#প্রিয়_নীড়হারা
৯
দৃতীর সাথে তানিয়ার সম্পর্কটা আজকাল একটু বেশি গাঢ় হয়েছে। অনেকটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এতে অবশ্য দৃতীর ভূমিকা ছিল বেশি৷ শুরু থেকে সম্পর্ক জোরদারের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল দৃতী। সেই তুলনায় তানিয়ার আচরণ ছিল খানিকটা শীতল। যা দৃতীর উষ্ণ অভ্যর্থনায় ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠে৷
দৃতীর আগমনে তানিয়ার একঘেয়ে জীবন খানিক রঙিন হতে শুরু করেছে৷ ঘরবন্দী তানিয়া এখন সবাইকে লুকিয়ে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়ে দৃতীর সাথে৷ কখনো হাঁটতে বের হয়, কখনো বা মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করে, গলির মোড়ে সবজি কিনে, চায়ের কাপ হাতে আড্ডা বসায় ছাদে৷ রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় তানিয়ার।
আজ দৃতীর একটা রেকডিং আছে। সব মিলিয়ে এক দেড় ঘন্টার কাজ৷ সকালবেলা অর্ণিত ও সিরাজকে বিদায় দিয়ে ধীরেসুস্থে ঘরের বাকি কাজ গুছিয়ে এগারোটার দিকে তৈরি হতে শুরু করলো দৃতী।
চোখে কাজল আঁকতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। ছুটল তানিয়ার ঘরে৷ গোসল থেকে মাত্র বেরিয়েছে তানিয়া৷ দৃতী বলল,
“মা, চলুন আপনাকে আমার অফিসে নিয়ে যাই৷ আমি কোথায় কাজ করি দেখে আসুন।”
দৃতীর এমন হুটহাট আবদারের সাথে পরিচয় আছে তানিয়ার৷ হঠাৎ এসে বলবে, মা চলুন সামনের রেস্টুরেন্ট থেকে ফ্রাইড রাইস খেয়ে আসি৷ আজকে ভাত খেতে ভালো লাগছে না। দৃতীর এমন উড়নচণ্ডী আচরণ প্রথমদিকে বিরক্ত লাগত তানিয়ার৷ কিন্তু দৃতী কখনো একলা পাখা মেলে উড়ে যায় না। সবসময় তানিয়াকে সাথে নিয়ে উড়াল দেয়৷ তাই কিছুদিনের মধ্যেই মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়ানোর নেশা বিমোহিত করে ফেলল তানিয়াকে। ইদানীং তানিয়া নিজেও দৃতীর অহেতুক কর্মকাণ্ড বেশ উপভোগ করে।
কিন্তু দৃতীর এমন প্রস্তাবে তানিয়া আজ একটু বেশি অবাক হয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল দৃতীর পাণে।
দৃতী তাড়া দিয়ে বলল,
“ঝটপট রেডি হয়ে নিন।”
“তুমি পাগল হয়েছ? আমি তোমার অফিসে গিয়ে কি করব?”
