হলুদ বসন্ত পর্ব-২৩+২৪

0
333

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী জামী

” দাদু, তুমি যাইবা গা? আবার কবে আসবা? কতদিন পর দ্যাশে আসলা কিন্তু একটা মাসও থাকলানা। ” কুলসুম বেগম কাঁদতে কাঁদতে ইশরাককে জিজ্ঞেস করল।

” কতদিন ঘরে বসে থাকব, দাদী! চাকরি না করলে বাবা-মার দ্বায়িত্ব পালন করব কিভাবে? বাবার শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছেনা। মা ও অনেক আগে থেকেই অসুস্থ। একজন কাজের মেয়ে দরকার। দাদু তুমি দু’জনেই অসুস্থ। তোমাদের দেখভাল করার জন্য সার্বক্ষনিক একজন নার্স প্রয়োজন। সাদাফের পড়াশোনা এখনো শেষ হয়নি। বাবার একার ইনকামে সবকিছু সামাল দেয়া সম্ভব হবেনা। চাকরিটা হয়ে গেলেই দু’জন কাজের মানুষ রাখব। ”

” তুমি তো সক্কলের জইন্য এত চিন্তা কর, তোমার কতা কয়জন চিন্তা করে? চিন্তা করলে, তোমার মা পড়াশোনা করনের সময়ই তোমার বিয়া দিতনা। পোলার কথা একবার চিন্তা করত। আবার যেই মাইয়াডার লগে বিয়া দিল, সেই মাইয়াডারও তোমার উপ্রে কুন দরদ নাই। তুমি বাঁচলা কি মরলা সেইডা সে দেখেনা। সেইদিন যে তুমি কত ট্যাকা দিয়া বাজার করলা, হেই মাইয়া একটা খাওন ও মুখে তুইলা দেখে নাই। আলু ভর্তা দিয়া ভাত খাইছে। দেমাগ কত ছেমরির। তোমার মত যোগ্য স্বামীরে হেয় পায়ের নিচে রাখবার চায়। দুই পয়সাও দাম দেয়না। ”

দাদির কথা শুনে একটুও অবাক হলোনা। অবনীর রাগ, জিদ সম্পর্কে ওর জানা হয়ে গেছে। সেই সাথে এটাও বুঝতে পারছে, দাদী ওকে অবনীর বিরুদ্ধে উস্কে দিতে চাইছে। তাই দাদীর ফাঁদে পা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

” এটা তেমন কিছুই নয়। একটু মান-অভিমান চলছে আমাদের মধ্যে। কয়দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখ। এসব নিয়ে তুমি কিন্তু ওকে বকাঝকা করোনা। তোমার মুখ স্পিডবোটের থেকেও বেশি ছোটে। মুখে লাগাম দেয়ার চেষ্টা কর বুঝলে? ”

” হ, সব দোষীই তো আমার। কিছু কইলেই আমি খারাপ। আমি বাদে বাকি সক্কলেই সাধু। ”

” এখন এসব কথা শুনতে চাইছিনা, দাদী। যাওয়ার আগে মাথা খারাপ করে দিওনা। রাতটুকু অন্তত শান্তিতে ঘুমাতে দাও৷ আমি আবারও বলছি, মা, চাচী, অবনীর সাথে মিলেমিশে থাকবে। তারা কষ্ট পায়, এমন কোন কথা বলবেনা। তোমার মেয়েদের নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছ? যেই তোমার দ্বায়িত্ব নেয়ার কথা উঠল, ঠিক তখনই তারা তাদের সংসারের দোহাই দিল। কেউই তোমাকে নিতে রাজি হলোনা। কিন্তু তারা একবারও ভাবলনা, আমার বাবা-মা কখনোই তোমাকে অন্য কোথাও পাঠাবেনা। তারা নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝেনা। যখন টাকার প্রয়োজন হয়েছে, তখনই এসে দাদুকে প্রেসার দিয়েছে। একবারও ভাবেনি, দাদুর টাকা প্রয়োজন হতে পারে। এতদিন আমার মা এসব বিষয়ে মাথা ঘামায়নি জন্যই যে ভবিষ্যতেও কিছু বলবেনা এটা কিন্তু ভেবোনা। মা যদি একবার বেঁকে বসে, তবে তুমি কোথায় যাবে ভেবে দেখেছ? তুমি নিশ্চিত থাক, তোমার মেয়েরা তোমাকে নিজেদের বাড়িতে নিবেনা। তোমার পেছনে এক পয়সাও খরচ করবেনা। অতীতে যা করেছ সেসব ভুলে যাও। ভবিষ্য সুখকর করতে নিজেকে পরিবর্তন কর। বুঝতে পেরেছ আমার কথা? ”

নাতীর কথাগুলো শুনে চোখমুখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কুলসুম বেগম। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ইশরাকের কথা তার পছন্দ হয়নি। ইশরাকও দাদীর মনোভাব বুঝতে পারল। তিক্ততায় ছেয়ে গেল ওর মন। এই একটা মানুষের জন্য ওদের সংসারে সারাজীবন অশান্তি বিরাজ করেছে। ভবিষ্যতেও হয়তো সেটাই থাকবে।

