#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৭৪. (প্রথমাংশ)
সেদিন রাত দেড়টার দিকে কামরুল মরে গেল। দোলন সাহেব ওদেরকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। এমপির কানে তিনজনের অবস্থার খবর দেননি।
জয় ঘুমে অচেতন। তার ফোন বাজছে। অন্তূ দ্রুত ফোনটা সাইলেন্ট করল যাতে ঘুম না ভাঙে। আস্তে আস্তে জয়ের পাশ থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে কল রিসিভ করে চুপ করে রইল।
দোলন সাহেব ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, হারামজাদা! তোর বউ এবার তোর জানের কাল হবে। মরবি তুই। নিশ্চিত জেনে রাখ, ব্যাটা। আর তুই মরলে তোর খয়রাতে আমি চরাম চরাম করে ঢোল বাজাবো।
অন্তূ দোলন সাহেবের কণ্ঠ চিনে ধীর আওয়াজে সালাম দিলো, “আসসালামুআলাইকুম, স্যার।ʼʼ
-“ওও! মুসিবতের বেডি, তুমিই ধরছো কল! তোমার পতি কই?ʼʼ
-“কী হয়েছে, স্যার?ʼʼ
দোলন সাহেব দীর্ঘশ্বাস টেনে খুব রিল্যাক্সে বললেন, “কী হয়নি, তা জিজ্ঞেস করো। যা হয়েছে অত বলার এনার্জি নেই। সকালে কোর্ট আছে। এনার্জি লস করতে পারব না।ʼʼ
-“আমার আন্দাজ বলছে, ওদের তিনজনের কেউ একজন জাহান্নামে পৌঁছে গেছে।ʼʼ
দোলন সাহেব অন্তূর বিচক্ষণতার প্রশংসা ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “এবার একটু ভয় পাও, মেয়ে! পথ সহজ না। তুমি ওদের কাল হতে গিয়ে তোমার নিজের কাল হবে। তোমাকে বাচাবে কে?ʼʼ
-“আমি তো বলিনি সহজ, স্যার। শিকার করতে গেলে জঙ্গলের ডাল-পালায় চামড়া ছিলার ভয় পেলে চলে না। কখনও বা শিকারের বিষদাঁতও সহ্য করতে হয়। কিন্তু তা বলে তীরের তাক নড়চড় করতে নেই।ʼʼ
দোলন সাহেব বললেন, “তুমি কি দক্ষ শিকারী?ʼʼ
-“না স্যার। আমি শিকারী নই। আমি হলাম শিকার, পরে সুযোগসন্ধানী।ʼʼ
-“তোমার বলির পাঠা কই?ʼʼ
-“ঘুমাচ্ছে। আপনার কাছে দুটো কথা জানার ছিল।ʼʼ
-“আমার হাতে এখন একটা সিগারেট। যেটা শেষের দিকে। যতক্ষণ ওটা টানবো, ততক্ষণ তোমার কথা বলার সুযোগ পাবে। আর আমি তোমার কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নই। মনে রেখো।ʼʼ
অন্তূ মলিন হাসল। মাথা ঘুরে উঠল। বারান্দার মেঝেতে হেলান দিয়ে বসে অন্তূ বলে, “আপনি শুধু ওই বাচ্চাগুলোকে মুক্ত করতে আমায় একটু সহায়তা করবেন তো, স্যার?ʼʼ
-“ওই শুধু ওইটুকুই। বেশি আশা রেখো না যেন। জয় আমির অথবা হামজাকে আঘাত করতে তুমি আমার কাছে একটুও সাহায্য পাবে না। উল্টো বলি হতে পারো। কারণ আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী না।
-“মুরসালীনের মহানের সঙ্গে কথা হয়েছে তো আপনার?ʼʼ
-“জয় আজকাল ভুল বেশি করছে। আগে করতো না। সেদিন আমাকে মুরসালীনের কাছে একা ফেলে চলে এলো। আমি কি ওকে সতর্ক করব, তোমার থেকে দূরে থাকতে?ʼʼ
অন্তূ হাসল, “করতে পারেন। মানলে ওর ভালো। না মানলে কী আর করার! সেটার সম্ভাবনাই বেশি।ʼʼ
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দোলন সাহেব, “হুউ! যা করবে তাড়াতাড়ি। তোমার মরণের ঘন্টা বাজবে, আমি সেই অপেক্ষায়। যুবতী বয়সেই মরে যাবে তুমি, খুব আফসোসের ব্যাপার। যতদিন হামজা না ফিরছে মিথ্যা আমি বলব এমপির কাছে। তারপর?ʼʼ
জয় ঘুমের মাঝে কেশে উঠল। অন্তূ সজাগ হলো। কল কেটে ভাবীর নম্বর তুলে কল করল। কলটা রিসিভ করলেন রাবেয়া, নাক পরিষ্কার করে সালাম দিয়ে বললেন, “কে?ʼʼ
-“ঘুমাওনি?ʼʼ
-“অন্তূ?ʼʼ
-“ভালো আছো, আম্মু?ʼʼ
রাবেয়ার ভারী নিশ্বাস শোনা গেল। বেশ ক’টা মাস অন্তূকে দেখেননি। উপচে আসা কান্নাটা লুকিয়ে নিতে খুব বেগ পেতে হলো উনার। অন্তূ জানে, রাবেয়া জায়নামাজে বসা। তাহাজ্জুদের সালাম ফিরিয়ে চোখ মুছে কল রিসিভ করেছেন।
রাবেয়া কেমন করে যেন জিজ্ঞেস করলেন, “বেঁচে আছিস তো, অন্তূ?ʼʼ
অন্তূ হাসে। চোখজোড়া জ্বলে উঠল তার। জানালার গ্রিল ভেদ করে আকাশের দিকে তাকায়। অন্তূরা কাঁদে না। আমজাদ সাহেবের নিষেধ আছে। তাই অন্তূ নিজেকে সামলে জানায়, “আমি মরব না, আম্মু। আমি মরব না।ʼʼ
রাবেয়া কথা বলতে পারছিলেন না। কাঁদলে অন্তূ রেগে যেতে পারে। তাই কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে বললেন, “জয়ের কাছে ফোনটা ধরায়ে দে তো, অন্তূ। একটু কথা বলব।ʼʼ
-“কী কথা বলবে?ʼʼ
-“ওর সাথে আমার বোঝাপড়া আছে। ওর সাহস কত হইছে রে? ওর না মা নাই! ওর কি কলজেও নাই? তোরে কেমন রাখছে, ওরে জিগাইতাম। ওরে বলতাম, তেইশ বছর আগে একটা মেয়ে জন্মাইছিলাম আমি। ওরে বলতাম, আমি একটা ছেলেও জন্মাইছিলাম। ওই দুইটার খোঁজ আছে ওর কাছে। একটু দে ওর কাছে।ʼʼ
অন্তূ ডাকে, “আম্মু?ʼʼ
রাবেয়া কথা বলতে পারলেন না। অন্তূও কিছু বলতে চেয়ে জিহ্বার আগা থেকে গিলে ফেলে। কথাটা আম্মুকে জানাতে তার ছটফটানি লেগে আসে। কিন্তু বলা হলো না। অন্তূ শক্ত করে ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়, প্রসঙ্গ বদলায়, “ভাবীর এখন কী অবস্থা, আম্মু?ʼʼ
-“সামনের মাসের শেষের দিকে তারিখ দিছে ডাক্তার। তুই আসবি না, অন্তূ? দেখতে আসবি না?ʼʼ
অন্তূ নিশ্চুপ। আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ল কোলের ওপর। আস্তে কোরে বলল, “আসব, আম্মু। ভাবীর ডেলিভারী ডেইটের আগেই অসব। আমি না আসলে হয়?ʼʼ শেষে বিরবির করে অন্তূ, “বেঁচে থাকলে আসব আমি, আম্মু। বেঁচে থাকলে আসব।ʼʼ
রাবেয়া ডাকলেন, “অন্তূ!ʼʼ
অন্তূর বুকের ভেতর ধুক করে উঠল। এই ডাকটা সাধারণ ডাক ছিল না। মাতৃত্বের ডাক। এই ডাকে মায়েরা ছেলেদের কাছে নিজেকে তুলে ধরেন। রাবেয়ার তো ছেলেটা নেই। অন্তূ রাবেয়ার হাতদুটো ধরে বলেছিল শেষবার, ‘অন্তূ তাদেরকে সব ফিরিয়ে দেবে। ভবিষ্যতটা কাধে নেবে।ʼ সেই দাবীতেই রাবেয়া ডাকলেন আজ অন্তূকে।
-“তোর ভাবীর বাড়ির লোকজন আমার আর তোর ভাবীরে আর বইতে পারতেছে না, অন্তূ। আমি বাড়ি যাইতে চাইলে নিয়ে যাবি, অন্তূ? আমি আর এইখানে থাকব না। চোখ বুজলেই তোর আব্বু আসে। আমারে বাড়ি যাইতে বলে। তুই আমাকে নিয়ে যা, অন্তূ।ʼʼ
বড় অবুঝ আবদার রাবেয়ার! অন্তূ চোখের সামনে দেখল বেয়ান বাড়িতে সরল রাবেয়ার অবহেলিত জীবন“টা। ছেলে নেই, স্বামী নেই, ঘরদোর পরের। রাবেয়া মাসের পর দিন কাটাচ্ছে। এর দায় কার?
বাকি রাতটা বারান্দায় বসে আব্বুর সাথে কথা বলে কাটলো অন্তূর। ভোরের আলো আধো আধো ফোটার সময় রুমে ফিরল। তুলনামূলক ভালো লাগছে শরীর। গরমের ভোর।
জয় অভ্যাস হলো উপুড় হয়ে শোয়া। খালি পিঠটা দেখা যায়। তাতে ট্যাট্টুর মতো ছেপে আছে অসংখ্য এবরো-থেবরো দাগ। লুঙ্গিটা উঠে আছে হাঁটুরও অনেকটা ওপরে। কালো কুচকুচে পশমে ভরা ঠ্যাঙের ওপর এক দলা ধরা মাংস নেই। গর্তের মতো দেবে আছে লম্বা ক্ষত। বাহুতে দাগ। কোথাও বা মাংস ঠেলে উঠেছে ক্ষত ভরাট হয়ে। কোথাও কালশিটে পড়া খাবলা ধরা মারের ছাপ। দেখে মনে হয় এখনও রক্ত জমাটবদ্ধ হয়ে চামড়ার নিচে জমে আছে। যখন-তখন টিউমার ও ক্যান্সার হওয়াটাই স্বাভাবিক।
গোসল দিয়ে এসে অন্তূ নামাজে বসল। মোনাজাতে মালিকের কাছে হাত তুলতেই হু হু করে কেঁদে ফেলল আজ সে। সে বহুদিন রবের কাছে কাঁদেনি। নিজের কলঙ্কিত হাতদুটো রবের কাছে তুলে ধরতে অন্তূর বড় লজ্জা লাগছিল। এই হাতে সে প্রাণ নিয়েছে, যে হাতে সে আইনের কলম ধরতে চেয়েছিল। অপরাধীর শাস্তি দেবার হক কি অন্তূর আছে? সেটা কি খু”‘ন নয়? খুন কুফরী! আর কুফরীর গুনাহ্ কি আল্লাহ পাক ক্ষমা করবেন? তার আর জয়-হামজার মাঝে পার্থক্য রইল কি! জীবন তাকে কোন পথে পরিচালনা করছে!?
