#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৭৬.
○
মিস ক্যাথারিন ঝিম ধরে বসে বেশ কিছুক্ষণ মাহেজাবিণকে দেখার পর এক টুকরো ক্লান্ত হাসি হেসে বললেন, “আই ওয়ান্না বি এফরেইড অফ ইউ, মাহ্জাবিণ!ʼʼ
মাহেজাবিণ চোখদুটো বুজে ম্লান হাসে, “কেন?ʼʼ
-“এই সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার আড়ালে এমন ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার জায়গা দিয়েছ! এটা তো নীতিবিরুদ্ধ! সৌন্দর্য ও নারীর ওপর মানুষ আস্থা হারাবে যে!ʼʼ
মাহেজাবিণ বলল, “আপনি আমার ক্ষমাকে নিষ্ঠুরতা বলছেন, এটা কি নীতিবিরুদ্ধ নয়? তবে কি আমি জয় আমিরকে খুন করলে সেটা নীতিগত হতো?ʼʼ
-“পলিসি ইজ ডেড হেয়ার। কিন্তু ওটা হতো ক্ষমা, তা জেনে রাখো!ʼʼ
মাহেজাবিণ একটু অবাক হবার মতো করে বলে, “এটা তো অধর্ম, মাদাম!ʼʼ
-“তুমি যে বারবার বলেছ সবচেয়ে কঠোর সাজার কথা, সেটাই তুমি সাজা মওকুফের নামে দিলে ওকে। আমি তোমাকে বুঝতে ভীষণ চাপ অনুভব করছি, মাহেজাবিণ! তুমি যা বলেছ, তাই করেছ। শুধু দৃষ্টিকোণ ঘুরিয়ে নিয়েছ। তুমি বলেছ কখনোই ক্ষমা করবে না। কিন্তু ক্ষমা করে দিয়েছ। অথচ এখানে আমি জয় আমিরকে তোমার দেয়া সবচেয়ে কঠোরতম শাস্তির ঘোষনা শুনছি।ʼʼ
-“এটা কোন ভিত্তিতে বলছেন, মাদাম?ʼʼ
-“মাহেজাবিণ তুমি জানো, কাঠখড়ি ও কেরোসিনের চেয়ে দিয়াশলাইয়ের দুর্বল-ছোট্ট কাঠিটি বেশি ভয়াবহ হয়?ʼʼ
-“জানতাম না।ʼʼ
-“কেননা দিয়াশলাইয়ের কাঠি কেরোসিন ও কাঠখড়িকে পোড়ানোর উদ্দেশ্যে নিজের সর্বস্বকে পুড়িয়ে ছাই করতেও দ্বিধাহীন। বরং নিজের ধ্বংস মেনে নিয়েই সে কেরোসিন ও কাঠখড়িকে জ্বালাবার জন্য নিজে জ্বলে ওঠে। তুমি হলে সেই দূর্বল, ছোট্ট এক কাঠখড়ি! এজন্যই তুমি ভয়াবহ!ʼʼ
শীতল-শান্ত মিস ক্যাথারিনকে একটু হতবিহ্বল দেখালো। তিনি দু-তিনটে বিক্ষিপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি একবারও নিজের কথা ভাবলে না? নিজেকে বলি দেবার বদলে এই ধ্বংসযাত্রায় আমি তোমাকে ভাবুক হতে দেখিনি কেন? সবচেয়ে বড় হারটা তো তোমার! এই জীবন বইবে কী করে? এই ভাবনায় চিন্তিত হওনি কেন, তুমি?ʼʼ
মাহেজাবিণ ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে বলে, “ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা জীবিতদের থাকে। মৃতরা এসব নিয়ে ভাববে কেন? আমি জয় আমিরকে গ্রহণ করার সাথে সাথে নিজেকে দাফন করেছি। দাফনকৃত লাশের ভবিষ্যত থাকে না।ʼʼ
-“আর তাই তোমাকে আজ আমি এই প্রশ্ন করতে পারছি না–এত কঠিন সাজা কোন অপরাধের বদলে দিলে তুমি জয় আমিরকে? নয়ত আজ আমার কাছে জবাবদিহি করতে হতো তোমাকে।ʼʼ
মাহেজাবিণ হেসে ওঠে, “আপনাকেও লোকটা পথভ্রষ্ট করে ফেলেছে, কেবল গল্পের মাঝেই! সত্যিই আমি এক ভয়ানক পুরুষের সংসার করেছি! যে যেকোনো কাউকে নিজের বশীভূত করে ফেলায় অলৌকিক শক্তিধর।ʼʼ
-“অথচ সেই ভয়ানক পুরুষকে আমি বলতে চাইব, সে তার চেয়েও ভয়ানক এক নারীকে নিজের ভেতরে স্থান দিয়েছে।ʼʼ
মাহেজাবিণ চোখদুটো বুজে সোফায় পিঠ এলিয়ে বসে বলল, “কারও রুহ্ জ্বালিয়ে কয়লা করে সেই কয়লাকে ভেতরে স্থান দিলে কেউ কতটা লাভবান হতে পারে, মাদাম? সেও ঠিক ততটাই পেয়েছে আমার কাছে। আমি বিচারক নই। প্রধান বিচারক ওই সৃষ্টিকর্তা আর দ্বিতীয়টা দুনিয়ার আইনত-আদালত! আমি জয় আমিরকে তাদের হাতেই সোপর্দ করলাম। ভুল করলাম?ʼʼ
মিস ক্যাথারিন মিনিট দুয়েক নিঃশব্দে দেখলেন মাহেজাবিণকে। আচমকা শ্লথ কণ্ঠে বললেন, “তুমি গর্ভবতী ছিলে, মাহেজাবিণ!ʼʼ
মাহেজাবিণ জবাব দেয় না। মিস ক্যাথারিন দুটো হাত জড়ো করে হাঁটুর ওপর রেখে মেরুদন্ড বাঁকা করে বসেন। তার জয় আমিরকে একবার দেখতে বড় ইচ্ছে করে। একবার দেখা করা দরকার ছিল।
সেই মুহুর্তে উনার কল্পনায় একটি দৃশ্যপট ছুটে আসে– কেন্দ্রিয় কারাগারের গভীরতম এক কাল-কুঠুরী সেলের সাথে হেলান দিয়ে বসা জয় আমির। তার মুখে সেই চিরায়ত হাসি। সেসময় কেউ তাকে খবর দেয়, তার ঘরওয়ালির গর্ভে একটি সন্তান জন্মেছে। আমির বংশের শেষ বংশধর! জয় আমিরের রক্ত-বীর্যে পয়দা… ঔরসজাত….আমিরদের উত্তরসূরী!
