#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |১৯|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধীরে ধীরে পথ পেরুচ্ছে অদিতি-ধ্রুবর বাস! অদিতির পাশে ধ্রুব বসে; মোবাইল দেখছে! মোবাইল দেখছে কথাটা ভুল অবশ্য; ওর স্থির দৃষ্টি ঘুরেফিরে বারবার আটকে যাচ্ছিল অদিতির দিকে। অদিতি চুপ করে অস্বস্তি নিয়ে জানালার বাইরে চেয়ে আছে, ভুলেও ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছে না। ওর খোলা চুল উড়ে ধ্রুবর মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ছিল বারবার। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে অদিতির উড়ে আসা চুল মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে কিছু বলবে ভাবলো।অথচ হঠাৎ অদিতির মলিন—বিমুগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে ও যেন থমকে গেল! অদিতির চুল উড়ছে; বাতাসের ঝাপটায় ওড়নাও উড়ছে; অথচ ওর মধ্যে নিজেকে গোছানোর কোনো তাড়া নেই; অস্থিরতা নেই। ও জানালার দিকে অপলক চেয়ে আছে; মাঝেমধ্যে কি যেন চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে। ধ্রুবর হঠাৎ কী হলো; সে ফোনটা নিয়ে আলগোছে-বড্ড নিঃশব্দে অদিতির একটা ছবি ক্যামেরা দিয়ে তুলে নিল। তারপর আবার ক্যামেরা কোলের উপর রেখে; দেখে যেতে লাগলো সামনে বসে থাকা মলিন অথচ সুন্দর মেয়েটির দিকে।
বাস স্টেশনে পৌঁছাতে আরো দু-ঘণ্টা। বাসের ঝাকুনিতে দুজনের অবস্থায় করুন। অদিতির এসব রাস্তায় চলাফেরা করার অভ্যাস থাকলেও; ধ্রুব এসবে নতুন। অদিতি কষ্ট পাবে দেখে ও এতক্ষণ চুপ করে সব সইছিলো। একপর্যায়ে বাস এমন জোরে ব্রেক কষলো; অদিতি ছিটকে পরলো সামনের সিটে! মাথাটায় ব্যথা পাবে; তার আগেই ধ্রুব দ্রুত হাত দিয়ে ধরে ফেলল ওকে। অদিতি নিজেকে ঠিক করে উঠে ভালোভাবে বসলো; ধ্রুব ওর মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললো——-‘ঠিক আছো?’
অদিতি নিচু গলায় জবাব দিল——‘হু!’
ধ্রুবর পিঠ ব্যথা করছিল! ও সিটে হেলান দিতেই সিট পেছনের সিকে ঝুঁকে গেল। সঙ্গেসঙ্গে পেছনের লোকটা খেঁকিয়ে উঠল; ——‘এই মিয়া; সিট ঠিক করেন আপনের।’
আচমকা চেঁচিয়ে উঠায় ধ্রুব ভারি বিরক্ত হয়ে পেছনের দিকে উকি দিল; একটা মাঝবয়সী লোক বসে আছে।নিজে নিজের সিট পেছনে অনেকটাই হেলিয়ে রেখেছে; অথচ ধ্রুবর বেলায় চেঁচালো। ধ্রুবর দিকে এমনভাবে চেয়ে আছে- যেন ধ্রুবকে এখানেই মাইর লাগাবে। ধ্রুব ওই চাউনি দেখে একটা রাগান্নিত দৃষ্টি ছুঁড়লো; হাতের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে লোকটাকে দেখে দাঁত খিঁচিয়ে বলল ——‘কি বলছিলেন আপনি যেন?’
ধ্রুবর হাতের ম্যাসাল; আর ওর চোখের রাগ দেখে হয়তোবা লোকটা ভয় পেয়েছে। ওমনি মিনমিন করে অন্যদিকে চেয়ে বিড়বিড় করলো——‘মাইয়া নিয়ে বাসে উঠে মস্তানি দেখাইতেসে।’
ধ্রুবর কানে কথাটা গেল; ওর রাগ এবার চিরিক দিয়ে মাথায় উঠে গেল। ও উঠে দাঁড়াতে চাইল ——-‘মাইয়া মানে? কি বোঝাতে—-‘
লোকটা আচমকা ধ্রুবর এমন রূপে এবার ভয় পেয়ে সেটিয়ে গেল একপ্রকার। ধ্রুব তেড়ে উঠতে চাইলে; ওর হাত দ্রুততার সঙ্গে চেপে ধরে অদিতি। ধ্রুব ওর হাতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অদিতির দিকে চায়। অদিতি চোখের ইশারায় ওকে থামতে বলছে। ধ্রুব ওই করুন দৃষ্টি দেখে চোখ বুজে জোরে শ্বাস ছেড়ে আবার জায়গায় বসে গেল।
অদিতি ধ্রুবর হাত ছেড়ে দিলো। ওর মাথাটা নিচু করে;আস্তে করে বললো——-‘আমাদের গ্রামের লোক একটু অন্যরকম। ওরা এভাবে বলে; এটা নিয়ে মারামারি করে লাভ নেই।’
ধ্রুব রাগে কাপছিলো! অদিতির সম্পর্কে বাজে বলাটা ও একদমই নিতে পারেনি।নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে: ধ্রুব অদিতির দিকে একটু ফিরে; শাসিয়ে বললো——-‘লোকটার বাড়ি তুমি আমায় চেনাবে; পরে দেখবো এটারে।’
অদিতির ঘুম পাচ্ছিলো! ও বাসের সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল; একপর্যায়ে ঘুমিয়েও গেল। ধ্রুব দেখে সেসব! অদিতির মাথা বারবার সিট থেকে হেলে পরে যাচ্ছিল। ধ্রুবর কী হচ্ছে আজ কে জানে! বারবার অদিতির দিকে চেয়ে থাকছে; ছুঁতে ইচ্ছে করছে; মেয়েটার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। অদিতি আজ প্রথমবার; এতটা পাশে আছে বলেই কি আজ ওর চাওয়াগুলো বেপরোয়া হচ্ছে?
ধ্রুব নিজেকে আশকারা দিল। ধীরে হাত বাড়িয়ে অদিতির মাথাটা নিজের কাঁধে হেলিয়ে দিলো! ঘুমের ঘোরে অদিতি ধ্রুবর কাঁধে নাক গুঁজে দিলো। এমনটা করার সাথেসাথে ধ্রুবর শ্বাস যেন আটকে এলো! ও ঢোক গিলে, ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের কাঁধের উপর পরে থাকা অদিতির দিকে তাকালো! অদিতি হুশে নেই। ধ্রুব ঢোক গিলে আবার সোজা হয়ে বসলো; ওর লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে।
তারপর যখন অদিতি ঘুমের ঘোরে ওর বাহু জড়িয়ে ধরলো। ধ্রুবর বুকের ধুকপুকানি যেন এবার লাগাম ছাড়লো।কোনো মেয়ে আজ-অব্দি ওর এতটা কাছে কোনোদিন আসেনি। ধ্রুবর কাছে এই ছোঁয়া নতুন! ধ্রুব এবার ঢোক গিলে, ওর কেমন একটা লাগছে। ও ধীরে ধীরে মাথাটা ঘুরিয়ে অদিতির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাল! অদিতি যেন আজ বড্ড নিশ্চিন্ত; ভীষণ আরাম করে ঘুমুচ্ছে। ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে দেখে গেল পুরোটাক্ষণ! তারপর আলগোছে অদিতির মাথা সেভাবেই রেখে দিল নিজের কাঁধে পুরোটা রাস্তা!
–
বাস লক্ষ্মীপুর পৌঁছেছে! ধ্রুবও ঘুমিয়ে পরেছিলো অদিতির মাথায় নিজের মাথা হেলিয়ে।বাসের মধ্যে শোরগোল শুনে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে দেখলো আশেপাশটা। অদিতি ওর কাঁধে তখনও মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। ধ্রুব সোজা হলো: ওকে ডাকল——‘অদিতি, গেট আপ! আমরা পৌঁছে গেছি।’
অদিতি একটা পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ ডাক শুনে নিভুনিভু চোখে তাকালো।! ওর মুখ প্রায় ছুঁইছুঁই ধ্রুবর মুখের সঙ্গে! ঘুমের রেশ কেটে, পুরো ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ছিটকে সরে গেল ও। দ্রুত ওড়না ঠিক করে অপ্রস্তুত গলায় বলতে চাইল——-‘আমি- আমি কখন আপনার..’
ধ্রুব কি উত্তর দিবে? ও অদিতিকে টেনে এনেছে নিজের কাঁধে বললে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে। ধ্রুব কিছুটা দোনামোনা করে বললো——-‘তুমি ঘুমের ঘোরে এসেছিলে; আমি আনিনি।’
অদিতি শুনলো। উঁকি দিয়ে আশেপাশটা দেখলো। সবাই ব্যাগ নিয়ে নেমে যাচ্ছে। ধ্রুব নিজের ব্যাগ গুছিয়ে, শার্ট টেনেটুনে উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে; মাথায় ক্যাপ পরে নিলো। তারপর অদিতির ধ্রুব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো ——‘দাও।’
অদিতি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে তাকাল! ধ্রুব কি ওকে হাত ধরার জন্যে বলছে? অদিতি অস্বস্তি নিয়ে আশেপাশে তাকালো ; এই বাসে অনেকেই হয়তো ওকে চিনতে পারে। অদিতি এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো——-‘এসব কি করছেন? আমি হাত ধরতে পারবনা।’
‘গিভ মি ইয়োর ব্যাগ।’———অদিতির কথা শেষ হওয়ার আগেই ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বললো!
অদিতি এবার ভীষণ লজ্জায় পরে গেল। ও এসব কি ভাবছিল? অথচ ধ্রুবর মনে সেসব কিছুই ছিল না। অদিতি ওর ব্যাগ নিজেই হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো; বললো ——‘আমি নিতে পারব। আপনি আগে আগে যান প্লিজ, কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
ধ্রুব অদিতির কথা শুনে আশেপাশে তাকাল! মানুষজনের ভিড় দেখে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো——‘চলো।’
বলে অদিতির বিপদের কথা ভেবে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। অদিতি ধ্রুবর থেকে দূরত্ব রেখে বাস থেকে নামলো। ধ্রুব বাস থেকে নেমে হাত মুচড়ে স্ট্রেচিং করছিল। অদিতি সেটা দেখে নিচু গলায় বললো——-‘রাস্তাটা ভালো না এদিকের। অনেকবার চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছিলো, লাভ হয়নি।’
ওর কথা শুনে ধ্রুব স্ট্রেচিং থামিয়ে সঙ্গেসঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল; বললো——‘ডোন্ট ওরি; আ’ম ফাইন।’
অদিতি বোঝে: ধ্রুব কখনোই ওর অসুবিধা প্রকাশ করবে না অদিতির সামনে।ওরা দাড়িয়ে থাকে। ধ্রুব একটুপর বললো——‘তোমাকে নিতে কেউ আসেনি?’
অদিতি খুঁজছে আশেপাশে কাউকে; বললো ——-‘আব্বা আসবেন।’
ধ্রুব নিজেও তাকালো আশেপাশে। অদিতির বাবা দেখতে কেমন; সেটা ওরও জানা দরকার। লোকটার কিসের এত অহংকার; গৌরবের বাহাদুরি; জানা লাগবে। হঠাৎ অদূরে নিজের বাবাকে দেখতে পেয়েই আটকে গেল অদিতি।ভয়ে ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো —‘সরে দাঁড়ান; আব্বা আসছেন।’
ধ্রুব আচমকা ধাক্কায় কয়েক পা পিছিয়ে অবাক চোখে অদিতির দিকে তাকাল! অদিতির চোখ-মুখ ভয়ে আতঙ্ক। একবার বাবাকে দেখছে তো আরেকবার ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছে।
পাঞ্জাবি গায়ে তোফাজ্জল মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। ধ্রুব তোফাজ্জলের সঙ্গে অদিতিকে দেখে বুঝতে পারল—এই সেই বিখ্যাত প্রেমের বিচারক। ও ভ্রু কুঁচকে চাইল; আগাগোড়া লক্ষ্য করতে থাকলো তোফাজ্জলকে। দেখেই মনে হচ্ছে ভীষণ রাগী এক মানুষ! ধ্রুব কিছুটা দূর থেকেই দেখছিল বাপ-মেয়েকে। তোফাজ্জল মেয়ের ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে বললেন——‘পথে অসুবিধা হয়েছে?’
অদিতি আড়চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে, সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ঘুরিয়ে তোফাজ্জলের দিকে চেয়ে জবাব দিল——‘না।’
তোফাজ্জল মেয়ের ব্যাগ নিয়ে নিলেন কাঁধে; গমগমে স্বরে বললেন——‘বাড়ি চলো।’
অদিতি বাবার পেছনে পেছনে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। স্টেশন ছাড়ার আগে একবার পেছন ঘুরে মলিন চোখে ধ্রুবকে দেখলো। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে চেয়ে ছিলো! দুজনের চোখে চোখ মিললো। একজনের চোখে ছিলো— প্রেমের ব্যর্থতা তো অন্যজনের চোখে চাপা রাগ। অদিতি মলিন চোখে চেয়ে, আবার বাবার দিকে ফিরে হেঁটে গেল।
___________
অদিতি যেতেই ধ্রুব ক্যাপ খুলে ফেলল! ওর মাথায় চড়ে গেভে কিছু একটা। তোফাজ্জল অদিতির বাবা না হলে এতক্ষণে….
ধ্রুব নিজের রাগ কন্ট্রোল করলো।ও পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে। স্টেশন ছেড়ে ও হাতে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে চলে গেছে সোজা অদিতির বাড়ির সামনে। ছোটখাটো একটা ইটের তৈরি বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট একটা উঠোন; উঠোনে হরেক রকম শাকসবজি লাগানো হয়েছে। উঠোনের একপাশে একটা ছোট্ট পুকুর। ধ্রুব বাড়ির বাইরে থেকেই সেসবের ছবি তুলল একটা। তখন তোফাজ্জল উঠোনে বসে পেপার পড়ছিলেন। একটা অচেনা ছেলেকে উনার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ির ভেতর থেকে ডাকলেন——-‘অ্যাই ছেলে, এদিকে আসো!’
ধ্রুব ক্যামেরা বন্ধ করে এগিয়ে গেলো। তোফাজ্জলের সামনে দাঁড়াতেই তিনি ধ্রুবকে আগাগোড়া ভালোভাবে দেখে নিলেন। যুবক ছেলে; চোখে সানগ্লাস; পিঠে ঝুলানো বাদামি রঙের ব্যাগ। দেখে তো শহুরে ছেলে মনে হচ্ছে। তোফাজ্জল বললেন——‘কোথা থেকে আসছো তুমি? গ্রামে নতুন লাগছে।’
ধ্রুব সানগ্লাস খুলে শার্টে ঝুলিয়ে; শান্ত স্বরে জবাব দিল—‘বরিশাল থেকে এসেছি; এই গ্রামে প্রজেক্টের কাজে।”
‘প্রজেক্ট? গ্রামে কিসের প্রজেক্ট?’— তোফাজ্জল নিজের স্বভাবতই সন্দেহ করলেন।
ধ্রুবর কাছে মিথ্যা তৈরি করাই ছিলো। ও নিজের ক্যামেরা দেখিয়ে বলল——‘আমি ফটোগ্রাফি করি! এই গ্রামে আমাকে আমার কোম্পানি থেকে পাঠিয়েছে; শুটের জন্য।’
তোফাজ্জল ভ্রু বাঁকিয়ে; হাত এগিয়ে বললেন——‘দেখি তোমার ক্যামেরা দাও তো, কী ছবি তুলো দেখি।’
ধ্রুব এবার কিছুটা থমকালো। ক্যামেরার প্রথম ছবিটাতেই অদিতি! বাসে তুলেছিল ও। ধ্রুব তোফাজ্জলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো; বোঝার চেষ্টা করল উনার মনের মতিগতি। বোঝা গেল; তোফাজ্জল ক্যামেরা নিয়েই ছাড়বেন। অন্যকেউ হলে; হয়তবা ধ্রুব সোজা মুখের উপর মানা করে দিতো। কিন্তু এখানে তোফাজ্জল দাঁড়িয়ে আছেন। উনার সঙ্গে ধ্রুবর প্রতিটা কথা; আচরণ সবকিছুর উপর নির্ভর করছে ধ্রুবর সঙ্গে অদিতির সম্পর্ক! ধ্রুব চুপচাপ ক্যামেরা এগিয়ে দিল।
তোফাজ্জল মাত্র দুটো ছবি দেখলেন; বাকি আর ঘাঁটালেন না। ক্যামেরা ফিরিয়ে দিলেন। ধ্রুব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। তোফাজ্জল বললেন——‘গ্রামে কার বাড়িতে থাকবে?’
ধ্রুবর কাছে জবাব তৈরি ছিলো——‘এখনো ডিসাইড করিনি। কাজ সবে শুরু হয়েছে। এখানে কোনো হোটেল পাওয়া যাবে?’
ওদের কথা বলার ফাঁকে অদিতি চুলে গামছা পেঁচিয়ে উঠানে এসেছে কাপড় মেলে দিতে। ধ্রুবকে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেখে অদিতি সেখানেই থমকে গেল। ধ্রুবরও তখন চোখ গেল অদিতির দিকে। ভেজা মুখ; গামছা পেঁচানো চুল; ওই মুখের উপর লেপ্টে থাকা ভিজে বেবি হেয়ারগুলো; আর হাতে বালতি। অদিতিকে লাগছিল পাক্কা গৃহিণী; শুধু শাড়িটাই মিসিং।ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে দেখে যেতেই লাগল ওই গোলগাল মুখের সৌন্দর্য্যটুকু।
তোফাজ্জল ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললেন——‘গ্রামে হোটেল খুঁজতে এসেছো? জীবনে গ্রাম দেখোনি?’
ধ্রুব তাৎক্ষণিক ধ্যান ভেঙ্গে গেল। ও দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললো অদিতির থেকে; গলা কেশে তাকাল তোফাজ্জলের দিকে। অদিতিও দ্রুত কাপড়ের বালতি উঠোনে রেখেই দৌঁড়ে আবার ভেতরে চলে গেল।
অথচ ভেতরে গেলেও, পর্দার ফাঁক গলিয়ে দেখতে লাগল ধ্রুবকে। ধ্রুবকে এভাবে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর হাত-পা কাঁপছে রীতিমত।ওখানে কী হচ্ছে কে জানে? বলা যায় না; এই ছেলে আদৌ কী বুঝতে পারবে অদিতির সমস্যাগুলো; ওর ভয়গুলো? যা গোঁয়ার ছেলে।যে কখনও কারো ধার ধারেনি; সে আজ তোফাজ্জলের কাটছাঁট কথা আদৌ সহ্য করবে কিনা কে জানে। অদিতি পর্দার আড়ালে মুখ লুকিয়ে দেখতে থাকলো শুধু।
ধ্রুব তোফাজ্জলের কথা জবাব দিল——‘শহরে বড় হয়েছি আমি! গ্রাম সম্পর্কে এক্সাক্টলি তেমন ধারণা নেই। যদি থাকার জায়গা না থাকে তবে রাতটা আজকে স্টেশনেই কাটিয়ে দিতে হবে মেবি।’
তোফাজ্জল ভাবলেন- একটা শহরের ছেলে স্টেশনে রাত কাটালে এটা গ্রামেরই বদনাম; উনার মেহমানদারির বদনাম। তাই তিনি পরে বললেন———‘স্টেশন কোনো থাকার জায়গা না। আমার বাংলো বাড়িতে থাকতে পারো কদিন; যদি আমার প্রস্তাব ভালো না লাগে, তবে রাতের বাস ধরে বাড়ি চলে যাও।’
ধ্রুবর চোখ-মুখ শান্ত! অথচ ভেতরে ভেতরে সে এসবই আশা করেছিল; সবকিছু প্ল্যানমাফিক চলছে। ও কাঁধের ব্যাগের ফিতে ধরে বলল—-‘আমার প্রবলেম নেই। খাবার আমি এখানেই কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেব।”
‘রেস্টুরেন্ট?’— তোফাজ্জল ভ্রু কুঁচকালেন।
ধ্রুব এবার কিছুটা হতাশ হয়ে বলল——‘গ্রামে হোটেল থাকে না; কিন্তু ছোট ধাবা থাকে শুনেছি। এখানে কি সেটাও নেই?’
তোফাজ্জল ধ্রুবর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলেন- এই ছেলে জীবনেও গ্রাম দেখেনি। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন——‘এখানে ধাবা নেই। ছোট ছোট দোকান আছে, যেখানে শুধু চা পাওয়া যায়। চা খেয়ে জীবন চললে, চা-ই খেতে পারো, নাহলে আমার এখানে খাবার খাওয়া যাবে।’
ধ্রুব মনেমনে হাসে! এই লোক ভারি অদ্ভুত! হেল্প করছেন; অথচ কথার মধ্যে কোনো নরম ভাব নেই। সবকিছুর মধ্যে একটা রাগি-ঘাড়ত্যাড়া ভাব। ভালো হয়েছে। জামাই-শ্বশুর ভালো জমবে—-দুজনের রাগ-ই তুঙ্গে থাকে সবসময়ই; এবং দুজনেই ঘাড়-ত্যাড়া। ওদের দুজনের জিন ধ্রুব-অদিতির বাচ্চাও পেয়ে গেলেও পেয়ে যেতে পারে।
ধ্রুব বললো——‘থ্যাংকস! আপনি চাইলে এসবের জন্যে আমি পে করতে পারি আপনাকে।’
তোফাজ্জল এবার মহা বিরক্ত হলেন; বললেন——‘ টাকা পয়সার হিসেব দেখানোর দরকার নেই। যাও গোসল করে খেতে আসো। পুকুর ওপাশে আছে; ঘরে গোসলের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই।”
ধ্রুব পুকুরটার দিকে একবার চেয়ে তারপর তোফাজ্জলের দিকে তাকালো। জবাব দিল——‘ওকে।’
তোফাজ্জল আর কথা বাড়ালেন না। পরপর চেয়ার থেকে পেপার নিয়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। তাকে ঘরের দিকে আসতে দেখে অদিতি দ্রুত পর্দার আড়াল থেকে সরে গেল। তোফাজ্জল দেখার আগেই দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ধ্রুব ওর বাড়িতেই থাকবে—অদিতির মন কু ডাকছে। ধ্রুবর ব্যাপারে বাবা জানলে সবার সামনে ওকে অপমান করবেন; ও এসব সহ্য করতে পারবে না একদমই। কেলেঙ্কারী ঘটবে দুজনের মধ্যেই; দুজনেরই যা অসম্ভব রাগ।
ধ্রুব হাতে টাওয়াল নিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। শহুরে জীবন থেকে এতটা দূরে এসে গ্রামের পুকুরে গোসল— ব্যাপারটা তার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। গায়ে শুধুমাত্র প্যান্ট রেখে পুকুরে নেমে পরলো। সাঁতার কেটে; ডুব দিয়ে উঠল।গোসল শেষে ভিজে গায়ে শার্ট-প্যান্ট পরে নিল। বাড়িতে থাকলে হয়তো খালি গায়েই প্যান্ট পরেই বের হয়ে যেত বাথরুম থেকে। কিন্তু এটা আরেকজনের বাড়ি! অনেকেই হাঁটচলা করে উঠোনে। তাছাড়া অদিতি আছে; ধ্রুব ওকে অপ্রস্তুত করতে চায়না।
ধ্রুব টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ ও থমকে দাঁড়াল। অদিতি উঠানে দাঁড়িয়ে কাপড় মেলে দিচ্ছে; ধ্রুবকে দেখেই অদিতির হাত কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। ও আশেপাশে তাকাল; কেউ কি দেখে নিচ্ছে?
ধ্রুব ভেজা গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওর কাছে এগিয়ে গেল। অদিতি তাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো; বললো——‘কেউ দেখবে; ভেতরে যান প্লিজ।’
ধ্রুব আশেপাশে তাকাল; কেউ নেই আশেপাশে। তোফাজ্জল বাইরে গেছেন। ধ্রুব অদিতির দিকে ঝুঁকে এসে আশপাশটা সতর্ক চোখে চেয়ে দেখতে দেখতে বলল ——‘তোমার বাবা আসলেই বড্ড কড়া। তুমি সত্যি তোমার বাবার মেয়ে তো?’
ধ্রুব এবার অদিতির দিকে মাথাটা নিচু করে তাকালো; ফিসফিস করে বললো——-‘ডাউট হচ্ছে আমার।’
অদিতি ভ্রু কুঁচকে ধ্রুবর দিকে মাথা তুলে তাকাল! ধ্রুব ওর দিকে আর একবারেও তাকাল না; যা বলার বলা শেষে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সেভাবেই বাড়ির সোজা সামনের বাংলোতে ঢুকে গেলো। অদিতি কিছুক্ষণ সেভাবেই চেয়ে; হঠাৎ করে হেসে ফেলল! ধ্রুব ওর আশেপাশে থাকছে; ব্যাপারটা ওকে হয়তো আনন্দই দিচ্ছে।
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |২০|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
দুপুরে তখন গোসল করে এসে ধ্রুব মাত্রই রুমে এসেছে। ছোট একটা রুম; রুমের একপাশে একটা পড়ার টেবিল, অন্যপাশে দুজনের জন্য একটি বেড। বেডের পাশে একটি ছোট টেবিল, যেখানে পানির কলস আর গ্লাস রাখা। ধ্রুব কখনোই এত ছোট রুমে থাকতে অভ্যস্ত নয়। বোঝাই যাচ্ছে, ওকে এখানে যতটুকু যত্ন করা দরকার; সেটুকুই করা হবে। এক্ষুনি জামাই আদর চাওয়াটা ধ্রুবর বোকামি! ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।
সারাদিনের জার্নিতে ধ্রুবর পুরো শরীর ব্যথা হয়ে গেছে। তারমধ্যে রাস্তার দুরবস্থা যেন আরেক বিপদ; পুরো শরীরের হাড্ডি-মাংস একদম এক করে ছেড়েছে। ধ্রুব ময়লা শার্ট খুলে পাল্টাচ্ছিল। চেয়ারের উপর টিশার্ট রাখা ছিল। খালি গায়ে ওদিকে যাওয়ার সময় হুট করে ঘরের দরজা খুলে গেল।ধ্রুব টিশার্ট হাতে পেছন ফিরে চাইলো; অদিতি এসেছে! বারবার পেছনের দিকে দেখে; ভীতস্বতন্ত্র মুখটা ঘোমটার আড়ালে ঢেকে, চোরের মতো ঘরে ঢুকে পড়ল!
ধ্রুব টিশার্ট হাতে দেখছিল অদিতিকে; ও বলল ——‘তুমি এখানে? কেউ দেখে নিলে—‘
অদিতি মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে ফেলল! তারপর দুজনেই একে অপরের দিকে তাকালো! অদিতি ধ্রুবকে খালি গায়ে এই প্রথম দেখামাত্রই ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুহূর্তেই। দ্রুত ও মুখ চেপে পেছনে ঘুরে গেল!
অদিতিকে পেছন ঘুরতে দেখে ধ্রুব নিজের শরীরের দিকে একবার চেয়ে দেখল— সে খালি গায়ে, শুধু প্যান্ট পরা। অদিতি অপ্রস্তুত হয়ে পরেছে; ধ্রুব সেটা বুঝে দ্রুত তাড়াহুড়ো করে টিশার্ট গায়ে দিতে লাগল।
অদিতির বুক কাঁপছে; এমন পরিস্থিতিতে সে জীবনে প্রথমবার পড়েছে।কোনো পরপুরুষকে এভাবে ও দেখেনি আজ অব্দি; অদিতি চোখ খিঁচে ফেলেছে দ্রুতই।ধ্রুব টিশার্ট পরতে পরতে কাচুমাচু গলায় বলতে লাগলো——–‘নক করে আসা উচিত ছিল, আই গেইজ”
অদিতি পেছন ফিরে থাকা অবস্থায় অপ্রস্তুত গলায় বলল——‘সরি, আমি বুঝি—”
ধ্রুবর টিশার্ট পরা শেষ! ও কথা মাঝপথে থামিয়ে বলল—-‘ন্যাকামি না করে পেছনে ঘুরো। আমি টিশার্ট পরে নিয়েছি।’
অদিতি ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকাল, কিন্তু লজ্জায় মুখ তুলে ধ্রুবর দিকে তাকাতে পারলো না। অন্যদিকে চেয়ে আছে দেখে ধ্রুব বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো——‘কি বলতে এসেছিলে?’
অদিতি এবার তাকাল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর রুমটা একবার দেখে নিল। এমন একটা স্যাতস্যাতে ঘরে ধ্রুব থাকছে শুধুমাত্র ওর জন্যে; অদিতিকে ব্যাপারটা অপরাধবোধে ফেলে দিচ্ছে বারবার। অদিতি কথা তুলল; বড্ড অনুনয় করে বললো——-‘ধ্রুব;আপনি এসবে অভ্যস্ত নন।কেন এমন করছেন? চলে যান; কিচ্ছু হবে না এসবে।’
ধ্রুব শুনে; অদিতির দিকে পিঠ দিয়ে আছে ও। অদিতির ওসব কথা পাত্তা না দিয়ে ব্যাগ থেকে প্যান্ট বের করতে করতে উদাস ভঙ্গিতে বলল—-‘তুমি এখন এই চোরের মতো আমার ঘরে এসব বলতে এসেছো?’
অদিতি লজ্জা পেয়ে ওরনা ঠিক করে; ধ্রুবর পিঠের দিকে তাকালো। ধ্রুবও প্যান্ট হাতে ওর দিকে ফিরে তাকাল; ওর চোখ ভীষণ শান্ত-স্বাভাবিক! অদিতি ওই চোখের দিকে চেয়ে এবার কাতর কণ্ঠে বললো——-‘আপনি চলে যান, ধ্রুব। আপনার সঙ্গে সামনে কী হবে, সেটা ভেবেই আমি দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। এসব এত সহজ নয়।”
ধ্রুব এবার বিরক্ত হলো; বললো———‘তুমি আমাকে বারবার চলে যেতে বলছো;অথচ তুমি নিজেও চাওনা আমি এখান থেকে তোমাকে না নিয়ে চলে যাই।সবসময় মুখে এক; মনে এক তোমার। আ’ম রিয়েলি টায়ার্ড নাও; অদিতি।’
অদিতির গলা কেপে উঠল; ও ধ্রুবর চোখে চোখ রেখে কেন মিথ্যা বলতে পারেনা? কেন ধ্রুব সবসময় ওর মুখে না বলা কথা বুঝে ফেলে?অদিতি অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আবারও মিথ্যা বললো——‘আপনি ভুল ভাবছেন; আমি মন থেকেই চাই আপনি চলে যান।’
ধ্রুব মাথাটা কাত করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো! পরপর ভেজা কাপড় বিছানাতে ছুড়ে ফেলে রেখে এগিয়ে আসতে লাগল অদিতির দিকে। ও অনেকটাই কাছে আসতেই অদিতি ওর দিকে চেয়ে পিছু হটে গেল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ধ্রুবর দিকে তাকাল ও। ধ্রুব মাথাটা ঝুঁকে ওর চোখে চোখ রেখে খেয়ে বলল——‘আবারও মিথ্যা; বারবার যে এত মিথ্যা বলো, তুমি হাঁপিয়ে যাও না তোফাজ্জল হায়াতের মেয়ে?’
অদিতি চোখ নামিয়ে ফেলল; আবারও ধরা পরে গেছে! ধ্রুব ওকে ঘাটালো না। ওর মনের উপর জোর দেখালো না। বরং বড্ড শান্ত-নরম গলায় বোঝালো——-‘আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা না করে নিজের জন্য করো। ভরদুপুরে এক নওজোয়ান ছেলের ঘরে একা একা এসেছো। তোমার প্রেমবিরোধী বাবা জানলে তো…”
ধ্রুব গলায় হাত দিয়ে মে/রে ফেলার ভঙ্গি করল। অদিতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো; ধ্রুবর মজা করা ওর একটুও ভালো লাগেনি। ধ্রুব অদিতির নাকের ডগায় তাজা-তাজা রাগ দেখে মৃদু হেসে ওর নাকে আলতোভাবে আঙুল ছুঁইয়ে বললো—-‘ডোন্ট ওরি।অ্যাই উইল বি ফাইন।’
অদিতি নাকে হাত চেপে ধরল! নাকটা যেন লাল হয়ে গেছে ওর। ধ্রুব নিজের মতো করেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। সে বাইরে যেতেই অদিতি দ্রুত ঘোমটা টেনে মাথা ও মুখ ঢেকে নিল। নিচে নেমে একবার দেখে নিলো; কেউ আছে কিনা। কেউ নেই দেখে এক দৌঁড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল।
__________
দুপুরে সবাই খেতে বসেছে। ধ্রুবর পাশে বসেছে অদিতির ছোট ভাই, ইফাজ। তোফাজ্জল সাহেব ছেলের মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছেন। ধ্রুব খেতে বসে খাবারের আইটেম দেখে কিছুটা বিরক্ত হলো। সবজির আধিক্য শুধু! একটা মাছের তরকারি আছে; অথচ ধ্রুব মাছ পছন্দ করেনা। ও মুখ কুঁচকে ফেলেছিল। পরপর স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে খেতে বসলো।
ধ্রুব সবজি পাতে তুলবে; তার আগেই অদিতির মা ফাহিমা ভুনা মাংসের একটা বাটি রান্নাঘর থেকে এনে ধ্রুবকে দিলেন। ধ্রুবর হাতে সবজির চামচ; ও অবাক হয়ে ফাহিমার দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহিমা হেসে বললেন——‘তুমি শহর থেকে এসেছো, এই সবজি-মাছ হয়তো তেমন খেতে পারবে না। এটা নাও; আমার বড় মেয়ে বানিয়েছে।”
‘বড় মেয়ে’ মানে তো অদিতি! ধ্রুব বাটির দিকে তাকিয়ে; হঠাৎ আরও এক দফা ওই মেয়েটার প্রেমে পরলো! ইচ্ছে করছিল তখন; ছুটে গিয়ে ওই মুগ্ধ মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে। ও নিজের অনুভূতির দা/বানল সামনে ফাহিমার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল—-‘থ্যাংক ইউ, আন্টি।’
ধ্রুব মাংস দিয়ে খেতে খেতে বারবার অদিতির কথা মনে করছিল। অদিতি লক্ষ্য করেছে সব; ও জানে ধ্রুব এসব খেতে অভ্যস্ত নয়। তাই নিজের হাতে মাংস রান্না করেছে। ধ্রুবর হৃদয় প্রশান্তিতে ভরে উঠল।
তোফাজ্জল সবার আগে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলে ইফাজ বাবার যাওয়ার দিকে চেয়ে হাফ ছাড়লো! সঙ্গেসঙ্গে ধ্রুবর বাহুর শার্ট চেপে ধরে বলল——-‘ভাইয়া; তোমার নাকি ক্যামেরা আছে?”
ধ্রুব খাওয়া থামিয়ে ইফাজের দিকে তাকালো! বলল——-‘হ্যাঁ, আমি ফটোগ্রাফি করি।’
ইফাজ চোরের ন্যায় আশপাশটা সতর্ক চোখে দেখে নিয়ে ধ্রুবর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল——‘আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যাবে? আমি তোমাকে একদম বিরক্ত করব না। শুধু তোমার ছবি তোলা দেখব।”
ধ্রুব ইফাজের বাচ্চা-বাচ্চা কথা শুনে মাথা নাড়লো; মৃদু কণ্ঠে বলল—-‘ঠিক আছে; নেব। আগে খাওয়া শেষ করো।”
ইফাজ খুশিতে ঝটপট খাওয়া শেষ করতে লাগল।
____________
ধ্রুব গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটছিল। ইফাজ পাশ দিয়ে খুশিতে দুলতে দুলতে হাঁটছিল। ধ্রুব ক্যামেরা হাতে ছোটোখাটো ছবি তুলছিল।ধ্রুব ফোকাস করছিল ক্যামেরা; ইফাজ তখব ধ্রুবর আঙ্গুল চেপে ধরে বললো——‘ভাইয়া; ছবি-গুলো দেখি না একটু।’’
ধ্রুব মানা করলো না; নিচের দিকে ঝুঁকে এসে ইফাজের বরাবর হয়ে ওকে সব ছবি দেখালো। ইফাজ ছবি দেকজটে দেখতে ধ্রুবর দিকে তাকালো! ও একটু দোনামোনা করছে; ধ্রুব হয়তো সেটা বুঝতে পারল। ও ইফাজের বাচ্চা-বাচ্চা মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো——‘ছবি তুলতে চাও তুমি?’
ইফাজের খুশি দেখে কে! ও লাফিয়ে উঠে বলল—-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’
ধ্রুব ইফাজের চুল এলোমেলো করে দিয়ে ক্যামেরা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো———‘তুলো।’
ইফাজ হাসিমুখে ক্যামেরা হাতে নিল, কিন্তু ছবি তোলার বেলায় তার মন খারাপ হয়ে গেল। ও তো শিখেনি কিভাবে ক্যামেরা ব্যবহার করে। ধ্রুব ইফাজকে ক্যামেরা হাতে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে বললো—-‘কি? ছবি তুলবে না?’
ইফাজ ক্যামেরা ফিরিয়ে দিলো; মন খারাপ করে বললো——‘আমি ক্যামেরা চালাতেই জানি না। যদি নষ্ট করে ফেলি?’
ধ্রুব শোনে! এই হায়াত পরিবারের ছেলেমেয়েগুলো একটু বেশিই ভদ্র-সভ্য! অথচ জামাই পাবে চুড়ান্ত উগ্র; অসভ্য কাউকে। তোফাজ্জল হায়াতের ভাগ্যের উপর হঠাৎ করেই বড্ড আফসোস হলো ধ্রুবর। ধ্রুব ইফাজের দিকে চেয়ে নরম কণ্ঠে বললো——‘আসো, আমি শেখাই।’
ধ্রুব রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে ইফাজের সমান হলো। পেছন থেকে ওর হাত ধরে, দুটো হাত ক্যামেরায় ছুঁলো! ইফাজের হাতে হাত ধরে তারপর কীভাবে ক্যামেরা চালাতে হয়, সেটা শেখাতে লাগল। ইফাজ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল ধ্রুবর শেখানো। ধ্রুব শেখানো শেষ করতেই ইফাজ নিজে নিজেই একটা ছবি তুলল। ছবিটা ছিল একটা গরুর গাড়ির, যা বেশ ভালোই এসেছে। নিজের তোলা ছবি দেখে ইফাজ খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠল। বললো——‘ভাইয়া, দেখো ছবিটা সুন্দর না?’
ধ্রুব দেখে; ছবিটা ততটা স্পষ্ট আসেনি, কিন্তু ইফাজের খুশি দেখে ধ্রুব শান্ত স্বরে বললো——‘জোস ছবি তুলেছো তুমি। আরো তুলবে?’
ইফাজ উচ্ছ্বসিত গলায় বললো——‘হ্যাঁ, আরো তুলব!’
ধ্রুব মানা করলো না; ওরও ভালো লাগছিল ইফাজের পাগলামি-গুলো! ও ইফাজের দিকে চেয়ে আশকারা দেখিয়ে মৃদু হেসে বললো——‘যত ইচ্ছা তুলো। আজকের দিনের জন্য এই ক্যামেরা তোমার।’
ইফাজ অবাক হয়ে বললো——-‘সত্যি? তোমার ফিল্ম শেষ হয়ে যাবে না তো?’
ধ্রুব হাসিমুখে জবাব দিলো——‘আমার কাছে আরো আছে। তুমি ছবি তুলতে থাকো।’
ইফাজ এটা শুনে খুশিতে নাচতে নাচতে যা দেখছে সেটার-ই ছবি তুলতে লাগল। ইফাজ ছবি তুলে তুলে ধ্রুবকে দেখাচ্ছে। ধ্রুব তার পাশে হাঁটছিল,মাঝেমধ্যে ইফাজকে টুকটাক নতুন কিছু শিখিয়েও দিচ্ছিলো।
একসময় ধ্রুবর হঠাৎ কী মনে হলো। সে হাঁটতে হাঁটতে ইফাজকে জিজ্ঞেস করলো——‘ইফাজ, তোমার বাবা বলছিলেন, আজ তোমাদের বাড়িতে মেহমান আসবে? কে আসবে, জানো?’
মিথ্যা কথা! তোফাজ্জল এমন কোনো কথাই বলেননি ধ্রুবকে। কিন্তু ধ্রুব ইফাজের মুখ থেকে কথা টেনে বের করার জন্যে কথা তুলেছে। ইফাজ এক চোখ বন্ধ করে; ডান চোখ দিয়ে ক্যামেরার লেন্স দেখতে দেখতে জবাব দিলো ——‘আজ না; আগামীকাল আসবে ওরা।’
ধ্রুব যেন এবার সুযোগ হাতে পেলো! ও ভ্রু কুঁচকে ফেললো; জিজ্ঞেস করলো —-‘ওরা কারা জানো তুমি?’
ইফাজ ছবি তুলতে তুলতে বলল —-‘আপুকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।’
কথাটা শুনেই ধ্রুবর চোয়াল মুহূর্তেই শক্ত হয়ে গেল। ও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে নিজেকে সামলালো; গলার স্বর যথাসম্ভব নরম রেখে প্রশ্ন করে গেলো——‘ছেলে কী করে?’
ইফাজ নিজের মতো করেই জবাব দিলো——‘দুলাভাই তো ঢাকায় চাকরি করে। মা বলছিলেন, উনি একটা কাপড়ের ফ্যাক্টরির ম্যানেজার।’
‘দুলাভাই’ শব্দটা শুনে ধ্রুবর মুষ্টি শক্ত হয়ে গেল।তারউপর তার প্রতিদন্ধী কিনা একজন ম্যানেজার! অথচ সে কিনা একটা ম্যানেজারের জন্যে মাথায় ‘আশি কেজি ওজনের জেলাসি’ পুষে রেখেছে! এমন শত ম্যানেজার ধ্রুবর আশেপাশে ঘুরঘুর করে।
ধ্রুব রেগে ইফাজের হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে গেল। ইফাজ ক্যামেরা খুইয়ে অবাক হয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলো; মন খারাপ নিয়ে বললো—-‘আর ছবি তুলবো না? তুমি তো বলেছিলে, আজ সারাদিন ক্যামেরাটা আমার।’
ধ্রুব হাসার চেষ্টা করে ক্যামেরা নিজের হাতে রেখে বললো—-‘এটা আমার ক্যামেরা। বাট আমি এটা তোমাকে দেব যখনই তুমি চাইবে। কিন্তু ওয়ান কন্ডিশন!’
ইফাজের মলিন মুখে হাসি ফুটলো; সে ধ্রুবর শার্ট ধরে টান দিয়ে বলল,—-‘বলো না কী শর্ত?’
ধ্রুব ক্যামেরা ওর কাঁধে ঝুলিয়ে হাঁটু গেড়ে ইফাজের মুখোমুখি বসলো। ইফাজের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলতে লাগলো——‘আজ থেকে তুমি আমার শালা! যখনই আমরা দুজন একা থাকব, তুমি আমাকে ‘দুলাভাই’ বলে ডাকবে।”
ইফাজের চোখ এ কথা শুনে চড়কগাছ হয়ে গেল! ও বড়বড় চোখ করে; অবাক হয়ে বললো—-‘কিন্তু তুমি তো আপুকে বিয়ে করোনি। তোমাকে কেন ‘দুলাভাই’ ডাকব?”
ধ্রুব বিরক্ত হলো! ছোট প্যাকেটে বড় ধামাকা এই পুঁচকে ছেলে। বাপের মতোই শেয়ানা ভীষণ। ধ্রুব একটু ভেবে নিল; পরপর মুচকি হেসে বোঝাতে লাগল আবুল-তাবুল; ——–‘আমার বিয়ে হচ্ছে না; পাত্রী পাচ্ছিনা বিয়ে করার জন্যে। কিন্তু আমার একটা শালা পাওয়ার ভীষণ শখ। যে আমাকে দুলাভাই বলে ডাকবে। বউ নেই, তাই শালাও পাচ্ছি না। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে; আজ থেকে তুমিই আমার শালা। ঠিক আছে?’
ইফাজের চোখ টলমল করে উঠল! ধ্রুবর দুঃখ-ভরা কাহিনি শুনে ওর চোখ ভিজে এলো! ও দুঃখী ধ্রুবকে সান্ত্বনা দিতে ওকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরল; ধ্রুব ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল; ও তবুও একহাত তুলে ইফাজের পিঠে রেখে বুলালো! ইফাজ নাক টেনে বললো—-‘আর কষ্ট পেওনা; তুমিই আজ থেকে আমার দুলাভাই।’
ধ্রুব ইফাজের বাচ্চামো; ওর সরলতা দেখে হেসে ফেলল শব্দ করে। ইফাজ মুখ উঠালো ধ্রুবর কাঁধ থেকে; ধ্রুবর হাসি ওর ইমোশনকে অপমান করে ফেলেছে। ধ্রুব হাসতে হাসতে ইফাজের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো—-‘আমাদের ‘শালা-দুলাভাই’ জুটি জোস হবে; শালাবাবু।’
ধ্রুব এখনো হাসছে! ইফাজ মুখটা ফুলিয়ে ওর হাসি দেখছে।তার অযথা হাসি ইফাজকে এবার বিরক্ত করতে লাগলো। ইফাজ দুহাত কোমরে রেখে নাক ফুলিয়ে বললো—-‘তুমি হাসছো কেন?’
ধ্রুব হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করল; ইফাজের হাত ধরে ওকে টেনে ওর ছোটমোট্ট শরীরটা নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে বললো——‘আমার বোঝা হয়ে গেছে- কেন ও এত্ত সরল! তোমরা তোমাদের মায়ের জিন পেয়ে গেছো। বাট অ্যাই লাভ ইট।’
ইফাজ ধ্রুবর কাঁধে মুখ গুঁজে শুধু শুনে যাচ্ছিল কথা-গুলো! অথচ এসব কথার মানে ও একবিন্দুও বুঝেনি।
_
ইফাজ আর ধ্রুব হাঁটছে। ইফাজের হাতে ক্যামেরা। ও ছবি তুলছে। ধ্রুব হাঁটতে হাঁটতে বললো——‘ইফাজ, তোমার আপুকে যে ছেলে দেখতে আসবে, সে কী ধরনের মানুষ?’
ইফাজ ক্যামেরায় তোলা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে অন্যমনস্ক গলায় বললো——‘দুল…’
সঙ্গে সঙ্গে ধ্রুব তাকালো ইফাজের দিকে। ইফাজ চমকে উঠে; ও ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে! এখন আবার যদি ধ্রুব ওর হাত ঠেকে ক্যামেরা নিয়ে যায়? ইফাজ দ্রুত জিভ কেটে বললো—-‘সরি, সরি। ওই ভাইয়ার নাম ফারদিন হোসেন। আব্বুর বন্ধুর ছেলে।”
ধ্রুব শান্ত হল; ছেলের বুদ্ধি আছে যথেষ্ট! ধ্রুব এবার মোক্ষম কথাটাই তুলে ফেললো—-‘ইফাজ; তোমার একটা সাহায্য দরকার আমার। করবে?’
ইফাজ ছবি তোলা বাদ দিয়ে; অবাক চোখে তাকালো ধ্রুবের দিকে। ধ্রব ইফাজের চাওনি দেখে আগেভাগেই সাবধান হয়ে লোভনীয় অফার তুললো দ্রুতই—-‘অব…সাহায্য করলে তুমি যা চাইবে, তা পাবে। এমনকি এই ক্যামেরাও; ফর লাইফটাইম।’
ইফাজের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল! সে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো—-‘কী কাজ দুলাভাই?’
#চলবে
#আমার_প্রেমিক_ধ্রুব |২১|
#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধ্রুব আর ইফাজ সারা দুপুর ক্যামেরা নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। বাড়ি ফেরার কিছুটা পথ আসতেই তারা দেখে, এক জায়গায় মানুষের অনেক ভিড় জমে আছে। গ্রামের মানুষজনও সেদিকে দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। ইফাজের মনে শঙ্কা; ও ভয় পেয়ে ধ্রুবর এক আঙুল চেপে ধরলো! ধ্রুব ইফাজের ধরে থাকা আঙ্গুলের দিকে একবার চেয়ে, ভ্রু কুঁচকে সামনের দিকে তাকালো। গ্রামের মানুষ হইচই করছিলো কিছু একটা নিয়ে। ধ্রুব এগিয়ে গিয়ে ঘটনাটি দেখতে চাইল। কিন্তু মাঝপথে ইফাজ ধ্রুবর আঙ্গুল ধরে আটকে ফেলে বললো——‘দুলাভাই, যেও না। যদি আমরা ফেঁসে যাই?’
ধ্রুব ইফাজের কথায় কান দিল না। সামনের ভিড়ের দিকে চেয়ে ভ্রু কুঁচকে শুধু বললো——-‘কিছু হবে না; আসো আমার সঙ্গে।’
ইফাজ ধ্রুবর আঙুল ছেড়ে হাত চেপে ধরলো ভয়ে। ওরা এগিয়ে গেল। সেখানে পৌঁছানোর পর দেখতে পেল—একটি ছেলে-মেয়েকে ঘিরে সবাই ভিড় জমিয়েছে। গ্রামের মানুষ ছেলে-মেয়েটির দিকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে তাকিয়ে আছে। সবাই একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ চিৎকার-চেঁচামেচি করছে। ছেলেটির মুখে মাস্ক ছিল, যা খুলে ফেলা হয়েছে। মেয়েটির বোরকার উপর নিকাব পরা। ধ্রুব আশপাশের কথা শোনার পর বুঝল—এই দু’জন এই গ্রামে প্রেম করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। গ্রামের লোকের এদের নিয়ে চুড়ান্ত কঠোর সমালোচনা দেখে ধ্রুব হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। ও যা শুনেছে, তা নিজের চোখে দেখতে পেয়ে সে বিস্মিত! ও কেন যেন স্পষ্ট ওই ছেলের জায়গায় নিজেকে দেখতে পাচ্ছে; আর মেয়েটির জায়গায় অদিতি!
গ্রামের মুরুব্বিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ছেলে-মেয়েটিকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। পবিত্র গ্রামের মাটি অপবিত্র করার সাহস দেখানোর জন্য তারা দায়ী। তোফাজ্জল হায়াতকে খবর দেওয়া হয়েছে। তার বাড়িতে আজ বিচারের আসর বসবে।
ধ্রুব তাদের এই আচরণ দেখে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এসব কি হচ্ছে? প্রেম করলেই এমন শাস্তি দিতে হবে? ধ্রুব কিছু বলার চেষ্টা করলো;———-‘আপনারা ঠান্ডা হোন প্লিজ। সামান্য প্রেমই তো করেছে; এখানে প্রবলেম কি?’
চারপাশের উত্তেজনা ধ্রুবর কথা শুনে আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেছে। ইফাজ ধ্রুবর আঙুল চেপে ধরলো ভয়ে। তার দুলাভাই এসব বলেছেটা কি? গ্রামের লোক ধ্রুবকে আগাগোড়া দেখছে। এই শহুরে ছেলে গ্রামে কোথায় এসেছে? ধ্রুব ওদের বাকা চোখে তাকানোকে পাত্তাই দিল না; নিজের মত করে বলে গেলো——‘আপনাদের মনে হচ্ছে না; যে আপনারা বেশি করছেন! ছেলে-মেয়ে এডাল্ট; নিজেদের মর্জিমত প্রেম করেছে। হোয়াটস রং উইদ দ্যাট?’
ইফাজের মাথায় পরে বাজ! ও আশেপাশের লোকের অবাক দৃষ্টি; ওদের কারো কারো রূড় দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে ধ্রুবর টিশার্ট টেনে ধরে ——-‘ভাইয়া , চলো এখান থেকে চলে যাই। আব্বা শুনলে আমাদের মেরে ফেলবে। চলো না।’
ইফাজ বারবার ধ্রুবকে টানছিল।ধ্রুব যায়না; ও তখনও স্থির ভঙ্গিতে সেভাবেই দাড়িয়ে থাকে। ও শুনতে চায়- গ্রামে এসব হচ্ছেটা কি? ওর ভ্রু কুচকানো! এ পর্যায়ে একজন মধ্যবয়স্ক লোক ধ্রুবর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে শাসিয়ে উঠে——‘অ্যাই ছেলে! গ্রামের মুরুব্বিদের সিদ্ধান্তের উপরে কথা বলার সাহস হয় ক্যামনে তোমার?’
ধ্রুব সেই ধাক্কায় পিছিয়ে যায়; বুকের দিকে একবার চেয়ে; পরপর শান্ত চোখে ওই লোকটাকে দেখে শুধু এটুকু বললো——‘গায়ে হাত দিবেন না।’
ওই মধ্যবয়স্ক লোক তবুও এগিয়ে যায় ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব পেছাতে থাকে; ওর রাগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। যেকোনো মুহূর্তে ঘু/ষি পরতে পারে! ওই লোক ধ্রুবর বুকে ধাক্কা দিতে দিতে বললো——‘প্রেমের পক্ষে থাকো। আল্লাহর বিরোধিতা করো? সাহস কম না তোমার!’
ধ্রুব পেছাতে থাকে; ধ্রুবর আঙুল চেপে ইফাজও পেছায়! একপর্যায়ে ধ্রু থামে; আর পেছায় না। ওই লোক এবার চুড়ান্ত খারাপ কথাটা বলে ফেলে———‘গ্রামের কোনো ছেড়িরে পছন্দ হয়েছে? নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করতেসস নাকি?’
ব্যাস; ধ্রুবর রাগ এবার তুঙ্গে উঠে যায়। ও রক্তলাল চোখে চেয়ে; হাত উঁচিয়ে ঘুষি বসাতে উদ্যত হলো! ইফাজ ভয় ধ্রুবর আঙ্গুল ছেড়ে দুহাতে চোখ চেপে ধরলো! তবে ধ্রুবকে আটকে দিল অন্য একজন বৃদ্ধ! ধ্রুবর হাত চেপে ধরতেই ধ্রুব চেচিয়ে উঠলো———‘ছাড়ুন আমাকে। ব্যাডার কতো বড় সাহস; কাকে নিয়ে কি বলছে! আমি অদ….’
ধ্রুব থমকে উঠে থেমে গেল হঠাৎ! কি বলতে যাচ্ছিল ও?ধ্রুব ঠান্ডা হয়ে যায় একদম; হাত নামিয়ে গায়ের টিশার্টের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে ভ্রু কুঁচকে সামনে থাকা লোকটার দিকে চায়। মধ্যবয়স্ক ওই লোকটার চোখে উপহাসের হাসি! ধ্রুব চোখ উল্টে ফেলে; হতাশ ও! নিজেকে সামলাচ্ছে ও অদিতির জন্যে; অথচ এরা ওকে ভালো থাকতেই দিচ্ছে না।
এসবের পর; ইফাজ ধ্রুবকে টেনে নিতে লাগল বাড়ির দিকে। ধ্রুব ইফাজের সঙ্গে হাঁটছিল ঠিকই;কিন্তু বারবার পেছনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল গ্রামের মানুষদের উন্মত্ত আচরণ। বাড়ি পৌঁছানোর পর দেখতে পেল, তোফাজ্জল হায়াতের উঠোনে বিচারসভা বসার জন্য চেয়ার-টেবিল সাজানো হয়েছে। ফাহিমা তখন চুলায় চা বসিয়েছেন।
ইফাজ বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই তাকে কাজে লাগিয়ে দেওয়া হলো। হঠাৎ ধ্রুবের দৃষ্টি গেল এক কোণে চেয়ার হাতে দাঁড়ানো অদিতির দিকে। ধ্রুব তাকিয়েই রইল; ওর চোখ অদ্ভুতভাবে ভীষণ শান্ত ছিলো! অদিতির চোখেমুখে নীরবতা! ধ্রুব চেয়ে ছিলো; অদিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠোনে চেয়ার রেখে ভেতরে চলে গেল।
এর মধ্যেই তোফাজ্জল হায়াতের উঠোনে লোকজনে গিজগিজ করতে লাগল। গণ্যমান্য লোকেরা চেয়ারে বসেছেন। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে আছে। মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সেই ছেলে-মেয়েটিকে। দু’জনই অবিরাম কাঁদছে। ছেলেটির বাবা-মা লজ্জায় মাথা নত করে আছে। মেয়েটির বাবা গাছ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, চোখে পানি; যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাবেন!
বিচার শুরু হলো।ধ্রুব একপাশে দাড়িয়ে আছে। অদূরে জানালার পর্দার ফাকে অদিতির অর্ধেক মুখটুকু দেখা যাচ্ছে। তোফাজ্জল হায়াত বিচারে এলেন। সবাই জায়গা ছাড়লো উনার জন্যে। তোফাজ্জল সকলের মধ্যমণি হয়ে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। তার চোখে ছিল শীতল দৃষ্টি। গ্রামের লোকজন জানাল——‘সাব; এদের ধানক্ষেতের পাশে অশ্লীল কাজ করতে দেখা গেছে।”
সঙ্গেসঙ্গে ছেলেটি প্রতিবাদ করে বললো——-‘আমরা কোনো অশ্লীল কাজ করিনি। আমরা শুধু দেখা করছিলাম।’
তোফাজ্জল হাত তুলে ছেলেটিকে থামিয়ে দিলেন। ছেলেটি হাত দেখে থেমে গেল। তোফাজ্জল তারপর ছেলেটির পরিবারের দিকে তাকিয়ে বললেন——-‘আপনারা কিছু বলবেন?’
ছেলের বাবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন——-‘আপনি যা সিদ্ধান্ত নেন, নিন। ওকে আমি আজ থেকে গ্রামবাসির সামন্য ত্যাজ্য করলাম।’
ছেলেটি হতবাক হয়ে চিৎকার করে উঠলো——‘আব্বা!’
ছেলের চিৎকারে মুষড়ে পরলেন উনি! কিন্তু একঘরে করে দেবার ভয়ে শাসিয়ে উঠলেন——‘চুপ! তোর মা মরার পর আমি তোকে কত কষ্টে বড় করেছি যাতে তুই বড় হলে রঙ্গলীলা করতে পারস এইজন্যে? শা/লা জা/নোয়ার!’
ছেলের চোখ বুজে ফেলেছ; বাবার মুখে নিজেকে নিয়ে ঘেন্না ওর রূহ অব্দি কাপিয়ে তুলেছে যেন। তোফাজ্জল ওসব দেখেন না; উনি মেয়ের পরিবারকে জিজ্ঞেস করলেন——-‘আপনাদের কিছু বলার আছে?’
মেয়েটির পরিবারও একই সুরে কথা বলে; মেয়েটির বাবা কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন———‘আমার মেয়েকে আমি ত্যাজ্য করলাম। আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, তাই মাইনা নেব।’
মেয়েটি এবার শব্দ করে ফুপিয়ে কেঁদে ফেললো। ছেলে হয়তো মেয়ের কান্না শুনে অপরাধবোধে ভুগে। ও এবার আর কোনো উপায় না পেয়ে; সোজা তোফাজ্জল হায়াতের পায়ে পড়ে গেল। তোফাজ্জল ওইভাবেই বসে; নড়লেন না জায়গা থেকে। ছেলে পায়ে হাত দিয়ে কাঁদতে লাগল——-‘চাচা, আমি ওকে বিয়ে করে ফেলবো! আমাদের সম্পর্ক আমি হালাল করে দিব। প্লিজ, তবুও এত বড় শাস্তি দেবেন না আমাদের।’
তোফাজ্জল হায়াত পা সরিয়ে ফেললেন। ছেলেটা মুখ থুবরে মাটিতে পরলে মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে আটকে ফেলা হলো ! ছেলেটা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো! তোফাজ্জল কঠোর কণ্ঠে বললেন———-‘প্রেম করার আগে এই প্রস্তাব দিলে আমরা মেনে নিতাম। হারাম কাজ করার আগে কেন হালাল করার কথা মাথায় এলো না?’