***

” অবনী, একটু আমার রুমে আসতে পারবি? ” অবনী নিজের ঘরে পড়ছিল। নাজমা আক্তারের ডাকে পেছন ফিরে চাইল। বড়মার শুকনো মুখ দেখে আপনাআপনি অবনীর ভ্রু কুঁচকে গেল। হাজার কষ্টের মাঝেও অবনী সব সময় বড়মাকে হাসতে দেখেছে। কিন্তু আজকে বড়মার মুখে হাসি নেই।

” আসছি, বড়মা। ”

নাজমা আক্তার আর সেখানে দাঁড়ালেননা। অবনীকে রেখেই চলে গেলেন। বড়মার এমন কাজে যারপরনাই অবাক হল অবনী।

” কেন ডেকেছিলে, বড়মা? তোমার কি শরীর খারাপ? ” নাজমা আক্তারের রুমে এসে জিজ্ঞেস করল অবনী।

” আমি ভালো আছি। তুই আয় আমার সাথে। অবনীকে হাত ধরে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ইশুর রুমে গেলেন নাজমা আক্তার।

অবনী গমনরত বড়মার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। এই বড়মা যেন ওর অচেনা।

কয়েক মিনিট পরই নাজমা আক্তার ইশরাকের রুমে ঢুকলেন। তার পিছুপিছু রুমে ঢুকল অবনী। অবনীকে দেখে ইশরাক চোখ ছোট করে তাকাল। ও ল্যাপটপে কিছু একটা করছিল। অবনী ইশরাকের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। চার বছর পর এই রুমে পা রাখল অবনী। বদলে ফেলা হয়েছে রুমটাকে। আসবাবপত্র আগেরগুলো নেই। সবকিছুই নতুন।

বিছানার কাছে গিয়ে ইশরাককে নিজের একপাশে বসালেন নাজমা আক্তার। অপর পাশে বসালেন অবনীকে। ওরা দু’জনই নাজমা আক্তারের কাজকর্ম কিছুই বুঝতে পারছেনা।

” তোরা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছিস? ভাবছিস, কেন তোদেরকে একসাথে ডেকেছি? ”

অবনী ইশরাক দু’জনই নীরব থাকল। ওদেরকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন নাজমা আক্তার।

” আজ তোদেরকে কিছু কথা বলবার জন্য ডেকেছি। আমি মনে করি, তোদের দু’জনের জন্যই কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানরা ভুল করবে এটাই প্রকৃতির অলিখিত নিয়ম। কিন্তু বাবা-মা হিসেবে আমরা যদি সেজন্য সন্তানদের ভুল বুঝি, ওদের সাথে দুর্ব্যবহার করি, দিনশেষে সেটা সকলের জন্যই ক্ষতিকর। ঠিক তেমনি আমার মনে হয়েছে তোদের সাথে দুর্ব্যবহার না করে, তোদের মুখোমুখি হওয়া দরকার। আমি বুঝতে পারছি তোরা না জেনেই বারেবারে ভুল করছিস। আজকে তোদের যদি শুধরে না দেই, তবে হয়তো তোদের সম্পর্কই শেষ হয়ে যাবে। তাই গত চার বছরেও তোদের সাথে যেই বিষয়ে কথা বলিনি, মাথা ঘামাইনি আজকে সেটা করতে হচ্ছে। এবং আমি মনে করি এটা আমার দ্বায়িত্ব। ”

অবনী ইশরাক দু’জনেই নাজমা আক্তার কি বলতে চলেছে সেটা বুঝতে পারছে। তাই এবারও তারা নীরব থাকল। নাজমা আক্তার ওদের উত্তরের অপেক্ষা করলেননা৷ তিনি একমনে বলেই চললেন,

” তোরা গত চার বছর ধরে একটা সম্পর্কে আবদ্ধ আছিস। হয়তো সেই সম্পর্কটা মধুরভাবে শুরু হয়নি। হয়তো বলছি কেন? শুরুটা মধুর ছিলনা। এখনো যে মধুর আছে সেটাও বলবনা। কোন পরিস্থিতিতে তোদের বিয়ে হয়েছে এটা নিশ্চয়ই তোর অজানা নয়, অবনী? বিয়ের কথা শুনে তুইও যেমন অবাক হয়েছিলি, তেমনি অবাক হয়েছিল ইশুও। ইশুর পক্ষে বিষয়টা সহজ ছিলনা। ও জ্বলছিল বেইমানের ছলনার আগুনে। ” নাজমা আক্তারের বলা কথাটা শোনামাত্রই ইশরাক অবনী একযোগে তাকায় তার দিকে। কিন্তু সেদিকে নজর নেই নাজমা আক্তারের। তিনি বলেই চলেছেন,

