প্রিয় নীড়হারা পর্ব-১১(শেষ পর্ব)

0
94

#প্রিয়_নীড়হারা

১১

দৃতীকে নিয়ে আসা হয়েছে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। সকালবেলা রাস্তা ফাঁকা ছিল বলে দ্রুত পৌঁছাতে পেরেছিল। ডাক্তার জানিয়েছেন, মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে দৃতীর। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের পর বর্তমানে দৃতী আশংকামুক্ত। আপাতত সে ধবধবে সাদা কেবিনের ধবধবে সাদা বিছানায় নীরবে ঘুমাচ্ছে৷

কেবিনের একপাশে রাখা সোফায় বসে নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে তানিয়া৷ অপরপাশে গম্ভীরমুখে বসে আছে অর্ণিত৷ দৃষ্টি তার সবুজ পোশাক পরিহিতা দৃতীর দিকে৷ যার মলিন মুখে প্রশান্তির আড়ালে চাপা দুঃখ দেখা যাচ্ছে।

কেবিন জুড়ে পায়েচারি করতে করতে সিরাজ সাহেব বলল,

“সকালবেলা কী এমন ঘটল যে মেয়েটা হুট করে হার্ট অ্যাটাক করে বসল?”

সিরাজ সাহেবের প্রশ্ন শুনে চমকালো তানিয়া৷ নিদ্রার ব্যাপারে সিরাজ কিছু জানে না। ওরা মা ছেলে মিলে এই বিষয়টির সমাধান করেছিল।

আজ সকালেও দৃতী অসুস্থ হওয়ার পর তানিয়া ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করে হতবিহ্বল অর্ণিতকে বলেছিল,

“ওমন মূর্তি মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো? মেয়েটাকে হাসপাতালে নিতে হবে৷ জলদি করো।”

তানিয়ার চিৎকারে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সিরাজ সাহেবের৷ বসার ঘরে এসে দেখল, অবচেতন দৃতীর মাথাটা কোলে নিয়ে তানিয়া কাঁদছে। রাতের পোশাক পরেই বেরিয়ে এসেছে সিরাজ সাহেব। ঘটনা কী ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।

সিরাজ সাহেবের উঁচু কণ্ঠের বিপরীতে অর্ণিত শান্ত স্বরে বলল,

“আস্তে কথা বলো, বাবা। এটা হাসপাতাল।”

অগত্যা জিঘাংসায় তালা ঝুলিয়ে সোফায় এসে বসল সিরাজ সাহেব।

_____

দীর্ঘ চব্বিশ ঘন্টা পর চোখ খুলল দৃতী। সজ্ঞানে আসলেও দৃতীর মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা গেল না। চোখের সামনে পুরো জীবনটাকে মিথ্যে হতে দেখেছে সে। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হতে হয়েছে৷ নির্বাক হয়ে গিয়েছে মেয়েটা।

দৃতীর খোলা চোখ দেখে তানিয়া হৈ হৈ রৈ রৈ করে নার্সকে ডেকে আনল। ডাক্তার এসে দৃতীর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গেল। পুরোটা সময় দৃতী শুধু ফ্যালফ্যাল করে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র দিয়ে ডাক্তার নার্স বিদায় নিলে দৃতীর পাশে বসল তানিয়া। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“এখন কেমন লাগছে?”

সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দৃতী শুকনো গলায় জানতে চাইল,

“নিদ্রা কে, মা?”

দৃতীর কণ্ঠের শীতলতা তানিয়াকে অবাক করে দিল। এর আগে দৃতী কখনো এতোটা শক্তভাবে কথা বলেনি। একটা দূর্ঘটনা মানুষের মধ্যে ভাবনাতীত পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানিয়া বলল,

“এসব আলোচনা পরেও করা যাবে। এখন তুমি বিশ্রাম নেও।”

“আমি এখনি জানতে চাই। না জানা অব্দি স্বস্তি পাচ্ছি না। চাপা টেনশন কাজ করছে। সেটা নিশ্চয়ই আমার জন্য ভালো হবে না।”

তানিয়া উঠে গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে এলো। সিরাজ আবার হুট করে চলে এলে কেলেংকারী ঘটে যাবে।

