼʼ

-“যদি বলি?ʼʼ

-“পারি না।ʼʼ

অন্তূ গর্জে উঠল, “আপনি নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছেন। মানুষকে আপনার ব্যাপারে কখনোই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেন না। আল্লাহর কসম, আপনি আজ হেঁয়ালি করলে আমি বিনা বিবেচনায় রুহ বের করে নেব আপনার।ʼʼ

জয় সামান্য হাসল। অন্তূ মাথা নাড়ে, “হাসবেন না। এভাবে হাসবেন না আমার দিকে তাকিয়ে।ʼʼ

জয় ঠোঁটে আঙুল রাখল, “ঠিকাছে। হাসব না। আমার একটা কনফিউশন আছে।ʼʼ

-“হু!ʼʼ

জয় ফিসফিস করে বলল, “অর্থাৎ তুমি আমার সব জেনে তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে এতদিন কাটালে? ‘মারবে না ছাড়বে! হ্যাঁহ? কেন মারবে? জয় আমির কেমন, কেন এমন?ʼ এত কৌতূহল কীসের আপনার, ঘরওয়ালি!ʼʼ

অন্তূ কণ্ঠ নিচু হলো, “এমন জলজ্যন্ত এক ঢেউ, যা সবকিছু ভাসাতে সক্ষম, তার ভাসার গল্প জানতে একটু কৌতূহল জায়েজ!ʼʼ

জয় হাসিমুখে একটা ঢোক গিলল। এতে তার পুরুষালি গলার উঁচু স্বরনালীর এপলসটা উঠানামা করে উঠল একবার। সেখানে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বড় মোহনীয়, সৌম্য, অভিজাত পুরুষ লাগে তাকে মাঝেমধ্যেই! জমিদারীর রক্ত রক্তের দায়ে ধুয়ে আলকাতরা হলেও তা ভুলেভালে রঙ চকচক করেই ওঠে বোধহয়!

জয় আলগোছে অন্তূর হাতদুটো নিজের বাহু থেকে ছড়িয়ে নিজের দুই হাতের মাঝে নিয়ে খেলতে খেলতে বলল, “এত পেরেশান কেন হচ্ছ? হু!ʼʼ

অন্তূ জয়ের চোখে তাকাল। খুব খেয়াল করলে দেখা যায়, জয় আমিরের চোখের মণি অতিরিক্ত কালো, একদম কৃষ্ণগহ্বরের মতো। যেখানে আলোও অস্তিত্বহীন।

অন্তূ নজর স্থির রেখে ধীর আওয়াজে বলে, “আমি প্রথমরাতে যখন আপনার কাছে নিজেকে সমর্পন করেছি, আপনার ভেতরে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে। পুরুষের উত্তেজনায় নারী তাকে পুরোদমে শোষণ করতে পারে। আমি সেদিন এক অসুস্থ জয় আমিরকে পেয়েছিলাম। যার ভেতরটা শূন্য, কিন্তু পুরু দেয়ালে ঘেরা! সেই দেয়ালের গণ্ডির সীমানায় প্রতিক্ষণে ফাঁপা হাহাকার ছিটকে বেড়ায়। কিন্তু সেই পুরু দেয়াল তা বাইরে আসতে বাঁধা দেয়!ʼʼ

-“কে বলে তুমি উকিল হবে? আমি বদদোয়া দিলাম, তুমি দুনিয়ার সেরা, বিশাল, বিরাট, অনেক বড়, বৃহত্তম, মহান সাহিত্যিক, কবি, দার্শনিক হবে। এখন বলো বদদোয়া কেন দিলাম?ʼʼ

-“কারণ আপনার দোয়া কবুল হবার চান্স নেই।ʼʼ

দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। পর মুহুর্তেই চোখ নামাল, দুজনই। জয় ঝুঁকে পড়ে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে, “আর অসুস্থ জয় আমিরের কাছে আপনার সেদিনের বলিদান আপনাকে কী জানালো?ʼʼ

-“আর সেদিনের আমার সেই বলিদান আমাকে শুধুই জানিয়েছে, ‘জয় আমিরকে জানতে হবে।’ গোড়া থেকে। আমি আপনার চঞ্চল পাপীষ্ঠ সত্ত্বার পেছনে আরেকটা জয় আমিরকে খুঁজেছি। অথবা আমি সেদিনই পারতাম আপনাকে কুচি কুচি করে কাটতে। কিন্তু আপনি জানেন, আমি আপনাকে কখনোই মারার চেষ্টা করিনি। উত্তেজিত করেছি, অতিষ্ঠ করেছি, ক্ষেপিয়ে তুলেছি কিন্তু চূড়ান্ত আঘাত করিনি। আজকের এই দিনটাকে নিয়ে আসতেই হয়ত এত আয়োজন।

অথচ আজ এই মুহুর্তেও আমার মনে হচ্ছে, আমি সেখানেই পড়ে রইলাম। দ্বিধা, জটিলতা, মারপ্যাচ, অস্থির সিদ্ধান্তরেখা… এখনও মনে হচ্ছে, আপনার বিচার করা যায় না, আপনাকে বিচার করা যায় না। বহুদূর হিসেব করে ফিরেও হঠাৎ চোখ মেললে দেখা যায় আমি সেই একই বিন্দুতে আঁটকে রয়েছি—কে জয় আমির? কেমন সে? কেন এমন সে? তার দায়ভার কীসের ওপর ন্যাস্ত করা যেতে পারে? এমনটা হবার ছিল না।
কিন্তু আমি বিবেচনার বিন্দু হারিয়ে ফেলছি। আপনার এত এত পাপ, প্রাপ্ত আঘাত আর ক্রমিক ঘটনাবলী এক বিন্দুতে শান্ত হচ্ছে না। তার ওপর আপনার আজব ব্যক্তিত্ব! যতটুকু খুলছি, ততটুকুই পেঁচিয়ে যাচ্ছে।

তবে একটা কথা উল্লেখযোগ্য, আজ এখন আমার ব্যক্তিগত দেনা-পাওনা আমি পাশে রেখেছি। তা আমার-আপনার একান্ত হিসেবের খাতায় জমা থাক আপাতত।ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল দু’পাশে, “মেরে ফেলো। শ্যুট মি! গুলি দেব? লোডেড ম্যাগাজিন আছে মনেহয় একটা পকেটে। এইটা অটো-সেমি মাল। একবার ম্যাগাজিন লোড করবে, এরপর ব্যাস বুম বুম বুম! দেব, দেব, সিস্টার? জটিলতাকে জিইয়ে রাখা মানেই কসরত। উড়িয়ে দাও। বিদ্রোহ করো! ভেঙে ফেলো আমার ভিত। চ্যাড়াব্যাড়া করে দাও একদম খুলি-টুলি!ʼʼ

অন্তূ তাকিয়ে রইল কেমন করে যেন জয়ের দিকে। একটু বিরক্তি, একটু কৌতূহল, হয়ত কিছু ঘৃণা অথবা বিরোধ কিংবা অনুরাগ হবে হয়ত! জয় মেঝের দিকে চেয়ে থেকে হাসল, “উহুহু! এভাবে তাকিয়ে থেকো না, ঘরওয়ালি!ʼʼ

অন্তূর স্বর বিরক্তিতে মিশে কঠিন হলো, “হু? কেন?ʼʼ

-“আমার মনে হবে তুমি আমার অতীত শোনার পর আমার দুঃখে দুঃখিত হয়ে আমার উকালতি করতে চাইতেছ। অবশ্যই তুমি অনেক বড় উকিল হতে পারো, কিন্তু জয় আমির তোমার মক্কেল হতে পারে না, ডিয়ার!ʼʼ জয় চোখ তুলে চট করে একবার চোখ মারল।

অন্তূ হাসল। চোখ সরিয়ে বলল, “অবশ্যই আপনি অনেকবড় ক্ষিপ্র বাজ হতে পারেন, কিন্তু আপনার পোষ মানার ক্ষেত্রটার আমাকে ঘিরেই হতে পারে। আর বাজপাখি পোষ মানলে সে তার পোষকের আওতায় শিকার করে।ʼʼ

চট করে অন্তৃ কথাটা ধরাতে না দেবার লক্ষ্যে দ্রুত প্রসঙ্গ বদলালো, “সন্ন্যাস গ্রহণ করলেও পারতেন। কারও দয়া, উপদেশ, আদেশ, অনুরাগ, ভালোবাসা…সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে লুঙ্গি ছেড়ে শালু গায়ে দিয়ে বেড়াতেন!ʼʼ

জয় আচমকা মাথা ঝারা মেরে হেসে উঠল, কিছু একটা এড়িয়ে হাসল, “হু! করব! তোমার একটা ব্যবস্থা করে ডিরেক্ট বাম ভোলে! হক মওলা! ধরো কলকি মারো টান..ʼʼ

অন্তূ বিরক্ত হয়ে আলতো ঝারা মেরে নিজের হাত ছড়িয়ে নিয়ে দৃঢ় গলায় মুরসালীনকে জিজ্ঞেস করল, “সেলিম ফারুকী যা করেছিল, তা আপনার পিতা জানতেন?ʼʼ

-“কখনোই জানতে পারেননি। আমি জেনেছি কথাটা সেলিম ফারুকীরও মৃত্যুর পর।ʼʼ

-“অতদিনেও জানলেন না কেন? সন্দেহ হয়নি কেন কখনও?ʼʼ

-“হামজা ভাই যা বলে এসেছিলেন, তারপর আর কখনও মাদ্রাসার ত্রি-সীমানায় প্রবেশ করতে পারেনি সেলিম।ʼʼ

-“তার আগেও সন্দেহ হবার কথা। আর যতদিনে মেয়র সাহেব গিয়ে তামাশা করে এলেন ততদিনের জয় আমিরের ওখানে থাকার তিন বছর হয়ে গেছিল। হুমায়িরা মায়ের সঙ্গে যা হয়েছিল, তার কোনো তদন্ত তিন বছরের মাঝেও কেন করেননি আপনারা?ʼʼ

জয় মুখ ভেঙচালো মনে মনে, “শালির মেয়ে স্বামীকে স্বামী মানে না, অথচ তার মাকে মা ডাকে। শালি ভন্ডর ঘরের ভন্ড! তোর পেছনে কুত্তা ছেড়ে দিয়ে দৌড়ানি দিলেও মনের দুক্কু মিটবে না।ʼʼ

মুরসালীনের মেরুদন্ডে কঠিন ক্ষত। সে দেয়ালে হেলান দিলো তারপরও, চোখ বুজে বলল, “ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে গেছিল। আব্বা কোনোদিন ভাবতেও পারেনি, সেলিমকে ধরে জিজ্ঞেস করলে সব জানা যেতে পারতো। ʼʼ

অন্তূ বলল, “যুক্তি দূর্বল লাগছে। তার সঙ্গে আপনাদের শত্রুতা ছিল, হোক সেটা ধর্মীয়ভাবেই। উনার পথ আলাদা ছিল। উনি ভন্ডদের অনুসারী ছিলেন। তবু আপনাদের সন্দেহ হলো না! আর আমার ধারণা, উনিই এসে আপনাদেরকে খোঁজ দিয়েছিলেন জয় আমির ও আম্মার ব্যাপারে।ʼʼ

-“ঠিক।ʼʼ

-“সেটাকে কীভাবে নিলেন আপনারা?ʼʼ

-“সেলিম কোনোভাবে জানতে পেরেছিল, আমিরদের বউয়ের ওই অবস্থা–এমনটাই জানিয়েছিল সেলিম। আব্বা জানতো, ও-ই জয়কে উদ্ধারকারী। ওর দিকে সন্দেহটা না যাবার এটাই একটা কারণ।ʼʼ

-“আরেকটা বিষয়, জয় আমিরকে সেদিন জবাই করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু উনার আম্মা মরে গেলে অথবা মেরে ফেলা হলেও পরে জয় আমিরকে কেন জীবিত অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে রাখা হলো? কেন?

-“এটা আমি পরে জানতে পেরেছি। জয়নাল আমির গ্রেফতার হবার খবর পুরো দিনাজপুরে তোলপাড় হয়ে জানাজানি হলো। কিন্তু জয় ও ওর মাকে ধরার জন্য বেশ কয়েকটা দলের সাথে সাথে রক্ষার জন্য আবার রাজন আজগরের লোকজন জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়েছিল সেদিন। পায়নি ঠিকই। তবে ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়েছিল সেলিমরা। পরে জঙ্গলে ফেলে যায়। এবং বলাই বাহুল্য, সন্ত্রাস সংগঠনে জয়নাল আমির ও আজগরেরা দোসর ছিল। এবং এজন্যই সেই কৃতজ্ঞতায় এই মাতাল আজও চাটে ওদেরকে।ʼʼ

জয় দুম করে লাত্থি মারল মুরসালীনকে, “টিনের চালে কাউয়া, তুমি আমার শাউয়া! বিটিরশালী, তোর মাকে কিন্তু যখন-তখন সালাম দিয়ে আসব। তোর ফ্যাদা প্যাচালে রাত গেল। কথা কম ক, আর আস্তে ক। আমি একটু ঘুমাই। গুড নাইট।ʼʼ সে লোহার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। খুব ঘুম পাচ্ছে তার।

মুরসালীন ব্যথা পাওয়া স্থানে হাত চেপে ধরে বলল, “এবং একটা কথা বলে রাখা দরকার, এই পাগলা কিন্তু এখনও মানে সেলিমসহ ওর সঙ্গিদেরকে সৈয়দ বাড়ির নির্দেশে পাঠানো হয়েছিল সেদিন রাতে আমির বাড়িতে।ʼʼ

জয় বলল, “হক কথা দিনে ছত্রিশবার স্মরণ করা যায়।ʼʼ

মুরসালীন বলল, “তুই না মরে গেলি এই মাত্র!ʼʼ

-“ধুর শালা। এত তাড়াতাড়ি তো মাইনষে মুতেও না। মরব মানে ঘুমাবো কেমনে?ʼʼ

মুরসালীন অন্তূকে জানালো, “আব্বার খুব অনুগত ছিল সেলিম। আরেকটা বিষয় আছে।ʼʼ

অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “কী বিষয়?ʼʼ

-“সেলিমের বড়বোনকে কিন্তু জয়নাল আমিরের সঙ্গীরা ইজ্জতহারা করে মেরেছিল যুদ্ধের সময়। সেজন্য সেলিম ফারুকীর পরিবারের কাছে আব্বা বংশের বড় ছেলে হিসেবে একটা দায়বদ্ধতা ছিল। সেলিমের ছোট বোনকে আমার মেজো চাচা বিয়ে করেছিলেন দোষ ঢাকতে। নয়ত যেমন জয়নাল আমির ভাবতেন আমাদের মাদ্রাসা আমার দাদু মিলিটারীর জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন, ফারুকীরাও ওরমকম একটা ভুল বুঝতে খুব তৎপর ছিল। ওরা ভাবতো, আমার পরিবার নিজেদের কোনো পাপে এতগুলো প্রাণ হারিয়েছে জয়নাল আমিরের হাতে।ʼʼ

আরেকটা ব্যাপার ছিল—জয়নাল আমিরের প্রিয় ভাতিজা জয়কে আব্বা আশ্রয় দিয়েছিল, এ নিয়েও ঘোর আপত্তি ছিল। সে বারবার আব্বার কাছে মিনতি করেছে, জয়কে বের করে দিতে। কিন্তু আব্বা জয়কে কাছছাড়া করেননি কখনও। এ নিয়েও একটা সন্দেহ ছিল ওদের। ওদের ধারণা ছিল, সৈয়দ পরিবার বোধহয় জয়নাল আমিরকে দোষী মানে না। কোনোভাবে বাচাতে চাইছে। ক্ষমা-টমা করে দিয়েছে। এজন্য জয়ের পক্ষ হয়ে অথবা জয়ের মায়ের বিচারের জন্য ওদের সঙ্গে কোনো আলাপে আব্বা যেতে পারেননি খুব একটা।ʼʼ

অন্তূ মাথা নাড়ল, “কিন্তু ফরহাদ চাচা কেন জয় আমিরকে কাছছাড়া করতে চাননি?ʼʼ

-“ওকে জীবিত রাখতে। সেই সময় ওকে ছাড়লে লোকজন মাংস আকারে কেটে পিস পিস করে বাড়ি নিয়ে যেত। ওকে মারার জন্য কতগুলো দল ওকে খুঁজছিল, ও আজও জানে না। ও যখন হামজা ভাইয়ের কাছে এলো, তখনও কতবার টপকে যেতে যেতে বেঁচেছে, সেই গল্প তো বলেনি এখনও।

কিন্তু সেলিম রোজ একবার করে মিনতি করতো আব্বার কাছে, জয়কে মাদ্রাসা থেকে মুক্ত করার জন্য। তখন জানতাম না– কেন? পরে জেনেছি, সে ভয় পেতো, জয় কখনও তার উপস্থিতি ছাড়া আব্বার কাছে পৌঁছে তার মায়ের ঘটনা বলে না দেয়। তার উদ্দেশ্য ছিল, জয়কে একবার মাদ্রাসা থেকে বের করতে পারলে চিরতরে জয়ের মুখটা বন্ধ করে দেবে, আর আমির বংশের সমাপ্তিও।

আব্বা বাড়ি এলে সেলিম আব্বার সাথে লেগে থাকতো। জয়কে জিজ্ঞেস করুন, সে কখনও সেলিমকে ছাড়া একা আব্বার কাছে যাবার সুযোগ পেয়েছে কিনা!ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরে বলল, “আপনার আব্বা জয়কে রক্ষা করতে চেয়েছেন সেলিমসহ বাকি শত্রুদের হাত থেকে, এটা বলতে চাইছেন?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দেবার আগেই জয় এক চোখ খুলে বলল, “অ্যাঁহ? উকিল সিস্টার, আপনে ওই শালার ছেলের কথা দিলে নিয়েন না। আসলে ওর বাপে আমারে জঙ্গি বানাইতে চাইছিল। কিন্তু আমি নেহাত ভালো লোক, তাই ফাঁদে পা দেইনি। ধন্যবাদ। গুড নাইট!ʼʼ

মুরসালীন শান্ত চিত্তে হাসল, “ওইটা লীগ না, জয়! সংখ্যা বাড়াতে কুত্তা-বিলাইও জয় বাংলার সৈনিক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তুই যাদের কথা বলছিস, তারা কারা তোর একটু হলেও ধারণা আছে। তোর মতো কাফেরকে ওরা সংগঠনে নেবে, এটা স্বপ্নও হতে পারে না।