” নিশ্চয়ই তোদের মনে প্রশ্ন জাগছে, আমি এই কথাটা কেন বললাম? ইশরাক আর রিশার বিষয়টা আমি শুরু থেকেই জানতাম। সময়ে-অসময়ে অবনীর রিশাদের বাড়িতে যাওয়া দেখে আমার মনে সন্দেহ জেগেছিল। একটু চোখকান খোলা রাখতেই জানতে পারি, অবনী ইশরাক আর রিশার পত্রবাহকের ভূমিকা পালন করছে। সেদিন আমার ভিষণ রাগ হয়েছিল, কষ্ট লেগেছিল। আমি সেদিন কেঁদেছিলাম। বিয়ের পর থেকে এই সংসারে এসে কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি। পরপর দুই ছেলের মা হলাম। কিন্তু মনের গহীনে একটা কন্যা সন্তানের আফসোস থেকেই গেছিল। যেদিন অবনীর জন্ম হলো, সেদিন যেন হাতে চাঁদ পেলাম। মনস্থির করলাম, দুই ছেলের একজনের বউ করব অবনীকে। দিন যত গড়ালো, ধীরে ধীরে তোরা বড় হতে লাগলি। ইশারাক আর অবনীর মজবুত বাঁধন আমাকে মুগ্ধ করল। একদিন ইশরাকের বাবার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলাম, অবনীই হবে আমার বড় পুত্রবধূ। সময় হলে ওয়াহাবের কাছ থেকে তার আদরের রাজকন্যাকে চেয়ে নেব। কিন্তু রিশার বিষয়টা আমাকে হতাশ করল। গোপনেই নিজের দুঃখ লুকালাম। কাউকে জানতেও দিলামনা। ইশরাকের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথাও বললামনা। জানতাম, তাহলে হিতে-বিপরীত হতে পারে। অবশ্য আমি জানতাম ওদের সম্পর্ক খুব বেশিদিন টিকবেনা। কারন রিশার পরিবারের লোকজনদের আমি ভালোভাবেই চিনি। ওরা একটু বেশিই লোভী। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, রিশাও ওর বংশের মানুষদের মতই হবে। হলোও তাই। রিশার বিয়ের পাঁচ-ছয়মাস আগেই জানতে পেরেছিলাম, ওর বিয়ের কথা হচ্ছে। রিশারও এতে অমত নেই। ভালো ছেলে পেলেই রিশার বিয়ে হবে। সেদিন আমার খুশি লাগলেও পরক্ষণেই ছেলের কথা ভেবে সেই খুশিটা স্থায়ী হয়নি। কারন আমি জানতাম, ইশু ঐ মেয়েকে কতটা ভালোবাসে। ওর বিয়ে হয়ে গেলে আমার ছেলেটা বাঁচবে কিভাবে সেই চিন্তাই আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। রিশার চাচীর মাধ্যমে সব খবরই আমি পেতাম। তখন থেকেই ইশুকে আকারে-ইঙ্গিতে বোঝাতাম। কিন্তু আমার ছেলেটা আমার কথার মর্মার্থই বুঝতনা। ছেলের চিন্তায় নাওয়াখাওয়া ছেড়ে দিলাম। একদিন জানতে পারলাম, কোন এক মেজরের সাথে রিশা সম্পর্কে জড়িয়েছে। তার সাথেই বিয়ের কথা চলছে। হাসিখুশি রিশাকে দেখে বুঝে গেলাম ও কখনোই ইশুকে সত্যিকারের ভালোবাসেনি৷ রিশার বাড়িতে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বিয়েতে ওর মত আছে কিনা। ও একবাক্যে হ্যাঁ বলল। একদিন রিশার বিয়ে হল। অবনীকে ইশুর চিন্তায় ছটফট করতে দেখলাম। বারবার আমার কাছে এসে ইশুর খবর জানতে চাচ্ছিল। ও মানতে পারছিলনা। অনেকগুলো মাস ধরে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া না করায়, ছেলের চিন্তায় আমি বিছানা নিলাম। আমার ছেলে খবরটা পেয়ে ছুটে আসল। সুযোগ বুঝে তার কাছে বিয়ের কথা বললাম। গাঁইগুই করতে করতে একসময় সে রাজিও হলো। অবনীও তাই। আমি জানতাম, প্রথম প্রথম দু’জন দু’জনকে মানিয়ে নিতে সমস্যাই হবে। কিন্তু ঘটনা যে এতদূর গড়াবে আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। বাসর রাতেই আমার ছেলে অবনীকে অপমান করে রুম থেকে বের করে দেবে, এটা আমার কল্পনায়ও ছিলনা। আমি দূর থেকে দেখলাম, ড্রয়িংরুমে পরে গিয়ে ব্যথায় কাতরানো অবনীকে। কাছে গিয়ে ওকে লজ্জায় ফেলতে চাইনি। জানিনা সে রাতে বদ্ধ দরজার আড়ালে কি ঘটেছিল। অবনীকে কাঁদতে দেখেও ওর কাছে যাইনি আমি। ইশুর ওপর রাগ হয়েছিল, কিন্তু ওর কথা ভেবে সেই রাগের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ ছিলনা। সকাল হতেই অবনীকে আগলে নিলাম বুকের ভেতর। সেদিন থেকেই ভুলের সূচনা। আমার ছেলে একের পর এক ভুল করে গেছে। আর তার খেসারত দিতে হয়েছে অবনীকে। এবার নিশ্চয়ই তোদের মনে প্রশ্ন জাগছে, কেন সেই রাতে আমি সামনে এলামনা? আমি চেয়েছিলাম, তোরা তোদের ব্যক্তিগত বিবাদ, ভুলবোঝাবুঝি নিজেরাই সামলে নিবি। সেই সুযোগও তোদের দিয়েছিলাম। অবনীকে বুকে টেনে নিয়েছিলাম। ওকে বুঝতেই দেইনি ও আমার ছেলের বউ। মেয়ে হিসেবে গ্রহন করেছি ওকে। কিন্তু তোরা ইগো দেখাতে গিয়ে কাছে আসার বদলে দূরে সরে গেলি। বিবাহিত হওয়া স্বত্বেও চারটা বছর তোরা দূরে ছিলি। গ্রামের লোকজন নানান কথা বলেছে। সেসব কথাকে পাশ কাটিয়ে কিভাবে চলতে হয় সেটা অবনীকে শিখিয়েছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আমার সব চেষ্টাই বৃথা গেছে। ভুলের হোক আর অন্যায়ের হোক শুরুটা যেমন ইশু করেছিল, তেমনি একে টেনে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছিস অবনী তুই । কেউ নিজের ভুল বুঝতে পেরে মন থেকে ক্ষমা চাইলে, একটা সুযোগ চাইলে তাকে ক্ষমা করে সুযোগ দিতে হয়। কিন্তু অবনী তুই সেটা করিসনি। রাগ তোর মনের গভীরে পুষে রেখেছিস। আজ তুই বলেই ফেললি, অন্য কোথাও তোর বিয়ে দিতে। তবে কি আমি ধরে নেব তুই এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাস? আমার ভুল সিদ্ধান্তের কারনে যে সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল, আমি চাই দু পক্ষের সমঝোতায় এর একটা সমাধান করতে। তুই চাইলে ইশু তোকে মুক্তি দেবে। এটা আমি বলছি। তুই কি চাস অবনী? ইশু, তোর মতামতও আমি জানতে চাই। ”

