হলুদ বসন্ত পর্ব-২৯+৩০

0
306

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_২৯
জাওয়াদ জামী জামী

দীর্ঘ রজনী, ঘুমহীন দু জোড়া চোখ। একজন সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করছে৷ অপরজন কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত, তার অভিযোগের খাতাও পূর্ণ হয়েছে। অভিমানও ফিঁকে হয়ে এসেছে অনেকটাই৷ তবুও সুক্ষ্ম একটা অস্বস্তি এখনো দুজনের মাঝে রয়েই গেছে। ইশরাক একটু নড়ল। হয়তো সে কিছু বলছে চাইছে, হয়তো দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করছে। শব্দ আসেনা, শুধু গভীর রাতের নিস্তব্ধতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে।

বাতাসে জানালার পর্দা সামান্য দুলে ওঠে। তবে কি দুজনের মধ্যকার নিরবতার দেয়াল ভাঙ্গবে? নাকি নতুন কোন সকাল আসার আগেই তারা নিজেদের মত করে মুখ ফিরিয়ে নেবে?

প্রতিটা ক্ষন অসহ্য ঠেকছে ইশরাকের কাছে। নিঃশ্বাসও ওর সাথে বেইমানী করছে। তারা ধীর গতিতে চলাচল করছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি প্রানটা বেরিয়ে গেল। বাধ্য হয়ে উঠে বসল ইশরাক। এক ঝলক তাকাল অবনীর দিকে। বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইল।

অবনী কপাল কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করল কি হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে ওরা এক বিছানায় আছে। অথচ একদিনও ইশরাককে এমন অস্থির হতে দেখেনি। কি হয়েছে তার? একবার পাশ ফিরে দেখবে নাকি? একই বিছানায় দুজন মানুষ শুয়ে আছে। একজন ছটফট করছে অথচ অপরজন চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবে এটা কি আদৌও সম্ভব?

” কি হয়েছে আপনার? শরীর খারাপ লাগছে? ”

অবনীর প্রশ্নে চোখ খুলল ইশরাক। তার ঠোঁটে কি অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে নিমেষেই মিলিয়ে গেল?

” কিছুই হয়নি। রাত জাগিসনা, ঘুমিয়ে পর। কালকেও বাড়িতে মেহমান থাকবে। মায়ের সাথে তোকে অনেক কাজ করতে হবে। তাই তোর ঘুমানো দরকার। ”

” হুঁ। আপনি ঘুমাবেননা? ”

” আগে আমাকে ‘ তুমি ‘ বলতিস। এখন ‘ আপনি ‘ কেন? ”

ইশরাকের এমন প্রশ্নে থতমত খায় অবনী। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়।

” আগের আমি আর এখনকার আমির মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। তাছাড়া আগেরকার মত স্বাভাবিক সম্পর্কও নেই দুজনের মধ্যে। দুজনের ক্ষেত্রে মধুর সম্ভাষণের জন্য সুসম্পর্ক থাকতে হয়। যেটা আমাদের মধ্যে নেই। ”

” এখন নেই বলে কি ভবিষ্যতে হতে পারেনা? আমরা চাইলেই সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। ”

” না পারেনা। ” ইশরাকের দিকে তাকালনা অবনী। পাশ ফিরে শুয়ে পরল। এই মুহূর্তে ইশরাকের দিকে তাকানো মানেই, ইশরাকের চোখে নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ করা যেটা চায়না অবনী। ও চায় মানুষটা আরও একটু পুড়ুক। বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে খাঁটি হোক তার ভালোবাসা।

অবনীর সরাসরি উত্তর শুনে ইশরাক বিষাদের হাসি হাসল। ওর মনে হল, অবনীর মন পাওয়া এ জীবনেও হয়ে উঠবেনা।

***

” এ তুই কি বলছিস, বাপ? এখনই চলে যাবি? কিন্তু কেন? তোর তো রাতে যাওয়ার কথা ছিল? যাসনা, বাপ। বাড়ি ভর্তি মেহমান, এখন যদি তুই চলে যাস, কেমন হবে বল? ”