একটা মজার কথা শুনবি? এই যে তোরা আমাকে সংগঠনের ছেলে ভাবিস না! আমাকে ওরা গ্রহণই করেনি। মুস্তাকিন ছিল ধার্মিক। কিন্তু আমি জন্মেইছিলাম গাফিল হয়ে। তুই চলে আসার দুই বছর পরেও আমার দ্বারা হিফজ্ হলো না। আব্বা রাগ করে আমার হাল ছেড়ে আমাকে জেনারেল স্কুলে ভর্তি করলেন। মুস্তাকিন যতটা ধার্মিক, ন্যায়পরায়ন, সভ্য ছিল; আমি ততটাই বিমুখ হলাম। মুস্তাকিন ভাই চলে যাবার পর আমাকে শুধু মাদ্রাসা কমিটির দায়িত্বে রাখা হয়েছে ঠেকায় পড়ে। কারণ সৈয়দদের মাঝে এক আমিই আছি। তুই আর কতটা মূর্খতা প্রকাশ করবি? যেখানে আমি চান্স পাইনি, সেখানে ওরা তোর মতো একটা অবিশ্বাসীকে দলে রাখতো? আব্বা তোকে শুধু মানুষ বানাতে চেয়েছিলেন। ধর্মের প্রতি তোর যা ভয়ানক ধারণা জন্মেছিল, তা অপসারণ করতে চেয়েছিলেন। ছোট্ট বয়সে তোর ভেতরে যে বিষ ঢালা হয়েছিল, তা নিংড়ে নিতে চেয়ে আব্বা বড়ো মাশুল গুণেছে জয়। তুই ভালো প্রতিদান দিয়েছিস!ʼʼ

জয় উঠে বসল। যেন খুব চেঁচামেচিতে তার ঘুমটাই ভেঙে গেছে। সে খুব অবাক হয়ে বলল, “আরেস্সালা! এত মহানুভবতার গল্প একসাথে শুনে বদহজম হয়ে যাবে তো! তুই আমার একটা কথা শুনবি, মুরসালীন?ʼʼ

মুরসালীন সোজা হয়ে বসল, “আমার কান তোর নামে কোরবান!ʼʼ

জয় বলল, “তুই কি জানিস–দোষ আর পাছা এক জিনিস। মানুষ নিজেরটা ছাড়া সবারটা দেখে।ʼʼ

-“যেমন তুই।ʼʼ

-“চুপ থাক শালা!ʼʼ

মুরসালীন কিছুক্ষণ চোখ বুজে থেকে মুচকি হাসল, “তুই কি জানিস, জয়! একজন প্রতিশোধপরায়ন মানুষ একটি কাচা মাটির স্তুপ। সুযোগ সন্ধানী মানুষ চাইলেই সেই মাটিকে দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো হাতিয়ার বানিয়ে ব্যবহার করতে পারে নিজ স্বার্থে। মাছ ধরবে পানি ছুঁবে না। পানি ছুঁবে সেই হাতিয়ার। তুই জানিস জয়, হাতিয়ারের চোখ থাকে না। হাতিয়ার অন্ধ হয়। তাকে চালনাকারীর চোখ দিয়ে সে শত্রুকে দেখে আঘাত করে।ʼʼ

-“তুই কি আমারে কইলি?ʼʼ

-“নাঃ! তুই একটা জয় আমিরের গল্প শোনালি, আমি তাকে বলছি।ʼʼ

-“দে আজ তুইও জ্ঞান দে। হাতি নদে পড়লে চামচিকায়ও পেছন মারে।ʼʼ

-“তুই নদে পড়েছিস শুনে ভালো লাগল। কিন্তু তুই তো হাতি না, তুই হলি গাধা। যাহোক, তুই ঘোষ্ট-রাইডার সিনেমা দেখেছিস, জয়?ʼʼ

-“হ।ʼʼ জয় মাথা নিচু করে হেসে ফেলল।

তা দেখে মুরসালীনও হাসল। মুরসালীন যা বোঝাতে চাইছে, তা এক লহমায় বুঝে হেসে ফেলেছে জয়। তাতে মুরসালীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আব্বা বলতো, আমি যে জয়কে ছাড়বো! আমার মনে চায় ওরে ভালো একটা তালিম দেই। দেশ-জাতির ভবিষ্যতে লাগাই ওর মাথাটারে। জাভেদ যা পয়দা করে রেখে গেছে, ও এক বারুদ! যে কামেই লাগাবি, তা ডিরেক্ট কামিয়াব। অথচ ওর এত চতুর আর চিতার মতোন দ্রুতগামী বুদ্ধি শকুনে খাবে।ʼʼ

-“তোর বাপে খালি আমার চরকায় তেল ঘষতো ক্যান হামেশা? নিজের চরকা ভাঙা ছিল নাকি তেল বেশি কিনে ফেলেছিল?ʼʼ

-“তুই বুঝে অবুঝ। আর বুঝে অবুঝেরা তাদের সুবিধামতো বোঝে। ধর যেটা বুঝতে ইচ্ছে করছে, সেটা বুঝছে। যেটা ইচ্ছা করছে না, সেটা বুঝেও বুঝছে না।ʼʼ

জয়ের হাসি বাড়ল সামান্য, “তাদের কোনো চিকিৎসা নাই। তুই তোর ডাক্তারি ফিরিয়ে নে। হাম নাহি শুধরেঙ্গে জি হাম নাহি শুধরেঙ্গে।ʼʼ

মুরসালীন বলল, “ঘোষ্ট রাইডার সিনেমার নায়ক জনি। ওর বাপের ক্যান্সার হয়েছে। একদিন একজন এসে বলল, তুমি আমাকে তোমার আত্মা দেবে, এই শর্তে এই কাগজটাতে সাইন করো, তার বদলে তোমার বাপকে আমি সুস্থ করে দেব। তোমার সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। জনি সাইন করে দিলো। কারণ তখন তার শুধুই তার বাপকে বাঁচাতে হবে। আগে-পরে বাদ। রাতারাতি তার বাপ সুস্থ হলো। কিছুদিন কাটলো। একদিন ওই লোক এলো। কাগজটা দেখালো। জনি তখন নিরুপায়। সে আগেই চুক্তিপত্রে সাইন করে ফেলেছে। তখন বিষয়টা খারাপ মনে হয়নি।

কিন্তু এবার টের পেল, সেই লোকটা মূলত শয়তান। শয়তান তার কাছে তার আত্মা কিনে নিয়েছে। এবার তার আত্মাকে দিয়ে যা খুশি করাতে পারে, জনি তা করতে বাধ্য। এরপর শয়তান জনিকে দিয়ে দেদারসে মানুষ মারতে থাকল। জনিকে জাহান্নামের দেবতা বানালো। সে যাকে ছোঁয় সে এক মুহুর্তে জ্বলে ভষ্ম হয়ে যায়।ʼʼ

জয় হো হো করে হেসে উঠল, “সিনেমাও দেখিস তুই? এ তো কঠিন পাপ! থুহ থু!ʼʼ

মুরসালীন মাথা নাড়ল, “আমি সৈয়দ বংশের কলঙ্ক! সব পাপাচারে ভাগ আছে আমার। তুই কি বুঝেছিস আমি কী বলেছি?ʼʼ

-“না।ʼʼ

দোলন সাহেব হেসে উঠে নিজের উপস্থিতির জানান দিলেন, “আমি যদি বুঝে না বুঝি আমাকে বোঝায় কোন শালা? ঠিক না, জয়?ʼʼ

জয় হাত তুলে সংগ্রামী ভঙ্গিমায় বলল, “ঠেক ঠেক! একমত, স্যার, একমত!ʼʼ

মুরসালীন হাসল, “হামজা ভাইয়ের চোখ দিয়ে দেখা শত্রুদের ব্যাপারে যা বুঝলে তারা আর তোর শত্রু থাকবে না, তুই তা বুঝতেই চেষ্টা করিসনি। কারণ ছোটবেলায় যে অবস্থান তোর কাছে নারকীয় মনে হয়েছিল, হামজা ছিল তখন তোর মুক্তির দূত! আর তুই নিজের অজান্তেই অসীম কৃতজ্ঞতায় হামজা ভাইকে তোর রুহ্ সঁপেছিস। আজ চাইলেও তার কর্মে অভিযোগ অথবা আপত্তি আসে না। তুই করতে চাস না।ʼʼ

জয় আনমনে স্বগোতক্তি করে, “হামজা ভাই আমারে একদিন কইলো, জয় রে! তোর-আমার গন্তব্য দুইটা, পথ এক। পথের শেষে একই বিন্দুতে একই রকম দেখতে দুইটা গন্তব্য! চল হাঁটি।ʼʼ

মুরসালীন নিস্তেজ চিত্তে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল, “গন্তব্য মানুষকে মৃত্যু অবধি পৌঁছে দেয়!ʼʼ

তার নরম দিলে জয়ের জন্য এক ঘা লাগল! পথভ্রষ্ট এই জয়কে মুস্তাকিন মহান ছোটবেলায় মাদ্রাসার দস্তরখানে বসিয়ে কত বুঝিয়েছে! ওই জয় পর্বতের মতো অটল চিত্তে কেবল চুপ থাকতো। ভেতরে কী জমাতো, কে জানে! আজ মনে হয় বিদ্বেষ। এই জগৎসংসার, সমাজ, দেশ, মানুষের প্রতি তার অসীম বিদ্বেষ একটু একটু কমে জমে এক মহাসমুদ্রে রূপ নিয়েছে। তা ঢেউ থামানোর উপায় নেই।

জয় তীব্র-বেগে মাথা নেড়ে স্বীকার করে, “হ, হ! মৃত্যুউউ!ʼʼ

অন্তূ খেয়াল মেলে দেখল জয়ের সেই পাগলামিটুকু। জয় আমির সত্যিই মৃত্যুর ওপর বড়োই আকর্ষিত! সে বলল, “সেই গন্তব্যে আপনার জন্য নিশ্চিত মৃত্যু লেখা থাকলেও মেয়র সাহেবের জন্য গচ্ছিত আছে ক্ষমতার ডালি। পথটা হলো, বিরোধীদের ধরে কচুকাটা করা। তাতে আপনার ভেতরে ইনপুট করা প্রতিশোধের বিষাক্ত প্রবৃত্তি মিটবে, আর আপনার তৈরি করা রাস্তা মেয়র সাহেবকে তার উদ্দেশ্য হাসিলে এক পিচ্ছিল পথ বানিয়ে দেবে। এই তো আপনাদের সেই এক পথ দুই গন্তব্য?ʼʼ

-“ব্রিলিয়ান্ট! আপনি চাইলে ভালো উকিল হতে পারতেন, ঘরওয়ালি!ʼʼ

অন্তূ গভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, “জেনেশুনে ক্ষয় হতে কেউ এত আগ্রহী হয়, জয় আমির?ʼʼ

জয় হাসল, “আমারে কেউ অক্ষত পায় নাই, ম্যাডাম! সুতরাং ক্ষয় হওয়ার মাল আরেকটু ক্ষয় হইলেই বরং প্রকৃতির নিয়ম বজায় থাকে। আমার উপরে মরিচা ধরছে সেই কোনকালে।ʼʼ

মুরসালীন গম্ভীর স্বরে শুধায়, “আব্বাকে কেন মেরেছিস? তোর মুখে শুনি! বল, কী কারণে মেরেছিস?ʼʼ

জয় লোহার খণ্ড থেকে আস্তে কোরে নেমে ঢালাই মেঝেটার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল। মুরসালীন ঠিক ওর পাশে একইভাবে শুয়ে পড়ল। দুটো দেহ পাশাপাশি পড়ে রইল। একটা ক্ষত-বিক্ষত আরেকটা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত!

-“আমার বড়বাবাকে আমি শেষবার কবে দেখছি জানিস? সেই রাত্তিরে। ওই যে ওই রাত্তিরে। বড়বাবা তার ভাবীকে বলেছিল, ‘জয়কে নিয়ে পালান, ভাবী। জলদি যান।ʼʼ

-“তোর বড়বাবা বিশাল বড় হিরো ছিল রে, জয়?ʼʼ

-“আমার বড়বাবা ছিল।ʼʼ

-“আইন, রাষ্ট্র ও দেশের মানুষের কী ছিল?ʼʼ

জয় হেসে ফেলল, “আইন, রাষ্ট্র, দেশের মানুষ?ʼʼ ডেকে উঠল জোরে করে , “ও দোলন স্যার? আছেন না? আমার ঘরওয়ালির হাতের ইশপেশাল বুলেট নসিব হয় নাই তো?ʼʼ

এতক্ষণে সবাই যেন ভুলে গেছিল, তারা ছাড়াও আরও একজন আজ জয় আমিরের গল্পের শ্রোতা রয়েছেন বড় ঘরে। দোলন সাহেব বললেন, “নাহ। হয়নি।ʼʼ

-“ব্যাডলাক! সেই দুঃখে আপনারে একখান গোপন কথা কই, স্যার?ʼʼ

-“হু?ʼʼ

জয় বাচ্চাদের মতো চেঁচিয়ে ঘোষণা করে, “আমি ছাড়া এই ঘরে আর কোনো দেশোদ্রোহী নাই, স্যার।ʼʼ

অন্তূর শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। চোখ বুজল সে। জয় আমির মিথ্যা বলে না। অন্তূ জয়ের গল্পের মাঝে এটাই তো আবিষ্কার করেছে এতক্ষণে! দেশ, দেশের মানুষ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র…এই সবের দ্রোহ একা বহনকারী জয় আমির আজ এই জয় আমির। যার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, পাপাচার, মানুষের ভোগান্তি, দেশের-দশের ভাঙন, ধ্বংস!

মুরসালীন চট করে ঘাঁড় ঘোরায়। জয় দাঁত বের করে হাসল, “আমার বড়বাবা তা-ই ছিল। বুঝেছিস তুই মুরসালীন?ʼʼ

-“জয়, তুই অকৃতজ্ঞ।ʼʼ

জয় আপত্তি জানায়, “নাহ! আমি অকৃতজ্ঞ না।ʼʼ

-“তুই আর সবার প্রতিদান চুকাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিস, শুধু যে বা যারা তোকে জীবন দিয়েছে তাদের জীবন শুষে বলিয়ান হয়েছিস। উত্তম বিচার বটে!ʼʼ

-“তোর আব্বা! তোর আব্বা আমির পরিবারকে খেয়েছে।ʼʼ

-“জবান সামলা।ʼʼ

-“কোথায় সামলাবো? ঘরওয়ালি! তুমার ওড়নার আঁচলডা দেও তো।ʼʼ তাড়াতাড়ি কোরে অন্তূর ওড়নার তলে জিহ্বা ঢাকল।

-“হামজা ভাই তোকে দিয়ে সার্কাসেও কাজ করিয়েছে নাকি? এমন জোকার জোকার হাল হয়েছে কেন তোর? আব্বা তোর অবস্থা এমনটাই আশংকা করতো তোর চলে আসার পর।ʼʼ

-“মুরসালীন তোর কথা শেষ কর। আমি রুমে যাব। মাথা ব্যথা করতেছে।ʼʼ

-“স্বাভাবিক! কথাবার্তা সেইদিকে যাচ্ছে, যা তুই আলোচনা করতে খুব অপছন্দ করিস। কিন্তু করতে হবে। সময় নেই আমাদের হাতে।ʼʼ

জয় মাথার নিচে হাতের কনুই দিয়ে বলল, “হ! ঠিক কথা। সময় নাই আমাদের হাতে।ʼʼ

মুরসালীন বড় হতাশার সাথে বলল, “জয়নাল কাকা সর্বশেষ যে পাপটা করেছিল, তা তোর সাথে।ʼʼ

-“পাপ? আমাকে ভালোবাসাটা?ʼʼ

-“মূর্খ! ভালোবাসা বুঝিস তুই?ʼʼ

-“তা বুঝি না অবশ্য!ʼʼ

-“তোর দুর্ভাগ্য। ভালোবাসা কাকে বলে বুঝিস না তুই, অথচ দাবী করিস কেউ কেউ তোকে ভালোবাসে। তুই একটা শক্তিশালী ঘুটি মাত্র। যা সবার দাবার চাল হয়েছে। যে যেমন পেরেছে তোকে ভালোবাসার নামে বিষে চুবিয়েছে। আল্লাহ পাক তোকে যে পরিমাণ নেয়ামত, মেধা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন, তা তুই কুকুরদের খোড়াক হিসেবে বিতরণ করে এক অধমে পরিণত হয়েছিস!ʼʼ

-“পুরোনো আলাপ। সেসব থাক। বোঝা তো, ভালোবাসা কী? আজ নতুন কিছু বুঝি।ʼʼ

-“যদি বলি, তোর স্ত্রী তোকে ভালোবাসে!ʼʼ

জয় যেন হাসতে ভুলে গেল। সে অতিরিক্ত হাসি পাওয়ার ফলে হাসতে ভুলে গিয়ে নিঃশ্বাস আঁটকে পড়ে রইল।

মুরসালীন আস্তে আস্তে উঠে বসে বলল, “সে তোকে এই পথ ছাড়তে বলেছে কখনও?ʼʼ

হাসি জোর করে চেপে মুখ ফুলিয়ে বলল, “হ।ʼʼ

-“আর কেউ?ʼʼ

-“না।ʼʼ

-“মনে কর, কেউ তো বলেছে সে ছাড়া!?ʼʼ

-“মনে নাই। ক্যান?ʼʼ

জয় চোখ খুলে তাকায়। মুরসালীন বলল, “কেন বলেনি? কেন তোকে কেউ এই মরার খেলা খেলতে মানা করেনি? অন্য পথের কথা বলেনি? বল, তুই বল। আমি তোর মুখে শুনব।ʼʼ

জয় কিছু বলল না। উঠে গিয়ে কামরুলের পকেট হাতরে সিগারেট বের করে এনে জ্বালালো।

মুরসালীন দৃঢ়স্বরে বলল, “কারণ কেউ তোরে কোনোদিন বাঁচাইবার চায় নাই। কেউ তোরে মানুষ মনে করে নাই। কেউ তোরে বোঝেই নাই! তুই যে মেধাবি, তুই অভিজাত বংশের রক্তে পয়দা, তোর ভিতরে মানুষ আছে, এটা তোকে ভুলিয়ে রাখতে এই দুনিয়ার যত আয়োজন! কিন্তু তোর স্ত্রী..ʼʼ

জয় সিগারেট ঠোঁট থেকে নামিয়ে তীব্র বাঁধা দিলো, “চুপ! চুপ! কিছুই না। আমি ওর আসামী মাত্র, আসামী। এর বেশি কিছু না। ভালোবাসা-বাসির মইদ্দে টানিস না।ʼʼ

-“তুই কোন ভালোবাসার কথা বলছিস, জানি না। কিন্তু ভালোবাসার বহুত প্রকারের মাঝে একটা এমনও আছে—

জয় চোখ বুজে লম্বা একটা টান সিগারেটে দিয়ে পুরো ধোঁয়াটুকু গিললো। তারপর নিঃশব্দে হাসল, এইটা যদি ভালোবাসা হয়, তাইলে তা সর্বজনীন! সবার জন্য প্রযোজ্য। ও এক আদর্শ মেয়ে, ভাই। আমার জায়গায় অন্য কোনো নষ্ট জয় থাইকলে তারেও ভালো হইতে বলতো। এইটাতে বিশেষত্ব খুঁজলে আমি তোরে দুই চামচ খাঁটি গু খাইতে সাজেশন দেব।ʼʼ

মুরসালীন বলল, “তুই যে পথে নেমেছিস, তাতে আছে কী?ʼʼ

-“তোরা যে পথে আছিস, তাতে আছে কী?ʼʼ

-“কী চাস?ʼʼ

-“কী আছে, দে! আমার তো কিছুই নাই। যা দিবি হাতে, তাই যাবে সাথে। দে..ʼʼ জয় হাত পাতলো।

-“চাস কী তুই? দেশের জন্য প্রেম আছে, মানুষের জন্য মমতা আছে, নারীর প্রতি সম্মান আছে, মনুষত্ব বোধ আছে। আমার দেশের মাটি আমি বেঁচে থাকতে আমার দ্বারা নোংরা হবে না, সেই দৃঢ় প্রত্যায় আছে বুকের ভেতরে। কী চাস তুই?ʼʼ

জয় আমির উপহাস করে হাসল। ঝারা মেরে মাথা নাড়ল দু’পাশে,

-“আমি জয় আমির যেইদিন খালি একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে ছিলাম, আমি আমার দাদুভাইয়ের কাটা মাথা দেখছি, বাপের মাংস ছিঁড়ে আসা শরীর দেখছি, সেই জন্মদাত্রীর লজ্জাস্থান হরণ হইতে দেখছি, যা চিরে দুনিয়ায় আসছি। আমি জয় আমির খিদের জ্বালায় তোর দ্যাশের জমিনের মাটি খুবলে খাইছি। একখান মজার কথা শুনবি? তোর দ্যাশের মাটি ক্ষুধার্ত জয় আমিরের খিদে মেটাইতে পারে নাই। তোর দ্যাশের মানুষ আমার মতোন জয় আমিররে ঘরে তুইলা আশ্রয় দেয় নাই। তোর দ্যাশের মানুষ, তোরা নারীদেরকে ম্যালা সম্মান করিস। খালি আমার ফুপু জয়নব, আমার আম্মা হুমায়িরা আর আরমিণেরা যখন ইজ্জত হারায় তখন তোর দ্যাশের মানুষ এইগুলারে সম্মান করতে জানে না। আমি ভুল কইছি মনেহয়। তোর দ্যাশের মানুষ নারীরে সম্মান দেয়, এই তিনডা তো নারীই ছিল না। ঠিক কইছি না?