নাজমা আক্তারের কথা শুনে অবনী ইশরাক দু’জনেই স্তব্ধ হয়ে গেছে। অবনী ছলছল চোখে বড়মার দিকে তাকিয়ে থাকে। বড়মা সবকিছুই জানত! অথচ এত বছরেও ওকে সেকথা জানতে দেয়নি। কিন্তু ও বড়মার প্রশ্নের উত্তর কি দেবে? কি চায় ও, সেটা আজ-অব্দি ভেবে দেখেনি। তবে একটুকু জানে, ও কোনদিনও বড়মাকে কষ্ট দিতে পারবেনা।

নাজমা আক্তার জবাবের অপেক্ষা করছেন। তিনি পালাক্রমে দু’জনের দিকেই তাকালেন। দু’জনকে উদ্দেশ্য করেই বললেন,

” জবাব দিচ্ছিসনা কেন? আজ রাতের মধ্যেই আমি জবাব চাই। আগামীকাল ইশু ঢাকা যাওয়ার আগেই আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চাই। অবনী, তোরও নিজেরমত করে বাঁচার অধিকার আছে। তোর যদি মনে হয়, এই সম্পর্ক তোকে পদে পদে অপমানে জর্জরিত করছে, তবে তুই নিঃসংকোচে বলতে পারিস। তোকে কেউ দোষী করবেনা, এটা আমার প্রতিশ্রুতি। সসম্মানে তোর মুক্তির ব্যবস্থা আমি করব। ইশু কাল ঢাকা যাওয়ার আগেই তোদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা আমি করব। ইশু, এবার বল তুই কি চাস? অবনী চাইলে ওকে মুক্তি দিবি? অবশ্যই তুই অন্যায় করেছিস। সেই হিসেবে জোর তুই করতে পারিসনা। তবে ক্ষমা চাইতে দোষ নেই। ”

বড়মার কথা শুনে অবনী কাঁপছে। এতগুলো বছর ধরে মনের ভেতর সেই প্রথম রাতের দুর্বিষহ স্মৃতিই ঘুরপাক খেয়েছে। ফলশ্রুতিতে ইশরাকের প্রতি রাগ জন্মেছে মনে। কিন্তু কখনো ডিভোর্সের কথা ভাবেনি।

” আমি আরেকটা সুযোগ চাই, মা। প্রয়োজনে আমি নিজের দোষ স্বীকার করে পুরো দুনিয়ার সামনে আমি অবনীর কাছে ক্ষমা চাইতে রাজি আছি। ও চাইলে, যেকোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। কিন্তু সেটা আমার স্ত্রীকে দূরে রেখে নয়। আমি চাই ও আমার কাছে থেকে আমাকে শাস্তি দিক। তবুও আমি আমার স্ত্রীকেই চাই, সেটা পুরো দুনিয়ার বিনিময়ে হলেও। ”

ছেলের কথায় যেন স্বস্তির পরশ নামল নাজমা আক্তারের চোখমুখে। এবার তিনি তাকালেন অবনীর দিকে।

” শুনলিতো ইশুর সিদ্ধান্ত? এবার তোর সিদ্ধান্ত জানা আমাকে। নির্ভয়ে বলতে পারিস। কেউ তোকে জোরজবরদস্তি করবেনা। ”

তবুও অবনী কোন উত্তর দিতে পারছেনা। ও মাথা নিচু করে ঠাঁয় বসে থাকল। ওর কানে বাজল ইশরাকের বলা কথাগুলো।

