পারমিতা পর্ব-০৩

0
79

#পারমিতা
#পর্ব_৩
#লেখিকা_Nabila_Ahmed

–যেই ছেলের সাথে….যেই ছেলের সাথে ও পালিয়েছে।
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে অরিয়ন।

পারমিতা কোনো উত্তর দিলো না।

–জবাব দে পরী।
পারমিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে চেচিয়ে বলে অরিয়ন।

–আপু পালায় নি, আপু পালায় নি।
পাগলের মতো বার বার বলতে থাকে পারমিতা।

–পরী, দেখ আমাকে।
অসহায়ের মতো বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে মুখ উঁচু করে অরিয়নের দিকে তাকায় পারমিতা। চোখ লাল হয়ে আছে অরিয়নের, তবে কি কান্না করেছিলো অরিয়ন? নাকি রাগে?? কেমন যেন লাগছে অরিয়নকে এখন দেখতে,অথচ সকালেও কি সুন্দর লাগছিলো দেখতে। অরিয়নের চেহারা দেখতেই হঠাৎ করে পারমিতার বুকের বা পাশে কেমন যেন চিনচিন ব্যাথা অনুভব করতে শুরু করেছে।

–তুই জানিস আমি আফরিনকে কতো ভালোবাসি।
ধীরে ধীরে শান্ত গলায় বলে অরিয়ন।

অরিয়নের কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে পারমিতা। কে জানেনা যে অরিয়ন আফরিনকে ভালোবাসে? তাদের ভালোবাসা সম্পর্কে সবাই অবগত।

–তুই কি চাস না আমি ভালো থাকি?? তুই কি চাস না তোর অনিয়ন ভাইয়া তার ভালোবাসার মানুষকে খুজে পাক??
পারমিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে অরিয়ন।

অরিয়নকে পারমিতা যতবার অনিয়ন বলে ডেকেছে ততোবার হয় মিথ্যে রাগ আর না হয় হাসি দেখতে পেয়েছে কিন্তু আজ, আজ যখন অরিয়ন নিজের মুখেই কথাটা বললো তখন যেন শুধু অসহায়ত্ব আর ব্যর্থ প্রেমিক ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না পারমিতা।

আবারও মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে পারমিতা।

–দেন হেল্প মি পরী, হেল্প মি টু ফাইন্ড হার।
ও…ও কি কিছু নিয়ে আমার সাথে রাগ করেছিলো? আমি কোনো ভুল করেছিলাম??
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–না না, আপু…
কথাগুলো যেন বার বার আটকে আসছে পারমিতার।

–আপু, আপু বলেছিলো এটা দুষ্টামি..আমাকে বলেছে আপু কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে..কিন্তু.. কিন্তু কেনো আসলো না, আমি তা জানিনা।
কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলে পারমিতা।

–তাহলে কি সত্যি কোনো ছেলের সাথে..
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো অরিয়ন।

কথাটা বলতেই যেন এক তীব্র ঘৃণা আর জেলাসি ফুটে উঠলো অরিয়নের চোখে। আফরিন আর অন্য কোনো ছেলের সাথে! তা যেন মানতেই পারছে না অরিয়ন।

–না না, আপু…আপু কখনো এরকম করবে না।
নিজের চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে পারমিতা।

–তাহলে ও কোথায়? ও আসছে না কেনো? কেনো বুঝতে পারছে না ওর আফনান ওর জন্য পাগল হয়ে আছে। তুই কল কর অকে, ও আমার সাথে রাগ করেছে কিছু নিয়ে, আমার কল ধরছে না। তুই কল কর, তোর কল ধরবে।
তাড়াতাড়ি করে বিছানার উপর থেকে পারমিতার মোবাইলটা নিয়ে তা পারমিতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে অরিয়ন।

“কি পাগলের মতো বলছো তুমি?? রাগ করলে কী এতোটাই রাগ যে বিয়ের দিনে ৪ টা ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও আসবে না?”মনে মনে ভাবে পারমিতা। বাড়ির প্রতিটা মানুষ আফরিনকে অনবরত কল করেই গেছে টানা ২ টা ঘন্টা কিন্তু অপর পাশ থেকে মোবাইল বন্ধ ছাড়া আর কিছুই জানতে পারেনি কেউ।

–আমার…আমার মনে হয় আপুর…আপুর কোনো বি..