ওই যে বইসা আছে শালির মেয়ে! ওইডারে জিগা! ওইডারে যেইদিন বেশ্যা মাগি বানাইছি আমি জয় আমির, তোর সমাজ-দ্যাশের মাইনষে ওরে একবার জিগায় নাই পর্যন্ত —’ওই ছেঁড়ি! আমিরের পোলায় তোরে সত্যি ছুঁইছে নাকি?ʼ জিগা ওরে! দেখ ওই শালি আইজও কাঁন্দে খালি। কিছু কইবার পারে না, করবার পারে না। ওরে ওইদিন আমি আমার নাম না দিলে ওয় কবে বদনাম হইয়া খতম হই যাইতো! তোর দ্যাশের মাটি ওর বালডা ছিঁড়তো!? তোর দেশপ্রেম কারে কী দিছে? তোরে কার বালডা দিছে? আজ এইখানে পচতেছিস মাসের পর মাস! এই তো! হ, তোর দ্যাশ-সমাজ ম্যালা ভালো। মহান মহান।ʼʼ

জয় আমির আবারও হেসে ফেলল কেমন করে যেন, “তোরা তো ভালো আছিসই, মুরসালীন! আমি এক জয় আমির খারাপ হইলে তোর দ্যাশ-দুনিয়ার থেকে কিচ্ছু খসবে না বা জোড়া লাগবে না।ʼʼ

জয় অন্তূর হাতখানা আবারও শক্ত করে চেপে ধরল। সেই হাতজোড়া থরথর করে কাঁপছে। জয় কিন্তু ভুলেও তাকাল না অন্তূর মুখের দিকে। আরমিণের কান্না সে দেখে না। ওই ছেঁড়ি কাঁদলে আড়ালে কাঁদবে। আজ সামনে কেঁদে ফেলেছে। সেই দোষ তো জয়ের না! অন্তূ হাতখানা চেপে ধরে ওকে নিয়ে গা ঝেরে উঠে দাঁড়াল জয় আমির,

-“ছেড়ে দে আমায়, মুরসালীন। এক জনম আমি জয় আমির হবো, পরের বার মাটি হয়ে হুমায়িরার পেটে জন্মাবো। সেইবার তোরা কেউ চাইলেও আমারে আর জয় আমির বানাইতে পারবি না কইলাম। এইবার খালি আমারে জয় আমির হইতে দে।ʼʼ

অন্তূকে তুলে নিয়ে নিস্তেজ দেহগুলো মাড়িয়ে চামড়ার স্যান্ডেলের খসখসে আওয়াজ তুলে অনেকটা এগিয়ে এলো জয়। পিঠ-পিছে অন্তূর ওড়না ঝুলছিল। তা একহাতে গায়ে জড়িয়ে অন্তূকে আগলে নিয়ে বড়ঘরের মাঝ বরাবর পেরিয়ে আসার সময় মুরসালীন আওয়াজ দিলো,

-“জিন্নাহ আমিরকে আমি মারিনি, জয়। তোর গল্প, আমার কথা আর তোর ভুল বোঝাবুঝি শেষ হতে এখনও অনেকটা বাকি।ʼʼ

চলবে..

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭২.

রাত সোয়া দুটোর সময় হামজা আকস্মিক রিমিকে ছেড়ে সাদা চশমাখানা টেবিলের ওপর রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তার ভেতরে কিছু তৈরি হলো। জটিল কিছু। ততক্ষণ হামজার মস্তিষ্ক কাটার মেশিনের ব্লেডের মতো চলেছিল। সামনে যা আসবে, ফালা ফালা হয়ে যাবে।

রিমি কাঁদছে। কিন্তু হামজা থামানোর চেষ্টা করল না। তার আবার বুকও জ্বলছে। এই জ্বলন অবর্ণনীয়! ব্যক্তিগত দুঃখ। এটা নতুন তার জন্য। ব্যক্তিগত দুঃখ বলতে এক অপরিচিত ব্যাপারের সাথে সে কিছুদিন চলাফেরা করছে। হামজা কখনও কাউকে ভালোবাসেনি। কিন্তু রিমির ক্ষেত্রেও কি কথাটা খাটে? এই প্রশ্নটাই সমস্যা তৈরি করছে মূলত।

রিমি তাকে শাস্তি দিতে যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তার দায়ভার কার? জয়ের বউয়ের নয়? হামজা কি ছাড়বে সেই দুঃসাহসী নারীটিকে? ধরলে নারীটি সইতে পারবে হামজার থাবা?

সে ফতোয়া বদলে একখানা নেভি-ব্লু পাঞ্জাবী পরল। এসির নিবিড় হাওয়ায় ঘুম জড়িয়ে আসছে চোখে। মস্তিষ্কের ভারে তার কঠিন শরীরটাও নুইয়ে আসা ভাব। ঘুমটা দরকার হামজার। তার আগে কিছুটা মদ খাওয়া দরকার। নয়ত এই অস্থিরতায় ঘুম আসে না। তার জন্য জয়কে দরকার। কিন্তু জয় বড়ঘরে আজ।

জয়ের রুমখানা পেরোনোর সময় দেখল দরজার নব লক। জয়ের বউ ভেতরেই ঘুমাচ্ছে তো? ব্যক্তিত্বের চাপে রাত-দুপুরে নবটা ঘুরিয়ে জয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে ওর ঘুমন্ত বউকে দেখার কাজটা করা হলো না। তবে একটা নিশ্চয়তা আছে বটে। জয়কে এখনও পুরোপুরি বশ করতে পারেনি ওর বউ! এটাই ধারণা হামজার। ঘরেই আছে আরমিণ।

আড়াইটার দিকে হামজা সংসদ সদস্যের বাসভবনে পৌঁছাল। দারোয়ান ঘুমে ঢুলছিল। হামজা না হলে সে ফটক খোলা তো দূর, লাগলে একটা মার্ডার করতো। এমপি সাহেবের নিরাপত্তা প্রথমত। কিন্তু হামজাকে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে সালাম ঠুকে বলল, “স্যার আপনের জন্যে ম্যালাক্ষণ বসে ছিল। এখন মনে হয় শুইয়া পড়ছে!ʼʼ

হামজা চুপচাপ নিশাচরের মতো ভেতরে ঢুকল। হাতে দুটো ফাইল। কেইস ফাইলের কপি— অভিযোগপত্র। আরেক হাতে একটা মাঝারি ঝোলা গাড়ি থেকে বের করল।

মাঝরাতে সংসদ সদস্যের বসার ঘরখানা হামজার শরীরের কড়া সুগন্ধির রহস্যে মেখে উঠল। নেমে এলেন ভুড়ি দুলিয়ে সংসদ সদস্য সাহেব। বড় করে হাসলেন। হাসল না হামজা। তার ভরিক্কি সৌম্য চেহারা, আঁধার কূপের মতো চোখদুটো স্থির, শান্ত, ঠিক শিকারী পেঁচার মতোন। সে সালাম অবধি দিলো না।

এমপি সাহেব বললেন, “তোমার রাত বারোটায় আসার কথা ছিল।ʼʼ

সোফায় বসে ফাইলগুলো এগিয়ে দিয়ে হামজা বলল, “ওদিকের ব্যবস্থা কতদূর করলেন?ʼʼ

ফাইলগুলো দেখতে চাইলেন এমপি সাহেব, হামজা বাঁধা দিলো, “পরে দেখে নেবেন। আমি শেষরাতের গাড়িতে রাজধানী যাব। কথা শেষ করি।ʼʼ

-“মাসুদ! চা-পানি দে রে!ʼʼ

-“লাগবে না। আলোচনায় আসি।ʼʼ

হামজা ঝোলা থেকে মোট তিনটা হ্যান্ডগান ও চারটা লোডেড ম্যাগাজিন বের করে সেন্টার-টেবিলের ওপর রেখে বলল, “এগুলোর লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স শুধু আমার একটা পিস্তলের আছে। এগুলো এখন বাড়িতে রাখা যাচ্ছে না। আপনি রাখুন। পরে নেব।ʼʼ

রেগে উঠলেন এমপি সাহেব, “তার মানে যখন-তখন তল্লাশি হবার পর্যায়ে আছো, হ্যাঁ? মরতে বাকি রাখোনি?ʼʼ

হামজা নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল। দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা গেল এমপির মুখে। ঘনঘন মাথা নাড়লেন, “তোমার জয় যা করছে, ভালো করেনি। ভালো করেনি।ʼʼ

-“ওর সেই অভ্যাস নেই। সে যাহোক, পলাশ আজগর মার্ডার কেইসে পুলিশ এখনও ডেডবডি পায়ইনি, অথচ জয়কে সাসপেক্ট নম্বর ওয়ানে রেখেছে। মাজহার, ঝন্টু কাকাসহ আরও পুরোনো কেইসগুলো কেউ নতুন করে খুলেছে। গোড়া থেকে সব তদন্ত শুরু হয়েছে স্পেশাল ব্রাঞ্চগুলোতে। সেখানে আমার বাড়িটা গবেষণার বিষয়। বুঝতে পারছেন?ʼʼ

অবাক হলেন এমপি, “কে খুলেছে সেইসব কেইস?ʼʼ

-“বলব সব। এখন কথা হলো, কয়দিন যে চাপাটা দিয়েছিলাম, তা আলগা করেছে কেউ বা তারা। তাকে এবং তাদেরকে ধরে বলি দিলেও এখন আর তা ঢাকা যাচ্ছে না। চারদিকের অবস্থা ভালো না। অন্তত এটার কাজ দ্রুত এগোনো দরকার আপাতত। ঢাকা থেকে ফিরে আমি নিজেই একবার যাব পুলিশ কাস্টাডিতে। অন্তত একটা নো-ফল্ট স্টেটমেন্ট দিয়ে আসতে হবে, নিজেকে সাফ রাখতে হবে যথাসম্ভব। কিন্তু জয়কে আমি থানার বারান্দায়ও দেখতে চাই না।ʼʼ গভীর বার্তা দিলো হামজা।

গলার স্বর চড়ল এমপির, “শোনো ইয়াং ম্যান! ঠান্ডা ঠান্ডা! তুমি নিশ্চিত মার্ডার আর তার কালপ্রিটকে পবিত্র গোলাপ ফুল বানানোর প্রস্তাব করতে আসছো। নরকে যাওয়া কাম এইটা, সহজ নাকি?ʼʼ

হামজা নির্বিকার বসে রইল। দুটো গ্লাসে এক শট অ্যালকোহল, দুটো করে পুদিনা পাতা, এক টুকরো আদা, একটু বিট লবন ও সোডা মিশিয়ে দুটো ড্রিংক তৈরি করলেন এমপি সাহেব। একটা গ্লাস হামজাকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “পুলিশ পলাশের বডিটা পেয়ে গেলে ব্যাপার হাতছাড়া হয়ে যাবে গো হামজা। ওইটার ভালো ব্যবস্থা করো।ʼʼ

-“বডি পাবে না।ʼʼ হেলান দিয়ে বসে গ্লাসে দুটো চুমুক দিলো হামজা।

-“পাবে না?ʼʼ

-“খাবার হিসেবে কুকুরের পেটে চলে গেছে। হজমও হয়ে গেছে। আপনি আপাতত ব্যবস্থা করুন যেন জয়কে ইন্টেরোগেশনে ডাকা না হয়। পুলিশ ফোর্সের প্রমাণের হিসেবে এত সহজে যাবার নয়। আমি বেঁচে আছি এখনও।ʼʼ

এমপি সাহেব একটু দুঃখিত ও অবাক হয়ে বললেন, “এত খারাপভাবে মারলে পলাশ ছেলেটাকে?ʼʼ সোজা হয়ে বসে ঘাড়ে হাত রাখলেন এমপি সাহেব। কিছুক্ষণ হা করে শ্বাস ফেলে বললেন, “ডুবো না হামজা, কোনোভাবেই ডুবো না! যেমনে ভাসতেছ, একবার ডুবলে জাহাজের ভাঙা পাটাতনও পাওয়া যাবে না গো!ʼʼ

-“দলের ছয়টা ছেলে পুলিশ হেফাজতে। রূপকথা আজগর, পরাগ ওরা নিজেদের শেষ সময় গুণছে শেলের পেছনে। আমার কবির বন্দি। আবার জঙ্গি শুয়োরের বাচ্চারা যখন-তখন হামলা করবে, আমি নিশ্চিত। আরেকটা কিছু চাল চালছে। ভেতরে ছিদ্র হওয়া ব্যাপার। আমার ব্যক্তিগত..ʼʼ

এমপি সাহেব সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছেন বুঝে সংযত হয়ে উঠল হামজা। সে ব্যক্তিগত আলাপ পেড়ে ফেলেছে ক্রোধে। এক সামান্য নারী তাকে মুচড়ে রেখে দিয়েছে তা লোক জানার নয়।

সে বলল, “বাড়িতে নিরাপত্তার বাঁধ প্রায় ভেঙে গেছে। সেই সেদিন ভেঙেছে যেদিন মুরসালীন বাড়িতে দেদারসে ঢুকে পড়েছিল।ʼʼ

সোজা হয়ে মনোযোগ এনে বসলেন এমপি, “একটা কথা বলবে হামজা?ʼʼ

হামজা বুঝল কী বলবেন এমপি। সে চুপ রইল। এমপি বললেন, “তোমার বাড়িতে তোমাকে জড়িয়ে কোনো বিরোধী আগাছা বেড়ে উঠেছে বলে আমার ধারণা, সেটা কি জয় নয় তো আবার?ʼʼ

ঝানু রাজনৈতিক লোকের সঠিক আন্দাজ হামজাকে ক্ষুব্ধ করে তুলল। কিন্তু সেই আগাছা জয় নয়। বরং জয় নিজেই সেই আগাছার শিকার হতে চলেছে। তাকে উদ্ধার করা দরকার। হামজার ভেতরে আবারও একটা ভয়ের উদ্রেক হলো, সে কেন এই মুহুর্তে রুমে ঢুকে আরমিণকে গলা টিপে মেরে এলো না?