” কিছু বলছিস না কেন? যা বলবার তাড়াতাড়ি বল। তোর উত্তর যদি না হয়, তবে আমি আজকেই উকিলের সাথে কথা বলব। কাল সকালের মধ্যেই তোদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করব। আর যদি তোর উত্তর হ্যাঁ হয় তবে, আমি দুইদিনের মধ্যেই পুরো গ্রামের মানুষকে দাওয়াত করব তোদের বিয়ে উপলক্ষে। যা বলবি তাড়াতাড়ি বল। ইশুর বড় ফুপুর ইচ্ছে ছিল তার ছোট মেয়ের সাথে ইশুর বিয়ে দেবে। মেয়েটা খারাপ নয়। দেখতে শুনতেও ভালো। ওর সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলে ওরা এক পায়ে রাজি হবে। ” অবনীকে চুপ থাকতে দেখে আবারও কথা বললেন নাজমা আক্তার।

এতক্ষন অবনী কাঁপলেও সেটা গোপনেই ছিল। কিন্তু বড়মার কথা শুনে সেটা আর গোপন থাকলনা। নাজমা আক্তার বুঝতে পারলেন অবনী কাঁপছে, সেই সাথে কাঁদছেও। তবুও তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন অবনীর দিকে।

ইশরাক নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে অবনীর দিকে। অবনীর ওপর নির্ভর করছে ওর সুখ-দুঃখ, ভালোমন্দ সবকিছু। কিন্তু অবনী নিরুত্তর রইল।

” অবনী, তাড়াতাড়ি কর। রাত হয়ে গেছে। ঘুমের ঔষধ খেয়েছি অনেকক্ষণ আগেই। আমি আর জেগে থাকতে পারছিনা। ”

” তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন? আমার কষ্ট হচ্ছে তো। ” অবনী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

” আমার এতকিছু দেখার সময় নেই। আমি চাচ্ছিনা তোরা দু’জনেই আমার একটা ভুল সিদ্ধান্ত আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাক। যে সম্পর্কে ভালোবাসা নেই সেই সম্পর্ক মিছেমিছি আঁকড়ে ধরে রেখে কি লাভ? কেটে দে এই বাঁধন, ছিঁড়ে ফেল সম্পর্কের মিছে মায়া। ”

মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইশরাক। মা এসব কি বলছে? কেন সে অবনীকে এভাবে জোর করছে? মা ও কি চায়না অবনী ওর থাকুক?

” কি রে কিছু বল? এভাবে মুখে কুলু পেতে আছিস কেন? তবে কি আমি তোর মৌনতাকে সম্মতির লক্ষ্মণ ভেবে ধরে নেব, তুই এই সম্পর্কে থাকতে চাসনা? ইশু, তোর বাবার কাছে গিয়ে উকিলের সাথে কথা বলতে বল। ”

” নাহ্। ” এতটুকুই বলতে পারল অবনী। ও আঁকড়ে ধরেছে বড়মার হাত। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে।

অবনীর সামান্য না উচ্চারণ শুনেই হাসি ফুটল নাজমা আক্তারের মুখে। ইশরাকও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। নাজমা আক্তার অবনীর হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

” ঠিক আছে। তবে আমি এই রুম থেকে অন্য কোথাও তোকে যেতে না দেখি। যত মান-অভিমান আছে সব মিটিয়ে ফেলবি। আমার ছেলে দেবদাস-এর মত ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা আমি দেখতে চাইনা। আবার তোর অসহায় চোখ দেখতেও আমার কষ্ট হয়। ইশু, দরজা বন্ধ কর। আর হ্যাঁ, আমি যেন আর কোনদিন অবনীর চোখে পানি না দেখি। ” নাজমা আক্তার সোজা রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। অপেক্ষা করলেন ইশরকাকের দরজা বন্ধ করার৷ দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ পেতেই তিনি জোরে শ্বাস ছাড়লেন। প্রানখোলা হাসিতে উদ্ভাসিত হল তার মুখাবয়ব। ছেলেমেয়ে দুটোর স্বার্থেই এতটুকু কঠোরতার অভিনয় তাকে করতে হয়েছিল।

চলবে..

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী জামী

ইশরাক দরজা বন্ধ করে কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করল। মায়ের কঠিন রুপ দেখে ও ভয়ই পেয়ে গেছিল। মায়ের কথা শুনে যদি অবনী ওকে ছেড়ে যেত, তবে ওর অবশ্যই বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যেত। অবনীর ফোঁপানোর আওয়াজ কানে যেতেই ইশরাক ওর দিকে তাকায়। এতক্ষণ রুমে দমবন্ধকর পরিস্থিতি থাকলেও এখন পরিস্থিতি পুরোটাই আলাদা। এই মুহূর্তে ও ভয় পাচ্ছে। ভাবছে কিভাবে অবনীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? ওর সাথে কথা শুরু করবে কিভাবে? যদি অবনী রিয়্যাক্ট করে? মনে মনে দোয়াদরুদ পাঠ করতে করতে ইশরাক এগিয়ে গেল অবনীর দিকে। কয়েক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর সাহস করে বসে পরল অবনীর পাশে।

” কাঁদিসনা, প্লিজ। তোর চোখের পানির একেকটা ফোঁটা আমার বক্ষপিঞ্জরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আমার হিয়া চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় সেই তীব্র যন্ত্রণায়। নিঃশব্দ কান্নার স্রোতে ভেসে যায় অনুভূতির সমস্ত সুর। প্লিজ থেমে যা। ”