জয়ের ছটফটানিটুকু যেন ব্রতী মিস ক্যাথারিনকে ভয়াবহ হিংস্রতার সাথে তেড়ে এলো। তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। কেঁপে উঠলেন। শরীরটা একটু ঘেমে উঠল। দু-চারটে এলোমেলো শ্বাস ফেলে মাহেজাবিণের দিকে তাকালেন। এইরকম শাস্তি বুঝি জয় আমিরদের হতে আছে? যে এক জীবন নিজের পরিচয়ের পেছনে ছুটেছে, তার সন্তানকে চোখে ও হাতে ছুঁয়ে না দেখতে পাবার শাস্তি মাহেজাবিণ জয়কে দিলো!
○
মুরসালীন সেদিন শেষরাতে দু-খানা চিঠি লিখেছিল। রক্তাক্ত-কাটাছেঁড়া-অবশ হাতে এক টুকরো কাগজ তুলে নিয়ে প্রথম চিঠিখানা লিখতে বসল—
আনসারী চাচা,
সালাম নেবেন আমার। আমি ভালো আছি। খারাপ থাকা অনেক হলো। এখন একটু ভালো থাকার ব্যাপারে ভাবা উচিত। আমি ভালো থাকার দ্বারপ্রান্তে। আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে এ কথা জেনে উত্তেজিত হয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনবেন না। আমি যে শান্তির জগতের কাছাকাছি, সেখান থেকে আমাকে জুলুমের দুনিয়ায় ফেরানোর চেষ্টা না করার হাতজোড় অনুরোধ থাকবে।
অনেক দৌড়েছি আমরা। পা দুটো ক্লান্ত হলেও চলে যেত। কিন্তু মামলা আমাদের পা অবধি থেমে নেই। ওদিকের অবস্থা জানি না। এখানে থাকার সুবিধা অনেক– শব্দ, আলো, বাতাস, পানির মতো ব্যাপারগুলোর জ্বালাতন নেই। বাইরের খবর এখানে পৌঁছে না। এখানকার খবর বাইরে যায় না।
এসবে আমি-আপনি অভ্যস্ত হতে পারি। কিন্তু যারা অভ্যস্ত না বা যাদের এখনই অভ্যস্ত হবার সময় আসেনি, তারাও রয়ে গেছে এখানে। এর দায় কে নেবে? আমার কাঁধ ভেঙে গেছে, যে কাঁধে আমি ওদের শুকনো- ক্ষুধার্ত মুখের দায়ের ভার তুলতে পারি। ওদের মুখের দিকে তাকানোর সাহস হারিয়ে ফেলেছি আমি। এতদিনে যখন কিছু করতে পারেননি, এবার ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে মরণের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথটাই বাকি আছে শুধু, আর কিছু হবার নেই।
আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, ওদিকে কিছু একটা চলছে। জয় আমিরের স্ত্রী-ঘটিত এখানে একটা বিপজ্জনক ঘটনা ঘটে গেছে। এটা কতদূর গড়িয়েছে জানি না। কিন্তু সব মিলিয়ে যা হবে, তা ভালো না।
চাচা, ওদের জান ও মালের হিফাজত করব এই ওয়াদায় ওদেরকে আমানত নিয়েছিলাম ওদের অভিভাবকদের কাছে। আমি বোধহয় আর সেই আমানত রক্ষা করার অবস্থায় নেই। ওদের জীবনকে বাজি ধরে আমি এই মুখ তুলে রবের সামনে দাঁড়াতে পারব না। হামজা পাটোয়ারী আমাকে ছাড়ার ভুল করবে না। তাই আপনি শুধু ছাত্রদের মুক্তির শর্তে তার কাছে একটা বার্তা ও আত্মসমর্পণপত্র পাঠান। এবং সে ছাড়তে চাইবে না। তার জন্য আগে মাদ্রাসার কার্যক্রম স্থগিত করে দিন। এবং এটা নিশ্চিত করে জানান ওদেরকে।
এই চিঠি আপনার হাতে পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে পড়বেন। সময় এখানে ও বাইরে যথাক্রমে পৃথিবী ও মহাকাশের মতো। বাইরে এক ঘন্টা কাটলে এখানে থাকা প্রাণের আয়ু থেকে এক যুগ কোরে চলে যাচ্ছে। আর আমার সাধ্যি নেই ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখার। এমদাদের পায়ে ইনফ্রাকশন ধরে গেছে। বাকিরা জড় বস্তুর মতো মিথ্যা নিঃশ্বাস ফেলছে। ওর যথাদ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
এসব উল্লেখ করলাম, যাতে মাদ্রাসার কার্যক্রম বন্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে আপনার হাত না কাঁপে।
আপনার স্নেহভাজন,
সৈয়দ মুরসালীন মহান
হাতের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ছিঁড়ে গেছে, সেসব স্থানে গলিত পুঁজ-রক্ত বেরিয়ে এলো দীর্ঘক্ষণ কলম ধরে রাখার ফলে। মুরসালীন দ্বিতীয় চিঠিখানা বাঁ হাতে লেখার চেষ্টা করে। মাংসপেশি ও শারীরিক দূর্বলতায় থরথর করে হাত কাঁপতে লাগল। কয়েকবার কেশে উঠল সে। নাকের কিনারা দিয়ে ঝিরঝির করে রক্ত এলো। মুরসালীন এবরো-থেবরো হাতে লেখে—
আমার প্রাণপ্রিয় আম্মা,