দৃতীর একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তানিয়া বলল,

“নিদ্রার সাথে অর্ণিতের পরিচয় ভার্সিটিতে। ওরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়তো। ছেলে যে প্রেম করছে সেটা আমি আন্দাজ করেছিলাম। সারাদিন মোবাইলটায় মুখ গুজে থাকত। প্রতি মুহূর্তে মেসেজে কথাবার্তা চলত। যুবক ছেলেকে শাসন করা যায় না। তাই দেখেও না দেখার ভান করে ছিলাম।
সত্যি বলতে আমি আসলে মনে মনে খুশি হয়েছিলাম বোধহয়। অর্ণিত নিজে জীবনসঙ্গী চুজ করেছে ভেবে খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। আমাকে আর ঘটা করে পুত্রবধূ খুঁজতে হবে না৷

অর্ণিতের পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর দ্রুত চাকরিটা হয়ে গেল। এরপর ও আমাকে জানালো নিজের পছন্দের কথা৷ আমি সেদিন ওর মোবাইলে নিদ্রার ছবি দেখলাম৷ একদেখায় পছন্দ হওয়ার মতো সুন্দরী মেয়ে। আমি বললাম, মেয়ের ঠিকানা দেও। প্রস্তাব পাঠাই।

অর্ণিতের মামাকে নিদ্রার পরিচয়, ঠিকানা দিয়ে বললাম, বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে। কিন্তু ছোটো, মানে অর্ণিতের মামা দুদিন পরে শুকনো মুখে হাজির হলো আমাদের বাড়িতে।

নিদ্রার সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য দিল, যা জানার পর অর্ণিতের সাথে নিদ্রার বিয়েটা আমি কিছুতেই হতে দিতে পারিনি। মূলত আমার অনিচ্ছার কারণে অর্ণিত নিদ্রার বিচ্ছেদ হয়।

এরপর আমি দ্রুত অর্ণিতের বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। যাতে ওর মুভ অন করা সহজ হয়। অর্ণিত সায় জানিয়েছিল। উপযুক্ত পাত্রীর খোঁজ চলছিল। এর মাঝে আমরা কুমিল্লা গেলাম। সেখানে তোমাকে দেখে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। অর্ণিত সম্মতি জানাতেই আমি আর দেরী করিনি৷ অর্ণিতের সাথে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এলাম তোমাকে।

কিন্তু দৃতী, আমি জানতাম না অর্ণিত এমন একটা কাজ করবে। ও আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, আমার পছন্দের মেয়ের সাথে সুখে সংসার করবে। ভুলে যাবে নিদ্রাকে।”

সাফাই শোনার আগ্রহ পাচ্ছে না দৃতী। ওর পুরো আগ্রহ নিদ্রাকে নিয়ে। তানিয়াকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“নিদ্রাকে আপনি মানা করে দিয়েছিলেন কেনো? কী এমন খুঁত ছিল ওর পরিবারের?”

তানিয়া অস্বস্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,

“নিদ্রার পরিবারে দুই বিয়ের রেওয়াজ আছে। ওদের কারোরই প্রথম বিয়ে টিকে না।”

“শুধুমাত্র এই কারণে ছেলের ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন?”

“তোমার কাছে এটা তুচ্ছ বিষয় হতে পারে কিন্তু আমার কাছে নয়। অর্ণিত আমার একমাত্র সন্তান। ওর জীবনে কোনোপ্রকার দূর্ঘটনা ঘটুক সেটা আমি কখনো চাইব না। নিদ্রার দাদুর দুই বিয়ে, বাবা, চাচা, ফুপির দুই বিয়ে। এমনকি নিদ্রার বড় ভাইয়েরও প্রথম সংসার টিকেনি। অর্ণিতের সাথে নিদ্রার বিয়ে হলে ওদের সংসারও টিকত না। আমার ছেলেটাকে ছেড়ে নিদ্রা একদিন ঠিকই চলে যেত। তখন আমার অর্ণিত কি করে সামলাতো নিজেকে? আমি মা হয়ে জেনে-বুঝে ছেলেকে এতো বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারি না। তাই কসম দিয়ে আটকেছিলাম অর্ণিতকে।”

“বিয়েটা হতে না দিয়ে ছেলের খুব উপকার করেছেন? আপনার ছেলে এখন কতোটা সুখে আছে তা নিশ্চয়ই জানা হয়ে গেছে?”

