#পারমিতা
#পর্ব_৪
#লেখিকা_Nabila_Ahmed
–আফরিন ভাবির খোজ পাওয়া গেছে।
–কোথায়??
প্রশ্ন করে চিন্তিত ওয়াহিদ চৌধুরী।
–কুমিল্লা।
জবাব দেয় আবরার ( আরিয়ানের আরেক নাম)।
–কুমিল্লা!!
অবাক হয়ে বলে উঠে মায়া চৌধুরী।
–বিয়ের দিন ও কুমিল্লা গিয়ে বসে আছে, তাহলে..তাহলে কি সত্যি কোনো ছেলের সাথে।
কথাটা বলে উঠে ওয়াহিদ চৌধুরী।
–আমাদের হাতে সময় কম,ভাইয়া রওয়ানা হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি চলো।
সবার দিকে তাকিয়ে বলে আবরার।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ চল।
কিছুক্ষণ এর মধ্যেই সবাই গাড়িতে করে রওয়ানা হয়েছে কুমিল্লা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্যে আফরিনকে ফিরিয়ে আনা, উদ্দেশ্য এমনটা করার কারণ জানা।
*************
হাইওয়ে ধরে গাড়ি চলতে শুরু করেছে। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে পারমিতা। ৬ ঘন্টা, মাত্র ৬ ঘন্টার মধ্যে পারমিতার জীবনটা কীভাবে পরিবর্তন হয়ে গেলো তা যেন অবিশ্বাস্য লাগছে পারমিতার কাছে।
❝পারমিতাকে তোর বিয়ে করতেই হবে❞ রাগন্ত হাবিব চৌধুরী বলে অরিয়নকে।
❝আমি আফরিনকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না বাবা ❞ জানিয়ে দেয় অরিয়ন।
❝আফরিন ফিরবে না, চোখ খুলে সত্যিটা দেখ❞বলে হাবিব চৌধুরী।
❝ফিরবে ❞বলে অরিয়ন।
❝ফিরবে না, দু ঘন্টা হয়ে গেছে কিন্তু পুলিশ অকে কোথাও খুজে পাচ্ছে না।❞অরিয়নের কাছাকাছি গিয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
❝না ফিরলে আমি অপেক্ষা করবো, অপেক্ষা করবো আফরিন যতোদিন ফিরে না আসে ততোদিন❞গম্ভীর সুরে জানায় অরিয়ন।
❝ আর আজ যে আমার সম্মান নষ্ট হবে?? বিদেশ থেকে ইনভেস্ট করতে যাদের দাওয়াত করে এনেছি তাদের সামনে মুখ দেখাবো কীভাবে আমি?? আমার তিলে তিলে গড়ে তোলা সব কিছু নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে❞ হতাশ হয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
❝কিছুই হবে না বাবা। সবাইকে বুঝিয়ে বললেই আমাদের সিচুয়েশন বুঝতে পারবে❞ হাবিব চৌধুরীর হাত ধরে বলে অরিয়ন।
❝সবাই আমার পিছনে পিছনে হাসবে অরিয়ন, আমার সাথে কম্পিটেশন করা লোকেরা এটার সুযোগ নিয়ে আমার বিপক্ষে কাজ করবে।❞
❝তুই পারমিতাকে বিয়ে করে নে অরিয়ন❞অনুরোধ করে বলে অরিয়ন।
❝আই এম সরি বাব বাট ক্যান নট ডু ইট❞মাথা নিচু করে মন খারাপ করে বলে অরিয়ন।
❝তাহলে তোকে আমি এই সম্পত্তি থেকে তেজ্য করবো❞ হঠাৎ করে বলে উঠে হাবিব চৌধুরী।
❝আফরিনের প্রতি আমার ভালোবাসা তোমার এই বিশাল সম্পত্তি থেকেও বেশি বাবা। যাই করো আমি আফরিনের সাথে বেইমানি করতে পারবো না❞ নিজের ডিসিশন জানিয়ে দেয় অরিয়ন।
–মিতা??
–মিতা??
–হুম মা??
মায়া চৌধুরীর ডাক শুনে ঘোর কাটে পারমিতার।
–বৃষ্টি তোর গায়ে পড়ছে, ধ্যান কোথায়??
মিতার মাথায় হাত রেখে বলে মায়া চৌধুরী।
–কোথাও না। এমনিতেই ভালো লাগছিলো তাই।
মৃদু এক হাসি দিয়ে বলে মিতা।
–যা হয়েছে তাতে তোর কোনো দোষ নেই, নিজেকে দোষারোপ করিস না।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে মায়া চৌধুরী।
কথাটা বলতেই মায়া চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা।
–আমি যদি তখন রাজি না হতাম তাহলে হয়তো কিছুই হতো না মা।
জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে পারমিতা।
–হয়তো, কিন্তু তাতে তোর কোনো দোষ নেই। তুই তো তোর বোনের কথা শুনেছিলি।
পারমিতার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে মায়া চৌধুরী।
আফরিনের টেনশন প্রতিনিয়ত যেন মরণ যন্ত্রণা দিচ্ছে মায়া চৌধুরীকে, তাও ভালোটার আশা করে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে।
–আপু…আপুকে আমরা ফিরে পাবো তাই না?