” জিদ করোনা, মা। মেহমানদের তোমরাই আপ্যায়ন করতে পারবে। আমার এখনই যেতে হবে। ইমারজেন্সী না হলে আমি যেতামনা। একটু বোঝার চেষ্টা কর, মা। ” ইশরাক মিথ্যা বলল। কোন ইমারজেন্সী কাজ নেই তার। সে শুধু অবনীর ওপর অভিমান করেই যেতে চাইছে। অবশ্য অভিমান বললে ভুল হবে, সে অবনীর মাথা ব্যথার কারন হতে চাইছেনা। ওকে দেখলেই অবনীর কুঁকড়ে যাওয়া, আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা বিরক্ত হওয়া ইশরাকের চোখ এড়ায়নি। তাই সে অবনীকে দুদণ্ড শান্তি দিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

” তোর যখন কাজ পরে গেছে, তাহলে যা। কিন্তু না খেয়ে তোকে যেতে দেবো না। রান্না শেষ, তুই খাবি চল। ”

” এখন খেতে বসলে বাস মিস করব, মা। আমি রাস্তায় খেয়ে নেব। তুমি এত উতলা হয়োনা। ”

ছেলে না খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে এটা মানতে পারছেননা নাজমা আক্তার। কিন্তু তার জেদি ছেলের সাথে পেরে ওঠার সাধ্য কারো নেই। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল ইশরাক। চোখের জলে ছেলেকে বিদায় দিলেন নাজমা আক্তার।

অবনী দূর থেকে ইশরাকের চলে যাওয়া দেখল। ও খুব করে আশা করেছিল ইশরাক পেছন ফিরে তাকাবে। কিন্তু ওকে নিরাশ করে ইশরাক দৃঢ় পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অভিমানের মেঘ জমল মনের গহীনে। অভিমানে কেঁদে ফেলল অবনী। বিরবির করে বলছে, সে কেন এত কষ্ট দেয় আমাকে? কেন এতটা কাঁদায়?

***

” এই যে মেয়ে, তোমার স্বামী চলে গেল আর তুমি খিলখিলিয়ে হাসছ! আশ্চর্য মেয়ে তুমি! তোমার জায়গায় আমি থাকলে কেঁদে বুক ভাসাতাম।তোমরা এখনকার মেয়েদের ভেতর ভালোবাসা তো নেই, সেই সাথে লাজলজ্জা বলতে কিছুই নেই। তোমাকেও আমার নির্লজ্জই মনে হচ্ছে। ” রিজিয়া বেগম যেন অবনীকে অপমান করতেই কথাগুলো বলল। উঠান ভর্তি মানুষজনে৷ সামনে সে অবনীকে কথার বানে জর্জরিত করল।

এমনিতেই অবনীর মন খারাপ, তারওপর রিজিয়া বেগমের কটুবাক্য শুনে ওর মাথা খারাপ হয়ে গেল। একদিন হয় সে এই বাড়িতে এসেছে, এরইমধ্যে সে এই বাড়ির লোকজনের বিষয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে!

” আপনি কিভাবে বুঝলেন আমার লজ্জা নেই? আমি কি আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙেছি? স্বামী চলে গেছে বলে কি এখন আমাকে উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে হবে? আমি নির্লজ্জ হলে আপনি কি? আপনি তো আস্ত একটা ডাইনী। একটা এতিম মেয়ের সাথে কি ব্যবহার আপনি করেছেন সেটা সবাই জানে। কি পরিমান নির্লজ্জ হলে একটা মা হারা মেয়ের কাছ থেকে তার বাবাকে ছিনিয়ে নেয় সেটা সবাই জানে। আটাশ বছর ধরে যে মানুষটা শ্বশুর বাড়িতে পরে রয়েছে, একবারও তার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি আপনারা। আজ তারই বাড়িতে এসে আসন গেড়েছেন, লজ্জা করছেনা আপনার? স্বামীর সব সম্পত্তি মা হারা মেয়েটাকে ফাঁকি দিয়ে নিজের সন্তানদের নামে লিখে নিয়েছেন, লজ্জা করেনি আপনার? যার নিজেরই লজ্জা নেই, সে আবার এসেছে অন্যের লাজলজ্জার বিচার করতে! কি ভেবেছেন, এত বছর পর এসে এই সংসারের রাশ নিজের হাতে নিবেন? আপনি নিতে চাইলেই সেটা আমরা হতে দেব? বড়মা আপনাদের দাওয়াত দিতেই চায়নি। কিন্তু আমরা বড়মাকে রাজি করিয়েছি। বিশেষ করে আমি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম বেইমান দেখতে কেমন হয়। দেখেও নিয়েছি। বেইমান দেখার জন্মের সাধ মিটেছে আমার। ” অবনী আরও কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু মিনারা খাতুন দৌড়ে এসে অবনীকে নিয়ে তার বাড়িতে গেলেন।