তুলি নামাজে বসেছিল। তরুর মৃত্যুর পর সে নিথর হয়ে গেছে। কোয়েলের সাথে আচরণ খারাপ হয়ে গেছে। রুম থেকে বের হয় না। অন্তূ প্রতিবেলা খাবার না দিয়ে গেলে না খেয়েই চলে। কোয়েলের যাবতীয় যত্ন রিমিই করে। রিমি কোয়েলের মা হয়ে গেছে।
অন্তূ গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। তুলি সালাম ফিরিয়ে বলল, “তুমি গিয়ে আরাম করো’গে। রান্না আমি করে নেব আজ।ʼʼ
অন্তূ কিছুক্ষণ তুলির সুশ্রী মুখখানা দেখে বলল, “এভাবে কতদিন?ʼʼ
-“কীভাবে, আরমিণ? যার জীবনে আচমকা দুঃখ আসে, সে নাহয় আবার দুঃখ কাটিয়ে সুখ পাবার আশা রাখতে পারে। কিন্তু যার জন্মই দুঃখের খাতিরে সে কেন বৃথা আশা রাখবে সুখের? এটা আমার অবৈধ বাপের বাড়ি বলে তোমরা কি তাড়িয়ে দেবে, আমায়?ʼʼ
অন্তূ বিছানা ছেড়ে তুলির গা ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ল। তুলির একখানা হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে বলল, “আপনার অবৈধ বাপের বাড়ি। আমি কে এ বাড়ির? আমার কী পরিচয় আছে?ʼʼ
-“হিসেবে তুমি এ বাড়ির বউ। এটাই জয়ের বাড়ি। ও কথা বলবে না।ʼʼ
অন্তূ হাসল, “আপনার-আমার নিজেদের একটা করে সংসার হলেও পারতো। কিন্তু নারী হিসেবে আল্লাহর বোধহয় আমাদেরকে পছন্দ হয়নি।ʼʼ
তুলি অন্তূর মুখে দিকে তাকায়, “তুমি জয়কে ছেড়ে দেবে, আরমিণ?ʼʼ
-“আপনার কথা শুনি। কোয়েলকে কীভাবে মানুষ করবেন ভেবেছেন?ʼʼ
-“তুমি নিয়ে নাও।ʼʼ
অন্তূ তাকাল। তুলি বলল, “আমি সত্যি বলছি আরমিণ। ওকে আমার আর ভালো লাগে না। আমার আর এই দুনিয়ার কিছুই ভালো লাগে না। আমি কে, আমি কেন, আমি কী?—এই প্রশ্ন আমাকে পাগল করে তোলে। তোমার কাছে আছে এই প্রশ্নের উত্তর?ʼʼ
-“আপনি একজন নারী। আপনি একজন মা। এত বড় দুটো শক্তিশালী পরিচয় থাকতেও এই সংকোচ কেন?ʼʼ
তুলি তাচ্ছিল্য করে হাসে, “আমি অবৈধ সন্তান, আমি ধর্ষিতা, আমি বিধবা, আমি আশ্রিতা। আরও নাও বড় বড় পরিচয়। এগুলো বললে না কেন?ʼʼ
-“আমি যে দুটো বলেছি, সেগুলো এক পাল্লায় রাখুন আর এগুলো এক পাল্লায় রাখুন, দেখবেন ওই পাল্লার ভার অসীম ছাড়িয়েছে।ʼʼ
-“তুমি মেয়ে রোজ রোজ আমায় মিছে সান্ত্বণা দিও না। নিজের কথা ভাবো একটুও?ʼʼ
-“আপনি কোয়েল ও নিজের একটা ব্যবস্থা ভাবুন। এখানের দিন ফুরিয়ে এসেছে আপনার।ʼʼ
তুলি যেন চমকে উঠল, “কেন? তোমরা কি সত্যিই আমায় বের করে দেবে?ʼʼ
অন্তূ শক্ত করে তুলির হাতখানা নিজের মুঠোয় আঁটলো, “কেউ আপনাকে বের করবে না, বরং কেউ থাকবে না আপনাকে এখানে আশ্রয় দেবার জন্য।ʼʼ
-“কোথায় যাবে? কী বলছো তুমি? কী করছো তোমরা?ʼʼ
-“আমরা কারা? জানি না। কিন্তু ধরুন এই বাড়িটা ভাঙার জন্য একজন দিনমজুর দরকার, আমি সেই দিনমজুর।ʼʼ
তুলি একটু আৎকে উঠল। বিস্ময় ও হতবিহ্বলতায় কিছু উচ্চারণ করতে পারল না। অন্তূ বলল, “আমি আপনার কাছে আজ এমন কিছু চাইতে এসেছি যা আপনার মন ভাঙতে পারে, মায়ার বাঁধতে পারে। কিন্তু আজ আপনি আমায় ফিরিয়ে দিতে পারবেন না।ʼʼ
-“কী চাইতে এসেছ, আরমিণ?ʼʼ
-“ভয় পাবেন না। আবেগ আপনাকে ভয় পেতে বলবে, কিন্তু বাস্তবতার কাছে আবেগ এক মুঠো ছাই। আপনি যে মুখে হামজাকে ছোট থেকে ভাই ডেকে এসেছেন, সেই মুখে আপনি তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবেন।ʼʼ
তুলি যেন গেড়ে বসল, “কী বলছো তুমি?ʼʼ
-“বড় বড় কাজে এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে হয়। আপনার সন্তানের পিতাকে সে ভাই হিসেবে মেরে হয়ত ভালোই করেছে, কিন্তু সে আরও এমন অনেক সন্তানের জন্য নরকের দেবতা। যার জন্য আপনার স্বামীর মৃত্যু হবে তার হাটু ভেঙে পড়ার প্রথম ধাপ। বোনের মুখে ভাইয়ের বিরুদ্ধে নিজের স্বামীর হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী বড় কার্যকর।ʼʼ
তুলি ভাষাহীন চোখে চেয়ে রইল। অন্তূ বাম হাতের মুঠোয় রাখা চাবি নিয়ে তুলিকে নিয়ে একবার বড়ঘরে গেল। তুলির বমি ঠেলে আসে, চোখ ফুঁড়ে আসে সেখানকার দৃশ্য দেখে। বস্তার মতো নিথর পড়ে আছে এককেটা ছোট ছোট দেহ। তার মাঝে রক্তাক্ত কয়েকটি যুবক ফজরের নামাজ আদায় করছে।
সেখান থেকে বেরিয়ে অন্তূ শুধু একটাই কথা বলল, “ওদের মায়ের কোল ভরিয়ে দিতে আপনার একটা সাক্ষী আমার চাই। এরপর আমি এই লড়াইয়ে আমি বাঁচতে পারি, তো আপনার ভারটুকুও আমার।ʼʼ
অন্তূ রিমির ঘরে আর গেল না। সে জানে রিমি এখন নিস্তেজ শরীরে বিছানায় পড়ে নীরবে কাঁদছে। অন্তূর চোখে বড় বেঁধে এই দৃশ্য। রিমি তার এই বয়সের একজন সরল-বিশ্বস্ত বান্ধবী কিনা!
বাথরুমে যদি দশটা লুঙ্গিও জমা হয়, তা কখনও নিজের হাতে ধুয়ে দেয় না জয়। দরকার পড়লে নতুন কিনে এনে পরে। চারটা লুঙ্গি জমে ছিল। অন্তূ সেগুলো ধুয়ে ছাদে গিয়ে মেলে দিয়ে এলো। একটু ভালোমতোন দেখল বাড়ির গোটা আশপাশটা। পাহারা নেহাত কম বসায়নি হামজা।
বেলা একটু বাড়লে একসাথে দুটো বমির ওষুধ খেয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। এককাপ সুন্দর চা বানিয়ে নিয়ে গিয়ে জয়কে ডাকল, বেলা নয়টা বাজে। উঠবেন নাকি পানিটানি ঢেলে দেব গায়ে?
জয় গালি ঝারার জন্যই বোধহয় আধো চোখ খুলেছিল। কিন্তু গালি এলো না মুখে। অন্তূ চুল আঁচড়াচ্ছে। কোমড় সমান চুল। খুব সামান্য কুঁকড়ানো। দেখতে আরও বেশি সুন্দর লাগে। অন্তূ এক পর্যায়ে চুলটা পিঠ থেকে তুলে সামনে আগলে নিয়ে আচড়াতে লাগল। হাতের চিকন চুরিখানা চিকচিক করে উঠল অন্তূর। বেরিয়ে এলো গলার চেইন। জয় চোখ বুজে ফেলে এ পর্যায়ে।
জয়ের কাছে মনে হলো এটাকে অপার্থিব এক সকাল বলে। এই সকালের মায়ায় যদি জয় আমির পড়ে, দোষটা একটুও জয় আমিরের নয়। কিন্তু ধ্বংসাত্বক ক্ষতিটা জয় আমিরেরই। এই মায়ার প্রশ্নও তার জন্য সর্বোচ্চ ক্ষতিকর। দূর্বলতার ঠাঁইকেই সাধারণ ভাষায় মায়া বলে।
জয়ের চোখের পর্দায় ভেসে উঠল–অন্তূ যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, স্বামী হিসেবে তার এখন কর্তব্য অন্তূর ওই চুল সরানো খোলা কাধে একটা চুমু খাওয়া। কিন্তু সে যে স্বামী হবার আগে আসামী!
জয় উঠে দাঁড়িয়ে লুঙ্গি বাঁধে। ঘড়িতে সবে সাড়ে সাতটা। তার বউ একটা বাটপারী করেছে। এর শাস্তি কীভাবে দেয়া যায়?
অন্তূ সে সময় বলে উঠল, “কী খাবেন?ʼʼ
-“তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করতেছ?ʼʼ
-“আমি বুঝতে পারছিলাম না কী রান্না করা যায়। আপনি যা খাবেন তা শুনলে একটা আইডিয়া পাওয়া যেত।ʼʼ
জয় এমন ভাব করে হেঁটে এসে অন্তূকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে গা ঘেঁষে আয়নার সামনে দাঁড়াল, যেন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আয়নার সামনে এলোমেলো চুল ঠিক করতে খুব ব্যস্ত।
ঘন ফেঞ্চকাট ঝাকড়া চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “বিরিয়ানী রাঁধো।ʼʼ আড়চোখে অন্তূকে দেখল আয়নার ভেতরে।
অন্তূ আয়নায় জয়কে লক্ষ করে বলে, “পছন্দ?ʼʼ
জয় এবার অন্তূর দিকে ঘাঁড় কাত করে, “হলে কী?ʼʼ
-“আমারও পছন্দ।ʼʼ
জয় যেন একটুখানি থমকায়। আরেকটু গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় পর হেসে ফেলে অন্তূর কানের কাছে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে, “পছন্দ চেঞ্জ করে ফেলো, ঘরওয়ালি। নয়ত ভালো মানুষদের সমাজে বদনাম হয়ে যাবে জয় আমিরের পছন্দমতো একটা নিজের পছন্দ রাখার দায়ে। তোমার জয় আমির ভালো না।ʼʼ
অন্তূ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে, “তার নামে বদনাম হয়েই এই নাম পেয়েছি। বদনামের ওপর বদনাম দৃশ্যমান হয় না।ʼʼ
জয় মাথা নিচু করে হেসে বিরবির করে, “আমার নামটাই এক জলন্ত বদনাম! কী বলেন, উকিল মহোদয়া!ʼʼ
-“আমি তো বিরিয়ানী রান্না তেমন পারি না। মানে আম্মু করতো, আমি…ʼʼ
অন্তূ সরে দাঁড়ায়। এই সকল মুহুর্তে জয়কে আপাত বিরহ দিয়ে তার চাপা আহত মুখখানা বড় প্রশান্তি দেয়।
-“রান্না-বান্না, স্বামীর যত্ন, সংসার সামলানো শেখার বয়সে উকালতি আর তদন্ত শিখলে তোমার সুয়ামীর কপাল এরমই হবে, সিস্টার! তোমার সুয়ামীর জন্য দুক্কু পেলুম।ʼʼ
অন্তূ হেসে ফেলল। জয়ের মনে হলো দেয়ালে মাথা টুকে হাসপাতালে চলে যেতে। এরকম একখানা অভাবনীয় সকাল পাবার কথা সে অজ্ঞান হয়েও ভাবে না। আজ তার সাথে উল্টাপাল্টা ব্যাপার ঘটছে।
অন্তূ জয়কে চারবার মুদির দোকানে পাঠালো বিভিন্ন মশলা-পাতি ইত্যাদি আনতে। তার কুকুরগুলোকে রুটি খাওয়াতে একটু দেরি হলো শেষবার। বকতে বকতে দোতলায় উঠল। আটবার উঠানামা করতে হয়েছে সিঁড়ি দিয়ে।
অন্তূ বলল, “কোয়েলের দুধ ফুরিয়ে গেছে।ʼʼ