আসসালামুআলাইকুম। চিঠির শুরুতেই আপনার অবাধ্য ছেলের অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানবেন। এ-কথা আজ প্রথমবার বলছি, অবাক হয়েছেন? আজ না বললে আর বলার সুযোগ পাবার নিশ্চয়তা নেই। আমি আপনাকে আজ মূর্খের মতো জিজ্ঞেস করব না, আপনি কেমন আছেন। কিন্তু আপনার এখন নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, আপনার বদমাশ ছেলে কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে। তা আমি আপনাকে শেষে বলব। এখন তার আগে দুটো কথা বলি।
আম্মা,
ছোটবেলায় আমি যখন পড়তে চাইতাম না, জেদ করতাম ‘এত কষ্ট করব নাʼ, আপনি বলতেন–’কষ্ট তোকে খোদার নৈকট্য দেবে। ঈমানদারেরা পৃথিবীতে সুখ পেতে আসে না। দুনিয়া তাদের জন্য নরক। এর বিনিময়ে তুই পাবি আখিরাতের অন্তত সুখ। বিশ্বাস রাখ। কষ্ট আর সুখ চাক্রিক। এখন তুই কষ্টে আছিস মানে সুখ সামনে আসছে।’ আমি সেই সান্ত্বণায় বড় হয়ে গেলাম। কিন্তু তারও অনেকদিন কাটার পরেও টের পেয়েছি, সুখ আসলেই কল্পিত এক তত্ত্ব। মানুষ ওই কল্পিত দিনের আশায় সারাটা জীবন দুঃখকে মেনে নেয় যে এই তো আর কয়েক কদম পেরোলেই সুখ! শেষ অবধি সে যখন অভিযোগ করবে, কই সুখ তো পেলাম না, দুঃখ থেকে মুক্তি তো মিললো না; এই অভিযোগ করার আগেই আল্লাহ্ পাক মানুষের জীবন-আয়ু কেড়ে নেন।
আজ আমি আপনাকে সেই অনিশ্চিত ধৈর্যই ধরতে বলব। আপনি বলতেন, ‘যার কিছু বা কেউ নেই, তার আল্লাহ আছে।’ আজ আপনাকে আমি সেই আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে যাচ্ছি, আম্মা। যেদিন আমি শেষবার আপনার কাছ থেকে এসেছি, আপনাকে জানাইনি। জানালে আপনি আপনি বের হতে দিতেন না। কিন্তু আমাকে তো বের হতেই হতো! আমি আপনাকে নামাজে কান্নারত অবস্থায় রেখে বের হয়ে এসেছি।
এবার আর আপনার কাছে ফেরা না হলে সেটা তকদীর। যখন আব্বা মরল, আমি জয় আমিরকে খুন করতে চেয়েছিলাম। আপনি বলেছিলেন, ‘খবরদার মুরসালীন। এই অকূলে আমাদের চারজনকে ভাসিয়ে তোর আব্বা চলে যাবেন, এটা তকদীর। তকদীরের ফয়সালার ওপর হাত ঘুরিয়ে কাফের হবি?’
আজ আমি আপনাকে সেই তকদীরের ফয়সালায় কাঁদতে নিষেধ করব। আহাজারি না করতে অনুরোধ করব। আপনি দুটোর পর তৃতীয়জনের দাবী ছেড়ে দিয়েও ধৈর্য ধরবেন, এরকম কথাই আজ আমি আপনাকে বলব, আম্মা।
আমি আপনাকে দেখিনি আজ বেশ কয়েকমাস। আজ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনার সরল-সহজ মায়াবী মুখটার ওপর মুমতাহিণা আর আপনাকে প্রাণভরে আজ একবার দেখতে না পাওয়া আমার তকদীর। আপনার হাতখানা আমার মাথা ছোঁয় না কতদিন! চুল টেনে ধরে বলে না, ‘জাহিলদের মতো চুল রাখবি বলে ভার্সিটি পড়াইছি তোরে? চুল যদি সুন্নতি কায়দায় ছেটে না আসিস, আমার সামনে আসবি না। কাফের হচ্ছিস ঢাকা থেকে থেকে। কাফেরের জায়গা নেই আমার ঘরে।ʼ
আমার চুল বেড়েছে অনেক। বাবরি হয়ে গেছে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই। আপনার খুব ইচ্ছে ছিল, আমি বাবরি রাখব। আজ হয়েছে আম্মা। আমার দাড়ি এক মুষ্ঠিখানেক হয়ে গেছে। আপনি দেখলে খুশি হতেন খুব। আবার অখুশি হবার মতোনও অনেক চিহ্ন গায়ে পড়েছে। না দেখাই ভালো রইল।
আজ মনে পড়ল, অনেকগুলো বেলা আমার খাবারের প্লেটে অর্ধেক মাছের মাথাটা তুলে দিয়ে আপনি বলেন না, ‘বাকি অর্ধেক মুমতাহিণার। ওর থেকে কেড়ে নিলে মার খাবি, মুরসালীন। আপনার হাতের মাছের ঝোলের ভাত খাবার ইচ্ছে করছে আজ।’
আজ অনেকগুলো দিন আমি নোংরা প্লেটে, দু-তিনদিন পর বেঁচে থাকার তাগিদে অন্ধকারে বসে দুই-এক লোকমা খাবার খাই। আপনি পাখা তুলে বাতাস করতে করতে বাতির সলতে বাড়িয়ে দেন না। এসবের আফসোস ঘুচে যেত, যদি একবার আপনাকে চোখের সামনে দেখতে পেতাম।
আম্মা দেখেছেন! আপনার ব্যর্থ ছেলে আজ শেষবার আরও একবার কাপুরুষতা দেখিয়ে দিলো এই চিঠিতে। মুস্তাকিন ভাই হলে এসব আবেগী কথাবার্তা কখনোই তুলতো না। আমি লিখে ফেলেছি। যখন চিঠি লিখতে কলম হাতে নিয়েছি, জানতাম না আমি এসব লিখে ফেলব। হাত থেতলানো আমার। এই চিঠি নষ্ট করে আবার লেখার শক্তি নেই। কলম ধরতে পারছি না শক্ত করে। তাই কাটলাম না। আবার আপনাকে কাঁদিয়ে ফেললাম! আজ কেন আমি এসব লিখে ফেলছি আপনার উদ্দেশ্যে, বুঝতে পারছি না। আপনার কাছে এসব লিখতে নেই…মুরসালীনকে ক্ষমা করবেন, আপনার মুরসালীন আপনাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলেছে–সে আপনার সঙ্গে থাকল না। অথচ আব্বা, মুস্তাকিন ও মুমতাহিণার পর তার থাকার ছিল আপনার কাছে।