নাজমা আক্তার এতক্ষণ উঠানেই ছিলেন। রিজিয়া বেগমের কথা শুনে তার রাগ হয়েছিল। তিনিই রিজিয়া বেগমের কথার প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলেন, তবে তার আগেই অবনীকে ফুঁসে উঠতে দেখে তিনি থেমে যান। তার সৎমাকে এতগুলো কথা শোনানোর পরও তিনি অবনীর ওপর একটুও রাগ করেননি। অবনী ভুল কিছু বলেনি। তিনিও যদি অবনীর মত প্রতিবাদী হতে পারতেন, তবে বছরে একবার হলেও বাপের ভিটায় তার পা পড়ত। আব্বার অন্তরে তার জন্য ভালোবাসা থাকত। কিন্তু আফসোস সৎমায়ের অত্যাচারে তিনি ভুলেই গেছিলেন প্রতিবাদ কাকে বলে।

” নাজমা, তোর সামনে এমনকি পুরো বাড়ির মানুষের সামনে তোরই ছেলের বউ তোর মাকে অপমান করল, আর তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস? এটা আমি তোর কাছ আশা করিনি। আর তুই কি সত্যিই আমাদের দাওয়াত করতে চাসনি? কেমন মেয়ে তুই! ” নাজমা আক্তারের আব্বা আফসোস করে বললেন।

” শুরুটা কিন্তু আমার তথাকথিত মা-ই করেছিল। তার কি দরকার ছিল আমার পুত্রবধূকে অপমানজনক কথা বলার? আমার ছেলে চলে গেছে জন্যই কি অবনীকে লোক দেখানো কান্না কাঁদতে হবে? ওর মনের মধ্যে কি চলছে সেটা কাউকে দেখানোর দরকার নেই। আর আমি কেমন মেয়ে সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন? আবার আমাদের পরিচিত অধিকাংশ মানুষই আপনি কেমন বাবা। আপনি আপনার স্ত্রীর কথা শুনে আমার সাথে কেমন আচরণ করেছেন সেটা অনেকেই জানে। আমাকে ঠকিয়েছেন সেটাও জানে। হ্যাঁ, এটা সত্যি আমি অবনী আর ইশুর বাবার জন্যই আপনাদের দাওয়াত করতে বাধ্য হয়েছিলাম। নয়তো যে বাবা আমাকে অনেক বছর আগেই পর করে দিয়েছে, তাকে দাওয়াত করার কোন প্রয়োজন ছিলনা। ”

নাজমা আক্তারের কথা শুনে লজ্জায়-অপমানে চেয়ার ছাড়লেন নাজিমুদ্দিন। তিনি স্ত্রী-সন্তানদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিলেন। রাগে তার চেহারা লাল হয়ে গেছে।

” তুই আমার মেয়ে, সেটা ভাবতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। নিজের বাবা-মাকে অপমান করতে তোর একটুও খারাপ লাগলনা? তুই আসলে কারও মেয়ে হবার যোগ্য নয়, না কারো মা হওয়ার যোগ্য। ” আবারও নাজমা আক্তারকে অপমান করলেন তার আব্বা।