-“মাথার ওপর তুলে এক আছাড় মারব এইবার কোয়েলরেও, তোমারেও!ʼʼ
-“তো আমি যাই? দুধ নিয়ে আসি?ʼʼ
-“বের হয়ে দেখ্!ʼʼ
-“আজ হবো।ʼʼ
-“কীয়েহ্! আবার কন, শুনি নাই!ʼʼ
অন্তূ সরল নজরে তাকায়। জয় এক মুহুর্তের জন্য ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। অন্তূর এই মারপ্যাচটা খাটছিল খুব জয়ের ওপর। কখনও নমনীয়তা না দেখানো অন্তূ হঠাৎ-ই এই চূড়ান্ত সময়ে কোমলতা প্রদর্শন করায় জয়ের চাতুর্যও হতবিহ্বল হয়ে পড়ছিল।
-“আমি আজ ভার্সিটি যেতে চাই। আপনার অনুমতি আছে?ʼʼ
জয় যেন ভুল শুনল। কিছুক্ষণ অনড় দাঁড়িয়ে থেকে চোখ ফেরালো, “আমার অনুমতি চাই, তোমার?ʼʼ
-“আপনার অনুমতি থাকলে আমি আজ ভার্সিটিতে যাব। সেমিস্টার শেষের দিকে। এটেন্ডেন্স থাকা চাই।ʼʼ
জয় ঢোক গিলে একটু সময় নিয়ে বলল, “আমি নামিয়ে দেব।ʼʼ
অন্তূ একটুও আপত্তি করল না, “আপনি কোথায় যাবেন?ʼʼ
-“জেলখানায়।ʼʼ
অন্তূ মশলা কষানোর চামচ নাড়া দিতে দিতে কষা মশলা ছুটে এসে অন্তূর বাম গালে লাগল। মুখের নরম ত্বক জ্বলে উঠতেই অন্তূ ছিটকে দাঁড়ায়। জয় যেন উড়ে এসে অন্তূর মুখটা অধিকারে নেয়, ট্যাপ ছেড়ে হাতের মুঠোয় পানি নিয়ে ক্ষততে দেয়। কিন্তু মুখের সংবেদনশীল ত্বকে ঠিক ফোসকা পড়া কালো দাগ উঠে এলো। ততক্ষণে মশলা পুড়ে ধোঁয়া উঠে গেছে। সেই গন্ধে অন্তূর চোখ-মুখ উল্টে এলো। জয় দ্রুত অন্তূর মুখ ও মাথাটা অনিয়ন্ত্রিত হাতেই যেন নিজের চওড়া বুকটার সাথে চেপে ধরে। ধরে রাখে ওভাবেই। জয়ের লম্বা কাষ্ঠল শরীরটার তুলনায় অন্তূ মেয়ে হিসেবে লম্বা হয়েও খাটো।
একহাতে গ্যাস অফ করে অন্তূর চুলে হাত রাখে জয়, আলতো চাপে বুকের কাছে অন্তূর মুখটা চেপে নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। অন্তূর অস্থির, অসুস্থ নিঃশ্বাস জয়ের বুকে ছুটে পড়ে। আলতো হাতে বারবার অন্তূর চুলে হাত বোলায়। এই জয়কে চেনা যায় না। জয় নিজেও চিনতে ভুল করে এই জয়টাকে। এই জয় জয় আমিরের ধ্বংসের প্রতিনিধি।
অন্তূ টের পায় জয়ের হৃৎপিণ্ডে আন্দোলন চলছে। দ্রিম দ্রিম করে হৃদকপাটিকা খুলছে, রক্ত বইয়ে দিয়ে আবার তার চেয়ে দ্রুত ও জোরে আঁটকে যাচ্ছে। অন্তূ একপেশে হাসে আলতো। এরকম বুকের কাঁপুনি অন্তূও টের পেয়েছিল। হাত-পা থরথর করে কেঁপেছিল। যেদিন তার ঘরে জয়ের অবৈধ বিচরণ প্রমাণিত হচ্ছিল ভরা সমাজে। হৃদযন্ত্রের এই উত্তাল তান্ডব একই রকম, শুধু শর্ত আলাদা।
জয় আস্তে কোরে জিজ্ঞেস করে, “বমি করবে? বাথরুমে নিয়ে যাব?ʼʼ
-“না। এখন আর বমি পাচ্ছে না।ʼʼ
অন্তূ এক প্রকার সূক্ষ্ণ অবহেলায় জয়কে সরিয়ে দিয়ে সরে আসে। তারপর জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সূক্ষ্ণ একটা আহত ভাব লক্ষ করে।
জয় অন্তূর মুখের ছোট্ট ক্ষততে গভীরভাবে একটা চুমু খায়। বেশ কিছুক্ষণ ঠোঁট সরায় না। সামান্য একটু জিহ্বার আগাও ছুঁয়ে যায় অন্তূর মসৃণ গালটা। জয় যেন শুষে নিশ্চিহ্ন করতে চায় অন্তূর গালের দাগটিকে।
মুখ তুলে আঙুল নেড়ে ঘষে সেখানে, শব্দহীন হেসে বলে, “এই গালে আমার ঠোঁট ততটা সময় স্থায়ি হবে না, যতটা সময় এই দাগ। পোড়ার দাগ ওঠে না। আমার কি এই দাগের ওপর হিংসা করা উচিত, ঘরওয়ালি?ʼʼ
অন্তূ মাথা নাড়ে, “আপনি কি পোড়ার দাগ নন আমার জীবনে? আপনি জলন্ত অগ্নিকুন্ড, আমি সেই আগুনে পুড়ে কালো-কয়লা হওয়া জ্বালানি-খড়ি।ʼʼ
জয় অন্তূর বাহুটা এতক্ষণ চেপে ধরে নিজের শরীরটাকে অবলম্বনের খুঁটি হিসেবে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। দূর্বল শরীর। এবার অন্তূকে রান্নাঘরের মেঝেতে বসালো।
জয় নিজেও মেঝের ওপর ঠেসে বসে আস্তে কোরে দেয়ালের সাথে হেলান দিলো। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে অন্তূর দিকে ঘাঁড় কাত করে বলল,
-“আমাকে তুমি অগ্নিকুন্ড বলো। অথচ আমি উত্তাল সমুদ্র। এবং পানিকে শাসন করা যায় না, ঘরওয়ালি। আর না যায় তার গতিবিধি পরিবর্তন করা। বড়জোর তুমিই উল্টো তার প্রবাহে ভেসে যাবে। সব হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমার ধ্বংসাবশেষটুকুও ভেসে যাবে নিরুদ্দেশ পানির উন্মত্ত প্রবাহের সাথে।ʼʼ
অন্তূ স্লান হেসে সামান্য কাধ ঝাঁকাল, “মানছি।ʼʼ
জয় যেন অবাক হয়ে তাকায়। তার চোখে প্রশ্ন, ‘তুমি! আমার কথা মানছো?ʼ
অন্তূর হাসি কমে আসে, ভাবুক চোখে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলে, “ধ্বংস হয়ে যাব, বলছেন? তার মানে ধ্বংস হবার এখনও বাকি অনেকটাই, হ্যাঁ!?ʼʼ
জয় এবার আর অন্তূর অসুস্থতা মানল না। আরেকটু সরে গিয়ে বসল। একটা চুরুট ধরিয়ে তাতে লম্বা টান দিয়ে মুখ-চোখ ভরে এক পাঁজা ধোঁয়া ছেড়ে হাসল, “আমি হেরে যাব একবার তোমার কাছে। তাতে পস্তাবে তুমি।ʼʼ
-“আপনি হেরে গেলে পস্তাব?ʼʼ
জয় ধোঁয়া গিলে দু’পাশে মাথা নাড়ল, “সেদিন আমার মতো ওভাবে হেরে যেতে না পেরে পস্তাবে।ʼʼ অন্তূর চোখে চেয়ে চোখ মারল, “হার-জিত আপেক্ষিক, ঘরওয়ালি। তুমি তো আর্টসের স্টুডেন্ট! আপেক্ষিকতা বোঝো?ʼʼ
-“বুঝি।ʼʼ
জয় একপেশে ঠোঁটে হাসে, “দৃশ্যমান পরাজয় কখনও চূড়ান্ত বিজয় কারও জন্য। এবং জিতে যাওয়াটা হেরে যাওয়া পথের প্রবেশদ্বার মাত্র।ʼʼ
-“কখনও কখনও জেনেবুঝে হেরে যায় মানুষ। কখন জানেন?ʼʼ
-“হু?ʼʼ
-“যখন মানুষের সামনে একটাই পথ থাকে—বেঁচে থাকলে হেরে যাও নয়ত তুমি মরে যাও! মৃত্যু আপনার মতো দায়বদ্ধতাহীন মানুষের জন্য। আমার কিছু দায় আছে।ʼʼ
-“আমি দায়বদ্ধ হলে মেরে ফেলবে?ʼʼ
অন্তূ শুধু হাসল। মনে মনে বলে উঠল, ‘আমি বলছি, আপনি দায়বদ্ধ হবার পরেও মরণই হবে আপনার একমাত্র মুক্তির পথ। আমি আপনাকে দায়বদ্ধ করে তুলব, এবং যেকোনো শর্তে বাঁচিয়ে রাখব। প্রতিক্ষণে জীবিত করে আবার মেরে ফেলব।’
জয় অন্তূকে আর রাঁধতেই দিলো না। মেঝেতে বসিয়ে রেখে নতুন করে মশলা কষিয়ে রান্না শুরু করল। পিকনিকে বিরিয়ানী রেঁধে অভিজ্ঞ হাত তার। অন্তূ মেঝেতে বসে বসে দেখল গলায় গামছা ঝুলিয়ে, লুঙ্গি পরে একদম পেশাগত বাবুর্চির মতো রান্না করছে জয়। বিরিয়ানীর গন্ধে সকাল সকাল দোতলা মেখে উঠল। রাধতে রাধতে আবার গলা ছেড়ে গান ধরল,
মাইয়ার পেছন ছাইড়া দিয়া মন্টু হইয়াছি
পাপের জন্য গঙ্গা জলে ডুব দিয়াছি
সবকিছু ছাইড়া আমি সাধু হইয়াছি….
প্রেমে আগুন লাগাইছি ও প্রেমের বিদায় জানাইছি…. প্রেমের গুষ্টি মেরেছি…
বাংলা মাল ছাইড়া হাতে শরবত নিয়াছি
বৈরাগ দিয়া কপালেতে তিলক লাগাইছি…
অন্তূ রিমির কাছে গিয়ে বলল, “আপনার বোরকাটা দিন, রিমি!ʼʼ
রিমি অবাক হলো, “আপনি বোরকা পরবেন, আরমিণ?ʼʼ
-“পরব।ʼʼ
জয় তৈরি হয়ে ওয়ার্কশপে নেমে গিয়েছিল। অনেকগুলো দিন পর গায়ে বোরকা চড়াতে গিয়ে অন্তূর ভেতরে পাগলাটে বিভ্রম তৈরি হলো। সে দেখল, আব্বু গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্তূর হুড়মুড় করে বোরকা পরে দৌড়ে গিয়ে আব্বুর হাতখানা চেপে ধরবে, রাস্তা পার হবে, ভার্সিটির গেটে নেমে বলবে, “ছাতা খোলো। খুব রোদ আব্বু। প্রেশার বাড়বে কিন্তু।ʼʼ
আমজাদ সাহেব গম্ভীর মুখে বলবেন, “রোদে ভিটামিন ডি থাকে। প্রেশার বাড়ে কে বলেছে তোকে? একা যাবার চেষ্টা করিস না। আমি আসব নিতে।ʼʼ
আজ বাইরে জয় আমির দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন প্রথমবার অন্তূ জয় আমিরের জন্য বোরকা পরে তৈরি হলো।
জয়ের নজর পড়তেই তার চঞ্চল চোখদুটো থমকে স্থির হলো। জয় দেখতে পায় এক জুনিয়র বোকা-বাঘিনীকে। যে কালো বোরকায় আবৃত, সুন্দর চোখদুটোয় তেজ, ধীর-স্থির বেপাত্তা চলন। জয়কে এড়িয়ে চলে যাচ্ছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দিকে। জয়ের ভেতরে জেদ উঠল, জয় কূটিল হাসে, মেয়েটাকে রোজ ডাকে, জ্বালাতন করার চেষ্টা করে। মিছেমিছি চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে। এটা তো সেই আরমিণ! তার ঘরওয়ালির আসার কথা ছিল না! জয়ের বুকের ভেতর কেমন একটা লাগে। মস্তিষ্কে যে চাপ সে বইছে আজ তিনটা দিন, তা একত্র হয়ে জয়কে গলা টিপে ধরে।
একটাবারও জিজ্ঞেস করে না, বোরকা কেন পরেছ হঠাৎ-ই? জিহ্বা সরে না জয়ের।
দুজন অনেকটা পথ হাঁটে আজ। রাস্তায় লোকে আলোচনায় বসে যায়। নোংরামি করে ধরা খেয়ে বিয়ে করা বউ সাবেক ভিপি জয় আমিরের। মেয়েটার লজ্জা শরম নেই। আবার পর্দা করে! এসব হলো ভন্ড।
জয় চুপচাপ হেঁটে যায়। দেহটাকে শূন্য লাগে তার। হামজা কেন আসছে না? বোঝাপড়া বাকি। এত হিসেব জয় এই সীমিত জীবনে কীভাবে মেলাবে জয়? পরিণতিহীন এক অনিশ্চিত পরিণতির পথটা এমন এলোমেলো লাগে কেন আজকাল?