কিন্তু তার উত্তেজনা বাইরে আসে না বলে ভেতরে তা চেপে গিয়ে বলল, “আমার বাড়িতে এখন শুধু প্রতিবেলা পুলিশি তল্লাশি চলবে। থামাতে পারব না। সন্দেহ গাঢ় করা যাবে না। থামালেই আগ্রহ পেয়ে বসবে। সেক্ষেত্রে তল্লাশি পুরোদমে করতে দেবার জন্য সহযোগিতা করতে হবে আমাকে।ʼʼ

হামজা থামল। পূর্ণ মনোযোগী হলেন এমপি সাহেব। হামজা ঠোঁট কামড়ে বিরতি কাটিয়ে ইঙ্গিতবহ সুরে সূক্ষ্ণ গলায় জানালো, “বড়ঘর পরিষ্কার করতে হবে।ʼʼ

এমপি সাহেব থুতনিতে হাত চেপে বসলেন, “আমার বাড়িতে হ্যান্ড-অভার করবে ওদের? আমার বেসমেন্টে রাখতে পারো। আমার বাড়িতে পুলিশে তল্লাশি চলে না।ʼʼ হাসলেন এমপি।

-“সোজা ওপরে অথবা কারাগার। বড়ঘর থেকে আপনার বাড়িতে ওদেরকে অতিথি করে পাঠাতে এই মাঝরাতের মিটিংয়ে আমি আসিনি।ʼʼ অশিষ্ট শোনালো হামজার গলা।

-“তো এখন কী চাও?ʼʼ

-“মুরসালীন মহানকে মেরে হাত ময়লা করব না আমি। ওকে পচানোর শখ আমার। কারাগারের ব্যবস্থা করবেন আপনি। বাকি ছোটবড় যা আছে, আমি সামলে নেব। তার জন্য অন্তত ক’টা দিন চাই। আপনি সেই কয়টা দিন পুলিশকে আমার বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে রাখুন। আপাতত এইটুকু মাস্ট বি।ʼʼ

মাথা নাড়লেন এমপি, “মুরসালীন সাবেক বিগ্রেডিয়ারের ছেলে। সরকারী ক্ষমতা সামান্য হলেও আছে বলা চলে। আর আমি আমার ক্ষমতার অপব্যবহার রয়েসয়ে করতে চাই। জানো–অতি ভজন মানুষের পাকস্থলীর হজমশক্তি কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে খেলে অনেক খাওয়া যায়। ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়া শিক্ষিত ছেলে। ওকে ভেতরে দিতে হালকা হলেও একটা টোপ চাই। যেন আমার রেপুটেশন সাফ থাকে, এমনকি আমার পালিত প্রশাসনের কাছেও।ʼʼ

-“আমি আপনাকে ভারী টোপ দিতে এসেছি।ʼʼ

ভ্রু জড়ালেন এমপি সাহেব, “হু?ʼʼ

চট করে অভিব্যক্তি বদলালো হামজা, “কিন্তু কথা হলো, আপনি নিতে পারবেন তো আচমকা?ʼʼ

এমপি সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। হামজা ভণিতা করার ছেলে না। বারুদ সে। হাভজার ভণিতায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন।

হামজা বলল, “আমার ওপরে রাগ করতে পারবেন না। আমি আসলে…আমার নিজেরও কিছুটা স্বার্থ ছিল বটে!ʼʼ

এই এক কথায় কাজ হয়ে গেল অবশ্য। এমপি সাহেব পণ করে নিলেন নিজের অজান্তেই, হামজা এখন চিরন্তন সত্যি বলবে।

-“এই, হামজা! ধাঁধা বানাবা না। তোমার মুখে সরাসরি কথা শুনতে ভাল্লাগে।ʼʼ

-“সীমান্তকে মুরসালীন খুন করেছে।ʼʼ

এমপি সাহেব যেন দুম করে দমে গেলেন চমকে। একেবারে দেবে বসে গেলেন সোফায়। হামজার মিথ্যেটা সত্যির চেয়েও বড় সত্যির হয়ে ওঠে মানুষের কাছে। কারণ হামজা দক্ষ, নিখুঁত তার ধূর্ততার চাল।

-“তুমি আজকে এই এখন আজ আমারে এই কথা বলতেছ? আমি পাগলের মতোন মাসের পর মাস খুনীরে খুঁজছি।ʼʼ ঝানু পলিটিশিয়ান হামজার সাথে টিকলেন না, দিশেহারা হতে দেখা গেল তাকে।

হামজা নির্বিকার চিত্তে বলল, “ওই যে বললাম স্বার্থ! আমি যদি তখনই বলে দিতাম, মুরসালীনই সীমান্তর খু^নী, আপনি ওকে তখনই মেরে ফেলতেন অথবা জেলে দিতেন। কিন্তু জয়ের পুরোনো হিসেব আর আমার উদ্দেশ্য ছিল ওকে দিয়ে। কিন্তু আমি সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম—ওকে দিয়ে আমার কাজ ফুরোলে আপনার হাতে তুলে দেবার। আজ সেই দিন।ʼʼ

এমপি সাহেব কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন। সীমান্ত এমপি সাহেবের স্ত্রীর বড়বোনের ছোটছেলে। হামজার বোনের সাথে ছেলেটার বিয়েতে এমপি সাহেবের হাত ছিল, তা হামজা জানে না। বিষয়টা আজও চেপে গেলেন। কেবল সীমান্তর মায়ের অবস্থাটা চোখে ভাসল। মহিলা ছেলের শোকে অন্ধ প্রায়। পুত্রবধুর নাম একবারও মুখে নেন না, নাতনির নামও না। কিন্তু ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। রোজ কল করে বলেন, “তুমি এমপি হয়ে কী লাভ? কী লাভটা কী?ʼʼ

এমপি সাহেবের ইগো খুব আঘাতপ্রাপ্ত হয়। উনার ইচ্ছে করল, এই মুহুর্তে সীমান্তর খুʼনী মুরসালীনকে ধরে খণ্ড খণ্ড করে পুকুরে শখ করে পোষা কুমিরকে খেতে দিতে। হামজা বরশী ফেলে চুপচাপ সোফার ওপর বসে রইল। এমপি সাহেবের ভাবুক মুখটা দেখে তার হাসি পাচ্ছে।

-“প্রমাণ আছে তোমার কাছে?ʼʼ

-“তা জোগাড় না করে খবর দেব আমি আপনাকে?ʼʼ

রাগ ভুলে একটু সন্তুষ্টি এলো ছেলেটার ওপর এমপির মুখে, কী আছে?ʼʼ

-“অস্ত্র। চাপ্পর দিয়ে কুঁপিয়ে মেরেছিল সীমান্তকে। সেটা রক্তাক্ত অবস্থায় আমি উদ্ধার করতে পেরেছি। শুকনো রক্ত।ʼʼ
এরপর ভীষণ দুঃখিত ভঙ্গিতে বলল, “আমি কীভাবে আমার বোনের বিধবা হবার এই শোক সহ্য করেছি, তা আর না বলি। শুধু বলব, মুরসালীনের ক্ষেত্রে আমি যতটা ধৈর্য ধরেছি, আর কেউ এতটা সুযোগ পায়নি আমার কাছে।ʼʼ

-“তুমি এখান থেকেই ঢাকা চলে যাবে?ʼʼ

হামজা জানালা দিয়ে অন্ধকার দেখতে দেখতে মাথা নেড়ে সায় দিলো। এমপি সাহেব জানালেন, “একটু আগে বড়ঘরে বাপ্পী কামরুল, দোলন সাহেব, রবিউল গেছে। জয় বাড়িতে না?ʼʼ

-“ও বড়ঘরেই আজ। ওরা কেন গেছে?ʼʼ

এমপি সাহেব চোখের শীতলতায় বোঝালেন, ওদেরকে ছিঁড়তে। একেকজন যদি দু-চারটে করেও মারে, “সেটুকুই বা আসে কোত্থেকে। মুখে বললেন, দোলনকে পাঠিয়েছি, শেষবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে। ঘাটিটা কোথায় ওদের সংগঠনের? জানা দরকার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দরকার ছিল না। আমি আর্মির ব্যাটাকে জিন্দা কবর দেব এবার। আর স্টেটমেন্টের চিন্তা করব না।ʼʼ

ঢাকা যাবার পথে জয়কে একবার কল করে জানতে ইচ্ছে করেছিল হামজার, বড়ঘরের খবর! আরমিণ হামজার অনুপস্থিতিতে কী ঘটাচ্ছে, তা নিয়েও ভাবনা এলো। কিন্তু তাকে সকাল হতে হতে রাজধানীতে পৌঁছাতে হবে।


জয় ফিরে এসে আবার বসল সেই লোহার খণ্ডের ওপর। অন্তূর হাতটা ধরা তখনও। অন্তূ দাঁড়িয়েই রইল। শরীর ভালো লাগছে না। চোখের সামনে মাঝেমধ্যেই অন্ধকার হয়ে আসছে। অবরুদ্ধ বড়ঘরটা জুড়ে ভ্যাপসা গন্ধ। পেট গুলিয়ে বমি আসতে চাইছে।

মুরসালীন জয়কে বলল, “তুই তো আমার কাছে এত সময় দিস না। আজ তোর গুরু কোথায় রে জয়?ʼʼ

-“তোদের নাম্বার লেগে যাচ্ছে তো! দোআ কালেমা পড়! ঢাকা গেছে।ʼʼ

মুরসালীন ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, “নয়ত আমার কাছে তোকে বেশিক্ষণ ছেড়ে রাখার রিস্ক সে নিতো না।ʼʼ

জয় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহটা হাঁটুর ওপর একটু ঝুঁকিয়ে বসে বলল, “তুই মারিসনি তো কে মেরেছে জিন্নাহকে? সত্যিই মরে গেছে রে জিন্নাহ?ʼʼ

মুরসালীন বলল, “জয়নাল আমিরকে মারার জন্য তুই আমার আব্বার হৃৎপিণ্ড খণ্ড করেছিলি, এবার যে জিন্নাহকে মেরেছে, তার কি করবি সেটা জেনেই আমি তোকে সব বলে দেব! বল।ʼʼ

জয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট উল্টে বলল, “আমি সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসতেছি, আমির বংশ নির্বংশ হবে। তারপর আসলেই সেইটার প্রক্রিয়া শুরু হইলো এক রাইতে, তখন আমার বয়স সাত। এটা বহুত লোকের আকাঙ্ক্ষা, কামনা–আমার বংশে কেউ থাকবে না। বড়বাবা এই কথাটাকে সহ্য করতে পারতো না। বড় হয়ে আমি টের পেলাম, আমিও পারি না। তুই জানিস মুরসালীন, আমার কেউ নাই? বাপ-দাদা-চাচা-ভাই…আমার আগে-পিছে কেউ নাই! আমি এতগুলো দিন দিলের ভিতরে পুষলাম আমি ছাড়াও আরেকটা দেহ আছে, যার শরীরে আমিরদের রক্ত বইছে। আইজ তুই কস, সেও নাই। তাইলে আমি যে এমন বহুত লোকরে মারছি, যারা আমারে নির্বংশ, লেজকাটা বলছে, তাদের কাছে যাইয়া আমার কি এখন মাফ চাওয়া উচিত?ʼʼ

মুরসালীন চুপ করে কেবল জয়ের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ! জয় ঢালাই মেঝে দেখছে। সে নিজের কথা বলার সময় মানুষের চোখ চোখ রাখে না। বড় ভয়, লোকে চোখের কথা না পড়ে ফেলে!

মুরসালীন বলল, “এমন অসংখ্য সত্ত্বার কাছে মাফ চাওয়ার আছে। কিন্তু আফসোস, তুই তাদেরকে পাবি না আর। তারা কেউ আর তোকে ক্ষমা করতে দুনিয়াতে নেই।ʼʼ

জয় হেসে ফেলল, “তার মধ্যে প্রধান তোর বাপ আর ভাই। তাই তো?ʼʼ

-“হতেও পারে। যদি বলি হ্যাঁ, খুব ভুল হবে না। কেন জানিস?ʼʼ

-“হ জানি। কারণ তোর বাপ আমার দেবতা আছিল। কত আদর যত্নে আমারে বন্দি কইরা রাখছিল, কত সুন্দর দিন কাটাইলাম, সেলিমরে চোখের সামনে দেখতে দেখতে পাগল হইলাম!ʼʼ

মুরসালীন বড় আফসোসের সাথে বলল, “তুই সেই মানুষটাকে কেবল নিজের নোংরা, পাগলাটে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ভুল বিচার করে খুব নৃশংস মৃত্যু দিয়েছিস, যে তোকে তিনটা বছর আগলে রেখেছিল!ʼʼ

জয় কেশে উঠল, “আগলে রেখেছিল? কস কী বাপ? মাথা ঘুরতেছে। একগ্লাস নেবু পানি খাইতে পারলে জানডা শান্তি লাগতো।ʼʼ

-“এটাও স্বাভাবিক। একজন অবিশ্বাসীর কাছে ধর্মীয় আচার শিক্ষাটা জুলুম মনে হওয়াই উচিত।ʼʼ

জয় মাথা দুলালো, “নাহ! আমি অবিশ্বাসী কে বলে? আমি হইলাম একজন সচেতন লোক। আমার বিশ্বাসের ম্যালা দাম। আবার আমার এই অবিশ্বাস বারবার ঠিক প্রমাণিত হইছে। কেমনে শুনবি?ʼʼ

মুরসালীন তাকিয়ে রইল। জয় বলল, “আমি নিজে বহুত মাইনষের কাল হইছি, যারা বিশ্বাসী–ধর্মে, পালনকর্তায়। কিন্তু ওদের ধর্ম আর পালনকর্তা ওদেরকে আমার হাত থেকে রক্ষা করে নাই। যেমনটা আমারে করে নাই!ʼʼ কাধ ঝাঁকাল জয়।

হতাশ সুরে চোখ ফিরিয়ে বলল মুরসালীন, “তুই জন্মেইছিস অবিশ্বাসী হয়ে, জয়। যে পঙ্গু কারণগুলো তুই তোর খোদাদ্রোহ অথবা দেশদ্রোহের দেখাস, তা শুধুই তোর স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ।ʼʼ

জয় মুচকি হাসল, “এই অবিশ্বাস আমার খুঁটি, মুরসালীন। আমি বিশ্বাস করতে জানলে কবে কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাইতাম। আমি আমাকে মানি, শুধু আমাকে। কিন্তু যখন বিশ্বাসের কথা ওঠে, আমিও আমার কাছে বেকার। আমি শুধু মানি, জয় আমির নিজে নিজেকে বানিয়েছে অপরকে ভেঙে, সে হাসতে শিখেছে মানুষকে কাঁদিয়ে। মানুষ তারে নিজ থেকে কিছু দেয় নাই, মাঝেমধ্যে তো বাঁচার জায়গাটুকুও দিতে চায় নাই! তোর আল্লাহ কিছুই দেয় নাই তারে। একটা পরিবার, একটা ঠিকানা, একটু সঙ্গ, একটু স্নে……এই অ-ভরসা তোর ধর্মের হাতে কামানো। তোর ধর্ম তোরে কী দিছে? এই বন্দিদশা?ʼʼ

-“বন্দি তো তুইও! তোর নফসের কাছে বন্দি, তোর অপ্রকৃতিতস্থ, বিকৃত চিন্তাধারার কাছে বন্দি। মদ ও পাপ সেই কারাগার, যা মানুষকে সাময়িক সস্তি দেয়, সাথে দেয় চিরস্থায়ী বন্দিত্ব। এই দুটোর মাঝে বিরতি এলেই পাপী ও নেশাগ্রস্থর ছটফটে মৃত্যু অনিবার্য! তোর রুহ্ সেই পাপের কাছে বন্দি।ʼʼ

ঠোঁট বাঁকাল জয়, “আর তুই অন্ধবিশ্বাসের কাছে। দেখ ভাই, আমি বিশ্বাস করি না। আমার জীবনডা খারাপ। তুই একজন খাঁটি বিশ্বাসী, ভালো লোক। তোর জীবনডা আরও খারাপ। তাইলে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীর পরিস্থিতি যদি একই হয়, আমি খালি খালি আমার বিশ্বাস খরচা করবডা ক্যান? বিশ্বাস বেচে একদিন বড়লোক হবো আমি।ʼʼ

মুরসালীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল, “বিশ্বাস করতে শক্তি লাগে। অসীম শক্তি। তুই ভীষণ দূর্বল, জয়। বিশ্বাস হলো কাঁচ। যা ঠুনকো আর ততটাই ধারালো। যখন-তখন ভেঙে যাবে আর তা বিঁধলে সেই রক্তক্ষরণে তোর মৃত্যুও হতে পারে। কাচ ভীতুদের হাতিয়ার হতে পারে না। কাচ নিয়ে খেলতে সিনা চাই বিশাল। তুই ভীতু। তোকে সামান্য আঘাতেও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলা যায়। আর সেই ভাঙনটা ধরে ভেতরে। যেটা আরও ভয়ানক।ʼʼ

জয় মাথাটা নত করে নিঃশব্দে হাসল, “তুই আমার অতখানি সহ্য করিস নাই।ʼʼ

মুরসালীন হেসে উঠল, “তাই তো। আমি তোর অতখানি সহ্য করিনি, তোর চেয়ে বেশি হয়ে গেছে।ʼʼ

জয় আলতো মাথা নাড়ে, “তাই নাকি?ʼʼ

-“আমি-তুই শুধু পথের বৈপরিত্যে আলাদা, নয়ত আমার কাছে সবরকম সুযোগ ছিল তুই হয়ে যাবার!ʼʼ

জয় দু’পাশে মাথা দুলিয়ে হাসল, “আমি হওয়া সহজ না।ʼʼ

-“খুব সহজ। তুই হওয়া খুবই সহজ।ʼʼ

-“বলিস কী? প্রসেসিংটা বল তো! আবার জন্মাইলে সহজ পদ্ধতিটা ট্রাই করব জয় আমির হবার। প্রসেসিং কী?ʼʼ

-“পঙ্গু দৃষ্টিভঙ্গি, ঠুনকো বিশ্বাস, অপাত্রে কৃতজ্ঞতা, একপাক্ষিক বিচার, স্বার্থলোভী ধর্মভরসা…!ʼʼ

-“আবার সেই ভরসা- বিশ্বাসের প্যাঁচাল! সম্বন্ধির ছাওয়াল আমি অবিশ্বাসী তাতে তোর আব্বার কী হে? তোরে তো আমি আমারে হেদায়েতের নসিহত করতে বলি নাই!ʼʼ

-“ধর্ম ছাড়া যে কেউ তুই। আমিও হয়ে যেতাম। ওই যে বললাম সব সুযোগ ছিল। শুধু পারিবারিক শিক্ষা ও দৃষ্টিভঙ্গিটা আলাদা হওয়ায় আজ আমি-তুই প্রধান বিরোধী!ʼʼ

–“আমার তো পরিবার নাই!ʼʼ

-“আমার কাছে যে পরিবার ও শিক্ষা ছিল তা অন্তত তোর কাছেও ছিল! কিন্তু সেটাকে তুই ভরসা করিসনি, উল্টো ঘেন্না করেছিস, সেই শিক্ষাগুলোকে শত্রু মেনে নিয়ে সেটার বিরুদ্ধে বরং লড়াই করেছিস।ʼʼ

জয়ের নাক শিউরে উঠল, “তোর-আমার পরিস্থিতি কি এক ছিল?ʼʼ

মুরসালীন জবাব দেয়, আংশিক না। পরে হ্যাঁ। তুই আমার আব্বাকে মেরেছিস, তখন আমরা তিন ভাইবোন অন্তত ততটুকু ছোট, যখন আব্বাকে আমাদের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। কিন্তু সেই বয়স থেকে দলীয় হামলায় যাযাবর জীবপ-যাপন করেছি আম্মাকে সাথে নিয়ে। শেষমেশ আব্বার বদৌলতে মুরসালীন একটা চাকরি পেল, কিন্তু তাকে সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ এলো। এই আমি জেল খাটা, পুলিশের হয়রানী, তোদের দাবরানি খেতে খেতে অনার্স পাশ করলাম। তোর শরীরের আঘাতের চিহ্ন গুণে আমার সঙ্গে মিলিয়ে নিস, পূর্ণ আছে। তারপর আমার বোন…ʼʼ

মুরসালীন কেমন কোরে যেন হাসল এই পর্যায়ে, “পার্থক্য হলো এসব আমাকে আমার পথে আরও অটল করেছে, আর তোকে ছিটকে বিপথে নিয়ে ফেলেছে। পার্থক্য ওই বিশ্বাস আর দৃষ্টিকোণের! আজ এতগুলো দিনে আমার রক্ত ছাড়া আর কিছু বের করতে পারেনি তোর গুরু। হয়ত এটা আমার বিশ্বাস, আমার ধর্মবিশ্বাস, আমার একত্ববাদ..