” ব্যস, অনেক বলেছেন। এবার থামুন। আমার মা কেমন সেটা ছেলে হিসেবে আমরা ভালোই জানি। সে যে একজন যোগ্য মা, যোগ্য স্ত্রী, যোগ্য পুত্রবধু এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি যে বাবা হিসেবে অযোগ্য এটা একশোভাগ সত্যি। কিভাবে পারলেন, নিজের ঔরসজাত সন্তানকে পর করে দিতে? তার বিয়ে দিয়ে বাবার কর্তব্য পালন করেছেন ভেবেছেন? কিন্তু বিয়ের পর একবারও তার খোঁজ নিয়েছেন? শ্বশুর বাড়িতে মা হারা মেয়েটা কিভাবে দিনাতিপাত করছে সেই খবর রেখেছেন? সেই মেয়ে যে দুই সন্তানের মা হয়েছে, সেই খবর জানতেন? দুই নাতীকে দেখতে এসেছেন কখনো? আজ আটাশ বছর পর এসে গলায় এত জোর থাকে কিভাবে? দ্বিতীয় স্ত্রী আর তার সন্তানরা আপনার কাছে সবকিছু এটা জানতাম, কিন্তু এটা বুঝতে পারিনি আমার মা আপনার কাছে এতটা ঘৃণার পাত্রী। আরে আপনি আমার মাকে ঘৃণা করবেন কি? আমরাই আপনাদের ঘৃণার চোখে দেখব আজকের পর থেকে। নিজেদের জাত চিনিয়ে গেলেন আপনারা। ” শান্তশিষ্ট সাদাফ মায়ের অপমানে রেগে গেল।

এরপর আর এই বাড়িতে তাদের থাকা চলেনা। নাজিমুদ্দিন তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিলেন। ঠিক তখনই নাজমা আক্তার এসে তাদের নিয়ে আসা মিষ্টির প্যাকেটগুলো নাজিমুদ্দিনের হাতে ধরিয়ে দিলেন।

” এগুলো নিয়ে যান। মিষ্টি আমার কোনকালেই পছন্দের ছিলনা এটা হয়তো আপনার জানা নেই। ” কথাটা বলেই বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন নাজমা আক্তার। হতভম্ব নাজিমুদ্দিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন। এরপর সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চলবে…

#হলুদ_বসন্ত
#পার্ট_৩০
জাওয়াদ জামী জামী

” আমার ওপর রাগ করেছ, মা? তোমার বাবা-মাকে আমি যাচ্ছেতাই বলে অপমান করলাম। ” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল অবনী।

” মোটেও না। আমি কি তোর ওপর রাগ করতে পারি? আর তাছাড়া শুরুটা তারাই করেছিল। এসব নিয়ে এতকিছু না ভেবে নিজের কথা ভাব। ইশু তো চলে গেল, যাওয়ার পর ফোন দিয়েছিল তোকে ? ইশু ফ্ল্যাট নিলে তোর সেখানে গিয়ে থাকতে হবে। তাই এবার ঢাকা যাওয়ার সময় নিজের সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাবি। সংসারের বাকি জিনিসপত্র আমি আর তোর মা গিয়ে দিয়ে আসব। তোর সংসার আমরা নিজের হাতে সাজিয়ে দেব। ”

” এতকিছু ভেবে রেখেছ তুমি! এত ভালো কেন তুমি, মা? তোমার মত শ্বাশুড়ি অনেক ভাগ্য করলে পাওয়া যায়। আজ পর্যন্ত অভিযোগের কোন সুযোগ তুমি দাওনি। তোমার মত শ্বাশুড়ি যদি প্রতিটা ঘরে থাকত, তবে সেই সংসারে কখনো অশান্তি হতোনা। ” অবনী সুকৌশলে নাজমা আক্তারের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল। ইশরাক ঢাকা যাওয়ার পর অবনীর সাথে যোগাযোগ করেনি।

” পাজি মেয়ে, এভাবে আমাকে মাথায় তুলতে হবেনা। এক কাজ কর, বাগানে গিয়ে কয়েকটা লেবু নিয়ে আয়। আব্বাকে লেবু পানি দিতে হবে। কিন্তু ঘরে কোন লেবু নেই। আমি ততক্ষণে হাতের কাজ সেড়ে নেই। ”

” আচ্ছা যাচ্ছি। ”