“অর্ণিত এমন ছেলে নয়। ও কখনো অন্যায় কিছু করতে পারেনা। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কিন্তু আছে৷ ওই মেয়েটা আমার ছেলেটার মাথাটা খেয়েছে। অর্ণিত না বলার সাথে সাথে নিদ্রা বিয়ে করে নিয়েছিল। কিন্তু ওই যে ওদের বংশের দোষ। প্রথম সংসারে সুখী হতে পারেনি নিশ্চয়ই। প্রথম সংসার ছেড়ে আবার ফিরে আসতে চাইছে আমার ছেলের জীবনে। কিন্তু তা আমি কিছুতেই হতে দিব না। অর্ণিতকে আটকাতে হবে। তুমি ওর বিবাহিতা স্ত্রী, তুমি আটকাবে ওকে। তোমার স্বামীর দিকে অন্য কেউ নজর দিলে তুমি তাকে বাঁধা দিবে।”

“আমি বাঁধা দেওয়ার কে? এই গল্পে আমার তো নিজেকে তৃতীয় পক্ষের একজন মনে হচ্ছে৷ অর্ণিত-নিদ্রার প্রেমকাহিনীতে ভিলেন দৃতী। আমার আগমনে নায়ক নায়িকার বিচ্ছেদ হয়েছে৷ কিন্তু দূরে গিয়েও হারিয়ে যায়নি তাদের ভালোবাসা। আজও চির অমলিন রয়েছে। ভিলেনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিয়মিত চলছে তাদের যোগাযোগ। এতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিরও মদদ রয়েছে৷ তা না হলে আমি কখনো টের পেলাম না কেনো? একই ঘরে, একই বিছানায় শুয়ে অর্ণিত অন্য একজনের সাথে কথা বলছে, অথচ আমি নির্বোধ চোখে কাঠের চশমা পরে দুনিয়াটা রঙিন দেখছিলাম।

অর্ণিত যা করেছে তা প্রকৃতির নিকট অন্যায় হলে এতোদিনে নিশ্চয়ই অন্যায়টি আমার চোখে পড়তো। পড়েনি মানে, এটা অন্যায় নয়। ভালোবাসা অন্যায় হতে পারে না। বরং ভালোবাসার পথে বাঁধা সৃষ্টি করা অন্যায়। যেটা আপনি করেছেন। তুচ্ছ কুসংস্কারকে মনে ধারণ করে অহেতুক ভয় পেয়ে অর্ণিতকে নিদ্রার থেকে দূরে যেতে বাধ্য করেছেন। কিন্তু আমি জেনে-বুঝে এমন অন্যায় করতে পারি না।
আমি সরে গেলে নায়ক নায়িকা আবার এক হতে পারবে। তাই আমি সরে যাব।”

“কীসব অলক্ষুণে কথা বলছ! তুমি কেন সরে যাবে? তোমাদের বিয়ে হয়েছে। তুমি অর্ণিতের স্ত্রী। ওই মেয়েটা কে যার জন্য তুমি হার মেনে নিচ্ছো!”

“ওই মেয়েটা অর্ণিতের ভালোবাসা। যাকে অর্ণিত মন থেকে চায়। কাগজ কলমের একটা সম্পর্কের থেকেও মনের সম্পর্কের জোর বেশি। তাইতো আপনি শত চেষ্টা করেও ওদের সম্পর্ক শেষ করে দিতে পারেননি।”

“তুমি আবেগ দিয়ে কথা বলছ। আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, দৃতী। প্রেমিকার থেকে স্ত্রীর অধিকার বেশি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা ধর্মের কাছে যাও। সবাই তোমার দিকেই রায় দিবে।”

“আমি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা ধর্মের কথা জানতে চাই না। আমার কাছে অর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ। সে কি চায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্ণিত আমাকে চায় না, সেটা আমার জানা হয়ে গেছে। আমি আর কিছু জানতে চাই না। আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন। মুক্তি দিন৷ অন্যের বিচ্ছেদের কারণ হওয়ার লজ্জা, গ্লানি বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আমি ক্লান্ত। আর পারছি না।”