তুই স্বার্থে আল্লাহকে তোর রক্ষার হাতিয়ার কল্পনা করেছিস, কখনও তাকে বিশ্বাস, মনে-প্রাণে ভরসা অথবা পালন করিসনি। তোকে বলা হয়েছিল, আল্লাহ রক্ষাকর্তা। যখন তোর বিপদ এলো, তোর আল্লাহর কথা মনে পড়ল। কিন্তু বিপদ রক্ষা হলো না, তুই বিমুখ হয়ে গেলি! ধর্মবিশ্বাস তোর কাছে বিপদের হাতিয়ার হয়েছিল, জীবনটা তোর কাছে এক্সপেরিমেন্টাল হয়েছিল। তুই তোর চাচার ধাচে গড়ে ওঠা এক অন্ধ, স্বার্থন্বেষী!ʼʼ

-“ইনডাইরেক্টলিও স্বার্থপর বলিস না আমাকে। আমার ভেতরে বেঁধে। ভায়োলেন্স হয়ে যাইতে পারি।ʼʼ

-“ঠিক আছে। ডাইরেক্টলি বললাম। তুই খুব নিম্নমানের স্বার্থবাদী, সুবিধাভোগী মানুষ।ʼ৻

জয় মাথা নাড়ল, “মেজাজ বদলাস না আমার। বড়বাবা আসবে না এখানে। আমাকে বল।ʼʼ

দোলন সাহেব হেসে বলে উঠলেন, “মুরসালীন মহান, সেই একটা জয়নাল আমির তো তোমার ভেতরেও আছে!ʼʼ

মুরসালীন ইঙ্গিত বুঝল। তার চোখদুটো দিয়াশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠল, সেই চোখ সামলে অদ্ভুত হেসে বলল, “আমি মুরসালীন পাঁচশোবার জন্মালে হাজার বার আমার বোনের ধর্ষককে বলি দিয়ে সেই রক্তে গোসল করব, স্যার। এখানে কোনো যুক্তি-তর্ক, ঠিক-বেঠিক, আইন-ধর্মের কোনো ঠাঁই নেই। এসবে কোনো আফসোস ও পাপের চিন্তা আমি রাখিনি ভেতরে। শুধু জানি, আমার বোনের ধর্ষকের রেহাই নেই, যতদিন আমার শ্বাস চলছে। হুমায়ুন পাটোয়ারীর মৃত্যু আমার হাতে লেখা ছিল, আরেকজনেরটা বাকি।ʼʼ

দোলন সাহেব জানালেন, “তারটা তোমার হাতে লেখা ছিল না।ʼʼ

মুরসালীন ভ্রু জড়াল, “পলাশ আজগর মরে গেছে, স্যার! কে মেরেছে?ʼʼ

দোলন সাহেব চুপ রইলেন। অথচ মুরসালীন চট করে ধরে ফেলল ব্যাপারটা, “কেন? জয় তার দোসরকে মেরে ফেলেছে কেন? ও কি ওর কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীকেই মৃত্যু ছাড়া অন্য প্রতিদান দেয় না? কী চলছে বাইরে?ʼʼ

দোলন সাহেব প্রসঙ্গ ধরলেন, “জয়নাল আমিরের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা কেন, মুরসালীন? জয়নব ও জেবাও জয়নালের বোন ছিল, মুরসালীন।ʼʼ

মুরসালীনের চোখ কি ভিজে উঠেছে! বিস্মিত হলো তাকে দেখা মানুষগুলো। এই মুরসালীন রক্তে গোসল করে উঠলেও পাথরের মতো অনড়, আজ তার কণ্ঠস্বর ভেঙে এসেছে।

মুরসালীন তা লুকোতে আলগোছে হেসে উঠল, “এই দুনিয়ার প্রত্যেকটা ভাই একেকটা জয়নাল আমির হোক! আমিও জয়নাল আমির, স্যার! কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমার জয়নাল আমির’ত্বে নিজের বোনের ইজ্জতের বদলে অন্যের বোন-মায়ের ইজ্জতের নেশা নেই। যা আমির বংশে আছে।ʼʼ

-“আমার জানামতে জয় তখন দিনাজপুরে ছিল না।ʼʼ

-“যায়-আসতো না, স্যার। ভাড়াটে লোক দিয়ে সৈয়দ বাড়ির নারীদের ইজ্জত ছিনতাই করা মানুষের ভাতিজা জয়। ইজ্জতের বদলে ওরা ইজ্জত নিতে জানে, স্যার। নিজের স্ত্রীকেও ছাড় দেয়নি। সেই ইতিহাসও পড়া আমার।ʼʼ

অন্তূ আশ্চর্য হয়ে বসে পড়ল মেঝের ওপর। জয় এখনও সেই ঢালাই মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। একটাবারও চোখ তুলে তাকায়নি, যতক্ষণ দোলন সাহেব ও মুরসালীন কথা বলেছে। অন্তূ অন্তত এবার আশা করেছিল জয় মুরসালীনকে কঠিন আঘাত করবে। জয় ঝুঁকে বসে ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি কপালে ঘঁষছে। মুখটা শক্ত, নাকের পাটা শিউরে উঠেছে, কিন্তু শান্ত! চাপা অস্থিরতা কপালের ভাঁজে দেখা গেল। একহাতে তখনও অন্তূর হাত।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে জয় কেবল জিজ্ঞেস করল, “জিন্নাহরে কে মারছে মুরসালীন?ʼʼ

দোলন সাহেব কিছু বলতে গিয়েও থামলেন। আর লাভ নেই। মুরসালীন চোখ দুটো আলতো করে বুজে হাসল, “তোর গুরুকে জিজ্ঞেস করতে হবে।ʼʼ

জয় মুখ তুলে চাইল। অনিয়ন্ত্রিতই তার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে অন্তূ হাত শক্ত করে চেপে ধরল আরেকটু।

মুরসালীন হাত নেড়ে বিদায় জানাল, “যাহ্ এখন। আর কথা বলতে ভালো লাগছে না।ʼʼ

মুরসালীন আর তাকাল না জয়ের দিকে। সে তার ছেঁড়া শার্টের একপ্রান্ত ছিঁড়ে শরীরের ধুলোবালি ও শুকনো রক্ত মোছার চেষ্টা করল। তাজা ক্ষততে পানি লাগলে ভীষণ জ্বালা ধরে। আশেপাশে পানিও নেই। মুরসালীন তায়াম্মুম করে ফজরের নামাজে বসল।

জয় আস্তে কোরে উঠে দাঁড়াল অন্তূকে নিয়ে। অনেকক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। তিনটে দেহ অচেতন হয়ে পড়ে আছে। হাসপাতালে পাঠানো দরকার। তার সেসব আর ইচ্ছে করছে না। এমপি সাহেব এদের অবস্থা জানার পর আরেকটা ঝড় আসবে। আসতে পারে আরমিণের ওপরও! কিন্তু জয়ের মাথাটা ফাঁকা লাগছে।

মুরসালীন নামাজে সালাম ফিরিয়ে বসল, তখনও জয় দাঁড়িয়ে। তার আশপাশে অনেকগুলো ছোট ছোট দেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে আছে। দু একজন ঘুম ভেঙে আধো চোখ খুলছে আবার শরীরের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ছে।

জয় খানিক পরে সব ওভাবেই ফেলে অন্তূকে নিয়ে দোতলায় উঠে এলো। অন্তূর শরীর চলছে না। কোনোরকম সে অযু করে এসে নামাজে বসল।

কোনো কথা নেই। খানিকটা দূরে বসে জয় মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে মন ভরে খানিকটা মদ খেলো। এরপর শরীরে একটা সাডেটিভ ইঞ্জেকশন পুশ করে শুয়ে পড়ল।

সারাদিন একটানা ঘুমিয়ে ঘুমটা ছুটল মাগরিব আজানের পর। অন্তূ নামাজে বসেছে। জয় চোখ বুজে উপুড় হয়ে পড়ে রইল। কিন্তু এর মাঝে অন্তূ আচমকা নামাজের মাঝে উঠে বাথরুমে দৌড়ায়। তার পায়ের আওয়াজে ঝিম ছেড়ে গেল জয়ের। এক দৌড়ে বাথরুমে পৌঁছে অন্তূকে ধরল, “কী হইছে? এই মেয়ে!ʼʼ

অন্তূ তাকাল। জয় আবার শুধায়, “কী? ওইভাবে দৌড়ায়ে আসলা ক্যান? শরীর খারাপ?ʼʼ

-“উহু!ʼʼ

অন্তূ জয়কে ছাড়িয়ে চোখে-মুখে পানি দিলো। তখনও কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে জয়।

অন্তূ বলল, “আপনার বড়ঘরে গেলেই আমার শরীর খারাপ হয়। তার ওপর আপনার যা মন মাতানো জীবনের গল্প! মানসিক ভাবে খালি পাগল হওয়া বাকি। আর তো শরীর! আমি ঠিক আছি। আপনার খাবার বাড়া আছে। খেয়ে আসুন।ʼʼ

জয় আচমকা অন্তূকে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। অন্তূ ঘটনার আকস্মিকতায় মৃদু চেঁচিয়ে উঠল, “এই এই! জয়। নামান আমাকে। নেশা চড়ে গেছে আপনার। নামান, নামান! পড়ে যাব আমি। এটা কী ধরণের কাজ? নামান! আল্লাহ!ʼʼ

গম্ভীর মুখে বলল, “চুপ। আমার সাথে ছলনা করবে না। নেশা করে কেন, মরার পরও তোমার বোঝা ওঠানোর সাধ্যি আছে জয় আমিরের। ঘুমাইছো? নাকি সারাদিন সংসার সামলানোর নাটক করছো? কী হইছে তোমার? চেহারার এই হাল কেন?ʼʼ

-“আমার সত্যি কিছু হয়নি। আশ্চর্য! দিব্যি ভালো আছি আমি। আপনার মতো আনহাইজিনিক পরিবেশে কমফোর্ট থাকার অভিজ্ঞতা নেই আমার।ʼʼ

জয় অন্তূকে বিছানায় টানটান শুইয়ে দিয়ে ওভাবেই ঝুঁকে রইল। জয়ের চোখে চোখ পড়লে অন্তূ মুখ ফেরায়।

জয় আচমকা অন্তূর গালটা ধরে নিজের দিকে ফেরালো, “আমার দিকে তাকাও! কী হইছে? কেমন লাগতেছে? আমি তোমার জীবনে কাল হয়ে তো বহুকাল আগেই আসছি, কিন্তু শরীর-চেহারায় এইরকম দূর্বলতা নতুন। অসুস্থ তুমি? ঘুমাওনি?ʼʼ

অন্তূ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। জয় কখনোই এভাবে নমনীয়তার সাথে, এমন হুটহাট তাকে ছোঁয় না। ইগোর চোটে ছোঁয়-ই না বলা চলে। অন্তূ জয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “কিচ্ছু হয়নি। ঘুমেরই অভাব। এই যা!ʼʼ

জয় সোজা হয়ে বসল বিছানায়, একটা বড় করে শ্বাস ফেলে আড়মোড়া ভাঙল। চট করে নিজের চিরায়ত রূপে ফিরল, “আমার ধারণা আমার এত দুক্কের গল্প শুনে আপনার উপরে তুমার একটা পিরিত পিরিত ভাব আইছে। নতুন প্রেমের আছড়। ঠিক না, ঘরওয়ালি?ʼʼ

অন্তূ চোখ বুজে ঘাড় কাত করে শুয়ে বলল, “আপনি আমার সেরকম স্বামী নন। আপনি স্বামী হবার আগে আসামী আমার! আপনার সামান্য একাংশের প্রেমে পড়াই যায়, অথচ বাকি অধিকাংশকে এড়ানোর উপায় কই!ʼʼ

জয় কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখল অন্তূকে। অন্তূর সৌন্দর্যে একটা ম্লান ছায়া পড়েছে। উজ্জ্বলতা হারানো মৃত তারকার মতোন এক অন্ধকার নেমেছে। জয়কে কেউ ভেতর থেকঃ ডেকে শুধায়, ‘এর দায় তোর নয় তো, জয়!ʼ

জয় অস্বীকৃতি জানায়, ‘আমার কেন?ʼ

ভেতর থেকে উত্তর আসে, ‘তুই যে সৌন্দর্য খুঁজছিস তা আমজাদ আলী প্রামাণিকের মেয়ের, তুই যা দেখছিস তা তোর স্ত্রীর! তাহলে দায় কার?ʼ

‘স্ত্রীর!ʼ কথাটা বিঁধল ভেতরে। আজ এই কথাটাকে নিয়ে মুরসালীন অপমানজনক ইঙ্গিত করেছে। জয়ের ভেতরে একটু আক্রোশ জেগে উঠল। তার স্ত্রী, অথচ সে-ই আসামী! এমনটাই তো বুঝিয়েছে মুরসালীন!

এখনও মেয়েটার শারীরিক সৌন্দর্য অক্ষত। চিকন স্বর্ণের চুড়ি পরা হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে শুয়েছে। সেই হাতদুটো সুন্দর। জয়ের চোখে অন্তূর শরীরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ, অন্তূর গলার নিচটা। ফর্সা গলায় স্বর্ণের চেইন। বরাবর জয়ের চোখ লেগে যায় ওখানে।

জয় অন্তূকে ডিঙিয়ে ওপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। অন্তূ উঠে বসে। জয় চোখ বুজেই হাত চেপে ধরল, “উঠো না, ঘরওয়ালি। শুয়ে থাকো আমার সাথে।ʼʼ

‌-“নামাজ শেষ হয়নি আমার। খেয়ে আসুন আপনি।ʼʼ

জয় অন্তূর হাত আরেকটু চেপে ধরে বলল, “নামাজ কাজাও পড়া যায়। আমি একটু ঘুমাবো তোমাকে সাথে নিয়ে। শরীর-মেজাজ কোনোটাই ভালো না। আমার পাশে শুয়ে পড়ো।ʼʼ

অন্তূ কপাল জড়িয়ে তাকাল জয়ের দিকে। নিশ্চিন্তে চোখ বুজে শুয়ে আছে। শক্ত করে চেপে ধরে আছে অন্তূর হাত। এই কাজটা আজ সারারাত থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার করেছে।

অন্তূ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করল, “জিন্নাহ আমিরকে যদি হামজা সাহেব মেরে থাকেন!ʼ

জয় চোখ খুলে সোজা অন্তূর চোখের দিকে তাকায়। নির্ঘুম চোখদুটো লাল, সজাগ।

চলবে..

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৭৩.

সৈয়দ ফরহাদ মুহাম্মাদ বারীকে মেরে জয় পাগল হয়ে উঠল জিন্নাহ ও তার মাকে খুঁজতে। পেলো না। চারদিকে তোলপাড় উঠে গেল ব্রিগেডিয়ারের মৃত্যুর খবরে, যেখানে তখন বাংলায় তাদের অনুকূল সময় চলছে।

সিনিয়র বিগ্রেডিয়ার বারী সাহেবকে প্রমাণহীনভাবে খুব সহজে মারতে পারার পেছনে অবশ্য একটা কারণ ছিল। জয় খুব সহজে ফরহাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিল, সেটাও একান্তে, ফরহাদ সাহেবের রাজধানীর ফ্ল্যাটে। দিনের বেলা।

জয় চলে আসার পর তিনি অধীর অপেক্ষা করেছেন, জয় দেখা করতে আসবে, একটাবার হলেও আসবে। জয় যায়নি। ফরহাদ সাহেব জানতেন জয় তাঁকে বড় ঘৃণা করে। কিন্তু তবু আশা রেখেছিলেন। বাঁকা জয়ের প্রতি একটা অঘোষিত স্নেহ তাঁর জমেছিল ভেতরে।

জয় অবশেষে উনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। মানুষটা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। আবার একটু লজ্জিতও। জয় নিশ্চয়ই জবাবদিহি চাইবে–কেন তিনি জয়ের বড়বাবাকে মেরেছেন? জেদি ছেলেটা কর্তব্যের মানে বুঝবে না। যাকে ছোটবেলায় নৈতিকতা শেখাতে গিয়েই নেতিবাচক চরিত্রে পরিণত হয়েছে তিনি।

জয় কেবল একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিল, “বড়বাবাকে মারলেন কেন, স্যার?ʼʼ

ফরহাদ সাহেব একটু কথা গুছিয়ে নেবার ফাঁকে জয় আবার বলে, “আপনি জানেন আমার কেউ নাই। আমার খাতিরে ছেড়ে দিলেন না কেন? সব তো কেড়ে নিছেন। দেখেন, আপনারা সফল। আমার কাছে কেউ নাই, কিচ্ছু নাই। আপনি আমার বড়বাবাকেও নিয়ে নিলেন। কেন, স্যার? আমি তো আপনার কিছু ক্ষতি করি নাই! করছি, স্যার?ʼʼ

বারী সাহেব সামান্য হেসে জয়কে হাত নেড়ে কাছে ডেকে বলেছিলেন, “তুই যে আইন মানতে নারাজ রে আমিরের ব্যাটা! নয়ত তোরে বুঝাইতাম!ʼʼ

-“আইন সব আপনাদের কেন? আমরা কেন আইন পাই না? আইন তো আমাদেরও দরকার পড়তে পারে, স্যার! পাই না কেন?ʼʼ

জয় আমির কাঁদতে পারবে না। তাই শুধু তার চোখের মণির শিরা লাল টকটকে হয়ে উঠল। নয়দিন আগেও সে তার বড়বাবার স-ঙ্গে দেখা করবে ভেবে উত্তেজনায় কাঁপছিল। তার মনে পড়ে গেল, সেই বড়বাবাকে চিরতরে তার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার হুকুমদাতা বিগ্রেডিয়ার তার সামনে। জয় প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করার ধৈর্য পায়নি।

শেষ মুহুর্তে ফরহাদ সাহেবের মুখে একটা জ্যোতিময় হাসি ফুটে উঠেছিল। সেই হাসিতে ব্যথা ছিল, ছিল মলিনতা! তার চোখদুটো গভীরভাবে শুধু জয়কেই দেখছিল। তিনি শুধু বলেছিলেন, “তুই এই পথে যাবি বলেই আশংকা করেছিলাম রে আমিরের ব্যাটা! দো’আ থাকল, আল্লাহ তোরে পথ দেখান! ধৈর্য দিন!ʼʼ

তিনি অস্পষ্টভাবে কালেমা শাহাদত পড়লেন–’আশ্শহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লাল্লাহ্…ʼ

জয় সেসব কিছুই দেখতে পায়নি। তখন তার চোখের সামনে এক অবরুদ্ধ নিশীথের আঁধার পর্দা। সেই পর্দায় বড়বাবার কঠিন মুখটা ভাসছে। জয় শেষবার সেই রাতে বড়বাবার কোলে চড়ে যে বড়বাবার চেহারাটা দেখেছিল–অভিজাত, কঠিন লাল, গম্ভীর মুখখানা! সে সেই মুখখানা দেখতে দেখতে বড় নৃশংসতার সাথে ফরহাদ সাহেবকে খু”ন করে ফেলল। বড়বাবা তাকে তখনও বলছে, ‘হাসবি শুধু। হাসবি, জয়। হাস্!ʼ

জয় হাসল। ফরহাদ সাহেবের রক্তে মাখা হাত টিস্যুতে মুছতে মুছতে জোরে জোরে হাসল। চোখদুটো জ্বলছে। তখন জয় আরও জোরে জোরে হাসতে হাসতে নির্জন সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো।

দিনাজজপুর ফেরার পর হামজা জয়কে আবার পাঠিয়ে দিলো রাজন আজগরের কাছে। তখন রাজন আজগর নিজেই দেশে ছিলেন না প্রাণ বাঁচাতে। কিন্তু তার লোকেদের সঙ্গে জয় রাজধানীতে থাকতে পারবে।

জয়কে পাওয়া গেল না বলে হামজাকে রিমান্ডে নেয়া হলো। উল্টো করে ঝুলিয়ে কাঁচা বাঁশ দিয়ে পেটানো হলো। ত্বকের নিচে রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে ধরে গেল। পাথরের দেয়ালে আঘাতের প্রতিধ্বনি ওঠে, তবু হামজা বলে না, জয় কোথায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর সামান্য চিকিৎসায় আবার চেতনা ফেরানো হলো তার।

একুশ বছরের এক যুবকের এই সহনশীলতায় কর্মকর্তারা হয়রান হলেন। হামজাকে আশ্বাস দিলেন, “আমরা শুধু জয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করব। তুমি বলছো সে খু-ন করেনি। তাহলে সামনে আনতে সমস্যা কোথায় জয়কে?ʼʼ

হামজা বলে, “আমি জানি না স্যার জয় কোথায়? আমি কিছুদিন যাবৎ হলে ছিলাম। আমার সঙ্গে ওর দেখা হয় না। ও কোথায় আমার জানা নেই।ʼʼ

-“তুমি জয়ের বাপ-মা, তুমিই তার সব, সবাই জানে। অনেকে একই সাক্ষী দিয়েছে। বেশি শেয়ানাগিরি করলে একেবারে ভেতরে ঢুকিয়ে দেব। তখন এই শেয়ানাগিরি পেছন দিয়ে যাবে।ʼʼ

-“তাই দিন। যেখানে আমি জানিই না জয় কোথায়, তাহলে ভেতরে রাখলেই কী বাইরে রাখলেই বা কী? জয় কিন্তু একদম বাচ্চা ছেলে না, স্যার। আপনারা সন্দেহ যখন করেছেন ওকে, ওর কি জানের মায়া নেই? আপনাদের মিথ্যা অভিযোগের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়েছে হয়ত।ʼʼ

বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন কর্মকর্তারা। হামজার কথায় উনারা নিজেরাই পেচিয়ে গেলেন এই সংশয়ে– আসলেই কি জয় আমির খুনটা করেছে নাকি করেনি!