–ভাইয়া?? ভাইয়া??
পারমিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজার অপর পাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠে।

দরজায় নক করতে শুনে তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে অরিয়ন।

–কি হয়েছে??
প্রশ্ন করে অরিয়ন।

–আইজিপি আংকেল এসেছে, তাড়াতাড়ি আয়।
অপর পাশ থেকে উত্তর আসে।

কথাটা শুনেই অরিয়ন আর এক মিনিট অপেক্ষা করলো না। সাথে সাথেই রুম থেকে বের হয়ে যায়।

রুমের ভেতর প্রবেশ করে আরিয়ান। হাবিব চৌধুরীর ২য় সন্তান আরিয়ান আবরার চৌধুরী। লম্বায় ৬ফুট ১ ইঞ্চি। দেখতে ঠিক বড় ভাইয়ের মতো সুদর্শন হয়েছে। বর্তমানে এম.বি.এ করছে।

ভেতরে প্রবেশ করেই এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পারমিতার দিকে এগিয়ে যায় আরিয়ান। পারমিতা, আরিয়ানের পারমিতা। পারমিতার জন্য অনুভূতি বুঝতে আরিয়ানের বেশিদিন লাগেনি। বুঝতে পেরেছে এই ছোট্ট পারমিতাকে আরিয়ান পছন্দ করে। সেই পারমিতা আজ বউ সেঁজে দাঁড়িয়ে আছে আরিয়ানের সামনে কিন্তু নিজের বউ হিসেবে না বড় ভাইয়ের বউ হিসেবে।

কাঁদতে থাকা পারমিতার সামনে আরিয়ান আসতেই জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে পারমিতা।

–আরিয়ান ভাইয়া, আমি সত্যি বলছি আমি এসবের কিছু জানিনা। আপু..আপু বলেছিলো আপু দুষ্টামি করছে।

–আপুর আবার কোনো বিপদ হলো না তো? এখনো…এখনো বাসায় ফিরে আসলো না।
আরিয়ান থেকে একটু সরে এসে চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে পারমিতা।

–তুই চিন্তা করিস না, আফরিন ভাবিবে ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আইজিপি আংকেল এসেছে, দেখবি আফরিন ভাবি চলে আসবে।
পারমিতার মাথায় হাত রেখে বলে আরিয়ান।

–সত্যি বলছো?
বলে পারমিতা।

–হ্যাঁ। আমি এখন যাই। তুই কাপড় চেঞ্জ করে নিচে আয়।
কথাটা বলেই আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করলো না আরিয়ান।

“কাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে আয়” কাপড় পাবে কোথায় পারমিতা? এই বাড়িতে মেয়ে বলতে অরিয়নের মা আনিকা চৌধুরীই আছে। বাড়িতে আসার সময় শুধুমাত্র আফরিনের কাপড় নিয়ে এসেছে সবাই।

ধীরপায়ে হেটে বিশাল আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় পারমিতা।
আফরিনের কোনো কাপড় পাবার আশায় আলমারি খুলতেই যেন বুকের কষ্টটা দ্বিগুণ হয়ে গেলো। সামনের বিশাল আলমারি জুরে শুধু নতুন নতুন জামা কাপড় ঝুলিয়ে রাখা আছে। এসব আফরিনের নয়, আফরিনের সব কিছু যে পারমিতার খুন চেনা। সব কিছু অরিয়ন আফরিনের জন্য নতুন করে কিনেছে তা বুঝতে আর বাকি রইল না পারমিতার।

“কোথায় তুই আপু?? সত্যি কি তুই কাউকে ভালোবেসে ফেলেছিস?” মনে মনে ভাবে পারমিতা। তাড়াতাড়ি নিচে যেতে হবে ভেবে আলমারি থেকে একটা সিম্পল থ্রি পিস সেট তুলে নেয় পারমিতা।

ওয়াশরুম জামা গায়ে বেড়িয়ে এসেছে পারমিতা। পরনের জামা লেহেঙ্গার মতোই বড় হয়েছে তাও আর কিছু না দেখেই তাড়াতাড়ি করে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে পারমিতা। এই বাড়ির আনাচেকানাচে সব কিছুই পারমিতার চেনা। ছোটকাল থেকেই বহুবার এসেছে এই বাড়িতে।
চট্টগ্রাম শহরের দু প্রান্তে থাকে দু পরিবার। যেখানে ২ নং গেট থাকে হাবিব চৌধুরী সেখানে হালিশহর থাকে ওয়াহিদ চৌধুরী।

পারমিতা তাড়াতাড়ি করে সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখতে পায় পুলিশের সাথে তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেড়িয়ে যায় অরিয়ন।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে মায়া চৌধুরী,কান্না করতে থাকা মায়া চৌধুরী একটু পর পর টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছছে। তার পাশেই বসে তাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে আনিকা চৌধুরী। হাবিব চৌধুরী, ওয়াহিদ চৌধুরী ও আরিয়ান মিলে এক পাশে দাঁড়িয়ে নিজেরা কথা বলছে।