“আমার অফিস দেখবেন। মস্ত বড় বিল্ডিং। সামনে একটা সুন্দর বাগানও আছে। ক্যাফেটেরিয়ার কফিটা দারুণ। আপনাকে খাওয়াবো আজকে।”
“তুমি ওখানে কাজ করবে আর আমি বসে বসে মাছি তাড়াবো৷ দরকার নেই, বাবা। তুমি যাও গিয়ে নিজের কাজ করে এসো। অর্ণিতের আব্বু জানলে আর রক্ষে থাকবে না।”
“কেউ জানবে না। মাত্র এক ঘণ্টার কাজ। উবার নিয়ে যাবো, কাজ শেষে একটু ঘুরেফিরে আবার উবারে চলে আসবো।”
দৃতীর জেদের কাছে বরাবরের মতো হেরে গেল তানিয়া। সত্যি সত্যি চলে গেল দৃতীর অফিসে। তানিয়ার আগমনে অফিস জুড়ে হৈ হৈ পড়ে গেল। কলিগের শাশুড়িকে পেয়ে সবাই লেগে গেল আদর আপ্যায়নে। তানিয়া ভেবেছিল দৃতী যখন রেকডিং করবে তখন সে একলা বোর হয়ে যাবে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো তার উলটো। একদল যুবক যুবতী নিজের কাজ ফেলে আড্ডা জুড়ে দিল তানিয়ার সাথে। তানিয়াও গল্পপ্রেমী মানুষ। মশগুল হয়ে রইলো আড্ডায়।
_____
ভালোয় মন্দে দেখতে দেখতে অনেকগুলো মাস কেটে গিয়েছে। জীবনের পাতায় নতুন নতুন সুখের স্মৃতি জমা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে খুব অবাক লাগে দৃতীর। অর্ণিতের মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে হয়।
আজ সারাদিন বসে বসে বিবাহিত জীবন নিয়ে ভাবছিল দৃতী। নিজের সুখে সে নিজেই বোধহয় নজর দিয়ে ফেলেছিল। তাই তো প্রকৃতির কোলে রাত নামতেই দৃতীর মুখটাও আঁধারে ঢেকে যেতে শুরু করল।
আজ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। প্রতিমাসে এই দিনে অর্ণিতের সাথে ফুচকা খেতে যায় দৃতী। আজও যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। হালকা সাজগোজ করে তৈরি ছিল দৃতী৷ অর্ণিত হাফ ডে অফিস করে বাড়ি ফিরে যথেষ্ট বিশ্রাম নিয়ে বাইরের যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল।
ফুচকা খাওয়া তো বাহানা মাত্র৷ আদতে এই সময়টুকু নিজেদের মধ্যে বিভোর থাকার সময়। খোলা আকাশের নিচে প্রাণভরে প্রিয়জনকে দেখার সময়।
রাতের খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে দৃতী বলল,
“এখানে সব রেখে গেলাম। সময় মতো ডিনার করে নিয়েন, মা।”
“সেসব নিয়ে তোমার এত ভাবতে হবে না। এমন ভাবে বলছ যেনো, তুমি আসার আগে আমি সংসার সামলাইনি।”
তানিয়ার এই খোঁচা মেরে কথা বলার স্বভাবে অভ্যস্ত হতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল দৃতীকে। শুরুর দিকে খুব মন খারাপ হতো। কিন্তু দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পর দৃতী বুঝল, তানিয়ার কথা বলার ধরণটাই এমন। বাচ্যভঙ্গীতে মাধুর্যতার অভাব।
একটা লম্বা সময় সিরাজের তিরস্কার, অপমান নীরবে সহ্য করতে করতে তানিয়ার মনে একপ্রকার তিক্ততা চলে এসেছে। ভেতরে জমেছে অপরিসীম ক্ষোভ। যা সরাসরি প্রকাশ করার সাহস নেই তানিয়ার৷ তাই কথায় কথায় দৃতীর উপর এভাবেই কিছুটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একজনের রাগ আরেকজনের উপর প্রকাশ করে মনে জ্বালা মেটায়।
তাই দৃতী এখন কিছু মনে করে না৷ তানিয়ার কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“ফিরতে দেরী হলে আপনারা ঘুমিয়ে পড়িয়েন৷”
সব গুছিয়ে দ্রুত পায়ে শোয়ার ঘরের দিকে গেল দৃতী। অর্ণিত নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে৷
পাঞ্জাবি, পায়জামা পরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল অর্ণিত৷ দৃতীকে দেখে উঠে দাঁড়ালো। তখনি বেজে উঠল অর্ণিতের মোবাইল।
অচেনা নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল অর্ণিত৷ ততক্ষণে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দৃতী। মোবাইলটা কানে চেপে ধরতে অর্ণিতের চেহারার রঙ উড়ে গেল৷ লালচে মুখ, অস্থির চোখের অর্ণিত দৃতীকে ওভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে চলে গেল বারান্দায়।
দৃতী ঠোঁট উল্টে সেখানেই দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। এক মিনিট, দু মিনিট করে প্রায় দশ মিনিট পেরিয়েছে। দৃতী বসে আছে বিছানার উপর। অস্থির চোখ বারবার চলে যাচ্ছে বারান্দার বন্ধ দরজার দিকে।
এই অসময়ে কে কল করলো? এখনি কেন তাকে কল করতে হলো? আরেকটু পড়ে কলটা আসলে কী এমন হতো? ধুর! ভালো লাগে না। কোথায় যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এভাবে বসে থাকা ভীষণ বিরক্তিকর। তবুও দৃতী চুপচাপ বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর বারান্দা থেকে ফিরে এলো অর্ণিত। তবে দৃতীর উচ্ছ্বাস কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। অর্ণিতের ছাইবর্ণ মুখটা দেখে বুক ধকধক করে উঠল। কোনো ঝামেলা হলো না তো?