অবনী বাগানে এসে বেশ কয়েকটা লেবু তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে। কিন্তু সামনে রিশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে নিজেও থমকে দাঁড়াল। চার বছর পর দেখা হল রিশার সাথে।

” রিশাপু! ”

” কেমন আছিস, অবনী? সংসার জীবন কেমন কাটছে? ” কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল রিশা।

” খুব ভালো আছি। আর সংসার জীবনও ঝাক্কাস কাটছে। এবার বল তুমি কেমন আছো? ”

” ভালো তো থাকবিই। একজনের ছুঁড়ে ফেলা জিনিস নিয়ে তোর মত মেয়েরাই ভালো থাকতে পারে। তা ইশরাক তোকে ভালোবাসে তো? সে তো আবার আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতনা। দিনরাত আমার পেছনে কুকুরের মত ঘুরত। সেই তারই হুট করে বিয়ের কথা শুনে আমি চমকে গেছিলাম। ও ছুঁয়েছে তোকে? বিছানায় গেছিস তোরা? ”

রিশার কথা শুনে ঘৃণায় অবনীর শরীর রি রি করছে। একটা মেয়ের মুখের ভাষা যে এতটা জঘন্য হতে পারে এটা ওর ধারনায় ছিলনা।

” তুমি একজন বিবাহিতা নারী হয়েও আমাদের বিষয়ে এত আগ্রহী কেন? নাকি জ্বলছে? তোমাকে পাগলের মত ভালোবেসেও ইশরাক আজাদ শেষমেশ আমাকে বিয়ে করেছে জন্য কি ইগোতে লাগছে? আর কি বললে, তুমি তাকে ছুঁড়ে ফেলেছ? ভুল, তুমি স্বার্থপরের মত একটা প্রতিষ্ঠিত ছেলেকে বিয়ে করতে গিয়ে ইশরাককে ধোঁকা দিয়েছ। বেইমানী করেছ তার সাথে। তার ভালোবাসা তোমার মত প্রতারকের হৃদয় ছুঁতে পারেনি, তাই তুমি তাকে কুকুর বলতে পারলে। আসলে তো কুকুর তুমি। টাকার গন্ধ পেয়ে ইশরাকের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে পায়ে মাড়িয়েছ তুমি। কিন্তু আজ দেখ, ইশরাক তোমার হাজবেন্ডের থেকে কোন অংশেও কম নয়। সবকিছু জানার পরে বুঝি ভেতরের জ্বলুনি কমাতে আমাকে কথা শোনাতে এসেছ? তুমি কি ভেবেছিলে, তোমার কাছে প্রতারিত হয়ে ইশরাক দেবদাস হয়ে জীবন কাটাবে? তুমি যদি নিজের সুখ খুঁজতে অন্য একজনের হাত ধরতে পার, তবে সে কেন বিয়ে করতে পারবেনা? তোমার লজ্জা করছেনা, পরপুরুষের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে? সে আমাকে ছুঁয়েছে কিনা, আমরা বিছানায় গেছি কিনা, সেটা একান্তই আমাদের ব্যাক্তিগত বিষয়। বিষয়টা মাথায় রেখে কথা বলবে। ”

” তুই কিন্তু আমাদের মাঝে পিওনের কাজ করতি। চিঠি বহন ছিল তোর কাজ। যেই দেখলি আমি নেই আর অমনি ওকে বিয়ে করে ফেললি? কি করো পারলি রে? একটুও বিবেকে বাঁধলনা? আমাদের ব্যাপারে প্রথম থেকেই সবকিছু জানতিস তুই। তারপরও লোভ সামলাতে পারলিনা? ”

” তাকে ছেড়ে যেতে তোমার যখন বিবেকে বাঁধেনি, তখন তাকে বিয়ে করতে আমার কেন বিবেকে বাঁধবে! চিঠি দেয়া-নেয়া করেছি বলেই যে তাকে বিয়ে করতে পারবনা, এমন হাদিস কোথায় পেয়েছ? আমাকে এতকিছু জিজ্ঞেস করছ কেন তুমি? হিংসেয় নাকি রাগে? নাকি তোমার স্বামী তোমাকে দুরছাই করে? নাকি সে তোমাকে বিছানায় নেয়না? ”