_____

সবার জন্য সকালের নাস্তা আনতে বাইরে গিয়েছিল অর্ণিত। হাসপাতাল করিডোরে পা দেওয়া মাত্র নার্স জানালো, আপনার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরেছে।

দ্রুত পায়ে কেবিনের দিকে ছুটল অর্ণিত। ফিরে এসে দেখল, বিছানার একপাশে বসে আছে তানিয়া। আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দৃতীর দিকে। আর দৃতী? সে মুখে আঁধার নামিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।

অর্ণিত ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করে টেবিলে নাস্তার প্যাকেট রেখে বলল,

“মা, খাবার নিয়ে এসেছি।”

তানিয়া শুকনো মুখে অর্ণিতে দিকে চেয়ে বলল,

“দৃতী চলে যেতে চাইছে।”

অর্ণিত অবাক হয়ে জানতে চাইল,

“কোথায় চলে যাবে?”

“তোর জীবন থেকে চলে যাবে।”

অর্ণিত ভ্রু কুঁচকে দৃতীর দিকে চাইল। দৃতী তখন চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে। ওর পাশে দাঁড়িয়ে বাহুতে হাত রেখে অর্ণিত ওকে ডাকল।

“এসবের মানে কি, দৃতী? এই দৃতী?”

দৃতী ঝটকা মেরে হাতটি সরিয়ে নিল। তানিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“তোরা কথা বল, আমি আসছি।”

তানিয়া দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল। দৃতী ঝটপট চোখ খুলে তানিয়াকে বলল,

“আমার মোবাইল সহ ভ্যানিটিব্যাগটি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন, মা। আমি এখান থেকেই চলে যেতে চাইছি। ও বাড়ির আর ফিরব না। ”

তানিয়া হতাশ চোখে অর্ণিতের দিকে চেয়ে নীরবে সায় জানিয়ে বাইরে চলে গেল। তানিয়া চলে যেতেই অর্ণিত বসল দৃতীর পাশে। দৃতী ধমকে উঠল,

“এখানে বসবেন না আপনি। দূরে গিয়ে দাঁড়ান।”

অর্ণিত চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম?”

“আপনার মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না আমার। আপনার উপস্থিতি আমার অসহ্য লাগছে৷ আপনি প্লিজ এখান থেকে চলে যান।”

দাঁতে দাঁত চেপে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে অর্ণিত শান্ত স্বরে বলল,

“আমাদের কথা বলা প্রয়োজন, দৃতী।”

“আপনার সাথে আমার কোনো কথা নেই।”

“আমার আছে। নিদ্রা সম্পর্কে সবটা তোমার জানতে হবে।”

“যখন জানানোর প্রয়োজন ছিল তখন জানান নি। এখন আমি আর জানতে চাইছি না।”

“শুধু তুমি চাইলেই হবে না। সময়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে৷ হ্যাঁ সেদিন নিদ্রার সাথে কথা বলছিলাম আমি। তবে প্রতিদিন আমাদের কথা হতো না। বিয়ের পর পাঁচ ছয়বার কথা হয়েছে মাত্র। ওর স্বামীর সাথে ঠিকঠাক মানিয়ে নিতে পারছে না। প্রচন্ড মানসিক চাপে আছে। তাই সেদিন আমাকে কল দিয়েছিল। ওই যে আমরা ফুচকা খেতে যাওয়া ক্যান্সেল করলাম, সেদিন প্রথম আমাদের আবার কথা হলো। ওর মানসিক সাপোর্ট দরকার ছিল। আমি চেয়েও ওকে এড়িয়ে যেতে পারিনি৷ পারিনি মুখের উপর কল কেটে দিতে।”

সেদিন কতো নিখুঁত অভিনয় করে অর্ণিত বলেছিল, অফিসে ঝামেলা হয়েছে৷ আর দৃতী বোকার মতো সেটা বিশ্বাস করে সারারাত অর্ণিতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। অর্ণিতের অস্থিরতায় অস্থির হয়েছে, অর্ণিতের কষ্টে কষ্ট পেয়েছে। সেইসব মুহূর্তের কথা মনে করে মেজাজ বিগড়ে গেল দৃতীর।

“আমি আপনার কাছে কৈফিয়ত চাইছি না। কোনো অজুহাত শুনতে চাইছি না। আপনাকে আপনার ভালোবাসা কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। আর কোনো মিথ্যে বলার দরকার নেই আপনার।”

“ছোট একটা ঘটনাকে টেনেহিঁচড়ে অযথা বড় করো না, দৃতী। কোথায় যাবে তুমি? কেনো যাবে?”