রিক্সাওয়ালা জয়কে দেখে দাঁত বের করে হাসে, “তুমার কাছে কইলাম কম ভাড়া নিতাম না, মামা। বেশি ভাড়া দেওন লাগব আমারে।ʼʼ
-“বেশি ভাড়া তুমার শ্যাটার ভিতর ভরে দেব, মামা। আমি একজন বেকার লোক। না জানি তুমি কইবা ভাড়া লাগতো না, ওঠেন, এক্কেরে জাহান্নাম পর্যন্ত নামায়ে দিয়ে আসি।ʼʼ
-“না। তুমি বড়লোকের ব্যাটা। বেশি ভাড়া না দিলে আমি রিক্সা টান দিমু না মানে দিমু না।ʼʼ
–“এই শালা, ট্যাকা কি গাছের ছাল না ভ্যাড়ার বাল? দে তোর রিক্সা দে। আমি চালায়ে যাই বিনামূল্যে। দেহ্।ʼʼ
-“লন। আপনেই যান গা। ন্যায্য ভাড়া না পাইলে আমি চালাইতাম না রিক্সা।ʼʼ
জয় রিক্সায় চড়ে বসল। আবার নেমে পড়ল, “নাহ্, মান ইজ্জত এমনিই নাই, তারপর আবার… তুই চালা। সাড়ে দুই ট্যাকা বেশি দেবোনি। চল যাই গা। ওঠো, ঘরওয়ালি!ʼʼ
অন্তূ ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢোকার পর থেকে যতক্ষণ দেখা গেল জয় একদৃষ্টে দেখল অন্তূ শহীদ মিনার চত্বর পেরিয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরকম এক সকালে এই মেয়েটিকে এই রূপেই প্রথমবার দেখেছিল সে।
জয়ের রিক্সা ঘিরে ধরল ছাত্র-ছাত্রী, জুনিয়রেরা। চোখ ফেরাতে হলো জয়ের।
অন্তূ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ঢুকে প্রফেসর মনোয়ারা রেহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে ভার্সিটির পেছনের পথ দিয়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। গাড়ি আসবে, তাকে তুলে নিতে।
চলবে….
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৭৪. (দ্বিতীয়াংশ)
মিনিট পনেরো চলার পর গাড়ি এসে থামল এক পুরোনো একতলা বাড়ির সম্মুখে। গাড়ির ভোঁতা আওয়াজে পেট গুলিয়ে আসছিল। বসার ঘরে ঢুকে আদব-কায়দাকে ছুটি দিয়ে সে দ্রুত বসে পড়ল সোফার ওপরে।
ঘরে মোট চারজন পুরুষ। অন্তূ এক সোফায় আলাদা বসা হেলান দিয়ে। একজন নারী পর্দার আড়াল থেকে একটি ছোট্ট মেয়েকে দিয়ে চা-নাশতা পাঠাল।
আনসারী মোল্লা সাহেব অন্তূকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি অসুস্থ, মা?ʼʼ
-“না, চাচা। আল্লাহর রহমতে ঠিক আছি। আপনি ভালো তো?ʼʼ
-“আল্লাহ রেখেছেন। চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি অসুস্থ। মুরসালীনের খবর কী? কিছু বলেছে তোমাকে?ʼʼ
-“সে আর মুক্তির আশা করে না। শুধু আপনারা বাচ্চাদের মুক্ত করুন, এই চাওয়া তার। আমি যেটুকু বুঝেছি।ʼʼ
-“একটা কথা জিজ্ঞেস করব, যদি কিছু মনে না করো?ʼʼ
-“বলুন, চাচা।ʼʼ
-“তোমারে আগে যেইবার দেখছি, বোরকা পরো নাই। আজ কি নিরাপত্তার জন্য? আমাদের সাহায্য করতে গিয়ে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?ʼʼ
অন্তূর ভেতরে এক তিক্ত অনুভূতি জন্মালো। সে তা গিলে প্রসঙ্গ বদলে ফেলল, “বাচ্চাদেরকে ওই জাহান্নাম থেকে মুক্ত করতে আর একজন সাহায্য করবেন বলেছেন। ঠিক সাহায্য নয়, বরং তিনি আমার উদ্দেশ্য ধরে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনিও চান বাচ্চিগুলো মায়ের কোলে ফিরুক।ʼʼ
“কে সে?ʼʼ
-“একজন উকিল। ওদেরই লোক। কিন্তু..ʼʼ
আৎকে উঠল সবাই। অন্তূ আশ্বাস দিলো, চিন্তা করবেন না। আপনাদের ব্যাপারে উনাকে কিছুই বলিনি। বলবও না। উনি শুধু জানেন আমি বাচ্চাদের মুক্তি চাই। কিন্তু কী করছি, সে সম্বন্ধে তেমন জানানো হয়নি। উনি চান মুরসালীন নিজেও ওদের কাছে হার স্বীকার করে মুক্ত হোক। মুরসালীন মহানের সঙ্গে কেমন অন্যরকম বোঝাপড়া রয়েছে উনার।ʼʼ
-“মুরসালীন কী বলে এ ব্যাপারে।ʼʼ
-“আপনারা আমার চেয়ে মুরসালীন মহানকে ভালো চেনেন।ʼʼ
-“এতদিনে বেঁচে আছে আল্লাহ, শুকরিয়া। কী হালে রাখছে ওরে কে জানে? হতে পারে আঘাত তাকে কাবু করেছে।ʼʼ
-“পারেনি। তাছাড়া হামজা কখনোই, কোনো শর্তেই মুরসালীনকে জীবিত ছাড়বে না। হামজা ঝুঁকি জিইয়ে রাখে না। মুরসালীন মহান আবার মুক্ত হয়ে তার পেছনে লাগবে, তার সাধের তৈরি জাহান্নাম ভেঙে ফেলতে চাইবে, এরকম সুযোগ হামজা কাউকে দেবে না।ʼʼ
কিছুক্ষণ নীরবতার পর আনসারী সাহেব বললেন, “তোমার উকিল ওদের লোক, তবু তোমাকে সাহায্য করছে কেন? এর পেছনে কোনো অন্য ব্যাপার নেই তো!ʼʼ
-“থাকলই বা। ততদিনে আমি সবকিছু অন্যরকম করে ফেলতে চাই।ʼʼ
-“তা কেমনে করবা? কত বলি, কত কুরবানী হয়ে যাচ্ছে। তোমার মতোন মেয়ে আমাদের সাহায্য করতে এসে বিপদে পড়লে আমি খুব অপরাধী হয়ে যাব রে মা মালিকের কাছে। সাবধানে থাইকো।ʼʼ
অন্তূ মনে মনে বলল, ‘উল্টো আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, চাচা। আমি বরং আপনাদেরকে ব্যবহার করছি। এই খেলার শেষ দেখা আমার একার পক্ষে সম্ভব না। আমি আপনার মতো এমন ওদের যেকোনো বিরোধীকে যানবাহন হিসেবে ব্যবহার করতে পারি ওদের ধ্বংসের পথে।ʼ
অন্তূ স্থির বসে থাকা জোয়ান লোকটির দিকে ফিরল, “আমার আন্দাজ সঠিক হলে আপনিই পুলিশ অফিসার!ʼʼ
লোকটা মাথা নাড়ল, “আপনার আন্দাজ সঠিক। এবং আমি ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) থেকে, রউফ কায়সার।ʼʼ
-“আপনি কেন সাহায্য করতে চান আমাকে? আপনারাও জয় আমির ও হামজাদেরই সহযোদ্ধা, আমার জানামতে।ʼʼ সূক্ষ্ণ একটা খোঁচা মারল অন্তূ।
-“বর্তমান সরকার যতদিন পুরো এই আমলের প্রশাসনকে কিনে ফেলতে সময় নেবে, সেই পর্যন্ত আমার মতো কিছু বিরোধী থাকবে।ʼʼ
অন্তূ বুঝল, বিরোধী দলীয় সমর্থক। তাতে অন্তূর যায় আসে না। রাজনৈতিক দলাদলীর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। কেবল তার একটি উদ্দেশ্য আছে। একটি ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন সে করবে। এবং এই ধ্বংযজ্ঞে সে যে কাউকে উপাদান বানাতে পারে, যেকোনোভাবে। তার কোনো ভয় নেই। পিছুটান আছে বেশ কয়েকটা যেগুলোকে দায়ভার বললে ভালো শোনাবে, এছাড়া আর কিছু নেই।
অন্তূ এক গ্লাস পানি খেলো বেশ কিছুটা সময় নিয়ে। এরপর বলল, “আমি আপনাকে আজ জয় ও হামজার অপরাধ জীবনের বিশেষ একাংশের ফিরিস্তি দেব। কিন্তু তার আগে আমার একটা শর্ত রয়েছে।ʼʼ
-“কী শর্ত?ʼʼ
-“উহু! এভাবে নয়। এই শর্ত পূরণে আপনার বেঁকে বসার চান্স রয়েছে সিংহভাগ। কিন্তু তা হলে আমার চলবে না। বরং আপনি আমার শর্ত মেনে নেবেন, এই শর্তে আমি আপনাকে সেই ফিরিস্তি শোনাবো।ʼʼ
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রউফ। উচু-লম্বা কালো চেহারা। গায়ের রঙ কালো হলেও চেহারার গড়ন ভালো। চোখদুটো গভীর, মুখের ভঙ্গিমা একটু কূটিল। সে অন্তূকে দেখল পর্যবেক্ষণের সাথে। অন্তূ এতে আশ্বস্ত হলো। এই খেলায় একটু চতুর লোক তার চাই। সরলদের কোনো কাজ নেই এখানে।
-“বলুন আপনার শর্ত। শোনা যাক!ʼʼ
অন্তূ বলল, “জয় আমিরের যেকোনো একটা পাপের শাস্তিও মৃত্যুদন্ড হতে পারে। কিন্তু আপনি তার পাপাচারের গোটা অধ্যায় জেনেও তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করতে পারবেন না।ʼʼ
তাচ্ছিল্য করে হেসে ফেলল রউফ, “কী আশ্চর্য, ম্যাডাম! আমি আইনের কাছে দায়বদ্ধ। অথচ আপনি তো আমাকে কথায় কথায় আমাকে কাস্টমাইজ করে ফেলছেন। আপনি আমাকে যে তথ্য দেবেন তার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ কিন্তু আইনকে কাস্টমাইজ করার বিষয়টা হাস্যকর। তার আগে আমি কারণ জানতে চাইব।ʼʼ
অন্তূ চোখদুটো মুদে হেলান দিলো আরেকটু, “কোনো প্রেমিককে তার প্রেমিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেবার পিয়ন হিসেবে আমি-আপনি এই চুক্তি করতে বসিনি এখানে। এবং আমি অপ্রয়োজনে, অযৌক্তিক কথা বলার জন্যও এতদূর বয়ে আসিনি, অফিসার!ʼʼ