আম্মা! আপনার অবাধ্য ছেলে আজ আপনাকে না দেখতে পাবার আকুলতা নিয়েই এই তথাকথিত স্বাধীন দেশ থেকে বিদায় নিয়ে আসল স্বাধীন জগতে যাবে। আমার মতো ব্যর্থ মুরসালীনদের একের পর এক মৃত্যুর মধ্য দিয়েই একদিন অব্যর্থ মুরসালীনেরা জন্ম নেবে, গর্জে উঠবে। তাদের রক্তে ধুয়ে এ দেশ একবার স্বাধীন হলেই আমি আবার ফিরে আসব আপনার পদতলে। সেদিন চোখ ভরে দেখব আপনাকে। মুমতাহিণারা আর যেদিন আমার মতো পঙ্গু ভাইয়ের বুক খালি করবে না, আপনার মতো মায়েরা যেদিন মুস্তাকিন মহানদের মতো আইনশৃঙ্খলার কর্মকর্তা ছেলেদের হারিয়ে কাঁদবে না, ওই দেশে আমি আবার ফিরে আসব আপনার কাছে।
আপনার মুরসালীন বেঁচে থাকবে, আম্মা। মুরসালীনদের মৃত্যু নেই। আপনি শুধু লাখোদের মাঝে খুঁজে নিতে পারলেই কতশত মুরসালীনকে পাবেন। আমি বেঁচে রইলাম।
আজ আর কিছু লিখব না। আজ শুধু ভাবব। মৃত্যু কি শেষ না শুরু! এই শহরে মৃত্যু কি আসক্তি নাকি অনীহা!
—
মুরসালীনের হাত থেকে কলম পড়ে গেল। ক্ষত থেকে পুঁজ পড়ছে। জীবনীশক্তি নিঃশেষ হবার পথে। মুরসালীনের গায়ে কাঁপুনি উঠল। সে জড়সরো হয়ে মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল লম্বা শরীরখানা গুটিয়ে নিয়ে।
—
দুপুরের দিকে জয় ও আরমিণ বেরিয়ে যাবার পর খবর এলো আজ হামজা দিনাজপুর ফিরছে। পুরোনো দিন হলে রিমির উৎসব লেগে যেত। কমপক্ষে দশ পদের রান্না করতে তাকে রান্নাঘরে কাটাতে হতো ঘন্টা পাঁচেক। কক্ষটা গোছগাছ করার পর হামজার পোশাক ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি কোরে রাখা শেষ হলে নিজেকে গোছানোর কাজ। গোসল করে একটা নেভি-ব্লু কালারের শাড়ি পরতে হতো তাকে। কালারটা হামজার পছন্দ।
দরজা খুলেই হামজার গায়ে চাদর, কোর্ট কিছু গায়ে থাকলে তা খুলে নিতে হয় রিমির। এরপর ওয়ালেট, চশমা, ঘড়ি অথবা বাজারের থলে বা কিছু থাকলে তা রিমির ওপর তুলে দিতে দিতে রুমে ঢুকেই পাঞ্জাবীখানা খুলে ছুঁড়ে মারার অভ্যাস হামজার।
ঘামের সাথে মিশে কড়া সুগন্ধির গন্ধখানা হামজা হামজা হয়ে ওঠে। ওই গন্ধে রিমির প্রাণ আছে, ওই গন্ধে রিমির একটা হামজা আছে। নাক কুঁচকে গোপনে সে গন্ধটা টেনে নিয়ে একখানা প্রাণোচ্ছল শ্বাস ফেলে আড়চোখে তার কঠোর পুরুষকে দেখে।
হামজার একখানা অভ্যাস আছে। বাইরে থেকে এসে সে সর্বপ্রথম গোসলে ঢোকে। রিমিকে বাথরুমের দরজাটা ধরে সেই সারাটাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় লুঙ্গি-তোয়ালে হাতে নিয়ে। বাথরুমের হ্যাঙ্গারের কোনো কাজ নেই।
গোসল সেরে এসে একখানা সিগার ধরিয়ে দোল কেদারায় গা মেলে বসে হামজা। তখন রিমির কাজ তার ভেজা মাথাটা মুছে দিয়ে ক্লান্ত শরীরটা একটু টিপে দেয়া, চুল টানা….এ সময় মতিভ্রম হলে রিমির আর নিস্তার নেই সে-বেলা।
এসব আজ স্বপ্নের মতোন, যেন আগের জন্মের স্মৃতি সেসব। রিমির নতুন এক জন্ম হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাপার হলো–এই জন্মেও রিমির দূর্বল নারীত্ব ওই নিঠুর পুরুষটিকে কামনা করে। সেই লোক কি জানে সেই যে রাতে রিমিকে কান্নারত রেখে রাজধানীর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে লোকটা, তারপর আর রিমি ঘুমায়নি। রাতে বিছানায় পিঠ ঠেকায়নি! রিমি পারে না। তার নগ্ন-নরম বুকটার ওপর লোকটা দাড়ি-গোফওয়ালা শক্ত মুখটার ভার না ছেড়ে দিলে রিমি একটুও ঘুমোতে পারে না।
রিমি তো ছোট ছিল। তার উচ্চতাও হামজার বিশাল দেহটার চেয়ে নেহাত ছোট। প্রথম প্রথম যখন অভ্যাস হচ্ছিল—হামজা রিমিকে বিছানায় চেপে ধরে রিমির আলগা বুকে চুল-দাড়িতে আবৃত মাথাটাসহ গোটা শরীরের ভার ফেলে ঘুমাতো। রিমি ঝগড়াও করেছে এ নিয়ে। তার দম বন্ধ হয়ে আসে। অতবড় মানুষের ভার তার ছোট্ট শরীরে সয়?
