প্রিয় নীড়হারা পর্ব-০৭

0
80

#প্রিয়_নীড়হারা


ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়ার কাজটি দৃতী নিজের কাঁধে নিয়েছে। ছয়তলা বিশিষ্ট ভবনটির ছাদটি বেশ খোলামেলা। একপাশে কাপড় শুকানোর জন্য রশি ঝুলানো আছে। অন্যপাশটি ফাঁকা। বিল্ডিং এর বাচ্চারা এখানে এসে খেলাধুলা করে৷ মহিলারা শেষ বিকালে আড্ডা বসায়৷ আর রাতের বেলা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পুরুষ সদস্যরা আসে নিকোটিনের ধোঁয়ায় সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে৷

এই ভরদুপুরে অবশ্য ছাদ ফাঁকা থাকে। রোদে কাপড় মেলে দিতে দিতে ছাদে এসে উপস্থিত হলো উপমা। বাবা-মা ও ভাইয়ের সাথে এই বিল্ডিংয়ে থাকে উপমা। ওর বাবা চাকরি করে কাস্টমসে৷ সেই সুবাদেই এখানে আছে৷ উপমা অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ে৷ কিন্তু ওর অভিজ্ঞতার ঝুলি দৃতীর থেকেও ভারি৷ এইটুকু বয়সেই মেয়েটি আত্মনির্ভরশীল। কথাবার্তা, চলনবলনে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে৷

উপমাকে বেশ ভালো লাগে দৃতীর৷ প্রথমদিকে কয়েকবার লিফটে দেখা হয়েছিল। চোখাচোখি হতেই দুজনে মৃদু হেসে নীরব অভ্যর্থনা জানিয়েছিল দুজনকে। তবে প্রথম আলাপ হয়েছিল এই ছাদে৷ সেদিনও কাপড় মেলতে এসেছিল দৃতী৷ উপমাও এসেছিল একটা মাঝারি বালতি হাতে৷

আজও উপমার হাতে শোভা পাচ্ছে ভেজা কাপড়ের বালতি। দৃতী বলল,

“আজকে কি ধুয়েছো?”

ভেজা কাপড় বাতাসে ঝাড়া দিয়ে উপমা বলল,

“জানালার পর্দাগুলো ময়লা হয়ে প্রায় কালো হয়ে গিয়েছিল। ওগুলোই ধুয়ে দিলাম। পাঁচতলায় এতো ধুলাবালি কীভাবে আসে আমি বুঝি না।”

“কয়েকদিন আগেই না এগুলো ধুয়ে দিলে! তোমার কি শুচিবাই আছে নাকি, উপমা?”

“কী যে বলো না আপু! কয়েকদিন আগে হবে কেনো! দুই সপ্তাহ আগে ধুয়েছি।”

“আর আমি মাসেও একবার ধুতাম না। শ্বশুরবাড়ি এসে লজ্জায় পড়ে ধুতে হচ্ছে। এমনিতেও কাপড় ধোয়া আমার খুব বিরক্ত লাগে।”

“আর আমার বিরক্ত লাগে চুপচাপ বসে থাকলে। ব্যস্ত থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। চট করে দিন শেষ হয়ে যায়। যেদিন কোনো কাজ থাকে না সেদিনটা যেনো শেষই হতে চায় না। উফ! কী বিরক্তিকর!”

“আজ কোনো কাজ ছিল না বুঝি?”

“নাহ। এজন্যই জানালার সব পর্দা খুলে ধুয়ে দিলাম।”

“হঠাৎ কাজ কমে গেলো কেনো?”

“ফ্রিল্যান্সিং এর এই এক অসুবিধা। কখনো কাজ করে কূল পাওয়া যায় না, আবার কখনো কোনো কাজই পাওয়া যায় না। কী আর করার! এভাবেই মানিয়ে নিতে হয়৷ তবে ফ্রিল্যান্সিং করে মজা আছে। কোনো বাধাধরা নিয়ম নেই। অগাধ স্বাধীনতা। মন চাইলে কাজ নিলে, না চাইলে রিজেক্ট করে দিলে। কেউ তোমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট করবে না৷ এজন্যই আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমাদের কোম্পানি জয়েন করে ফেলো। তোমার কণ্ঠস্বর মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর। তুমি কথাও বলো চমৎকারভাবে। এক মাসে একটা কোর্স করে নিলেই হয়ে যাবে ভয়েস আর্টিস্ট।”

উপমার কথায় দৃতী হাসে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নিজের কণ্ঠস্বরের প্রশংসা এর আগেও শুনেছে। খুব একটা আমলে নেয়নি দৃতী। কিন্তু প্রথমবার একান্ত সময় কাটানোর এক পর্যায়ে অর্ণিত যখন ফিসফিসিয়ে বলেছিল,

