হলুদ বসন্ত পর্ব-১৫

0
78

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_১৫
জাওয়াদ জামী জামী

” আল্লাহ তোর বাবার মনের আশা পূরণ করেছেন। তার নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন তুই পূরন করেছিস, মা। আজকের মত খুশি জীবনে কখনোই হইনি আমরা। তুই আমাদের জীবনের সকল খুশি একদিনে এনে দিয়েছিস। তোকে সন্তান হিসেবে পেয়ে আমরা গর্বিত। ” অবনীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মিনারা খাতুন। তার পাশে বসে কাঁদছেন ওয়াহাব আহমেদও। অবনী মেডিকেল এডমিশনেও দেশ সেরা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল ভর্তির সুযোগ পেয়েছে।

অবনী কাঁদছে। কাউকে দেখিয়ে দেবে সে-ও পারে। ওর বাবা কিংবা ও লোভে পরে কারও ঘাড়ে চাপেনি। কারও বোঝা হয়ে বেঁচে থাকবার জন্য জন্ম হয়নি ওর। নিজের দ্বায়িত্ব এবং পরিবারের দ্বায়িত্ব ও হাসিমুখে পালন করবে আজীবন।

” অবনী, আমি এরশাদ চাচার কাছে যাই। ভর্তি হতে টাকা লাগবে, এছাড়াও তোর বই কিনতে হবে। অনেকগুলো টাকা লাগবে। আগে থেকেই তাকে বলে রাখি। প্রয়োজনের সময় সহজেই পাওয়া যাবে। ” চোখ মুছে বললেন ওয়াহাব আহমেদ।

” কোথাও যেতে হবেনা, বাবা। আমি যে এতদিন ছাত্র পড়িয়েছি, কোচিং-এ ক্লাস নিয়েছি , মোটামুটি ভালো টাকা পেয়েছিলাম। অর্নিকে দেয়ার পরও জমানো টাকা আছে। ঐ টাকাগুলো দিয়েই এবারের মত উৎরে যাব, বাবা। তুমি পড়াশোনার খরচ নিয়ে কোন টেনশন করোনা। এবং অর্নির জন্যও নয়। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি, অর্নির পড়াশোনার খরচও আমিই দেব। ”

” অনেক কষ্ট করেছিস, আর নয়। ছোট থেকে আজ পর্যন্ত তোদের দুই বোনকে তোদের পছন্দের কিছুই দিতে পারিনি। তারপরও কোন অভিযোগ তোরা করিসনি। এবার থেকে তোদের সব খরচ আমিই বহন করব। নয়তো বাবা হিসেবে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবনা। ”

” এটা কি ধরনের কথা, বাবা? তুমি আমাদের জন্য সারাজীবন কত কষ্ট করেছ, সেটা আমরা জানি। কর্পদশূন্য অবস্থা থেকে আজ তুমি এই পর্যন্ত এসেছ পরিশ্রমের জোরেই। অনেক পরিশ্রম করেছ, আর নয়। এবার থেকে তোমাদের সব দ্বায়িত্ব আমার। সাদাফ ভাইয়ার সাথে কথা বলেছি। টিউশনি খুঁজে দেবে ভাইয়া। দুই জায়গায় কথাও বলেছে। আমি ঢাকা যাওয়ার পরপরই টিউশনি শুরু করতে পারব। দেখবে আমাদের আগেরমত আর অনটন থাকবেনা। ”

” আমি এখনো মরে যাইনি, মা। তুই এই বয়সে হাড়ভাঙা খাটুনি করবি আর আমি বাবা হয়ে সেটা দেখব? কখনোইনা। তুই মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবি। প্রতিবারের মত ভালো রেজাল্ট করবি, এটাই আমার চাওয়া। তার জন্য যা যা করার প্রয়োজন আমি করব। দরকার হলে আমি আগের থেকেও বেশি পরিশ্রম করব। এ নিয়ে তোর কোন কথা আমি শুনতে চাইনা। তুই কোন টিউশনি করবিনা। মন দিয়ে পড়াশোনা করবি শুধু। ”