ছোট ঘটনা? এতো বড় ধোঁকা দেওয়ার পরেও বড় মুখ করে বলছে দৃতী অযথা ঝামেলা করছে! রাগে উন্মাদ হয়ে উঠল দৃতী। মাথার নিচে রাখা বালিশটা তুলে অর্ণিতের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,

“আমি কোথায় যাবো সেটা আমার ব্যাপার। আপনি বের হোন এখান থেকে। দূর হোন আমার চোখের সামনে থেকে।”

বালিশ ছুড়তে গিয়ে দৃতীর হাত থেকে ক্যানোলা খুলে গিয়েছে। ব্লাড আসতে শুরু করেছে৷ তা দেখে অর্ণিত অস্থিরভাবে এগিয়ে গেলো দৃতীর দিকে। তাতে আরও ক্ষেপে গেল দৃতী। হাতের কাছে যা কিছু পেল তাই ছুড়ে মারল অর্ণিতের দিকে। হুড়োহুড়িতে ব্লাড প্রেশার পরিমাপক যন্ত্রে দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগল সংখ্যা। তীব্র শব্দে জানান দিতে থাকল হৃদ স্পন্দনের ঊর্ধ্বগতি।

দৃতীর শ্বাসে যখন টান পড়তে শুরু করল, তখন হুশ ফিরল অর্ণিতের। রাগে, ক্ষোভে, হতাশায় দৃতীর অসুস্থতার কথা সে ভুলতে বসেছিল। স্মরণ মাত্র থেমে গেল সে।

“দৃতী, রিলেক্স। শান্ত হও। হার্টবিট বাড়ছে। আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।”

কিন্তু দৃতী কোনো শাসন বারণ মানার মতো অবস্থায় নেই। বাধ্য হয়ে ইমার্জেন্সি বাটন চাপতে হলো অর্ণিতকে।
ডাক্তার নার্স ছুটে এসে আবারও দৃতীকে নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করে দিল।

____

দৃতীকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। অর্ণিত ডাক্তারের সাথে দেখা করে কেবিনে ফিরে এলো। তানিয়া উৎকণ্ঠা সহকারে অপেক্ষা করছিল। অর্ণিতকে দেখে একপ্রকার ছুটে এসে জানতে চাইল,

“ডাক্তার কি বলল?”

“দৃতীর মানসিক অবস্থা খুবই নড়বড়ে। স্ট্রেস থেকে দূরে রাখতে বলেছে। সামান্যতম মানসিক চাপ বিপদের কারণ হতে পারে। এদিকে এই মেয়ে অহেতুক জেদ ধরে বসে আছে। নিজের বাড়িঘর ছেড়ে কোথায় যেতে চাইছে ও? অবুঝের মতো করছে৷ এই মুহুর্তে জোরও খাটাতে পারছি না। ডাক্তার স্পষ্ট বলে দিয়েছে, কোনোপ্রকার মানসিক চাপ যাতে দেওয়া না হয়। ”

“এখন কি করবে?”

“আমি জানি না, মা। আমার মাথা কাজ করছে না।”

“দৃতীর বাড়িতে খবর দিবো?”