ইশরাকের গলায় এমন কিছু ছিল নিমেষেই থেমে যায় অবনীর কান্না। এতক্ষণে পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হল। বন্ধ দরজার আড়ালে শুধু ওরা দু’জন। যে মানুষটাকে সে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করত, সেই মানুষটার সাথেই কাটাতে হবে দীর্ঘ রজনী। কথাটা মনে আসতেই ভয়ের শীতল স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে নামতে থাকল। রাগে-অভিমান, দুঃখ-কষ্টের মাঝে অবনী কখনোই ভাবেনি আজকের এই রাত জীবনে কখনো আসবে। একটা প্রশ্ন এসে মনে উঁকিঝুঁকি মারছে। যদি ইশরাক ওর ওপর জবরদস্তি করে? ভয়ে হাতের তালু ঘামছে। পরপর কয়েকটা ঢোক গিলল। বোধহয় ললাটে কয়েক ফোঁটা ঘাম আতঙ্কের দহন হয়ে ঝরে পরছে।

অবনীকে উসখুস করতে দেখে ইশরাক ভ্রু কোঁচকায়। মানস চোখে দেখতে পেল, অবনী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। যেন অদৃশ্য কোন ভয় তাকে গ্রাস করছে। মুহূর্তেই ইশরাক বুঝে গেল ঘটনা কি। অবনীর ছেলেমানুষী দেখে মৃদু হাসল।

” অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পর। আমি ঐ পাশে শুচ্ছি। মাঝখানে বর্ডার হিসেবে কোলবালিশ থাকবে। তোর কোন ভয় নেই। আমি মানুষ, হায়েনা নই। ” অবনীকে অবাক করে দিয়ে ইশরাক পাশ ফিরে শুয়ে পরল।

অবনী পেছনে তাকিয়ে দেখল অপর দিকে পাশ ফিরে শুয়েছে ইশরাক। স্বস্তির নিঃশ্বাস পেলে ও এবার পুরো রুম দেখতে শুরু করল। অনেক বছর ধরে রুমটায় আসা হয়নি। নতুন আসবাবপত্র এসেছে দেখেও একবারের জন্যও উঁকি দেয়নি এই রুমে। সামনে তাকাতেই বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে গেল অবনী। দেয়ালে ওর ছবি ঝুলছে! ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারল, কয়েকদিন আগে রান্নাঘরে বড়মার সাথে কাজ করছিল। গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার। এলোমেলো চুলে ঝুঁকে কিছু একটা করছিল। তখনই ছবিটা তোলা হয়েছে। কিন্তু অবনী একবারের জন্যও বুঝতে পারেনি কেউ ওর ছবি তুলেছে! অবনী বুঝতে পারছে কাজটা এই লোকটার। ছবির দিকে তাকিয়ে বিরবির করে কয়েকটা গালি দিল ইশরাককে। এরপর খুব সাবধানে পিঠ ঠেকালো বিছানায়।

ঘুম ভাঙ্গতেই ঘড়ির দিকে চোখ গেল। আটটা বাজে! তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়ল। লজ্জায় ওর শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল। বড়মা কি ভাবছে! বিছানায় তাকাতেই দেখল ইশরাক সটান হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমে বিভোর সে। একহাত কপালের ওপর রেখেছে, আরেক হাত রেখেছে বুকে। অবনী বুকে ফুঁ দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। ভাগ্যিস লোকটা রাতে কিছু করেনি।

দরজা খুলেই দাদীকে দেখতে পেল অবনী। কুলসুম বেগম ড্রয়িংরুমে কিছু একটা করছিল। অবনীকে ইশরাকের রুম থেকে বেড়োতে দেখে তার ভ্রু কপাল আপনা-আপনিই কুঁচকে গেল। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা সে আশা করেনি। অবনী দাদীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে রান্নাঘরে গেল। নাজমা আক্তার এক মনে কাজ করছেন। অবনী গিয়ে দাঁড়াল বড়মার পাশে।

” বড়মা। ”

” হুঁ। ”

” কিছু করতে হবে? ”

” নাহ্। আমি করছি। ”

বড়মার গম্ভীর মুখখানা দেখে অবনীর কান্না পেল। তার এমন নির্লিপ্ত ভাব অবনীকে পোড়াচ্ছে। এই বড়মাকে দেখে অভ্যস্ত নয় সে। এদিকে নাজমা আক্তার অবনীকে দেখেও না দেখার ভাব করে কাজ করছেন। অবনী বড়মার পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। টুকটাক কাজ করতে থাকল। নাজমা আক্তার ওকে বাঁধা দিলেননা কিংবা কিছু করতেও বললেননা। রান্না শেষ হলে অবনী খাবারগুলো টেবিলে নিয়ে যায়। সব গোছগাছ করে রাখে। এবার সবাই আসলে খেতে দেবে।

নাজমা আক্তার সবাইকে খেতে ডাকলেন। একে একে সবাই এসে হাজির হল।

” অবনী, তুই তো আমাদের বাড়িতে কখনো খাসনা। তুই বরং তোর বাড়িতে গিয়েই খেয়ে আয়। ” নাজমা আক্তার ব্যাঙ্গ করে বললেন।