“তোমার কণ্ঠে অর্ণিত নামটা এতো মধুর শোনায়, দৃতী! এই যে আবেশে বুদ হয়ে বারবার ডাকছ, আমার মনে হচ্ছে কোনো সংগীত শুনছি। এই ডাক শোনার জন্য হলেও রোজ তোমাকে কাছে চাই।”

নারীদেহের বাঁকে বাঁকে এতো সুখের সঞ্চার, জানা ছিল না দৃতীর। অর্ণিত তাকে সেই সুখের সন্ধান দিয়েছে। সুখের ভেলায় ভাসতে ভাসতে দৃতী তখন দ্বিকবিদিকশূণ্য। উত্তেজনায় অস্থির দৃতী কী বলছে, কী করছে সেই জ্ঞান ছিল না। অর্ণিতের সেই কথা শুনে দৃতী খানিকটা সামলে নেয় নিজেকে। রাঙা মুখটা লুকায় অর্ণিতের বলিষ্ঠ বুকে।

সেদিন দৃতীর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগে৷ অর্ণিত যেহেতু বলেছে তার মানে তার কণ্ঠস্বরে সত্যিই কিছু একটা আছে।

উপমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর সেও একদিন বলে বসল,

“আপু, তোমার কণ্ঠস্বর চমৎকার। এতো মধুর শোনায়! তুমিও চাইলে আমার মতো ভয়েস আর্টিস্ট হতে পারবে। চেষ্টা করবে নাকি? আমি তোমাকে হেল্প করতে পারব।”

হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল দৃতী। কিন্তু উপমা থেমে নেই। প্রায়শই একই প্রস্তাব জানায় দৃতীকে। আজ দৃতী প্রকৃত জবাবটি দিয়েই দিল।

“চাইলেই কী করা যায়, উপমা? বিয়ের আগে কতো প্ল্যান ছিল! ক্যারিয়ার গড়বো, আয় রোজকার করবো, বাবাকে সাপোর্ট দিব। কিন্তু এখন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে রঙিন স্বপ্ন ভেঙে গেছে৷ সংসারের এতো কাজ, এতো ব্যস্ততার মাঝে সময় বের করা দায়৷ তারপর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের অনুমতির একটা ব্যাপার আছে৷ বিয়ের পর মেয়েদের জীবনটা অনেক বদলে যায়। তুমি এখনো বাবার বাড়িতে আছো, তাই অগাধ স্বাধীনতা পাচ্ছো। যখন যা ইচ্ছে করছ, ছাড়ছ৷ কাউকে জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না৷ কিন্তু বিয়ের পর দেখবে বাড়ির দরজায় পা দেওয়ার আগেই কতোজনের অনুমতি নিতে হচ্ছে। কোথায় যাবে, কেনো যাবে, কার সাথে যাবে, কখন ফিরবে- হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷”

বাস্তবতার এমন নিষ্ঠুর বর্ণনায় উপমার মুখে আঁধার নামল। সত্যিই তো, বিয়ের পর মেয়েদের জীবনে কতো পরিবর্তন আসে! এতোসব পরিবর্তন মেনে নিয়ে নিজের কথা আলাদা করে ভাবার সময় কোথায়?

দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে দৃতীকে উৎসাহ দিতে উপমা বলল,

“ভাইয়াকে দেখে যথেষ্ট আধুনিক, মুক্তমনা মনে হয়। আমার মনে হয়, ভাইয়া তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিবে। তুমি একবার উনাকে বলেই দেখো না।”

“সংসার কি শুধু তোমার ভাইয়াকে নিয়ে করছি? বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি আছেন। উনাদের মতামতের একটা ব্যাপার আছে। অর্ণিতকে বুঝিয়ে বলতে পারলেও আমার মনে হয় না, আমার শ্বশুরমশাইকে বুঝাতে পারব। উনি বেশ সেকেলে মানসিকতার মানুষ।”

“তবুও তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো। যদি তুমি চাও আরকি। জোর করছি না কিন্তু।”

“তোমার থেকে ভয়েস ওভারের এতো গল্প শুনেছি যে আমি নিজেও আগ্রহবোধ করছি। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। সবে নতুন সংসার শুরু করেছি। এমন কিছু করতে চাইছি না, যাতে সংসারে ঝামেলা সৃষ্টি হয়। আরও কিছুদিন যাক। আরেকটু বুঝে নেই, আরেকটু গুছিয়ে নেই। তারপর না হয় চেষ্টা করবো। ততদিন টিকে থাকুক তোমাদের ট্রু-টিউন।”

“ট্রু-টিউন এর দুয়ার সবসময় তোমার জন্য খোলা থাকবে। তোমার যখনি সুযোগ হবে, যাস্ট আমাকে জানিও। বান্দা হাজির হয়ে যাবে।”