অবনীর কথাগুলো শুনে রিশা কি একটু কুঁকড়ে গেল? অবনী দেখল কয়েক সেকেন্ডের জন্য রিশার চেহারা ছাইবর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু খুব দ্রুতই রিশা নিজেকে সামলে নিল।

” খুব বড় বড় কথা শিখেছিস দেখছি! এত বেশি অহংকার ভালো নয় বুঝলি? ”

” কথা শিখেছি! কই? আমি তো শুধু তোমার কথার উত্তর দিলাম। ইট মেরেছ কিন্তু পাটকেল খাবেনা এটা কি করে হয়? ভবিষ্যতে আমার সামনে এসে এমন আবোলতাবোল কথা বলবেনা বুঝলে? সেদিন কিন্তু এই সামান্য কথাতে থামবনা আমি। সেদিন সবার সামনে তোমার মুখোশ খুলে দেব বলে দিলাম। সর তো, যেতে দাও আমাকে। যতসব ফালতু লোকজন এসে ঝামেলা করে। ” রিশাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বাড়ির দিকে গেল অবনী।

রিশা হতভম্ব হয়ে অবনীকে যেতে দেখল। অবনীর চোখেমুখে সুখীভাব প্রকট। যা দেখে বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে রিশার। অথচ সুখী হওয়ার কথা ছিল ওর। চার বছর আগে ইশরাকের সাথে অবনীর বিয়ের কথা শুনে রিশা কোন প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি। কিন্তু বিয়ের তিন বছর পর যখন জানতে পারল, ওর স্বামী ওকে রেখে অন্য মেয়েতে মজেছে, তখন থেকেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে সে। আর তাই হিংসা হয়েছে অবনীর ওপর। যে জায়গায় ওর থাকবার কথা ছিল, সেই জায়গায় আজ অবনী রাজত্ব করছে। বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারেনা রিশা। গতকাল রাতে বাড়িতে এসে যখন শুনেছে, ইশরাক অবনীর বিবাহোত্তর সংবর্ধনা হয়েছে, তখন থেকেই ও নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। ফলশ্রুতিতে আজ এসেছিল অবনীর মুখোমুখি হতে ওকে কিছু কটু কথা শোনাতে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে ও নিজেই অবনীর কাছে অপমানিত হল। রাগে, দুঃখে রিশার চোখে পানি আসল।

***

” অবনী, এত দেরি করলি কেন? আব্বা সেই কখন থেকে তোকে ডাকছে। দে লেবুগুলো আমাকে দে। ”

” তোমার না হওয়া বউমার সাথে কথা বলছিলাম, মা। সে আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছিল। তোমার ছেলের রাজ কপাল বুঝলে? তার বিয়ের পরও প্রাক্তন এসে নিজের অধিকার দেখাতে চাচ্ছে। এমন কপাল কয়জনের হয়! ”

” রিশা এসেছিল? কোথায় সে? আর সে তোকে কি বলেছে? অবনী, তুই ওরা কথা মন-মস্তিস্ক থেকে ঝেড়ে ফেলে দে। তুই ভালো করেই জানিস ও কেমন মেয়ে। ” উদগ্রীব হয়ে বললেন নাজমা আক্তার।

” বাদ দাও তো, মা। ওর কথা কে শুনেছে। একটা ফালতু মেয়ের কথায় আমি নাচব, এটা কি তোমার মনে হয়? ও নির্ঘাত সংসার জীবনে অসুখী। তাই আমার সংসার ভাঙ্গার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি সেটা হতে দিলে তো। ”

অবনীর কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন নাজমা আক্তার। কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারলেননা। ভয় হচ্ছে তার।

” তুই তাড়াতাড়ি ঢাকা ফিরে যা। আমার ভয় হচ্ছে। ও যদি ইশরাকের সাথে দেখা করে? ইশরাক যদি ওকে গ্রহন করে? আমি সহ্য করতে পারবনা, মা। ” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন নাজমা আক্তার।