তাকে এ সময় হামজার থামানোর কৌশলটা কী শিকারী জাতীয় ছিল! পোড়া-কালো ঠোঁট রিমির কচি ঠোঁট আকড়ে ধরলেই রিমির শরীর আওলে যেত। নারীদেহ পুরুষের এমন ছোঁয়ার কাছে কত বাজেভাবে শিকার হয়ে যায়, সেসব জানে লোকটা?
আজ সেই দম বন্ধকর পরিবেশ না তৈরি হলে রিমির ঘুম আসে না। সে বিছানায়-ই টিকতে পারে না। রিমিকে এসে খবরটা দিয়ে গেল একটা ছেলে, “ভাবী! ভাই ঢাকা থেকে ফিরতেছে।ʼʼ
রিমির জিজ্ঞেস করতে জিহ্বা নড়ে, ‘সেটা তোমার ভাই আমাকে জানাতে বলেছে?ʼ
কিন্তু বলা হয় না। ওরা কেউ রিমির দিকে চোখ তুলে সরাসরি তাকায় না। আবার বেশিক্ষণ সামনেও থাকে না। হামজার আদেশ অথবা নিষেধ বোধহয় এমনই!
কথাখানা শোনার পর রিমির ভেতরে যে যাতনা শুরু হলো, তা বেসামাল হয়ে উঠল। এই সময় রিমির কী করার অভ্যাস, রিমি করছে কী! তরু কোথায়, শাহানা কই! বাড়িতে হামজার ফেরার খবরে তোড়জোড় শুরু হচ্ছে না কেন?
এ কথা ভাবতেই আবার বিষাক্ত সেই অনুভূতি রিমির গলা চেপে ধরল। এসবের জন্য দায়ী ওই লোকটা। বাড়িটা শ্মশান হয়ে গেছে। যেখানে শুধু নেই নেই আর নেই! প্রাণ নেই।
রিমি ছুটে যায় বারান্দায়। সে আর এক মুহুর্ত এখানে থাকবে না। সে চলে যাবে বাপের বাড়ি। হামজা ফিরে তাকে এই অবস্থায় দেখবে! আবার লোকটার সম্মুখীন সে হবে! তাও এই পরিস্থিতিতে এই অবস্থায়! কিন্তু উপায় কী! কারও সাহস নেই হামজার অনুমতি না নিয়ে রিমিকে ওই বাড়িতে দিয়ে আসার, অথবা ওই বাড়ি থেকে এসে কেউ তাকে নিয়ে যাবার। হামজা বাপের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করে না। রিমি হামজার ঘরের আসবাবের মতো হয়ে গেছে, যেদিন তাকে বউ করে তুলে এনে এই ঘরে রেখেছে হামজা। সে বোধহয় একা বাপের বাড়ি যাবার পথটাও ভুলে গেছে!
রিমির মনের আগুন যেন শরীর পুড়াতে লাগল। সে গিয়ে টেনে-হিঁচড়ে পরনের মুচড়ে যাওয়া শাড়িখানা গা-ছাড়া করে ঝরনার নিচে বসে পড়ল। একে একে শরীরের সমস্ত বস্ত্র খুলে ফেলল। তবু শরীরের জ্বলুনি কমে না।
রিমি হাত-পা গুটিয়ে নিয়ে বসে থাকে ঝরনার তলে। হু হু করে কেঁদে ওঠে। তার সুখের সংসারে কার নজর লেগেছে! পাপের নজর এত ভয়বহ হবে কেন? রিমির বেহায়া মন তার বিরুদ্ধে গিয়ে জানায়–এই মুহুর্তে বোধহয় ওই পাপী পুরুষটা একটাবার এসে ব্যকুলচিত্তে রিমির দেহখানা নিজের সাথে লেপ্টে নিলে রিমির এই জ্বলুনি কমে যেত। রিমির হাতের নখে নিশপিশ অনুভূতি জাগছে লোকটার পশমী বুকে গাঢ় খামচির আঁচড় ফেলতে।
রিমির কাছে এই সত্য ভাবনাখানা অসহ্য ঠেকে। তার ভেতরে নিষ্ঠুর লোকটার জন্য জমাটবদ্ধ এই ভালোবাসাকে রিমি ঘৃণা করে। এভাবে রিমির সত্ত্বায় যেন চিড় ধরল, দ্বি-বিভক্ত হলো তা।
রিমি একখানা তোয়ালে পেঁচিয়ে রুমে আসে। আয়নায় নিজেকে দেখে। সারা দেহে শুধু হামজা, ফোলা-লাল চোখদুটোতেও হামজার প্রভাব! এই হামজাময় নিজেটাকে রিমি কীভাবে গুটিয়ে নেবে তা ভাবতে গেলে রিমির শরীর অসাড় হয়। সে কেন আরমিণের মতো না? সে কেন এই ঘর-সংসারের মাঝে নিজেকে বিলীন করে ফেলেছে!
সে কেন যে সেদিন ছটফটানি থেকে নিজেকে আড়াল করতে দূর্বল শরীরখানা টেনে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। দিনকয়েক পর ফিরবে লোকটা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে। রিমি কি আজও পারবে লোকটার ক্লান্তির উপশমক হতে?