রউফ কপাল জড়িয়ে বলল, “কে প্রেমিক?ʼʼ
-“জয় আমির। এবং তার পুরোনো প্রেমিকা হলো মৃত্যু। সে নির্দিষ্ট একটা সময় অবধি বাঁচতে চায়। কেননা তার কিছু কাজ পুরো করার আছে। তা ফুরোলে সে সেই পথে এগিয়ে যাবে, যেখানে তার মৃত্যু অবধারিত।ʼʼ
-“তা কেমন?ʼʼ
-“হতে পারে সে তার কোনো শিকারের সামনে বুক পেতে দেবে। কিংবা আইন সামনে পড়ে গেলে আইনের সামনে।ʼʼ
-“তার কারণ?ʼʼ
-“বেশ কয়েকটা কারণ রয়েছে।ʼʼ
-“কী কারণ?ʼʼ
-“প্রথমত সে জীবনকে ভয় পায়। মৃত্যু তার জীবনের একমাত্র মুগ্ধতা। দ্বিতীয়ত সে তার কোনো শিকারের হাতে প্রাণ দিতে চায় যেন সে এটা প্রমাণ করার মাধ্যেমে হাসতে হাসতে মরতে পারে যে যেকোনো শিকারই তার মতো একেকটা প্রতিশোধপরায়ন, হিংস্র, পাপী জয় আমির হয়ে ওঠে, যেমনটা সে হয়েছিল। তৃতীয়ত সে বন্দিত্বকে ঘেন্না করে। আইনের হাতে আত্মসমর্পণ করে বন্দি হবার বদলে সে অবশ্যই শখের সঙ্গে বুলেটের সামনে বুক মেলে ধরবে। যেটা কোনো মূল্যেই হতে দেয়া যাবে না।ʼʼ
-“ওয়েট ওয়েট! সেকেন্ড টাইম হোয়াট ইউ সেইড, আই ওয়াননা বি গট দ্যাট এগেইন, হোয়াট ডু ইউ মিন?ʼʼ
অন্তূ গভীর করে শ্বাস টানল, “সে নিজেকে তুলে ধরতে চায়। সে প্রমাণ করতে চায়—যেকোনো শিকার একবার সুযোগ ও প্রাণ ফিরে পেলে শিকারী হয়ে ওঠে। ঠিক তার মতো। আর এটা পাপ নয়, এটা হলো প্রতিক্রিয়া।ʼʼ
রউফ চায়ের কাপটা হাতে ধরে অনেকটা সময় চুপ করে বসে রইল। অন্তূর চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মতোন ভেসে উঠল—অন্তূকে অপদস্ত করার পর যেদিন জয় তাদের বাড়িতে এসেছিল রাবেয়া ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। জয় তখন হেসে বলেছিল, ‘সবাই স্বার্থপর, দেখেছেন? আগেরবার এসেছিলাম, আমি এতিম বলে আপনি নিজেকে আম্মা ডাকতে বলেছিলেন। এবার যেই একটু ক্ষতি করেছি, আর কথাই বলছেন না। অথচ এখনও কিন্তু আমি জয় আমির সেই এতিমই আছি। নাকি এখন বাপ-মা বেঁচে উঠেছে আমার?ʼ
অন্তূ সেদিনই বুঝে গেছিল জয়ের চিন্তাধারাকে। এরপর সে শুধু তার আন্দাজ প্রমাণ করেছে। এবং জয়কে জানতে জয়কে জমিনের মতোন খুঁড়ে গেছে।
-“আপনার কাছে ওদের অপরাধের কেমন তথ্য রয়েছে? শুধু তথ্য নাকি প্রমাণও?ʼʼ
-“প্রমাণে পরে আসছি। সাক্ষ্য দিয়ে শুরু করি। মাস কয়েক আগে মেয়র হামজা পাটোয়ারী তার বোনের স্বামী সীমান্তকে খুন করেছে। আমার সামনে।ʼʼ
রউফ নড়েচড়ে বসল, “আপনার সামনে?ʼʼ
-“আপনি যে সোফায় বসে আছেন, ধরুন সেখানে আপনি কাউকে কুপিয়ে মারছেন, আমি ওই যে ওই দরজার কাছে দাঁড়ানো।ʼʼ
-“এরপর?ʼʼ
-“পলাশ আজগর। তাকে মারা হয়েছে কাঠের মেশিনে টুকরো করে। সেই মেশিন ও কাঠের মিলের মালিকের হদিশ আমি আপনাকে দেব। তাকে ধরে নিয়ে আসবেন। এবং সে সাক্ষী দিতে অবশ্য রাজী হবে না। তার জন্য তাকে টর্চার সেলেও রাখা লাগতে পারে দু-একদন। তাছাড়া তার একটা ছোট্ট মেয়েও আছে। যদি একটু অন্যায় উপায় অবলম্বন করতে চান তো তাকে জিম্মি করেও স্বীকারক্তি নিতে পারেন। এবং তার এক পা পঙ্গু। সেটা করেছে জয় আমির। বিষয়টা প্রমাণ করতে এখন পুলিশ হেফাজতে থাকা কবির আপনার ভালো ইনফর্মার হতে পারে। সে উপস্থিত ছিল সেসময়।ʼʼ
রউফ কায়সার পর্যবেক্ষকের মতো চেয়ে থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কথাগুলো।
অন্তূ বলল, “সাবেক মেয়র, ঝন্টু সাহেবের ছেলে মাজহার, তাকে জয় আমির জবাই করে মেরেছে।ʼʼ
-“আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন?ʼʼ
-“না। আমার হাত থেকে চাপ্পর নিয়ে গেছিল। এবং আমি খুব ভুল না হলে তার মাথাটা কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এবং সেই কবরটাও শনাক্ত করে দিতে পারি। এবং সেখানে আপনি পলাশের মাথার খুলিটাও পাবেন।ʼʼ
-“আচ্ছা।ʼʼ রউফ কিছু লিখল।
অন্তূ বলল, “এবং ঝন্টু সাহেবকে দুই ভাই মিলে মেরেছে বলেই আমার ধারণা। যদি একজনও মারে, সেদিন বেরিয়েছিল দুজন। এবং এটার প্রমাণ..ʼʼ
-“আছে আমার কাছে। রউফ হাসল, “তদন্তের সময়ই একটি সিসিটিভি ফুটেজ আমরা উদ্ধার করেছিলাম। এবং সেখানে হামজা পাটোয়ারীকে ঝন্টু সাহেবের বাড়ির রাস্তায় দেখা গেছে। কিন্তু উনাকে তেমন একটা জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ তখন পাইনি কেননা উনি ক্ষমতাসীন দলের কর্মী। যেহেতু ওটা উনার শ্বশুরবাড়িও, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুটা চাপা পড়ে গেছিল। এবার আর এই দ্বিধাটা রইল না।ʼʼ
অন্তূ যাবতীয় অপরাধের বিবরণ দেবার পর আনসারী সাহেবকে বলল, মেয়র এখন ঢাকাতে। সে ফিরলে সব শেষ ধরুন! সুতরাং সে ফেরার আগে যা করতে পারবেন। এবং স্বাভাবিকভাবে সে আজকাল ফিরে আসবে। এখন আপনাদের কাজ হলো সে যাতে এত দ্রুত ফিরতেই না পারে, এমন কিছু করা।
-“কী করতে বলছো?ʼ
-“গাড়ি এক্সিডেন্ট করিয়ে দিন।ʼʼ
-“অ্যাহ?ʼʼ
-“দু চারদিন হাসপাতাল ঘুরে আসুক। বাড়ি আর ঢাকা করতে করতে পেরেশান হয়ে গেছে ভীষণ।ʼʼ
সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ অন্তূকে দেখল। অন্তূ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনারা পাটোয়ারী বাড়িতে ঢোকার জন্য কালকের দিনটা পাবেন। কাল জয় আমিরকে নিয়ে বের হবো আমি। সেইটুকু সময় আপনারা পাবেন।ʼʼ
—
হামজা বড়মহলের সঙ্গে একটি মিটিং শেষ করে হোটেলে ফিরল বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে। হোটেলটা যে মন্ত্রীর, তার সঙ্গেই মিটিং শেষ করে ফিরল সে। পাঞ্জাবীখানা খুলে খালি গায়ে শুয়ে পড়ল বিছানার ওপর। ঘুমের অভাবে শরীরে অসহ্য অস্থিরতা টের পাচ্ছিল। জয়কে গত দু’দিনে বহুবার কল করেছে সে, কোনো সারা পাওয়া যায়নি।
হামজা ওভাবেই উঠে গিয়ে বেলকনির গ্রিল ধরে দাঁড়াল। রাজধানীর এক অভিজাত হোটেলের বেলকনি থেকে ব্যস্ত এই মহানগরী বড় রহস্যময় লাগল হামজার কাছে। এই ব্যস্ত নগরী কাউকে কিচ্ছু দেয় না। হাসিল করতে হয়, সেই হাসিলের সিংহভাগই অনৈতিক হাতে আদায়কৃত। হামজাকেও কিছু দেয়নি। দেয়নি বলাটা অকৃতজ্ঞতা হবে। ব্যথা দিয়েছে। কখনও শরীরের, কখনও খিদের, কখনও বা পরিচয়হীনতার, কখনও অনূভূতিহীনতার, কখনও বা এত লড়াই করে জেতা এইটুকু ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার ভয়ের ব্যথ।
ক্ষমতার লড়াই যারা লড়ে তারা জানে তারা কতটা অসহায়! তারা চাইলেও একজন ভালো মানুষ হতে পারে না। নেশার চেয়ে বড় প্রবৃত্তি নেই। ক্ষমতার নেশার চেয়ে বড় নেশা নেই।
রিমির মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। যারা রোজ ব্যথা পায়, তাদের সয়ে যায়। যার একদমই অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা নেই, তারা কীভাবে সইবে? হামজার জানা নেই। হামজা কখনও কিছু ধরে রাখতে চায়নি ক্ষমতা ও জয়কে ছাড়া। কিন্তু এরপর মনে হলো সে আরেকটা জিনিস ধরে রাখতে চেয়েছে–রিমিকে। সরল রিমিকে। সেই রিমি এখনও সরল কিন্তু তিক্ততার বশে বশীভূত। হামজা আন্দাজ করে, রিমি যখন-তখন মুখে চেয়ে বসবে, আমাকে তালাক দিন।
হামজা শক্ত করে চেপে ধরল গ্রিলটা। তার বলবান হাতের মুঠোর ওপর মোটা মোটা রগগুলো খাড়া হয়ে উঠল। বুকের ভেতরে এক চাপা সূঁচালো ব্যথা টের পাওয়া যাচ্ছে। রিমির মুখে উচ্চারিত এই কথায় হামজার যে হেরে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা ও ব্যর্থতা আছে, তা হামজা সামাল দেবে কী করে?
এরপরের ভয়টা হামজাকে বিষের মতো গ্রাস করে। সে সব সহ্য করতে পারবে, সে পারে। কিন্তু…জয়ের চোখে তার জন্য অভিযোগ…. ঘৃণা!