উপমা যেভাবে দ্রুত পায়ে এসেছিল সেভাবে ফিরে গেল। অথচ দৃতী ঘরে ফিরল ক্লান্ত পায়ে৷ সারাটা দিন কাটলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে। মন থেকে কিছু চেয়েও তার পেছনে ছুটতে না পারার আফসোস থেকে জন্ম নেওয়া একটা দীর্ঘশ্বাস দৃতীকে নিস্তেজ করে দিয়েছিল।

দৃতীর পরিবর্তন নজরে এসেছে তানিয়ার। কয়েকবার জিজ্ঞাসা করল।

“তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”

দৃতী জোরপূর্বক হাসি ফোটায় মুখে অহেতুক মন খারাপকে বিদায় জানানোর তীব্র চেষ্টা করে বলে,

“শরীরটা একটু ম্যাচম্যাচ করছে। জ্বর আসবে কিনা বুঝতে পারছি না।”

“আমি আগেই বলেছি, এতো কাজ নিজের কাঁধে নিও না। তোমার কী এসবের অভ্যাস আছে! একসাথে কতোগুলো কাপড় ধুয়ে ঠান্ডা বাধিয়ে ফেললে তো। বারণ করেছিলাম, কিন্তু তুমি আমার কথা শুনলে না৷ এখন ভুগতে হচ্ছে কাকে? আমাকে না তোমাকে?”

“কিছু হবে না, মা। একটা নাপা খেলেই দেখবেন ঠিক হয়ে গিয়েছি।”

তবুও তানিয়ার দুশ্চিন্তা গেল না। সন্ধ্যায় আদা চা করে দিল। রাতের এঁটো থালাবাসনে হাত দিতে দিলো না। পানি থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখল দৃতীকে।

দৃতীর উদাসীনতা খানিকটা আঁচ করেছে অর্ণিতও। ব্যস্ত শিডিউলে দৃতীকে খুব একটা সময় দিতে পারছে না বলে, রাগ করেছে হয়তো। এই ভেবে রাতের বেলায় একটুখানি বেশি আদর দিয়ে পুষিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু তাতেও যখন দৃতীর মুখের ক্লান্তি দূর হলো না, তখন ভাবতে শুরু করল অর্ণিত।

বুকের মধ্যে গুটিশুটি মেরে আশ্রয় নেওয়া দৃতীর এলোকেশে বিলি কেটে দিতে দিতে প্রশ্ন করল,

“কী এতো ভাবছ বলো তো।”

“কই! কিছু না।”

“কিছু একটা নিশ্চয়ই তোমাকে ভাবাচ্ছে। সারাদিন কেমন উদাস হয়ে ঘুরে বেড়ালে! এখনোও মনে হচ্ছে গভীর ভাবনায় বিভোর।”

“উহু। তেমন কিছু না।”

“আমাকে বলবে না? এতোটুকুও কি বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি? পারিনি তোমার ভরসা হতে?”

অর্ণিতের বুক হতে মুখ তুলে অর্ণিতের দিকে তাকালো দৃতী। বলবে না, বলবে না করেও বলে ফেলল।

“পাঁচতলার উপমা মেয়েটার কথা মনে আছে? ওই যে মাঝেমধ্যে লিফটে দেখা হয়।”

“হুম, চিনি। ওর কি হয়েছে?”

“ওর কিছু হয়নি। ও একটা কোম্পানিতে কাজ করে। ওর কোন এক বন্ধুর কোম্পানি। ট্রু-টিউন। ভয়েস ওভার, ভয়েস আর্টিস্ট নিয়েই ওদের কাজ। উপমা আমাকে বলছিল, ওখানে ভয়েস আর্টিস্ট হয়ে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে জয়েন করতে।”

এতোটুকু বলে দৃতী থামল। অপেক্ষা করল অর্ণিতের প্রতিক্রিয়ার। দৃতীর চুলে বিলি কাটতে থাকা অর্ণিতের হাতটি একমুহূর্তের জন্যও থামেনি। সে স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইল,

“তুমি কি কাজটা করতে চাইছ?”

“এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে খানিকটা আগ্রহ জন্মেছে। তুমি অনুমতি দিলে চেষ্টা করতে চাচ্ছি।”

“এখানে আমার অনুমতির কি আছে? তোমার ইচ্ছে হলে করবে।”

“তোমার আপত্তি নেই?”

“মোটেও না। ডু হোয়াট ইউ ওয়ান্ট টু ডু। ইটস ইউর লাইফ, দৃতী।”

“কিন্তু বাবা-মা? উনারা কি ভালোভাবে নিবেন?”

“সে বিষয়ে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”

“এই ভয়টাই আমি পাচ্ছি।”

“ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মা আপত্তি করবে না। বাবা করতে পারে। আমি বাবার সাথে কথা বলে নিব। তুমি চিন্তা করো না।”

চলবে….