কিন্তু হামজার ওপর টর্চারিংয়ের চতুর্থ দিন জয় এসে হাজির, সে আত্মসমর্পণ করল। কর্মকর্তারা দুই ভাইয়ের কার্যক্রমে হতবাক হয়ে গেলেন। জয় এসে বলল, “আপনারা নাকি আমারে খুঁজতেছেন?ʼʼ

-“খুন করে পালালে তো খুঁজবোই।

-“পালালে কেউ এসে ধরা দেয় না, স্যার! আর খুন করলেও না। আপনাদের সমস্যাটা হইলো—আসল খুনিকে খুঁজে না পাইলে আমার মতো দূর্বল, নিষ্পাপদেরকে টার্গেট করেন কেইস ডিসমিস করার জন্য। দুঃখজনক।ʼʼ

জয়ের কথায় সবাই যেমন বিভ্রান্ত হলো তেমনই ওর দুঃসাহসে হতবাক! জয় হামজার সাথে দেখা করার জন্য সামান্য একটু সুযোগ চাইল। যেহেতু সে নিজে এসে আত্মসমর্পণ করেছে, সে অনেকটা ছাড় পেল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে নেবার আগে হামজার সেলেই রাখা হলো।

হামজা আক্রমণাত্মক হয়ে তেড়ে এলো, “শুয়োরের বাচ্চা। এখানে এসেছিস কেন? মরার এত শখ হয়েছে তোর?ʼʼ

-“নিজের শখ আমার উপরে চাপাইও না, বড়সাহেব। খুন তো করছিই! তা স্বীকার না করে মার খাচ্ছ তুমি। মরার শখ আমার হলো কীভাবে?ʼʼ

হামজা গলা চেপে ধরল, “আমি মার খাচ্ছি তাতে তোর বাপের কী? তোকে বলেছিলাম না আন্ডারগ্রাউন্ড থাক। সময় ভালো না! ক্যান আসছিস এইখানে?ʼʼ

জয় একগাল হাসল, “একা একা মার খাচ্ছ, ব্যাপারটা ভালো লাগতেছিল না। আমার ভাগ নিতে আসলাম। হক ছাড়া যাবে না।ʼʼ

হামজা দিশেহারা হয়ে পড়ল, “বাইঞ্চোদের বাচ্চা! একবার ধরা খাইলে আর ছাড়া পাবি না। নিশ্চিত মার্ডার! শালার.. তোরে…আমি তোরে কী করব ক তো! এইজন্যে তোরে আন্ডারগ্রাউন্ড করছিলাম রে হারামির বাচ্চা?ʼʼ

জয় আরাম করে নোংরা মেঝেতে টানটান হয়ে শুয়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে পা দুলাতে দুলাতে বলে, “তুমি একবার আমারে কইছিলা, ‘একসাথে বাঁচতে না পারলে একসাথে মরে যাব। একা একা বেঁচে থাকার দরকার নেই। বুঝলি, জয়?ʼ আইজ তার পরীক্ষা দিবার আইছি। আমার তো কেউ নাই। তোমারে এরা এমনে শ্যাষ কইরা ফালাইলে আমি বাল বাইরে এমনেই মইরা যাইতাম!ʼʼ

হামজা শক্ত করে জয়ের হাতটা চেপে ধরে ধরেই রাখে। অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, “চুপ থাক। তোর কথা কানে ঢুকলে রক্ত গরম হচ্ছে।ʼʼ

জয় বেহায়ার মতো দাঁত বের করে একটু হাসল। এখন তার চোখে-মুখে একটুও ভয় নেই। হামজা মার খাবে আর সে পালিয়ে থাকবে এ আবার কোনদেশি কথা?

জয়কে যখন নিতে আসল ইন্টেরোগেশনে নেবার জন্য, কোনোভাবেই হামজার হাতের বাঁধন থেকে জয়কে ছাড়ানো গেল না।

পুলিশ কাঠের লাঠি দিয়ে হামজার কব্জির ওপর মারল এক বাড়ি। খট করে শব্দ হয়ে কব্জিটা বোধহয় ছুটেই গেল! জয়ের হাত ছুটে গেল। পুলিশেরা একটা পন্থা নীরবেই পেয়ে গেল। হামজার সামনে জয়কে মারতে শুরু করা হলো।

জয়কে প্রশ্ন করা হলে সে উত্তর না দিয়ে বরং উল্টো-পাল্টা প্রশ্ন করছিল। যেমন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “খুনটা তুই কেন করেছিস, জয়?ʼʼ

জয় জিজ্ঞেস করল, “খুন করা কি খারাপ?ʼʼ

-“তোর মতে কি ভালো?ʼʼ

সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি যদি খুন করি, আমার কী শাস্তি হবে?ʼʼ

-“প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর তোর ফাঁসি হতে পারে। করেছিস কি না খুন, তাই বল।ʼʼ

-“খুন যে করবে তারই ফাঁসি হবে?ʼʼ

-“ধরা পড়লে অবশ্যই শাস্তি হবে।ʼʼ

জয়ের ভেতরে এবার নিজের কৃতকর্মের ওপর দৃঢ়তা এলো। সে একটুও পাপ করেনি। তার গোটা পরিবার খুন হয়েছে। তার বদলে সেই খুনীদেরকে জয় তাদেরকে দিলেই বরং সেটা আইন। গোটা সৈয়দ পরিবারকে মরতে হবে। এজন্য তাকে বাঁচতে হবে। মরতে অবশ্য তার খারাপ লাগে না। কিন্তু শাস্তি না দিয়ে মরা যাবে না।

তাকে মারতে মারতে প্রায় জ্ঞানহারা করে ফেলা হলো। কিশোর বলে ছাড় পেল না সে। কিন্তু স্বীকার করল না কিছুই।

এক সময় কান ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে জয়ের। মেঝেতে পড়ে নাকে আঘাত পাবার পরেও জয় নিজের সবটুকু চেষ্টা করে নিজেকে আর্তনাদ করা থেকে থামাতে। তার ভয় হয়–তার আঘাতে হামজা নির্ঘাত খুনের দায় নিজে স্বীকার করে বসবে।

হলো সেরকমই। হামজা পুলিশের পায়ের কাছে বসে পড়ল, “জয় কিছু করে নাই স্যার! ওরে মারবেন না।ʼʼ

-“পুলিশ পৈশাচিক হাসল, তাইলে কি তুই করছিস?ʼʼ

হামজা চট করে বলে, “হ!ʼʼ

-“অ্যাহ্!ʼʼ

“-জি স্যার। মানে খুন করি নাই। কিন্তু আমার অপরাধ আছে, স্যার। জানি কে খুন করছে।ʼʼ

জয় তখন শরীরের ভর ছেড়ে চামড়া ছেঁড়া শরীরে মেঝের ওপর পড়ে আছে। আগ্রহ পেয়ে বসল পুলিশ। হামজা সেলিমের নাম বলে দিলো। পুলিশ জিজ্ঞেস করলেন, “সে কেন মারবে বিগ্রেডিয়ারকে?ʼʼ

হামজা জানালো, “কারণ সেলিম বারী স্যারের মাদ্রাসায় কিছু বছর আগে আগুন দেবার সময়ও আমাকে কাজে লাগিয়ে কিছু বছর আগেও একবার সেই মাদ্রাসায় আগুন দিয়েছিল। তারপর মাদ্রাসা থেকে খুব মারধর করে তেড়ে দেয়া হয় সেলিম কাকাকে। সেই রাগ…ʼʼ

-“তো তুই বলতে চাচ্ছিস, সে এবার বারী সাহেবকে মারতেও তোকেই ব্যবহার করেছে?ʼʼ

-“হ্যাঁ, স্যার। জয়কে বারী সাহেব খুব ভালোবাসতো। আমাকে হুমকি দিয়ে সেলিম জয়ের মাধ্যমে বারী সাহেবের সাথে দেখা করার সুযোগ করে নিছিলো স্যার। আমি জয়কে পাঠাইছিলাম সেলিম কাকার সাথে। এই আমার অপরাধ। কিন্তু জয় খুন হওয়া দেখেনি। ওকে বের করে দিয়েছিল সেলিম কাকা। আর ওর সিড়ি বেয়ে নামাই দেখেছেন আপনারা। তারপর আর সেলিম কাকার সাথে দেখাও হয় নাই আমাদের।ʼʼ

প্রমাণের অভাবে আরও কিছুদিন টর্চার করে ফায়দা না পেয়ে দুই কিশোরকে ছেড়ে দেয়া হলো বটে। এবং হামজার কথা বেশ বিশ্বাসযোগ্য হলো, কারণ সেলিম আসলেই নিখোঁজ ছিল। এই কাজটা হামজার বড়ভাইয়েরা অন্তত করেছিল হামজাকে রক্ষা করতে। সেলিমকে সাময়িক গুম করা হয়েছিল।

সেলিমের লুকিয়ে থাকার ব্যাপারটাতে মুস্তাকিনসহ সংগঠনের সবাইও হামজার স্টেটমেন্ট আরেকবার বিশ্বাস করল। কারণ সেলিমের দ্বারা এমন কিছু অসম্ভব নয়। আবার সে খুনের পরপরইআ লাপাতা। আবার সে জয় চলে আসার পরপরও সত্যিআ অনেকবার মাদ্রাসা ও জয়-হামজাকে একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্থ করার চেষ্টা করেছে।

জয় ও হামজার ভালো চিকিৎসা হলো না। কারাগারের মারগুলো শরীরে বসে গেল। সদ্য যুবক বয়সে হামজার উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদযন্ত্রে বিভিন্ন রোগশোক দেখা দিয়েছিল এতে। দিনদিন এসব ঘটনাবলী হামজার ভেতরে পৈশাচিকতার ভাণ্ডার গড়ে তুলছিল। তার কেবল ক্ষমতাই চাই, ক্ষমতা!

সেই মারের আঘাত কাচা থাকতে থাকতেই জয় নিখোঁজ হলো। সেলিম ফারুকী বড় সূক্ষ্ণ কৌশলের সঙ্গে জয়ের মস্তিষ্ক ও শরীরকে একসাথে ধ্বংস করার কৌশলে মজলেন। অন্ধকার কবরের মতো কোথাও একটা তাকে আটকে রাখা হলো মাসখানেকের মতোন। সেলিম ফারুকী জয়ের সাথে সেই দিনগুলোতে যা যা করেছিল, জয় সেই সময়টা মৃত্যুর সঙ্গ নিয়ে বেঁচে ছিল। কিন্তু মৃত্যু এবারও তার সঙ্গে প্রতারণা করল।

সেলিম ফারুকীর কৌশলী টর্চার জয়ের মস্তিক ও শরীরের চিরস্থায়ী ক্ষতি সাধন করতে সক্ষম হলো। জয়ের মাংসপেশী ও রক্ততে বিভিন্ন আজব উপসর্গ দেখা দিয়েছিল এ সময়।

সেখান থেকে ফেরার পর থেকে জয়ের মাংসের ভেতরে কামড়াতো। নাক দিয়ে রক্ত পড়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভয়ানক উপসর্গ ও শরীরের যন্ত্রণা! ড্রাগে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল সে। সেলিম ফারুকীর ইনজেক্ট করা অবিরাম ড্রাগ জয়কে ড্রাগের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলল।

নিয়মিত সেবনের জন্য যেসব মেডিসিন ডাক্তার দিলো, তা তাকে কোনোদিন গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ডাক্তার একটা চমৎকার ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, জয়ের লোহিত রক্তকণিকার গুণগত মান নষ্ট হবার পথে। এবং সে যে সকল ড্রাগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তা তার শরীরের নষ্ট কোষের বৃদ্ধিতে বেশ ভালো সহায়তা করছে। এটা ভবিষ্যতে ব্লাড-ক্যান্সারের রূপ নিতে পারে। জয়ের শরীরের ব্লাড-করপাসলের মাদার-সেলগুলো সব মিলিয়ে খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।

তিনটে বছর মুস্তাকিন বিশ্বাস করেছিল–তার আব্বাকে সেলিম মেরেছে। সে সময়টা সে হন্য হয়ে সেলিমকে খুঁজেছে। কিন্তু সেলিম সন্দেহের দায়ে পলাতক। এতে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল সে অপরাধী।

কিন্তু ২০০৬ এর শুরুর দিকে মুরসালীন জানতে পারল সেলিম মারেনি, মেরেছে জয়। যে জিন্নাহকে জয় বছরের পর বছর খুঁজে পায়নি, সেই জিন্নাহ আমির মুরসালীন ও তাদের সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে বন্দি হলো জয়কে ধরার টোপ হিসেবে।

সময়টা হামজা ও জয়ের জন্য অতিরিক্ত প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল। তখন বিরোধী সরকারের সময়সীমা প্রায় শেষের দিকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার সময় হয়ে এসেছে প্রায়।

হামজা ও জয় জানের মায়া ত্যাগ করে নিজেদের দলীয় প্রচারণায় নামলো। তাদের শেষ সুযোগ এটা! এবার দল ক্ষমতায় আসতেই হবে, অন্তত তাদের দুজনের অনেক পুরোনো হিসেব চুকানোর দায়ে হলেও।

সে সময় জিন্নাহকে ছাড়িয়ে আনতে জয় পাগল হয়ে উঠেছিল। তার একূল-ওকুলে কেউ নেই জিন্নাহ ছাড়া! এতে করে বর্তমানের দলীয় কর্মসূচিতে ব্যাঘাত ঘটছিল। যা হামজার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। তাদেরকে জিততে হবে। যেকোনোভাবে। জীবনের হিসেবের খাতাগুলো পড়ে আছে, শরীরের আঘাত, পেটে খিদে, প্রবৃত্তির নেশাগ্রস্থতা, বদলার আগুন….হামজা এগুলোকে এড়ানোর সাধ্যি রাখে না। তাকে জিততেই হবে।

জয় যতটা উতলা হয়ে উঠছিল জিন্নাহকে মুক্ত করতে, একবার ওকে দেখতে, হামজা ততটাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল জয়কে হারানোর আতঙ্কে। সবে তাদের যাত্রা শুরুই হয়নি, তার মাঝে জিন্নাহ ঢুকে এলো। মুস্তাকিন জিন্নাহর মুক্তির বদলে জয়কে চায়। যেখানে জয়কে নিজের রাখতে হামজা দুনিয়ার সাথে একটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেই পারে। জয় তার রগে রগে মিশে যাওয়া সঙ্গদোষ, ডান হাতের মুঠিতে আঁকড়ে ধরার মতো হাত, বুকের সাথে মিশিয়ে পিঠে চাপড় মারার মতোন শক্ত সিনা, জয় তার এক জনমের পাপাচারের সঙ্গী! সে জয়কে ছোট্ট বয়সে জিতে এনেছে। তার রুহ্ না গেলে জয় যাবে না।

জয়কে সে আশ্বাস দিলো, নির্বাচনে জিত তাদের হবে। তারপর দুনিয়া তাদের। এখন শুধু প্রচারণার কাজে মন লাগা।

দেশে মার্শাল ল জারী হলো। হামজা সেনাবাহিনীর হাতে মার খেলো। দেহে ছেপে যাওয়া দাগের সংখ্যা বাড়ল, গাঢ় হলো ক্ষতগুলো, ভেতরের আগুন নিভে, ব্যথা গলে তা লাভায় পরিণত হলো। যা জলন্ত কিন্তু শান্ত, গলিত। তা দাউদাউ করে জ্বলে না, কেবল নিঃশব্দে বয়ে যায় জমিন পুড়িয়ে ছাই করতে করতে।

নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০০৮ এর ডিসেম্বরের শেষ তারিখে। জিতে গেল হামজার দল। এবার হামজার অধিপত্য বিস্তারে আর বাঁধা এলে হামজা তা মানবে কেন? বাঁধা হয়ে যা আসবে, তা ছাই হবে।

মুস্তাকিনদের ভেসে বেড়ানোর দিন এলো। চারদিকে তাদের আটক, গুম-খুন বাড়ল। সেরকম ভাসমান এক সময় বন্দি জিন্নাহ আমির গায়েব হয়ে গেল তাদের আঁটকখানা থেকে। কেউ জানল না জিন্নাহ কোথায়!