বড়মার কথাটা অবনীর বুকে গিয়ে লাগল। কখনোই বড়মা ওকে খাবার নিয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু আজ এ কি বলল সে! বড়মার কথার ধরনও একটু কেমন যেন।

নাজমা আক্তারের কথা শুনে বেশ খুশি হল কুলসুম বেগম। এতদিন তার জন্যই কুলসুম বেগম অবনীকে জব্দ করতে পারেনি। আজ বোধহয় সেই সুযোগ এসেছে। কুলসুম বেগম সিদ্ধান্ত নিল, আজকে থেকেই সে অবনীকে জব্দ করতে যা যা করার করবে। সে অবনীকে ইশরাকের জীবন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে। এরপর তার নাতনী মিতুর সাথে ইশরাকের বিয়ে দেবে।

ইসহাক আজাদ চেয়ার টেনে বসতে গেলে অবনী তাকে বাঁধা দেয়।

” চাচা, তুমি ঐ চেয়ারে গিয়ে বস। তুমি জানোনা এটা আমার চেয়ার? ” চার বছর আগেও এটাই অবনীর চেয়ার ছিল। ও এই চেয়ার ছাড়া অন্য কোথাও বসতনা।

ইসহাক আজাদ হেসে আরেক চেয়ারে গিয়ে বসলেন। নাজমা আক্তার আঁড়চোখে অবনীর কর্মকাণ্ড দেখছেন। অবনী একটা প্লেট নিয়ে তাতে দুইটা পরোটা আর ডিম ভাজা নিয়ে খেতে শুরু করেছে।

” ছেমরির কামডা দেখছ! ক্যাম্নে সক্কলরে রাইখাই নিজে খাইতাছে! এইডা নাকি বাড়ির বউ! ইমুন অলক্ষুণে কারবার আগে দেখি নাই। কি দুনিয়াডা আইলো গো। বাড়ির কারো মুখে এখনো খাওন উঠেনি, কিন্তু এই ছেমরির সেইদিকে কুন নজর নাই! ” কুলসুম বেগম খেঁকিয়ে উঠল। সে নাজমা আক্তারকে উস্কে দিতে চাচ্ছে।

” আহ্ বুড়ি, এত কথা বল কেন? আমি কি তোমার টাকায় কেনা খাবার খাচ্ছি? আমি আমার শ্বশুরের টা খাচ্ছি। তোমার এত জ্বলে কেন? আর সকলের হাত কি আমি বেঁধে রেখেছি? খাওনা কেন? নাকি তোমাদের খেতে কেউ বারণ করেছে? ঠিক বলেছিনা, শ্বাশুড়িমা? ” অবনী ভয়ে ভয়ে তাকাল নাজমা আক্তারের দিকে। ও চাচ্ছে নাজমা আক্তার ওর পক্ষে কথা বলুক।

” আম্মা, ও নিজের মত খাচ্ছে খাক। আপনি এসব কি বলছেন ওকে? এটা কি অবনীর নিজের বাড়ি নয়? এই বাড়িতে খেতে গেলে সবার অনুমতি নিতে হবেনা ওর। ”

অবনী বড়মার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল। এইতো ও আগের বড়মাকে ফিরে পেয়েছে।

এরপর আর কেউ কোন কথা বললনা। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে যে যার রুমে গেল।

অবনী গেল রান্নাঘরে।

” বড়মা? ”

” হু। ”

অবনী এবার ঘাবড়ে গেল। বড়মা আবারও হুট করেই গম্ভীর হয়ে গেছে। কিন্তু কেন? ও আবার কি ভুল করল? পরক্ষনেই অবনীর নিজের ভুলের কথা মনে পরল। কিন্তু ও লজ্জা পাচ্ছে। কিভাবে কাজটা করবে? অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উসখুস করল। বড়মার মনযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করল। কিন্তু কোন কাজ হলোনা। বাধ্য হয়ে চোখমুখ খিঁচিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল,

” মা, আমি একটু ঐ বাড়িতে যাব। আমার কাপড়চোপড় নিয়ে আসতে হবে। ”

অবনীর মুখে মা ডাক শুনে খুশিতে কেঁদে ফেললেন নাজমা আক্তার। তার অনেক বছরের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। তিনি এগিয়ে গেলেন অবনীর দিকে। ওকে জড়িয়ে নিলেন বুকে। চুমু দিলেন ওর পুরো মুখে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,

” কি বললি আরেকবার বল? আমার কলিজা জুড়াক। ”

বড়মার আদর পেয়ে কাঁদল অবনীও। মৃদু গলায় বলল,

” মা। হয়েছে নাকি আবারও ডাকব? ”

” যা তোর সব জিনিসপত্র একে একে নিয়ে আয়। না তোকে আনতে হবেনা। আমি রেখাকে পাঠাচ্ছি, অর্নি সব গুছিয়ে দেবে, রেখা নিয়ে আসবে। তুই আগামী কয়েকদিন এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবিনা। ”

” কিন্তু রেখা খালা কোথায়? তাকে তো দেখছিনা। ”