মায়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে পারমিতা।
–হ্যাঁ। দেখবি ঠিক তোর বাবা অকে খুজে বের করবে।
কথাটা বলতেই যেন চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলো মায়া চৌধুরীর।
–তাই যেন হয়।
কথাটা বলেই সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে পারমিতা।
************
কুমিল্লা বিবিরহাট বাজারের সামনে গাড়ি এসে থেমেছে। জানালা দিকে দোকানের সাইনবোর্ডের উপর জায়গার নামটা দেখতে পায় পারমিতা।
–এখানে কেনো মা?? এখানে আপু আসবে কি জন্য??
প্রশ্ন করে পারমিতা।
–বুঝতে পারছি না কিছু।
বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে মায়া চৌধুরী।
তাড়াতাড়ি করে সবাই গাড়ি থেকে নামতেই কিছুটা দূরে ৮/১০ জন পুলিশকে দেখতে পায় সবাই।রাস্তার এক পাশে আফরিনের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। পুলিশের সাথেই দাঁড়িয়ে আছে অরিয়ন। দূর থেকে অরিয়নের চেহারাটা ঠিক মতো দেখতে পারছে না পারমিতা তবে অরিয়নকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না পারমিতার।
গাড়ি থেকে নেমেই সবাই তাড়াতাড়ি করে অরিয়নের কাছে চলে যায়। পারমিতার পা যেন বরফ হয়ে রইল, চাইলেও হাটতে পারছে না। অরিয়নের কাছে যেতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মায়া চৌধুরী। ওয়াহিদ চৌধুরী জড়িয়ে ধরে মায়াকে।
“তবে কি আপুর এক্সিডেন্ট??” মনে মনে ভাবে পারমিতা।
–যেমন ভাবছিস তেমন কিছুই না।
পেছন থেকে বলে উঠে আবরার।
আবরারের কথা শুনে পেছনে ফিরে তাকায় পারমিতা। পারমিতাকে দেখে মৃদু এক হাসি দেয় আবরার।
–চল।
কথাটা বলেই পারমিতার হাত ধরে সবার দিকে হাটতে থাকে আবরার।
–আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না এসব।
বলে হাবিব চৌধুরী।
–আফরিন এমন কিছু করবে তা ভাবতেও পারছি না।
আনিকা চৌধুরী বলে।
–আমরা ভেবেছিলাম ও হয়তো রেগে আছে বা কোনো বিপদে পড়েছে।
কান্না করতে করতে বলে মায়া চৌধুরী।
পারমিতা কাছাকাছি আসতেই কথাগুলো শুনতে থাকে। গাড়ির ভেতরে উঁকি দিয়ে আফরিনকে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু গাড়িতে আফরিনের পরনের জামা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না পারমিতা। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। অরিয়ন রোবটের মতো এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারো কোনো কথা বা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না।
–কি হয়েছে??
সবার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে পারমিতা।
–আপু কোথায়??? গাড়ি এখানে কেনো??
ঘটনা জানার জন্য একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে মিতা।
কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই যেন মিতাকে দেখে চুপ করে রইল।
–আমরা সন্দেহ করছি আফরিন চৌধুরী তার প্রেমিকের সাথে এখান দিয়ে বর্ডার পার করে ভা*রত চলে গিয়েছে।
একজন পুলিশ বলে উঠে মিতার উদ্দেশ্যে।
কথাটা শুনতেই সবার দিকে অবাক হয়ে তাকায় মিতা। অরিয়ন দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে তা চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কথাটা শুনতেই মায়া চৌধুরী আরও বেশি কান্না করতে লাগলেন। ওয়াহিদ চৌধুরী লজ্জায় পারছে না মুখ কোথাও লুকিয়ে রাখতে। অন্যদিকে হাবিব চৌধুরী নিজের কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আনিকা চৌধুরী দৌড়ে গিয়ে অরিয়নের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন।
–কি আজেবাজে বলছেন এসব, আপু এরকম কখনোই করবে না।
রাগ হয়ে বলে মিতা।
–সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে আফরিনের গাড়িতে একজন ছেলে আছে। গাড়ি পাওয়া গেছে কুমিল্লা বর্ডারের সাথে আর এখানে তাদের দুজনের মধ্যে একজন ও নেই।
পুলিশের লোকটা আবারও বলে।
–বাবা, ইনি কি সব বলছে এগুলা??