সিড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পারমিতাকে প্রথমেই খেয়াল করেন আনিকা চৌধুরী। পারমিতাকে দেখতেই যেন চেহারা থেকে সব ধরনের মায়া, কামলতা দূর হয়ে গেলো। ভ্রু কুচকে, দাঁতে দাঁত চেপে এসে হাজির হয় পারমিতার সামনে। আনিকা চৌধুরীকে উঠে যেতে দেখে পারমিতার দিকে চোখ যায় মায়া চৌধুরীর।

–সব দোষ এই মেয়েটার। আমি নিশ্চিত আফরিনকে এই বুদ্ধি এই মেয়েটা দিয়েছে।
পারমিতার দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে বলে আনিকা চৌধুরী।

–এই মেয়ে, বলো আফরিন কোথায়? আফরিনকে এই বুদ্ধি কেনো দিয়েছো বলো??
পারমিতার ডান বাহু ধরে চেচিয়ে বলতে থাকে আনিকা চৌধুরী।

আনিকা চৌধুরীর চেচামেচি শুনে সকলের দৃষ্টি যায় পারমিতার দিকে। কেউ কিছু বলার আগেই আনিকা চৌধুরীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় মায়া চৌধুরী।

–কি করছেন এসব আপা?? অকে ছাড়ুন।
পারমিতাকে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলে মায়া চৌধুরী।

পারমিতার চোখ দিয়ে পানি পড়া যেন বন্ধই হচ্ছে না। মায়া চৌধুরীকে একটু শক্ত করে ধরে রেখে স্থির থাকার চেষ্টা করে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যাবে।

–তুমি জানোনা মায়া, এই মেয়েটা আফরিনকে হিংসা করে। একটা অলুক্ষনে মেয়ে ও।

–আপা, আপনি ভুলে যাচ্ছেন মিতা আমার মেয়ে। অকে নিয়ে এসব বলবেন না।

–মেয়ে বললেই মেয়ে হয়ে যায় না মায়া। এই মেয়েটার জন্য আমার ছেলেটা আফরিনকে হারিয়েছে, জীবনটা শেষ হয়ে গেছে আমার ছেলের।

–আনিকা চুপ করো তুমি।
আনিকা চৌধুরীর সামনে এসে বলে হাবিব চৌধুরী।

–হাবিব তুমি..

–জীবন কি একাই অরিয়নের শেষ হয়েছে?? মিতার হয়নি?? আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন অরিয়নের সাথে বিয়ে হয়েছে মিতার। আমি,আপনি আর সবাই এটা ভালো করেই জানে আফরিন ফিরে আসলে অরিয়ন ছেড়ে দিবে মিতাকে। আমার মিতার জীবনটা শেষ মাঝখান থেকে।
রাগ হয়ে বলতে থাকে মায়া চৌধুরী।

–মায়া তুমি..

–না ভাইয়া, আপনি আর ওয়াহিদ কাজটা ঠিক করেন নি। আমার এক মেয়ের ভুলের মাশুল আমার অন্য মেয়ে দিবেনা। একবার ভেবেছেন এখন আফরিন ফিরে আসলে কী হবে??
কথাগুলো বলতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে মায়া চৌধুরীর।

–আমার মেয়েটার বয়স ১৮ হয়েছে মাত্র। এর মধ্যে ডিভোর্সির ট্যাগ লাগিয়ে দিবেন আপনারা।
আপ…

–মায়া চুপ করো। তুমি ভালোই জানো আমরা হুট করে এমন ডিসিশন কেনো নিয়েছি।
মায়া চৌধুরীকে সান্ত করার জন্য বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–যত বড়ই কারণ হোক, আমার মেয়ের জীবন থেকে বড় না ওয়াহিদ। তুমি অরিয়নকে চিনো না?? চিনো না তুমি অকে?? আফরিন ফিরে আসুক বা না আসুক ও কোনোদিনও মিতাকে মেনে নিবে না।

–কিহ? কোথায়??
হঠাৎ করে মোবাইলে বলে উঠে আরিয়ান।

–কি হয়েছে??
আরিয়ানের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে হাবিব চৌধুরী।

–আচ্ছা আমরা এক্ষুনি বের হচ্ছি।
কথাটা বলেই কল কেটে দেয় আরিয়ান।

–কি হয়েছে বল..কোথায় যাবো??
চিন্তিত হয়ে বলে ওয়াহিদ চৌধুরী।

–আফরিন ভাবির খোজ পাওয়া গেছে।

চলবে…..