অবনী বুঝল বাবা ওর কোন কথাই শুনবেনা। তাই সে নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিল।

***

” অবনী, তুই এবারেও আমাদের কাছ থেকে কিছু নিবিনা? এভাবে আমাদের পর করে দিচ্ছিস? তোর চাচা কত আশা করে আছে, তোর ভর্তির সমস্ত খরচ তোর চাচা দেবে। মেডিকেলে পড়ার সমস্ত খরচ তোর চাচা দিতে চায়। ”

” আমাকে মাফ কর, বড়মা। আমি নিজের খরচ নিজেই বহন করতে চাই। বাবা চাইছে সে আরও পরিশ্রম করে আমার খরচ বহন করতে। এবার যদি তোমাদের কাছ থেকে সব খরচ নেই, বাবা কষ্ট পাবে। আমি চাইনা বাবা আরও পরিশ্রম করুক, কষ্ট পাক। টাকা চাইনা আমার। তোমরা দোয়া কর। এই বন্ধুর পথ যেন আমি সহজেই পেরিয়ে যেতে পারি। ”

” তোর অভিমান কবে ভাঙ্গবে সেটা আমি জানিনা। গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে তুই আমার ছেলের বউ হয়ে আছিস, কিন্তু একবেলাও তোকে এ বাড়িতে খাওয়াতে পারলামনা। একটা সুতাও তোকে দিতে পারলামনা। এই আফসোস আমার আজীবন থাকবে। অথচ তুই আমার কাছে সন্তান বৈ অন্য কিছু নয়। কিন্তু সেই আদরের সন্তানের জন্য কোন খরচই আমি করতে পারিনা। আমার ছেলের অন্যায়টা কি খুব বেশি রে, মা? সে কি ক্ষমার অযোগ্য কোন অপরাধ করেছে? কখনোই কি তোরা এক হবিনা? আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে? ”

” কেউ কোন অপরাধ করেনি, বড়মা। আর আমার নেই কোন অভিমান। সময়ই বলে দেবে ভবিষ্যতে কি হবে। তবে এতটুকু বলতে পারি, কিছু কিছু ক্ষত সারতে সময় লাগলেও তার দাগ থেকে যায় চিরটাকাল। ”

” আমার ছেলেটা বড্ড দুর্ভাগা। নয়তো তোর মত মেয়েকে রেখে কি দূরে থাকতে পারে? যে ছেলেটা তোকে নিজের করে পেলনা, তোর পরশ নিজের শরীরে পেলনা, তোর ছোঁয়ায় জীবন রাঙ্গাতে পারলনা, তারমত হতভাগ্য দ্বিতীয়টি নেই। আমার ভাবতে কষ্ট হয়, সেই হতভাগ্য ব্যক্তি আমার ছেলে বলে। তোকে আর কি বলব, আমার ছেলে নিজের ভাগ্যে নিজেই কুড়াল মেরেছে। নিস না চাচার কোন টাকা। তারপরও চাইব তুই ভালো থাক। নিজের স্বপ্ন পূরণ কর। ” অভিমানে কেঁদে ফেললেন নাজমা আক্তার।

” তুমিও আমার ওপর রাগ করছ, বড়মা! তুমিও বুঝলেনা আমাকে? তবে আমি কার বুকে নিজের দুঃখ লুকাব? কার ভালোবাসায়, কার সাহসে আমি স্বপ্ন পূরণের পথে নামব? তবে কার শাসনে আমি নিজেকে সাফল্যের পথে নিয়ে যাব? কে আমাকে পথ দেখাবে, বড়মা? ”

” তোর সকল সুখ-দুঃখে আমি তোর পাশে ছিলাম, থাকব। শুধু একটাই চাওয়া তোর কাছে, পারলে আমার ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিস। ”

” বড় বউমা, আমাকে এক কাপ চা দেবে? ”