—
জয় ধপ করে বসে আবার চেয়ারখানায়। অস্ফূট স্বরে একবার উচ্চারণ করে, ‘বড়সাহেব!ʼ
তার এই নিরবতার মাঝে অন্তূ চৌপায়ার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বোজে। বদ্ধ আমির নিবাসের সদরঘর যেন প্রতিধ্বনিতে কোলাহলপূর্ণ হয়ে উঠল। ঘুরপাক খেলো চারপাশে—
জয় আমির!
আপনি দায়হীন, বাঁধনহারা।
বাঁধনহারা বুঝি পাপের দায়ে হারে?
আপনি এক মৃত্যুঞ্জয়ী।
মৃত্যু কখনও আপনার শাস্তি হতে পারে?
তাই আপনাকে জীবন দিলাম,
আপনার চির-পাওনাদার হলাম।
পাওনা মিটিয়ে ফিরবেন একবার,
বিরোধ মেটাবার কথা ভাববো সেইবার।
ফিরলেন হয়ত, সাথে থাকল অতীত,
একবার আবার রচিত হবে অবরুদ্ধ নিশীথ!
জয় আরেকটা সিগার ধরিয়ে নিঃশব্দে বসে সিগারের ধোঁয়া গিলল অনেকটা সময়। হিসাব-নিকাশের সময় ধোঁয়ার সঙ্গ ভালো কাজে দেয়। অনেকটা সময় পর সিগারটা পায়ের তলে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে হাসে। ঝুঁকে বসে অন্তূকে নিজের খুব কাছে এনে থুতনি উচিয়ে মুখটা তুলে ধরে চোখের সামনে।
-“আমারে ক্ষমা করে দিলেন, উকিল ম্যাডাম! কীসের ভিত্তিতে….হু? আইজ কয়ডাদিন আমারে খুব আবেগপ্রবণ রূপে দেখছেন, তাই মনে হইছে আমি অতীতের দুক্কে ডুব মেরে ধুয়ে-মুছে ফর্সা হয়ে গেছি?! তাই আমারে ক্ষমা করাই যায়! চ্যাহ্, শালার! এই চিনলেন আমারে?ʼʼ
কূটিল হয়ে উঠল জয়ের মুখটা, “আপনাদের সমাজের মানুষ তাদের ফেলে আসা কালকে কুকুরের মতো চাটে, যা তাদেরকে চিরকাল অতীতের গোলাম করে রাখে। জয় আমির তাদের মধ্যকার কেউ না।ʼʼ
অন্তূ বলে, “মিথ্যা কথা। আপনি ভেঙে গুড়ো-গুড়ো হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু মচাকাতে নারাজ। সে যাহোক, ক্ষমাটা শুধুই আমার পক্ষ থেকে। মনে রাখতে হবে।ʼʼ
অন্তূর সমস্যা হচ্ছিল বলে জয় সিগারটা পায়ের তলে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে দু’পাশে মাথা নাড়ল, “টিকবে না। আমি সেই অনিবার্য, যার পাপকে পাশ কাটানো যায় না। টিকবে না আপনার এই ক্ষমার মহত্ত্ব! আমার পাপের স্রোতে দূরে ভেসে চলে যাবে আপনার আদর্শের কুড়কুড়ানি!ʼʼ
-“এটাই কি আপনার একমাত্র লক্ষ্য?ʼʼ
জয় ঠোঁট উল্টালো, “ক্ষমা করার কারণ খুঁজতে গেলে আমি দেখতে পাচ্ছি আমার বিগত কয়দিনের ফুন মারা খাওয়া ঢ্যামনাচোদা চেহারা!ʼʼ
-“ইগোতে লেগেছে?ʼʼ
-“আপনার কাছে ক্ষমা আশা করি নাই। কারণ তখন বুঝিই নাই বিষয়টা!ʼʼ
জয় নিজস্ব ভঙ্গিতে গা দুলিয়ে হেসে উঠল এ পর্যায়ে। অন্তূর থুতনিটা আরেকটু নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে চোখের মণি বরাবর তাকিয়ে বলে, “তোমার মতে আমার আন্দাজশক্তি ভালো। ঠিক না?ʼʼ
অন্তূ সতর্ক হয়ে উঠল। জয় অন্তূর গাল চিপে ধরে আলতো হাতে, “আমার ঘরের ছলনাময়ী! কী খেললে মাইরি আমায়। নিয়ে!ʼʼ
অন্তূ একটুও ভীত হয় না, বরং এবার মৃদু হেসে ফেলল, “এই খেলার পদ্ধতি তো আপনারই কাছে শেখা। কাউকে জমজমাট মৃত্যু দিতে হলে তাকে আগে ঘটা করে বাচিয়ে নিতে হয়।ʼʼ
জয় ভ্রু উচায়। কিছুক্ষণ অন্তূর সুশ্রী চেহারাখানা মন ভরে দেখে নিচু গলায় বলে, “এই মুহুর্তে আমি যদি খানিকক্ষণের জন্যও যদি জিন্নাহকে হারানোর শোক ভুলে যাই, তুমি কতক্ষণ টিকবে আমাদের বিরুদ্ধে?ʼʼ
অন্তূ ঠিক ততটাই চাপা দৃঢ়তার সাথে বলে, “নিজের রক্তের সাথে বেইমানী করা জয় আমির, আমি ভয় পাই না আপনাকে। জানেন তো আপনি।ʼʼ