মস্তিষ্কের মধ্যভাগটা দপদপ করে উঠল। মাথা ঝারা মারল হামজা। দ্রুত রুমে এসে প্রেশারের ওষুধ ও দুটো ঘুমের ওষুধ খেলো। তার ইচ্ছে করছে রুমটাকে ভেঙে আছড়ে গুড়ো গুড়ো করে ফেলতে। হামজা অস্থিরতা ও ভয়কে ঘেন্না করে। ক্ষমতা ও জয় তার। সে একটা আফসোসে আজ বহুদিন যাবৎ ঘুমায় না।
অন্তূ মেয়েটাকে ক্লাবঘরে তুলে নিয়ে যাবার কথা ছিল। এরকম বাড়ন্ত কাউকে পথে রাখতে নেই। অন্তূকে সে সুযোগ দিলে সে মুস্তাকিন মহানের মতোন কেঁচোর বদলে খুঁড়তে খুঁড়তে অজগর সাপ বের করে আনতো। এ কথা পলাশ জানতে পেরে বলেছিল, ‘হামজা তুমি আমার হক নষ্ট কোরো না এভাবে। তুমি কি জানো, কাকতালীয় ওই ছোটপাখির ভাই আমার কাছে ঋণী! ক্লাবঘর ছাড়ো, তুমি আমার ঘরে আনো। আমার ওপরে তোমার ভরসা নাই?ʼʼ
হামজা সম্মতি দিলো। অন্তূর প্রধান দূর্বলতা তার আব্বু। দ্বিতীয়টা সম্মান। দুটো লুট করতেই পলাশ সিদ্ধহস্ত, তার হাত পাকা। কিন্তু বাজির চাল পাল্টে দিয়েছে সেই সন্ধ্যার শেষক্ষণে জয় আমির। অন্তূ বেঁচে গেল সেদিন, আমজাদ সাহেবও।
এরপর অন্তূকে ঢাকায় তুলে নেবার কথা ছিল। কিন্তু তার মাঝে অন্তূ জয়কে থুতু নিক্ষেপ করে যে আরও একবার চাল পাল্টে দেবে হামজা তা ভাবতেও পারেনি। বিষয়টা সে জেনে বরং খুশিই হয়েছিল। সেদিন জয় পলাশের রুফটপ থেকে অন্তূকে বাঁচালেও, এই থুতুর বদলা নিতে হলেও জয় এবার অন্তূকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
কিন্তু জয় তার আগেই হামজাকে না জানিয়ে এক অঘটন ঘটিয়ে বসল। থুতুর বদলে থুতুর আয়োজন করল। হামজা সেদিন অত অল্প সময়ে আর কিছু ভাবতে পারেনি। নির্বাচনের ক’দিন পর, রেপুটেশন রক্ষার চেয়ে বড় কর্ম নেই একজন রাজনৈতিকের জন্য। নতুন অবস্থায় মানুষের মন ভাঙা চলবে না, মহান হতে হবে। সেই মুহুর্তে অন্তূকে হাতের মুঠোয় রাখার একমাত্র উপায় তার মাথায় জয়ের সাথে বিয়ে দেয়াই এসেছিল।
হামজা বেড-সাইড টেবিলের ওপরের ল্যাম্পটা তুলে এক আঁছাড় মারল। চুরমার হয়ে গেল তা বিকট শব্দ তুলে। এতবড় ভুল হামজা কী করে করেছিল সেদিন? আরও কয়েকটা ভুল হামজা করেছে এই কয়টা মাসে। সে মেয়েটাকে দূর্বল করতে অন্তিককে ট্রাকের চাকার নিচে পিষে ফেলেছে। পরিবারকে উচ্ছেদ করে ছেড়েছে। কিন্তু জেদি মেয়েটাকে জবাই করার সঠিক কাজটা সে করেনি। এবং সবচেয়ে বড় ভুল সে করেছে সে জয়কে মেয়েটার কাছে ছেড়ে রেখেছে।
এর পেছনেও অন্তূর একটা চাল বোধহয় খেটেছিল। অন্তূর সাথে জয়ের সম্পর্ক এতই বিশ্রী ও বিরোধী ছিল যে হামজার কখনও খেয়ালই আসেনি ওই মেয়েটার ওপর জয় নিজেকে হারাতেই পারে কোনো একদিন! রোজ মারধর, চেঁচামেচি, বৈপাক্ষিক বাক-বিতন্ডা, বোকা বোকা উত্তেজনা! হামজা যেন বিভ্রান্ত হয়ে উঠেছিল!
হামজা বিছানার চাদর চেপে ধরে মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসল। ইচ্ছে করছে হাতুরি দিয়ে মাথার ওপর এক বাড়ি মেরে সবটা থামিয়ে দিতে।
দরজায় নক পড়ল। একজন সার্ভিসবয় এসেছে। সাথে একটি মেয়ে। মুখে সাজগোজ, শাড়ি পড়ার ধরণ ও ব্লাউজ দেখে বুঝে ফেলল হামজা মেয়েটা কী!
সার্ভিসবয় খুব বিনয়ের সাথে বলল, “স্যার, আপনার ড্রিংক। ভেতরে রাখব?ʼʼ
হামজা হেঁটে এসে বিছানায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “রাখো।ʼʼ
সার্ভিস বয় মদের বোতল রেখেও দাঁড়িয়ে আছে দেখে বলল, “কিছু বলবে?ʼʼ
স্যার! একটু লাজুক হাসল ছেলেটা, “ম্যানেজার, মানে ম্যানেজার স্যার ওকে পাঠাইছে আপনার সেবার জন্য! একা আছেন। একটু সঙ্গ দরকার হতে পারে। আমাদেরকে আপনার স্পেশাল সেবার জন্য বলে দেয়া হইছে উপর থেকে।ʼʼ
হামজা অবহেলার দৃষ্টি মেলে একবার দেখল মেয়েটার দিকে। আসল চেহারা বোঝার উপায় নেই, এত গাঢ় সাজ সেজেছে। হামজা মনে মনে বকে উঠল, ‘খানকি সাজছে কত? হোগা ভরা সাজের মাইরে চুদি! শালি স্লাট!ʼ
এই কাজে সেজে আসার কোনো কারণ খুঁজে পেল না সে। বিয়ের পর আর কখনও অন্য নারীকে ছোঁয়া হয়নি। আজ বিরহ, মনের অস্থির যন্ত্রণা অথবা অনেকদিন রিমির সঙ্গছাড়া থাকার ফলে পৌরুষ উত্তেজনায়ই হোক হামজার ভেতরে এক প্রকার আবেশ জাগল। মদ ও নারীসঙ্গ এই মুহুর্তে খুবই দরকার। ছেলেটাকে চলে যেতে ইশারা করে মেয়েটাকে কাছে ডাকল। মেয়েটা দরজা আঁটকে এসে নিজেকে লুটিয়ে হামজার পায়ের কাছে বসল।
হামজা হাঁটুর ওপর কব্জি রেখে ঝুকে বসে। এক আঙুলে থুতনিটা তুলে ধরে চেহারাটা দেখে। খারাপ না তবে মেকাপের ওপর দিয়েও দু চারটে ব্রণ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা একদৃষ্টে হামজার ফুলে থাকা বুক, শক্ত পেট ও বাহুর পেশী দেখছিল। শেষ অবধি আচমকা শ্যামলা বলিষ্ঠ বুকে কালো কুচকুচে পশমের ওপর হাত রাখল।
হামজা তাচ্ছিল্য হাসে। তার ভেতর থেকে আগ্রহ কমে আসছে। সে বেহায়া মেয়েলোক পছন্দ করে না। মেয়ে মানুষ হবে লাজুক, পুরুষের সংস্পর্শে কুঁচকে উঠবে, এমন নারীকে ছুঁতে পুরুষদেহ ব্যকুল হয়।
নড়াচড়ার মাঝে ইচ্ছাকৃত বুকের কাপড় ফেলে দিলো মেয়েটা। হামজা দেখল। কয়েকবার মুখে আঙুল নাড়ল। রাগ মাথাচাড়া উঠছে। যতবারে মেয়েটার দিকে চাইছে, তার ভেতরটা আবেদন করছে যেন চোখদুটো রিমির লজ্জায় লাল নত মুখখানা পায়!
তা না পেয়ে ভেতরের রাগ ও যন্ত্রণা বেড়ে অসহ্য পর্যায়ে চলে গেল। তার এই চৌত্রিশ বছরের জীবনে এই শৃন্যতার বোঝা সে বয়নি আগে। তার বাপ হবার ছিল, তার একজন স্বামী হবার ছিল। সে নিজের একটা পরিবার চেয়েছে, যা তার কোনোদিন নেই। হামজার মনে পড়ল, সে পরিচয়হীন হয়েই মরতে চলেছে। তারও জয়ের মতোন আগেপিছে কেউ নেই। রিমি থাকতে দেয়নি।
বুকটা কেমন মুচড়ে এলো। হৃৎপেশীতে টান অনুভব হলো। সে কি সব হারাতে চলেছে? জয়, রিমি, সন্তান, ক্ষমতা! চোখ বুজে নিজের বুক থেকে মেয়েটার হাত সরিয়ে শান্ত-হিংস্র গলায় বলল, “আউট!ʼʼ
মেয়েটা বুঝতে পারল না যেন। হামজা চোখ খুলল, মেয়েটা আৎকে উঠল। লাল টকটক করছে হামজার দুই চোখের শিরা। গম্ভীর দাড়ি-গোফওয়ালা মুখ, রক্তলাল চোখে চেয়ে হাত সরিয়ে নিলো মেয়েটা।
হামজা বলল, “যাবার সময় দরজার নব লক করে যাবে।ʼʼ
মেয়েটার চোখে হতাশা। সে যেন শুধু পয়সার জন্যই নয়, হামজার মতো পুরুষের সঙ্গ পেতেই চেয়েছে আজ হামজাকে দেখার পর।
ভয় পেয়ে মেয়েটার চলে যাবার পর হামজা মদের বোতল খুলে বসল। সে বহুদিন এত মদ একবারে বসে পান করেনি। তার মাথায় একটা চিন্তা এলো, সে যেমন নিজের সন্তান ও স্ত্রীর বিরহে এমন জঘন্যভাবে কাতর হয়ে পড়েছে! সে হামজা, তার মতো পাথরের ভেতরে প্রাণ টের পাওয়া যায় আজকাল। সেখানে জয় কী করে সামলাবে নিজেকে। ছটফট করে উঠল হামজা। অসম্ভব! এদিকের কাজ অতি শীঘ্রই সেরে তাকে দিনাজপুর ফিরতে হবে। জয়ের জীবনে কোনো পিছুটান থাকতে পারে না। হামজা রাখবে না। জয়কে সে ধ্বংস হতে দেবে না। তার কলিজার এক টুকরো জয়। চোখের সামনে জয়কে হেরে যেতে দেখা হামজার কাছে মৃত্যুসম।
কল বেজে উঠল। এমপি মন্ডল সাহেবের কল। তিনি জানালেন কামরুল তার বড়ঘরে খুন হয়েছে। বাপ্পী আর রবিউল গুরুত্বর আহত বুলেটের আঘাতে।
হামজার মস্তিষ্ক এমন সময় এমন সংবাদ গ্রহণ করতে পারছিল না যেন। অনেকক্ষণ মদের বোতলটা হাতে চেপে নির্বিকার বসে রইল হামজা। বড়ঘরে কী হয়েছে তার উ
অনুপস্থিতিতে? তার একটা সম্ভাব্য দৃশ্য ফুটে উঠল হামজার চোখের সামনে। একটা গভীর করে শ্বাস টেনে চোখ বুজে বসে রইল মিনিট খানেক, দম ছেড়ে তাকাল।
এরপর জয়কে কল করল। তিনবারেও কল রিসিভ করল না জয়।
—
জয় অন্তূকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে আর কারাগারে গেল না। ক্লাবে গিয়ে কয়েকজনকে বলল, “ভার্সিটির আশেপাশেই থাকবি। তোদের ভাবী বের হলে রিক্সা ধরে দিয়ে পেছন পেছন এসে বাড়িতে ঢুকিয়ে দিবি।ʼʼ
এরপর ছয় সাতজনকে সাথে নিয়ে কুষ্টিয়াগামী বাসে উঠল। দিনাজপুর থেকে কুষ্টিয়া কমবেশি আট ঘন্টার পথ। রাত আটটা বাজবে সেখানে পৌঁছাতে। গাড়ি যখন গ্রাম্য সড়ক দিয়ে চলছিল, রাস্তার দু ধারে ফসলি জমি, বাসের জানালা দিয়ে আসা শনশনে বাতাস।
জয় সেই চলমান প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠল,
কাগজের ফুলে কভু ভ্রমর আসে না
মরা গাছে কখনও ফুল ফোটে না..