জিন্নাহ্ আমির হামজার হাতে বলী হয়ে গেল একরাতে। জয়ের শেষ পিছুটানকে মেরে হামজা হাত মুছে ফেলল কালো পাঞ্জাবীর নিচের পৃষ্ঠে। জয় জানেনি তা। দিন যত যাচ্ছিল, জয় উন্মাদ হয়ে উঠছিল জিন্নাহকে পেতে, আর তারল আগ্রাসন বাড়ছিল সৈয়দ পরিবারের প্রতি। যা হামজা চাইছিল ঠিক সেই মোতাবেকই সব এগোলো।

হামজার ওয়ার্কসপ উঠল। বাড়ির নকশায় বড়ঘর তৈরি হলো। নিজে নকশা তৈয়ার করেছিল পাটোয়ারী বাড়ির। বড়ঘরটা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৬৫-৩০ ফুট। বড়ঘর তৈরির খাতিরে হামজার বাড়ি মোট মিলিয়ে বিশাল হলো। দোতলার অর্ধেকের বেশি খালি পড়ে থাকে। সেখানটা পরিত্যক্ত।

বড়ঘরের গুদামের অংশে মেটাল-মেল্টিং মেশিন এলো! ২০১২-তে বড়ঘরে সেই ধাতু গলানোর চুল্লিতে সর্বপ্রথম সেলিম ফারুকী গলেছিল। তাকে পিস পিস করে কেটে কেটে গলানো হয়েছিল চুল্লিতে। হামজা কেটেছে, জয় গলিয়েছে। সেলিমের বাঁ হাতের একাংশ পচে ক্ষয় হয়েছে বড়ঘরেই।

সেলিম ফারুকীর হাতে পাথরের আংটির কমতি ছিল না। অন্তূ প্রথমদিন বড়ঘরে ঢুকে সেই ক্ষয়িত হাতের আংটিগুলো দেখেছিল।

মুস্তাকিন মহান পিবিআই ডিপার্টমেন্টে ইনভেস্টিগেটর নিযুক্ত হলো, তখন বাংলাদেশে পিবিআই ডিপার্টমেন্ট পুলিশের এক নতুন ব্রাঞ্চ। চাকরির এক বছরেরও কম সময়েই মুস্তাকিনের দল-বিরোধী তদন্ত কার্যক্রমের ফলে উপর মহল থেকে আদেশ এলো তাকে প্রথমে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে পরে দুনিয়া থেকে।

কিন্তু জয়ের বদৌলতে মুস্তাকিনের জায়গা হলো, হামজার বড়ঘর। সময় ২০১৩ এর শেষের দিকে।

মুস্তাকিনের চেহারার সাথে খুব বেশি মিল ছিল মুমতাহিণার। মিল-মহব্বতও বেশি দুই ভাই-বোনের। মুস্তাকিনের চেহারায় নমনীয়তার সাথে বীরত্বপূর্ণ তেজ বেশি লক্ষ করা যায়। এক গাল মাঝারি চাপদাড়ি। গায়ের রঙ পুরুষ হিসেবে ফর্সা। টাখনু অবধি গোটানো প্যান্ট। মাঝারি চুলগুলো বিন্যস্ত। কপালের মাঝখানে নামাজের কড়া পড়া কালো দাগ। বড় শোভনীয় এক পৌরুষ দীপ্তি চোখে-মুখে। জোরে হাসতে দেখা যায় না লোকটাকে। মুচকিই হাসিই বেশি। চোখদুটো গভীর, বিচক্ষণ, বিনয়ী!

মুস্তাকিন বড়ঘরের চারদিকটা দেখে নিয়ে হা করে শ্বাস ফেলে মেঝেতে বসল। জয়কে দেখে একগাল মুচকি হাসল, “ভালো আছিস?ʼʼ

জয় গিয়ে সামনে বসলে মুস্তাকিন বলল, “এখন কী করছিস?ʼʼ

-“কী করতেছি বললে খুশি হবি? আজ তোর খুশির দিন।ʼʼ

-“আমার খুশি হবার মতো কিছু করছিস না, তুই। সুতরাং যা বলবি, তাতেই সামান্য দুঃখ পাব। তবু বল।ʼʼ

জয় দাঁত বের করে হাসল, “আমার অবস্থা মনে কর—’ও দয়াল জান নিবা নাও, দম ক্যা বাইর হইয়া যায়ʼ টাইপের। গরীব-ধরীব মানুষ, দুক্কের দিন একরকম কেটে যাচ্চে। কিন্তু তাই বলে তোর কোনো দুঃখ আমি রাখব না। তোর দুঃখ দূর করতেই এইখানে আনছি তোরে।ʼʼ

একটু থেমে খুব জ্ঞানীর মতো করে জয় বলল, “বুঝলি মুস্তাকিন, মাইনষের কপাল আর লুঙ্গির গিট্টু কখন কীভাবে খুলে যায়, কেউ জানে না। আজ তোরটা খুলব।ʼʼ

পলাশ চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “লুঙ্গির না কপালের রে, জয়?ʼʼ

-“লুঙ্গিরটা খুললে কপাল আপনা-আপনিই খুলে যায়, পলাশ ভাই। কপালের সব নেয়ামত তো লুঙ্গির তলেই!ʼʼ

মুস্তাকিন জয়কে গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করতে করতে টের পেল কেউ আসছে। ধীর-স্থির পদক্ষেপে হামজা এসে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা এক হাসি দিলো, “ভালো আছো?ʼʼ

-“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো?ʼʼ

‌-“সবসময়। তোমার ভালো থাকারও একটা ব্যবস্থা করতে চাই। তোমার জন্য একটা সুযোগ আছে। সেটা জানানোর আলাপ করতেই এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা। তুমি আবার খারাপভাবে নাওনি তো এভাবে তুলে আনার বিষয়টা?ʼʼ

মুস্তাকিন হামজার ধূর্ত মুখখানির দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, “না। আমাকে এখানে আসতে হবে, তা নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। তবে আপনার সুযোগ বোধহয় আমি গ্রহণ না করে আপনাকে অসন্তুষ্ট করতে চলেছি, হামজা ভাই। এতে আপনি কিছু মনে না করলেই হলো।ʼʼ

হামজা বড় উচ্ছ্বাসিত হয়ে হাসল, “তার ব্যবস্থাও আছে, চিন্তা কোরো না, ভাই। আমি আছি না!ʼʼ

মুস্তাকিন বিরবির করল, “তা তো বটেই! সেই ব্যবস্থা শুরুর অপেক্ষায়।ʼʼ

পলাশ উঠে এলো। তার হাসিতে বড়ঘর জুড়ে উঠল। সে হাসলে চোখ কুঁচকে ওঠে, তাতে চোখের মণির জ্বলজ্বলে ভাবটা বেশি ফুটে ওঠে। এসেই সে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল মুস্তাকিনকে দেখে।

হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “গুড জব, ছোটভাই! অল্পদিনের চাকরিতে আমারে একদম নড়চড় করে রেখে দিচ্ছিলে! তোমার তদন্তের কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট আমি। আরেকটু সুযোগ পাইলে একদম আমারেই খালাশ করে দিতা, কোনো সন্দেহ নাই। সাহসের ব্যাপার-স্যাপার! গুড জব, গুড জব। আই এপ্রিশিয়েট! গুড।ʼʼ

মুস্তাকিন একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।ʼʼ

জয় জিজ্ঞেস করল, “জিন্নাহ কোথায় রে?ʼʼ

-“নেই।ʼʼ

জয় ভ্রু উঁচায়, “উহ্? কীহ্? শুনি নাই। আবার ক।ʼʼ

মুস্তাকিন শান্ত চোখে চেয়ে রইল। জয় আবার জিজ্ঞেস করে, “জিন্নাহ্কে ফিরিয়ে দে। তোর জান দেব।ʼʼ

মুস্তাকিন হাসে, “চেয়েছি?ʼʼ

জয় মুস্তাকিনের কাধে হাত রাখল, “চাইবি। সত্যি বলছি, বিশ্বাস কর। তুই জান চাইবি আমার কাছে।ʼʼ

-“হ্যাঁ, আব্বারটা। দে ফিরিয়ে দে।ʼʼ

জয়ের চোয়াল আটলো, “জিন্নাহ্কে এতদিন আঁটকে রেখে আমারে পাস নাই। নতুন আর কীসের আশায় বাচ্চা ছেলেটারে কষ্ট দিচ্ছিস? আমি শুরু করলে তোর পুরো সংগঠনের রুহুতে কাঁপন উঠাবো। জয় আমির ওয়াদায় পাক্কা।ʼʼ

“জিন্নাহ্কে ফিরিয়ে দিলে তার বদলে তুই ফাঁসিতে ঝুলবি আব্বাকে খুন করার অপরাধে? দলের নয়জন যুবক তোদের হাতে বলি হয়েছে, তার অপরাধে? কারাগার ভরে উঠছে দিনে দিনে আমাদের লোক দিয়ে, তার অপরাধে?ʼʼ

-“অপরাধ? কোনটারে বা তোরা অপরাধ কস, আমি ওই বই থেকে অপরাধের সংজ্ঞা শিখি নাই।ʼʼ

-“তুই যে বই থেকে অপরাধের সংজ্ঞা শিখেছিস, ওটা মূলত অপরাধ শেখার বই ছিল। ‘অপরাধ কীʼ এই বিষয়টা আলাদা বইয়ে শেখানো হয়। ওটাকে নৈতিকতা বলে।ʼʼ

-“নৈতিকতা আর চিংড়ি মাছ এক আমার কাছে। স্বাদ ভালো, কিন্তু গা চুলকায়।ʼʼ

মুস্তাকিন জয়কে দেখল। ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি, তাতে এক প্রকার হিংস্র উন্মাদনা।

-“জিন্নাহ্কে ফেরত দিবি, মুস্তাকিন? তোর শরীরের নৈতিক রক্ত আমার অনৈতিক হাতে লাগলে চামড়া জ্বলার সম্ভাবনা আছে। যা আমি চাইতেছি না আপাতত।ʼʼ

-“সমস্যা নেই। শুরু কর। উর্দুতে একটা কথা আছে—কাল করবে তো আজ, আজ করবে তো এখন। করবি যখন, করে ফেল। দ্বিধা কেন? জিন্নাহ্ কোথায় আমি জানি না। মরলেও জানি না, বাঁচলেও জানি না।ʼʼ

হামজা চুপচাপ মেশিনের খণ্ডের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ভালো দর্শক। চুপচাপ দেখতে তার ভালো লাগে।
পলাশ মুস্তাকিনের মুখটা মাটিতে ফেলে নিচের চোয়ালটা জুতো দিয়ে চেপে ধরে ঢালাই মেঝেতে ঘষল। তাতে মুরসালীনের চোয়ালের চামড়া ছিঁড়ে যায়। পলাশের বড় শান্তি লাগল তা দেখতে।

পলাশ অমায়িক হেসে বলল, “আমার নামে কমপক্ষে ছাব্বিশটা কেইস খুলছো তুমি, মুস্তাকিন। আমি কি এতই খারাপ? তুমি ভাই মানুষ চেনো না, যারে তারে নিয়া খেলতে আসো। তোমার কাম অপরাধীদের নিয়ে, আমার পেছনে লাগছো ক্যান? আমি কি অপরাধী? আমি একজন সফল ব্যবসায়ী। তোমার কোনো ধারণা আছে এই খানে আসতে আমার কত পরিশ্রম গেছে?ʼʼ

জুতোর বাঁট দিয়ে মুস্তাকিনের মুখের ওপর কষে এক লাত্থি মারল পলাশ। মুস্তাকিনের নিচের ঠোঁটটা থেতলে, ফেটে রক্ত ছিটকে এলো। নাক দিয়ে চিরচির করে রক্ত বেরিয়ে এলো। কপালের ত্বক ছিলে গেল, চোখে আঘাত লেগে ঝাপসা হলো চোখ, জ্বলুনি উঠল খুব। মুস্তাকিনের ঠোঁটের রক্তটুকু পলাশ আঙুলের ডগায় তুলে নিয়ে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল।

মুস্তাকিন আবার উঠে বসে। ক্ষত-বিক্ষত মুখে তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে, “কাপুরুষ গায়ে লেখা থাকে না, পলাশ আজগর। আমি তদন্ত ভরা ময়দানে করে তোর গেইম অভার করছিলাম, আর তুই আমার এক ফোঁটা রক্ত নিতে দেখ কত আয়োজন করেছিস! একজনের জন্য এই ঘরে তিনজন, বাইরে শ খানেক দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিস। এইটাকেই বরং বীরত্ব ধরে মরি যে এক আমিকে দমন করতে তোদের গোটা ফৌজ দাঁড়িয়ে যেতে হয়। খোলা ময়দানে আমার একার জন্য তুই একা আসতি নাহয়! হারলেও অন্তত এইটুকু আনন্দ তো নিয়ে মরতাম যে জীবনের শেষ মোকাবেলাটা কোনো পুরুষের সাথে হয়েছিল! এখন তো মরার পরেও এই আফসোস থাকবে যে কতকগুলো কুকুরের দলীয় দংশনে প্রাণ হারিয়েছি আমি সৈয়দ মুস্তাকিন মহান।ʼʼ

পলাশ দুঃখিত ভঙ্গিতে হাসল, “আমি তোর আফসোসের চিন্তা করছি না, ইনভেস্টিগেটর! আমি আমার সৌভাগ্যের কথা ভাবছি যে তোর মতো একজন সৎ, বীর, আইনের কর্মকর্তার মহান শরীরে আমি আমার কুত্তা মার্কা দাঁত বসাতে পারব। এই দুঃখে আমি তোকে জীবিত রাখব, ইনভেস্টিগেটর। পরাগের মাঝে আমি তোর পরিচয় জীবিত রাখব। ওকে লোক চেনে না, তোর বীরত্বপূর্ণ নামে চিনবে।ʼʼ

পলাশ অলস পায়ে হেঁটে গিয়ে একটা বস্তা টেনে এনে জয়ের সামনে রাখে। তাতে হকিস্টিক, মেহগনির কাঁচা খড়ি, রড, ছুরি, দা, চাপ্পর, বড় বড় কয়েকটা স্ক্রু-ড্রাইভার, হাতুরি, ছোট্ট কুড়াল, কয়েকটা শাবল ইত্যাদি। বেশ ভার বস্তাটা। পলাশের জোয়ান, বলবান শরীরও ঘেমে উঠল এই খাটুনিতে।

জয় শরীরের শার্ট ও গেঞ্জি খুলে শার্টটা ফেলে দিলো মেঝেতে, গেঞ্জিটা মুস্তাকিনের মুখে গুজে দিয়ে তখন রড দিয়ে পিটাতে শুরু করল, হামজা আস্তে কোরে সেখান থেকে চলে যায়। সে নতুন বিয়ে করেছে। রিমি জিজ্ঞেস করলে বলবে, সিগারেট টানতে গেছিল। বেশি দেরি করলে কথাটা অবিশ্বাসযোগ্য হতে পারে, কারণ সিগারেট খেতে খুব বেশি দেরি লাগে না।

মুস্তাকিনের ডান হাতের কনুইয়ের অস্থি-সন্ধিটা খটাং করে ছুটে হাতটা ঝুলে গেল মোটা ইস্পাত রডের আঘাতে। শরীরের চামড়া উঠে মাংসপেশিগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে উঠে এলো কোনো কোনো আঘাতে। মুস্তাকিন প্রথমবার জ্ঞান হারানোর আগে মুখে গুজে থাকা গেঞ্জির ওপরই একবার বমি করে ফেলল।

জয় ক্লান্ত হয়ে রড ফেলে দেয়। গেঞ্জিটা বের করে আনে। মুস্তাকিন অচেতনের মতো পড়ে রইল। সেদিন জিজ্ঞাসাবাদ আর হলো না। ডাক্তার দু’দিন ধরে চিকিৎসা দিলো মুস্তাকিনকে বড়ঘরেই। ডাক্তার তার জীবনের শেষ চিকিৎসাটা বেশ যত্নের সাথে, ব্যথিত হৃদয়েই করল।

মুস্তাকিনের জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তারের দেহটা ধাতু-গলানোর মেশিনের জ্বালানি হয়ে গেল। হামজা ডাক্তারকে বড়ঘর থেকে বাইরে পাঠানোর ঝুঁকি নেবে কেন?

সেই একই প্রশ্ন জয়ের, “জিন্নাহ্কে ফিরিয়ে দে। তোকে খুন করার খুব একটা ইচ্ছে নেই আমার।ʼʼ

মুস্তাকিন বুঝেছিল, জয়ের ভেতরের উন্মাদনা। সে যদি বলে জিন্নাহ্ নিখোঁজ, জয় বিশ্বাস করবে না। সে জন্মগত অবিশ্বাসী। সে ধরে নেবে জিন্নাহ্কে ওরা মেরে ফেলেছে। মুস্তাকিনের চোখের সামনে আম্মা, মুমতাহিণা, মুরসালীন আর মাদ্রাসার ছোট ছোট এতিমগুলোর মুখ ভেসে উঠল। জয় ওদেরকে মশার ঠ্যাংয়ের মতো ছিঁড়ে ফেলবে।

মুস্তাকিন শেষ মুহূর্তেও স্বীকার করেনি জিন্নাহ্ হারিয়ে গেছে। সে বছর ধরে জিন্নাহর খোঁজ করেছে। কিন্তু না খুঁজে পেয়েছে, না কে তাকে অপহরণ করতে পারে তার কোনো প্রমাণ বা হদিশ মিলেছে। তার ধারণা ছিল, কেউ জিন্নাহ্কে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে জয়ের ভেতরে এই খেয়াল কোনোভাবেই আসতে দিতে পারে না যে জিন্নাহ্ বেঁচে নেই। জয় উন্মাদ ও অন্ধ। তাকে বিশ্বাস করানো যাবে না জিন্নাহ্কে মুরসালীন মারেনি। মুস্তাকিন জয়ের ভেতরে এই ভয়টুকু রাখল যে সৈয়দ পরিবারে হামলা হলে জিন্নাহর জান যেতে পারে। যাতে মুস্তাকিনের পরিবার আপাতত সুরক্ষিত থাকে জয়ের কাছ থেকে।

মুস্তাকিন শেষ মুহুর্তে একবার মুরসালীনের সাথে দু-চারটে কথা বলার জন্য আর আম্মা ও মুমতাহিণাকে দেখার জন্য বড় ছটফট করেছিল।

জয়ের কাছে সেসব বেকার। সে কবে এইসব মায়ার সম্পর্কের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে এসবের ঊর্ধ্বে চলে গিয়ে এক পিশাচ হয়ে বেঁচে আছে। যে জীবন্মৃত। তাকে মৃত্যু দেয়া সম্ভব নয়। কারণ সে জীবিতই নেই। জয়ের অতৃপ্ত রুহ্ মৃত্যুকে প্রদক্ষিণ করে কিছুদিনের সময় চেয়ে নিয়ে পিশাচ হিসেবে রক্তের নেশায় ফিরে আসা চলন্ত ধ্বংস।