শ্বশুরের গলা পেয়ে নাজমা আক্তার আঁচলে চোখের পানি মুছলেন। মাথা নেড়ে চলে গেলেন রান্নাঘরে।

” অবনী, তুমি কি বড় বউমাকে কোন আঘাত দিয়েছ? বউমা কাঁদছে কেন? ”

” হয়তো আমার কথায় বড়মা আঘাত পেয়েছেন, দাদু। সেজন্যই হয়তো কাঁদছিলেন। আমি বোধহয় ভালো পুত্রবধূ হয়ে উঠতে পারিনি। ব্যর্থতা আমার। জীবন আমাকে পদে পদে শিক্ষা দিচ্ছে। চাইলেও অনেককিছু ভুলতে পারছিনা আমি। ”

” না চাইলেও অনেককিছুই ভুলতে হয়। জীবনটা শুধু পড়াশোনা করার জন্য কিংবা ক্যারিয়ার গড়ার জন্যই নয়। একজন মানুষকে পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ার গড়ার পাশাপাশি সংসারধর্মও পালন করতে হয়। স্বামী, সন্তান, শ্বশুর, শ্বাশুড়ি নিয়ে পরিপূর্ণ একটা সংসারের চাদরে নিজেকে আবৃত করতে হয়। আর এই সংসারধর্ম পালনে যে জয়ী হয়, সেই ব্যাক্তিই জীবনযুদ্ধে জয়ী। দেশে অনেকেই আছে যারা চিরকুমার। দেখবে তারা জীবনের একটা পর্যায়ে এসে হাহাকার করে। একাকিত্ব ঘোচাতে চায় অনেকেই। কিন্তু সময় তো আর থেমে থাকেনা। আবার অনেক দম্পতিই আছে যারা নিঃসন্তান। তারা একটা সন্তানের জন্য কতকিছু যে করে এটা তোমার অজানা নয়। আবার সুখের জন্য কতজনই একূল ছেড়ে ওকূলো যেতে দু’বার ভাবেনা। সবকিছুর মূলেই আছে সুখ। আর একটা পরিপূর্ণ সংসারই কাউকে সুখী করতে পারে। আর জীবনে সুখী হতে গেলে ক্ষমা করতে শিখতে হয়। আজ হয়তো আমার কথাগুলো তোমার কাছে খারাপ লাগছে। কিন্তু এটাই সত্যি। ”

” আফসোস তোমার এই উপদেশগুলো তোমার অতিপ্রিয় নাতি মিস করে গেল। ”

” কে বলল ইশু এগুলো মিস করে গেছে? কাউকে নিরাশ করতে জানিনা আমি। আমার কাছে তোমরা দু’জনেই সমান। ”

” বুঝলাম। ”

” এবার শোন, আমার সাথে কাল ব্যাংকে যাবে। তোমার ভর্তির জন্য কিছু টাকা রেখে দিয়েছি। কালকে সেগুলো তোমার হাতে তুলে দেব। ”

” আমার কোন টাকা লাগবেনা, দাদু। ভর্তির টাকা আমি জমিয়ে রেখেছি। টাকাগুলো তুমি তোমার অন্যান্য নাতি-নাতনীদের দিও। ওরা খুশি হবে। আর তাছাড়া শেষ বয়সে তোমার বউ বাপের বাড়ি যাক, এটা আমি কোনভাবেই চাইনা। ”

” তোমার কোন কথাই আমি শুনতে চাইনা। এমনকি আমি চাইওনা তুমি কোন কথা বল। আমি আমার নাতনিকে চাইলেই যেকোন কিছু দিতে পারি। সারাজীবন অন্যান্য নাতি-নাতনীদের দিয়েই গেছি। এবার তোমাদের পালা। তোমার বাবার বাবা হিসেবে এতটুকু আমি চাইতেই পারি। এবং বিশ্বাসও করি আমার নাতনি তার দাদুর বিশ্বাস ভঙ্গ করবেনা। ”