ধ্রুব শুনতে থাকে; ছেলেটি বিষণ্ণ গলায় বলল——-‘ওর পরিবার মানবে না; আমি বেকার তাই। তাছাড়া আমি ভয় পেয়েছিলাম। তাই আপনাদের কাছে যেতে পারিনি।”
তোফাজ্জল হায়াত বললেন——-‘আমি তোমাকে চাকরি দিতাম। তুমি আমার কাছে কেন আসোনি?”
ছেলেটি উত্তর দিল——-‘আমি ভয় পেয়েছিলাম, চাচা। আপনি প্রেমের এত ঘোর বিরোধী। যদি কিছু করে ফেলতেন!”
তোফাজ্জল আশপাশে তাকিয়ে সবার জবাব নেওয়ার জন্যে বললেন——-‘আমি এই গ্রামে কাউকে সৎ পথে সাহায্য করতে অস্বীকার করেছি আজ অব্দি? কেউ কি কখনো আমার কাছে আসতে ভয় পেয়েছো?”
গ্রামের লোকেরা একে অন্যের দিকে তাকাল। শেষমেশ সবাই মাথা নেড়ে তোফাজ্জলের অবদানের কথা একবাক্যে স্বীকার করল। তোফাজ্জল এবার ছেলেটার দিকে তাকালেন; বললেন ———‘হারাম তো হারামই। এবার অন্যদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তোমাদের সঙ্গেও তাই ঘটবে।”
এ কথায় যেন পুরো উঠোনে হইচই লেগে গেল! ছেলেটি এবার নিজেই কেঁদে ফেলল। তোফাজ্জল হায়াত উঠে দাঁড়ালেন। সবার উদ্দেশ্যে বললেন——-‘ওদের এখনই বিয়ে দেওয়া হবে। কাজী আনা হোক। তারপর তোমরা এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে। যেহেতু তোমাদের বাবা-মা তোমাদের ত্যাজ্য করেছেন, তাই তাদের একঘরে করা হবে না। তবে যদি তাদের সঙ্গে তোমাদের পরিবারের কোনো যোগাযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ছেলে-মেয়ের বাবারা সবাই হতবুদ্ধি হয়ে তোফাজ্জলের দিকে তাকিয়ে রইলো! ওদের হৃদয় থমকে গেছে যেন! মুহূর্তেই কোলাহল শুরু জয়ে গেল। তোফাজ্জল নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। হঠাৎ পেছন থেকে সেই ছেলেটি চিৎকার করে ডেকে উঠল——-‘হায়াত সাব; দাঁড়ান!’
ছেলেটির চিৎকারে তোফাজ্জল থামলেন। পেছনে ফিরে গম্ভীর-শান্ত দৃষ্টিতে ছেলেটিকে দেখলেন; সঙ্গে উপলব্ধি করলেন ওর চোখের হিংস্রতা-প্রতিশোধপরায়নতা! ছেলেটি এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল উনার। তার চোখে ছিলো অদ্ভুত এক ভাষা! সে তার ভেজা চোখ দুটো তোফাজ্জলের চোখে রেখে বললো——‘আপনি এত্ত প্রেম বিরোধী, লোকের ভালোবাসার উপর আঙ্গুল তোলেন! যদি কোনোদিন আপনার ছেলে-মেয়ে প্রেম করে, তখন কী করবেন? তখন কেমন বিচার করবেন?’
ধ্রুব থমকে তাকিয়ে রইলো! ওর নিঃশ্বাস আটকে গেছে; তোফাজ্জলের জবাব শোনার জন্যে ওর ভেতরে ছটফট!
তোফাজ্জল গ্রামবাসীর দিকে তাকালেন। সবার চোখে এক অদ্ভুত কৌতূহল! তোফাজ্জল গভীর শ্বাস নিলেন; দু মুহূর্তে না ভেবে; বলে ফেললেন—-‘সেদিন আমি নিজের হাতে আমার মেয়েকে খু/ন করব!’
ধ্রুব বিস্মিত হয়ে তাকালো তোফাজ্জলের দিকে; ওর হৃদয়ে তখন টগবগিয়ে রক্ত ছুটছে! ধ্রুব যেন নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। একজন বাবা এমন কথা কীভাবে বলতে পারে?ধ্রুব অবাক-হতবম্ব চোখে জানালার দিকে তাকায়; অদিতির চোখ-টুকু আজ শান্ত-স্থির! ও এস জানতই; ওর জন্যে এসব কথা আজ নতুন নয়। ধ্রুব তাকাতেই অদিতি চোখ নামিয়ে ফেলল! ধ্রুব বোঝে- আজ অদিতির কিছুই বলার নেই।
তোফাজ্জল ছেলেটার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে গ্রামের সবার উদ্দেশ্যে বললেন——‘আগামীকাল আমার মেয়েকে আমার পছন্দ করা ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে আসবে। আপনাদের নিমন্ত্রণ রইল। আসবেন!”
ধ্রুব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে; চুপচাপ শুধু শোনে যায়। তোফাজ্জল তারপর ছেলের কঠিন চোখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন——‘মেয়ে-ছেলে মানুষ করতে জানতে হয়! আমি দোয়া করি, তুমি যেন ভালো বাবা হও।”
এ কথা বলে তোফাজ্জল নিজের ঘরের ভেতর চলে গেলেন। ছেলেটিকে ঘিরে ধরে গ্রামের লোকেরা শাসাতে লাগল। কেউ বলল——-‘তুই এভাবে কথা বললি কেন? হায়াত সাহেবের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে তোর সাহস হলো কী করে?”
ছেলেটি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ ভ্রুকুঞ্চিত। সে তোফাজ্জলের ঘরের দিকে তাকিয়েই রইল। ধ্রুব শুধু ওই ছেলেটাকে দেখতে থাকে; যার মধ্যে ও নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পারছে।
__________
বিচার কাজ শেষ হয়েছে! ধ্রুব ঘরে এসে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে বিছানায় হিয়ে বসেছে। রীতিমত ফুঁসছে ও! মন যেন অসংখ্য শব্দ আর প্রশ্নের ভারে চিৎকার করে উঠতে চাইছে। সারাদিনের ঘটনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। গ্রামবাসীর হিংস্র চাহনি, ছেলেটার অসহায় আকুতি, আর তোফাজ্জল হায়াতের কাঠিন্য—সবকিছুই যেন ওর বুকের ভেতর একটা ভারী পাথরের মতো চেপে বসেছে।
ধ্রুবর সবকিছু অসহ্য লাগছে। ও জুতো পায়েই বিছানায় লম্বালম্বি শুয়ে পরলো, সারারাত চোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হচ্ছিল না। বারবার; বারবার মনে পরছিলো , ছেলেটার শেষ প্রশ্ন—-‘যদি আপনার মেয়ে প্রেম করে, সেদিন কী করবেন?” আর তোফাজ্জল হায়াতের সেই জবাব—‘নিজের হাতে খু/ন করব।’
ধ্রুব অন্ধকার ঘরের সিলিংয়ের দিকে চেয়ে থাকে; একসময় অতিষ্ট হয়ে আবার উঠে বসে পরে। বাতি জ্বালিয়ে মাথাটা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। একসময় সেটাতেও শান্তি না মিললে; যথে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। চাঁদের আলোয় গ্রামের কাঁচা রাস্তা, উঠোনের মাটি, আর দূরে নদীর ঢেউগুলো জ্বলজ্বল করছিল। কিন্তু ধ্রুবর চোখে সেই আলো ধরা পরছিলো না। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল ছেলেটার কান্না, মেয়েটার ভীত মুখ, আর তোফাজ্জল হায়াতের কঠিন মুখটা।
ওই ছেলেটা ধ্রুব হতে পারত; মেয়েটা অদিতি হতে পারতো! ধ্রুব ওই ছেলেটার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠল। জানালার গ্রিলে হাত ঠেসে চেপে ধরে কল লাগালো কাউকে; ওপাশ থেকে কল রিসিভ হলে ধ্রুব হিসহিসিয়ে বলল ——-‘লক্ষীপুর গ্রাম; ছেলে ঢাকার ম্যানেজার; খোঁজ নাও।
——-‘আপাতত এটাই করো বলদ! এর পরবর্তী কাজ আমি জানিয়ে দেব।’
#চলবে