ওয়াহিদ চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলে মিতা।
–উনারা কি দেখেছে আমি জানিনা কিন্তু এসব..এসব সত্যি নয় বাবা। মা বিশ্বাস করো আমার কথা..আপু এরকম কখনো করতেই পারে না।
অশ্রুসিক্ত চোখে বলতে থাকে মিতা।
মিতার কথা শুনে মায়া চৌধুরীর কান্না যেন আরও বেড়ে গেলো।
–মা তুমি আমাকে বিশ্বাস করো..আপু এরকম কিছুই করেনি..কো…
–না করলে আফরিন কোথায়??
গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে অরিয়ন।
–ও যদি পালিয়েই না যায় তাহলে কোথায় গেলে ও?? সিসিটিভিতে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে ও নিজের ইচ্ছায় হাসতে হাসতে ছেলেকে গাড়িতে উঠিয়েছে।
আফরিন আর অন্য কারো সাথে? কথাটা বলতেই যেন অরিয়নের চেহারা পালটে গেলো। তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছে তবে এই ঘৃণা আফরিনের প্রতি নয়, আফরিনের সাথে থাকা ছেলের প্রতি।
–অরিয়ন ভাই…
–শাট আপ পরী। শাট.আপ।
চেচিয়ে বলে অরিয়ন।
অরিয়নের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে মিতা।
–শান্ত হ অরিয়ন। মাথা খারাপ করিস না।
অরিয়নের কাধে হাত রেখে বলে আনিকা চৌধুরী।
–তুই যদি তখন এসব করতে রাজি না হতি তাহলে আমার আফরিন আজ আমার কাছে থাকতো। কিন্তু না, বাচ্চাদের মতো তোর এসব করতে হলো।
কথাটা বলেই মিতার সামনে নিয়ে দাঁড়ায় অরিয়ন।
–আমি তো শুধু আপু…আপুর কথা..রাখছিলাম।
আমতা আমতা করে বলে মিতা।
–তোর বাচ্চামি আর তোর কথা রাখা আমার জীবন থেকে আফরিনকে কেড়ে নিয়েছে।
কথাটা বলেই সবাইকে রেখেই নিজের গাড়িতে উঠে চলে যায় অরিয়ন।
–আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়েটা একটা অলক্ষী…মেয়েটা শুধু সবার ক্ষতি ছাড়া কিছুই করতে পারেনা। প্রথমে আ…
–চুপ করো আনিকা।
চেচিয়ে বলে হাবিব চৌধুরী।
–হ্যাঁ। আমাকে শুধু চুপ করিয়েই রাখতে পারবে।
কথাটা বলে আনিকা চৌধুরী ও গিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ে।
–আফরিন কেনো এমন করলো ওয়াহিদ?? কেনো ও আমাদের ওর পছন্দের কথা না বলে এভাবে পালিয়ে গেলো??
ওয়াহিদ চৌধুরীর বুকে মাথা রেখে কান্না করতে থাকা মায়া চৌধুরী বলে।
–হয়তো ভেবেছিলো অরিয়ন কিছুতেই রাজি হবে না কিন্তু আজ ও আমাদেরকে সবার চোখে ছোট করে দিলো মায়া। আমরা কি বাবা-মা হিসেবে এতোটাই খারাপ।
কথাটা বলত্ব বলতে ওয়াহিদ চৌধুরীর চোখ দিয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো যা মিতার নজরের আড়াল হলো না।
মা – বাবাকে এতো লজ্জিত আর ভেঙ্গে পড়তে কখনো দেখেনি মিতা। তাদের কোনো ছেলে না থাকলেও সব সময় আফরিন আর মিতাকে নিয়ে গর্ববোধ করেছেন তারা। আর এখন?? এখন সন্তান হিসেবে কি পাওনা দিলো তাদের?? অপরাধবোধ যেন ক্রমাগত গ্রাস করে নিচ্ছে মিতাকে।
–চাচ্চু, চলো এখন রওয়ানা দি।
ওয়াহিদ চৌধুরীর সামনে এসে বলে আবরার।
–হুম।
সায় দেয় ওয়াহিদ চৌধুরী।
গাড়ি আবারও চলতে শুরু করেছে। ড্রাইভারের সাথে সামনে আবরার বসেছে। পেছনে দু ভাই আর তাদের স্ত্রী। আর একদম পেছনের সিটে বসেছে পারমিতা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পায় ভোরের আলো একটু একটু উঠতে শুরু করেছে। আগামীকাল থেকে নতুন এক যাত্রা শুরু হবে সবার জন্য।
যেখানে,
অরিয়ন আফরিনের হবু স্বামী বা প্রেমিক নয়। পারমিতার স্বামী।
যেখানে,
অরিয়ন সব কিছুর জন্য দোষারোপ করছে পারমিতাকে।
যেখানে,
আফরিন থাকুক বা না থাকুক একে অপরের থেকে বিচ্ছেদ নিশ্চিত।
চলবে…..