কলমের কালি যদি যায় শুকিয়ে,
জীবনের খাতা শূন্য থেকে যায়, আমি লিখব কোথায়…
তার ফোন বাজছে। তিনবার বেজে গেল। হামজার কল। তার ধরতে ইচ্ছে করল না। এটা এক ধরণের ব্যথা। এই ব্যথার নাম জানে না জয়। এই যে সব রকমের ব্যথাকে ছাড়িয়ে ওঠা এই ব্যথাটা, এটার উৎপত্তি মুরসালীনের একটা বাক্য! সে তার একমাত্র অবলম্বণের প্রতি সন্দেহিন। এই দ্বিধা তার ও হামজার মাঝে আসার ছিল না। ব্যথাটা রিংয়ের আওয়াজের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল।
চতুর্থবার রিসিভ করে চুপ রইল। হামজা বলল, “কামরুলকে কে মেরেছে জয়?ʼʼ
-“কে মারবে আমি ছাড়া?ʼʼ
-“তুই মেরেছিস?ʼʼ
-“আর কে মারার আছে?ʼʼ
-“কেন?ʼʼ
-“বাড়াবাড়ি করছিল। মারার উদ্দেশ্যে গুলি করিনি। কিন্তু জায়গামতোন লাগছে, টপকে গেছে। আমার দোষ নাই কোনো।ʼʼ
-“বাপ্পী আর রবিউল….ʼʼ
কথাটা পুরো হবার আগেই জয় কল কেটে ফোন বন্ধ করে দিলো। এখন জিজ্ঞেস করবে, কোথায় তুই। জয়ের কাছে জবাব নেই। সে হামজার সাথে এভাবে কথা বলতে চায় না।
রাত সাড়ে আটটার দিকে মার্জিয়ার বাপের বাড়িতে সাতজন অজ্ঞাত যুবক ঢুকল। বাড়ির লোকজনদের হাতে কেজি পাঁচেক মিষ্টি ধরিয়ে দিলো।
জয় চারদিকটা দেখল একবার। দুটো ঘর দালান, ওপরে চিনের চাল। দুটো ছাপড়া টিনের বেড়াওয়ালা ঘর। তার মধ্যে একটা রান্নাঘর বোধহয়। মার্জিয়া বারান্দায় হাঁটছিল উচু পেটটা নিয়ে। জয়কে দেখে তার ভেতরটা কেঁপে উঠল, ঘেন্নায় ভরে এলো বুকটা। জয়কে সবাই প্রশ্ন করল, “কে তুমি?ʼʼ
জয় বেহায়ার মতোন হেসে মার্জিয়ার দিকে ইশারা করে তুড়ি বাজালো, “এই তো, ভাবী! কী যেন নাম! ধ্যাৎ শালার! বয়স হচ্ছে তো, স্মৃতিশক্তি দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। উমম! মার্জিয়া ভাবীইই! উনার ননদের একমাত্র স্বামী আমি–জয় আমির। শাশুড়ি আর ভাবীর সাথে দেখা করতে আসলাম। আপনারা খুশি হননি তো? খবরদার হবেন না। আমি একটু কুফা মানে অশুভ আছি। হিহি, ভালো আছেন ভাবী?ʼʼ
মার্জিয়া আতঙ্কিত চোখে চেয়ে রইল। এমন ধরণেরই এক তান্ডব বছর পাঁচেক আগে একবার হয়েছিল বাড়িতে, তারপর তার জীবন বদলে গেছে।
-“ভাবী! আরমিণের আম্মা কই? কোন ঘরে থাকেন উনি?ʼʼ
রাবেয়া হলদে লাইটের আলোয় চশমা চোখে দিয়ে নিচু জলচৌকির ওপর বসে কাঁথা সেলাই করছিলেন। জয় জুতো পায়ে ঘরে উঠে গিয়ে উনার সামনে বিছিয়ে রাখা কাঁথার ওপর বসল। রাবেয়া চমকে উঠলেন জয়কে দেখে। ওর এই বাড়ি চিনে আসার কথা তো না! জয়ের মুখে সেই চঞ্চল হাসি।
চলবে…
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৭৪. (বর্ধিতাংশ)
অন্তূ যখন উঠে চলে আসছিল তখন পেছন থেকে রউফ রসিক সুরে জিজ্ঞেস করে ওঠে, “জয় আমিরকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারব না। তার বদলে কী শাস্তি দেবার অনুমতি দেবেন আপনি?ʼʼ
অন্তূ দরজা চেপে ধরে পেছন ফিরে তাকায়, “যাবজ্জীবন কারাদন্ড! কারাগারের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর কালকুঠুরীখানা যেন তার বসবাসের জায়গা হয়। এবং সেখানে থাকবে না কোনো পরিচিতদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ! সে বন্দিত্বের অন্ধকারকে ভয় পায়, সে আইনকে বড্ড ভয় পায়।ʼʼ
“এটা জয় আমিরের হিসেব গেল। আর হামজা পাটোয়ারী সাহেবেরটা?ʼʼ
অন্তূ হেসে বলল, “এটা সময় বলবে।ʼʼ
বেরিয়ে আসতে আসতে অন্তূ মনে মনে বলল, ‘নেশাগ্রস্থ এক অন্ধ-পঙ্গু তার হাতের লাঠি হারিয়ে কতটা দিশেহারা হয়ে পড়ে আপনি জানেন না, রউফ সাহেব; আর যদি সেই লাঠি হয় তার বড় ভালোবাসার ধন! সেই দিশেহারা বুড়ো শেয়ালকে আমি আইনের হাতে তুলে দিয়ে হাতছাড়া করব না। তার সঙ্গে কত হিসেব বাকি আমার! সুযোগ পেলে তার জন্য কারাগার আমি তৈরি করব আমার হাতে।ʼ
—
জয়কে দেখে রাবেয়ার চোখে-মুখে আক্রোশের মতো একটা ব্যথা ফুটে উঠল, “এইখানে আইছো ক্যান? হুমকি দিতে, আমারে ভয় দেখাইতে?ʼʼ
“আরে শাশুড়ি, আপনি তো ভুল বুঝতেছেন! আমি কি খারাপ ছেলে নাকি?ʼʼ
-“ক্যান আসছো তাইলে আমার কাছে, জয়? আর কী আছে আমার? কী দেব তোমারে? কিচ্ছু নাই আমার। অন্তূ কিছু করছে?ʼʼ
রাবেয়ার কথাগুলো একদৃষ্টে চেয়ে থেকে শুনল জয় তারপর একটু হেসে বলল, “ওর কী করার কথা? ওরেস্সালা! আমারে যাতে গলাটলা টিপে জয় বাংলা করে দেয়, এই বুদ্ধিসুদ্ধি দিছেন নাকি গতরাতে?ʼʼ
রাবেয়া ভঙ্গুর গলায় বলেন, “তার দরকার পড়বে না। আল্লাহ বিচারক। আমার আল্লাহ আছে। উনি সব জানেন, সব দেখেন।ʼʼ
জয় জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “হু হু, থাকলে নিশ্চয়ই দেখেন। উনি দেখেন বলেই তো আপনার এই অবস্থা!ʼʼ
-“দিন সবার আসে, জয়। আইজ তুমি ভালো অবস্থায় আছো, কে বলতে পারে কালকেও এই অবস্থায় থাকবা। এইরকম ভালো একদিন স্বামী-সন্তান নিয়ে আমিও ছিলাম। আইজ নাই।ʼʼ
জয় মাথা নুইয়ে হেসে ফেলল, “আমি স্বয়ং জীবিত এক বদদোয়া। আমার ওপর আপনার বদদোয়া কাজ করবে না।ʼʼ
-“তুমি কি এইখানে আমারে ভয় দেখাইতে আসছো, যাতে অন্তূরে দূর্বল করতে পারো! এক আমিই তো আছি যারে জিম্মি করবা আর অন্তূ ভয় পাবে। মারবা আমারে? মারো জয়, মারো! কিচ্ছু নাই এই মায়ের কাছে। মেরে ফেলো আমারে। আমি সেই হতাভাগি দূর্বল মা, যে তার দুই ব্যাটা-বেটিরে তোমাদের মতোন রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচাইতে পারে নাই। এখন আবার জিন্দা আছি অন্তূর দূর্বলতা হবার জন্যে, তুমি তারচে মেরে ফেলো আমারে। অন্তূর আর কোনো দূর্বলতা না থাক্। মারো..ʼʼ টসটসে গরম নোনাজলে গাল ভিজে উঠল রাবেয়ার।
জয়ের ডান হাতখানা নিজের দিকে টেনে নিয়ে আঘাত করতে করতে কেঁদে ফেলল রাবেয়া,“মারো! মারো না! অনেক শক্তি না তোমার? কত ক্ষমতা দিছে আল্লাহ্ তোমারে! যা খুশি করো, বিচার নাই, সাজা নাই। তোমরাই তো মানুষ। যে মহিলার ছেলে নাই, মেয়ে কাছে নাই, স্বামী নাই, ঘর নাই, তারে বাঁচাইয়া আর কত সাঁজা দিবা? আমার মতোন অভাগীর বাঁচার হক নাই আল্লাহর জমিনে।
অন্তূরে আমি বলতাম, এত তেজি হস না। মেয়ে মানুষের এমন হইতে নাই। শোনেনি আমার কথা। ওর বাপের মতোন বেপরোয়া হইলো। আইজ মনেহয় ও ঠিক ছিল। তুমি মারো আমারে। আমি অন্তূর দূর্বলতা হবো না। তুমি আমারে মাইরে ফেলো। ওর কেউ নাই। আমি থাকলে আরও মুসিবত। তুমি ওরে আমার দোহাই দিয়ে হুমকি দিলে আমার অন্তূ উকিল হতে পারবে না। ওর আব্বা ওরে উকিল বানাইতে চাইছিল। আমার সেই সাধ্যি নাই। আমি খালি ওর ঘাঁড়ের বোঝা হয়ে বেঁচে আছি। আমার মেয়ের কত স্বপ্ন জানো, জয়? আমি মা ওরে জন্ম দিছি দুনিয়ায় খালি শাস্তি-সাজা পাবার জন্যে। আমার অন্তূ কিচ্ছু পায় নাই কোনোদিন। কিছু চাইতোই না। ওর বয়সী মেয়েদের কত আবদার থাকে। আমার অন্তূ ওর বাপের মা ছিল। তারে জাহান্নামে দিছি আমি। আমার হাত বান্ধা। কিচ্ছু বলবার সাধ্যি নেই আমার তোমারে।ʼʼ
“কী বলতে চান? শুনি! আঘাত করতে চান?ʼʼ
জয় পকেট থেকে ধারালো এক ড্যাগার বের করে ধরে হাসে, “এই নেন…আপনার অন্তিককে ট্রাক চাপা দিয়ে মেরেছি আমি। ধরুন, জানের বদলে জান।ʼʼ
রাবেয়া চোখ দুটো বুজে ছিটকে উঠল, “খবরদার ওই জিনিস আমআর কাছে আনবা না। দূরে সরাও।ʼʼ
-“কেন? মারবেন না আমায়? সুযোগ পেয়েছেন, কাজে লাগান। এটা হলো একটা সচেতন নাগরিকের বৈশিষ্ট্য। আমি চলে গেলে কিন্তু আফসোস হবে ছেলের খুনিকে ছেড়ে দেবার।ʼʼ
রাবেয়া কান্নাভেজা চোখে মলেন হাসেন, তার কণ্ঠস্বরটা থরথর করে কাঁপে, “আমি কে গো আমার ছেলের খুনের বদলা নেবার? আমার আল্লাহ কি দেখে না? তুমি আমার ছেলেরে মারছো, আমিও যদি সেই একই পাপ করি, আমার-তুমার মধ্যে তফাত কী থাকলো? আমি কি বিচারক? বিচারক তো এক মালিক। ওই জিনিস তুমার হাতেই ভালো মানায়। তুমার তো দরদের লোক নাই, তাই তুমিই পারবা কারও দরদের জিনিস ছিনাইয়া নিতে। আমার হাত দূর্বল গো, জয়।ʼʼ
জয় নিজের বাম হাত দিয়ে রাবেয়ার হাতখানা ধরে থামিয়ে বলল, “আপনার মেয়ে কিন্তু আপনার মতোন ভাবে না। সি ওয়ান্ট জাসটিস! সে বিচার চায়, বিচার করতে চায়। আপনার মহান নীতি সে মানে না, এটা জেনে কি আপনার কষ্ট পাওয়া উচিত না?ʼʼ
-“তুমি ছুঁইও না তোমার হাত দিয়ে আমারে। তোমার হাতে অন্তিকের রক্ত লেগে আছে…ʼʼ
জয় একদৃষ্টে তাকিয়ে বলে, “আপনি আগে ছুঁয়েছেন আগে আমাকে।ʼʼ
-“এখন ছাড়ো। তুমি ছুঁইও না আর। ছেলের রক্তে মাখা হাত মা সহ্য করতে পারে না। তুমি ছাড়ো!ʼʼ
জয় জিজ্ঞেস করে, “সব মায়েরাই কি আপনার মতো হয়?ʼʼ