” আমার মনে হয়, তুমি আমাকে বিপদে ফেলার মতলব আঁটতে থাক সব সময়। তুমি তোমার বউকে দিয়ে আমাকে শিক্ষা দেয়ার ফন্দি আঁটছ বোধহয়? তবে জেনে রাখ, এতটাও বোকা আমি নই। তোমার কথা আমি শুনছিনা বুঝলে? ”

” শুনতে তোমাকে হবেই। নয়তো চিরদিনের জন্য দাদুকে হারাবে তুমি। আমি ভুলে যাব অবনী নামে কোন নাতনী আমার আছে। এমনকি আমার মৃতদেহ দেখবার অনুমতিও তোমাকে দেবোনা আমি। ”

” দাদু! ”

” এটাই সত্যি। তো কি সিদ্ধান্ত নিলে? যাবে আমার সাথে ব্যাংকে? ” দাদু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন অবনীর দিকে। তিনি তার নাতনীর মোক্ষম জায়গায় আঘাত করেছেন।

” অগত্যা। আমি আমার দাদুকে হারাতে চাইনা। ” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অবনী।

” কালকে কিন্তু তুমি আমাকে বিরিয়ানি খাওয়াবে? এক লাখ টাকার বিনিময়ে এতটুকু আপ্যায়ন আমাকে করাই যায় তাইনা? ” দাদু সাবধানী গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

” এতগুলো টাকা! এত টাকা আমার লাগবেনা, দাদু। ”

” তোমার কত টাকা লাগবে, সেটা আমি বুঝব। এখন যা লাগবে, সেটা খরচ করবে। বাকিটা ব্যাংকে রাখবে। প্রয়োজন অনুয়ায়ী খরচ করবে। ”

” কিন্তু তুমি এত টাকা কোথায পেলে? ”

” দক্ষিণ মাঠের জমি থেকে টাকাগুলো এসেছে। গত তিন বছর যাবৎ ঐ জমির টাকা জমাচ্ছি আমি। এছাড়াও পেনশনের টাকা কিছু কিছু করে রেখেছি। ”

” বুড়ি শুনলে রাগ করবে, দাদু। ”

” তুমি আর আমি ছাড়া কেউই কিছু জানবেনা। কাল সকাল দশটার মধ্যেই আমরা ব্যাংকে যাব কেমন? অর্নাকেও নিও। ওকে ছাড়া বিরিয়ানি খেতে আমার ভালো লাগবেনা। ”

” আচ্ছা। তোমার কথা অমান্য করার সাধ্য কি আমার আছে? ”

দাদু হাসলেন শুধু। নাজমা আক্তার দরজায় এসে দাঁড়ালে তিনি আর কিছু বললেননা।

” এত দেরি হল কেন, বউমা? ”

” সাদাফ ফোন দিয়েছিল, আব্বা। ওর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেরি হল। রাগ করবেননা। ”

” রাগ করিনি। দাও দেখি চা খেয়ে মাথা ঠান্ডা করি। তোমার বড় ছেলের বউ আমার মাথা গরম করতে প্রস্তুত থাকে সব সময়। ”

” দাদু আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ কিন্তু। ”

” ঝগড়া বাদ দিয়ে চা নিয়ে তোর চাচার কাছে যা। সে নাকি বাগানে বসে প্রকৃতি দেখবে আর চা খাবে। ”

অবনী বড়মার হাত থেকে ট্রে নিয়ে বাগানে গেল।

পরদিন সকালে অবনী, অর্নি আর দাদু মিলে ব্যাংকে গেল। দাদু একলক্ষ টাকা তুলে অবনীকে দিলেন। আর দশ হাজার টাকা দিলেন অর্নিকে।

কয়েকদিন পর অবনী বাবা আর বড় চাচার সাথে ঢাকা রওনা দিল। ইসহাক আজাদ আর ওয়াহাব আহমেদ মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিলেন এরপর অবনীর থাকার ব্যবস্থা করে বাড়ি ফিরলেন।

চলবে…