” উঠানে কাজ করছে। তুই ঘরে যা। তোর কাপড়চোপড় নিয়ে আসার ব্যবস্থা আমি করছি। এক কাজ কর, তোর রুমে গিয়ে দেখ আলমারিতে নতুন বেডশিট রাখা আছে, তুই সেটা বিছিয়ে ফেল। জানালার পর্দাগুলোও বদলে ফেল ৷ আলমারিতেই সব পাবি। আমার ছেলের বউ নিজের বাড়িতে এসেছে অথচ আমি তার রুমটাই সাজিয়ে দিতে পারিনি, এই লজ্জা আমি কোথায় রাখব৷ ” নাজমা আক্তার হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন উঠানে।

অবনী বড়মার কাজকর্ম দেখে হাসতে লাগল। কিন্তু যখনই মনে পরল ইশরাকের রুমে যেতে হবে, তখনই মুখের হাসি মুছে গেল। মুখ কাঁচুমাচু করে রুমে গেল।

ইশরাক বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। অবনীকে ভেতরে আসতে দেখে ল্যাপটপ চালু রেখেই উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে গেল আলমারির কাছে।

” বেডশিট কোথায়? আর পর্দাগুলো? ” ইশরাককে উদ্দেশ্য করে বলল অবনী।

” এদিকে আয়। সবকিছু দেখে নে। ” অবনী ইশরাকের দিকে এগিয়ে গেল।

ইশরাক আলমারির কপাট খুলে দিল।

” দেখে নে কোথায় কি আছে। আজকে থেকে এসবকিছুর মালিক তুই। কোথায় কি রাখবি এটা তোর বিষয়। চাইলে নিজের কাপড়চোপড়ও রাখতে পারিস। ”

” হুঁ।”

ইশরাককে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে অবনী বেডশিট খুঁজতে শুরু করল।

” পর্দাগুলো খুলতে হবে। ” যেন হাওয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল মেয়েটা।

ইশরাক হেসে জানালা থেকে পর্দা খুলতে শুরু করল। ইতোমধ্যেই অবনী পুরোনো বেডশিট বদলে নতুনটা বিছিয়েছে। ইশরাক পর্দা খুললে অবনী আবারও হাওয়ার সাথে কথা বলল,

” এগুলো টানিয়ে দিতে হবে। ” ইশরাক অবনীর কথামত কাজ করল।

কাজ শেষ করে অবনী রুম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলেই ওকে পেছন থেকে ডাকল ইশরাক।

” অবনী, একটু শুনবি? ” অবনী থমকে দাঁড়ায়। ইশরাক কয়েক মুহূর্ত পর এসে দাঁড়ায় অবনীর সামনে। অবনীর সামনে বাড়িয়ে ধরল ওর হাত। অবনী দেখল ইশরাককে হাতে একটা ব্যাগ।

” তোর জন্য এনেছিলাম। ইচ্ছে হলে ব্যবহার করিস, নয়তো ফেলে দিস। তবুও আমাকে ফেরৎ দিসনা। ”

অবনী হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিল। ইশরাক আর সেখানে দাঁড়ালোনা। বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
অবনী ব্যাগটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। একে একে ব্যাগ থেকে বের করছে সবকিছু। কয়েকটা বক্স দেখে ওর কপাল কুঁচকে গেল। ধীরে ধীরে খুলল বক্সগুলো। চেইন, কানের দুল, আংটি, ব্রেসলেট আর কয়েকটা ড্রেস আছে ব্যাগে। সেই সাথে আছে অবনীর সেদিনের ফিরিয়ে দেয়া বালা আর কানের দুল। অবনী স্থির হয়ে বসে রইল। নিজের সাথেই নিজে বোঝাপড়া করল অনেকক্ষণ। অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হল। প্রথমে বালা দুটো হাতে ঢোকাল। এরপর ধীরে ধীরে কানে দুল জোড়া পরল, যেন চাঁদের টুকরো দুটি ঝুলে রইল তার কান দুটোয় । বক্স থেকে সোনার চেইনটা নিয়ে গলায় জড়াল। যা সকালের মৃদু আলোয় ঝলমল করছিল। ধীরে ধীরে আংটিটা তুলে নিল, এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল তার দীপ্তির দিকে। তারপর অনামিকায় পরল। যেন চিরবন্ধনের এক নীরব স্বাক্ষর রেখে গেল সেখানে। গহনাগুলো পরা হলে বাকিগুলো ব্যাগে তুলে রাখল অবনী। ব্যাগটা আলমারিতে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসল।

ইশরাক ড্রয়িংরুমে বসে ছিল। অবনীকে দেখে ও মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকল। সামান্য কানের দুল, চেইন আর হাতের বালায় যেন ওকে বউ বউ লাগছে। গর্বে ফুলে উঠল ইশরাকের বুক। এই মেয়েটা ওর ‘ বউ ‘ ভাবতেই ইশরাকের তনুমন আন্দোলিত হচ্ছে। বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আছড়ে পরছে হিয়ার দুকূলে। প্রেমকাননে উড়ে বেড়াচ্ছে রংবেরঙের প্রজাপতি।

ইশরাকের মুগ্ধ দৃষ্টি অবনীর নজর এড়ালোনা৷ কিন্তু ও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বড়মার কাছে গেল।

চলবে…