ছেঁড়া-ছুটো মুরসালীনকেই জয় সারারাত ধরে পিটালো। ফাঁড়া খড়ির ধার কাঁটাযুক্ত চাবুকের চেয়ে ক্ষয়কারী। মুরসালীনের দেহের মাংস খড়ির সাথে ছিঁড়ে ছিঁড়ে এলো। বেশ কয়েকবার রক্তবমি করে ফেলল। নাক ও কান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ফজরের আজানের আগে জয় টের পায়, মুস্তাকিন শুধুই একটা ছেঁড়া দেহ। জয়ের কোনো কাজে সে লাগবে না। মুস্তাকিনকে চিৎ করে শুইয়ে প্রসস্থ শাবলের এক কোপে মুস্তাকিনের গলাটা আলাদা করে ফেলল দেহ থেকে। ঠিক আলাদা নয়, সামান্য একটু ঘাঁড়ের কাছে চামড়ার সাথে বেঁধে রইল। এক দলা রক্ত ফিনকি দিয়ে ছুটে এসে জয়ের বুক, মুখ, হার ভরিয়ে দেয়।

জয় সেই রক্তে ডুবে ধপ করে বসে মেঝেতে। চোখ দুটো বুজে বসে থাকে ওভাবেই মিনিট পাঁচেক।

শেষরাতে দোতলায় উঠে এসে গোসল করে বেশ কয়েকটা ড্রাগ শরীরে ইনজেক্ট করে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে সে সাজায় মুরসালীনকে ধরার প্লান। মুরসালীনের পদক্ষেপ বড় বিচক্ষণ। জয় উপায় খুঁজে পায়, মুরসালীনকে ধরতে মুমতাহিণা একটা ভালো টোপ।

মুস্তাকিনদের মাদ্রাসায় যেসব রাজাকার ও জঙ্গি পয়দা হচ্ছে, তাদেরকে নিপাত ডাক এলো হামজার কাছে। জয়ের কাছে বিষয়টা খারাপ লাগল না। বাচ্চাদের জীবন খারাপ কাটাটাই নিয়ম। জয়ের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। আর জিন্নাহও তো পচে মরছে! সেও তো কিশোর।

অন্তূর শরীরটা প্রতি মুহুর্তে আরও বেশি দূর্বল হয়ে পড়ছে। সে বেশ কিছুক্ষণ পর শুধু জয়কে এইটুকু জিজ্ঞেস করতে পারল, “আপনি মুস্তাকিন মহানকেও মেরে ফেললেন?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “মেরে ফেললাম।ʼʼ

অন্তূ কত কিছু বলতে চায়, কিন্তু একটা ঢোকের সাথে সবটা গিলে নিয়ে শুধু আস্তে কোরে বলে, “তার কাছে তো জিন্নাহ নাও থাকতে পারে!ʼʼ

-“ছিল। কিন্তু পরে আর পাইনি। সামলে ফেলেছিল আমারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুমানোর জন্যে।ʼʼ

-“আর তারপর?ʼʼ

-“তারপর মুরসালীনকে খুঁজতে শুরু করলাম।ʼʼ

-“পলাশ কেন সাহায্য করেছিল এতে?ʼʼ

-“মুস্তাকিনকে মারার পর পলাশের গুদামে আগুন দিয়েছিল মুরসালীন।ʼʼ

অন্তূ কিছুক্ষণ চুপচাপ চোখ বুজে বসে রইল। তার এই প্রতিক্রিয়াটা অদ্ভুত। সে এ নিয়ে আর কিছু বলল না। তার শরীরটা দূর্বল হয়ে পড়েছে। আজকাল নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা শরীরের। যখন-তখন সুস্থ-অসুস্থতার চক্র ঘুরতে থাকে।

জয় তার নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ও জানা গল্পটুকু অন্তূকে বলে একটা মোটা চুরুট ধরালো। অশান্ত জয়কে খুব বেশি দেখা যায় না। সিগার টানা জয়টাই মূলত অশান্ত, অস্থির, বুকে ব্যথা চাপা জয়। অন্তূ টের পায় জয়ের ভেতরে এখন তোলপাড় চলছে। এই তোলপাড়ের নাম–হামজা। তোলপাড়ের নাম হিসেবে নামটা নতুন।

জয় সিগারের ধোয়া ছাড়ল নাক-মুখ ভরে। তাতেই অন্তূর নিস্তব্ধতা ভাঙে। ধোয়া নাকে যেতেই এক লাফে ছিটকে খাটের কিনারায় বসে বমি করে ফেলল। বমিতে শুধু পিচ্ছিল থুতু। অর্থাৎ সারাদিন কিচ্ছু খায়নি। ওড়নাটাকে মুড়ে মোটা করে নাকে চেপে ধরল অন্তূ। জয় প্রথমে বুঝল না, যখন বুঝল এক লাফে উঠে গিয়ে সিগার ফেলে এসে অন্তূকে চেপে ধরে, “ঘরওয়ালি! এইহ্! ঘরওয়ালি, আরমেইণ! ঠিক আছো তুমি? কী হইছে? এই মেয়ে! কী সমস্যা কী?ʼʼ

অন্তূ নাক-চোখ-মুখ চেপে ধরে বসে রইল। ইশারায় বোঝালো তার মাথা ঘুরছে, তেমন কিছু না।
জয়ের মুখটা শক্ত হলো, “শালির মেয়ে মার খাবি আমার হাতে? তোর কী হইছে? জণ্ডিস? খাস না, বমি করিস, চেহারার হাল বেহাল। আবার জিগাইলে কস কিছু হয় নাই। মরবি? আমারে না মাইরাই মরবি?ʼʼ

অন্তূ চোখ-মুখ ওড়নায় চেপে কাত হয়ে শুয়ে রইল চুপচাপ। জয় ঝুকে পড়ে আলতো হাতে ঝাকায়, “আরমিণ! ..ওই..ʼʼ

-“হু!ʼʼ

-“আমি সিগার ফেলে আসছি। আর নাই ধোঁয়া। তাকাও আমার দিকে। শোনো।ʼʼ

অন্তূ তাকায়। জয় দ্রুত গিয়ে রুমের দরজা-জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো। এসি অফ করে ফ্যান দিলো। ড্রেসিং টেবিলের ওপর সাজানো তার এক সারি পারফিউম থেকে একটা তুলে ঘরে স্প্রে করল। অন্তূ তবু নাক ছাড়ে না। তার যেকোনো গন্ধই অসহ্য লাগে।

জয় আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। পরনের শার্টের দুটো বোতাম খুলে গম্ভীর স্বরে বলল, “চলো!ʼʼ

-“কোথায়?ʼʼ

-“অসুস্থ তুমি। ডাক্তার দেখিয়ে আনি।ʼʼ

-“প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ

-“জোর করলে আবার বোলো না, আমার দোষ!ʼʼ

-“আপনার কোনো দোষ নেই। দোষ তো…ʼʼ

আচমকা কঠিন হয়ে উঠল জয়ের কণ্ঠস্বর, হাত ধরে চাপ দিয়ে বলল, “অসুস্থ দেখাচ্ছে, আরমিণ! ওঠ্!ʼʼ

অন্তূ ছিটকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “ছুঁবেন না আমাকে। বললাম না, কিছুই হয়নি আমার! আপনার সাথে কোথাও যাব না আমি।ʼʼ

কথাটা বলে অন্তূ চোখ অর্ধ খুলে জয়ের ভাবমূর্তি লক্ষ করে। কিন্তু জয় আশ্চর্যজনকভাবে কোনো আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে অন্তূকে ভাবনায় ফেলে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরল ভাতের থালা নিয়ে। খাবার দেখে অন্তূর নাড়ি-ভূড়ি বোধহয় গলার কাছে উঠে এলো।

জয় খাবার মুখের কাছে আনতেই বালিশ তুলে মুখের ওপর রাখে অন্তূ। উঠে বসতে চায়। জয় অন্তূর হাত থেকে বালিশটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারল একদিকে। বাহু চেপে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে পিঠের পেছনে বালিশ খাড়া করে দিয়ে অন্তূকে হেলান দিয়ে বসায়।

অন্তূ মুখ ফিরিয়ে বলে, “আমি খাব না। জোর করলে কিন্তু এই মুহুর্তে বের হয়ে যাব বাড়ি থেকে।ʼʼ

জয় শুধু ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার নষ্ট হাতদুটো যথেষ্ট শক্ত, আরমিণ। তোমার গায়ে তুলতে বাধ্য কোরো না। তোমার নরম শরীরে সইবে না।ʼʼ

-“মারবেন? মেরে ফেলুন না! আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কেন? কেউ সামান্য বিরোধিতা করলেও রেহাই নেই। শিখেছেন তো তা-ই।ʼʼ

জয় খাবার তুলে অন্তূর মুখের সামনে ধরে বলল, “তখন আসোনি কেন অন্যকিছু শেখাতে?ʼʼ

অন্তূ মুখটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “সেই দায় আমার ছিল না।ʼʼ

-“এখন আর তাহলে নতুন করে সেই দায় টানার দরকার নাই। যা শেখার তো শিখেই গেছি। এখন আর কী করার! ধরো, হা করো।ʼʼ

-“এখন দায় দেখাই কারণ এখন আমি…ʼʼ অন্তূ থেমে জয়ের খাবারের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেয়।

জয় জিজ্ঞেস করে, “কী এখন তুমি? আমার ঘরওয়ালি?ʼʼ

-“এখন আপনি যা করছেন তা আমার উপস্থিতিতে। আমার আশপাশে। আবার যা করেছেন তাও আমাকে শুনতে হচ্ছে।ʼʼ

-“শুনতেছো ক্যান? কান বন্ধ রাখো। আমি তো শোনাইতে চাই নাই। তুমিই শোনার জন্য পেছনে পড়েছিলে!ʼʼ

-“সেটা কারণবশত!ʼʼ

জয় হাসল, “লাভ নেই। তুমি যদি ভেবে থাকো আমার গল্প শোনার পর আমাকে নতুন করে বিচার করার সুযোগ পাবে, তাহলে আমি বলব—তুমি আমাকে যত জানবে চক্রবৃদ্ধি হারে শুধু পাপ পাবে। আমার জান নিতে অধৈর্য হবে আরও।ʼʼ

অন্তূ তাচ্ছিল্য করে হাসল, “আপনি কি আমাকে আপনার জান নিতে উৎসাহিত করছেন?ʼʼ

-“তোমার হাতদুটো সুন্দর। কোন এক বুজুর্গ বলেছিলেন, সুন্দর হাতের আঘাতে মরলে বেহেশত নসীব হবার সুযোগ থাকে। কোন শালির ছাওয়াল বলেছিল, জানি না।ʼʼ

-“রসিকতা করছেন?ʼʼ

জয় জিজ্ঞেস করল, “খাবে না?ʼʼ

-“খাব না। বমি পাচ্ছে। জুলুম করছেন আমার ওপর।ʼʼ

জয় হাত ধুয়ে ফেলল কেন যেন। অন্তূর মুখে উচ্চারিত ‘জুলুম’ কথাটার আছড় লাগল যেন।

অন্তূ বড় শান্ত কণ্ঠে বলল, “পাপ যথেষ্ট করেছেন। এবার ছাড়লেও পারেন। আমি আর কখনও বলব না আপনাকে একথা। আমি এবার চূড়ান্ত ক্লান্ত, জয় আমির।ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “তুমি আইছো আমার অন্ধকার অ-জীবনে। পাপ আর পূণ্যের মাঝে যেই সীমানা-প্রাচীরখানা থাকে, তার ওইপাশে আলো এইপাশে আন্ধার। আলোর ভিতরে বসবাস করা মানুষদের এইপাশে প্রবেশের অনুমতি নাই। তুমি সেই নিষেধ অমান্য করে, সীমা লঙ্ঘন করে এইপাশে পা রাখছো। দোষ কার?ʼʼ

-“সেই প্রাচীরখানা ভেঙে ফেলুন না! সেটাই তো বলছি। ওই প্রাচীরটার নাম–অনুতাপহীনতা। আত্মসমর্পণ করুন।তাহলেই তো এপাশের আলো ওপাশের অন্ধকারকে সরিয়ে আলোকিত করে তোলে। আলো গতি রুখে দেয়া যায় না। তা সামান্য পথ পেলেও অন্ধকারকে ধ্বংস করে।ʼʼ অন্তূ চোখ বুজে মাথাটা হেডবোর্ডে ঠেকায়।

জয় কেমন করে যেন হাসল, “এই প্রাচীর আমার মতোন পাপীরা নিজেদের বহুদিনের পাপ-সাধনার মাধ্যমে নিজ হাতে গড়ে তোলে, ঘরওয়ালি! তা চাইলেই ভাঙা সম্ভব হয় না। এই অন্ধকারের সাথে আমার রুহ্ অবধি জড়ানো। হয় রুহ্টা বের করে নাও, নয়ত আমাকে ছেড়ে দাও আমার পথে।ʼʼ

-“এখনও পথ ফুরায়নি? মানুষের ব্যথার অভিশাপ আর কত কামালে আপনি তৃপ্ত হবেন? আমি জানতে চাই।ʼʼ

জয় হেসে উঠল, “কেউ আমায় ‘পাপীʼ বলে ডাকলে আমার শান্তি লাগে। আমার রক্ত আর অনুপ্রেরণা খারাপ, ঘরওয়ালি। বড়বাবা বলতো, ‘পাপ যখন করবি, লোকে পাপী বললে দোষের কী? তবে পাপের চেয়ে বেশি বললে সেই পাপটুকু করে পূরণ করে দিবি। এই যা!ʼ বড়সাহেব বলে, ‘পাপীদেরকে পাপের পথে থামতে নেই। পরিণতি ভয়াবহ হয়।ʼ ʼʼ

অন্তূ কিছু বলতে যাচ্ছিল, জয় চট করে অন্তূর ঠোঁটে ডানহাতের তর্জনী চেপে ধরল, “গোসলও করো নাই। কী করছো সারাদিন?ʼʼ

অন্তূকে আবারও কোলে তুলে নিলো জয়। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “কী ছলনা পাকাচ্ছ, বলো তো ছলনাময়ী? আমি কি বুঝতে ভুল করছি আজকাল আমার ঘরের দুশমনকে?ʼʼ

অন্তূ চোখ কুঁচকে জয়ের শার্ট আঁকড়ে ধরে একটু। জয় থেমে গেল। ধুক ধুক করে উঠল তার হৃদযন্ত্রখানি। তাও টের পেল অন্তূ।

অন্তূকে বাথরুমের মেঝেতে বসিয়ে ঝরনা ছাড়ে জয়। রাত নয়টার এই গোসলে অন্তূর শরীরে পানি ঝরে পড়তেই দূর্বল শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। অন্তূ মস্তিষ্কে প্যানিক চড়ল। সেই মহা-গোসলের ক্ষণ তার মাথায় হামলা করল। অন্তূ সেদিন বাড়িতে গোসল করেছিল, এই জয় আমির তখন তাদেরই বাড়িতে ঢুকে ঘাপটি মেরে বসা অন্তূকে খুন করতে। অন্তূ কি ভুলেছে তা?

জয় অন্তূর ওড়নাটা খুলে নেয়। পানিতে ভিজে অন্তূর দেহে কাপড় লেপ্টে গেছে। জয় তা এড়াতে চায়। তার চোখ যায় অন্তূর মুখে। অন্তূর চোখ বেয়ে যে নোনাজল ঝরছে তা ঝরনার পানি ধুয়ে নিয়ে বেয়ে যাচ্ছে অন্তূর শরীর বেয়ে। জয় ঢোকল গিলল।

অন্তূর সালোয়ার কামিজটা কম্পিত হাতে খুলতে যায় জয়। আবার থেমে আগে নিজের আধভেজা সাদা শার্টখানা খোলে। অন্তূর শরীরটা কাঁপছে। চোখদুটো বন্ধ। কাঁদছে অন্তূ। জয় অন্তূর শরীর থেকে কাপড় খুলে নিয়ে নিজের শার্টটা পেঁচিয়ে দিলো অন্তূর দেহে।

অন্তূর ভেজা থুতনিতে আঙুল নেড়ে জয় বলে, “তোমাকে হাসতে বা কাঁদতে তেমন দেখিনি আমি। হাসবে না জানি। কান্নাও চলবে। কাঁদো.ʼʼ

জয়কে কেউ ডেকে বলল, ‘আজকের পর তোর বউয়ের সৌন্দর্যের মামলা উঠলে বলে দিস, তোর বউয়ের সৌন্দর্যকে ম্লান করার সাধ্যি কান্নারও নেই। বরং কান্না সৌন্দর্য পায় তার চোখে এসে।ʼ

জয় মলিন হাসে। অন্তূকে গায়ে পানি ঢালে। অন্তূর শরীর ছুঁতে গেলে অন্তূ যেন এই জগতে ফেরে। আতঙ্কে আর্তনাদ করে ওঠে, “আপনার ছোঁয়াকে বিষাক্তভাবে অনুভব করছি আমি।ʼʼ

জয় অন্তূর গলায় বডিওয়াশ মাখাতে মাখাতে ধীর আওয়াজে বলে, “তাহলে নিশ্চিত থাকো, তুমি জয় আমিরের ছোঁয়াই পাচ্ছ।ʼʼ

অন্তূ চোখদুটো আরও শক্ত করে বুজে বলল, “আমি কি আপনাকে বাঁধা দিতে পারি না এই মুহুর্তে?ʼʼ

-“পারো না।ʼʼ

-“আপনার মতো পাপী কেন আমাকে ছোঁয়ার বৈধতা পেলো জয় আমির?ʼʼ

-“প্রশ্নটা ঘুরিয়ে আমি তোমাকে করতে পারি —তোমার মতো নিষ্পাপ কেন আমার মতো পাপীর জন্য বৈধ হলো?ʼʼ

-“আমি নিষ্পাপ নই।ʼʼ

-“সে তো আমার ছোঁয়া লাগার পর।ʼʼ

অন্তূর শরীরটা জয় মুছিয়ে দিলো তোয়ালেতে। বুকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে তোয়ালেতে অন্তূর শরীরটা মুড়িয়ে আবারও পাঁজাকোলে তুলে নিলো।

বিছানায় এনে শুইয়ে দিয়ে ওভাবেই ঝুঁকে রইল অন্তূর দিকে। অন্তূ নাক ও চোখ লাল। চোখদুটো বোজা। জয়ের ভেতরে পুরোনো একটা হিংসা জাগলো, তার তুলনায় অন্তূ অতিরিক্ত ফর্সা।

জয় আরেকটু ঝুঁকে অন্তূর কানের ভেজা লতিতে একটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলে, “আজ তোমার আসামীর নামের অভিযোগের খাতায় আরেকটা অভিযোগ লিখে নাও। সে তোমার অসুস্থতার ফায়দা লুটবে আজ। কিন্তু তুমি বাঁধা দিতে পারবে না। তুমি ঘেন্নায় কাঁদবে, কিন্তু সে তা গ্রাহ্য করবে না।ʼʼ

চলবে…