জয় আচমকা অন্তূর ঠোঁট চেপে ধরে প্রগাঢ় একখানা চুমু খায়। অন্তূকে যেন শুষতে চায় সে। চুমুটা ধীরে ধীরে উগ্র হয়ে ওঠার সাথে সাথে অন্তূর গালে তার হাতও ঠিক ততটাই শক্ত হতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর অন্তূর ঠোঁট থেকে ঠোঁটটা সামান্য সরায়। তখন তার চোখদুটো টকটকে লাল।সেই মুখভঙ্গিমার কথিত বর্ণনা নেই। তা দুর্বোধ্য! চাপা আক্রোশ জয়ের পৌরুষ কণ্ঠনালিতে কাঠিন্য পেয়ে বেরিয়ে আসে চাপা ধীর আওয়াজে, “বেইমানী তোর দক্ষতা, আরমিণ।ʼʼ
অন্তূর নাক শিউরে ওঠে, “সত্যকে অস্বীকার করার মাধ্যমে তা মিথ্যা করার ব্যর্থ চেষ্টা ছাড়ুন। আপনার ভেতরে শিকারীকে এখনও পুঁজো করার সাধ যদি অবশিষ্ট থাকে আপনার ভেতরে তাহলে আমি বলব আপনি এই হতভাগা-উত্তরাধিকারের যোগ্যই না।ʼʼ
জয় নিষ্প্রভ বাঁকা হেসে মাথা দোলালো, “এই উত্তরাধিকার আমার সবচেয়ে বড় শিকারী। আমাকে রক্তে চুবিয়ে তুলে স্থির দাড়ায়ে আছে এখনও। মাগার আমারে আর আমার রাখে নাই। তুমি আবার আমায় ভড়কাচ্ছ, ডিয়ার!ʼʼ
অন্তূ এক চিলতে হাসে, “ভড়কানোই তো কাজ আমার। তবে জেনে রাখুন আপনি যতক্ষণ আপনার দেবতার বিপক্ষে ততক্ষণ আপনি সঠিক পথে।ʼʼ
জয় হেসে চোখ মারে, “কিন্তু আমি তো ভুল রাস্তার লোক!ʼʼ
কথা শেষ করেই পেছনের হোলস্টার থেকে পিস্তল খুলে অন্তূর কোলের ওপর ছুঁড়ে মারতে মারতে উঠে দাঁড়িয়ে দু’পাশে হাত প্রসারিত করে নিজের বুকটা মেলে ধরে জয় অন্তূর সামনে। এক কদম করে পেছায়।
অন্তূ চোখে জিজ্ঞাসা, পিস্তল কেন দেয়া হলো তাকে। জয় জানায়, “ওটা এখনই প্রয়োজন পড়বে আপনার, উকিল ম্যাডাম! কাজের চিজ কিন্তু। সামলে…ʼʼ
অন্তূ বিভ্রান্ত চোখে দেখে জয়ের হাস্যজ্জোল ভয়াবহ রূপ। অন্তূ জয়ের সবরকম হাসি চেনে। এই হাসিতে জয়ের সবচেয়ে নিষ্ঠুর হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ ছিটকে আসে।
জয় বলে, “এখন আমার প্রথম কাজ হলো বড়ঘর সাফ করা। বড়সাহেবেরর রক্তের দাম না তুলে আমি তো ঢাকা যেতে পারি না। আফসোস আজ যা হবে আপনার আড়ালে হবে। আপনার সাজা মওকুফেরই সমান এটা।ʼʼ
অন্তূর সারা শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে শিউরে ওঠে। আব্দুর আহাদের রক্তশূন্য মুখটা অন্তূর বুকের ভেতরটায় এক ধাক্কা
মারে। অন্তূ উঠে দাঁড়ায়।
জয় পুরো হলরুম কাঁপিয়ে হেসে উঠল। হাসির দমকে বদ্ধ চার দেয়ালে প্রতিধ্বনি উঠল। অন্তূকে সে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করে, “সাব্বাস, ঘরওয়ালি! প্রেস দ্য ট্রিগার। নো টেনশন, মাল লোডেড। জাস্ট শ্যুট!ʼʼ
নিজের বুকে একদম হৃদযন্ত্রের ওপরে আঙুল নির্দেশ করে, “এই যে এইখান বরাবর। শ্যুট, শ্যুট! নয়ত বড়ঘর কইলাম আজ খালাস! আমাকে ঠেকাতেই হবে আপনার। ইনসাফের পক্ষে দু চারটে খুন জায়েজ, ম্যাডাম! চালান গুলি। জয় আমির আজ তীর্থে যাবে। চালা, আরমিণ। গুলি চালা।ʼʼ
অন্তূর বুক হাপড়ের মতোন ওঠে-নামে। তার চোখ জ্বলছে। সে জয় আমিরের কাছে শুধায়, আপনি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন?ʼʼ
-“নাহ্! ছিঃ। আমি শুধু বলছি–আমি অনিবার্য পাপ, যা এড়ানো যায় না। ক্ষমা করা যায় না তা। আমার সামনে মহানুভবতার জায়গা নেই।ʼʼ
অন্তূ পিস্তল তাক করে ধরে জয়ের কপাল বরাবর। লম্বাদেহী জয়ের কপাল বরাবর পিস্তল তুলে ধরতে অন্তূর হাত অনেকটা উচুতে মেলতে হয়। অন্তূ দেখতে পায় জয়ের মুখের উল্লাস! অন্তূ মাথাটা ঝিনঝিন করে ওঠে–কেউ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে এত উৎসাহিত হতে পারে? কারও চেহারা মৃত্যুকে সামনে রেখে এত বেপরোয়া হাসিতে মেতে উঠতে পারে? আর সে নিকৃষ্টতম পাপী হয়, তাকে কি অন্তত মৃত্যুর সাজা দিতে আছে?