দৃতী কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ক্লান্ত স্বরে অর্ণিত বলল,
“আমরা ফুচকা খেতে অন্যদিন যাই?”
এই পরিস্থিতিতে ফুচকা খাওয়ার কথা ভাবছেও না দৃতী। সদা হাস্যোজ্জ্বোল অর্ণিতের ছাইবর্ণ চেহারা দেখে দৃতীর শখ আহ্লাদ সব বিদায় নিয়েছে। সে ঝটপট দাঁড়িয়ে অর্ণিতের হাত দুটো ধরে প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেনো তোমাকে?”
“তেমন কিছু না।”
“বললেই হলো। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কে ফোন করেছিল? কি বলল?”
“অফিসের ঝামেলা। তুমি বুঝবে না। সিরিয়াস কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে। আমরা অন্যদিন যাই, ঠিক আছে?”
“সেসব পরে দেখা যাবে। আগে তুমি এখানে বসো, একটু রিলেক্স হও। পানি খাবে?”
দৃতী দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি আনলো। কড়া লিকারের চা বানিয়ে দিল। অনেকক্ষণ অর্ণিতের পাশে বসে থাকল। কিন্তু অর্ণিতের চিন্তাগ্রস্ত মুখমন্ডলে কোনো পরিবর্তন হলো না।
বাইরে যেতে নিয়েও না যাওয়ায় বেশ অবাক হলো তানিয়া। দৃতীর কাছে বারবার জানতে চাইল,
তোমরা গেলে না কেনো? কোনো সমস্যা হয়েছে? ঝগড়াঝাটি করেছো?
দৃতী কি উত্তর দিবে বুঝতে পারল না। সে তো নিজেই জানে না ঠিক কি সমস্যা হলো৷
____
একপ্রকার ঝড় আছে, হুট করে আসে। বলা নেই, কওয়া নেই একদিন রাতে হুট করে উথাল-পাথাল ঝড় এসে আত্মা পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে যায়৷ তারপর সকাল হতেই চারপাশ শান্ত, নিস্তব্ধ হয়ে রয়। প্রকৃতি হয়ে উঠে আরও স্নিগ্ধ, আরও সতেজ৷ তখন চারদিকে তাকিয়ে মনে হয়, যেনো গতরাতে ভয়াল ঝড় কোনো তান্ডবলীলা চালায়নি। সবটাই ছিল ভ্রম৷
পরদিন সকালে অর্ণিতকে দেখে এমনি মনে হয়েছে দৃতীর৷ গতরাতের মুষড়ানো মানুষটিকে সকালবেলা সতেজ, প্রাণবন্ত দেখে খুশি হবে নাকি অবাক হবে বুঝতেই পারছিল না দৃতী৷
এই মানুষটিকে দেখে কে বলবে, গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়েছে৷ মাঝরাতে আর সইতে না পেরে দৃতী নিজের ঘুম বিসর্জন দিয়ে অর্ণিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল বলেই না ঘুমাতে পেরেছিল অর্ণিত।
অন্যদিনের কথা বললেও পরেরদিনই দৃতীকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে গেল অর্ণিত। দৃতী বারবার বলল,
“দরকার নেই। একমাস ফুচকা না খেলে কিছু আসে যায় না৷ অফিসের ঝামেলা মিটিয়ে নেও৷ আমরা তারপর যাবো।”
অর্ণিত নিজ সিদ্ধান্তে অটল। জোর করে নিয়ে গেল দৃতীকে। বলল,
“আমি যখন ওয়াদা করেছি৷ বরখেলাপ করা যাবে না৷ প্রতি মাসে ফুচকা খাওয়ানো চাই, চাই।”
_____
শহরে একটু আধটু ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। লেপ বা মোটা কম্বলের দরকার হয় না। আলমারি থেকে পাতলা কম্বল বের করে একটি তানিয়ার ঘরে দিয়ে এলো দৃতী। আরেকটা বের করে রাখল নিজেদের বিছানায়।
সে রাতে অনেকদিন পর কম্বলের উষ্ণতার সাথে অর্ণিতের উষ্ণতা মিলেমিশে ভালোবাসাবাসি হলো অনেকসময় জুড়ে৷
মাঝরাতে ঠান্ডাটা যেনো আরও জেঁকে বসল। এই অসময়ে গোসলে ঢুকে বাঁকা চোখে তাকাল দৃতী। ঠান্ডা পানি ছুয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“এখন আমার ঠান্ডা লেগে গেলে তোমার খবর আছে৷”
অর্ণিতও খানিকটা ভাব নিয়ে বলল,
“এখন সব দোষ আমার, তাই না? যেনো আমি জোর করেছি।”
“করেছোই তো। প্রথম চুমুটা তুমিই তো দিলে।”
“আর তুমি যে আমার বুকে নাক ঘষছিলে।”
“তো কি হয়েছে? নাক ঘষেছি বলে তুমি আদর করতে শুরু করবে?”
“আমি তো ভেবেছি, তোমার আদর চাই। তাই ওভাবে কাছে এলে।”
“কীসের সাথে কী মিলাচ্ছো! মাথায় সবসময় দুষ্টামি ঘুরলে এমনি হয়। আবহাওয়া বদলাচ্ছে। এই সময় মাঝরাতে গোসল করলে নিশ্চিত ঠান্ডা লাগবে৷ তুমি আর আমার ধারের কাছেও আসবে না, বলে দিচ্ছি।”
“এটা কোনো কথা বললে?”
“হ্যাঁ বললাম। এটাই তোমার শাস্তি।”
“কতোদিন কাছে আসবো না?”
“এক মাস।”
“বেশি হয়ে গেল না? এক সপ্তাহ তবুও মানা যায়। কিন্তু এক মাস! অসম্ভব।”
“এক মাস মানে, এক মাস-ই।”
“ওয়েট, তোমার ঠান্ডা না লাগার ব্যস্ততা করছি।”
সেই মধ্যরাতে পা টিপেটিপে রান্নাঘরে গেল অর্ণিত। বাতি না জ্বালিয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চুলায় পানি বসিয়ে দিল। এক হাড়ি গরম পানি নিয়ে এসে হাজির হলো দৃতীর সামনে। অর্ণিতের এহেন কর্মকাণ্ডে দৃতী মিটিমিটি হাসছে।
বালতিতে গরম পানি ঢেলে দিয়ে অর্ণিত বলল,
“নেও, এখন আর ঠান্ডা লাগবে না। এবার শাস্তি মওকুফ করা হোক।”
দৃতী মুখখানা আরও গম্ভীর করে বলল,
“ঠিক আছে। এক মাস থেকে কমিয়ে এক সপ্তাহ করা হলো।”
চলবে..
#অক্ষরময়ী