রাবেয়া আঁচল তুলে চোখের পানি মোছেন। জয় জিজ্ঞেস করে, “হু? সব মায়েদের জন্যই কি ছেলের রক্ত কষ্টদায়ক?ʼʼ
-“তুমি বুঝবা না মা’র দরদ।ʼʼ
জয় গম্ভীর হয়ে বলে, “বোঝার কথা না। আমার রক্ত দেখে কোনোদিন আমার মা কাঁদে নাই।ʼʼ
-“তোমার কি মায়ের দরকার আছে, জয়?যে মা’র দরদ বোঝে সে কোনো মা’র বুক খালি করে না।ʼʼ
জয় বাচ্চাদের মতো জিজ্ঞেস করে, “আমি যেভাবে অন্তিককে মেরেছি, আপনার অন্তূও যদি আমাকে ওভাবে মেরে ফেলে, আপনি আমার জন্য কাঁদবেন এভাবে?ʼʼ
রাবেয়া একটু থমকালেন। জয় রাবেয়ার সেই কম্পমান হাতখানা টেনে নিয়ে নিজের মাথায় রেখে জিজ্ঞেস করে, “কাঁদবেন আমার জন্য? আমার মা নেই। আমি অন্তিকের মতোন ওরম রক্তাক্ত হয়ে পথে-প্রান্তরে পরে থাকব ঠিকই, কিন্তু আপনার মতো করে কাদার কেউ নেই আমার। কাঁদবেন আপনি আমার জন্য?ʼʼ
রাবেয়া হাত সরাতে চান জয়ের মাথা থেকে, জয় সরাতে দিলো না। রাবেয়া জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা অথচ রুষ্ট গলায় বললেন, “সন্তানের খুনির জন্য কাঁদতে নেই।ʼʼ
জয় হাসে, “আপনি একদিন আপনাকে ‘মা’ ডাকতে বলেছিলেন আমাকে। ওসব কথার কথা ছিল তাই না? নিজের মা ছাড়া অন্যের সন্তানের জন্য কেউ কাঁদে না, হু? আমি আমার রক্ত দেখে বিলাপকারী সেই একমাত্র কাঁদুনির রক্তও ছুঁয়ে দেখেছি। আমার হাত শুধু আপনার ছেলের না, জয় আমির নামক ছেলের মায়ের রক্তেও ধোয়া, সে ছিল একমাত্র নারী, যে জয় আমিরের রক্ত দেখে হয়ত আপনার মতোই কাঁদতো। আপনি বুঝবেন না আমার হাতের কেরামতি!ʼʼ
রাবেয়া কিছুক্ষণ জয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হু হু করে কেঁদে ফেললেন গা কাঁপিয়ে। জয় নিজের মাথার ওপর থেকে রাবেয়ার হাত ছেড়ে দিলেও রাবেয়া হাত নামিয়ে নিলেন না। জয় ডানহাত দিয়ে পকেট এক থেকে বান্ডিল টাকা বের করে আলগোছে রাবেয়ার কাঁথার তলে রাখে।
অপর হাতে রাবেয়ার মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, “শোনো হতভাগী, তোমার আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম যাও, তোমার অন্তিকের একটা মেয়ে হবে, ঠিক তোমার মেয়ের মতো। কিন্তু তোমার বদদোয়া যেন না থামে আমার জন্য, খবরদার! আজ আসি। আবার দেখা নাও হতে পারে।ʼʼ
রাবেয়া চট করে চোখ তুলে তাকাতেই জয় হেসে উঠল হো হো করে, “তোমার মেয়ের হাতে যদি শহীদ হয়ে যাই!ʼʼ
চোখ মেরে গা ঝেরে উঠে দাঁড়ায় জয়। আর তাকায় না পেছনে। বেরিয়ে আসে দলবলসহ। আসার সময় মার্জিয়ার দিকে তাকিয়ে একবার হাসে, “ভাবী, আপনার মেয়ে হলে নাম রাইখেন, হুমায়িরা! একটা সতর্কবার্তা দেই আগেই। এই নামডা সুন্দর কিন্তু জীবন না। ওকে আবার বলবেন না যে ওর বাপের খুনী ওর নাম দিয়েছে। নাম বদলে ফেলবে আবার। আমার ইজ্জত যাবে।ʼʼ
জয় সকাল সাড়ে পাঁচটায় দিনাজপুর পৌঁছাল। বাড়িতে ঢুকে দরজায় দুম দুম করে দুটো লাত্থি মেরে চেঁচিয়ে ডাকল, “তরুউউ! তরুউউউউ! তর…ʼʼ
থেমে গেল জয় আমির। কেউ হেঁটে আসছে। জয়ের বুকের ভেতর আঁটকে এলো। দম বন্ধ হয়ে একটা ভয়াবহ ব্যথা শক্ত হয়ে উঠল সেখানে। যে পা হেঁটে আসছে, তা কি তরুর হতে পারে? তরু আসছে জয়ের জন্য দরজা খুলতে? জয় এই ভোর সকালে ভেতরে ঢুকে দেখবে নির্ঘুম লাল চোখ নিয়ে তরু দুই প্লেট খাবার বেড়ে নিয়ে বসেছিল রাতভর। এখন জয়কে বিরবির করে দু-চার কথা শোনাবে।
দরজা খুলেই অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “কোথায় ছিলেন সারারাত? কোথায় গিয়েছিলেন?ʼʼ
জয়ের ঘোর ভাঙে। বুকের ব্যথাটা ছড়াচ্ছে এপাশ-ওপাশে। চোখ পরিষ্কার হচ্ছে। কণ্ঠস্বরটা তরুর মতো মিনমিনে, জড়ানো না। একটু তেজস্বী, স্পষ্ট! জয় একটা মাথা ঝারা মারে, মুহুর্তের মাঝে নিজে চিরচেনা রূপে হেসে ওঠে, “হোয়াট’স আপ, ঘরওয়ালি? আপনি কি চিন্তিত? সব ঠিকঠাক?ʼʼ
অন্তূ ঘরে হাঁটা ধরল। জয় হাইবুট জোড়া নিজের রুম পর্যন্ত আসতে আসতে খুলল। তারপর দুটো দু’দিকে ছুঁড়ে মারল। রুমে ঢোকার আগে পেছন ফিরে ডাইনিং টেবিলগুলো আবার একবার দেখে।
অন্তূ গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। শরীর ভালো লাগছে না। দূর্বলতায় হাত-পা পড়ে আসছে। গোসলে ঢুকলে জয়ের খুব গান আসে। গলা ছেড়ে গান না গাইলে গোসল শুদ্ধ হয় না। সে গলা ছেড়ে গান ধরল,
ভালোবেসে এইবার আয় কাছে তুই
সব ভুলে একবার আয় তোকে ছুঁই…
গোসল শেষে বেরিয়ে দেখল অন্তূ খাবার এনে ঢেকে রেখেছে। জয় লুঙ্গি বাঁধতে বাঁধতে আবদার করে, “খাইয়ে দাও।ʼʼ
-“আমি?ʼʼ
-“যাহ শালা! বিয়ে মোটে একটাই করছি। চাইলেও আরেক বউকে হুকুম করার ক্যাপাসিটি আপাতত নাই। তুমিই দাও!ʼʼ
অন্তূ জয়কে খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, “লোক এসেছিল।ʼʼ
-“এমপির লোক?ʼʼ
অন্তূ লোকমা তুলে ধরল। তাদের দুজনের কথাবার্তা মুখে খুব বেশি বলার দরকার পড়েই না বলা চলে। অঙ্গভঙ্গি ও মুখভঙ্গিতেই আধো আধো কথায়ই সব জানা-বোঝা হয়ে যায়।
জয় সপ্রতিভ হয়ে উঠল, “কী বলছে? কিছু বলছে? উপরে আসছিল?ʼʼ
-“না। আমি নেমে গিয়েছিলাম?ʼʼ
জয়ের মুখ লাল হয়ে উঠল, “কী বাবদে? নিচে নামছিস ক্যান?ʼʼ
-“নইলে ওপরে উঠে আসতো। বাড়িতে আপনি বা মেয়র সাহেব কেউ নেই। চুপচাপ চলে যেতে আসেনি ওরা। পরে আমি এবং আপনার ছেলেরা কথা বলে বিদায় করেছি।ʼʼ
জয় আনমনে নাক শিউরে মেঝের দিকে চোখ কুঁচকে চেয়ে রইল। অন্তূ জিজ্ঞেস করে, “কুষ্টিয়া গেছিলেন আপনি?ʼʼ
জয় চট করে তাকায়, “অন্তূকে দেখে একটুক্ষণ। তারপর হেসে ফেলে, বাবার মুরিদ টুরিদ হইছো নাকি? দাওয়ায় বসে কাবার কুত্তা খেদাও!ʼʼ
অন্তূ হাসে, “সাধারণ জ্ঞান। আপনার মতো ধূর্ত লোকের ফোন দিয়ে, আপনারই ঘরের বারান্দায় কথা বললাম শুনলেন না আপনি?ʼʼ অন্তূ কথা বের করার জন্য বলে, “দোলন সাহেবের সাথে কথাও তো শুনেছেন! সেটা বলছেন না কেন?ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “না তখন আসলেই ঘুমাইছি।ʼʼ
সেদিন খেয়ে-দেয়ে জয় দুপুর অবধি ঘুমিয়ে ঘটনাক্রমে প্রথমত জয় একবার অন্তূকে নিয়ে বড়ঘরে গেছিল। এবং মুরসালীনের কাছে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর পেয়েছিল! যা চমকপ্রদ, যা জয়ের চিন্তাধারায় বড় গভীরভাবে শেষ তৃতীয় আঘাতটা হেনেছিল।
তারপর পুরো বেলাটা সে মদ পান করল। সারারাত মরার মতো ঘুমালো। যেন সে পালাতে চাইছে, মুরসালীনের কথাগুলো থেকে, নিজের থেকে, অতীত থেকে। সেই কথাগুলোর দায় মেটাবার সাধ্যি তার নেই। তা বদলাবার পথ নেই। অতীতকে শুধু স্মৃতিতে ধরা যায়। তা বদলানোর জন্য যে সময়-যন্ত্রের তত্ত্ব মানুষ দিয়েছে তা কেবল একটি কল্পতত্ত্ব!
পরদিন সকালে রিমি বের হলো রুম থেকে। রান্নাঘরে অন্তূকে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে আপনার?ʼʼ
-“আমার? কী হয়েছে?ʼʼ
বলতে চান না যখন, “আমি আর জিজ্ঞেস করলাম না। আমার বাঁ চোখটা আজ কয়দিন খুব লাফাচ্ছে, লোকে বলে এটা অশুভ লক্ষণ। আপনি বিশ্বাস করেন?ʼʼ
অন্তূ হাসল, “করতে ইচ্ছে করছে এখন আপাতত। তবে আমার মনেহয় বেশি কাঁদার কারণে এমন হচ্ছে।ʼʼ
জয় দশটার দিকে ঘুম থেকে জাগলে অন্তূ বলল,
“আপনার আজ এমপির কাছে যাবার কথা।
-“তুমি এত ইন্টারেস্ট নিচ্ছ কেন?ʼʼ
অন্তূ কেমন উদাসীন হয়ে পড়ল, “কারণ কামরুলের মার্ডার আমার হাতেই হয়েছে।ʼʼ
কথাটা বলে নিজের হাতের তালুদুটো দেখে অন্তূ তাকিয়ে। জয় বলল, “কে বলেছে? দোলন স্যার?ʼʼ
-“আমাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?ʼʼ
জয় হেসে উঠল। ঘাঁড় এপাশ-ওপাশ মুচড়ে বলল, “আমার হাতে এবার একটা এমপি খুন করাতে চাও?ʼʼ
-“আপনি এর আগে কাকে খুন করেছেন?ʼʼ
জয় গামছাটা গলায় ঝুলিয়ে গোসলে ঢুকে পড়ল।
অন্তূ বসে রইল ওভাবেই। সে শুধু এটুকু বুঝল জয়য় আমিরের কাছে তার কিছু ঋণ জমে যাচ্ছে। লোকটা নিজের ইচ্ছাকৃতাভাবে নিজেকে তার কাছে পাওনাদার করছে নাকি আসলেই সে অন্তূকে বাঁচাতে চায়, ভেবে পেল না!
জয় বের হলে অন্তূ বলল, “আপনাদের আমির নিবাস কি বিশাল বড়?ʼʼ
জয় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, “তুমি যাবে?ʼʼ
-“আপনি তো এখন এমপির কাছে যাবেন!ʼʼ
জয় মুচকি হাসে, “জয় আমিরের মন বড়, সিস্টার! কোনোদিন একবার তা জিতে কিছু চেয়ে দেখতে…ʼʼ
অন্তূ মনে মনে বলল, ‘এটাই তো ভয়, জয় আমির! তার দিল জিতে কেউ তার রুহের ওপর অবধি কব্জা পেয়ে যায়, তারপর আপনাকে দিয়ে সব করানো যায়, সব! এত বড় কাঙাল আপনি! অথচ আমার কাছে এই শেষক্ষণে কিছুই নেই আপনাকে দেবার মতোন শুধু যন্ত্রণা ছাড়া।ʼ
চলবে..