“কি বলবে? মেয়ে অসুস্থ তাড়াতাড়ি আসুন। কেনো শুধু শুধু টেনশন দিতে যাবে? দৃতী সুস্থ হোক। তারপর জানানো যাবে।”

“আচ্ছা ও যখন চাইছে তখন কয়েকটা দিন না হয় থাকুক নিজের মতো। বাপের বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসুক। রাগ পরে গেলে তুমি গিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিয়ে এসো।”

সপ্তাহখানেক পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল দৃতী। শুধু ভ্যানিটিব্যাগ সঙ্গে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তানিয়া আস্ত একটা লাগেজ গুছিয়ে দিয়েছে। এই কাপড়ে দশ বারোদিন অনায়াসে বাবার বাড়িতে কাটিয়ে দিতে পারবে দৃতী।

লাগেজ দেখে সিরাজ সাহেব বলল,

“এটা কার লাগেজ?”

তানিয়া ফিসফিসিয়ে বলল,

“দৃতীর।”

“এই শরীর নিয়ে আবার কোথায় যাবে?”

“বাবার বাড়ি।”

“এই অসুস্থ শরীরে কুমিল্লা যাবে! না করে দেও। এখন যাওয়ার দরকার নেই। পরে কখনো যাওয়া যাবে।”

“অর্ণিতের সাথে রাগ করে চলে যাচ্ছে।”

“কী আশ্চর্য! এটা রাগারাগি করার সময় হলো? কি নিয়ে রাগ করেছে?”

“তা জানি না৷ তবে বড় রকম ঝগড়াঝাটি হয়েছে।”

“স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়াঝাটি হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে বাবার বাড়ি যেতে হবে? কথায় কথায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া আবার কেমন স্বভাব! এসব আমাদের পরিবারে চলবে না। বলে দেও তোমার পুত্রবধূকে।”

পাশ থেকে অর্ণিত গম্ভীরস্বরে বলল,

“আমার স্ত্রী আমার অনুমতি নিয়েই যাচ্ছে। তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি। আমাদের দাম্পত্য জীবনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করো না।”

সব গুছিয়ে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়ালো দৃতী। অনেকদিন পর সূর্যের আলো গায়ে মাখতে ভালো লাগছে। পাশ থেকে অর্ণিত মৃদুস্বরে বলল,

“গাড়িতে উঠো। তোমাকে কুমিল্লার বাসে তুলে দিয়ে আসি।”

লাগেজের হাতলে হাত রেখে দৃতী সরাসরি তাকাল অর্ণিতের দিকে। স্পষ্টভাবে বলল,

“নো থ্যাংকস। তার প্রয়োজন হবে না। আমি কুমিল্লা যাচ্ছি না।”

অর্ণিত অবাক হয়ে শুধালো,

“তাহলে কোথায় যাবে?”

“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। আপনি কোথায় যাবেন, আপনার গন্তব্য কি সেটা আপনার জানা থাকলেই হবে। আমারটা আমাকে ভাবতে দিন।”

অর্ণিত অবাক হয়ে দৃতীর শান্ত মুখখানার দিকে চেয়ে রইল। দৃতী অবশ্য কারো দিকে ফিরে চাইল না। বছর ঘুরে আরেক শীতের সকালে সুখ স্মৃতিভরা সংসারের মায়াজাল ছেড়ে পা বাড়ালো সামনে।

সকালবেলা শহরের রাস্তাঘাটে তখনো বাস, রিক্সার কোলাহল শুরু হয়নি। পিচঢালা রাস্তায় লাগেজ টানতে টানতে হেঁটে চলে যাচ্ছে দৃতী। অর্ণিতের বড্ড ইচ্ছে হলো দৃতীর পেছন পেছন হাঁটার। কিন্তু পরিস্থিতির নিকট অর্ণিতের বাঁধা পড়ে আছে। তবে অর্ণিত জানে, দৃতীকে সে হারিয়ে যেতে দিবে না। শীতের কুয়াশার সাধ্য নেই দৃতীকে লুকিয়ে ফেলার, অর্ণিতের চোখের আড়াল করার।

রৌদ্রজ্বল কোনো এক সকালে সে ঠিকই খুঁজে নিবে দৃতীকে। হাত রাখবে দৃতীর হাতে। পাশে দাঁড়িয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবে অনেকটা পথ। এ শুধু সময়ের অপেক্ষা।

আসন্ন ভবিষ্যতকে আবার আলোকিত করতে আজ কুয়াশার গভীরে হারিয়ে যেতে দিল দৃতীকে।

অসমাপ্ত
#অক্ষরময়ী