” মা, এত ভয় পাচ্ছ কেন? নিজের ছেলেকে চেনোনা তুমি? তোমার কি মনে হয়, তোমার ছেলে বোকা? যে তাকে আঘাত দিয়েছে, অপমান করেছে তাকে সে গ্রহণ করতে আদৌও পারে? কক্ষণো না, মা। সে মরে যাবে, তবুও ঐ মেয়ের ছায়াও মাড়াবেনা। তাই চিল কর। যাও মাথা ঠান্ডা করে বস। তোমার জন্য লেবুর শরবত নিয়ে আসছি। ”

এবার যেন স্বস্তি পেলেন নাজমা আক্তার। অবনীকে শান্ত থাকতে দেখে তার ভালো লাগছে। কিন্তু ভয় যাচ্ছেনা ভেতর থেকে। অবনী দাদুকে লেবু পানি দিয়ে বড়মার জন্য লেবুর শরবত নিয়ে আসল। দাদী আর ফুপুদেরও দিল।

***

” বড় বউমা, দাদু ভাই কি বাসা দেখছে? অবনীর তো ঢাকা যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। ” আব্দুর রহিম জিজ্ঞেস করলেন।

” বাসা দেখছে আব্বা, কিন্তু পছন্দ হচ্ছেনা ওর। ও প্রতিদিন অফিস থেকে বেরিয়েই বাসার খোঁজ করছে। ”

” ভালো একটা বাসা পেলেই শান্তি পাই। দাদু ভাইয়ের খাওয়ার কষ্ট হচ্ছে খুব। অবনী থাকলে রান্না করে দিতে পারত। আচ্ছা, অবনী আর সাদাফ একসাথে যাবে? ”

” অর্নার পরীক্ষা কাল থেকে শুরু হবে। প্রথমদিন ওকে নিয়ে সাদাফ পরীক্ষার কেন্দ্রে যাবে। কালকের পরদিন ওরা যাবে। অবনীর ব্যাগপত্র অনেকগুলো হবে। অবনী একা সবগুলো নিতে পারবেনা। সেজন্য সাদাফকে যেতে হবে। ”

” দাদু ভাইয়ের জন্য তরকারি রান্না করে পাঠিয়ে দিও। ছেলেটা অনেক দিন ধরে খাবার কষ্ট করছে। ”

” দেব, আব্বা। অবনীকে বলেছি। ও নিয়ে যাবে। ”

***

” টেনশন করবিনা একদম। পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত আমরা কেন্দ্রে থাকব। মনে রাখিস এবারেও দেশ সেরা হতে হবে তোকে। ”

” কালকের পরদিন তো তুমি চলেই যাবে। তখন বুঝি আমার টেনশন হবেনা? তুমি থাকলে একটু টেনশন মুক্ত থাকি। ”

” কি করব বল, যেতেই হবে। অবনী এবার বোধহয় সাথে বেশকিছু ব্যাগ নিবে। ওর একা একা ব্যাগগুলো নিয়ে কষ্ট হবে। আর তাছাড়া আমার জরুরী কয়েকটা ক্লাস আছে। সব মিলিয়ে যেতেই হবে। তবে প্রতিদিন বাড়ি থেকে বেড়োনোর আগে এবং রাতে নিয়ম করে ভিডিও কলে কথা বলব। রাগ করিসনা। ”

” রাগ করব কেন! আমাকে কি তোমার স্বার্থপর মনে হয়? নিজের সুবিধার জন্য তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে পারি আমি? কাল রাতের গাড়িতে যাবে? নাকি আগামী পরশু সকালে? ”

” রাতের গাড়িতেই যেতে হবে। পরদিন অবনীর ক্লাস আছে। জানিসই তো ওর ক্লাস মিস গেলে কত সমস্যা? অবনী বারোটার গাড়িতে টিকেট কাটতে বলেছে। ”

” আবার কবে আসবে? ”

” যখন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে, যখন মনে হবে, একজনের মায়াবী মুখখানা না দেখতে পেলে আমার পুরো দুনিয়ায় আঁধার নেমে আসবে। ঠিক তখনই চলে আসব আমি। ”