অন্তূর বিলম্ব জয়কে বিরক্ত করে। তার ঠোঁট থেকে হাসি কমে আসে। তার চোখ কথক হয়ে ওঠে। সেই চোখে চোখ রেখে অন্তূর বুকের ভেতর ঝড় উঠে আসে। শ্বাস-প্রশ্বাস গতি হারায়। অন্তূর গলার মাংসপেশী অস্বাভাবিক হারে থরথর করে কেঁপে ওঠে। তার চোখদুটো জ্বলে।
জয় চোখে চোখ মিলিয়ে শুধায়, “আপনার চোখে একখানা পটি বেঁধে দেব? জয় আমিরের চোখে তাকিয়ে তার বুকে গুলি চালানো সহজ না, ম্যাডাম!ʼʼ
তার এক মুহুর্তের মাঝে অন্তূকে এসে থাবা মেরে ধরে জয়, “তাহলে সেই বুকে ছলনার ছুরি চালানো এত সহজ কেন? হ্য? কী চাই তোর, আরমিণ? আমার ধ্বংস? চেয়ে নিতি। তোর দুই হাতের তালুতে এনে ফেলতাম জয় আমিরের ধ্বংসের এক মুষ্ঠি ছাই!ʼʼ
দূঢ়চিত্তে জয় আমিরের চেহারার দিকে চেয়ে থাকা অন্তূর চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোটা নোনতা পানি গাল বেয়ে পড়ে। জয় বলে, “কিন্তু তোরা কেন ছলনার পথ বেছে নিস আমার বেলায়? আমার সাথে ছলনা করা খুব সহজ তাই? আমি কাঙাল, তাই?ʼʼ
অন্তূ মলিন হাসে, “একসময় মনে হতো, আপনি কাঙাল। একটু স্নেহ, ভালোবাসা অথবা সঙ্গ-এর কাঙাল। না, তা আপনি নন। আপনি শুধুই একজন পাপীষ্ঠ পুরুষ।ʼʼ
জয় হাত শিথিল করে হাসে, “স্নেহ আমি চাইছি এই আমি’র জন্য। কিন্তু আপনাদের সমাজে এই জয়কে ভালোবাসার নিয়ম নাই। আমাকে ভালোবাসার কথা আইলে শর্ত উঠছে আমার বদলে যাবার। তহন বুঝছি, ওই ভালোবাসা নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত না অথবা এই জয় আমিরের জন্যে না। তার মানে ভালোবাসা পাইলে পাবে ওই বদলে যাওয়া শালা। এই আমি খালি শাস্তি পাবার যোগ্য। ……..শ্যুট মি!ʼʼ
জয় অন্তূকে ছেড়ে আবার একটু দূরত্ব বাড়িয়ে পিছিয়ে যায়। অন্তূকে উৎসাহ দেয়, “আইজ হয়ত তুই আমার রক্ত ছুয়ে দেখবি অথবা ওদের রক্তে তোকে গোসল করাবো আমি।ʼʼ
অন্তূ পিস্তলের তাক নামিয়ে জয়ের হাই বুটের ওপরে গোড়ালির দিকে তাক করে। জয় শব্দ করে হাসে। হো হো করে হাসে অন্তূর নীরব আগ্রাসন দেখে। কিন্তু অন্তূ গুলি চালায় না।
জয় পেছাতে পেছাতে সদর-দরজায় ঠেকে। তা খুলে অন্তূকে বলে, “তোর কসম আরমিণ, একবার চৌকাঠের ওপাড়ে না রাখলে আমার ঠেকাইতে পারবি না! রক্তের একটা ছোটখাটো পুকুর কাটবো আজ আমি। গুলি চালা! পিঠ বরাবরই চালা।ʼʼ
জয় পা উচু করে চৌকাঠের ওপাড়ে না তুলে ধরে বাচ্চাদের মতোন হাসতে হাসতে পেছন ফিরে চায়, “শেষ সুযোগ, ঘরওয়ালি! আমি ওপাড়ে পা রাখলে আর ফিরাইতে পারবা না আজ। থামাও এখুনি, সময় আছে।ʼʼ
অন্তূ ক্লান্ত চোখে দেখে, জয়ের উচ্ছ্বাসিত চেহারাটা! এই খেলায় সে খুব আনন্দ পাচ্ছে। হয় অন্তূ আজ তার রক্ত নেবে অথবা সে অন্তূর দোসরদের প্রাণ! ভীষণ মজার খেলা। জয় অপেক্ষা করে অন্তূর ট্রিগার দাবানোর। দাবাচ্ছে না দেখে সে চৌকাঠের ওপাড়ে পা ফেলতে উদ্যত হবার ভান করে।
পিচ্ছ্ করে একটা শব্দ হয়। জয় আমির চোখদুটো আরাম কোরে বুজে নেয়। কিন্তু শাল কাঠের চৌকাঠের একাংশ বিধ্বস্ত জাহাজের পাটতনের মতো চুড়মার হয়ে কোথাও ছড়িয়ে পড়ে। অন্তূর কাঁচা হাতে ছোঁড়া গুলিটা গিয়ে দেয়াল ভেদ করে আঁটকে যায়।
বুলেট শরীর ভেদ করেনি বলে জয়কে এক মুহুর্ত হতাশ দেখায়। একখানা দীর্ঘশ্বাস চেপে সে সশব্দে গা দুলিয়ে হেসে অন্তূর দিকে তাকায়, “যাহ্ শালা! টার্গেট মিস? শীট ম্যান, শীট শীট! চর্চার ঘাটতি। ব্যাপার না। সুযোগ পেলে হাতে ধরে শিখিয়ে দেব। জয় আমিরের ঘরওয়ালি পিস্তল চালাতে জানে না এই খবর সমাজ জানলে ইজ্জত যাবে তো!ʼʼ
অন্তূ হতবিহ্বল চোখে জয়ের চৌকাঠ মাড়িয়ে ওপাড়ে পা রাখা দেখে। তার কিছুই করার নেই আর। কোনো অলৌকিক কিছু না ঘটলে কি আজ বড়ঘর জয় আমিরের তান্ডবের হাত থেকে রক্ষা পাবে? সে দরজার দিকে পা বাড়ালে জয় দরজার পাল্লাদুটো এটে দিলো—
-“আপনি এখানেই থাকছেন। এখানেই কবর হবে আপনার। ওই বাড়িতে আর আপনার আদর্শের ছায়া পড়বে না। আসি।আমির নিবাস উপভোগ করুন। বড়সাহেব আমার অপেক্ষায়।ʼʼ
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন]