#প্রিয়_নীড়হারা
৬
ছুটির দিনে বাড়িতেই আছে অর্ণিত৷ সকালের নাস্তা খেয়ে বাবার সাথে বাজারে গিয়েছিল। পুরো সপ্তাহের বাজার করেছে। আজকের জন্য কেনাকাটা হয়েছে একটু অন্যরকম। প্রতি শুক্রবার চাকুরিজীবীর ঘরে যেরকম বাজার হয় আরকি৷ রান্নাঘর থেকে মশলা কষানোর ঘ্রাণ আসে, অনেকক্ষণ ধরে জ্বলে গ্যাসের চুলা। একটু ধনী পরিবারের রান্নাঘরের গরুর গোশতের ঘ্রাণে পেটের ক্ষুধা মোচড় দিয়ে উঠে পথচারীর।
অর্ণিতদের বাড়িতে প্রতি শুক্রবার দুপুরের পাতে গরুর গোশত জুটে৷ আজও তাই রান্না হচ্ছে৷ তবে আজকে একটু বাড়তি আয়োজন করতে সিরাজ সাহেবের আদেশে পোলাও রান্না হচ্ছে৷ ডিমের কোপ্তা, গরুর গোশত, মাছ ভাজি, সবজি, আবার সালাদ। এতোসব রান্নার আয়োজন করতে গিয়ে নাভিশ্বাস দশা দৃতী ও তানিয়ার৷
অথচ বসার ঘরের টেলিভিশনটির সামনে আয়েশ করে বসে আছে এ বাড়ির পুরুষ সদস্যরা৷ সোফায় বসে সকালের পত্রিকাটিতে মুখ গুজেছে সিরাজ৷ অপরপাশের সোফায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে গতরাতের ফুটবল ম্যাচের রিপিট টেলিকাস্ট দেখছে অর্ণিত।
ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত পায়ে বসার ঘরে এলো দৃতী৷ অর্ণিতের সামনের সোফার টেবিলে একটি বড় স্টিলের প্লেট রেখে বলল,
“এগুলোর খোসা ছাড়াও।”
অর্ণিত অবাক হয়ে তাকাল। এখন তাকে রান্নাঘরের কাজ করতে হবে নাকি! তবে হতভম্ব চেহারাখানা দৃতীর চোখ রাঙানো দেখে স্বাভাবিক করে ফেলল সে। দৃতী যেভাবে ছুটে এসেছিল সেভাবেই ফিরে গেল৷
সিরাজ সাহেব মুখের সামনে থেকে পত্রিকাটি একটুখানি সরিয়ে দেখল, তার ছেলে সুবোধ বালকের মতো সোফায় বসে মটরশুঁটির খোসা ছাড়াচ্ছে।
পুরুষ মানুষ রান্নাঘরের কাজ করছে দেখে মনে মনে বেজায় বিরক্ত হলো সিরাজ। এই অধঃপতনও তার দেখা বাকি ছিল! বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানো ভেড়া প্রকৃতির ছেলে কিছু কথা বলার জন্য মনটা উসখুশ করছে। কিন্তু ছেলের দাম্পত্য জীবনে হস্তক্ষেপ করার মতো অশোভন কাজটি সে করতে পারল না। হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফের মনোযোগ দিল পত্রিকায়।
ফুটবল ম্যাচ দেখতে দেখতে মটরশুঁটির খোসা ছাড়াচ্ছে অর্ণিত৷ গোল হওয়ার মুহূর্তগুলোয় থেমে যাচ্ছে তার হাত৷ টেলিভিশনের পর্দায় স্থির হচ্ছে চোখ জোড়া। এদিকে প্লেটের মটরশুঁটি পড়ে আছে অবহেলায়।
রান্নাঘর থেকে দৃতীর গলার আওয়াজ শোনা গেলো,
“খোসা ছড়ানো হলে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো।”
ধ্যান ভাঙ্গল অর্ণিতের। দ্রুত হাতে খোসা ছাড়াতে লাগল। সিরাজ সাহেব পত্রিকার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, এখনো অর্ধেক মটরশুঁটি বহাল তবিয়তে রয়েছে৷ ছেলের এমন অপটু হস্তের কাজে সিরাজ সাহেব নিরাশ হলো। এভাবে খোসা ছাড়াতে থাকলে আজকে আর রান্না শেষ হওয়া লাগবে না। অর্ণিত নিজেও ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পেরে দ্রুত কার্যসাধন করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ ছেলেকে এমন অথৈ জপে হাবুডুবু খেতে দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো সিরাজ সাহেব। পত্রিকাটি ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে নীরবে প্লেট থেকে মটরশুঁটি তুলে নিল। নিজেও হাত লাগালো রান্নাঘরের কাজে।
_________
বিয়ের পর স্বামীর হাত ধরে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল তানিয়ার৷ তারপর থেকে গৃহের মধ্যে আটকে আছে সে। বাড়ির বাইরে খুব একটা বের হতে দেখা যায় না তাকে। নতুন বউ থাকাকালীন বছরে দু তিনবার বাবার বাড়ি যাওয়া হতো। অর্ণিত জন্মানোর পর ধীরে ধীরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। বাবা মা মারা যাওয়ার পর এমনিতেও বাবার বাড়ির সাথে মেয়েদের যোগাযোগের সুতোটা পুরোপুরি ছিঁড়ে যায়৷ এতিম তানিয়ার এখন আর কোথাও যাওয়ার নেই। তার জীবন আটকে গেছে স্বামীর সংসারে৷
এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চোখে গাঢ় করে কাজল দিতে দিতে দৃতী জিজ্ঞাসা করল,
“আপনার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না, মা?”
দৃতীর ঘরে বিছানার উপর পা ঝুলিয়ে বসে দৃতীর তৈরি হওয়া দেখছিল তানিয়া৷ দৃতীর কথায় ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল,
“বাইরে বলতে?”
“এই ধরুন পার্কে ঘুরতে গেলেন কিংবা মেহমানের বাড়িতে বেড়াতে গেলেন। অথবা বিকালবেলা বাড়ির সামনের রাস্তায় একটু হাঁটতে বের হলেন। ইচ্ছে করে না?”
“আগে টুকটাক বের হতাম অর্ণিতের বাবার সাথে৷ মার্কেটে যেতাম শপিং করতে, কলিগের বাড়িতে দাওয়াত, কলেজের অনুষ্ঠান এসবে আরকি৷ এখন আর ইচ্ছে করে না। বয়স বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে শারীরিক দুর্বলতাও৷ ঘরের কাজ শেষ করে দুদণ্ড জিরোতে পারলেই শান্তি।”
ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে তানিয়ার দিকে ঘুরে তাকিয়ে দৃতী বলল,
“আজকে আমাদের সাথে চলুন। ফুচকা খাবো।”
দৃতীর দুষ্টামিতে তানিয়া হেসে ফেলল। বলল,
“পাগল হয়েছো! এই বয়সে ফুচকা খেতে যাবো? ওসব তোমাদের শোভা পায়। যাও গিয়ে ঘুরে এসো৷ আমাদের বয়সে আমরাও অনেক ঘুরেছি৷”
সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে শীতলপাটি বিছিয়ে রাখা৷ তার উপর পা মুড়ে বসে আছে দৃতী ও অর্ণিত। দৃতীর সামনে দুটো ফুচকার প্লেট। একটি প্লেটের অর্ধেক ফুচকা সে ইতোমধ্যে খেয়ে ফেলেছে৷ অন্য প্লেটের ফুচকাগুলোও খাবে৷
দৃতীর সামনে পানির বোতল হাতে নিয়ে বসে আছে অর্ণিত৷ কিছুক্ষণ আগে দৃতীর জোরাজুরিতে সে একটি ফুচকা খেয়েছে৷ এতো আদরমাখা কণ্ঠে দৃতী অনুরোধ করলো যে অর্ণিত না করতে পারেনি৷ তার উপর দৃতী ভীষণ যত্ন করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। গ্রহণ না করে কোনো উপায় ছিল না৷ কিন্তু ফুচকা খেয়ে অর্ণিতের মরোমরো দশা।
এতো ঝাল! এখনো অর্ণিতের মুখের ভেতরটা এখনো জ্ব*লে পু*ড়ে যাচ্ছে।
অথচ ওর সামনে বসে এই ঝাল ফুচকা তেতুলের টকে চুবিয়ে গোগ্রাসে গিলছে দৃতী। একটা খেয়েই দাঁত টক হয়ে গিয়েছে অর্ণিতের৷ দৃতী কীভাবে খাচ্ছে কে জানে!
প্লেটের ফুচকা শেষ করে সামনে রাখা দই ফুচকার প্লেটটি টেনে নিল দৃতী৷ অর্ণিতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“দই ফুচকা খাবে? এটাতে বেশি ঝাল নাই। খেয়ে দেখো।”
অর্ণিত দুই হাত জোড়ো করে বলল,
“আমার যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে। আর ইচ্ছে নেই। তুমিই খাও। আরোও খেতে চাইলে বলো, আরেক প্লেট অর্ডার দেই।”
“দিলে ভালো হয়। পেটে এখনো কিছুটা জায়গা বাকি আছে। মনে হচ্ছে আরেক প্লেট খেতে পারব। আরেকটা দই ফুচকা দিতে বলো।”
অর্ণিত বিরসমুখে দোকানী ছেলেটাকে ডেকে আরেক প্লেট ফুচকার অর্ডার দিলো। তারপর মশা কামড় খেতে খেতে হতাশাগ্রস্থ অর্ণিত সামনে বসে থাকা পেটুক মেয়েটিকে একদৃষ্টিতে দেখতে থাকল। মুখ হা করে একটি আস্ত ফুচকা একেবারে মুখে পুড়ছে দৃতী। দেখতে বিদঘুটে লাগার কথা। অথচ অর্ণিতের কাছে বেশ আদুরে লাগছে৷
ঝালের চোটে চোখের কোণে জল চিকচিক করছে৷ তাতে লেপ্টে গেছে চোখের কাজল। রাত্রির প্রথম প্রহরে হুড নামানো রিক্সায় বসে ফুরফুরে বাতাসে এলোমেলো চুলের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অর্ণিত আরেকবার নিশ্চিত হলো, খুব সাধারণ এই মেয়েটির পাশে বসে আস্ত এক জীবন অনায়সে পাড়ি দিতে পারবে সে। তার ছড়ানো কাজলের মায়া কাটাতে একটা দীর্ঘ জীবনও কম পড়ে যাবে অর্ণিতের।
চলবে..
#অক্ষরময়ী