সাদাফের কথায় লজ্জা পায় অর্না। লাজুক হেসে মুখ লুকায় ওড়নার আড়ালে।

পরদিন অর্নাকে নিয়ে অবনী আর সাদাফ পরীক্ষা কেন্দ্রে যায়। পুরোটা সময় ওরা কেন্দ্রের পাশেই ছিল। এক সময় অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে বেরিয়ে আসল অর্নি। ওরা জিজ্ঞেস করায় বলল পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। এরপর ওরা তিনজন মিলে প্রথমে রেস্টুরেন্টে গেল। সেখানে খাওয়াদাওয়া করে এরপর গেল টিকেট কাটতে। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ওদের বিকেল হয়ে গেল।

বাড়িতে ফিরেই অবনী গোছগাছ শুরু করল। নাজমা আক্তার শুরু করলেন রান্না। ছেলেদের জন্য তিনি তিন ধরনের মাংস রান্না করলেন। আরও কিছু রান্না করতে চাইলে সাদাফ নিষেধ করল।

রাত সাড়ে এগারোটায় ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে বিশ মিনিট লাগবে। ওদেরকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে ইসহাক আজাদ এবং ওয়াহাব আহমেদ দুই ভাই-ই গেলেন।

***

সকাল দশটার দিকে অবনীকে হোস্টেলের সামনে নামিয়ে দিল সাদাফ। একে একে ওর ব্যাগগুলো সিএনজি থেকে নামিয়ে গেটের সামনে রাখল। ওরা আরও আগেই পৌঁছাত। কিন্তু পথিমধ্যে গাড়িতে সমস্যা দেখা দেয়ায় তিন ঘণ্টা লেট হয়েছে পৌঁছাতে। অবনী একজনকে ডেকে ব্যাগগুলো ভেতরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। সাদাফ সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দিল৷

” ভাইয়া, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি তরকারিগুলো গরম করে নিয়ে আসছি। নয়তো তুমি হোস্টেলে পৌঁছে দেখবে সব নষ্ট হয়ে গেছে। ”

” গরম করবি কিভাবে? রান্নার ব্যবস্থা আছে তোদের? ”

” তুমি জানোনা, ব্যবস্থা থাকেনা করে নিতে হয়? আমরাও ব্যবস্থা করে নিয়েছি। তুমি দশ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি আসছি। ”

” তুই শুধু আমার খাবার গরম করে নিয়ে আয়। ভাইয়া এসে নিজের খাবার নিয়ে যাবে৷ এখন গেলে ভাইয়াকে পাবোনা। ”

” আচ্ছা। ”

অবনী রুমে গিয়ে সবগুলো তরকারি গরম করল। ইশরাকের ভাগেরটা রেখে সাদাফের গুলো নিয়ে বাহিরে আসল৷

” এই নাও। রুমে গিয়ে বক্স থেকে বের করে রেখ। নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। আর আমি ফোন করলে চলে এস। তোমাদের জন্য রান্না করে রাখব। ”

” তুই অযথা ঝামেলা করতে যাবি কেন? আগে যা করেছিস ঠিক আছে। সামনে তোর পরীক্ষা। রান্নার চিন্তা না করে পড়ায় মন দে৷ ”

” পড়ার চিন্তা আমার আছে। তুমি নিজের চিন্তা কর। আর দেরি করোনা, হোস্টেলে যাও। সারারাত ঘুমাতে পারোনি। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে লম্বা একটা ঘুম দাও। ”

” তোর এ বেলায় আর ঘুম হবেনা। ক্লাস আছে বোধহয়? বিকেলে ঘুমিয়ে নিস। নয়তো শরীর খারাপ হবে। নিজের খেয়াল রাখিস। আর ভাইয়া আসলে তাকে দেরি করাসনা। ”

” আচ্ছা, আচ্ছা। ”

সাদাফ চলে গেলে অবনীও রুমে চলে যায়। অবনী লক্ষ্য করলনা মাহি নামের ওর সিনিয়র সেই ছেলেটি এতক্ষণ ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার চোখে ছিল ঘৃণা আর রাগ।

চলবে…